ভক্তরাজ প্রহ্লাদের পূর্বজন্মের কাহিনী
সূতমুনিকে শৌনকাদি মুনিরা জিজ্ঞাসা করলেন-হে মহামুনি, ভক্তরাজ প্রহ্লাদ শিশুকাল থেকেই বাসুদেবের নাম স্মরণ করে তার ভক্তরূপে পরিণত হয়েছিলেন, এ কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু যখন দেবাসুর যুদ্ধ আরম্ভ হয়, তখন সেই যুদ্ধে হরির সঙ্গে প্রহ্লাদ যুদ্ধ করলেন এবং তারই হস্তে নিহত হলেন। ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে এমন যুদ্ধ কেন? আপনার অজানা কিছুই নেই। অতএব দয়া করে বলে আমাদের মনের সংশয় দূর করুন।
সূতমুনি বললেন–এই বিষয়টি পিতামহ ব্রহ্মা মহাত্মা ব্যাসের কাছে বর্ণনা করেন। পরে এই বিষয়টি ব্যাসদেব প্রকাশ করেন। সেই কাহিনী আপনারা এখন শ্রবণ করুন।
শিবশর্মা নামে একজন দেবজ্ঞ মহাযোগী পশ্চিম সাগর প্রান্তে দ্বারা কাপুরীতে বাস করতেন। তিনি যোগবলে যখন যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করতেন। তার পাঁচ পুত্রের প্রত্যেকেই শাস্ত্রজ্ঞ এবং পিতৃভক্ত। সেই পুত্রদের নামযজ্ঞশর্মা, বেদশৰ্মা, ধৰ্মৰ্শৰ্মা, বিষ্ণুশর্মা ও সোমশর্মা। শিবশর্মা চিন্তা করলেন–আমার প্রত্যেক পুত্ৰই পিতৃভক্ত, আমি যা বলি, সঙ্গে সঙ্গে তা তারা পালন করে। একবার পরীক্ষা করে দেখি এদের। তারপর তিনি মায়া বিস্তার করে পুত্রদের সামনে ছল প্রদর্শন করে দেখালেন যে, তাদের জননী প্রবল জ্বরে রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।
পুত্ররা মাতার মৃত্যুতে গভীর দুঃখ পেল। তারপর পিতাকে বলল–পিতা, যার গর্ভে আমাদের জন্ম, তিনি নিজে দেহ ত্যাগ করে স্বর্গে গমন করেছেন। এখন আমাদের কর্তব্য কি? মাতার দেহ কিভাবে সকার করব?
শিবশর্মা জ্যেষ্ঠপুত্র যজ্ঞশর্মাকে বললেন–তুমি একটি শাণিত অস্ত্রের দ্বারা তোমার মৃত মাতার শরীর খণ্ড খণ্ড করে যত্র তত্র ছড়িয়ে দাও।
পিতার আদেশ শুনেই কোন কথা না বলে যজ্ঞশর্মা একটি তীক্ষ্ণ খড়ের সাহায্যে মায়ের মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করে একটি ঝুড়িতে করে নিয়ে যত্রতত্র ছড়িয়ে দিল। তারপর পিতার কাছে এসে বলল– আপনার আদেশ আমি যথাযথভাবে পালন করেছি পিতা। এবার অন্য কাজের জন্য আদেশ করুন। অতি দুষ্কর হলেও সেই কাজ আমি করব।
