গৃহপতিকে শিবের কৃপা
নর্মদা নদীর তীরে নর্মপুর নামে এক শহর ছিল, বিশ্বানর নামে এক ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নী শুচিশ্মতাঁকে নিয়ে সেই নগরে বাস করতেন। বড় নিষ্ঠাবান, সকল কাজই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। শিবের পূজা করে তার সময় কাটে কিন্তু একটাই দুঃখ, তাঁর কোনো ছেলেপুলে নেই, ব্রাহ্মণীর বড় ইচ্ছা শিবের মত একটি পুত্র যেন তিনি লাভ করতে পারেন। স্বামীকে মনের কথা বলেন। ব্রাহ্মণও চান একটা পুত্র, ভাগ্যে থাকলে তবে তো।
বিশ্বানর একদিন চিন্তা করলেন শিবের মত পুত্র যদি পেতে হয় তাহলে শিবের আরাধনা করতে হবে। তিনি শিবের প্রিয় স্থান বারাণসীতে গেলেন, সেখানকার সাধু সজ্জনদের জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় পূজা করলে তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যাবে। সবাই বিশ্বেশ্বর লিঙ্গের কথাই বললেন। তখন বিশ্বানর সেখানেই গেলেন। ভক্তিভরে গঙ্গার জল দিয়ে শিবলিঙ্গের পূজা করে স্থির মনে ধ্যানে বসলেন।
প্রথম প্রথম তিনি একবেলা আহার করতেন, পরে তিনি একেবারে অনাহারে তপস্যা শুরু করলেন। একবছর কেটে গেল, তারপর কিছুদিন পরে তিনি দেখতে পেলেন শিবলিঙ্গের উপরে একটি অপরূপ সুন্দর শিশু। চোখ দুটি টানা, ঠোঁট দুটি লাল, মাথায় জটা, আবার উলঙ্গ।
ব্রাহ্মণ বুঝতে পারলেন স্বয়ং মহাদেবই শিশুর রূপ ধরে দেখা দিলেন। আনন্দে আত্মহারা বিশ্বানর।
শিশুরূপী শিব বললেন– হে বিশ্বানর, তোমার আশা পূর্ণ হবে, ঘরে ফিরে যাও।
বিশ্বানর ফিরে এলেন নিজের ঘরে। কিছুদিন পরে তাদের ঘর আলো করে এক পুত্রের জন্ম হল। খবর পেয়ে ছুটে এল সবাই। শুধু পাড়া-প্রতিবেশী নয়, মুনি-ঋষি, দেবতা, গন্ধর্ব, যক্ষ, কিন্নরাদি সকলেই, এমনকি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরও এলেন। প্রত্যেকে বহু উপহার আনলেন, এত লোকের আগমনে সেই স্থান যেন এক তীর্থের আকার ধারণ করল। প্রচুর উপহার বিশ্বানর সবাইকে দান করে দিলেন। সেই নবজাতকের জাতকর্মাদি সবই করলেন স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা, শিশুর নাম দিলেন গৃহপতি। আর তারপর গৃহপতি বড় হতে লাগল। ব্রহ্মা তাকে শিক্ষা দিল। অল্পবয়সে গৃহপতি চারিবেদ শিখে মহাপণ্ডিত হয়ে গেল। একদিন গৃহপতি মা, বাবার সেবা করছেন, এমন সময় নারদ এলেন বীণা বাজিয়ে, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী খুব ব্যস্ত হয়ে উঠলেন তার সেবায়। চরণ ধুইয়ে আসনে বসতে দিলেন এবং ঘরে যা ফলমূল ছিল তা সাজিয়ে খেতে দিলেন, দেবর্ষি খুব সন্তুষ্ট হলেন। গৃহপতি তখন ন’বছরের বালক। মুনিবর তাকে ডাকলেন, গৃহপতি এগিয়ে গেল মুনির কাছে, মুনিবর তার হাত দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন বালকের মুখপানে। তারপর বিশ্বানরকে বললেন– তোমার এই ছেলে সাধারণ নয়, রাজাধিরাজ হবে, তোমার বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
এই কথা শুনে বাবা মা খুব খুশি হলেন।
কিছুক্ষণ মুনিবর চুপ থেকে আবার দুঃখের স্বরে বললেন–ছেলেটির সবই ভালো কিন্তু একটা খারাপ লক্ষণ সব ভালোকে শেষ করে দেবে।
ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী সে কথা শুনে আঁৎকে উঠলেন, বললেন–কি খারাপ লক্ষণ দেখলেন আমাদের পুত্রের?
