নিরানব্বইতম অধ্যায়
বায়ু বললেন–সূত বর্ণিত তৃতীয় পাদ শুনে ঋষিরা চতুর্থ পাদের বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করলেন। সুত বললেন–এখন ভাবী সাবর্ণ মনু ও বর্তমান বৈবস্বত মনুর বিবরণ বলব। ভাবী মন্বন্তরে যাঁরা সপ্তর্ষি হবেন, তাদের নাম সংক্ষেপে বলছি। অনাগত সাত মহর্ষিই প্রখ্যাত, কুশিক নন্দন গালব, জমদগ্নিসূত ভার্গব, বশিষ্ঠ গোত্রীয় দ্বৈপায়ণ সারস্বত বংশীয় কৃপ, আত্রেয়, দীপ্তিমান, কাশ্যপ, ঋষ্যশৃঙ্গ এবং ভরদ্বাজ গোত্রীয় অশ্বত্থামা–এই সাত মহাত্মা সাত মন্বন্তরের ঋষি। সুতরাং, অমিতাভ, মুখ দেবগণের তিনটি গণ প্রখ্যাত। এক এক গণে কুড়িজন করে দেব রয়েছেন। এই দেবগণ মরীচি নন্দন মহাত্মা কাশ্যপের পুত্র। ভাবী মন্বন্তরে এরাই দেবতা হবেন। বিরোচন নন্দন বলি এঁদের ভাবী ইন্দ্র। সাবর্ণ মনুর নয়জন পুত্র হবে। তাদের নাম–বীরবান, অবরীয়ান, নির্মোহ, সত্যবাক, কৃতী, চরিফু, আদ্য, বিষ্ণু, কচ ও সুমতি।
ঐ মনুদের মতে অনেকে দক্ষের দৌহিত্র। প্রিয়তম দুহিতার গর্ভজাত। তারা মহৌজা। মহাতপস্বী, মেরুপৃষ্ঠবাসী তাদের অনেকে ব্ৰহ্মাদিদেব এবং ধীমান দক্ষ প্রজাপতি থেকে উৎপন্ন। ঋষিরা বলেন– দক্ষ কিভাবে কন্যার পুত্রোৎপাদন করলেন? সূত বললেন–আমি ভাবী সাবর্ণ মনুদের বিবরণ এবং তাদের জন্ম বিষয়ে বর্ণনা করছি। চাক্ষুষ মন্বন্তরের শুরুতে ঐ সব ভবিষ্যৎ মনুর জন্ম হয়। এদের মধ্যে পাঁচজন মনু দক্ষ প্রজাপতির দৌহিত্র চারজন মনু মহর্ষি থেকে উৎপন্ন। একজন ছায়া সংজ্ঞার পুত্র সাবর্ণ। সংজ্ঞা সূত বৈবস্বত মনু সাবর্ণ মনুর জ্যেষ্ঠ। কি বেদ, কি শ্রুতি, কি পুরাণ সর্বত্রই এঁরা প্রভবিষ্ণু, সর্বভূত পতি। ঐ মনুদের দ্বারাই সমগ্র পৃথিবীপালিত।
সম্প্রতি বৈবস্বত মনুর অধিকার কাল চলছে। এবার যাঁরা অবশিষ্ট আছেন অর্থাৎ দেব, ঋষি, দানব, দ্বিজ ইত্যাদির বিবরণ বলছি। ব্রহ্মা বৈরাজলোকে ধর্ম ও ভব সহ এক যোগে উপাসনা কাজে নিরত থাকা কালে দক্ষ প্রজাপতি তাঁর সুব্রতা নামে সর্বকনিষ্ঠ পরম ধার্মিক কন্যাকে নিয়ে ব্রহ্মের কাছে গেলেন, ব্রহ্মা ভব ও ধর্মের সামনে দক্ষকে দেখে বললেন–হে দক্ষ! তোমার কন্যা সুব্রতা চার পুত্রের জন্ম দেবে। ঐ পুত্ররা ভাবীকালে চারজন চতুর্বর্ণের সংস্থাপক মনু হবেন। ব্রহ্মার কথা শুনে সবাই এমন কি ব্রহ্মা নিজেও মনে মনে কন্যার সঙ্গে সঙ্গত হলেন। এর পরে ঐ কন্যা তাদেরই মত চারটে সন্তান তৎক্ষণাৎ প্রসব করলেন। তারা নিজেরা মীমাংসা করে নিলেন। যাঁকে যাঁর মতো দেখতে তিনিই তার পুত্র। এরকম মীমাংসা করে চার দেব নিজ নিজ সমান বর্ণ পুত্রকে নিজের বলে গ্রহণ করলে এঁরা সাবর্ণ মনু নামে বিখ্যাত হন। চাক্ষুষ মন্বন্তর অতীত হলে বৈবস্বত মনুর প্রারম্ভে প্রজাপতি রুচির রৌপ্য নামে এক পুত্র হয়। বৈবস্বত মন্বন্তরে সূর্য থেকে উৎপন্ন দুজন মনু রাজত্ব করেছিলেন। তাদের একজন। বৈবস্বত মনু, আরেকজন সাবর্ণ মনু। সূর্য থেকে ছায়ার গর্ভে যিনি উৎপন্ন হয় তিনি সাবর্ণ মনু। প্রথম মনু দক্ষ পুত্র মেরু সাবর্ণী। এঁর অন্য নাম রোহিত প্রজাপতি। ইনি ভবিষ্য মন্বন্তরের ভবিষ্য মনু। তাঁর অনেক ছেলে, সবাই মহাত্মা। তারা তিন ভাগে বিভক্ত– মরীচি গর্ভ, সুশর্মা ও পার।
ভাবীকালে অদ্ভুত নামে এক দেব এঁদের ইন্দ্র হবেন। পাবক নন্দন ইন্দসুন্দর কার্তিকেয় স্কন্ধ, পুলস্ত্য বংশীয় মেধাতিথি, কশ্যপগোত্রীয় বসু, ভৃগুবংশীয় জ্যোতিষ্মন, অঙ্গিরাবংশীয় দ্যুতি, বশিষ্ঠ্য গোত্রীয় বসিত। আত্রেয় হব্য বাহন, পৌলবংশীয় সুতপা। এঁরা রোহিত মন্বন্তরের সপ্তর্ষি। প্রথম সাবর্নির নয় পুত্র বিখ্যাত।
তাদের নাম ধৃতকেতু, দীপ্তিকেতু, সাপ, হস্ত, নিরাময়, পৃথুশ্ৰবা, অনীক, ভূরিদ্যুম্ন ও বৃহদ্রথ, দশম পর্যায়ে ধর্মপুত্র দ্বিতীয় সাবৰ্ণি মনুর নাম ভাব্য। এই ভাব্য মনুর অধিকার কালে সুখমন ও বিরুদ্ধ নামে দুটি গণ প্রসিদ্ধ। এঁরা সকলেই দ্যুতিমন্ত। শত সংখ্যায় বিভক্ত। ধর্মপুত্র মনুর অধিকার কালে এঁরাই দেবগণ হবেন। শান্তি এঁদের ভাবী ইন্দ্র বলে কথিত। পুলহ বংশীয় হবিষ্মন, ভৃগুবংশীয় শ্রীমান সুকীর্তি, অত্রি ও বশিষ্ট গোত্রীয় আপমূর্তি নামে দুই ঋষি, পুলস্ত্য বংশীয় প্রতীপ, কশ্যপ গোত্রীয় নাভাগ, অঙ্গিরা বংশীয় অভিমন্যু–এঁরাই এ মন্বন্তরের সপ্তর্ষি। সুক্ষেত্র, উত্তমৌজা, ভূরিষেণ, বীর্যবান, শতানীক, নিরমিত্র, বৃষসেন, জয়দ্ৰথ, ভুরিদ্যুম্ন ও সুবৰ্চা, এই দশজন এই ভাবী মনুর পুত্র।
এই মন্বন্তরে দেবতাদের তিনটি গণ বিখ্যাত। তিনগণের একটি গণে ত্রিশ জন দেব বিরাজমান। পণ্ডিতরা দেব কামজ এবং মুহুর্তাত্মক দেবগণ মনোজবগণ নামে কথিত। এবার এই মন্বন্তরীয় সপ্তর্ষিদের নাম বলছি। কাশ্যপ, হবিম্মান, ভার্গব, বপুম্মান, আত্রেয়, বারুণি, বশিষ্ঠ, ভৃগু, আঙ্গিরস, পুষ্টি, পৌলিস্ত্য, নিশ্চর এবং পুলহ অগ্নিতেজা।
এবারে সুকর্ম নামে দেবতাদের কথা শুনুন। সুগর্বা, বৃষভ, পৃষ্ঠ, কৃপি, দ্যুম্ন, বিপশ্চিত, বিক্রম, ক্রম, বিতৃত ও কান্ত- এরা সুকর্মা দেবগণ। এঁদের ছেলেরা হল বয়েদ্দিত, জিষ্ঠ, বচস্বী, দ্যুতিমান ইত্যাদি। এই মন্বন্তরে সপ্তর্ষিরা হলেন কৃতী, আত্রেয়, সুতপা, অঙ্গিরস, তপোমূর্তি, কাশ্যপ, তপস্বী, পৌলস্ত্য, তপোপায়ন, পৌহল, তপোরতি ও ভার্গব তপোমতি, এঁরাই এই মন্বন্তরীয় সপ্তর্ষি।
কাশ্যপ অগ্নী, পৌলস্ত, মগধ, ভার্গব, অগ্নিবাহ, আঙ্গিরস, শুচি, ঔজস্বী ও সুবল এঁরা ভৌত্য মনুর পুত্র। রৌচ্য ও ভৌত্য এই দুই মনু পুলহ ও ভৃগু বংশীয়। ভৌত্য মনুর আধিপত্য কালের অবসানেই কল্পাবসান নিশ্চিত। এইভাবে ত্রৈলোক্য ত্যাগ করে মন্বন্তরীয় প্রধান প্রধান পুরুষেরা ঊর্ধ্বে মহৎলোকে গেলে সেই সময় সমস্ত ত্রৈলোক্য নিরাধার হয়ে পড়ে।
ত্রৈলোক্যের প্রধানগণ অতীত হলে ইন্দ্র প্রমুখ দেবশ্রেষ্ঠ, জিতেন্দ্রিয় দেবগণ, চাক্ষুষ মন্বন্তর পর্যন্ত চতুর্দশ মনুগণ ও অন্যান্য দেবগণ সকলেই তখন ঊর্ধ্বলোক কল্পবাসীদের সঙ্গে মিলিত হন। তারপর মহলোক পরিত্যাগ করে সেই সব চতুর্দশ গণ অনুচরসহ সশরীরে জনলোকে যান। এভাবে দেবগণ মহর্লোক থেকে জনলোকে প্রস্থান করলে অবশিষ্ট চরাচর ভূত বিনষ্ট হয়। তারপর ব্রহ্মা সেই সহদেব, ঋষি, পিতৃ ও দানবদের সংহার করে যুগয়ে মহৎ সৃষ্টির সূচনা করে আবার সৃষ্টি স্থাপন করেন।
সহস্র চতুর্যুগে ব্রহ্মার একদিন ও হাজার যুগে তাঁর রাত্রি হয়। অহোরাত্র জ্ঞানসম্পন্ন পণ্ডিতেরা ব্রহ্মার দিবরাত্রি মান এরকমই নির্দেশ করেন। নৈমিত্তিক, প্রাকৃতিক ও আত্যন্তিক প্রলয় বলে উল্লিখিত। তারপর ব্রহ্মা ত্রৈলোক্যবাসী সমস্ত দেবতাদেরকে সংহার করে নিজের দিন অবসানে সৃষ্টি সংহার করে থাকেন। তারপর দিব্য হাজার যুগের অবসানে সেই প্রজাপতি প্রজাপুঞ্জের সৃষ্টি বিস্তারে প্রবৃত্ত হয়ে থাকেন। ঐ সময় শতবর্ষ ধরে অনাবৃষ্টি হয়। সেই সময় সৌর রশ্মির অসহ্য তেজে সবকিছু জ্বলতে থাকে। সূর্য সপ্তরশ্মি দ্বারা মহাসাগর থেকে জল পান করে। সমুদ্র, নদী, পাতাল থেকে সমস্ত জল পান করে পৃথিবীকে দগ্ধ করান। পাতাল দগ্ধ করে পরে তিনি নাগলোক দগ্ধ করে থাকেন। পৃথিবী দগ্ধ করার পর ঐ আগুনে স্বর্গলোকও দগ্ধ করেন। গন্ধর্ব, পিশাচ, রাক্ষস ইত্যাদিকে দগ্ধ করে থাকেন। এর পর নানা আকারের নানা বর্ণের মেঘ ঘোর গর্জন করতে করতে নভঃস্থল পরিপূর্ণ করে জল বর্ষণ করে। মেঘগুলি তখন প্রলয় রশ্মিকে নিভিয়ে দেয়।
জল দিয়ে সমস্ত লোক আবৃত হলে বুধগণ এই অবস্থাকে একানব বলে বর্ণনা করেন। একানব অবস্থায় কোনোকিছুর তখন সীমা থাকে না, সমস্তই প্রলয় হয়ে যায়। ঐ সমুদ্রের মতো জল সমস্ত মহীমণ্ডলকে আচ্ছাদিত করে। এভাবে একানবে স্থাবর জঙ্গম সমস্ত নষ্ট হয়ে গেলে তখন একমাত্র সহস্রাক্ষ, আদি পুরুষ ব্রহ্মাই থাকেন।
ঐ প্রভু চতুর্যুগের অবসান হলে সমস্ত ভুবন সলিলাপ্লুত হলে শয়ন ইচ্ছায় রাত্রি কল্পনা করেন। যখন চার প্রকার প্রজার সংহার সাধন করে ব্রহ্মা শয়ন করেন তখন শুধু সপ্ত মহর্ষিই সেই মহাত্মাকে দেখে থাকেন। ভৃগু প্রভৃতি মহাত্মা ঋষিগণ ব্রহ্মার নিদ্রা অবস্থায় ব্রহ্মাকে দর্শন করেন। ব্রহ্মা স্বীয় আত্মায় সমস্ত সংগ্রহ করে একানব জলে তপোময়ী রাত্রিতে বাস করেন।
আদিত্যের তেজে দেব, ঋষি, মনুষ্যাদি, ভূতবৃন্দ দগ্ধ হয়ে যায়। তারপর এরা জল লোকে আশ্রয় নেয়। তারপর ব্রহ্মার রাত্রি অবসানে আবার তারা জন্মগ্রহণ করে। ঋষি, মনু, দেব, চতুর্বিধ প্রজার আবার উদ্ভব হয়। জগতে যেমন সূর্যের উদয়াস্ত অবধারিত তেমনি ভূতগণেরও উৎপত্তি সংসার নামে নিরূপিত, চরাচর ভূতবৃন্দ প্রজাকর্তা প্রজাপতি মহেশ্বর ব্রহ্মার দেহে বারবার প্রবেশ করে ও বারবার নির্গত হয়। এ জগতের যা কিছু সবই তার দ্বারাই সৃষ্ট।
মন্বন্তর যুগ সহস্রাত্মক, এর দুই হাজার যুগ পূর্ণ হলে এক কল্পকাল নিঃশেষ হয়ে থাকে। একে ব্রাহ্মদিন বলে বলা হয়। এই দিন সংখ্যার কথা বিশদে বলছি, মানুষের চোখের একটি স্পন্দনকেও নিমেষ বলা যায়। পনেরো নিমেষে এক কাষ্ঠা। এই কাষ্ঠারই নামান্তর হল লব। পাঁচ লবে এক ক্ষণ। বিশ লবে এক কলা। এই সব সংখ্যা দিয়েই চাঁদ সূর্যের গতি নির্ণয় করা হয়। পনেরো নিমেষে এক কাষ্ঠা। ত্রিশ কাষ্ঠায় এক কলা। ত্রিশ কলায় এক মুহূর্ত।
জল দিয়েও এরকম পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। যেমন তেরো পল জল এক প্রস্থ। এর চার প্রস্থে এক নালিক বা এক ঘট। চার আঙ্গুল পরিমাণ চারটে স্বর্ণমাসা দিয়ে কলসীতে ছিদ্র করলে তা দিয়ে দিন-রাত প্রতি মুহূর্তে দুই নালিক পরিমাণ জল ক্ষরিত হয়। রবির গতি তারতম্য থাকলেও সব ঋতুতে অহোরাত্র ছয়শো দুই কলা কাল নির্দিষ্ট আছে। এটাই মানুষের অহোরাত্র পরিমাণ। ক্ষত্রিয় অহোরাত্রের পরিমাণ ছয়শো দশ কলা। এটাই সাধন মান। এই মানের দ্বাদশ মাসে মানুষদের এক বৎসর হয়। এটাই এক দিব্য অহোরাত্র। এইভাবেই মাস, দিন, ঋতু, অয়ন, বৎসরাদি নির্ণয় হয়।
ব্রাহ্ম দিবসের পরিমাণ দিব্যমানের এক কোটি বিশ লক্ষ নব্বই সহস্রাধিক করা। ঋষিরা একথা শুনে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে কাল সংখ্যা বিষয়ক সন্দেহ ভাজনের জন্য জিজ্ঞাসা করলেন। আমরা মানুষ মান সম্মত সংখ্যা দিয়ে প্রলয় পরিমাণ শুনতে ইচ্ছা করি। ভগবান বায়ু ঋষিদের কথা শুনে সংক্ষেপে বললেন–মানুষ মানের চারশো বত্রিশ কোটি একানব্বই লক্ষ আশি হাজার বছর কালই প্রলয় অবধি ব্রহ্মার দিনমান। মানুষ পরিমাণে এই প্রলয়কাল নির্দিষ্ট হল। প্রলয়ে সাত সূর্য সমুদিত হলে লোক সকল বিলীন হয়ে যায়। জল দিয়ে লোক সকল আপ্লুত হয়। স্থাবর, জঙ্গম, জগৎ নষ্ট হয়ে যায়। সংহার কাজ শেষ হলে প্রজাপতি শান্ত হন। সমস্ত দগ্ধ লোকে অন্ধকারে ঢেকে যায়। এই রাত্রি শুধু সলিলে প্লাবিত। এর অবসানে আবার ব্রাহ্মদিনের সূচনা। এই ভাবে ব্রহ্মার অহোরাত্র পরিবর্তিত হচ্ছে। নিখিল ভূত বিলয় অবধি ব্রহ্মার অহোরাত্র। প্রজাপতি ব্রহ্মার পরমায়ু বিপরার্ধকাল। তিনি এই পরিমাণ কালই অবস্থান করে থাকেন।
প্রলয় বৃত্তান্ত শেষ হল। এটি ব্রাহ্ম নৈমিত্তিক প্রলয় বলে নির্দিষ্ট।
.
