বায়ু পুরাণ ৫১-৬০

একান্নতম অধ্যায়

সূত বললেন– এরপর পৃথিবীর উপরিভাগ ও নীচের ভাগের বর্ণনা শুনুন। এই ধরিত্রী, মাটি, আকাশ, বাতাস, জল, জ্যোতি পঞ্চভূতে পরিব্যাপ্ত। এরা অনন্ত জগতের ধারক। এই ধরাই সমস্ত প্রাণীর জননী। ধরিত্রীতে নানা জনপদ, অধিষ্ঠান, পত্তন, নদ, নদী, পাহাড় ও অনেক জাতি রয়েছে। এই পৃথিবী দেবী অনন্তা। এখানে নদ, নদী, সাগর, পর্বত ও আকাশের ভেতর ও অন্যান্য জায়গাতেও জল আছে। এজন্য জলরাশিকে অনন্ত বলা হয়। অগ্নি সকলেরই মধ্যে ব্যাপ্ত ও সমস্ত বস্তুর উৎপাদক, এজন্য এটি অনন্ত বলে কথিত। এছাড়া আকাশ নানা বস্তুর আশ্রয়, রমণীয়, বহু বিস্তৃত। সুতরাং অনন্ত আকাশ সজ্ঞাত বায়ুকে অনন্ত বলা হয়ে থাকে। পৃথিবীর ওপর জল ও জলের উপর ধরিত্রী দেবী রয়েছেন। তার নীচে আকাশ আবার মাটি, তারপর আবার জল এইভাবে পরের পর এই অনন্ত সৃষ্টির অন্ত নাই। পণ্ডিতেরা তাই বলেন।

সপ্তম রসাতল পর্যন্ত প্রথমে মাটি, তারপর জল, তারপর আকাশ এভাবে পর্যায় ভাগ আছে। রসাতলের বিস্তার অযুত যোজন এবং তা সমানভূমি। এভাবে পণ্ডিতরা সাতটি তলের এক এক তলকে বহু বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। অতল, সুতল, বিতল, গতস্তল মহাতল, শ্ৰীতল ও পাতাল পর পর এই সাতটি তল রয়েছে। এবার যথাক্রমে এদের ভূমি ভাগের বিষয় বলা হচ্ছে।

প্রথমটির মাটি কালো রঙের, দ্বিতীয়টির পাণ্ডুর, তৃতীয় লাল, চতুর্থ পীত, পঞ্চম শর্করার মতো। যষ্ঠটি পাথরে ভরা, সপ্তটির সোনার রঙ। এসব তলের প্রথমে ভীমনদী ইন্দ্ৰশত্রু অসুরদের রাজা নমুচির বাসস্থান রয়েছে। কালোমাটির প্রথম তলে রয়েছে শঙ্কুকর্ণ, নিষ্কলাদ, ভীমনামে রাক্ষস, শুলদন্ত স্বাপদ, মহাত্মা ধনঞ্জয় কলম ও অন্যান্য নাগ ইত্যাদি। দ্বিতীয় তলের প্রথমেই বিশালবক্ষ দৈত্যেন্দ্র মহাজম্ভের নগর। এখানে কৃষ্ণ, জয়গ্রীব, নিকুম্ভ, শঙ্খ গোমুখ, নীল রাক্ষস, মেঘ, কম্বল নাগ। অশ্বতর কদ্রপুত্র, মহাত্মা তক্ষক এদের পুর ও নগর রয়েছে। এছাড়া নাগ, দানব ও রাক্ষসদের বহু হাজার পুর এই দ্বিতীয় পাণ্ডু ভূমিতলে রয়েছে।

তৃতীয় তলে মহাত্মা প্রহ্লাদ, তারক, ত্রিশিরা, শিশুমার–এদের পুরী রয়েছে। চ্যবণ রাক্ষস, রাক্ষসেন্দ্র কুম্ভিল, খর, ক্রুর ইত্যাদির বিশাল আবাসস্থল তৃতীয় তলে। পীতভূমিতে নাগ, দানব ও রাক্ষসদের আবাসস্থল, চতুর্থ তলের মহাত্মা দানবরাজ কালনেমী, গজকর্ণ, কুঞ্জর–এদের পুরী ও হাজার নগর আছে। শর্করা ভূমি পঞ্চমতলে অসুর সিংহ ধীমান বিরোচনের নগর। নাগদের পুরী আছে। এছাড়া দানব ও রাক্ষসদের হাজার হাজার বাসস্থান। ষষ্ঠতলে পুলেমা মহিষ, উৎক্রোশের পুরী আছে। কশ্যপ পুত্র নাগরাজ বাসুকীও এখানে রয়েছেন, সর্বপশ্চিমের সপ্তমতলে স্ত্রী পুরুষ নিয়ে বলির পুরী আছে। এই পুরী সবসময় আনন্দিত, থাকে এটি দেবসুরদের দ্বারা রক্ষিত।

এখানে সুরকুন্দের মহানগর আছে। এই তলটিতে দিতি সুতদের অনেক সংখ্যক পুরী, হাজার হাজার নাগ নগর, দৈত্য, দানব আর রাক্ষসদের বাসগৃহ আছে। এই পাতাল তলের পর বিস্তীর্ণ জায়গাতে শেষ নাগের আবাসভূমি আছে। এই নাগের চোখ রক্তপদ্মের মতো, শরীরের প্রভা শঙ্খের মতো স্বচ্ছ সাদা ও পরনে নীল বসন। ইনি মহাত্মা অজেয় অমর। ঐ বিশাল মহাভুজ দ্যুতিমান, চিত্রমালাধারী বলবান কুণ্ডলীর মুখ, যেন সোনার চূড়ার মতো নির্মল ও প্রদীপ্ত। হাজার মুখ নিয়ে শোভা পেয়ে থাকেন। ইনি শ্বেত পর্বতের শিরোদেশে বাস করে থাকেন। মহাবল, মহানাগের এই মহাতেজা মহানাগপতিকে উপাসনা করেন। নাগবংশের অধিপতি হল এই শেষনাগ, দেব, অসুর, মহানাগ ও রাক্ষসদের নিয়ে এই ব্যবহারিক সাত রসাতলের বর্ণনা দেওয়া হল।

এই জায়গাটির পর যা কিছু আছে তা অদৃশ্য, ব্যবহার বর্জিত, অগম্য। এরপর প্রথমে যে পর্যন্ত সূর্য ও চাঁদ মণ্ডলাকারে প্রকাশ পেয়ে থাকে, চাঁদ ও সূর্যের সে সব গতির বর্ণনা করছি। সাতসমুদ্র ও সাত দ্বীপের যে পরিমাণ বিস্তার পৃথিবীর বিস্তারও ততদূর। চাঁদ ও সূর্য ঐ সাত দ্বীপ ও সাত সাগরের বাইরের পরিধি অর্থাৎ আকাশ মণ্ডলের পরিধি পর্যন্ত প্রকাশিত হয়ে থাকেন। সূর্য এই তিন লোক পরিভ্রমণ করেন, এজন্য একা-খ্য অবধাতু দ্বারা ‘রবি’ শব্দটি এসেছে। সূর্যমণ্ডল ভারতবর্ষের বিশাল বর্গ পরিমাণের সমান। সূর্যের বিস্তার নয় হাজার যোজন, চন্দ্রের পরিমাণ এর দ্বিগুণ। এরপর সাত দ্বীপ, সাত সাগর নিয়ে পৃথিবীর বিস্তার, দেবতারা এর পরিমাণ ঠিক করেছেন এবং এটি পুরাণুনুমোদিত। এই পৃথিবীর বিস্তার মেরু মধ্যে থেকে সবদিকেই এক কোটি যোজন এবং এর উচ্চতা মেরুর চারিদিকে ভূমির সমান। পৃথিবী চারদিকেই তিন কোটি এক লক্ষ হাজার যোজন বিস্তৃত। পৃথিবী বিস্তারের পরিমাণ এভাবে দেওয়া হয়ে থাকে। আকাশ যে পরিমাণ ও যে পর্যন্ত তারার সন্নিবেশ দেখা যায় তাকেই আকাশ মণ্ডল এবং ভূতলের পরিধি মণ্ডলকে ভূমণ্ডল মান বলা হয়। আবার ভূতলের পরিমাণ দিয়েই আকাশ মান নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। সপ্ত লোকমণ্ডল একের এক এইভাবে সংস্থিত। যেখানে প্রাণীরা থাকে ঐ সপ্তলোক নিয়েই অন্তকটাই পরিসংখ্যাও হয়। এর মধ্যে সপ্তদ্বীপা মেদিনী এবং ভুভব, মহ, জন, তপ ও সত্য এই সপ্তলোক।

এ সপ্তলোক নিজের নিজের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আবরণে আবৃত হয়ে পৃথক পৃথকভাবে বিরাজ করে। বাইরের আবরণই পরস্পর দশগুণ বেশি। অন্তকণ্টাহের চারিদিকে ঘন জল রয়েছে। তা সমস্ত পৃথিবীর মনজলকে ঘন উদধি দিয়ে ধারণ করে রয়েছে। ঘনোদধির পরেই ঘনতেজ রয়েছে। ঘনতেজের চারিদিক দিয়ে ঘন বায়ু ঐ মণ্ডলকে ধরে রেখেছে। ঘন বায়ুর পরমাহকাশ মহাকাশ মহাভূত দিয়ে এবং মহাভূত আবার মহাকাশ দিয়ে ঢাকা। ঐ মহাকাশ অনন্ত দিয়ে আবৃত।

এবার বলছি গ্রহ নক্ষত্রাদির কথা এবং লোকপালদের পুরী ও নগরের কথা। মেরুর পূর্বদিকে মানস পর্বতের চূড়োতে নানা প্রকারের সোনার মতো পরিষ্কার পবিত্র ইন্দ্রপুরী এবং দক্ষিণ দিকে মেরুর মাথায় সংযমন পুর আছে। সূর্যপুত্র যম এই পুরীতে বাস করেন। এর পর উত্তর দিকে মেরুর মাথায় বরুণের রমণীয় পুরী আছে। এভাবে উত্তরদিকে তাদের বিভাবরী পুরী। এভাবে লোকপাল গণ মানস পাহাড়ের উত্তর-পূর্বে তোক রক্ষার জন্য নিজেরা বাসস্থান করছেন। সূর্য যখন দক্ষিণ দিকে চলেন, তখন তাঁর বানের মতো গতি।

সূর্য তখন জ্যোতিশ্চক্র আশ্রয় করে সব সময় চলতে থাকেন। যখন তিনি মধ্যস্থানের অমরাবতীতে এসে পড়েন তখন তাকে বৈবস্বত যমের সংযমন পুরে উদয় বুঝতে হবে। রবি সুখাপুরীর মধ্যে চলে গেলে তখন অর্ধেক রাত হয়, পরে ঐ সুখাপুরী থেকেই সূর্যকে উঠতে দেখা যায়। এরপর বিভাবরী পুরীতে যখন আসেন অর্ধরাত হয়। সূর্য ইন্দ্রপুরীতে গিয়ে অস্তমিত হন। সে সময় দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দেশে বিকেল, দক্ষিণ ও অপরাপর দেশে দুপুর, উত্তরাপথে যে সব লোক বাস করে তাদের শেষ রাত এবং উত্তর-পূর্ব কোণে যাদের বাস, তাদের প্রথম রাত।

এভাবে উত্তর ভারতেও সূর্য সুখানামের বরুণ পুরীতে গেলে দুপুর, চন্দ্রের বিভাবরী পুরীতে গেলে উদয়, অমরাবতীতে অর্ধেক রাত এবং সংযমনপুরে অস্ত যায়। আর যখন চন্দ্রের বিভাবরী পুরীতে মধ্যাহ্ন ও ইন্দ্রে অমরাবতীতে উদয় তখন সংযমনপুরে অর্ধরাত আর বরুণের সুখাপুরে অস্ত যায়। এভাবে সূর্য তাড়াতাড়ি চলতে থাকলে মনে হয় আকাশের নক্ষত্ররা চলেছে। এভাবে সূর্য দক্ষিণের শেষে চারটি দ্বীপে বিচরণ করে বারবার উদিত হয় ও অস্ত যায় এবং মধ্যাহ্নে নিজ রশ্মি দিয়ে পূর্বাধ ও পরার্থে স্বর্গীয় দ্বারগুলোতে এক সাথেই সূর্য তাপ দিয়ে থাকেন। উদয় থেকে দুপুর পর্যন্ত তাপের পরিমাণ ও তেজ বাড়তে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে ঐ কিরণ কমতে কমতে অস্তে চলে যান। সূর্য সমস্ত দিকেই তাপ দিয়ে থাকেন পূর্ব দিকে এর উদয় ও পশ্চিমে অস্তাচল। সকল লোকের উত্তরে মেরু ও দক্ষিণে লোকালোক পর্বত। রশ্মি কমে গেলে রাত্রিতে আর লোকালোক পর্বত দেখতে পাওয়া যায় না। বহুদূর থেকে উদয়ের সময়ের সূর্যকে রশ্মিহীন বলে মনে হয়। সৌরকিরণ সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় অগ্নিতে প্রবেশ করে, আবার সূর্য উদয় হলে অগ্নির তেজ তাতে প্রবেশ করে। দক্ষিণ ও উত্তর এই দুই ভূমিতে যখন সূর্য উদিত হয় তখন রাত্রি জলের মধ্যে প্রবেশ করার জন্য জলের তামা রঙ হয়। আবার সূর্য অস্তমিত হলে দিন জলে প্রবেশ করে। দিন যখন জলে প্রবেশ করে তখন জলের রঙ সাদা হয়। সূর্যের উদয় ও অস্ত নিয়েই দিবা-রাত্রির ব্যবস্থা।

এভাবে সূর্য যখন পুষ্কর মধ্যে বিচরণ করেন, এক এক মুহূর্তে মেদিনীর এক এক অংশ অতিক্রম করে থাকেন। সূর্যকে মুহূর্তে একত্রিশ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার যোজন বলা হয়। যখন সূর্য ক্ষীরোদ সাগরে উত্তর দিক থেকে উদিত হয়ে বিচরণ করতে করতে দক্ষিণ দিকে বিষুব রেখায় আসেন, তখন বিষুব মণ্ডলের যোজন পরিমাণ হয় তিন কোটি একাশি লক্ষ যোজন। শাক দ্বীপের উত্তরদিকে উদিত হয়ে বিচরণ শ্রাবণ মাসে যখন সূর্য উত্তর কাষ্ঠা অবলম্বন করেন, সে সময় উত্তর কাষ্ঠাস্থিত মণ্ডল পরিমাণ হল এক কোটি আশি নিযুত আটান্ন লক্ষ যোজন।

সূর্যের উত্তর পথ নাগবীথি ও দক্ষিণ পথ অজবীথি নামে খ্যাত। মূলা পূর্বাষাঢ়া ও উত্তরষাঢ়া এই তিন নক্ষত্রে অজবীথি এবং অভিজিৎ প্রভৃতি তিন নক্ষত্রে নাগবীথি নির্দিষ্ট রয়েছে। দক্ষিণাচলে সূর্য যতদূর বিচরণ করেন তার মনজল পরিমাণ এক যোজন উঁচু। এর পরিমাণ একত্রিশ হাজার দুশ একুশ যোজন। কুমোরের চাকার গতির মতো সূর্য তাড়াতাড়ি দক্ষিণায়নের পথ শেষ করেন, সূর্য এই সময়ে বারো মুহূর্তের মধ্যে দ্রুত গতিতে ভালো ভালো ভূমিগুলো এবং সাথে তেরোটি নক্ষত্র অল্প সময়ের জন্য পরিভ্রমণ করেন। আর রাত্রিতে বারো মুহূর্তে আঠেরোটি নক্ষত্র পরিভ্রমণ করে থাকেন। সূর্য যখন উত্তরায়ণে অল্প গতিতে ঘোরেন, তখন চোদ্দটি নক্ষত্রকে পরিভ্রমণ করে থাকেন।

