তীর্থযাত্রা থেকে প্রত্যাগত কৃকলের পথিমধ্যে পিতৃবন্ধন দর্শন, পত্নীহস্তে অন্ন পাকানন্তর শ্রাদ্ধকারণে কৃকলের পিতৃমুক্তি
ভারতবর্ষে প্রায় সকল তীর্থ দর্শন করে সঙ্গীসাথীদের নিয়ে কৃকল বাড়ি ফিরছেন, হঠাৎ পথের মাঝে এক বিরাট পুরুষকে দেখলেন, কৃকলের পিতৃ পুরুষগণকে তিনি বন্দী করে কৃকলকে বললেন–তোমার যথাযথ উত্তম পুণ্য লাভ হয়নি। তীর্থফলও তোমার নেই। এতদিন ধরে তীর্থ দর্শন করা তোমার বৃথা হল। তোমার নিজের সন্তোষলাভ হল কিন্তু উত্তম পুণ্যলাভ হল না।
সেই বিরাট পুরুষের কথা শুনে কৃকল খুবই আশ্চর্য হয়ে বলল–কে আপনি? আমার পিতৃপুরুষগণকে আমার কোন্ দোষের জন্য বন্ধন করলেন? কেন আমার তীর্থযাত্রার ফল লাভ হবে না?
তখন সেই বিরাট পুরুষ ধর্ম বললেন–যে নিজের পুণ্যতমা স্ত্রীকে ত্যাগ করে যায়, তার সব পুণ্যই বৃথা। যে স্ত্রী ধর্মশীলা পতিব্রতানিষ্ঠা, পুণ্যবৎসলা তাকে ত্যাগ করে যে ধর্মকর্ম করতে চেষ্টা করে, তার সব ধর্মকর্মই বৃথা হয়। সর্বসদাচারনিরতা, ধর্মসাধনা-তৎপরা পতিব্রতনিষ্ঠা এমন গুণশালী মহামতী স্ত্রী যার ঘরে, তার ঘরে মহাতেজা দেবগণ বিরাজ করেন। তার পিতৃগণ তার গৃহে অবস্থান করে সর্বদাই মঙ্গল চিন্তা করেন। তার গৃহে সমস্ত তীর্থক্ষেত্রই বিরাজমান। পুণ্যভাৰ্য্যার দ্বারাই গার্হস্থ্য-ধর্ম সিদ্ধ হয়, গার্হস্থ্য আশ্রয় করে সমস্ত জীব জীবনধারণ করে, গার্হস্থ্যর মত অন্য উত্তম আশ্রম আর হয় না। যেজন ভাৰ্য্যাহীন, তার গৃহ শ্মশানের সমান, যজ্ঞ দান তার কিছুই সিদ্ধ হয় না, সেই পুরুষের কোন ব্রতই সফল হয় না। ধর্ম সাধনের জন্য স্ত্রীর তুল্য কেউ নেই। ভাৰ্য্যা সম পুণ্য নেই, ভাৰ্য্যা মম সুখ নেই, ভাৰ্য্যা সম তীর্থ নেই।
হে নরাধম, স্ত্রীকে ত্যাগ করে তীর্থে গেল পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য, কিন্তু সেই তীর্থফল তোমার কোথায়? ভাৰ্যাহীন হয়ে তীর্থে যে শ্রাদ্ধ-দানাদি করেছ, তাতে কোন ফল হল না, বরং অনেক অপরাধ হয়েছে। সেই অপরাধের জন্যই তোমার পিতৃপুরুষগণকে আমি বন্ধন করেছি। তুমি স্ত্রী ব্যতীত যে শ্রাদ্ধান্ন দিয়েছ তা বৃথা হয়েছে।
যে সুপুত্র শ্রদ্ধায় শ্রাদ্ধ দান করে, স্ত্রী শ্রাদ্ধান্ন প্রস্তুত করে, সেই শ্রাদ্ধকর্তা সুপুত্রের পিতৃগণ ঐ শ্রাদ্ধে তৃপ্তি লাভ করে। তুমি স্ত্রীকে বঞ্চিত করেছ। যেহেতু তোমার পিতৃগণ স্ত্রী ব্যতীত অন্যের প্রস্তুত অন্ন ভক্ষণ করেছে তাই এরা চোররূপে গণ্য হয়ে আবার কাছে বন্দী রয়েছে। স্ত্রী নিজের হাতে যে অন্ন পাক করে তা অমৃত সমান হয়। সেই অন্নই পিতৃগণ তৃপ্ত হয়ে ভোজন করে। স্ত্রী ব্যতীত পুরুষের ধর্ম সিদ্ধ হয় না। স্ত্রী বিনা যে ধর্ম তা বিফল।
ধর্মের এই কথা শুনে কৃকল অতি বিনয়ের সঙ্গে বলল–হে ধর্মরাজ, আমি পত্নীকে তীর্থে না নিয়ে গিয়ে, আর তার হাতে প্রস্তুত করা শ্রাদ্ধান্ন না দিয়ে যে অপরাধ করেছি, তার থেকে কীভাবে মুক্ত হব? কেমন করে. আমার এই পিতৃপুরুষগণ উদ্ধার পাবে তা আমাকে বলুন।