শততম অধ্যায়
বায়ু বললেন–যে সব সূক্ষ্মদর্শী ব্রাহ্মণ লোক চরিত্রবান হয়ে যাগযজ্ঞাদির সাথে বিশেষ বিশেষ ধর্মাচারণ করেন, তাঁরা মহর্লোকে দেবতাদের সাথে অবস্থান করেন। আগে যে অতীত অনাগত, ভবিষ্যত কীর্তিমান চোদ্দজন মনুর বিবরণ বলেছি, সেই মনুগণ, ঋষি, দেবতা, গন্ধর্ব, রাক্ষস, সবাই প্রত্যেক মন্বন্তরে বারবার জন্মগ্রহণ করে থাকেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রাদি মধ্যে যাঁরা শ্রদ্ধাবান সত্যবাদী, দম্ভহীন ভাবে ধর্মাচারণ করেন তারা মহর্লোকে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ঋষিরা তখন জিজ্ঞাসা করলেন- হে বায়ু! আপনি যে মহলোকের কথা বললেন–সে কেমন? বায়ু মধুর বাক্যে বললেন–চৌদ্দটি লোক আছে। সেখানে মানবগণ বাস করেন। তার মধ্যে সাতটি কৃত, আর অপর সাতটি অকৃত নামে অভিহিত। পৃথিবী, অন্তরীক্ষ, দিব ও মহঃ এই লোক চতুষ্টয় আণবিক নামে প্রসিদ্ধ। এরা ক্ষয় বুদ্ধিযুক্ত। যেসব লোক ক্ষয় বুদ্ধিহীন, তার উল্লেখ করছি। নৈমিত্তিক লোকসকল প্রলয়কাল পর্যন্ত স্থায়ী। জল, তপ ও সত্য এই তিনটি লোক একান্ত সত্বগুণ বহুল। এদের স্থিতিকাল কল্পান্ত পর্যন্ত। ভূঃ প্রথম, ভূব দ্বিতীয়, স্বলোক তৃতীয়, মহ চতুর্থ, জন পঞ্চম, তপঃ ষষ্ঠ, সত্য সপ্তম। এর পর নিরালোক। ভূর্লোক পার্থিব, ভূব অন্তরীক্ষ এবং স্বলোকেই স্বর্গলোক। পুরাণশাস্ত্রে এটাই নির্ণীত আছে। অগ্নি ভূতের অর্থাৎ ভূলোকের অধিপতি বলে ভূতপতি নামে, বায়ু ভূবলোকের অর্থাৎ অন্তরীক্ষ লোকের অধিপতি বলে ভূস্পতি এবং সূর্য ভব্যের অর্থাৎ স্বর্গলোকের অধিপতি বলে দিবস্পতি নামে প্রসিদ্ধ। ব্রহ্মা, মহঃশব্দ উচ্চারণ করা মাত্র মহর্লোকের উৎপত্তি হয়েছিল। দেবগণের অধিকার কাল শেষ হলে তারা সেই মহর্লোকে গিয়ে অবস্থান করেন।
জনলোকে পঞ্চমলোক, তা থেকেই জনগণের প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে। কল্পান্তকালে লোক সকল দগ্ধ হয়ে গেলে তারা তপলোকে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন। ঋভু ও সনৎ কুমারাদি তপঃ উর্ধরেতাগণ ঐ জায়গাতে বাস করেন বলে এটি তপঃলোক নামে অভিহিত হয়ে থাকে। ব্রহ্মলোক সত্য নামে পরিচিত, ঐ সত্যলোক হল সপ্তম লোক দেবগণ সবাই স্বর্গলোকবাসী। সর্প, ভূত, পিশাচ, নাগ, মানুষাদি ভূতলবাসী, রুদ্র, সাতরস্বা মরুদগণ ও অশ্বিনী কুমারদ্বয় নিকেতহীন, কিন্তু এরা ভূবলোকে বাস করে থাকেন। আদিত্য, ঋভু, সাধ্য ও অঙ্গিরা প্রভৃতি ঋষি এবং পিতৃগণ এরা ভূর্বলোকেই বাস করেন। শুক্র থেকে চাক্ষুষ পর্যন্ত মনুগণ, যাঁরা একবার ভূবলোকে বাস করেছেন তারাও মহলোকে গিয়ে অবস্থান করেন।
সাবর্ণ ইত্যাদি চোদ্দ মন্বন্তরে পুনরাবৃত্তি তপঃলোক থেকেই হয়ে থাকে। সত্যলোক সপ্তম লোক, এরই অন্য নাম ব্রহ্মলোক, এর বিনাশ হয় না। সেখানকার অধিবাসীদের পুনরাবৃত্তি হয় না। ভূর্লোক থেকে সূর্য পর্যন্ত ভূবলোক। সূর্য থেকে ধ্রুব স্বর্গলোক। ধ্রুব থেকে জনলোক পর্যন্ত ভূর্লোকবাসীরা রসাত্মক ও অন্নভোজী। ভূবলোকবাসীরা সোমপায়ী। স্বর্গলোকবাসীরা অদ্যপায়ী। এই দেবতারা যজ্ঞ দিয়ে পরস্পর যাজন করে থাকেন। সপ্তবিধ দেবতা দেববংশেই জন্মগ্রহণ করে থাকেন। চাররকম দেবতা অতীত হয়েছেন। বিবিধ দেবতা অবশিষ্ট আছেন। এঁরাও দশবার জন্ম মরণ দশা পেয়ে, সুষ্ঠভাবে সেই জনলোক ত্যাগ করে বৈরাজ ধামে গমন করেন। যেখানে দশক অবধি বাস করে সেখান থেকে পূর্ব ক্রমে ব্রহ্মলোকে যান।
মুনিরা এরপরে বৈরাজ লোকবাসীদের জীবনযাত্রা বিষয়ে জানতে চান। সূত বললেন–পরিশুদ্ধতম জনলোকবাসীরা বৈরাজলোকে গিয়ে দশকল্প যাবৎ সেখানে বাস করে থাকেন। এঁরা সকলেই জ্ঞানী, সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছমূর্তি। সেখানে শুদ্ধবুদ্ধি সম্পন্ন সনৎ কুমারাদি সিদ্ধগণ দশকল্প শেষ হলে বৈরাজ ধাম পরিত্যাগ করে উৎসুক হয়ে পরস্পর বলেন, আমরা ব্রহ্মলোক আশ্রয় করলে আমাদের কুশল হবে। এই বলে সেই মহাত্মারা আত্মা দিয়ে ব্রহ্মের মধ্যে লীন হয়ে যান। এঁরা ব্রহ্মানন্দ নিমগ্ন হয়ে অমৃতত্ব প্রাপ্ত হন। বৈরাজলোক থেকে ব্রহ্মলোক ছ’গুণ উর্ধ্বে অবস্থিত। সেখানকার অধিবাসীরা সকলেই শুদ্ধ, বুদ্ধ, পরম তপস্বী, তাদের সুখ-দুঃখের অনুভূতি নেই। এই সমস্ত জ্ঞানী, ব্রহ্মলোকবাসীরা ব্রহ্মার সাথে অব্যক্ত প্রকৃতিতে লীন হন।
উৰ্দ্ধরেতা দেবর্ষিগণ, কর্মযোগের চরম সাধন করে পাপ শরীর ত্যাগ করে অমৃত লাভে সক্ষম হন। যারা সংসার বিরাগী, মোহহীন, সত্যবাদী, শান্ত, দয়াবান, জিতেন্দ্রিয়, নিঃসঙ্গ, শুচি তারাই ব্রহ্মলাভ করেন। ঋষিরা তখন জিজ্ঞাসা করলেন –পরাধ কাকে বলে? তারপরই বা কি? আমরা জানতে চাই। সূত বললেন–আপনারা আমার কাছে পরাধ ও পরের পরিসংখ্যা শুনুন। দশ হাজার এক অযুত, শত সহস্র এক নিযুত, দশ নিযুতে এক কোটি, দশ কোটিতে এক অর্বুদ।
শতকোটিতে এক পদ্ম, সহস্র কোটিতে এক খর্ব, দশ হাজার কোটিতে এক নিখর্ব, শত কোটি সহস্রে এক শঙ্কু এবং সহস্র সহস্র কোটিকে দশ গুণ করলে তাকে সংখ্যাতত্ত্বজ্ঞ মনীষীরা সমুদ্রল সংজ্ঞায় অভিহিত করে থাকেন। সহস্রাযুত কোটিতে এর মধ্যে, সহস্ৰ নিযুত কোটিতে এক অন্ত। সহস্র কোটি কোটিতে এক পরার্ধ এবং দুই পরার্ধে এক পরসংখ্যা নির্ণয় করা হয়। শত সংখ্যাকে পরিদৃঢ় ও সহস্র সংখ্যাকে পরিপদ্মক বলে। অযুত, নিযুত, প্রযুত, অবুদ, নির্বুদ, খর্ব, নিখর্ব, শঙ্কু, পদ্ম, সমুদ্র, মধ্যম, পরার্থ, পর ইত্যাদি মিলে আঠারোটি সংখ্যা।
এই আঠারোটি সংখ্যা পরস্পর গুণিত হয়ে শত শত সংখ্যায় পরিণত হয়। কল্পকালের পরিমাণ সংখ্যা, সৃষ্টি, প্রবৃত্তি কাল থেকে এক পরাধ। এর পরেও এক পরার্ধকাল সৃষ্টি রহিত অবস্থায় যায়। তার থেকে আবার সৃষ্টি শুরু হয়ে থাকে। সুতরাং এক সৃষ্টি থেকে আরেক সৃষ্টি পর্যন্ত কাল এক পরপদ বাচ্য। ব্রহ্মাই একমাত্র স্থিত, এই জন্য সমস্ত জাগতিক পদার্থের মধ্যে সেই ব্রহ্মকে পরপদে অভিহিত করা যায়। তার অর্ধকেই পরিধি বলে। পুরুষ, প্রকৃতি ও ব্রহ্মা এঁরা সংখ্যা দ্বারা গণনার অতীত।
পরার্ধ, পর, ব্রহ্ম, প্রকৃতি ও পুরুষ এই পঞ্চ তত্ত্ব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট বিধান নেই। দিব্য দৃষ্টি সম্পন্ন যোগীরাই এই সব তত্ত্ব নির্ণয় করতে পারেন। কিন্তু ব্রহ্মা এই সমস্ত তত্ত্ব জ্ঞান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলে ব্রহ্মা সেই সমস্তই দর্শন করে থাকেন। ব্রহ্মবাদী ঋষিরা বললেন–ব্রহ্মলোক যতদূর অন্তরে অবস্থিত, এর অন্তর পরিমাণ যত ক্রোশ এবং যেভাবে পরিমাণ করা যায় ইত্যাদি বিষয়ে বলুন। বায়ু বললেন–এই আমি আপনাদের অন্যান্য বিবষিত বিষয় বলছি, অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত ভাগ অতি মহতত্ত্ব স্থূল বলেই বিভাবিত। মহৎ থেকে ভূতাদি দশ ভাগ স্থূল, এরচেয়ে পরমাণু দশভাগ বেশি, এই পরমাণু অতি সূক্ষ্ম, এটি অনুভব দ্বারাই গ্রাহ্য। কিন্তু চোখ দিয়ে দেখা যায় না। জগতে যা কিছু ভেদ করা যায় না তাই পরমাণু বলে খ্যাত। সূর্য রশ্মির মধ্যে সূক্ষ্ম রজঃকণা দেখা যায়, তাই পরমাণু।
অষ্ট পরমাণুর যে সমবায়, তার নাম এসরেণু, এটি পদ্মরজঃ বলে নির্দিষ্ট, আট এসরেণু দিয়ে এক রথরেণু পরিকল্পনা করা হয়। আট এসরেণু সমবায়কে বুধগণ বলাগ্র নামে নির্দেশ করে। আট বলাগ্রে এক লিক্ষা এবং অষ্ট লিক্ষায় এক যুগ। যুগকাষ্ঠককে এক যব বলে ধরা হয়। আট যব এক অঙ্গুলি বলে কথিত। বারো আঙ্গুল পর্বকে এক বিতস্তি বলা হয়। একুশ অঙ্গুলি পর্বে এক রত্নি হয়ে থাকে। চব্বিশ অঙ্গুলিতে এক হাত পরিমাণ নির্দিষ্ট, বিয়াল্লিশ অঙ্গুলিতে এক কিঙ্কু পরিমাণ হয়। মনীষীরা ছিয়ানব্বই অঙ্গুলিতে এক ধনুঃপরিমাণ নির্দেশ করেন। এই ধনুঃ পরিমাণ এক গদ্যুতি সংখ্যায় নির্দেশ করে।
ধনু, দণ্ড, যুগ ও নালী এসবই অঙ্গুলির মানের সাথে তুলনীয়। তিনশো ধনুতে এক নম্ব হয়। দু হাজার ধনুতে এক গচ্যুতি। আট হাজার ধনু এক যোজন। এভাবে ধনু দ্বারা যোজন নিরূপণ করা হল। এই যোজনা দিয়েই ব্রহ্মাস্থানের ব্যবধান বলাই।
মহীতল থেকে এক লক্ষ যোজন উপরে দিবাকর। দিবাকর থেকে শত সহস্র যোজন উর্ধে নিশাকর, নিশাকর থেকে শত সহস্র যোজন ঊর্ধ্বে সমস্ত নক্ষত্র মণ্ডল প্রকাশ পেয়ে থাকে। মেরু মণ্ডল তারও দুলক্ষ যোজন ওপরে। নক্ষত্রমণ্ডল থেকে এক একটি গ্রহ পরস্পর পরস্পর অপেক্ষা উর্ধভাগে অবস্থিত। সমস্ত তারা গ্রহের নিচের ভাগে বুধ গ্রহ বিচরণ করে। তার উপরে শুক্র, তার উপরে মঙ্গল, তার উপরে বৃহস্পতি, বৃহস্পতির উপরে শনৈশ্চর বিচরণ করেন। এর থেকে লক্ষ্য যোজন ওপরে সমস্ত সপ্তর্ষি মণ্ডল থেকে এক লক্ষ যোজন ঊর্ধ্বে।
যোজন পরিমাণ দিয়ে ত্রৈলোক্যের মান বলা হয়। এই ত্রৈলোক্যই প্রতি মন্বন্তরে দেবতাদের এবং বর্ণাশ্রমবাসীদের লৌকিক যাগযজ্ঞ প্রবর্তিত হয়ে থাকে। ধ্রুবলোক থেকে মহর্লোক এক কোটি যোজন ঊর্ধ্বে অবস্থিত। আর দু কোটি যোজন ঊর্ধ্বে জনলোক অবস্থিত। এখানে কল্পবাসী ব্রহ্মপুত্র দক্ষ প্রভৃতি সাধু সম্প্রদায় আছেন। এই লোক থেকে চারগুণ ওপরে তপঃলোক রয়েছে। এখানে বৈরাজ নামে দেবতারা রয়েছেন। এঁরা সব সময়ই শান্তিময়, এঁদের ক্লেশ নেই।
তপঃলোকের দু-গুণ ওপরে সত্য লোক রয়েছে। যাঁদের জরা, মরণ বা জন্ম নেই। এ লোকে যাঁদের বাস, এই লোককেই ব্রহ্মলোক বলে। ব্রহ্মোপাসক ব্যক্তি একবার এখানে এলে আর এই জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য কোথাও যান না। ব্রহ্মলোক থেকে অন্যের ঊর্ধ্বভাগের পরিমাণ চার কোটি পঁয়ষট্টি নিযুত যোজন। এই অংশের অধোভাগেই ধ্রুবের অবস্থান।