শিবশর্মা খুব খুশী হলেন যজ্ঞশর্মার এই কথা শুনে। বুঝলেন তাঁর প্রথম পুত্র প্রকৃতই পিতৃভক্ত। এরপর দ্বিতীয় পুত্র বেদশর্মাকে তিনি পরীক্ষা করবার জন্য ডাকলেন। বললেন–বেদশর্মা, তোমাদের মাতা এখন পরলোকগতা, কিন্তু আমার অন্তর এখন কামানলে দগ্ধ হচ্ছে। এই কথা বলে তিনি মায়াবলে বাড়ি থেকে কিছুদূরে এক সুন্দরী নবযৌবনা রমণী সৃষ্টি করে পুত্রকে দেখিয়ে বললেন– ওই যে নারীমূর্তি দেখতে পাচ্ছে, আমারই জন্য ওই নারীকে তুমি অবশ্যই নিয়ে আসবে।
পিতার আদেশে বেদশর্মা পিতাকে প্রণাম করে সেই মায়া-নারীর কাছে গিয়ে বলল–দেবী, আমার পিতা কামনার পীড়িত হয়ে আপনাকে প্রার্থনা করছেন। অতএব আপনি আমার বৃদ্ধ পিতার সেবাকার্যে নিযুক্ত হন।
মায়া-নারী বেদশর্মার কথা শুনে বলল–তোমার পিতা একজন বৃদ্ধ জরাগ্রস্থ শিথিলেন্দ্রিয়, আর আমি নবযৌবনা সুদর্শনা নারী। কখনই আমি তাকে সঙ্গ দান করতে পারব না। তুমি রূপ সৌভাগ্যবান, দিব্য লক্ষণযুক্ত, মহাতেজা সুপুরুষ। আমি বরং তোমারই সেবা করব। তুমিই আমার এই অঙ্গ ভোগ করবার যোগ্য।
মায়া-নারীর এমন পাপযুক্ত কথা শুনে বেদশর্মা বলল-দেবী, আমাকে তুমি এমন কথা বলো না। আমি পিতৃভক্ত, পিতার জন্য আমি তোমাকে প্রার্থনা করছি। তুমি অন্যকথা বলো না, আমার পিতাকেই ভজনা করো। দেবী, তুমি যা চাইবে, যদি পৃথিবীতে দুর্লভও হয়, তবে স্বর্গরাজ্য থেকে এনে দিতে পারি।
মায়া-নারী বলল-পিতার জন্য তুমি এতদূর করতে পার, তাহলে এখনই তুমি আমাকে ইন্দ্র ও মহাদেবকে দর্শন করাও। তুমি নিশ্চয় এই দুর্লভ সামগ্রী আমাকে প্রদান করবে।
এই কথা শুনে বেদশর্মা ধ্যানরত হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবরাজ ইন্দ্র এবং দেবদেব মহেশ্বর সেখানে উপস্থিত হলেন। বেদশর্মাকে বললেন–তুমি আমাদেরকে কি জন্য স্মরণ করেছ? তুমি যা প্রার্থনা করবে, আমরা তা অবশ্যই প্রদান করব।
বেদশর্মা বলল–আমার প্রতি আপনারা যদি প্রসন্ন হন, আমাকে তাহলে অমন পিতৃভক্তি প্রদান করুন। তখন ইন্দ্র মহাদেব ‘তাই হবে বলে সেখান থেকে অন্তর্হিত হলেন।
মায়া-নারী বলল-ব্রাহ্মণ, তোমার পোন দেখলাম। আমার দেবতায় কোনো প্রয়োজন নেই। পিতার জন্য যদি তুমি আমাকে আকাঙ্ক্ষা কর, তাহলে তুমি নিজের হাতে নিজের মস্তক ছেদন করে আমাকে দাও।
মায়া-নারীর কথা শুনে মহা আনন্দে বেদশর্মা বলল–আমি ধন্য হলাম ঋণ থেকে মুক্ত হলাম। এই আমি নিজের মস্তক ছেদন করছি, তুমি ধর। এই কথা বলে, দেবশর্মা নিজের মাথা কেটে মায়া নারীর হাতে দিল।
মায়া-নারী বেদশর্মার কাটা মাথা নিয়ে শিবশর্মার কাছে গিয়ে বলল–ব্রাহ্মণ, আপনার পুত্র বেদশৰ্মা আপনার জন্য নিজেই নিজের মস্তক ছেদন করে পাঠাল। আপনি এটি গ্রহণ করুন। আপনার সেই পিতৃভক্ত পুত্র আপনার জন্যই আমায় এই উত্তমাঙ্গ দিয়েছে, অতএব আমায় আপনি উপভোগ করুন।
