বরাহ অবতারের কাহিনী
সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নির্দেশে স্বায়ম্ভুব মনুর তিন কন্যা শ্রদ্ধা সৃষ্টিতে ব্রতী হলেন। কিন্তু আরও সৃষ্টি চাই। ব্রহ্মা মনুকে আরও সৃষ্টির আদেশ করলে তিনি বললেন–হে পিতা প্রলয় সলিলে ত্রিভুবন জল মগ্ন হলে জীব কোথায় গিয়ে ঠাঁই নেবে?
ব্রহ্মা ভাবলেন তাই তো ধরিত্রীকে উদ্ধার করার একটা উপায় বের করতে হয় শ্রীহরি তার নাসারন্ধ্র থেকে এক বরাহ মূর্তির আবির্ভাব করলেন। সেই বরাহ দেখতে দেখতে মহা আকার ধারণ করলেন, তিনি প্রচণ্ড গর্জন করে উঠলেন। ধরিত্রীর সন্ধানে জলে ডুব দিলেন, ঘ্রাণের সাহায্যে তাকে অবলীলায় নিজের দাঁতের অগ্রভাগ দ্বারা জল থেকে তুলে ধরলেন ধরণিকে।
ভগবান বরাহ দেবের কাজে বাধা দিতে ছুটে এলেন দৈত্যরাজ হিরণ্যাক্ষ। তিনি তার গদার আঘাতে দৈত্যের বিনাশ ঘটালেন তখন বরাহদেবের গায়ের রং ছিল তখন নীল। ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতাদের বুঝতে দেরি হল না যে ইনিই স্বয়ং শ্রীহরি। সকলে মিলে তখন তাঁর স্তব করতে শুরু করলেন।
একদিন দক্ষ কন্যা দিতি কামশরে পীড়িত হলেন। তিনি স্বামী কশ্যপের কাছে এসে হাজির হলেন। তার কামপীড়া প্রশমিত করার জন্য স্বামীকে আবেদন জানালেন। কিন্তু মহর্ষি কশ্যপ রাজি হলেন না। তিনি দিতিকে নানা ধর্মতত্ত্ব শোনালেন। কিন্তু দিতি নাছোড়বান্দা। অতএব শেষ পর্যন্ত সেই নিষিদ্ধ সন্ধ্যায় মুনি কশ্যপের বীর্য ধারণ করলেন নিজ গর্ভে।
কশ্যপ বললেন–সন্ধ্যাকালে মৈথুন করা নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও তুমি মৈথুনে রত হয়েছ, যেহেতু তোমার চিত্ত পবিত্র ছিল না, তোমার অভিশপ্ত ওই গর্ভ হতে দুটি কুলাঙ্গার পুত্রের জন্ম হবে। তারা ত্রিলোকের সকলের দুঃখের কারণ হবে। ভগবান শ্রীহরির দ্বারা তাদের বিনাশ হবে। তবে ভগবানের প্রতি এবং স্বামীর প্রতি তোমার অবিচল ভক্তি আছে। যার প্রভাবে তুমি এক নাতি লাভ করবে, যে হবে শ্রীবিষ্ণুর মহান ভক্ত।
স্বামীর মুখে এই কথা শুনে দিতি মনে মনে অত্যন্ত দুঃখ পেল, পরক্ষণেই ভগবতবৎসল নাতির কথা শুনে তার মন খুশি হল। শত বছর ধরে দিতি কশ্যপের বীর্য গর্ভে ধারণ করেছিলেন। সেই গর্ভের তেজে চারিদিকে অন্ধকার নেমে এল। ঢাকা পড়ে গেল সূর্য-চন্দ্রের মুখ। দেবতাগণ বিচলিত হলেন, অন্ধকারের কারণ জানতে চেয়ে ব্রহ্মার কাছে দেবতারা ছুটলেন।
ব্রহ্মা বললেন–আমার চারপুত্র সনক, সনদ, সনাতন ও সনকুমার। তারা যোগ শক্তির প্রভাবে চিজগতে বৈকুণ্ঠ লোকে হাজির হয়েছে। তাদের দেখে মনে হয় পাঁচ বছরের বালক, আসলে তাঁরা সমস্ত জীবকুলের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ও আত্মতত্ত্ববেত্তা। তাঁরা দিগম্বর হয়ে স্বর্গের প্রবেশদ্বারে এলে বাধাপ্রাপ্ত হয়। জয় ও বিজয় নামে দুই প্রহরী তাঁদের ঢুকতে না দিলে তাঁরা রেগে গিয়ে অভিশাপ দিল–তোমরা এই মুহূর্তে দানববংশে জন্ম নেবে।
