ভাগবত পুরাণ – ০২য় স্কন্ধ

ভাগবত পুরাণ দ্বিতীয় স্কন্দ
প্রথম অধ্যায়
শুকদেবের উত্তর দান এবং ভগবানের বিরাট রূপ বর্ণনা

শুকদেব বললেন–মানুষের পক্ষে যাঁদের শ্রবণ এবং কীর্তনাদি করা উচিত, তাদের মধ্যে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ তার সম্পর্কে তুমি জানতে চেয়েছ। এ অতি উত্তম প্রশ্ন। কারণ এর দ্বারা লোকের কল্যাণ হবে, হে মহারাজ যারা আত্মতত্ত্ব অর্থাৎ নিজের স্বরূপ জানে না এবং স্ত্রী পুত্রাদিতে অনুরক্ত গৃহমোদী হয়, তাদের মঙ্গলের জন্য হাজার হাজার শুনবার মতো বিষয় আছে। তাদের রাত কাটে স্ত্রী সম্ভোগে, দিন কাটে অর্থ উপার্জনে এবং কুটুম্বের ভরণ পোষণে, নিজের সৈন্যের মতো দেহ স্ত্রী পুত্ৰাদি চিরস্থায়ী হয়

জেনেও তাতে আসক্ত থাকে তারা। তারা অবশম্ভাবী মৃত্যুকে অবলোকন করে না। হে পরীক্ষিত, সেজন্য পথে সকলের আত্মা ঈশ্বর এবং হরিকে সর্বদা শ্রবণ কীর্তণ স্মরণ করা উচিত। আত্মজ্ঞান, অষ্টাঙ্গ যোগ, নিজ বর্ণ ও আশুবিহিত ধর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারাই মনুষ্য জন্মের লাভের ফল পাওয়া যায়। মরণ সময়ে নারায়ণের শরণ হল শ্রেষ্ঠ ফল।

এই ভাগবত পুরাণ সকল বেদের সমকক্ষ। দ্বাপরের শেষ ভাগে পিতা বেদব্যাসের কাছে আমি তা অধ্যয়ন করেছি, হে রাজর্ষি, আমি নির্গুণ ব্রহ্মে পরিণিষ্ঠিত লীলা মৃতে আকৃষ্ঠ হয়ে ভাগবত প্রয়াণ অধ্যয়ন করি। তুমি পুরুষোত্তম বিষ্ণুর কৃপা লাভ করেছ। আমি তোমাকে ভাগবত পুরাণ বলব।

মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে মানুষ ভয় শূন্য হয়ে অনাসক্তির পুর শাস্ত্রের দ্বারা নিজের দেহ এবং দেহ সম্বন্ধীয় আশা ছিন্ন করবে। ধীর ব্রহ্মচর্যাদির দ্বারা সংযত পুরুষ গৃহ থেকে বহির্গত হবে। পবিত্র নির্জন স্থানে যথাবিধি কুশ ও মৃগচর্ম অর্থাৎ বস্ত্রা নির্মিত আসনে উপবিষ্ট হবে। অ-কার, উ-কার, এবং ম-কার, এই তিনটি অক্ষরে কথিত ব্রহ্মত্তর মন্ত্র মনে মনে অভ্যাস করবে। একে প্রণবমন্ত্র বলে। প্রণবমন্ত্র জপ করতে করতে প্রাণায়মের দ্বারা জিত শ্বাস হয়ে মনকে স্থির করবে। বুদ্ধিরূপ সারথির সাহায্যে মনের দ্বারা রূপাদি বিষয় থেকে চোখ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গণকে সংযত করবে। কর্মের দ্বারা বিক্ষিপ্ত মনকে নিশ্চয়ান্মিক বুদ্ধির দ্বারা পরম মঙ্গলের কারণে ভগবানের রূপ থেকে বিচ্ছিন্ন না করে ভগবানের চরণাদি এক-একটি অঙ্গের ধ্যান করবে। মনকে বিষয় চিন্তা থেকে মুক্ত করবে। আত্মাকে সমাধিস্থ করবে। মন স্থির হলে আর কিছু চিন্তা থাকবে না। ধীরযোগী রজঃ এবং তম গুণের দ্বারা শান্ত এবং বিমূঢ় মনকে সংযত করবে।

রাজা বললেন–হে ব্রাহ্মণ, কী প্রকারে ধারণা করতে হয় এবং যাতে ধারণা করা সম্ভব তা আমাদের বুঝিয়ে বলুন।

শুকদেব বললেন–স্বস্তিকা দেব আসন এবং প্রাণায়ামের দ্বারা নিঃশ্বাস জয় করবে। আসক্তি রহিত এবং জিতেন্দ্রিয় হবে। ভগবান হরি স্কুল রূপে বুদ্ধির দ্বারা মনকে যুক্ত করবে। ভগবানের এই অতীত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান কার্য মাত্র বিশ্ব প্রকাশ পাচ্ছে। সপ্ত আরোহণ যুক্ত ব্রহ্মাণ্ডে জীবের অন্তর্যামী যে ভগবান রয়েছেন তিনি ধারণার বিষয়। এই বিরাট পুরুষের পাদের অধোভাগ রসাতল। মহাতল এই সৃষ্টি কর্তার পদের গুমখাদেশ এবং তলাতল তার দুটি জঙ্ঘা।

বিশ্বমূর্তি ভগবানের জ্ঞান দুটি শীতল এবং বিতাল ও অতল তার রূদ্বয়। পৃথিবী তার জঙ্ঘা বা কটিদেশ, নাভি আকাশ, তাঁর বক্ষস্থল জ্যোতিসমূহ, মর্ত্যলোক গ্রীবা, জনলোক তার বদন। তপলোকে আদিপুরুষ, হিরণ্যগর্ভে ললাট এবং সত্যলোক সহস্র শীর্ষা সেই ভগবানের মস্তক।

ইন্দ্রাদি দেবগণ তার বাহু, দশদিক তাঁর বাহু, দশদিক তাঁর কর্ণর, শব্দ তার চক্ষুর ইন্দ্রিয়, রাত্রি এবং দিন তার নেত্রলোম সত্যলোক অর্থাৎ ব্রহ্মপদ তার ভ্রুকুটি, জল দেবতা করুণ এই আদিপুরুষের তালু এবং রস তার জিহ্বা। বেদসমূহ তার ব্রহ্মরন্ধ্র, যম শ্রেষ্ঠ দন্ত, পুত্রাদির স্নেহলেশ তার দন্ত পংক্তি। জনগণের উন্মাদকারী মায়া তার হাসি, অপার সংসার তার কটাক্ষপাদ। লজ্জা, তার উৰ্দ্ধত্তষ্ঠ লোভ তার অধোরষ্ঠ ধর্ম তাঁর স্নেহ এবং অধর্মের পথ তার পৃষ্ঠ দেশ। প্রজাপতি তার লিঙ্গ বরুণ তার দুটি অন্তকোষ, সমুদ্র তার উদার এবং পর্বত সমূহ তার অস্থিপুঞ্জ।

নেনুপেন্দ্র, নদী তার নাড়ি, ব্রহ্ম তার লোম, অসীম শক্তিশালী বায়ু তার নিশ্বাস, কাল তার গতি এবং সংসার প্রবাহ তার ক্রীড়া। হে কুরশ্রেষ্ঠ অধিপতি মেঘগুলি ঈশ্বরের কেশরাশি, সন্ধ্যা সে ধূমাপুরুষে বদ্ধ, প্রকৃতি তার হৃদয় এবং চন্দ্র তার বিকারের আশ্রয়ভূত মন। মহৎ তত্ত্ব সেই সর্বাত্মার বিজ্ঞান শক্তি ক্ষুদ্র তাঁর অহংকাল। অশ্ব, অশ্বতর উষ্ট্র, এবং হাতী, তাঁর নখ। মৃগ এবং পশুগণ তার কটি দেশ।