ধর্মরাজ বললেন–এখন তুমি গৃহে যাও কৃকল। তুমি গৃহে না থাকায় তোমার গৃহিণী খুবই দুঃখ ভোগ করছে। গৃহে গিয়ে সেই পতিব্রতাকে সান্ত্বনা দাও। তার হস্তে শ্রাদ্ধ দানাদি সম্পাদন করে, পুণ্যতীর্থ সমস্ত স্মরণ করে সুরোত্তম গণের অর্চনা কর। এতেই তোমার তীর্থযাত্রার ফল লাভ করবে।
ধর্মরাজ কৃকলকে এই কথা বলে অন্তর্হিত হলেন। তারপর মহাত্মা কৃকল গৃহে এসে পতিব্রতা পত্নীকে দেখে খুব আনন্দ লাভ করল। সুকলাও গৃহাগত স্বামীকে দেখে আনন্দে তৎকালীন পুণ্য– মঙ্গলাচরণ করল।
তারপর কৃকল এক দেবমন্দিরে পত্নীর সঙ্গে শ্রদ্ধা যুক্ত হয়ে পরম পুণ্যাবহ শ্রাদ্ধকাৰ্য্য সম্পন্ন করল।
তখন ভগবান বিষ্ণু, ব্রহ্মা, মহেশ্বর এবং অন্যান্য দেবগণ পিতৃগণ এবং অন্যান্য দেবতাগণ আকাশমণ্ডলে সমাগত হয়ে সেই দম্পতিকে বললেন–তোমাদের মঙ্গল হোক তোমরা বর প্রার্থনা কর। আর মুনিরা সেই দম্পতির স্তব করলেন।
কৃকল বলল–আমাদের কোন পুণ্য প্রভাবে বরদান করবার জন্য আপনারা এখানে সমাগত হয়েছেন?
তার উত্তরে ইন্দ্র বললেন–হে কৃকল, তোমার এই পত্নী পতিব্রতা সুফলা পরম মঙ্গলময়ী, এই সত্যবলেই তুষ্ট হয়ে আমরা তোমাদের বরদান করবার জন্য এখানে এসেছি।
তারপর ইন্দ্র সুফলাকে পরীক্ষা করবার জন্য যা যা চেষ্টা করেছেন এবং কিভাবে বিফল হয়েছেন সবকথা কৃকলের কাছে বললেন। কৃকল মহা আনন্দ লাভ করল সুফলার চরিত্র শুনে। তারপর তারা সব দেবতাকে প্রণাম জানিয়ে বলল–আপনারা যদি আমাদের প্রতি তুষ্ট হয়ে থাকেন তাহলে যেন জন্মে জন্মে দেবতাদের প্রতি আমার ভক্তিমান থাকি। ধর্মে ও সত্যে আমাদের যেন অনুরাগ থাকে। আপনাদের প্রসাদে পিতৃপুরুষগণের সঙ্গে যেন আমরা বৈষ্ণবলোকে গমন করি।
কৃকল এই বর প্রার্থনা করলে দেবতাগণ বললেন–তোমাদের প্রার্থিত সমস্তই লাভ হবে, এই কথা বলে সেই দম্পতির মাথায় পুস্পবৃষ্টি করে এবং তাদের স্তব করে নিজ নিজ ধামে গমন করলেন।
মহাত্মা যযাতিকতৃক সত্যধর্মে প্রজাপালন তাঁকে স্বর্গধামে আনয়নের জন্য ইন্দ্র কর্তৃক মাতলিকে প্রেরণ এবং যযাতির অস্বীকার ও মর্ত্যধামেই স্বর্গের মতো সুখ সৃজন এবং পুনরায় কামাতিকে প্রেরণ করে যযাতিকে জরাগ্রস্তকরণ।
নহুষের পুত্র সত্ত্বগুণান্বিত ধর্মশীল মহামতি যযাতি। যযাতির এই সব গুণের জন্য নহুষ তাকে রাজপদে অভিষিক্ত করে ইন্দ্রপদ লাভ করেন। রাজা হবার পর যযাতি সত্যধর্মে সকল প্রজাপালন করলেন। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্যের কন্যা দেবযাত্রী এবং দৈত্যরাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠাকে বিবাহ করেন। এই দুজনের গর্ভে পাঁচজন পুত্র জন্মলাভ করে। প্রত্যেকেই পিতৃতুল্য পরাক্রমশালী। ধর্মানুসারে রাজ্য প্রতিপালনের জন্য ত্রিভুবনে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন যযাতি।
একসময় দেবর্ষি নারদ স্বর্গধামে গিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রকে যযাতির সত্যধর্মের কথা বলে বললেন, তিনি বহু যজ্ঞ, বহু দান করেছেন। মহারাজ নহুষের থেকে যযাতি অধিক গুণসম্পন্ন।
