ভাগবত পুরাণ – ০৯ম স্কন্ধ

ভাগবত পুরাণ – নবম স্কন্দ
প্রথম অধ্যায়
সূর্যবংশের বর্ণনা

মহারাজ পরীক্ষিৎ বললেন–হে ব্রাহ্মণ, আপনার বর্ণিত মন্বন্তর সকলের বিবরণ এবং সেই সকল মন্বন্তরে অনুষ্ঠিত অনন্তবীর্য ভগবান শ্রীহরির বীর্যময় চরিত সমূহের কথা আমি শুনেছি। দ্রাবিড় দেশের অধিপতি সত্যব্রত নামক যে রাজর্ষি অতীত কল্পের অবসানে ভগবান শ্রীহরির সেবার দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন, তিনিই বিবস্বানের পুত্র মনু হয়েছেন। ইহাও আপনার নিকট শুনেছি। ইক্ষাকু প্রভৃতি নরপতিগণ সেই বৈবস্বত মনুরই সন্তান–তাও আপনি বলেছেন, হে মহাভাগ ব্রাহ্মণ, সম্প্রতি আপনি সেই নৃপতিদের বংশ এবং বংশজাত ব্যক্তিগণের চরিতকথা পৃথক পৃথক বর্ণনা করুন, আমরা সর্বদা তা শ্রবণে ইচ্ছুক। ঐ সকল নরপতিগণের বংশে পূর্বে যাঁরা জন্মেছিলেন ভবিষ্যতে যাঁরা জন্মিবেন এবং সম্প্রতি যারা বর্তমান রয়েছেন, আপনি সেই সকল পুণ্যকীর্তি পুরুষগণের বিক্রমের কথা আমাদের নিকট বলুন।

শ্রীসূত বললেন–ব্রহ্মবাদী ব্রাহ্মণগণের সভায় রাজা পরীক্ষিত কর্তৃক এইপ্রকার দৃষ্ট হয়ে পরম ধর্মজ্ঞ শুকদেব বলতে আরম্ভ করলেন। শুকদেব বললেন–হে শত্রুনাশক শতবর্ষেও মনুর বংশ বিস্তৃতরূপে বর্ণনা করা যায় না, অতএব প্রাধান্যরূপে তা বর্ণনা করছি। শোন, উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট সকল প্রাণীর যিনি আত্মা (অর্থাৎ উপাদানভূত) প্রলয়কালে এই বিশ্বে একমাত্র, সেই পরম পুরুষেই লীন ছিল, অগ্রে কেবল তিনিই ছিলেন, কল্পনান্তে তত্ত্বতীত বিশ্ব বা অন্য কিছুই ছিল না। তখন সেই পরমপুরুষের নাভি হতে একটি হিরন্ময় পদ্মকোষ উদগত হয়, হে মহারাজ, এতে চতুর্মুখ ব্রহ্মা আপনা হতেই উৎপন্ন হয়েছিলেন, ঐ ব্রহ্মার মন হতে মরীচির জন্ম হয়। তার পুত্র কশ্যপ, ঐ কশ্যপের পত্নী দক্ষকন্যা অদিতি, তার গর্ভে কশ্যপের ঔরসে বিবস্বান্ (সূর্য) নামক পুত্রের উৎপত্তি হয়।

হে ভরতকুল নন্দন, বিবস্বান্ হতে পত্নীর সংজ্ঞার গর্ভে শ্রাদ্ধদেব নামক মনু জন্মগ্রহণ করেন। সংযতাত্মা মনু পত্নী শ্রদ্ধার গর্ভে দশটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ঐ পুত্রগণের নাম ইক্ষবাকু, নৃগ, শর্যাতি, দিষ্ট, ধৃষ্ট, করূষ, নরিষ্যন্ত, পৃষধ, নভগ ও কবি। ইক্ষবাকু প্রভৃতির উৎপত্তির পূর্বে মনু যখন নিঃসন্তান ছিলেন, তৎকালে প্রভাবশালী মহর্ষি বশিষ্ঠ তার সন্তান লাভের জন্য মিত্র ও বরুণদেবের যজ্ঞ করেছিলেন, মনুর পত্নী শ্রদ্ধা, সেই যজ্ঞের অন্যতম যাজ্ঞিক হয়ে হোতার নিকট গিয়ে প্রণাম করে এই প্রার্থনা করেন–যে প্রকারে আমার কন্যা হয়, সেরূপ করে আপনারা হোম করুন। শ্রদ্ধার অভ্যর্থনায়, অধবর্ষ কর্তৃক প্রেরিত হয়ে হোতা হবিঃ গ্রহণ পূর্বক তাহা ত্যাগ করার পূর্বে একাগ্রচিত্তে শ্রদ্ধার প্রার্থনার অনুরূপ ধ্যান করতে করতে মুখে ‘বষট’–এই শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন। হোতার এইরূপ ব্যভিচার (অর্থাৎ যজমানের সংকল্প থেকে বিপরীত সংকল্প রূপ হেতু ইলা নামে এক কন্যা জন্মাল)। তাকে দেখে মনু চিত্তে অতি সন্তুষ্ট না হয়ে গুরু বশিষ্ঠদেবকে এরূপ বললেন–হে ভগবান আপনাদের মত ব্রহ্মজ্ঞানের কর্মের এরূপ বিপর্যয় ঘটল, ইহা কি? হায় কি কষ্ট, মন্ত্রের ত কখনও ঘটতে পারে না। আপনারা ব্রহ্মজ্ঞ যোগী পুরুষ তপস্যার দ্বারা আপনাদের সকল কাম দগ্ধ হয়েছে, অতএব দেবতাদের মধ্যে মিথ্যার আবির্ভাবের ন্যায় কিরূপে আপনাদের সংকল্পের বৈষম্য হল?

আমার প্রপিতামহ ভগবান বশিষ্ঠদেব সেই বাক্য শ্রবণ করে হোতার ব্যতিক্রম জানতে পেরে, মনুকে এরূপ বলেছিলেন-হে মহাভাগ, তোমার হোতার ব্যভিচার–দোষেই যদিও এরূপ সংকল্প বৈষম্য ঘটেছে, তথাপি আমি নিজ ব্ৰহ্মতেজের প্রভাবে তোমাকে সুপুত্র যুক্ত (অর্থাৎ ঐ কন্যারই পুত্রত্ব) করব। হে রাজ, এইরূপ কৃতনিশ্চয় হয়ে মহা যশস্বী বশিষ্ঠ কন্যা ইলার পুরুষত্ব কামনায় আদিপুরুষ ভগবানের স্তব করেছিলেন। ভগবান ঈশ্বর শ্রীহরি সেই বশিষ্ঠের কামনা অনুসারে বর দিয়েছিলেন, তাতে ইলা সুন্ম নামে শ্রেষ্ঠ পুরুষরূপে পরিণত হল। হে মহারাজ, একদিন মহাবীর সুদ্যুম্ন দুঃখ বোধ করতে লাগলেন। রাজা পরীক্ষিৎ জিজ্ঞাসা করলেন–ভগবান্ ঐ স্থান ঐরূপ গুণযুক্ত কিরূপ হল এবং কোন্ ব্যক্তিই বা ঐ স্থানকে ঐরূপ করেছেন? আমাদের এ বিষয়ে মহৎ কৌতূহল জন্মেছে, আপনি আমাদের প্রশ্নের সমাধান করুন।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–রাজন, একদিন উত্তম ব্রত পরায়ণ ঋষিগণ ভগবান শংকরকে দর্শন করার জন্য সেই বনে আগমন করেছিলেন। তাদের দীপ্তির দ্বারা দিক সকলের অন্ধকার এবং অন্য সকলের দীপ্তি নিরস্ত হয়েছিল। তৎকালে ভগবতী অম্বিকাঁদেবী বিবসনা ছিলেন, অতএব মুনিদের দেখে অতিশয় লজ্জিত হয়ে পতির ক্রোড় হতে উত্থানপূর্বক সত্বর কটিবসন পরিধান করলেন। এদিকে ঋষিগণও তাদের বিহার প্রসঙ্গ লক্ষ্য করে, সেখান থেকে নিবৃত্ত হয়ে নর-নারায়ণাশ্রমে গমন করলেন। তখন ভগবান শংকর প্রিয়ার প্রীতি কামনায় এরূপ বলেছিলেন–এরপর যে পুরুষ এখানে প্রবেশ করবে, সে তৎক্ষণাৎ স্ত্রী হবে। এর পর হতে পুরুষগণ সেই বন পরিত্যাগ করেছে। এদিকে স্ত্রীমূর্তিধারী সুদ্যুম্ন স্ত্রীমূর্তিধারী অনুচরগণের সহিত বন হতে বনান্তরে বিচরণ করতে লাগলেন।

এক সময় ভগবান বুধ তাকে স্ত্রীগণে পরিবৃত হয়ে নিজ আশ্রম সমীপে ভ্রমণ করতে দেখলেন। দর্শন করামাত্রই বুধের কামোদ্ভব হল এবং সেই সুদ্যুন্ম যিনি মনোহর রূপিণী হয়েছিলেন, তিনিও চন্দ্রের পুত্র সেই বুধকে নাতিরূপে কামনা করলেন। অনন্তর বুধ তার গর্ভে পুরুরবা পুত্ররূপে উৎপাদন করেছিলেন। আমরা শুনেছিমনুপুত্র রাজা সুদ্যুম্ন এইরূপে স্ত্রীত্ব প্রাপ্ত হয়ে কুলগুরু বশিষ্ঠকে স্মরণ করেছিলেন, তখন বশিষ্ঠদেব সুদ্যুম্নের এরূপ অবস্থা লক্ষ্য করে অত্যন্ত পীড়িত হয়ে কৃপাবশতঃ তার পুরুষত্ব কামনাপূর্বক ভগবান শংকরের আরাধনা করেছিলেন। হে মহারাজ, তৎকালে ভগবান শংকর বশিষ্ঠদেবের প্রীতিসাধন ও নিজবাক্যের সত্যতা রক্ষা করে এরূপ বলেছিলেন–হে ঋষিপ্রবর, তোমার গোত্ৰজাত এই সুদ্যুম্ন এক মাস পুরুষ এবং একমাত্র স্ত্রী হবে, আর এরূপ ব্যবস্থা ক্রমেই সে ইচ্ছানুসারে এই পৃথিবী পালন করুক।

হে রাজন, ঐ প্রকারে কুলাচার্য বশিষ্ঠদেবের অনুগ্রহে সুন্ম পুনরায় পুরুষত্ব লাভ করে ঐ ব্যবস্থাক্রমে পৃথিবী পালন করেছিলেন, কিন্তু যখন তিনি স্ত্রীভাব প্রাপ্ত হতেন, তখন লজ্জায় লুক্কায়িত থাকতেন বলে প্রজাগণ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয় নাই। যা হোক, হে মহারাজ সুদন্মের ধর্মপরায়ণ তিন পুত্র–উকল, ময় ও বিমল। তারা দক্ষিণাপথের রাজা হয়েছিলেন। তারপর বৃদ্ধবয়সে প্রতিষ্ঠানশুরের অধিপতি রানি সুদ্যুম্ন পুত্র পুরুরবাকে রাজ্য প্রদান করে বনে গমন করেছিলেন।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়
পৃষধর, কবি প্রভৃতির বংশবিস্তার কথন

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজ, নিজ পুত্র সুদ্যুম্ন ঐ প্রকারে বনে চলে গেলে, বৈবস্বত মনু পুত্র কামনা করে শত বছর যমুনার নিকটে তপস্যা করেছিলেন। তারপর মনু পুত্র লাভের জন্য প্রভু শ্রীহরির উপাসনা করে নিজের তুল্য ইক্ষবাকু প্রভৃতি দশটি পুত্র লাভ করেন। মনুর পৃষ নামে যে পুত্র হয়েছিল গুরু বশিষ্ঠ তাকে গোরক্ষায় নিযুক্ত করেছিলেন, অতএব সেই পুত্র বীরাসন (খড়হস্ত হয়ে রাত্রি জাগরণরূপ) ব্রত অবলম্বনপূর্বক রাত্রিকালে অবহিত হয়ে গো রক্ষা করতেন। একদিন রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল, এমন সময় একটি বাঘ এসে গোষ্ঠে প্রবেশ করলে শয়নরত গো-সমূহ ভীত হয়ে গোষ্ঠের মধ্যে ইতস্ততঃ বিচরণ করতে লাগল। তৎকালে বলবান ব্যাঘ্র একটি গাভীকে ক্ষমতাবলে গ্রহণ করে পলায়ন করতে থাকলে, সেই গাভী ভয়ে কাতর হয়ে চিৎকার করছিল। তখন পৃষ সেই চিৎকার শুনে সেই অনুগমন করল। রাত্রিতে সে সময় আকাশে তারাগণও মেঘে আচ্ছন্ন থাকায় খড়হস্তে দ্রুতগামী পৃষধ না জেনে ব্যাঘ্র মনে করে অজ্ঞানতঃ ‘একটি কপিলা গাভীর মস্তক ছেদন করেছিলেন। তৎকালে খড়ের অগ্রভাগে আঘাতে সেই ব্যাঘ্রেরও একটি কর্ণ ছিন্ন হলে ব্যাঘ্র অতিশয় ভীত হয়ে রক্তপাত করতে করতে সেখানে থেকে পলায়ন করল। শত্রুনাশক পৃষ মনে করেছিলেন, ব্যাঘ্র নিহত হয়েছে, কিন্তু রাত্রি প্রভাত হলে দেখলেন কপিলা নিহত হয়েছে, অতএব তিনি দুঃখিত হলেন।

হে রাজ, যদিও রাজকুমার পৃষর্ধের ঐ অপরাধ অজ্ঞানকৃত, তথাপি কুলাচার্য ধেনু শোকে ব্যাকুল হয়ে তাকে এই বলে শাস্তি দিলেন–”ওরে পাপিষ্ঠ তুই ক্ষুত্রবন্ধু ও নিকৃষ্ট ক্ষত্রিয়ও হতে পারবি না, এই কর্মের জন্য শূদ্র হবি। আচার্য এরূপ অভিশাপ দিলে পৃষপ্ৰ কৃতাঞ্জলিপুট হয়ে তাই স্বীকার করলেন এবং পরে ঊর্ধ্বরে মুনিদের প্রিয় ব্রত ধারণ করলেন। তারপর তিনি সর্বাত্মা বিশুদ্ধস্বরূপ পরম পুরুষ ভগবান বাসুদেবের একনিষ্ঠ ভক্তি যোগ লাভ করে সকল প্রাণীর সুহৃদ ও সমভাবাপন্ন হলেন। এই রপে তিনি লোকসঙ্গ হতে বিমুক্ত শান্তচিত্ত সংযাতন্দ্রিয় পরিগ্রহশূন্য, জ্ঞানতৃপ্ত ও একাগ্ৰমনা হয়ে, যদৃচ্ছালব্ধ দ্রব্য দ্বারা নিজের জীবনধারণপূর্বক পরমাত্মায় চিত্ত সমর্পণ করে জড়, অন্ধ ও বধিরের ন্যায় পৃথিবী পর্যটন করতে লাগলেন। এরূপ আচরণ সম্পন্ন মুনিব্রতাবলম্বী পৃষপ্ৰ এক সময় বনে গিয়ে প্রজ্জ্বলিত দাবানল দেখতে গেলেন এবং সেই অগ্নিতে প্রবেশ পূর্বক কলেবর ভস্মাৎ করে পরম ব্রহ্মপদ লাভ করেছিলেন।

মনুর কনিষ্ঠ পুত্র কবি বিষয়ে নিঃস্পৃহ হয়ে বন্ধু-বান্ধব সহ রাজ্য বিসর্জন করেন। পরে অন্তঃকরণ মধ্যে স্বপ্ৰকাশ পরম পুরুষকে ধারণপূর্বক কৈশোর বয়সেই অরণ্যে প্রবেশ করেছিলেন। সুতরাং তার বংশ বৃদ্ধি হয় নাই। মনুর পুত্র করূষ হতে কারুষ নামে বিখ্যাত ক্ষত্রিয়গণের উৎপত্তি হয়েছিল, তারা উত্তরাপথের রক্ষক, ব্রাহ্মণগণের হিতকারী ও ধর্মানুরাগী ছিলেন। এইরূপ ধৃষ্ট নামক মনুর নাম হতে ধাষ্ট বলে প্রসিদ্ধ ক্ষত্রিয় জাতি উৎপন্ন হয়।

এই ধাষ্টগণ পরে পৃথিবীতে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন। মনুর পুত্র নৃগের বংশে নৃগের পুত্র সুমতি, সুমতির পুত্র ভূতজ্যোতি এবং ভূতজ্যোতির পুত্র বসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বসুর সন্তান প্রতীক, তার পুত্র ওষবান্ ঐ ওষবানেরও ওখবা নামে এক পুত্র এবং ওঘবতী নামে এক কন্যা জন্মে। রাজা সুদর্শন ঐ কন্যার পাণিগ্রহণ করেন।

হে রাজ, নরিষ্যন্ত নামে যে মনুপুত্র তাঁর পুত্র চিত্রসেন? চিত্রসেনের পুত্র ঋক্ষ, ঋক্ষের পুত্র মীঢ়বান, মীঢ়বানের পুত্র পূর্ণ এবং পূর্ণের পুত্র ইন্দ্র সেন, ইন্দ্রসেন হতে বীতিহোত্র, বীতিহোত্র হতে সত্যবা, সত্যশ্রবা হতে উরুবা, উরুবা হতে দেবদত্ত এবং দেবদত্ত হতে ভগবান অস্মি স্বয়ং অগ্নিবেশ নামক পুত্ররূপে উৎপন্ন হন। এই অগ্নিবেশ্যা হতেই অগ্নিবেশ্যায়ন নামে বিখ্যাত ব্রাহ্মণ বংশের সৃষ্টি হয়েছিল। এইরূপে নরিষ্যন্তের বংশ বর্ণিত হল। এরপর দিষ্টের বংশ বলছি শোন।

দিষ্টের পুত্রের নাম নাভাগ, পরে যে নাভাগের কথা বলা হবে ইনি তা হতে ভিন্ন। ইনি কর্মদ্বারা বৈশ্বত্ব প্রাপ্ত হন। ইহার পুত্র ভলন্দন এবং ভলন্দনের পুত্র বৎসপ্রীতি, বৎসপ্রীতির পুত্র প্রাংশু, প্রাংশুর পুত্র প্রমতি, প্ৰমতির পুত্র খনি, খনিত্রের পুত্র চাক্ষুস এবং চাক্ষুসের পুত্র চিত্রবংশতি। হে মহারাজ, বিবিংশতি পুত্র রম্ভ, রম্ভের পুত্র ধর্মাত্মা খনীনেত্র এবং খনীনেত্রের পুত্র রাজা করন্ধম।

করন্ধমের পুত্রের নাম অবিক্ষিৎ, অবিক্ষিতের পুত্র মরুত্ত সার্বভৌম নরপতি ছিলেন। মহাযোগী অঙ্গিরার পুত্র সংবর্ত এই মরুত্তকে যজ্ঞ করিয়েছিলেন। মরুত্তের যজ্ঞের মত আর যজ্ঞ হয়নি। যজ্ঞে ব্যবহার্য দ্রব্যাদি সমস্ত কিছুই স্বর্ণময় ও সুশোভন ছিল। মরুত্তের যজ্ঞে দেবরাজ ইন্দ্র প্রচুর সোমরস এবং যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণগণ প্রচুর দক্ষিণালাভ করে অতিশয় হৃষ্ট হয়েছিলেন। মরুদগণ সেখানে পরিবেশক এবং বিশ্বদেবগণ সভাসদ ছিলেন।

মরুত্তের পুত্র দম, তার পুত্র রাজরর্ধন, তার পুত্র সুধৃতি, সুধৃতির তনয় নর, তার পুত্র কেবল, তার হতে ধুন্ধুমান উৎপন্ন হন। ধুন্ধুমানের তনয় বেগবান, তাঁর পুত্রবধূ এবং তার সন্তান রাজা তৃণবিন্দু নানা সগুণের আধার ছিলেন বলে শ্রেষ্ঠা অপ্সরা অলম্বষাদেবী তাঁর ভজনা করলে তার গর্ভে কয়েকটি পুত্র এবং ইয়বিলা নামে এক কন্যার জন্ম হয়। পুলস্ত্যপুত্র যোগেশ্বর বিশ্রবা ঋষি পিতার নিকট হতে পরম বিদ্যা লাভ করে এই ইলবিলার গর্ভে কুবেরকে পুত্ররূপে জন্ম দিয়েছিলেন। অলম্বুষার গর্ভে তৃণবিন্দুর পুত্রগণের নাম-বিশাল, শূন্যকহু ও ধূম্রকেতু। এদের মধ্যে রাজা বিশালাই বংশরক্ষক ছিলেন এবং তিনিই বৈশালী পুরী নির্মাণ করেন। বিশালের পুত্র হেমচন্দ্র, হেমচন্দ্রের পুত্র ধূম্রাক্ষ এবং ধূম্রাক্ষের পুত্র সংযম হতে কৃশাশ্ব ও দেবজ নামক দুই পুত্র জন্মগ্রহণ করেন।

কৃশাশ্বের পুত্রের নাম সোমদত্ত, ইনি অনেক অশ্বমেধ যজ্ঞের দ্বারা যজ্ঞপতি পরমপুরুষ শ্রীহরির আরাধনা করে যোগীন্দ্র গণের প্রাপ্য উত্তম গতি লাভ করেছিলেন। সোমদত্তের পুত্র সুমতি এবং সুমতির পুত্র জনমেজয়। বিশালের বংশে উৎপন্ন এই সকল রাজা মহারাজা তৃণবিন্দুর যশ ধারণ করেছিলেন (অর্থাৎ তার মত যশস্বী হয়েছিলেন।)

.

তৃতীয় অধ্যায়
শর্যাতির কন্যা সুকন্যা এবং রেবতের পৌত্রী রেবতীর চরিত্র বর্ণনা

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, মনুপুত্র শর্যাতি ব্ৰক্ষিষ্ঠ (অর্থাৎ বেদার্থ তত্ত্বজ্ঞ) রাজা ছিলেন। তিনি আঙ্গিরাদের সত্রে দ্বিতীয় দিবসের করণীয় কর্ম সমূহের উপদেশ করেন। তার সুকন্যা নামে একটি কমললোচনা কন্যা ছিল। একদিন রাজা শর্যাতি কন্যার সহিত বনে গিয়ে চ্যবন মুনির আশ্রমে প্রবেশ করলেন। রাজকন্যা সুকন্যা সখীগণে পরিবৃত হয়ে বৃক্ষ হতে দ্বারাপুদি চয়ন করতে করতে এক স্থানে বাল্মীকের ছিদ্র মধ্যে খদ্যোতের (জোনাকী পোকার) মত দুটি জ্যোতি দেখতে পেলেন। তা দেখে রাজকন্যার অতিশয় কৌতূহল জন্মিল। তারপর সেই কন্যা যেন দৈবপ্রেরিত হয়ে অজ্ঞানতা বশতঃ একটা পলাশ গ্রহণ করে ঐ জ্যোতিপুঞ্জ দুটি বিদ্ধ করলে, তা থেকে অবিশ্রান্ত রুধির নির্গত হতে লাগল।

তৎক্ষণাৎ রাজার সৈন্য সামন্তের মলমূত্র নিরুদ্ধ হল। রাজর্ষি শর্যাতি বিস্মিত হয়ে নিজের অনুচরগণকে জিজ্ঞাসা করলেনতোমরা কোনভাবে ভৃগু নন্দন মহর্ষি চ্যবনের নিকট কোন অপরাধ কর নাই তো? আমার মনে হচ্ছে, আমাদের মধ্যে কেউ তার আশ্রম দূষিত করে থাকবে।

তখন সুকন্যা ভীত হয়ে পিতাকে বলল–পিতা আমি কিছু করেছি, না জেনে একটা কণ্টক দিয়ে দুটি জ্যোতিঃপদার্থ বিদ্ধ করেছি। কন্যার সেই কথা শুনে শর্যাতি ভীত হয়ে বাল্মীকের মধ্যে প্রচ্ছন্নরূপে অবস্থিত চ্যবন মুনিকে ধীরে ধীরে প্রসন্ন করেছিলেন। তখন মুনির অভিপ্রায় জেনে তার হস্তে কন্যা সম্প্রদান করলেন। তারপর শর্যাতি বিপদ হতে মুক্ত হয়ে মুনিকে সম্ভাষণ পূর্বক তার অনুমতি নিয়ে নিজপুরে প্রত্যাগমন করলেন।

এদিকে সুকন্যা অতিকোপণ চ্যবনকে পতিরূপে লাভ করে, তার চিত্তের অভিপ্রায় জেনে অতি সাবধানে সর্বদা আনুগত্যের দ্বারা তার প্রতি উৎপাদনে প্রবৃত্ত হলেন। কোন এক সময় অশ্বিনীকুমারদ্বয় চ্যবনমুনির আশ্রমে উপস্থিত হলে, মুনি তাদের যথোচিত পূজা করে বললেন–হে প্রভুদ্বয়, আপনারা আমাকে যৌবন দান করুন। যজ্ঞে আপনাদের সোমদানের ব্যবস্থা না থাকলেও আমি যজ্ঞে আপনাদের সোমপূর্ণ পাত্র প্রদান করব। প্রমাদাগণের অভিলষিত যে বয়স ও রূপ, তা আমায় প্রদান করুন।

বিপ্রবর চ্যবনের ঐ বাক্যে স্বর্গবৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয় তাকে অভিনন্দন পূর্বক বললেন–তাই হবে, আপনি এই সিদ্ধ হ্রদে অবগাহন করবেন চলুন। এই বলে অশ্বিনীকুমারদ্বয় সেই জরাজীর্ণ শিরাজালে পরিব্যাপ্ত লোমচর্ম ও পক্ককেশ মুনিকে নিয়ে নিজেরাও সেই হ্রদে প্রবেশ করলেন। কিছু পরে সেই হ্রদ থেকে অতিকমনীয় রমণীগণের প্রিয় তিনটি পুরুষ উত্থিত হলেন। তিনজনেরই গলায় পদ্মমালা, কর্ণে কনককুন্তল এবং তিনজনই সুরূপ ও শোভন বসন পরিধান করেছিলেন। পতিব্রতা সুন্দরী সুকন্যা সূর্যের মত দীপ্তিশীল ও সমান রূপ বিশিষ্ট সেই তিনটি পুরুষকে দর্শন পূর্বক নিজ পতিকে চিনতে না পেরে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের শরণাপন্ন হলেন। (অর্থাৎ আপনারা পৃথক হয়ে আমার পতিকে দেখিয়ে দিন–এই প্রার্থনা করলেন)।

তখন অশ্বিনীকুমারদ্বয় তার পতিব্রতে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে নিজ পতি দেখিয়ে দিলেন এবং পরে ঋষির অনুমতি লয়ে বিমানযোগে স্বর্গলোকে গমন করলেন।

হে রাজন, কিয়ৎকাল পরে রাজা শর্যাতি যজ্ঞ করবেন স্থির করে চ্যবন আশ্রমে গিয়ে দেখলেন কন্যার পার্শ্বে সূর্যতুল্য তেজস্বী এক পুরুষ বসে রয়েছেন। কন্যা পিতার পদবন্দনা করলে রাজা শর্যাতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে কন্যাকে জিজ্ঞাসা করলেন –কি করেছ? তোমার কি অভিপ্রায়? তুমি সর্বলোক পূজত নিজ পতি চ্যবন মুনিকে বঞ্চনা করেছ, যেহেতু তিনি জরাগ্রস্ত, তাই নিজ অত্রিয় স্বামী ত্যাগ করে তুমি এই পতিকে উপপতিকে ভজনা করছ। তুমি সদবংশে জন্মগ্রহণ করেছ, অথচ তোমার বুদ্ধি কিরূপে বিপরীত ভাবে এরূপ জঘন্য কার্যে প্রবৃত্ত হল? তুমি এই যে উপপতি স্বীকার করেছ, এতে তোমার পিতৃকুল এবং স্বামীকুলকে নরকগামী করছ। পিতা এরূপ বলতে আরম্ভ করলে শুচিস্মিতা সুকন্যা ঈষৎ হাস্য করে বললেন–হে পিতঃ, ইনিই তোমার জামাতা সেই ভৃগুনন্দন মহামুনি চ্যবন। পরে তার যেরূপে রূপযৌবন লাভ হয়, সে সকল কথা পিতার নিকট বর্ণনা করলেন। তা শুনে রাজা শর্যাতি বিস্মিত ও প্রীত হয়ে কন্যাকে আলিঙ্গন করলেন।

তারপর মহর্ষি চ্যবন বীর শানতকে সোমথাগ করাতে প্রবৃত্ত, বিস্মিত ও প্রীত হয়ে কন্যাকে আলিঙ্গন করলেন।

তারপর মহর্ষি চ্যবন বীর শ্যাতিকে যজ্ঞ করাতে প্রবৃত্ত হয়ে, যজ্ঞে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সোমপানের ব্যবস্থা না থাকলেও নিজের তেজে তাদের সোমপাত্র প্রদান করলেন। কিন্তু ভৃগুনন্দ চ্যবন স্বীয় ব্ৰহ্মতেজে দেবরাজের বর্জ্য সহিত দক্ষিণ হস্ত স্তব্ধ করে দেন। অশ্বিনীকুমারদ্বয় চিকিৎসার বলে পূর্বে সোমযোগ থেকে বহিষ্কৃত অর্থাৎ সোমপানের অনধিকারী থাকলেও, তখন হতে সকল দেবতা তাদের উভয়ের জন্য সোমপাত্র দানে সম্মত হলেন। শর্যাতি হতে উত্তানবৰ্হি, অনার্ত ও ভূরিষেন নামক তিন পুত্রের জন্ম হয়। তাদের মধ্যে অনার্ত হতে রেবত নামক পুত্ৰ উৎপন্ন হয়েছিলেন।

হে অরিন্দম, ঐ রেবত সমুদ্র গর্ভে কুশস্থলী পথে এক নগরী নির্মাণ করে তাতে অবস্থিতি পূর্বক আনর্তাদি দেশ পালন করেছিলেন। তার একশত পুত্র জন্মে, তাদের মধ্যে কুকুষ্মী জ্যেষ্ঠ ও সর্বোত্তম। এক সময় কুকুষ্মী নিজ কন্যা রেবতাঁকে সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মাকে উপযুক্ত বরের কথা জিজ্ঞাসা করার জন্য মুক্ত দ্বার (প্রতিবন্ধক রহিত) ব্রহ্মলোকে গমন করেছিলেন। সে সময় গন্ধর্বগণ তথায় সঙ্গীত আলপি না পেয়ে কুকুষ্মী ক্ষণকাল অপেক্ষা করলেন। পরে অবকাশ পেয়ে প্রণাম পূর্বক নিজের অভিপ্রায় নিবেদন করলেন। ভগবান ব্রহ্মা তা শ্রবণ করে হাস্য সহকারে বললেন–হে রাজন, তুমি পৃথিবী স্থিত যে সকল ব্যক্তিকে মনে মনে কন্যার পর রূপে চিন্তা করেছিলে, কালবশে (কারণ তুমি এখানে আসার পর মনু লোকের পরিমাণে) সপ্তবিংশতি চতুযুগ পরিমিত কাল অতীত হয়েছে।

হে রাজন, সম্প্রতি দেবদেব ভগবানের অংশ মহাবল বলদেব যেখানে আছেন, সেখানে গমন কর এবং তুমি সেই নররত্নকে নিজের কন্যারত্ন প্রদান কর। যার নামাদি শ্রবণ ও কীর্তন পরম পুণ্যজনক সেই জগৎপতি ভগবান পৃথিবীর ভার হরণের জন্য নিজ অংশে অবতীর্ণ হয়েছেন। ব্রহ্মা এরূপ আদেশ করলে রাজা কুকুষ্মী তাকে প্রণাম করে নিজ পুরীতে প্রত্যাগমন করলেন। তৎকালে তার ভ্রাতৃগণ যক্ষগণের ভয়ে সেই স্থান ত্যাগ করে নানা স্থানে বাস করছিলেন। তারপর রাজা কুকুষ্মী বলশালী বলদেবকে আনন্দময়ী মনোরমা নিজ কন্যা সম্প্রদান করে, তপস্যার জন্য নারায়ণ শ্রম বদরিকাক্ষেত্রে গমন করেছিলেন।

.

চতুর্থ অধ্যায়
নভাগচরিত কথন ও অম্বরীষের উপাখ্যান

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, মনুপুত্র নভগ, নভগের কনিষ্ঠ পুত্রের নাম নাভাগ। (তিনি দীর্ঘকাল গুরুকুলে বাস করায় তাকে নৈষ্টিক ব্রহ্মচারী মনে করে তার সহোদর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃগণ পিতার সম্পত্তি থেকে তাকে বাদ দিয়ে ভাগ করে নিয়েছিলেন)। দীর্ঘদিন পর ব্রহ্মচার্য সমাপন করে গুরুগৃহ হতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করতঃ নাভাগ নিজের ভাগ চাইলেন।

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃগণ জ্ঞানী কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে তার প্রাপ্য ভাগরূপে পিতাকেই দান করলেন। নাভাগ পিতার নিকট গিয়ে বললেন–পিতঃ আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃগণ আপনাকেই আমার ভাগরূপে নির্দিষ্ট করেছেন। পিতা নভগ ইহা শুনে বললেন–পুত্র, তুমি তাদের প্রতারণা বাক্যে বিশ্বাস করো না, কারণ আমি সম্পত্তির মত ভোগ্যবস্তু নই। তথাপি তারা যেহেতু আমাকে তোমার প্রাপ্য ভাগরূপে দান করেছে, অতএব আমি তোমার জীবিকার নির্দেশ করছি। হে বিদ্বান, অঙ্গিরার সন্তানগণ এখন যজ্ঞ করছেন।

তারা যদিও অতিশয় মেধাবী তা হলেও ছয়দিনে সম্পদনীয় বিভিন্ন যজ্ঞীয় কর্মের অনুষ্ঠানকালে মন্ত্র বিশেষ না জানায়, প্রতি কর্মের ষষ্ঠ দিবসীয় কর্মের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে তারা মুগ্ধ হচ্ছেন। তুমি গিয়ে সেই মহাত্মাদের বৈশ্বদেব সম্বন্ধীয় দুটি সূক্ত পাঠ করাও। কর্ম সমাপ্ত হলে যখন তারা স্বর্গে গমন করবেন, তখন যজ্ঞের অবশিষ্ট ধন অবশ্য তোমাকে দিয়ে যাবেন, তুমি এখনি তাঁদের নিকট গমন কর। নাভাগ পিতার উপদেশ অনুসারে সেরূপ কার্য করলেন, অঙ্গিরার সন্তানগণ যজ্ঞের অবশিষ্ট ধন তাকে দান করে স্বর্গলোকে গমন করলেন।

তারপর নাভাগ যখন সেই সমস্ত ধন গ্রহণ করতে উদ্যত হন, তখন কৃষ্ণকায় কোনও এক পুরুষ (শ্রীরুদ্র) উভয় দিক হতে এসে বললেন–এই যজ্ঞক্ষেত্রস্থিত ধন আমার। তখন নাভাগ বললেন–এ ধন আমার, এখুনি ঋষিগণ আমাকে দিয়ে গেলেন। তখন সেই পুরুষ (শ্রীরুদ্র) বললেন–আমাদের এ বিবাদে তোমার পিতাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে এস, এ বস্তু কার?

