নৃসিংহ অবতারের কাহিনী
লক্ষ্মী-নারায়ণের দর্শন উদ্দেশ্যে একবার ব্রহ্মার মানসপুত্র চতুঃসেন বৈকুণ্ঠধামে এসে হাজির হলেন। কিন্তু দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে জয় ও বিজয় নামে দুই দ্বারী। তারা তাকে বাধা দিলে তিনি তাদের অভিশাপ দিলেন– অসুরবংশে জন্ম হবে এবং তিন জন্মে শাপ মুক্ত হয়ে আবার বৈকুণ্ঠ ঠাঁই পাবে।
এক জন্মে তারা দিতির পুত্র হয়ে হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু নামে জন্ম লাভ করে। বরাহরূপী শ্রীবিষ্ণু ওই হিরণক্ষের বিনাশ ঘটালে হিরণ্যকশিপু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়। সে ঠিক করল ওই মৎস্য, কূর্ম ও বরাহ রূপধারী হীন নারায়ণের মাথা শূল দ্বারা ছিন্ন করে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবে।
সে নিজেকে অজেয়, অমর করবার বাসনায় মন্দর পর্বতে গিয়ে কঠোর তপস্যায় ব্রতী হল। ব্রহ্মার উদ্দেশ্যে সেই তপস্যার ফলে হিরণ্যকশিপুর মস্তক হতে সৃষ্টি হল ধূমযুক্ত তমোময় অগ্নি। চারদিকে ছড়িয়ে সেই অগ্নি নদী ও সমুদ্র সকালে বিচলিত হল, ধরণী কেঁদে উঠল, দৈত্যের তপস্যার তেজ দেখে দেবতারা ভীত হলেন। তাঁরা তাড়াতাড়ি ব্রহ্মার সমীপে সে প্রণাম নিবেদন করে বললেন– হে তাত, আমরা হিরণ্যকশিপুরের তপস্যার ঘোর প্রভাবে দুর্বিষহ কষ্ট ভোগ করছি। আপনি আমাদের রক্ষা করুন।
ব্রহ্মা মন্দর পর্বতে এলেন। হিরণ্যকশিপুকে দেখা দিয়ে বললেন– হে বৎস তোমার তপস্যায় আমি মুগ্ধ, বলো কী বর প্রার্থনা করো।
হিরণ্যকশিপু বললেন–প্রভু আমাকে অমর হবার বর দান করুন।
–শোনো, জগতে কেউ অমর হয় না, ব্রহ্মা বললেন–তবে তোমাকে এমন বর দেব যা জগতে দুর্লভ। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে তোমার মৃত্যু হবে না, ঘরের ভিতরে বা বাইরে তোমার মুত্যু হবে না। দিনে বা রাতেও তোমার মরণ হবে না। আমার সৃষ্ট প্রাণীগণের দ্বারা তোমার মৃত্যু হবে না। কোনো অস্ত্র তোমায় মারতে পারবে না। যুদ্ধে তুমি সর্বদা হবে অজেয়।
ব্রহ্মার বর শুনে দৈত্য অত্যন্ত খুশি হল। এবার সে ব্রহ্মার বরে বলীয়মান হয়ে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর প্রতি বিষোদগার করতে শুরু করল। স্বর্গ মর্ত্য পাতালে সমস্ত দেবাসুর, মনুষ্য, গন্ধর্ব, যক্ষ ও রাক্ষসদের কাছে নিজেকে অজেয় প্রমাণ করল। স্বর্গরাজ্য অধিকার করে ইন্দ্রের বাসভবনে রাজা হয়ে অবস্থান করতে শুরু করল।