এই কথা শুনে দেবরাজ ইন্দ্র খুবই চিন্তিত হলেন। ভাবলেন–শত যজ্ঞ করে নহুষ আমার পদ লাভ করেছিলেন, শচীর বুদ্ধিবলে সে ইন্দ্রপদ থেকে ভ্রষ্ট হল। তার পুত্র যযাতিও আমার ইন্দ্রত্ব হরণ করতে পারে। কাজেই ঐ যযাতিকে যে-কোন ভাবে স্বর্গপুরে আনতে হবে।
এই চিন্তা করে ইন্দ্র তার সারথি মাতলিকে যযাতির কাছে পাঠালেন তাকে স্বর্গে আনবার জন্য। মাতলি মর্ত্যধামে যযাতির রাজসভায় উপস্থিত হয়ে বললেন–হে রাজন, আপনি ইন্দ্রলোকে চলুন। স্বয়ং দেবরাজ আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য। মহাবীৰ্য্য পুরূরবা, বিচিত্তি, শিবি, মনু, ইক্ষবাকু, আপনার পিতা নহুষ, শান্তনু, ভরত, নরেশ্বর কার্তবীৰ্য প্রভৃতি নৃপতিগণ মর্ত্যে বহু যজ্ঞ সাধন করে স্বর্গে মহাসুখ ভোগ করছেন। আপনি ও অশীতি সহস্রবর্ষব্যাপী রাজত্ব করে বহু যজ্ঞে দান, পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান করেছেন। সেই পুণ্যগুণে আপনি স্বর্গে মহাসুখ ভোগ করুন। ইন্দ্রের সঙ্গে সেখানে সখ্য স্থাপন করুন। তাই আর দেরী না করে এই পাঞ্চভৌতিক দেহ পরিত্যাগ করে স্বর্গে চলুন।
রাজা যযাতি মাতলির কথা শুনে তাকে বহুবিধ তত্ত্বকথা জিজ্ঞাসা করলেন। মাতলি পঞ্চভূতের সৃষ্টি ও লয়ে, স্বর্গ ও নরকে গতি, কর্মবিপাক, ধর্মের ফল, যমরাজকর্তৃক পীড়া প্রভৃতি বিষয়ের কথা বললেন। তারপর যযাতি বললেন–আমি শরীর ত্যাগ করব না, পার্থিব শরীর ব্যতীত আমি স্বর্গেও যাব না। বয়ঃ ক্রমের অনন্তকাল আমার অতীত হয়েছে। তবুও আমার দেহ ষোড়শ বর্ষ বয়স্কের যুবকের মত বলবীর্য রূপ সমন্বিত হয়ে শোভিত। গ্লানি, হানি, শ্রম, জরা, ব্যাধি কিছুই নেই। হে মাতলি, আমি প্রতিদিন হৃষীকেশের ধ্যান ও নামোচ্চারণ রূপ উত্তম রসায়ন পান করেছি। তাতেই আমার পাপব্যাধির নাশ হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণনামরূপ মহৌষধ এ সংসারে থাকতে মূঢ়গণ তা পান না করে পাপব্যাধি পীড়িত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। ধ্যান, জ্ঞান, পূজা, দান ও পুণ্যের সাহায্যে আমার সাহায্যে আমার শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ। গোবিন্দের প্রসাদে এইরকম দেহশুদ্ধি হয় বলেই আমি আর স্বর্গে যাব না। এই স্থানকে স্বর্গধামে পরিণত করব। আপনি স্বর্গে গিয়ে দেবরাজকে বলুন। আর কোন কথা না বলে মাতলি যযাতিকে নমস্কার করে প্রস্থান করলেন।
তারপর মহারাজ যযাতি তার দূতদের আদেশ করলেন–হে দূতগণ, তোমরা আমার রাজ্যের সর্বত্র প্রচার কর, যাতে শ্রীহরির নাম সংকীর্তন সবাই করে। প্রজাগত যেন জড় বিষয় ত্যাগ করে অমৃতোসম ভাব, ধ্যান, পুণ্য তপ, যাগ, দান প্রভৃতির দ্বারা একমাত্র শ্রীমধুসূদনের আরাধনা করে।
আর যে আমার আদেশ পালন করবেন না, তাকে চোরের মতন শাসন করবে।