মায়া-নারীর মুখে এই কথা শুনে বেদশর্মার দুই ভাই ভায়ের এই সাহস দেখে কাঁপতে কাঁপতে বলাবলি করতে লাগল–আমার মাতা সদ্য প্রাণত্যাগ করেছেন। আর এই ভাই আমাদের পিতার জন্য প্রাণত্যাগ করল। অশেষ ধন্যবাদের যোগ্য আমাদের এই ভাই।
ব্রাহ্মণ শিবশর্মা পুত্রদের মুখে এই কথা শুনে বুঝলেন যে, প্রকৃতই পিতৃভক্ত বেদশর্মা। ভক্তিবলেই সে নিজের মস্তক ছেদন করেছে। এরপর তিনি তার তৃতীয় পুত্র ধর্মশর্মাকে বললেন– এই ভ্রাতার মস্তক গ্রহণ কর।
পিতার আদেশ পালন করবার জন্য ধর্মশর্মা ভ্রাতার মস্তক নিয়ে বাড়ির বাইরে এসে যোগসাধনা গুরু করল। তপস্যা ও সত্যবলে যমরাজ ধর্মের আরাধনা করল। ধর্মরাজ তার সামনে আর্বিভূত হলে তিনি বললেন–হে ধর্মশর্মা, তুমি কিসের জন্য আমার আরাধনা করলে? আমায় কি করতে হবে বল?
ধৰ্মৰ্শৰ্মা বলল–যদি–হে সব্রত, তোমার তপস্যা ও পিতৃভক্তি দেখে অতি প্রসন্ন হয়েছে আমি। তুমি তোমার ভ্রাতা বেদশর্মার ছিন্ন মস্তকটি তার ছিন্ন দেহের সঙ্গে যুক্ত কর, আমার বর–প্রভাবে আবার জীবন লাভ করবে। এখন তুমি অন্য কোন দুর্লভ বর প্রার্থনা কর।
ধর্মরাজার কথা শুনে ধর্মশর্মা বলল–যদি আপনি প্রসন্ন হয়ে থাকেন, তবে আমার পিতার পাদ-পূজনে অচলা ভক্তি, ধর্মে অনুরাগ এবং অন্তে মোক্ষধাম প্রার্থনা করি।
তোমার সমস্তই হবে এই কথা বলে ধর্মরাজ সেখান থেকে অন্তর্হিত হলেন।
তারপর ধর্মশর্মা বেদশর্মার ছিন্ন মস্তকটি দেহের সঙ্গে যুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই দেবশর্মা যেন ঘুম থেকে উঠে বলল–সেই দেবী কোথায় গেলেন ভাই? আর পিতাই বা কোথায় আছেন?
তার উত্তরে ধর্মশৰ্মা তাকে সব কথা বলে পিতার সামনে উপস্থিত হল দুই ভাই। তারপর ধর্মৰ্শৰ্মা পিতাকে বলল “পিতা, আমি তপস্যাবলে এই বেদশর্মাকে পুনরায় লাভ করেছি। আপনি আপনার পুত্রকে গ্রহণ করুন।
শিবশর্মা পুত্রের পিতৃভক্তির পরিচয় পেয়ে কোন কথাই বললেন–না। আবার চিন্তা করে চতুর্থ পুত্র বিষ্ণুশর্মাকে ডেকে বললেন–পুত্র, আমি বৃদ্ধ জরাতুর, ইন্দ্রিয় শিথিল। কিন্তু আমি এই কামিনীর সহবাস ইচ্ছা করি। এই ললনা আমার সহবাস ইচ্ছা করছে না। আমি যাতে একে লাভ করি তুমি তাই করো। আমি জানি সমুদ্র মন্থনে যে অমৃত উঠেছিল, সেই অমৃত সর্বব্যাধি হয়, কুৎসিতকে সুন্দর করে, বৃদ্ধকে যুবায় পরিণত করে, অতএব সুরপুরে গিয়ে তুমি আমার জন্য অমৃত আন। আমি সেই অমৃত সেবন করে এই কামিনীর সঙ্গ পরম আনন্দে উপভোগ করি।