এরপর চক্রের গতি কমে গেলে, চক্রের মাঝে মাটির পিণ্ডের মত আস্তে আস্তে তিনি ধ্রুব নক্ষত্রে ভ্রমণ করেন। ঐ ধ্রুব নক্ষত্রকে ত্রিশ মুহূর্তে এক অহোরাত্র ভ্রমণ করে দুই কাষ্ঠার মাঝের মণ্ডলগুলো পরিভ্রমণ করেন। মঙ্গল ভ্রমণ করতে করতে সূর্য যখন উভয় কাষ্ঠার মাঝে আসেন তখনই তাঁর দিবারাত্রির মত দ্রুতগতি ও মন্দগতি হয়।

চন্দ্র উত্তরদিকে গেলে দিন অল্পগতি হয়। তেমনি সূর্যের উত্তর গতিতে রাত্রি দ্রুতগতি হয়। চাঁদ দক্ষিণে গেলে দিন শীঘ্রগতি এবং সূর্যের দক্ষিণ দিকের গতিতে রাত্রি অল্পগতি হয়। লোকালোক পর্বতের চারদিকে যে সব দিকপাল আছেন, তাদের ওপর দিয়ে বিশেষ বেগে অগস্ত্যে নক্ষত্র বিচরণ করেন। এর বিশেষ গতি দিয়েও দিন রাত ভাগ হয়ে থাকে। লোকালোক পর্বতের পেছনে ও সামনে সূর্য তেজ প্রকাশিত হয়। এর উচ্চতা এক হাজার দশ যোজন। এর একদিকে প্রকাশমান সূর্য ও অন্যদিকে অন্ধকারময় এবং সবদিক পরিমণ্ডল তারাদের সাথে নক্ষত্র প্রহর্তা চাঁদ ও সূর্যরা অভ্যন্তর ভাগ থেকে আলো দিয়ে থাকেন। লোকালোক পর্বত প্রমথদের একাংশে প্রকাশিত অন্য অনেককাংশ অপ্রকাশ এভাবেই রয়েছে। দিন ও রাত্রির মাঝের সময়কে সন্ধ্যা বলে। এক সময় সন্ধ্যাকালে রাক্ষসেরা সূর্যকে গ্রাস করতে চাইল। সন্দেহ নামে বিখ্যাত দুরাত্মা ত্রিশকোটি রাক্ষস প্রতিদিন সূর্যকে খেতে চায়। তাই ভীষণ যুদ্ধ বাধে সুর্যের সঙ্গে রাক্ষসদের। তারপর শ্রেষ্ঠ দেবতারা ও ব্রাহ্মণরা সন্ধ্যাকে উপাসনা করে এক মহাজল নিক্ষেপ করেন। ঐ জল ওঙ্কার মন্ত্র ও গায়ত্রী মন্ত্রপুত, সেজন্য বজ্রের মতো দৈত্যদের পুড়িয়ে মারে। ব্রাহ্মণরা আকৃতি দান করলেন হাজার কিরণ সূর্য আরও প্রদীপ্ত হয়ে ওঠেন। এরপর মহাদ্যুতিময় পরাক্রমশালী সূর্য সহস্র যোজন ও পরে চলে যায়। এরপর ভগবান ব্রহ্মা, বালখিল্য ঋষি, মহর্ষি মরীচি ও ব্রাহ্মণেরা নিজের জায়গায় চলে যায়। পনেরো নিমেষে এক কাষ্ঠা, ত্রিশ কাষ্ঠায় এক কলা, ত্রিশ কলায় এক মুহূর্ত, ত্রিশ মুহূর্তে এক অহোরাত্র গোনা হয়। দিনের ভাগ অনুসারে তা যথাক্রমে কমে বা বেড়ে গেলেও সন্ধ্যায় পলিত। সব ভালোই এক মুহূর্ত থাকবে। দিনের হ্রাস বৃদ্ধিতে এর ব্যতিক্রম হবে না। আদিত্য যখন নিজের রেখাতে থাকেন, তখন থেকে তিন মুহূর্তকালের নাম প্রাতস্তন এবং তা দিনের পাঁচভাগের একভাগ। সেই প্রাতস্তন কাল থেকে মুহূর্ত এর সঙ্গব এবং সঙ্গব কালের পর তিন মুহূর্ত মধ্যাহ্ন। ঐ সায়াহ্ন সাধ পনেরো মুহূর্তের পর মুহূর্ত ত্রয়। পনেরো মুহূর্ত দিন ও রাত্রির সমান মধ্যস্থলে।

দিন ও রাত্রির পরিণাম সার্ধ পনেরো মুহূর্ত করে বলা হয়। কখনও দিন রাত্রিকে কখনও রাত্রি দিনকে গ্রাস করে। এজন্য দক্ষিণ ও উত্তরায়ণে দিন রাত্রির মানের হ্রাস বৃদ্ধি হয়। শরৎ ও বসন্ত কালে এই দিন ও রাত্রি সমান হয়। এভাবে পনেরো দিনে এক পক্ষ, দুই পক্ষে এক মাস, এক বৎসর। একশো বিরাশি কলায় এক মাত্রা হয়। পণ্ডিতরা চল্লিশ হাজার আটশো সত্তর মাত্রায় বৈদ্যুতি পরিমাণ নির্ণয় করেন। চারশো বৈদ্যুতি পরিমাণে চরাংশ ও নালিকা হয়। সংবৎসর প্রভৃতির পাঁচ রকম বছরের চাররকম পরিমাণ বিশেষে আছে। কুড়িশত পর্ব পূর্ণ হলে রবির একযুগ হয়। এক অয়নে ষাট সৌরমাস।

শ্বেত পর্বতের উত্তরদিকে শৃঙ্গবনে পর্বতের তিনটি চূড়া আছে। পূর্বদিকে সোনার, দক্ষিণদিকে রূপার, উত্তর দিকে শৃঙ্গটি নানা ধাতু দিয়ে তৈরী। সূর্য যখন শরৎ ও বসন্ত কালে মধ্যম গতি অবলম্বন করে সেই পর্বতের বিষুবরেখার কাছের শৃঙ্গে চলে যান, তখন দিন ও রাত সমান হয়। সূর্যের রথে দিব্য ঘোড়াগুলো যুক্ত রয়েছে। এরা পদ্মরাগের কিরণে রাঙা, মেষ রাশি ও তুলা রাশিতে সূর্য থাকলে, দিন ও রাত্রি পনেরো মুহূর্ত হয়।

সূর্য যখন কৃত্তিকা নক্ষত্রের প্রথমাংশে থাকেন, চাঁদ তখন বিশাখা নক্ষত্রের চতুর্থ অংশের অবস্থান করেন। সূর্য যখন বিশাখার তৃতীয় অংশে অবস্থান করেন, চাঁদ তখন কৃত্তিকায় মাথায় বিরাজ করেন। মহর্ষিরা এই কালকে বিষুবকাল বলে বর্ণনা করেন। চাঁদ ও সূর্যের গতি দিয়েই কাল নির্ণীত হয়ে থাকে। বিষুবকালে রাত্রি ও দিন সমান হয়। এই সময়ে পিতাদের উদ্দেশ্যে দান করা উচিত। বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের দান করবে। কারণ ব্রাহ্মণ দেবতার মুখ স্বরূপ, কলা, কাঠা, মুহূর্ত প্রভৃতির তারতম্যে দিনরাত্রি ও অধিমাস হয়।

অনুমিতি ও রাকা দুটিই পূর্ণিমা। আর সিনীবালী ও কুহু এই দু-রকম অমাবস্যাও হয়ে থাকে। মাঘ ও ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় এরা উত্তরায়ণ এবং শ্রাবণ ও ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ এরা দক্ষিণায়ন বলে বিখ্যাত। সবার মিলনে এক বৎসর হয়। ব্রহ্মতনয় পাঁচ বৎসর এর কথা বলা হয়েছে। ঋতুগুলো এদেরই অংশ, দৈব ও পত্রিক কাজে ঋতু থেকে অমাবস্যা এবং তা থেকেই বিষুবই প্রশস্ত লোকালোক পর্বত আলোকের শেষ ভাগে রয়েছে। লোকপালেরা এখানেই বাস করেন। বিরাজ, সুধামা, শঙ্খপাখ্য, কদম, হিরণ্যলোম, রজত ও কেতুমাল লোকলোক পর্বতের চারধারে থাকেন। এরা অনলস, পরিজন ছাড়া, নিরভিমান, অগস্ত্যের উত্তরে অজবীথির দক্ষিণ পথটি পিতৃবান বলা হয়। এখানে প্রজাবনে অগ্নিহোত্রী মুনিরা বাস করেন।

এঁদের আগের বংশধরের বাড়িতে পরবর্তী বংশধরের যেমন জন্ম হয়, তেমনি পরের বংশধরের বাড়িতেও আগের বংশধরের মরণের পর উৎপত্তি হয়ে থাকে। অষ্টাশি হাজার গৃহস্থ মুনি প্ৰজাবিস্তারের জন্য দক্ষিণপথ আশ্রয় করে চাঁদের স্থিতিকাল অবধি থাকেন। এরা লোক ব্যবহার, ইচ্ছা, দ্বেষ যুক্ত প্রভৃতি বিষয় ভোগ জনিত দোষে এই সিদ্ধগণ শ্মশান আশ্রয় করেন। দ্বাপর যুগে এরা প্রজা কামনায় জন্ম নেন। নাগবীথির উত্তরে সপ্তর্ষি মণ্ডলের দক্ষিণে সূর্যের উত্তরাপথ, এটি দেবযান নামে খ্যাত।

সেখানে যে ব্রহ্মচারীরা বাস করেন তারা গৃহস্থ নন। এঁরা মৃত্যুকে জয় করেছেন। এই ঊর্ধরেতা মুনিরা সংখ্যায় অষ্টাশি হাজার। এরা কল্পস্থিতিকাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। এঁরা লোক প্রসঙ্গ বর্জন, ইচ্ছা, দ্বেষ, সংযম ইত্যাদি কারণে অমৃতত্ব লাভ করেছেন। এটি ত্রৈলোকের স্থিতিকাল ব্রহ্মহত্যাপাপী, অশ্বমেধ জনিত পুণ্যবান বা ঊর্ধরেতা। সবাই প্রলয়কালে ক্ষয়প্রাপ্ত হন। সপ্তর্ষি মণ্ডলের ওপরে ধ্রুবের নিজের ভাগ পর্যন্ত বিষ্ণুপাদ, এখানে এসে আর ফিরতে হয় না। এই পাদ আশ্রয় করেই লোকসাধক ধ্রুব অবস্থান করেন।

.

বাহান্নতম অধ্যায়

সূত বললেন, স্বায়ম্ভর মন্বন্তর বর্ণনা প্রসঙ্গে অতীতে যা বলা হয়। এখন ভবিষ্যত বিবরণ বলছি। ঋষিরা একথা শুনে লোমহর্ষণ সূতকে চাঁদ ও সুর্যের গতির কথা জিজ্ঞাসা করলেন। ঋষিরা জিজ্ঞাসা করলেন–এই সব জ্যোতিষ্ক মণ্ডলী কিভাবে আকাশে পরস্পর সংখ্যাত ছাড়া ঘুরে চলেছে? এই বিচিত্র বৃত্তান্ত শুনতে ইচ্ছা হয়। সূত বললেন–এ বৃত্তান্ত প্রত্যক্ষ দেখা গেলেও প্রাণীরা মুগ্ধ হয়ে থাকে। নরমণ্ডলে উত্তানপুত্র ধ্রুব চাঁদ সূর্য গ্রহ নক্ষত্রাদির সঙ্গে ভ্রমণ করেন। ধ্রুবের এই স্বাধীন পরিভ্রমণ দ্বারা চাঁদ সূর্য গ্রহ নক্ষত্রাদি নিয়ন্ত্রিত হয়। এদের যোগভেদ, অস্ত, উদয়, দক্ষিণায়ন, উত্তরায়ণ বিষুব, গ্রহবর্ণ এই সমস্তই ধ্রুব থেকে ঘটে। জ্যোতিষ্ক মণ্ডলী ধ্রুবের অধিকারে রয়েছে সূর্য শুধু নিজের তেজে ঢেকে ফেলেন মাত্র। হে বিপ্রজন, সূর্য থেকে বায়ুযুক্ত নাড়ী দিয়ে কোনে সংক্রান্ত হয়ে থাকে। লোক থেকে যে জল আসে তা মেঘে থাকে পরে মেঘ থেকে বায়ুজনিত আঘাতে ঐ জল মাটিতে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে। জলরাশি এভাবেই ওপরে উঠে মাটিতে পড়ে।

কিন্তু এর নাশ হয় না, পরিবর্তনই ঘটে থাকে। বিধাতা এই মায়া দিয়েই ভূতদের ধারণ করে থাকেন। ত্রিলোক এই মায়া দিয়েই আচ্ছন্ন। সূর্যদেবই সর্বলোক প্রভু, প্রজাপালক, সমস্ত লোকে যত জল আছে, তা চন্দ্র থেকে ঝরে পড়ছে। সূর্য থেকে গ্রীষ্ম আর লোম থেকে আসে শীত। হে দ্বিজোত্তম গণ! লোমপুত্র প্রভৃতিও নানা মহানদীরূপে পরিণত হয়েছেন। সর্বভূতের শরীরে জল রয়েছে। পুড়ে যাওয়ায় পর সেই জল ধোঁয়া হয়ে যায়। তাতেই অভ্রের উৎপত্তি, এতেই জলরাশি থাকে। মেঘ বায়ুজাত বজ্রধ্বনি আর অগ্নিজাত বিদ্যুত-এর প্রকাশ করে ছয় মাস বৃষ্টি দিয়ে থাকে।

কবিরা মেঘকে বলেন অভ্র, মেঘগুলো উৎপত্তি ভেদে তিন রকম! আগ্নেয়, ব্রহ্মজ ও পক্ষজ। আগ্নেয় মেঘ জলজাত। এই মেঘে শীত, বৃষ্টি, বাতাস এগুলো মিলে উপলব্ধি হয়। এরা মোষ, শূকর কিংবা মত্ত হাতির মতো পৃথিবীতে নেমে আসে। এদের নাম জীমূত। এদের দ্বারাই জীব সৃষ্টি রক্ষা পায়। এরা জল ধারাময়, শব্দহীন ও মহাকায় বৃক্ষ নিঃশ্বাসে উৎপন্ন বিদ্যুৎগুণ যুক্ত গর্জন প্রিয় মেঘেরা ব্রহ্মজ নামে বিখ্যাত। মাটি থেকে উঁচুতে পর্বত চূড়ায় এরা বর্ষণ ও গর্জন করে থাকে। ধরণী তাদের গর্জন শুনে আনন্দিত হয়। শস্যশ্যামলা সুন্দরী হয়ে ওঠে।

পক্ষজ মেঘদের নাম পুষ্করাবর্ত। আগে ইন্দ্র পক্ষধর বিরাট বিরাট পাহাড়দের অত্যাচার থেকে প্রাণীদের রক্ষা করার জন্য তাদের পাখাগুলো কেটে দেন। এই পাখাগুলো জলে ভরা মেঘ হয়ে যায়। এদের নাম পুরষ্করাবর্ত। তারা নানা রূপধারী ঘোরাকার। এরা কল্পের শেষে বর্ষণ ঘটায়। এই তৃতীয় শ্রেণীর মেঘেরা যুগান্তকালে বৃষ্টি দেয়। এরা কল্পপরিবর্তের কাজ করে। যে প্রকৃত হিরন্ময় অন্ত এর মধ্যে ব্রহ্মা উদ্ভূত হয়েছেন। সেই ঘোলা থেকেই মেঘদের সৃষ্টি। পর্জন্য ও দিগগজ নামে মেঘেরা হেমন্তকালে মাস্য বৃদ্ধির জন্য ঠান্ডা তুষার রাশি বর্ষণ করে পরিবহ নামে শ্রেষ্ঠ বায়ুদের আশ্রয়। এই বায়ু স্বর্গ পথে তিনটে ধারাতে পুণ্যা অমৃতশালিনী আকাশগঙ্গা বয়ে চলেছে।

