ম্লেচ্ছ বিনাশ যজ্ঞ করে রাজা প্রদ্যোত হলেন ম্লেচ্ছ হন্তা
দ্বাপর যুগের শেষে যাদবরা অত্যাচারী হয়ে ওঠাতে কৃষ্ণ নিজে থেকেই যদুকুল ধ্বংস করলেন। গান্ধারীর অভিশাপ বাক্যকে সত্যে পরিণত করলেন। অবশ্যম্ভাবীকে কেউ রোধ করতে পারে না। বর্ণাশ্রম ধর্ম বলে কিছু রইল না।
আগে নিয়ম ছিল ক্ষত্রিয়রাই রাজা হয়ে দেশশাসন করবে। কিন্তু তখন ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, যে যখন সুযোগ পেল রাজা হয়ে বসল। খাঁটি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় নেই বললেই চলে। দেশ থেকে বৈদিক ক্রিয়াকর্ম উঠে গেল, ব্রাহ্মণেরা যাগ-যজ্ঞ ছেড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরী-বাকরী করছে।
আগে ছিল সপ্তদ্বীপা একমাত্র পৃথিবী কিন্তু ক্রমে তা টুকরো টুকরো হয়ে অসংখ্য রাজ্যে পরিণত হল। এক এক রাজ্যে এক একজন রাজা। সকলেই সর্বেসর্বা হতে চায়। শুরু হল ম্লেচ্ছের রাজত্ব। অনাচার শুরু হল।
সেই সময় হস্তিনাপুরে রাজা ছিলেন পাণ্ডবদের বংশধর ক্ষেমক। রাজ্যে এমন অনাচার দেখে তিনি পুত্র প্রদ্যোতকে রাজ্যের ভার দিয়ে চলে গেলেন কলাপ গ্রামে। সেখানে সাধারণ ভাবে থেকে শ্রীহরির আরাধনায় মগ্ন হলেন।
প্রদ্যোত রাজ সিংহাসনে বসে প্রজা শাসন করতে সাধ্যমত চেষ্টা করলেন। সফলও হলেন তিনি অনেকাংশে। হস্তিনাপুরকে যথাসাধ্য শান্তিতে রাখবার চেষ্টা করলেন।
প্রদ্যোতের পিতা ক্ষেমক কলাপ গ্রামে সাধন ভজন নিয়ে থাকেন। কোথায় কি হচ্ছে খবর রাখেন না। ম্লেচ্ছরা গুপ্তচরের দ্বারা ক্ষেমকের খবর পেয়ে গোপনে ক্ষেমককে হত্যা করল। রাজা প্রদ্যোত কিছু জানতে পারলেন না।
একদিন রাজা প্রদ্যোত রাজসভায় বসে রাজকার্য পরিচালনা করছেন, সেই সময় দেবর্ষি নারদ সেখানে উপস্থিত হলেন। মুনিকে দেখে রাজা তাকে একটি সুন্দর আসনে বসিয়ে পাদ্য-অর্য দিয়ে তার পূজা করলেন। তারপর বললেন–আপনার চরণধূলি পড়ায় আমার পুরী ধন্য হল। এখন আপনার আগমনের কারণ বলুন।
দেবর্ষি নারদ বললেন–আমরা ঋষি মানুষ, ভগবানের নামগান নিয়ে থাকি। পৃথিবীর মানুষজন ভাল থাকলেই আমাদের আনন্দ। রাজা আমি একটি দুঃখের খবর তোমাকে জানাতে এসেছি। মনে হয় তোমার কানে সে খবর এখনো পৌঁছায়নি।
এই কথায় রাজা প্রদ্যোতের বুকটা দুরু দুরু করে উঠল। তিনি জানেন নাকি এমন দুঃখের কথা। উদ্বেগের সঙ্গে তিনি মুনিবরকে সেই দুঃখের কথা জিজ্ঞাসা করলেন।
দেবর্ষি বললেন–ম্লেচ্ছরা তোমার বাবাকে হত্যা করেছে। শোনামাত্রই রাজা প্রদ্যোত চমকে উঠলেন।
দেবর্ষি আবার বললেন–তোমার মত ধার্মিক রাজা থাকতেও তারা তোমার বাবাকে হত্যা করল। এমন নিষ্ঠুর কর্মের জন্য আমার মনে শান্তি নেই। তাই ভাবলাম এ খবরটা তোমাকে জানানো দরকার।
রাজ প্রদ্যোত দুঃখে-ক্রোধে অস্থির হয়ে উঠলেন।
দেবর্ষি আবার বললেন–অপঘাতে মৃত্যু হওয়ার জন্য তোমার পিতাকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। যদি তাকে সেখান থেকে মুক্ত করতে চাও, তবে ম্লেচ্ছ নিধন যজ্ঞ কর।
এই কথা বলে দেবর্ষি নারদ রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বীণা বাজাতে বাজাতে চলে গেলেন। রাজা প্রদ্যোত ক্রোধে জ্বলতে জ্বলতে বললেন–আমি এই শ্লেচ্ছদের যতদিন না বিনাশ করতে পারি ততদিন এই ম্লেচ্ছনিধন যজ্ঞ চলবে, তবেই শান্তিলাভ করব আমি।
রাজা প্রদ্যোত পণ্ডিতদের বললেন–অবশ্যই আমি যজ্ঞ করব। বেদবিদ ব্রাহ্মণ যেখানে যত আছেন তাহাদের আমন্ত্রণ জানান। আমার পূর্বপুরুষ মহারাজ জন্মেজয় যেমন সর্পনিধন যজ্ঞ করেছিলেন, আমিও তেমন ম্লেচ্ছনিধন যজ্ঞ করব।
কুরুক্ষেত্রের বিশাল স্থান জুড়ে যজ্ঞের কুণ্ড তৈরি হল। সেই কুণ্ডের চারিদিকে যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণগন বসলেন। সেই কুণ্ডে প্রচুর পরিমাণে কাঠ ও ঘি ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হল। ব্রাহ্মণেরা মন্ত্র উচ্চারণ করে ঘৃতাহুতি দিতে থাকলেন।
মন্ত্রশক্তির আকর্ষণে যেখানে যত ম্লেচ্ছ ছিল, যজ্ঞ কুণ্ডের মধ্যে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। ভয়ঙ্কর দৃশ্য, কাতারে কাতারে ম্লেচ্ছজাতি আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। দেখতে দেখতে ম্লেচ্ছকুল প্রায় নির্মূল হল। ঘৃতাহুতি সমাপ্ত করলেন ব্রাহ্মণেরা। নির্বিঘ্নে যজ্ঞের সমাপ্তি হল।
এইভাবে ম্লেচ্ছদের বিনাশ করবার জন্য রাজা প্রদ্যোতের আর এক নাম হল ম্লেচ্ছহন্তা। এরপর এক এক করে বহুবছর কেটে গেল। ম্লেচ্ছরা এই সময়ের মধ্যে আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। এরপর দ্বাপরের পর আসবে কলি। ম্লেচ্ছ ধর্ম, ম্লেচ্ছ কর্ম, ম্লেচ্ছর আচার সব কিছুই কলিতে হবে। বিধাতার নিয়ম অনুসারে এইভাবেই পৃথিবীতে আসতে হবে কলিতে।