মানুষ তার আশ্রয়স্থল, মন তার বুদ্ধি, পক্ষীগণ তাঁর শিল্পনৈপুণ্য, গন্ধর্ব বিদ্যাধর চারণ এবং অঙ্গরা তার স্বর ও স্মৃতি, অসুরসৈন্য তার বল। ব্রাহ্মণ, তাঁর মুখ ক্ষত্রিয় তাঁর বাহু বৈশ্য তার উরু, শুদ্র তার চরণ তিনি বিভিন্ন নামধারী বসু এবং রুদ্র প্রভৃতি দেবগণে পরিবৃত। যজ্ঞ তার কাজ। হে মহারাজ ঈশ্বর শরীরের এই অবয়ব সংস্থানের কথা আমি তোমাকে বললাম। যোগীগণ তার নাম গান করে থাকে। জীব যেমন স্বপ্নে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনেক দেহকে প্রত্যক্ষ করে, তেমনই সকলের অন্তরাত্মা ঈশ্বর একাকী অনুভব করে থাকেন। ঈশ্বর ভিন্ন অন্যত্র মন আসক্ত হলে নিজের অধঃপতন হবে।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়
যোগীদের উক্রমণ প্রকার বর্ণন এবং সদ্য মুক্তি ও অমুক্তি নিরুপণ

শুকদেব বললেন– প্রলয় অবসানে আত্মজ্ঞানী ব্রহ্মা এই ধারণার দ্বারা ভগবান হরিকে তুষ্ট করেছিলেন। তিনি পূর্ব কল্পে সৃষ্টি স্থিতি লাভ করেছিলেন। প্রলয়ের আগে এই জগৎ যেমন ছিল আবার তেমনই সৃষ্টি করলেন। বেদ বিহিত কর্মমার্গ সুখমাত্র প্রদর্শন করিয়ে থাকে মানুষের বুদ্ধি সেই ব্যর্থ শর্তাদি সুখের কামনা করে বাসনার সাথে শয়ন করলে মিথ্যা স্বপ্নমাত্র দৃষ্টি হয়। মায়াময় সৃষ্টি হয় মায়াময় সংসারে পরিক্রমণ করে। সেই লোভ ও সুখ প্রাপ্ত হলেও মানুষ প্রকৃত সুখ না করতে পারে না। শরীর ধারণের জন্য যতটুকু দ্রব্যের প্রয়োজন, বুদ্ধিমান ব্যক্তি দ্রব্যের সেইটুকু অংশই গ্রহণ করেন। এতে যথার্থ সুখ নেই জেনে অনাসক্ত হবার চেষ্টা করবেন।

শরীর ধারণের উপযোগী দ্রব্যসকল বিনা চেষ্টাতেও লাভ করতে পারা যায়, তুমি যে সব জায়গাতে আছো। তাতে সুখে নিদ্রা হলে শয়নের জন্য কোমল শয্যার কী প্রয়োজন? স্বয়ংসিদ্ধ দুটি বাহু থাকতে মস্তক স্থাপনের জন্য বালিশের প্রয়োজন আছে কি? অঞ্জলিতে খাদ্যবস্তু রেখে আহার করতে পারা যায়, তবে বিবিধ অনুপাত্রের প্রয়োজন কী? যদি দিগম্বর হয়ে বা বল্কল পরিধান করে দেহ লজ্জা নিবারণ করা যায়, এর জন্যে পট্ট বস্ত্রের কী প্রয়োজন? পথে পথে কি বস্ত্রখণ্ড পড়ে থাকে না? বৃক্ষগুলি কি ফল আর ছায়া দান করে না? নদীসকল কি শুকিয়ে গেছে? পর্বত গুহাগুলির দুয়ার কি বন্ধ হয়েছে? শ্রীকৃষ্ণ তার শরণাগতকে সদা সর্বদা রক্ষা করেন।

কী জন্য বুদ্ধিমান ব্যক্তি অন্ধ জনগণের সেবা করবে? অতএব চিত্তের স্বত্ত্ব সিদ্ধ আত্মা প্রিয় সত্য ও অনন্ত রূপে যে ভগবান বিরাজমান, তারই সেবা করা কর্তব্য। বৈরাগ্যে নিশ্চল হয়ে পরম নিবৃত্তি লাভ করে ভগবানের ভজনে রত হলে সংসার হেতু অবিদ্যার বিনাশ হয়।

অতি বিরল কেউ কেউ নিজের দেহ মধ্যে হৃদয়ের যে আকাশ রয়েছে সেখানে অবস্থিত পদ্মচক্র শঙ্খ গদাধারী চতুর্ভুজ পুরুষের ধারণা স্মরণ করে থাকেন। ওই পুরুষের বদন প্রসন্ন। তার নয়নপদ্মের মতো সুবিস্তৃত। কটি দেশে কদম্ব পুষ্পের কেশরের মতো পীত বর্ণের বস্ত্রের আচ্ছাদন। তার চারটি বাহু মহারত্ন খচিত স্বর্ণ নির্মিত অলংকারের দ্বারা শোভিত। মস্তকে উজ্জ্বল রত্ন খচিত কিরীট স্থাপিত। দুটি কানে কুন্তল বিরাজিত। মহাযোগী বিকশিত হৃদপদ্ম মধ্যে পাদপল্লব স্থাপিত। বক্ষ স্থলের বাম দিকে লক্ষ্মী রেখা যুক্ত। গলদেশে কৌস্তভ রত্নের হার। কটি দেশে মহামূল্য চন্দ্রহার। তার আঙুলে অঙ্গুরীয়চরণে নূপুর এবং মণিবন্ধে কঙ্কন। তার বদন ঈষৎ কুঞ্চিত, নির্মল নীলবর্ণ কুন্তলের অতিশয় শোভমান। তার মুখে হাসি অতি উত্তম আনন্দ পূর্ণ হাসি যুক্ত দৃষ্টিতে উল্লাসিত ভুরু ভঙ্গিতে ভক্তদের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

শ্রীকৃষ্ণের চরণ কমল থেকে বদন পর্যন্ত এক একটি অঙ্গের ধ্যান মনে মনে করবে। যে সমস্ত অঙ্গের ধ্যান করা সহজে হয়ে যাবে, সেই অঙ্গের ধ্যান পরিত্যাগ করে অন্য অঙ্গের ধ্যান করবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যতদিন পর্যন্ত প্রেমভক্তির জন্ম না হবে ততদিন নিত্য নৈমিত্তিক কাজের শেষে যত্ন সহকারে বিরাট পুরুষের ধ্যান করা কর্তব্য। হে মহারাজ, সাধক যখন দেহত্যাগ করতে ইচ্ছে করবেন, তখন দেশ এবং কালের অপেক্ষা করবেন না। তিনি শক্তি প্রভৃতি সুখকর আসনে উপবেশন করবেন। প্রাণায়াম করে ইন্দ্রিয়গুলিকে মনের দ্বারা সংযত করবেন। নির্মল বুদ্ধির দ্বারা মনকে সংযত করবেন। বুদ্ধিকে জীবাত্মাতে সংলগ্ন করবেন। শুদ্ধ জীবাত্মাকে পরমাত্মাতে সংলগ্ন করে পরম শান্তি লাভ করবেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি যোগের কাছ থেকে নিবৃত্ত হবেন। এই জাতীয় পরমাত্মাতে সমাধিযুক্ত যোগীর প্রতি দেবতাগণের নিয়ামক কালও প্রভুত্ব করতে পারবে না, জগতের ওপর যারা প্রভুত্ব করেন সেই দেবতাদের কথা আর কী বলব?

