দেবমালির সাধনায় সিদ্ধিলাভ
বেদমালি নামে একজন শ্রীহরির পূজক ব্রাহ্মণ ছিলেন, যিনি নিকৃষ্ট দান গ্রহণ করতেন ও কেনাবেচাও করতেন। যজ্ঞমালী সব সময় তার চিন্তা ছিল, যেমন করেই হোক অর্থ অর্জন করতে হবে। ক্রমে যজ্ঞমালি ও সুমালি নামে তার দুই পুত্র জন্মাল। পিতা দুজনকেই স্নেহ করেন।
একদিন মনে মনে বেদমালি ভাবলেন আমি তো জীবনে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করেছি,একবার সেগুলি গুণে দেখা দরকার। তিনি গোপনে সেই অর্থ গুণতে লাগলেন, কিন্তু গুণে যেন শেষ হয়না। আবার মনে মনে ভাবলেন বহু অন্যায় দান আমি গ্রহণ করেছি। জপ তপ ও নিষিদ্ধ জিনিস বিক্রি করেছি। এত সম্পদ তো পেলাম কিন্তু শান্তি তো পেলাম না। এত ধন সঞ্চয় তো করলাম তবু ধন সঞ্চয়ের নেশা তো আমার একটুও কমল না। ব্রাহ্মণ হয়ে ব্রাহ্মণের কোন কাজই করা হল না। যা সঞ্চিত ধন আছে তা দুই ছেলের পক্ষে যথেষ্ট। খুব সুখেই দিন কেটে যাবে ওদের। আর না, এবার অন্যায়ভাবে আর ধন সঞ্চয় করব না।
এই প্রকার নানা কথা চিন্তা করে একদিন দেবমালি দুই ছেলেকে ডেকে তার সমস্ত অর্থ চারভাগ করে দুভাগ নিজের কাছে রাখলেন আর দু’ভাগ দুই ছেলেকে দিলেন। অন্যায়ভাবে আর কোনও দান তিনি গ্রহণ করতেন না। যেসব মাদক দ্রব্য বিক্রি করতেন, তাও বন্ধ করে দিলেন, ধীরে ধীরে তার মন থেকে লোভ দূর হয়ে গেল।
তারপর ধর্মকর্মে মন দিলেন। দেবমন্দির নির্মাণ ও জলাশয় খনন করার জন্য তিনি অর্থ ব্যয় করতে লাগলেন। দীন দুঃখীদের সাহায্য করলেন। এইভাবে পুণ্য কাজে তার সঞ্চিত ধন ব্যয় করলেন। পরে বাণপ্রস্থ আশ্রম পালন করার জন্য তিনি বনে চলে গেলেন। বনের মধ্যে দিয়ে যাবার সময়ে তিনি একটি পোবন দেখতে পেলেন। তার মাঝে একটি বেদীতে একজন সন্ন্যাসী বসে আছেন। চারপাশে অনেক যুবক ব্রহ্মচারী বসে তার কথা এক মনে শুনছেন তার নাম জ্ঞানঅস্তি।
দেবমালি এগিয়ে গিয়ে সন্ন্যাসীকে প্রণাম জানালেন। সেই সন্ন্যাসী তার দিকে তাকাতে দেবমালি সাহস করে এগিয়ে গিয়ে তাঁর চরণে দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম জানালেন। তখন সন্ন্যাসী আসন ছেড়ে উঠে দেবমালিকে আলিঙ্গন করলেন। তার পবিত্র শীতল স্পর্শে দেবমালির মনে হল তার সারা জীবনের জ্বালা এক মুহূর্তেই জুড়িয়ে গেল,মন আনন্দে ভরে উঠল।
হঠাৎ সন্ন্যাসী দেবমালিকে বললেন–মুখ দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন তোমার কিছু খাওয়া হয়নি। আগে কিছু আহার্য সেবন কর, তারপর যে জন্য এসেছ, তা শুনব।
সন্ন্যাসীর কথায় তার শিষ্যরা দেবমালির সেবার ব্যবস্থা করল। ফলমূল জল খেয়ে বেশ তৃপ্তি লাভ করল দেবমালি।
তারপর সেই সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে প্রণাম করে বলল–সারাজীবন ধরে নানাভাবে আমি রোজগার করেছি। কোনো ভালো-মন্দ বিচার করিনি। কিন্তু মোহ যাচ্ছে না দেখে গভীর চিন্তায় সঞ্চিত অর্থের অর্ধেক দুই ছেলেকে দিয়ে বাকি অর্ধেক ধর্মকাজে ব্যয় করে সংসার ছেড়ে বনে চলে এসেছি। ঈশ্বরের করুণায় আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হল।
মৃদু হেসে সন্ন্যাসী বললেন–সংসারে সুখ-দুঃখ দুই আছে। সংসারের মাঝে আসল জিনিসটি কি সেটা জানতে হবে। তার সন্ধান পেয়ে জোর করে তাকে ধরতে পারলেই হল। সুখ আপনা থেকেই আসবে। কিন্তু সবাই জানতে পারে না সেই আসলকে। তাই দুঃখের সাগরে ভাসে।
এই সংসারে বিষ্ণুর আরাধনাই হল আসল। তারই ইচ্ছায় সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় প্রভৃতি হয়। কিন্তু তিনি থেকেও নেই। কারণ সবার দৃষ্টিগোচরে তিনি আসেন না। দেবমালি তুমি হরি-সাধনা করলে তোমার মনের সকল জ্বালা দূর হবে।
জানস্তিকে গুরুদেব রূপে বরণ করে দেবমালি হরি সাধনায় বসলেন। বেশ কিছুদিন কেটে গেল হরিসাধনা করে। এখন মন শান্ত। কোনো লোভ, মায়া, মমতা, বিষয়-তৃষ্ণা কিছুই নেই। মনে চরম প্রশান্তি।
শ্রীহরিকে পাবার চিন্তার দেবমালির মন ব্যাকুল হল। একদিন ধ্যানে বসে শ্রীহরির রূপ চিন্তা করছেন। এমন সময় তার মনের মধ্যে কিছু প্রশ্নের উদয় হল-আমি কে? কোথা থেকে এলাম? পৃথিবীতে কেন মানুষ হয়ে জন্মালাম? এখন আমার কি কর্তব্য? প্রভৃতি প্রশ্ন তার মনে জাগল।
দেবমালি এইসব প্রশ্ন নিয়ে গুরুদেব জিজ্ঞাসা করলেন।
মুনি জানস্তি উত্তর দিলেন–আত্মজিজ্ঞাসার দ্বারা শান্তি লাভ করা যাবে। নিজেদের ইচ্ছায় আমরা সংসারে যাতায়াত করি না। ঈশ্বর তার জগৎ সৃষ্টির কারণে আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের কর্তব্য সকলের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করা। আমি কে’-র উত্তর মানুষ যেদিন খুঁজে পাবে, সেদিন তার সবকিছু জানা হয়ে যাবে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তার কাছে এক হয়ে যাবে। তখন সে বুঝবে আমিই সেই পরমব্রহ্মের অংশ, আমি অজয়, অমর, শাশ্বত, সনাতন। আমার ক্ষয় নাই, বিনাশ নাই। তুমি আরো সাধনা কর দেবমালি। সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।
গুরুদেবের উপদেশ মতো জগৎসংসার ভুলে দেবমালি সাধনায় বসলেন। কেটে গেল তার মনের সংশয়। যথার্থ, উত্তর পেয়ে অমৃতের আস্বাদন লাভ করলেন।