তখন নাভাগ পিতার নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। পিতা নভগ বললেন–হে বৎস! প্রজাপতি দক্ষের যজ্ঞকার্যে যে সকল বস্তু উদ্বৃত্ত হয়েছিল, ঋষিগণ যজ্ঞভূমিগত তৎসমুদায় ভগবান রুদ্রের ভাগ বলে নির্দিষ্ট করেছিলেন, বিশেষতঃ সেই রুদ্রদেবই জগতের সকল বস্তুর অধিকারী, এতে যজ্ঞবশিষ্ট কথা কি? তখন নাভাগ সেই পুরুষের (রুদ্রের) নিকট এসে প্রণাম করে বললেন– হে ইশ, যজ্ঞভূমিগত এ সমস্ত ধন আপনারই একথা আমার পিতা বললেন। হে ব্ৰহ্মণ, আমি মস্তক নত করে আপনাকে প্রসন্ন করতে ইচ্ছা করছি।

নাভাগের কথায় তুষ্ট হয়ে শ্রীরুদ্র বললেন– যেহেতু তোমার পিতা যথার্থ ধর্মের কথা বলেছেন এবং তুমিও সত্য কথা বলছ, সেইহেতু তুমি মন্ত্রদশী। তোমাকে জ্ঞানরূপ সনাতন ব্রহ্ম প্রদান করছি। আর এই যজ্ঞাবশিষ্ট এই ধন আমি তোমাকে দিলাম, তুমি গ্রহণ কর।

এই কথা বলে ধর্মবৎসল ভগবান রুদ্র অন্তর্হিত হলেন। হে মহারাজ, যিনি সকাল ও সন্ধ্যাকালে সংযত চিত্তে ইহা স্মরণ করবেন, তিনি জ্ঞানবান ও মন্ত্রজ্ঞ হয়ে আত্মার সদ্গতি লাভ করবেন।

যা হোক, নাভাগ হতে মহাভাগবত ও পরম নিপুণ অম্বরীষের জন্ম হয়। যে ব্রহ্মশাপ কখনও প্রতিহত হয় না তাও (অর্থাৎ ব্রহ্মকর্তৃক নির্মিত কৃত্যরূপ অনন্ত) তাকে স্পর্শ করতে পারে নাই। রাজা পরীক্ষিৎ বললেন–হে ভগবন, দুল্য ব্রহ্মদণ্ড যাঁর প্রতি প্রযুক্ত হয়ে নিজ শক্তি প্রকাশে সমর্থ হয়নি, সেই ধীমান রাজর্ষি অম্বরীষের কথা শুনতে ইচ্ছা করি।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, মহাভাগ অম্বরীষ সপ্তদ্বীপ যুক্ত পৃথিবী, অক্ষয় সম্পদ এবং লোকসমূহের অতি দুর্লভ অতুলনীয় ঐশ্বর্য লাভ করেও, বৈভবের নশ্বরতা জেনে, যে বিভব দ্বারা ও বিভবের নাশ হেতু মানুষ মোহগ্রস্ত হয়, সেই বিভব রাশিকে স্বপ্নের মত তুচ্ছজ্ঞান করেছিলেন।

তিনি ভগবান বাসুদেব এবং তাঁর ভক্ত সাধুগণের প্রতি পরম ভাব (ভক্তি) লাভ করেছিলেন। যার ফলে এই বিশ্ব তাঁর নিকট লোষ্ট্রের মত তুচ্ছ মনে হত। যাতে ভগবান শ্রীহরির ভক্তগণের প্রতি অনুরাগের ফলে উৎপন্ন হয়, মহারাজ অম্বরীষ সে ভাবেই নিজ চিত্তকে শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মযুগলে সমর্পণ করেছিলেন।

এইরূপে বৈকুণ্ঠ গুণাগুণবর্ণনে বাক্য সকলকে নিয়োগ করেছিলেন, শ্রীহরির মন্দির মার্জনাদি কার্যে করদ্বয় ব্যাপৃত করেছিলেন। আর নয়নদ্বয়কে শ্রীভগবদ বিগ্রহের অধিষ্ঠানক্ষেত্র সমূহের দর্শনে, আলিঙ্গন ক্রিয়াকে ভগবদ ভক্তজনের অঙ্গসঙ্গে, নাসিকাকে ভগবানের পাদপদ্মের সংসর্গহেতু সদগন্ধযুক্ত তুলসীর সৌরভগ্রহণে, জিহ্বাকে ভগবনের প্রতি নিবেদিত অন্নাদির আস্বাদনে তৎপর করেছিলেন। আর পদযুগলকে ভগবান হরির ক্ষেত্রে (ধর্মাদি ও মন্দিরাদি) পরিক্রমায়, মস্তককে তার শ্রীপাদ পদ্মের প্রণামকার্যে এবং কাম অর্থাৎ মাল্য চন্দনাদি সেবাকে ভগবানের প্রসাদিকৃত মাল্যচন্দনাদির গ্রহণেই নিযুক্ত করেছিলেন কিন্তু বিষয়ভোগের জন্য কামনা করেন নাই।

এইরূপে তিনি সর্বত্র আত্মচিন্তামূলক নিজ সকল কার্যই সর্বদা সর্বযজ্ঞের অধিষ্ঠাতা ও অর্ধেক্ষজ (অর্থাৎ সকল ইন্দ্রিয়ের অগোচর) ভগবানে সম্পর্ক করে ভগবদ্ভক্ত ব্রাহ্মণগণের উপদেশ অনুসারে রাজ্য পালন করতেন। তিনি জনশূণ্য দেশে সরস্বতী নদীর স্রোতের প্রতিকূলে বহু অশ্বমেধ যজ্ঞ দ্বারা যজ্ঞাধিষ্ঠাতা পরমেশ্বর শ্রীহরির আরাধনা করেছিলেন।

বশিষ্ঠ, অসিত, গৌতম প্রভৃতি ঋষিগণের সাহায্যে সেই সকল সুবিস্তৃত যজ্ঞ সম্পাদিত করেছিলেন এবং যজ্ঞসমূহের অঙ্গীভূত ক্রিয়া-সমুদয় ও দক্ষিণা তার মহাবৈভব দ্বারা সংবর্ধিত হয়েছিল। তাঁরা যজ্ঞসমূহে মনোরম বস্ত্র বিভূষিত সদস্য ও ঋত্বিগণকে দেবগণের সাথে তুল্য রূপে. তাদের দেখা গিয়েছিল, দেবগণের চক্ষুর নিমেষ না থাকার জন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে সত্য, তথাপি এস্থলে ঋত্বিক ও সদস্যদের যজ্ঞ কর্মাদির দর্শনে চক্ষুর নিমেষ না থাকায় তারা সমরূপ হয়েছিলেন (অর্থাৎ অনিমেষ নয়নে তাঁরা যজ্ঞাদি দর্শন করায়, তাদের দেবতা বলে মনে হচ্ছিল।

সব সময় উত্তমশ্লোক ভগবান শ্রীহরির লীলাদি শ্রবণ ও কীর্তনে রত থাকায় অম্বরীষ মহারাজের কোন নিজ জনও দেবতাগণের প্রিয় স্বর্গলোকের কামনা করত না, এতে অম্বরীষের যে স্বর্গ কামনা ছিল না তা আর বেশি কি? তিনি সর্বদা হৃদয় মধ্যে ভগবান শ্রীহরিকে প্রত্যক্ষ করতেন বলে, সিদ্ধগণের পক্ষেও দুর্লভ এবং স্বরূপ সুখ দ্বারা সংবর্ধিত বিষয় সমূহও তাদের আনন্দ দান করতে পারে নি।

যা হোক মহারাজ অম্বরীষ ঐ প্রকার ভক্তিযোগ ও তপস্যাযুক্ত স্বধর্মদ্বারা ভগবান হরির প্রীতি উৎপাদন করতঃ ক্রমে ক্রমে সমস্ত অভিলাষ পরিত্যাগ করেন। এইরূপে তার কলত্র, পুত্র, মিত্র, গৃহ, হস্তী, উত্তম, রথ, অশ্ব, অক্ষৰ্য্য, রত্ন, বসন, ভূষণাদি অন্ত ধনভাণ্ডারের প্রতি উপেক্ষা জন্মেছিল, ভগবান হরি তার একনিষ্ঠ ভক্তিভাবে প্রীত হয়ে তাঁকে ভক্তগণের রক্ষক ও প্রতিপক্ষ সৈন্যদের ভয়জনক সুদর্শনচক্র প্রদান করেছিলেন।

হে মহারাজ, সেই অম্বরীষ রাজা সর্বসময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনার বাসনায় তুল্যশীল স্বীয় মহিষীর সহিত মিলিত হয়ে সংবৎসর যাবৎ দ্বাদশী ব্রত ধারণ করেছিলেন। তিনি ব্রত সমাপ্তির পর কার্তিক মাসে ত্রিরাত্র উপবাসী থেকে একদিন যমুনায় স্নান করে মধুবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজায় প্রবৃত্ত হলেন।

মহভিষেকের বিধান অনুসারে সর্বপ্রকার উপচার দিয়ে অভিষেক করে; বসন, ভূষণ, গন্ধ ও মাল্যাদির দ্বারা একাগ্রমনে ভগবান কেশবের পূজা করলেন। তারপর যে সকল ব্রাহ্মণ আপ্তকাম বলে পূজা প্রার্থী নন, ভক্তিসহকারে সেইরূপ মহাভাগ্যবান ব্রাহ্মণগণেরও পূজা করলেন।

পরে তিনি সাধু ব্রাহ্মণদের স্বর্গশৃঙ্গ রৌপ্য খুর যুক্তা উত্তম বস্ত্রাচ্ছাদিতা এবং দুগ্ধ, চরিত্র, রূপ ও বয়স প্রভৃতি সম্পন্ন ষাট কোটি ধেনু দান করলেন। এরপর তিনি ব্রাহ্মণদের উৎকৃষ্ট সুস্বাদু অন্ন ভোজন করিয়ে তাদের অনুমতি গ্রহণপূর্বক নিজে জলপানের উপক্রম করলেন।

হে রাজন, রাজা অম্বরীষ পারণ করতে যাবেন, এমন সময় ভগবান দুর্বাসা ঋষি অতিথিরূপে তাঁর গৃহে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে রাজা পারণের উদ্যম পরিত্যাগ পূর্বক তৎক্ষণাৎ সমাগত সেই অতিথিকে অভ্যর্থনা, আসন ও বিবিধ পূজা দ্রব্য দ্বারা পূজা করে তার পাদমূলে উপস্থিত হয়ে ভোজনের জন্য প্রার্থনা জানালেন।

মহর্ষি দুর্বাসা তার প্রার্থনায় সানন্দে সম্মতি প্রদানপূর্বক নিয়মানুযায়ী মাধ্যাহ্নিক কর্ম সম্পাদনের জন্য প্রস্থান করলেন এবং যমুনায় গিয়ে ব্রহ্মচিন্তা করতঃ সেখানে পবিত্র জলমধ্যে নিমগ্ন হয়ে রইলেন।

এদিকে দ্বাদশী তিথির আর অর্ধ মুহূর্তমাত্র অবশিষ্ট আছে। এর মধ্যে পারণ না করলে ব্ৰতবৈগুণ্য হয়, ধর্মজ্ঞ রাজা অম্বরীষ ধর্মসংকটে পতিত হয়ে ব্রাহ্মণদের সহিত বিবেচনা করতে লাগলেন। তিনি তখন বিবেচনা করলেন ব্রাহ্মণকে লঙঘন করলে (অর্থাৎ অতিথিরূপে নিমন্ত্রিত দুর্বাসার ভোজন না করিয়ে নিজে ভোজন করলে) যেরূপ দোষ হয়, তার থেকে দ্বাদশীতে পারণ না করলেও সেরূপ দোষ ঘটে।

এ অবস্থায় যা করলে আমার কল্যাণ হয় এবং আমাকে কোন দোষ স্পর্শ না করে ব্রাহ্মণগণের সহিত এরূপ বিচারপূর্বক তিনি স্থির করলেন যে–আমি কেবলমাত্র কিঞ্চিৎ জল দ্বারাই পান করব, যেহেতু জলমাত্র ভক্ষণকে বিপ্রগণ ভোজন ও অভোজন দুই বলেছেন। হে কুরুশ্রেষ্ঠ রাজর্ষি অম্বরীষ তখন মনে মনে ভগবান শ্রীহরির ধ্যান করতে করতে জল মাত্র পান করে দুর্বাসার আগমন প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।

তার পরেই দুর্বাসা ঋষি আবশ্যক কর্ম সমাপন পূর্বক যমুনার কূল হতে এসে উপস্থিত হলেন। যদিও রাজা তাঁকে দেখে আনন্দ প্রকাশ করলেন এবং কৃতাঞ্জলী হয়ে সন্মুখে দণ্ডায়মান হলেন, তথাপি তার আচরণ (অর্থাৎ জলপান) দুর্বাসা নিজ বুদ্ধিবলে বুঝতে পারলেন। তখন ক্রোধে তাঁর সর্বশরীর কম্পিত হতে লাগল। নয়নযুগল ভুকুটিহেতু কুটিল ভাব ধারণ করল, বিশেষতঃ তখন ক্ষুধার্ত অবস্থায় মহারাজ অম্বরীষ কৃতাঞ্জলী হলেও তিনি এরূপ বলতে লাগলেন–অহো, এ ব্যক্তি কি নৃশংস! ধনসম্পত্তির মদে অতিশয় মত্ত হয়েছে, এ আর এখন বিষ্ণুভক্ত নয়। নিজেকে স্বতন্ত্র ঈশ্বর বলে মনে করে। এর ধর্মব্যতিক্রম দেখ। তারপর অম্বরীষকে লক্ষ্য করে বললেন–আমি অতিথিরূপে উপস্থিত হলে, আতিথ্য বিধান অনুসারে আমাকে নিমন্ত্রণ করেও তুমি আমাকে ভোজন না করিয়ে স্বয়ং অগ্রে ভোজন করেছ। অতএব আমি সত্যিই এর ফল তোমাক দেখাচ্ছি।

এইরূপ বলতে বলতেই ক্রোধোদ্দীপ্ত দুর্বাসা ঋষি মস্তক হতে একগাছি জটা উৎপাদন পূর্বক তাতে রাজার প্রতিকূলে কানাসতুল্য একটা কৃত্যা (মারণাত্মিকা দেবতা) নির্মাণ করলেন। মহারাজ অম্বরীষ সেই কৃত্যাকে অসিহস্তে পদভরে ভূমিতল কম্পিত করে, জ্বলন্ত আকারে নিজের দিকে আসতে দেখেও নিজের স্থান হতে কিঞ্চিন্মাত্র বিচলিত হলেন না। তারপর অগ্নি যেমন ক্রুদ্ধ সর্পকে দগ্ধ করে, তেমনি ।

মহাপুরুষ ভগবান শ্রীহরি কর্তৃক ভক্তের রক্ষার জন্য পূর্ব হতে নির্দিষ্ট সেই সুদর্শন চক্র ঐ কৃত্যাকে দগ্ধ করে ফেলল। তারপর ঋষি দুর্বাসা নিজের প্রয়াস নিষ্ফল হতে এবং সুদর্শন চক্রকে নিজের দিকে আসতে দেখে ভীত হয়ে প্রাণরক্ষার জন্য চারদিকে ধাবিত হলেন।

প্রজ্বলিত শিখাবিশিষ্ট দাবানল যেরূপ সর্পকে গ্রাস করার জন্য তার দিকে অগ্রসর হয়, সেরূপ ভগবানের চক্র পলায়মান ঐ ঋষির পশ্চাৎ ধাবমান হল। আর দুর্বাসাও তাকে পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসতে দেখে গুহায় প্রবেশ করতে ইচ্ছুক হয়ে সুমেরুর দিকে ধাবিত হলেন। এইরূপে তিনি দিমণ্ডল, আকাশ, পৃথিবী, পাতাল, সমুদ্র এবং লোকপাল সহ লোকসকলেও স্বর্গে গমন করলেন। কিন্তু যে যে স্থানে তিনি যান, সেই সেই স্থানেই চক্রকে দেখতে লাগলেন।

এইরূপ তিনি সন্ত্রস্তচিত্তে সর্বত্র আশ্রয় অন্বেষণ করেও যখন কোথাও নিজের রক্ষক কাউকে পেলেন না, তখন ব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন–হে বিধাতঃ, আপনি সাক্ষাৎ বিষ্ণুর তেজঃস্বরূপ এই সুদর্শন চক্র হতে আমাকে রক্ষা করুন।

শ্রীব্রহ্মা বললেন–ঋষি, দুই পরার্ধ সংবৎসর কাল পরে ক্রীড়ার অবসান হলে (অর্থাৎ বিশ্বের পালন লীলা সমাপ্ত হলে) যে, বিষ্ণু যখন কালরূপে এই নিখিল ব্রহ্মাণ্ডদাহের ইচ্ছা করবেন, তখন তার ভুভঙ্গী মাত্রেই বিশ্বের সহিত আমার এই ব্রহ্মলোক অন্তর্হিত হবে। আর আমি (ব্রহ্মা) শংকর, দক্ষ, ভৃগু প্রভৃতি এবং প্রজাপতিগণ ভূতপতি গণ ও দেবেন্দ্র প্রমুখ আমরা সকলে যাঁর আজ্ঞা প্রাপ্ত হয়ে, যেরূপে লোকহিত হয়; সেইরূপ নিজ নিজ মস্তক দ্বারা নিয়ম সকল বহন করছি, তুমি তাঁর ভক্তদ্রোহী, তোমাকে রক্ষা করতে আমার সামর্থ্য নেই। ব্রহ্মার নিকট হতে এরূপে প্রত্যাখ্যাত হয়ে, সুদর্শন চক্র দ্বারা পরিপীড়িত ঋষি দুর্বাসা কৈলাসবাসী ভগবান শংকরের শরণাপন্ন হলেন।

শ্ৰীশংকর বললেন–হে বৎস, আমরা লোক পালকত্বের অভিমানী হয়ে যে সকল ব্রহ্মাণ্ডে বিচরণ করি, জীবরূপী ব্রহ্মার উপাধিস্বরূপ এরূপ আরও অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড বিগ্রহ যাঁর মধ্যে যথাকালে উৎপন্ন ও বিলীন হয়, সেই ভূমা পুরুষ পরমেশ্বরের উপর আমাদের কোনরূপ প্রভুত্ব নাই। আমি (শংকর), সনকুমার, নারদ, ভগবান ব্রহ্মা, কপিল (যাঁর আন্তরিক তমঃ তপগত হয়েছে), ব্যাসদেব, দেবল, ধর্ম আসুরি এবং মরীচি প্রভৃতি অন্যান্য সিদ্ধেশরগণ-আমরা সকলে সর্বজ্ঞ হয়েও যাঁর মায়া জানতে পারি নাই পরন্তু তার মায়ায় অভিভূত হয়ে রয়েছি, সেই বিশ্বেশ্বর শ্রীহরির এই সুদর্শন চক্র আমাদের নিকট অতি দুঃসহ, অতএব তুমি তারই শরণাগত হও, সেই শ্রীহরিই তোমার মঙ্গল করবেন।

রাজ, দুর্বাসা এই প্রকারে শংকরের নিকর্য ও নিরাশ হয়ে ভগবন্ধাম বৈকুণ্ঠে গমন করলেন। সেখানে লক্ষ্মীদেবীর সহিত শ্রীহরি–বিরাজ করছিলেন। ঐ ঋষি ভগবৎ পাদমূলে পতিত হয়ে কম্পিত কলেবরে বললেন–হে অচ্যুত, হে অনন্ত, হে সাধুজনের কাঙিক্ষত, প্রভো, আমি মহৎ অপরাধ করেছি, হে বিশ্বভাবন, আমাকে রক্ষা করুন। হে প্রভো, আপনার পরম অনুভব না জেনে, আপনার প্রিয় ভক্তগণের অনিষ্ট করেছি, হে বিধাতঃ আমার এই অপরাধের নিষ্কৃতি বিধান করুন। হে ভগবান, আপনার ভক্তাদোহীর নিষ্কৃতি নেই এরূপ বলতে পারেন না, কারণ, যাঁর নামমাত্র কীর্তনে নরকস্থ প্রাণীও মুক্তিলাভ করে, সেই আপনার পক্ষে কোন কার্যই অসাধ্য নয়।

শ্রীভগবান বললেন–হে দ্বিজ, আমি ভক্তের অধীন বলে স্বয়ং অস্বতন্ত্রের তুল্য উত্থান আমার প্রিয় এজন্য সাধু ভক্তগণ আমার হৃদয় গ্রাস করেছে। হে ব্ৰহ্মণ, আমিই যাঁদের পরম গতি, সেই সমস্ত সাধু ভক্তজন ব্যতীত আমি নিজের আত্মাকে এবং আজন্তিকী শ্রীকেও (অর্থাৎ তা ব্যভিচারিণী লক্ষ্মীকেও) আকাঙ্ক্ষা করি না।

যে সকল ব্যক্তি পুত্র, কন্যা, গৃহ, স্বজন, ধন, প্রাণ এবং ইহলোক ও পরলোক সব কিছু পরিত্যাগ করে আমার শরণাপন্ন আমি তাদের পরিত্যাগ করতে কি প্রকারে উৎসাহী হতে পারি? সতী রমণীগণ যেরূপ স্বামীদিগকে বশীভূত করে, আমার প্রতি আবদ্ধচিত্ত সমদর্শী সাধুগণও সেরূপ ভক্তির দ্বারা আমাকে বশীভূত করেন, আমার সেবার দ্বারা যারা পরিপূর্ণ (অর্থাৎ পরিতৃপ্ত), আমার সেই ভক্তগণ আমার সেবার ফলে ভাগবৎ মুক্তি চুতষ্ঠয় প্রাপ্ত হলেও তা গ্রহণ করতে ইচ্ছা করেন না, এ অবস্থায় যা কালনাশও (অর্থাৎ কালবশতঃ বিনশ্বর, সে রূপ স্বর্গাদি বিষয় তারা কিরূপে ইচ্ছা করতে পারেন, সাধুগণই আমার হৃদয় এবং আমিই সাধুগণের হৃদয় স্বরূপ, অতএব তারা আমা ভিন্ন কিছুই জানেন না এবং আমিও সাধুগণ ব্যতীত অপর কিছুমাত্র জানি না।

হে বিপ্র, আমি তোমায় উপায় বলছি, শোন। তোমার এই হিংসা যাঁহা হতে জন্মেছে তুমি সত্বর তারই শরণাগত হও। সাধুগণের প্রতি কোন তেজ প্রয়োগ করলে উহা প্রয়োগকারীই অমঙ্গল সাধন করে।

ব্রাহ্মণগণের তপস্যা ও বিদ্যা (জ্ঞান)–এই উভয়ই নিঃশ্রেয়স্বার (অর্থাৎ নিরতিশয় পুরুষার্থ –সাধন মুক্তিজনক) বটে, কিন্তু দুর্বিনীত বার্তার পক্ষে এ দুটিই বিপরীত ফল দান করে। হে ব্ৰহ্মণ, তুমি নাম্নী নাভাগ, রাজা অম্বরীষের নিকট গমন কর, তোমার মঙ্গল হোক। সেই মহাভাগ্যবান যাতে ক্ষমা করেন, তুমি তাই কর এবং তা হলেই তোমার শান্তিলাভ হবে।

.

পঞ্চম অধ্যায়
অম্বরীষের অনুগ্রহে দুর্বাসার দুঃখ নিবৃত্তি এবং দুর্বাসা কর্তৃক অম্বরীষের প্রশংসা

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, ভগবান হরি এরূপ আদেশ করলে চক্ৰাপিত দুর্বাসা দুঃখিত হয়ে মহারাজ অম্বরীষের নিকট এসে তাঁর চরণ গ্রহণ করতে উদ্যত হলেন। দুর্বাসা কর্তৃক পাদস্পর্শহেতু অতিশয় লজ্জিত মহারাজ অম্বরীষ তাঁর এরূপ উদ্যম লক্ষ্য করে কৃপাতুর হয়ে শ্রীহরির অস্ত্র সুদর্শনের স্তুতি করতে লাগলেন।

অম্বরীশ বললেন–হে সুদর্শন, তুমি অগ্নি, তুমিই ভগবান সূর্য, তুমি নক্ষত্ৰসকলের পতি চন্দ্র, তুমিই জল, পৃথিবী, আকাশ বায়ু, পঞ্চতন্মত্র এবং ইন্দ্রিয় বর্গ স্বরূপ অর্থাৎ তোমার শক্তি দ্বারাই অগ্নি প্রভৃতি নিজ নিজ কার্য করছে। হে অচ্যুতপ্রিয় হে সর্বস্ত্র বিনাশক, হে পৃথিবী পালক, তোমাকে নমস্কার করছি, তুমি এই ব্রাহ্মণের রক্ষক হও।

তুমিই ধর্ম, ঋত (সুনৃতা বাণী), সত্য, যজ্ঞ, সর্বজ্ঞভভাক্তা, লোকপাল, সর্বাত্মা এবং তুমি মহাপুরুষ বিষ্ণুর পরম সামর্থ্য স্বরূপ। হে সুলভ, তুমি অদ্ভুতকর্মা, যেহেতু আসান ধর্মের সেতু স্বরূপ, অতএব তুমিই অধর্মরত অসুরদের ধুম্রকেতু অর্থাৎ দাহক, তুমিই ত্রিলোকের রক্ষক। তোমার তেজঃপুঞ্জ অত্যুজ্জ্বল, তুমি মনের তুল্য বেগবান, তোমার স্তব করতে কে সমর্থ হবে? অতএব আমি তোমার প্রতি কেবল নমঃ শব্দ প্রয়োগ করছি।

হে সুদর্শন, তোমার ধর্ম তেজের দ্বারা ভগবতের তমঃ (অন্ধকার বা অজ্ঞান) দূরীভূত হয়েছে এবং মহাত্মাদের দৃষ্টি প্রকাশিত হয়েছে হে বিষ্ণু তোমার মহিমা দুরত্যয়, সৎ-অসৎ পর-অপর ইত্যাদি, সমস্ত পদার্থ তোমারই স্বরূপ, কারণ সূর্যাদির প্রকাশও তোমা হতেই হয়ে থাকে।

হে অজিত, অঞ্জন ভগবান হরি কর্তৃক যখন তুমি বিমুক্ত হও, তখন দৈত্য দানব মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে তাদের বাহু, উদর, উরু, চরণ এবং জানুর সমরাঙ্গণে বিরাজ করে থাক।

হে জগতের রক্ষক তুমি সর্বসহ, উপবান গদাধর তোমাকে খল ব্যক্তিদের প্রহারের জন্যেই নিযুক্ত করেছেন। অতএব, আমাদের কুলের সৌভাগ্য লাভের জন্য এই বিপন্ন ব্রাহ্মণের মঙ্গল বিধান কর।

এতেই আমাদের প্রতি মহান অনুগ্রহ বিস্তার করা হবে। হে সুদর্শন, যদি আমার কোন দান অথবা যজ্ঞ জন্য সুকৃত থাকে, যদি আমি স্বধর্মের সুন্দররূপ অনুষ্ঠান করে থাকি, আর আমাদের কুলদেবতা যদি বিপ্র হন, তা হলে এই ব্রাহ্মণ সন্তান মুক্ত হউন। সকল প্রাণীগণের প্রতি আমাদের আত্মরৎ জ্ঞান থাকায়, সর্বগুণাধার অদ্বিতীয় ভগবান যদি আমাদের প্রতি প্রীত হয়ে থাকেন, তা হলে এই ব্রাহ্মণ সন্তাপযুক্ত হউক।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, রাজা অম্বরীষ এই প্রকার স্তুতি করলে, ভগবানের সুদর্শন চক্র যা বিপ্রবর দুর্বাসাকে সর্বতোভাবে দগ্ধ করছিলেন, রাজার প্রার্থনানুসারে শান্ত হলেন। তারপর মুনি দুর্বাসা অস্ত্রাগ্নির সন্তাপ হতে মুক্ত হয়ে স্বস্তিলাভ করলেন এবং মহারাজ অম্বরীষকে উত্তম আশীর্বাদ প্রদান পূর্বক তার প্রশংসা করতে লাগলেন।

দুর্বাসা বললেন–অহো, আন্দদাসদের অদ্ভুত মহত্ত্ব, আজ আমার দৃষ্টিগোচর হল। হে রাজন্ আমি তোমার প্রতি অপরাধ করেছি, তথাপি তুমি আমার মঙ্গলের চেষ্টা করলে অথবা যে সকল ব্যক্তি সাত্বতপতি ভগবান হরিকে বশীভূত করেছেন, সেই মহাত্মা সাধুপুরুষদের দুধার বা দুস্ত্যজ কি আছে? যাঁর নাম শ্রবণ মাত্রেই পুরুষ নির্মল (অর্থাৎ সবঅপাপমুক্ত) হয়, তীর্থপাদ যার পদে গঙ্গাতীর্থ বিরাজ করছে সেই ভগবান শ্রীহরির দাসগণের কোন কার্যই বা অবশিষ্ট থাকে? হে রাজন তুমি অতি করুণাত্মা, তোমা কর্তৃক আমি অনুগৃহীত হলাম, যেহেতু আমার অপরাধের প্রতি দৃষ্টিপাত না করে, আমার প্রাণ রক্ষা করলে।

মহারাজ অম্বরীষ দুর্বাসার প্রত্যাগমন আকাঙ্ক্ষা করে এতকাল অনাহারেই ছিলেন, এখন তার চরণযুগল ধারণপূর্বক তাকে প্রসন্ন করে আহার করালেন। তৎকালে দুর্বাসা ঋষি অতিথির যোগ্য ও সাদরে আনীত, সর্বঅভিলাষ পূরণকারী অন্নাদি ভোজন কর।

হে মহারাজ, আমি ভগবন্ধক্ত তোমার দর্শন স্পর্শ, আলাপ এবং আত্ম বুদ্ধিজনক অতিথি সকারের দ্বারা প্রীত ও অনুগৃহীত হয়েছি, স্বর্গরমণীগণ নিরন্তর তোমার এই বিশুদ্ধ কর্মের গান করবেন এবং এই পৃথিবীও তোমার পরম পবিত্ৰা কীর্তিকথা সর্বদা কীর্তন করবে।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে, রাজন পরীক্ষিৎ মহর্ষি দুর্বাসা পরিতুষ্টচিত্তে এই প্রকারে মাতার গুণকীর্তন করে, যথোচিত সম্ভাষণ পূর্বক আকাশমার্তো অহেতুক (শুষ্কতর্কাদি শুণ্য) ব্রহ্মলোকে গমন করলেন।

দুর্বাসা ঋষি (সুদর্শনাস্ত্রের তাড়নায় পলায়ন করে যে পর্যন্ত ফিরে আসেন নাই, সেই অবসর মধ্যে এক বৎসর অতীত হয়েছিল, রাজাও তাঁর দর্শনের আকাঙ্ক্ষায় জলমাত্র পান করেই ততকাল অতিবাহিত করেছিলেন।

দুর্বাসা ঋষি প্রস্থান করলে, মহারাজ অম্বরীষ ব্রাহ্মণের আহার হেতু অতিপবিত্র উচ্ছিষ্ট অন্ন ভোজন করলেন, এবং দুর্বাসার বিপদ বিপন্মুক্তি এবং নিজের তৎকালীন ধৈর্যাদি লক্ষ্য রূপে, এ সময় পরম পুরুষ ভগবানের প্রভাব বলেই তিনি মনে করেছিলেন, এরূপ বহুগুণ বিশিষ্ট মহারাজ অম্বরীষ বিবিধ ক্রিয়াকলাপের দ্বারা পরমাত্মা সাক্ষাৎ ব্রহ্মরূপী ভগবান বাসুদেবের প্রতিই ভক্তি ভাব ধারণ করেছিলেন। সেই ভক্তির প্রভাবে ব্রহ্মপদ সহিত সকল প্রকার ভোগ তার সমক্ষে নরকতুল্য জ্ঞান হত।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–তারপর ঐ ধীর অম্বরীষ নিজের ন্যায় স্বভাব বিশিষ্ট পুত্রগণকে রাজ্যভার সমর্পণ করে বনে প্রবেশ করলেন। তৎকালে তিনি পরমাত্মা বাসুদেবের প্রতি চিত্ত সমর্পণ করেছিলেন এবং সেজন্য তার গুণত্রয়ের প্রবাহ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সেই রাজন, অম্বরীষ মহারাজ্যের এই পবিত্র চরিত্র যে ব্যক্তি কীর্তন এবং সতত ধ্যান করেন, তিনি ভগবতভক্ত ভগবত হবেন। আর যে মানব ভক্তিপূর্বক মহাত্মা অম্বরীষের চরিত্র শ্রবণ করবেন তারা সকলেই বিষ্ণুর প্রসাদে অনায়াসে মুক্তিপদ লাভ করবেন।

.

ষষ্ঠ অধ্যায়
বংশ বর্ণন, মান্ধাতা, সৌভরির চরিত্র কহন

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, রাজা অম্বরীষের তিন পুত্র–বিরূপ, বোতুর্মান ও শম্ভু। বিরূপের পুত্র পৃষদ, পৃষদশ্বের পুত্র রথাতি, রথাতির রথীতর, রথীতরের সন্তান না হওয়ায় তিনি মহর্ষি অঙ্গিরার নিকট সন্তান প্রার্থনা করলে অঙ্গিরা রথীতরের পত্নীর গর্ভে ব্রহ্মতেজঃ সম্পন্ন কয়েকটি পুত্র উৎপাদন করেছিলেন।

অঙ্গিরা কর্তৃক উৎপাদিত এই পুত্রগণ রথীতরের ক্ষেত্রে জন্মগ্রহণহেতু রথীতর গোত্র হলেও অঙ্গিরার বীর্যে উৎপন্ন বলে অঙ্গিরস সংজ্ঞা দ্বারাও পরিচিত হয়েছিলেন এবং তারা ক্ষত্রিয় গোত্র ব্রাহ্মণ বলে রথীতরের সন্তাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। মনু হাঁচির সময় তার নাসিকা হতে এক পুত্রের জন্ম হয় তার নাম ইক্ষবাকু। ইক্ষবাকুর একশত পুত্রের মধ্যে বিকুক্ষি, নিখি ও দত্তক– এই তিনজন জ্যেষ্ঠ। হে মহারাজ ইক্ষাবাকুর পুত্রগণের মধ্যে পঁচিশজন আর্যবর্তের পূর্বভাগে, পঁচিশজন পশ্চিমভাগে, তিনজন মধ্যভাগে এবং অপর পুত্রগণ আর্যাবর্তেরই দক্ষিণ ও উত্তরাদি নানা স্থানের রাজা হয়েছিলেন।

একদিন ইক্ষবাকু অষ্টকা শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে পুত্র অবকুক্ষিকে আদেশ করলেন–বৎস, শীঘ্র অরণ্যে গিয়ে শ্রাদ্ধের জন্য পবিত্র মাংস আহরণ কর। বিকুক্ষি ‘তাই করছি’ এই বলে বনগমন পূর্বক শ্রাদ্ধের উপযোগী বহুতর মৃগ বধ করলেন। তারপর শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত হওয়ার ভ্রমবশত ঐ সকল পশুর মধ্য হতে একটি শশের (মৃগবিশেষের) মাংস ভক্ষণ করলেন।

তিনি অবশিষ্ট মাংস পিতার নিকট অর্পণ করলে পিতা কুলগুরু বশিষ্ট দেবকে ঐ মাংস ভক্ষণ (অর্থাৎ শ্রাদ্ধের উপযোগী সংদ্ধার) করার জন্য নিযুক্ত করলেন। তখন বশিষ্ঠ বললেন– এ মাংস দূষিত হয়েছে। ইহা কর্মযোগ্য হবে না। তারপর ইক্ষবাকু বশিষ্ট কর্তৃক কথিত পুত্রের কর্ম জানতে পেরে ক্রোধবশতঃ সদাচার ত্যাগী সেই পুত্রকে দেশ হতে বাহির করে দিলেন। তারপর ইক্ষাকু তত্ত্বোপবদেশক আলোচনায় প্রবৃত্ত হলেন। পরিশেষে রাজ্যভোগে বিরক্ত হয়ে যোগী হলেন এবং যোগদ্বারা দেহত্যাগ করে ব্রহ্মপদ লাভ করলেন।

পিতার দেহত্যাগের পর বিকুক্ষি দেশে প্রত্যাবর্তন পূর্বক এই পৃথিবীর শাসনকার্য পরিচালনা করে বহু যজ্ঞ দ্বারা শ্রীহরির আরাধনা করেন। তিনি শশাদ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। সেই বিকুক্ষির পুত্র পুরঞ্জয় তিনিই ইন্দ্রহাব ও কুকুৎস্থ নামে অভিহিত হন। যে সকল কর্মের জন্য এই সকল নাম হয়েছিল, তা শোন।

পূর্বকালে দানবের সাথে দেবতাদের বিশ্ববিনাশন যুদ্ধ হয়েছিল, সে সময় দেবগণ দৈত্যগণ কর্তৃক পরাজিত হলে মহাবীর পুরঞ্জয়কে তাঁদের সাহায্যের দানী বরণ করেছিলেন। তখন তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে নিজের বাহন হবার জন্য প্রার্থনা করলে ইন্দ্ৰ প্ৰথমত লজ্জিত হয়ে পরে বিশ্বাত্মা দেবাদেব প্রভু বিষ্ণুর বাক্যে স্বীকার করে পুরঞ্জয়ের বাহন হবার জন্য মহাবৃষৎ হয়েছিলেন।

এইরূপে ইন্দ্র বাহন হওয়ার পুরঞ্জয়ের ইন্দ্রবাহ এই নাম হয়েছিল। তারপর পুরঞ্জয় যুদ্ধের উপযোগী ধর্ম দিব্য ধন ও সুতীক্ষ বাণসমূহ, ধারণপূর্বক যুদ্ধের ইচ্ছাই মহাবৃক্ষ রূপী ইন্দ্রের উপর আরোহণ করে তার বাকুদে স্কেন্ধ্রের উপরিস্থিত উন্নত স্থানে অবস্থান করলেন, তখন দেবগণ তাঁর স্তব করেছিলেন। এই রঙ্গে পরমপুরুষ মহাত্মা বিষ্ণুর তেজে বলবান রাজা পুরঞ্জয় দেবগণের সাথে মিলিত হয়ে পশ্চিম দিকে দৈত্যপুরী অবরোধ করলেন। তখন দৈত্যদের সাথে তার তুমুল সংগ্রাম হয়েছিল।

সে সকল দৈত্যসমরে তার সম্মুখীন হল, তাদের তিনি যম সন্দর্শনাথ প্রেরণ করলেন। তখন দৈত্যগণ যুদ্ধে আহত হয়ে প্রচণ্ড প্রলয়াগ্নিতুল্য তদীয় বানমতনের সম্মুখভাগ পরিত্যাগ পূর্বক সত্তীর নিজ নিজ আলয়ে পাতালে পলায়ন করলেন।

রাজর্ষি পুরঞ্জয় এইরূপে দৈত্যপুর জয় করে রমণীগণ সহ সমস্ত ধন দেবরাজ ইন্দ্রকে প্রদান এ সকল কর্মের জন্য তিনি বিভিন্ন নামে কথিত হন। (অর্থাৎ দৈত্যপুর জয় করায় পুরঞ্জয় ইন্দ্রকে বাহন করায় ইন্দ্রবাহ এবং বৃষরূপী ইন্দ্রের বাকুলে অবস্থান করায় বাকুৎস্থ নামে পরিচিত হয়েছিলেন।

পুরঞ্জয়ের, পুত্র অনেনা তাঁর পুত্র পৃথু, পৃথুর পুত্র বিশ্বগন্ধি, তাঁর পুত্র চন্দ্র এবং চন্দ্রের পুত্র যুবনাশ্ব। যুবনাশ্বের পুত্রের নাম শ্রীবন্ত, তিনি শ্রীবস্তী পুরী নির্মাণ করেন। শ্ৰীবন্তের পুত্র বৃহদ এবং বৃহদশ্বের পুত্র কুবলয়া। তিনি উতষ্ক ঋষির প্রীতি-সাধনের জন্য নিজ একবিংশতি সহস্র পুত্রগণের সহিত মিলিত হয়ে ধুন্ধু নামক অসুরকে বিনাশ করলে ধুন্ধুমার নামে বিখ্যাত হন।

কিন্তু ধুন্ধুর মুখাগ্নির দ্বারা তাঁর পুত্রগণ দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে কেবলমাত্র তিনটি পুত্র অবশিষ্ট ছিলেন। হে মহারাজ, সেই তিন পুত্র দৃঢ়শ্ব, বাদিলা এবং ভদ্রা নামে প্রসিদ্ধ। দৃঢ়শ্বের পুত্র হর্থশ্ব এবং হর্থশ্বের পুত্র নিকুম্ভ। নিকুম্ভের পুত্র বাহলাশ্ব, তা হতে কৃশাশ্ব উৎপন্ন হন। সেই কৃশাশ্বের তনয় সেনজিৎ, তার পুত্র যুবনাশ্ব।

যুবনাশ্বের একশত ভার্য্যা ছিল, তথাপি তিনি অনুগত্য জন্য নির্বিঘ্ন হয়ে ঐ একশত ভার্যার সহিত বনে গমন করেছিলেন। কৃপালু ঋষিগণ সুমমাহিত হয়ে তার পুত্র লাভের জন্য ইন্দ্ৰযজ্ঞের অনুষ্ঠান আরম্ভ করলেন। একদিন রাতে রাজা যুবনাশ্ব তৃষ্ণার্ত হয়ে জল পানের জন্য সেই যজ্ঞশালায় প্রবেশ করলেন। সেখানে যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণদের নিদ্রিত দেখে নিজেই যজ্ঞ দ্বারা পুত কলসীতে রক্ষিত মন্ত্রপুত জল (অর্থাৎ রাজপত্নীদের পুত্রলাভের জন্য রক্ষিত মন্ত্রপূত জল) পান করলেন। হে মহারাজ তারপর যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণগণ জাগ্রত হয়ে কলসটি জলশূণ্য দেখে জিজ্ঞাসা করলেনএই পুত্রসন্তান উৎপাদক পবিত্র জল কে পান করেছে? তারপর ঈশ্বরের প্রেরণায় রাজাই এই জল পান করেছেন জেনে সেই ব্রাহ্মণগণ বললেন, অহো, দৈববলই মুখ্যবল, লোকবল কিছুই নহে–এরূপ বলে ঈশ্বরের উদ্দেশে নমস্কার করলেন।

তারপর যথাকালে যুবনাশ্বের দক্ষিণ কুক্ষি লক্ষণ যুক্ত একটি পুত্র জন্মিল। তখন ব্রাহ্মণগণ। বললেন–এই কুমার স্তনপানের জন্য অত্যন্ত রোদন করছে। এখন শিশুটি কী পান করবে? তখন দেবরাজ ইন্দ্র-বৎস রোদন করো না, মাং ধাতা’ মান্ধাতা (অর্থাৎ আমাকে পান করবে) এই বলে নিজের তর্জনী প্রদান করলেন। (এজন্য এ বালকের মান্ধাতা নাম হয়)। এই বালকের পিতা যুবনাশ্বের উদর বিদীর্ণ হলেও ব্রাহ্মণ ও দেবগণের অনুগ্রহে তিনি মৃত্যুগ্রস্ত হন নাই। তারপর যুবনাশ্ব সেখানেই তপস্যার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।

হে মহারাজ, রাবণাদি দস্যুগণ এই মান্ধাতার ভয়ে সব সময় সন্ত্রস্ত থাকত। সেইজন্য দেবরাজ ইন্দ্র তার আর একটি নাম দেন–এসদ্দস্য। তারপর যুবনাশ্বের পুত্র মান্ধাতা রাজচক্রবর্তী হয়ে ভগবান শ্রীহরির প্রভাবে একাকী সপ্তদীপা পৃথিবীকে শাসন করেছিলেন।

তিনি আত্মতত্ত্বজ্ঞ হয়েও প্রকৃত দক্ষিণাযুক্ত যাগসমূহের দ্বারা সর্বাত্মক, অতীন্দ্রিয় সর্বদেবময় দেবতা বিষ্ণুর আরাধনা করেছিলেন, যে বিষ্ণু স্বয়ং যজ্ঞের দ্রব্য মন্ত্র বিধি, যজ্ঞ যজমান, ঋত্বিক সমূহ, যজ্ঞফল, ধর্ম, যজ্ঞের দেশ ও কাল এই সমস্ত রূপে বিরাজমান যতদূর পর্যন্ত সূর্য উদিত হয় এবং যে পর্যন্ত অস্ত যায়, ততদূর পর্যন্ত সমস্ত স্থান যুবনাশ্বপুত্র মান্ধাতার ক্ষেত্র বলে কথিত হয়ে থাকে। যা হোক ঐ রাজা শশবিন্দুর কন্যা ইন্দুমতীর গর্ভে পুরুকুৎস, অম্বরীষ এবং যোগী মুচুকুন্দ– এই তিনটি তনয় উৎপন্ন করেন। ঐ তিন তনয়ের পঞ্চাশ জন ভগিনী (অর্থাৎ মান্ধাতার ঐ তিন পুত্র ব্যতীত আরও পঞ্চাশটি কন্যা) ছিল। তারা সকলেই ঋষি সৌভরিকে পতিত্বে বরণ করে।