হিমালয়ের উত্তরে সুমেরুর দক্ষিণে আর হেমকূট নামে পর্বতের মাঝে পুণ্ড্র নামে বিখ্যাত এক নগর আছে। সেই পর্বতে তুষার বৃষ্টি হলে পর আবহ বায়ু নিজের প্রভাব নিয়ে আবার সেই মহাগিরিতেই বর্ষণ করে। হেমকূট থেকে হিমালয় পর্যন্তই বৃষ্টি ছয়ান্য দেশে তেমন হয় না। তবে অল্প অল্প যে বৃষ্টি তাতে ভূমির শস্য বৃদ্ধি হয়। সূর্যই প্রকৃতপক্ষে বৃষ্টির স্রষ্টা, সূর্য ও বায়ু আবার ধ্রুবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এরপর সূর্য রথের কথা বলা হচ্ছে। এর রথ একটি চক্র, পাঁচটি অর ও তিনটি নাভিযুক্ত, স্বর্ণময় ছয়রকম ভেদমুক্ত একটি চাকার প্রান্ত নিয়ে গঠিত। এটি পথের অন্ধকার দূর করে খুবই উজ্জ্বল ও মহাবেগশালী। এই রথে সূর্য বিচরণ করেন। এই রথের বিস্তার পরিমাণ দশ হাজার যোজন। ব্রহ্মা সোনার তৈরি, প্রচণ্ড বেগশালী অশ্বযুক্ত মহারথ তৈরি করেছিলেন। এই জ্যোতির্ময় রথে চড়ে সূর্য অন্তরীক্ষ পথে বিচরণ করে থাকেন। এই রথের নাভি দিবা, অরা ও নেমি ছয় ঋতু, রথমধ্য অব্দ, কুরদ্বয় দুই অয়ন বন্ধুর মুহূর্ত, যুগ ও অক্ষ কোটি অর্থ ও কাম, সোনা-কাষ্ঠা-ক্ষণ, অনুকৰ্ষ-নিমেষ, ঈর্ষা সব, উন্নত ধ্বজ-ধর্ম এবং এর বাহন সাতটি অশ্ব। গায়ত্রী, ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ, জগতী, পঙ্কিত, বৃহতী, উষ্ণীক–এই সাতটি ছন্দ। এর চক্র অক্ষে বাঁধা, অক্ষ ধ্রুবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এজন্য চক্রের সাথে অক্ষ ভ্রমণ করে। এই জ্যোতির্ময় রথে চড়ে নভোমণ্ডল পরিভ্রমণ করছেন সূর্য। ধ্রুবতারা আকাশপথে রথকে ঘুরিয়ে চলেছে।

.

তিপান্নতম অধ্যায়

সূত বললেন– সেই সূর্যরথে আদিত্য, দেবতা পনর্ধব, অপ্সরা গ্রামের নেতা, সর্প ও রাক্ষস, এরা পর্যায় ক্রমে দুমাস করে থাকে। চৈত্র ও বৈশাখ– এই দুমাস থাকে বাতাস্ত অর্যমা এই দুজন আদিত্য। পুলস্ত পুলহ এই দুজন ঋষি। বাসুকী সংকীর্ণ দুজন সর্প, তম্বুর ও নারদ এ দুজন গায়ক শ্রেষ্ঠ গন্ধর্ব, ক্রতু স্থলা, পুঞ্জিকাস্থলা ও দুজন অপ্সরা রথকৃচ্ছ ও উর্জ ও দুজন গ্রামণী হেবি ও প্রবেতি দুজন রাক্ষস। জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় এ দুমাস থাকে মিত্র ও বরুণ আদিত্য, অত্রি, বশিষ্ঠ ঋষি, তক্ষক ও রম্ভসৰ্প, মেনকা ও সহজন্য অপ্সরা, হাহা ও হু হু গন্ধর্ব, রথস্বন ও রথচক্র গ্রামের নেতা, পৌরুষেয় ও বধ-রাক্ষস শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে ইন্দ্র বিবস্বান আদিত্য, অঙ্গিরা ও ভৃগুমুনি, এলাপত্র ও সঙ্খপাল সর্প, বিশ্বাবসু ও উগ্রসেন গন্ধর্ব প্রাতঃ অরুণ গ্রামণী, প্রয়োচ ও নিম্নোচ অপ্সরা, বাঘ ও শ্বেত রাক্ষক–এরা বাস করে।

শরতকালে শুভ্রদেব মুনিরা বাস করেন। পর্জন্ত ও পুষ্প আদিত্য, ভরদ্বাজ ও গৌতম মুনি, বিশ্বাবসু ও সুরভী গব্য বিশ্বাচী, ও ঘৃতাচী অপ্সরা ঐরাবত ও ধনঞ্জয় সর্প, লোহিত ও সুষেণ গ্রামের নেতা, আপত্তবতে রাক্ষস এরা, আশ্বিন ও কার্তিক এই দুই মাস সূর্যরথে বাস করে, অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে অংশ ও ভগ আদিত্য, কশ্যপ ও ঋতুমুনি মহাপদ্ম, কর্কটক সর্প চিত্ৰকোণ ও ঊনায় গন্ধর্ব, ঊর্বশী ও বিচিত্তি অপ্সরা, তাক্ষ ও আবষ্টনেমি গ্রামের নেতা, বিদ্যুৎ ও স্ফুর্জ রাক্ষস এরা সূর্যরথে বাস করে। শীতকালে মাঘ ফাল্গুন এই দুই মাস সুষেণ ও বিষ্ণ আদিত্য জমগ্ন ও বিশ্বামিত্র মুনি, কম্বল ও অশ্বতর সর্প, ধৃতরাষ্ট্র সূর্যবর্চা গন্ধর্ব, তিলোত্তমা ও রম্ভা অপ্সরা, ঋতজিত ও সত্যজিৎ গ্রামের নেতা, বক্ষোপেত যজ্ঞোপেত রাক্ষস এরা সূর্যরথে থাকে। এঁরা আত্মতেজে সুর্যকে আপ্যায়িত করে থাকেন। মুনিরা রবির স্তব পাঠ করেন। গন্ধর্বরা নাচে গানে তাঁকে তৃপ্তি দেন। গ্রামের নেতারা রথের রশ্মি ধারণ করে থাকেন। সর্পেরা সূর্যকে বাহন করে থাকে। রাক্ষসরা রক্ষীরূপে সূর্যকে অনগমন করে। মুনিরা উদয় থেকে অস্ত অবধি বরিকে পরিচর‍্যা করেন। এই সমস্ত দেব, মুনি, গন্ধর্ব, পন্নগ, অপ্সরা, গ্রামের নেতা ও রাক্ষসরা সূর্যরথে ছমাস বাস করে তাপ, বৃষ্টি, প্রকাশ ও বাতাস ইত্যাদি প্রাণীদের শুভাশুভ উৎপাদন করে থাকেন। এঁরা কখনো নানা দেহের শুভ অবতরণ করে অশুভ বিধান করেন, কখনো পাপীদের পাপরাশি এরা বায়ুবেগী বিমানে চড়ে সূর্যের সাথে ভ্রমণ করে। মন্বন্তর কাল পর্যন্ত এরা বৃষ্টি ও রোদ দিয়ে প্রজাদের আনন্দ বিধান করে থাকেন।

অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব কালেই একই নিয়ম। চোদ্দ মন্বন্তর পর্যন্তই এঁরা এভাবে আবর্তিত হয়। সূর্যদেব রশ্মি পরিবর্তন করে দিনরাত্রি ভাগ করে গ্রীষ্মে তাপ, শীতে হিম এবং বর্ষাকালে বৃষ্টি দিয়ে পিতা ও মানুষদের তৃপ্তিসাধন করে থাকেন। চন্দ্র শুক্লপক্ষে সূর্যের তেজে পূর্ণ হলে, দেবতারা কৃষ্ণপক্ষে সেই অমৃত পান করেন। সূর্য থেকে সেই অমৃত, জলরাশি ও বৃষ্টি পেয়ে শস্য বেড়ে ওঠে। মর্তের লোকেরা তা অন্নরূপে ব্যবহার করে খিদে মেটায়। দেবতারা অমৃত দিয়ে অর্ধেক মাস ধরে তৃপ্তি লাভ করেন। মর্ত্যবাসীরা অন্ন খেয়েই জীবিত থাকে। এই অন্ন সূর্য কিরণেই পুষ্ট। সূর্য তার রশ্মি দিয়ে জল শুষে নেন। একচক্র ও সাত ঘোড়া যুক্ত রথে চড়ে দিনরাত সাতটি দ্বীপ ও সমুদ্রবেষ্টিত মহীমণ্ডলে ঘুরে বেড়ান। কল্পের প্রথমে একবার মাত্র যুক্ত হয়ে এই বেগবান মহাবলবান ঘোড়াগুলি কল্পের শেষ পর্যন্ত সূর্যরথ বহন করে থাকে।

.

চুয়ান্নতম অধ্যায়

এক বৎসর তারার ভেতরে ও বাইরে আশি শত মণ্ডল পথ পরিক্রমা করে। সূর্যের মতো চাঁদেরও রশ্মির হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। চাঁদের রথ তিনটে চক্র যুক্ত। এর দুপাশে অশ্বেরা রয়েছে। এটি জলের মধ্যে থেকে উঠে এসেছিল। দশটি দ্রুতগামী ঘোড়া আদিকাল থেকে শঙ্খের মতো সুন্দর শুভ্র কান্তিময় চন্দ্রকে কল্পের শেষ পর্যন্ত বহন করে থাকে। চাঁদের ঘোড়াগুলি হল–যখু, ত্ৰিখন, বৃষ, বাজী, বল, বাম, তুবণ্যহংস, বৈঠামী ও মৃগ। আবহমান কাল থেকে এই ঘোড়াগুলি চন্দ্র রথকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দেবতা ও পিতাদের নিয়ে চাঁদ চলাচল করে। সূর্য পনেরোদিন সুমুন্ন নামে রশ্মি দিয়ে প্রতিদিন চাঁদের এক ভাগ করে পূরণ করেন। তাই শুক্লপক্ষে চাঁদের কলাগুলি বাড়তে থাকে। এই সূর্যতেজে কলাবৃদ্ধি করে। চাঁদ একপক্ষ পূর্ণ হলে পূর্ণ মণ্ডল হিসেবে বিরাজ করে। দেবোর সেই চাঁদের সৌম্য মধু পান করেন।

কৃষ্ণ পক্ষে একরাত শুধু সমস্ত দেবতা, পিতা ও মহর্ষিরা মিলে সোমের অমৃত পান করেন। এরপর আস্তে আস্তে কলাক্ষয় হয়। পিতারা অমাবস্যাঁতেই আসেন। এরপর চাঁদের পনেরোটি ভাগের কলার কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকতে পিতারা অপরাহ্ন কালে অবশিষ্ট অংশ পানের জন্য উপস্থিত হন। সেই অবশিষ্ট কলা থেকে যে সুধামৃত পাওয়া যায়, তারা দ্বিকলাত্মক কালমাত্র পান করেন। তাতেই তাঁরা একমাত্র তৃপ্ত থাকেন। অমাবস্যায় পিতারা যতক্ষণ সোমের পনেরো কলা পান করে শেষ করেন। ততক্ষণ তার অন্তভাগ পরিপূরিত হতে থাকে। চাঁদের ষোলোকলা এভাবে বাড়ে আর পনেরোকলা এভাবে কমে যায়। সূর্যই এই ক্ষয়বৃদ্ধির কারণ।

এরপর রাহু তারা ও রথের বিবরণ বলছি। বুধের রথ জল তেজোময়। মেঘের মতো ধ্বজ পতাকা। যুক্ত। এই রথের বেগ বায়ুর মতো। আটটি ঘোড়া এই রথকে বয়ে নিয়ে চলে। এই রথে দিব্য সারথি রয়েছে। শুক্রের রথ সূর্যের মতো উজ্জ্বল ও সুন্দর। এর ঘোড়াগুলি নানা বর্ণের। সাদা, শিশঙ্গ, সারঙ্গ, নীল, পীত, লাল, কালো, সবুজ প্রভৃতি দশ রকম স্থূলকায় বায়ুবেগী ঘোড়া শুক্রের রথ বয়ে নিয়ে চলে। মঙ্গলের রথ আটটি ঘোড়া যুক্ত, ঘোড়াগুলি দেখতে সুন্দর। ঘোড়াগুলো লাল রঙের। এরা আগুন থেকে জন্মেছে, মঙ্গল সেই রথে চড়ে রাশিচক্রে সোজা পথে বিচরণ করেন। অঙ্গিরা পুত্র দেবাচার্য বৃহস্পতি বায়ুর মতো বেগবান কাঞ্চন রথে আরোহণ করে সব জায়গা ঘুরে বেড়ান। শঙ্খচরের রথ কালো ও লোহা নির্মিত। এর ঘোড়াগুলি ব্যোমজাত ও বর্ণ।

রাহুর রথ কালো রঙের আটটি ঘোড়াযুক্ত, রথ কৃষ্ণবর্ণ, অন্ধকারময়। রাহু পূর্ণিমার দিন সূর্য থেকে বেরিয়ে চাদে ঢোকে আর অমাবস্যার দিনে চাঁদ থেকে বেরিয়ে বয়ে নিয়ে চলে। রথ ও ঘোড়াগুলির বর্ণনা দেওয়া হল। চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহেরা সবাই বায়ুময় অদৃশ্য রশ্মি দিয়ে ধ্রুবে নিয়ন্ত্রণে রাশিচক্রে ঘুরতে ঘুরতে যথাবেগে ভ্রমণ করছে। ফলে জ্যোতিরা সবসময়ই একাদশীতে ধ্রুবের অনুগমন করে। নদীজলে নৌকার মতো বায়ুমণ্ডলে দেবালয়গুলোর রয়েছে, তাই নভোমণ্ডলে দেবতাদের দেখা পাওয়া যায়, যত তারা, তত সংখ্যক বাতরশ্মি ধ্রুব স্বয়ং ভ্রমণ করেন ও সমস্ত জ্যোতিমণ্ডলকে পরিক্রমিত করেন। জ্যোতিমণ্ডলকে বয়ে নিয়ে চলে বলে সেখানে বাতাসের নাম প্রবহ। সেই তারাময় পিণ্ডমায় নামে ধ্রুব আকাশমণ্ডলে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। তাকে দেখলে পাপক্ষয় হয়। সেই ক্ষেত্রে মত তারা আছে দর্শনকারী মানুষ তত হাজার বছর বাঁচে। সেই শিশুমার সবসময়ই রয়েছেন। এঁর তত্ত্ব বিভাগ অনুযায়ী জানা উচিত। উত্তানপাদের উত্তর বণু বা চোয়াল, যজ্ঞ ঐ ঠোঁটে, ধর্মমাখা হৃদয় নারায়ণ দেব এবং মাধ্যে দেবগণ, পূর্ব দুপর্যায়ে দুজন অশ্বিনী কুমার। পশ্চিম দুপায়ে বরুণ ও অর্যমা, গুহ্যদেশে মিত্র বা পুচ্ছে বা পিছনের দিকে অগ্নি, মহেন্দ্র, মরীচি, কশ্যপ ও ধ্রুব এরা প্রতিষ্ঠিত। শিশুমার এর উদয় বা অস্ত নেই। নক্ষত্র, চাঁদ, সূর্য, তারা ও গ্রহেরা সবাই উন্মুখ, হয়ে চক্রাকারে গগন মণ্ডল আশ্রয় করে আছে এবং সবাই ধ্রুবকে ঘিরে রয়েছে, ধ্রুবই প্রধান। ধ্রুব একাই মেরু পর্বতের মাথায় অধোমুখে থেকে মেরুকে দেখতে দেখতে সবসময় পরিভ্রমণ করে এবং এর সাথে সমস্ত জ্যোতিষ্ককে আকর্ষণ করে থাকে।

.

