নন্দীশ্বরের কাহিনি
মানবের জন্ম হয় পুরুষ ও নারীর মিলনের ফলে। সকলেই মৃত্যুমুখে পতিত হয় শৈশব, বাল্য, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য ইত্যাদি অতিক্রম করার পর। যার জন্ম হল, একদিন তার মৃত্যু হবেই।
মহাত্মা শিলাদ মনে মনে চিন্তা করলেন–আমি এভাবে পুত্রসৃষ্টি না করে শিবকে তপস্যার দ্বারা সন্তুষ্ট করে অযোনিজ ও মৃত্যুহীন পুত্র লাভ করব। এই চিন্তা করে শিলাদ মহাদেবের আরাধনা করে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। নিশ্চলভাবে বসে সহস্র যুগ কেটে গেল, তাঁর দেহ বল্মীক অর্থাৎ উইপোকায় ঢেকে গেল। এর ফলে তার বদলে কেবল উইমাটি দেখা যেতে লাগল। বজ্রকীট সূচীমুখ রক্তকীটেরা তার দেহের রক্ত ও মাংস খেয়ে নিঃশেষ করার ফলে তিনি মাংসহীন রক্তহীন হয়ে এমন তপস্যায় নিমগ্ন থাকলেন যে, নিজের দেহের এমন অবস্থার কথা তিনি জানতেও পারলেন না। কেবলমাত্র দেহের অস্থিগুলিই রইল।
সহস্র যুগ কেটে যাবার পর মহাদেব উমা ও তার গণের সঙ্গে সেই বিপ্র শিলাদের কাছে উপস্থিত হয়ে স্পর্শ করলেন তাকে। তারপর বললেন–তোমার তপস্যায় আমি তুষ্ট বিপ্র, তোমার মনোমত বর। চাও।
শিবের স্পর্শে শিলাদ আবার পূর্ব শরীর লাভ করলেন। তারপর চোখ মেলে মহেশ্বরের অপূর্ব মূর্তি দেখতে পেয়ে প্রণাম জানিয়ে বললেন–হে দেব, আপনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে অযোনিজ ও মৃত্যুহীন পুত্র দান করুন।
মহাদেব বললেন–কেউ এ জগতে অমর নয়। একদিন না একদিন সবার মৃত্যু হবে। মৃত্যুঞ্জয় একমাত্র আমি অর্থাৎ আমার মরণ নেই। আমি তুষ্ট তোমার তপস্যায়। তাই তোমার পুত্ররূপে আমি জন্ম নেব। পুত্রলাভের জন্য এক যজ্ঞ কর তুমি। তোমার আযযানিজ পুত্ররূপে সেই যজ্ঞেই আমি উৎপন্ন হব। আমার নাম রাখবে নন্দী। তাতে আমার ও জগতের পিতা হবে তুমি।
শিব এই কথা বলে সগোষ্ঠী অন্তর্হিত হলেন। শিবকে পুত্ররূপে পাওয়ার আশায় শিলাদ যজ্ঞ করলেন। প্রলয়ের অগ্নিসদৃশ এক শিশুর উদ্ভব হল সেই যজ্ঞ থেকে। আকাশ থেকে সেই সময় মেঘেরা আনন্দে বর্ষণ শুরু করল। সিদ্ধ-সাধ্যগণ পুষ্প বৃষ্টি করতে লাগল।
সেই শিশু কাল-সূর্যসম, ত্রিনয়ন, চতুর্ভুজ, জটামুকুটধারী, হীরক কুণ্ডলধারী, হীরক বর্মাবৃত। শূল টঙ্ক-গদা হাতে। সেই শিশু গর্জন করতে লাগল মেঘের মতো। ব্রহ্মা, ইন্দ্রাদি দেবতাগণ আর মুনীন্দ্রগণ সকলেই শিলাদের যজ্ঞাগারে উপস্থিত ছিলেন। তারাও সেই শিশুর স্তব শুরু করলেন। শিলাদত্ত এমন অদ্ভুত পুত্রলাভ করে প্রীতিভাবে প্রণাম করে তাঁর স্তব করতে লাগলেন।
