পতিব্রতা নারী সুকলার কাহিনি
বারাণসীধামে কৃকল নামে এক বৈশ্য বাস করতেন। তার স্ত্রী সুকলা মহা সতীসাধ্বী, নিত্য ধর্মাচারপরায়ণা, পতিগতপ্রাণা, বৈশ্য কৃকলও উত্তর পুরুষ। মহাজ্ঞানী ধর্মজ্ঞ, গুণবান। কৃকল পুরাণে “তীর্থযাত্রায় বহুপুণ্য” এই উক্তি পাঠ করে, কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে তীর্থভ্রমণে বার হলেন।
তখন তার স্ত্রী সুকলা বলল–হে প্রিয়, তোমার সঙ্গে আমিও যাব। আমারও তীর্থদর্শন করার খুব ইচ্ছা। বিশেষতঃ আমি সবসময়ই তোমার অনুগামিনী, পতি পরায়ণা নারীই পুণ্যশীলা নাম ধরে। যে নারী স্বামীর দক্ষিণ-পদকে প্রয়োগ আর বামপদকে পুষ্কররূপে কল্পনা করে আর স্বামীর পাদোদকে স্নান করে, সেই নারী মহা পুণ্যবতী। স্বামীই হচ্ছেন সতীর্থময় এবং সর্বপুণ্যময়। দীক্ষিত হয়ে যজ্ঞসাধনে যে পুণ্য হয়, স্বামীর সেবাতেই একমাত্র সেই পুণ্য লাভ হয়। রমণীর পতিশুশ্রূষা ছাড়া আর কোন ধর্ম নেই। তাই হে কান্ত, তোমার ছায়া আশ্রয় করে তোমারই সাহায্যে সুখদান করতে করতে আমি সদাই তোমার অনুগামিনী হব।
কৃকল পত্নী সুকলার কথা শুনে চিন্তা করল যে, সুকলা রূপবতী এবং তার বয়সও অল্প, তীর্থভ্রমণের সময় অনেক দুর্গম পথ পার হতে হবে। কোন স্থানে প্রচণ্ড শীত বা প্রচণ্ড গরম হবে তাতে প্রত্নীর রূপের সৌন্দর্য নষ্ট হতে পারে। উত্তম বর্ণালিনী অঙ্গ মলিন হয়ে যাবে। কোমল পদদ্বয় কাকরযুক্ত পথে চলতে গেলে ব্যথা পাবে। পথে আহারাদিও সবসময়ে নাও পাওয়া যেতে পারে তাহলে এই রমণী ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করবে কেমন করে? কাজেই আমি একাই তীর্থভ্রমণে যাব, এই কথা চিন্তা করে একদিন রাতে কৃকল সঙ্গীদের সঙ্গে গোপনে তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করল।
তার স্ত্রী সুকলা সকালে স্বামীকে শয্যায় দেখতে না পেয়ে বড়ই দুঃখ পেল। বুঝতে পারল যে তার স্বামী তীর্থভ্রমণেই গেছে। মনে মনে চিন্তা করল যে, তাকে সঙ্গে না নেওয়ার কারণ কি। কিছুই ঠিক করতে পারল না। সুকলা স্থির করল যে তার স্বামী ফিরে না আসা পর্যন্ত সে ভূমিশয্যাতেই শয়ন করবে। ঘৃত, তৈল, দধি, ক্ষীর, লবণ, তাম্বুল প্রভৃতি মধুর বস্তু ত্যাগ করবে। দিনে একবার মাত্র আহার করবে। সুকলার চোখে সবসময় অশ্রুধারা। পরিধেয় বস্ত্র মলিন। স্বামী বিয়োগানলে সে দগ্ধ ও কৃষ্ণবর্ণ হল। চোখে ঘুম নেই। দেহ ক্ষীণ হল ক্রমশঃ।
সুকলাকে কৃশ ও দুঃখিত দেখে তার সখীরা তাকে বলল–তোমার স্বামী তীর্থভ্রমণে গেছেন, ফিরে আসবেন। বৃথা দেহকে শোষণ করে লাভ কি? এ সংসারে কে কার স্বামী, পুত্র, স্বজন, বান্ধব? এ সংসারে কারও সঙ্গে কারও সম্বন্ধ নেই। তাই তুমি সবকিছু ভোগ কর, অযথা দেহকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি?
