বলাসুরের দেহ থেকে সৃষ্ট রত্নরাজি
মহাবলশালী এক অসুর, নাম “বল”, দেবতাদের সঙ্গে তার প্রবল যুদ্ধ হল। সে অধিকার করে নিল দেবতাদের সিংহাসন ও সম্পত্তি। জাতে দানব, কিন্তু ধর্মে ছিল তার প্রবল জ্ঞান। কেউ তার কাছে গিয়ে সাহায্য ভিক্ষা করলে, বিমুখ হয়ে ফিরে আসত না।
দেবতারা সকলেই স্বর্গচ্যুত। কীভাবে হৃত সিংহাসন ফিরে পাওয়া যায়, তাই নিয়ে সভা ডাকা হল। চলল জল্পনা কল্পনা। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর স্থির করা হল, যেভাবেই হোক বলের প্রাণভিক্ষা চাইতে হবে।
দেবতারা সদলবলে অসুর বলের কাছে এসে দাঁড়ালেন।
বল তাঁদের দেখে অত্যন্ত প্রসন্ন হল। উৎফুল্ল চিত্তে জানতে চাইল–হে দেবতাগণ, বলুন, কী কারণে আমার কাছে আপনাদের আগমন?
–আমরা সকলে মিলে একটা যজ্ঞ করার মনস্থ করেছি।
দেবতাদের জবাব শুনে অসুর বলল–তাতো খুব ভালো কথা। উত্তম কথা। শুনে আনন্দিত হলাম। বলুন কী দিতে হবে আমায়, দ্বিধা করবেন না।
বলের এহেন কথা শুনে দেবতারা একটু বুকে বল পেলেন। সাহসে ভর করে জবাব দিলেন– হে অসুররাজ, কিছু মনে করবেন না, আসলে আমরা সব জিনিস জোগাড় করে ফেলেছি, কেবল ওই একটা ছাড়া, তাই আপনার কাছে আমাদের আগমন।
–বলুন, কী সেই জিনিস? আমি কথা দিচ্ছি, আপনাদের যজ্ঞের সব উপকরণ আমি দেব।
–জানেন তো, উত্তম বলি ছাড়া যজ্ঞ পূর্ণতা লাভ করে না। দেবতারা. বলতে থাকলেন, শাস্ত্রে বলেছে, ধার্মিক জনের দেহ যজ্ঞে বলি হলে, সেই যজ্ঞ সার্থক হয়। তাই এই কাজের জন্য আপনার প্রাণ আমরা প্রার্থনা করছি।
দেবতাদের ছল বুঝতে পারল অসুররাজ বল। তথাপি তিনি নিজেকে ওই যজ্ঞে উৎসর্গ করতে আপত্তি করল না। প্রফুল্ল চিত্তে যজ্ঞানুষ্ঠানে এসে হাজির হল।
পরম পুণ্যাত্মা বল। দেবতাদের মঙ্গলের জন্য যুপকাষ্ঠে মাথা গলিয়ে দিল বলির জন্য। দুনিয়াতে এমন দাতা পাওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। বলাসুর দেহ দান বৈকুণ্ঠ ধামে যাত্রা করল। পড়ে রইল তার দেহ। তার প্রতিটি অঙ্গ প্রতঙ্গ থেকে জন্ম নিল এক একটি রত্ন।
অসুরের মৃতদেহ নিয়ে দেবতারা বিমানে চড়ে আকাশপথে ভ্রমণ করলেন। তার দেহ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পৃথিবীর সমুদ্র, পর্বত, নদ, হ্রদ, বন, উপবন, সমভূমি, প্রতিটি স্থলে পড়ল। যেসব জায়গায় বলির দেহাংশ পড়ল সেখানে সৃষ্টি হল এক-একটি রত্নের খনি। পদ্মরাগ, ইন্দ্রনীল, বৈদুৰ্য্য, পুলক, স্ফটিক, মণি, প্রবাল, পুষ্পরাগ, মুক্তো, মরকত ইত্যাদি রত্নরাজি।