পঞ্চান্নতম অধ্যায়

ঋষিরা বলেন–আপনি যে বিখ্যাত দেব গ্রহগুলোর উল্লেখ করলেন সেই দেব গ্রহগুলো কিভাবে রয়েছে? জ্যোতির্গণ সম্বন্ধে বিবরণ দিন। ঋষিদের অনুরোধ শুনে সমাহিত মনে সূত বললেন– মহাপ্রাজ্ঞরা এ সম্বন্ধে কী মত প্রকাশ করেছেন, আমি সে বৃত্তান্ত বলছি। তার আগে অগ্নির উৎপত্তি বৃত্তান্ত বলছি। ব্রাহ্ম রজনীর শেষে যখন চারটে ভূত মাত্র বাকি ছিল, যখন কোন পদার্থ সৃষ্টি হয়নি, ঘন অন্ধকারে সমস্ত আচ্ছন্ন তখন সবার প্রথমে যে অগ্নি দেখা যায় তাই পার্থিব অগ্নি। যে অগ্নি সূর্য থেকে তাপ দেয়, তার নাম শুচি অগ্নি। বিদ্যুৎ, জঠর ও সৌর-এ তিন অগ্নিই জলাগৰ্ভ। সেজন্য সূর্যকিরণ দিয়ে জলপান করে দীপ্তি পেয়ে থাকেন বৃক্ষাগ্নিতে যদি বৈদ্যুত অগ্নি সমষ্টি হয় তবে তা আর জ্বলে নিভে যায় না।

মানুষের জঠরের অগ্নি ও জলে শান্ত হয় না। জঠর অগ্নি খুব জ্যোতি সম্পন্ন। আর যা অগ্নি মণ্ডলাকারে বিরুদ্ধ ভাবে প্রকাশ পায় তা দিনের থেকে রাত্রিতে বেশি দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়। কারণ সূর্য অস্ত গেলে একপাদ পরিমিত সৌরী প্রভা সেই অগ্নি মধ্যে ঢুকে পড়ে, তাবোর উদয়কালে পার্থিব অগ্নি একপাত্র প্রভা সূর্যের মধ্যে প্রবেশ করে। সেজন্য সূর্যদেব তাপিত করে থাকেন। উত্তর ভূম্যর্ধে বা এই দক্ষিণ ভূম্যর্ধে সূর্যোদয় হলে রাত্রি জনমধ্যে আবিষ্ট হয়। এজন্য দিনেরবেলা জল তামার মত রঙীন দেখায়। আবার সূর্য অস্ত গেলে দিন রাত্রির মধ্যে প্রবেশ করে, এজন্য রাত্রিতে সাদা ভাস্বর দেখায়। যে অগ্নি, সূর্য থেকে কিরণ দিয়ে জলপান করে তা বিনিদ্র পার্থিব অগ্নি। একে দিব্যঅগ্নি বলা হয়। সেই অগ্নি সহস্রপথ, কুম্ভের মত গোলাকার, যে সহস্র রশ্মি দিয়ে চারদিক থেকে সমুদ্র, নদী, কুয়ো, বিল, স্থাবর জঙ্গম সব রকম জল আকর্ষণ করে। সূর্যের বিভিন্ন রকম কিরণ আছে, যেমন উষ্ণ, শীত, ও বর্ষণ ক্ষরণকারী। বর্ষণকারী পাঁচটি কিরণ আছে। এরা বন্দন, বন্দ্য, স্বৰ্তশ, নূতন ও অমৃত নামে বিখ্যাত।

এছাড়া দৃশ্য, মেধ্য বাহ্য, হূদন ও চন্দ্র ইত্যাদি তিনশো হিমবর্ষী কিরণ আছে। উত্তাপদানকারী তিনশো কিরণ আছে। সূর্য এইসব কিরণ দিয়ে পিতৃদেব ও মনুষ্যগণকে সমানভাবে পোষণ করে থাকেন। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে সূর্য তিনশো কিরণে তাপ দেন, বর্ষা ও শরৎ কালে চারশো কিরণে তাপ বর্ষণ করে ও হেমন্ত ও শিশিরকালে তিনশো কিরণে হিম সৃষ্টি করে। তারা, চাঁদ, গ্রহাদি সূর্য থেকে জন্মেছে। নক্ষত্রের অধিপতি হল সোম, গ্রহরাজ সূর্য। প্রথম পাঁচটি গ্রহ কামরূপী ও অসাধারণ সামর্থ্য এদের রয়েছে। অগ্নি, আদিত্য ও জলই চাঁদ।

অন্য কয়েকটি গ্রহের কথা বলছি এবার। স্কন্দদেবই মঙ্গলগ্রহ, নারায়ণই বুধ, রুদ্রদেবই সাক্ষাৎ ধর্মরাজরূপী যম। তিনিই শনৈশ্চর গ্রহের রূপ ধরে রয়েছেন। দেবগুরু ও অসুরগুরু হলেন যথাক্রমে শুক্র ও বৃহস্পতি। দেবাসুর মানুষ সমস্ত জগতই আদিত্যের। সমস্তই সূর্য থেকে জন্মায় আবার সূর্যেই লয় প্রাপ্ত হয়। জগতই গ্রহময়। ক্ষণ, মুহূর্ত, দিন, রাত, পক্ষ, মাস, সব, বৎসর, ঋতু, কাল ও যুগ– সমস্তই সূর্যে লয় ও উদয় হয়। আদিত্য ছাড়া কাল গণনা যায় না।

কাল জ্ঞান ছাড়া দীক্ষা আহ্নিক কিছুই সিদ্ধ হয় না। ঋতু বৈচিত্র্য না থাকলে ফুল ফল ইত্যাদি উৎপন্ন হবে কি করে? স্বর্গ মর্ত্য কোথাও সূর্য ছাড়া ব্যবহার নিষ্পত্তি হয় না। হে দ্বিজ শ্রেষ্ঠগণ। দ্বাদশাত্মা প্রজাপতি সূর্যই কাল ও অগ্নিস্বরূপ, ত্রিলোকেই তিনি তাপ দান করেন। সূর্যের হাজার রশ্মির মধ্যে সাতটি রশ্মি প্রধান। এরাই গ্রহ সৃষ্টির আধার নামগুলি হল সুষুম্ন, হরিকেশ, বিশ্বকর্মা, বিশ্বশ্রবাঃ সংযদ্বসু, অর্ধাগবসু ও স্বরাট। সুষুম্ন রশ্মি ক্ষীণ চন্দ্রকে বাড়িয়ে তোলে। হরিকেশ রশ্মি পুরোভাগ বর্তী। এটি নক্ষত্রসেমী, বিশ্বকর্মা। রশ্মি দক্ষিণে থেকে বুধের বৃদ্ধি করে। বিশ্বশ্রবা রশ্মি পশ্চাদ ভাগের এটি শুক্ৰযোনি। সংষদ্বসু রশ্মি মঙ্গলের উৎপাদক, অর্ধাগবাসু রশ্মি, বৃহস্পতির শনি এবং আবাট নামে রশ্মি শানেশ্বরকে আপ্যায়ন করে থাকে।

এভাবে সূর্যের প্রভাবে গ্রহ নক্ষত্র তারকাদের বৃদ্ধি হয়। ক্ষয় পায় না বলে নক্ষত্র এই নাম হয়েছে। কিরণ দিয়ে নক্ষত্রদের মধ্যে আপতিত হন। গ্রহাশ্রয়ে থেকে জনগণের ত্রান সাধনে সহায়তা করে বলে এরা তারকা। শুক্ল তেজোময় বলে এদেরকে তারা বলা যায়। তেজ ও জল ক্ষরণ করে বলে সূর্যের আরেক নাম সবিতা। চন্দ্ৰধাতু থেকে এবং শুক্লত্ব, অমৃতত্ত্ব ইত্যাদি বিবিধ অর্থে ব্যবহার বলে চাঁদ শব্দটি এসেছে। আকাশে চাঁদ ও সূর্যের দুটি মণ্ডল, জল তেজোময়, দিব্য ভাস্কর কুণ্ডের মতো গোলাকার। সূর্য ও চন্দ্র মণ্ডলে সব দেবতারাই প্রবেশ করেন। সব মন্বন্তরেই তারা চঁদ ও সূর্যের আশ্রয় থেকে প্রকাশমান হন। তাদের সেই আশ্রয়স্থানগুলো দেব গৃহ। সূর্য সৌরস্থান, সোম সৌম্যস্থল, এবং শনৈশ্চর স্থান আশ্রয় করে থাকেন। সূর্য মণ্ডলের তিম্ভ পরিমাণ হাজার যোজন। সূর্যের বিস্তারের চেয়ে চাঁদের বিস্তার দ্বিগুণ।

রাহু অধোভাগে বিচরণ করে। পৃথিবীর ছায়া দিয়ে সেই মণ্ডলাকৃতি রাহু নির্মিত। এর বিরাট স্থান তমোময়। রাহু পূর্ণিমার দিন আদিত্য থেকে বেরিয়ে যেখানে প্রবেশ করে অমাবস্যার দিন আবার সোম থেকে আদিত্যে প্রবেশ করে। শুক্র চাঁদের ষোলোভাগ, বৃহস্পতি বিষ্কম্ভ পরিমাণ দিয়ে তা থেকে পাদহীন এবং যোজনাগ্রবর্তী মঙ্গল ও শনি, বৃহস্পতি থেকে একপাদহীন। অপেক্ষাকৃত বড় তারার বিস্তার বুধের সমান। এরা প্রায়ই চাঁদের কাছাকাছি। তারা নক্ষত্রগুলোয় পরস্পর পাঁচ, চার, তিন, দুই এক ও আধযোজন ব্যবধানে রয়েছে।

শনি, বৃহস্পতি ও মঙ্গল এরা সব গ্রহের উপরিভাগে আস্তে আস্তে বিচরণ করেন। এদের নীচে অন্য চারটি মহাগ্রহ–সূর্য, সোম, বুধ ও শুক্র, এরা তাড়াতাড়ি বিচরণ করে থাকেন। সাধারণত আকাশে যত তারা আছে ততগুলি নক্ষত্র রয়েছে। সংখ্যায় হাজার হাজার কোটি, নক্ষত্র পথ আছে। সেই পথ। দিয়েই সূর্য অয়ন অনুসারে চলাচল করে, পর্বকালে যখন চাঁদ উত্তরায়ণে থাকেন, তখন বুধ বুধের জায়গায়, রাহু ও নক্ষত্র যে যার স্থানে থাকে। এইসব স্থান পুণ্যাত্মা মানুষের জ্যোতি দিয়ে তৈরি। কল্পের শুরুতে ব্রহ্মা, এই সমস্ত নির্মাণ করেছিলেন। মহাপ্রলয় পর্যন্ত এটি স্থায়ী হয়। বৈবস্বত মন্বন্তরে অদিতি, পুত্র সূর্যদেব, ধর্মপুত্র বসুচন্দ্রদেব, অসুর, যাজক, ভার্গব ও শুক্ৰদেব, অঙ্গিরাপুত্র দেবগুরু বৃহস্পতি, ত্বিসি পুত্র বুধ, অগ্নি বিকল্প মঙ্গল ও সিংহিকা পুত্র ভূত সন্তাপন অসুর রাহু হন। নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য গ্রহাদির, দেবতাদের স্থানগুলোর বর্ণনা করা হল। সহস্র কিরণ সূর্যের স্থান অগ্নিময় শুক্লবর্ণ, চাঁদের স্থান জলময় শ্বেতবর্ণ, বুধের স্থান বলময় শ্যামবর্ণ। বৃহস্পতির স্থান বিরাট সবুজ রঙের। আট রশ্মিযুক্ত শনির স্থান কালো ও জলময়। রাহুর স্থান তামস। তারকাগুলোও শ্রুত রশ্মি জলময়। অতিশুভ্রবর্ণ ও পুণ্য কীর্তিদের আশ্রয় বলা হয়।

তারকাগুলিকে বিধাতা কল্পের প্রথমে বেদের দ্বারা নির্মাণ করেছিলেন। সূর্য যখন দক্ষিণ পথে নাগবীথিতে বিচরণ করেন তখন ভূমিলেখা দিয়ে আবৃত হয়ে অমাবস্যা পূর্ণিমার যথাকালে দেখা দেন এবং খুব তাড়াতাড়ি অস্তে যান। চাঁদ উত্তর পথে থাকলে দেখা যায়। কিন্তু দক্ষিণ পথে থাকলে নিয়ম অনুসারে কখনও দৃশ্য কখনও অদৃশ্য হন। জ্যোতিষ্কদের গতির নিয়ম আছে। সেই অনুসারে চাঁদ সূর্য নিয়মিত কালে বিষুবরেখায় উদয়-অস্ত হয়ে থাকে। কিন্তু উত্তর বীথিতে অমাবস্যা পূর্ণিমায় অস্ত ও উদয়ের পরে কালের ব্যতিক্রম দেখা যায়। সূর্য যখন দক্ষিণায়ন পরবর্তী হন, তখন তিনিই সবগ্রহের নিম্নচারী। তার উপরে বিস্তীর্ণ মণ্ডল, চাঁদ, তার ওপরে নক্ষত্র মণ্ডল, তার ওপরে বুধ, তার ওপরে বৃহস্পতি এবং তারও ওপরে শনৈশ্চর, এর উপরে সপ্তর্ষি মণ্ডল আর সবচেয়ে ওপরে ধ্রুব চাঁদ সমস্ত গ্রহদের মধ্যে দিব্য তেজোময় আকাশে প্রতিদিন যথা নিয়মে নক্ষত্রগুলোর সাথে যুক্ত-বিযুক্ত হয়ে থাকেন।

এই সমস্ত গ্রহ পূর্বকালে নক্ষত্র গুলোতে উৎপন্ন হয়। গ্রহদের অগ্রগণ্য অদিতি পুত্র সূর্য, চাক্ষুষ মন্বন্তরে বিশাখা নক্ষত্রে জন্ম নেন। ধর্ম পুত্র ত্বিষিমাস, বিশ্বাবসু নেমে শীত, রশ্মি, নিশাকর কৃত্তিকাতে সমুৎপন্ন হন। শুক্র পুষ্যা নক্ষত্রে প্রাদুর্ভূত হন। জগৎগুরু বৃহস্পতি ফাল্গুনি নক্ষত্রে, প্রজাপতি সূত, মঙ্গল গ্রহ আষাঢ়া নক্ষত্রে জন্মলাভ করেন। রেবতী নক্ষত্রে শনৈশ্চর এবং রাহু ও কেতু এই দুই গ্রহে জন্ম নেন। ধ্রুব হলেন সমস্ত গ্রহের আদি। নক্ষত্রদের মধ্যে প্রবিষ্ঠা, অয়ন মধ্যে উত্তর, পাঁচ বছরের মধ্যে সংবৎসর ঋতুদের মধ্যে শিশির মাসগুলোর মধ্যে মাঘ, দুটো পক্ষের মধ্যে শুক্লপক্ষ, তিথিগুলোর মধ্যে প্রতিপদে দিন ও রাতের মধ্যে দিন, মুহূর্তের মধ্যে রৌদ্র মুহূর্ত এবং কালগুলির মধ্যে নিমেষাত্মক কালই আদি বলে কালবিদরা বলেন। সূর্যই কাল বিভাগের ও চার রকম ভূতের প্রবর্তক ও নিবর্তক। লোক ব্যবহারে সুশৃঙ্খলার জন্যই ঈশ্বর এই সুনিয়ন্ত্রিত জ্যোতিশ্চক্রকে বিন্যাস করেছেন। এটি বিরাট ও বৃত্তাকার। এই জ্যোতিষচক্র প্রকৃতির একটি অদ্ভুত পরিণাম। জ্যোতিষগুলির গতি সম্বন্ধে কোন মানুষই তার নিজের চোখে ঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারবে না। জ্যোতিষ্ক তত্ত্ব নির্ণয় ব্যাপারে চোখ শাস্ত্র জল ও লিখিত গ্রন্থ ও গণিত বুদ্ধি সম্পর্কে এই পাঁচটি কারণ জানতে হবে।

.