এই কথা শুনে পতিব্রতা সুকলা বলল–তোমরা বেদসম্মত বাক্য বলছ না। তোমরা পাপিয়সী, নারী স্বামীসঙ্গ ত্যাগ করে একা থাকে। নারী স্বামীর কাছে থেকেই সবসময়ে তার সেবা করবে। স্বামীর দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়ার চেয়ে প্রাণ ত্যাগ করা মঙ্গলজনক। স্বামীই নারীদের তীর্থ স্বরূপ, তাই মনো বাক্যে নারীর স্বামী সেবা করা উচিত। নারীর রূপযৌবন ও সৃষ্টি সব কিছুই একমাত্র স্বামীর জন্য। স্বামী তুষ্ট থাকলে সব দেবতাই সেই নারীর প্রতি তুষ্ট থাকেন। তাই স্বামীই নারীর প্রভু, দেবতা, তীর্থ আর পুণ্য। স্বামীর অভাবে নারী শৃঙ্গার ভূষণ, রূপ, সৌগন্ধ সমস্তই ত্যাগ করে।
সখীরা, স্বামীই নারীর পরম ধর্ম, স্ত্রী কখনই সনাতন ধর্ম ত্যাগ করবে না। আমি এই মহৎ সনাতন ধর্ম অবগত আছি। তবুও স্বামী কেন আমাকে ত্যাগ করলেন তা আমি বুঝতে পারছি না। আমি স্বামী বিনা জীবন ধারণ করতে পারব না।
সুকলার এমন কথা শুনে তার সখীরা খুব প্রশংসা করল। দেবতারা ধর্মবৎসলা সুকলার ধ্যান করতে লাগল। দেবরাজ ইন্দ্র সুকলার কথা জানতে পেরে মনে মনে চিন্তা করল–এমন পতিব্রতা ধর্মপ্রাণা নারী এ জগতে বিরল। আমি এর পতিস্নেহ ও ধৈৰ্য্য বিনাশ করব।
এই কথা চিন্তা করে রতিপতি মদনকে ইন্দ্র আহ্বান করে বললেন–হে মদন, পতিব্রতা সুকলাকে তুমি আমায় বশীভূত কর। ইন্দ্রের এই আদেশ শুনে গর্বভরে মদন বলল– ইতিপূর্বে কত মুনি, ঋষি, দেবতাকে আমি জয় করেছি। অবলা এই নারীকে জয় করা অতি তুচ্ছ ব্যাপার।
ইন্দ্র বললেন–কৌতুকবশতই আমি রূপ, গুণ, ধন-সম্পন্ন পুরুষ হয়ে ঐ নারীকে বিচলিত করব। কামে, লোভে, ক্রোধে, কিংবা অন্য কোন কারণে আমি এমন করছি না। ওই নারীর সপাতিব্ৰত্য কেমন তা পরীক্ষা করার জন্য তোমাকে তার কাছে পাঠাচ্ছি।
কামদেব এই কথা শুনে খুব সুন্দর রূপ ধরে ইন্দ্রের সকুলার সামনে গেলেন। কামদেব তাকে আকর্ষণ করার বহু চেষ্টা করল কিন্তু সুকলা ইন্দ্রের দিকে এবারও তাকাল না। নানাভাবে কাম চেষ্টা দেখাতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই সুকলার মন টলাতে পারলেন না। ইন্দ্র তখন এক দূতাঁকে সুকলার কাছে পাঠালেন।
সেই দূতী সুকলার কাছে গিয়ে বলল–তোমার মত রূপবতী নারী আমি দেখিনি। তুমি কার ভাৰ্য্যা? তোমার স্বামী কোথায়?
দূতীর প্রশ্নের উত্তর সুকলা বলল–ধর্মাত্মা। কৃকল আমার স্বামী। তিন বৎসর হল তিনি তীর্থযাত্রায় গেছেন। স্বামী বিনা একান্তই দুঃখিতা আমি। কিন্তু তুমি আমাকে এমন প্রশ্ন করছ কেন? কে তুমি?