এবারে অধোগত ভূতবৃন্দের বাসস্থানের কথা বলছি শুনুন। কুরকর্মা প্রাণীরাই নিজ নিজ কর্মফলে ঐ সব জায়গায় গিয়ে থাকে। রৌরব, রোধ, শূকর, তাল, তপ্তকুণ্ড, মহাজ্বাল, বিমোচন, কৃমি, কৃমিভক্ষ রুধিরান্ধ, তমঃ লোহ, অসিজ ইত্যাদি তমসাচ্ছন্ন নরকগুলি যমের অধিকারে থাকে। যারা পাপ কাজ করে তারা কর্মফলের জন্য নরকে যায়। সমস্ত নরকই ভূমির নীচে রয়েছে। কুটসাক্ষী, মিথ্যাবাদী, একপক্ষবাদী নর রৌরব নরকে যায়। এইভাবে গো, প্রাণঘাতী ব্যক্তি রোধ নরকে, ব্রহ্মঘাতী, সুরাপায়ী, স্বর্ণচোর ব্যক্তি শূকর নরকে যায়। ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যঘাতী ব্যক্তি তাল নরকে, ভগিনীগামী ও রাজঘাতী ব্যক্তি তপ্ত কুম্ভে, গুরুজনের অবমাননাকারী, গুরুকে কটু কথায় আঘাতকারী ব্যক্তি শাবল নরকে যায়।
এইভাবে ভূমির নীচে সপ্ত নরকের বর্ণনা আছে। অধম থেকে ঐ সব নরকের উৎপত্তি, প্রথমে রৌরব নরক, এটি ওপরে দারুণ ঠান্ডা ও নীচে ভীষণ গরম, এর নীচে তমো নামে ভীষণ নরক আছে তা প্রবল ঠান্ডা, সেখানে সব বিষধর সাপ আছে, অধীচি নরকে যন্ত্র দ্বারা পীড়ন করা হয়। লৌহ নরক তো এর থেকেও ভীষণ অবিধেয় নরক যা অদৃশ্য অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু এখানে পীড়ন ও বধ চলে। নরক ভোগের শেষে কর্মসূত্রে আবদ্ধ জীবরা আবার কর্ম অনুসারেই জন্মগ্রহণ করে। আবার সেই নরকে গিয়ে উকট দুঃখ ভোগ করে। কর্মক্ষয়ে দেবগণকেও নরকবাসী হতে হয়। এভাবে নিজ নিজ কর্মফলে জীবগণের উধ্বগতি বা অধোগতি হয়ে থাকে।
এরপর যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণরা আবার বায়ুকে জিজ্ঞাসা করলেন–লোকালোকবাসী নিখিল ভূত বৃন্দের মধ্যে যে সব প্রাণী এ সংসারে বিচরণ করে তাদের কথা বলুন। এই শুনে বায়ু বললেন–প্রাণীপ্রবাহ, অনাদি, অনন্ত, এদের গণনা হওয়া সম্ভব নয়। তবে ব্রহ্মা সংখ্যা পূর্বক যেরূপ নির্দেশ করেছেন তা শুনুন। স্থাবরদের যে সহস্রতম ভাগ, সেই সংখ্যক পার্থিব কৃমি এদের থেকেই উৎপন্ন। এই কৃমিদের সহস্রতম ভাগই জলীয় প্রাণীগণ। জলীয় প্রাণীদের সহস্রভাগে লৌকিক বিহঙ্গগণ, বিহঙ্গধর্মদের সহস্র ভাগে দ্বিপদগণ, দ্বিপদের সহস্রতম ভাগে ধার্মিকগণ, ধার্মিকদের সহস্রতম ভাগে স্বর্গীয় ধার্মিকগণ ও স্বর্গীয় ধার্মিকদের সহস্রতম ভাগে মুক্ত পুরুষগণ।
যে সব পাপাচারী দুরাত্মাগণের মৃত্যু হয় তারা রৌরব নামে তামস নরকে পড়ে উৎকট ও প্রচণ্ড গরম অবস্থা ভোগ করে। স্বয়ম্ভু এরকম বর্ণনাই দিয়েছেন। ঋষিগণ বললেন–মহ, জন, তপঃ ও সত্য এই সব ভূত, ভাবী ও বর্তমান লোক আপনি পরপর বলেছেন। এবার লোকান্তর কি রকম আমাদের কাছে বলুন। বায়ু বললেন–মনীষীরা তর্ক দ্বারা, যোগীগণ যোগ দ্বারা প্রত্যক্ষ করে এবং কর্মীগণ তপস্যাবলে এই তত্ত্ব জেনে থাকেন। ঋভু, সনৎকুমারাদি শুদ্ধ বুদ্ধি, লোকহীন বিরজক, বুদ্ধ, মহর্ষিগণ, সাধুগণ, সেই ঈশ্বর ধাম প্রত্যক্ষ করেছেন।
জ্ঞান, বৈরাগ্য, ঐশ্বর্য, তপস্যা, সত্য, ক্ষমা, ধৈর্য ইত্যাদি দশটি গুণ মঙ্গলময় পরমেশ্বরে প্রতিষ্ঠিত। এই পরমেশ্বরের পরমস্থান পরিমাণ রহিত। চিরস্থির, সুখ দুঃখাদি বৈষয়িক সম্পর্কহীন, মায়াময় সৎস্বরূপ। এটি সমগ্র সৃষ্টির মূল স্থান। মায়াময় মহেশ্বর নিজ মায়া দিয়েই তা নির্মাণ করেছেন। ভূর্লোক থেকে ব্রহ্মলোক, তেরো কোটি পনেরো নিযুত যোজন অন্তরে রয়েছে। ব্রহ্মলোক থেকে এক কোটি পঞ্চাশ নিযুত যোজন ব্যবধানে রয়েছে ব্রহ্মাণ্ডকটাহ, উধ্বর্ভাগের সীমা ঐ পর্যন্ত। এরপর আর গতি নেই। সেই অগম্য প্রদেশ নিত্য, অসংখ্য পরস্পর গুণাশ্রয়ী সূক্ষ্ম। তা থেকেই জগকর্তা ব্রহ্মা প্রাদুর্ভূত হয়েছেন। তিনি প্রাদুর্ভাব, তিরোভাব, স্থিতি, বিধি, দয়া ইত্যাদির মূল আশ্রয়। তিনি নিজেই প্রকাশিত, যে হিরন্ময় অন্তর্জগৎ সৃষ্টির মূলে তা ঈশ্বর থেকে প্রাদুর্ভূত। ঈশ্বর থেকেই বীজ বিভাগ হয়ে থাকে, ক্ষেত্রজ্ঞই সেই বীজ, প্রকৃতিকে যোনি বলা হয়। মহাত্মা বিভু, লোক সৃষ্টি ও লোক সংস্থানের জন্য প্রকৃতি সহযোগে আত্ম তনু দিয়ে ব্রহ্মলোক ব্রহ্মাণ্ডাদির সৃষ্টি করেন। ব্রহ্মলোকের ওপরে আর ব্ৰহ্মকটাহের নীচের ভাগে একটি সুন্দর পুরী আছে। ঐ পুরীর নাম শিব। ঐ পুরী শত সহস্র যোজন আয়ত, এটি অভ্যন্তরে মহীমণ্ডল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ। ঐ পুরীতে তেজোদীপ্ত সূর্যের মতো উজ্জ্বল সোনার মহাপ্রকার আছে। ঐ স্বর্গীয় পুরী ঘণ্টার শব্দে মুখরিত। ঐ জায়গায় জরা-মৃত্যু নেই। ভগবান বৃষধ্বজ ঐ পুরীর অধিস্বামী।
ঐ সুন্দর প্রাসাদ মনের কল্পনার মতোই যেন সাজানো। এখানে রত্নময় বালুকা রয়েছে। চারিদিকে সুগন্ধ যুক্ত ফুল ফুটে রয়েছে। সেগুলি নানা রঙের, এখানে সাতটি মহানদী আছে। এদের নাম হল-বরা, বরেণ্যা, বরদা, বরাহগা, বরবর্ণিনী, বরমা, বরভদ্রা। ঈশ্বরের এই সুন্দর পুরীর কথা কেউই জানেন না। তবে যাঁরা একান্তই ধ্যাননিষ্ঠ, যোগসম্পন্ন এবং জিতেন্দ্রিয় তারাই মহাত্মা বৃষধ্বজের এই প্রাসাদ দর্শন করতে পারেন। এই সুমহান প্রাসাদ স্বীয় তেজে দীপ্যমান, রত্নরাজি দিয়ে সুসজ্জিত। প্রাসাদের মধ্যে ত্র্যম্বকের আবাসে লক্ষ্মী, স্ত্রী, বপুঃ মায়া, কীর্তি শোভা ও সরস্বতী প্রভৃতি রূপবতী দেবীরা নিজের আত্মাকে শত কোটি অংশে বিভক্ত করে নিরলসভাবে নিরন্তর সেই ভগবান মহাত্মা মহাদেবকে তুষ্ট করছেন। সুন্দরী দেবীদের অসংখ্য পরিচারিকা আছে। তারা কেউ কেউ সুভগা, চারুলোচনা, সুন্দরী গজানো, লোহিতনেত্রা। দশবাহুধারী ভগবান মহাদেব নন্দী ইত্যাদি প্রমথগণ, রুদ্রগণের সঙ্গে তিনি বিহার করে থাকেন। রুদ্রগণ সকলেই মহাদেবের মতো উদার ও পরাক্রমশালী। এদের দেখতে ভীষণাকৃতি, এঁরা এক মনে মহাদেবের পূজায় নিরত। তার হাতে দশবর্ণ নামে বিচিত্র ধনু আছে। তাঁর হাতে ত্রিশূলও আছে। তিনি তেজে কান্তিচ্ছটায় অগ্নিশিখার মতোই প্রজ্জ্বলিত। এই মহাত্মা দেবেশের সামনে একটি অতি সুন্দর, মনোহর সোনার তৈরী জলপূর্ণ কমণ্ডলু আছে। চতুর্ভূজাঃ বিজয়া দেবী শ্রীযুক্তা হয়ে শোভা বর্ধন করে মহাদেবের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। বিজয়ার পরনে পাণ্ডুর বসন, অঙ্গে অসি লতা জড়ানো ও বক্ষে বিরাট মুক্তার মালা দুলছে। তার পিছনে অনেক অপ্সরা ও রমণী বিরাজমান। এছাড়া তার পুত্র ময়ূর বাহন সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
যেসব রাজা সোনা দান করেছেন, যেসব ব্রাহ্মণ সংযমী, গৃহধর্মাচারী ও যাঁরা ব্রহ্মবাদী যাঁরা সাত্ত্বিক তপঃসম্পন্ন তারাই এই শিবপুরে দেবাদিদেবের সভাষদ। বারবার মন্বন্তর হওয়া সত্ত্বেও শিবের সভা একই রকম আছে। এবার সেই দেব দেবের সম্বন্ধে অবক্ষয় ঘটনা বলছি। সোনার আভাযুক্ত, প্রচণ্ড গতিশালী কতগুলি বাঘ তাঁর অনুগামী। এদের এই দেবই নির্মাণ করেছেন। এরা যমেরও দর্প হরণকারী। মহাদেবের এই প্রাসাদের স্তম্ভগুলি তার মায়ায় নির্মিত। এক হাজার সিংহ অগ্নিময় পাশ দিয়ে শৃঙ্খলিত করা আছে। সিংহগুলি রূপে তেজে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ত্র্যম্বকের ভবনে এরা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে বাস করছে। এই সিংহগুলি হল মহাত্মা ঈশ্বরের ক্রোধস্বরূপ। তিনি পুরাকালে নিজ দেহ থেকে ক্রোধ রাশিকে সিংহাকারে রূপ দিয়ে অগ্নিময় জালে আবদ্ধ রেখেছেন।
যজ্ঞভাগের জন্য দক্ষের সঙ্গে ঈশ্বরের বিরোধ ঘটেছিল। সেই সময় ঈশ্বরের আদেশে এই সহস্র সিংহের কোনও একটা সিংহকে বন্ধনমুক্ত করা হয়। সেই সিংহ দক্ষের সেই প্রসিদ্ধ যজ্ঞ ধ্বংস করেছিল। ঐ ভবপুরবাসী পুরুষেরা সকলেই বৈশ্বানরমুখ বিশ্বরূপী, কপদী, নীলকণ্ঠ। শিবগ্রীব, ত্রিলোচন, জটামুকুটমালী পিনাকধারী মুক্তাহার মণ্ডিত, দেবগণাপেক্ষা সর্বজ্ঞ, সর্বদশী। এঁরা আত্মাকে বহুধা বিভক্ত করে অজর ও অমর ভাবে নানা সুদুর্লভ ভোগরাশি উপভোগ করে নানা ভাবে খেলা করছেন। তাদের গতি স্বেচ্ছামত। তারা স্বয়ংসিদ্ধ, মহাত্মাগণই এগারো কোটি রুদ্র। এইসব মহাত্মা রুদ্রদের নিয়ে ভগবান মহেশ্বর সেই পুরীতে বিহার করেন। তবে তারা এক এবং অভিন্ন বায়ু এইভাবেই বর্ণনা করেছিলেন। ঋষিরা তখন বায়ুকে বললেন–আপনার সমস্ত বর্ণনা শুনে আমরা তৃপ্ত হয়েছি। এবার আমাদের সেই মহাদেবের পারিপার্শ্বিক আদিত্যগণ, ক্রোধবিক্রম সিংহগণ, বৈশ্বানরগণ, ভূতগণ ও অনুগামী ব্যাঘ্রগণ-ভীষণ প্রলয়কালে কোন অবস্থায় অবস্থিত হয় তা, আমাদের কাছে। যথাযথ প্রকাশ করে বলুন। বায়ু বললেন–আমি সিংহ, ব্যাঘ্র ইত্যাদির কথা বলেছি, এবার অন্য যাঁরা সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের পরমতত্ত্ব এখন ব্যাখ্যা করছি।
ব্রহ্মানন্দন, সনক, সনন্দ, সনাতন, বেছু, কপিল, আসুর ও মহাযশামুনি পঞ্চশিখ, এছাড়া অন্যান্য আরও অনেকে সেই আদি কারণ অব্যক্ত ঈশ্বর সত্তা জেনে আগেই পরম গতি পেয়েছেন। তারপর বহুকাল অতীত হলে কল্পাবসানে মহাভূত সমূহের বিনাশ করে যখন প্রলয়কাল উপস্থিত হয়, তখন ঐ অনেক কোটি রুদ্র সত্যাবলম্বনে জ্ঞানময় তেজে আত্মভাবের উপলব্ধি করেন। এঁদের প্রতি মহেশ্বরী প্রসন্না হন। এঁরা পরমাণুস্বরূপ মহেশ্বরকে পেয়ে ভীষণ জন্ম-মৃত্যুর সংসার নদী উত্তীর্ণ হন। সেই যে সিংহ, আদিত্য, ভূত, ভব্য, অনুগামী বাঘেদের কথা বলেছি, ভগবান ভবদের সৃষ্টি প্রলয়ে বিষ্ণুর সাথে মিলিত ভাবে সৃষ্টি ও সংহার করেন। সংহার কালেই তার রুদ্রমূর্তি দেখা যায়। এই রুদ্রই সামময় ও যজুর্ময়। হে দ্বিজ! তিনি একমাত্র জগতের নাথ, অনাদি নিধন ভগবান। একথা শোনার পর সেই দ্যুতি সম্পন্ন ঋষিরা নিজ নিজ আশ্রমে স্বীয় আত্মায় মহেশ্বরকে ধ্যান করতে লাগলেন। তারা ভক্তিযোগে রুদ্রদেবের শরণাপন্ন হয়ে রুদ্রসালোক্য লাভ করলেন। অমদ্যপাদী, জিতেন্দ্রিয় শূদ্রও যদি ভবে ভক্তি যুক্ত হয়, তবে তারও প্রলয় পর্যন্ত পরমায়ু হয়। আর যদি কোনো মদ্যপ যদি ভক্ত হয়, তবে সে মদ্যপায়ী প্রমথদের সঙ্গে বিহার করে থাকে। এই মহাদেবই মর্তবাসীর দ্বারা পূজিত হয়ে বরদান করে থাকেন।
