শাপগ্রস্ত দেবতা রাজা শূরসেনের পুত্রের সর্পরূপে জন্মলাভ, ভোগবতীর সঙ্গে বিবাহ। গোদাবরীতে স্নানে শাপমুক্তি
বহুকাল পূর্বে প্রতিষ্ঠান পুর নামে এক সমৃদ্ধশালী নগর ছিল, সেই রাজ্যের রাজা ছিলেন শূরসেন। মহা প্রতাপশালী তিনি। একটি বিষয় ছাড়া সকল দিক থেকেই সুখী তিনি। তিনি অপুত্রক। এই একটি মাত্র তার দুঃখ ছিল। তার এই বিশাল রাজ্য ভবিষ্যতে কে শাসন করবে? যৌবন গেল? কাল গেল। আর ক’দিন বা বাঁচবেন? দুশ্চিন্তায় রাজার দিন কাটতে থাকে। এমন সময় তার স্ত্রী গর্ভবতী হলেন। খবরটা শুনে রাজার মনে আর আনন্দ ধরে না। তারপর যথা সময়ে রানির একটি সন্তান জন্ম নিল। দাসী এসে রাজাকে খবর দিল কিন্তু মনে তার কোনো আনন্দ নেই। খবর শুনেই রাজা ছুটে চললেন অন্দরমহলে। গিয়ে দেখেন সবাই চুপচাপ, সকলের মুখ শুকনো। তারপর রাজা একেবারে কাছে গিয়ে দেখল–একটা ছোট সাপ। রাজা অবাক হলেন। রানির গর্ভে জন্মালো একটা সাপ!
রাজার ছেলে হলে এমনিতে ধুমধাম পড়ে যায়। কিন্তু আজ গোটা রাজ্যে সবাই চুপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। রাজা রানি বুঝতে পারছেন না, কি করবেন এই সাপের বাচ্চাকে নিয়ে? ফেলে দেবেন, না পুষবেন? অবশেষে রাজা ঠিক করলেন রাজার ছেলে হয়ে যখন জন্মেছে, তখন থাক, ওকে বড় করে তোলা হোক। তার পর যা হবার হবে, সবই আমার অদৃষ্ট।
সাধ্যমত পরিচর্যা হল তার। দিন যায় শিশু সাপ বড় হয়। অন্দরমহলের একটি অন্ধকার ঘরের মধ্যে তাকে রাখা হয়। আহারাদির কোনো ত্রুটি নাই। সেই ঘরেই খেলে বেড়ায় আপন মনে। মা বাবা মাঝে মাঝে দেখতে যায় তাকে। আর যার উপর পরিচর্যার ভার আছে সে তো যাবেই, অন্য আর কেউ তেমন তার কাছে ঘেঁসে না, যদি কামড়ে দেয়।
দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। বেশ হৃষ্টপুষ্ট হল সেই সাপ, রাজবাড়ির দামী দামী খাবার খেয়ে। একদিন সৰ্পপুত্রকে দেখে ফিরে যাচ্ছেন রাজা, সহসা শুনলেন মানুষের কণ্ঠে কে যেন বলছে–বাবা, একটু দাঁড়ান, আমি রাজপুত্র এখনও আমার নামকরণটা হলনা, আর হল না আমার কোনো সংস্কারও, বাবা তুমি আমার জন্য এই সব ব্যবস্থা কর।
কথা শুনে রাজা অবাক হয়ে যায়। এখানে এই সাপ ছাড়া আর তো কেউ নেই। তাহলে কি এই সাপই মানুষের মত কথা বলছে? তখন তিনি সাপের কাছে গিয়ে তার গায়ে হাত বুলাতে লাগলেন, আর সাপও মনের আনন্দে দুলতে লাগল।
তারপর রাজা রাজপুরোহিতকে ডেকে এনে ক্ষত্রিয় বিধান মতে সেই সাপের সকল সংস্কার করালেন, নাম রাখলেন নাগেশ্বর।
মানুষের কণ্ঠে সাপ যখন কথা বলতে পারে, তাহলে এই সাপ নিশ্চয় শাপভ্রষ্ট কোনও ব্যক্তি হবে। এই চিন্তা করে তার ঘরে সুন্দর খাটের উপর সুন্দর বিছানা পেতে দেবার ব্যবস্থা করলেন রাজা।
আরো কয়েকটা বছর কেটে গেল, প্রতিদিনের মত রাজা পুত্রকে দেখতে গেলেন। একদিন দেখলেন পালঙ্কের উপর তার পুত্র বেশ সুখেই শুয়ে আছে, ফিরে আসবেন, এমনসময় আবার সেই মানুষের কণ্ঠে বলল-বাবা আমার বয়স হয়েছে, আমি এখন যুবক। কাজেই আমার বিয়ের ব্যবস্থা কর।
নাগেশ্বরের কথা শুনে রাজা বিস্মিত, কেমন করে এই সাপের বিয়ে হবে। সাপের বিয়ে হবে সপিণীর সঙ্গে, কিন্তু উপযুক্ত সপিণী পাব কোথায়? কে না চায় পুত্রের বিয়ে দিয়ে ঘরে পুত্রবধূ আনতে? মনে মনে রাজা বুঝতে পেরেছেন, এ সাপ কোন সাধারণ সাপ নয়, কিন্তু কোন্ অদৃষ্ট বলে এমন সাপের আকৃতি, কে বলবে?
রাজা নাগেশ্বরকে বললেন–বাবা, তোমার আমি বিয়ের ব্যবস্থা করছি, কিন্তু কোথায় পাব তোমার মেয়ে, কে তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে?
পিতার কথা শুনে নাগেশ্বর বলল–বাবা আপনি রাজা, আপনি ইচ্ছা করলে সবই পারেন, চেষ্টা করুন নিশ্চয় সফল হবেন।
শূরসেন মহাচিন্তায় পড়লেন। সাপকে কি কোনও নারী বিয়ে করতে চাইবে? তখন তিনি মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কিন্তু মন্ত্রীরা কি বলবেন? সাপের বিয়ে। কেউ কি কখনো শুনেছে?