দূতী বলল–যে কারণে তোমার কাছে এসেছি তা আমি সত্যই বলব। সব শুনে যা ভাল বুঝবে তাই করবে। আমার মনে হয় তোমার স্বামী মহাপাপী, তাই তোমাকে ত্যাগ করে চলে গেছে। তুমি সাধ্বী রমণী। সে আর বেঁচে আছে কিনা কে জানে? তুমি কেন বৃথা শোক করছ? এই দিব্য হেমকান্তি দেহকে কেন নষ্ট করছ? মানব বাল্যকালে বাল্যখেলা ছাড়া আর কোন সুখলাভ করে না, বৃদ্ধকালে জরা এসে তার দেহকে কুৎসিত করে তোলে। কেবলমাত্র যৌবনেই মানুষ সুখ ভোগ করে। যৌবন চলে গেলে তখন কোন কাৰ্য্যই সিদ্ধ হয় না। হে ভদ্রে, জল চলে গেলে সেতুবন্ধের যেমন প্রয়োজন হয় না, তেমনি যৌবন চলে গেলে ভোগবিলাসও নিষ্ফল। যতক্ষণ দেহে যৌবন ততক্ষণ সুখভোগ কর। কামশরে তোমার দেহ দগ্ধ হচ্ছে, তুমি মদিরা পান কর। ওই দেখ, মহা ধনবান এক রূপগুণশালী পুরুষ তোমার জন্য স্নেহযুক্ত।
দূতীর কথা শুনে সুকলা বলল–জীবের বাল্য, তারুণ্য, বার্ধক্য নেই। জীব স্বয়ংসিদ্ধ, অমর, নির্জর, অকাম হয়ে লোকে আত্মরপে বর্তমান। দেহের বিনাশের পর আবার নতুন দেহ ধারণ করে।
সুকলার বহু তত্ত্ব কথা শুনে দূতী ইন্দ্রের কাছে এসে সুকলার ধর্মজ্ঞান, ধৈৰ্য্যশীলতা প্রভৃতির কথা বলল। ইন্দ্র মনে মনে চিন্তা করলেন–এমন জ্ঞানগর্ভ কথা এই মহীমগুলে আর কোন নারী বলতে পারে না। ইন্দ্র মদনকে নিয়ে সুকলার গৃহে এলেন। একাকী সুকলা তখন গৃহে পতির চরণ ধ্যান করছে। যোগী যেমন কেবলমাত্র ধ্যেয় বস্তুরই ধ্যান করে, তেমনি সুকলা পতিচিন্তা ছাড়া অন্য কিছু জানে না।
সেই সময় মদন এবং দেবরাজ সেই সতীর মনকে বিচলিত করার জন্য বহু চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাঁদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। মদন যখন এই নারীর কাছে হার মানল তখন ইন্দ্র তাঁকে বললেন–হে কাম, সত্বস্বরূপের ধ্যাননিবিষ্টা সতী সুকলাকে জয় করবার শক্তি তোমার নেই। এই সতী বীৰ্য্য গর্বিত বীরের মত ধর্মরূপ চাপ এবং জ্ঞানরূপ উত্তম শক্তি নিজহাতে গ্রহণ করে যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত। তুমি একে লক্ষ্য করে আত্মপৌরুষ করেছ, কিন্তু এ যুদ্ধে এই সতী তোমাকেই জয় করেছে। তাই এখান থেকে পলায়ন কর, নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা কর। পূর্বে তুমি মহাত্মা শিবের দ্বারা দগ্ধ হয়েছিল আর এখন এই সতীর সঙ্গে বিরোধ করলে তুমি নিশ্চয়ই কুৎসিত যোনি পাবে। অতএব এই সতীকে এখন ত্যাগ করা উচিত আমাদের।
এই কথা শুনে কাম বললেন–হে সুরেশ, যদি আমি এই নারীকে এখন ত্যাগ করে চলে যাই তাহলে জগতে আমার কীর্তি নাশ হবে। সকলে বলবে মদনকে এই নারী জয় করেছে। যে মুনি-ঋষি, দেবাসুরদের আমি জয় করেছি, আমাকে তারা উপহাস করবে। এখনও বলছি, ঐ নারীকে আমি জয় করবই। আপনি কিসের জন্য ভয় পাচ্ছেন?