জয় ও বিজয় তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। তারা সেই পাঁচ দিগম্বরের পায়ে পড়ে মাথা কুটতে লাগল। কিন্তু মুখ দিয়ে যা বেরিয়ে গেছে তা তো আর ফেরৎ নেওয়া যায় না। কিন্তু উপায়? স্বয়ং ভগবান শ্রীহরি মুশকিল আসান হয়ে আবির্ভূত হলেন। তিনি চতুঃসনকে দর্শন দিলেন এবং বললেন–তোমাদের যথোপযুক্ত অভিশাপ দিয়েছে।
তারপর দুই প্রহরীর দিকে তাকিয়ে বললেন–তোমরা শান্ত হও। আমার আশীর্বাদে তোমরা আবার এই স্বর্গপুরীর দ্বারী হয়ে ফিরে আসবে।
চতুঃসনকের অভিশাপ শত বছর পরে দিতির গর্ভজাত দুই যমজ পুত্র হয়ে জয় ও বিজয় জন্ম নিল। তাদের ভূমিষ্ঠ ক্ষণে ত্রিভুবন ব্যাপী নানারকম ভীতিপ্রদ ও আশ্চর্যজনক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে গেল।
দুই পুত্রের মধ্যে আগে যার জন্ম হল, কশ্যপ তার নাম রাখলেন হিরণ্যাক্ষ আর দিতি যাকে প্রথমে গর্ভে ধারণ করেছিল, তার নাম রাখা হল হিরণ্যকশিপু।
কঠোর তপস্যা করে হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার বর লাভ করলেন। সেই বরের প্রভাবে সে অত্যন্ত গর্বিত হয়ে উঠল। আর ব্রহ্মার বরে হিরণ্যাক্ষ হল অত্যন্ত পরাক্রমশালী এবং গর্বোদ্ধত। আর হিরণ্যাক্ষ ও ব্রহ্মার বলে অতীব গর্বোদ্ধত হল। তারা কাজের ওপর মস্ত বড়ো একটা ঢাকা নিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের যত্রতত্র বিচরণ করত। তাদের পথ আটকে দাঁড়াবে এমন সাধ্য কার আছে? কাউকে তারা ভয় পেত না। সকলেই তাদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে, ত্রিভুবন জুড়ে চলেছে তাদের রাজত্ব।
একদিন হিরণ্যাক্ষ সমুদ্রের তলদেশে প্রবেশ করল। বরুণদেবকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান জানাল।
বরুণদেব বললেন–হে বীর! তোমার যুদ্ধ করার যখন এতই বাসনা তখন আদিপুরুষ ভগবান বরাহদেবের কাছে যাও। তোমার অভিলাষ তিনিই পূর্ণ করবেন।
হিরণক্ষ এলো নারদের কাছে, বরাহদেব কোথায় আছেন? জেনে নিয়ে সে এসে হাজির হন রসাতলে, তখন বাহদেব তার দুটো দাঁতের ওপর পৃথিবীকে ধারণ করে ওপরদিকে তুলে নিয়ে চলেছেন। এ দৃশ্য দেখে দৈত্য হিরণক্ষ অত্যন্ত চটে গেল। বরাহরূপী শ্রীহরির উদ্দেশ্যে যা নয় তাই বলে গালাগাল দিল। তারপর তাকে আক্রমণ করল।
শুরু হল দুজনের মধ্যে গদাযুদ্ধ। কী ভীষণ সেই যুদ্ধ! এক সময় শ্রীবিষ্ণুর হাত থেকে গদা পড়ে গেল। স্বর্গ থেকে দেবগণ এ যুদ্ধ দেখে আঁতকে উঠলেন। ভগবান এবার সুদর্শন চক্র তুলে নিলেন। হিরণক্ষ গদা ছেড়ে হাতে নিল ত্রিশূল, চক্র এবং ত্রিশূলের মধ্যে যুদ্ধ চলল। এরপর অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে তাঁরা মুষ্টি যুদ্ধে মেতে উঠলেন। বজ্রকঠোর এক মুষ্টি প্রহার এসে পড়ল দৈত্যের মস্তকে, হিরনাক্ষের মাথা টলে গেল। চোখ বিস্ফারিত হল। তারপর বিশাল এক কাটা গাছের মতো মাটিতে সশব্দে পড়ে গেল।
অসুরকুলজাত দিতি পুত্র হিরণাক্ষকে শ্রীহরি নিজের মূর্তি দর্শন করালেন। হিরণ্যাক্ষের নামের বিনাশ হল, তার নশ্বর দেহটি পড়ে রইল, সে ঠাঁই পেল বৈকুণ্ঠলোকে। ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতাগণ বলে উঠলেন–আহা, কী সৌভাগ্যজনক মৃত্যু।
দেবতাগণ এরপর হিরণ্যাক্ষ দৈত্যের সংহারকারী বরাহরূপী শ্রীহরির স্তব করতে শুরু করলেন।