ছাপান্নতম অধ্যায়

ঋষিরা বললেন– হে মহাভাগ! কোন্ দেশে, কোন কাজে ব্ৰহ্মপুরুগামীদের পুণ্য উত্তম ঘটনা ঘটেছিল, সে সমস্ত আমাদের জানান। সূত বললেন–নগরাজ হিমালয়ের উত্তরদিকে, সরোবর, নদী, হ্রদ, পবিত্র উদ্যান, তীর্থ দেবায়তন, গিরিশৃঙ্গ, প্রভৃতি জায়গায় দেবভক্ত মহাত্মা মুনিরা বিধি অনুসারে দেবাদিদেব মহাদেবের স্তব করেন। ঐ সব মুনি নাম, ঋক যর্জুবেদ ও নাচগান, পূজা, ওঙ্কার ও নমস্কার প্রভৃতি দিয়ে শিবকে সব সময় পূজা করতে থাকেন।

একবার সূর্য জ্যোতিষচক্রের মাঝে এলে সূর্যতাপে নিয়তাত্মা মুনিদের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়। এই সময় বায়ু ‘নীলকণ্ঠকে নমস্কার’ এ কথাটি উচ্চারণ করেন। তখন অষ্টাশী হাজার বালখিল্য মুনি বায়ুকে বললেন– পবিত্র এই শব্দ সম্বন্ধে আপনার কাছে জানতে ইচ্ছা করি, যে যে কারণে অম্বিকাপতির কণ্ঠ নীল হয়েছে তা আমাদের জ্ঞাত করান। আপনার মুখ থেকে শোনার অন্য অর্থ আছে। কারণ আপনার থেকেই প্রথমে জ্ঞান, পরে উদ্যম, তারপর প্রবৃত্তি জন্মে, তারপর শেষে বর্ণ প্রবৃত্তি হয়। আপনার গিরি সর্বত্র, দেবতাদের মধ্যেও আপনি ছাড়া আর কেউ নেই এটিই জীবেরা সব সময় প্রত্যক্ষ করে থাকে। আপনাকেই বাচস্পতি ঈশ্বর ও নায়ক বলা হয়। তাই কিভাবে নীলকণ্ঠের গলা বিকৃত হয়েছে, তা বলুন।

ঋষিদের কথা শুনে লোকপূজ্য মহাতেজ বায়ু প্রত্যুত্তরে বললেন–পূর্বকালে সত্যযুগে ব্রহ্মার মানসপুত্র ধর্মাত্মা বশিষ্ঠ, ময়ূরবাহন কার্তিককে এমন প্রশ্ন করেছিলেন। পার্বতীর হৃদয়ের নন্দন কার্তিকেয়কে ভক্তিসহকারে বশিষ্ঠ এমন প্রশ্ন করলেন, হে হরনন্দন– উমা, অগ্নি ও গঙ্গা এই সবই আপনার উৎপত্তি স্থান; আপনাকে প্রণাম। হে কৃত্তিকাপুত্র আপনি শরবনে জন্মেছেন, আপনার ছটি মুখ, বারোটি চোখ, আপনার হাতে শক্তি শোভা পায় ও পতাকাতে দিব্য ঘণ্টা বাজছে, আপনাকে নমস্কার। এভাবে কার্তিকেয়ের স্তব পাঠ করে বশিষ্ঠ জিজ্ঞাসা করলেন –কুন্দ ফুলের মতো সাদা শিবের কণ্ঠে, এই যে নীল রঙ দেখা যাচ্ছে তা কি কিভাবে হল? আমি এ বিষয়ে শ্রদ্ধা সম্পন্ন। মঙ্গলাবহ এই পবিত্র ঘটনা আপনি বলুন।

বশিষ্ঠের একথা শুনে মহাতেজা কার্তিক বললেন, মা উমার কোলে শুয়ে আমি যেমন শুনেছিলাম তা বলছি। প্রথমে আমি সেই কৈলাস পর্বতের কথা বলছি। নানা বৈচিত্র্যময় ধাতুতে শোভিত, তপ্ত কাঞ্চনের মতো এর প্রভা। পর্বতের শিলাতলে বজ্ৰস্ফটিকময় শিলা আছে। সিঁড়িগুলি সুবর্ণময় ধাতুতে গড়া। কোথাও ভ্রমরের গান শোনা যাচ্ছে, কোথাও কলকল শব্দে বৃষ্টি পড়ে, কোথাও বা কন্দর দেশ ময়ূর ও বকদের ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত। অপ্সরা ও কিন্নর এর দল ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কোথাও পাথরের সিঁড়িতে বাঘ এবং সিংহ মুখ, কোথাও গজ, অশ্ব, বিড়াল ও ভীষণ শিবা মুখের প্রমথরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের দেখতে কেউ বেঁটে, কেউ লম্বা, কেউ রোগা, কেউ মোটা, কারো লম্বোদর, কারো হাত, উরু খর্বকার, কারো একটি পদ, কারো বহুপদ, কারো মাথা নেই, কারো এক চোখ, মণিমুক্তো রত্নে ভরা সোনার শিলা তলে সুখী মহাযোগী ভূতপরিবৃত মহাদেবকে উমা বললেন, হে ভগবান! হে মহাদেব! আপনার গলাতে মেঘের মত নীল ও কি দেখা যাচ্ছে? হে ঈশ্বর এই নীলিমার কারণ কি? আমার মনে হয় এর বিশেষ কোনো কারণ আছে, আমার ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে। এসব কথা আমাকে বলুন। দেবশঙ্কর বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, যখন দেবতারা অমৃতের জন্য সমুদ্রমন্থন করেন, তখন প্রথমেই কালো জলের মতো বিষ ওঠে। তখন দেবতাগণ ও দৈত্যরা ভয় পেয়ে স্বয়ং ব্রহ্মার কাছে যান। ব্রহ্মা বললেন, কি জন্যে আপনারা ভয় পাচ্ছেন? আপনাদের জন্য আমি আটগুণ ঐশ্বর্য প্রকাশ করেছি। কেউ কি আপনাদের ঐশ্বর্য চুরি করেছে? আপনারা সবাই ত্রৈলোক্যের ঈশ্বর, আপনারা স্বচ্ছন্দ বিহারী, আপনারা প্রজাদের সব কাজে প্রবৃত্ত করতে পারেন। আপনারা এতটা ভয় পাচ্ছেন কেন?

মহাত্মা ব্রহ্মার এমন কথা শুনে ঋষি প্রভৃতি দেব-দানবরা বলতে শুরু করলেন–মহাত্মা দেব ও অসুররা সমুদ্র মন্থন করলে, প্রলয়কালীন সংবর্তনামে আগুনের মতো কালো ত্রৈলোক্য বিনাশী ঐ বিষ চারিদিকে প্রদীপ্ত করে ওপরে উঠেছে। ঐ বিষে দগ্ধ হয়ে গৌরাঙ্গ জনার্দন বিষ্ণুও কালো হয়ে গিয়েছেন। বিষ্ণুকে দেখে ভয় পেয়ে আমরা আপনার শরণ নিচ্ছি। পিতামহ ব্রহ্মা একথা শুনে লোকহিতের জন্য বললেন–হে দেবগণ! হে তপোধন ঋষিরা, আপনারা শুনুন যে বিষ বিষ্ণুকেও কালো করে ফেলেছে, শঙ্কর ছাড়া এই বিষের বেগ কেউ সহ্য করতে পারে না। এই বলে লোক পিতামহ শঙ্করের স্তব শুরু করলেন। তিনি বললেন–হে বিরুপাক্ষ, তোমাকে প্রণাম। তোমার অনন্ত চোখ তোমার হাতে পিনাক ও বজ্র, তুমি ত্রিলোকের অধীশ্বর, সমস্ত প্রাণের পতি, তাপস ও ত্রিলোচন, তোমাকে নমস্কার। তোমার রাগেই মদনদেব ভস্ম হয়েছেন, তুমি কালেরও কাল, তুমি করাল, শঙ্কর, কপালী, বিরূপ, তুমি ত্রিপুর দাহ করেছ, তুমি বুদ্ধ, শুদ্ধ মুক্ত। তোমার দ্বিতীয় আর কেউ নেই।

তোমার দুহাত পদ্মের মতো নরম, দশদিক তোমার বদন, তুমি ত্রিলোকের বিধাতা তুমি, চন্দ্র ও বরুণ, তোমায় নমস্কার। তুমি উমার প্রিয়, সর্বদিন, পক্ষ, মাস, অর্ধমাস, সংবৎসর তোমার শরীর, তুমি কখনও বহুরূপ, কখনও মুণ্ডিত মস্তক, তোমার হাতে নরকপাল, শিরোদেশে তোমার চুড়া; তুমি ধ্বজ ও রথযুক্ত; তুমি ব্রহ্মচারী, তুমি ঋক, যজুর ও সামময়, তুমি পুরুষ ও ঈশ্বর, তোমায় নমস্কার। তুমি অনন্ত গুণে ভুষিত, তাই তোমাকে নমস্কার করি, ব্রহ্মা এভাবে স্তব ও প্রণাম করে আরও বললেন– যার শিরোদেশ গঙ্গাজলে আপ্লুত, সেই অতি সূক্ষ্ম ও যোগ দিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব, আমার ভক্তি, জেনে আবির্ভূত হোন, কারণ চাঁদকে প্রত্যক্ষ করা গেলেও, তিনি কারোর ডাকে আসেন না। হে দেবী, তারপর নানা স্তুতিবাক্যের দ্বারা ভগবান ব্রহ্মা, এভাবে স্তুতি করলে, খুশি হয়ে পিতামহ ব্রহ্মাকে বললাম–হে ভগবান! হে জগতপতি! আমি আপনার কি প্রিয় কাজ করব? প্রত্যুত্তরে ব্রহ্মা বললেন–হে ভগবান। হে পদ্মনেত্র শুনুন, সুরাসুর গণেরা সমুদ্র মন্থন করলে, সমুদ্র থেকে নীল মেঘের মতো রঙীন ভয়ংকর বিষ উঠেছে। ঐ বিষ প্রলয়কালীন আগুনের মতো আবির্ভূত হয়েছে। প্রথমেই এই কালানলের মত বিষকে উঠতে দেখে আমরা ভীষণ ভয় পেয়েছি। যখন যাই উৎপন্ন হোক না কেন, আপনিই তো সবার আগে ভোজন করে থাকেন। তাই হে মহাদেব, লোকহিতের জন্য আপনিই এই বিষ পান করুন। ত্রিভুবনে আপনি ছাড়া কোনও পুরুষ নেই যে এই বিষ পান করতে পারে। শঙ্কর বললেন–হে দেবী! আমি তখন ব্রহ্মার এরকম কথা শুনে বিষপানে সম্মতি দিয়ে সেই বিষপান করলাম। সেই ঘোর ভয়ংকর বিষপান করায় তখনই আমার কণ্ঠের রঙ কালো হয়ে গেল। হে গিরিরাজ নন্দিনী, আমি পরম ব্রহ্মার কথা শুনে, দেবতা, দৈত্য, যক্ষ, গন্ধর্ব, সমস্ত প্রাণী, পিশাচ, রাক্ষস ইত্যাদির সামনে সেই বিষ পান করায় আমার কণ্ঠ নীল রং ধারণ করল। সেই কালকূট কণ্ঠে ধারণ করলে আমায় দেখে সুর অসুররা বিস্মিত হলেন। এরপর সকলে মিলে অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে বলতে শুরু করলেন–হে দেবাদিদেব, তোমার বীর্য, পরাক্রম ও যোগবল ধন্য। তোমার প্রভুত্বকেও ধন্যবাদ দিতে হয়। তুমিই সূর্য, চন্দ্র, ভূমি, জল, যজ্ঞ ও নিয়ম, তুমি বহ্নি, পবন, নিখিল চরাচরের কর্তা, প্রলয়কালে তুমি সব প্রাণীদের রক্ষাকর্তা। সকলে মাথা নত করে শিবের চরণবন্দনা করে নিজেদের আবাসস্থলে চলে গেলেন।

এই যে লোকবিশ্রুত বিখ্যাত নীলকণ্ঠ উপাখ্যান বললেন, এটি পরম পবিত্র, গোপনীয় স্বয়ং স্বয়ম্ভু এই পাপ প্রণাশিনীর কথা বলেছেন। যে ব্যক্তি সবসময় ব্রহ্মসঙ্কৃত কথা শোনেন, তাঁর বিপুল ফললাভ হয়। এই পবিত্র ব্যক্তির গায়ে স্থাবর জঙ্গম সে কোন বিষ নিক্ষিপ্ত হলেও এর প্রভাবে প্রশমিত হয়। এটি পুরুষকে রাজসভায় সম্মানিত করে, এই কথা এভাবে শ্রবণে জয়, পথ গমনে মঙ্গল, গৃহে সম্পদ প্রাপ্তি হয়ে থাকে, হে বরাননে। নীলকণ্ঠ, ত্রিশুলপানি, বৃষবাহন এই সব নাম যে ব্যক্তি শরীরে ধারণ করেন তার গতি শুনুন। আকাশপথে বাতাসের গতি যেমন সবসময় থাকে, তেমনি সেই ব্যক্তি আমার মতো বলশালী, শ্রীমান, পরাক্রমী হয়ে আমার আদেশে সমস্ত লোকে বিচরণ করতে সমর্থ। ভক্তিমান মানুষরা আমার চরিত্র কথা শুনলে তাদের সুগতি হয়। ব্রাহ্মণরা বেদজ্ঞান প্রাপ্ত হন, ক্ষত্রিয় পৃথিবী জয় করেন, বৈশ্য সম্পদ পান শূদ্র, সুখ লাভ করেন। রোগী রোগ থেকে মুক্তি পায়। গর্ভিনী পুত্র লাভ করে। শত সহস্র গরু দান করে সে পুণ্য হয়, বিভুর এই দিব্য কথা শুনেও সেই ফল লাভ হয়। এর একটি শ্লোকে বা অর্ধেক শ্লোক ধারণ করলে মানুষ রুদ্রলোকে যেতে পারে। হে পার্বতী! আমি চতুরানন ব্রহ্মার প্রতি খুশি হয়ে এই ইতিহাস বলেছি। এখন এই পুণ্যফলযুক্ত কাহিনী তোমাকে বললাম। এরপর কার্তিক প্রিয় চন্দ্রশেখর দেবীর কাছে এইসব পুণ্য কথা বলে বৃষে চড়ে উমার সাথে কিসিন্ধ্য গুহাতে প্রবেশ করলেন। বায়ু মুনিদের কাছে এই কাহিনী ব্যক্ত করলেন।

.