বিষ্ণুশর্মা পিতার এমন কথা শুনে বলল–পিতা, আপনার সুখকর সকল উত্তম কাৰ্যই আমি করতে প্রস্তুত আছি। এই কথা বলে পিতাকে প্রণাম করে উত্তম বল, তপস্যা ও নিয়ম-প্রভাবে অন্তরীক্ষ পথে অগ্রসর হল। ক্রমশঃ সে গগনান্তরে প্রবেশ করল।
বিষ্ণুশর্মার উদ্দেশ্য জানতে পেরে দেবরাজ ইন্দ্র চিন্তা করলেন, এই যুবক সাধন বলে স্বর্গের অমৃত মর্তে নিয়ে যাবে আর মর্তবাসীরা অমর হয়ে থাকবে, তা আমি কখনো হতে দেব না। যেমন করেই হোক একে স্বর্গে আসায় বাধা দিতে হবে। এই চিন্তা করে দেবরাজ ইন্দ্র স্বৰ্গবেশ্যা সুন্দরী মেনকাকে ডেকে বললেন–শিবশর্মার পুত্র বিষ্ণুশর্মা স্বর্গে আসছে। যেমন করেই হোক তুমি তার গতি রোধ কর।
ইন্দ্রের কথা শুনে মেনকা নন্দনকাননে গিয়ে বীণা বাজিয়ে মধুর স্বরে গান করতে শুরু করল। মেনকাকে দেখতে পেয়ে তার উদ্দেশ্য বুঝতে বিষ্ণুশর্মার আর বাকী থাকল না যে সুধা আনার জন্য বিঘ্ন ঘটাতেই সে এভাবে ওত পেতে বসে আসে। কাজেই তার দিকে দৃষ্টিপাত না করেই সে তাড়াতাড়ি চলতে লাগল।
মেনকা ভাবল–হায়! আমার মত একজন সুন্দরী এখানে বসে মধুর স্বরে গান গাইছি, তবুও এই যুবক আমার দিকে তাকাচ্ছে না। মেনকা তখন ব্রাহ্মণ পুত্রের উদ্দেশে বলল–হে মহামতে, তুমি কোথায় যাচ্ছ? কিছুক্ষণ তুমি এখানে অপেক্ষা কর। আমাকে বল, তোমার কি প্রয়োজন। আমি তোমার শরণাপন্ন হলাম কারণ আমি তোমার রূপ দেখে কামবানে জর্জরিত, তুমি আমাকে রক্ষা কর।
মেনকার কথা শুনে বিষ্ণুশর্মা বলল–পিতার জন্য আমি তাড়াতাড়ি ইন্দ্রলোকে যাচ্ছি। দেবতাদের চরিত্র আমার অজানা নয়। অেমার চরিত্রও আমি খুব ভালভাবে জানি। কিন্তু তেমন চরিত্রের মানুষ আমি নই। বিশ্বামিত্রাদি মুনি তোমার রূপে মুগ্ধ হতে পারেন, কিন্তু আমি শিবশর্মার পুত্র, যোগ তপঃসিদ্ধ, অনেক আগেই কামাদি মহাদোষ আমি জয় করে ফেলেছি। কাজেই হে সুন্দরী, আমি এখন ইন্দ্রলোকে যাই, তুমি অন্য কোন ব্যক্তিকে ভজনা কর।
মেনকার চেষ্টা ব্যর্থ করে বিষ্ণুশর্মা সত্বর অগ্রসর হতে লাগল। তখন স্বয়ং ইন্দ্র নানারকম ভয় দেখাতে লাগলেন তাকে। কিন্তু পতিভক্ত ব্রাহ্মণের তেজে সেই সব বিভীষিকা সঙ্গে সঙ্গেই তুলারশ্মির মত ভস্মীভূত হয়ে গেল। ইন্দ্র বারে বারে বিঘ্ন সৃষ্টি করাতে বিষ্ণুশর্মার আর বুঝতে বাকী রইল না যে, দেবরাজ ইন্দ্রই এই সব কাজ করছেন। তখন বিষ্ণুশর্মা মনে মনে ভাবল–আমি স্বধর্মে রত আছি, তাই যে আমার বিঘ্ন সৃষ্টি করবে তাকে আমি রক্ষা করব না। আমি ইন্দ্রকে ইন্দ্রলোক থেকে পাতিত করব, কিছুতেই তার অন্যথা হবে না। যে হনন করে সে নিজেই হত হয়ে থাকে। আমি অন্য দেবরাজ সৃষ্টি করব।
