অর্জুনের তপস্যা
দুর্যোধনের সঙ্গে পাশা খেলায় পরাজিত হন পঞ্চপাণ্ডব। তারা পরাজিত হয়ে রাজত্ব হারিয়ে দ্রৌপদীর সঙ্গে অরণ্যমধ্যে বাস করতে লাগলেন। পঞ্চপাণ্ডবের কুটিরে একদিন উপস্থিত হলেন ব্যাসদেব। তাকে দেখে পঞ্চপাণ্ডবরা খুশি হলেন এবং তার পূজা করলেন, এবং তাঁকে নিজেদের মনের কথা জানালেন। বললেন, আজ আমরা ধন্য হলাম। আজ আমাদের জন্ম সফল হল। দুর্যোধন আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছে, এখন আপনার দর্শন পেয়ে আমাদের সকল কষ্টের অবসান হলো।
ব্যসদেব বললেন, যারা সুজন ব্যক্তি তারা প্রাণান্তের পরও পবিত্র ধর্ম ত্যাগ করেন না। তোমাদের পিতার মৃত্যুর পর ধৃতরাষ্ট্র তোমাদেরকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন। কিন্তু পরে দুর্যোধনের প্ররোচনায় ধৃতরাষ্ট্র তোমাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। এই সংসারে যেপ্রকার বীজ বপন করা হয় তেমনই অঙ্কুর হয়। দুঃখ করো না, তোমাদের ভালোই হবে।
যুধিষ্ঠির ব্যাসদেবকে বললেন, প্রভু আমাদের এই দুঃখ দূর করার জন্য কোনো উপদেশ দিন। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন শঙ্করের আরাধনা করতে, কিন্তু আমরা করিনি। আপনি বলুন, এখন আমাদের কী করণীয়।
ব্যাসদেব বললেন, আমি সবসময় শিবের সেবা করি, তোমরাও শিবের সেবা কর। তারপরে ব্যাসদেব বিচার করে বললেন, তোমাদের মধ্যে অর্জুনই শিবপূজার যোগ্য ব্যক্তি। কারণ অর্জুন নবরূপী পুরাতন মুনি। হে অর্জুন, তুমি ইন্দ্রনীল পর্বতে গিয়ে শিবের তপস্যা কর।
ব্যাসদেবের উপদেশ মতো অৰ্জুন গেলেন ইন্দ্রনীল পর্বতে। সেখানে সুন্দর অশোকবনে শিবলিঙ্গ তৈরি করলেন। তারপর ব্যাসদেবের উপদেশমত ত্রিকালীন স্নান এবং নানারকম পূজা করলেন এবং তপস্যা শুরু করলেন। সেই তপের ফলে অর্জুনের মাথা থেকে তীক্ষ্ণশ্বর বেরোতে লাগল। দেবতাগণ তা দেখে ভয় পেলেন। তারা ইন্দ্রের কাছে গেলেন।
ইন্দ্র তার নিজের পুত্র অর্জুনের অভিপ্রায় জানতেন। তাই দেবতাদের কাছে তার পরিচয় গোপন করে এক আশ্চর্যরূপ ধারণ করে তিনি অর্জুনের কাছে গেলেন।
অতি বৃদ্ধ জরাজর্জর, জটাধারী হয়ে হাতে লাঠি ধরে টলতে টলতে ইন্দ্র অর্জুনের কাছে গেলেন। অর্জুন তাকে দেখতে পেয়ে বসতে দিলেন, এবং তার পূজা করলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন তার পরিচয়।
ইন্দ্র নিজের কোন পরিচয় দিলেন না। বললেন, তুমি এই নবীন বয়সে কেন তপস্যা করছ? তুমি নিশ্চয় সুন্দরীর আকাঙ্ক্ষায় তপস্যা করছ না, কাউকে নিশ্চয় জয় করতে চাইছো?