সৌভরি ঋষি একসময় যমুনার জলে মগ্ন হয়ে কঠোর তপস্যায় রতকালীন মৈথুনরত একটি মৎস্যরাজের সুখ দেখে ঐ বিষয়ে তার স্পৃহা জন্মালে রাজা মান্ধাতার নিকট একটি কন্যা প্রার্থনা করলেন।

রাজা মান্ধাতা বললেন–হে ব্রাহ্মণ, আপনি কন্যাদের ইচ্ছাপূরণ পূর্বক স্বয়ংসভায় উপনীত হয়ে কন্যা গ্রহণ করুন। তখন সৌভরি ভাবলেন–আমি বৃদ্ধ, লোলচর্ম, পক্ককেশ এবং কম্পিত মস্তক এ সকল কারণে আমাকে রমণীগণের অপ্রিয় মনে করে এবং অন্যান্য কারণেও আমি মনোমত নই বলে রাজা আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অতএব আমি নিজ দেহটিকে এরূপ সুন্দর করব যাতে দেবরমণীগণও আমাকে কামনা করেন, আর রাজরমণীদের কথা কী? এই ভেবে সেরূপ কৃতনিশ্চয়ই হলেন তপস্যার প্রভাবে তার সেই অপরূপ রূপ হল।

তারপর প্রতিহারী সৌভরি ঋষিকে সমৃদ্ধিশালী কন্যান্তঃপুরে প্রবেশ করলে পঞ্চাশটি রাজকন্যাই সেই একজনকে পতিরূপে বরণ করলেন। তৎকালে রাজকন্যাগণের সকলেরই চিত্ত তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায় তাকে পাবার জন্য পরস্পর সৌহার্দ ত্যাগ করে সকলেই–ইনি আমার যোগ্য পতি, তোমাদের নয়–-এরূপ বিবাদ আরম্ভ করেছিলেন।

যা হোক, সৌভরি ঋষি মন্ত্ৰসামর্থ্যে সম্পন্ন ছিলেন। তাঁর অপার তপঃশক্তিবলে তৎক্ষণাৎ প্রত্যেক ভবনে মহামূল্য পরিচ্ছদ প্রস্তুত হল এবং নানাবিধ বন, উপবন সুশোভিত ও সরোবর — সকল সৌগন্ধি কার-কাননে সুসজ্জিত হয়ে উঠল। আর যাবতীয় গৃহে দাস-দাসী সকল সুন্দর রূপে অলংকৃত এবং সর্বত্র পক্ষী ভ্রমর ও স্তুতি পাঠকগণ মধুর স্বরে গান আরম্ভ কর। তিনি মহামূল্য শয্যা, আসন, বসন, ভূষণ, স্নান ও অনুলেপন, আহার ও মাল্যসম্ভারে সমৃদ্ধশালী হয়ে সকল ভবন ও উপবনাদিতে সেসকল বণিতাগণের সাথে অহরহ বিহার করতে লাগলেন। হে রাজন, সৌভরির গার্হস্থ্য ধর্ম অবলোকন করে সপ্তদ্বীপা পৃথিবীর অধিপতি মান্ধাতারাও সুমহৎ বিস্ময় জন্মেছিল।

সাম্রাজ্য সম্পত্তি সম্পন্ন বলে তাঁর যে গর্ব ছিল, তা তিনি পরিত্যাগ করলেন। কিন্তু সৌভরি ঋষি ঐপ্রকারে গৃহাশ্রমে অবিরত হয়ে যদিও বিবিধ সুখে বিষয় ভোগ করতে লাগলেন, তথাপি ঘৃতবিন্দুপাতে যেরূপ বহ্নির পরিতৃপ্তি হয় না, তার ন্যায় কিছুতেই তার তৃপ্তি বোধ হল না।

একসময় মন্ত্রজ্ঞ গণের আচার্য সেই সৌভরি ঋষি নির্জনে উপবিষ্ট হয়ে নিজের বিষয় চিন্তা করতে লাগলেন। তাতে মৎস্য সংসর্গে তার নিজের যে তপস্যার হানি হয়েছে, তা অনুভব করলেন। তখন তিনি অনুতপ্ত হয়ে এরূপ বলেছিলেন–অহো, আমি ব্রতনিষ্ঠ, সাধু তপস্বী ছিলাম, আজ আমার এই সর্বনাশ দেখ। আমি জলমধ্যে থেকে মৈথুনরত মৎস্যের সঙ্গহেতু চিরকালের সঞ্চিত তপোবল বিসর্জন দিয়েছি। (বস্তুতঃ ভগবদ পার্ষদ গরুড়ের প্রতি অপরাধের ফলেই মহামুনি সৌভরির এই গার্হস্থ্য যোগ)

মুক্তিকামী পুরুষ সর্বতোভাবে মৈথুনাসক্তগণের সঙ্গ ত্যাগ করবেন। ইন্দ্রিয়সমূহকে বাহ্য বিষয়ে। লিপ্ত করবেন না এবং সর্বদা একাকী নির্জনে বিচরণ করে মনকে অনন্ত পরমেশ্বরে নিযুক্ত করবেন, আর যদি সঙ্গ করতে হয়, তাহলে যারা ভগবানের প্রীতির জন্যই ধর্মাচরণ করেন, সেরূপ সাধুগণেরই সঙ্গ করবেন। আমি জলমধ্যে একাকী তপস্যায় রত ছিলাম, পরে সৎস্যের সঙ্গহেতু পঞ্চাশটি ভার্যার সম্বন্ধে এসে পঞ্চাশ হলাম।

এরপর প্রত্যেকের গর্ভে শত পুত্রের জন্মদান করে এখন পঞ্চাশ সহস্র হয়েছি। এ অবস্থায়ও আমি ঐহিক ও পারলৌকিক কর্মবিষয়ক বাসনা সমূহের অন্ত পাইনি। মায়িক গুণসমূহ আমার চিত্তকে হরণ করায় আমি সারিক বিষয় রাশিকেই পুরুষার্থ জ্ঞান করছি।

এইরূপ তিনি কিয়ৎকাল গৃহবাসের পর বিরক্ত হয়ে বানপ্রস্থ ধর্ম অবলম্বনপূর্বক বনে গমন করলেন এবং তৎকালে পতিব্রতা পত্নীগণও তাকে অনুগমন করেছিলেন। আত্মজ্ঞ ঋষি সেই বন মধ্যে আত্মদর্শনের উপযোগী তীব্র আখ্যার অনুষ্ঠান করে, পশ্চাৎ গার্হস্থ্যাদি অগ্নিয়ের সহিত আত্মাকে পরমাত্মায় যুক্ত করেছিলেন (অর্থাৎ ব্রহ্ম নির্বাণ লাভ করেছিলেন)।

হে মহারাজ, তৎকালে তার পত্নীগণ নিজ পতির ঐরূপে আধ্যাত্মিকগত অর্থাৎ পরব্রহ্মে বিলয় অবলোকন করে, অগ্নিশিখা যেমন নির্বাণপ্রাপ্তি অনলের সঙ্গে যায়, তার ন্যায় তদীয় এভাবে তাঁর সহগামিনী হলেন (অর্থাৎ তারাও মুক্তি লাভ করলেন।)।

.

সপ্তম অধ্যায়
ত্রিশুঙ্গ ও হরিশচন্দ্রের উপাখ্যান

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, আমি পূর্বে মান্ধাতার পুত্রশ্রেষ্ঠ যে অম্বরীষের কথা বলেছি, পিতামহ যুবনাশ্ব তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করেছিলেন। এই অম্বরীষের পুত্র যৌবনাশ্ব ও হারী–এই দুই জন প্রধান। ভ্রাতা মদগণ ভগিনী নর্মদাকে পুরুবৎসের হস্তে সম্প্রদান করলে, নর্মদা পুরুবৎসকে নাগরাজের নিয়োগে রসাতলে নিয়ে যান।

পুরুবৎস সেখানে বিষ্ণুর শক্তি ধারণ করে বধযোগ্য অনেক গন্ধর্বের প্রাণ বিনাশ করলে, নাগরাজ তাকে বর দেন–যেসকল ব্যক্তি পুরুবৎসের চরিত স্মরণ করবে, তাদের সর্পভয় থাকবে না। পুরুবৎসের পুত্র এসদস্যু, ইনি অনরণ্যের জনক। অনরণ্যের পুত্র হর্য, হর্যশ্বের পুত্র প্রারুণ এবং প্রারুণের পুত্র ত্রিবন্ধন।

ত্ৰিবন্ধনের পুত্র সত্যব্রত, ইনি পরে ত্রিশঙ্কু নামে বিখ্যাত হন। তিনটি শঙ্কুর মত দুঃখ হেতুকদোষ যাঁর, তিনি ত্রিশঙ্কু। পিতার অসন্তোষ উৎপাদন, গুরুর দুগ্ধবতী ধেনুবধ এবং অপ্রোক্ষিত মদ্য সেবন এই তিনটি দোষ থাকায় তিনি ঐ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। পরে পরিণীয় ঘন বিপ্রকন্তা হরণের অপরাধে ক্রুদ্ধ পিতার অভিশাপে ইনি চণ্ডালত্ব প্রাপ্ত হলে, বিশ্বামিত্রের প্রভাবে সশরীরে স্বর্গে গমন। করেন।

এখনও ইহাকে আকাশে দেখা যায়। দেবতাগণ তাকে নীচের দিকে মাথা করে স্বর্গ হতে ফেলে দিলে, বিশ্বাসী এই তাঁকে নিজের শক্তিবলে আকাশে স্তম্ভিত করে রেখেছিলেন। ত্রিশঙ্কুর পুত্র হরিশচন্দ্র, এই হরিশচন্দ্রের জন্যই পক্ষীরূপধারী বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের বহু বৎসর যুদ্ধ হয়েছিল। (বিশ্বামিত্র রাজসূয় যজ্ঞের দক্ষিণার ছলে হরিশচন্দ্রের সর্বস্ব হনন করলে, বশিষ্ঠ ক্রদ্ধ হয়ে, বিশ্বামিত্রকে তুমি আড়ী লক্ষ্মী হও–এরূপ শাপ দিলে, তিনিও বশিষ্ঠকে শাপ দেন- তুমি বক পক্ষী হও। পরে আড়ী ও বকরূপী উভয়ের বহুকাল যুদ্ধ হয়)।

সন্তানহীন বিষঃচিত্ত রাজা হরিশচন্দ্র নারদের উপদেশে জলধিপতি বরুণের শরণাপন্ন হয়ে প্রার্থনা করলেন, হে প্রভো, আপনার অনুগ্রহে আমার পুত্র হোক। যদি আমার বীর পুত্র হয়, তা হলে তাকেই পশুরূপে উৎসর্গ করে আপনার যাগ করব। বরুণ বললেন–”তথাস্তু অর্থাৎ তাই হবে। এর পরই রাজা হরিশচন্দ্রের রোহিত নামে একটি পুত্র জন্মিল।

তখন বরুণদেব বললেন–হে রাজন, তোমার পুত্র হয়েছে, এর দ্বারা আমার যজ্ঞ কর। হরিশচন্দ্র বললেন–হে দেব, দশ দিন বয়ঃক্রম অতীত না হলে পশু পবিত্র ও যাগ যোগ্য হয় না। অতএব দশ দিন অতীত হোক। যাগ করব। দশ দিন অতিক্রান্ত হলে বরুণদেব পুনরায় এসে বললেন–রাজ এখন যাগ কর। রাজা বললেন–দন্ত উৎপন্ন হলেই পশু পবিত্র হয়। তারপর দন্ত জন্মিলেন বরুণদেব এসে বললেন–রাজন, তোমার পুত্রের দন্ত উৎপন্ন হয়েছে, এখন যাগ কর। তখন রাজা বললেন–এই দন্তগুলি যখন পতিত হবে, তখন যজ্ঞের যোগ্য হবে।

এরপর দন্ত সমূহের পতন হলে বরুণ বললেন–এখন যাগ কর। হরিশচন্দ্র বললেন–যখন পশুর দন্ত পতনের পর পুনরায় দন্ত উৎপন্ন হয়, তখনই পশু শুদ্ধ হয়। এরপর দন্তসমূহ পুনরায় উৎপন্ন হলে বরুণ এসে বললেন–এখন তোমার পুত্রের দ্বিতীয় বার দন্ত উৎপন্ন হয়েছে, অতএব যজ্ঞ কর। তখন হরিশচন্দ্র বললেন–হে বরুণরাজ, ক্ষত্রিয় পশু চর্ম পরিধানের যোগ্য হলেই পবিত্র হয়।

পুত্রের প্রতি বৎসল্য হেতু স্নেহানুবদ্ধ হৃদয় রাজা হরিশচন্দ্র বঞ্চনা করে যে যে সময়ের কথা বলেছিলেন, বরুণদেব সেই সেই সময়েরই প্রতীক্ষা করেছিলেন। তারপর রোহিতাশ্ব পিতার অভীপ্সিত কর্ম (অর্থাৎ তার দ্বারা বরুণের যজ্ঞ করবেন জানতে পেরে প্রাণরক্ষার জন্য ধনুর্ধারী হয়ে বনে প্রবেশ করলেন।

এরপর রোহিত শুনতে পেলেন পিতা বরুণ কর্তৃক ত্রস্ত হয়েছেন। (অর্থাৎ জলোদর রোগে আক্রান্ত হয়েছেন)। এটা জেনে বন থেকে গ্রামে আসবার উদ্যোগ করলে, ইন্দ্র তাকে বারণ করলেন। ইন্দ্র বলল–বিবিধ তীর্থক্ষেত্রের সেবা করে পৃথিবী পর্যটন করা পুণ্য কার্য। অতএব তুমি তাই কর। তখন রোহিত এক বছর বনেই বাস করলেন। এইরূপ দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম প্রতি বর্ষেই ইন্দ্র বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে উপস্থিত হয়ে তাঁকে গ্রাম গমনে নিষেধ করেছিলেন।

এইরূপে রোহিত ষষ্ঠ বৎসর পর্যন্ত অরণ্যে ভ্রমণ করেছিলেন, তারপর প্রত্যাগমন করতঃ যখন পুরীর নিকটে এলেন তখন অজীগর্তের নিকট হতে তার মধ্যম পুত্র শুনঃশেফকে ক্রয় করে আনলেন এবং পিতাকে গিয়ে প্রণাম করলেন। তারপর মহাযশাঃ হরিশচন্দ্র নরমেধ দ্বারা বরুণাদি দেবগণের যজ্ঞ করে জলোদর রোগ হতে মুক্ত হন। মহাজনগণের মধ্যে রাজা হরিশচন্দ্রের কথা প্রসিদ্ধ। সেই যজ্ঞে বিশ্বামিত্র হোতা, আত্মজ্ঞ জমদগ্নি অববয়ু, বশিষ্ঠ ব্ৰপহ্ম, এবং অয়াস্যমুনি উকাতা (অর্থাৎ মাঘগানকারী) হয়েছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র এই যজ্ঞে তুষ্ট হয়ে রাজা হরিশচন্দ্রকে স্বর্ণময় রথ প্রদান করেছিলেন।

শুনঃশেফের মাহাত্ম্য পরে (বিশ্বামিত্রের আখ্যান প্রসঙ্গে) বলা হবে। (মহাযশঃ হরিশচন্দ্রের এই নরমেধ কার্যে যদি অত্যন্ত বৈদিক কর্মপরতাই ধরা হয়, তবে তাতে ব্রহ্মকৈবল্য হবে, কিন্তু ভগবৎ সম্বন্ধে ধরা যেতে পারে না, ক্রমসন্দর্ভে শ্রীপাদ শ্রীজীব গোস্বামী)।

হে মহারাজা পরীক্ষিত, সভার্য হরিশচন্দ্রের সত্য সামর্থ্য এবং ধৈর্য অবলোকন করে মহামুনি বিশ্বামিত্র অতিশয় প্রীত হয়ে তাকে অগাধ জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। এই জ্ঞান লাভের ফলে রাজা হরিশচন্দ্র মনকে পৃথিবীতে ধারণ (অর্থাৎ তার সহিত এক) করে, পৃথিবীকে জলের সাথে, জলকে তেজের সাথে, তেজকে বায়ুর সাথে, বায়ুকে আকাশের সাথে, আকাশকে অহংকারের সাথে, এবং অহংকারকে মহত্ততত্ত্বের সাথে এক করে তন্মধ্যে জ্ঞানকলা (অর্থাৎ জ্ঞানের অংশমাত্রের) ধ্যান করেছিলেন অর্থাৎ জ্ঞানের ঐ অংশকেই আত্মরূপে চিন্তা করেছিলেন। তারপর সেই আত্মকালে প্রকাশিত ধ্যানের বৃত্তিদ্বারা অজ্ঞানকে সম্পূর্ণ রূপে দগ্ধ করে ফেললেন। পরে নির্বাণ দ্বারা জ্ঞানাংশ পরিত্যাগপূর্বক মুক্ত বন্ধন হয়ে অনির্দেশ ও অচিন্তনীয় স্ব-স্বরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।

.

অষ্টম অধ্যায়
সাগর চরিত বর্ণনা

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, রোহিতের পুত্রের নাম হরিত, হরিতের পুত্রের নাম চম্প, এই চম্পই চম্পা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। চম্পের পুত্র সুদেব এবং সুদেবের পুত্র বিজয়। বিজয়ের পুত্র ভরুক, তার পুত্র বৃক এবং বৃকের পুত্র বাহুক। শত্রুগণ রাজ্য হরণ করলে বাহক নিজ ভার্যার সহিত বলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। রাজা বাহুক বৃদ্ধ বয়সে দেহত্যাগ করলে, তার মহিষী সহমরণের ইচ্ছা করায় মহর্ষি ঔব তাকে গর্ভবতী জেনে সহমরণ হতে নিবৃত্ত করলেন। ঐ মহিষীর সপন্তীগণ গর্ভের কথা জানতে পেরে তাকে অন্নের সাথে বিষ প্রদান করেন। সেই গরল অর্থাৎ বিষের সহিতই পুত্র ভূমিষ্ট হয়ে সগর নামে প্রসিদ্ধ হন। সগর মহাযশস্বী সার্বভৌম রাজা ছিলেন এবং তার পুত্রগণই সাগরের সৃষ্টি করেন। সগর রাজা স্বীয় গুরু ঔর্ব ঋষির বাক্যে যবন, শক, হৈহয় এবং বর্বর এই সকল জাতীয়দের প্রাণবধ করেন নাই। ভিন্ন ভিন্ন জাতিকে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে বিকৃত বেশী করেছিলেন। কোন জাতিকে মুণ্ডিত মস্তক অথচ শ্মশ্রুধারী কোন জাতিকে মুক্ত কেশ অথচ অর্ধমুণ্ডিত কোন জাতিকে কেবলমাত্র বহির্বাসধারী এবং কোন জাতিকে বহির্বাসহীন কেবল কৌপীনধারী করেছিলেন।

সগর রাজা মহর্ষি উপদিষ্ট উপায় অনুসারে বহু অশ্বমেধ যজ্ঞের দ্বারা সর্ববেদ ও সর্বদেবময় পরমাত্মা জগদীশ্বর শ্রীহরির আরাধনা করেছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তার যজ্ঞে পশুরূপে উৎসর্গীকৃত একটি অশ্বকে হরণ করে নিয়ে যান। সগরের সুমতি ও কেশিনী নামে দুই ভার্য্যা ছিলেন। তন্মধ্যে সুমতির পুত্রগণ বলদৃপ্ত বলে পিতার আদেশ পালন করতে গিয়ে অশ্বের অনুসন্ধান করতে পৃথিবীর চারদিক খনন করেছিলেন। তারপর তারা পূর্বোত দিক মহামুনি কপিলদেবের নিকট সেই অশ্বটিকে দেখতে পেলেন–এবং এই ব্যক্তিই অশ্বাপহারী চোর, এখন চোখ বুজে বসে আছে, সুতরাং এই পাপিষ্ঠকে বধ কর, বধ কর–এই বলে সেই ষাট হাজার সগর-পুত্র অস্ত্র উদ্যত করে কপিল মুনির দিকে ধাবিত হলে, মুনিবর নয়নযুগল উন্মীলিত করলেন।

বস্তুতঃ দেবরাজ ইন্দ্ৰই-কপিল মুনি অশ্ব হরণ করেছেন–এই কথা বলে রাজপুত্রদের মতিভ্রম ঘটিয়েছিলেন। এইজন্যেই তারা কপিলকে বধ করতে উদ্যত হওয়ায় মহদ্ব্যাতিক্রম হেতুই (অর্থাৎ মহাপুরুষের প্রতি অনুচিত আচরণমূলক পাপের দ্বারা) হত হয়ে নিজ নিজ দেহের অগ্নির দ্বারাই ক্ষণকাল মধ্যে ভস্মীভূত হয়েছিলেন।

হে রাজন, কেউ কেউ বলে থাকেন, সগর পুত্রগণ কপিলমুনির কোপাগ্নিতে দগ্ধ হয়েছে, একথা সুসঙ্গত নয়। কারণ আকাশে যেরূপ পার্থিব ধূলরাশির অস্তিত্ব সম্ভাবনা করা যায় না, সেরূপ যাঁর আত্মা জগৎকে পবিত্র করে বিশুদ্ধ সত্ত্বমূর্তি সেই কপিল মুনির মধ্যে কীরূপে ক্রোধময় তামস ভাবের সম্ভাবনা করা যেতে পারে, আর যিনি ইহলোকে সাংখ্য রূপে সুদৃঢ় নৌকার প্রবর্তন করেছেন এবং সেই নৌকার সাহায্যে মুমুক্ষ ব্যক্তি, মৃত্যুর পথ স্বরূপ এই দুষ্পর সংসার সাগর পার হতেছেন। সেই সর্বত্র সমদর্শী সর্বজ্ঞ মহাপুরুষের শত্রু মিত্রাদি ভেদজ্ঞান কিরূপে হতে পারে?

সগর রাজা যে পুত্ৰ অসমঞ্জস বলে উক্ত হতেন, বস্তুতঃ তিনি সগরের ঔরসে কোশিনীর গর্ভজাত সন্তান। অজ্ঞ লোকেরাই তাকে অসমঞ্জস বলতঃ বস্তুতঃ তিনি সমঞ্জস ছিলেন। সেই অসমঞ্জসের পুত্র অংশুমান তিনি পিতামহ সগরের সর্বদা হিতাচরণ করতেন। ঐ অসমঞ্জস পূর্বজন্মে যোগী ছিলেন। লোক সঙ্গবশতঃ যোগভ্রষ্ট হন। এই জন্মে জাতিস্মর হয়ে জন্মগ্রহণ করে লোকসঙ্গের ভয়েই নিজেকে অসামাজিক অসজ্জনের মত দেখাতেন।

তিনি লোকের উদ্বেগ জন্মিয়ে লোক গর্হিত আচার ও জ্ঞাতিগণের অপ্রিয় আচরণ করতেন। তিনি সর্বদা ক্রীড়ারত বালকদের সরযূর জলে নিক্ষেপ করতেন। পিতা সগর পুত্রস্নেহ বিসর্জন করতঃ এইরূপ আচরণকারী পুত্রকে পরিত্যাগ করেন। তখন তিনি নিজ যোগেশ্বর্য প্রভাবে নিহত বালকদের পুনর্জীবিত করে সকলকে দেখান। তারপর তিনি বনে চলে গেলেন। হে মহারাজ, তখন অযোধ্যাবাসী সকলেই বালকগণকে পুনরায় ফিরে আসতে দেখে বিস্মিত হয়েছিল এবং রাজা সগরও স্বয়ং অনুতাপ করেছিলেন।

তারপর অংশুমান রাজা সগর কর্তৃক অশ্বের অন্বেষণে প্রেরিত হয়ে পিতৃব্যগণের খাতের পথে। গমনপূর্বক ভস্মরাশির নিকট অশ্বটিকে দেখতে পেলেন। মহামতি অংশুমান, সেখানে কপিলমুনি রূপে অবতীর্ণ ভগবান বিষ্ণুকে উপবিষ্ট দেখে প্রণামপূর্বক কৃতজ্ঞলি হয়ে একাগ্রচিত্তে তার স্তুতি করতে লাগলেন। অংশুমান বললেন–হে ভগবন্‌, ব্রহ্মা জন্মরহিত হয়েও আজ পর্যন্ত নিজ অপেক্ষাপর পরমেশ্বর আপনাকে সমাধি দ্বারা দেখতে পেলেন না এবং যুক্তির দ্বারাও জানতে পারলেন না। এ অবস্থায় যারা সেই ব্রহ্মার মন, দেহ ও বুদ্ধিদ্বারা দেবতা তির্যক প্রাণী ও মনুষ্য রূপে সৃষ্ট হয়েছে, তার মধ্যে অজ্ঞ অর্বাচীন আমরা কিরূপে আপনাকে অবগত হব; যারা দেহধারী, বুদ্ধিই তাদের প্রধান বলে তারা বুদ্ধির চালনায় বাহ্য বিষয়েরই জ্ঞান আহরণ করে, বস্তুতঃ তাদের চিত্ত আপনার মায়ার দ্বারা মোহিত হয়েছে, আপনি তাদের হৃদয়ে বিরাজমান হলেও তারা আপনাকে জানতে পারে না। কিন্তু জাগরণ ও স্বপ্নকালে শব্দাদি বিষয়সমূহ এবং সুষুপ্তিকালে কেবলমাত্র তমঃ অর্থাৎ অজ্ঞানই অনুভব করে।

ভগবান, যাঁদের মায়া গুণচরিত ভেদজ্ঞান ও মোহ স্বভাবতঃই বিনষ্ট হয়েছে, আপনি সেই সনন্দন প্রভৃতি মুনিগণেরই ধ্যেয় জ্ঞান ঘনস্বরূপ (অর্থাৎ বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ)। মায়ামুগ্ধ আমি কিরূপে আপনার ধ্যানে সমর্থ হব? হে প্রশান্ত আপনি কার্যকারণ হতে বিমুক্ত এবং নাম রূপহীন। আপনার মধ্যে মায়াগুণ, সৃষ্টি প্রবৃত্তি কর্ম এবং ব্রহ্মাদি বিভিন্ন রূপ তিরোহিত হয়েছে। আপনি বস্তুতঃ পুরাণ পুরুষ, তথাপি জ্ঞানোপদেশ প্রদানের জন্য এই মূর্তি ধারণ করেছেন আমি আপনাকে কেবল প্রণাম করছি। হে বিভো, এই লোক আপনার মায়ায় বিরচিত হয়েছে। ইহাতে বস্তুবুদ্ধি করে কাম, লোভ, ঈর্ষা এবং মোহে ভ্ৰান্তচিত্ত মানবসকল গৃহাদিতে ভ্রমণ করে। কিন্তু হে ভগবান, আপনার কৃপায় আপনার দর্শন লাভ হওয়ায় আজ আমাদের কাম, কর্ম ও হৃদয়ের আশ্রয়রূপ দৃঢ়তর মোহাংশ ছিন্ন হয়ে আমরা কৃতার্থ হলাম।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, অংশুমান এরূপে ভগবান কপিলমুনির মাহাত্ম কীর্তন করলে তিনি অনুগ্রহ প্রকাশপূর্বক তাঁকে এরূপ বলেছিলেন। শ্রীভগবান বললেন–বৎস তোমার পিতামহের পিও এই অশ্ব নিয়ে যাতব্যগণ নিজ উদ্ধারের জন্য কপিল মুনিকে নতষযজ্ঞ সম্পন্ন

আর তোমার এই দগ্ধ পিতৃব্যগণ নিজ উদ্ধারের জন্য একমাত্র গঙ্গাজল লাভেরই যোগ্য। অন্য কোন বস্তুতে এদের সদ্গতি হবে না। তারপর অংশুমান কপিল মুনিকে নত মস্তকে প্রণাম ও পরিক্রমার দ্বারা প্রসন্ন করে, অশ্বটিকে নিয়ে এলেন এবং সগর সেই পশুর দ্বারা অবশিষ্ট যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন। এরপর মহারাজ সগর অংশুমানের উপর রাজ্যভার সমর্পণ পূর্বক বিষয়স্পৃহাশুন্য ও বন্ধনমুক্ত হয়ে গুরু ঔবমুনির উপদিষ্ট সাধনমার্গে সর্বোত্তম গতি লাভ করেছিলেন।

.

নবম অধ্যায়
ভগীরথের গঙ্গাবতরণ ও সৌদাস চরিত্র বর্ণন

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, যেমন সগর রাজা পৌত্র হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করে তপস্যা করতে বনে গমন করেন, অংশুমানও তেমনি পুত্রকে রাজত্ব দিয়ে গঙ্গানয়ন কামনায় দীর্ঘকাল তপস্যা করেছিলেন। কিন্তু গঙ্গা আনয়ন করতে সমর্থ হন নাই। কিছুকাল পরে কালবশতঃ তার মৃত্যু হয়। অংশুমানের পুত্র দিলীপ, তিনিও পিতার ন্যায় গঙ্গানয়নে অসমর্থ হয়ে কালগ্রাসে পতিত হন। দিলীপের পুত্র ভগীরথ, তিনি গঙ্গার আনয়নের জন্য সুমহৎ তপস্যা করেছিলেন। তারপর গঙ্গাদেবী প্রসন্না হয়ে। তাঁকে দর্শন দিয়ে বললেন–হে বৎস, আমি তোমাকে বর দিতে এসেছি। তখন রাজা ভগীরথ অবনত হয়ে নিজের অভিপ্রায় (অর্থাৎ উদ্ধার) নিবেদন করলেন। গঙ্গাদেবী বললেন– রাজ, আমি যখন আকাশ হতে ভূতলে পতিত হব, তখন কাউকে আমার বেগ ধারণ করতে হবে, নতুবা আমি ভূতল ভেদ করে রসাতলে গিয়ে পড়ব। কে আমার বেগ ধারণ করবে? আর, আমি পৃথিবীতে যেতে ইচ্ছা করি না, কারণ মনুষ্যেরা আমাতে পাপ সকল প্রক্ষালন করবে, সেই পাপ আমি কোথায় মার্জনা করব, এ বিষয়ে উপায় চিন্তা কর।

শ্রীভগীরথ বললেন–দেবী ধরাতলে ব্রহ্মনিষ্ঠ, শান্তান্তা, লোকপাবন, সন্ন্যাসী, সাধুগণ আপনার জলে স্নান করার সময় তাদের গাত্রসঙ্গদ্বারা আপনার পাপ হরণ করবেন, যেহেতু তাদের মধ্যে সর্বপাপ নাশক শ্রীহরি বিরাজ করেন। মাতঃ সূত্রসমুহের মধ্যে যেমন বস্তুত ওতপ্রোত থাকে, তেমনি যাঁর মধ্যে এই বিশ্ব ওতপ্রোতভাবে বিদ্যমান রয়েছে, সকল প্রাণীর আত্মা সেই ভগবান রুদ্র আপনার বেগ ধারণ করবেন।

রাজা ভগীরথ গঙ্গাদেবীকে এইপ্রকার বলে তপস্যার দ্বারা ভগবান শিবের সন্তোষ বিধানে তৎপর হলেন। তাঁর প্রতি আশুতোষের সন্তোষ জন্মিল। তারপর সর্বলোকের হিতকারী ভগবান শংকর ভগীরথের প্রার্থনায়, ‘তথাস্তু’, অর্থাৎ তাই হোক-বলে অঙ্গীকারপূর্বক শ্রীহরির পাদস্পর্শহেতু পবিত্র সলিলা গঙ্গাকে নিজ মস্তকে ধারণ করলেন। রাজর্ষি ভগীরথ যেস্থানে নিজ পিতৃপুরুষের দেহ ভস্মীভূত হয়ে ভূমিতে পড়েছিল, সেখানে ভুবনপাবণী গঙ্গাকে নিয়ে গেলেন। তিনি বায়ুর মত বেগগামী রথে আরোহণ করে আগে আগে চললেন, তার পেছনে পেছনে ত্রিলোকপাবনী গঙ্গা ধাবমানা হয়ে সকল দেশ পবিত্র করতে ভস্মীভূত সগর সন্তানদের নিজ জল দ্বারা সিক্ত করলেন। হে রাজন, সগরপুত্রগণ ব্রাহ্মণের প্রতি আত্মকৃত দণ্ডে হত হয়েও কেবল দেহ ভস্মদ্বারা যার জল স্পর্শমাত্রে স্বর্গে গমন করল, আর শ্রদ্ধাপূর্বক তার সেবা করলে কি ফল হতে পারে চিন্তা কর। সগর পুত্রগণ ভস্মীভূত অঙ্গদ্বারা গঙ্গার সংস্পর্শ হেতুই স্বর্গগামী হয়েছিলেন। এ অবস্থায় যাঁরা ব্রতনিষ্ঠ হয়ে শ্রদ্ধাসহকারে গঙ্গাদেবীর সেবা করেন, তাঁদের কথা আর কি বলব?

হে রাজন্ এস্থলে গঙ্গাদেবীর যে মাহাত্ম বর্ণিত হল, তা পরম আশ্চর্যজনক নয়, কারণ তিনি অনন্ত শ্রীহরির চরণপদ্ম প্রসূতা ও পাপ নাশিনী। হে কুরুবর্ষ, অমল মুনিগণ শ্রদ্ধাসহকারে যে অনন্তে মনোনিবেশ করে দেহ সম্বন্ধ পরিত্যাগ পূর্বক সদ্যই তৃতীয় স্বরূপ প্রাপ্ত হন, তার পাদপদ্ম প্রভাব অবশ্যই অনির্বচনীয়। যা হোক, রাজা ভগীরথের পুত্রের নাম শ্রুত, তাঁর পুত্র নাভ, নাভের পুত্র সিন্ধুদ্বীপ, তার পুত্র অযুতায়ুঃ, তার ঔরসে নলের সখা ঋতুপর্ণ নলকে অক্ষক্রীড়ার রহস্য শিক্ষা দিয়ে, তার নিকট হতে অশ্ববিদ্যা লাভ করেন। ঋতুপর্ণের পুত্রের নাম সর্বকাম। সর্বকামের পুত্র সুদাস। তার পুত্র সৌদাস, ইনি দয়ন্তীর স্বামী। তাঁকে “মিত্রসহ’ এই নামে, কোথাও বা কল্মষ নামে উল্লেখ করা হয়। ইনি বশিষ্ঠের শাপে রাক্ষস এবং নিজকর্মবশতঃ নিঃসন্তান হয়েছিলেন।

রাজা পরীক্ষিৎ জিজ্ঞাসা করলেন –ব্রাহ্মণ, মহাত্মা সৌদাসের প্রতি গুরু বশিষ্ঠদেব কিজন্য শাপ দিয়েছিলেন, যদি তা গোপনীয় হয়, আমাদের বলুন, আমরা শুনতে ইচ্ছা করি। শ্রীশুকদেব বললেন–একদিন সৌদাস মৃগয়ায় গিয়ে একটি রাক্ষসকে বধ করেন, কিন্তু তার ভাইকে ছেড়ে দেন। তারপর সেই রাক্ষস ভ্রাতৃহত্যার প্রতিকার করতে ইচ্ছুক হয়ে রাজার অনিষ্ট চিন্তা করতে করতে পাঁচকরূপে রাজার গৃহে অবস্থান করতে লাগল। একদিন মহর্ষি বশিষ্ঠ রাজগৃহে আগমনপূর্বক ভোজনেচ্ছা প্রকাশ করলে, সে নরমাংস পাক করে আনল। ঐ মাংস পরিবেশনের সময় ভগবান বশিষ্ঠদেব দিব্যদৃষ্টি বলে উহা অভক্ষ্য দ্রব্য জানতে পেরে ক্রুদ্ধচিত্তে রাজাকে অভিশাপ দিলেন– এরূপ নরমাংস ব্যবহার দোষে তুমি রাক্ষসভাব লাভ করবে, পরে বশিষ্ঠ ঋষি, রাক্ষসই ঐ নরমাংস দিয়েছে, রাজার কোন দোষ নেই জানতে পেরে ঐ শাপকে দ্বাদশ বর্ষমাত্র স্থায়ী করেছিলেন।

এদিকে রাজাও বিনা অপরাধে অভিশপ্ত হওয়ায় ক্রুদ্ধ হয়ে জলগণ্ডুষ গ্রহণপূর্বক গুরুকে প্রতিশাপ দিতে উদ্যত হলে, পত্নী দয়মন্তী বারণ করায় তিনি দিসমূহ, আকাশ ও পৃথিবী সকলকেই জীবময় দেখে অর্থাৎ কোথাও সেই জল নিক্ষেপ করতে না পেরে, অবশেষে ক্রোধাগ্নিরূপে সেই জল নিজের পাদদ্বয়ে পরিত্যাগ করলেন। তারপরে রাজা সৌদাস রাক্ষসত্ব প্রাপ্ত হলেন এবং তার পদযুগল কল্মষ অর্থাৎ মিশ্রিত নানা বর্ণবিশিষ্ট হল। এইরূপে তিনি অরণ্যমধ্যে ভ্রমণ করতে করতে একদিন মৈথুনকর্মরত বনবাসী ব্রাহ্মণ-দম্পতাঁকে দেখতে পেলেন। তখন তিনি ক্ষুধার্ত হয়ে আহারের জন্য ব্রাহ্মণকে গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণী অতি দীনের মত বলতে লাগলেন–হে মহারাজ, আপনি রাক্ষস নন, কিন্তু সাক্ষাৎ ইক্ষবাকু বংশীয় রাজগণের মধ্যে একজন মহারথ। বিশেষতঃ আপনি দয়মন্তীর পতি বলে এরূপ অধর্ম করতে পারেন না। আমি পুত্রকামা, আমার পতিরও রতিক্রিয়া সমাপ্ত হয় নাই, অতএব আপনি আমাকে এই ব্রাহ্মণপতি প্রদান করুন। হে বীর, হে মহারাজ, এই মানবদেহে পুরুষদের অখিল পুরুষার্থ সাধন হয়, অতএব এই দেহের নাশকে সর্বার্থ নাশ বলা হয়েছে।

আর, এই ব্রাহ্মণ বিদ্বান্ এবং শীল ও বিবিধ গুণযুক্ত। যিনি সকল ভূতগণের মধ্যে ভূতসমুদয়ের আত্মরূপে অবস্থিত, অথচ মায়াগুণ যোগে অন্তর্হিত, সেই মহাপুরুষ সংজ্ঞক ব্রহ্মবস্তুর ইনি আরাধনা করতে বাসনা রাখেন। হে ধর্মজ্ঞ, পুত্র যেমন পিতার বধযোগ্য হয় না, তেমনি ব্রহ্মর্ষি শ্রেষ্ঠ এই ব্রাহ্মণ ও রাজর্ষিশ্রেষ্ঠ আপনার বধ্য হতে পারে না। কর্ম, মন ও বাক্যের দ্বারা সকল প্রাণীগণের প্রতি সৌহার্দ আচরণকেই বিদ্যে বিবেকসম্পন্ন পণ্ডিতগণ শীল বলে থাকেন। আপনি সজ্জন সম্মত রাজা, আর আমার পতি নিষ্পাপ, ব্রহ্মবাদী ও শ্রোত্রিয় সাধুপুরুষ। এ অবস্থায় গো-বধের ন্যায় ইহার বধ কিরূপে আপনার বিচারে সঙ্গত হতে পারে, আর যদি আপনি তাকে ভক্ষণই করেন, তা হলে আগে আমাকে ভক্ষণ করুন, যেহেতু আমি তার বিরহে মৃতপ্রায়া হয়ে ক্ষণকালও বেঁচে থাকতে পারব না। করুণভাষিণী ব্রাহ্মণী এরূপে অনাথার মত বিলাপ করতে থাকেন, পাপমোহিত সৌদাস তাঁর কথা আগ্রাহ্য করে–ব্যাঘ্র যেমন গবাদি পশু ভক্ষণ করে, তেমনি সেই ব্রাহ্মণকে ভক্ষণ করেছিলেন।

তখন ব্রাহ্মণী গর্ভদান কর্তা নিজ পতিকে রাক্ষসে ভক্ষণ করছে দেখে, নিজের জন্য শোক করতে করতে ক্রোধে রাজাকে এরূপ অভিশাপ দিলেন-হে পাপিষ্ঠ, হে নির্বোধ, যেহেতু তুমি কামপীড়িতা আমার স্বামীকে ভক্ষণ করেছ-সেইহেতু আমি বলছি–তোমারও মৈথুন নিমিত্ত মৃত্যু হবে। পতিলোক পরায়ণা ব্রাহ্মণী মিত্রসহকে (রাজা সৌদাসকে) এরূপ অভিশাপ দিয়ে ব্রাহ্মণের অস্থিসমূহ প্রজ্বলিত অগ্নিতে নিক্ষেপ পূর্বক নিজেও দেহত্যাগ করলেন (অর্থাৎ নিজেও অগ্নিতে প্রবেশ করে স্বামীর অনুগমন করলেন)। দ্বাদশ বৎসর অতীত হলে সৌদাস শাপমুক্ত হলেন। তারপর একদিন মৈথুনকর্মে উদ্যত হলে মহিষী দয়মন্তী ব্রাহ্মণীর অভিশাপের কথা জানিয়ে স্বামীকে নিবারণ করলেন। নিজ কর্মদোষে নিঃসন্তান রাজা সৌদাস এর পর হতে স্ত্রীসম্ভোগ সুখ ত্যাগ করলেন এবং বশিষ্ঠদেব তাঁরই নিয়োগক্রমে দয়মন্তীর গর্ভাধান করেন। দয়মন্তী সাত বৎসর সেই গর্ভ ধারণ করলেন, কিন্তু কোন সন্তান ভূমিষ্ঠ হল না। পরে বশিষ্ঠই অশ্ম অর্থাৎ প্রস্তর দ্বারা দয়মন্তীর উদরে আঘাত করলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। অক্ষ্ম দ্বারা আঘাতের ফলে জন্মহেতু তার অক্ষুক এই নাম হয়েছিল। সেই অক্ষুক হতে বালিকার জন্ম হয়। স্ত্রীলোকগণ বেষ্টন করে পরশুরামের কোপ হতে তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। এই কারণে তিনি নারীকবচ বলে কথিত হয়ে থাকেন। আবার পৃথিবী ক্ষত্রহীন বলে, ইনিই ক্ষত্রিয়কুলের মূল হওয়ায় ‘মূলক’ নামেও পরিচিত হয়েছিলেন। মূলকের পুত্রের নাম দশরথ, তাঁর পুত্র ঐড়বিড়ি, তার পুত্র রাজা বিশ্বসহ এবং তারই পুত্র রাজচক্রবর্তী খট্টাঙ্গ।

দুর্জয় মহাবীর রাজা খট্টাঙ্গ দেবগণের প্রার্থনায় যুদ্ধে দৈত্যদের সংহার করেন। তারপর মুহূর্তকালমাত্র আয়ুর অবশেষে জানতে পেরে নিজ পুরীতে আগমনপূর্বক পরমেশ্বরে মনোনিবেশ করলেন। তৎকালে তিনি এরূপ নিশ্চয় করেছিলেন কুলদেবতা ব্রাহ্মণ অপেক্ষা প্রাণ, পুত্র, ধন সম্পত্তি, পৃথিবী, রাজত্ব এবং ভাষাও আর অধিক প্রিয় নহে, আমার মতি কখনও অল্পমাত্র অধর্মে রত হয়ে নাই এবং আমি উত্তমঃশ্লোক শ্রীহরি ভিন্ন জগতে অন্য কোন বস্তুই দেখতে পাই নাই। ত্রিভুবনের অধিপতি দেবগণ আমাকে অভিলষিত বরদানে ইচ্ছুক হলেও, ভূতভাবন হরিতে আমার ভাবনা থাকায় আমি তাও বরণ করি নাই। যাঁদের ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি বিক্ষিপ্ত, সেই দেবতাগণও নিরন্তর নিজ হৃদয়ে অবস্থিত পরমপ্রিয় সেই আত্মাকে (ভগবানকে) অবগত হতে পারে না, এতে অপরে দেখবে সম্ভবনা কি? যাহা ভগবানেরই মায়ারচিত এবং গন্ধর্ব নারীর ন্যায় বাস্তব সত্তাহীন, তদৃশ ত্রিগুণময় জাগতিক বিষয়সমূহের সম্বন্ধে স্বভাবতঃই চিত্তে যে আসক্তি বদ্ধমূল রয়েছে, এরপর আমি বিশ্বকর্তা শ্রীহরির ভাবনাবলে, তা ছিন্ন করে সেই ভগবানেরই শরণাপন্ন হব।

তারপর রাজা খট্টাঙ্গ শ্রীনারায়ণাশ্রিতা বুদ্ধির দ্বারা এরূপে নিশ্চয় করে, দেহাদি বিষয়ে আত্মাভিমান রূপ অজ্ঞান পরিহারপূর্বক স্বীয়ভাবে অর্থাৎ নিজ স্বরূপে অবস্থান করেছিলেন। ভক্তগণ যাঁকে ভগবান বাসুদেব বলে থাকেন এবং যিনি বাক্যাদির অবষিয় বলে শূন্যরূপে কল্পিত হন, কিন্তু যিনি শূন্য না হয়ে পরিপূর্ণরূপেই বিরাজমান, সেই সূক্ষ্ম (নির্লেপ) পরব্রহ্মই জীবের স্বীয়ভাব অর্থাৎ নিজ স্বরূপ (রাজা খট্টাঙ্গ সেই স্বরূপেই প্রাপ্ত হয়েছিলেন)।

.