রাজা বললেন–যেমন করেই হোক আপনারা আমার পুত্রের জন্য একটি সুলক্ষণা কন্যা এনে দিন। মন্ত্রীরা কোন দিন নাগেশ্বরকে দেখেনি। রাজার আদেশ পালন করতেই হবে। মন্ত্রীরা একসঙ্গে পরামর্শ করতে লাগলেন। কিন্তু কুল-কিনারা কিছু খুঁজে পেলেন না। ভাবতে ভাবতে সহসা এক বৃদ্ধ মন্ত্রী বললেন–পূর্বদেশে বিজয় নামে এক রাজা আছে, তার আটজন পুত্র আর একমাত্র কন্যা। যেমন রূপ, তেমনি গুণ। আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। যদি তিনি কন্যা দিতে রাজি হন। রাজাকে মন্ত্রীরা এই বিষয় জানালে রাজা প্রচুর অলংকার উপঢৌকন দিয়ে সসৈন্যে সেই মন্ত্রীকে পাঠিয়ে দিলেন বিজয় রাজের কাছে।
পার্ষদের সঙ্গে বিজয়রাজ বসে আছেন রাজসভায়, এমন সময় শূরসেনের মন্ত্রী সেই সব উপঢৌকন তাকে দিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। রাজা শুরসেনের নাম ডাক ছিল। তার নাম শোনা মাত্রই বিজয় রাজা খুব উৎসাহের সঙ্গে মন্ত্রীবরকে বসবার আসন দিলেন। এবং তার আসার কারণ জানতে চাইলেন।
উত্তরে মন্ত্রী বললেন–আমাদের রাজার একমাত্র পুত্র নাগেশ্বর, যদি আপনার কন্যার বিয়ে দেন তার সঙ্গে, তাই রাজামশাই আমাকে পাঠিয়েছেন। রাজার পুত্র যে সাপ, সে কথা কিন্তু তারা বললেন না।
মন্ত্রীর মুখে এই কথা শোনামাত্র বিজয়রাজ পরম আনন্দে বলেন উঠলেন–আমার পরম সৌভাগ্য যে শূরসেনের পুত্রবধূ হবে আমার কন্যা। আমার কন্যা ভাগ্যবতী বলতে হবে।
শুভ সংবাদ নিয়ে মন্ত্রী প্রতিষ্ঠা নগরে ফিরে গিয়ে রাজাকে সব বললেন। রাজা কিন্তু চিন্তায় পড়লেন, কেমন করে পুত্রের বিয়ে দেবেন। পুত্রের কাছে গিয়ে সব বললেন রাজা, তখন নাগেশ্বর রাজাকে বিবাহের কৌশল বলে দিল। রাজা বললেন–মন্ত্রীকে। মন্ত্রী আবার চললেন, বিজয়রাজের কাছে গিয়ে বললেন–হে রাজন, আমাদের রাজকুমার নিজে এসে বিয়ে করতে পারবেন না। বিশেষ অসুবিধায় পড়েছেন।
মন্ত্রীর কথা শুনে বিজয়রাজ বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। এও কি সম্ভব, বর আসবে না বিয়ে করতে, তাহলে বিয়ে হবে কেমন? কোনও কারণে যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে কন্যা বরের বাড়িতে যাবে সেখানেই না হয় বিয়ে হোক।
মন্ত্রী বললেন–না বিয়ে এখানেই হবে, রাজকুমারের তেমন ইচ্ছা। কুমার বলেছেন ক্ষত্রিয় আমরা, পাত্রী যখন স্থির, তখন কোনো কারণে পাত্র না গেলেও অস্ত্র কিংবা শস্ত্র কিংবা অলংকার যাকে হোক পাত্র হিসাবে ধরে মালা বদল করালেই হবে। হে রাজা, আপনি রাজকুমার নাশেশ্বরের কোন অস্ত্রের সঙ্গে শুভ লগ্নে আপনার কন্যার মালাবদল করুন। আমরা সমাদরে মহা ধুমধামে বধূমাতাকে নিয়ে যাব।
অগত্যা সেই ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হলেন বিজয়রাজ। অস্ত্রের সঙ্গে মালা বদল হল তার কন্যা ভোগবতীর। নানা অলংকারে সাজিয়ে বিশাল ধুমধামের সঙ্গে শোভাযাত্রা সহকারে চতুর্দোলায় চড়িয়ে শূরসেনের রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসা হল ভোগবতাঁকে। অন্দরমহলের এক সুন্দর সজ্জিত গৃহে তাকে রাখা হল। পরিচর্যার ব্যবস্থা করা হল। অনেক দাসী তার দেখা শোনায় থাকল কিন্তু যাঁর জন্য এ বাড়িতে আসা সেই স্বামী কোথায়? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না। তিনি কি বিদেশে না মৃগয়ায় গেছেন? এক এক করে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। রাজকুমারের দেখা নেই, এই বিষয়ে কেউ কিছু বলছে না। ভোগবতী সাহস করে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে না। ভোগবতী নিজের ঘরে বসে মনে মনে চিন্তা করছে।
এদিকে নাগেশ্বর থাকে তার নিজের ঘরে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দেখা হয় না, কেউ কাউকে চেনেও না। একদিন রানিমা নাগেশ্বরের ঘরে গেল তাকে দেখতে, মাকে দেখে নাগেশ্বর বলল–তোমরা আমার বিয়ে করা বউকে ঘরে আনলে কিন্তু বউ আমার কাছে আসে না কেন?
রানিমা জবাব দিতে পারলেন না। বউমা যাতে কষ্ট না পায় তাই তাকে সবাই মিলে যুক্তি করে ঠকিয়েছে। যখন সে জানতে পারবে তার স্বামী একটি সাপ, তখন সে বাঁচবে কেমন করে? যদি কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে? এই ভেবেই এতদিন তাঁকে স্বামীর কথা কেউ বলেনি। কিন্তু এখন ছেলে যে বউ দেখতে চাইছে, কি করি এখন?
রানি তখন তাঁর খাস দাসীকে ডেকে পাঠাল, তাকে ভাল করে বুঝিতে ভোগবতীর ঘরে পাঠিয়ে দিল। স্বামীর পরিচয় এমনভাবে পুত্রবধূর কাছে বলতে হবে যাতে করে সে নাগেশ্বরকে দেখামাত্র উভ্রান্ত হয়ে না পড়ে।
সেই দাসী ভগবতীর কাছে গিয়ে নানা গল্পসল্প করার সময় বলল–এতদিন বিয়ে হয়েছে তোমার, এই প্রাসাদে একা একা থাকতে হচ্ছে, স্বামীর সঙ্গে দেখা নেই, স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য মনটা ছটফট করছে, তা আমরা নিশ্চয় বুঝি, তাই এলাম তোমাকে বলতে, তুমি মহা ভাগ্যবতী মা, তোমার স্বামী একজন শাপভ্রষ্ট দেবতা, তার তুলনা হয়না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে মানুষের আকৃতি না ধরে একটি সর্গের আকৃতি ধরে জন্ম নিয়েছে। এই প্রাসাদেই থাকে রাজকুমার। যেহেতু সাপের মূর্তি তার, তাই সে সকলের সামনে বের হয়না, তুমি কি তোমার সেই স্বামীকে একবার দেখতে যাবে?