রাজার দূতেরা তার আদেশ সর্বত্র প্রচার করল। এই আদেশ শুনে সব প্রজারা তখন থেকে বিষ্ণুর পূজা, ধ্যান, গুণগান, মন্ত্র জপ করতে লাগল, প্রজারা বৈষ্ণবভাবে ভাবিত হয়ে জয়যুক্ত হল। এইভাবে রাজ্যশাসন করা যযাতির রাজ্যে দুর্ভিক্ষা, ব্যাধি এবং প্রজাদের অকাল মরণ হল না। প্রত্যেকের গৃহে বিষ্ণু মন্দির তুলসী কানন দেখা গেল। সকলের মুখে কৃষ্ণ, হরি, কেশব, মধুসূদন, মুকুন্দ, রাম, নরসিংহ, পদ্মনাভ, বাসুদেব, বামন, গোবিন্দ, হৃষিকেশ, শ্রীধর শ্রীপতি প্রভৃতি নাম উচ্চারিত হল। নারীরাও গৃহের কাজে ব্যস্ত থেকেও সর্বদা এই সব নাম উচ্চারণ করল।
এইভাবে মহীতল বিষ্ণুলোক সদৃশ হল। জনগণ তখন সকলেই তরুণ শরীরে বহুবর্ষ জীবিত থাকত। সকলেই, নীরোগ, জ্ঞানবান যজ্ঞদান পরায়ণ দয়ালু, পরোপকারী হল। বিষ্ণুভক্ত ও নিত্য সর্বধর্ম পরায়ণ ছিলেন মহারাজ যযাতি। তাঁর রাজত্বকালে প্রজারা যমালয়ে যেত না। তারা সকলেই রাগ-দ্বেষ বর্জিত ছিল। যমদূতেরা সর্বত্র ভ্রমণ করেও কোন পাপীকে দেখতে পায় না। রাজা যযাতি তরুণের মতো প্রতিভাত হয়ে ক্রৌর প্রসাদে বহু কীর্তি ও যশঃ অর্জন করে পৃথিবীতে লক্ষ বৎসর রাজত্ব করলেন। ধর্মরাজের দূতেরা যযাতির রাজত্বে কোন পাপীকে না পেয়ে তারা যমালয়ে ফিরে ধর্মরাজকে যযাতির ধর্ম–ধর্মের কথা বলল। তিনি বিষ্ণুভক্ত, অতি পবিত্র, তিনি স্বর্গে পরিণত করেছেন পৃথিবীকে।
তাই একদিন যমরাজ দেবরাজের সভায় গমন করে, দেবরাজ ইন্দ্রকে বললেন–পরম বৈষ্ণব মহাত্মা যযাতি সব মর্তবাসীকে বৈষ্ণবে পরিণত করেছেন। মর্ত্যলোকেই বৈকুণ্ঠ বিরাজ করছে। তারা কেউ পাপ করে না, মিথ্যা কথা বলে না। প্রত্যেকই কামক্রোধ বিজয়ী, দানশীল, ধর্মপরায়ণ এবং শ্রীহরির অর্চনায় রত।
ধর্মরাজের কথা শুনে ইন্দ্র বললেন–আমি দেবর্ষি নারদের কাছে যযাতির বিষয় জানতে পেরে তাঁকে স্বর্গধামে আনার জন্য সারথি মাতলিকে পাঠাই, কিন্তু তিনি স্বর্গসুখভোগ চান না, তিনি ভূমণ্ডলকেই স্বর্গে পরিণত করেছেন। আমি তার কারণে তাই ভীত হয়ে আছি।
ধর্মরাজ তখন বললেন–হে দেবেশ–যদি আপনি আমার হিত চান, তাহলে যে কোনভাবে যযাতিকে এখানে নিয়ে আসুন।
ধর্মের কথা শুনে দেবরাজ ইন্দ্র চিন্তা করে কামদেব, গন্ধর্বগণকে মকরন্দ ও রতিকে আদেশ করে বললেন–যে, যেভাবেই হোক যযাতিকে স্বর্গে আনা চাই।
দেবরাজের আদেশ পেয়ে কামাদিগণ যযাতির রাজসভায় উপস্থিত হয়ে, তাকে আশীর্বাদে অভিনন্দিত করে নাটকাভিনয়ের প্রস্তাব করল। যযাতির সম্মতি নিয়ে, বিপ্ররূপী বামন চরিত ও তার আবির্ভাব বিষয়ক অভিনয় অনুষ্ঠিত হল। জরা অপ্রতিম রূপবতী নারীর বেশ ধারণ করে সুস্বরে উত্তম সঙ্গীত পরিবেশন করল। তার সেই কন্দর্পমায়াময়গীত বিলাস, হাস্যললিত, দিব্যচরিত ও দিব্যভাবে মহারাজ মুগ্ধ হলেন।
সেই অভিনয় দেখে রাজা যযাতি এমন মুগ্ধ হলেন যে, মল-মূত্র পরিত্যাগ করে পাদ প্রক্ষালন করেই আসনে বসলেন। সেই অবকাশে জরা তাকে ধারণ করলেন। কামদেব এইভাবে দেবরাজের হিতসাধন করলেন।
নাটকাভিনয় শেষ হলে কামাদি সক্কলে প্রস্থান করলেন। আর ধর্মাত্মা যযাতি জরাভিভূত হয়ে অত্যন্ত কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। বিষয়কর্মে পরান্মুখ হলেন। মহাত্মা যযাতির মৃগয়ায় গমনে কাম কন্যা দর্শনে মোহিত এবং আপন জরা পুত্র পুরুকে দান করে তার তারুণ্য গ্রহণপূর্বক কামকন্যাকে বিবাহ ও সুখভোগ শেষে পুরুকে তারুণ্যে প্রদান করে আপন জরা গ্রহণ করতঃ সর্ব প্রজাপুঞ্জের সঙ্গে স্বর্গাদিলোকে গমন।