একশো একতম অধ্যায়
সূত বললেন–পরমপুরুষ স্বয়ম্ভুর প্রত্যাহার বর্ণনা করছি। কল্প শেষ হওয়ার সামান্য সময় অবশিষ্ট থাকতে থাকতেই ঈশ্বর সৃষ্টি প্রত্যাহার করতে আরম্ভ করেন। দ্রুম নামে অন্তিম মনুর অধিকালের শেষে কলিযুগের শেষভাগে জগতে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা উপস্থিত হয়। তখন ব্রহ্মার সৃষ্ট জগৎ ক্ষয় পেয়ে অদৃশ্য হতে থাকে। এভাবে জগতের সংহার আরম্ভ হয়। প্রথমতঃ জল সকল ভূমির সন্ধাত্মক গুণ গ্রাস করে ফেলে, তাতে ভূমি জলের মধ্যে লীন হয়ে যায়। তখন আর পৃথিবীর উপলব্ধি থাকে না। কেবলমাত্র জলেরই উপলব্ধি হয়। সর্বজগৎ পূর্ণ করে অনন্ত বিস্তৃত সেই জলরাশি মহাশব্দে মহাবেগে ইতস্ততঃ বিচরণ করতে থাকে। তারপর জলের রস তেজের মধ্যে মিশে যায়। সেই তেজরাশি বায়ুর মধ্যে মিশে গেলে সব কিছু আলোকহীন হয়ে পড়ে। তখন শুধুমাত্র বায়ুকেই উপলব্ধি করা যায়। আকাশের ওপরে-নিচে-পাশে সব জায়গায় কেবল বায়ুর সঞ্চারণই অনুভূত হয়।
এরপর আকাশ বায়ু গুণকে গ্রাস করে। তাতে বায়ু শান্ত হয়ে যায়। তখন শব্দযুক্ত আকাশ সমস্ত কিছু ঢেকে দেয়। পরে ভূতাদি তামস অহঙ্কারতত্ত্ব আকাশের শব্দগুণকে গ্রাস করে। তখন আকাশের উপলব্ধিও থাকে না। কেবল ভূতেন্দ্রিয়ময় অভিমাত্রিক ভূতাদি তামস অহঙ্কারই প্রকাশিত থাকে। এরপর তাকে গ্রাস করে বুদ্ধিরূপী মহৎ তত্ত্ব। এই মহৎ তত্ত্বাদিই হল আত্মা। যাকে বুদ্ধি, মন, লিঙ্গ, মহান ও অক্ষর প্রভৃতি শব্দে উল্লেখ করে থাকেন। নাম বা বুদ্ধির অভাব হেতু তখনকার সেই অবস্থা জ্ঞাণীগণেরও উপলব্ধির বিষয় হয় না। তবুও চিত্তবৃত্তির কারণেই উপলব্ধি করা যায়। নিজ মদমদাত্মক পরম কারণেই অব্যক্তকারে অবস্থান করেন। এইভাবে প্রত্যাহার সময়ে সাত রকম প্রাকৃত পদার্থের একে অপরের মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটে। সপ্তদ্বীপ, গিরি, সমুদ্র সম্বন্বিত সপ্ত লোেকাত্মক ব্রহ্মাণ্ড জলের মধ্যে বিলীন অবস্থায় থাকে। এইভাবে জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, ভূতাদি অহঙ্কারত্ব, অব্যক্ত প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। তারপর এই প্রাকৃত গুণগুলির সমান অবস্থা প্রাপ্ত হয়। অব্যক্ত প্রকৃতিকেই ক্ষেত্র বলা যায়। ব্রহ্মকেই ক্ষেত্রজ্ঞ শব্দে অভিহিত করা হয়। সকল সৃষ্টিতেই ক্ষেত্ৰজ্ঞদের আবির্ভাব ও তিরোভাব দেখা যায়। যারা আলাদা ভাবে ক্ষেত্রজ্ঞ তত্ত্ব জানেন, তাদের ব্রহ্মবিদ বলা যায়। ব্রহ্মই বিষয় এবং অব্যক্তই অবিষয়। প্রত্যেক শরীরে সুখ-দুঃখ ইত্যাদির আলাদাভাবে উপলব্ধি ঘটে। প্রকৃতিবশে যখন এই ভেদ প্রবৃত্তির সংযম ঘটে তখন কালাত্মক দ্বারা স্বয়ম্ভর স্থিতিবুদ্ধি বিনিবৃত হয়। তখন ব্রহ্মলোকবাসী সকলেই বৈরাগ্যযুক্ত হন। সুতরাং তাঁদের আত্ম অহঙ্কার বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাতে সেই ক্ষেত্রজ্ঞরা শুদ্ধ নিরঞ্জন রূপে প্রকৃতিতেই নির্বাণ প্রাপ্ত হন। তাঁদের আর জন্মের পুনরাবৃত্তি হয় না। ধর্ম, অধর্ম, তপ, জ্ঞান, শুভ, অশুভ, সত্য, মিথ্যা, ঊর্ধ্বভাব, অধোভাব, সুখ দুঃখ ইত্যাদি জ্ঞানীদের যা কিছু শুভাশুভ এবং পুণ্য-পাপ ইত্যাদি প্রকৃতিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। আবার সৃষ্টির উৎপত্তির দেহীদের দেহধারণের সাথে সাথে সংযুক্ত হয়।
গুণমাত্ৰাত্মক বৃত্তিগুলি রাজসী, তামসী ও সাত্ত্বিকী– এই তিনভাবে প্রবর্তিত হয়ে থাকে। ঊর্ধ্বভাগ দেবাত্মক সত্ত্ব গুণাত্মক, অধোভাগ জড়াত্মক তমঃ গুণাত্মক এবং এই দুইয়ের মধ্যবর্তী, ইহলোক প্রাপক রজোগুণাত্মক বলা যায়। ত্রিলোকের সর্বভূতের মধ্যে এই তিনটি গুণ পরিবর্তিত হতে থাকে। তাই জ্ঞানবান ব্যক্তির ক্ষেত্রে গুণগুলি বর্জনীয়। মানুষেরা পাপ গতি লাভ করে। প্রাণীগণ তমোগুণে অভিভূত হয়ে যথার্থ তত্ত্ব জানতে পারে না। সেই জন্যই তিনরকম কাজে আবদ্ধ থাকে। প্রথম প্রকৃত বন্ধন, দ্বিতীয় বৈকারিক বন্ধন, তৃতীয় দক্ষিণাত্মক বন্ধন–এই তিন বন্ধনে প্রাণীগণ আবদ্ধ হয়ে পড়ে। যারা রাগ-দ্বেষের অতীত, তারাই জ্ঞানী এবং তাঁদের সেই জ্ঞানই জ্ঞানপদবাচ্য। তমোগুণ হল অজ্ঞানতাজনক এবং রজোগুণ নানা কাজের উৎপাদক। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক– এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের কারণে দুঃখময় কাজগুলির উৎপত্তি হয়।
এবার আমি প্রাণীদের মোহ উৎপাদক রাগের কথা বলছি। এই রাগের প্রভাবেই প্রাণীরা বিষয়াসক্ত হয়ে পড়ে। কামনাজনিত দ্রব্যে বাধা পেলে দুঃখ জন্মায়। এই আধি ভৌতিক সংসারে এই অনুরাগের ফলেই জীবের উৎপত্তি ঘটে। অজ্ঞানতা থেকেই অনুরাগের উৎপত্তি। সুতরাং এই অজ্ঞানতাকেই ত্যাগ করা উচিত। এই অজ্ঞান পথ অস্থির ও তির্যক যোনিরও কারণ। আবার তির্যক যোনি থেকে অন্যান্য যন্ত্রণার কারণ ঘটে। জীব সেই অজ্ঞানতা যাতনাস্থান ও ষোলো রকম তির্যক যোনি পেয়ে নানা দুঃখবশতঃ যন্ত্রণাভোগ করে। চিত্ত সত্তমাত্রাত্বক, তত্ত্ব বিচার দিয়ে সত্ত্বের স্ফুরণ হয়। তার ফলে তত্ত্বজ্ঞান জন্মে। সত্ত্ব ও ক্ষেত্রজ্ঞের জ্ঞানই জ্ঞানপদবাচ্য। এই জ্ঞান থেকেই যোগোৎপত্তি ঘটে। ফলে চিত্তের সত্ত্ব তারতম্যের জন্য সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটে। মুক্ত হলে লিঙ্গ শরীরের বিনাশ ঘটে থাকে।
তত্ত্বদর্শীরা মোক্ষকে তিন প্রকারের বলে বর্ণনা করেন। জ্ঞান প্রভাবে বিষয় বিয়োগের জন্য একপ্রকার মোক্ষ হয়। তার ফলে রাগ ক্ষয় হেতু লিঙ্গাভাব, সেজন্য কেবল তত্ত্ব নিরঞ্জন তত্ত্ব লিঙ্গাভাব, সেজন্য শুদ্ধত্ব এবং তা থেকে নিষ্ক্রিয়তা জন্মে। এই মোক্ষ দ্বিতীয় প্রকার আর তৃষ্ণাক্ষয়ের জন্য যে মোক্ষ তাই তৃতীয় প্রকার বলে বিখ্যাত। এরপর দোষ দর্শন হেতু বৈরাগ্যের বিবরণ বলছি। দিব্য ও মানুষ পাঁচরকম বিষয়গুলিতে দোষ দেখে অনাসক্তি, অবিদ্বেষ অবলম্বন করা উচিত। দেহীদের বৈরাগ্য অবলম্বন করা উচিত। সংসার অনিত্য, অমঙ্গলদায়ক ও দুঃখময় তা বিবেচনা করে বিশুদ্ধ কাজ করা উচিত। এরূপ করলে সমস্ত প্রাণী তার বশীভূত হয়।
তৃষ্ণাক্ষয় তৃতীয় মোক্ষকারণ বলে বিখ্যাত। দোষ হেতু পাঁচ রকম শব্দাদি বিষয় দ্বেষাভাব, অনাসক্তি আর সেই বিষয়ে প্রীতি ও অপ্রীতি বর্জন এটি বৈরাগ্যের কারণ বলে বিবেচিত। তাঁরা যে বর্ণাচারণ করেন তাই দেবত্ব লাভের কারণ। ব্রহ্মা থেকে পিশাচ পর্যন্ত আট রকম দেব সৃষ্টি। অনিমাদি আট রকম ঐশ্বর্য, এই আট রকম সৃষ্টিভেদের হেতু। বর্ষাকালে আকাশ মণ্ডলে মেঘের মধ্যে ধোঁয়া চক্ষুতে দেখা গেলেও যেমন প্রত্যক্ষ হয় সেরকম জীবের দ্বারা প্রত্যক্ষ না হলেও সিদ্ধরা দিব্যচোখে দেখেন।
জীব, প্রাণ, লিঙ্গ, কারণ প্রভৃতি পর্যায়ে বাচক শব্দে সেই জীবেরই উল্লেখ হয়ে থাকে। সেই জীবই সমগ্র পরিব্যাপ্ত। জাগতিক পদার্থ সমূহ তত্ত্বজ্ঞান হয়ে দেহ পাতান্তে জীব যথেচ্ছ স্বাধীনভাবে বহির্গত হয়ে থাকে। অব্যক্ত জ্ঞানীর জন্মকারণে সকলের নাশহেতু প্রাণ ইত্যাদি গুণ পরিণামগুলি বিযুক্ত হয়। তখন শরীর ও মনের কর্মবীজ থাকে না বলে জীবের শরীয়ান্তর ঘটে না। সে চতুর্দশ তত্ত্বজ্ঞান প্রভাবে শুদ্ধ হয়ে প্রকৃতিতে প্রতিনিবৃত্ত হয়।
ক্ষেত্রজ্ঞ নামরূপহীন, কিন্তু তাতে নাম-রূপের কল্পনা করা হয় মাত্র। যিনি ক্ষেত্রকে জানেন তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ। ক্ষেত্রজ্ঞান জন্মালেই জীবের মঙ্গল লাভ হয়। এজন্য ক্ষেত্রজ্ঞকে শুভসংজ্ঞায় অভিহিত করা যায়। জনগণ এই জন্যই সবসময় ক্ষেত্রজ্ঞকে স্মরণ করেন, ক্ষেত্ৰজ্ঞানশালীর ক্ষেত্রের ভাবনা থাকে না। ক্ষেত্র প্রত্যয় এবং ক্ষেত্রজ্ঞ প্রত্যয়ী।
সংসার রূপ নরক থেকে পুরুষকে পরিত্রাণ করেন বলেও ক্ষেত্রসংজ্ঞা নির্বাচিত হয়েছে। সুখ, দুঃখ ও মোহ- এই তিনভাব ভোজ্য পদবাচ্য। পুরে শয়ন করেন বলে পুরুষ সংজ্ঞা ও পুরের জ্ঞান আছে বলেও পুরুষ নাম নির্বাচিত। পুরুষ তত্ত্বজ্ঞরা বলেছেন–পুরুষ শুদ্ধ, নিরঞ্জন জ্ঞানাজ্ঞান বর্জিত অস্তি নাস্তি প্রত্যয় রহিত। শুদ্ধত্বের জন্য তিনি অনির্দেশ্য এবং সবসময় আনন্দ স্বরূপ বলে সমদর্শন। তিনি আত্মানন্দে মগ্ন। এই জ্ঞানময় পরম পুরুষের দর্শন লাভ করলে মানবের উদ্ধার লাভ হয়। মনের সাহায্যে তাকে পেলে আর বিষয় আসক্ত হতে হয় না। এই ব্যক্ত-অব্যক্ত সৃষ্টি, সংহার সেই পরম পুরুষ থেকেই হয়ে থাকে। পরম পুরুষ সমগ্র জগৎ সৃষ্টি করেন আর লয়কালে গ্রাস করে থাকেন। প্রকৃতির বৈচিত্র্য বশেই সৃষ্টি লয় সাধিত হয়। এই সৃষ্টি ও সংহারে প্রকৃতি ও পুরুষ দুজনই কারণ। সৃষ্টির আদিকাল থেকে অন্তকাল পর্যন্ত সেই পরম পুরুষকে প্রকৃতি দেবী আত্মাতে নিরুদ্ধ করে থাকেন। সৃষ্টির এই তৃতীয় প্রকার হেতু বলা হল।
ঋষিরা বললেন–হে সূত! পুনঃ সৃষ্টি কিভাবে প্রবর্তিত হয়? নতুন সৃষ্টি কি করে সম্ভব হয়, তা আমাদের বলুন। সূত বললেন–এই সৃষ্টির তত্ত্ব সত্যই অবর্ণনীয়। প্রত্যক্ষ ও অনুমান দিয়ে যুক্তি