দাসীর মুখে স্বামীর কথা শুনে স্বামীকে দেখবার জন্য ভোগবতীর প্রাণটা ব্যাকুল হয়ে উঠল। আর বলল–সৌভাগ্য না থাকলে মানুষের ভাগ্যে কি দেবতা স্বামী জোটে? আমি নিশ্চয় আমার স্বামীকে দেখতে যাব। তার পরিচর্যা করব।
রানিমার কাছে দাসী এসে সব কথা বলল। দুচোখ জলে ভরে এল রানিমার। তারপর পুত্রবধূকে নিয়ে রানিমা নাগেশ্বরের ঘরে এলেন। প্রথমে সাপ দেখে একটু ভয় পেলেও দ্বিধা, সংকোচ কাটিয়ে নাগেশ্বরের দিকে এগিয়ে এল ভোগবতী। রানিমা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেলেন। মন প্রাণ দিয়ে স্বামীর সেবা করতে লাগল ভোগবতী।
একদিন অনেক রাত্রিতে পালঙ্কে শুয়ে আছে নাগেশ্বর ও ভোগবতী। সমগ্র রাজমহল নিশ্ৰুপ। সহসা নাগেশ্বর ভোগবতাঁকে বলল–এতদিন আমি তোমারই অপেক্ষায় এই শরীর নিয়ে আছি, ভোগবতী এখন তুমি আমাকে মুক্ত কর।
সাপ কথা বলছে দেখে ভোগবতী অবাক হয়ে গেল–হে স্বামী, তুমি কি বলছ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
নাগেশ্বর বলল–ভোগবতী, তোমার কি মনে নেই? আমি কিন্তু পূর্ব জন্মের কথা ভুলিনি। মনে করে দেখ, তুমি আমার পূর্বজন্মে স্ত্রী ছিলে। কৈলাসে শঙ্করের কাছে থাকতাম। একদিন পার্বতীর সঙ্গে মহেশ্বর কি একটা বিষয়ে নিয়ে হেসে উঠছেন দেখে আমিও হাসি চেপে রাখতে পারিনি। তখন আমাকে হাসতে দেখে মহেশ্বর ক্রোধভরে অভিশাপ দিলেন, তুই আমার কথায় হেসেছিস, যা তুই মানুষের ঘরে সাপ হয়ে জন্মাবি।
মহাদেবের অভিশাপ বাণী শুনে আমি বুঝলাম, গুরুজনদের গোপন কথা শুনে কি অপরাধই বা করেছি আমি। তখন আমি মহেশ্বরের চরণতলে লুটিয়ে পড়ে বললাম–প্রভু আমার বড় অন্যায় হয়েছে, তাই আপনি আমাকে শাপ দিলেন, কিন্তু দয়া করে বলুন কেমন করে আমি শাপ থেকে মুক্ত হব?
মহেশ্বর দয়া করে বললেন–বিবাহ করার পর গোদাবরীতে স্নান করলে নরদেহ লাভ করবে। ভোগবতী এবার আমি তোমার দ্বারা শাপমুক্ত হব।
নাগেশ্বরের কথা শুনে ভোগবতীর পূর্বজন্মের সব কথা স্মরণ হল, গোপনেই দুজন চলে গেল দণ্ডকারণ্যে, পবিত্র গোদাবরীর জল যেই না ডুব দিল নাগেশ্বর, সঙ্গে সঙ্গেই অন্যরূপ, অন্যরূপ মানবদেহ, রাজপুত্রই বটে, এক দিব্য যুবক। ভোগবতী স্নান করল সেই গোদাবরীতে। তারপর দুজনে মিলে ভক্তির সঙ্গে মহাদেবের পূজা করল। তারপর গোপনেই ফিরে এল রাজপ্রাসাদে।
প্রভাতে উঠে ভোগবতী এক দাসীর সাহায্যে রাজা ও রানিকে ডেকে আনল। বললেন–দেখুন মা, আপনাদের পুত্র পালঙ্কের উপর শুয়ে আছে, পুত্রকে দেখে তাদের আনন্দের সীমা নেই। নাগেশ্বর পিতা মাতার চরণে প্রণাম করল। তারপর বললেন–পিতা, এবার আমাদের বিদায় দিন, আমরা ছিলাম কৈলাসবাসী, শিবের শাপে আমি সর্পরূপে জন্মগ্রহণ করেছি আপনার ঘরে, এখন শাপমুক্ত হয়েছি। কাজেই এবার বিদায় দিন, আমরা শিবলোকে ফিরে যাই।
দুঃখের সঙ্গে রাজা শূরসেন বললেন–না বাবা, তা কেমন করে হবে? আমি বৃদ্ধ হয়েছি। আর যে কদিন আমার জীবন আছে, আমি বানপ্রস্থাশ্রমে কাটাতে চাই, তুমি এই রাজ্যের ভার নাও। তুমি রাজ্য পরিচালনা কর। তারপর যখন সময় হবে পুত্রের হাতে রাজ্য দিয়ে তুমি ইচ্ছামত স্থানে যেতে পারবে।
পিতার বাক্য লঙ্ঘন করতে পারল না নাগেশ্বর। প্রতিষ্ঠানপুরে রাজ সিংহাসনে বসে পরম আনন্দে প্রজাপালন করতে লাগলেন। আর তার শাসনে সমৃদ্ধ হল তার রাজ্য।
দিতির ত্রিভুবন বিজয়ী সন্তান লাভের অভিলাষ, কশ্যপের উপদেশে ব্রত ও গর্ভধারণ, ইন্দ্রের দ্বারা। গর্ভচ্ছেদন এবং উনপঞ্চাশ মরুতের সৃষ্টি, দিতির পুত্র হল দেবতা–
কশ্যপের অনেক পত্নী, তাদের মধ্যে প্রধান তিনজন, অদিতি, দিতি আর দনু। অদিতির পুত্ররা দেবতা, দিতির পুত্ররা দৈত্য আর দনুর পুত্ররা দানব। দেবতারা শান্তশিষ্ট, নম্র, বিনয়ী ধীর আর দৈত্য-দানবরা হল খল, কুটিল, অনাচারী, হিংস্র, দেবতাদের ঠিক বিপরীত। একই পিতার সন্তান হয়ে বিপরীত স্বভাব। সবসময় দেবতা আর দৈত্য-দানবের মধ্যে গণ্ডগোল লেগেই থাকত। কখনো কখনো মারামারি করতেও ছাড়ত না। অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে যুদ্ধও বাধে। মাঝে মাঝে সবার পিতা কাশ্যপ চুপ করে থাকেন, এ বিষয়ে কাউকে কোন কথাই বলেন না।
বিদ্যা-বুদ্ধিতে দেবতারা অনেক উন্নত। দৈত্য-দানবরা মহাশক্তিধর। কিন্তু দেবতাদের বুদ্ধির জোরে দৈত্য-দানবরা শক্তিশালী হয়েও প্রায় পরাজিত হত। তাই দিতি আর দনুর মনে শান্তি নেই। অদিতির ছেলেদের সবাই সুখ্যাতি করে, শ্রদ্ধা ও সমীহ করে। সেইজন্য অদিতির মনে না জানি কত অহংকার।
ছেলেদের সুখ্যাতি হলে সকল মায়েরই অন্তর আনন্দে ভরে ওঠে। পুত্রদের জন্য অদিতির মনে ছিল সেই আনন্দ। কিন্তু দিতি আর দনু, সেই আনন্দকেই অহংকার ভেবে নিয়ে অন্তরের মধ্যে জ্বলেপুড়ে মরতে লাগল।