এই যোগীর ওপর সত্ত্ব, রজ ও তম, গুণ এবং অহংকার, প্রভৃতি প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কিন্তু আত্মা ভিন্ন সমস্ত বস্তুকে উপেক্ষা করে আমিই ব্রহ্ম, এরূপ ধৃষ্টতা পরিহার করে, পরম পূজ্য শ্রী ভগবানের চরণ কমল আলিঙ্গন করে পরম আনন্দে তিনি মগ্ন থাকেন। দেহ অথবা অন্য কোনো বস্তুর প্রতি তার আসক্তি থাকে না। এটাই ভগবানের শ্রেষ্ঠ তত্ত্ব আচার্যরা মনে করে থাকেন।

দেহ ত্যাগের প্রকার সম্পর্কে বলা হয়েছে –প্রথমে পাদমূলের দ্বারা মূলাধার নিযুক্ত করতে হবে। অক্লান্তভাবে প্রাণবায়ুকে উৰ্বদিকে নাভি প্রভৃতি ছয়টি স্থানে উত্তোলিত করতে হবে। নাভিতে মণিপুরচক্রে আনীত প্ৰাণবায়ুকে হৃদয়ে অনাহুত চক্রে আনতে হবে। উদানবায়ুর সাহায্যে কণ্ঠদেশের নীচে বিশুদ্ধ চক্রে তাকে নিয়ে যেতে হবে। এবার জিত চিত্ত মুনি বুদ্ধির দ্বারা বিকাশ করে সেই বায়ুকে তালু মূলে অর্থাৎ বিশুদ্ধ চক্রের অগ্রভাগে নিয়ে যাবেন। কান চোখ, নাসিকাদ্বয় এবং মুখ, এই সাতটি প্রাণ বায়ুর পথকে নিমুক্ত করবেন। অর্থাৎ অন্য কোনো লোকে যাবার ইচ্ছে না থাকলে প্রাণ মূল থেকে প্রাণবায়ুকে ক্রুদ্বয়ের মধ্যে আজ্ঞা চক্রে নিয়ে যাবেন। কিছুক্ষণ থেকে অকুণ্ঠ দৃষ্টিতে ব্রহ্মকে লাভ করবেন। ব্রহ্মার ভেদ করে দেহ এবং ইন্দ্রিয় ত্যাগ করবেন।

সদ্য মুক্তির কথা এইভাবে বলা হল। এবার ক্রম মুক্তির কথা এইভাবে বলা হয়েছে। হে রাজন, যদি কোনো যোগী ব্ৰহ্মপদ অথবা অণিমাদি আটটি ঐশ্বর্য যুক্ত সিদ্ধগণের বিহারভূমি কিংবা ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছাপ্রকাশ করেন, তা হলে মন এবং ইন্দ্রিয়গণের সাথেই ভ্রমণ করবেন। বায়ুর মধ্যে সূক্ষ্ম শরীর রেখে মহাযোগীরা ত্রিভুবনের বাইরে এবং ভেতরে ভ্রমণ করতে পারেন। যে সমস্ত যোগীরা উপাসনা, তপস্যা, যোগ এবং জ্ঞান সাধন করে থাকেন তারা এই গতি প্রাপ্ত হন। কর্মের দ্বারা এই গতি হয় না। যোগী ব্রহ্মালোকের পথে জ্যোতির্ময় সুষম্না নাড়ির দ্বারা আকাশ মার্গ দিয়ে অগ্নিলোকে প্রবেশ করবেন। নির্মল দেহ উদ্ধাস্থিত উঠে নারায়ণের অধিষ্ঠিত শিশুমায়ের মতো জ্যোতিষ চক্রে যাবেন, পরবর্তী পর্যায়ে যোগী বিশ্বের নাভিস্বরূপ বিষ্ণুর সম্বন্ধি শিশুমার চক্র নির্মল লিঙ্গ শরীর দ্বারা অতিক্রম করবেন। অন্যের নমস্কৃত এবং ব্রহ্মবিদ ঋষিগণের বাসস্থান মহললোকে গমন করবেন। সেখানে কল্পকালজীবি ভৃগুমহা আনন্দে অবস্থান করছেন। কল্পান্তে যোগী অনন্তদেবের মুখাগ্নিতে সমস্ত জগৎ দগ্ধ হতে দেখবেন। দ্বিপরাধব্যাপী স্থিত, সিদ্ধেশ্বরগণের মত্যলোকে গমন করবেন। যারা ভগবানের ধ্যানরূপ করতে পারেন না। তাঁদের বার বার মনুষ্য জন্মের কষ্ট স্বীকার করতে হয়। তাদের এই দুর্গতি দেখে ব্রহ্মলোক বাসী মহাপুরুষরা তাদের প্রতি শোক প্রকাশ করে থাকেন। এছাড়া সেখানে কোনো কারণেই শোক জরা মৃত্যু দুঃখ বা ভয় নেই।

এবার যোগী সূক্ষ্ম শরীর লাভ করেন। নির্ভয়ে পৃথিবীর জল এবং অগ্নিমূর্তি হয়ে বায়ুমূর্তি হন। তারপর আকাশ মূর্তি হন। ভোগ শেষ হলে পরমাত্মা মূর্তি হন। পরে যোগী ঘ্রাণেন্দ্রিয় অবলম্বন করে। গন্ধ, তন্মাত্র রসনেন্দ্রিয়ের দ্বারা ত্বগিন্দ্রেয়ের রস সৃষ্টির দ্বারা রূপ, ত্বগিন্দ্রেয়ের দ্বার বায়ু শ্রোত্রের দ্বারা শব্দ তন্মাত্র এবং প্রাণকে অবলম্বন করে সমস্ত কর্মকে পেয়ে থাকেন। যোগীর সূক্ষ্ম ভূত এবং ইন্দ্রিয় গণের লয়ের স্থান মনোময় ও দেবময় অহঙ্কারকে পেয়ে থাকেন। তাই তিনি অহংঙ্কারের সাথে মহৎ তত্ত্ব লাভ করেন। এখানে গুণ সকলের হয়। তিনি প্রকৃতি তত্ত্ব প্রাপ্ত হন। প্রকৃতি হয়ে হন আনন্দময়, উপাধি গুলি শেষ হলে নির্বিকার আনন্দরূপ পরমাত্মাকে লাভ করেন। হে মহারাজ, ওই যোগী আর কখনও জগতে ফিরে আসেন না। তিনি ভগবত গতি প্রাপ্ত হন।

হে মহারাজ সৃষ্টির প্রথম ব্রহ্মার আরাধনায় তুষ্ট হয়ে ভগবান নারায়ণ তাকে দুটি পথের কথা বলেছিলেন। এই দুটি পথ অর্থাৎ উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ণের কথা বেদে বলা হয়েছে। তুমি এ দুটি পথের কথা প্রশ্ন করেছিলে, দুটি পথ সনাতন অর্থাৎ নিত্য এ সংসারে ভ্রমণকারী জীবের এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। যার দ্বারা ভগবান বাসুদেবের প্রতি পরাশক্তি লাভ হয়ে থাকে।

ভগবান ব্রহ্মা একাগ্রে চিত্তে তিনবার বেদ পর্যালোচনা করে ভক্তিযোগের কথা বলেছেন। ভক্তিযোগের দ্বারা হরির প্রতি ভালোবাসা জন্মায়।

যদি বল অনুভূত পদার্থে রতি হয়, তাহলে অ-অনুভূত ভগবানে কী ধরনের আসক্তি জন্মাবে?