সকল দিক অধিকার করার পরও দৈত্যের মনের অভিলাষ এখনও পূর্ণ হয়নি। হিরন্যকশিপুর পত্নী ছিলেন কয়াধু। তার চার পুত্র। সবচেয়ে ছোট ছেলের নাম প্রহ্লাদ। সেই পুত্র সত্য প্রতিজ্ঞ ও জিতেন্দ্রিয়, বালক সুলভ কোনোরকম আচরণ তার মধ্যে দেখা যেত না। সর্বদা শ্রীহরির পাদপদ্মে মতি ছিল ব্যাপ্ত। প্রহ্লাদের এ হেন আচরণ দেখে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি পুত্রকে তার আদর্শ মেনে চলার আদেশ দিলেন। কিন্তু কোনো ফল হল না দেখে হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে পাঠিয়ে দিলেন শুক্রাচার্যের এই দুই পুত্র ষণ্ড ও অর্ঘকের কাছে। সেখানে থেকে প্রহ্লাদ দানবীয় শিক্ষা লাভ করবেন।
কিন্তু প্রহ্লাদের এসব শিক্ষাদীক্ষার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। তার কাছে শ্রীকৃষ্ণ একজনই। শ্রীবিষ্ণুর মাহাত্ম কীর্তনই তার কাছে শ্রেষ্ঠ বিদ্যা। কিছুদিন পরে পুত্র গৃহে ফিরে এলে পিতা হিরণ্যকশিপু তাকে কোলে বসিয়ে বললেন, এতদিন ধরে তুমি গুরুর কাছে কী শিক্ষা লাভ করলে?
অম্লান বদনে প্রহাদ জবাব দিলেনশ্রবণ, কীর্তন, বিষ্ণুস্মরণ, পাদসেবন, অর্চন, বন্দন, দাস্য সখ্য ও আত্মনিবেদন এই নয় প্রকার ভক্তি। যে শিক্ষা লাভ করে ভগবানের প্রতি সম্যক মন-প্রাণ সঁপে দেওয়া যায়, তাই হল শ্রেষ্ঠ বিদ্যা। অথচ যে গুরুর কাছে আপনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন, তার এ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই।
পুত্রের কথা শুনে পিতা রাগে ফেটে পড়লেন। বললেন– গুরু যদি এ শিক্ষা না দিয়ে থাকে তোর এমন দুর্মতি হল কীভাবে?
প্রহ্লাদ বললেন– পরমার্থ গতি ভগবান শ্রীহরিকে জানতে হলে চাই বাহ্যিক বিষয়গুলির প্রতি অনীহা। বিষয় স্পৃহাশূন্য উদারচেতা মহত্তম ব্যক্তিগণের চরণরেণু দ্বারা যে পর্যন্ত অভিজ্ঞতা না হওয়া যায়, সেই পর্যন্ত বেদবর্ণিত কাজ এবং কর্মের অনুষ্ঠান করলেও মানবের প্রতি সংসার দুঃখজনক। সে শ্রীহরির চরণকমল স্পর্শ করতে পারে না।
দৈত্যরাজ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে ছেলেকে কোল থেকে মাটিতে নামিয়ে দিলেন। এবং তাকে বধ করার আদেশ দিলেন।
শূল হাতে অনুচরের দল ছুটে এল। প্রহ্লাদের মতি শ্রীহরির চরণে সমর্পিত। তাই ওই শূলের আঘাত প্রহ্লাদের ক্ষতি করতে পারল না।
দৈত্যরাজ তাকে হত্যার জন্য নানারকম ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন সামান্যতম। পাগলা হাতির পায়ের তলায় ফেলে দিলেন, পর্বতের চূড়া থেকে নীচে ফেলে দিলেন, বিষ প্রয়োগ করলেন, দিনের পর দিন অনাহারে রাখলেন, বিষধর সাপেদের মাঝে ছেড়ে দিলেন, কিন্তু কিছুতেই ওই নিষ্পাপ শ্রীকৃষ্ণ ভক্ত বালক প্রহ্লাদের বিনাশ ঘটাতে পারলেন না।