সাতান্নতম অধ্যায়

ঋষিরা বললেন– গুণ, কর্ম এবং বীর্যবত্তায় কে শ্রেষ্ঠ এবং কবে গুণপরম্পরা সূত্রপাত তা আমরা শুনতে ইচ্ছা করি। সূত বললেন– প্রাচীনরা মহাদেবের মাহাত্ম্য ও ইতিহাস বর্ণনা করে থাকেন। আমি তা বলছি শুনুন। প্রাচীনকালে বিষ্ণু বলিকে বেঁধে দানবদের হত্যা করলে দেবরাজ ইন্দ্র খুশি হন। দেবরাজ বিষ্ণুকে তখন দর্শন করতে আসেন। বিশ্বরূপাত্মা বিষ্ণু ক্ষিরোদ সমুদ্রে শায়িত ছিলেন। সেখানে ব্রহ্মর্ষি, যক্ষ, গন্ধর্বত, অপ্সরা, নাগ, দেবর্ষি, নদী ও পর্বত সকলে এসে পুরাণ পুরুষ মহাত্মা হরিকে স্তব করতে লাগলেন। বললেন– হে প্রভো! তুমি বিধাতা, তুমিই এই চরাচরের কর্তা, তোমার প্রসাদেই আমরা এই ত্রিভুবন ও কল্যাণ লাভ করেছি। তুমি অসুরদের জয় করেছ, বালিকে বেঁধেছো, পুরুষোত্তম বিষ্ণুকে সিদ্ধ ঋষিগণ স্তবে তুষ্ট করে বললেন–হে প্রভু কালাত্মা, কালঙ্কয়, যিনি মায়া বিকাশ করে ব্রহ্মার সাথে লোকদের সৃষ্টি করেছেন, তারই প্রসাদে যুদ্ধে জয় হয়েছে। আগে ত্রিভুবন গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা ছিল, তার উদরের মধ্যে জীবরা অবস্থান করছিল। তিনি হাজার মস্তক, হাজার চোখ, হাজার পদ রূপে শঙ্খ, চক্র, গদা ধারণ করে স্বচ্ছ জলে শুয়েছিলেন।

সেই সময় দূর থেকে এক যোগী পুরুষকে দেখতে পেলাম। তিনি শত শত সূর্যের মতো তেজ ও দীপ্তিতে উজ্জ্বল, চতুরানন কমণ্ডলুধারী সেই পুরুষোত্তম ব্রহ্মা আমার কাছে এসে এখানে রয়েছেন, তা আমাকে বলুন। আমি আমার থেকেই জন্মেছি। আমি তোক সকলের স্রষ্টা। আমি তখন ব্রহ্মাকে বললাম আমি তোক সকলের কর্তা আমিই তা বারবার সংহার করছি। আমি ও তুলনা করে কথা বলছি তখন উত্তর দিকে একটি জ্বলন্ত, জ্যোতি দেখলাম আমরা বিস্ময়ে অবাক হবে। দেখলাম সেই তেজে সমস্ত জলরাশি জ্যোতির্ময় হল। আমরা সেই জ্যোতি দর্শন করবার জন্য শীঘ্র সেদিকে গেলাম, দেখলাম সেই জুলন্ত তেজ পৃথিবী ও স্বর্গ ছাড়িয়েও বিরাজ করছে। সেই জ্যোতি মণ্ডলের মধ্যে অব্যক্ত প্রভাবশালী এক লিঙ্গ দর্শন করলাম। ঐ লিঙ্গ মহাতেজা, ঘেরে রূপী সমস্ত প্রাণীর পক্ষে ভয়ঙ্কর।

তারপর ব্রহ্মা আমাকে বললেন–এই মহাত্মা লিঙ্গের অনন্ত আমি দেখব, আপনি অধোভাগে গমন করুন। এবং আমি অন্তসীমা খুঁজে পাওয়ার জন্য ঊর্ধ্বভাগে গমন করি। এভাবে হাজার বছর অর্ধোভাগে ভ্রমণ করে তার সীমা আবিষ্কার করতে পারলাম না, ব্রহ্মাও শেষ দর্শন করতে পারলেন না। মহা সলিলের কাছে আমাদের দেখা হল। আমরা সেই তেজোদীপ্ত লিঙ্গের মায়াতে জন্তুএর মতো হয়ে রইলাম। তখন ধ্যানের মধ্যে সেই মহাসলিলে সকল লোকের স্রষ্টা, সংহর্তা সর্বতোসুখ, অব্যয়, প্রভু ঈশ্বরকে দেখলাম। আমরা হাতজোড় করে সেই অব্যক্ত ভয়ংকর রূপী, ভীমনাদি শূলপানি, মহাদেবকে নমস্কার করলাম। বললাম–হে ভূতপতি, তোমাকে নমস্কার, তুমি পরব্রহ্মা, তুমি পরম অক্ষর এবং তুমিই পরম পদ, তুমি রুদ্র, তুমি শ্রেষ্ঠ, তুমি মঙ্গলময়, ওঙ্কার স্বরূপা।

তুমি ব্রত ও নিয়ম, তুমি বেদ, তুমি সুর এবং তুমিই এই দৃশ্যমান লোকসমূহ। তুমি আকাশের শব্দ স্বরূপ, ক্ষিতি গন্ধস্বরূপ, বায়ুব, অর্শস্বরুপ ও চন্দের আধার। তুমি জ্ঞান এবং তুমিই পণ্ডিত। নিখিল প্রাণীদের কর্তা, তুমি মৃত্যু, তুমি কাল, তুমি ত্রিলোক ধারণ করছো। তুমি পূর্বদিকবর্তী মুখ দিয়ে ইন্দ্রের কাজ করছে। দক্ষিণ মুখ দিয়ে লোক সকল ক্ষয় করছে। পশ্চিম মুখে বরুণদেবের কাজ সমাধা করছ। আদিত্য বসু, রুদ্রগণ দুই অশ্বিনীকুমার, সাধ্য, বিদ্যাধর তোমার সৃষ্ট।

হে দেবেশ, উমা, সীতা, গায়ত্রী, গুহ, লক্ষ্মী, বাগদেবী সরস্বতী, কীর্তি, ইতি, মেধা, লজ্জা, তুষ্টি, পুষ্টি, ক্রিয়া, সন্ধ্যা এবং রাত্রি এ সবই তোমার থেকে উৎপন্ন। হে অযুত সূর্য প্রভাবশালী, হে সহস্র চাঁদের দীপ্তি বিশিষ্ট তোমাকে নমস্কার করি। হে পর্বত রূপীন, সর্বগুণাকর তোমাকে নমস্কার করি। হে রুদ্র পিনাকপানি, সায়ক ও সহস্র বাহু, পদ্মনাভ তোমাকে নমস্কার করি।

মহামতী, মহাযোগী দেব, পিনাকপানি, বৃষবাহন, বিবিধমালা চন্দনে সজ্জিত মহেশ্বর, মহাদেব তখন সহস্র কোটি মুখ হাঁ করে মেঘ গম্ভীর নাদে হেসে উঠলেন। মনে হল তিনি সমস্ত কিছুকে গ্রাস করবেন। মহাত্মা শঙ্করের হাসির শব্দে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। তখন মহাযোগী বললেন– তোমরা ভয় পেয়ো না। আমার দক্ষিণ হাত থেকে পিতামহ ব্রহ্মা পরে বামহাতে উদ্ভুত বিষ্ণু নিয়ত যুদ্ধে রত। তোমাদের প্রতি খুশি হয়েছি তোমাদের বর দেবো। “ আমরা বা আবার প্রসন্ন চিত্তে তার চরণ নমস্কার করে বললাম–হে সুরেশ্বর! দেব যদি আমাদের প্রতি আপনার প্রসন্নতা থাকে, যদি আপনি আমাদের বর দেন তবে আপনাতে যেন সবসময় আমাদের ভক্তি থাকে। ভগবান বললেন–হে মহাভাগ, তাই হোক। তোমরা বিবিধ প্রজা সৃষ্টি ও পালন করো এ বলে তিনি অদৃশ্য হলেন। এই সেই যোগী পুরুষের কথা আপনাদের কাছে বললাম। তিনি সমস্ত নিখিল বস্তু সৃষ্টি করেছেন, আমার শুধু বরের হেতু মাত্র। জ্ঞানীরাই একমাত্র অব্যক্ত অজ্ঞাত অচিন্ত্য ও অদৃশ্য যোগীপুরুষকে দর্শন করে থাকেন। দোধিপতি একই শঙ্করকে আপনারা নমস্কার করুন। সেই অচিন্ত্য ঈশ্বর একমাত্র জ্ঞানী জনেরই দর্শন লভ্য।

.

আটান্নতম অধ্যায়

শাংসপায়ন বললেন–হে সূত! ইলাপুত্র নরপতি পুরুষরা কিভাবে স্বর্গে গিয়েছিলেন এবং প্রতিমাসীয় অমাবস্যায় কিরূপেই বা পিতৃগণের তৃপ্তি সাধন করতেন? সূত উত্তর দিলেন–সেই মহাত্মা ইলাতনয়ের প্রভাব, চন্দ্রমায় সূর্যসংযোগ, কৃষ্ণপক্ষের হ্রাস-বৃদ্ধি, চন্দ্রের অমৃত প্রাপ্তি, পিতাদের তর্পণ, পুরুরবা কর্তৃক পিতাদের তৃপ্তিসাধন–এই সমস্ত কথাই বলছি। সে সময় চন্দ্র ও সূর্য এক রাশিতে ও সমান নক্ষত্র এবং একই মণ্ডলে মিলিত হয়, সেই সময়ের নাম অমাবস্যা। পুরুরবা প্রতি অমাবস্যাঁতে মাতামহ ও পিতামহরূপী সূর্য চন্দ্র দর্শনের জন্য যেতেন। ইলাপুত্র বিদ্বান পুরুরবা প্রতি অমাবস্যাঁতেই সোমের উপাসনা করতেন। তখন তার উপাসনায় চন্দ্র প্রসন্ন হলে পিতৃগণের জন্য অমৃত ক্ষরিত হত।

সেই উপাসক পুরুরবা সম্পূর্ণ অমাবস্যায় স্থিতি এবং ঐ অমাবস্যায় চতুর্দশী ও প্রতিপদ কালযুক্ত কাল ও লবদ্বয়, এই দুই কাল উপাসনা উপযুক্ত মনে করে অমাবস্যা ও কুহু কলার উপাসনা করতেন। পিতৃগণের মাস তৃপ্তির জন্য সূর্য শুক্লপক্ষে পনেরোটি কিরণধারা চন্দ্রের সুধামৃত পূরণ করেন। কৃষ্ণ পক্ষে আবার সুধামৃত গ্রহণ করে থাকেন।

সৌম্য, বহিষদ, কাব্য, ঋতু, অগ্নি প্রভৃতি এরা একটি সংবৎসর। সংবৎসর থেকে ঋতু হয়েছে, ঋতু থেকে অয়ন বৎসর থেকে উদ্ভূত ছয় মাসের অয়ন ও এক রূপ পিতৃগণ বৎসর থেকে জাত যে মাসদ্বয়াত্মক ঋতু তা পিতৃগণ ব্রাহ্মকল্পে দেবমানে যে পাঁচ বৎসর তা প্রপিতামহগণ। সোমপায়ীগণ থেকে সৌম্য পিতৃগণ। ভৃগুর তনয়েরা সোমপায়ী, সৌম্যদরকে উপহূত বলা যায়। কাব্য পিতৃগণ আদ্যাপানে পরিতৃপ্ত হন। উত্মাপা ও দিবাকীর্তি বলে যেসব পিতৃগণ আছেন, তারা প্রতিমাসে স্বর্গে সুধাপান করেন।

গগনতলবাসী এই সমস্ত দেবতারা প্রতিমাসে অমাবস্যাঁতে সুধা পান করেন। মহাত্মা পুরুরবা সেখানে থাকেন। তর্পণ দিয়ে তাদের তুষ্ট করেন। সোম থেকে মাসে মাসে ক্ষরিত হয় বলে একটি সুধা। তাইই সোমপায়ী পিতৃলোকের অমৃত। ছন্দোজাত তেত্রিশ দেবতা এভাবে কৃষ্ণপক্ষের সোমের পনেরা কলাজাত জলময় সুধা অমৃত ও মধুপান করে মাসাপ্তে চতুর্দশীতে প্রস্থান করেন। পঞ্চদশী কলা সূর্যের সুষুম্না কিরণে আবার ক্রমশ আপ্যায়িত হতে থাকে। অমবস্যাঁতে পিতৃগণ দুই কলামাত্র কাল সেই সোমকলা পান করেন, তখন সূর্য আবার রশ্মি দ্বারা চাঁদকে পূরণ করেন। পিতৃগণ পান করে যেমন চন্দ্রকলা নিঃশেষ করেন। সূর্য আবার সুষুম্না দিয়ে তাকে পরিপূর্ণ করেন। এভাবে প্রতিদিন চাঁদের এক কলা করে বাড়ে।

কৃষ্ণপক্ষে ক্ষীণ চাঁদের কলা শুক্লপক্ষে বেড়ে যায়, পৌর্ণমাসীতে চন্দ্র পূর্ণ শশী হিসেবে শোভা বাড়ায়। এই হল কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষের চাঁদের হ্রাস বৃদ্ধির নিয়ম। এরপর পর্ব ও পর্বসন্ধিগুলোর উল্লেখ করছি। শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষে অর্ধেক মাসেও তেমনি কতকগুলো পর্ব আছে। ফলে অর্ধমাসে তৃতীয়াদি পর্বগুলো প্রসিদ্ধ। সায়াহ্নকালের অনুমতির দুই লব এবং অপরাহ্নকালে রাস্তার দুই সব কালক্রিয়া বলে নির্দিষ্ট। কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ যদি অপরাহ্নকালের প্রবৃত হয় তবে সে কাল কৃষ্ণপক্ষ বলেই ধরা হবে। আবার সন্ধেবেলায় প্রতিপদের প্রবৃত্তি হলে সেই কাল পৌর্ণমাসিক বলে ধরতে হবে। চন্দ্র ও সূর্য যদি যুগমাত্র ব্যবধানে বিষুবরেখার উপরে সমসূত্রপাতে উদিত হয়ে পরস্পরকে দর্শন করে, তাহলে তার নাম যতীপাত। সূর্যকে অবলম্বন করেই কালের বিশেষ সংখ্যা কল্পনা করা হয়। কালের উৎকর্ষ অপকর্ষ সূর্য দিয়েই নিরূপণ করা হয়। যে রাত্রে চাঁদ পূর্ণ অবস্থায় প্রকাশিত হন, তাকে পূর্ণিমা বলে। আবার কোনো পূর্ণিমায় যদি এক কলা অপূর্ণ থাকে, সেই পূর্ণিমাকে ‘অনুনতি’ বলা হয়। পূর্ণমণ্ডলে চাঁদ যখন দীপ্তি প্রকাশ করে, তখন তাকে রাকা বলে। পঞ্চদশীর রাত্রিতে চন্দ্র ও সূর্য ‘অমা’ অর্থাৎ একত্র এক নক্ষত্রে বাস করেন। তাই এই তিথি হল অমাবস্যা। এরপর আবার চাঁদ, সূর্য পরস্পর পৃথক হয়ে যান। যে বিছিন্ন অমাবস্যাঁতে চাঁদ, সূর্য পরস্পর মিলিত হয়ে পরস্পরকে দর্শন করেন, তাকে দর্শ বলে। পর্বসিদ্ধি অমাবস্যা ও কুহু– এদের দুই লবপরিমিত কাল বিশেষ ক্রিয়াযোগ্য। মধ্যভাগে সূর্যের সাথে সঙ্গত হয়ে, অমাবস্যা চন্দ্রহীন হয়ে পড়ে। দিনের অর্ধেক পর্যন্ত চাঁদের সাথে থেকে রবি চন্দ্র মনজল থেকে সরে যান। শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে চাঁদ মণ্ডল থেকে বিমুক্ত হন।

চন্দ্র ও সূর্যের পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার দ্বিলব কালই আহুতি ওষ্ঠ ক্রিয়াদির জন্য প্রশস্ত। এরই নাম ঋতুসুখ। এদের মধ্যে অমাবস্যাই প্রধান পর্ব চাঁদ, সূর্য অমাবস্যায় মিলিত ভাবে প্রকাশ পান। পরে চাঁদ আস্তে আস্তে সূর্যমণ্ডল থেকে সরে যায়। চন্দ্র দুই লবকাল মাত্র সূর্যমণ্ডল স্পর্শ করেন। সেই কালই অমাবস্যা নিমিত্তক আহুতি ও বষটু ক্রিয়ায় বিহিত। যে কালে কোকিল কুহু শব্দে ডেকে ওঠে, অমাবস্যাও সে কালের সমান গুণসম্পন্ন বলে গুহ নামে বিখ্যাত। যে অমাবস্যায় নিশাকর, সিনীবালী পরিমাণে সূর্যমণ্ডলে প্রবিষ্ট হন, তা সিনীবালী নামে প্রসিদ্ধ। অনুমতি, রাকা, সিনীবালী ও কুহু এদের সকলেরই দুই লব মাত্র কাল প্রশস্ত। হে মুনিগণ! একে পর্বসন্ধি তাৎপর্য বলা হয়। চন্দ্র শুক্লপক্ষে পর্ব সন্ধিকালে রাত্রিতে সম্পূর্ণ মণ্ডলে প্রকাশিত হন। চাঁদ প্রতিদিন এক কলা করে বৃদ্ধি লাভ করে তাই চাঁদের ষোলকলা নয়, পনেরোটি কলা আছে। সোমপায়ী, সোমবর্ধনকারী আর্তব শিশুদের বিবরণ দিলাম। এরপর মাস শ্রাদ্ধভোজী পিতৃগণের আচার, সামর্থ্য ও শ্রাদ্ধ এ সবের বৃত্তান্ত বলছি। কঠোর তপস্যা করেও মৃত মানুষদের পরলৌকিক গতি বলতে পারা যায় না। লৌকিক পিতৃগণকেই শ্রাদ্ধদেব বলা হয়। তাঁরা সৌম্য, অযযানিজ, যাগশীল, পিতৃগণ, দেবশিশু মানুষপিতৃ এই কয় ভাগে বিভক্ত। মানুষ পিতৃগণ লৌকিক পিতৃপদবাচ্য পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহ- এরা হল লৌকিক পিতৃগণ।