এই চিন্তা করে ইন্দ্রকে বিনাশ করবার জন্য বিষ্ণুশর্মা উদ্যত হলে, ইন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে এসে বললেন–হে বিপ্র, তপস্যা, সত্য, নিয়ম, মৌচ ও দমনগুণে তোমার সমান অন্য কেউ নেই। তুমি আমার সব অপরাধ ক্ষমা কর। দুর্লভ হলেও আমি নিশ্চয়ই তোমায় বরদান করব।
ইন্দ্রের কথা শুনে বিষ্ণুশর্মা বলল-ব্রাহ্মণের মহারৌদ্র তেজ দেবগণের লক্ষ্যেও দুঃসহ। বিশেষতঃ যিনি পিতৃভক্ত ব্রাহ্মণ, তার তেজ একান্ত পক্ষেই অসহনীয়। মহাত্মা ব্রাহ্মণগণের তেজোভঙ্গ করা কখনই উচিত নয়। হে দেবেশ, এখন আপনি যদি না আসতেন, তাহলে আমি নিজতেজ প্রভাবে অন্য কোন মহাত্মাকে এই স্বর্গরাজ্য দান করতাম। আপনি নিজেই যখন এসে আমাকে বর দান করবার জন্য উৎসুক হয়েছেন, তাহলে এই বর প্রার্থনা করি, অমৃত আর অবিচলা পিতৃভক্তি আপনি আমায় দান করুন।
বিষ্ণুশর্মার বাক্যে ইন্দ্র প্রসন্ন হয়ে বললেন–আমি অমৃতসহ এই বরই তোমাকে দান করলাম এই কথা বলে সাদরে অমৃতকুম্ভ তাকে দান করে বহু সম্মান জানিয়ে বিদায় দিলেন।
তারপর বিষ্ণুশর্মা সর্বব্যাধি বিনাশক অমৃত নিয়ে মর্ত্যধামে এসে পিতাকে বলল-পিতা, স্বর্গ থেকে এই অমৃত আমি এনেছি। এর দ্বারা আপনি নিরোগ হয়ে পরম তৃপ্তিলাভ করুন। পুত্রের এই কথা শুনে শিবশর্মা পরম আনন্দে সকল পুত্রদের ডেকে বললেন–তোমরা সকলেই পরম পিতৃভক্ত। তাই তোমরা প্রীতমনে বর গ্রহণ কর।
তখন বিষ্ণুশর্মার পাঁচ পুত্র একটু আলোচনা করে পিতাকে বলল–পিতা, আমাদের সুব্রতা– মাতার মৃত্যু হয়েছে। আপনার প্রসাদে তিনি নীরোগ হয়ে জীবিত হোন। আর জন্ম-জন্মান্তর ধরে
আপনারাই আমাদের পিতা ও মাতা হোন। আমরা পুণ্যচারী হয়ে আপনাদের পুত্র হই।
শিবশর্মা বললেন–তোমাদের পুত্রবৎসল মাতা সদ্যই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন, সদ্যই তিনি জীবিত হয়ে আসবেন। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তার স্ত্রী সেখানে এসে হৃষ্টভাবে বললেন–এই কারণেই সৎপুত্র সমুৎপন্ন হয়, এই কারণেই প্রত্যেক মানুষ কুল প্রদীপ সৎপুত্র কামনা করে হে পুত্রগণ, যে স্বামীর ঔরসে তোমাদের মতন পুত্র আমি লাভ করেছি, জানি না, এই ধর্মাত্মা ধর্মবৎসল মহাপুণ্যশালী আমার ভর্তা কোন্ পুণ্যবলে উৎপন্ন হয়েছেন। তোমাদের পিতা এইরূপ পুণ্যপ্রভাব, তোমরাও পুত্রবৎসল। যে মুহূর্তে শিবশর্মার বিবাহিতা স্ত্রী আবির্ভূত হলেন, সঙ্গে সঙ্গে সেই মায়া নারী অন্তর্হিত হলেন।