অদিতির এই অহংকার আর সুখ কিভাবে নষ্ট করা যায়, তার উঁচু মাথাটা কিভাবে মাটিতে লুটিয়ে দেওয়া যায়–গোপনে সেই চিন্তাই করতে লাগল দিতি আর দনু। এমন সময় হঠাই সেখানে এসে হাজির নারদ। বললেন–মায়েরা, তোমরা কি চিন্তা করছ আমি জানি। এসব নিয়ে কেন নিজেদের কষ্ট বাড়াচ্ছ? পুণ্যকর্ম না করলে কি মনের মত ফল পাওয়া যায়? তোমরা আমার কথা যদি বুঝতে না পার তাহলে তোমাদের স্বামীদেবতা কাশ্যপকেই জিজ্ঞাসা করলে তো তিনিই তোমাদের বলবেন, এই বলেই দেবর্ষি নারদ সেখান থেকে চলে গেলেন।
দিতি আর দনু নারদের কথা ঠিকমতো বুঝতে পারল না। স্বামী কশ্যপকে জিজ্ঞাসাও করল না! নিজেরাই পরামর্শ করতে লাগল, দনু দিতিকে বলল–অদিতি সবসময় স্বামীর কাছে কাছেই থাকে। আর তার নানাভাবে সেবা করে। তুমি আর তাকে কাছে ঘেঁসতে দিওনা। তুমি সব সময় তার কাছে কাছে থাক আর সেবা যত্ন কর। দেখবে স্বামীর মন তোমার উপর পড়বে নিশ্চয়।
দনুর উপদেশটা দিতির মনে ধরল, কাশ্যপকে এভাবেই পুরোপুরিভাবে নিজের আয়ত্তে এনে মনের ইচ্ছা সফল করতে হবে। চিন্তামত কাজ শুরু করে দিল দিতি। সবসময় স্বামীর সেবাতেই ব্যস্ত রইল। সে সেবার কোনো ত্রুটি নেই। এইভাবে চলল বেশ কিছু দিন। প্রজাপতি কশ্যপ সন্তুষ্ট হলেন, দিতিকে বললেন–আমার অনেক পত্নীর মধ্যে অদিতিই কেবল আমার এতদিন সেবা যত্ন করত। তোমরা আর কেউ উৎসাহ দেখাতে না, কিন্তু এখন তুমি আমার সেবা যত্ন করে আমাকে খুব প্রীত করেছ, এখন তুমি কী বর চাও বল। কি পেলে তুমি খুশি হবে?
স্বামীর কথায় দিতি খুব খুশি। বলল–স্বামী, আমি এমন এক পুত্র চাই, যে হবে সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। ত্রিভুবন বিজয়ী হবে। সেই পুত্রকে কেউ কোনোদিন হারাতে পারবে না।
–তাই হবে, বললেন–কশ্যপ। কিন্তু তার জন্য তোমাকে একটি ব্রত করতে হবে।
দিতি বলল–সে ব্রত যত কঠোর হোক না কেন, আমি তা পালন করবই। বীরশ্রেষ্ঠ পুত্র আমার চাই-ই।
কশ্যপ বললেন–মন দিয়ে শোন তাহলে দিতি, মন থেকে সকল রকম পাপচিন্তা দূর করে বারো বছর ধরে কঠোর সংযমের মধ্যে থাকতে হবে। যদি সক্ষম হও তা পালন করতে, তাহলে অবশ্যই আমি তোমার বাসনা পূরণ করব।
বীর প্রসবিণী হওয়ার আশায় দিতি তাই করল। বারো বছর যাবৎ কঠিন সংযমের মধ্যে থেকে কাটাল সে, ব্রত পালনে কোনরূপ ত্রুটি নাই। সন্তুষ্ট হলেন কশ্যপ। দিতির গর্ভ সঞ্চার করলেন। তারপর উপদেশ দিলেন, যতদিন গর্ভে সন্তান থাকবে, ততদিন খুব কঠোরভাবে নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। সবরকম সদাচারে থাকতে হবে। মিথ্যে কথা বলা চলবে না। কখনও এলোচুলে থাকবে না। স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের চিন্তা করবে না। উত্তরদিকে মাথা করে শোবে না। সন্ধ্যার সময় শয়ন করবে না। বাড়ি ছাড়া কোথাও যাবে না। জোরে হাসবে না। এইরকম বহু উপদেশ দিলেন কশ্যপ। আর বললেন–যদি নিষ্ঠার সঙ্গে এই নিয়মগুলি পালন করতে পার, তাহলে নিশ্চয় সুপুত্র লাভ করবে।
এই কথা বলে তপস্যার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু কালের জন্য কশ্যপ চলে গেলেন অন্যত্র। তখন দিতি ঋষি অগস্ত্যের আশ্রমে এসে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলেন স্বামীর উপদেশ। দিন যায়, গর্ভ বৃদ্ধি পায়।
দনুর পুত্র ময়দানব মায়াবিদ্যা বলে দিতির গর্ভের ব্যাপার জেনে ফেলল। দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে তার খুবই বন্ধুত্ব। চিন্তা করলেন দিতির সন্তান যদি নির্বিঘ্নে ভূমিষ্ঠ হয় তাহলে বন্ধুর ভীষণ বিপদ হবে। তাই এই ব্যাপারে ইন্দ্রকে জানান উচিত বলে মনে করল সে। দানবদের সঙ্গে দেবতাদের সব সময় শত্রুতা, কিন্তু খুব বুদ্ধিমান ইন্দ্র কৌশল করে ময়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে নিয়েছিলেন। তার কারণ ময়ের বড় ভাই নমুচি তখন দানব প্রধান। একবার সে স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করলে দেবতাদের সঙ্গে বাধে তুমুল যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে ইন্দ্র পরাজিত হয়ে প্রাণ ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে লাগলেন। তাকে পালাতে দেখে নমুচি তার পিছে ধাওয়া করল। পেছনে নমুচিকে আসতে দেখে ইন্দ্র প্রাণ বাঁচাতে ঢুকে পড়লেন সমুদ্রের ফেনার মধ্যে, তারপর নমুচি সেখানে এসে তাকে আক্রমণ করলে ইন্দ্ৰ বজ্রের আঘাতে সেখানে নমুচিকে শেষ করে দিলেন। এভাবে দাদার মৃত্যুতে ময় খুব ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিজ্ঞা করল যেমন করেই হোক এর প্রতিশোধ নেবে। তাই সে শুরু করে দিল বিষ্ণু ও অগ্নির তপস্যা। সেই সময় সে কোন প্রার্থী এলে, তাকে তার ইচ্ছামত দ্রব্য প্রদান করতে লাগল। আর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু আর অগ্নিদেব তাকে দিল নানা বিধ অস্ত্রশস্ত্র। আবার বিষ্ণু ময়কে মায়াবিদ্যা দান করলেন।