এর উত্তরে বলা হয়েছে –ক্ষেত্রজ্ঞ এবং অন্তর্যামী হিসেবে ভগবান হরি সমস্ত প্রাণীতে দৃষ্ট হতে পারেন। ব্রহ্মাদি দর্শন স্রষ্টা ব্যাতিরেকে হতে পারে না। বুদ্ধাদি করণ হেতু কর্তার অধীন। এই অনুপপত্রী এবং অনুমাপক বিবিধ লক্ষণ দ্বারা ঈশ্বর স্বতন্ত্র কর্তা। হে মহারাজ, সমস্ত লোকে সব জায়গায় সব সময় এবং সকল প্রকারে ভগবান হরিকে স্মরণ করা উচিত। হরির কথা শ্রবণ, কীর্তন ও আলোচনা করা উচিত। হে সকল সৌভাগ্যশালী জন সাধুগণের আত্মার মতো প্রিয় ভগবান হরির কথারূপ অমৃতপান করেন, তারা ভগবানের চরণ কমলের কাছে গিয়ে উপনীত হতে পারেন।

তৃতীয় অধ্যায়
বিভিন্ন কামনা পূর্তির জন্য নানা দেবতার উপাসনা বর্ণন

শ্ৰী শুকদেব বললেন–হে মহারাজ, তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে যে, বিবেকী মানুষদের করণীয় কী? তার উত্তর দেওয়া দিচ্ছি গো। যিনি ব্রহ্মতেজ কামনা করেন, যিনি দেহের প্রচারক ব্রহ্মার উপাসনা করবেন। ইন্দ্রিয়ের শক্তি কামনাকারী ইন্দ্রের এবং পুত্রকামনাকারী প্রজাপতি দক্ষাদির উপাসনা করবেন। যিনি শরীরের সৌন্দর্য কামনা করবেন যিনি দেবী দুর্গার উপাসনা করবেন। তেজস্বী হবার কামনা থাকলে অগ্নির উপাসনা করতে হবে। ধনর্ষি হলে অষ্টবসুদের প্রার্থনা করতে হবে এবং প্রভুত্ব কামনায় রুদ্রদের উপাসনা করতে হবে। ভষ্য ও ভোজ্য কামনায় অদিতিকে, স্বর্গ কামনায় আদিত্যদের, রাজ্য কামনায় বিশ্বদেবগণের এবং প্রজাদের মঙ্গল কামনায় জনস্বার্থ গণের অর্চনা করবেন। যিনি আরোগ্য কামনা করেন, তাকে অশ্বিনীকুমার-দ্বয়ের পূজা করতে হবে। পুষ্টিকাম ব্যক্তি ইলা, এবং পৃথিবী দেবীকে ও প্রতিষ্ঠাকামী ব্যক্তি লোকমাতা স্বর্গ ও পৃথিবীর ভজনা করবেন। সৌন্দর্যের প্রার্থী হলে গান্ধবদের পূজা করতে হবে। যজ্ঞপতি বিষ্ণু যশের কামনা পূরণ করেন। বরুণ অর্থের কামনা পূরণ করেন। বিদ্যার কামনা হলে শিবকে তুষ্টি করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর সুখের কামনায় ভগবতী দেবীর উপাসনা করা উচিত। ধর্মর্ষিরা বিষ্ণুর, পুত্রকামী পিতৃ-পুরুষদের, রক্ষকামনায় যজ্ঞ এবং বলোভের কামনা থাকলে মরুগণের উপাসনা করা উচিত। রাজ্য কামীরা মনুকে প্রার্থনা করবেন, শত্রুবধ ‘কামনায় রাক্ষসদের, বিষয় কামনায় চন্দ্রের এবং বৈরাগ্য কামনায় ভগবানের উপাসনা করবেন।

মহারাজ, যিনি উদার বুদ্ধি এবং ভগবানের একান্ত ভক্ত, তার কামনা থাকুক অথবা না থাকুক তিনি একাগ্রচিত্তে নারায়ণের ধ্যান করবেন। তিনি যে দেবতারই উপাসনা করুন না, যদি ভগবানের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি জন্মায়, তবে তা হবে পরম পুরুষার্থ লাভ। হরিকথা শুনলে ভগবত তত্ত্বের জ্ঞান হয়। মন প্রসন্ন হয়। হরি কথা শুনলে বিষয়ে বৈরাগ্য জন্মায়। এই বৈরাগ্য মোক্ষলাভের নিশ্চিত পথ। তারপর ভগবানের প্রতি গভীর ভক্তি শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়।

শৌণক বললেন, মহারাজ পরীক্ষিত একথা শুনে ব্যাসপুত্র শুকদেবকে আর কী জিজ্ঞাসা করে ছিলেন। আমরা হরিকথা শুনতে ইচ্ছুক। ভাগবতগণের সভাতে যে কথাই হোক, তার ফল হরি কথাই হবে। পাণ্ডুবংশধর ভগবত ভক্তরাজা পরীক্ষিত ছোটো বেলায় খেলার সময় কৃষ্ণবিষয়ক খেলা খেলতেন। ভগবান ব্যাস দেবপুত্র শুকদেবও বাসুদেব পরায়ণ, তাদের মিলনে শ্রী কৃষ্ণের গুণ কীর্তনই হবে। ভগবত কথায় যে সময় অতিবাহিত হয় তাই সার্থক। প্রতিদিন সূর্যোদয় এবং অস্ত, গমনের দ্বারা জীবের আয়ুরথ হরণ করে। বৃক্ষগুলি কি জীবিত থাকে না? কর্মকারের অগ্নি বায়ু সঞ্চারের যন্ত্র কি নিশ্বাস প্রশ্বাসের কাজ করে না? গ্রাম্য পশু কুকুর বিড়াল তাহার ও স্ত্রীর সঙ্গ করে না? এই কাজগুলি করলে জীবন সার্থক হয় না।

শ্রী কৃষ্ণ নাম যার কর্ণ কুহরে প্রবেশ করেনি, কুকুর, বিষ্ঠাভোজী –শুকর কন্টক ভোজী উট এবং ভারবাহী গর্দভের মতো। যে কান ভগবানের কথা শ্রবণ করে না, সে দুটি গর্ত মাত্র। হে সূত, যে জিভ ভগবানের নাম উচ্চারণ করেনা, তা ভেকের তুল্য, যে মাতা মুকুন্দের চরণ কমলে প্রণাম করে না, তা উষ্ণীষ ও মুকুটে শোভিত হলেও কেবল ভারমাত্র। যে দুটি হাত হরির পূজা করেনা, তা উজ্জল সূবর্ণ কঙ্কনে ভূষিত হলেও মৃত ব্যক্তির হাতের মতো। মানুষের দুটি চোখ যদি বিষ্ণুর মূর্তি দর্শন না করে তাহলে তা ময়ূর পুচ্ছের চোখের মতো। যে দুটি পা শ্রীহরির পূণ্য ক্ষেত্রে গমন করেনা, তা গাছের গুঁড়ির মতো ব্যর্থ।

যে মরণশীল মানুষ ভক্তের চরণধূলি কখনও নিজ অঙ্গে ধারণ করে না, সে বেঁচে থাকলেও শবতুল্য, অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির মতো। যে হৃদয় পাষাণের মতো কঠিন, হরিনাম শ্রবণ কীর্তনেও সে হৃদয়ে বিকার হয় না। যদি বিকার হয়, তাহলে নয়নে অশ্রু এবং গায়ে শিহরণ দেখা দেবে। হে প্রিয়, তুমি আমাদের অনুকূল মনোরম কথা বলেই এখন বলল, আত্মবিদ্যা বিশারদ ব্যাস নন্দন কী বলেছিলেন।

.