জরাভিভূত হয়ে মহারাজ যযাতি মৃগয়ার জন্য একদিন বনে গমন করেন। সেই সময় এক মৃগ তার কাছে আসে। স্বর্ণময়, সর্বাঙ্গসুন্দর চতুঃশঙ্গ সেই মৃগকে দেখে রাজা বধ করবার জন্য উদ্যত হলে, মৃগটি সেখান থেকে ছুটে পালাল। রাজাও তার পিছু পিছু ছুটতে লাগলেন। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর রাজা আর সেই মৃগটিকে দেখতে পেলেন না। রাজা সুশোভিত বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে একটি সুন্দর সরোবর দেখতে পেলেন। সেই সরোবর তটে এক গাছের তলায় রাজা বসলেন।
সহসা এক নারীকণ্ঠের সুমধুর গান রাজা শুনতে পেলেন। এমন সময় দিব্যরূপা এক নারী রাজার কাছে এলে রাজা তাকে প্রশ্ন করলেন–কে তুমি? কার কামিনী? এখানে কিজন্য এসেছ? কিন্তু সেই বীণাধারিণী নারী কোন উত্তর না দিয়ে কেবল হেসে সেখান থেকে চলে গেল। রাজা তখন চিন্তা করলেন, এই নারী কে? কেন আমার কথায় কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেল? মনে হয় যে মৃগটিকে আমি দেখেছি, সেই মৃগটি মায়াবলে নারীরূপ ধারণ করেছে। নিশ্চয় কোন দানবকুলের মায়ারূপ।
রাজা যখন চিন্তা করছেন তখন সেই নারী আবার রাজার দিকে তাকিয়ে হেসে অন্তর্হিত হল। সেই সুমধুর গান আবার রাজার শ্রবণগোচর হলে সেই সংগীত অনুসরণ করে রাজা গিয়ে দেখলেন–জলের ওপর সহস্রদল পদ্মের ওপর বসে অতি মনোরমা এক নারী মধুরস্বরে গান গাইছেন। রাজা দেখে ভাবলেন, নিখিল চরাচরে এখন রমণীরত্ন আর নেই। এই সুন্দরী নারীর রূপ দেখে ও গান শুনে রাজার দেহ-মন কামাকুলিত হল। কামানলে দগ্ধ হয়ে রাজা ভাবতে লাগলেন কেমন করে এই কামিনী আমার ভোগ্যা হবে? এই পদ্মাননবালা যদি আমাকে আলিঙ্গন করে তবে আমার জীবন সফল হবে।
এই চিন্তা করে সেই কামিনীকে উদ্দেশ্য করে রাজা যযাতি বললেন–কে তুমি শুভে? আমি যে রমণীকে আগে দেখেছি, সেই নারী কি তুমি? আমি চন্দ্র বংশীয় নহুষনন্দন যযাতি সপ্তদ্বীপের অধীশ্বর। হে ভদ্রে, তুমি আমার হও, আমার চিত্ত তোমাতেই আসক্ত। তোমার যা কাম্য, অবশ্যই আমি তা দেব। কামাহত হয়ে তোমার শরণ নিলাম, তুমি আমাকে পরিত্রাণ কর।
মহারাজের এমন উক্তি শুনে সেই দিব্যনারী তার সখী বিমলাকে বলল–সমাগত রাজাকে আমার পরিচয় জানিয়ে দাও তুমি সখী।
তখন বিশালা বলল–পুর্বকালে কামকে মহাদেব দগ্ধ করলে তার পত্নী রতিদেবী এই স্থানে রোদন করতে থাকেন। রতি প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে তখন দেবতারা মহাদেবকে বলেন-হে মহাদেব, আপনি কামকে জীবিত করুন। না হলে রতি জীবনধারণ করতে পারবে না।
মহাদেব বললেন–আমি কামের জীবন দান করব। কিন্তু সে কায়াবিহীন হয়ে থাকবে এবং মাধবের সখা হবে, তখন কন্দর্প জীবন লাভ করল। তারপর এই সরোবরে আগমন করল। এটি কামসরোবর। মদনদেব দগ্ধ হলে দুঃখ পীড়িতা রতির কোপ থেকে দারুণাকৃতি অনল উখিত হল। রতি সেই অনলে দগ্ধ হয়ে মোহ মূৰ্ছিত হয়ে অশ্রু মোচন করে। সেই সব অশ্রুবিন্দু থেকে জরার উৎপত্তি হয়। তা থেকে অনিষ্টকারক বিয়োগ নামে দুর্মেধা সৃষ্টি হয়। আর দুঃখ ও সন্তাপক নামে দুই ভ্রাতারও জন্ম হয়।