মায়ের এই সাধনার কথা ইন্দ্র শুনেই তার একেবারে হৃদকম্পন শুরু হল। চিন্তা করলেন, কেমন করে তপস্যা নষ্ট করা যায়। ভাবতে ভাবতে একটি উপায় স্থির করে ব্রাহ্মণবেশে ময়ের কাছে গিয়ে উপস্থিত। ব্রাহ্মণকে প্রার্থীরূপে দেখে ময় জিজ্ঞাসা করল, কি পেলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন। ইন্দ্র চাইলেন, একমাত্র বন্ধুত্ব। আজব এই প্রার্থনা কিন্তু উপায় তো নাই। যে যা চাইবে ময় তাকে তাই দেবে, আর না দিলে সত্য রক্ষাও হয় না। দানব হলে কি হবে, সত্যভ্রষ্ট হতে কিন্তু ময়ের খুব ভয়। তাই বন্ধুত্ব স্বীকার করল, আর জানতে চাইল পরিচয়।
আত্মপ্রকাশ করলেন ইন্দ্র। সর্বনাশ, যাকে নিধন করার জন্য এই সাধনা, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কি আর করা যাবে। কথা যখন দিয়েছে তখন পালন করতেই হবে।
সেই থেকে ময় হল ইন্দ্রের বন্ধু। এখন ইন্দ্রের জন্য যে কোন কাজ করতে ময় প্রস্তুত। দিতির গর্ভের সংবাদ দিল ময় ইন্দ্রকে। খবরটা শুনেই ইন্দ্র যেন মুষড়ে পড়ল। দিতির পুত্রই তাহলে স্বর্গের অধিপতি হবে।
ময় বলল–এত মুষড়ে পড়লে চলবে না, একটু শক্ত হও আমার কথা শোন। বন্ধু, তুমি এখন কাশ্যপের আশ্রমে চলে যাও। সেখানে তোমার সম্মা দিতির সেবাযত্ন কর, যেমন নিজের মায়ের মত, তারপর সুযোগ পেলে তার গর্ভের সন্তানকে বিনষ্ট করে দাও। গর্ভের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যাক। অপূর্ব যুক্তি বন্ধু ময়ের খুব প্রশংসা করেই চললেন।
কাশ্যপের আশ্রমে দেবরাজ মনপ্রাণ দিয়ে সেবা করতে লাগলেন দিতির। আর খুঁজতে লাগলেন সুযোগ। ইন্দ্রকে এভাবে পরিচর্যা করতে দেখে দিতি অবাক হলেন। কিন্তু সে যে তার কোন ক্ষতি করতে পারে এটা কিন্তু কখনও ভাবতেও পারলেন না। যথারীতি কশ্যপের উপদেশ মেনে চলে দিতি, ত্রিভুবনবিজয়ী পুত্রলাভের আশায়।
একদিন খুব ক্লান্তি এসেছে দিতির। তখন সন্ধ্যাবেলা। চোখে যেন ঘুম জড়িয়ে আসছে, শুয়েই পড়লেন বিছানায় উত্তর দিকে মাথা রেখে। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বামীর নিয়মের কথায় কখন যেন বিস্মৃত হলেন।
ইন্দ্র সুযোগ পেয়ে গেলেন। কালবিলম্ব না করে ইন্দ্র প্রবেশ করলেন দিতির গর্ভের মধ্যে। সূক্ষ্ম আকারে বজ্র মারলেন শিশুর উপর। শিশুটি সাত টুকরো হয়ে গেল। আর্তনাদ করে উঠল। আমার তো এখনও জন্ম হয়নি। আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে কেন আমাকে মারবার জন্য বজ্র প্রয়োগ করলে, তা ছাড়া আমি তো তোমার ভাই, আমাকে এভাবে অসহায় অবস্থায় যে মারলে তাতে কি তোমার সম্মান বৃদ্ধি পাবে। তুমি তো সাধারণ ব্যক্তি নও, ত্রিভুবনের অধিপতি, তোমার দ্বারা এমন হীন অন্যায় কাজ করা কখনও উচিত হয়নি।
ইন্দ্র ভাবলেন, একটা বাচ্চাকে সাত টুকরো করলাম, এখনও দেখছি সাতটি জীবন্ত ছেলে হয়ে চিৎকার করছে। মা রুত কাঁদতে থাকেন, তাকে থামাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তারা শুনল না ইন্দ্রের কথা, ইন্দ্রও শুনলেন না তাদের কথা। আবার অস্ত্র প্রয়োগ করে এক এক টুকরোকে আবার সাতটি করে টুকরো করলেন। হয়ে গেল উনপঞ্চাশ খণ্ড কিন্তু তবুও কেউ মরল না। প্রজাপতি কশ্যপের অক্ষয় বীর্য। তাকে বিনাশ করবে কার সাধ্য আছে। সেই উনপঞ্চাশ জনই চিৎকার শুরু করে দিল।
সেই চিৎকারে দিতির ঘুম ভেঙে গেল। বুঝতে পারল, ইন্দ্র শান্তশিষ্ট সেজে তার সেবাযত্ন করতে এসে কি সর্বনাশই না করল। তার সব আশা ব্যর্থ হয়ে গেল। অভিশাপ দিলেন ইন্দ্রকে। ইন্দ্রের অপকর্ম কাশ্যপও জানলেন। তিনিও ইন্দ্রকে অভিশাপ দিলেন। ধ্যানযোগে কশ্যপে জানতে পারলেন, ছুটে এলেন অগস্ত্যের আশ্রমে। তার পুত্র হয়ে ইন্দ্র এমন কুকাজ করল? ইন্দ্র দিতির গর্ভের মধ্যে বসেই বাইরের সব কাণ্ড শুনলেন। ভয়ে আর বেরিয়ে আসতে পারলেন না। কিন্তু পিতা কশ্যপ এসে ডাক দিলেন, ইন্দ্র কোথায়, বেরিয়ে এস, অগত্যা ইন্দ্র বেরিয়ে এলেন। খুব তিরস্কার করলেন কশ্যপ। কি আর বলবেন ইন্দ্র মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
তারপর সবাই বসে চিন্তা করতে লাগলেন–এখন কি করা যায়। সবাই মিলে ব্রহ্মকে স্মরণ করলেন। ব্রহ্মা এসে সবকিছু অবগত হলেন। বললেন–এখন তার দ্বারা কিছু হবে না। মহাদেবের স্মরণ নেওয়া হোক। তখন সবাই মিলে স্তব স্তুতি করলেন মহাদেবকে। মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে ইন্দ্রকে শাপমুক্ত করলেন। আর দিতির গর্ভের ঊনপঞ্চাশ জন সন্তানকে মরুত নামে অভিহিত করলেন। অমরত্ব লাভ করল তারা, দেব সমাজে ঠাঁই পেল।
দিতির মনে আশা ছিল ত্রিভুবন বিজয়ী সন্তান লাভের। তা আর হল না। তবে তার পুত্রগণ অমর হয়ে দেবতার আসনে বসতে পেল, এটাও কিছু কম নয়।