অনুসারে এ তত্ত্বের আলোচনা করতে হয়। প্রাণীদের ধর্মাধর্ম সমস্তই এই অব্যক্ত প্রকৃতিতে বিলীন হয়। সত্ত্ব মাত্রাত্বক ধর্ম তখন প্রকৃতির পরিণাম কালে বুদ্ধিপূর্বক সর্বকার্যে প্রবর্তিত হয়। ক্ষেত্রজ্ঞ কিন্তু অবুদ্ধি পূর্বক প্রকৃতির সেই গুণগুলি উপভোগ করে থাকেন। ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের চব্বিশ প্রকার বিকার ঘটিয়ে মহদাদি সৃষ্টির প্রবর্তন করে। ক্ষেত্রজ্ঞই তখন ব্রহ্মাণ্ডের ঈশ্বর বলে প্রকটিত হয়। প্রকৃতির অনুগ্রহে ইনি সর্বভূতপতি, মুক্তিদাতা, মহাপদবাচ্য, আদিদেব ব্রহ্মা নামে সিদ্ধ। ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ অনাদি এবং সূক্ষ্ম, সকলের আদি। অনাদিকাল পর্যন্ত পরস্পর সংযুক্ত।
সংক্ষেপে ব্রহ্মার উৎপত্তি বর্ণনা করছি। অব্যক্ত কারণ স্বরূপ প্রকৃতি পুরুষ থেকে এক মহৈশ্বর্যশালী পুত্র জন্মে। ইনিই ব্রহ্মা। তিনি মহাপদবাচ্য। তার থেকেই এক সাথে ভূতেন্দ্রিয়গুলির জন্ম হয়। এভাবে সৃষ্টির বিস্তার ঘটে থাকে। এই সৃষ্টি খুবই বিস্তৃত। প্রকৃতি এবং পুরুষ রচিত সৃষ্টির বৃত্তান্ত শুনে মেধাবী মানব কখনো মোহগ্রস্ত হন না। যে বিদ্বান ব্রাহ্মণ এই প্রাচীন ইতিহাস শোনেন শোনান, তিনি মহেন্দ্রলোকে বাস করেন। হে ব্রহ্মবাদী মুনিরা, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদানুমোদিত এই মহাপুরাণ, ধন, পুণ্য, যশঃ ও আয়ু প্ৰদায়ক। যে জন প্রভূত ধন সম্পন্ন মহাতেজা এই কীর্তি কাহিনী বিস্তার করে, সে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে মহৎপুণ্য লাভ করে। যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধের সময় এই পুরাণ অন্ততঃ একপাদও ব্রাহ্মণদের শোনায় তার কান সিদ্ধ হয়। আগে ব্রহ্ম, বায়ুকে এই সর্বপাপহর, পুণ্যকর, সুপবিত্র পুরাণ শাস্ত্র দান করেন, বায়ু থেকে উশনা, তার থেকে বৃহস্পতি তা লাভ করেন। বৃহস্পতি থেকে সবিতা, তারপর মৃত্যু, ইন্দ্র ইত্যাদি থেকে শেষে প্রভু দ্বৈপায়ণ এই পুরাণ কথা প্রাপ্ত হল।
একশো দুইতম অধ্যায়
ঋষিগণ বললেন–হে মহাভাগ সূত! আপনি ব্রহ্মদেবের প্রসাদে সমস্ত শাস্ত্র মর্ম উপসংহার বিধির সাথে সেই আঠারো পুরাণ ইতিহাস সম্পূর্ণ ভাবে কীর্তন করেছেন। তার মধ্যে মৎস্য পুরাণে চোদ্দ হাজার, ভবিষ্য পুরাণে পাঁচশো চোদ্দ হাজার, মার্কণ্ডেয় পুরাণে নয় হাজার, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আঠারো হাজার, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে একশো বারো হাজার, ভাগবত পুরাণে আঠারো হাজার, ব্রহ্ম পুরাণে দশ হাজার, বামন পুরাণে অযুত সংখ্যক, আদি পুরাণে দশ হাজার, বায়ু পুরাণে তেইশ হাজার, নারদীয় পুরাণে তেইশ হাজার, গরুড় পুরাণে একোনবিংশতি হাজার, পদ্ম পুরাণে পঞ্চান্ন হাজার, কূর্ম পুরাণে সতেরো হাজার, বরাহ পুরাণে চব্বিশ হাজার, স্কন্দ পুরাণে একাশী হাজার, অগ্নি পুরাণে আঠারো হাজার, শিব পুরাণে এগারো হাজার সংখ্যক শ্লোক রয়েছে।
এই আঠারো পুরাণকেই মহাপুরাণ বলে। এছাড়া আরও কিছু জানার আছে। সূত বললেন–একদা পরাশর নন্দন ব্যাসদেব সর্ববেদার্থ ঘটিত পুরাণের কথা বলতে বলতে মনে মনে এরকম চিন্তা করেছিলেন যে–আমি বেদবিরোধে বর্ণাশ্রমীদের ধর্ম,বহুবিধ যুক্তিমার্গ ও সূত্র নির্ণয় দিয়ে জীবাত্মা ও ব্রহ্মের ভেদনিরস্ত করে শ্রুতিসম্মত বিচারে অক্ষয়, পরমাত্মা, পরমপদ ব্রহ্মের স্বরূপ নিরূপণ করছি। যাঁকে লাভ করার জন্য মহপ্রাজ্ঞ মুনিগণ ব্রহ্মচর্য, বানপ্রস্থাদি ধর্ম, যতিধর্ম, ধ্যান, সমাধি, যম নিয়ম প্রভৃতির আচরণ করে থাকেন। যাঁকে প্রাপ্তির জন্য মনীষীরা সব বাধা পরিত্যাগ করে মাত্র বেদাত্মাকে শিরোধার্য করে নিষ্কাম ভাবে ব্রহ্মার্পণ কর্মে বুদ্ধি নিয়োগ করে থাকেন। বিচার করে দেখা গেছে যেমন ফেণা, ঊর্মি ও বুলুদ থেকে জল আলাদা নয়, তেমনি এই বিশ্ব থেকেও ব্রহ্ম আলাদা নন, এই বিশ্বও ব্রহ্মের বিকারাভাস মাত্র। ব্রহ্ম থেকেই ব্রহ্মাণ্ড উৎপন্ন হয় কিন্তু ব্রহ্মের কোনও উৎপত্তি নেই। ব্রহ্মাকে জানতে না পারলে এই জগৎ জগঞ্জপেই ভাসমান হয়। কিন্তু তাকে জানতে পারলে তখন আর এই জগৎ জগৎ, বলে বোধ হয় না। তিনি চক্ষুর চক্ষু, ত্বকের ত্বক, রসনার রসনা, প্রাণের প্রাণ।
মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রাণ ও ক্রিয়াশক্তি দিয়ে তার স্বরূপ জানতে পারে না। তিনিই পরাকাষ্ঠা ও পরাগতি। এই পরম পুরুষ পরমানন্দ স্বরূপ আনন্দ বিগ্রহ। এই রামবিলাস কৃষ্ণাখ্যরসিক গোপললনাদের মধ্যে বিরাজিত। এঁরই মাথায় রত্ন নির্মিত শিখিপুচ্ছচূড়া লোভমান। এঁরই কানে বিদ্যুৎ প্রভার মতো রমণীয় কুণ্ডলদ্বয় শোভা পায়। ইনিই কুঞ্জে কুঞ্জে লীলা করেছেন। এই পীতাম্বরধারী সর্বাঙ্গে চন্দন মেখে মোহনবাঁশী বাজিয়ে গোপ-বালাদের মন জয় করেছিলেন। এই ব্রহ্মস্বরূপ, নির্গুণ শ্রীকৃষ্ণই পৃথিবীতে লীলা করে থাকেন।
বেদ হল সাক্ষাৎ নারায়ণ স্বরূপ। বেদব্যাসও তত্ত্ব নির্ণয়ে সক্ষম হলেন না, তখন ভাবলেন আমি কার কাছে যাই? কি করি? জগতে কি এমন কেউ সর্বদর্শন পারদর্শী পুরুষ নেই যাঁর কাছ থেকে এইসকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়? এরকম চিন্তা করে বেদব্যাস তপস্যা শুরু করলেন, ঐ অবস্থায় তিনশো বছর কেটে গেলে চার বেদ তার সামনে আবির্ভূত হল। বেদ সকলের মূর্তি খুব মনোহর, চোখ পদ্ম পাপড়ির মতো, মাথায় জটার মুকুট, হাতে কুশ গুচ্ছ, স্কন্ধদেশে মৃগচর্ম, ব্রাহ্ম ধর্ম তাদের ব্রহ্মরন্ধ্রে, শৈব ধর্ম সিঁথিতে, শাক্ত ধর্ম জিহ্বায়, বৈষ্ণব ধর্ম হৃদয়ে, সৌর ধর্ম নেত্রে এবং বৌদ্ধ ধর্ম তাদের ছায়ায় অবস্থান করছে।
তখন মুনি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন প্রদীপ্ত, আদিত্য, প্রজ্বলিত হুতাসন, ব্রহ্মতেজোময় বেদ চতুষ্টয় দেখে তাদের যথাযোগ্য ভাবে বন্দনা করলেন। বললেন, আজ আমি কৃতার্থ হলাম। আজ আমার জন্ম, মন, পরমায়ু সফল হল। যেহেতু আপনারা ভূত, ভবিষ্যত ও বর্তমান সবকিছুই জানেন, আপনাদের কাছে কিছুটা জানতে চাইছি। বাসনা বিজড়িতচিত্ত কর্মীদের সৎকর্মের ফল স্বর্গ আর ঈশ্বর অর্পিত চিত্ত ব্যক্তিদের কর্মের ফল চিত্ত শুদ্ধি। চিত্ত শুদ্ধি থেকে জ্ঞান ও জ্ঞান থেকে মোক্ষ লাভ হয়। মোক্ষ মানে ব্রহ্মের সাথে একতা প্রাপ্তি। ব্রহ্ম-নিঃসঙ্গ, জ্ঞানরূপ, নিরীহ, অচল, শুদ্ধ, আগুন ও ব্যাপক নির্বিকার ব্ৰহ্ম বিনষ্ট হন না। এই ব্রহ্ম থেকেই জগৎ প্রকাশিত, পরব্রহ্মই অদ্বিতীয় রূপে বিরাজমান।
এই যে আপনারা ঈশ্বরতত্ত্ব নিরূপণ করেছেন এতে আমার এতটুকু সংশয় নেই। হে মহাভাগগণ! এর থেকেও গূঢ় রহস্য যদি কিছু থাকে, তা আমাকে বলুন। তখন সেই বেদগণ ব্যাসদেবের কথা শুনে বললেন–হে মহাপ্রাজ্ঞ! আপনাকে ধন্যবাদ, আপনিই সাক্ষাৎ বিষ্ণু এবং পরীদের আত্মা। আপনি পুরাণ, ইতিহাস ও সূত্রগুলিতে যে রহস্য বারবার প্রকাশ করেছেন তা আমাদের সম্মত। অক্ষয় পরমব্রহ্মই সর্ব কারণের কারণ। ফুলের রূপ রস-গন্ধের মতো ঐ আত্মস্বরূপের আত্মস্বরূপ আছে। এটি অতীব পরম রহস্য বলে জানবেন।
.
একশো তিনতম অধ্যায়
সূত বললেন–এবার গয়া মাহাত্মের কথা বলেছি। দেবর্ষি নারদ সনৎকুমারকে প্রশ্ন করলেন–হে সনৎকুমার, শ্রেষ্ঠ তীর্থগুলির কথা আমাদের বলুন। উত্তরে সনকুমার বললেন–পবিত্র তীর্থ গয়াতীর্থের বিষয় শুনুন। এই তীর্থ পৃথিবীর যাবতীয় তীর্থের শ্রেষ্ঠ তীর্থ। এক সময়ে যজ্ঞের জন্য ব্রহ্মা কর্তৃক প্রার্থিত হয়ে গয়াসুর এখানে তপস্যা করেন। ব্রহ্মা এই গয়াসুরের মাথায় একটি পাথর দিয়ে ওখানেই যজ্ঞ করেন। ব্রাহ্মণদেরকে ব্রহ্ম যজ্ঞ শেষ করে গৃহাদি দান করেছিলেন। শ্বেতবরাহ কল্প গয় এখানে একটি যজ্ঞ করেন। এই গয় থেকেই গয়াক্ষেত্র বিখ্যাত। পুত্র গয়াতে গেলে পিতাদের আত্মার আনন্দ ও শান্তি হয়। পিতাগণ বহু পুত্রের কামনা করেন, কারণ কোনো পুত্র গয়াতে যাবে, কোনও পুত্র অশ্বমেধ দিয়ে তাদের তৃপ্তিসাধন করবেন, কেউ বা নীলবৃষ উৎসর্গ করবেন। যে পুত্র তিন পক্ষ গয়াতে বাস করে, তার সাতকুল পর্যন্ত পবিত্র হয়ে থাকে। যে কেউ যখন তখন অন্যের নামে গয়াক্ষেত্রে পিণ্ড দান করে, সে ব্রহ্মলোকে যায়। ব্রহ্মজ্ঞান, গয়াশ্রাদ্ধ, গোগৃহে মরণ, কুরুক্ষেত্রে বাস-মানুষের এই চার প্রকার মুক্তির কারণ। গয়াতে গিয়ে একবার পিণ্ড দিলেই তার আর কিছু দুর্লভ থাকে না। গয়াতে ব্রাহ্মণদের তুষ্ট করতে হয়।
তারা তুষ্ট হলেই দেবতারা তৃপ্ত হন। মুণ্ডন ও উপবাস সব তীর্থে করতে হয়। ভিক্ষু গয়াতে গিয়ে দণ্ড প্রদর্শন করবেন, পিণ্ডদান তার কর্তব্য নয়। বিষ্ণুপদে দণ্ড রাখলেই, পিতৃগণের সাথে তিনি মুক্ত হবেন। গয়ায় গিয়ে প্রতি পদক্ষেপেই অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়। পায়েস, চরু, পিঠা, ফল মূলাদি, ঘি, গুড় বা শুধু দই মধু দিয়ে শ্রাদ্ধে পিণ্ড দান করতে হয়। ফলাকাঙ্খী তীর্থ শ্রাদ্ধকারী ব্যক্তিগণ শ্রাদ্ধদানের সময় কাম, ক্রোধ, লোভ পরিত্যাগ করবেন। গয়াক্ষেত্রের বৈতরণী নদীতে স্নান ও গোদান করতে হয়। এভাবে অক্ষয়বটে গিয়ে ব্রহ্মকল্পিত ব্রাহ্মণ তুষ্ট হলেই দেবতারা পিতৃগণসহ তুষ্ট হন। মীন (চৈত্র), ধনু (পৌষ), মেষ (বৈশাখ), কন্যা (আশ্বিন) এবং বৃষ (জ্যৈষ্ঠ) রাশিতে সূর্য অবস্থান করেন, এই সবকালই গয়া কাজে দুর্লভ। মাঘ মাসের সূর্যগ্রহণে গয়াশ্রাদ্ধ দুর্লভ।
.