দশম অধ্যায়
শ্রীরামচরিত বর্ণন

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, খট্টাঙ্গ রাজার পুত্র দীর্ঘবাহু তা হতে মহাযশস্বী রঘুর জন্ম হয়। রঘু হতে মহারাজ অজ এবং ঐ অজ হতে মহাত্মা দশরথ জন্মগ্রহণ করেন। সাক্ষাৎ ব্রহ্মময় ভগবান শ্রীহরি দেবগণের প্রার্থনায় রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন–এই চার ভাগে বিভক্ত নিজ অংশাংশ দ্বারা রাজা দশরথের পুত্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। হে রাজন, বাল্মীকি প্রভৃতি তত্ত্বদর্শী ঋষিগণ সীতাপতি ঐ রামচন্দ্রের চরিত্র সুবিস্তৃতরূপে বর্ণনা করেছেন। তুমিও বারবার শুনেছ, তথাপি সংক্ষেপে বলছি, শোন। যিনি পিতৃসত্য পালনের জন্য রাজ্য পরিত্যাগ করে, প্রিয়তমার করস্পর্শ সহনেও অসমর্থ সুকোমল পদযুগল দ্বারা বনে বনে বিচরণ করলে কপিবর (হনুমান বা সুগ্রীব) এবং অনুজ লক্ষ্মণ যাঁর পথশ্রান্তি অপনয়ন করে দিতেন শূর্পণখার নাসাকর্ণ ছেদনহেতু (রাবণ সীতা হরণ করলে) যিনি প্রিয়তমার বিরহ জনিত ক্রোধবশে ভুভঙ্গী করায় সমুদ্র ভীত হলে, যিনি তার উপর সেতুবন্ধন করে রাবণাদি খলগণ রূপ বনের দাবানল হন। (অর্থাৎ তাদের সংহার করেছিলেন) সেই শ্রীরামচন্দ্র আমাদের রক্ষা করুন।

যিনি বিশ্বামিত্র ঋষির যজ্ঞে লক্ষ্মণের দৃষ্টির সম্মুখে (তারও অপেক্ষা না করে), মারীচ প্রভৃতি প্রধান প্রধান রাক্ষসদের একাকী বধ করেছিলেন, (সেই অযোধ্যার রাজা শ্রীরামচন্দ্র আমাদের রক্ষা করুন)। তিনি সীতার স্বয়ংবর গৃহে বীরপুরুষসমূহের সমাজ মধ্যে মহাদেবের ধনু উক্ষুদণ্ডের মত গ্রহণ করে জ্যা আরোপণের পর আকর্ষণ ও মধ্যভাগে ভগ্ন করেন। সেই ধনু অতিশয় গুরুতর ছিল, তিন শতবাহকে তা আনয়ন করে দেয়, কিন্তু রামচন্দ্রের লীলা বালগজতুল্য অদ্ভুত, অতএব তিনি অবলীলাক্রমে তা ভগ্ন করেন। যে সীতাদেবী পূর্বে লক্ষ্মীরূপে বক্ষঃস্থলে থেকে আদর লাভ করতেন, নিজ অনুরূপ গুণ, শীল, বয়স ও অঙ্গকান্তিসম্পন্না সেই সীতাদেবীকে স্বয়ংবর সভায় জয় করে নিয়ে যাবার সময় পথে, যিনি একবিংশতিবার পৃথিবীর ক্ষত্ৰকুল সংহারকারী পরশুরামের দর্প চূর্ণ করেছিলেন, সেই শ্রীরামচন্দ্র আমাদের রক্ষা করুন।

(কোন সময় কৈকেয়ীর প্রতি তুষ্ট হয়ে রাজা দশরথ তাঁকে বর দিতে প্রতিশ্রুত হন। রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক সময়ে দাসী মন্থরার কুপরামর্শে কৈকেয়ী ভরতের যৌবরাজ্য এবং রামের বনবাস প্রার্থনা করেন।) সত্যপাশে আবদ্ধ স্ত্রৈণ রাজার আদেশকেও যিনি অবনত মস্তকে স্বীকারপূর্বক যোগী পুরুষের প্রাণত্যাগের ন্যায় অনায়াসে রাজ্য সম্পদ অনুরাগী সুহৃদগণ ও গৃহ পরিত্যাগ করে বনে গমন করেছিলেন, সেই অযোধ্যারাজ শ্রীরামচন্দ্র আমাদের রক্ষা করুন। যিনি রাবণের ভগিনী কামাতুরা শূর্পণখার (নাসিকা কর্ণ ছেদন করতঃ) রূপ বিকৃত করে, নিজ হস্তে অসহনীয় ধনুর্বাণ ধারণপূর্বক তারই আত্মীয় খর দূষণ প্রভৃতি চতুর্দশ সহস্র রাক্ষস বধ করেছিলেন, সেই কোশলেন্দ্র আমাদের রক্ষা করুন।

হে মহারাজ, সীতার সৌন্দর্যাদির কথা শুনে কামাতুর রাবণ সীতাহরণের অভিপ্রায়ে দুরাত্মা মারীচ নামক রাক্ষসকে নিযুক্ত করলে, মারীচ অদ্ভুত দর্শন স্বর্ণমৃগ রূপ ধারণপূর্বক রামচন্দ্রকে আশ্রম থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর ভগবান রুদ্র (বীরভদ্র) যেমন দক্ষকে বধ করেছিলেন, তেমনি শ্রীরামচন্দ্রও তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা সত্বর মারীচকে নিহত করেছিলেন। বনে রক্ষণহীন মেষকে যেমন বৃক (নেকড়ে বাঘ) হরণ করে, তেমনি শ্রীরামচন্দ্রের অনুপস্থিতিকালে রাক্ষসরাজ রাবণ, বিদেহ রাজ দুহিতা রাম বণিতাকে অপহরণ করলে, রামচন্দ্র প্রিয়তমা বিরহিত হয়ে স্ত্রী-সঙ্গীদের এরূপ দুর্গতি প্রচারের জন্যই নিজে ভ্রাতা লক্ষ্মণের সাথে বনে বনে ভ্রমণ করতে লাগলেন। ব্রহ্মা ও শংকর যাঁর চরণপদ্ম অর্চনা করেন সেই মানবাকার ভগবান শ্রীরামচন্দ্র সীতা উদ্ধার করতে গিয়ে রাবণের হস্তে নিহত অকৃতদার জটায়ু পক্ষীকে পুত্রের মত শাস্ত্রবিধানে দাহনাদিপূর্বক সকার করলেন। পরে নিজেকে গ্রহণের জন্য প্রসারিত বাহু কবন্ধের প্রাণসংহার করেছিলেন। তারপর বানরগণের সাথে মিত্রতা করে বালি বধ করেন এবং তাদের সাহায্যে প্রিয়তমা সীতার লঙ্কায় অবস্থানের কথা জানতে পেরে বানর সৈন্যগণের সহিত সমুদ্রতীরে গমন করলেন।

সাগরতীরে ত্রিরাত্র উপবাসপূর্বক সমুদ্রের আগমন প্রতীক্ষা করলেও সমুদ্র উপস্থিত না হওয়ায়, শ্রীরামচন্দ্র ক্রোধলীলার অভিনয় করে বিস্তৃত কটাক্ষপাত করলে, সমুদ্র মধ্যস্থিত কুম্ভীর ও মকরাদি জলজন্তুগণ অতিশয় উদ্বিগ্ন হল। সমুদ্রও তার গর্জন স্তব্ধ করে মূর্তিমান হয়ে মস্তকে অর্থ্যাদি পুজোপহার ধারণপূর্বক শ্রীরামচন্দ্রের পাদপদ্মে উপনীত হয়ে বলতে লাগলেন–হে ভূমন, আমরা জড়মতি এজন্য এতকাল আপনাকে জানতে পারিনি। আপনি নির্বিকার আদিপুরুষ ও জগদীশ্বর। আর যাঁর বশবর্তী সত্ত্বগুণ হতে সুরগণ, রজোগুণ হতে প্রজাপতি সকল এবং তমোগুণ হতে ভূতপতি সকল উৎপন্ন হন, আপনি সেই গুণেশ্বর। হে বীর, আপনি স্বচ্ছন্দে আমার জল অতিক্রম করে গমন করুন। বিশ্রবামুনির পুরীষতুল্য ও ত্রিলোকের পীড়াদায়ক রাবণকে সংহার করে নিজ পত্নীকে লাভ করুন। যদিও আমার জল আপনার গমনের প্রতিবন্ধক নয়, তথাপি জগতে কীর্তি বিস্তারের জন্য আমার জলের উপর সেতু রচনা করুন, ভবিষ্যতে দিবিজয়ী নৃপতিগণ সে সেতুর নিকট এসে আপনার যশগান করবেন।

তারপর রামচন্দ্র বিবিধ পর্বতশৃঙ্গ দ্বারা সমুদ্রের উপর সেতু বন্ধন করলেন। ঐ সকল পর্বতশৃঙ্গস্থিত বৃক্ষসমূহের শাখা প্রভৃতি অবয়ব সমুদয় বানর বীরগণের হস্ত দ্বারা কম্পিত হতেছিল। এরপর সেতুবন্ধ হলে বিভীষণের পরামর্শক্রমে সুগ্রীব, নীল, হনুমান প্রভৃতি সেনাগণের সহিত শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কায় প্রবেশ করলেন। যে লঙ্কা পূর্বেই (সীতান্বেষণ সময়ে) হনুমান কর্তৃক দগ্ধ হয়েছিল। গজসমূহের দ্বারা নদীর যেরূপ আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তৎকালে শ্রীরামচন্দ্রের প্রবেশহেতু লঙ্কারও সেরূপ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ বানর রাজগণের সৈন্যগণ সেখানকার ক্রীড়াস্থান ধ্যানাগারত কোম, গৃহাদির দ্বারক, রুদ্ধদ্বার সভা বলভী (প্রসাদের উপরিস্থিত আচ্ছাদন ভাগ) এবং কপোতসমূহের আশ্রয়স্থান সকল রুদ্ধ করতে লাগল। আর বেদী, পতাকা, স্বর্ণকলস ও চতুষ্পথ, প্রভৃতি সমুদায় ভগ্ন করে দিল।

রাক্ষসরাজ রাবণ তা লক্ষ্য করে, নিকুম্ভ, কুম্ভ, ধূম্রাক্ষ, দুর্মখ, সুরান্তক ও নরান্তক প্রভৃতি সমস্ত অনুচর এবং ইন্দ্রজিৎ প্রহস্ত, অতিকায়, বিকম্পর্নাদি পুত্রদের পরে কুম্ভকর্ণকে প্রেরণ করলেন। যদিও ঐ সকল রাক্ষস সেনা অসি, শূল, ধনুঃ, প্রাস, ঋষ্টি, শক্তি, শর, তোমর, খাদি বিবিধ শাস্ত্র অতিশয় দুর্ধর্ষ ছিল, তথাপি রামচন্দ্র লক্ষ্মণ, সুগ্রীব, হনুমান, গন্ধমাদন, নীল, অঙ্গ, জম্বুবান এবং প্ৰণসাদি সেনাপতিগণের সহিত মিলিত হয়ে তাদের অভিমুখে যাত্রা করলেন। তারপর শ্রীরামচন্দ্রের সেনাধ্যক্ষ অঙ্গদ প্রভৃতি বীরগণ দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য হস্তী, পদাতিক, রথ ও অশ্ব সমন্বিত চতুরঙ্গ সেনাদের মধ্যে পতিত হয়ে, সীতাদেবীর দেহ স্পর্শহেতু ক্ষীণমঙ্গল রাবণের অধীন সেই রাক্ষসগণকে বৃক্ষ, পর্বত, গদা ও বামদ্বারা নিহত করতে আরম্ভ করল। রাক্ষসরাজ রাবণ নিজ সৈন্যদের বিনাশ দর্শনে ক্রুদ্ধ হয়ে নিজ রথে আরোহণপূর্বক শ্রীরামচন্দ্রের অভিমুখে অগ্রসর হল। ঐ সময় ইন্দ্ৰসারথি মাতুলি দীপ্তিশালী দেবেন্দ্রের রথ এনে উপস্থিত করলে শ্রীরামচন্দ্র তাতে আরোহণ করে বিরাজ করতে লাগলেন। রাবণ সুতীক্ষ্ম ক্ষুশর ক্ষেপণ পূর্বক আঘাত করল।

তৎকালে শ্রীরামচন্দ্র রাবণকে বললেন–হে রাবণ, তুমি রাক্ষসদের মধ্যে বিষ্ঠাতুল্য। তুমি আমার আগোচরে যেহেতু কুকুরের ন্যায় আমার ভার্যাকে হরণ করেছ, সেইহেতু অলঙঘ্য প্রভাব কাল যেমন অধর্মকারী ব্যক্তিদের যথোচিত ফলদান করে, তেমনি আমিও আজ লজ্জাশূন্য তোমার নিন্দিত কর্মের সমুচিত ফল দান করছি। শ্রীরামচন্দ্র রাবণকে এরূপ ভর্ৎসনা করে, ধনুকে বাণ যোজনাপূর্বক তার দিকে নিক্ষেপ করলেন এবং ঐ বাণ বজ্রের মত তার হৃদয় ভেদ করল। তারপর মৃত্যু হলে সুকৃতী ব্যক্তি যেমন অধোলোক পতিত হয়, রাবণও তেমনি দশ মুখে রক্ত বমন করতে করতে পুষ্পক রথ হতে ভূপতিত হল। তা দেখে রাক্ষসগণ সকলে হাহাকার করতে লাগল।

রাবণের মৃত্যুর পর মন্দোদরীর সহিত সহস্র সহস্র রাক্ষসী লঙ্কাপুরী হতে বাহির হয়ে রোদন করতে করতে যেখানে রাবণ পতিত হয়েছিলেন, সেখান উপস্থিত হলেন। তারা লক্ষ্মণের বাণদ্বারা নিহত নিজ নিজ পতিদের আলিঙ্গন করে, হস্তদ্বারা নিজ বক্ষঃ প্রভৃতি স্থানে আঘাত করতে করতে করুণ স্বরে রোদন করছিল। তারা বলতে লাগল–হে নাথ, হে লোভয়ংকর রাবণ, আমার হত হলাম, তোমার অভাবে শত্রুপীড়িতা এই লঙ্কাপুরী কাকে আশ্রয় করবে? হে মহাভাগ, তুমি কামপরবশ হয়ে সীতার তেজঃপ্রভাব জানতে পার নাই–যে তেজের প্রভাবে তুমি এই মৃত্যুদশায় উপনীত হয়েছ, হে কুলনন্দন, তোমার হতেই এই লঙ্কা এবং আমরা পতিহীনা হলাম। তুমি আত্মদোষে নিজের দেহকে গৃগণের ভক্ষ্য ও আত্মাকে নরকভাগী করলে।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–তারপর কোশলাধিপতি শ্রীরামচন্দ্রের অনুমোদনক্রমে বিভীষণ পিতৃযজ্ঞ বিধানক্রমে জ্ঞাতিদের ঔধ্বদেহিক ক্রিয়াকলাপ নির্বাহ করলেন। তারপর শ্রীরামচন্দ্র অশোকবনে শিংশপো বৃক্ষের মূলদেশে অবস্থিত নিজ বিরহসন্তাপ্তা, ক্ষীণদেহী সীতাদেবীকে দর্শন করলেন। তৎকালে শ্রীরামচন্দ্রের দর্শনজনিত আনন্দে সীতাদেবীর মুখপদ্ম উৎফুল্ল হলে, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র দৈন্যস্তা প্রিয়তমা ভার্যাকে দেখে তাঁর প্রতি কৃপা প্রকাশ করলেন। তারপর ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বিভীষণকে রাক্ষসগণের অধিপতি, লঙ্কাপুরী এবং কল্পকাল স্থায়ী পরমায়ু প্রদান করে, সীতাকে নিয়ে রথে আরোহণ করলেন। পরে হনুমান, লক্ষ্মণ ও সুগ্রীবের সহিত নিজ পুষ্পক রথে আরোহণ করলেন। এবং বনবাস ব্রত সমাপ্ত হওয়ায় অযোধ্যাভিমুখে যাত্রা করলেন। (তৎকালে বিভীষণ ও তার সহযাত্রী হয়েছিলেন)। তার যাত্রাপথে লোকপালগণ তার উপর পুষ্পবর্ষণ এবং ব্রহ্মাদি দেবগণ প্রীতিভরে তার চরিত কীর্তন করেছিলেন।

শ্রীরামচন্দ্র আসতে আসতে শুনলেন, ভ্রাতা ভরত অযোধ্যার বহির্ভাগে শিবির করে জটিল ও বল্কলধারী হয়ে আছেন, প্রাণীধারনার্থ গোমূত্র পক্ক যবান্নমাত্র ভোজন করেন। অতএব করুণাদ্র হৃদয়ে হয়ে তার জন্য সন্তাপ করতে লাগলেন। এদিকে ভরত রামচন্দ্রের উপস্থিতির কথা শুনতে পেয়ে তার পাদুকাযুগল মস্তকে ধারণপূর্বক পৌরজন, অমাত্যবর্গ ও পুরোহিতগণের সহিত অগ্রজের দিকে অগ্রসর হলেন। তৎকালে ভরত নন্দিগ্রামস্থিত নিজ শিবির হতে গীতবাদ্য ধ্বনি সহযোগে, নিরন্তর উচ্চস্বরে বেদমন্ত্র পাঠরত দেবজ্ঞ ব্রাহ্মণগণের সহিত শ্রীরামচন্দ্রের প্রত্যুৰ্গমনের জন্য অগ্রসর হয়েছিলেন। প্রাপ্তভাগে সুবর্ণর সে রঞ্জিত পতাকারাজি এবং বিবিধ ধ্বজাশোভিত উত্তম অশ্বমুক্ত, সুবর্ণময় পরিচ্ছদ মণ্ডিত স্বর্ণময় রথসমূহ, স্বর্ণমাকৃত সৈন্যসমুদয়, শ্রেণীবদ্ধ বহুবাহ বারাঙ্গানা এবং পদচারী ভৃত্যগণের সাথে রাজোচিত ছত্র চামরাদি ও বিবিধ পণ্যদ্রব্য নিয়ে ভরত শ্রীরামচন্দ্রের নিকট গিয়ে তাঁর পদযুগলে পতিত হলেন।

তৎকালে তার নয়নযুগল ও বক্ষঃস্থলে প্রেমাবেগে অশ্রুসিক্ত হয়েছিল। ভরত পাদুকাযুগল সামনে রেখে বাষ্পকুলনেত্রে কৃতাঞ্জলি হয়ে অবস্থান করলে, শ্রীরামচন্দ্র বাহুযুগল দ্বারা দীর্ঘকাল পর্যন্ত তাকে আলিঙ্গন করে নয়নজলে স্নান করালেন। পরে তিনি, সীতা ও লক্ষ্মণ ব্রাহ্মণগণকে এবং পূজনীয় কুলবৃদ্ধগণকে প্রণাম করলেন এবং প্রজাগণ তাকে নমস্কার করল। তখন উত্তর কোশলস্থ অর্থাৎ অযোধ্যার সমস্ত প্রজাগণ তাঁকে নমস্কার করল। তখন উত্তর কোশলস্থ অর্থাৎ অযোধ্যার সমস্ত প্রজাগণ। বহুকাল পর নিজেদের অধিপতিকে আগত দেখে আনন্দসাগরে মগ্ন হলেন। এবং নিজ নিজ উত্তরীয় বসন কম্পিত করত হর্ষে পুষ্পমালা বর্ষণ ও নৃত্য আরম্ভ করলেন। হে রাজন, রামচন্দ্র যখন অযোধ্যায় প্রবিষ্ট হন, তৎকালে ভরত পাদুকাদ্বয় গ্রহণ করলেন, বিভীষণ ও সুগ্রীব চামর ও ব্যাজন নিলেন, পবনতনয় হনুমান্ শ্বেতচ্ছত্র ধারণ করলেন। শত্রুঘ্ন ধনুক ও তৃণ সীতা তীর্থোদকের কমণ্ডলু, আর অঙ্গদ খঙ্গও ঋক্ষরাজ জাম্বুবান স্বর্ণময় করেছিলেন।

হে মহারাজ, তৎকালে পুষ্পক রথে অবস্থিতি রামচন্দ্রকে রমণীগণ স্তুতি ও বন্দিগণও বন্দনা করলে, তিনি গহনসহ উদিত চন্দ্রের ন্যায় বিরাজ করছিলেন। তারপর শ্রীরামচন্দ্র ভ্রাতা ভরত কর্তৃক অভিনন্দিত হয়ে উৎসবযুক্ত পুরীমধ্যে প্রবেশ করলেন। এবং রাজভবনে প্রবেশ করে নিজ মাতা কৌশল্যা কৈকেয়ী প্রভৃতি গুরুপত্নীগণ ও গুরুজনদের পূজা করলেন। পরে বয়স্য ও কনিষ্ঠ ব্যক্তিদের দ্বারা পূজিত হয়ে তাদেরও যথোচিত সন্মান করলেন। প্রাণসঞ্চারে দেহ যেরূপ উত্থিত হয়, সেরূপ। তৎকালে মাতৃবর্গ নিজ নিজ সন্তানদের পেয়ে সহসা উত্থিত হলেন এবং তাদের ক্রোড়ে আরোপণ করে বাষ্পবারির দ্বারা অভিষেক করত শোক সন্তাপ পরিত্যাগ করলেন।

অনন্তর কুলগুরু বশিষ্ঠদেব কুলবৃদ্ধদের সহিত মিলিত হয়ে রামচন্দ্রের জটা মোচন করিয়ে, চতুঃসমুদ্রে জল প্রভৃতি অভিষেক দ্রব্যের দ্বারা ইন্দ্রের ন্যায় তার যথাবিধি, অভিষেক করলেন। এইরূপ শিরস্নানের পর শ্রীরামচন্দ্র মনোরম বস্ত্র, মাল্য ও বিবিধ অলংকারে শোভিত হয়ে, ভার্য্যা সীতাদেবী এবং বস্ত্রালংকারে ভূষিত ভ্রাতৃগণের সহিত অতিশয় দীপ্তি পেতে লাগলেন। তারপর ভ্রাতা ভরত প্রাণিপাতপূর্বক তাকে প্রসন্ন করালেন, তিনি রাজসিংহাসন গ্রহণ করলেন এবং স্বধর্মনিরত ও বর্ণাশ্রমগুণযুক্ত প্রজাদের পিতার মত পালন করতে প্রবৃত্ত হলেন। প্রজারাও তাকে পিতা বলে মান্য করতে থাকল। সর্বপ্রাণীর সুখাবহ ধর্মজ্ঞ শ্রীরামচন্দ্রের রাজা হলে, ত্রেতাযুগ বিদ্যমান থাকলেও বস্তুতঃ সেই কাল সত্যযুগের তুল্য হয়েছিল।

হে ভরতকুলশ্রেষ্ঠ মহারাজ, তৎকালে বর্ণ, নদী, পর্বত, বর্ষ, দ্বীপ্য ও সাগরসমূহ সকলই প্রজাগণের অভীষ্ট পূরণ করেছিল। অর্ধেক্ষজ ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের রাজত্বে প্রজাগণের অধিঃ (মনঃপীড়া) ব্যাধি (দৈহিক রোগ), জরা, গ্লানি, দুঃখ, শোক, ভয়, ক্লান্তি, এমনকি তাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও মৃত্যু ছিল না। একপত্নী ব্রতধারী ও, রাজর্ষির আচরণমুক্ত ভগবান শ্রীরামচন্দ্র সর্বদা শুদ্ধভাবে থেকে, প্রজাগণের গৃহস্থেচিত ধর্ম, শিক্ষাদানের জন্যই নিজে উদার আচরণ করতেন, তৎকালে স্বামীর অভিপ্রেত বিষয়ে অভিজ্ঞা সীতাদেবী বিনয়বনতা হয়ে প্রেম, আনুগত্য, শীল, বুদ্ধি ও লজ্জাদ্বারা শ্রীরামচন্দ্রের চিত্ত আকর্ষণ করেছিলেন।

.

একাদশ অধ্যায়
শ্রীরামচন্দ্রের বংশবর্ণন ও ভক্তগণের সহিত তার স্বপদবরাহণ

শ্ৰীশুকদেব বললেন–তারপর ভগবান শ্রীরামচন্দ্র আচার্য বশিষ্ঠদেবের উপদেশ অনুসারে যথাযথ, উত্তম উপকরণাদিযুক্ত সর্বাঙ্গ সম্পন্ন যজ্ঞসমূহের দ্বারা সর্বদেবময়, বিষ্ণুরূপী নিজেকেই নিজে অর্চনা করেছিলেন। তিনি যজ্ঞান্তে হোতাকে পূর্বদিক্‌, ব্রহ্মাকে দক্ষিণ দিক, অধ্বযুকে পশ্চিম দিক্ এবং সামগানকারীকে উত্তর দিক্ দান করলেন। ঐ সকল দিকের মধ্যবর্তী যে সকল ভূমি ছিল, তা কোন নিঃস্পৃহ ব্রাহ্মণই পাবার যোগ্য–এরূপ বিবেচনা করে ঐ সকল ভূমিভাগ আচার্যকে দান করলেন। এইরূপ দানের পর শ্রীরামচন্দ্রের কেবলমাত্র বস্ত্র ও অলংকার এবং সীতাদেবীর কেবলমাত্রই মাঙ্গলিক অলংকারই অবশিষ্ট রইল। তৎকালে দানপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণগণ ব্রাহ্মণ বৎসল ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের প্রশংসাযোগ্য ঐরূপ বাৎসল্য দর্শনে প্রীত ও স্নেহাচিত্ত হয়ে ঐ সকল লব্ধ দ্রব্য তাকে প্রত্যার্পণ করে এরূপ বলেছিলেন–হে ভগবান, হে ভুবনেশ্বর, আপনি আমাদের অজ্ঞান অন্ধকার বিনাশ করেছেন। প্রভো, আপনি ব্রহ্মণ্যদেব, অকুণ্ঠমেধাবী, আপনাকে আমরা নমস্কার করি। আপনি উত্তমঃশ্লোকদের অগ্রগণ্য অহিংসাপরায়ণ মুনিগণও নিজ নিজ চিত্তে আপনার পাদপদ্ম সতত চিন্তা করেন।

এক সময়ে শ্রীরামচন্দ্র নিজের সম্বন্ধে প্রজাগণের অন্তরের ভাব জানতে ইচ্ছা করে রাত্রিকালে অপরের অলক্ষ্যে গূঢ়ভাবে ভ্রমণ করতে করতে কোন এক ব্যক্তির নিজের স্ত্রীর উদ্দেশ্যে কথিত বাক্য শ্রবণ করেছিলেন।-তুমি পরগৃহগামী দুষ্ট অসতী বলে আমি আর তোমার ভরণ-পোষণ করব না। স্ত্রৈণ রাম পরগৃহগতা সীতার ভরণ-পোষণ করতে পারেন, কিন্তু আমি তোমাকে আর গ্রহণ করতে পারি না। অজ্ঞ লোক না বুঝে নানারূপ অপপ্রচার করে, তারা দুরারাধ্য অর্থাৎ তাদের কোনরূপেই নিবৃত্ত করা যায় না। এ অবস্থায় লোকভয়ে ভীত পতি রামচন্দ্র সীতাদেবীকে পরিত্যাগ করলে, তিনি বাল্মীকি মুনির আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সীতাদেবী তৎকালে গর্ভবতী ছিলেন এবং যথাকালে কুশ ও লব নামে খ্যাত যমজ পুত্র প্রসব করলে মহর্ষি বাল্মীকিই তাদের জাতকর্মাদি ক্রিয়াসমূহ সম্পাদন করলেন।

হে রাজন পরীক্ষিৎ, এদিকে অযোধ্যায় লক্ষ্মণের অঙ্গদ ও চিত্রকেতু নামে দুই পুত্র এবং ভরতের তক্ষ ও পুষ্কল নামে দুই পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শত্রুঘেরও দুটি পুত্র জন্মিল, যথা– সুবাহু ও শ্রুতসেন। ঐ সময় ভরত দিগ্বিজয়ে যাত্রা করে কোটি কোটি গন্ধ নিহত করলেন এবং তাদের ধন এনে সমস্ত রাজাকে সমর্পণ করলেন। আর, শত্রুঘ্ন মধুপুত্র লবণ রাক্ষসের প্রাণসংহার করে মধুবণে মথুরাপুরী নির্মাণ করলেন। পতি কর্তৃক নির্বাসিতা সীতাদেবী মহর্ষি বাল্মীকির নিকট নিজ পুত্র দুটিকে সমর্পণ করে, শ্রীরামচন্দ্রের চরণযুগল ধ্যান করতে করতে পাতালে প্রবেশ করলেন।

সীতার পাতাল প্রবেশ শ্রবণ করে, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র নিজ বুদ্ধিবলে শোক সম্বরণ করতে চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বর হয়েও প্রেয়সীর সুমহৎ গুণরাশি বারবার স্মৃতিপথে উদিত হওয়ায় একেবারে নিরোধ করতে সমর্থ হলেন না। হে কুরুপ্রবর, স্ত্রী ও পুরুষের প্রসঙ্গ সর্বত্রই এইরূপ ভীতিজনক হয়। ঈশ্বরগণেরও যখন এরূপ অবস্থা ঘটে, গৃহাসক্ত গ্রাম্যজনের কথা আর কি বলব? তারপর প্রভু শ্রীরামচন্দ্র অখণ্ডিত ব্রহ্মচর্য ধারণ করে, ত্রয়োদশ সহস্র বৎসর অগ্নিহোত্র অনুষ্ঠান করেছিলেন। এরপর তিনি স্মরণকারী ভক্তগণের হৃদয়ে দণ্ডকারণ্যের কণ্টকবিদ্ধ পদযুগল বিন্যস্ত করে (অর্থাৎ তাদের চিত্তে নিজ পদযুগলের স্মৃতি রেখে) নিজ জ্যোতির্ময় ধামে গমন করলেন।

হে রাজন, শ্রীরামচন্দ্রের সমুদ্রবন্ধন ও অস্ত্রসমূহ দ্বারা রাক্ষসবধ ইত্যাদি কার্য যদিও কবিগণ আশ্চর্য বলে বর্ণনা করেছেন, তথাপি তা তার যশঃস্তুতি বলে গণ্য হতে পারে না। কারণ যাঁর প্রভাব অপেক্ষা অধিক বা যাঁর তুল্য প্রভাব আর কারোরই নেই তার বৈরিবধে কপিগণ কি সাহায্য করবে? সুগ্রীবাদির নিকট শ্রীরামচন্দ্রের আশ্রয় গ্রহণ যেরূপ লীলামাত্র, রাক্ষসবধাদিও সেরূপ লীলামাত্র জানবে। হে মহারাজ, আমার একথা অযুক্ত মনে কোরো না, কারণ ভগবান শ্রীরামচন্দ্র কেবলমাত্র দেবগণের প্রার্থনায় লীলার জন্যই ঐ অবতার স্বীকার করেছিলেন। যাঁর নির্মল যশোরাশি দিগন্ত পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়ে দিগহস্তী সকলের আচ্ছাদন পট-স্বরূপ হয়েছে, মার্কণ্ডেয়াদি মুনিগণ এখনও যুধিষ্ঠিরদের নৃপতিগণের সভায় যাঁর নির্মল যশঃকীর্তন করে থাকেন এবং যাঁর পাদপদ্ম দেবতাগণ ও নরপতিগণের মুকুট-রূপে সেবিত হচ্ছে, আমরা সেই ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের স্মরণ গ্রহণ করছি। অযোধ্যা-নিবাসী পুণ্যাত্মা যে সকল ব্যক্তি সেই রামচন্দ্রকে স্পর্শন অথবা দর্শন করেছিলেন, কিংবা যারা তাকে উপবেশন করিয়েছিলেন, অথবা যারা তার অনুগত হয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই যোগীগণ যে স্থানে যান, সেই পুণ্যলোকে গমন করেছিলেন।

হে মহারাজ, যে পুরুষ শ্রবণযোগে শ্রীরামচন্দ্রের এই উপাখ্যান ধারণ করবেন, তিনি উপশম-নিষ্ঠ হয়ে নিশ্চয় কর্মবন্ধন হতে বিমুক্ত হবেন।

তারপর রাজা পরীক্ষিৎ জিজ্ঞাসা করলেন–ব্রাহ্মণ, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, স্বয়ং কি প্রকারে বর্তমান ছিলেন? নিজের অংশস্বরূপ ভ্রাতৃগণের প্রতিই বা কিরূপ আচরণ করতেন? আর সাক্ষাৎ পরমেশ্বর স্বরূপ শ্রীরামচন্দ্রের প্রতি সেই ভ্রাতৃগণ, প্রজাগণ এবং পুরবাসী সকলেই বা কিরূপ আচরণ করত? শ্ৰীশুকদেব বললেন–রাজন, রাজসিংহাসন গ্রহণের পর ত্রিলোকপতি ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ভ্রাতৃগণকে দিবিজয়ের আদেশ দিয়েছিলেন এবং অনুচরগণের সহিত মিলিত হয়ে পুরজনদের দর্শন দানের জন্য পুরী দর্শন করতেন। তার পরিদর্শনের পূর্বেই পথসকল সুগন্ধি সলিলে ও হস্তীগণের মদজলে সিক্ত হত। ঐ পুরী নিজ স্বামীকে প্রাপ্ত হয়ে যেন অতিশয় হর্ষোন্মত্ততা প্রকাশ করত। তোরণ, পুরদ্বার, সভা, চৈত্য ও দেবমন্দির প্রভৃতি স্থানে সংস্থাপিত সুবর্ণ কলস ও পতাকারাজি সবদাই ঐ পুরীর শোভাবর্ধন করত। ঐ পুরীমধ্যে স্থানে স্থানে বৃন্তযুক্ত গুবাকগুচ্ছ, কদলীবৃক্ষ, মনোরম, বস্ত্রের পট্টিকা দর্পণ, বস্ত্র এবং মাল্য ইত্যাদির দ্বারা স্থানে স্থানে মঙ্গলবোরণ রচিত হত। পুরীদর্শনকালে তিনি যে যে স্থানে গমন করতেন, পুরবাসীগণ উপহারহস্তে তার নিকট এসে আশীর্বাদবাণী উচ্চারণ করতেন। হে দেব, আপনি পূর্বে বরাহরূপে এই পৃথিবী উদ্ধার করেছিলেন, এক্ষণে সেটা প্রতিপালন করুন।

অনন্তর নারী-পুরুষ সকল প্রজাগণ দীর্ঘকাল পর নিজেদের অধিপতি কমললোচন শ্রীরামচন্দ্রকে সমাগত দেখে, তাকে দর্শন করার প্রবল আগ্রহে গৃহ পরিত্যাগ-পূর্বক প্রাসাদে আরোহণ করে, অতৃপ্ত নয়নে তার উপর পুষ্পবর্ষণ করতেন। তারপর তিনি নিজ পূর্বপুরুষ নরপতিগণের সেবিত, সর্বপ্রকার রত্নভাণ্ডারযুক্ত ও মহামূল্য প্রভৃতি পরিচ্ছদ শোভিত নিজগৃহে প্রবেশ করতেন। সেখানকার দ্বারের দেহলী (চৌকাঠ) সমূহ বিদ্রুম-মণিময়, স্তম্ভশ্রেণী বৈদূর্যময়, গৃহতল মরকতময় ও অতিস্বচ্ছ তার ভিত্তিসকল স্ফটিক ও অতিশয় উদ্দীপ্ত ছিল। এইরূপ সেই গৃহটি বিচিত্র পুষ্পমাল্য, উৎকৃষ্ট পট্টিকা, বসন ও রত্নসমূহের কিরণে উদ্দীপ্ত, আর চৈতন্যতুল্য উজ্জ্বল মুক্তাফলে ও কামনীয় ভোগসাধন দ্রব্যসমূহে সর্বতোভাবে মনোহর ছিল। সুগন্ধি ধূপদীপে সুবাসিত ও পুস্পমণ্ডলে মণ্ডিত এবং অলংকার স্বরূপে দেবতুল্য স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ছিল। আত্মারামগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ভগবান শ্রীরামচন্দ্র সেই গৃহে প্রণয়াসক্তা নিজ অভীষ্টা প্রিয়তমা সীতার সহিত বিহার করতেন। এইরূপে তিনি বহু বৎসর ধর্মের অবরোধ যথাকালে বিবিধ ভোগ্য বিষয়সমূহ ভোগ করেছিলেন। তৎকালে মানবগণ নিরন্তর তার পাদপদ্মের ধ্যান করত।

.