অতি উজ্জ্বল প্রভামুক্ত মণির নাম হীরক বা বজ্র! অসুরের অস্থিকণা থেকে সৃষ্টি হল বজ্র। বিভিন্ন অঞ্চলে ওইসব বজ্র বা হীরক পড়ল। তাদের বিভিন্ন রং ও আকার। তীক্ষ্ণধার যুক্ত হীরার খনি যেখানে আছে, সেই অঞ্চল মহাপুণ্যস্থান হিসেবে সুবিদিত। এ হল দেবতাদের বাসভূমি। হীরার বর্ণানুসারে জাতি-ভেদ হয়। হরিবর্ণ হীরায় শ্রীহরির বাস। তাম্রবর্ণ হীরায় পবনের আসন, পিঙ্গলে অগ্নি থাকেন। পীতবর্ণ হীরাতে ইন্দ্র বিরাজ করেন। যম থাকেন শ্যামবর্ণ বজ্রে। রক্তের ন্যায় লাল বা হরিদ্রা রঙের মতো হীরা রাজা রাজরারা ব্যবহার করে থাকেন।
সম্পদ দানকারী হীরা গুণযুক্ত আর যে হীরা খারাপ, তা ব্যবহারে দুঃখ ভোগ হয়। অশেষ গুণের অধিকারী অথচ এক শৃঙ্গ এবং বিশীর্ণ, এমন হীরা ধারণ করলে সর্বনাশ অনিবার্য। বজ্ৰ শৃঙ্গ অগ্নিদগ্ধ, স্ফুটিত হলে কিংবা মধ্যস্থলে যদি বিশীর্ণ হয়, কিংবা কিছুচিহ্ন যুক্ত হয়, তাহলেও তা ধারণ করা উচিত নয়।
বর্তমানে হীরার বদলে কাঁচের ব্যবহার হচ্ছে, হীরা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাই সঠিক হীরা যাচাই করে নেওয়া উচিত।
বলাসুরের মাংসখণ্ড, হস্তী, মেঘ, শঙ্খ, মৎস্য, সর্প, বাঁশ ও শুক্তিকে পড়ে মুক্তোর সৃষ্টি করেছে। এসবের মধ্যে শুক্তিতে যে মুক্তো সৃষ্ট হয়, তা হল অন্যতম। শুক্তিজ মুক্তো ছাড়া আর কোনো মুক্তো বিদ্ধ করা যায় না। এই ধরনের মুক্তো উজ্জ্বলও হয়। তবে সব ধরনের মুক্তোই মঙ্গলদায়ক। সর্পমুক্তো গৃহে রাখলে সাপের বা রাক্ষসের উৎপাত হয় না। মেঘ থেকে সৃষ্ট মুক্তো পৃথিবীর মানুষ পায় না, তা দেবতারাই গ্রহণ করে। মেঘমণি যেখানে থাকে, তার সহস্র যোজনের মধ্যে অমঙ্গল প্রবেশ করতে পারে না।
অন্নের পাত্রে রেখে জামরসে ভিজিয়ে পাক করে ভেলার মূলে ঘষলে, মুক্তো বিশুদ্ধ হয় এবং তার উজ্জ্বলতা বাড়ে। মাছের পেটের মধ্যে মুক্তোকে রেখে কাদা মাখিয়ে পুড়িয়ে দুধ বা জলে পাক করলে সুচিকণ মুক্তো পাওয়া যায়। পরে পরিষ্কার কাপড়ে ঘষে নিলে উজ্জ্বলতা আসে।
মুক্তো ব্যবহার করার আগে খাঁটি কিনা যাচাই করে নেওয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে লবণ মেশানো জলে একরাত মুক্তো ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর শুকনো কাপড় নিয়ে ঘষে ঘষে মুছে ফেলতে হয়। তারপর শুকনো কাপড়ে জড়িয়ে রাখতে হয়, যদি মুক্তো মলিন না হয়, তাহলে জানবেন এটা খাঁটি।
শ্রেষ্ঠ মুক্তো চেনার উপায় সম্পর্কে বলা হয়েছে–শ্বেতবর্ণ, স্বচ্ছ, নির্মল, বৃহৎ প্রমাণ, স্নিগ্ধ, ভারী, উজ্জ্বল ও বৃত্তাকার মুক্তোই অন্যতম সেরা। এই ধরনের মুক্তো অনর্থ দূর করে।