দৈত্যপতি ভ্রূ-কুঞ্চিত করে চিন্তা করতে লাগলেন, এসময় এগিয়ে এলেন শুক্রাচার্যের পুত্রদ্বয়– ষণ্ড ও অর্ঘক। তারা বললেন– হে দৈত্যরাজ, আপনার ভঙ্গি দেখে সমস্ত লোকপাল গণ ভয়ে কম্পমান। প্রহ্লাদ বালক, তার আর দোষ কী, সৎসঙ্গের অভাবের ফলেই তার মধ্যে এমন বুদ্ধিভ্রংশ ঘটে গেছে। পিতা শুক্রাচার্য এসে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে বরুণের পাশ দিয়ে বেঁধে রাখুন। দেখবেন, কোথাও যেন পালিয়ে না যায়।
গুরু পুত্রদ্বয়ের বাক্যে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু পুত্র প্রহ্লাদকে গৃহস্থ ধর্মী রাজগণের উপযুক্ত যে ধর্ম, তা শিক্ষা দিতে আদেশ করলে, শুক্রাচার্যপুত্র ষণ্ড ও অর্মক তাঁকে ধর্ম, অর্থ, ও কাম বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করলেন। তথাপি প্রহ্লাদ অন্যান্য বালকদের সঙ্গে সেই শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক তত্ত্বকথা শোনাতেন।
গুরুগৃহে অন্যান্য ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তিনি মিষ্টি হেসে বলতেন- হে অসুরনন্দনগণ, ভাগবত ধর্ম সন্ধানে জ্ঞান বাল্যকালেই শিক্ষা নেওয়া উচিত। কারণ আশি লক্ষ যোনিতে ঘুরে তারপর মনুষ্য যোনিলাভ করা যায়। এই মনুষ্য জন্মই বিষ্ণুর আরাধনায় পরমার্থ দাতা। কামনায় তাড়িত হলে বিষ্ণু ভক্তি অর্জন করা যায় না। বাল্যকাল থেকে বিষ্ণুর প্রতি মতি স্থির রাখলে জীবনে কোনো কিছুতেই ভীত হতে হয় না। শ্রীহরির পাদপদ্ম লাভ করে পরম গতি সম্ভব যা অতি মঙ্গলকর।
হে রাজন সখাবৃন্দ, শ্রীহরি অতি সহজেই প্রসন্ন হন। কারণ তিনি সকল প্রাণীর হৃদয়েই অবস্থান করছেন। যে কোনো জন, যে কোনো সময় তার মনের উপাচার দিয়েই তার পাদবন্দনা করতে পারে। যদি আমরা তাঁর নামকীর্তন করতে পারি, আর তার চরণসেবা করতে সমর্থ হই তাহলে বলুন মুক্তিও তার কাছে তুচ্ছ বলে মনে হবে।
বপ্রহ্লাদের সখারা তার মুখে এমন ধর্মতত্ত্ব উপদেশ শুনে বিস্মিত হত। তারা জানতে চাইল, কার কাছ থেকে প্রহ্লাদ এমন বিদ্যা লাভ করেছেন।
প্রহ্লাদ বললেন– আমি মাতৃজঠরে থাকাকালীন আমার পিতা কঠোর তপস্যা করতে মন্দর পর্বতে চলে গিয়েছিলেন। এই অবসরে দেবতারা দৈত্যদের আক্রমণ করলেন। দৈত্য প্রধানরা তাদের সবকিছু নিয়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। দেবরাজ ইন্দ্র এই অবসরে আমার মাকে হরণ করলেন। ইন্দ্র কর্তৃক হিরণ্যকশিপুর মহিষীকে হরণ করার কালে নারদ মুনির সঙ্গে ইন্দ্রের সাক্ষাৎ ঘটে। পথের মাঝে নারদ জানতে চাইলেন- হে ইন্দ্র এই নারী হরণের কারণ কী?