দ্বাদশ অধ্যায়
শ্রীরামতনয় কুশ ও ইক্ষবাকু পুত্র শশাদের বংশ বিবরণ

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, কুশের পুত্রের নাম অতিথি, তার পুত্র নিষেধ, তার পুত্র নভ, তার পুত্র পুণ্ডরীক এবং পুণ্ডরীকের পুত্র মেধম্বা। ক্ষেমধন্বার পুত্র দেবানীক, তার পুত্র অনীহ (বা হীন), তার পুত্র পারিমাত্র, পারিমাত্রের পুত্র বলস্থল। তাঁর পুত্র বজ্রনাভ, ইনি সূর্যের অংশে উৎপন্ন হন। বজ্রনাভের পুত্র সুগন, তার পুত্র বিস্তৃতি। ঐ বিধৃতি হতে হিরণ্যনাভের উদ্ভব হয়। ইনি জৈমিনির শিষ্য এবং যোগাচার্য ছিলেন। কৌশল্য যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি তার নিকট মহাসিদ্ধিদায়ক ও অহংকারনাশক অধ্যাত্মযোগ শিক্ষা করেছিলেন, হিরণ্যনাভের পুত্র পুষ্প, তাঁর পুত্র ধ্রুবসন্ধি, তাঁর পুত্র সুদর্শন, তাঁর পুত্র অগ্নিবর্ণ, তার পুত্র শীঘ্র এবং শীঘ্রের পুত্র মরু। এই মরুযোগে সিদ্ধিলাভ করে সম্প্রতি কলাপগ্রামে বাস করছেন এবং কলিযুগের অবসানে বিনষ্ট সূর্যবংশকে পুনরায় প্রবর্তিত করবেন। মরুর পুত্র প্রসুশ্রুত, তাঁর পুত্র সজি, তার পুত্র অমর্ষণ, তাঁর পুত্র মহস্বাণ এবং তার পুত্র বিশ্ববাহু। বিশ্ববাহুর পুত্র প্রসেনজিৎ, তার পুত্র বৃহদ্বল। তোমার পিতা অভিমন্যু এই বৃহদ্বলকে সংগ্রামে হত্যা করেছিলেন।

ইক্ষবাকু বংশীয় এই সকল রাজা অতীত হয়েছেন। সম্প্রতি ভবিষ্যৎ নরপতিগণের কথা শ্রবণ কর। বৃহদবনের ঔরসে বৃহণ নামক পুত্র উৎপন্ন হবেন। বৃহদরণ হতে উরুক্রিয়, তা হতে বৎসবৃদ্ধ, তা হতে প্রতিব্যোম, তা হতে ভানু এবং ভানু হতে সেনাধিপতি দিবাক জন্মগ্রহণ করবেন। দিবাক হতে সহদেব, তা হতে মহাবীর বৃহদশ্ব, তা হতে ভানুমান, তা হতে প্রতীকাশ্য এবং প্রতীকাশ্ব হতে সুপ্রতাঁকের জন্ম হবে। সুপ্রতীক হতে মরুদেব, তা হতে সুনক্ষত্র, তা হতে পুষ্কর, তা হতে অন্তরীক্ষ, তা হতে সুতপা এবং তা হতে অমিত্রজিতের উৎপত্তি হবে। অমিত্রজিৎ হতে বৃহদ্রাজ, তা হতে বৰ্হি, তা হতে কৃতঞ্জয়, তা হতে রণঞ্জয় এবং তা হতে সঞ্জয় জন্মলাভ করবেন। সঞ্জয় হতে শাক্য, তা হতে সুদ্ধোদ, তা হতে লাঙ্গল, তা হতে প্রসেণজিৎ এবং তা হতে ক্ষুদ্রকের জন্ম হবে। ক্ষুদ্রক হতে রণক, রণক হতে সুরথ এবং সুরথ হতে সুমিত্র জন্মগ্রহণ করবেন। এই সুমিত্র পর্যন্তই বংশ স্থায়ী হবে। ইহারা সকলেই বৃহদ্বলের বংশজাত। ইক্ষবাকুগণের এই বংশে সুমিত্রই শেষ রাজা হবেন। কারণ এই সুমিত্রের রাজত্বকালের পরই কলিযুগে বংশ লুপ্ত হবে।

.

এয়োদশ অধ্যায়
নিমিবংশ কথন এবং নিমির দেহত্যাগাদি বর্ণন

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, ইক্ষবাকু তনয় নিমি কোনসময় যজ্ঞ আরম্ভ করে মহর্ষি বশিষ্ঠকে ঋত্বিক কর্মে বরণ করলে ঐ মুনি বললেন–হে রাজন, ইন্দ্র আমাকে পূর্বে তার যজ্ঞে ঋত্বিক পদে বরণ করেছেন। অতএব আমি ইন্দ্রের যজ্ঞ সমাপন করে আসছি, ততকাল তুমি আমার প্রতীক্ষা কর। রাজা নিমি একথা শুনে মৌনী হয়ে থাকলেন। বশিষ্ঠও ইন্দ্রের যজ্ঞ করতে গেলেন। এদিকে আত্মবান্ নিমি জীবন অনিত্য মনে করে, কুলগুরু বশিষ্ঠের আগমনের পূর্বেই অন্য ঋত্বিকগণের দ্বারা যজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন। তারপর ইন্দ্রের যজ্ঞ সমাপন করে বশিষ্ঠ মুনি ফিরে এসে, শিষ্যের আজ্ঞালঙঘনরূপ আচরণ লক্ষ্য করে অভিশাপ দিলেন—’পণ্ডিতাভিমানী নিমির এই দেহের পতন হোক। তখন নিমিত্ত অন্যায়কারী গুরুকে অভিশাপ দিয়ে বললেন–লোভবশতঃ ধর্মজ্ঞানশূন্য আপনারও দেহের পতন হোক।’ অধ্যাত্ম-তত্ত্বাজ্ঞ নিমি এই বলে নিজের দেহ ত্যাগ করলেন। সে সময় বশিষ্ঠ ঋষিরও শরীরপাত হল, কিন্তু কিয়ৎকাল পরে যজ্ঞে উর্বশীর দর্শনে মিত্র ও বরুণের বীর্যস্খলিত হলে কুম্ভমধ্যে রক্ষিত ঐ বীর্য হতে আমার প্রপিতামহ বশিষ্ঠদেব জন্মলাভ করেন।

যজ্ঞের ঋত্বিকগণ নিমির ত্যক্ত দেহ গন্ধ বস্তুর মধ্যে রেখে যজ্ঞ সমাপন করলেন। যজ্ঞ-সমাপ্তির পরে যজ্ঞে সমাগত দেবগণকে তারা বললেন–হে দেবগণ, আপনারা বরদানে সমর্থ, যদি প্রসন্ন হয়ে থাকেন, তবে রাজার এই দেহ আবার জীবিত হোক। তখন দেবগণ ‘তাই হোক’ এরূপ বললেন। নিমি বললেন–আমার যেন আর দেহবন্ধন না হয়। শ্রীহরির প্রতি যাঁদের চিত্ত সমর্পিত, সেই মুনিগণ দেহের বিয়োগভয়ে কাতর হয়ে আর এই দেহপ্রাপ্তি কামনা করেন না, কিন্তু শ্রীহরির চরণকমলেরই ভজনা করেন। মৎস্যগণের যেরূপ জলেই মৃত্যু হয়, সেরূপ এই দেহেরও যেহেতু সর্বত্রই মরণ ঘটে, সেইহেতু আমি আর দুঃখ শোক–ভয়জনক এই দেহ ধারণ করতে ইচ্ছা করি না। দেবতাগণ বললেন–তা হলে এই নিমি বিদেহ (দেহহীন) হয়েই প্রাণীদের নয়নদ্বয়ে যথেচ্ছভাবে বাস করুক। এরপর হতেই নিমি প্রাণীগণের নেত্রের উন্মেষ ও নিমেষের প্রবর্তক রূপে লক্ষিত হতেছেন।

তারপর মহর্ষিগণ প্রজাগণের অরাজকতার ভয় বিবেচনা করে, নিমির দেহ মন্থন করলে এক কুমারের উৎপত্তি হল। অসামান্য জন্মহেতু সেই নিমি তনয়ের নাম জনক, বিদেহ নিমি হতে জন্ম হওয়ায় তার নাম বৈদেহ এবং মন্থন হতে জন্মহেতু তাঁর নাম মিথিল। ইনিই মিথিলা পুরী নির্মাণ করেছিলেন। হে মহারাজ, সেই জনকের পুত্র উদাবসু, তার পুত্র নন্দিবর্ধন, তার পুত্র সুকেতু এবং সুকেতুর পুত্র দেবরাত। দেবরাতের পুত্র বৃহদ্রথ, তাঁর পুত্র মহাবীর্য, তার পুত্র সুধৃতি, তাঁর পুত্র বৃষ্টকেতু, তাঁর পুত্র ধৃষ্টকেতু, তাঁর পুত্র হৰ্য্যশ্ব এবং হৰ্য্যশ্বের পুত্র মরু। মরুর পুত্র প্রতীপক, তা হতে কৃতরথ জন্মগ্রহণ করেন। হ্রস্বরোমার সন্তান সীরধ্বজ। তিনি এক সময় যজ্ঞের জন্য ভূমি কর্ষণে প্রবৃত্ত হলে, সীর অর্থাৎ লাঙ্গলের অগ্রভাগ হয়ে সীতাদেবীর আবির্ভাব হয়েছিল, এজন্য তিনি সীরধ্বজ নামে প্রসিদ্ধ হন। সীরধ্বজের পুত্র কুশধ্বজ, তাঁর পুত্র ধর্মধ্বজ এবং ধর্মধ্বজের দুই পুত্র কৃতধ্বজ ও মিতধ্বজ।

হে মহারাজ কৃতধ্বজের পুত্র কেশিধ্বজ এবং মিতধ্বজের পুত্র খাণ্ডিক্য। কেশিধ্বজ আত্মবিদ্যায় নিপুণ এবং খাণ্ডিক্য কর্মতত্ত্বজ্ঞ ছিলেন। এই খাণ্ডিক্য কোন কারণে কেশিধ্বজের ভয়ে গৃহ হতে পলায়ন করেন। কেশিধ্বজের পুত্র ভানুমান এবং ভানুমানের পুত্র শতদ্যুম্ন। শতদ্যুম্নের পুত্র শুচি, ঐ শুচি হতে সনদ্বাজ উৎপন্ন হন। সনদ্বাজের আত্মজ ঊর্জকেতু, তার পুত্র অজ এবং অজের পুত্র পুরুজিৎ। পুরুজিতের পুত্র অরিষ্টনেমি, তার পুত্র তায়, তার পুত্র সুপার্শ্বক, সুপার্শ্বকের, পুত্র চিত্ররথ এবং তার পুত্র মিথিলাধিপতি ক্ষেমাধি। ক্ষেমাধির পুত্র সমরথ (হেমরথ-পাঠান্তর), তার পুত্র সত্যরথ, তার পুত্র, উপগুরু এবং এই উপগুরু হতে অগ্নিদেবের অংশ-জাত উপগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন।

উপগুপ্তের পুত্র বস্বনান্ত, তার পুত্র যুযুধ, তাঁর পুত্র সুভাষণ, তাঁর পুত্র শ্রুত, তাঁর পুত্র জয়, তার পুত্র বিজয় এবং বিজয়ের পুত্র ঋত। ঋতের পুত্র শুনক, তার পুত্র রীতহব্য, তার পুত্র ধৃত, তার পুত্র যুযুধ, তার পুত্র সুভাষণ, তার পুত্র শ্রুত, তার পুত্র জয়, তার পুত্র ঋত। ঋতের পুত্র শুনক, তার পুত্র বীতহব্য, তার পুত্র ধৃত, তার পুত্র কৃতি এবং কৃতির পুত্র মহাবলী। হে মহারাজ, মিথিলার, এই নরপতিগণ সকলেই যাজ্ঞবল্ক্য-প্রমুখ যোগেশ্বরগণের অনুগ্রহে আত্মবিদ্যায় সুনিপুণ হয়ে গৃহে থেকেও সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্ব বিমুক্ত ছিলেন।

.

চতুর্দশ অধ্যায়
চন্দ্রবংশ বর্ণন, বুধের জন্মবৃত্তান্ত এবং পুরুরবার উপাখ্যান

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজ, সূর্যবংশ বর্ণনার পর এখন পবিত্র চন্দ্রবংশের কথা বলছি, শোন। চন্দ্রবংশে বিভিন্ন পুণ্যকীর্তি পরপতিগণের চরিত্র বর্ণিত হয়েছে। সহস্ৰশীর্ষা পরম পুরুষ ভগবানের নাভিরূপ হৃদস্থিত পদ্ম হতে, ব্রহ্মা উৎপন্ন হন। সেই ব্রহ্মার পুত্র অত্রি, তিনি সকল গুণে পিতৃতুল্য ছিলেন। সেই অত্রির আনন্দাশ্রু হতে সোম নামক এক অমৃতময় পুত্র উৎপন্ন হলে, ব্রহ্মা তাঁকে ব্রাহ্মণ ওষুধি ও নক্ষত্রগণের অধিপতি করেছিলেন। সেই সোম ত্রিভুবনের জয় করে রাজসূয় যজ্ঞ করেছিলেন। তারপর গর্ববশতঃ বৃহস্পতির পত্নী তারাকে বলপূর্বক হরণ করেন। দেবগুরু বৃহস্পতি বার বার সোমের নিকট প্রার্থনা করলেও সোম গর্ববশতঃ তাকে পরিত্যাগ না করায় দেবতা ও দানবদের মধ্যে সংগ্রাম উপস্থিত হল। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য বৃহস্পতির প্রতি বিদ্বেষবশতঃ অসুরগণের সহিত নক্ষত্রপতি সোমের পক্ষ অবলম্বন করলেন। আর ভগবান শঙ্কর পূর্বে অঙ্গিরার নিকট বিদ্যাগ্রহণ করায় স্নেহে সকল ভূতগণের সাথে মিলিত হয়ে গুরুপুত্র বৃহস্পতি, সহায় হয়েছিলেন আর সকল দেবগণের সাথে যুক্ত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির অনুগামী হলেন। তখন (বৃহস্পতির পত্নী) তারার জন্য দেবতা ও অসুরগণের সংহারাত্মক এক ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হল।

তারপর অঙ্গিরা বিশ্বস্রষ্টা ব্রহ্মাকে সকল কথা নিবেদন করলে, তিনি সোমকে ভৎর্সনা করে তারাকে নিজ স্বামীর নিকট অর্পণ করলেন। তখন বৃহস্পতি তারাকে গর্ভবতী বলে জানতে পারলেন। তারপর বৃহস্পতি তারাকে বললেন–হে দুর্বুদ্ধি-পরায়ণে, তুমি আমার ক্ষেত্র হতে অপরের অর্পিত গর্ভ শীঘ্র ত্যাগ কর। হে অসিত, আমি সন্তানকামী, এজন্য নিজ স্ত্রী তোমাকে ভস্ম করব না, তখন তারা লজ্জিত হয়ে স্বর্ণকান্তি একটি কুমারকে গর্ভ হতে পরিত্যাগ করলে, ঐ কুমারের প্রতি বৃহস্পতি এবং চন্দ্র উভয়েই নিজ নিজ স্পৃহা অনুভব করেছিলেন।

উভয়েই “এই পুত্র আমার, তোমার নয়”–এরূপ বলে তুমুল বিবাদ আরম্ভ করলে, মুনিগণ ও দেবগণ তারাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু তারা লজ্জায় কিছুই বললেন–না। তখন ঐ কুমার মাতার অলীক লজ্জায় ক্রুদ্ধ হয়ে বলল হে অসদাচারিণী, নিজের দোষ বলছ না কেন? শীঘ্রই আমার নিকট উহা প্রকাশ কর।

এরপর ব্রহ্মা তারাকে নির্জনে ডেকে নিয়ে সান্ত্বনা প্রদানপূর্বক জিজ্ঞাসা করলে, তারা ধীরে ধীরে বললেন—’এই পুত্র চন্দ্রেরই।’ তখন চন্দ্র ঐ পুত্রকে গ্রহণ করেছিলেন। হে মহারাজ, ব্রহ্মা ঐ বালকের গম্ভীর বুদ্ধি দেখে “বুধ”–এই নাম রেখেছিলেন। চন্দ্র এই পুত্রলাভে অতিশয় হৃষ্ট হয়েছিলেন। বুধ হতে (সুদ্যুম্নরূপ ত্যাগ করে স্ত্রীরূপে অবস্থিত) ইলার গর্ভে পুরুরবার জন্ম হয়, একথা পূর্বে বলেছি। দেবর্ষি নারদ ইন্দ্রের সভায় পুরুরবার রূপ, গুণ, উদারতাশীল, ধনসম্পত্তি ও বিক্রমের কথা বর্ণন করলে, অপ্সরা উর্বশী তা শুনে কামপীড়িত হয়ে তার নিকট গমন করেছিলেন। মিত্র ও বরুণের অভিশাপে মনুষ্যভাব প্রাপ্ত হয়ে উর্বশী কন্দর্পের মতো অতি সুন্দর পুরুষশ্রেষ্ঠ পুরূরবার দেখে কোনরূপে ধৈর্য ধারণ করে তার নিকট উপস্থিত হলেন। উর্বশীকে দেখে পুরূরবার নয়নযুগল হর্ষভরে উৎফুল্ল ও দেহ রোমাঞ্চিত হল এবং তিনি মধুর বাক্যে তাঁকে বললেন–হে বরারোহ, তোমার কি কারণে আগমন হয়েছে? এখানে উপবেশন কর? তোমার অভিলষিত আমি কি করতে পারি? তুমি আমার সাথে বিহার কর এবং আমাদের এই বিহার দীর্ঘকাল স্থায়ী হোক।

উর্বশী বললেন–হে সুন্দর, কোন্ রমণীর দৃষ্টি ও মন তোমাতে আসক্ত না হয়? যেহেতু তোমার বক্ষঃস্থল লাভ করে রমণেচ্ছায় রমণীকে বিবেক– ধৈর্যাদি সবকিছু বিচ্যুত হয়। হে রাজ, হে মানদ, আমার এই দুটি মেষ গচ্ছিত রাখ এবং তুমি এদের রক্ষা করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার পুত্রের মতো পালিত মেষ-দুটিকে তুমি রক্ষা করবে, ততকাল আমি তোমার সাথে রমণ করব। যেহেতু রূপ ঔদার্য প্রভৃতি গুণে যিনি প্রশংসনীয় তিনিই আমাদের মতো অপ্সরাগণের বরণীয় পতি। হে বীর, আমি কেবলমাত্র ঘৃত (অমৃত) ভক্ষণ করব এবং মৈথুনকাল ব্যতীত, কোন সময়ে তোমাকে নগ্ন দেখব না। মহামতি পুরুরবা একথায় সম্মত হলেন এবং তিনি বললেন–সুন্দরী, তোমার আশ্চর্য রূপ ও ভাব দেখলেই নরলোকের মোহ হয়। আর, তুমি স্বর্গবাসিনী দেবী, স্বয়ং আগমন করেছ, কোন মনুষ্য তোমায় সেবা না করবে? তারপর পুরুষশ্রেষ্ঠ পুরুরবা রতিদায়িনী উর্বশীর সহিত চৈত্ররথ প্রভৃতি স্বর্গীয় বিহারক্ষেত্র সমূহে যথাযোগ্য বিহার করেছিলেন। পদ্মকেশরের ন্যায় গন্ধযুক্তা দেবী উর্বশীর রতিলীলায় আসক্ত এবং তার মুখসৌরভে আকৃষ্ট হয়ে রাজা পুরুরবা দীর্ঘকাল পর্যন্ত আমোদ উপভোগ করলেন।

এদিকে দেবরাজ ইন্দ্র সুরপুরে উর্বশীকে দেখতে না পেয়ে, আমার সভায় উর্বশী না থাকলে শোভা পায় না–এই বলে উর্বশীকে আনার জন্য গন্ধবদের প্রেরণ করলেন। গন্ধর্বগণ মধ্যরাত্রির অন্ধকারে পুরুরবার বাসভবনে গিয়ে রাজার নিকট গচ্ছিত উর্বশীর মেষ দুটিকে হরণ করেছিল। তখন নীয়মান পুত্রবৎ পালিত মেষ দুটির কাতর চিৎকার শ্রবণ করে দেবী উর্বশী বললেন– হায়, আমি এই বীরাভিমানী নপুংসক কুৎসিত পতির দ্বারা বিনষ্ট হলাম। এ বীর আমার পুত্র দুটিকে রক্ষা করবে– এ বিশ্বাস করে আমি বিনষ্টা হয়েছি এবং দস্যুগণ আমার পুত্র দুটিকে হরণ করল। ইনি রাতে নারীর ন্যায় সন্ত্রস্ত-চিত্তে শুয়ে থাকেন এবং দিনে পুরুষের ন্যায় আচরণ করেন। তারপর অঙ্কুশাহত হস্তীর ন্যায় উর্বশীর বাক্যবাণে আহত হয়ে রাজা সেই রাতেই খঙ্গা হাতে নিয়ে বিবস্ত্র হয়েই ক্রোধে দস্যগণের প্রতি ধাবিত হলেন। তখন সেই গন্ধর্বগণ মেষ দুটিকে পরিত্যাগ করে, বিশিষ্ট দ্যুতিশালী হয়ে দীপ্তি বিস্তার করছিল এবং উর্বশী সেই আলোকের মধ্যে মেষ দুটিকে নিয়ে নগ্ন স্বামীকে আসতে দেখলেন।

(রাজার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ উর্বশী চলে গেলে) রাজা পুরুরবা শয্যায় পত্নীকে না দেখে বিমনা হলেন এবং তাকে ছাড়া ব্যাকুলচিত্ত হয়ে শোক করতে করতে পৃথিবী ভ্রমণ করতে লাগলেন। তারপর এক সময় তিনি কুরুক্ষেত্রে সরস্বতী নদীর তীরে পাঁচটি সখীর সহিত উর্বশীকে দেখতে পেয়ে হৃষ্টমুখে এরূপ সুশোভন বাক্য বলেছিলেন-হো জায়ে, তুমি থাক থাক। তুমি এখন আমার নিকট হতে সুখের চরম দশা প্রাপ্ত হওনি, অতএব ঘোর বিরহ দুঃখে আমাকে ত্যাগ করো না। এস, আমরা নানারূপ বাক্যালাপ করব। হে দেবী, তোমার জন্যই আমার এই কমনীয় দেহ দূরদেশে নীত হয়েছে, তুমি না থাকলে এ দেহের এখানেই পতন হবে। তোমার অনুগ্রহের বিষয় না হলে, এ দেহ বৃক ও গৃগণ ভক্ষণ করবে।

উর্বশী বললেন–হে রাজন, তুমি মৃত্যুকামনা করবে না, যেহেতু তুমি পুরুষ, অতএব ধৈর্য ধারণ কর। এই ইন্দ্রিয়রূপী বৃকগণ যেন তোমাকে ভক্ষণ না করে অর্থাৎ তুমি ইন্দ্রিয়পরবশ হয়ো না। স্ত্রীলোকদের হৃদয় বৃকের চিত্তের মতো নিষ্ঠুর, কারও প্রতি তাদের সখ্য হয় না। স্ত্রীলোকগণ করুণাশূন্য, কুর, অসহিষ্ণু এবং প্রিয় বস্তুর জন্য সর্বদাই সাহস করে (অর্থাৎ তাদের অভিলষিত বস্তু লাভের জন্য ইহলোক ও পরলোকের কোন বিচার না করেই তাতে প্রবৃত্ত হয়)। তাঁরা অত্যল্প বিষয়ের জন্যও বিশ্বস্ত পতি বা ভ্রাতাকে হত্যা করে থাকে। বিশেষতঃ স্বচ্ছন্দবিহারিণী কুলটা রমণীগণ অজ্ঞ লোকদের বিশ্বাস উৎপাদন করতঃ সৌহার্দ বিসর্জন দিয়ে নিত্য নূতন পুরুষকে পেতে ইচ্ছা করে। যা হোক, তুমি সংবৎসরান্তে একরাত্রি আমার সহিত বিহার করতে পারবে, তাতেই তোমার আরও সন্তান উৎপন্ন হবে। তারপর পুরুরবা উর্বশীকে গর্ভিণী দেখে নিজ পুরীতে গমন করলেন এবং সংবৎসরান্তে আবার সেখানে এসে বীরপুত্রের জননী উর্বশীকে লাভ করে হৃষ্টচিত্তে তার সহিত একরাত্রি বাস করেছিলেন। তারপর উর্বশী বিরহকাতর দীনভাবাপন্ন রাজাকে বললেন–হে রাজন, তুমি এই গন্ধবদের স্তুতি কর, তা হলে তারা আমাকে তোমার নিকট অর্পণ করবে।

হে মহারাজ পরীক্ষিৎ, তখন তখন পুরুরবা গন্ধর্বগণের স্তুতি করলে তারা তুষ্ট হয়ে রাজাকে একটি অগ্নিস্থলী (যজ্ঞাদির জন্য অগ্নিরক্ষার পাত্র-বিশেষ দান করলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল–রাজা এই অগ্নি দ্বারা যথোচিত ক্রিয়া করলেই উর্বশীকে লাভ করবে।) কিন্তু রাজা ঐ অগ্নিস্থালীকেই উর্বশী মনে করে, তা নিয়েই রাতে বনে বিচরণ করতে করতে প্রাতঃকালে বুঝতে পারলেন–ইহা অগ্নিস্থালী উর্বশী নয়, এর পর তিনি সেই স্থালীটি বনে রেখে গৃহে গমন করলেন এবং প্রতিদিন রাতে উর্বশীর চিন্তা করতে লাগলেন। এইরূপে ত্রেতাযুগের প্রবর্তন হলে, তার মনে কর্মবোধক বেদত্রয় প্রাদুর্ভূত হল। তারপর রাজা বনে সেই অগ্নিস্থালীর নিকট গিয়ে দেখলেন–সেখানে শমীবৃক্ষের অভ্যন্তরে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষ রয়েছে। তার দ্বারা দুটি অরিণ (যে কাষ্ঠখণ্ডদ্বয় অপর একটি কাষ্ঠখণ্ডের উপর রেখে ঘর্ষণ করলে মধ্যবর্তী কাষ্ঠখণ্ড হতে যজ্ঞের অগ্নি প্রজ্বলিত হয়) নির্মাণ করে উর্বশী লোক কামনায় নিম্নস্থিত অরণিকে উর্বশীরূপে উপরের অরণিকে নিজ আত্মারূপে এবং মধ্যস্থিত কাষ্ঠখণ্ডকে পুত্ররূপে মন্ত্রানুসারে ধ্যান করে মন্থন করেছিলেন।

তারপর সেই মন্থনক্রিয়া হতে যজমানের ভোগ্য ধনরূপ অগ্নি উৎপন্ন হলে, ত্রয়ীবিদ্যা-বিহিত আধান-সংস্কারের ফলে সেই অগ্নি ত্রিবৃৎ (অর্থাৎ দক্ষিণাগ্নি, গার্হপত্য ও আহবণীয় এই ত্রিবিধ) রূপে পরিণত হন।

ইনি পুণ্যলোক প্রাপক বলে রাজা ইহাকে পুত্ররূপে কল্পনা করেছিলেন, এরপর রাজা পুরুরবা সেই অগ্নির দ্বারা উর্বশীলোক কামনা করে। যজ্ঞেশ্বর সর্বদেবময় ভগবান অধ্যক্ষজ শ্রীহরির উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করেছিলেন। হে রাজন, পূর্বে সত্যযুগে সর্বপ্রকার বাক্যের বীজভূত প্রণবই একমাত্র বেদ, দেবতাও একমাত্র নারায়ণ, অগ্নিও একমাত্র লৌকিক এবং বর্ণও হংস নামে একমাত্রই ছিল। ত্রেতাযুগে পুরুরবা হতেই বেদ ত্রয়ীময় অর্থাৎ তিনভাগে বিভক্তরূপে প্রকাশিত হন। রাজা পুরুরবা পুত্ররূপ অগ্নির সাহায্যেই (অর্থাৎ তার দ্বারা যথোচিত যজ্ঞ সম্পাদন করেই) গন্ধর্বলোক প্রাপ্ত হয়েছিলেন। (বস্তুতঃ সত্যযুগে সকল ব্যক্তিই সত্ত্বগুণ প্রধান ছিলেন, কাজেই প্রধান সকলেই ধ্যাননিষ্ট হয়ে থাকতেন। তারপর রজোগুণ প্রদান ত্রেতাযুগ বেদাদির বিভাগ দ্বারা কর্মমার্গ প্রকাশিত হয়েছে।)

.

পঞ্চদশ অধ্যায়
ঋচীক, জমদগ্নি ও পরশুরামের চরিত্র বর্ণন

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, উর্বশীর গর্ভে রাজা পুরুরবার ছয়টি পুত্র উৎপন্ন হয়, তাদের নাম– আয়ু, ঞতায়ু, সত্যায়ু, অয়, বিজয়, ও জয়। শ্রুতায়ুর পুত্র বসুমান, সত্যায়ুর পুত্র তঞ্জয়, অয়ের তনয়ের নাম এক। জয়ের সন্তান অমিত, বিজয়ের সুত ভীম। ভীমের পুত্র কাঞ্চন, তার পুত্র তোক। ঐ হোত্রক হতে সেই জহ্নর জন্ম হয়। যিনি এক গণুষে গঙ্গা পান করেছিলেন। জহ্নর পুত্র পুরু, পুরুর পুত্র বলাক এবং বলার্কের পুত্র অজক। অজুকের পুত্র কুশ, কুশের পুত্র কুশাস্তু, তনয়, বসু ও কুশনাভ এই চারজন। কুশাম্বুর পুত্র গাধি। ঐ গাধির সত্যবতী নামে এক কন্যা হয় দ্বিজবর ঋচীক গাধির নিকট সেই কন্যা বিবাহের জন্য প্রার্থনা করলে, গাধি কন্যার অনুরূপ বর নয় মনে করে ভৃগুবংশজাত ঋচীককে বললেন–হে ব্রাহ্মণ, যাদের একটি কর্ণ শ্যামবর্ণ এবং দেহের কান্তি চন্দ্ৰতুল্য, এরূপ এক সহস্র অশ্ব কন্যার পণস্বরূপ দান করুন। আপনি ইহা যথেষ্ট বিবেচনা করবেন না, যেহেতু আমরা কুশিক বংশোদ্ভূত।

গাধি এরূপ বললে, ঋচীক তার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে বরুণের নিকট গেলেন এবং তার নিকট হতে অনুরূপ এক সহস্র অশ্ব এনে তা শুল্করূপে প্রদানপূর্বক সত্যবতাঁকে বিবাহ করেছিলেন। কিছুকাল পরে ঋচীকের পত্নী ও শ্বশ্র পুত্রকামনা করে যথাবিধি চরু পাক করতে প্রার্থনা করলে, মুনি ঋচীক পত্নীর জন্য ব্রাহ্ম মন্ত্রে এবং শশার জন ক্ষাত্রমন্ত্রে চরু পাক করে স্নান করতে গেলেন। এই সময় সত্যবতীর জননী মনে করলেনভার্যার প্রতি ভর্তার সমধিক স্নেহ হয়ে থাকে, জামাতা আমার কন্যার জন্য যে চরু পাক করে গেলেন, তা অবশ্য আমার নিমিত্ত পাক করা চরু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকবে, অতএব কন্যার নিকট ঐ চরু প্রার্থনা করলেন। সত্যবতী মাতার বাঞ্ছায় ব্রাহ্ম মন্ত্রভিমন্ত্রিত নিজের চরু তাঁকে প্রদান করে, নিজে ক্ষাত্র মন্ত্রভিমন্ত্রিত জননীর চরু ভোজন করলেন। পরে ঋচীক মুনি ইহা জানতে পেরে পত্নী সত্যবতাঁকে বললেন–তুমি অতিশয় নিন্দিত কর্ম করেছ–এর ফলে তোমার পুত্র উগ্র ও হিংসাপরায়ণ এবং তোমার ভ্রাতা শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মজ্ঞ হবে। তখন সত্যবতী “এরূপ না হোক”- বলে বিনয় সহকারে মুনিকে প্রসন্ন করলে, ভার্গব ঋচীক বললেন–তোমার পুত্র এরূপ না হলে, তোমার পৌত্র এরূপ হবে। তারপর সত্যবতী হতে শান্তস্বভাব পুত্র জমদগ্নির জন্ম হয়েছিল। সেই সত্যবতী লোকপাবনী মহাপুণ্য কৌশিকী নদী হয়েছিলেন।

জমদগ্নি রেণুর কন্যা রেণুকাকে বিবাহ করেন। রেণুকার গর্ভে জমদগ্নি ঋষির বসুমান প্রভৃতি পুত্রগণ জন্মগ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র ‘রাম (পরশুরাম) নামে বিখ্যাত। পণ্ডিতগণ তাঁকে ভগবান বাসুদেবের অংশজাত এবং হৈহঁয় কুলের নাশকারক বলে থাকেন। তিনি পৃথিবীকে একবিংশতিবার নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন। তিনি অল্প অপরাধেই পৃথিবীর ভারস্বরূপ, রজঃ ও তমোগুণাচ্ছন্ন ব্রাহ্মণবিরোধী দর্শান্ধ ক্ষত্রিয়কুলের সংহার করেছিলেন। মহারাজ পরীক্ষিৎ জিজ্ঞাসা করলেন –হে ব্রাহ্মণ, অজিতেন্দ্রিয় ক্ষত্রিয়গণ ভগবান রামের নিকট কি অপরাধ করেছিলেন, যার জন্য তিনি বারবার ক্ষত্রিয়কুলের বিনাশ করেছিলেন?