হে মহারাজ, তারপর কেউ বলল, কাম এসেছে। তখন রতির কামকে দেখে অশ্রুপূর্ণ দুই চোখ থেকে আনন্দাশ্রু নির্গত হয়ে জলের মধ্যে পতিত হল। তাতে প্রীতি, খ্যাতি, লজ্জা এবং শান্তির সৃষ্টি হল। তার থেকে দুটি কন্যার জন্ম হল। তাদের নাম লীলা ও ক্রীড়া। তারপর রতির সঙ্গে যখন কামের একান্ত সংযোগ ঘটল, তখন রতির কামচক্ষু থেকে নির্গত আনন্দাশ্রু দ্বারা একটি সুন্দর পদ্মের সৃষ্টি হল। আর সেই সুপদ্ম থেকেই এই সুন্দরী ললনার জন্ম হল। এর নাম অশ্রুবিন্দুমতী। আমি বরুণের কন্যা বিশালা।
হে রাজেন্দ্র, আমি এই সুন্দরীর জন্মবৃত্তান্ত ও আমার পরিচয় দিলাম। আমার এই সখী পতি কামনায় তপস্যা করছে।
বিশালার কথা শুনে যযাতি বললেন–হে শুভে, তোমার কথা সমস্তই শুনলাম, এখন আমার কথা শ্রবণ কর, এই সুন্দরী রতিকন্যা আমাকে ভজন করুক। এই কন্যা যা আকাঙ্ক্ষা করবে, সবই তার প্রাপ্য হবে। যাতে ইনি আমার বশীভূত হন, হে কল্যাণী তুমি তেমন কর। রাজার কথা শুনে বিশালা বলল–আমার সখীর এক ব্রত আছে, মহারাজ, সর্বজ্ঞ, সুন্দর দেহ, বীরলক্ষণাক্রান্ত, ধর্মপরায়ণ, তেজস্বী, দাতা, ব্রাহ্মণের একান্ত প্রিয়, সুমতি এমন গুণসম্পন্ন বরকেই ইনি মনে মনে কামনা করেন।
এই কথা শুনে মহারাজ যযাতি খুশি হয়ে বললেন–বিধাতা আমাকে তেমনই গুণসম্পন্ন করেই সৃজন করেছেন।
রাজার কথা শুনে বিশালা বলল–হে রাজন্ আপনাকেই ত্রিজগতে পুণ্যবান বলে মনে করি। আপনার মধ্যে সমস্ত গুণ থাকলেও একটি মাত্র দোষের জন্য আমার সখী আপনাকে মনোনীত করবেন না, সেটি হল আপনার জরাগ্রস্ত দেহ। তাই তখনই আমার সখী আপনার প্রিয়া হবে, যখন আপনি জরাহীন দেহ হবেন। হে ভূপতে, আমি শুনেছি পুত্র, ভ্রাতা বা ভৃত্য, এদের কারোর ওপরে জরা সংক্রামিত করে তার তারুণ্য গ্রহণ করা যায়। অতএব আপনি পুত্রকে জরা দান করে তার তারুণ্য গ্রহণ করে সুন্দর রূপ ধারণ করে আমার সখীর কাছে আসুন।
বিশালার মুখে এই কথা শুনে কামাসক্ত যযাতি গৃহে ফিরে আপন পুত্রগণকে ডেকে বললেন–হে পুত্রগণ, তোমরা আমার সুখানুষ্ঠান কর। আমার মন বর্তমান কামানলে দগ্ধ। তোমাদের মধ্যে যে কোনো একজন আমার জরা গ্রহণ করে আপন যৌবন আমাকে দান কর। আমি ইচ্ছামত কামিনী উপভোগ করি। যে আমার এই জরা গ্রহণ করবে, পরবর্তীকালে আমার রাজ্য সেই ভোগ করবে।
পিতার বাক্যে যদু-আদি চারপুত্র বিভিন্ন তত্ত্বকথা বলে সেই আদেশে অসম্মত হলে কনিষ্ঠ পুত্র পুরু পিতার জরা গ্রহণ করল। আর যযাতি পুরুর তারুণ্য গ্রহণ করে নবযৌবন সম্পন্ন হলেন।
তারপর রাজা যযাতি যুবকের মত নবকলেবর ধারণ করে কামাসক্ত হয়ে ঐ নারীর ধ্যান করতে করতে কামসরোবরে গমন করলেন। অশ্রুবিন্দুমতী সেই সরোবরেই ছিলেন। পরমানন্দে যযাতি তার সখীকে বললেন–জরা ত্যাগ করে, তরুণ দেহ ধারণ করে আমি এসেছি। তোমার সখী এখন আমার ভজনা করুক।