মুনি বললেন– এই শিশুর পরমায়ু যোগ খুবই অল্প। আর মাত্র চার বছর আয়ু আছে। মা বাবার মাথায় যেন বজ্রপাত হল।
নারদ বললেন–বজ্রপাতেই মৃত্যু হবে এই বালকের।
কথাটা শোনামাত্রই বাবা-মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বিশ্বানর একটু শান্ত হয়ে মুনির চরণ ধরে বললেন, কোনো ভাবেই কি এই বালকের আয়ু বাড়ানো যায় না?
কপালের লেখা কেউ খণ্ডাতে পারে না, আমি আর কি করব? এই কথা বলে নারদঠাকুর চলে
গেলেনর আর শুচিত্মীতার মন গল্প পরমায়ু পুত্রকে দিলেবলেনি। দেবর্ষি চলে।
বিশ্বানর আর শুচিত্মীতার মন খুবই খারাপ, কঠোর সাধনা করে শিবের বরে এমন সুন্দর মেধাবী পুত্র লাভ হল। কিন্তু মহাদেব এমন অল্প পরমায়ু পুত্রকে দিলেন কেন?
বালক গৃহপতি নারদের সব কথাই শুনেছে। কিন্তু তখন কিছু বলেনি। দেবর্ষি চলে যাওয়ার পর মা বাবাকে কাঁদতে দেখে বলল– মা, বাবা, তোমরা কাঁদছ কেন? আমি তোমাদের সেবা করব।
আর আমি শাস্ত্র পড়ে জেনেছি, যে পুত্র তার বাবা-মার সেবা করে তার কখনও কোনো বিপদ হয় না। যদি হয় তাহলে বুঝতে হবে শাস্ত্রের কথা মিথ্যা, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণু, আর সংহারকর্তা মহেশ্বর। আমি মহাদেবের তপস্যা করব। তিনি ইচ্ছা করলেই আমার অল্পবয়সের মৃত্যুযোগ খণ্ডাতে পারেন, তোমরা আমাকে অনুমতি দাও, তপস্যায় যাই।
মা-বাবা তো অবাক, এইটুকু ছেলে কি বলছে? তারপর বিশ্বানর ভাবলেন গৃহপতি যা বলছে তা যদি করতে পারে তাহলে শিব নিশ্চয়ই কৃপা করবেন। কিন্তু এইটুকু ছেলে কিভাবে কষ্ট সহ্য করবে, কিভাবে তপস্যা করবে? কিন্তু অনুমতি না দিলে তো অকালেই পুত্রকে হারাতে হবে।
গৃহপতি তার বাবা মাকে বলল– তোমরা আমার কষ্টের কথা ভাবছ? কিন্তু কষ্ট না করলে দুর্দৈব কাটবে কেমন করে?
মা বাবার আর কি বলার আছে? বুক ফেটে যাচ্ছে, তবু অনুমতি দিলেন। বালক গৃহপতি মা বাবাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়ল, বেশ কিছুদিন হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছল কাশীধামে। গঙ্গার ধারে বসে পড়ল এক জায়গায়। নিজেই গঙ্গামাটি দিয়ে শিবলিঙ্গ তৈরি করলো। কাছাকাছি বন থেকে ফুল আর বেলপাতা সংগ্রহ করে পূজা করতে লাগল প্রত্যেকদিন, একমনে ধ্যান করল, খাওয়া দাওয়ার কথা তার মনেই নেই।
এক এক দিন পার হল, মাস যায় বছর পার হল। এই করে তিন বছর পার হল। গৃহপতির বারো বছর বয়স হলে তার মৃত্যুর দিন যে এগিয়ে আসছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। নিত্য নিত্যই শিবকে গঙ্গাজলে স্নান করাচ্ছে। ফুলের মালা গেঁথে শিবলিঙ্গের উপর সাজিয়ে দিয়ে ধ্যান করছে গৃহপতি।
তারপর এল সেই মৃত্যুর দিন। বজ্র হাতে নিয়ে এলেন দেবরাজ ইন্দ্র। বললেন, গৃহপতি তুমি বালক হয়ে যেভাবে তপস্যা করছ তাতে আমি খুব খুশি, বল কি বর চাও?
