মিত্রবরুণ ও অগস্ত্যের কাহিনী
দেবতা কিম্বা দানব কেউই সাধারণতঃ মুনিঋষিদের প্রতি বিরূপ বা কোন রকম হিংসা করেন না। কিন্তু এক সময়ে দানবদের অত্যাচারে মুনি-ঋষিরা একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন।
তখন ত্রিভুবনের রাজা ইন্দ্র, অগ্নিদেব আর বরুণদেবকে সেই দানবদের দমনের জন্য পাঠালেন। অগ্নি প্রলয়কারী রূপ ধরে আগে আগে চললেন আর তার পিছে পিছে পবনদেব প্রলয়বেগে চললেন। দানবপুরীর ঘরবাড়ি, বন-উপবন, সব কিছু সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। দানবরাও সেই আগুন থেকে রেহাই পেল না।
তখন তারক, বিরোচন, কমলাক্ষ প্রভৃতি প্রধান কয়েকজন অসুর প্রাণভয়ে ভীত হয়ে সমুদ্রে দুর্গ তৈরি করে বাস করতে লাগল।
তখন অসুরদের অত্যাচার থেকে মুনি-ঋষিরা বাঁচলেন আর দেবতারাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কিন্তু অসুররা রাগে যখন তখন সমুদ্র থেকে বেরিয়ে এসে মুনি-ঋষিদের ওপর অত্যাচার চালাত। তারপর সমুদ্র দুর্গে আশ্রয় নিত। ইন্দ্র অসুরদের দমন করার চেষ্টা করেও বিফল হন।
এইভাবে বহুদিন কেটে যাবার পর, দানবদের অত্যাচার থামানোর জন্য আবার অগ্নি ও বায়ুকে পাঠালেন। বলে দিলেন–সমুদ্রের জল শুকিয়ে দিয়ে ওদের পুড়িয়ে মারবে। এই কথা শুনে অগ্নি ও বায়ু বুঝতে পারলেন যে এই কাজ করা সম্ভব নয়। তাদের চুপ থাকতে দেখে ইন্দ্র অবাক হয়ে বললেন–কি হল? তোমরা কেউ কিছু বলছ না কেন? আমার আদেশ অমান্য করতে চাও?
তখন অগ্নি ও পবন বললেন–হে দেবরাজ, আপনি সত্যিই কি আমাদেরকে সমুদ্র শুকিয়ে দেবার আদেশ করলেন? এই কথা শুনে ইন্দ্র রেগে গিয়ে বললেন–আমি কি তোমাদের ঠাট্টা-তামাসা করছি?
তখন পবন আর অগ্নি বললেন–দেবরাজ, আপনি কি ভেবে-চিন্তে আমাদের এই আদেশ দিলেন? বিশাল সমুদ্রের কোন কূল-কিনারা নেই। কত অসংখ্য প্রাণী সেখানে বাস করে। কয়েকজন অসুরকে মারবার জন্য, এই সব নির্দোষ প্রাণীদের হত্যা করার কোন প্রয়োজন আছে কি?
পবনদেব ও অগ্নির কথা শুনে ইন্দ্র রেগে গিয়ে বললেন–এত সাহস তোমাদের যে আমার কথার সমালোচনা কর। আমার আদেশ অমান্য করার জন্য যাও তোমরা মর্তে গিয়ে ঋষি হয়ে থাক। প্রাণীদের প্রতি তোমাদের যখন এত দয়া, রাজ আজ্ঞা অবমাননা করে অহিংসা ধর্মকে পালন করতে চাইছ। তাহলে যাও ঋষি হয়ে অহিংসা ধর্ম পালন কর। কিন্তু তোমাদের দেহ আলাদা হবে না। একই দেহে দুজনে থাকবে।
অগ্নি ও বরুণ দেবরাজের অভিশাপ মাথায় নিয়ে মর্ত্যে এলেন একই দেহে মিত্রাবরুণ নাম নিয়ে। এই মিত্রাবরুণের পুত্র হলেন অগস্ত্য মুনি। এক অদ্ভুত ভাবে জন্ম হয় এই অগস্ত্য মুনির।
ধর্মের ঔরসে নারায়ণ ঋষি নাম দিয়ে ভগবান বিষ্ণু জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বহুকাল গন্ধমাদন পর্বতে কঠোর তপস্যা করেন। ইন্দ্র তার তপস্যা দেখে ভয় পেয়ে ভাবলেন তার সিংহাসনে কেড়ে নেবার জন্য বুঝি নারায়ণ ঋষি তপস্যা করছেন। ইন্দ্র তার তপস্যা ভঙ্গ করবার জন্য মদনদেবকে আদেশ করলেন।
রতিপতি মদন তার দলবল নিয়ে তপস্যা ভঙ্গ করবার বহু চেষ্টা করলেন। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। নারায়ণ ঋষি নির্বিকার থাকলেন। নারায়ণ ঋষি যখন জানতে পারলেন যে, এ সবই স্বয়ং দেবরাজের কীর্তি, তখন তিনি নিজের ঊরু থেকে অপূর্ব একটি রমণীরত্ন সৃষ্টি করে ইন্দ্রকে উপহার দিলেন। তার নাম রাখলেন ঊর্বশী। এই উর্বশীকে দেখে মদনদেবেরও মাথা ঘুরে গেল।
মিত্রাবরুণ এই সময়ে সেই গন্ধমাদন পর্বতে ছিলেন। মহান সংযমী সেই দুই ঋষিও উর্বশীকে দেখে মোহিত হয়ে গেলেন। মিত্র আগে গিয়ে উর্বশীকে তার মনের কথা বললেন। উর্বশীর প্রতি নারায়ণ ঋষির আদেশ ছিল, যে ডাকবে তার কাছে সে যাবে, তাই উর্বশী মিত্রের ডাকে সাড়া দিল। তা দেখে বরুণ স্থির থাকতে না পেরে, তার আঁচল ধরে টানতে লাগলেন।
তখন উর্বশী বরুণকে বললেন–আমি আগে মিত্রের ডাক পেয়েছি। তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে তোমার কাছে ফিরে আসব। তখন বরুণ বাধ্য হয়ে উর্বশীকে বললেন–যাচ্ছ যাও, আমার কথা যেন ভুল না।
ঊর্বশী সম্মত হয়ে মিত্রের কাছে চলে গেল। কিন্তু উর্বশী বরুণকে এভাবে কথা দেবার জন্য মিত্রদেব ভীষণ রেগে গিয়ে তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন। কোন কথা না বলে চলে গেলেন উর্বশী। কিন্তু তাকে কামনার ফলে যে শক্তি সঞ্চিত হয়েছিল, সেই শক্তি এক জলভর্তি কুম্ভের মধ্যে গিয়ে পড়ল।
ঋষিদের বীৰ্য্য কখনও ব্যর্থ যায় না। তাতেই অগস্ত্যের জন্ম হল। কুম্ভের মধ্যে জন্মের কারণ তার এক নাম হল ‘কুম্ভজ’ বা ‘কুম্ভযোনি’। পরে এই অগস্ত্য সমুদ্রকে শোষণ করে অসুরদের সংহার করবার জন্য কঠোর তপস্যা করে মহাশক্তির অধিকারী হলেন।
এইভাবে সমুদ্র শোষণ হতেই অগ্নিদেব ও পবনদেব শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গলোকে ফিরে গিয়ে নিজ নিজ পদ অলঙ্কৃত করলেন।