একশো চারতম অধ্যায়
নারদ জিজ্ঞাসা করলেন–গয়াসুর কিরূপে জন্মগ্রহণ করলেন? কেনই বা তপস্যা করলেন বা কি করে তার দেহ পবিত্র হল? সনৎকুমার উত্তর দিলেন–লোকপিতামহ ব্রহ্মা বিষ্ণুর নাভি থেকে সমুদ্ভূত হন। তিনি পূর্বকালে অসুর ভাবে অসুর ও দেবভাবে দেবতাদেরকে সৃষ্টি করেন। দানবদের মধ্যে গয়াসুর–অধিক বলসম্পন্ন ও বৈষ্ণব। তার উচ্চতা একশো-পঁচিশ যোজন ও স্থূলতা ষাট যোজন। গয়াসুর কোলাহল পাহাড়ে বহু হাজার বছর নিঃশ্বাস রোধ করে তপস্যা করেন। দেবতারা তখন পিতামহ ব্রহ্মাকে বললেন, গয়াসুর থেকে আমাদের রক্ষা করুন। ব্রহ্মা দেবতাদের বললেন–চলুন আমরা দেবাদিদেব শঙ্করের কাছে যাই। কৈলাসে গিয়ে কৈলাসপতিকে বললেন–এই মহাসুর থেকে আমাদের রক্ষা করুন। এরপর তারা বিষ্ণুর কাছে গেলেন। বিষ্ণু বললেন–আপনারা সকলে অসুরের কাছে যান আমিও যাচ্ছি।
বিষ্ণু বললেন–হে গয়াসুর! তোমার তপস্যায় আমি তুষ্ট হয়েছি। এবার তুমি বর চাও। গয়াসুর বললেন–হে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরাদি দেবগণ। আমি যেন দেব, ব্রাহ্মণ, নিখিলযজ্ঞ শিলা, দেব, ঋষি, অব্যয়, সর্বপ্রকার যোগী, ধার্মিক অপেক্ষাও পবিত্র হই।
দেবগণ তখন ‘পবিত্র হও’ এই বর গয়াসুরকে দিলেন। ব্রহ্মাদি দেবগণ বিষ্ণুর কাছে গিয়ে বললেন–আপনি গয়াসুরকে বরদান করলেন, তার দর্শন মাত্রই স্বর্গাদি তিন লোক শূন্য হয়েছে। বিষ্ণু এই কথা শুনে ব্রহ্মাকে বললেন–আপনি গয়াসুরের কাছে গিয়ে যজ্ঞের জন্য তার দেহ প্রার্থনা করুন। ব্রহ্মাকে দেখে গয়াসুর কৃতজ্ঞচিত্তে বললেন–আমি আপনাদের জন্য কি করব বলুন। ব্রহ্মা বললেন–হে অসুর! বিষ্ণুর বরে তোমার দেহ পবিত্র। তাই যজ্ঞের জন্য তোমার পবিত্র দেহ আমায় দান করো। গয়াসুর বলল–সর্বভূতের উপকারে আমার এই দেহে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হোক।
লোক পিতামহ ব্রহ্মা অমৃত, শৌনিক, শান্ত স্বভাব, গোকর্ণ, আত্রেয়, গোভিল, পরস্পর প্রভৃতি মানস প্রজা সৃষ্টি করে গয়াসুরের শরীরে যজ্ঞ করলেন। ধর্মরাজকে বললেন–তোমার গৃহের শিলা গয়াসুরের মাথায় রাখ, যাতে গয়াসুর অবিচল থাকে। কিন্তু অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও গয়াসুর নিশ্চল হল না দেখে ক্ষীরোদ সাগর থেকে উত্থিত হয়ে আদি গদাধর বিষ্ণু ঐ শিলার ওপর অবস্থান করলেন। এখানে তার নাম হল জনার্দন ও পুণ্ডরীকাক্ষ। এরূপ ব্রহ্মাণ্ড, পিতামহ, প্রপিতামহ, ফলস্বীশ, কেদার ও কনকেশ্বর পাঁচ নামে বিভক্ত হয়েছিলেন। তারপর গজরূপী বিনায়ক, সূর্য, সীতা নামে লক্ষ্মী, গৌরী গায়ত্রী, অষ্টবসু, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, বিশ্বনায়ক পবন এবং উরগ, যক্ষ, গন্ধর্বগণ, দেবগণ ঐ শিলায় অবস্থান করলেন। শ্রীহরি গদা নিয়ে অসুরকে স্থির করলেন। এজন্য এখানে তার নাম হল আদি গদাধর। গয়াসুর বললেন–হে দেবগণ! আপনারা কেন আমাকে প্রতারিত করলেন? বিষ্ণুর আদেশে কি আমি নিশ্চল থাকতাম না?
দেবগণ নিজেদের পা দিয়ে, বিষ্ণু গদা দিয়ে আমাকে অত্যন্ত কষ্ট দিয়েছেন। আমি ব্যথিত হয়েও আপনাদের অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। নিবেদন করছি। আমার নামে এই ক্ষেত্র প্রসিদ্ধ হোক। পাঁচ ক্রোশ গয়াক্ষেত্র ও ক্রোশমাত্র গয়াশির-এর মধ্যে সমস্ত তীর্থ বিদ্যমান থেকে মানবদের মঙ্গল বিধান করুক। আপনারা ব্যক্ত অব্যক্তরূপে সবসময় এই ক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত হোন, গদাধর স্বয়ং নিখিল লোকের পাপ নাশ করুন। এই তীর্থ সেবীদের ব্রহ্ম ইত্যাদির পাপ বিনষ্ট হোক। নৈমিষ, পুষ্কর, গঙ্গা, প্রয়াগ ও বারাণসী এই সব ও অন্যান্য তীর্থ এবং স্বর্গ ও ভূতল, অন্তরীক্ষ থেকে দেবগণ সবসময় এখানে এসে মানবদের হিতসাধন করুন। নারায়ণ প্রভৃতি দেবতারা বললেন, তোমার প্রার্থনা পূর্ণ হবে। তখন গয়াসুর আহ্লাদিত হয়ে স্থির হলেন।
তারপর দেবতারা সেখানে প্রতিষ্ঠিত হলে ব্রহ্মা তার যজ্ঞে ব্রাহ্মণদের জন্য নানা উপকরণসহ গৃহ নির্মাণ করে ছিলেন, এবং তাদেরকে পঞ্চক্রোশী গয়া, যেখানে পাঁচটি গ্রাম, কামধেনু, কল্পবৃক্ষ, পারিজাত প্রভৃতি গাছ, ক্ষীরবহা মহানদী, ঘৃতকুল্যা, মধুশ্রাবী, অন্নাদি, ফলমূলসহ নানা ভক্ষ্য, ভোজ্য দান করলেন এবং ব্রাহ্মণদের বললেন–আপনারা অন্য কারো কাছে কিছু চাইবেন না। কিন্তু লোভবশত দ্বিজরা ধৰ্মারণ্যে ধর্মের যজ্ঞে ধনাদি গ্রহণ করেন। ব্রহ্মা রেগে গিয়ে তাদের অভিশাপ দিয়ে ছিলেন–তোমাদের প্রচুর থাকা সত্ত্বেও তোমরা লোভের বশবর্তী হয়েছে, তাই তোমরা অধিক ঋণযুক্ত হবে। রত্নময় পর্বত সকল প্রস্তরময় হবে, নদীগুলি ক্ষীরব থাকবে না, গৃহগুলি মৃন্ময় হবে। পরে অভিশপ্ত ব্রাহ্মণদের প্রতি দয়া করে ব্রহ্মা বললেন–যতদিন পৃথিবীতে চাঁদ-সূর্য থাকবে, ততদিন তীর্থক্ষেত্র থেকে জীবিকা অর্জন করতে পারবেন। যাঁরা গয়াক্ষেত্রে শ্রাদ্ধ করবেন, অবশ্যই তারাই আপনাদের পূজা করবেন।
.
একশো পাঁচতম অধ্যায়
নারদ জানতে চাইলেন– গয়াসুর কিভাবে শিলা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং শিলার রূপ ও মাহাত্ম্য কি? নারদের এই কৌতূহলের উত্তরে সনৎ কুমার বললেন–পূর্ব কালে নিখিল বিজ্ঞান পারদর্শী ধর্ম নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। ধর্মের ঔরসে বিশ্বরূপার গর্ভে ধর্মব্রতা নামে এক রূপ যৌবনবতী কন্যা জন্মালেন। ধর্ম কন্যাকে উপযুক্ত স্বামীর জন্য অযুত যুগ তপস্যা করতে বললেন। ব্রহ্মার মানস পুত্র মরীচি সেই কন্যাটিকে বললেন– তুমিই আমার একমাত্র অনুরূপা পত্নী, তোমার আমি ‘অনুরূপ’ স্বামী। তুমি আমায় ভজনা কর। হে ধর্মব্রতা, তুমিই আমার ধর্মপত্নী হও। ধর্মব্রতা বললেন–আপনি আমার পিতার কাছে প্রার্থনা করুন। একথা শুনে মুনি ধর্মের কাছে ধর্মব্রতাকে প্রার্থনা করলে ধর্ম কন্যাকে মরীচির হাতে অর্পণ করলেন।
ধর্মব্রতার গর্ভে একশো পুত্র জন্মাল। একদিন মরীচি বন থেকে ফুল তুলে এনে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরলেন, তারপর ভোজনের শেষে বিশ্রামরত হলে তার পত্নী পদসেবা করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে মরীচি ঘুমিয়ে পড়লে ব্রহ্মা সেই আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। ধর্মব্রতা মনে মনে চিন্তা করলেন, ইনি আমার শ্বশুর, এখন কিভাবে তার পূজা করা যায়। তিনি পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে শ্বশুর ব্রহ্মার পূজা করলেন, ব্রহ্মাও ভোজন অন্তে উত্তম শয্যায় শুয়ে বিশ্রাম করতে লাগলেন। সেই সময় মরীচি ঘুম ভেঙ্গে রেগে গিয়ে ধর্মব্রতাকে অভিশাপ দিলেন, তুমি আমার আদেশ অমান্য করে অন্যত্র গিয়েছ, এজন্য আমার অভিশাপে তুমি শিলা হও। পত্নী ধর্মব্রতা রুষ্ট হয়ে বললেন–পিতা ব্রহ্মা উপস্থিত হয়েছেন বলেই আমি আপনার শয্যা ত্যাগ করে উঠে এসেছি। আমি ধর্ম বুদ্ধিতেই এই কাজ করেছি। আমি নির্দোষ। আপনি যখন এই শাপ দিলেন তখন আমিও আপনাকে শাপ দিচ্ছি আপনিও মহাদেব দ্বারা অভিশপ্ত হবেন। ধর্মব্রতা তার স্বামীকে ব্যাকুল দেখে নিজেও ব্যাকুল হয়ে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে প্রণাম করলেন। তারপর কাঠ জ্বালিয়ে অগ্নির ওপর বসে দুশ্চর তপস্যা করতে লাগলেন।
অভিশপ্ত মরীচিও এমন তপস্যা শুরু করলে ইন্দ্রাদি দেবগণ ব্যথিত হয়ে হরির শরণ নিলেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, দেবাদিগণ আগুনের মধ্যে অবস্থানকারী ধর্মব্রতাকে বললেন–একমাত্র তুমিই এমন কঠিন তপস্যা করবার সামর্থ্য দেখিয়েছ। তুমি বর প্রার্থনা কর। ধর্মব্রতা বললেন–স্বামী শাপ হরণ করবার জন্যই এই ভয়ঙ্কর দুষ্কর কাজ করছি। তাই মরীচি যে শাপ দিয়েছে তা অপনোদিত হোক। দেবগণ বললেন–মরীচির শাপ অন্যথা হওয়ার নয়। দেব দ্বিজ কেউই অন্যথা করতে পারে না। ধর্মব্রতা বললেন–হে দেবগণ! যদি আমাকে স্বামীর শাপ থেকে মুক্ত করতে না পারেন, তবে আপনারা আমায় বর দিন, যাতে আমি শিলা হয়েও ব্রহ্মাণ্ড মধ্যে নদ, নদী, সরোবর, তীর্থ, দেব, ঋষি, মুনি ও প্রধান প্রধান দেবগণ থেকেও অতি পবিত্র ও শুভ হই এবং ত্রিলোকের মধ্যে যে সব ব্যক্ত অব্যক্ত লিঙ্গ আছে সেই সমস্ত যেন তীর্থ রূপে সর্বদা আমার দেহে প্রতিষ্ঠিত থাকে। গদাধর সকল তীর্থের শ্রেষ্ঠ একটি দৃশ্যতীর্থ হোক। এখানে শ্রাদ্ধাদি দিয়ে পিতৃগণের মুক্তি হোক।
এখানে সব প্রাণী শরীর পরিত্যাগ করে বিষ্ণুর স্বরূপ প্রাপ্ত হোক। হরি অর্চিত হলে সমস্ত যজ্ঞ যেমন সম্পূর্ণ হয় তেমনি এই তীর্থে স্নান, শ্রাদ্ধ, তর্পণ অক্ষয় ফলজনক হোক। আমার দেহে থেকে যিনি জপ করবেন, তিনি অচিরেই সিদ্ধিলাভ করবেন। এখানে শ্রাদ্ধাদি করে মানুষ পিতৃগণের উদ্ধার করে নিঃসংশয়ে বিষ্ণু লোকে যাবেন। দেবগণ আমার শরীর ছেড়ে চলে যাবেন না। যতকাল ব্রহ্মা থাকবে ততকাল এই শিলাও বর্তমান থাকুক। পতিব্রতা ধর্মব্রতার কথা শুনে দেবতারা বললেন–তুমি যা প্রার্থনা করলে তাই হবে। তুমি যে কালে গয়াসুরের মস্তকে শিলারূপে নিশ্চল হয়ে থাকবে সে সময় আমরাও তোমার উপরে নিজ নিজ পা রেখে নিশ্চল হয়ে থাকব। শিলা রূপিণী ধর্মব্রতাকে এভাবে বর দান করে দেবগণ অন্তর্ধান করলেন।
.