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, হৈহয়গণের অধিপতি ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ অর্জুন (কার্তবীর্যাজুন) ভগবান নারায়ণের অংশজাত দত্তাত্রেয় ঋষিকে পরিচর্যাদি কর্মের দ্বারা আরাধনা করে, তাঁর অনুগ্রহে সহস্র বাহু, শত্রুগণের দুর্ধর্ষত্ব ইন্দ্রিয়বর্গ ও ওজঃশক্তির অনিবার্য প্রভাব, সম্পদ, তেজ, বীর্য, যশ, বল, যোগেশ্বরত্ব এবং অনিমাদি গুণসমূহের আশ্রয়রূপ ঐশ্বর্য লাভ করেছিলেন। এর ফলে তিনি বায়ুর মত অবাধ গতিতে লোকমধ্যে সর্বত্র বিচরণ করতেন। এক সময় তিনি বৈজয়ন্তী (নবরত্ন রচিত) মালা ধারণপূর্বক বহুসংখ্যক রমণীরত্নে পরিবৃত ও মদমত্ত হয়ে নর্মদার জলে ক্রীড়া করতে করতে বাহুসকলের দ্বারা জলপ্রবাহ রুদ্ধ করেছিলেন। ঐ সময় রাক্ষসরাজ রাবণ দিগবিজয়ে বহির্গত হয়ে নর্মদার তীরে শিবির স্থাপন পূর্বক সেখানে ইষ্ট দেবতার পূজা করেছিলেন। এ অবস্থায় বীরাভিমানী রাবণ স্রোতের প্রতিকূলে প্রবাদির নর্মদার জলরাশির দ্বারা নিজের শিবির প্লাবিত হতে দেখে অর্জুনের ঐরূপ বীর্য সহ্য করতে পারলেন না। তারপর রাবণ অর্জুনকে আক্রমণ করলে, অর্জুন রমণীগণের সন্মুখেই অপরাধকারী রাবণকে অনায়াসে বন্দী করে মহিষ্মতী পুরীতে বানরের মত কিছুকাল আবদ্ধ করে রাখলেন। এবং পরে স্বেচ্ছায় অবজ্ঞাভরে তাকে মুক্তি দিলেন।

সেই অর্জুন এক সময় মৃগয়ার জন্য নির্জন বনে ভ্রমণ করতে করতে যদৃচ্ছায় জমদগ্নির আশ্রমে প্রবেশ করলেন। তখন তপোধন জমদগ্নি একটিমাত্র কামধেনুর সাহায্যেই সৈন্য, অমাত্য ও বাহনসমূহের সহিত সমাগত রাজা অর্জুনের যথাযথ আতিথ্য সকার করলেন। রাজা অর্জুন নিজ ঐশ্বর্য অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ কামধেনুরূপ সেই রত্নটি দেখে, তার প্রতি অভিলাষহেতু হৈহঁয়গণের সহিত স্বয়ং সেই আতিথ্য সৎকারের প্রতি সমাদর প্রকাশ করলেন না। তারপর রাজা অৰ্জুন ঋষির কামধেনুটি হরণ করার জন্য নিজ অনুচরদের আদেশ করলে, তারা বৎসসহ ক্রন্দনরতা ধেনুটিকে বলপূর্বক মহিষ্মতী পুরীতে নিয়ে গেল। রাজা চলে যাওয়ার পর রাম আশ্রমে এসে রাজার ঐরূপ দৌরাত্মের কথা শুনে আহত সর্পের ন্যায় ক্রুদ্ধ হলেন।

তারপর তিনি অসহিষ্ণু হয়ে ভীষণ কুঠার, বর্ম ও তৃণসহ ধনু ধারণপূর্বক সিংহ যেমন হস্তীর প্রতি ধাবিত হয়, তেমনি রাজার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হলেন। রাজা অর্জুন নিজ মহিষ্মতী পুরীতে প্রবেশ করতে করতে দেখতে পেলেন–ভৃগুশ্রেষ্ঠ পরশুরাম কৃষ্ণাজিন পরিধানপূর্বক পরশু, বাণ প্রভৃতি, আয়ুন সহিত ধনুর্ধারণ করে মহাবেগে আগমন করছেন এবং সূর্যতুল্য দ্যুতিশালী তার জটাসমূহ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এ দেখে অর্জুন ভীত হয়ে পরিত্রাণের জন্য হস্তী, অশ্ব, রথ, পদাতিক, গদা, অসি, বাণ, ঋষ্টি, শতঘ্নী ও শক্তির সহিত সপ্তদশ অক্ষৌহিণী সেনাকে রামের অভিমুখে প্রেরণ করলে, ভগবান রাম একাকীই তাদের সকলকে বিনাশ করলেন। তৎকালে মন ও বায়ুর ন্যায় প্রবল বেগবান, শত্রুপক্ষ সংহারকারী রাম কুঠারের আঘাত করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্রে যে যে স্থানে গমন করেছিলেন, সেই সেই স্থানেই শত্রু সৈন্যগণের সারথি ও বাহন নিহত এবং নিজেদের হস্ত, উরু ও গ্রীবাদেশ ছিন্ন হলে, তারা ভূতলে পতিত হয়েছিল।

অনন্তর হৈহঁয়ধিপতি অর্জুন দেখলেন রণাঙ্গন রুধির ধারায় কর্মময় হয়ে উঠেছে এবং পরশুরামের কুঠার ও বাণপ্রহারে নিজ সৈন্যগণের বর্ম, ধ্বজ, ধনু ও দেহ খণ্ড বিখণ্ড হওয়ায়, প্রায় সকল সৈন্যই যুদ্ধে পতিত হয়েছে, অতএব ক্রোধে স্বয়ং যুদ্ধে অগ্রসর হলেন। এরপর অর্জুন সহস্র বাহুদ্বারা এককালে রামের উদ্দেশ্যে পাঁচশত ধনুতে পাঁচশত বাণ যোজনা করলে, অস্ত্রধারীগণের শ্রেষ্ঠ রাম একটিমাত্র ধনুকে যোজিত বাণসমূহের দ্বারা এককালেই অর্জুনের সকল ধনুকবাণ ছেদন করলেন। তারপর অর্জুন নিজ সহস্র হস্তদ্বারা, পর্বত ও বৃক্ষরাশি উৎপাটিত করে রামের বধের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে তার দিকে ধাবিত হলে, রাম তীক্ষ্মধার কুঠার দ্বারা সর্পের ফণাসমূহের ন্যায় তার সহস্রবাহু সবলে ছেদন করলেন। তারপর রাম ছিন্নবাহু অর্জুনের গিরিশৃঙ্গ সদৃশ উন্নত মস্তকটিও দেহ হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। তখন অর্জুনের দশ সহস্র পুত্র ভয়ে পলায়ন করলেন।

এরপর শত্রু সৈন্য বিনাশক রাম বৎসসহ হোমের সহায়ক ধেনুটিকে নিয়ে আশ্রমে প্রত্যাগমনপূর্বক পরহস্ত গমনে ক্লেশযুক্তা সেই ধেনুটি পিতার নিকট অর্পণ করলেন। রাম নিজকৃত সকল কর্ম পিতা ও ভ্রাতৃগণের নিকট বর্ণনা করলে, তা শুনে জমদগ্নি বললেন–হে রাম, হে মহাভুজ রাম, তুমি পাপ কার্য করেছ, যেহেতু সর্বদেবময় রাজাকে বৃথা নিহত করেছ; হে বৎস, আমরা ব্রাহ্মণ, ক্ষমাগুণের দ্বারাই পূজ্য হয়েছি। এই ক্ষমা গুণের দ্বারাই সর্বলোকগুরু ব্রহ্মা পারমেণ্ঠিত্ব সর্বোৎকৃষ্ট পদও লাভ করেছে। আর এই ক্ষমাগুণের দ্বারাই ব্রাহ্মণের শোভা সূর্যের দীপ্তির মত সমুজ্জ্বল হয় এবং ক্ষমাশীলগণের প্রতি ভগবান জগদীশ্বর শ্রীহরি শীঘ্রই প্রসন্ন হয়ে থাকেন। হে বৎস, অভিষিক্ত ক্ষত্রিয় রাজার বধ ব্ৰহ্মবধ থেকেও গুরুতর। অতএব তুমি ভগবান হরির চিন্তায় রত হয়ে তীর্থসেবার দ্বারা পাপ মোচন কর।

.

ষোড়শ অধ্যায়
জমদগ্নিবধ পরশুরাম কর্তৃক ক্ষত্রিয়গণের সংহার এবং বিশ্বামিত্র বংশ বর্ণন

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে কুরুনন্দন, পিতা কর্তৃক এরূপ আদিষ্ট হয়ে পরশুরাম, ‘তাই করছি’– এই বলে স্বীকার করে, সংবৎসর কাল নানা তীর্থ পর্যটন করে আবার আশ্রমে ফিরে এলেন। কোন এক সময়ে রেণুকাঁদেবী জল আনতে গিয়ে গঙ্গায় অপ্সরাগণের সাথে ক্রীড়ারত পদ্মমাল্যধারী গন্ধর্বরাজ চিত্ররথকে দেখতে পেলেন। রেণুকা জল আনার জন্য গঙ্গায় গিয়ে ও ক্রীড়ারত চিত্ররথকে দেখে তার প্রতি ঈষৎ স্পৃহাবতী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, ওদিকে হোমবেলা অতিক্রান্ত হতে লাগল, তাও স্মরণ করলেন না। তারপর নিজেই কালতিক্রম লক্ষ্য করে মুনি জমদগ্নির অভিশাপ ভয়ে ভীত হয়ে আশ্রমে ফিরে জলের কলসটি মুনির সম্মুখে রেখে কৃতাঞ্জলিপুটে অবস্থান করছিলেন। তারপর মুনি পত্নীর ঐরূপ অন্যায় আচরণ জানতে পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন–হে পুত্রগণ, তোমরা এই পাপীয়সীকে হত্যা কর। কিন্তু পুত্রগণ এরূপ আদিষ্ট হয়েও তা পালন করলেন না। পরশুরাম পিতা জমদগ্নি মুনির সমাধি ও তপস্যার প্রভাব সম্যরূপে জানতেন বলে, পিতার আদেশে তৎক্ষণাৎ মাতা ও ভ্রাতৃগণকে বধ করলেন। এতে সত্যবতীসুত জমদগ্নি সন্তুষ্ট হয়ে পরশুরামকে ইচ্ছানুরূপ বর দিতে চাইলে, তিনি নিহত ব্যক্তিদের পুনর্জীবন এবং এই হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তাদের বিস্মৃতি–এই দুটি বর প্রার্থনা করলেন। তারপর বরের প্রভাবে নিহত ব্যক্তিগণ নিদ্রাভঙ্গে জাগ্রত ব্যক্তিদের ন্যায় সত্বর গাত্রোত্থান করলেন। বস্তুতঃ পরশুরাম পিতার তপঃপ্রভাব বিশেষরূপে জানতেন বলেই তার আদেশে নির্বিচার সুহৃদগণকে বধ করেছিলেন।

হে মহারাজ, কার্তবীর্যাজুনের পুত্রগণ পরশুরামের বীর্যে পরাভূত হয়ে এবং তার দ্বারা নিজেদের পিতার বধের বৃত্তান্ত স্মরণ করে কোথাও শন্তি লাভ করতে পারল না। একদিন ভ্রাতৃগণের সহিত রাম আশ্রম হতে বনে গেলে, কার্তবীর্যাজুনের পুত্রগণ সুযোগ পেয়ে শত্রুতাসাধনের ইচ্ছায় জমদগ্নির আশ্রমে উপস্থিত হল। তৎকালে মুনি জমদগ্নি উত্তমঃশ্লোক ভগবান শ্রীহরিতে চিত্ত স্থির করে অগ্নিশালায় উপবিষ্ট ছিলেন। এ অবস্থায় তাকে দেখতে পেয়ে পাপকর্মে কৃতনিশ্চয় সেই অর্জুনের পুত্রগণ তাকে হত্যা করল। তখন পরশুরামের জননী রেণুকা অতি করুণভাবে পতির প্রাণরক্ষার জন্য প্রার্থনা করলেও অতি দারুণ সেই নিকৃষ্ট ক্ষত্রিয়গণ বলপূর্বক মুনির মস্তক ছেদন করে নিয়ে গেল। তারপর দুঃখ শোকে পীড়ি পতিব্রতা রেণুকা নিজ হস্তদ্বারা বক্ষঃস্থলে আঘাত করতে করতে “হা রাম, হা রাম, হা বৎস, এস, শীঘ্র এস”–উচ্চস্বরে ক্রন্দন করতে লাগলেন।

জমদগ্নির পুত্রগণ দূর হতে হা রাম, হা রাম–এইরূপ আর্তনাদ শুনতে পেয়ে শীঘ্র আশ্রমে এসে পিতাকে নিহত অবস্থায় দেখতে পেলেন। তৎকালে তারা দুঃখ, ক্রোধ, অসহিষ্ণুতা, কাতরতা ও শোকাবেগে বিমোহিত হয়ে হাঃ পিত, হা সাবধা, হা ধর্মিষ্ঠ, আপনি আমাদের ত্যাগ করে স্বর্গে গমন করলেন, এইরূপ বিলাপ করতে লাগলেন। তারপর রাম পিতার দেহ ভ্রাতৃগণের নিকট রেখে কুঠার হস্তে ক্ষত্রিয়কুল বিনাশের জন্য কৃতসংকল্প হলেন। হে মহারাজ, তারপর রাম ব্রহ্মগতিগণের পাপে নষ্টশী মাহিষ্মতী পুরী গমন করে, তার মধ্যস্থলে কার্তবীর্যাজুনের পুত্রগণের ছিন্ন মস্তকরাশির দ্বারা একটি সুবৃহৎ পর্বত রচনা করলেন। আর তাদের রক্তে দ্বারা ব্রাহ্মণবিদ্বেষীগণের ভয়াবহ একটি ঘোরতর নদীর সৃষ্টি করলেন। তারপর ক্ষত্রিয়গণ অল্প অন্যায় করলেই পিতার বধকে নিমিত্ত করে পৃথিবীকে একবিংশতিবার নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন। সামন্তপঞ্চক ক্ষেত্রে তাদের রক্তজলে পরিপূর্ণ নয়টি হ্রদ নির্মাণ করেছিলেন। (পরশুরামের একবিংশতিবার ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংসের কারণ–পতির শোকে রেণুকা একুশবার নিজের বক্ষঃতাড়না করেছিলেন, এজন্য পরশুরাম ততবার ক্ষত্রিয়বংশ ধ্বংস করেছিলেন। এটা লোক প্রসিদ্ধি শ্রীধর স্বামীপাদ।)।

তারপর তিনি পিতার ছিন্ন মস্তক দেহের সহিত যুক্ত করে এবং ঐ দেহ কুশের উপর রেখে যজ্ঞসমূহ দ্বারা সর্বদেবময় অন্তর্যামী বিষ্ণুর অর্চনা করেছিলেন, তিনি যজ্ঞান্তে হোতাকে পূর্বদিক, ব্রহ্মাকে দক্ষিণ দিক, অধ্বর্যকে পশ্চিম দিক্‌, উন্নীতাকে উত্তর দিক অপর ঋত্বিক সকলকে কোণসমূহ, কশ্যপকে ঐ সকল দিকের মধ্যভাগ, উপদ্রষ্টাকে আর্যাবর্ত এবং সদস্যগণকে অবশিষ্ট ভূমিভাগ দান করেছিলেন। এর পর তিনি মহানদী সরস্বতীতে গিয়ে অবভৃত স্নান (যজ্ঞ সমাপ্তি কালীন স্নান করেন।

যারা অশেষ কলুষ প্রক্ষালণ-পূর্বক সূর্যের ন্যায় বিরাজ করছিলেন। তারপর রামকর্তৃক পূজিত জমদগ্নি স্মৃতিযুক্ত (অথবা চৈতন্যময়) নিজ দেহ লাভ করে সপ্তর্ষিমণ্ডলে সপ্তম ঋষি হয়েছিলেন। হে মহারাজ, জমদগ্নিতনয় কমললোচন ভগবান রামও আগামী মন্বন্তরে বেদপ্রবর্তক সপ্তর্ষিগণের অন্যতম হবেন। তিনি ন্যস্তদণ্ড (অর্থাৎ ক্ষত্রিয়বধাদি রূপ কার্য পরিত্যাগ করে) এবং প্রশান্ত চিত্ত হয়ে অদ্যাপি মহেন্দ্র পর্বতে অবস্থান করছেন। সিদ্ধ, গন্ধর্ব ও চারণগণ তাঁর বিচিত্র চরিত গান করছেন। এইরূপে ভগবান বিশ্বাত্মা শ্রীহরি ভৃগুবংশে অবতীর্ণ হয়ে পৃথিবীর ভারস্বরূপ ক্ষত্রিয়গণকে বহুবার সংহার করেছেন।

মহারাজ গাধী হতে জ্বলন্ত অগ্নির ন্যায় মহাতেজস্বী বিশ্বামিত্র তপস্যার দ্বারা ক্ষত্রিয়ত্ব পরিহার করে ব্রহ্মতেজ (অর্থাৎ ব্রাহ্মণত্ব) লাভ করেছিলেন। এই বিশ্বামিত্রের একশত পুত্র হয়, তাঁর মধ্যে কেবল মধ্যমের নাম মধুদুঃ, তথাপি সকল পুত্ৰই মধুদুলস্ নামে উক্ত হতেন। বিশ্বামিত্র অজীগর্তের পুত্র, ভৃগুবংশীয় “দেবরাত”–এই অপর নামধারী শুনঃশেফকে পুত্ররূপে গ্রহণ করে নিজ পুত্রদের বললেন–তোমরা ইহাকে জ্যেষ্ঠরূপে গণ্য করবে। অজীগর্ত হরিশচন্দ্রের যজ্ঞকালে পুত্র শুনঃশেফকে যজ্ঞীয় পশুরূপে হরিশচন্দ্রের নিকট বিক্রয় করেছিলেন। শুনঃশেফ (বিশ্বামিত্রের উপদিষ্ট মন্ত্রে) প্রজাপতি প্রভৃতি দেবতাদের স্তুতি করে পাশবন্ধন হতে মুক্ত হয়েছিলেন। তাপস শুনঃশেফ ভৃগুবংশীয় হলেও হরিশচন্দ্রের বরুণযজ্ঞে দেবগণ কর্তৃক “রাত” অর্থাৎ প্রদত্ত হয়েছিলেন (অর্থাৎ দেবগণ তাঁর জীবন রক্ষা করেছিলেন। এজন্য তিনি “দেবরাত” নামে গাধি-বংশীয়গণের মধ্যে প্রসিদ্ধ হন।)

মধুদুন্দসগণের মধ্যে জ্যেষ্ঠ উনপঞ্চাশগণ শুনঃশেফের জ্যেষ্ঠত্ব সঙ্গত মনে না করে তা স্বীকার করলেন না। এজন্য পিতা বিশ্বামিত্র ক্ষুব্ধ হয়ে অভিশাপ দিলেন-হে দুর্জনগণ, তোমরা ম্লেচ্ছ হও। তখন মধুছন্দাঃ কনিষ্ঠ পঞ্চাশ ভ্রাতার সহিত বললেন–হে পিতঃ, আপনি আমাদের জ্যেষ্ঠত্ব বা কনিষ্ঠত্ব যা মনে করেন, আমরা তাই মান্য করব। তারপর তারা মন্ত্রদ্রষ্টা শুনঃশেফকে–”হে আর্য, আমরা আপনার অনুগামী”–এই বলে জেষ্ঠ্যেরূপে তাঁকে তখন গ্রহণ করলেন। তখন বিশ্বামিত্র পুত্রদের বললেন–তোমরা যারা আমার পূজনীয়ত্ব স্বীকার করে আমারে আদেশ পালন করে, আমাকে যথার্থই পুত্রবান করেছ–সেই তোমরা আমার বরে পুত্রবান হবে। হে কুশিকগণ, এই দেবরাত আমার পুত্র হল, তোমরা এর অনুগামী হবে।

হে মহারাজ, বিশ্বামিত্রের অষ্টক, হারী জয় ও ক্রতুমান্ প্রভৃতি আরও অনেক পুত্র ছিল। বিশ্বামিত্রের পুত্রগণের মধ্যে জ্যেষ্ঠ উনপঞ্চাশ জন অভিশপ্ত, কনিষ্ঠ পঞ্চাশ জন পিতার অনুগ্রহ- প্রাপ্ত এবং অপরের পুত্র দেবরাত পুত্ররূপে স্বীকৃত। এইরূপে কৌশিক গোত্র নানা প্রকার এবং অন্য প্রবর প্রাপ্ত হয়েছে। বস্তুতঃ দেবরাতের জ্যেষ্ঠত্ব হেতুই এরূপ হয়েছে।

.

সপ্তদশ অধ্যায়
ক্ষত্রবৃদ্ধ, রাজি, রম্ভ ও অনেনার বংশ বর্ণন।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, পুরুরবার আয়ু নামে যে পুত্র ছিলেন, তাঁর পাঁচটি পুত্র হয়। তাঁদের নাম–নহুষ, ক্ষত্রবৃদ্ধ, রাজি, রম্ভ ও বীর্যবান অনেনা। সম্প্রতি ক্ষত্রবৃদ্ধের পুত্র সুহোত্র, তার তিন পুত্র–কাশ্য, কুশ ও গৃৎসমদ।

গৃৎসমদের পুত্র শুনক, শুনকের পুত্র ঋগবেদজ্ঞ শ্রেষ্ঠ শৌণক ঋষি। কাশ্যের পুত্র কাশি, তাঁর পুত্র রাষ্ট্র, তার পুত্র দীর্ঘতমা এবং দীর্ঘতমার পুত্র আয়ুর্বেদের প্রবর্তক ধন্বন্তরি। ইনি ভগবান বাসুদেবের অংশজাত এবং যজ্ঞভাগের ভোক্তা। হঁহার স্মরণমাত্রেই সকল রোগের উপশম হয়ে থাকে। ধন্বন্তরির পুত্ৰ কেতুমান, তাঁর পুত্র ভীমরুথ, তার পুত্র দিবোদাস, তার পুত্র দ্যুমান। ইনি প্রতর্দন নামে প্রসিদ্ধ হন। এই প্রতৰ্দনই শত্রুজিৎ, বৎস, ঋতধ্বজ এবং কুবলয়া– এই সকল নামেও প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর অলর্ক প্রভৃতি অনেক পুত্র হয়েছিল। হে মহারাজ, এই অলকব্যতীত অন্য কোন রাজা অক্ষুণ্ণ যৌবনের অধিকারী হয়ে ছেষট্টি (ছয় ষষ্টি) হাজার বছর পৃথিবীতে রাজত্ব ভোগ করেন নাই। অলর্কের পুত্র সন্ততি, তার পুত্র সুনীথ, তার পুত্র ধর্মকেতু, তা হতে সত্যকেতু উৎপন্ন হন। সত্যকেতুর পুত্র ধৃষ্টকেতু, তাঁর পুত্র রাজা সুকুমার, তার পুত্র ভগ এবং তার পুত্র ভার্গভূমি।

হে মহারাজ, এই সকল রাজা সকলেই কাশির পুত্র-পৌত্রাদি রূপে উৎপন্ন এবং সকলেই কাশির প্রপিতামহ ক্ষত্রবৃদ্ধের বংশগত। রম্ভের পুত্র রভস, তাঁর পুত্র গম্ভীর এবং গম্ভীরের পুত্র অক্রিয়। অক্রিয়ের সন্তান ব্রহ্মজ্ঞ হওয়ায় তার আর বংশবিস্তৃতি ঘটে নাই।

এরপর অনেনার বংশবিবরণ শোন। অনেনার পুত্র শুদ্ধ, তাঁর পুত্র শুচি, তা হতে ধর্মসারথি চিত্ৰকুর উৎপত্তি হয়। চিত্ৰকুর সন্তান শান্তরজা, ইনি কর্মমার্গ হতে নিবৃত্ত, জিতেন্দ্রিয় ও জ্ঞানী ছিলেন, এজন্য তার বংশবিস্তৃতি হয়নি। রাজির অতুলনীয় পরাক্রমশালী পাঁচশত পুত্র ছিলেন। এক সময় মহারাজ রাজি, দেবগণের প্রার্থনায় দৈত্যগণের বিনাশ করে ইন্দ্রকে স্বর্গরাজ্য প্রদান করেন। ইন্দ্র রাজির পদযুগল ধারণপূর্বক তারই হস্তে স্বর্গরাজ্য প্রদান করে প্রহাদ প্রভৃতি শত্রুগণের ভয়ে তার নিকট আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু রাজির মৃত্যুর পর ইন্দ্র, তার পুত্রগণের নিকট স্বর্গরাজ্য প্রার্থনা করলে, তারা ইন্দ্রকে তা না দিয়ে নিজেরাই স্বর্গের অধিপতিরূপে যজ্ঞভাগ পর্যন্ত গ্রহণ করতে লাগল।

তারপর দেবগুরু বৃহস্পতি রাজিপুত্রদের বুদ্ধিভ্রংশের জন্য অভিচার বিধান দ্বারা হোম আরম্ভ করলেন, তাতে তারা অচিরেই সন্মার্গ হতে ভ্রষ্ট হলেন, তখন দেবরাজ ইন্দ্র তাঁদের বধ করলেন। একজনও অবশিষ্ট রইল না। হে মহারাজ, ক্ষত্রবৃদ্ধের পৌত্র কুশ, পুত্র প্রতি তার পুত্র জয়, তার পুত্র কৃত। কৃতের পুত্র রাজা হর্যবল, তার পুত্র সহদেব, তার তনয় হীন, হীনের সন্তান জয়সেন, তাঁর পুত্র সংকৃতি এবং সংস্কৃতির পুত্র ক্ষত্রধর্মনিষ্ঠ মহারথ জয়। এই সকল নরপতি ক্ষত্রবৃদ্ধের বংশে উৎপন্ন হন। এর পর রাজা নহুষের বংশ বৃত্তান্ত বলছি শোন।

.

অষ্টাদশ অধ্যায়
যযাতির চরিত্র বর্ণন

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, দেহধারী পুরুষের ছয়টি ইন্দ্রিয়ের (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মন) মত রাজা নহুষের যতি, যযাতি, সংযাতি, আয়তি, বিয়তি ও কৃতি নামক ছয়টি পুত্র হয়েছিল। রাজাদি ভোগে প্রবিষ্ট হলে পুরুষ আত্মা ও পরমাত্মাকে জানতে পারে না এবং তাঁর পরিণাম নরকাদি দুঃখ এটা জেনে যতি, পিতা নহুষ রাজ্য দান করলেও রাজ্যভার গ্রহণ করতে ইচ্ছা করলেন না। স্বর্গরাজ্য লাভ করে রাজা নহুষ শচীদেবীর প্রতি ধৃষ্টতার জন্য অগস্ত্যাদি মুনিগণ তাঁকে স্বর্গচ্যুত ও অজগরত্ব প্রাপ্ত করালে, যযাতি কনিষ্ঠ চার ভাইকে চারদিকের শাসনকার্যে নিযুক্ত করে, নিজে শুক্রাচার্য ও অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা দেবযানী ও শর্মিষ্ঠাকে বিবাহ করে পৃথিবী পালন করেছিলেন।

রাজা পরীক্ষিৎ জিজ্ঞাসা করলেন-হে ব্রহ্মর্ষি, ভগবান শুক্রাচার্য ব্রহ্মর্ষি আর নহুষপুত্র যযাতি ক্ষত্রিয়–এ অবস্থায় ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের এই প্রকার প্রতিলোম বিবাহ কি করে হয়েছিল?

শ্ৰীশুকদেব বললেন–এত সময় দানবেন্দ্র বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা সহস্র সখী ও গুরুপুত্রী দেবযানীর সহিত মিলিত হয়ে পুরের নিকটস্থ উদ্যানে বিহার করতে গিয়েছিলেন। সেই মনোহর উপবনে তরুসকল পুষ্পভারে অবনত হয়েছিল এবং পদ্ম-পুষ্প শোভিত সরোবরে ভ্রমরগণ কলস্বরে গুঞ্জন করছিল। তৎকালে কমলনয়না সেই কন্যাগণ সরোবরের তীরে গিয়ে নিজ নিজ পরিহিত বস্ত্র উপরে রেখে জলে অবতরণপূর্বক পরস্পর জলসিঞ্চন করে বিহার করছিলেন। এই সময় দেবী পার্বতীর সহিত ভগবান শংকরকে বৃষে আরোহণ করে নিকটস্থ পথ দিয়ে গমন করতে দেখে কন্যাগণ লজ্জাবশতঃ সত্বর তীরে উঠে বস্ত্র পরিধান করেছিলেন। তখন ব্যস্ততাবশতঃ শর্মিষ্ঠ না জেনে গুরুকন্যার বস্ত্রকেই নিজ বস্ত্র মনে করে পরিধান করলে, দেবযানী ক্রুদ্ধ হয়ে এরূপ বললেন–অহো, তোমরা এই দাসীর অন্যায় কার্য লক্ষ্য কর। কুক্করীর যেরূপ যজ্ঞের হবিঃ গ্রহণ করে, এই দাসীও সেরূপ আমার পরিধেয় বস্ত্র পরিধান করেছে।

দেবযানী আরও বললেন–যাঁরা তপস্যার দ্বারা এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, যাঁরা পরম পুরুষ ভগবান বিষ্ণুর মুখ-স্বরূপ, যাঁরা স্বয়ং-প্রকাশ-রূপ জ্যোতির্ময় পরব্রহ্মকে হৃদয়ে ধারণ করেন, যাঁরা মঙ্গলময় বেদমার্গের প্রদর্শক, লোকপালশ্রেষ্ঠ দেবগণ এমনকি লোকপাবন বিশ্বাত্মা ভগবান শ্রীহরিও যাঁদের বন্দনা করেন, সেই ব্রাহ্মণগণ স্বভাবতঃই পূজ্য, তন্মধ্যে ভৃগুবংশীয় বলে আমরা বিশেষ সম্মানভাজন। এ দাসীর পিতা অসুর বৃষপর্বা আমাদের শিষ্য। এ অবস্থায় শুদ্রের বেদ-ধারণের ন্যায় এই অসতী আমাদের পরিধেয় বসন পরিধান করেছে। গুরুকন্যা দেবযানী এরূপ তিরস্কার করতে থাকলে, শর্মিষ্ঠা ক্রোধে আহতা ভুজঙ্গীর ন্যায় ঘন ঘন দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করতে করতে ওষ্ঠ দংশনপূর্বক দেবযানীকে এরূপ বলেছিল–ওরে ভিক্ষুকী। তুমি নিজের বৃত্তান্ত না জেনেই বহুভাবে আত্মপ্রশংসা করছ, কিন্তু তুমি কি কাকের ন্যায় (জীবধারণের জন্য) আমাদের গৃহের প্রত্যাশা কর না? শর্মিষ্ঠা ক্রোধে এরূপ আরও কর্কশবাক্যে গুরুপুত্রী পূজ্য সতী দেবযানীকে তিরস্কার করে, তার বস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাকে কূপে ফেলে দিল।

তারপর শর্মিষ্ঠা নিজ গৃহে চলে গেলে রাজা যযাতি মৃগয়া করতে করতে দৈবাৎ সেখানে উপস্থিত হলেন এবং জলপানের জন্য সেই জলশূন্য কূপের নিকট এসে দেবযানীকে দেখতে পেলেন। তখন দয়াপরবশ হয়ে রাজা বিবস্ত্রা দেবযানীকে নিজের উত্তরীয় বস্ত্র দিয়ে নিজ হস্তদ্বারা তার হস্তধারণ পূর্বক কূপ হতে উদ্ধার করলেন। নিজের উদ্ধারকারী বীর যযাতিকে শুক্রকন্যা দেবযানী প্রেমপূর্ণ বাক্যে বললেন–হে শুক্রপুরবিজয়ী মহারাজ। আপনি আমার পাণিগ্রহণ করেছেন। অতএব আপনি আমাকে গ্রহণ করায়, অপর কেউ যেন আমার পাণিগ্রহণ না করে। আমি কূপমগ্ন ছিলাম, তবুও যে আপনার দর্শন পেলাম, ইহা দৈবেরই ঘটনা, কোন মনুষ্যকৃত নহে। (আমাদের এই প্রতিলোম–বিবাহ শাস্ত্রনিষিদ্ধ হলেও) আমাদের দুই জনের এই সম্বন্ধ নিশ্চয়ই পরমেশ্বর নির্বন্ধ করে রেখেছে, ইহা অন্য পুরুষকৃত নয়। হে মহাভুজ, আমি পূর্বে যাকে শাপ দিয়েছিলাম, বৃহস্পতির পুত্র সেই কচের অভিশাপে কোন ব্রাহ্মণ আমার পাণিগ্রহণ করবেন না। (পূর্বে বৃহস্পতির পুত্র শুক্রাচার্যের নিকট মৃতসঞ্চীবনী বিদ্যা লাভ করেছিলেন, সেই সময় দেবযানী তাকে বিবাহ করতে চাইলে, কচ বলেছিলেন–তুমি আমার গুরুপুত্রী, পূজণীয়া, তোমাকে বিবাহ করতে পারি না। তখন ক্রুদ্ধ হয়ে দেবযানী তাকে শাপ দিয়েছিলেন–তোমার অধীত বিদ্যা নিষ্ফল হবে। তাতে কচ দেবযানীর প্রতি শাপ দিয়েছিলেন– তোমার কোন ব্রাহ্মণ পতি হবে না। এরূপ বিবাহ অশাস্ত্রীয় বলে অনভিপ্রেত হলেও রাজা যযাতি উহা দৈব কর্তৃক প্রাপিত বলে মনে করলেন। বিশেষতঃ তাঁর আর্যচিত্ত কখনও অধর্মে প্রবর্তিত হয় না– এজন্য দেবযানীর প্রতি নিজের চিত্তের অনুরাগ উপলব্ধি করে, তার বাক্য গ্রহণ করলেন। (অর্থাৎ যদি তোমার পিতা সম্প্রদান করেন, তবে তোমাকে গ্রহণ করব–এরূপ বলেছিলেন।)

তারপর বীর যযাতি চলে গেলে, দেবযানী রোদন করতে করতে পিতার নিকট গিয়ে শর্মিষ্ঠার কৃত সকল আচরণের কথা নিবেদন করলেন। তা শুনে বিবেকী শুক্রাচার্য পৌরহিত্যের নিন্দা এবং উঞ্ছবৃত্তি নিন্দা করতে করতে কন্যার সহিত পুরী হতে নির্গত হলেন। তখন বৃষপর্বা বুঝতে পারলেন যে–শত্রু দেবগণের বিজয় সম্পাদনই এখন গুরুদেবের অভিপ্রায়, অতএব তাকে প্রসন্ন করার জন্য পথিমধ্যে অবনত মস্তকে শুক্রাচার্যের পদযুগলে পতিত হলেন। ভগবান শুক্রাচার্যের ক্রোধ ক্ষণার্ধ কালমাত্র স্থায়ী হওয়ায় তিনি শিষ্য বৃষপর্বাকে বললেন–হে রাজন, আমি কন্যাকে ত্যাগ করতে পারি না, অতএব তুমি এর অভিলাষ পূর্ণ কর। বৃষপর্বা তা অঙ্গীকার করলে, দেবযানী নিজের অভিপ্রায় প্রকাশ করে বললেন–আমি পিতা কর্তৃক প্রদত্ত হয়ে যেখানে যাব, শর্মিষ্ঠাও নিজ সহচারীগণের সাথে সেখানে আমায় অনুগমন করবে। তখন বৃষপর্বা বিবেচনা করে দেখলেন– শুক্রাচার্য চলে গেলে আমাদের ঘোর সঙ্কট, আর তিনি এখানে থাকলে আমাদের গুরুতর কার্যসিদ্ধির সম্ভাবনা, অতএব তখনই গুরুপুত্রী দেবযানীর হস্তে সখীসমেত শর্মিষ্ঠাকে অর্পণ করলেন। পিতা কর্তৃক প্রদত্ত হওয়ায় রাজকন্যা শর্মিষ্ঠা সহস্র সখীর সহিত দাসীর মত দেবযানীর পরিচর‍্যা করতে প্রবৃত্ত হলেন।

তারপর ভগবান শুক্রাচার্য শর্মিষ্ঠার সহিত নিজ কন্যা দেবযানীকে যযাতির হস্তে সম্প্রদান করে, বিশেষ করে তাকে বলে দিলেন–রাজন, তুমি কখনও শর্মিষ্ঠাকে নিজ শয্যায় স্থান দিতে পারবে না। হে মহারাজ, কিছুকাল পরে শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে পুত্রবতী দেখে, নিজ ঋতুকালে সখীর পতি যযাতিকেই পুত্রোৎপাদনে জন্য নির্জনে প্রার্থনা করলেন।

দৈত্যরাজ কন্যা শর্মিষ্ঠা সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রার্থনা করলে, শুক্রচার্যের নিষেধ বাক্য স্মরণ করেও যযাতি ঐ প্রার্থনা পূর্ণ করা ধর্ম বলে বিবেচনা করায় যথাকালে সেই দৈবপ্রাপ্ত ঘটনা স্বীকার করেছিলেন। দেবযানী যদু ও তবসু পুত্রদ্বয় এবং শর্মিষ্ঠা দ্রুহ্য, অনু ও পুরু এই তিন পুত্র প্রসব করেছিলেন। মানিনী দেবযানী নিজ স্বামী হতে শর্মিষ্ঠার সন্তানোৎপত্তির কথা জানতে পেরে ক্রোধে

মূচ্ছিত প্রায় হয়ে তৎক্ষণাৎ পিতৃগৃহে গমন করলেন। কামুক যযাতি নানারূপে অনুনয় বাক্য পত্নীকে। সান্ত্বনা দিতে দিতে তার অনুগমন করলেন। কিন্তু পাদ-সংবহনাদির দ্বারাও তাকে প্রসন্ন করতে পারলেন না।

এদিকে কন্যার মুখে সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হয়ে শুক্রাচার্য ক্রুদ্ধ হয়ে যযাতিকে বললেন–হে স্ত্রী কামুক মিথ্যাচাররত, মূঢ়, মানবদের বিরূপকারিণী ‘জরা তোমার শরীরে প্রবেশ করুক’। ইহা শ্রবণ করে যযাতি ক্ষিপ্লচিত্ত নিবেদন করলেন–হে ব্রাহ্মণ, আপনার কন্যার উপভোগ দ্বারা আমি এখনও কামতৃপ্ত হইনি। এ অভিশাপ আপনার কন্যাতেও ফলবে।

তা বুঝতে পেরে তখন শুক্রাচার্য বললেন–যে ব্যক্তি তোমার জরা গ্রহণ করতে ইচ্ছা করবে, তুমি তার যৌবনের সঙ্গে যথেচ্ছরূপে নিজ জরার বিনিময় করতে পারবে। যযাতি এই প্রকারে জরা বিনিময়ের ব্যবস্থা লাভ করে জ্যেষ্ঠপুত্রকে আহ্বান করে বললেন–হে বৎস, তুমি আমার এই জরা গ্রহণ করে আমাকে নিজ যৌবন দান কর। হে বৎস, তোমার মাতামহ আমার এই জরার সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু আমি এখনও বিষয়ভোগে পরিতৃপ্ত নই। অতএব তোমার যৌবনদ্বারা আরও কিছু বছর বিষয়সুখ অনুভব করব।

যদু বললেন–হে পিতঃ, এই যৌবনকালে আপনার জরা গ্রহণ করতে উৎসাহ বোধ করছি না। কারণ পরিপূর্ণ সুখ অনুভব না করে মানুষের বিষয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা আসতে পারে না। হে ভারত, তারপর যযাতি যথাক্রমে তুর্বসু, দ্রুহ্য এবং অনুকে জরা গ্রহণের কথা বললে অনিত্য যৌবন দিতে নিজ বুদ্ধিসম্পন্ন ও ধর্মজ্ঞান রহিত সেই সকল পিতার আদেশ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এরপর যযাতি বয়সে কনিষ্ঠ অথচ অধিক গুণশালী পুত্র পুরুকে বললেন–হে বৎস, তুমি তোমার অগ্রজগণের মত আমার আদেশ প্রত্যাখ্যান করতে পার না। (বস্তুতঃ যযাতি পরধর্মবিৎ, জরাগ্রহণে ভগবাদারাধিনার বিঘ্ন হবে বলে তিনি জরা গ্রহণ করলেন না। দশম স্কন্ধে বললেন–ধর্মশীল যদু বংশে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবতার রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এজন্য পারমার্থিক, ভগবৎসেবার জন্যই প্রকৃত ধর্ম লঙ্ঘন করেছিলেন, কিন্তু অপর পুত্রগণ অধার্মিক, কেবল বিষয়ভোগের কামনায় পিতার আদেশ উপেক্ষা করেছিলেন।)।

পুরু বললেন–হে মহারাজ, যাঁর প্রাসাদে মানুষ পরম পদ লাভ করতে পারে, ইহলোকে কোন্ ব্যক্তি সেই জন্মদাতা পিতার উপকারের প্রত্যুপকার করতে পারে? যে পুত্র পিতার চিন্তিত বিষয় নিজ হতেই সম্পাদন করে, তাকে উত্তম বলা হয়, আদিষ্ট হয়ে কার্যকরী পুত্র মধ্যম, কিন্তু যে পুত্র আদেশ পেয়েও তা পালন করে না, সে পিতার বিষ্ঠাতুল্য। হে মহারাজ, এই বলে পুরু আনন্দিত মনে পিতার জরা গ্রহণ করলেন এবং যযাতিও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের যৌবন দ্বারা যথোপযুক্ত বিষয়সমূহ ভোগ করতে লাগলেন। সপ্তদ্বীপের অধিপতি যযাতি পিতার মত প্রজাগণকে সম্যক্ পালন করে, অক্ষুণ্ণ ইন্দ্রিয়শক্তি সম্পন্ন হয়ে প্রীতির সহিত বিষয়ভোগ করতে লাগলেন। প্রেয়সী দেবযানীও মন, বাক্য, দেহ ও অন্যান্য ভোগ্য বস্তুর দ্বারা প্রতিদিন নির্জনে প্রিয়তমের পরম প্রীতি সম্পাদন করেছিলেন।

রাজা যযাতি প্রভূত দক্ষিণাযুক্ত বহু বহু যজ্ঞ করতঃ সর্বদেবময় সর্ববেদস্বরূপ যজ্ঞপুরুষ ভগবান হরির অর্চনা করেছিলেন। আকাশে (মেঘরাশির) ন্যায় যার মধ্যে এই বিশ্ব বিরচিত হয়ে, ইন্দ্রিয়সমূহের জাগরণকালে স্বপ্ন, মায়া ও মনোরথের মত ক্ষণকাল প্রকাশিত এবং ইন্দ্রিয়সমূহের বিরামকালে অদৃশ্য হয়েছে, মহারাজ যযাতি নিস্পৃহ হয়ে সেই পরম সূক্ষ্ম, পরম গুহ্য বাসুদেবরূপী ভগবান নারায়ণকে নিজ হৃদয়ে স্থাপন করে তারই আরাধনা করেছিলেন। হে মহারাজ, এইরূপে সার্বভৌম নরপতি যযাতি মন ও পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সহস্র বৎসর বিষয়ভোগ করেও বহির্মুখ ইন্দ্রিয়বর্গের দ্বারা পরিতৃপ্ত হতে পারেননি।

.