চতুর্থ অধ্যায়

রাজার সৃষ্টি বিষয়ক প্রশ্নও শুকদেবের মঙ্গলাচরণ পূর্বক শ্রীমদ ভাগবত কথা শুরু করলেন। সূত বললেন– পরীক্ষিত, শুকদেবের আত্মতত্ত্ব নিয়ামক বাক্য শ্রবণ করলেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা অর্পণ করলেন। তিনি স্ত্রী-পুত্র গৃহ, গৃহ হস্তি, অশ্ব, ধন রত্ন বন্ধুবর্গ এবং রাজ্যের আসক্তি ত্যাগ করেছিলেন। হে মহাত্মাগণ, আপনারা আমাকে যা জিজ্ঞাসা করছেন, মহাত্মা পরীক্ষিতও সেই প্রশ্ন করেছিলেন। নিজের আসন্ন মৃত্যু জেনেও তিনি ভগবান বাসুদেবের প্রতি আসক্তি যুক্ত হয়েছিলেন।

পরীক্ষিত বললেন–হে নিষ্পাপ ব্ৰহ্মণ! অদ্ভুতকর্মা ভগবান হরির কাজ পণ্ডিতদেরও দুজ্ঞেয় বলে মনে হয়। এক ভগবান পুরুষ রূপে থেকেই একসঙ্গে ব্রহ্মাদি দেবতাদের জন্মগ্রহণ পূর্বক বহুকর্ম করেছেন। ভগবানের সৃষ্টি লীলা সবিস্তারে বর্ণনা করে আমার সন্দেহ দূর করুন। আমি জানি, আপনি যেমন বেদাদি শাস্ত্রে কুশল তেমন ভাবেই পরব্রহ্মতত্ত্বে অভিজ্ঞ।

সূত বললেন, মহারাজ পরীক্ষিত বিশেষ ভাবে অনুরোধ করায় শুকদেব ভগবানকে স্মরণ করে বলতে শুরু করলেন,

শ্ৰী শুকদেব বললেন–প্রপঞ্চ জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় রূপ লীলা করার জন্য যিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর মূর্তি ধারণ করে রজঃ স্বত্ব ও তম গুণ সম্পন্ন হন, সেই ভগবানকে প্রণাম করি। তিনি সাধুদের পালক, কুযযাগীদের দুজ্ঞেয় অর্থাৎ তাদের কাছ থেকে দূরে অবস্থান করেন, যিনি অসাম্য এবং নিরতিশয় ঐশ্বর্যের দ্বারা আনন্দময় স্বরূপে বিহার করেন, তাঁকে প্রণাম। যাঁর নাম, রূপ, গুণ এবং লীলাবলীর কীর্তন শ্রবণ স্মরণে সকল জীবের পাপ সমূহ বিনষ্ট হয়, সেই সুমঙ্গল কীর্তি ভগবানকে নমস্কার, বিবেকী জনগণ যার চরণে সেবার দ্বারা ইহলোক ও পরলোকের মনে আসক্তি পরিত্যাগ করে তাকে প্রণাম। তপস্বী, জ্ঞানী, কখী দহনশীল, যশস্বী, মনস্বী যোগী মন্ত্রবিদগণ তাদের নিজ নিজ কর্ম যাকে সম্পূর্ণ না করে কোনো মঙ্গল লাভ করতে পারেন না, সেই সুমঙ্গল কীর্তির ভগবানকে নমস্কার।

কিরাত, হূণ, অন্ধ্র, পুলিন্দ, পুকস, আভীর, শুভ্র, যবন প্রভৃতি জন্মগত পাপী এবং অপর কর্ম বংশ পাপী যে ভগবানের চরণ আশ্রয় করে শুদ্ধ হয়েছেন, সেই ভগবানকে প্রণাম করছি। তিনি আত্মদর্শী, মহাপুরুষদের আত্মা, যিনি ঈশ্বরেরও ঈশ্বর তিনি বেদজ্ঞ কর্মকাণ্ড স্মৃতি শাস্ত্রজ্ঞ ধর্মকর্ম এবং উপাসনা কাণ্ডের দ্বারা প্রকাশিত হয়ে থাকেন। ব্রহ্মা, শঙ্কর প্রভৃতি দেবতাগণ যাঁর স্বরূপ নিশ্চিতরূপে নিরুপণ করতে পারেন না, সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রসন্ন হোন। তিনি সর্বসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী মহালক্ষ্মী দেবীর পতি। তিনি যোগ্য পতি, অর্থাৎ সমস্ত সাধনের ফলদাতা। তিনি সকল লোকের প্রতি পালক তিনি অন্তর্যামী এবং ত্রিভুবনের পালক। তিনি পৃথিবীর পালক। অন্ধক, বিষ্ণুও সাত্ত্বিকদের পালক ও রক্ষক। ভক্তদের প্রতিপালক তার প্রতি আমার আস্থা অপরিসীম। মহাপুরুষরা যাঁর চরণে ধ্যানরূপ সমাধির দ্বারা পরিশীলিত বুদ্ধিতে আত্মতত্ত্ব দেখে থাকেন, সগুণ নিগুণ প্রকৃতির দ্বারা তাঁকে প্রকাশ করে থাকেন। উনি ভগবান মুকুন্দ অর্থাৎ মুক্তিদাতা। উনি যেন আমার প্রতি প্রসন্ন হন। সৃষ্টির প্রথমে ব্রহ্মার হৃদয়ে উনি সতীর স্মৃতি প্রকাশ করেছিলেন। ঐশ্বর্যপূর্ণা বেদরূপা সরস্বতী ব্রহ্মার বদন থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন তার দ্বারা ব্রহ্মার চতুর্মুখ থেকে বেদবাণী প্রকাশ পেয়েছিল। জ্ঞান প্রদাতা ঋষিদের আচার্য ভগবান আমাদের প্রণাম গ্রহণ করুন।

যে প্রভু আকাশ ইত্যাদি পঞ্চ মহাভূত দ্বারা প্রাণীদের শরীর সৃষ্টি করেন, তার মধ্যে অন্তর্দেহী রূপে বাস করেন, তাকে প্রণাম। এই জন্য তাঁকে পুরুষ বলা হয়। তিনি একাদশ ইন্দ্রিয়, পঞ্চমহাবৃত স্বরূপ ষোড়শ কলার প্রকাশক হয়ে তাদের পালন করেন। সেই ভগবান আমার বাক্যকে অলঙ্কৃত করুন। ভক্তগণ যাঁর মুখপদ্মের জ্ঞানময় মধু পান করেছিলেন, সেই বেদব্যাসকে নমস্কার করছি। হে মহারাজ, দেবর্ষি নারদ, ব্রহ্মার কাছে প্রশ্ন করায়, তিনি এই কথাই নারদকে বলেছিলেন।

.