রত্নবীজ বলাসুরের রত্ন নিয়ে আকাশে ফিরে যেতে গিয়ে বাধা পেলেন সূর্যদেব। লঙ্কেশ্বর রাবণ তেড়ে এলেন। সূর্য ভীত হয়ে সেই রক্ত লঙ্কার এক নদীতে ফেলে দিলেন। নদীটির নামকরণ করা হল রাবণ গঙ্গা। নদীর তীরে জাত বহু রত্নরাজির মধ্যে আছে পদ্মরাগ, সৌগন্ধিক, স্ফটিক, এছাড়া আরও নানাধরনের বহু মূল্যবান মণি। পদ্মরাগ মণি নানা প্রকারের। স্ফটিক সূর্যের আলো পড়লে কাছাকাছি সকল বস্তুই দীপ্ত হয়। সৌগন্ধিক মণিতে ঈষৎ নীলের আভা আছে। কুরুবিন্দ মনি বর্ণহীন।– তাই তার রঙের ছটা দেখা যায় না।
দোষমুক্ত মণি অর্থাৎ ছিদ্রযুক্ত, মলিন, অমসৃণ, অনুজ্জ্বল–এই ধরনের মণি ধারণ করলে রোগ শোক ভোগ করতে হয়। এমনকি প্রাণনাশ পর্যন্ত হতে পারে। তাই ত্রুটিপূর্ণ মণি ব্যবহার না করাই শুভ। পদ্মরাগ মণি শত্রুর বিনাশ ঘটায়।
নাগরাজ বাসুকি বলাসুরের পিত্ত নিয়ে ফিরে যাওয়ার উপক্রম করলেন। গরুড় তা দেখতে পেয়ে পাখা বিস্তার করে তার পথ আটকে দিলেন। বাসুকি তাড়াতাড়ি সেই পিত্ত ফেলে দিলেন সাগরে। সেই পিত্ত থেকে জাত হল মরকতের, গরুড় সেই পিত্তের সামান্য কিছুটা গ্রহণ করে জ্ঞান হারালেন। সেই পিত্ত তার নাকের ছিদ্র দিয়ে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। সেখানেও সৃষ্টি হল মরকত মণির। যে মরকত মণির ছটা তির্যকভাবে পড়ে, সেই মণি ধারণ করলে যুদ্ধে জয় অনিবার্য, কিন্তু মণির তেজ চিরকাল স্থায়ী থাকে না।
বলাসুরের চোখ থেকে সৃষ্টি হল ইন্দ্রনীল মণি।
দেহত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্তে, অসুররাজ এক বিকট গর্জন করেছিল, যা থেকে পুষ্পরাগ মণি জন্মায়। আর হল বৈদুর্য মণি। কর্কেচল মণির জন্ম দিল অসুরের নখ। এই মণি সর্বপাপ হরণকারী, পরমায়ু দানকারী।
অসুরের বীর্য থেকে সৃষ্ট ভীষ্মক মণি কণ্ঠে ধারণ করলে সম্পত্তি লাভ হয়। হিংস্র জন্তু-জানোয়ার দুরে চলে যায়। এই মণি সর্বপাপ হরণকারী, পরমায়ু দানকারী।
এই মণি ধারণ করে পিতৃতর্পণ করলে পিতার কুল বহুবর্ষ তৃপ্তি লাভ করে। সাপের সাহায্যে বলাসুরের নিপতিত নখ স্থানে স্থানে ছড়িয়ে পড়ল। যেখানে যেখানে পড়ল সেখানে অপূর্ব চিত্রিত ও উজ্জ্বল পুলক মণির জন্ম হল। এই মণি মঙ্গল ও শুভবুদ্ধিদায়ক। অসুরের ত্বকে জন্ম দিল ইন্দ্রপোপ মণি, এটি নর্মদা প্রদেশে পড়েছিল। বলাসুরের মেদ নিয়ে গেলেন হলধর রাম। নেপাল ও চীন দেশে তা পড়ল। সৃষ্টি হল স্ফটিক, যাকে মহামণি বলা হয়। বিদ্রুম মণির জন্ম দিল বলাসুরের অস্ত্র। এই মণি ধারণ করলে ধনশালী হওয়া যায়।