ঊনবিংশ অধ্যায়
যযাতির গৃহত্যাগ-কথন

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, স্ত্রৈণ রাজা যযাতি এরূপে বিষয় ভোগ করতে করতে একসময় নিজের আত্মপ্রবঞ্চনা বুঝতে পেরে চিন্তিত হয়ে প্রিয়তমা দেবযানীর নিকট এইরূপ ইতিহাস বর্ণনা করেছিলেন।–হে ভাৰ্গবি, বনবাসী জিতেন্দ্রিয় পুরুষগণ আমার মত গৃহস্থের চরিত্র অনুভব করে, এদের কি করে মঙ্গল হবে ভেবে একটি ইতিহাস বলেছিলেন, তা শোন। (এখানে রাজা নিজেকে লক্ষ্য করে নিজেকে ছাগ এবং পত্নীকে লক্ষ্য করে ছাগী শব্দ ব্যবহার দিয়ে, নিজেদের ইতিহাসই বর্ণনা করেছেন।),

এক সময় একটি ছাগ (পুরুষ) বনমধ্যে (সংসারে) নিজের প্রিয় (বিষয়) অন্বেষণ করতে করতে হঠাৎ একটি ছাগীকে স্বকর্মবশতঃ কূপের মধ্যে পতিত দেখতে পেল। তারপর কামুক সেই ছাগ, ছাগীর উদ্ধারের উপায় চিন্তা করতে করতে শৃঙ্গের অগ্রভাগ দ্বারা কূপের তীরভাগের মৃত্তিকাদি উত্তোলনপূর্বক নির্গমের পথ নির্মাণ করে দিল। ঐ পথে সেই সুন্দরী ছাগী উপরে উঠে সেই ছাগকেই পতিরূপে কামনা করল। তারপর সেই ছাগী তাকে পতিরূপে বরণ করেছে দেখে, আরও অন্যান্য ছাগী হৃষ্টপুষ্ট, শ্মশ্রযুক্ত, রেতঃনিঃসরণকারী, রতিনিপুণ সেই অতিপ্রিয় ছাগটিকেই নিজ নিজ কান্তরূপে কামনা করেছিল। এরপর সেই লোভী ছাগ কামগ্রস্ত হয়ে একাকীই সেই বহু ছাগীর রতিবর্ধন করতে করতে নিজের আত্মাকে ভুলে গেল।

তারপর যে ছাগী পূর্বে কূপের মধ্যে পতিত হয়ে কষ্ট ভোগ করেছিল, সে নিজের প্রিয় ছাগকে অন্য প্রিয়তমা ছাগীর সাথে রমণ করতে দেখে ছাগের অনুচিত কর্ম সহ্য করতে পারল না। তখন সেই ছাগী সুহৃদরূপী দুষ্টচিত্ত, ক্ষণসুহৃদ, ইন্দ্রিয়াসক্ত ও কামুক সেই ছাগকে পরিত্যাগ করে, নিজের প্রভুর নিকট চলে গেল। তখন স্ত্রৈণ ও বিহরকাতর সেই ছাগও ছাগীকে প্রসন্ন করার জন্য নিজ জাতির উচিত শব্দ করতে করতে তাকে অনুগমন করল, কিন্তু পথে কোনপ্রকারেই, তাকে প্রসন্ন করতে পারল না। সেই ছাগীর প্রভু ছিলেন কোনও এক ব্রাহ্মণ। তিনি ক্রোধে সেই ছাগের লম্বমান অণ্ডদ্বয় ছেদন করে দিলেন এবং পরে নিজ কন্যারূপা ছাগীর কামোেপভোগের জন্যই উপায়বিজ্ঞ সেই ব্রাহ্মণ ছাগের ছিন্ন অণ্ড আবার যুক্ত করে দিলেন। হে ভদ্রে, এই রূপে সেই ছাগ পুনরায় অণ্ড লাভ করে কূপতিত ছাগীর সাথে বহুকাল ভোগাসক্ত থেকেও অদ্যাবধি বিষয়ভোগে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। হে সুন্দরী, সেই ছাগের মত আমিও তোমার প্রণয়পাশে বদ্ধ হয়ে অতিশয় কাতর হয়ে পড়েছি, তোমার মায়ায় মোহিত হয়ে, আমার আত্মবিস্মৃত ঘটেছে।

হে ভদ্রে, এই পৃথিবীতে যত ধান্য, যব, স্বর্ণ, পশু ও রমণী রয়েছে, তাদের সমষ্টিও কামহাত পুরুষের মনের তৃপ্তি পূরণ করতে পারে না। কাম্য বিষয়সমূহের উপভোগের দ্বারা কখনও কামনার উপশম হয় না। কিন্তু ঘৃতের দ্বারা অগ্নি যেমন অত্যধিক প্রজ্জ্বলিত হয়, তেমনি ভোগের দ্বারা কামনার উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই হয়ে থাকে। যখন পুরুষ সকল প্রাণীতে অমঙ্গল ভাব (অর্থাৎ রাগ-দ্বেষাদি বৈষম্য) পরিত্যাগ করে এবং সর্বত্র সমদৃষ্টি হয়, তখন তার সকল দিকই সুখপ্রদ হয়ে ওঠে, বিষয়লোলুপ দুর্মতিজনের পক্ষে যা অগ্রহণীয়, জরাজীর্ণ ব্যক্তির নিকটও যা জীর্ণ হয় না এবং দুঃখরাশি বহন করে, সুখার্থী পুরুষ সেই তৃষ্ণা সত্বর ত্যাগ করবেন। আর স্ত্রীলোকের সন্নিধান সর্বপ্রকারেই ত্যাগ করা উচিত। মাতা, ভগিনী কিংবা কন্যার সঙ্গেও নির্জনে একাসনে (অর্থাৎ সংলগ্নভাবে) অবস্থান করবে না যেহেতু, প্রবল ইন্দ্রিয়বর্গ জ্ঞানী ব্যক্তিকেও আকর্ষণ করে থাকে, নিরন্তর বিষয়রাশি উপভোগ করতে করতে আমার সহস্র বৎসর পূর্ণ হয়েছে, তথাপি সর্বক্ষণ সেই সকল বিষয়ের প্রতিই আমার তৃষ্ণা রয়েছে। অতএব আমি সম্প্রতি এই বিষয়তৃষ্ণা পরিত্যাগ-পূর্বক পরম ব্রহ্মে মন সমাহিত করে, সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দরহিত ও নিরহংকার হয়ে মৃগদের সাথে বনে বিচরণ করব। হে প্রিয়ে, ঐহিক বা পারলৌকিক বিষয়ভোগের চিন্তা ও উপভোগে জীবের সংসার-বন্ধন ও আত্মার অধঃপতন হয়–তা জেনে ঐ সকল বিষয়কে অসৎ (অর্থাৎ অনিত্য) মনে করে যিনি উহার চিন্তা ও উপভোগ না করেন, তিনি যথার্থ সমদর্শী।

ভোগনিস্পৃহ নহুষতনয় যযাতি পত্নী দেবযানীকে এরূপ বলে, পুরুকে তার যৌবন প্রত্যার্পণ করে তার কাছ হতে নিজের জরা গ্রহণ করেছিলেন। এরপর তিনি দ্রুহ্যকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকের, যদুকে দক্ষিণ দিকের, তুর্বসুকে পশ্চিম দিকের এবং অনুকে উত্তর দিকের রাজা করলেন। তারপর তিনি অখিল ভূমণ্ডলের আধিপত্য ক্ষত্রিয়োত্তম প্রিয়তম পুত্র পুরুকে অভিষিক্ত করে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃগণকে তার অধীনে রেখে স্বয়ং বনে গমন করেছিলেন। পক্ষদ্বয় উৎপন্ন হলে যেমন পক্ষিশাবক অল্পকালের মধ্যেই দীর্ঘকালের আশ্রিত নিজ বাসস্থান পরিত্যাগ করে, তেমনি যযাতিও বহু বৎসর বিষয়-সেবায় পরিচালিত নিজ ছয়টি ইন্দ্রিয়কে ক্ষণকালের মধ্যেই উপেক্ষা করেছিলেন। তারপর প্রখ্যাত মহারাজ যযাতি বনমধ্যে আত্মানুভূতির দ্বারা সমস্ত সঙ্গ হতে বিমুক্ত হয়ে, গুণত্রয়জাত উপাধি পরিহার-পূর্বক পরম ব্রহ্ম বাসুদেব ভগবত গতি লাভ করেছিলেন।

যদিও পূর্বোক্ত গাথাটি পরিহাসের ন্যায় উক্ত হয়েছে, তথাপি স্ত্রী-পুরুষের প্রণয়ে প্রায়ই এরূপ গ্লানি ঘটে বলে, দেবযানী তা শ্রবণ করে, গাথাটি নিজের নিবৃত্তিমার্গ অবলম্বনের উৎসাহজনক মনে করেছিলেন। তারপর দেবযানী ঈশ্বরপরতন্ত্র জীবগণের সংসারে সুহৃদগণের সাথে মিলন পানীয়শালায় পথিকগণের মিলনের মত অনিত্য এবং ভগবান শ্রীহরিরই মায়া-রচিত মনে করে, স্বপ্নতুল্য জ্ঞানে সর্ব বিষয়ে আসক্তি পরিহার-পূর্বক ভগবান শ্রীকৃষ্ণেও চিত্ত সমর্পণ করতঃ নিজ দেহত্যাগ করেছিলেন।

“ভগবান আপনি বিধাতা, বাসুদেব, সর্বভূতের নিবাসভূমি, পরম শান্ত ও সর্বপেক্ষা বৃহৎ, আপনাকে নমস্কার করি।” (দেবযানী সবসময় এরূপ বলে ভগবানে মন সমাবেশিত করেছিলেন।) .

বিংশ অধ্যায়
পুরুবংশ–বর্ণন এবং দুষ্মন্ত ও ভরতের চরিত্র-কথন

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে ভরত, সম্প্রতি পুরুর বংশ অর্থাৎ যে বংশে তুমি জন্মগ্রহণ করেছ সেই বংশের বিবরণ বলছি শোন। এই পুরুবংশে অনেক রাজর্ষি ও ব্রহ্মর্ষি জন্মগ্রহণ করেছেন। পুরু হতে জন্মেজয়ের জন্ম হয়, তার পুত্র চিম্বান, চিম্বানের পুত্র প্রবীর, তার মনুস্য এবং মনুস্যর পুত্র চারুপদ। চারুপদের পুত্র সুদু, সুদুর পুত্র বহুগব, বহুগবের পুত্র সংযাতি, সংযাতির পুত্র অহংযাতি এবং অহংঘাতির পুত্র রৌদ্রাশ্ব। জগতের আত্মা মুখ্য প্রাণের বশীভূত দশটি ইন্দ্রিয়ের ন্যায় ঘৃতাচী নাম্নী অপ্সরার গর্ভে রৌদ্রাশ্বের দশটি পুত্র হয়েছিল।

তাঁদের নাম–ঋতেয়, কক্ষেয়ু, কুন্তিলেয়ু, কৃতেয়ু, জলেয়ু, সন্ততেয়ু, ধর্মেয়ু, সত্যেয়ু, ব্রতেয়ু এবং সর্বকনিষ্ঠ বনেয়ু। হে নৃপ, ঝতেয়ুর পুত্র রন্তিনাব রন্তিনাবের তিন পুত্র–সুমতি, ধ্রুব ও অপ্রতিরথ। অপ্রতিরথের পুত্রের নাম কন্থ। কন্থের পুত্রের নাম মেধাতিথি। মেধাতিথি হতে প্রস্কন্ন প্রভৃতি দ্বিজাতি পুত্রগণের জন্ম হয়। সুমতির পুত্র রেঙি এবং রেঙির পুত্র দুষ্মন্ত। (দুষ্যন্ত–পাঠান্তর)।

কোন এক সময় রাজা দুষ্মন্ত মৃগয়া করতে গিয়ে কন্বমুনির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। তৎকালে তিনি কয়েকজন মাত্র সৈন্যদ্বারা পরিবৃত ছিলেন। তিনি সেখানে লক্ষ্মীদেবীর ন্যায় নিজ কান্তির দ্বারা আশ্রমের শোভাবর্ধনকারী দেবমায়াতুল্য এক রমণীকে দেখে সেই সুন্দরীর সঙ্গে বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হলেন। তার দর্শনে তিনি অতিশয় হৃষ্ট হয়েছিলেন এবং তার পরিশ্রম দূর হয়েছিল। তিনি কামপীড়িত হয়ে হাসতে হাসতে মধুর বচনে জিজ্ঞাসা করেছিলেন–হে কমলপত্রাক্ষি, তুমি কে? কার কন্যা? এই নির্জন বনে কি করতে বাসনা করেছ? হে সুমধ্যমে, তুমি যে ক্ষত্রিয় কন্যা–এটা আমি নিশ্চিতই অনুভব করেছি, কারণ পৌরবগণের চিত্ত কখনও অধর্মে প্রবৃত্ত হয় না। (অর্থাৎ তুমি ক্ষত্রিয় কন্যা এবং আমার বিবাহযোগ্যা না হলে, আমার আর্যচিত্ত কখনও তোমার প্রতি আসক্ত হত না।)

শকুন্তলা বললেন–হে বীর, আমি বিশ্বামিত্রের কন্যা এবং মাতা মেনকা বনমধ্যে আমাকে ত্যাগ করেছিলেন। এ সকল বৃত্তান্ত ভগবান কন্ব অবগত আছেন। সম্প্রতি আমি আপনার কি সেবা করব, বলুন। হে পদ্মনেত্র, আপনি উপবেশন করুন, আমাদের পূজা গ্রহণ করুন। আশ্রমমাচিত আহার্য রূপে প্রচুর নীবার ধান্য রয়েছে, তার অন্ন ভোজন করুন এবং যদি ইচ্ছা হয় এখানে বাস করুন।

দুষ্মন্ত বললেন–হে সু, তুমি কুশিকবংশে জন্মগ্রহণ করেছ, তোমার এরূপ আচরণ উপযুক্ত বটে।

যেহেতু রাজকন্যাগণ স্বয়ং যোগ্য বরকে বরণ করে থাকে, তখন শকুন্তলা তার বাক্যে সম্মতি দান। করলে, দেশ-কালের বিধানজ্ঞ ঐ রাজা গান্ধর্ব বিধির দ্বারা শকুন্তলাকে যথাধর্ম বিবাহ করেছিলেন। তারপর অব্যর্থবীর্য রাজা দুষ্মন্ত মহিষী শকুন্তলার গর্ভাধান করে, পরদিন নিজপুরে চলে গেলেন। তারপর যথাকালে শকুন্তলা একটি সন্তান প্রসব করলেন। মহর্ষি কন্ব বনমধ্যেই সেই নবজাত কুমারের জাতকর্মাদি ক্রিয়াসমূহ সম্পন্ন করেছিলেন। ঐ বালক শৈশবেই নিজ বলে বনের সিংহকে আবদ্ধ করে খেলা করত।

কিছুকাল পরে শকুন্তলা ভগবান হরির আশীর্বাদে উৎপন্ন সেই দুরন্ত বিক্রমশালী পুত্রকে নিয়ে স্বামীর নিকট গমন করলেন। যখন রাজা দুষ্মন্ত সেই অনিন্দিত ভার্যাকে কোনক্রমেই গ্রহণ করলেন না, তখন শ্রবণকারী সর্বপ্রাণীর সমক্ষে আকাশ হতে অশরীরী বাণী আবির্ভূত হয়ে এরূপ বলেছিল–হে দুষ্মন্ত, মাতা ভস্ত্রা (অর্থাৎ চর্মপাত্রের ন্যায় আধারমাত্র), বস্তুতঃ পুত্র পিতারই হয়, যেহেতু পিতাই পুত্ররূপে উৎপন্ন হন। অতএব তুমি তোমার এই নিজ পুত্রকে ভরণ কর। আর শকুন্তলাকে অবজ্ঞা করো না। হে নরদেব, বংশরক্ষক পুত্ৰই পিতাকে যমালয় (নরক) হতে উদ্ধার করে। তুমিই এই গর্ভের উৎপাদক, শকুন্তলা সত্যই বলেছে। আকাশবাণী শোনার পর রাজা দুষ্মন্ত ভার্য্যা ও পুত্রকে গ্রহণ করেছিলেন।

কালান্তর পিতা দুষ্মন্ত গত হলে মহাযশস্বী সেই পুত্র ভরতই রাজ-চক্রবর্তী হয়েছিলেন। শ্রীহরির অংশজাত ভরতের মহিমা আজও পৃথিবীতে পরিগীত হয়। ভরতের দক্ষিণ হস্তে চক্রচিহ্ন এবং পদযুগলে পদ্মকোষের চিহ্ন (রেখা) ছিল। মহাসামর্থশালী ভরত মহা অভিষেক দ্বারা সম্রাট পদে অভিষিক্ত হয়ে, মমতার পুত্র দীর্ঘতমাকে পুরোহিত পদে বরণপূর্বক গঙ্গাতীরে যজ্ঞের উপযোগী পবিত্র স্থানে পঞ্চান্নটি অশ্বদ্বারা যজ্ঞ করেছিলেন। এইরূপে তিনি যমুনার তীরেও আটাত্তরটি যজ্ঞীয় অশ্বের দ্বারা যাগ করেছিলেন।

ঐ সকল যজ্ঞে তিনি ব্রাহ্মণদের প্রচুর ধন দান করেছিলেন। দুষ্মন্ত তনয় ভরতের যজ্ঞীয় অগ্নি উত্তম গুণযুক্ত দেশে স্থাপিত হয়েছিল, সেখানে অগ্নি-স্থাপনকালে সহস্র ব্রাহ্মণ ভরত কর্তৃক প্রদত্ত ধেনুগণকে ভাগ করে নিয়েছিলেন। প্রত্যেকে তের হাজার চুরাশিটি গাভী গ্রহণ করেছিলেন। দুষ্মন্তপুত্র ভরত তেত্রিশ শত অশ্বমেধ যজ্ঞ করে পৃথিবীস্থিত নরপতিগণকে বিস্ময়ান্বিত করে, দেবতাদের বৈভবকেও অতিক্রম করেছিলেন। তিনি শ্রীহরির অংশজাত বলে দেহত্যাগের পর দেবতাদের গুরু ভগবান শ্রীহরিকেই প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

মহারাজ ভরত কোন কর্মবিশেষে শ্বেতদন্ত কৃষ্ণবর্ণ বিশিষ্ট চতুর্দশ নিযুত শ্রেষ্ঠ হস্তী হিরণ্য পরিবৃত হয়ে দান করেছিলেন। ভরতের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নরপতিগণ ভরতের অনুষ্ঠিত মহৎ কর্মসমূহের অনুরূপ কর্ম করতে পারেন নাই। ভরত দিগবিজয়কালে কিরাত, হূণ, যবন, পৌণ্ড, কঙ্ক, খশ, শক, ম্লেচ্ছ এবং ব্রাহ্মণবিরোধী নরপতিদের বধ করেছিলেন।

পূর্বে যে সকল অসুর দেবতাদের পরাজিত করে পাতালপুরে বাস করেছিল, সেই সকল বলবান অসুর দেবরমণীগণকেও পাতালে নিয়ে গিয়েছিল। মহারাজ ভরত সেই অসুরদের জয় করে দেবরমণীগণকে পুনরায় স্বর্গে দেবগণের নিকট আনয়ন করেন। মহারাজ ভরত তার রাজত্বকালে স্বর্গ ও পৃথিবীর প্রজাগণের সকল অভিলাষ সর্বদা পূর্ণ করতেন। তিনি সাতাশ হাজার বছর রাজ্য শাসন করে পৃথিবীর সকল দিকে নিজের সৈন্য চালনা করেছিলেন। এইরূপে দীর্ঘকাল রাজ্যভোগের পর মহারাজ ভরত লোকপালগণ অপেক্ষাও সমধিক খ্যাতি সম্পন্ন এবং শৌর্যপ্রভাবে অলঙ্ঘনীয় রাজাদেশ সমস্তই মিথ্যা মনে করে সকল বিষয় হতে নিবৃত্ত হয়েছিলেন। তারপর তিনি বনে গিয়ে ভক্তির দ্বারা ভগবানকে লাভ করেছিলেন।

হে মহারাজ, ভরতের বিদর্ভদেশীয় তিনটি পত্নী ছিলেন। তাঁরা মনোমত হলেও রাজা ভরত তাদের পুত্রগণকে নিজের সদৃশ নয় বলায় তারা অনুমান করলেন নিজেদের সতীত্বের প্রতি ভরতের সন্দেহ হয়েছে, অতএব তিনি আমাদের ত্যাগ করতে পারেন–এই ভয়ে তারা জন্মের পর সকল সন্তানকেই হত্যা করেছিলেন। এভাবে তারা বংশ রক্ষার্থে ব্যর্থ হলে বংশরক্ষার জন্য বায়ুগণের ও সোমের যাগ করেছিলেন মহারাজ ভরত, তাতে মরুদগণ প্রসন্ন হয়ে তার হস্তে ভরদ্বাজ নামক পুত্র সমর্পণ করেন। ভরদ্বাজের জন্ম ও সমর্পণ বৃত্তান্ত বলেছেন–ভ্রাতা উতথ্যের পত্নী মমতার গর্ভাবস্থায় একদিন বৃহস্পতি গোপনে তার সহিত রতিকর্মে প্রবৃত্ত হলে, গর্ভস্থ সন্তান এই অন্যায় কর্মে প্রবৃত্ত হতে নিষেধ করায় তিনি তাকে “অন্ধ হও”–বলে শাপ দিয়ে বীর্য সেচন করেন। এরপর গর্ভস্থ সন্তান পায়ের গুল্ফ দেশের অধোভাগ দ্বারা ঐ বীর্যকে বাহির করে দিলে, তৎক্ষণাৎ ঐ বীর্য হতে এক পুত্র উৎপন্ন হয়।

মমতা বৃহস্পতির বীর্যজাত এই পুত্রকে পরিত্যাগের ইচ্ছা করলে, দেবগণ ঐ পুত্রের নামের অর্থ নিরূপণাত্মক একটি শ্লোক উচ্চারণ করেছিলেন। তা এইরপে–মমতা সন্তান ত্যাগে উদ্যত হলে বৃহস্পতি বলেছিলেন-হে মূঢ়, এই পুত্র ‘ব্বাজ’ অর্থাৎ তোমার স্বামীর ক্ষেত্রে আমা হতে উৎপন্ন বলে উভয়েরই হয়, অতএব তুমি ইহার ভরণ কর। এতে মমতা উত্তর করেন–তুমিও ইহার পোষণ কর।

আমাদের দুজন হতে এ বালক উৎপন্ন হয়েছে, আমি একা কেন পোষণ করব–এ বলে তারা দুজন বিবাদ করতে করতে বালককে পরিত্যাগ করে যান, এই কারণে এই পুত্রের নাম “ভরদ্বাজ” হয়েছে। দেবগণ এরূপ বলতে আরম্ভ করলে মমতা, সেই পুত্রকে ব্যর্থ মনে পরিত্যাগ করেন এবং মরুদ্গণ তাকে পালন করে, পরে ভরতের বংশ ব্যর্থ হয় দেখে পুত্ররূপে ভরতের হস্তে অর্পণ করেছিলেন।

.

একবিংশ অধ্যায়
ভরতবংশ বৰ্ণন এবং রন্তিদেবের চরিত্র কথন

শ্ৰী শুকদেব বললেন–হে রাজন, ভরতের বংশ বিতথ (অর্থাৎ ব্যর্থ হলে ভরতের প্রতি মরুদগণ কর্তৃক ভরদ্বাজ প্রদত্ত হয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ হলেও দত্তক পুত্র বলে ভরদ্বাজের নাম বিতথ হয়েছিল। বিতথের পুত্র মনু, তা হতে বৃহৎক্ষত্র, জয়, মহাবীর্য, নর এবং গর্গ–এই পাঁচ পুত্র জন্মে। তার মধ্যে নরের তনয় সংস্কৃতি। হে পাণ্ডুনন্দন, সংস্কৃতির পুত্র গুরু ও রন্তিদেব। রন্তিদেবের মহিমা ইহলোক ও পরলোকে সর্বদা কীর্তিত হয়ে থাকে। উদ্যম ব্যতীতই আকাশ হতে যেন ভোগ্য বস্তুসকল তার নিকট উপস্থিত হত। তিনি যখন যা পেতেন, তাই দান করতেন বলে, ক্ষুধার্ত অবস্থায় সপরিবারে অবসাদগ্রস্ত থাকতেন।

তিনি নিষ্কিঞ্চন ও ধীর পুরুষ ছিলেন। এক সময় তিনি জলমাত্রও পান না করে আটচল্লিশ দিন অতিবাহিত করার পর প্রাতে তার নিকট পায়েস ও পানীয় জল উপস্থিত হল। তৎকালে তাঁর পরিবারবর্গ অতিশয় কষ্টভোগ করছিলেন এবং ক্ষুধা তৃষ্ণায় তার শরীর কাঁপছিল। এ অবস্থায় তিনি ঐ সকল ভোজ্যবস্তু ভোজন করতে ইচ্ছুক হলে, এক ব্রাহ্মণ অতিথিরূপে উপস্থিত হলেন। তখন রন্তিদেব সর্বভূতে শ্রীহরির জ্ঞান করে, শ্রদ্ধাসহকারে সমাদরপূর্বক সেই অন্ন অতিথি ব্রাহ্মণকে ভাগ করে : দিলেন। সে ব্রাহ্মণ তা ভোজন করে চলে গেলেন।

এরপর অবশিষ্ট অন্ন পরিবারের জন্য ভাগ করে, নিজে কিঞ্চিত আহারের উদ্যোগ করছেন, এমন সময় এক শূদ্র অতিথিরূপে উপস্থিত হলে, শ্রীহরির স্মরণ করে সেই শূদ্রকেও অন্ন ভাগ করে দিলেন। সেই শূদ্র ভোজন করে চলে গেলে, কুকুরগণের সাথে এক অতিথি এসে উপস্থিত হয়ে বলল–হে রাজন, আমি এই কুকুরগণের সহিত ক্ষুধায় কাতর হয়েছি, আমাকে অন্ন দান করুন। মহারাজ রন্তিদেব তখন যা অবশিষ্ট ছিল, সে সমস্তই সম্মান ও সাদরে কুকুরগণ ও তাদের পালককে দান করে নমস্কার করলেন। এরপর রন্তিদেব একজনের মাত্র তৃপ্তির যোগ্য যে জল অবশিষ্ট ছিল, তাই পান করতে উদ্যোগী হলে, এক চণ্ডাল এসে বলল–হে মহারাজ, এই অশুভ ব্যক্তিকে জল দান করুন। তখন রন্তিদেব সেই চণ্ডালের অতি কষ্টে উচ্চারিত করুণ বাক্য শ্রবণ করে, কৃপাবশতঃ অতিকাতর হয়ে এরূপ মধুর বাক্য বলেছিলেন।

আমি পরমেশ্বরের নিকট অষ্টৈশ্বর্য যুক্ত পরমগতি অথবা নির্বাণ মুক্তিও কামনা করি না, কিন্তু আমি জগতের সকল প্রাণীর অন্তরে থেকে তাদের সকল প্রকার দুঃখ নিজেই ভোগ করতে ইচ্ছা করছি, যাতে সকল দেহীর দুঃখ দূরীভূত হয়। এ ব্যক্তি অতি দীন, জীবনধারণের বাসনা করছে, এর জীবন রক্ষার জল অর্পণ করলেই আমার ক্ষুধা, তৃষ্ণা, পরিশ্রম, গাত্রঘূর্ণন, দৈন্য, ক্লান্তি, শোক, বিষাদ ও মোহ–সমস্তই নিবৃত্ত হবে। এইরূপ বলে স্বভাবতঃ দয়ালু মহারাজ রন্তিদেব স্বয়ং পিপাসায় ম্রিয়মান হয়েও সেই পুষ্কশকে (চণ্ডালকে) নিজের পানীয় জল প্রদান করেছিলেন।

বিভিন্ন ফলপ্রার্থী ব্যক্তিগণের ফলদাতা ত্রিভুবনের অধিপতি ব্রহ্মাদি দেবগণই রন্তিদেবের ধৈর্য পরীক্ষার জন্য ভগবান বিষ্ণুর মায়াবলে প্রথমতঃ শূদ্রাদিরূপে উপস্থিত হয়ে, পরে তাঁকে নিজ নিজ মূর্তি দর্শন করিয়েছিলেন। কিন্তু মহারাজ রন্তিদেব সেই সকল দেবতাকে নমস্কার করে, নিঃসঙ্গ ও নিস্পৃহ হয়ে কেবল বাসুদেবে চিত্ত সমর্পণ করেছিলেন। ঐ সকল দেবতাদের নিকট কিছুই প্রার্থনা করেননি। হে মহারাজ, রন্তিদেব ঈশ্বরাতিরিক্ত অন্য ফল আকাঙ্ক্ষা না করে মনকে ঈশ্বরের চিন্তায় নিযুক্ত করলে, ত্রিগুণাত্মিকা মায়া তাঁর নিকট লয়প্রাপ্ত হয়েছিলেন। রন্তিদেবের অনুগত, ব্যক্তিগণ তার সঙ্গপ্রভাবে সকলেই ভগবৎপরায়ণ যোগী হয়েছিলেন।

মনুর অপর পুত্র গর্গ হতে শিনির জন্ম হয়। তাঁর পুত্র গার্গ। ইনি ক্ষত্রিয় হতে ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন। মনুর অপর পুত্র মহাবীর্য হতে পুরিতক্ষয় উৎপন্ন হয় এবং পুরিতক্ষয় হতে এয্যারুনি, কবি ও পুস্করারুণির জন্ম হয়। এয্যারুনি প্রভৃতি তিনজন ক্ষত্রবংশে ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। বৃহৎক্ষেত্রের পুত্র হস্তী, যিনি হস্তিনাপুর নির্মাণ করেন। অজমীঢ়, দ্বিমীঢ় ও পুরুমীঢ়–এই তিনজন হস্তীর পুত্র। অজমীঢ়ের বংশজাত প্রিয়মেধ প্রভৃতি ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন। ঐ অজমীঢ় হতে বৃহদিষু নামে অন্য এক পুত্রও জন্মে, তার পুত্র বৃহদ্ধ, বৃহদ্ধনুর সন্তান বৃহৎকায়, তার তনয় জয়দ্রথ। জয়দ্রথের পুত্র বিশদ, তার পুত্র সেনজিৎ এবং সেনজিতের চারপুত্র-রুচিরাশ্ব, দৃঢ়হনু, কাশ্য ও বৎস। রুচিরাশ্বের পুত্র পার, তাঁর পুত্র পৃথুসেন। পারের অপর পুত্রের নাম নীপ। তার একশত পুত্র হয়েছিল। এই নীপই শুককন্যা কৃত্বীর গর্ভে ব্রহ্মদত্তকে উৎপন্ন করেন। ব্রহ্মদত্ত যোগী ছিলেন এবং তিনি ভার্য্যা সরস্বতীর গর্ভে বিম্বকসেন নামে এক পুত্র উৎপাদন করেছিলেন।

বিম্বকসেন জৈগীষব্যের উপদেশ যোগশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন। ঐ বিম্বকসেন হতে উদকসেনের জন্ম হয়। উদকসেনের পুত্র ভল্লাট–ঐ সকল রাজা বৃহদিষুর বংশোদ্ভব। দ্বিমীঢ়ের পুত্রের নাম যবীনর, তাঁর পুত্র কৃতীমান, কৃতিমানের পুত্র সত্যধৃতি, তাঁর পুত্র দৃঢ়নেমি এবং দৃঢ়নেমির পুত্র সুপার্শ্ব। সুপার্শ্বের পুত্র সুমতি, তাঁর পুত্র সন্নতিমান, সন্নতিমানের পুত্র কৃতী, ইনি হিরণ্যাবের নিকট হতে যোগোপদেশ লাভ করে প্রাচ্য সামদেবের ছয়টি সংহিতা বিভাগ–পূর্বক অধ্যাপক করেছিলেন।

কৃতীয় পুত্ৰ উগ্ৰায়ুধ নীপ, তার পুত্র সুবীর এবং সুবীরের পুত্র রিপুঞ্জয়। রিপুঞ্জয়ের পুত্র বহুরথ। হস্তীর পুত্র পুরমীঢ় নিঃসন্তান ছিলেন। অজমীঢ়ের বংশে প্রিয়মেধাদি ব্রাহ্মণ এবং বৃহদিষ্ণু প্রভৃতি ক্ষত্রিয় উৎপন্ন হয়েছিলেন। ব্রহ্মণে অজমীঢ়ের অপর বংশ বলছেন। হে মহারাজ, অজমীঢ়ের নলিনী নাম্নী পত্নীর গর্ভে নীল নামক পুত্র হয়, নীলের পুত্র শান্তি। শান্তির পুত্র সুশান্তি। তাঁর পুত্র পুরুজ, তাঁর পুত্র অর্ক এবং অর্কের পুত্র ভাশ্ব। ভাশ্বের মুদগল প্রভৃতি পাঁচ পুত্র জন্মেছিল। তাদের নাম–মুদগল, যবীনর, বৃহবিশ্ব, কাস্পিল্য ও সঞ্চয়। তৎকালে ভৰ্ম্যাশ্ব বলেছিলেন–আমার এই পাঁচ পুত্র পাঁচটি দেশ রক্ষা করতে সমর্থ। এজন্য তাদের “পঞ্চাল”–এই সংজ্ঞা হয়েছিল। মুদল হতে মৌদগল্য নামক ব্রাহ্মণ গোত্রের প্রবর্তন হয়।

ভর্ম্যাশ্ব পুত্ৰ মুদগল হতে যমজ সন্তান হয়। তার মধ্যে দিবোদাস পুরুষ এবং অহল্যা কন্যা। অহল্যার গর্ভে গৌতমের ঔরসে শতানন্দের জন্ম হয়। শতানন্দের পুত্র ধনুর্বেদ-বিশারদ সত্যধৃতি এবং সত্যধৃতির পুত্র শরদ্বা। একসময় উর্বশীর দর্শণে শরগুচ্ছের উপর শরদ্বানের বীর্য পতিত হলে, তা হতে শুভলক্ষণযুক্ত যমজ সন্তানের উৎপত্তি হয়। রাজা শান্তনু মৃগয়া করতে গিয়ে তাদের দেখতে পান এবং কৃপাপরবশ হয়ে তাদের নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে পুত্রটির নাম কৃপ এবং কন্যাটির নাম কৃপী। এই কৃপীই দ্রোণাচার্যের পত্নী হয়েছিলেন।

.

দ্বাবিংশ অধ্যায়
দিবোদাসাদির বংশ কথন এবং ঋক্ষবংশে পাণ্ডবাদি উৎপত্তি বর্ণন

শ্ৰীশুকদেব বললেন, হে মহারাজ–দিববাদাসের পুত্রের নাম মিত্ৰায়ু (মিত্রেয়ু–পাঠান্তর), তার পুত্র চব্যন, তাঁর পুত্র সুদাম, সুদামের পুত্র সহদেব। সহদেবের পুত্র সোমক, এই সোমক জন্তু নামক পুত্রের জনক। সোমকের একশত পুত্রের মধ্যে জন্তু জ্যেষ্ঠ এবং পৃষত কনিষ্ঠ। এই পৃষত হতে সর্বসম্পযুক্ত হতে দ্রুপদের জন্ম হয়েছিল। দ্রুপদ হতে দ্রৌপদী নামে এক কন্যা এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি পুত্রগণের জন্ম হয়। এরা ভৰ্য্যাশ্বের বংশধর এবং পাঞ্চাল সংজ্ঞায় পরিচিত। হে রাজন, এরপর অজমীঢ়ের বংশান্তর বলছি, শোন।

আজমীঢ়ের অন্য তনয় যে ঋক্ষ, তার পুত্র সংবরণ, ঐ সংবরণ হতে সূর্য-তনয়া তপতীর গর্ভে কুরুক্ষেত্র পতি কুরু জন্মগ্রহণ করেন। সেই কুরুর চার সন্তান–পরীক্ষিৎ, সুধনু, জন্তু ও নিষধ। তার মধ্যে সুধনুর পুত্র সুহোত্র, তাঁর পুত্র চ্যবন এবং চ্যবনের সন্তান কৃতী। কৃতীর পুত্র উপরিচর বসু, তা হতে বৃহদ্রথ প্রভৃতির উৎপত্তি হয়। অন্যান্য পুত্রদের নাম-কুশাম্বস, মৎস্য, প্রত্যগ্র এবং চেদিপ ইত্যাদি তারা সকলেই চেদিপ অর্থাৎ চেদিদের রাজা ছিলেন।

বৃহদ্রথ হতে কুশগ্রের জন্ম হয়, তার তনয় ঋষভ, তার পুত্র সত্যহিত, সত্যহিতের পুত্র পুষ্পবান্ এবং তাঁর পুত্র জহু। বৃহদ্রথের অন্য ভার্যার গর্ভে দেহের দুটি খণ্ড উৎপন্ন হলে মাতা তাদের বাইরে ফেলে দেন। পরে জরা নামক রাক্ষসী তা দেখতে পেয়ে খেলার ছলে ঐ দুই খণ্ড সংযুক্ত করে, “জীবিত হও, জীবিত হও”–এরূপ বললে ঐ বালক সর্বাবয়ব সম্পন্ন হয়ে জরাসন্ধ নাম প্রাপ্ত হয়েছিল। ঐ জরাসন্ধের পুত্র সহদেব, তার পুত্র সোমাপি, তাঁর হতে এবার জন্ম হয়। কুরুপুত্র পরীক্ষিৎ নিঃসন্তান ছিলেন। জহুর পুত্রের নাম সুরথ। সুরথের পুত্র বিদূরথ, তাঁর পুত্র সার্বভৌম, তার পুত্র জয়সেন, জয়সেনের সন্তান রাখিক, তা হতে অযুতায়ুর উৎপত্তি হয়। অযুতায়ুর পুত্র আক্রোধন, তার পুত্র দেবাতিথি। তাঁর পুত্র ঋক্ষ, তার পুত্র দিলীপ এবং দিলীপের পুত্র প্রতীপ। ঐ প্রতীপের তিন পুত্র– দেবাপি, শান্তনু এবং বাহ্লীক। তার মধ্যে দেবাপি পিতৃরাজ্য পরিত্যাগ করে অরণ্যে গমন করেছিলেন। অতএব মধ্যম পুত্র শান্তনু রাজা হন। তার পূর্ব জন্মের নাম ছিল মহাভিষ। তিনি জরাগ্রস্ত যাকে দুই হাত দিয়ে স্পর্শ করতেন, সে সকল ব্যক্তিই পুনরায় যৌবনপ্রাপ্ত হত এবং উৎকৃষ্ট শান্তি লাভ করত। এই কর্মের দ্বারা তিনি শান্তনু নামে প্রসিদ্ধ হন। এক সময় তার রাজ্যে দ্বাদশ বৎসর বৃষ্টি না হওয়ায় ব্রাহ্মণগণ তাকে বললেন–হে মহারাজ, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অবিবাহিত থাকতে কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিবাহ করলে, সে যেমন পরিবেত্তা হয়ে দোষভাগী হয়, তেমনি। তুমি জ্যেষ্ঠভ্রাতার পূর্বে স্বয়ং রাজ্য ভোগ করায় পরিবেত্তা হয়েছ। অতএব তুমি পুর ও রাষ্ট্রের কল্যাণ বৃদ্ধির জন্য সত্বর জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে রাজ্য দান কর। ব্রাহ্মণগণ এরূপ বললে, শান্তনু জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দেবাপিকে রাজ্য গ্রহণের জন্য বহু অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু এর পূর্বেই শান্তনুর মন্ত্রী অশ্ববার (অথবা অশ্মরাত) দেবাপির নিকট কয়েকজন ব্রাহ্মণ পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা দেবাপিকে পাষণ্ডমত গ্রহণ করিয়ে বেদমার্গ হতে বিচ্যুত করায় দেবাপি বৈদিক মতের নিন্দাবাদ করেন, যার জন্য তার রাজত্ব গ্রহণের ইচ্ছা রইল না। বেদের নিন্দা করায় পাতিত্যদোষে দেবাপি রাজ্য গ্রহণের অযোগ্য হওয়ায়, শান্তনুর রাজ্যগ্রহণের কোন দোষ না থাকায় দেবগণ তুষ্ট হয়ে রাজ্যমধ্যে জলবর্ষণ করেছিলেন। সেই দেবাপি যোগ অবলম্বনপূর্বক এখনও কলাপগ্রামে বাস করছেন। কলিকালে চন্দ্রবংশ বিলুপ্ত হলে এই দেবাপি সত্যযুগের প্রারম্ভে পুনরায় ঐ বংশের প্রবর্তন করবেন। বাত্নীক হতে সোমদত্ত, সোমদত্ত হতে ভূরি এবং ভূরি হতে ভূরিশ্রবা ও শল–নামেই দুই পুত্রের জন্ম হয়েছিল।