পঞ্চম অধ্যায়
ব্রহ্মার সৃষ্টাদি বর্ণন ও হরিলীলা কীর্তন

ব্রহ্মাণ্ড নির্মাণের কাহিনি শুনতে চাইলে পদ্মযোনি ব্রহ্মা দেবর্ষি নারদকে বললেন–হে নারদ, যিনি সকলের স্রষ্টা, ঈশ্বর, নির্বিকার এবং অন্তর্যামী, যাঁর প্রকাশে চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, নক্ষত্র, গ্রহাদি জগৎ আলোকিত করে, সেই ভগবান নারায়ণ থেকে আমার সৃষ্টি। সেই পরমেশ্বরের কথাতেই প্রেরিত হয়ে তারই সৃষ্ট জগতের সৃষ্টি করে থাকি। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই গুণ তিনটির দ্বারা যার গতি নিরূপণ করা যায় না, সেই ভগবান হরি আমাদের সকলের প্রভু। মায়ার অধীশ্বর ভগবান মায়ার দ্বারা ইচ্ছা করে নিজেতে সূক্ষ্মভাবে অবস্থিত কালকে এবং জীবাত্মাতে সূক্ষ্মভাবে অবস্থিত অদৃষ্ট ও স্বভাবকে স্বেচ্ছায় সৃষ্টির জন্য অঙ্গীকার করেছিলেন। সেই ভগবান কালে অধিষ্ঠিত হলেন কাল থেকে গুণ ক্ষোভ হয়। গুণের সাম্যভাব পরিত্যক্ত হলে সৃষ্টির জন্য উন্মুখতা জন্মায়। স্বভাবে অধিষ্ঠান করলে রূপান্তর এবং জীবের অদৃষ্টে অধিষ্ঠিত হলে মহতত্ত্বের উৎপত্তি হয়।

কাল ও স্বভাব দ্বারা বিকার প্রাপ্ত হয়ে রজোগুণ ও সত্ত্বগুণে বর্ধিত হলে তা থেকে তমোগুণ লাভ হয়। তাকে বলে অহংকার তত্ত্ব, যা ভূত ইন্দ্রিয় ও দেবতা নামে চিহ্নিত। এই তত্ত্ব আবার রূপান্তরিত হয়ে বৈকারিক, তেজস ও তামসে পরিণত হয়েছে। পঞ্চভূতের তামস অহংকার বিকার প্রাপ্ত হয়ে আকাশের উৎপত্তি হয়েছে এবং এর ফলে সৃষ্টিকারী শব্দ আকাশের সূক্ষরূপ গুণ; আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে প্রাণ, ওজঃ সহ এবং জল সৃষ্টি হয়েছে।

স্পর্শ ও শব্দ যুক্ত হয়ে উৎপন্ন হয়েছে অগ্নি। অগ্নি থেকে জলের সৃষ্টি এবং তা থেকে পৃথিবীর জন্ম।

সাত্ত্বিক অহংকার বিকার প্রাপ্ত হলে তা থেকে মন এবং বৈকারিক সাত্ত্বিক দশ ইন্দ্রিয়ের দশ অধিষ্ঠাত্রী দেবতা উৎপন্ন হয়েছে। ভগবানের শক্তি দ্বারা পঞ্চ মহাভূত ইন্দ্রিয় সকল মন ও গুণগুলি একত্রিত মিলিত হয়ে সমষ্টি ও ব্যষ্টি স্বরূপ এই জগৎ সৃষ্টি হয়। বহু সহস্র বছর পরে কাল কর্ম ও স্বভাবে অধিষ্ঠিত হয়ে পরমেশ্বর অচেতন ব্রহ্মাণ্ডে চেতনা দান করেন।

সেই পরমেশ্বর অণ্ড থেকে বেরিয়ে হাজার মস্তক, হাজার বদন, হাজার চোখ, হাজার বাহু, হাজার উরু ও চরণ বিশিষ্ট হয়ে এই অণ্ড পৃথক করার অভিলাষ করেন। মনীষীগণ ধারণা করে থাকেন, তাঁর জঙঘা থেকে ঊধ্বাঙ্গ পর্যন্ত সাতটি উধ্বলোক এবং জঙঘা থেকে নিম্নাঙ্গ সাতটি অধোলোকের সৃষ্টি করেছে। পরমেশ্বরের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য এবং চরণ থেকে শূদ্রের জন্ম।

পরমেশ্বরের চরণ থেকে কটি পর্যন্ত অবয়বে পাতাল থেকে ভূর্লোক পর্যন্ত সপ্তলোক নাভিতে ভুবর্লোক, হৃদয়ে স্বর্গলোক, ব্রহ্মঃস্থলে মহলোক, গ্রীবাতে জনলোক, স্তনদ্বয়ে তোলোক, এবং মস্তক সকলে সত্যলোক –এইভাবে ত্রিলোকের কল্পনা করা হয়েছে।

.

ষষ্ঠ অধ্যায়
বিরাট পুরুষের বিভূতির বর্ণন

সেই বিরাটরূপী ভগবানের মুখ থেকে তাঁর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা অগ্নির উৎপত্তি হল। তার ত্বক সাত ধাতু ও সাত ছন্দের সৃষ্টি করেছে। তার জিহ্বা থেকে তিন প্রকারের অন্ন, এবং তার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা বরুণের উৎপত্তিস্থল। তার নাসিকাদ্বয় বায়ুর পরম আশ্রয়, যা সকল প্রাণীর প্রাণ। তার শরীর সমস্ত বস্তুর সারাংশ ও সৌভাগ্যের উৎপত্তি স্থান।

বিরাট পুরুষের রোমরাজি উদ্ভিদ জাতির আশ্রয়স্থল। তার চরণ শরণ ও সকল বরের আশ্রয় জল, শত্রু, বিশ্ব সৃষ্টি মেঘ ও প্রজাপতির উৎপত্তিস্থল লিঙ্গ। তার পৃষ্ঠদেশ পাপ ও অবিদ্যার জন্মস্থান।

তার হৃদয় সমস্ত প্রাণীর লিঙ্গদেহের আস্পদ।

বিরাট পুরুষের মন সকলের মনের জন্মদাতা। সেই পরম পুরুষ তার দেহ এবং ব্রহ্মাণ্ডের ভেতর ও বাইরে সমস্ত বস্তুকে প্রকাশ করেছেন। তিনি অমৃত ও অভয়ের অধিশ্বর। তিনি নিজানন্দ অনুভব করে থাকেন, তাই তার মাহাত্ম অনুধাবন করা অত্যন্ত দুষ্কর। তিনি মহলোকের উপরিতল তিনলোকের মস্তক স্থানীয় জনলোকে অমৃত, তপোলোকে অভয় সুখ নিহিত রেখেছেন। প্রপঞ্চের বাইরে ভগবনের তিনটি পাদ অংশে নৈষ্ঠিক, ব্রহ্মচারী বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাসীদের বাসস্থান। আর ত্রিলোকের মধ্যে গৃহস্থদের বাস। কর্মের পথ দক্ষিণ এবং মোক্ষের পথ উত্তর– এই উভয় পথেই এই সর্বব্যাপী ক্ষেত্রজ্ঞ পুরুষ। বিচরণ করেন।

ভূত, ইন্দ্রিয় ও গুণাত্মক বিরাট দেহ থেকেই ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি, পরমেশ্বর নিজ ধামে থেকে জগতের ওপরে প্রভাব বিস্তার করেন।

ব্রহ্মা বললেন–শ্রীহরির নাভি কমল থেকে আমার উৎপত্তি। পরমেশ্বরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছাড়া যজ্ঞের কোনো উপকরণ দেখতে পাইনি। তার দেহ থেকে যজ্ঞের উপকরণগুলি সংগ্রহ করে তাই দিয়েই ঐ যজ্ঞ পুরুষের উপাসনা করেছিলাম। তার দ্বারা নিযুক্ত হয়ে আমি সৃষ্টি করি। তার বশীভূত হয়ে রুদ্র সংহার করেন এবং সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়–এই তিনটির শক্তি যুক্ত পরমেশ্বরের বিষ্ণুরূপে পালন করেন।

কার্য ও কারণাত্মক যা কিছু সৃষ্টি করার আছে, তা ভগবান নারায়ণ থেকে পৃথক নয়।

আমি বেদময়, তপোময়, প্রজাপতিগণের অভিনন্দিত ও সমাহিত চিত্তে নিপুণ যোগের অনুষ্ঠান করেও আমার সৃষ্টি কর্তা ভগবান সেই পরম পুরুষকে জানতে পারিনি। আমি সৃষ্টি কর্তা, ব্রহ্মা রুদ্র যাঁর পারমার্থিক স্বরূপ জানতে পারিনি। অপর দেবতারা তা কী করে জানবে? আমরা সেই ভগবানের লীলাকীর্তন করি মাত্র। সেই ভগবানের চরণে প্রণাম নিবেদন করি।