মদন রতি ও প্রীতিকে সুকলার কাছে পাঠিয়ে তাকে জয় করবার চেষ্টা করলেন। রতি ও প্রীতি নানাভাবে সুকলাকে বোঝাবার চেষ্টা করলে, সুকলা তাদের বলল-আমার মহামতি স্বামী আমার রতি প্রতিগ্রহ করে বিদেশে গেছেন। আমার এই দেহ বর্তমানে নিরাশ্রয়। আমার স্বামী যেখানে আছেন আমিও সেখানে আছি। আমার কাম ও প্রেম দুটিই সেই স্বামীর কাছে।
রতি ও প্রীতি সুকলার এই কথা শুনে লজ্জিতা হল। তারা মদনের কাছে গিয়ে বলল– এ নারী দুর্জয়া। সুকলা সত্যই পতিব্রতা ও পতিকামা, অতএব হে কাম, তুমি আত্মপৌরুষ ত্যাগ কর।
এই কথা শুনেও কাম দমলেন না। বললেন–সুকলা যখন দেবরাজ ইন্দ্রের রূপ দেখবে, আমি তখন তাকে আহত করব।
ইন্দ্র সুবেশ ধারণ করে রতির সঙ্গে সুকলার কাছে এসে বললেন–ভদ্র পূর্বে প্রীতিবশতঃ আমি তোমার কাছে একজন দূতাঁকে পাঠিয়েছিলাম। আমি তোমার ভজনা করতে চাই। কেন তা প্রত্যাখ্যান করলে?
সুকলা বলল–আমি একাকিনী নই, সেই কারণে কাউকে আমি ভয় করি না। পুরুষকার শূরগণ আমাকে সবসময়ে রক্ষা করছে। যতক্ষণ আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরবে, ততক্ষণ আমি আপনার প্রস্তাবে উত্তর দিতে বাধ্য নই। আমার স্বামীর কর্ম সাধনেই আমি ব্যস্ত আছি। কিন্তু কে আপনি মরণকেও ভয় করেন না?
ইন্দ্র বললেন–আমি একমাত্র তোমাকেই এখানে একা দেখেছি। যে সব রক্ষকগণের কথা তুমি বলছ, কেমন দেখতে তাদের? একবার দেখাও আমাকে।
তার উত্তরে সুকলা বলল–যিনি ধৃত, মতি, গতি বুদ্ধি প্রভৃতি নিজ আত্মপরিজনের আধিপত্যে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যাঁর সব ধর্ম অবিচল, যিনি নিত্যযুক্ত ও মহাত্মা, সেই ধর্মাত্মা সব সময় আমাকে রক্ষা করছেন। শান্তি ও ক্ষমার সঙ্গে সত্য আমার সঙ্গে সর্বদা বর্তমান। আমি সব সময় সত্যাদি সমস্ত ধর্মকে রক্ষা করছি। আমাকে কি তুমি বলাকার করবার ইচ্ছা কর? তুমি কে? আমার স্বামীর সত্য, ধর্ম, পুণ্য ও জ্ঞানাদি পরম সহায়। তাদের দ্বারা আমি রক্ষিত হয়ে ইন্দ্রিয় দমন ও শান্তি পরায়ণা হয়েছি। যদি বীৰ্য্যবান কামদেবও আমাকে আঘাত করার চেষ্টা করে তবে তা ব্যর্থ হবে। অতএব, তুমি যেই হও, এখান থেকে পলায়ন কর। যদি তুমি আমার নিষেধ অমান্য কর, তাহলে আমার তেজে এখনই তুমি দগ্ধ হবে।
সুকলার কথা শুনে ইন্দ্র আশ্চর্য হয়ে কামদেবকে বললেন–এ নারীর সতীত্ব দেখ। ইন্দ্রের এই কথার পর সুকলার কাছ থেকে সবাই যে যার নিজ স্থানে চলে গেল। আর পুণ্যশীলা সুকলা পতিধ্যানে নিজের গৃহে প্রবেশ করল।