ভদ্রশীলের কাহিনি
ভদ্রশীল ছিলেন গালব ঋষির পুত্র। শিশুকাল থেকেই ভদ্রশীল ছিলেন হরি-পরায়ণ। খেলাচ্ছলে তিনি মাটি দিয়ে বিষ্ণু মূর্তি গড়ে নানা রকম ফুল দিয়ে পূজা করে প্রার্থনা করতেন–হে নারায়ণ, তুমি সকলের মঙ্গল কর। গালব মুনি পুত্রের কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন-তোমার এই পূজা দেখে আমি অবাক হয়েছি। তুমি যে নারায়ণের নিত্য পূজা কর, এসব কে শেখাল তোমাকে?
মুনির প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রশীল বলল–বাবা, পূর্বজন্মের কথা আমার সব মনে আছে। ধর্মরাজের কাছে আমি সব কিছু জেনেছি।
পুত্রে কথায় গালব মুনি অবাক হয়ে ভাবলেন, এইটুকু ছেলে, জাতিস্মর হয়ে পূর্বজন্মের কথা সব মনে রেখেছে। তিনি পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন-বল বৎস পূর্বজন্মে তুমি কে ছিলে?
ভদ্রশীল বলল-পূর্বজন্মে আমার চন্দ্রবংশে জন্ম হয়েছিল। আমার নাম বৰ্চকীর্তি। আমি ছিলাম সসাগর পৃথিবীর রাজা। এক লক্ষ বছর রাজত্বকালে আমি বহু ধর্ম ও অধর্মের কাজ করেছি। সেই পাপ কাজের ফলে আমার সব পুণ্য ক্ষয় হয়ে গেল, ক্রমে ক্রমে বেদমার্গ ত্যাগ করে, সকল যজ্ঞ নষ্ট করলাম। প্রজারাও আমার দুষ্কর্ম দেখে পাপ কাজে মেতে উঠল।
একদিন বহু সৈন্য সঙ্গে নিয়ে আমি বনে যাই মৃগয়ার জন্য। একসময় সৈন্যদের কাছ থেকে আমি বহু দূরে চলে গিয়েছিলাম। আমি তখন ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর। ঘুরতে ঘুরতে নর্মদা নদীর তীরে ক্লান্ত হয়ে একটি গাছের ছায়ায় এসে বসলাম। এরপর ক্রমশঃ অনুকার সমীভূত হল, সেই নির্জন অরণ্যে রাতে গম্ভীর হল। হঠাৎ এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখলাম। একাদশী ব্রতের জন্য অনেক লোক এসে সেখানে জড়ো হল এবং তারা সরারাত জেগে রইল। আমিও তাদের সঙ্গে জেগে রইলাম। সারাদিনের পরিশ্রমের ফলে ক্লান্ত ছিলাম, সারাদিন কোন আহারও জোটেনি, ক্ষুধায় কাতর থাকলেও সারারাত্রি জেগে কাটালাম। ফলে অতি দুর্বলতার কারণে প্রাণবায়ু নির্গত হল।
হে পিতা, এর পরের আশ্চর্য ঘটনা শোন। তারপর বিশাল দাঁতওয়ালা, যমদূতেরা এসে ভীষণ কাঁটাযুক্ত পথে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে নিয়ে চলল যমপুরীতে। চিত্রগুপ্ত তার খাতা খুলে আমাকে আমার পাপ-পুণ্যের হিসাব দেখালেন।
চিত্রগুপ্ত বললেন–এই ভদ্রশীল অনেক পাপকর্ম করে মহাপাপী ছিল। কিন্তু একাদশী তিথিতে অনাহারে অনিদ্রায় থাকার জন্য এবং বিশেষ করে নর্মদা নদীর তীরে মৃত্যুর কারণে এর সকল পাপ খণ্ডন হয়েছে।
চিত্রগুপ্তর কথা শুনে যমরাজ আমাকে প্রণাম জানিয়ে দূতদের বললেন–পৃথিবীর যাঁরা ধার্মিক হবেন, যাঁরা একাদশী ব্রত করবেন, আমার এখানে তাদেরকে আনবে না, শ্রীহরির চরণতলে তারা ঠাঁই পাবেন। শ্রীহরির স্মরণ নেবার জন্য যারা শিক্ষা দেন তারা শুদ্ধচরিত্র। তাদের ওপর আমার কোনও অধিকার নেই। যাঁরা গুরুর সেবা করেন, নিজ ধর্ম পালন করেন, হরিকথা শোনেন, তাদের কাছে কখনো তোমরা যাবে না।
যাঁরা একাদশী ব্রত, জন্মাষ্টমী ব্রত পালন করে না, যারা অপরের নিন্দা করে, সাধুর দোষ দেখে, ব্রাহ্মণের সম্পদ হরণ করে তাদেরকেই বহু কষ্ট দিয়ে আমার কাছে নিয়ে আসবে। হে পিতা, যমরাজের এমন কথা শুনে আমি অনুতাপে দগ্ধ হলাম। তাতেই আমার সব পাপ ক্ষয় হয়ে গেল। আমার দেহটি তখন শ্রীহরির পদযুগলের মত সুন্দর হয়ে গেল, আমার দেহ থেকে জ্যোতি বেরুতে লাগল।
তাই দেখে যমরাজ আমাকে প্রণাম করে নানান স্তুতি করলেন।
যমরাজ আমাকে এইভাবে সম্মান দেখানোর জন্য, যমদূতেরা অবাক হয়ে গেল।
তারপর ধর্মরাজ আমাকে বৈকুণ্ঠে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে বহু কল্পকাল সুখে বাস করলাম। তারপর দীর্ঘকাল ইন্দ্রলোকে বাস করে, শেষে আপনার পুত্র রূপে জন্মালাম। হরির কৃপায় আমি জাতিস্মর হলাম, পূর্বকথা আমার সব মনে পড়ল। হে পিতা, এই কারণেই আমি শ্রীহরির পূজা করি আর একাদশী ব্রতও পালন করি।
পুত্রের কথা শুনে গালব ঋষি বললেন–হরিভক্তিপরায়ণ পুত্র লাভ করে আমি ধন্য, আমার বংশও পবিত্র হল।