তিনি বিশুদ্ধ, সত্য ও জ্ঞান স্বরূপ। তিনি সকলের অন্তর্যামী, সমস্ত সন্দেহের অতীত, তিনি নিগুর্ণ, তিনি জন্ম-মরণ রহিত। আমি ব্রহ্মা শিব, যজ্ঞ, বিষ্ণু এগুলি তার গুণাবতার। প্রজাপতিগণ, ঋষিগণ, দেবগণ, নৃপতিগণ, গন্ধর্ব, বিদ্যাধর, যক্ষ, ব্রহ্ম, পিতৃ শ্রেষ্ঠ, ঋষিশ্রেষ্ঠ, সিদ্ধে, দানবেন্দ্র, প্রেত পিশাচ, ভূত, জলচর প্রাণী, পশুপাখি সম্পত্তি, বীর্য বল তেজ ক্ষমা শোভা –সবই পরতত্ত্ব অর্থাৎ সেই ভগবানের বিভূতি বা অবতার।

.

সপ্তম অধ্যায়

ভগবানের অবতার লীলা কীর্তন সমুদ্র নিমগ্ন পৃথিবী উদ্ধারের জন্য ভগবান নারায়ণ বরাহ মূর্তি ধারণ করে তার প্রচণ্ড দম্ভের আঘাতে দৈত্য হিরণ্যাক্ষকে বধ করেছিলেন। তিনি ইন্দ্র হয়ে ত্রিলোকের মহতী, আর্তি হরণ করে হলেন হরি। অত্রিমুনির প্রতি প্রসন্ন হয়ে তার পুত্র রূপে ‘দত্ত নাম নিয়ে জন্ম নিয়েছিলেন। ঋষিপত্নী দেবহুতির গর্ভে ‘কপিল’ নামে জন্মে নিজ জননীকে তত্ত্ব-সংখ্যান-রূপ আত্মতত্ত্ব উপদেশ করেছিলেন। ধর্মের পত্নী দক্ষের কন্যা মূত্রি গর্ভে নিজের তপস্যার প্রভাব যুক্ত ‘নর’ ও ‘নারায়ণ’ –দুই মূর্তিতে জন্মগ্রহণ করেন।

পাঁচবছরের বালক ধ্রুবের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ভগবান ‘পৃশ্মিগভ’ রূপে ধ্রুবকে ধ্রুবলোক দান করেছিলেন। মহারাজ বেন ব্রাহ্মণদের অভিশাপ মাথায় নিয়ে নরকগামী হলে ঋষিদের প্রার্থনায় ভগবান ‘পৃথু’ নামে তার গৃহে পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

ভগবান অগ্নীপ্র পুত্র মহারাজ নাভি হতে তার পত্নী সুদেবীর গর্ভে ‘ঋষভ’ রূপে অবতীর্ণ হন। ব্রহ্মা বললেন–আমার যজ্ঞে সুবর্ণবর্ণ, ছন্দোময়, যজ্ঞময়, সর্বদেবময়, যজ্ঞপুরুষ সেই ভগবান হয় শীর্ষ রূপে অবতীর্ণ হন এবং সেই সময় তার নিশ্বাস থেকে বেদসকলের সৃষ্টি হয়।

প্রলয়কালে ভগবান মৎস্য’ রূপে পৃথিবীর প্রাণীসকলকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। অমৃত লাভের জন্য ক্ষীরসাগর মন্থনকারী দেবাসুরদের, মন্থনদণ্ড স্বরূপ মন্দর পর্বত, ভগবান কূর্ম’ রূপে স্বীয় পৃষ্ঠে ধারণ করেছিলেন। ভগবান বিষ্ণু স্বয়ং নৃসিংহ মূর্তি ধারণ করে বলদপিৰ্ত দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুকে নিজের উরুদেশে রেখে নখের দ্বারা বিদীর্ণ করে বধ করেন। যজ্ঞাধিপতি বিষ্ণু বামন’ রূপে মহারাজ বলির কাছ থেকে ত্রিপাদ পরিমিত ভূমি প্রার্থনার ছলে ত্রিভুবন গ্রহণ করেছিলেন। ভগবান সর্বশক্তিমান হয়েও ধর্মের পথে বিচরণকারী জনকে যাঞ্জা ছাড়া ঐশ্বর্য থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এমন বিবেচনা করে মহারাজ বলির কাছে থেকে তিনি ত্রিলোক প্রার্থনা করেছিলেন।

হংস অবতারে ভগবান ভক্তিযোগ দিয়েছিলেন। আত্মজ্ঞান প্রকাশকে জ্ঞানের কথাও বলেছিলেন। পরমপুরুষ ‘ধন্বন্তরি’ রূপে অবতীর্ণ হয়ে মহারোগীদের রোগসকল নিজের নাম দ্বারাই বিনষ্ট করেছিলেন। সেই উগ্রবীর্য হরি ‘পরশুরাম’ রূপে অবতীর্ণ হয়ে পৃথিবীর ভারস্বরূপ ও দৈবকর্তৃক মৃত্যুর জন্য প্রেরিত ক্ষত্রিয়কুলকে একুশবার উৎপাটন করেন। আমাদের প্রতি প্রসন্ন হয়ে তিনি ‘রামচন্দ্র’ রূপে পৃথিবীতে এসেছিলেন। নিপীড়িত পৃথিবীর ভার অপনোদনের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কলিযুগের ক্ষেত্রে হরি ‘কল্কিরূপে আবির্ভূত হয়ে কলির শাসনকারী হবেন। জগতের সৃষ্টি কার্যে তপস্যা, আমি ব্রহ্মা, ঋষিগণ ও নয়জন প্রজাপতি এবং রক্ষা কাজে ধর্ম, যম, অর্থাৎ বিষ্ণু, মুনিগণ, দেবগণ নৃপতিগণ, অসুরগণ, অধর্ম, রুদ্র, ক্রোধ–সকলেই সর্বশক্তিমনে ভগবানের মায়ের বিভূতি।

যিনি সৎ, অসতের পরতত্ত্ব নিত্য সুখময়, সর্বদা প্রশান্ত, ভয় রহিত, জ্ঞান স্বরূপ, যাঁকে কোনো শব্দ দ্বারা জানতে পারা যায় না, মায়া যার সামনে দাঁড়াতে লজ্জা পায়, মুনিগণ যাঁকে ব্রহ্ম বলে মানেন, সেই নিত্য সুখরূপই পরম পুরুষ ভগবানের স্বরূপ। তিনি সকল কর্মের যশদাতা এবং সমস্ত কর্মের প্রবর্তক। যিনি ভগবানের মায়ার কার্য অর্থাৎ লীলা শ্রদ্ধা পূর্বক কীর্তন করেন, অনুমোদন ও শ্রবণ করেন তার মন কখনও মায়া দ্বারা আবিষ্ট হয় না।

.

অষ্টম অধ্যায়
মহারাজ পরীক্ষিতের প্রশ্ন

মহারাজ পরীক্ষিত শুকদেবের কাছে জানতে চাইলেন –হে ব্রাহ্মণ, প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক শূণ্য জীবাত্মার পঞ্চভূত দ্বারা যে দেহের উৎপত্তি হয়, সেটা কি বিনা কারণে নাকি এর কোনো কারণ আছে?