তখন শিলাদ বললেন–হে দেব, আপনি আমার পুত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছেন এবং আমাকে ও সারা জগতকে দুঃখ থেকে রক্ষা করবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। হে সর্বজ্ঞপুত্ৰ, যেহেতু আপনি জগতের রক্ষক তখন আমারও পিতা। যেহেতু আমি আপনার দ্বারা আনন্দ লাভ করেছি, তাই নন্দী নামে আপনি জগতে খ্যাত হবে। হে দেব, আপনাকে পুত্ররূপে জ্ঞান করে যা যা আমি বলেছি তা আমার প্রতি সদয় হয়ে ক্ষমা করুন।
তারপর শিলাদ মুনিগণের উদ্দেশ্যে বললেন–হে মুনিগন, আমি অতি ভাগ্যবান যে স্বয়ং মহেশ্বরকে আমি পুত্র রূপে লাভ করেছি। আমার জন্ম সার্থক। এই কথা বলে তিনি নন্দী’ কে কোলে নিয়ে নিজের কুটিরে প্রবেশ করলেন। ধনলাভ করে নির্ধন যেমন আনন্দ পায়, তেমনি মহেশ্বরকে পুত্ররূপে পেয়ে শিলাদ আনন্দ লাভ করলেন।
নন্দী শিলাদের কুটিরে প্রবেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যে দৈবদেহ ত্যাগ করে মানুষের রূপ ধরল এবং ঈশ্বরের ইচ্ছায় নন্দীর দৈব-স্মৃতিও লোপ পেল। পুত্রের এমন রূপ পরিবর্তন দেখে শিলাদ ও তার আত্মীয় স্বজনেরা কিছুক্ষণ কাঁদল।
সবই ভগবানের ইচ্ছা এই চিন্তা করে শিলাদ বৈদিক ব্রাহ্মণগণের দ্বারা পুত্রের জাত-কর্মাদি সম্পন্ন করালেন। নন্দী বড় হয়ে সকল রকমের শাস্ত্র শিক্ষা লাভ করলেন। চারিবেদ, ধনুবেদ, গন্ধর্বশাস্ত্র, অশ্বলক্ষণ, হস্তীচরিত, নরলক্ষণ প্রভৃতি উপদেশ দিলেন শিলাদ।
নন্দীকে দেখবার জন্য শিলাদের কুটিরে মিত্রাবরুণ নামে দুজন মুনি একদিন এলেন। ভালোভাবে সেই বালককে নিরীক্ষণ করার পর তারা শিলাদকে বললেন–হে বিপ্র, এই পুত্রকে আমরা অল্পায়ু বলে মনে করছি। সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত হলেও এই পুত্র এক বছরের বেশি বাঁচবে না।
শিলাদ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মিত্র ও বরুণের কথা শুনে। একি? যজ্ঞে মৃত্যুহীন পুত্র লাভের কথা স্বয়ং মহাদেব বলেছেন। দুই মহর্ষি এখন কি বলছেন? তারপর পুত্রকে আলিঙ্গন করে শিলাদ আক্ষেপ করে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
তার আত্মীয়স্বজনেরাও শিলাদের অবস্থা দেখে কাঁদতে লাগল। উমাপতি শঙ্করের স্তব করলেন। অযুত সংখ্যায় দূর্বা মধুসিক্ত করে হোম করলেন। পৌত্রের মৃত্যু আশঙ্কায় শিলাদের পিতাও মূর্ছা গেলেন। এই দেখে নন্দী তাদের এবং নিজে মৃত্যু ভয়ে সেই মৃতবৎ পিতাও পিতামহকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করতে লাগল। আপন হৃদয়ে দশভূজ পঞ্চানন শিবের ধ্যান করতে লাগল।