যাঁরা সোমযাগ করেন তারা সোমবন্ত নামে বিখ্যাত। যাঁরা সোমযাগের সহায়তা করেন তাঁরা বহির্ষদ নামে প্রসিদ্ধ। সেই সোমযাগে যাঁরা হোম করেন, তারা অগ্নিয়াও নামে খ্যাত। এরা এভাবে নানা কাজে যুক্ত থেকে পুনর্জন্ম পর্যন্ত সন্তুষ্ট মনে দিন কাটান। আশ্রমধর্ম পালনকারী, যাগ-যজ্ঞাদি করেন। যেসব ধর্ম নিষ্ঠ দ্বিজরা, তাঁরা মরণের পরে এই পিতৃগণের সাথে বিহার করেন। যাঁরা মৃত্যু পর্যন্ত নিষ্ঠাসহকারে ব্রহ্মচর্য, তপস্যা, যজ্ঞ, শ্রদ্ধা, বিদ্যা ও দান এই সব করে থাকেন, তারা সোমপায়ী সূক্ষ পিতৃগণের সাথে স্বর্গধামে আনন্দের সাথে পিতাদের উপাসনা করেন।

এঁরা সন্তানের জনক যদি হন তবে বংশধর তাদের শ্রাদ্ধ করে তৃপ্তি দান করে থাকেন। এই মানুষ পিতৃগণ মাসিক শ্রাদ্ধ খেয়ে থাকেন, এছাড়া যারা আশ্রম-এর নিয়ম পালন করেননি, সংকীর্ণ কর্ম দুরাত্মা ব্যক্তিরা মরণের পর যমালয়ে যন্ত্রণায় অনুশোচনা করে। দীর্ঘকাল ধরে ক্ষিদে তেষ্টায় কষ্ট পায়। শাল্মলী বৈতরণী, কুম্ভীপাক প্রভৃতি নরকে নিজ নিজ কাজের জন্য দারুণ যন্ত্রণা ভোগ করে সেই প্রেতস্থানের জীবদের উদ্দেশ্যে ভূতলে তিনটে পিণ্ড দেওয়া হলে নরক থেকে মুক্তি পায়। ভগবান সনতকুমার, দিব্য চোখ দিয়ে প্রেত ও শ্রাদ্ধাদির গতাগতি সম্যক জেনে এই সমস্ত বলেছেন। দেবতাদের পিতৃত্ব পিতৃগণের দেবত্ব এবং পিতৃগণের স্বতুত্ব আত্মবত্বাদি এভাবে বর্ণনা করা হল।

.

ঊনষাটতম অধ্যায়

ঋষিরা বললেন–স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে যে চারটে যুগ ছিল, তাদের প্রকৃত তত্ত্ব ও অবস্থা বিস্তারিতভাবে শুনতে ইচ্ছা করি। সূত বললেন–পৃথিবীর বর্ণনার সাথে সাথে আমি চারটে যুগ সম্বন্ধে বলছি। এবার সবিস্তারে অন্য তত্ত্বগুলো বর্ণনা করছি। যুগ, যুগভেদ, যুগধর্ম, যুগসন্ধি, যুগাবংশ, সন্ধান এই ছ-প্রকার যুগতত্ত্ব বলছি। লৌকিক, নিমেষ, কাষ্ঠা, কলা ও মুহুর্তাদি পরিমাণ অনুযায়ী বছর অনুসারে চারযুগ সম্বন্ধে বলব। একটি ছোট্ট অক্ষর উচ্চারণের সময়কে নিমেষ বলে। পনেরো নিমেষে এক কাষ্ঠা, ত্রিশ কাষ্ঠায় এক কলা, ত্রিশ কলায় এক মুহূর্ত, এবার ত্রিশ মুহূর্তে এক অহোরাত্র, তার মধ্যে কৃষ্ণপক্ষকে দিবা আর শুক্লপক্ষকে রাত্রি বলে। মানুষের হিসেবে ত্রিশমাসে পিতৃলোকের এক মাস এবং তিনশো ষাট মাসে পিতৃগণের এক বছর। মানুষ মানের একশো বছরে পিতাদের তিনবছর চার মাস হয়। লৌকিক মানের এক বছরে দৈব এক অহোরাত্র। তার মধ্যে উত্তরায়ণ দিবা এবং দক্ষিণায়ন রাত্রি। মানুষ মানের ত্রিশ বছরে এক দৈব মাস এবং একশো বছরে দিবা তিন মাস দশদিন হয়।

মানুষের তিনশো ষাট বছরে এক দিব্য সংবৎসর। গণিত বিশারদরা আরো অনেক সংখ্যা নির্ণয় করেছেন। ভারতবর্ষে চারটে যুগ কল্পনা করা হয়েছে। প্রথমে কৃতযুগ, তারপর ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। কৃতযুগ চার হাজার বছর। এর সন্ধ্যা চারশো এবং সন্ধ্যাংশ চারশো বছর। অন্যসব যুগেরও সন্ধ্যাংশ যুগমন যত হাজার বছর তত শতবর্ষ। ত্রেতা যুগ তিন হাজার বছর। এর সন্ধ্যা তিনশো ও সন্ধ্যাংশ তিনশো বছর। দ্বাপর যুগ, দুহাজার সন্ধ্যা একশো এবং সন্ধ্যাংশ একশো বছর। চারযুগের মোট যোগফল পরিমাণ বারো হাজার বছর। এটা হল দিব্য পরিমাণ। চোদ্দ লক্ষ চল্লিশ হাজার বৎসর হল কলিকালের মানুষ পরিমাণ।

এছাড়া চারযুগের সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশগুলির পরিমাণ তেতাল্লিশ নিযুত বিশ হাজার বছর। এভাবে চার যুগের মন্বন্তর কালগুলিও নির্দিষ্ট। মানুষমানের ত্রিশ কোটি সাতষট্টি নিযুত। বিশ হাজার বছরে এক মন্বন্তর।

ত্রেতাযুগের আদিমকালে ব্রহ্মার আদেশে মনু, সপ্তর্ষিরা ধর্ম প্রচার করেন। ঋক্, সাম্‌ যজুঃ অনুযায়ী দর পরিগ্রহ, অগ্নিহোত্রাদি ধর্মগুলো সপ্তর্ষিরা প্রচার করেন। বর্ণাশ্রম নিয়ম অনুযায়ী আচার প্রতিপালন ইত্যাদি ধর্ম মনুর দ্বারা প্রচারিত হয়। আদিকল্পে দেবতাদের মন্ত্রগুলো নিজেই প্রাদুর্ভূত হয়েছিল। পরে হাজার হাজার মন্ত্র মনু ও সপ্তর্ষিদের অন্তঃকরণে আবার অভিব্যক্ত হয়। ঋক, সাম, যজঃ অথর্ব মন্ত্র– এ সমস্ত সপ্তর্ষি দ্বারা প্রচারিত। আর মনু বলেছেন মর্ত্যধর্ম। দ্বাপরদিকালে জনগণের আয়ু কমে গেলে সেই বেদকে ভাগ করা হয়। ব্রহ্মার দ্বারা পূর্বে সৃষ্ঠ দিব্য, ঋষি, তপস্বী ও দেবগণ দ্বাপরে ও কলিযুগে প্রাদুর্ভূত হন।

যুগে যুগে বেদ ও বেদাঙ্গগুলোর বিকার ঘটতে থাকে। ত্রেতা যুগে ক্ষত্রিয়রা উদ্যম যজ্ঞ, বৈশ্যরা হবির্যজ্ঞ, শুদ্রেরা পরিচর‍্যা যজ্ঞ এবং বিপ্রেরা জপ যজ্ঞনিষ্ঠ ছিলেন। তখন ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণদের, বৈশ্যরা ক্ষত্রিয়দের, শুদ্ররা বৈশ্যদের অনুগত ছিল। পরস্পর সকলেই সুখে আনন্দে দিন কাটাত। তারা সকার্য করত ও বর্ণাশ্রম ধর্ম মেনে চলত। ত্রেতাযুগে প্রজাদের সংকল্পে ও বাক্যে সব কাজ সিদ্ধ হত। তখন আয়ু, মেধা, বল, জপ, আরোগ্য ধর্ম জটিলতা এমন সর্বসাধারণের মধ্যেই ছিল। পরে কালবশে প্রজারা সেই ধর্মপালনে উদাসীন হয়, পরস্পর ধর্ম বিষয়ে বিবাদ করে মীমাংসার জন্য স্বয়ম্ভর মুনির কাছে এলে, মনু সেই প্রজাদের দেখে অবসরে কারণ যথাযথ বিচার করে ধ্যানমগ্ন হয়ে শতরূপা নামে পত্নীর গর্ভের সন্তানের জন্ম দেন। মনুপুত্র প্রিয়ব্রত ও উত্থানপাদ সবার প্রথম রাজা হন।

সেই থেকে শাসনকর্তা রাজাদের উৎপত্তি হয়। ধর্ম স্থাপনের বিধান করা হলেও জনগণ গোপনে পাপ করতে লাগলো। তখন তপস্যা, বর্ণ সকলের বিশেষ বিভাগ, সংহিতা। ও নানারকম মন্ত্র ঋষি ও ব্রাহ্মণেরা প্রণয়ন করলেন। তখন দেবতারা সমস্ত সম্ভারের সাথে যজ্ঞের প্রবর্তন করলেন। ত্রেতাযুগে সত্য, জপ, তপস্যা, দান ইত্যাদি ধর্ম প্রবর্তন করা হয়। ত্রেতাযুগের রাজারা যোগ্য দণ্ডদাতা ব্রহ্মজ্ঞ, যাগশীল, পদ্মপলাশ নেত্র, বিশাল বক্ষ, মহাধনুর্ধর, বক্র, রথ, মণি, ভাগ, নিধি, অশ্ব ও গজ এই সাতটি নৃপতিদের প্রধান রত্ন বলে গণ্য হত। চক্র, মণি, ধনু, রত্ন, কেতু ও নিধি সাতটি প্রাণহীন রত্ন। ভার্যা, পুরোহিত, সেনানী, রথকার, মন্ত্রী, অশ্ব, কলভ, এই সমস্ত প্রাণী রত্ন। এই চোদ্দ প্রকার রত্ন সমস্ত রাজারই প্রয়োজনীয়।

অতীত, অনাগত সব মন্বন্তরেই বিষ্ণুর অংশে ভূতলে চক্রবর্তী রাজাদের জন্ম হয়। নৃপতিরা পরস্পর বিবাদ বিরোধ না করে অদ্ভুত ভাবেই ধর্ম, বল, সুখ ও ধন এই চারটি বিষয় লাভ করতেন। তাঁরা বল ও তপস্যা দিয়ে দেব, মানুষ, দানবদের পরাজিত করতে পারতেন। তখনকার রাজাদের শরীরে অমানুষ লক্ষণগুলি দেখা যেত। কপালের উপরে চুলের, কিছু অংশ সুদৃশ্য। জিভ সুমার্জিত, ঠোঁট ও দাঁত তামা রঙের। তাদের আজানুলম্বিত বাহু, সিংহের মতো ঘাড়ের গঠন, সকলের দুপা চক্র মৎস্য আঁকা, হাতের তল দুটি শঙ্খ পদ্ম চিহ্ন শোভিত। তারা পঁচাশি হাজার বছর বেঁচে থাকতেন। তাদের গতিবিধি ছিল সর্বত্র আকাশে, সমুদ্রে, পর্বতে পাতালে। যজ্ঞ, দান, তপস্যা ও সত্য এই চাররকম ধর্ম প্রবর্তিত ছিল। বর্ণাশ্রম ধর্ম তখনই শুরু হয়। দণ্ড বা শাস্তি দেওয়ার নীতি ও ত্রেতাযুগেই প্রবর্তিত হয়েছিল। তখন সব প্রজাই হৃষ্টপুষ্ট, নীরোগ পূর্ণকাম ছিল।

তখন মানুষের আয়ু তিনহাজার বছর, সকলেই পুত্র-পৌত্র ইত্যাদি সহ সুখে কাল কাটাতো। এগুলি হল ত্রেতাযুগের লক্ষণ। এবার ত্রেতা সন্ধির বিষয়ে বলছি। সন্ধ্যা স্বভাব ত্রেতাযুগের একপাদ। আর যুগস্বভাব, সন্ধ্যা স্বভাবের একপাদের সাথে প্রবর্তিত হয়।

শাংখ্যপায়ণ বললেন– স্বায়ম্ভব মন্বন্তরে কিভাবে যজ্ঞ শুরু হয়েছিল, সেই বর্ণনা করুন। তখন বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা কিরূপ ছিল? সূত একথা শুনে বললেন–ত্রেতাযুগের শুরুতে যেমন যজ্ঞ শুরু হয়েছিল শুনুন–বর্ষণের পর শস্য উৎপন্ন হতে দেখে গৃহ, আশ্রম, পুর প্রভৃতিতে জীবিকা প্রতিষ্ঠিত হল । বিশ্বভূক নামে ইন্দ্র দেবতাদের সাথে মিলে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা, মন্ত্র সংহিতা প্রচার, সমস্ত রকম সামগ্রী সম্পন্ন যজ্ঞ প্রবর্তিত করেন। সে সময় অশ্বমেধ যজ্ঞ আরম্ভ হলে মেধ্য, পশু দিয়ে যজ্ঞ হচ্ছে শুনে মহর্ষিরা এলেন। ব্রাহ্মণেরা সবাই কাজে ব্যস্ত, মধুরস্বরে গান হচ্ছে, মহাত্মারা যজ্ঞে আহুতি দিচ্ছেন। যজ্ঞের সময় দেবতারা যজ্ঞভাগ ভোজী হন। এমন সময় যে মহর্ষিরা এসেছিলেন তারা পশুর আহুতি দেওয়া হচ্ছে দেখে পশুদের প্রতি দয়াবান হয়ে সকলে মিলে ইন্দ্রের কাছে বললেন–এ আপনার কেমন যজ্ঞবিধান? আপনি ধর্ম কামনায় হিংসা করছেন? হিংসা কখনো ধর্ম হতে পারে না। হে দেবরাজ! আপনি যদি শাস্ত্রমতে যজ্ঞ করতে চান যজ্ঞবীজ দিয়েও যজ্ঞ করতে পারেন, তাতে বিধি পালন হবে, ধর্ম লাভ হবে কিন্তু হিংসা হবে না কারণ পুরাকালে স্বয়ং ব্রহ্মা, তিনবছরের পুরনো, বীজ দিয়ে যজ্ঞের বিধান করেছেন।