মহামুনি দধীচির কাছে দেবতাগণ অস্ত্র সংরক্ষণ, মুনি কর্তৃক অস্ত্রের তেজ গ্রহণ ও স্বেচ্ছায় তনুত্যাগ। মুনির অস্থিতে বজ্র নির্মাণ, ঋষিপত্নী লোপামুদ্রার প্রাণত্যাগ, সুধাপানে সন্তানের জীবনধারণ, নাম পিপ্পলাদ, পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে শিবের ধ্যান। শিবের তৃতীয় নয়ন থেকে কৃত্যার আবির্ভাব, স্বর্গপুরী ধ্বংস দেবতাগণের পলায়ন। পিপ্পলাদের পিতা মাতাকে দর্শন ও উপদেশ লাভ–
ভাগীরথী নদীর তীরে বিশেষ শান্ত পরিবেশে দধীচি মুনির আশ্রম। দৈত্য দানবেরা কোনরূপ উপদ্রব করতে পারে না। যে-কোন অতিথি আসুন না কেন মুনিবর সবাইকে সমাদর করতেন। তাই সবাই দধীচি মুনিকে খুব শ্রদ্ধা করত। পতিব্রতা লোপামুদ্রা তারই ভার্যা। স্বামীর মত তিনিও সেবা-পরায়ণা, স্বামীর সকল কাজেই হাত লাগাতেন তিনি।
একদিন সূর্যদেব, রুদ্র অশ্বিনীকুমার, বিষ্ণু, যম, ইন্দ্র, আদি দেবতাগণ তাঁর আশ্রমে এলেন। কি সৌভাগ্য! মুনির আর আনন্দ ধরে না। কেমন করে সেবা করবেন তাদের, সেই নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দধীচি মুনি। দেবতারাও সেই মুনিকে সমাদর করে বললেন–মুনিবর, আমাদের সেবার জন্য এত ব্যস্ত হবেন না। আমরা একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি, সেটা মিটিয়ে এক্ষুনি চলে যাব।
দেবতারা আজ অতিথি মুনির আশ্রমে, তাদের কোনও নিষেধ তিনি শুনলেন না। তাই যথাযোগ্য সমাদরে পাদ্য, অর্ঘ্য, আসনাদি দিয়ে তাদের পূজা করে বললেন– এবার বলুন, আপনারা কোন্ প্রয়োজনে আমার কাছে এসেছেন? আপনাদের জন্য আমি কী করতে পারি? আমার সাধ্যের মধ্যে হলে আমি নিশ্চয় তা পূরণ করব।
দেবতারা বললেন–দানবদের সঙ্গে সবেমাত্র যুদ্ধ শেষ হল। এবারের যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি। আমাদের এই যুদ্ধের পর বহু শক্তিশালী অস্ত্র অবশিষ্ট রয়েছে। কিন্তু এমন কোনও নিরাপদ স্থান আমাদের নেই যেখানে নিশ্চিন্তে ওগুলি রেখে দিতে পারি। তাই এলাম আপনার কাছে। আপনার এই আশ্রমে দৈত্য দানবরা কখনও আসতে সাহস করে না। আপনি যদি এই অস্ত্রগুলি রেখে দেন, তাহলে খুব ভালো হয়। আবার প্রয়োজন হলে নিশ্চয় নিয়ে যাব।
দেবতাদের কথায় মুনিবর সঙ্গে সঙ্গেই রাজী হলেন। তখন অস্ত্রগুলি সেখানে রেখে দেবতারা ফিরে গেলেন স্বর্গে।
কিন্তু স্বামীর সঙ্গে একমত হতে পারলেন না লোপামুদ্রা। মুনিকে বললেন–আমার মনে হয় দেবতাদের কথায় এভাবে হঠাৎ রাজি হওয়া আপনার উচিত হয়নি। আমরা আশ্রমবাসী, আশ্রমে কেন অস্ত্র শস্ত্র থাকবে? আমাদের শত্রু কেউ নেই।
লোপামুদ্রার কথা শুনে দধীচি মুনি বললেন–কাজটা হয়তো ঠিক হয়নি। কিন্তু দেবতাদের কথা ফেলব কেমন করে? লোপামুদ্রা বললেন–অস্ত্রগুলি যদি কোনো কারণে হারিয়ে যায় কিংবা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কি হবে? দেবতারা ফেরৎ চাইলে দেবেন কেমন করে?
এবার দধীচি মুনির টনক নড়ল, বললেন–ঠিক বলেছ লোপামুদ্রা, কিন্তু দেবতাদের কথায় না বলব কেমন করে?
যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন উপায় কী? যত্ন করে রেখে দেওয়া ছাড়া আর কী করা যাবে? দেখতে দেখতে তিন লক্ষ ষাট হাজার বছর কেটে গেল। দেবতারা এর মধ্যে একটিবারও এলেন না মুনির আশ্রমে। অস্ত্রগুলি ক্রমশ ক্ষয় হতে লাগল দেখে মুনি বড় সমস্যায় পড়লেন। তাই একদিন মুনি তার ভগ্নি সভস্তিনীর সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন। (যার ডাক নাম বক) বড় মহীয়সী নারী, তিনি থাকেন মুনিরই আশ্রমে। কী আর পরামর্শ দেবেন তিনি, কেবল উদ্বেগই বাড়ল।
দিনে দিনে অস্ত্রগুলি প্রভাহীন আর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে দেখে সেগুলি সঠিকভাবে রক্ষার জন্য একটা উপায় স্থির করলেন মুনি নিজেই, যার ফলে দেবতারা যখন অস্ত্রগুলি চাইবে, তখন ঠিক পূর্বের মতই যেন দিতে পারেন। এবার তিনি মন্ত্রঃপুত জল দিয়ে অস্ত্রগুলি ধুয়ে ফেললেন। সেই ধৌত জলের সঙ্গে বেরিয়ে এল অস্ত্রের তীব্র তেজ। কোনো দ্বিধা না করেই দধীচি মুনি তা পান করে নিলেন। অস্ত্রগুলি তেজহীন হল। আর সেই সব তেজ জমা হয়ে রইল মুনির দেহের মধ্যে আর কোনো চিন্তা নাই মুনির।
এই কাজের পর দেবতারা এসে হাজির দধীচির আশ্রমে। চাইলেন তাদের অস্ত্র। বললেন–অসুরেরা আবার আমাদেরকে আক্রমণ করেছে, তাই অস্ত্রগুলি নিতে এলাম।
দধীচি মুনি দেবতাদের কথা শুনে বললেন–আপনারা এতদিন আসছেন না দেখে আমার খুব ভয় হয়েছিল, যদি দানবেরা এসে ওগুলি লুট করে নিয়ে যায়। তাই আমি ওগুলোকে অকেজো করে সব দিব্যশক্তি পান করে দেহাস্থিতে ধরে রেখেছি। আপনাদের ওই পুরনো অস্ত্রের তেজ আমি ফিরিয়ে দিতে পারব না।
মুনির কথা শুনে দেবতারা স্তম্ভিত হলেন, এখন উপায় কী?
মুনিবর একটু চিন্তা করে বললেন–একটা উপায় আছে। যোগবলে আমি আমার দেহ ত্যাগ করব। আপনারা আমার প্রাণহীন দেহ থেকে যেমন খুশি অস্ত্র তৈরি করে নিন।
মুনির এমন কথা শুনে দেবতারা অবাক হলেন, একি সম্ভব? আমাদের জন্য একজন খ্যাতনামা মুনি প্রাণ বিসর্জন দেবেন?