একশো ছয়তম অধ্যায়
সনৎকুমার বললেন–এবার সেই মুক্তিদায়িনী শিলার মহিমার কথা বলছি। এটি পৃথিবীর মধ্যে বিচিত্র শিলাতীর্থ। ঐ শিলার সংস্পর্শে লোক সকল হরিলোক প্রাপ্ত হয়। এভাবে তিনলোক শূন্য হলে যমপুরীও শূন্য হয়ে ওঠে। দেবগণসহ যম ব্রহ্মার কাছে গিয়ে বললেন–আপনার প্রদত্ত অধিকার এই যমদণ্ড গ্রহণ করুন। ব্রহ্ম উত্তরে বললেন–এই শিলা নিয়ে গিয়ে নিজের গৃহে স্থাপন কর। ব্রহ্মার আদেশে যম সেই শিলা নিজ গৃহে নিয়ে এলেন। আবার নিজ অধিকারে পাপীদের শাসন করতে লাগলেন। দেবরূপিণী এই শিলা এইভাবে জগতে খ্যাত হয়। এই দুই পবিত্র বস্তুর যোগেই ব্রহ্মা অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন।
এই যজ্ঞভাগী হতে বিষ্ণু প্রভৃতি দেবগণকে আসতে দেখে শিলা তাদেরকে বললেন–পিতৃগণের মুক্তির জন্য আপনারা এ শিলায় অবস্থান করবেন। তখন কেউ পা দিয়ে, কেউ মূর্তি দ্বারা আবার অনেকে মূর্ত ও অমূর্ত ভাবে শিলায় অধিষ্ঠিত হলেন। মহানদী ও প্রভাবেশ সধাম স্থানে স্নান করে ঐ শিলায় পিণ্ডদান করলে মানবের প্রেতত্ব শেষ হয়। মহানদীতে রাম ও সীতা স্নান করেছিলেন বলে এটি রামতীর্থ নামে বিখ্যাত। এখানে মাতঙ্গ মুনির আশ্রম দেখা যায়। শিলার ডান হাতে কুণ্ড পর্বত প্রতিষ্ঠিত। এই পর্বতে ঈশান, বর্ঘ, বহ্নি, বরুণদ্বয় ও চার রুদ্র–এই সব মহেশ্বর পিতৃগণের মোক্ষদাতা। ভরতাশ্রমে শ্রাদ্ধাদি করলে অনন্ত ফল লাভ হয়। এখানে চতুর্যগ স্বরূপ সূর্যের চারটে মূর্তি আছে। মূর্তি দর্শন ও স্পর্শ করলে পিতৃগণ উদ্ধার পায়।
শিলার বামপাদেও গিরি আছে, যেখানে পিণ্ডদান করলে পিতৃগণ ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়। দেবগণ এখানে নিত্যই রয়েছেন। এইসব তীর্থ ও আশ্রমপদ মানবদের সমস্ত অশুভ কাজ বিনাশ করে থাকে। এই পুণ্য নৈমিষ্যারণ্য ব্যাস, ব্রহ্মা, শিব, হরি ইত্যাদি দেবগণ দ্বারা সেবিত। শিলার বাঁ হাতের পর্বতটি মহাত্মা অগস্ত্য এনেছিলেন। ব্রহ্মা ও শিব এখানে উগ্র তপস্যা করেন। এই পর্বর্তকে স্বর্গ বলা যায়। গন্ধর্বরা এখানে নৃত্য গীত করে থাকেন। সতী, পার্বতী এবং মহাদেব এখানে রয়েছেন।
শিলার দক্ষিণ হাতে ধর্মরাজ ভস্মকুট পর্বত ধারণ করে আছেন। অনসূয়ার সঙ্গে ঋষি অগস্ত্য এখানে বাস করেন। মহর্ষি অগস্ত্য এই স্থানে ব্রহ্মার কাছ থেকে দুর্লভ বর ও লোপামুদ্রা নামে পত্নী লাভ করেন।
এখানে এক বটবৃক্ষ আছে, সেখানে ব্রহ্মা থাকেন। তার সামনে রুক্মিণী কুণ্ড পশ্চিমে কপিলা নদী। এই নদীতে স্নান ও কপিলেশ্বরকে পূজা করলে শ্রাদ্ধকারীর পিতার মুক্তি লাভ হয়। এখানে সরস্বতী কুণ্ড আছে। শিলা বাঁ হাত দিয়ে গৃদকুট পর্বত ধারণ করেছেন। এখানে ঋণমোক্ষ ও পাপমোক্ষ নামক শিব আছেন। ঐ শিবের দর্শনে শিবলোক লাভ হয়। সেখানে গজরূপী বিঘ্ননাশক বিনায়ক রয়েছেন। মুণ্ডপৃষ্ঠের নীচে এক দেবদারু বন আছে। ঐ মুণ্ডপৃষ্ঠ ও অরবিন্দ পর্বত দর্শন করলে পাপ বিনষ্ট হয়। ধর্মরাজের দ্বারা শিলার বামপাদে প্রেত পর্বত স্থাপিত হয়েছে। এই গিরি আগে পাপময় ছিল বলে একে প্রেত পর্বত বলে।
ধর্মরাজের পাদস্পর্শে এই প্রেত পর্বত পরিত্রাণ লাভ করে। মুণ্ড পৃষ্ঠ পর্বতে মহাদেবের পদচিহ্ন অঙ্কিত আছে, এখানে তার বাসস্থান। এটি দর্শন করে মানুষ পাপ থেকে মুক্ত হয়। ক্ষেত্র মধ্যে গয়াক্ষেত্র অতি পবিত্র। মুণ্ডপৃষ্ঠের সানুদেশে লোমহর্ষণ লোমশ তপস্যা করে সিদ্ধি লাভ করে। লোমশমুনি নিজের তপস্যার ক্ষমতায় বেত্রবতী, চন্দ্রভাগা, সরস্বতী, কাবেরী, সিন্ধু, মহাবৈতরণী, গঙ্গা, যমুনা গণ্ডকী, অলকানন্দা, কৌশিকী ইত্যাদি নদীকে নিয়ে এসেছিলেন। তাই এ সমস্ত নদীতে স্নান ও পিণ্ডদানে পিতৃগণ স্বর্গ লাভ করেন।
ক্রৌঞ্চপাদে নিক্ষরা নামে পুষ্করিণী আছে, সেখানে নিয়ম করে তিনদিন শ্রাদ্ধ ও স্নান করলে পিতৃগণ পাঁচ রকম পাপমুক্ত হয়ে স্বর্গলাভ করেন। ভস্মকূট পর্বতে জনার্দন রয়েছেন। এই জনার্দনের বাঁ হাতে জীবিত ব্যক্তির দধি মিশ্রিত পিণ্ডদান করতে হয়। এই পিণ্ডে তিল দেওয়া চলবে না। পিণ্ডদান। কালে প্রার্থনা করতে হবে–হে জনার্দন, তোমার হাতে পিণ্ড দান করলাম। আমি বা সেই ব্যক্তি মারা গেলে তুমি গয়াশিরে পিণ্ড পৌঁছিয়ে দিও। হে জনার্দন, তুমি পিতৃগণের মোক্ষদাতা, তোমাকে নমস্কার। ধর্মাত্মা ভীম বা জানু মাটিতে রেখে বলেছিলেন, “হে পুণ্ডরীকাক্ষ, তুমি পিতৃগণের মোক্ষদাতা হও, তোমাকে নমস্কার। এই ভাবে শ্রাদ্ধ করে তিনি ভ্রাতৃগণ, পিতৃগণ ও সাতকুলসহ ব্রহ্মলোকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্মীপতি বিষ্ণু সমস্ত দেবতাদের সাথে ব্যক্ত-অব্যক্ত রূপে এই শিলায় রয়েছে। এজন্য এই শিলা দেবময়ী হয়েছে।
.
একশো সাততম অধ্যায়
নারদ জিজ্ঞাসা করলেন–আদি গদাধর, বিষ্ণু কি জন্যে এই শিলায় অধিষ্ঠিত হলেন? তাঁর গদাই বা কিরূপে উৎপন্ন হল? সনৎকুমার উত্তর দিলেন পূর্বকালে গদা নামে এক অসুর ছিল। তার অস্থি বজ্র থেকেও দৃঢ়। এক সময়ে ব্রহ্মা সেই বজ্রসম দৃঢ় অস্থি প্রার্থনা করলে সে তার শরীরাস্থি ব্ৰহ্মদেবকে অর্পণ করে। তারপর ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা বজ্ৰ সমৰ্থ কুঁদ দিয়ে গদাসুরের অস্থি থেকে এক অদ্ভুত গদা সৃষ্টি করে স্বর্গে স্থাপন করলেন। তারপর ব্রহ্মনন্দন হেতি রাক্ষস শত সহস্র বছর ধরে তপস্যা করে, বর চাইলেন–দেব, দৈত্য, নরগণের বিবিধ অস্ত্র শস্ত্রের দ্বারা আমি যেন অবধ্য থাকি। দেবগণ তথাস্তু’ বলে আজ্ঞা দিলে হেতি ইন্দ্রাদি দেবতাদের যুদ্ধে পরাজিত করে ইন্দ্রত্ব ভোগ করতে লাগল। তখন সকলে ভীত হয়ে শ্রীহরির শরণ করলেন। বিষ্ণু জানালেন-হেতি দেবাসুর দ্বারা অবধ্য। রুদ্রপদ, ব্রহ্মপদ, দিব্য, কশ্যপপদ, পঞ্চাগ্নিপদ, ইন্দ্রপদ, অগস্ত্যপদ ইত্যাদিতে গদাধর বিষ্ণুর ব্যক্তরূপ। গায়ত্রী, সাবিত্রী, সন্ধ্যায়, সরস্বতী, গয়াদিত্য, শ্বেতর্ক, অষ্টবসু, সপ্তর্ষি, বিনায়ক, জনার্দন, মঙ্গলা প্রভৃতি আদি গদাধরের ব্যক্তরূপ।
ব্রহ্মা বললেন–যিনি গুণবিদ হয়েও সত্ত্ব, রজ ও তমো গুণের অতীত, যাঁকে কোনও পাপ স্পর্শ করে না সেই গদাধর গয়ায় এসেছেন, সেই বরদ গদাধরকে আমি প্রণাম করি। যাঁর জন্ম নেই, যাঁর শব্দাদি ও মুখাদি অবয়ব নেই, সেই গদাধরকে নমস্কার।
যিনি মনের অতীত, যাঁর মতিগতি নেই, যিনি অব্যয়, পণ্ডিতেরা শ্রেষ্ঠ স্তব দিয়ে যাঁকে সবসময় স্তব করেন, যিনি চিদাত্মক, হৃদয়গত, সেই আদি গদাধরকে আমি নমস্কার করি। ব্রহ্মা বিষ্ণুকে বললেন–আমি, আপনি ছাড়া দেবরূপী শিলাতে অবস্থান করব না। আমি ব্যক্তিতাদি রূপে সবসময়, আপনার সাথে মিলে ওই শিলায় অবস্থাতে ইচ্ছা করি। তখন জনার্দন লক্ষ্মীর সাথে সুব্যক্ত রূপে ঐ শিলায় সর্বস্তুতি করলেন। যারা ভক্তি সহকারে গদাধরের পূজা করে তারা কুষ্ঠরোগগ্রস্ত হলেও রোগমুক্ত হয়। আদি গদাধরের দর্শনে মানুষেরা ধন, ধান্য, আয়ু, আরোগ্য, সুখ প্রভৃতি নানা ভোগ্যবস্তু পেয়ে থাকে।
এভাবে নরগণ গদাধরকে গন্ধদান করলে, গন্ধাঢ্য পুস্পদান করলে সৌভাগ্যশালী, ধূপদানে রাজপ্রাপ্তি এবং শ্রাদ্ধ পিণ্ডাদি দান করলে তার পিতৃগণ বিষ্ণুপুরে গমন করেন। শিব স্বয়ং গদাধরের স্তব করেছিলেন। শিব বললেন–যে দেবমুণ্ড পৃষ্ট পর্বত ও কল্পতীর্থ রূপে অব্যক্ত আমি সেই গদাধরকে নমস্কার করি। যিনি অব্যক্ত জ্ঞানরূপী, আমি সেই গদাধরকে নমস্কার করি। যিনি দেহ, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, প্রাণ ও অহঙ্কার বর্জিত, যিনি জগৎ সুষুপ্তি আদি অবস্থা থেকে মুক্ত, আমি সেই গদাধরকে নমস্কার করি। সনকুমার বললেন–দেবাদিদেব গদাধর মহেশের এরকম স্তবে শিলায় অবস্থান করলেন। গদাধরকে পূজা করলে, ধৰ্মাৰ্থীকামী ধর্ম, অর্থকামী অর্থ, কার্যকারী কাম ও মোক্ষার্থী মোক্ষ লাভ করে। রাজা বিজয় প্রাপ্ত হন। শূদ্র সুখ লাভ করে। যে ব্যক্তি আদি গদাধর হরিকে পূজা করে পুত্র লাভ করে, এমন কি মন দিয়ে যে সমস্ত বস্তু প্রার্থনা করা যায়, গদাধরে পূজা দিয়ে সেই সমস্তও লাভ করে থাকে।
.
একশো আটতম অধ্যায়
সনকুমার বললেন–হে নারদ, পূর্বকালে ব্রহ্মা যে গয়াশ্রাদ্ধকারীদের নিষ্কৃতির বিষয় বলেছিলেন, সেই গয়া যাত্রীদের কথা এবার বলছি। গয়াগামী ব্যক্তি বিধিপূর্বক শ্রাদ্ধ, কৌপীন ধারণ, গ্রাম প্রদক্ষিণ এবং শ্রাদ্ধ শেষ ভোজন করে অন্য গ্রামে যাবেন। সন্তুষ্ট হয়ে অহঙ্কারহীন হয়ে যাত্রা করতে হবে। মহানদীর নির্মল জল দিয়ে স্নান করে তর্পণ করবেন এবং নিজের বেদ শিক্ষানুসারে অর্ঘ্য ও আবাহনবর্জিত শ্রাদ্ধ করবেন। পরদিনে শুদ্ধ হয়ে প্রেত পর্বতে গিয়ে ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করে দেবাদির তর্পণ করে প্রেত পর্বতে সপিণ্ডদের শ্রাদ্ধ করবেন। তারপর আচমন করে পিতৃদেব গণকে আবাহন করে শ্রাদ্ধ করতে হবে। এরপর যত্নের সাথে পঞ্চাঙ্গ প্রণাম করবেন।
পিতৃ কাজে যখন মানুষ তিল গ্রহণ করে, তখনই অসুরেরা সেখান থেকে চলে যায়। গয়ায় প্রথমে পিতৃকুলের কাজ করতে হয়। ডান হাতে কুশ নিয়ে সমস্ত বস্তু দিয়ে পিতৃগণের শ্রাদ্ধ করবে, অন্যান্য বিধি নিজ নিজ বেদানুসারে অনুষ্ঠিত হবে। যত্নের সাথে পিতৃতীর্থে হাত জোড় করে একমুঠি ছাতু নিয়ে অক্ষয় পিণ্ড দান করতে হয়। মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক তিল ও জল দিয়ে কুশে আবাহন করবে–দেব, ঋষি, ব্রহ্মা, পিতা, মানব, প্রমাতামহী, মাতামহী, মাতা, প্রপিতামহ, পিতামহ, পিতাদের জন্য পিণ্ড দান অক্ষয় হোক।
পিতা, মাতা, পত্নী, ভগিনী, কন্যা, পিতৃস্বসা, মাতৃস্বসা–এঁদের সাত গোত্র বলে। এঁদের মধ্যে আগের মতোই পিণ্ডদানে, পিতার চব্বিশ, মাতার কুড়ি, পত্নীর ষোল, বোনের বারো, কন্যার এগারো, এই একশ একটি কুলের উদ্ধার হয়।-পিতৃকুলে যাঁরা মারা গেছেন, যাঁদের কোনো গতি নেই, কুশের ওপর তিল জল দিয়ে তাদের আবাহন করছি। মাতামহকুলে জাত যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, যাদের কোন গতি হয়নি কুশের ওপর তিলজল দিয়ে তাদের আবাহন করছি। বন্ধুদের মধ্যে যাঁরা মারা গেছেন এবং গতি হয়নি তাদেরও তিল জল দান করা যায়। এইভাবে যারা অপঘাতে মারা গেছেন, পশুর হাতে মারা গেছেন, তাদের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান হয়।
যাঁরা বান্ধব ছিলেন এবং বান্ধব নন এমন কেউ, পিতৃ ও মাতৃবংশের গুরু, শ্বশুর বংশে যাঁরা মারা গেছেন, এমনকি যাঁদের নাম জানা নেই তাদের উদ্দেশ্যেও পিণ্ডদান করা যায়। স্ত্রী পুরুষের আলাদাভাবে পিণ্ড দান করতে হয়, না হলে তর্পণ নিষ্ফল হয়। মন্ত্রে বলতে হয়-হে ব্রহ্মদি দেবগণ। আপনারা সাক্ষী হন, আমি গয়ায় এসে পিতৃগণের পিণ্ড দিলাম। তাদের যেন নিষ্কৃতি হয়। আমি দেব, ঋষি ও পিতৃ–এই তিনপ্রকার ঋণ থেকে মুক্ত হলাম। এইভাবে প্রেত পর্বত থেকে শুরু করে গয়াতীর্থের সকল স্থানের পিণ্ডদান করতে হবে। পিতৃগণের মধ্যে কেউ প্রেতরূপে রয়েছে, তিল মিশ্রিত ছাতু দ্বারা সকলকে তৃপ্ত করতে হবে।
.