এটি মহান ধর্ম। বিশ্বভুক মুনিদের এই কথা শুনে চিন্তা করতে লাগলেন মহর্ষিরা। ইন্দ্রের সঙ্গে বিবাদে বিরক্ত হয়ে মহর্ষিরা ইন্দ্রের মতানুসারে উপরিচর বসুকে মীমাংসা করতে বললেন। রাজা উপরিচর তাদের কথা না শুনে দোষ-গুণ বিচার না করে বলতে লাগলেন–শাস্ত্রের উপদেশ মতো মেধ্য পশু ও বীজ দিয়ে যজ্ঞ করবে। বেদবাক্য অনুসারে যজ্ঞে হিংসা স্বভাব প্রতিপন্ন হয়। অতিতাপস, যোগী মহর্ষিদের দ্বারা আবিষ্কৃত মন্ত্রগুলো হিংসাত্মক। আমি এজন্যই একথা বললাম। আপনারা রাগ করবেন না। আমি মিথ্যা বলছি না। মহর্ষিরা বসুর এই কথা শুনে রেগে গিয়ে বললেন–রজো হয়ে তুমি মিথ্যা কথা বললে! তুমি রসাতলে প্রবেশ করো।

এই কথা বলা মাত্র বসু নিজ বাক্যদোষে ধরাতলবাসী হলেন। এর থেকে শিক্ষণীয় এই যে–বহু জ্ঞানী ব্যক্তিও কোনো বিতর্কিত বিষয়ে মতামত দেবেন না। কারণ বর্ণের সূক্ষ তত্ত্ব বোঝা খুবই কঠিন, এজন্য একমাত্র মনু ছাড়া দেব ঋষি কেউই সক্ষম নন। আগে সহস্র কোটি ঋষিরা নিজেদের তপস্যার বলেই স্বর্গগামী হয়েছেন। তাই তারা দান বা যজ্ঞ ইত্যাদিকে তেমন প্রশংসা করেন না। নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী ফলমূল শাক, জল ও পাত্র দান করেই তারা স্বর্গলোক বাসী হয়েছেন। তপস্যা ব্রহ্মচর্য সত্য, অনৃশংসত, ক্ষমা, ধৃতি, এগুলিই সনাতন ধর্মের মূল কথা। যজ্ঞধর্ম মন্ত্রদ্বারা, সাধনা, করা হয় আর অনশন দ্বারা তপস্যা পালন করা হয়। যজ্ঞ দিয়ে দেবত্ব আর তপস্যা, দিয়ে বৈরাগ্য প্রাপ্তি হয়। জ্ঞান দিয়ে কেবল লাভ হয়। এইভাবে পুরাকালে যজ্ঞপ্রবর্তনের সময় ঋষিদের সাথে দেবতাদের সুমহান বিবাদ হয়েছিল। ঋষিরা হিংসাত্মক ধর্মাচরণ দেখে যজ্ঞভূমি ছেড়ে চলে যান। দেবতারা যজ্ঞ সম্পাদন করেন।

শোনা যায়, প্রিয়ব্রত, উত্তানপাদ, ধ্রুব, বিরাজ প্রভৃতি ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়বংশের অনেক মহাত্মা, বিখ্যাত রাজর্ষি তপস্যার প্রভাবেই স্বর্গগামী হয়েছেন। এজন্য যজ্ঞের থেকে তপস্যাকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়। তপস্যার প্রভাবেই ব্রহ্মা এই চরাচর জগত সৃষ্টি করেছেন। তপস্যাই জগতের মূল। স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে এভাবেই যজ্ঞ শুরু হয়েছিল। সেই থেকে প্রতিযুগে তা প্রচলিত রয়েছে।

.

ষাটতম অধ্যায়

সূত বললেন–এবার দ্বাপর যুগের বৃত্তান্ত বলছি। এই যুগে ত্রেতাযুগের সিদ্ধগুলি লোপ পায়। তখন আবার লোভ, অধৈর্য, বাণিজ্য, যুদ্ধ, পরস্পর ভেদাভেদ, পণ, দণ্ড, মদ, দম্ভ, দৌর্বল্য, এই সব রজঃ তমের বৃত্তির প্রকাশ হয়। দ্বাপরে নানারকম ধর্মের বৈকল্য ঘটে এবং কলিতে ধর্মের বিলুপ্তি ঘটে। দ্বাপর যুগে বর্ণ আশ্রম বিনষ্ট হতে থাকে। সব বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার জন্য কোনো মতেই বিশ্বাস থাকে না। ধর্মতত্ত্ব নিয়ে জনগণের মধ্যে সংশয় বাড়ে। প্রজাদের মতভেদ ঘটতে থাকে। বিভিন্ন মতবাদী জনগণ নানারকম শাস্ত্র প্রচার করেন। ত্রেতাযুগে বেদমাত্র ছিল।

ক্রমে আয়ুষ্কাল কমে যেতে থাকলে দ্বাপরাদি কালে সেই বেদকে বেদব্যাসেরা বিভক্ত করেন। কালক্রমে শ্রুতিধর ঋষিদের মন থেকে ঋক, যজুঃ, সাম সংহিতাগুলো কিছুটা বিলুপ্ত হতে থাকে। সেই সামান্য বৈকল্য থেকেই কল্পসূত্র, ব্রাহ্মণ ও মন্ত্র প্রবচনগুলো সব বিস্মৃত হয়ে যায়। তখন অনেকে তীর্থাদিতে ভক্তিমান হয়। দ্বাপর যুগে আশ্রয় ধর্মের বিপর্যয় ঘটতে থাকে। দ্বাপরের ধর্মমত প্রবর্তিত হয়ে কলিতে আস্তে আস্তে বিনষ্ট হতে থাকে। প্রজাদের কাজের জন্য দ্বাপর যুগে অনাবৃষ্টি, ব্যাধি ও উপদ্রব জন্মে। এতে প্রজাদের মধ্যে মৃত্যু প্রাদুর্ভাব হয়। পরে বাক্য-মন-কর্ম জনিত দুঃখে প্রজাদের মনে ক্রমশঃ দুঃখ মোক্ষ বিষয়ক বিচার উৎপাদন করে। সেই বিচার থেকে মনে আসে বৈরাগ্য। বৈরাগ্য থেকে দোষ দর্শন, দোষদর্শন থেকে প্রজাদের জ্ঞান উৎপত্তি হয়। আয়ুর্বেদ, বেদাঙ্গ, জ্যোতিষ, অর্থশাস্ত্র, অপরাপর সব শাস্ত্রই মতভেদ পূর্ণ হয়ে ওঠে। দ্বাপর যুগে কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করতে হত। শ্রমজীবির সংখ্যাই ছিল বেশি।

লোভ, বাণিজ্য, যুদ্ধ, নানামত স্থাপন, বেদশাস্ত্র প্রণয়ন, ধর্মের ব্যভিচার, রাগ, হত্যা, বর্ণাশ্রম, লোভ, কাম, দ্বেষ এই সমস্ত সমুদ্ভূত হয়। দ্বাপরে জনগণের আয়ু দুই হাজার বছর।

দ্বাপর শেষ হলে সন্ধ্যা প্রবৃত্ত হয়। তখন দ্বাপরের গুণগুলো কিছুটা কমে। এর পর আসে কলিযুগ। হিংসা, মিথ্যা, ছলনা, তপস্বীদের হত্যা–এই সব কলিযুগের স্বভাব। এভাবে বেদ ধর্ম আস্তে আস্তে কমে যায়। কলিকালে রোগ, দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি, বিপর্যয় ইত্যাদি হতে থাকে। প্রজারা অধার্মিক, অনাচার, মূঢ়, ক্রোধী ও সবসময় মিথ্যাবাদী হয়। দুরাকাঙ্ক্ষা, কদাচার, অসদুপায়ে জীবিকার্জন প্রভৃতি দুষ্কর্মের জন্য প্রজাদের ভয় উপস্থিত হয়। হিংসা ছলনা, ঈর্ষা, ক্রোধ, অসূয়া, মিথ্যাবাদ, রাগ এবং লোভ; এগুলো কলিযুগে দেখা যায়। তখন দ্বিজদের বেদ অধ্যয়ন ও যাগযজ্ঞ আর হয় না। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যজাতি উৎসন্নে যায়।

ব্রাহ্মণরা শূদ্রাদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংসর্গ করে। তখন ভূণহত্যা প্রভৃতি নানা কুকর্ম ঘটতে থাকে। প্রজাদের আয়ু, মেধা, বল, রূপ, সৌভাগ্য কমে অসতে থাকে, শূদ্ররা ব্রাহ্মণাচার ব্রাহ্মণরা শুদ্ৰাচার, রাজা রাজকাজে এবং চোর চৌকাজে ব্যস্ত থাকে। কলিকালে ভৃত্যরাও প্রভুভক্তি হারিয়ে ফেলে। কলিকালে মেয়েরা দুঃশীলা পতিব্রতহীনা, মায়াময়ী হয়। পশুবৃদ্ধি, গরুক্ষয় এবং সাধুদের তিরোধান এগুলোও কলিতে হয়। যুগান্তকালে পৃথিবী ক্রমে অল্পফলা হবে। রাজারা করগ্রহণ করবে। প্রজাদের রক্ষা করবে না, নিজ নিজ রক্ষায় ব্যস্ত থাকবে।

সেই অধর্মের যুগে সবাই ব্যবসায়ী হবে। শূদ্রেরা ব্রত গ্রহণ করে কৌপীনধারী ও তাপসচারী হবে। কলিযুগে সবাই পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত হবে। বিক্রেতারা সবসময়ই খারাপ জিনিস দিয়ে ক্রেতাদের বঞ্চনা করবে। সেই যুগে পুরুষের সখ্যা কম, মেয়েদের সংখ্যা বেশি হবে। সকলেই মাংসভোজী, অসরল, হিংসুক হবে। উপকার করলেও তা স্বীকার করবে না, মানুষ নীচ কাজ করতে প্রবৃত্ত হবে টাকার লোভে। এটাই কলিযুগের লক্ষণ। পৃথিবী ক্রমশ নরশূন্য হবে। বসুমতী আস্তে আস্তে অল্পজলা ও অল্পফলা হবে। রাজারা যোগ্য শাসনও করবে না।

কলিকালে জনগণ পরধনরত্ন চুরি করবে। কামুক, দুরাত্মা, অধার্মিক ও দুঃসাহসী হবে। শূদ্রেরা তখন ধর্মানুষ্ঠান করবে। শস্যচোর, বস্ত্ৰচোরের আবির্ভাব হবে। শান্তি, আরোগ্য, সামর্থ্য দুর্লভ হয়ে উঠবে। কলিযুগের দুঃখিত মানুষের আয়ু একশো বছর মাত্র। গেরুয়াধারী বৈরাগী, কাঁপালিক, বেদ, বিক্রয়ী বর্ণাশ্রম ধ্বংসী পাষণ্ডদের উৎপত্তি হতে থাকবে। কেউ আর বেদপাঠ করবে না। কলিযুগে প্রজারা স্ত্রীহত্যা, গোহত্যা, ও পরস্পর মারামারি কাটাকাটি করে কোনমতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করবে। কলিতে প্রজারা ভূণ হত্যা করবে। অধর্মের বশে যজ্ঞগুলো উৎসন্নে যাবে।

কলিকালে ধন্য জনগণই মন থেকে হিংসা বিদ্বেষ সরিয়ে শ্রুতিস্মৃতি বিহিত ধর্মানুষ্ঠান করে থাকে, কলিযুগের অবস্থা এই বললাম। এবার সন্ধ্যাংশের কথা শুনুন। যুগে যুগে সন্ধ্যাগুলোর এক এক পাদ হানি হয়। সন্ধ্যাতে যুগ স্বভাব একপাদ, এবং সন্ধ্যাংশে সন্ধ্যা স্বভাব একপাদ মাত্র থাকে। স্বয়ম্ভব মন্বন্তরে আদি কলিযুগের সন্ধ্যাংশকালে, বিষ্ণুর অংশে ভৃগু গোত্রে প্রমিতি নামে এক দুষ্টরাজাদের শাসনকর্তা জন্মায়। তিনি অস্ত্র নিয়ে শত সহস্র ব্রাহ্মণের সঙ্গে ঘোড়া রথ হাতির সাথে প্রচুর সেনা নিয়ে কুড়ি বছর ধরে পৃথিবী পরিক্রমা করে প্রচুর ম্লেচ্ছ ও শুদ্র রাজাদের নিধন করেন। এইভাবে রাজা প্রমিতি পাষণ্ড ধ্বংস করেন।

বলবান, প্রমিতি, উদীচ্য, মধ্যদেশীয়, পার্বতীয়, প্রাচ্য, প্রতীচ্য, বিন্ধ্যাচল গত, সীমান্তস্থ, দাক্ষিণাত্য, দ্রাবিড়, সিংহল, গান্ধার, যবন, বর্বর, চীন, কেত ও কিরাত প্রভৃতি ম্লেচ্ছদের বিনষ্ট করেন। বীর্যবান প্রমিতি বত্রিশ বছর বয়সে সমস্ত পৃথিবী পর্যটন করে শূদ্র, অধার্মিক ম্লেচ্ছ রাজাদের বধ করে সৈন্য ও অমাত্যদের সাথে গঙ্গা যমুনার মধ্যে দেহত্যাগ করেন। এরপরে জায়গায় জায়গায় যে অল্প প্রজারা ছিল তারা পরস্পর হিংসা করত।

সেই অরাজক অবস্থায় প্রজারা ভীত, ব্যাকুল, পরিশ্রান্ত হয়ে প্রাণরক্ষার জন্য ছোটাছুটি করতে থাকে। তখন লোকেদের আকার আরো ছোটো হয়ে যায়, আয়ু হয় মাত্র পঁচিশ বছর। তারা অনাবৃষ্টিতে কষ্ট পেয়ে, স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে নিজের জায়গা ছেড়ে দূরের দেশগুলোতে গিয়ে বাস করতে শুরু করেন। তারা মধু, মূল, ফল ভক্ষণ করে অতিকষ্টে জীবন যাপন করে। আস্তে আস্তে জরা রোগ আর খিদেতে কষ্ট পেয়ে তাদের উপলব্ধি জন্মায়। এই উপলব্ধি থেকে ধর্মশীলতা জন্মাতে থাকে। কলির অবশিষ্ট সেই প্রজারা ধর্মপরায়ণ হলে অহোরাত্র মধ্যে যুগ পরিবর্তন হয়। তখন ভবিতব্য অনুসারে আবার সত্যযুগের প্রবর্তন হতে থাকে। সত্যযুগ শুরু হলে কলির প্রজাদের তখন সেই সত্যযুগের আদিম প্রজা বলা হত।

যেসব সিদ্ধজন তখন ছিলেন তারা এবং অপরাপর সপ্তর্ষিরা কলিকালের প্রজাদের সঙ্গে নির্বিশেষে মিলে রইলেন। প্রজারা তাঁদের উপদেশ অনুযায়ী ধর্মাচরণ করতে থাকে। বীজ থেকে যেমন অঙ্কুর জন্মে, তেমনি কলির শেষের প্রজাদের থেকেই সত্যযুগের প্রজাদের উৎপত্তি হয়ে থাকে। এভাবে একযুগ থেকে অন্যযুগে প্রজাবিস্তার হয়ে থাকে। সুখ, আয়ু, বল, রূপ, ধর্ম, অর্থ, কাম–এ সমস্ত যুগানুসারে একটু একটু করে ক্ষীণ হতে থাকে। হে দ্বিজগণ, চারযুগে যে তত্ত্ব জানা যায়, তা সবিস্তারে বললাম। এই চারযুগের এক হাজার বার আবর্তনে ব্রহ্মার এক দিবা এবং ব্রহ্মার রাত্রিও ততকাল বলে জানতে হবে। চারযুগের একটা বিশেষ লক্ষণ যে, ক্রমশ আয়ুক্ষয় হয় বলে প্রজারা অসবল ও জড়তা পূর্ণ হতে থাকে। এভাবে চারযুগের একাত্তর আবর্তনে এক জন্মান্তর শেষ হয়। কল্পযুগগুলোর পরস্পর লক্ষণ একই থাকে। মন্বন্তর-গুলোয় এটাই লক্ষণ। বুদ্ধিমান মানুষ অতীত মন্বন্তরের অভিজ্ঞতা দিয়ে আগামী মন্বন্তর সম্বন্ধে অনুমান করতে পারেন। বিধাতা যুগে যুগে যুগকার্য সাধনের জন্য এরকম সৃষ্টি প্রবর্তন করেন।