মাতার এই কথা শুনে পুত্রেরা মহা আনন্দে বারবার জননীর পায়ে প্রণাম করে বলল–লোকে সন্মাতা ও সৎ পিতা লাভ করে উত্তম পুণ্যবলে। আমাদের ভাগ্য বলেই আমরা আপনার মত পুণ্যবতী মাতা লাভ করেছি। আমাদের জন্মে জন্মে যেন আপনারাই পিতা-মাতা হন।
তারপর শিবশর্মা বললেন–আমি তোমাদের প্রতি অতি প্রসন্ন পুত্রগণ। আমার কাছে তোমরা বর প্রার্থনা কর।
পঞ্চপুত্র বলল–পিতা, প্রসন্ন হয়ে যদি বরদানে উৎসুক হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের সেই সপ্তাপবর্জিত গোলোকে প্রেরণ করুন।
শিবশর্মা বললেন–তপস্যা এবং পিতৃভক্তি গুণে আর আমার প্রসাদে তোমরা গোলোকে প্রস্থান কর।
ব্রাহ্মণ শিবশর্মা এই আশিসবাণী উচ্চারণ করা মাত্রই শ্রীবিষ্ণু সেখানে আবির্ভূত হয়ে শিবশর্মাকে বললেন–হে দ্বিজ, সৎপুত্রগণ সহ ভক্তিবলে তুমি আমাকে জয় করেছ। এখন তুমি তোমার এই পুণ্যশীলা পুত্ৰশীলা ভাৰ্যার সঙ্গে আমার ধামে আগমন কর।
শ্রীহরির এই কথা শুনে শিবশর্মা বললেন–আমার কনিষ্ঠ পুত্র সোমশর্মা ব্যতীত অন্য চারপুত্র বৈষ্ণবলোকে গমন করুক। আমি আমার ভাৰ্য্যা ও কনিষ্ঠ পুত্রের সঙ্গে ভূতলে বাস করতে চাই।
সত্যবাদী ব্রাহ্মণ শিবশর্মার এই কথা শুনে শ্রীহরি তার চারপুত্রকে চতুর্ভুজ শঙ্খ-চক্র-গদাধর ইন্দ্রনীল তুল্য বর্ণে মহাতেজা হার-কঙ্কণাদি শোভিত রত্নমালা মণ্ডিত শ্রীবিষ্ণুর মূর্তি ধারণ করিয়ে আপন দেহেই বিলীন করালেন। তারপর শ্রীহরি শিবশর্মার সামনেই অন্তর্হিত হলেন।
তারপর শিবশর্মা তার কনিষ্ঠ পুত্র সোমশর্মাকে বললেন–তুমি পিতৃভক্তি পরায়ণ, এই অমৃতের কুম্ভ তোমাকে দিচ্ছি। তুমি এটি রক্ষা কর। আজই আমি ভাৰ্য্যার সঙ্গে তীর্থযাত্রার উদ্দেশে বার হব। এই কথা বলে শিবশর্মা অমৃতকুম্ভ কনিষ্ঠ পুত্রের হাতে দিয়ে সস্ত্রীক তীর্থের উদ্দেশে চলে গেলেন। দশ বছর ধরে বিভিন্ন তীর্থ ভ্রমণ করে এবার ঘরে ফেরার জন্য চিন্তা করলেন। ভাবলেন–আমার চারপুত্রকে নানাভাবে পরীক্ষা করেছি। সোমশর্মাকে এবার পরীক্ষা করব। এই চিন্তা করে তিনি মায়াবলে কুষ্ঠরোগী হলেন আর তার স্ত্রীও একইভাবে রোগগ্রস্ত হলেন। এরপর তারা গৃহে ফিরলেন।
এদিকে ধর্মাত্মা সোমশর্মা অতীন্দ্রিয় প্রহরীর মতো দিনরাত সেই অমৃতকুম্ভ রক্ষা করছে। সস্ত্রীক শিবশর্মা গৃহে ফিরলে, পিতামাতাকে রোগগ্রস্ত দেখে সোমশর্মা খুবই দুঃখ পেল। ভক্তিভরে পিতামাতাকে প্রণাম করে বলল–আপনার মতো তপোনিধি সর্বগুণান্বিত ব্যক্তি এ জগতে কাউকে দেখি না। তাহলে এমন দশা কি করে হল?