নন্দীর প্রতি তুষ্ট হয়ে মহাদেব বললেন–তোমার মৃত্যুভয় কেন হে বৎস নন্দিন? তোমার পার্থক্য নেই। বিপ্রদ্বয়কে আমিই পাঠিয়েছি। আমার অতি প্রিয় গণপতি হবে তুমি। আমার মত বীৰ্য্যবান ও পরাক্রমী হবে। আমার পাশে সবসময় তুমি থাকবে।
এই কথা বলে মহেশ্বর তার পদ্মমালাটি নন্দীর গলায় পরিয়ে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে নন্দীর তিনটি চোখ এবং দশটি হাতের সৃষ্টি হল।
বৃষধ্বজ শিব তার জটা থেকে জল গ্রহণ করে এই জল নদীরূপে প্রবাহিত হোক বলে পরিত্যাগ করলে সেই জল নদীরূপ ধারণ করল। মহেশ্বর তার নাম রাখলেন ‘জটোদশ।
মহাদেব নন্দীকে ‘তোমার এই পুত্র’ বলে উমার সামনে আনলে, দেবী পার্বতী নন্দীর মস্তক চুম্বন করে তাঁর গাত্র স্পর্শ করলেন। তখন দেবীর পুত্রস্নেহের কারণবশতঃ স্তনদ্বয় হতে ত্রিস্রোতাকারে শ্বেতবর্ণ দুগ্ধে নন্দীকে অভিষিক্ত করলেন। দেবীর সেই স্তনদুগ্ধের স্রোতত্রয়কে মহাদেব ত্রিস্রোতঃ নামে অভিহিত করলেন। নন্দীকে দেখে শিবের বৃষ আনন্দে উচ্চঃস্বরে শব্দ করলে বৃষনাদ সস্তৃতারূপে আর এক নদীর উৎপন্ন হল। শিব তার নাম রাখলেন বৃষধ্বনি। স্বর্ণের্দকা ও জাম্বু নামে দুটি নদীর সৃষ্টি হল। এই পঞ্চনদীর জল নিয়ে মহেশ্বরের পূজা যে করবে, সে শিবের সাযুজ্য ও মুক্তি লাভ করবে।
উমার অনুমতি নিয়ে নন্দীকে গণেশ্বর পদে অভিষিক্ত করার জন্য মহেশ্বর সকল গণপতিকে স্মরণ করলেন। মহেশ্বর নন্দীশ্বরকে গণ-সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করবার কথা সকলকে জানালে, আনন্দে সেইসব গণপতিগণ সকল কিছু সংগ্রহ করলেন। সুন্দর একটি মণ্ডপ নির্মাণ করে কলস, ক্ষুদ্র ঘণ্টিকা, পাদপীঠ প্রভৃতি দ্বারা সজ্জিত করা হল। বিভিন্ন তীর্থের জল, শঙ্খ, ব্যজন দেবভোগ্য, বস্ত্রযুগল, হার, ছত্র, কেয়ুর, কুণ্ডল প্রভৃতি আনা হল। দেবতা, ঋষি, ব্রহ্মা ও তার মানসপুত্রেরা সমবেত হলেন সেখানে।
পিতামহ ব্রহ্মা মহেশ্বরের আজ্ঞায় নন্দীশ্বরকে পঞ্চনদীর জলে স্নান করিয়ে অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন করলেন। তারপর বিষ্ণু, ইন্দ্র এবং লোকপালকগণও নিয়মানুসারে নন্দীশ্বরের অভিষেক কার্য সম্পন্ন করলেন।
এইভাবে শিবের সেনাপতি পদে অভিষিক্ত হলেন শিলাদের পুত্র নন্দীশ্বর। মরুতের কন্যা দেবী সুযশাকে পিতামহের অনুমতিক্রমে বিবাহ করলেন। যৌতুক হিসাবে লাভ করলেন–উত্তম সিংহাসন, সুবিমলছত্র, চামরধারিনী বহু পরিচারিকা প্রভৃতি। দেবী মহালক্ষ্মী মুকুটাদি সুমনোহর ভূষণে ভূষিত করলেন।
শিবের অনুগ্রহে আজ পর্যন্ত কোথাও এই নন্দীর সদৃশ বিভু উৎপন্ন হয়নি। তারপর পার্বতী ও নন্দীকে নিয়ে মহাদেব বৃষের পৃষ্ঠে চড়ে কৈলাসে উপনীত হলেন।