একশো নয়তম অধ্যায়
সনকুমার বললেন–এবার উত্তর মানসের পঞ্চতীর্থের বিধি বিস্তারিত বলছি। প্রথমে আচমন, হাতে কুশ ধারণ এবং মাথায় জলের ছিটে দিয়ে উত্তর মানসে যাবে। স্নানের পর তর্পণ করে সপিণ্ড শ্রাদ্ধ করবে। এখানে সূর্য প্রণাম করতে হয়। এরপর মৌনী হয়ে উত্তর মানস থেকে দক্ষিণ মানসে যাবে। এই দুই তীর্থের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে ত্রিলোক খ্যাত কনখল তীর্থ। কনখলের দক্ষিণ ভাগে দক্ষিণ মানসতীর্থ। এই দক্ষিণ মানসে আবার তিনটি তীর্থ আছে। এই সব তীর্থে পিতৃগণের মুক্তির জন্য আলাদা ভাবে শ্রাদ্ধ করবে। এরপরে শ্রেষ্ঠ তীর্থ অর্থাৎ ফতীর্থে গমন করবে। পুরাকালে ব্ৰহ্ম যে গয়াক্ষেত্রে যজ্ঞ করেছিলেন, সেই যজ্ঞের দক্ষিণাগ্নির রজ থেকে এই ফন্তু তীর্থের উৎপত্তি হয়েছে। ত্রিভুবনে বহু তীর্থ ছেড়ে দেবগণ স্নান করার জন্য সেই ফতীর্থে এসে থাকেন।
এই ফন্তু আদি গদাধরের শরীর থেকে এসেছে। গঙ্গার থেকে ফন্তু শ্রেষ্ঠ। এখানে স্নান করলে অশ্বমেধ যজ্ঞ অপেক্ষা বেশি পুণ্য হয়। যে ব্যক্তি গদাধরকে পঞ্চামৃত দিয়ে স্নান বা পুষ্প চন্দন দিয়ে পূজা করে না তার কৃত শ্রাদ্ধ নিষ্ফল হয়। প্রথমে ব্রহ্মতীর্থের কূপে স্নান করে শ্রাদ্ধ করতে হবে। এই কূপ ও যুপের মাঝে শ্রাদ্ধ করলে পিতৃগণের মুক্তি হয়ে থাকে। দ্বিতীয় দিনে ধর্মারণ্যে যাবে। এই ধর্মারণ্যেই ব্রহ্মা যজ্ঞ করেছিলেন। তৃতীয় দিনে ব্রহ্ম সরোবরে স্নান করে সপিণ্ডক শ্রাদ্ধ করবে। ব্রহ্ম যজ্ঞ শেষ করে এই ঘূপ উঠিয়ে ছিলেন। তাই নাম ব্ৰহ্মঘূপ। এই ঘূপ প্রদক্ষিণ করলে বাজপেয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়। এরপর ব্রহ্মদেবকে নমস্কার করতে হয়।
এখানে একটি ব্রহ্মা কল্পিত আম গাছ রয়েছে, ঐ গাছের সেচন মাত্রই পিতৃগণ মোক্ষ লাভ করেন। তারপর সংযত হয়ে এই মন্ত্রে যমবলি দান করতে হবে। এরপর কাকবলি দান করতে হবে। তারপর চতুর্থ দিনে ফন্তু তীর্থে গিয়ে স্নান ও তর্পণ করে, তারপর গয়া শিরস্থিত বিষ্ণুপদে সপিণ্ডক শ্রাদ্ধ দান করবে। সাক্ষাৎ গয়াসুরের মাথায় অবস্থিত নাগ, জনার্দন, উত্তরমানস এঁর মধ্যে রয়েছে ফন্তুতীর্থ।
ব্ৰহ্ম সরোবর থেকে শুরু করে উত্তর মানস পর্যন্ত দেবদুলর্ভ ফল্গুতীর্থ রয়েছে। ক্রৌঞ্চপাদ থেকে গয়াসুর মস্তক পর্যন্ত ফল্গুতীর্থ এবং এটিই সাক্ষাৎ গয়াসুরের মুখ। এই গয়াসুরের মুখে দেওয়া শ্রাদ্ধ অক্ষয় হয়। গদাধরের পাদপদ্মে শ্রাদ্ধ অক্ষয় হয়। রুদ্র পদে শ্রাদ্ধ করলে মানুষ শতকুল ও নিজে শিবলোকে যায়। এভাবে কশ্যপ পদে শ্রাদ্ধ করলে পিতৃগণের ব্রহ্মলোক, দক্ষিণাগ্নি পদে ব্রহ্মপুর, গার্হপত্য পদে বাজপেয় যজ্ঞ ফল, ফলষজ্ঞ আহরণী পদে অশ্বমেধযজ্ঞ ফল, ফল, মাতঙ্গ পদদ্বয়ে শ্রাদ্ধ করলে ব্রহ্মলোক লাভ হয়।
পাঁচ রকম পাপকারীও সূর্যপদে শ্রাদ্ধ করলে তার পিতৃগণ অর্কপুরে যেতে সমর্থ হন। এছাড়া কার্তিকের পদে শ্রাদ্ধ করলে পিতৃগণের শিবলোক ও গণেশপদে শ্রাদ্ধ করলে রুদ্রলোক প্রাপ্তি হয়। পূর্বকালে ভরদ্বাজ মুনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে দিব্য কাশ্যপ পদে শ্রাদ্ধ করে পিণ্ডদান করতে উদ্যত হলে সেই কশ্যপ পদ থেকে একটি সাদা ও একটি কালো হাত নির্গত হল। ঐ হাত দেখে মহামুনি ভরদ্বাজ নিজের মা শান্তাকে জিজেস করলেন–এর মধ্যে কে আমার পিতা? আপনার জানা থাকলে বলুন। কোন হাতে আমি পিণ্ডদান করব? শান্তা বললেন–কালো অর্থাৎ কৃষ্ণ হাতে দান কর। ভরদ্বাজ পিণ্ডদান করতে উদ্যত হলে দুটি হাতই বলতে থাকে–তুমি আমার ঔরসজাত রাজপুত্র আমাকে পিণ্ড দান করো। আবার কৃষ্ণ হাত বলে–তুমি আমার ক্ষেত্রজ পুত্র আমায় পিণ্ডদান করো। মাতা বললেন–তুমি উভয়কেই পিণ্ডদান করো।
স্বয়ং রাম দশরথের হাতে পিণ্ডদান না করে, রুদ্রপথে পিণ্ডদান করে শাস্ত্র ভঙ্গ করা হল কিনা চিন্তা করে ভয় পেলেন। কিন্তু দশরথ জানালেন, রাম সঠিক কাজ করেছেন, এতে তিনি মুক্ত হয়ে রুদ্রলোক প্রাপ্ত হতে পারবেন। রামকে দশরথ আশীর্বাদ করলেন। গয়াশিরে ভীষ্ম তাঁর পিতার হাতে পিণ্ড না দিয়ে বিষ্ণু পদে পিণ্ড দিয়েছিলেন। এতে শান্তনু বলেছিলেন, পুত্র তুমি শাস্ত্রে অবিচল, তুমি ত্রিকালদর্শী হও এবং যেন তোমার বিষ্ণু পদে গতি হয়। তুমি ইচ্ছা মৃত্যু বরণ করবে। শান্তনু মুক্তি লাভ করলেন।
মানুষেরা যার নাম করে গয়াশিরে পিণ্ডদান করবে তারা নরকস্থ হলে স্বর্গে যাবে এবং মোক্ষ লাভ করবে। মুণ্ড পৃষ্ঠাদির সব জায়গায় এই পদচিহ্ন রয়েছে। বিষ্ণুপদ দিয়ে হেতি অসুরকে মাথা দ্বিখণ্ডিত করে, সেখানে গদা প্রক্ষালন অ-পিণ্ডক শ্রাদ্ধ করতে হয়। অক্ষয় বটে অন্ন দিয়ে যত্ন সহকারে শ্রাদ্ধ করে ব্রাহ্মণগণকে সন্তুষ্ট করবে।
এরকম করলে পিতৃগণের অক্ষয় সনাতন ব্রহ্মলোক প্রাপ্তি হয়। বটগাছের কাছে শাক কিংবা শুধু জল দিয়েও যদি একজন ব্রাহ্মণকে ভোজন করানো হয়, তবে কোটি কোটি ব্রাহ্মণ ভোজনের সমতুল্য হয়। তারপর বস্ত্র ও গন্ধাদি দিয়ে পুত্রাদির সাথে গয়াতীর্থে পুরোহিতকে পূজা করে যত্ন পূর্বক ষোড়শ প্রকার দান করবে। তারপর অক্ষয় বটকে প্রণাম করবে।
এরপর প্রপিতামহ বিষ্ণুকে এই মন্ত্রে প্রণাম করবে যথা, কলিকালে মানবগণ প্রায়ই শিবভক্ত হবে, এজন্য গদাধর হরি লিঙ্গরূপী বন্দনা করি–আমি তার।
.
একশো দশতম অধ্যায়
সনকুমার বললেন–গয়া রাজা বহু অন্ন ও বহু দক্ষিণাযুক্ত যে যজ্ঞ করেছিলেন ত্রিলোকের বলি ও আকাশের তারকা রাজির মতো যজ্ঞীয় দ্রব্যের গণনা করা যায় না। যজ্ঞে যে সব রত্ন সুবর্ণাদি দিয়েছিলেন তা আগে কেউ, কাউকে দেননি। ভবিষ্যতেও কেউ দিতে পারবে না। ব্রাহ্মণগণ ওই যজ্ঞের প্রশংসা করেছিলেন। বিষ্ণুপুরাণ প্রভৃতি দেবগণ সন্তুষ্ট হয়ে গয়কে বলেছিলেন—’তুমি বর চাও’ রাজা গয় প্রার্থনা করলেন ব্রহ্মার দ্বারা যে সমস্ত ব্রাহ্মণ অভিশপ্ত হয়েছেন, তার যজ্ঞে পূজিত হোন ও গয়াপুরী এই নাম বিখ্যাত হোক। রাজা গয়ও বিষ্ণুলোকে গিয়েছিলেন। বিশালনগরীতে বিশাল নামে এক অপুত্রক রাজা ছিলেন। তিনি পুত্র লাভের আশায় গয়াশিরে পিণ্ডদান করেন। পুত্র লাভের পর বিশাল আকাশে তাকিয়ে দেখলেন, শ্বেত, রক্ত ও কৃষ্ণ পুরুষ পিতা। তিনি বললেন–ইন্দ্রলোক থেকে এসেছি, অন্য দুজন নানা পাপে অত্যন্ত পাপী কিন্তু তোমার পিণ্ডদানে মুক্তি পেলেন। তোমার দেওয়া জলে আমরা তিনজন গতি লাভ করেছি। এবার আমরা স্বর্গবাসী হব।
এক প্রেত রাজ নিজের প্রেতত্ব মুক্তি কামনায় এক বণিককে বলল, আমার নামে গয়াশিরে পিণ্ড দিও। গয়াগামী ঐ বণিক সেইভাবে পিণ্ডদান করলে প্রেত রাজও মুক্তি লাভ করল। মহানদীতে স্নান করে গায়ত্রীর সামনে প্রাতঃসন্ধ্যায় উপাসনা করে সপিণ্ডক শ্রাদ্ধ করলে সমস্ত কুলের ব্রাহ্মণ্য লাভ হয়। সরস্বতী তীর্থে যথাবিধি স্নান করে সকাল সন্ধ্যায় উপাসনা করলে পিতৃগণ বিষ্ণুলোকে গমন করে।
মুণ্ড পৃষ্ঠে গদাধরের পাদ অঙ্কিত বিশাল ক্ষেত্র লেলিহান নামে তীর্থ। এখানে ভারতশ্রমে গিরিকর্ণ মুখে পিণ্ডদান করলে তার শতকুল উদ্ধার পেয়ে থাকে।
দেবনদীতে স্নান করে বৈতরণীতে গো দান করলে একশো কুল উদ্ধার পায়। পিতৃগণের উদ্ধারের জন্য এই বৈতরণী গয়াক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন। এখানে এসে তিনরাত উপোস করতে হয়। কিন্তু যে মানুষ এখানে সোনা ও গোরু দান করে না সে গরীব হয়ে জন্ম নেয়, দশাশ্বমেধিক জংসতীর্থ, অমরকন্টক এবং কোটিতীর্থে স্নান করে মানব যদি কোটিশ্বরের দর্শন করে, সে কোটি জন্ম পর্যন্ত ধনাঢ্য বেদপারগ ব্রাহ্মণ হয়ে জন্ম নেয়।
প্রাচীনকালে পার্বতী ও শঙ্কর পারিজাত কাননে বসে অবস্থান করার সময় মরীচি সেখানে এলে শঙ্কর অসন্তুষ্ট হয়ে অভিশাপ দেন। শঙ্করের শাপে ভীত হয়ে মরীচি তপস্যায় রত হলে মহাদেব তুষ্ট হয়ে বর দেন–তোমার গয়ায় মুক্তি হবে। তখন মরীচি গয়ায় গিয়ে শিলার ওপর বসে কঠিন তপস্যা করতে লাগলেন। তিনি শঙ্করের অভিশাপে কৃষ্ণবর্ণ হয়েছিলেন, পরে শুক্লবর্ণ হন। এবার বিষ্ণু তাঁকে বর দিতে চাইলেন। মরীচি বললেন–আমি শঙ্করের শাপ থেকে মুক্ত হয়েছি, এবার এই শিলা পিতৃগণের মুক্তি দাত্রী হোক। বিষ্ণু আশ্বাস দিলে মরীচি স্বর্গে গেলেন। গয়াতীর্থের একটি পদ্মবনে পাণ্ডু শিলাতে যুধিষ্ঠিরও শ্রাদ্ধ করেছিলেন। যুধিষ্ঠির পিতার হাতে পিণ্ড না দিয়ে শিলার ওপরেই দিলেন।
পাণ্ডু সন্তুষ্ট হয়ে বললেন–তুমি আমার পরিত্রাণ করেছ। তুমি পৃথিবীতে রাজ্য ভোগ করে ভাইদের সাথে সশরীরে স্বর্গ লাভ করো। তোমাকে দর্শন করা মাত্র নরকবাসীরা পবিত্র হয়ে স্বর্গ ধামে আসবে। এই বলে পাণ্ডু শাশ্বত স্বর্গলাভ করলেন। গয়াকূটে পিণ্ড দিলে অশ্বমেধ যজ্ঞেয় ফললাভ ও ভস্মকূটে প্রণাম করলে পিতৃগণের উদ্ধার হয়। এখানে স্নান করলে মানব পাপ থেকে মুক্ত হতে পারে। মাতঙ্গ মুনির পদ শ্রাদ্ধকারী ব্যক্তি স্বর্গে যান।
মুনিসত্তম বশিষ্ঠ এখানে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। সেই যজ্ঞ থেকে শিব আবির্ভূত হয়ে বশিষ্ঠকে বর দান করতে চাইলেন। বশিষ্ঠ বললেন–হে দেবাদিদেব! যদি আমার ওপর তুষ্ট হন তবে আপনি সব সময়ে এখানে থাকুন। শিব বললেন, “তথাস্তু। ধৈনুকারণ্যে স্নান নমস্কার ও পুজো করে কামধেনু পদে পিণ্ডদান করলে পিতৃগণ ব্রহ্মলোকে যেতে পারেন। মুণ্ডপৃষ্ঠ পর্বতের কাছে গয়ানজিতে কর্দমাল তীর্থ। এখানে শ্রাদ্ধ করলে পিতৃঋণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এখানে ফন্তুচণ্ডী, শ্মশানাক্ষী ও মঙ্গলা প্রভৃতির পুজো করতে হয়। গয়াতীর্থের সবক্ষেত্রেই জিতেন্দ্রিয় ঋষি ও দেবগণ রয়েছেন।
গয়াগয়, গয়াদিত্য, গায়ত্রী, গদাধর, গয়া এবং গয়ামুর–এই ছয় গয়া মুক্তি দায়িকা। যে মানব এই পুণ্য গয়া তীর্থ আখ্যান সবসময় পাঠ বা শ্রদ্ধার সাথে শোনে, সে পরমগতি লাভ করে। যে সমাহিত মনে গয়া মাহাত্ম্য অভ্যেস করে, হে নারদ! এই অভ্যাস দিয়েই তার রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়ে থাকে। যার গৃহে এই গয়ার পবিত্র উপাখ্যান আছে, সেই গৃহে শাপ, চোর ও আগুনের ভয় থাকে না। হে নারদ! ত্রিভুবনের যে সব তীর্থ আছে, সেই সব তীর্থই গয়ায় দেখা যায়। এই গয়া আখ্যান সম্বন্ধে আমি যা শুনেছি, সেই সমস্তই বললাম। সূত্র বললেন–সনৎকুমার, ভক্তি সহকারে মুনি পুঙ্গব নারদকে এইসব পুণ্য কথা নিবেদন করলেন, বিদায় নিয়ে নিজের আশ্রমে ফিরে গেলেন।