শিবশর্মা বললেন–পুত্র, তুমি দুঃখ কর না। পাপপুণ্যময় কর্মী তার কর্মের জন্যই ফলভোগ করে। তুমি যদি পুণ্য ইচ্ছা কর, তাহলে আমাদের দুজনার সেবা-শুশ্রূষা কর।
সোমশর্মা বলল–হে পিতা, আমি অবশ্যই আপনাদের সেবা করব।
এই কথা বলে সোমশর্মা পিতামাতার দুঃখে দুঃখিত হয়ে তাদের শ্লেষ্ম, মল-মূত্র শোধন, পাদ ধৌত করণ স্নানাদি করতে লাগল। নিজ হাতে রান্না করে পিতামাতাকে ভোজন করায়, তাদের যখন যা প্রয়োজন সবসময় তা পূরণ করে। এককথায় তাদের সেবায় কোন রকম ত্রুটি রাখে না।
পুত্রের এইরকম প্রিয় ব্যবহার দেখে শিবশর্মা মনে মনে খুব খুশি। তিনি ভাবলেন–এই পুত্রকে আরো কঠিন পরীক্ষা করে দেখবো। দেখি, সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় কি না? এই চিন্তা করে শিবশর্মা একদিন সোমশর্মাকে ডেকে অতি নিষ্ঠুর বাক্যে বললেন–তুই আমাদের ঠিকমতো সেবা করিস না। আমাদের প্রতি যথাযোগ্য আচরণ করিস না। কেন? তোর এই রকম ব্যবহারে আমরা তুষ্ট নয়। এই কথা বলে শিবশর্মা একটা লাঠি দিয়ে পুত্রকে প্রহার করতে লাগল।
শিবশর্মার এমন নিষ্ঠুর ব্যবহারেও কোনরকম রাগ না করে সন্তুষ্ট মনে সোমশর্মা আগের মতনই সেবা-শুশ্রূষা করতে থাকল। কাজেই সেই পরীক্ষায় সোমশর্মা ভাবলেন–একে আরও কঠিন পরীক্ষা করব। এই চিন্তা করে মায়াবলে সেই অমৃতকুম্ভ থেকে অমৃত হরণ করে বললেন–পুত্র, এতদিন আমার মনে ছিল না যে আমার বাড়িতে এই অমৃত আছে। সেই অমৃত পান করে নীরোগ হতে পারি আমরা। দাও, আমাদের সেই অমৃত এনে দাও। তাড়াতাড়ি সেই অমৃতকুম্ভ আনতে গিয়ে সোমশর্মা দেখল কুম্ভ আছে ঠিকই কিন্তু তাতে অমৃত নেই। তখন সে গভীর দুঃখের সঙ্গে ভাবছে–আমার কোন পাপের ফলে এই অমৃতকুম্ভ অমৃতশূন্য হয়েছে। পিতার কাছে এই কথা বললে রোগার্ত পিতা আমার প্রতি আরো কূপিত হবেন।
তারপর সোমশর্মা মনে মনে চিন্তা করল–আমার সত্য প্রতিষ্ঠা, গুরুশুশ্রূষা তপস্যাদিতে যদি সত্যধর্ম রক্ষা হয়ে থাকে, তাহলে এই কুম্ভ অমৃতযুক্ত হোক। সোমশর্মার এই রকম চিন্তায় সেই কুম্ভ পুনরায় অমৃতে পূর্ণ হয়ে গেল। তখন সোমশর্মা মহানন্দে অমৃতপূর্ণ কুম্ভ নিয়ে পিতাকে দিয়ে বলল– পিতা, এই অমৃত পান করে আপনি অচিরে নীরোগ হবেন।