বিশালা বলল–হে মহারাজ, আপনি জরা ত্যাগ করে এসেছেন, কিন্তু একটি দোষে আমার সখী আপনাকে মনোনীত করছেন না, আপনার দুই ভাৰ্য্যা বর্তমান। আপনি কিভাবে এর বশীভূত হবেন? অগ্নিতে প্রবেশ কিংবা পর্বত শিখরে থেকে পতনও ভাল, তবুও সপত্নী বিষসংযুক্ত স্বামী গ্রহণ করা উচিত নয়। আপনি গুণের সাগর হলেও আপনাকে কান্ত বলে মনে করা যায় না।
রাজা বললেন–আমি কখনই ভাৰ্য্যান্তর সঙ্গ করব না। এই প্রতিজ্ঞা করছি আমি।
তখন অশ্রুবিন্দুমতী বললেন–হে রাজন, এই অঙ্গীকারে আমি আপনার ভাৰ্য্যা হলাম। রাজা যযাতি এই কথা শুনে পরম আনন্দে তাকে গান্ধবর্মতে বিবাহ করলেন। তারপর তিনি সেই কামিনীর সঙ্গে বনে, উপবনে, সমুদ্রতটে বিংশতি সহস্র বৎসর সুখে বিহার করলেন।
তারপর রাজা অশ্রুবিন্দুমতীর ইচ্ছায় পুত্র পুরুকে দিয়ে মহাযজ্ঞ সম্পাদন করলেন। এবার কামকন্যা ইন্দ্রলোক, ব্রহ্মলোক, শিবলোক আর বিষ্ণুলোক দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলে মহারাজ যযাতি বললেন–প্রিয়ে, তুমি কৌতুকবশে যা অভিলাষ করেছ, আমার পক্ষে তা অসাধ্য, পুণ্য। দান, যজ্ঞ ও তপস্যা দ্বারাই এটি সাধন করা যায়। মর্তে এখন কোন ব্যক্তিকে আমি দেখিনি, যিনি মর্ত থেকে সশরীরে স্বর্গে গেছেন, তোমার অন্য কোন অভিলাষ থাকলে আমাকে বল, আমি অবশ্যই তা পূরণ করব।
তার উত্তরে কামপুত্রী বললেন–আমি যা প্রার্থনা করেছি অন্যের কাছে তা অসাধ্য হলেও, আপনার কাছে তা অসাধ্য নয়। হে নৃপতি, তপস্যায়, যশস্বিতায়, বীর্য্যে, দানে, যজ্ঞে আপনার মতো মানুষ, এই মর্ত্যে আর একজনও নেই। আমি যা বলব তা আপনি করবেন, এই অঙ্গীকার করে আমাকে গ্রহণ করেছেন। এখন সেই অঙ্গীকার রক্ষা করছেন না কেন? এই কারণে আমি আপনাকে পরিত্যাগ করে পিতৃগৃহে যাব।
রাজা বললেন–আমার কথিত বিষয় নিশ্চয় পালন করব, কিন্তু কেমন করে আশ্চৰ্য্য সাধন করব? আমার যা সাধ্য তা বল, আমি নিশ্চয় তা করব।
তার উত্তরে অশ্রুবিন্দুমতী বললেন–হে নরেশ, আমি আপনার বশীভূত হয়েছি এই আশা করেই, যে আপনি সর্বলোক গমন করতে পারবেন। আপনি সকল গুণসম্পন্ন। এই আশাতেই আমি আপনাকে স্বামীরূপে বরণ করেছি। যার প্রতি বিষ্ণু প্রসন্ন আছেন, সে সর্বত্রই ভ্রমণ করতে পারে। আপনি যম ও ইন্দ্রের সঙ্গে বিরোধ করে এই মর্ত্যকে ব্যাধি ও পাপহীন করেছেন। তাই আপনার মত নৃপতি এই জগতে আর নেই।
যযাতি বললেন– হে প্রিয়ে, তোমার বাক্য সত্যি, আমার সাধ্য কিছুই নেই। শ্রীহরির কৃপায় সমস্ত সুলোকই আমার সাধ্য। আমার স্বর্গে যাওয়ার ইচ্ছা নেই একটি কারণে। স্বর্গে গেলে দেবগণ আমাকে আর মর্তে ফিরতে দেবেন না। আর আমি যদি না আসি তাহলে আমার বিরহে সমস্ত প্রজা মৃতবৎ হবে।
কামকন্যা বললেন–আপনি আমায় ইষ্টলোক দেখিয়ে আবার মর্ত্যে আসবেন।
তখন যযাতি চিন্তা করলেন–মানুষকে কালই কামে নিয়োগ করে কাল মানবকে দাতা, আবার কখনও যাচক করে। মন্ত্র, তপ, দান, মিত্র, কেউই কাল কবলিত মানবকে রক্ষা করতে পারে না। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ–এই তিনটি যেখানে যখন যার দ্বারা সংঘটিত হবে, তার অন্যথা কখনও হবে না। সংসারে কর্মই সব। কর্মই পুরুষকে সুখ-দুঃখে প্রেরণ করে। স্বকৃত সুখ-দুঃখ সকলেই ভোগ করে।