পাপ বা পুণ্য কোন প্রকার বস্তু কীভাবে অনুষ্ঠিত হলে কোন্ অধিকারীর পথে দেবাদি– ভাব লাভ হতে পারে? মানুষের সাধারণ ধর্ম কী? তার জাতি বা বিশেষ ধর্ম বা কী? ভিন্ন ব্যবসায়ী রাজর্ষিদের ধর্ম কী?

ভগবানের আরাধনার বিধান কী এবং অধ্যাত্ম শাস্ত্রোক্ত অষ্টাঙ্গ যোগের বিধানই বা কী?

মহাপ্রলয়ে যাঁদের উপাধি ঈশ্বরে বিলীন হয়ে যায়, সেই জীবগণ আবার কীভাবে সৃষ্ট হয়? জীবের বন্ধন, মুক্তি এবং স্বরূপ অবস্থিতি কীভাবে হয়?

.

নবম অধ্যায়
শ্ৰী শুকদেব কর্তৃক রাজার প্রশ্নের উত্তর দান

শ্ৰী শুকদেব বললেন–হে মহারাজ, হরির অনাদি-অবিদ্যাশক্তি নিজ মায়া দ্বারা অনুভবাত্মা জ্ঞান স্বরূপ জীবের দেহাদির সাথে সম্পর্ক অর্থাৎ জন্ম হয় না।

অব্যর্থ দৃষ্টি, মহাতপস্বী ব্রহ্মা কর্তৃক মন প্রাণ এবং জ্ঞানেন্দ্রিয় কর্মেন্দ্রিয় জয় করে দৈব পরিমাণে সহস্র বৎসর একাগ্র চিত্তে কঠোর তপস্যা তুষ্ট হয়ে ভগবান শ্রী হরি তাকে সর্বোৎকৃষ্ট নিজ ধাম বৈকুণ্ঠ লোক দর্শন করালেন। ব্রহ্মা সেই বৈকুণ্ঠে এসে নিখিল ভক্তজনের প্রতিপালক লক্ষ্মীদেবীর প্রিয়তম নারায়ণের দর্শন লাভ করলেন। তার চারটি বাহু, বক্ষস্থলে লক্ষ্মী দ্বারা অলংকৃত। পরনে পীতবসন, কর্ণে কুন্তল অরুণবর্ণ দুটি লোচন, আহ্লাদিত জাস্য যুক্ত, বদন। উত্তম আসনে তিনি বসে আছেন। তিনি উত্তম পাসদবৃন্দ দ্বারা পরিবেষ্টিত।

ভগবানের ঐ রূপ দেখে বিশ্বশ্রষ্ঠব ব্রহ্মার অন্তর আনন্দে পরিপূর্ণ হল। তিনি তাঁর চরণকমল বন্দনা করলেন।

ভগবান শ্রীহরি বললেন–হে বেদগর্ভ ব্রহ্মা, তোমার মঙ্গল হোক। আমার ইচ্ছার প্রভাবেই তুমি বৈকুণ্ঠ লোক দর্শন করলে। তুমি যখন জষ্ঠি করে বিমোহিত হয়েছিলে, তখন আমিই তোমাকে তপস্যা করতে আদেশ করেছিলাম। তপস্যা আমারই সাক্ষাৎ হৃদয়, আমিই তপস্যার স্বরূপ তপস্যার দ্বারা আমি এ জগৎ যেমন সৃষ্টি করি তেমন তপস্যার দ্বারাই তা সংহার করি। তপস্যার দ্বারা বিশ্বপালন করি। করি। তপস্যা আমার শক্তি যা সাধারণের পক্ষে বোঝা অত্যন্ত দুষ্কর।

সৃষ্টির পূর্বে আমি একাই ছিলাম, সৃষ্টির পরেও আমিই আছি। এই যে বিশ্ব সেটাও আমি মহাপ্রলয়ের পরে যা অবশিষ্ট থাকবে, তাও আমি। অর্থাৎ অক্ষদি, অনন্ত ও অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান আমিই একমাত্র তত্ত্বকার্যের পর কারণের গুণ কার্যে উপলব্ধি হয়, তার পূর্বে কিন্তু কারণরূপে তার বিদ্যমান থাকে, তেমনি আমিও ভূত, ভৌতিক পদার্থে প্রবিষ্ট এবং ঐ সকলে অপ্রবিষ্ট থাকি অর্থাৎ আমার সত্ত্বাই ঐরকম। যে বস্তু সব সময় সব অবস্থাতেই থাকতে পারে তাই আত্মা।

হে রাজন, ঐ বিরাট পুরুষ থেকে ঐ বিশ্বের যে রূপ সৃষ্টি এবং অন্যান্য যে সকল প্রশ্ন তুমি আমাকে করেছ ভাগবত ব্যাখ্যা শ্রবণ করলে তার উত্তর পাবে।

.

দশম অধ্যায়
শ্রীমদ্ভাগবতের দশ লক্ষণ বর্ণনা

শ্রীমদ্ভাগবতে দশটি বস্তুর কথা বলা হয়েছে –সর্গ (সৃষ্টি), বিসর্গ (বিসৃষ্টি) স্থান, পোষণ, উতি, মন্বন্তর, ঈশান, কথা, নিরোধ (প্রলয়), মুক্তি, আশ্রয়। পরমেশ্বর থেকে প্রকৃতির সত্ত্বাদি গুণত্রয়ের পরিমাণ হেতু আকাশাদি পঞ্চ মহাভূত, শব্দাদি পঞ্চতন্মাত্র, একাদশ ইন্দ্রিয়, মহত্তত্ত্ব ও অহংকারতত্ত্ব–এগুলির বিরাজরূপে ও স্বরূপে যে উৎপত্তি, তার নাম (সর্গ, ব্রহ্মা থেকে যে স্থাবর। জঙ্গমাদির সৃষ্টি তা ‘বিসর্গ। ভগবান কর্তৃক সৃষ্ট বস্তু গুলির যথাযথ শৃঙ্খলা রক্ষা করে পালনে যে উৎকর্ষ তার নাম ‘স্থিতি। ভক্তদের প্রতি ভগবানের অনুকম্পার নাম ‘পোষণ’। কর্মের যে বাসনা তা ‘উতি’ মনু প্রভৃতি ভক্তগণের ধর্মের নাম ‘মন্বন্তর। হরির অবতার বৃন্দের চরিত্র এবং তার অনুবর্তী ভক্তদের নানা আখ্যানযুক্ত পবিত্র কথাই ‘ঈশান কথা। ভগবান হরি যোগনিদ্রা অবলম্বন করলে নিজ উপাধির সাথে জীবগণের ভগবানে যে লয় ‘নিরোধ’ অবিদ্যার দ্বারা অধ্যস্ত জীবের কতৃত্বাদি অভিনিবেশ পরিহার পূর্বক নিজস্বরূপে যে অবস্থান তা ‘মুক্তি। যা হতে এই নিখিল বিশ্বের সৃষ্টি এবং যাতে সব কিছু লয় প্রাপ্ত হয়, যাকে পরব্রহ্ম ও পরমাত্মা বলা হয়, তার নামই আশ্রয়।

ভগবানের স্থূলরূপের বহির্ভাষা পৃথিবী, অপ, তেজ, মরুবায়ু, আকাশ, অহংকার, মহত্তত্ত্ব প্রকৃতি — আটটি আবরণের দ্বারা আবৃত রয়েছে। ভগবানের সূক্ষ্মরূপ লিঙ্গ শরীর স্থূল শরীরের কারণ স্বরূপ। তাই কোনো বিশেষণ নেই। তা উৎপত্তি স্থিতি ও লয়শূন্য এবং সর্বদা একরূপ অর্থাৎ অপক্ষয়াদিরহিত, এজন্য বাক্য ও মনের অগোচর।