দেবতাদের মুখের ভাবে মুনিবর বললেন–এতে ইতস্তত করার কী আছে? আমার দেহ দিয়ে যে অস্ত্র তৈরি হবে তা দিয়ে অত্যাচারীরা বিনষ্ট হবে, সর্ব স্থানে শান্তি ফিরে আসবে। এ তো আমার পরম সৌভাগ্যের কথা। আত্মদানের এমন সুযোগ কে হাতছাড়া করতে চায়?
মুনির কথা শুনে দেবতারা আর কী বলবেন? মৌনী হয়ে সম্মতি জানালেন। যোগাসনে বসলেন দধীচি মুনি, পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার সংযোগ ঘটিয়ে দিলেন। পড়ে রইল নিষ্প্রাণ দেহ। তাই নিয়ে চলে গেলেন দেবতারা। দিলেন বিশ্বকর্মাকে। তারপর বিশ্বকর্মা শক্তিশালী মুনির অস্থি দিয়ে তৈরি করলেন এক ভয়ংকর বজ্র। তখন অসুরাধিপতি ছিলেন বৃত্র। ইন্দ্রের দ্বারা নিক্ষিপ্ত হয়ে সেই বজ্র বৃত্রকে সংহার করল। মহামুনি দধীচির কীর্তি ত্রিভুবনে প্রচারিত হল।
আশ্রমে বসে দধীচি মুনি যখন স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেন, সেই সময় মুনিপত্নী লোপামুদ্রা মন্দিরে উমার অর্চনায় ব্যস্ত ছিলেন। ফিরে এসে দেখলেন স্বামীর প্রাণহীন দেহ। তারপর শুনলেন সকল কথা, শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন তিনি। মনে পড়ল তাঁর বহুপূর্বের কথা, যেদিন দেবতারা এসেছিলেন তাদের অস্ত্রশস্ত্র তার স্বামীর কাছে রাখবার জন্য, বুঝতে পেরেছিলেন তিনি, কোন বিপদ ঘটতে পারে। সত্যই হল তাই। কিন্তু আর উপায় কী আছে। স্বামী ছাড়া তিনি বাঁচবেন কেমন করে? ঠিক করলেন এ দেহ আর রাখবেন না। অগ্নিতে বিসর্জন দেবেন। কিন্তু তার গর্ভে যে মহানমুনি দধীচির সন্তান। তাকে নিয়ে যে মরা হবে না। তাই তিনি যোগবলে সঙ্গে সঙ্গেই গর্ভাশয় থেকে শিশুটিকে বের করে একটি পিপ্পল গাছের তলায় রেখে দিয়ে গঙ্গা ধরাদেবী আর আশ্রমের বৃক্ষলতাদের আহ্বান করে বললেন–এই শিশুকে রেখে যাচ্ছি তোমাদের কাছে। তোমারই এর রক্ষক হলে।
তারপর লোপামুদ্রা অগ্নিতে প্রবেশ করে প্রাণ বিসর্জন ছিলেন। সকল আশ্রমবাসী হাহাকার করে উঠল। আশ্রমের বৃক্ষলতা, জীব-জন্তুগণও নীরবে কাঁদল। তারা যে এমন মা বাবা উভয়কেই হারাল।
গর্ভধারিণী চলে গেলে সদ্যজাত শিশু বাঁচবে কেমন করে? ওষধি লতা-বৃক্ষাদির অধিপতি সোমদেব সুধার অধিকারীও তিনি। সবাই তো সোমদেবের কাছে গিয়ে সদ্যেজাত মাতৃহারা শিশুর প্রাণ রক্ষার জন্য আবেদন জানালেন। কোন দ্বিধা না করে সোমদেব দিয়ে দিলেন সুধা। সেই সুধা পান করে শিশু বড় হতে লাগল।
পিপ্পলবৃক্ষই তার সজাগ দৃষ্টি রাখল শিশুটির উপর। তাই শিশুটি পিপ্পলাদ নামে পরিচিত হল। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল পিপ্পলাদ। বড় হয়ে মনে প্রশ্ন জাগল তার গাছের মা-বাবা গাছ। যে পশু, তার মা বাবা পশু। মানুষের বাবা মা তো মানুষ হবে। কিন্তু সে মানুষ হয়েও তার মা এই পিপ্পল গাছ? ছোট্ট বালক মনের তোলপাড় করা এই সমস্ত প্রশ্ন একদিন পিপ্পলকেই জিজ্ঞাসা করল পিপ্পলাদ। পিপ্পলি কোনও কথা গোপন না রেখে সব জানিয়ে দিল। শুনতে শুনতে পিপ্পলাদের চোখে জল এল। ক্রোধে রাঙা হয়ে উঠল মুখ। এত বড় অন্যায় করল দেবতারা। তাদের জন্যই প্রাণ দিতে হল পিতাকে। আর পিতার অভাবে মাও চলে গেলেন। আমি তাদের পুত্র হয়ে এই অন্যায় সহ্য করব না। প্রতিশোধ নেবই।
পিপ্পলাদকে ক্রোধান্বিত হতে দেখে পিপ্পল তাকে সোমদেবের কাছে পাঠিয়ে দিল। পিপ্পলাদ গেল সোমদেবের কাছে। শুনল একই কথা। সোমদেব কিন্তু সাবধান করে বলল–বাবা, তুমি, দেবতাদের চেন না, মহাশক্তিশালী তারা। প্রতিশোধ নিতে হলে তোমাকেও মহাশক্তিধর হতে হবে। তুমি এখনও বালক। আগে যুদ্ধবিদ্যা আয়ত্ত কর, শক্তি লাভ কর, তারপর না হয় প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে।
কথাটা যুক্তিপূর্ণ মনে হল পিপ্পলাদের। জিজ্ঞাসা করল–আপনি বলুন, কার কাছে আমি এসব বিদ্যা শিখতে পারব?
সোমদেব বললেন–এসব বিদ্যা শিখবার জন্য তুমি মহাদেবের কাছে যাও। গোদাবরী নদীর তীরে দণ্ডকারণ্য, সেখানেই বসে তুমি শিবের আরাধনা কর। তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই তোমার সিদ্ধিলাভ হবে।
সোমদেবের কথামত পিপ্পলাদ বসল গভীর ধ্যানে। সন্তুষ্ট হলেন শিব। আবির্ভূত হয়ে পিপ্পলাদকে বললেন–বৎস! পিপ্পলাদ কি তোমার প্রার্থনা?
