শিবভক্ত শ্বেতরাজার কাহিনী
মহাত্মা শ্বেত পরম ধার্মিক, শিবভক্ত ও মহাবীর। রাজা হিসাবে তার প্রচুর খ্যাতি, তিনি শ্রেষ্ঠ প্রজাপালক। শিবের পূজা না করে জল গ্রহণ করেন না। মুখে সব সময় মহাদেবের কথা, শিবের প্রসাদে তার দেহে কোনো ব্যাধির সংস্রব নেই। তার রাজ্যের ব্রাহ্মণাদি চার বর্ণ। প্রত্যেকই নিজ নিজ ধর্ম পালন করত। কেউ কখনও পুত্রের মৃত্যুজনিত দুঃখ পায়নি। অসময়ে কারও মৃত্যু হত না, গরীবও ছিল না কেউ, শিব পূজার ফলেই তাঁদের সকল কার্য সফল হত।
শ্বেতের বয়স হয়েছে। বৃদ্ধ দশা, কিন্তু তার নিত্য শিবপূজা করা চাই। অতঃপর পরমায়ু শেষ হল, যম পাঠালেন তার দূতগণকে, নিয়ে যাওয়ার জন্য।
দণ্ড হাতে নিয়ে দূতেরা চলল শ্বেতরাজার কাছে। রাজা তখন শিবমন্দিরে লিঙ্গ পূজা করছেন। দূতেরা তাঁর দিকে তাকিয়েই থাকল, ধর্মরাজের আজ্ঞা আর পালন করতে পারল না।
যমপুরীতে থেকে ধর্মরাজ সবই বুঝতে পারলেন। দণ্ড হাতে নিয়ে নিজেই এলেন রাজার কাছে। দেখলেন রাজা সেই একই অবস্থায়। পূজা যেন তার শেষ হতেই চায় না। কিছু করার উপায় নেই, প্রেতরাজ পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছেন।
এমন সময় হাতে খড়গ নিয়ে স্বয়ং কাল এলেন সেখানে। তিনি দেখলেন যমরাজ ভয়াতুর হয়ে শিবমন্দিরের দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- ওহে, ধর্মরাজ, তুমি কিজন্য, রাজাকে নিয়ে যাচ্ছ না? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভয় পেয়েছে? তুমি আর কালবিলম্ব না করে নিয়ে যাও রাজাকে।
কালের কথা শুনে ধর্মরাজ বললেন– দেব, আমি আপনার আদেশ অবশ্যই পালন করব। কিন্তু শিবভক্তের কাছে যাব কেমন করে? শূলপাণির ভয়ে কিছুই করতে পারছি না।
যমের কথা শুনে কাল ভীষণভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে রাজাকে বিনাশ করতে উদ্যত হলেন। অসংখ্য সূর্যের মতো উজ্জ্বল কাল যখন মন্দিরে প্রবেশ করলেন, তখন শূলপাণি ক্রোধভরে তার দিকে তাকালেন। শিবভক্ত শ্বেতরাজ ধ্যানস্থ হয়ে আত্মাকে পরমাত্মারূপে চিন্তা করছেন। তাকে বিনাশ করার জন্য দম্ভ ভরে উদ্যত হয়ে, শিবের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত দেখে তাঁরই দিকে ধাবিত হলেন।
তখন মহেশের তৃতীয় নয়ন জ্বলে উঠল, ভস্মীভূত হল কাল। উগ্ৰাকৃতি, প্রচণ্ড স্বভাব ও জগতের একমাত্র গ্রাসকর্তা কাল এভাবে দগ্ধ হলেন। তারপর শ্বেতরাজা বাহ্যজ্ঞান পেয়ে দেখলেন কাল তাকে বিনাশ করতে এসে রুদ্রের দ্বারা দগ্ধ হয়েছেন, তখন তিনি অতিশয় ব্যাগ্র হয়ে রুদ্রদেবের কাছে। প্রার্থনা করলেন- হে শম্ভু, আপনি কি করেছেন? কাকে দগ্ধ করলেন আমার সামনে? কে কি দুর্ব্যবহার করল, তা আমি জানি না।
রাজাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য শঙ্কর বললেন, মহারাজ, এই কাল সকল প্রাণীরাই ভক্ষক, এখন এই ক্রুদ্ধস্বভাব কাল আমারই সামনে তোমাকে গ্রাস করতে এসেছে। তাই তো পুড়িয়ে মারলাম ওকে। সবার মঙ্গলে ও তোমাকে রক্ষার জন্যই আমাকে এমন করতে হল। যারা পাপী, অধার্মিক লোক, বিনাশক ও পাষণ্ড তাদেরকে আমি বিনাশ করি।
মহারাজ শ্বেত বললেন, কাল বশেই লোক পুণ্যকাজ করে। কালেই ধার্মিষ্ট হয়, কেউ জ্ঞানী হয়, কেউ কেউ ভক্তিমান হয়, কেউ উপাসক, কেউ আবার মুক্ত হয়। কালই চরাচরের কর্তা আবার পালনকর্তা। তিনিই প্রাণীগণের প্রাণ স্বরূপ, তাই আপনি এই কালকে বাঁচিয়ে তুলুন। হে প্রভু, যদি সৃষ্টি রক্ষা করতে চান, তাহলে কালকে তাড়াতাড়ি জীবিত করুন। কাল ছাড়া এ জগতে কেউ বাঁচবে না।
রুদ্রদেব তখন ভক্তের বাসনা পূর্ণ করবার জন্য হাসতে হাসতে কালকে বাঁচিয়ে তুললেন। যমদূতগণ তখন কালকে আলিঙ্গন করলেন, আর কাল লজ্জিত হয়ে মহাদেবের বহু স্তবস্তুতি করলেন।
তারপর কাল শ্বেতরাজাকে উদ্দেশ করে বললেন– সমস্ত মানবজগতে আপনি বিনা আর কারও অস্তিত্ত্ব নাই। ত্রিভুবনের অজেয় দেবকে আপনি জয় করেছেন। আমি এই চরাচর বিশ্বকে বিনাশ করি।
হাসতে হাসতে বললেন– হে কাল, আপনি রূদ্রের পরমরূপ, আপনি সর্বপূজ্য। যাঁরা আত্মনিষ্ঠ কৃতিবান, তারা আপনারই ভয়ে শিবের শরণাপন্ন হন। তারপর যম ও মৃত্যু শ্বেতরাজার স্তব করলেন। তারপর দূতগণকে বললেন– যারা ত্রিপ, জটা বা রুদ্রাক্ষ ধারণ করে কিংবা যে জন ভয়ে বা জীবিকার জন্য শিব নাম কীর্তন করে, তারা শত পাপী বা দুরাচারী হলেও সাক্ষাৎ শিবজপধারী, তাতে কোন সন্দেহ নাই। তাই তাদেরকে কখনও আমার এই নরকে আনবেন না।
সেই অবিনশ্বর মহাদেব কালকে দগ্ধ করে যে মহারাজ শ্বেতকে অভয় দিয়েছিলেন, সেই শ্বেতরাজা দেহান্তে শিবের সাযুজ্য মুক্তি লাভ করেন।