গৃহপতি চোখ খুলে ইন্দ্রকে দেখে তার চরণে প্রণাম জানিয়ে বলল, আমি মহেশ্বরের উদ্দেশে তপস্যা করছি। আমি তো আপনার ধ্যান করিনি। তাহলে আপনি কেন বর দেবেন? শিব যদি তুষ্ট হয়ে বর দেন তাহলে আমি নেব।
বালকের মুখে এমন কথা শুনে ইন্দ্র চটে গেলেন, বললেন– এতটুকু বালকের এত বড় স্পর্ধা, আমাকে অবজ্ঞা করে। গৃহপতি আমি তোমাকে বর দিতে এসেছি, বর চাও।
বালক আবার বললো– আপনি রুষ্ট হবেন না। আমি শিবকে তুষ্ট করে তাঁর কাছে থেকে বর নিতে চাই। আপনার দেওয়া বর আমার প্রয়োজন নেই। দয়া করে আপনি আমাকে বিরক্ত করবেন না।
বালকের মুখে এমন কথা শুনে ইন্দ্র আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। বজ্র তুলে মারবার জন্য উদ্যত হলেন, কি ভয়ানক তেজ সেই বজ্রের, ঝলকে ঝলকে আগুন বেরোচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে পারল না আর, গৃহপতি চোখ বন্ধ করে থাকল।
সহসা মনে পড়ল নারদ মুনি বলেছিলেন কপালের লিখন খণ্ডায় না, তাহলে কি শিব তুষ্ট হননি, বজ্রের আঘাতে তাকে মরতে হবে?
এই ভেবে গৃহপতি চেতনা হারাল, কিছুক্ষণ পরেই চেতনা ফিরে পেল। তার মনে হল কে যেন তার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছেন। চোখ খুলে দেখলো, বাঘছাল পরা, মাথায় জটা, হাতে ত্রিশূল, গায়ে সাপ, মণিময় মালা গলায় আর মুখে মৃদু হাসিতে ভরা এক মোহময় মূর্তি। উঠে দাঁড়াল গৃহপতি, প্রণাম করল তার পায়ে।
শঙ্কর বললেন– আমি এসেছি, তোমার কোন ভয় নেই, আমি তোমার তপস্যায় তুষ্ট হয়েছি। তোমাকে পরীক্ষা করবার জন্য ইন্দ্রের বেশে এসেছিলাম। তুমি তপস্যা করে অগ্নিকে জয় করেছ। তাই আমি তোমাকে আজ থেকে অগ্নির অধীশ্বর করলাম। এই ব্রহ্মাণ্ডে যত দেবতা আছে, মানুষ, মুনি, ঋষি সকলেই তোমার পূজা করবে, এখন বাবা মার কাছে ফিরে যাও। তোমার জন্য বিশ্বকর্মা নগর বানিয়েছেন তার নাম অর্চিষ্মতী, স্বর্গের পাশেই সেই নগর।
তারপর গৃহপতি মহাদেবের চরণে প্রণাম জানাল, নিজের দেশে ফিরে এল। মা, বাবা তাকে দেখে খুব আনন্দ পেল এবং সব কথা শুনে আনন্দে বিহ্বল হয়ে উঠল।
যথাকালে বাবা মাকে নিয়ে গৃহপতি অর্চিষ্মতী নগরে গিয়ে রাজরাজেশ্বর হলেন।