পিপ্পলাদ বলল–আমি চাই পিতৃহত্যার প্রতিশোধ অর্থাৎ দেবতাগণের বিনাশ।
মহেশ্বর বললেন–বৎস। তুমি কি আমার তৃতীয় নয়ন দেখতে পাচ্ছো? যদি না পাও তাহলে আগে সেই চেষ্টা কর। তারপর অন্য কথা।
পিপ্পলাদ আবার শুরু করল কঠোর তপস্যা। চলে গেল বহুকাল, ধীরে ধীরে তার চোখের সামনে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠল শিবের তৃতীয় নয়ন। যা দিয়ে তিনি সমুদ্রের মধ্যে বিষকে ধ্বংস করতে পারেন। পিপ্পলাদের মনে আনন্দ আর ধরে না। এবার আমার কার্য সিদ্ধ হবে।
কিন্তু বাধ সাধলেন পিসিমা গজস্তিনী, দধীচির ভগ্নী। বললেন–মন থেকে ঈর্ষা ত্যাগ কর। প্রত্যেকে যে যার নিজ নিজ কর্মফল ভোগ করে। যার মনে ঈর্ষা থাকে তার নরকে গতি হয়। এ কথা আমার নয়, তোমার মায়ের। কাজেই দেবতাগণের প্রতি তোমার হিংসা করা তোমার উচিত নয়।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! মন তার তখন দেবনিধনে উন্মত্ত। দেবনিধন সংকল্পে অটল, সেই ইচ্ছাই জানাল শিবকে। শিব আর কি করবেন? তৃতীয় নয়নটি বিস্ফারিত করলেন। এক ভয়ংকর মূর্তি কৃত্যার সৃষ্টি হল। ঘোড়ার মত তার আকৃতি। জ্বলজ্বল করছে তার চোখ। লক লক করছে তার জিভ। সামনে যাকেই পাবে তাকেই যেন শেষ করে দেবে। বলল–কি করতে হবে আমাকে?
পিপ্পলাদ বলল–যেখানে যত দেবতা আছে সকলকে বিনাশ কর। তার কথা শেষ হতে না হতেই সেই কৃত্যা বিনাশকল্পে হা হা করে এগিয়ে আসছে সেই পিপ্পলাদের দিকেই। পিপ্পলাদ তো অবাক! বলল–আমাকে কেন? আমি তো দেবতা নই। কৃত্যা বলল–দেবতার সেবায় অমৃত পান করে তুমিও দেবতা।
নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে এনেছ। এখন উপায়? প্রাণ ভয়ে ছুটে চলল শিবের কাছে। পেছনে পেছনে ধাওয়া করে চলছে কৃত্যা। শিব কৃত্যাকে বাধা দিয়ে বললেন–পিপ্পলাদের ইচ্ছাতেই তোমার সৃষ্টি হয়েছে। তুমি পিপ্পলাদের কোনও ক্ষতি করবে না। আমার এখান থেকে তুমি এক যোজনের মধ্যে থাকবে না।
অগত্যা কৃত্যা সেখান থেকে চলে গেল। যেখানেই যায়, সেখানেই শুরু হয়ে যায় দারুণ অগ্নিকাণ্ড, স্বর্গপুরেও ভীষণ ব্যাপার। সইতে পারল না দেবতারা। ছুটে এলেন শিবের কাছে। বললেন–হে প্রভু, আমাদের আপনি রক্ষা করুন। কৃত্যার দ্বারা স্বর্গপুরী পুড়ে এখন ছাই। আপনার বরে পিপ্পলাদ দুরন্ত হয়ে উঠেছে। আপনি ওকে একটু শান্ত করুন।
মহাদেব বললেন–আপনারা আপাততঃ আমার কাছে এক যোজনের মধ্যে অবস্থান করুন। পিপ্পলাদকে শান্ত করা যায় কিনা দেখছি।
শিবের কথামত দেবতারা সেইখানেই রয়ে গেলেন। শিব পিপ্পলাদকে ডেকে বললেন–শোন পিপ্পলাদ, তুমি কত বড় মহান ঋষির পুত্র, পৃথিবীর উপকারের জন্য তিনি স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণ দান করেছিলেন। এমন মহান ব্যক্তির ছেলে হয়ে তোমার অন্যের উপর আক্রোশ করা উচিত হয়েছে কি? তাছাড়া দেবতাদের বিনাশ করে কি তুমি তোমার পিতা মাতাকে ফেরৎ পাবে?
মহাদেবের কথা শুনে শান্ত হল পিপ্পলাদ। ভাবলেন–সত্যই তো দেবতাদের বিনাশ করে মা বাবাকে তো ফিরে পাব না। মন থেকে দূর করলেন ক্রোধ। আমার পিতা মাতাকে কত লোক শ্রদ্ধা করত। কত খ্যাতি তাদের। কিন্তু আমার এই পাপচোখে তাদের একটিবারও দেখতে পেলাম না। এমন হতভাগ্য আমি। পিপ্পলাদের মন কেঁদে উঠল। মনমরা হয়ে সে বসে থাকল।
তাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে শিব স্নেহ করে তাকে বললেন–তুমি কেন এমন করে মনমরা হয়ে বসে আছো? কি ভাবছ? আমি তা পূরণ করার চেষ্টা করব।
পিপ্পলাদ বলল–এমনই হতভাগ্য আমি মা-বাবাকে একটিবার দেখতেও পেলাম না। যদি একবার তাদের দর্শন পেতাম। যদি তারা আমাকে আশীর্বাদ করতেন, তাহলে মনে শান্তি পেতাম।
শিব বললেন–পরের জন্য যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পারেন, তাদের মৃত্যু নাই। তারা অমর, তাদের আর জড় দেহ থাকে না বটে, কিন্তু চিন্ময় দেহ ধারণ করে সদা বিরাজিত। তোমার যখন পিতা-মাতাকে দেখার এত ইচ্ছা, তাহলে দেখ আমি তোমাকে দিব্য দৃষ্টি দান করছি।
সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে বিমান নেমে এল, সেই বিমানের মধ্যে বসে দধীচি মুনি তার ভার্য্যা লোপামুদ্রার সঙ্গে। পিপ্পলাদ চমকে উঠলেন। কে এঁরা। এঁরাই কি তার মা বাবা?
বিমান থেকে নেমে দধীচি ও লোপামুদ্রা পিপ্পলাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পিপ্পলাদের আর বুঝতে বাকি রইল না। যে এঁরাই তার পিতা মাতা। লম্বা হয়ে ভূমিতে অর্থাৎ সাস্টাঙ্গে প্রণাম জানাল সে। তাদের চরণে। তারা স্নেহাশীষে ভরিয়ে দিলেন পুত্রের মন। আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল পিপ্পলাদ।
তারপর তারা উভয়েই পিপ্পলাদকে বললেন–শুন পুত্র, আমাদের কিছু উপদেশ। এই চরাচরে কোন কিছুই চিরকাল থাকে না। যতদিন তুমি এই ধরায় থাকবে, নিজের স্বার্থ ভুলে সকলের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করবে। সবসময় চিন্তা করবে–এই জীবনটা তোমার একার জন্য নয়, সকলের জন্য। এখন তুমি নিজের আশ্রমে ফিরে গিয়ে বিয়ে করে সংসারী হও। এই কথা বলে মুনি দম্পতি ফিরে গেলেন সেই দিব্য বিমানে। অবাক হয়ে চেয়ে রইল পিপ্পলাদ। আর কোনও দুঃখ-ক্ষোভ নাই, ফিরে গেল আপনার আশ্রমে। পিতামাতার আদেশ যথাযথ ভাবেই পালন করে কালে এখন মহান ঋষিতে পরিণত হলেন পিপ্পলাদ।