ইন্দ্র বললেন–ইনি কয়াধু, হিরণ্যকশিপুর পত্নী, কয়াধু গর্ভবতী। এক অসুরের জন্ম দেবে ওই গর্ভ। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে মেরে ফেলব। তাই আমি এই নারীকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছি।
দেবর্ষি নারদ বললেন– তুমি ভুল করছ। এর গর্ভে বেড়ে উঠছে এমন এক শিশু যে নিজগুণে ভগবত ভক্ত হবে। এর বিনাশ ঘটলে তোমাকে অচিরেই স্বর্গ ত্যাগ করতে হবে। শ্রী প্রহ্লাদ বলতে থাকেন– নারদের বাক্য শুনে ইন্দ্র আমার মাকে ত্যাগ করে চলে গেলেন স্বর্গলোকে। নারদ তারপর আমার মাকে নিজের আশ্রমে নিয়ে গেলেন আর বললেন।–তোমার স্বামী হিরণ্যকশিপু প্রাসাদে ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি নিশ্চিন্তে এখানে বাস করো। আর তুমি হবে ইচ্ছা প্রসবিণী।
নারদ তারপর আমার মাকে ভগবত তত্ত্বকথা শোনাতে লাগলেন। মায়ের গর্ভে বসে আমি সেই সকল উপদেশ শ্রবণ করেছিলাম। যা আজও বিস্মৃত হইনি আমি।
জন্ম মৃত্যুর আবর্তন বিনাশ করার জন্য অনেক উপায় থাকলেও ভক্তি যোগ থেকেই দেবর্ষি নারদ শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করেছেন। গুরু সেবা, সকল লব্ধ বস্তু সমর্পণ, সাধুসঙ্গ, ঈশ্বরের প্রতি আরাধনা, শ্রদ্ধা সহকারে শ্রীকৃষ্ণের গুণকীর্তন, শ্রীগোবিন্দের পাদপদ্ম চিন্তন– সবই ভক্তি যোগে করেন– ফলে ঘটে থাকে। সকল প্রাণীতেই শ্রীহরি বাস করেন– একথা স্মরণে রেখে হিংসা ভুলে যাওয়া উচিত। এভাবে পঞ্চইন্দ্রিয় ও ষড়রিপুকে বশীভুত করা সম্ভব। লাভ হয় ভক্তি, যে ভক্তির দ্বারা শ্রীহরির চরণে চিত্তনিবেদিত হয়। তাই সখাগণ, তোমরা চিত্তমাঝে সেই পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের চিত্র অঙ্কিত করে তার ভজনা করো।
প্রহ্লাদের মুখ নিঃসৃত মধুক্ষরা ভক্তিব্যঞ্জক শব্দাবলী বালকদের অভিভূত করল। বালকেরা আর আচার্যের শিক্ষা গ্রহণ করল না।
ছাত্রদের এমন ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধা দেখে গুরু শুক্রাচার্য সমস্ত ঘটনা দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুকে জানালেন। তিনি পুনরায় পুত্র নিধনের চেষ্টায় মেতে উঠলেন। হুঙ্কার দিয়ে বললেন– ওরে অবোধ বালক। আমি ক্রুদ্ধ হলে ত্রিভুবন থরথর করে কেঁপে ওঠে ভয়ে, আর তুই সামান্য এক বালক হয়ে আমার আদেশ অমান্য করছিস কোন্ সাহসে? তোকে আমি মৃত্যুপুরীতে পাঠিয়ে দেব।
–রাজন, আপনি প্রহ্লাদের পিতা, ক্রোধ সংবরণ করুন। ওই ক্রোধই আপনার আসল শত্রু। যে পরম পুরুষ সকলের বল, সেই বিষ্ণুর প্রতি মতি রাখুন। অসুরভাব ত্যাগ করুন।
হিরণ্যকশিপু বললেন– ওরে পাপিষ্ঠ। তুই কি জানিস, এই ত্রিভুবনে আমি সকলের পরমেশ্বর। তোর মৃত্যু অনিবার্য। দেখি তোর বিষ্ণু তোকে কীভাবে বাঁচায়। যদি সবেতেই তার অবস্থান হয়, তাহলে এই পাথরের স্তম্ভে তাকে দেখছি না কেন?