চিন্তিত রাজা যযাতিকে তখন রতিকন্যা অশ্রুবিন্দুমতী বললেন–হে রাজন, সব স্ত্রীলোক চপল হয়। কিন্তু আমি চপলতাবশে আপনাকে এভাবে পরিচালিত করছি না। আমার দেবলোক দর্শনের প্রবল ইচ্ছা। দেবদর্শন মানুষের পক্ষে দুর্লভ, কিন্তু মহাপুণ্যপদ, এতে যদি আপনার দুঃখ হয়ে থাকে, তাহলে থাক্ আর আমি বলব না। আপনাকে স্বর্গে যেতে হবে না। আমি এমন কাজ করব না যাতে আপনার দুঃখ হয়।
তখন যযাতি বললেন–হে দেবী, আমি চিন্তা করছি যে, আমি যখন স্বর্গে যাব, তখন আমার প্রজাবৃন্দ দীন হয়ে যাবে। দুরাত্মা শামনরাজ ব্যাধির দ্বারা তাদের ত্রাস সৃষ্টি জন্মাবে। যাই হোক, তোমার সঙ্গে আমি স্বর্গে যাব।
এই কথা বলে মহারাজ যযাতি তার জরাগ্রস্ত পুত্র পুরুকে ডেকে বললেন–হে পুত্র, তুমি এতদিন আমার জরা গ্রহণ করে অনেক কষ্ট ভোগ করেছ, আর তোমার তারুণ্য গ্রহণ করে আমি বহুকাল সুখভোগ করলাম। এখন এস, তুমি তোমার তরুণ্য গ্রহণ কর, আর আমি আমার জরা ফিরিয়ে নিই। আমার রাজ্যের অধিকারী হবে তুমি। ধর্ম অনুসারে প্রজাপালন করবে। দুষ্টের দমন ও সাধুর সেবা করবে। ত্রিজগতের পুজ্য ব্রাহ্মণদের ভক্তিভরে পালন করবে। বিচক্ষণ ব্যক্তির সঙ্গে মাঝে মাঝে নিজ কোষাগার পর্যবেক্ষণ করবে। প্রসাদ, ধন ও ভোজন দানে নিত্য নিজের সৈন্যদের সম্মানিত করবে। সব দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবে। নিজে সংযতাত্মা থাকবে। কখনও মৃগয়ায় গমন করবে না। স্ত্রীজন ও মহাবলশালী ব্যক্তিকে কখনও বিশ্বাস করবে না। যজ্ঞের দ্বারা শ্রীহরির অর্চনা করবে। প্রজাদের সুখ সুবিধার কথা সব সময় চিন্তা করবে। পরধন আর পরদারে কখনও লোভ করবে না। পূর্বপুরুষদের সব সময়ে অনুসরণ করবে। সর্বদা তুমি বেদ ও শাস্ত্র আলোচনা করবে।
মহামতি যযাতি পুত্র পুরুকে জ্ঞানমূলক বহু উপদেশ দান করে আশীর্বাদ করে তাকে রাজসিংহাসনে বসালেন। তারপর প্রজাদের আহ্বান করে আনন্দের সঙ্গে বললেন–হে প্রজাবৃন্দ আপনারা, সুখে কাল যাপন করুন, আমি আমার পত্নীর সঙ্গে স্বর্গলোক, ব্রহ্মলোক, শিবলোক এবং সবশেষে বৈষ্ণবলোকে গমন করব।
রাজার এই কথা শুনে প্রজারা দুঃখে ভেঙে পড়ল। তারা বলল–হে মহামতি রাজাধিরাজ আপনি যেখানে থাকবেন, আমাদেরও সঙ্গে সেখানে নিয়ে চলুন। আপনি বিনা আমাদের জীবনধারণের প্রয়োজন নেই। আপনি যেখানে সেখানেই আমাদের পরম সুখ। আমরা আপনার সঙ্গেই গমন করব। মহারাজ যযাতি প্রজাদের এমন কথা শুনে তাদের সবাইকে নিয়ে স্বর্গে গমন করলেন। ঋষিগণ, চারণগণ মহামতি যযাতির স্তব করতে লাগল। সবার সঙ্গে যযাতি যখন ইন্দ্রলোকে উপস্থিত হলেন, তখন দেবতা গন্ধর্ব ও চারণগণের সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্র তার সামনে এসে উপস্থিত হয়ে তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর যযাতি ব্রহ্মলোক, রুদ্রলোক এবং বিষ্ণুলোকে গমন করলেন, সর্বত্রই তিনি পরম সম্মানিত হলেন।