সোমশর্মার কথা শুনে শিবশর্মা অতি আনন্দে বললেন–হে পুত্র, তোমার তপস্যা, ইন্দ্রিয় সংযম, গুরুস্তুশ্রুষা এবং ভক্তিদর্শনে আমি অতি পরিতৃপ্ত। আমাদের বিকৃতরূপ পরিত্যাগ করছি তুমি দেখে সুখ লাভ কর।
পিতামাতার পূর্বেকার সুন্দর রূপ দেখে সোমশর্মা আনন্দে পিতামাতার চরণে বার বার প্রণাম জানাতে লাগল।
তারপর শিবশর্মা সস্ত্রীক আপন পুণ্যপ্রভাব বিষ্ণুলোকে যাত্রা করলেন। মহাত্মা সোমশৰ্মা তারপর তপস্যা শুরু করলেন। আহারাদি সংযমন করে, কারো কাছে কিছু ভিক্ষা না করে অযাচিতভাবে যা পায় তাতেই সে জীবন রক্ষা করে। ক্রমশঃ তার মৃত্যুকাল উপস্থিত হল। এইবার স্বয়ং ভগবান তাকে পরীক্ষা করার জন্য তার কাছে কতকগুলি দৈত্যকে পাঠালেন। মৃত্যুশয্যায় শায়িত সোমশর্মা তার চারপাশে দৈত্যদের উচ্চস্বরে কথা শুনে তাদের দেখে ভয়ে ভীত হয়ে পরলোকে যাত্রা করল। দৈত্যভয়ে ভীত হয়ে মৃত্যুর জন্য সেই মহাত্মা সোমশর্মাকে দৈত্যগৃহে হিরণ্যকশিপুর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করতে হল।
পূর্বতন যোগাভ্যাসের জন্য সে জাতিস্মর হল। পূর্বের সবকথা চিন্তা করে সে ভাবল–সারাজীবন ধর্মপথে থেকে শুধুমাত্র মৃত্যুর সময় দৈত্যদের দেখে দেহত্যাগ করার জন্য দৈত্যকুলে আমাকে জন্মগ্রহণ করতে হল। তাহলে এবার যদি আমি বিষ্ণুর হাতে মৃত্যুবরণ করি, তাহলে দিব্যগতি লাভ করতে পারব। সবসময়েই সে এই চিন্তা করত। শ্রীমদ্ভগবতগীতায় ভগবান বলেছেন, মৃত্যুর সময় যে যেই ভাব। স্মরণ করে মরবে, পরের জন্মে সে সেই ভাব নিয়েই জন্মাবে। ভগবান তার অভীষ্ট পূরণও করেছিলেন। ঘোরতর দেবাসুর তিনি চক্রপানির হাতে নিহত হলেন। এমন গুণবন্ত পুত্র নিহত হওয়ার কারণে তার মা কমলা পুত্রের জন্য খুব কাদলেন। তখন দেবর্ষি নারদ তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–ভগবান শ্রীহরি তোমার পুত্রের ইচ্ছাতেই তাকে নিধন করেছেন। আবার তোমার গর্ভেই সেই পুত্র জন্মলাভ করবে। তুমি দুঃখ করোনা, আর কারোর কাছে এ বিষয়ে প্রকাশ করো না। তোমার ওই পুত্রের অসুরভাব থাকবে না। দেবভাবে অম্বিত হবে, সকল দেবতারও নমস্য হবে। তুমি সর্বদা সেই পুত্রের দ্বারা সুখলাভ করবে। এই বলে দেবর্ষি চলে গেলেন।
তারপর যথাসময়ে কমলার গর্ভে প্রহ্লাদের জন্ম হল। বাল্যকাল থেকেই কৃষ্ণধ্যান করতে লাগল। ভগবান শ্রীহরি তার জন্যই হিরণ্যকশিপুর নৃসিংহমূর্তি ধারণ করে বধ করলেন।