প্রহ্লাদ ধীর কণ্ঠে জবাব দিলেন– পিতো! শ্রীবিষ্ণু সবেতেই বিরাজমান। অতএব এই স্তম্ভেই তিনি বর্তমান।
শ্রী নারদ বললেন– ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তখন হিরণ্যকশিপু ভঙ্গ হস্তে তেড়ে এলেন। তিনি সজোরে আঘাত করলেন সামনের পাথরের স্তম্ভে। অতি ভীষণ শব্দ শোনা গেল এবং পরমুহূর্তে এক নর সিংহের আবির্ভাব ঘটল। যার অর্ধেক নর এবং অর্ধেক পশুর। তার ভয়ানক দুটি চোখ ফুটে বেরোচ্ছে দুটি গোলা, অতি উন্নত ও তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি। খঙ্গের মত ধারালো তার জিভ, অতি ভয়ংকর সেই মূর্তি। ইনিই স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
এমন বিকট রূপী নরসিংহের মূর্তি দেখে হিরণ্যকশিপু ভাবলেন, মহামায়াবী হরি এইভাবে তার বিনাশ করতে চাইছে।
ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গদা ঘোরাতে ঘোরাতে দৈত্যরাজ ছুটে এলেন। নরসিংহকে বধ করতে উদ্যত হলেন। নরসিংহরূপী শ্রীহরি হিরণ্যকশিপুকে গ্রহণ করলেন। ঠিক যেমন গড়ুর মহাসর্প গ্রহণ করে তাকে আক্রমণ করে, আবার ছেড়ে দিলেন।
নরসিংহের হাত থেকে রেহাই পেয়ে দৈত্যরাজ ভাবলেন, তার ভয়ে নরসিংহ কম্পমান। এবার তিনি খঙ্গ ও চক্র নিয়ে সেই ভয়ংকর নরসিংহকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলেন।
নরসিংহের বিকট হাসিতে ফেটে পড়লেন। সভার দ্বারদেশে নিজের উরুদ্বয়ের উপর দৈত্য রাজকে স্থাপন করে নিজের নখর দিয়ে তার উদর বিদীর্ণ করে দিলেন। পিতামহ ব্রহ্মার বচনানুসারে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বিনাশ ঘটল। সন্ধ্যার সময় দ্বারদেশে শ্রীহরির উরুর ওপর তার নখরাঘাতে দানবরাজের মৃত্যু হল।
দৈত্যরাজের অন্যান্য অনুচরদেরও নৃসিংহ তার নখের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে দিলেন। হাজার হাজার অসুরের মৃত্যু হল। তখনও তিনি ক্রোধে উন্মাদ। তিনি সিংহাসনে এসে বসলেন। তার ভয়ংকর মুখ ও চেহারা দেখে কেউ তার সম্মুখে যেতে সাহস করল না। আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করা হল। অপ্সরা ও গন্ধর্বগণ নৃত্যগীতে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করল। ব্রহ্মা, শিব, ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতাগণ, প্রজাপতিগণ, চতুর্দশ মনু, সকলেই করজোড়ে তার বন্দনা করতে লাগলেন। তা সত্ত্বেও তার রাগ প্রশমিত হল না।
শ্রীব্রহ্মার আজ্ঞায় শ্রীপ্রহ্লাদ পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন নৃসিংহদেবের কাছে। মাটিতে পড়ে তার পাদস্পর্শ করলেন। শ্রী নৃসিংহদেব বালক প্রহ্লাদকে হাত ধরে উঠিয়ে বালকের মস্তকে আপনার কমল হস্ত রাখলেন। ভগবানের করস্পর্শে শ্রীপ্রহাদের শরীরে বিদ্যুৎ শিহরণ ঘটে গেল, রোমাঞ্চিত হলেন তিনি। দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল আনন্দের বারিধারা। চিত্তে তার অপার আনন্দ। তিনি নিজের বুকে নৃহরির পদযুগল স্থাপন করলেন। তার স্তব করতে শুরু করলেন।
দেবর্ষি নারদ বললেন–শ্রীপ্রহ্লাদের মুখে শ্রীহরির গুণকীর্তন শুনে নৃসিংহদেব সন্তুষ্ট হলেন। তার ক্রোধ দূর হল। তিনি প্রহ্লাদকে বললেন– হে বৎস, তোমার স্তবে আমি প্রসন্ন হয়েছি। বলো কী বর তুমি চাও?