শান্তনু হতে গঙ্গার গর্ভে জিতেন্দ্রিয় ভীষ্মদেবের জন্ম হয়। ইনি সকল ধর্মজ্ঞগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, পরম ভাগবত ও বিদ্বান ছিলেন। এই ভীষ্ম বীরসমূহের অগ্রণী ছিলেন এবং সংগ্রামে পরশুরামেরও সন্তোষ উৎপাদন করেছিলেন। দাসরাজ্যের কন্যা সত্যবতীর গর্ভে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে রাজা শান্তনুর দুই পুত্র হয়। উপরিচর বসুর বীর্যে মৎস্যগর্ভে এক কন্যা জন্মেছিল, দাসেরা (ধীবরগণ) তাকে প্রতিপালন করে, এজন্য দাসকন্যা বলে প্রসিদ্ধ, বস্তুতঃ তার নাম সত্যবতী।

জ্যেষ্ঠ চিত্রাঙ্গদ, চিত্রাঙ্গদ-নামক গন্ধর্ব কর্তৃক নিহত হন। এই সত্যবতীর গর্ভে (বিবাহের পূর্বে) মহর্ষি পরাশর হতে সাক্ষাৎ ভগবান হরির অংশে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন মুনি অবতীর্ণ হন। তিনি বেদ-বিভাগ করে বেদের রক্ষা করেন এবং তাঁর নিকট হতে আমি এই শ্রীমদ্ভাগবত অধ্যয়ন করি। সেই ভগবান বাদরায়ণ (কৃষ্ণদ্বৈপায়ন) নিজ শিষ্য পৈল প্রভৃতিকে পরিত্যাগ করে শান্তস্বভাব নিজ পুত্র আমাকে পরমগুহ্য এই ভাগবতশাস্ত্রের উপদেশ করেছিলেন।

যা হোক, বিচিত্রবীর্য কাশীরাজের দুই কন্যা অম্বিকা এবং অম্বালিকার পানিগ্রহণ করেন। মহাবল ভীষ্ম, স্বয়ম্বরসভা হতে তাঁদের বাহুবলে হরণ করেন। ঐ দুই পত্নীতে বিচিত্রবীর্য অত্যন্ত আসক্ত হওয়ায় অল্পকালের মধ্যে যক্ষারোগে মৃত্যুমুখে পতিত হন। মাতার আজ্ঞায় ভগবান বাদরায়ণ নিঃসন্তান কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে অর্থাৎ অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র এবং অম্বালিকার গর্ভে পাণ্ডু এবং দাসীর গর্ভে বিদুরের জন্মদান করেন। হে মহারাজ, ভার্য্যা গান্ধারীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্র জন্মগ্রহণ করেন, তার মধ্যে দুর্যোধন জ্যেষ্ঠ। এছাড়া দুঃশলা নামে একটি কন্যারও জন্ম হয়।

মৃগরূপে মৈথুনরত এক মুনিকে মৃগয়াকালে বধ করায় তাঁর অভিশাপে পাণ্ডু মৈথুনক্রিয়া হতে নিবৃত্ত হওয়ায় তার প্রথমা পত্নী কুন্তীর গর্ভে ধর্ম, বায়ু ও ইন্দ্রের অনুগ্রহে যথাক্রমে যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন এবং অপর পত্নী মাদ্রীর গর্ভে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের অনুগ্রহে নকুল ও সহদেবের জন্ম হয়। ঐ পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী দ্রৌপদী। তার গর্ভে যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডব হতে পাঁচটি সন্তান হয়েছিল, তারা তোমার পিতৃব্য। সেই পাঁচ পুত্রের মধ্যে যুধিষ্ঠিরের পুত্র প্রতিবিন্ধ্য, ভীমসেনের পুত্র শ্রুতসেন, অর্জুনের পুত্র শ্রুতকীর্তি, নকুলের পুত্র শতানীক, এবং সহদেবের পুত্র শ্রুতকর্মা।

হে মহারাজ, এছাড়াও যুধিষ্ঠির হতে পৌরবীর গর্ভে দেবক এবং ভীমসেন হতে হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচের জন্ম হয়। ভীমসেনের অপর ভার্য্যা কালীর গর্ভে সর্বগত নামে এক পুত্রের জন্ম হয়েছিল। সহদেব হতে পর্বতকন্যা বিজয়ার গর্ভে সুহোত্রের জন্ম হয়। নকুল নিজ অপর পত্নী করেনুমতির গর্ভে নরমিত্র নামক পুত্র উৎপাদন করেন। অর্জুনও নিজ অপর পত্নী নাগকন্যা উলুপীর গর্ভে ইরাবন্ এবং অপর এক পত্নী মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার গর্ভে বভ্রুবাহনের জন্মদান করেন। (মণিপুররাজ অর্জুনের সহিত কন্যার বিবাহকালে বলেছিলেন–এই কন্যার পুত্র আমার হবে, এই জন্য) কন্যার পুত্র বভ্রুবাহন মণিপুররাজেরই পুত্ররূপে গণ্য হয়েছিলেন। অর্জুনের সুভদ্রা নামে আর এক ভার্য্যা ছিল, তা হতে তোমার পিতা অভিমুন্য উৎপন্ন হন, তিনি সমস্ত অতিরথ বীরের জয়কারী ও মহাবীর ছিলেন। তা হতে রাজকন্যা উত্তরার গর্ভে তোমার জন্ম হয়। রাজন, অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র তেজে কুরুবংশ পরিক্ষীণ হতে হয়েছিল, তুমিও তাতে বিনষ্ট হওয়ায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই প্রভাবে মৃত্যুর মুখ হতে জীবন সহিত তুমি মুক্ত হয়েছ।

হে বৎস, সম্প্রতি তোমার পুত্ররূপে মহাবীর এই জনমেজয় শ্রুতসেন, ভীমসেন ও উগ্রসেন বর্তমান রয়েছে। এর মধ্যে জনমেজয় তক্ষক হতে তোমার মৃত্যুর বিবরণ অবগত হয়ে রোষবশতঃ সর্পযজ্ঞের কাবষেয় তুরকে পুরোহিত পদে বরণ পূর্বক অশ্বমেধ ও অন্যান্য বহু যজ্ঞ করবেন। (এরপর ভবিষ্যৎ রাজবৃত্তান্ত বলছেন)

হে মহারাজ, জনমেজয়ের পুত্র শতানীক যাজ্ঞবন্ধ্যের নিকট হতে ঋগাদি ত্রয়ী বেদ পাঠ করে যাগাদি–জ্ঞান, কৃপাচার্যের নিকট হতে অস্ত্রজ্ঞান এবং শৌনক হতে কর্মবিদ্যা লাভ করবেন। শতানীকের পুত্র সহস্রানীক, তা হতে অসীমকৃষ্ণ, এবং তা হতে নেমিচক্রের জন্ম হবে। এঁর রাজত্বকালে হস্তিনাপুরকে গঙ্গানদী গ্রাস করলে, তিনি কৌশাম্বী নগরে বাস করবেন। ঐ নেমিচক্রের উপ্ত নামে সন্তান হবে, তার পুত্র চিত্ররথ,তা হতে শুচিরথ জন্মিবেন। শুচিরথের পুত্র বৃষ্টিমান, তাঁর পুত্র সুষেন নামে মহীপতি হবেন। সুষেনের সুনীথ নামে তনয় হবে। তার পুত্র নৃচক্ষু। নৃচক্ষু হতে সুখীনলের জন্ম হবে। সুখীনল হতে পরিপ্লব, পরিপ্লব হতে সুনয়, সুনয় হতে মেধাবী, মেধাবী হতে নৃপঞ্জয়, তা হতে দূর্ব এবং দূর্ব হতে তিমি নামক পুত্রের জন্ম হবে। শতানীকের পুত্র দুর্দমন, তার অপত্য মহীনর। মহীনরের তনয় দণ্ডপানি, তাঁর সন্তান নিমি, সেই নিমি হতে ক্ষেমক উৎপন্ন হবেন।

হে মহারাজ, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়–জাতির উৎপত্তি–ক্ষেত্র এ দেবর্ষিগণের সমাদর প্রাপ্ত এই বংশ রাজা ক্ষেমকের পরেই কলিযুগে অবসান প্রাপ্ত হবে।

অনন্তর মগধবংশীয় যে সকল নরপতি হবেন, তাদের বিবরণ বলছি। বৃহদ্রথ তনয় জরাসন্ধের যে পুত্র হবে, তাঁর পুত্র মাজারি। (এই মার্জারির অপর নাম পূর্বোক্ত সোমাপি) সেই মার্জারি হতে শ্রুতবা জন্মগ্রহণ করবেন। তার পুত্র অযুতায়ু এবং তাঁর হতে নিরমিত্রের জন্ম হবে। নিরামিত্রের পুত্র সুনক্ষত্র, তাঁর হতে বৃহৎসেন, তাঁর হতে কর্মজিৎ, তাঁর হতে সুতঞ্জয়, তাঁর হতে বিপ্র এবং বিপ্র হতে শুচি জন্মগ্রহণ করবেন। শুচি হতে ক্ষেম তাঁর হতে সুব্রত হতে ধর্মসূত্র, সুব্রত হতে সম, সম হতে দুমৎসেন (দৃঢ়সেন) তাঁর হতে সুমতি এবং সুমতি হতে সুবলের জন্ম হবে। সুবলের পুত্র সুনীথ, তার সন্তান সত্যজিৎ, এবং তাঁর পুত্র বিশ্বজিৎ এবং বিশ্বজিৎ হতে রাজা রিপুঞ্জয় জন্মগ্রহণ করবেন। হে মহারাজ বৃহদ্রথের বংশধর এই নরপতিগণ সহস্র বৎসর রাজত্ব করবেন। এর পরবর্তী রাজাগণের কথা দ্বাদশ স্কন্ধে বলা হবে।

.

ত্রয়োবিংশ অধ্যায়
অনু, দ্রুহ্য, তুবসু প্রভৃতির বংশ কথন

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, যযাতি–পুত্র অনুর তিন পুত্রসভানর, চক্ষুও পরেক্ষু। সভানর হতে কালনর এবং তার পুত্র সৃঞ্জয়, সৃঞ্জয়ের পুত্র জনমেজয়, তার পুত্র মহাশীল (মহাশাল পাঠান্তর), তাঁর পুত্র মহামনা এবং মহামনার দুই পুত্র–উশীনর ও তিতিক্ষু। তার মধ্যে উশীনরের চার পুত্র–শিবি, বর, কৃমি ও দক্ষ। শিবি হতে বৃষাদর্ভ, সুবীর, মদ্র ও কেকয়–এই চার পুত্রের জন্ম হয়। তিতিক্ষুর পুত্র রুদ্ৰথ, তার পুত্র হোম, তার পুত্র সুতপা এবং সুতপা হতে বলি উৎপন্ন হন।

বলির ক্ষেত্রে (অর্থাৎ তার পত্নীর গর্ভে) দীর্ঘতমা হতে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, শুভ্র, পুন্ড্র ও ওড্র এই ছয়জন প্রত্যেকেই যথাক্রমে পূর্বদিক স্থিত ছয়টি দেশকে নিজ নিজ নামে পরিচিত করেন। (অর্থাৎ ঐ ছয়টি দেশের অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, শুভ্র, পুন্ড্র ও ওড্র (উত্‌কল)–এই সকল নামকরণ করেছিলেন। অঙ্গ হতে খলপান এবং খলপান হতে দিবিরথের জন্ম হয়। দিবিরথের পুত্র ধর্মরথ, তার পুত্র চিত্ররথ নিঃসন্তান ছিলেন এবং তিনি রোমপদ নামে বিখ্যাত হন। রোমপদের সখা রাজা দশরথ তাকে দত্তকরূপে নিজ কন্যা শান্তাকে দান করেছিলেন। ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি এই শান্তাকে বিবাহ করেন। একসময় রোমপাদের রাজ্যে অনাবৃষ্টি হলে (ঋষ্যশৃঙ্গ এখানে এলে বৃষ্টি হবে– ব্রাহ্মণগণ এরূপ নিশ্চয় করে বললে) বারাঙ্গণাগণ নৃত্য, গীত, বাদ্য বিবিধ বিলাস, আলিঙ্গন ও নানারূপে সকার দ্বারা মোহিত করে, (বিভাণ্ডুক ঋষি হতে) হরিণীর গর্ভে উৎপন্ন মুনি ঋষ্যশৃঙ্গকে তপোবন হতে রাজার পুরীতে আনয়ন করলে রাজ্যে বৃষ্টিপাত হয়।

তারপর তিনি নিঃসন্তান রাজার সন্তানলাভের জন্য মরুদযজ্ঞ করে রাজাকে সন্তান দান করেন। রাজা দশরথও এই ঋষ্যশৃঙ্গ কর্তৃক অনুষ্ঠিত পুত্রযাগের ফলেই চারপুত্র লাভ করেছিলেন। রোমপাদের পুত্র চতুরঙ্গ তার পুত্র পৃথুলাক্ষ। পৃথুলাক্ষ হতে বৃহদ্রথ, বৃহকর্মা ও বৃহদ্ভানু–এই তিন পুত্রের জন্ম হয়। তার মধ্যে বৃহদ্রথের পুত্র বৃহমনা এবং তার পুত্র জয়দ্রথ। জয়দ্রথের ভার্যা সম্ভূতির গর্ভে বিজয়ের জন্ম হয়। বিজয়ের পুত্র ধৃতি,তার পুত্র সকর্ম এবং তাঁর পুত্র অধিরথ।

নিঃসন্তান অধিরথ একসময় গঙ্গাতীরে ক্রীড়া করতে করতে, কন্যা অবস্থায় কুন্তীর গর্ভজাত এবং তৎকর্তৃক পরিত্যক্ত পেটিকার মধ্যে অবস্থিত শিশুকে প্রাপ্ত হয়ে নিজ সন্তানরূপে পালন করেছিলেন। হে মহারাজ, সেই পালিত পুত্রের নাম কর্ণ এবং তার পুত্র বৃষসেন। যযাতি-পুত্র দ্রুহ্যর তনয় বভ্রু এবং তার পুত্র সেতু।

সেতুর পুত্র আরদ্ধ তাঁর পুত্র গান্ধার, গান্ধারের পুত্র ধৃত, তাঁর পুত্র দুর্মদ, দুর্মদের পুত্র প্রচেতা। ঐ প্রচেতার একশত পুত্র উত্তরদিকে অবস্থিত হয়ে ম্লেচ্ছগণের অধিপতি হয়েছিলেন। তুসুর সন্তান বহ্নি, বহ্নির পুত্র ভর্গ এবং ভর্গের পুত্র ভানুমান্। ভানুমানের পুত্র ত্রিভানু, তার পুত্র মরুও, তিনি অপুত্রক বলে পুরুবংশীয় দুষ্মন্তকে পুত্ররূপে গ্রহণ করেন, কিন্তু সেই দুষ্মন্ত রাজ্যলোভে আবার পুরুবংশে আশ্রয় করেছিলেন।

হে নরশ্রেষ্ঠ, এখন যযাতির জ্যেষ্ঠপুত্র যদুর বংশ বর্ণনা করছি। ঐ বংশ অতিশয় পবিত্র, মানবগণের সকল পাপনাশক। যদুবংশের কথা শ্রবণ করলে মনুষ্যমাত্রেই সকল প্রকার পাপ হতে মুক্ত হয়। এই যদুবংশে ভগবান পরমাত্মা শ্রীহরি নররূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

যদুর চারপুত্র–সহস্ৰজিৎ, ক্রোষ্ট্র, নল ও রিপু। তার মধ্যে সহস্রজিতের পুত্র শতজিৎ, শতজিতের তিন পুত্র মহাহয়, রেণুহয় ও হৈহয়। হৈহয়ের পুত্র ধর্ম,তার পুত্র নেত্র, তাঁর পুত্র কুন্তি, কুন্তির পুত্র সোহনিজ, তার পুত্র ভদ্রসেন। ভদ্রসেনের দুই সন্তান–দুর্মদ ও ধনক। ধনক কৃতবীর্যের জনক, এছাড়া কৃষাগ্নি কৃতবর্মা ও কৃতৌজা এই তিন জনও ধনকের পুত্র। তাদের মধ্যে কৃতবীর্যের পুত্র অর্জুন। ইনি সপ্তদ্বীপের অধীশ্বর হয়েছিলেন এবং ভগবান শ্রীহরির অংশজাত দত্তাত্রেয় হতে যোগসম্পদ লাভ করেছিলেন। পৃথিবীতে অন্য কোন রাজা যজ্ঞ, দান তপস্যা যোগ শাস্ত্রজ্ঞান, বীরত্ব ও দয়াদির দ্বারা কার্তবীর্যাজুনের স্থান লাভ করতে পারবেন না। কার্তবীর্যাজুনের নাম স্মরণ করলে কারও বিত্ত নষ্ট হয় না। অব্যাহত পরাক্রম কার্তবীর্যাজুন পঁচাশি হাজার বছর ছয় ইন্দ্রিয়ের ভোগ করেছিলেন।

পরশুরামের সহিত যুদ্ধকালে কার্তবীর্যাজুনের সহস্র পুত্রের মধ্যে পাঁচটি মাত্র পুত্রই অবশিষ্ট ছিলেন, তাদের নাম–জয়ধ্বজ, শূরসেন, বৃষভ, মধু এবং ঊর্জিত। তার মধ্যে জয়ধ্বজের পুত্র তালজ। তালজঙ্ঘের একশত পুত্র হয়েছিল, তারা তালজঙ্ ক্ষত্রিয় নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। রাজা সগর এদের সংহার করেন। তালজষ্মের পুত্রগণের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বীতিহোত্র তাঁর পুত্র মধু, বৃষ্ণি ও যদুর বংশ বলেই এই মধুকুল বৃষ্ণিকুল ও যদুকুল নামে এবং এই বংশের সন্তানগণ মাধব, বাষ্ণেয় ও যাদব নামে খ্যাত। যদুর পুত্র ক্রোষ্ট্র হতে বৃজিহ্বান্ জন্মগ্রহণ করেন। বৃজিহ্বানের পুত্র স্বাহিত, তাঁর পুত্র চিত্তরথ এবং তা হতে মহাভাগ শশবিন্দুর উদ্ভব হয়। তিনি তৎ জাতির শ্রেষ্ঠ চতুর্দশ মহারত্নের অধীশ্বর এবং অপরাজিত রাজচক্রবর্ত্তী ছিলেন। (বিভিন্ন জাতীয় বস্তুগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তুর নাম মহারত্ন)। চতুর্দশ মহারত্ন–সর্বশ্রেষ্ঠ হস্তী,অশ্ব, রথ রমণী, বাণ, নিধি, মাল্য, বস্ত্র, বৃক্ষ, শক্তি, পশিস, মনি, ছত্র ও বিমান। মহাকীর্তি শশবিন্দুর সহস্ৰ পত্নী ছিলেন, তাদের প্রত্যেক পত্নীতে এক এক লক্ষ সন্তান হওয়ায় তাহা হতে দশ লক্ষ সহস্র সন্তান উৎপন্ন হয়। সেই সমস্ত পুত্রের মধ্যে পৃথুশুবা, পৃথুকীর্তি, পুণ্যযশা ইত্যাদি ছয়জন প্রধান ছিলেন। তাদের মধ্যে পৃথুশবার পুত্র ধর্ম, তার পুত্র উশনা, তিনি শতাশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। হে মহারাজ,উশনার পুত্র রুচক, তাঁর পাঁচ পুত্র ছিলেন,তাদের নাম শ্রবণ কর–পুরুজিৎ, রুক্স, রুত্মেষ, পৃথু ও জ্যামঘ, শেবীর পতি জ্যামঘ, নিঃসন্তান হয়েও শৈবার ভয়ে অন্য কার পরিগ্রহ করে নাই।

এক সময় তিনি শত্রুদের জয় করে, তাদের গৃহ হতে একটি কন্যা হরণ করে আনলেন। শৈব্যা সেই কন্যাকে রথের উপর দেখেই ক্রোধে অসহিষ্ণু হয়ে স্বামীকে এরূপ বললেন–হে প্রবঞ্চক, কে এই কন্যা, যাকে রথে করে আমার নিকট নিয়ে এসেছ? জ্যামঘ ভয়ে ব্যাকুল হয়ে উত্তর দিলেন, এ কন্যা তোমার পুত্রবধূ, তখন শৈব্যা সবিস্ময়ে পতিকে বললেন–আমি বন্ধ্যা আমার কোন সপত্নীও নেই এ অবস্থায় এ কন্যা কিরূপে আমার পুত্রবধূ হতে পারে? তখন জ্যামঘ বললেন– হে রাজ্ঞি, তুমি যে পুত্র প্রসব করবে, এই কন্যা তারই স্ত্রী হবে।

হে মহারাজ, বিশ্বদেবগণ ও পিতৃগণ জ্যামঘের বাক্যের অনুমোদন করেছিলেন। তারপর শৈব্যা গর্ভবতী হয়ে একটি সুলক্ষণ পুত্র প্রসব করেন। ঐ বিখ্যাত পুত্র বিদর্ভ নামে খ্যাত হন এবং পরে এক সাধ্বী কন্যার পাণিগ্রহণ করেছিলেন।

.

চতুর্বিংশ অধ্যায়
যুদবংশ কথন এবং সেই বংশে শ্রীকৃষ্ণাবতারের সূচনা

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, বিদর্ভ সেই পত্নীর গর্ভে কুশ, ক্ৰথ এবং বিদর্ভকুলনন্দন রোমপাদের জন্মদান করেন। ঐ রোমপাদের পুত্র বভ্রু এবং বভ্রু হতে কৃতি জন্মগ্রহণ করেন। কৃতির তনয় উশিক এবং উশিক হতে চেদি ও দমঘোষ প্রভৃতি নরপতিগণের জন্ম হয়েছিল। ক্রথের পুত্র কুন্তি, তার পুত্র বৃষ্ণি, তাঁর পুত্র নিবৃতি, তাঁর পুত্র দশাহ, তার পুত্র জীমূত, তাঁর পুত্র বিকৃতি, তাঁর পুত্র ভীমরথ। তার পুত্র নররথ, এবং নররথের পুত্র দশরথ। দশরথের পুত্র শকুনি, তাঁর পুত্র করম্ভি তার পুত্র দেবারাত, তাঁর পুত্র দেবক্ষত্র, তার পুত্র মধ, তার পুত্র কুরুবংশ এবং কুরবংশের পুত্র অনু। অনুর পুত্র পুরুহোত্র, তার পুত্র আয়ু তার পুত্র সত্বিত, সাত্বতের সাত পুত্র–ভগমান, ভঝি, দিব্য, বৃষ্ণ, দেবাবৃধ, অন্ধক ও মহাভোজ।

হে আর্য মহারাজ, ভগমানের এক পত্নীর গর্ভে নিম্লোচি, কিকিন ও ধষ্টি এই তিন পুত্র এবং অপর পত্নীর গর্ভে শতাজিৎ, সহস্রাজিৎ ও অযুতাজিৎ–এই তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। দেবাবৃধের পুত্র ব তাদের (পিতা-পুত্রের) সম্বন্ধে কবিগণ প্রশস্তি রূপে এরূপ দুটি শ্লোক পাঠ করে থাকেন–আমরা দূর হতে, যেরূপ, শুনতে পাই, নিকটে এসেও সেরূপই দেখতে পাই, মহাত্মা ব মনুষ্যগণের শ্রেষ্ঠ আর দেবব্ধ দেবতাগণের সমান। তাদের বংশজাত পঞ্চষষ্টি এবং ষট সহস্র ও অষ্টম সংখ্যক পুরুষ ব ও দেবাবুধের উপদেশে মোক্ষ লাভ করেছিলেন। সাত্বতের সন্তান মহাভোজ অতিশয় ধার্মিক ছিলেন। তাঁর বংশে ভোজগণের উৎপত্তি হয়।

হে পরন্তপ, বৃষ্ণির দুই পুত্র–সুমিত্র ও যুধাজিৎ। যুধাজিতের পুত্র শিনি ও অনমিত্র। তাঁদের মধ্যে অনমিত্রের তনয় নিম্ন তার দুই সন্তান–সত্রাজিৎ ও প্রসেন। অনিমিত্রের শিনি নামে অন্য এক পুত্র ছিল, তার আয় সত্যক। সত্যকের পুত্র যুযুধান, তাঁর পুত্র জয়, তার পুত্র কুনি এবং কুনির পুত্র যুগন্ধর। অনমিত্রের অপর পুত্র বৃষ্ণি, তাহা হতে শয্যল্ক ও চিত্ররথ নামক দুই পুত্রের জন্ম হয়। শয্যল্ক হতে দুই পুত্রের জন্ম হয়।

শয্যল্ক হতে গান্ধিনীর গর্ভে অক্রুর ভিন্ন আরও দ্বাদশ জন বিখ্যাত পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। তাদের নাম–আসঙ্গ, সারমেয়, মৃদুর, মৃদুবিৎ, গিরি, ধর্মবৃদ্ধ, সুকর্মা, ক্ষত্রোপেক্ষ, অরিমদন, শত্রুঘ্ন, গন্ধমাদ ও প্রতিবাহু, এদের সুচীরা (সুচারা) নামে এক ভগিনী ছিলেন। অকুরের দুই পুত্র দেবমান ও উপদেব। চিত্ররথের পুত্র পৃথু, তদ্ভিন্ন বিদূরথ প্রভৃতি আরও অনেক সন্তান তার হয়েছিল। তারা সকলেই বৃষ্ণিবংশের সন্তান।

কুকুর ভজমান, শুচি, ও কম্বল বহিষ–এই চারজন অন্ধকের পুত্র। কুকুরের পুত্র বহ্নি, তাঁর পুত্র বিলোমা। বিলোমার পুত্র কপোত রোমা, তার পুত্র অনু। তুম্বরু নামক অনুর সখা ছিলেন। অনুর পুত্র অন্ধক। অন্ধকের পুত্র দুন্দুভি, তার পুত্র অবিদ্য, এবং অবিদ্যের পুত্র পুনর্বসু। পুনর্বসুর পুত্র আহুক এবং কন্যা আহুকীর তার মধ্যে আহুকী দুই পুত্র-দেবক ও উগ্রসেন।

দেবকের চার পুত্র দেববান, উপদেব, সুদেব এবং দেববর্ধন। তাদের ধৃতদেবা প্রভৃতি সাত ভগিনী ছিলেন–ধৃতদেবা, শ্রীদেবা, দেবরক্ষিতা, গৃহদেব ও দেবকী। বসুদেব এই সাত ভগিনীকেই বিবাহ করেছিলেন। কংস, সুনামা, ন্যগ্রোব, কঙ্ক, শঙ্কু, সুহু, রাষ্ট্রপাল, বৃষ্টি ও তুষ্টি–এই নয়জন উগ্রসেনের পুত্র। আর কংসা, কংসাবতী, কঙ্গ, শূরভূ, রাষ্ট্রপলিকা–এই পাঁচজন, উগ্রসেনের কন্যা। তারা বসুদেবের দেবভাগাদি কনিষ্ঠ ভ্রাতৃগণের ভার্য্যা ছিলেন।

অন্ধকপুত্র ভজমানের সন্তান ছিলেন বিদূরথ, বিদূরথের পুত্র শূর, শূরের পুত্র ওজমান, ওজমানের পুত্র শিনি, শিনির পুত্র ভোজ এবং ভোজের পুত্র হৃদীক। হৃদীকের চারপুত্র–দেববাহু, শতধনু, কৃতবর্মা দেবমীঢ়। দেবমীঢ়ের পুত্র শূর, তার পত্নীর নাম মারিষা। শূর মারিষার গর্ভে দশটি নিপাপ পুত্র উৎপন্ন করেন। তাদের নাম-বসুদেবস, দেবভাগ, দেবশ্রবা, আনক, সৃঞ্জয়, শ্যামক, বৎসক ও বৃৎসক ও বৃক। বসুদেবের জন্মকালে দেবতাদের দুন্দুভি ও ঢাকের শব্দ হয়েছিল। এজন্য শ্রীহরির অধিষ্ঠানস্বরূপ বসুদেবকে আনকদুন্দুভি বলা হয়। পৃথা, শ্রুতদেবা, শ্ৰতিকীর্তি, শ্রুতশবা ও রাজাধিদেবীশূরের এই পাঁচ কন্যা বসুদেবাদির ভগিনী। শূর নিজ সখা কুন্তিরাজকে অপুত্রক দেখে নিজ কন্যা পৃথাকে সন্তানরূপে দান করেছিলেন। কোন সময়ে এই পৃথা (কুন্তী) গৃহাগত অতিথি দুর্বাসাকে সেবার দ্বারা তুষ্ট করে, তার নিকট হতে দেবহুতি নামে এক বিদ্যা লাভ করেন। (এই বিদ্যার প্রভাবে যে কোন দেবতাকে আহ্বান করলে তিনি নিকটে আসেন।) এক সময় কুন্তী ঐ বিদ্যার প্রভাব জানার জন্য শুচি হয়ে সূর্যদেবকে আহ্বান করেছিলেন। সূর্যদেব তৎক্ষণাৎ এসে উপস্থিত হলেন, তা দেখে বিস্মিত চিত্তে কুন্তী বললেন–হে দেব, আমি কেবল বিশ্বাসের জন্য বিদ্যার প্রয়োগ করেছিলাম, আমাকে ক্ষমা করুন এবং নিজস্থানে প্রত্যাগমন করুন।

সূর্যদেব বললেন–হে দেবী, দেবদর্শন কখনও নিষ্ফল হয় না। আমি তোমার গর্ভে একটি পুত্র উৎপাদন করব এবং যাতে তোমার যোনি দূষিত না হয়ে যায় আমি সেরূপ ব্যবস্থা করব। এই বলে সূর্যদেব গর্ভধান করে স্বর্গলোকে গমন করলেন। তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় সূর্যের ন্যায় একটি কুমার ভূমিষ্ঠ হল। পৃথা লোকভয়ে ভীত হয়ে অতিকষ্টে নদীর জলে (পেটিকার মধ্যে করে) সেই পুত্রকে ত্যাগ করেছিলেন। তোমার পিতামহ সত্যবিক্রম পাণ্ডু সেই কুন্তীকে বিবাহ করেছিলেন।

করুষ–নরপতি বৃদ্ধশর্মা শ্রুতদেবাকে বিবাহ করেন। ঋষির অভিশাপগ্রস্ত (ভগবানের দ্বারপাল বিজয়, দিতিপুত্র হিরণ্যাক্ষ এখন) দ্ৰন্তবক্র তার গর্ভজ সন্তান। কৈকয়–বংশীয় ধৃষ্টকেতু শ্রুতকীর্তির পাণিগ্রহণ করেছিলেন। তাতে সন্তর্দন প্রভৃতি পাঁচটি পুত্রের জন্মেছিল। তার কৈকয়রূপে পরিচিত। রাজা জয়সেন রাজাধিদেবীর পাণিগ্রহণ করেন, তাতে বিন্দু ও অনুবিন্দু নামে দুই পুত্রের জন্মদান করেন। তাঁর পুত্র শিশুপাল যার উৎপত্তি বিবরণ পূর্বে বলা হয়েছে। এরপর বসুদেবের ভ্রাতাদের পত্নী ও পুত্রদের বিবরণ বলছেন। দেবভাগের ভার্য্যা কংসা, তার গর্ভে চিত্রকেতু ও বৃহদ্বল নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়। দেবশ্রবা হতে কংসাবতীর গর্ভে সুবীর ও ইমান জন্মগ্রহণ করেন। কঙ্ক হতে নিজ পত্নীর কঙ্গর গর্ভে (বক)–সত্যজিৎ ও পুরুজিতের জন্ম হয়। সঞ্জয় রাষ্ট্রপালীর গর্ভে বৃষ, দুমৰ্ষণ প্রভৃতি পুত্রগণের জন্মদান করেন। শ্যামক হতে শুরভূমির গর্ভে হরিকেশ ও হিরণ্যাক্ষের জন্ম হয়। বৎসক মিশ্ৰকাশী নাম্মী অপ্সরার গর্ভে বৃক প্রভৃতি পুত্রদের জন্মদান করেন। বৃক দুধাক্ষীর গর্ভে তক্ষ, পুস্কর, মালা প্রভৃতি পুত্রদের উৎপাদন করেছিলেন। সুদামনী শমীক হতে সুমিত্র, অজন ও পাল প্রভৃতি পুত্র প্রসব করেন। নিজভার্য্যা কণিকার গর্ভে ঋতধাম ও অজয় নামে পুত্রদ্বয় উৎপাদন করেছিলেন।

দেবকী প্রভৃতি সাত ভগিনী এবং পৌরবী, রোহিনী, ভদ্রা, মদিরা, রোচনা ও ইলা– ইহারা বসুদেবের পত্নী ছিলেন। বসুদেব রোহিনীর গর্ভে বলদেব গদ, সারণ, দুর্মদ, বিপুল ও ধ্রুব এবং কৃত প্রভৃতি পুত্রগণের জন্মদান করেন। সুভদ্র, ভদ্রাবাহু, দুর্মদ, ভদ্র ও ভূত প্রভৃতি দ্বাদশ জন পৌরবীর গর্ভজাত সন্তান। নন্দ, উপানন্দ, কৃত্তক ও শূর প্রভৃতি মদিরার পুত্র বাসুদেব– ভার্যা কৌশল্যা (ভদ্রা) কেশি নামে কুলনন্দন একমাত্র পুত্র প্রসব করেন। বসুদেব হতে রোচনার গর্ভে হস্ত, হেমাঙ্গদ প্রভৃতি এবং ইলার গর্ভে সদুকুল– শ্রেষ্ঠ উরুবল্ক প্রভৃতি পুত্রগণের উৎপত্তি হয়েছিল। হে মহারাজ, বসুদেব হতে ধৃতদেবার গর্ভে বিপৃষ্ঠ নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। শান্তিদেবার গর্ভে প্রশম প্রথিত প্রভৃতি জন্মগ্রহণ করেন। রাজন্য, কল্প, বর্ষ প্রভৃতি দশ জন উপদেবার পুত্র। শ্রীদেবার গর্ভে বসু, হংস ও সুবংশ প্রভৃতি ছয়জন পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। দেবরক্ষিতা গদ প্রভৃতি নয় জন পুত্র লাভ করেন। ধর্ম যোদ্ধা অষ্টবসুর জন্মদান করেন। সেরূপ বসুদেবও সহদেবার গর্ভে প্রবরস, তমুখ্য প্রভৃতি আটটি পুত্রের উৎপাদন করেছিলেন।

এইরূপ উদারমতি বসুদেব দেবকীর গর্ভেও আটটি পুত্রের জন্মদান করেন। তাদের নাম কীর্তিমান, সুষেণ, ভদ্রসেন, ঋজু, সংমর্দন, ভদ্র এবং সপ্তম নাগরাজ সংকর্ষণ। হে মহারাজ, ভগবান স্বয়ং শ্রীহরিই শ্রীকৃষ্ণরূপে তাদের অষ্টম পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তোমরা পিতামহী মহাভাগা সুভদ্রাও তাদেরই কন্যা। হে রাজন, যে যে সময়ে ধর্মের ক্ষয় এবং পাপের বৃদ্ধি হয়, সেই সেই সময়ে ভগবান শ্রীহরি অবতাররূপে আত্মপ্রকাশ করে থাকেন। হে মহারাজ, ভগবান স্বয়ং মায়ার নিয়ন্তা, সর্বসঙ্গ–রহিত। সকলের সাক্ষী এবং সর্বব্যাপী। এ অবস্থায় একমাত্র মায়ার বিলাস ব্যতীত তার জন্ম বা কর্মের কোন হেতু থাকতে পারে না। ভগবানের মায়ার বিলাস জীবের প্রতি অনুগ্রহ–স্বরূপ, যেহেতু প্রলায়ান্তে জীবের দেহাদি সৃষ্টির দ্বারা ধর্মাদির প্রবর্তনের জন্যই মায়িক সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় ঘটে থাকে। আবার এই মায়ার বিলাস শ্রবণ করলে, জীবের দেবাদি সৃষ্টির নিবৃত্তিহেতু আত্মলাভ (মোক্ষপ্রাপ্তি) সম্ভব বলে, ইহা তাদের প্রতি ভগবানের অনুগ্রহ। (ভগবানের এই মায়ার বিলাস পৃথিবীর প্রতি অনুগহ-স্বরূপ)। হে মহারাজ, অসংখ্য সেনাবৃন্দের অধিপতি রাজচিহ্নধারী অসুরগণের ভারে আক্রান্ত পৃথিবীর ভার লাঘবের জন্যও তার এই উদ্যম জানবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলদেবের সহিত এই ধরাতলের যে সকল অপরিমেয় কর্মের অনুষ্ঠান করেছিলেন।

তা সুরেশ্বরগণের মনের দ্বারাও বিচারের অযোগ্য। কলিযুগে যে সকল ভক্ত জন্মগ্রহণ করবেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাদের দুঃখ, শোক ও অজ্ঞান-নাশক স্বীয় পরম পবিত্র যশোরাশি বিস্তার করে গিয়ছেন। ঐ যশ সাধুপুরুষদের কর্ণামৃত ও শ্রেষ্ঠ তীর্থস্বরূপ, একমাত্র শ্রোত্ররূপ অঞ্জলির দ্বারা পান করলে মানুষ কর্মর্বাসনা পরিত্যাগ করতে সমর্থ হয়, হে মহারাজ, ভোজ, বৃষ্টি, অন্ধক, মধু, শূরসেন, দশাহ, কুরু, সৃঞ্চয় ও পানজুর বংশধরগণ নিরন্তর তাঁর চরিতাবলির প্রশংসা করে থাকেন। সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্নিগ্ধ, সুস্মিত দর্শন, উদার বচনা, বিক্রমলীলা এবং সর্বাঙ্গ সুন্দর নিজ বিগ্রহ দ্বারা সমস্ত মনুষ্যলোককে আমোদিত করেছেন।

তার হাস্যবিলাসযুক্ত বদনমণ্ডল, মকরাকৃতি কুণ্ডল–যুগলের শোভায় মহোহর কর্ণযুগল ও সমুজ্জলগণ্ডযুগলের সমাবেশে, অতিসুন্দর বলে উহা সর্বদাই দর্শক মণ্ডলীর উৎসব বিস্তার করে। নর ও নারীগণ নয়নদ্বারা সানন্দে সেই বদনশোভা নিরন্তর পান করেও পরিতৃপ্ত হতে পারেন নাই, কিন্তু নিমেষহেতু দর্শনের বিঘ্ন ঘটায়, নিমেষ-সৃষ্টিকর্তা নিমির প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। (সংক্ষেপে শ্রীকৃষ্ণলীলা বলছেন)-হে রাজন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রথমতঃ নিজ, চতুর্ভুজ রূপে আবির্ভূত হয়ে পশ্চাৎ মানবাকৃতি ধারণপূর্বক পিতৃগৃহ হতে ব্রজে গমন করেন।

পরে ব্রজবাসীদের স্বার্থ সম্পাদন পূর্বক শত্রুগণকে বধ করে বহু রমণীকে বিবাহ করেন এবং তাঁদের গর্ভে অসংখ্য পুত্র উৎপাদনপূর্বক সেই পরম পুরুষ লোকসমাজে স্বকীয় বেদমার্গ বিস্তারের জন্য যজ্ঞসমূহের দ্বারা, যজ্ঞেশ্বররূপী নিজেরই অর্চনা করেছিলেন। সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণই পৃথিবীর গুরুতর ভার হরণের জন্য কুরুবংশীয় গণের পরস্পর সজ্ঞাত বিবাদমূলক যুদ্ধে কালরূপী নিজের দৃষ্টিমাত্র–দ্বারাই পৃথিবীস্থিত রাজগণের সেনা সমুদয় সংহার করে অর্জুনের বিজয়বার্তা ঘোষণা করেন। পরে লীলা অবসানে উদ্ধবের নিকট পরম তত্ত্ব, উপদেশ করে সেই নিজেরূপেই স্বধামে গমন করেছেন।