প্রহ্লাদ বললেন– হে শ্রীহরি, যে জিনিস মনকে মলিন করে, তা আমি চাই না। যে কাজ বীজ, প্রাণ, আত্মা, ধর্ম, ধৈর্য, বুদ্ধি, লজ্জা, শোভা, তেজ, স্মৃতি ও সত্যকে ধ্বংস করে সেই কামবীজের বিনাশ আমি চাই, আপনি আমাকে সেই বর দান করুন।
নৃসিংহদেব বললেন– হে প্রহ্লাদ, আমি জানি, তুমি আমার একান্ত ভক্ত। তোমাদের মতো ভক্তদের পরলোকে বা ইহলোকে কোনো ভোগবিলাসের প্রতি আসক্তি থাকে না। তথাপি তোমাকে এই মন্বন্তর পর্যন্ত দৈত্যকুলে বাস করে সমস্ত রকম ভোগ করতে হবে।
প্রহ্লাদ বললেন– হে দেব, আপনার পবিত্র স্পর্শে আমার পিতা ধন্য হলেন। কিন্তু উনি আপনাকে অনেক নিন্দা করেছেন। এ জন্য তাকে যেন পাপ ভোগ না করতে হয়, এই আমার প্রার্থনা।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন– হে বৎস, দৈত্যবংশে জন্মে তুমি এই কুলকে পবিত্র করেছ, এক বংশ পুরুষের সঙ্গে তোমার পিতাও পাপ মুক্ত হয়েছেন।
নৃসিংহদেবকে প্রফুল্ল বদনে বসে থাকতে দেখে ব্রহ্মা এগিয়ে গেলেন। তিনি শ্রীভগবানের স্তব করতে লাগলেন।
ভগবান বললেন– হে পদ্মযোনিব্রহ্মা, খল প্রকৃতির সাপকে দুধ পান করালে যেমন অনিষ্টেরই প্রশ্রয় দেওয়া হয়, সেইরকম, আপনি আর কখনও এইসব অসুরদের বরদান করবেন না।
এই কথা বলে শ্রীহরি সেখান থেকে অন্তর্হিত হলেন।
এবার দৈত্য ও দানবদের রাজা করা হল প্রহ্লাদকে। ব্রহ্মা এবং অন্যান্য দেবতাগণ তাকে আশীর্বাদ করলেন। প্রহ্লাদ তাদের পৃথক পৃথক ভাবে চরণ বন্দনা করলেন। তারপর সকলে যে যার ভবনে ফিরে গেলেন।
চতুঃসেনের অভিশাপ মতো দ্বিতীয় জন্মে জয় ও বিজয় রাবণ ও কুম্ভকর্ণ রূপে রাক্ষসযযানিতে জন্ম লাভ করল। শ্রীরামচন্দ্র তাদের বিনাশ ঘটিয়েছিলেন। অনন্তর তারা এই যুগে শিশুপাল ও দন্তবক্র রূপে জন্মলাভ করে। শ্রীহরির প্রতি শুক্রবারের কারণ তোমারই স্বচক্ষে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা মুক্ত হয়েছেন। মৃত্যুর সময় যে যা চিন্তা করে মৃত্যু গ্রহণ করে, পরজন্মে সে সেইরূপ লাভ করে।
বিষ্ণু বিচিত্রময় চরিত্র এই পুণ্য আখ্যান যে পাঠ করে, যে শ্রবণ করে, তার সমস্ত পাপের বিনাশ ঘটে।