বৃদ্ধের জিজ্ঞাসা শুনে অর্জুন সব কথা খুলে বললেন। তখন ইন্দ্র অর্জুনের মনোরথ অবগত হয়ে বললেন, তুমি সুখের জন্য এই তপস্যা করছ। এটা কিন্তু তুমি ঠিক করনি, কারণ লৌকিক সুখ স্বপ্নতুল্য, বরং তুমি মুক্তির জন্য তপস্যা করতে চাইলে কর।
অর্জুন বৃদ্ধের কথা শুনে রেগে গিয়ে বললেন, আমি মুক্তি চাই না। আপনি কিজন্য আমার তপস্যায় বিঘ্ন করতে এসেছেন, এখন আপনি যেতে পারেন।
অর্জুনের কথা শুনে ইন্দ্র নিজের স্বরূপে দেখা দিলেন। অর্জুন তখন খুব লজ্জা পেলেন। তখন ইন্দ্র হেসে অর্জুনকে বললেন–তুমি ধন্য। তুমি কৃতার্থ, তোমার মন ও নিশ্চয় দেখছি। তাই তোমাকে বলছি–দুর্যোধনাদি শত্রুগণ অতীব বলিষ্ঠ, দ্রোণ, ভীষ্ম কৰ্ণাদি বীর জগতে অজেয়। তাদেরকে জয় করা আর কারো দ্বারা সম্ভব নয়। শিব ছাড়া অন্য কেউই এদের জয় করতে পারবে না। তাই তুমি শিবেরই ভজনা কর। তবে তুমি সিদ্ধিলাভ করতে পারবে। খুব সাবধান হয়ে তপস্যা করবে। ইন্দ্রের নির্দেশে অর্জুন আবার ঘোরতর তপস্যা শুরু করলেন। পরম যোগীর মত এক পায়ে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে– তাকিয়ে বার বার মন্ত্র জপ করতে লাগলেন।
অর্জুনের তপস্যা তেজ দেখে বিস্মিত হলেন দেবতারা, পরে দেবতারা শিবের কাছে গিয়ে বললেন, প্রভু, যে মানুষটি আপনার কৃপা লাভের জন্য এত কঠোর তপস্যা করছে, সে যা চাইছে তা আপনি দিচ্ছেন না কেন?
শিব দেবতাদের বললেন, চিন্তা করো না। আমি যথাসময়ে তাকে বর দেবো।
এমন সময় মূক নামে এক দৈত্য শূকরের রূপ ধরে অর্জুনের কাছে গেল। সেই মায়াবী দৈত্যকে দুরাত্মা দুর্যোধনই পাঠিয়েছিল। সেই শুকর তার তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে এই চিন্তায় অর্জুন ধনুকে শর যোজনা করলেন। এদিকে অর্জুনকে রক্ষা ও পরীক্ষা করার জন্য শিব এলেন ব্যাধের রূপ ধরে। তাঁর সঙ্গে এলেন তার ব্যাধগণ। তারাও সকলে ব্যাধের রূপ ধরল, ব্যাধরূপী শিব যেন তাদের রাজা।
শুকরটি ছুটে আসছে অর্জুনের দিকে। তার পিছন পিছন ছুটছেন শিব। শূকর যখন অর্জুনের কাছাকাছি তখন শিব ও অর্জুন একই সঙ্গে বাণ নিক্ষেপ করলেন শূকরকে। শিবের বাণ লাগল শূকরের পেছন দিকে, তারপর তার দেহ ভেদ করে মুখ দিয়ে বের হয়ে মাটিতে মিশে গেল। আর অর্জুনের বাণ শুকরের মুখে ঢুকে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে পাশেই পড়ে গেল। এইভাবে উভয়ের বাণাঘাতে শূকর সেখানেই পড়ে গেল। সে ছটফট করতে করতে মারা গেল। সেই সময়েই শূক দৈত্যের আসল ভয়ঙ্কর রূপ দেখা গেল। তখন শিব আর অর্জুন দুজনে আনন্দিত হলেন।
শিব সেই বাণ আনার জন্য একজন ভৃত্যকে পাঠিয়ে দিলেন। অর্জুনও সেখানে গেলেন, আর সেই শিবভৃত্যরূপী ব্যাধকে গালাগালি দিয়ে তার বাণটি নিয়ে নিলেন।
তাই দেখে শিবভৃত্য বলল, আমাদের বাণ তুমি কেন নিলে? কথা শুনে অর্জুন বললেন–ব্যাধ, তুমি মূর্খ, তাই না জেনে এমন কথা বলছ। এই বাণ দিয়ে এখুনি এই শূকরকে আমি বধ করলাম, তাহলে কিভাবে এই বাণ তোমার হবে? এই দেখ বাণের পেছনে ময়ূরপুচ্ছ আছে। আর আমার নামও লেখা আছে।
ব্যাধরূপী শিবভৃত্য অর্জুনের কথা শুনে হাসলো। তারপর বলল–ওরে, তুই শোন, তুই তপস্যা করছিস না, তপস্বীর বেশ ধরেছিস মাত্র। তপস্বীরা কি কখনো মিথ্যা কথা বলে? আমি একা নয় আমাদের সেনাপতি আছে। তুমি যে বাণটি এখুনি মাটি থেকে তুলে নিলে ওটি তার। কাজেই ওই বাণটি আমায় দাও। ওই বাণ দিয়ে প্রভু ওই শূকরটি মেরেছেন তোমাকে রক্ষা করবার জন্য। তবে তোমার যদি বাণটি দরকার থাকে, তাহলে আমার প্রভুর কাছ থেকে গিয়ে চেয়ে নিয়ে এস। তিনি তোমায় নিশ্চয় দেবেন।
তখন অর্জুন বললেন, ওরে ব্যাধ, তোর সব কথাই মিথ্যা। তারা চোর, ব্যাধ, তোদের প্রভু রাজা যতই হোক আমি তার কাছে ভিক্ষা চাইব কিভাবে? আমরা ক্ষত্রিয় কখনো কারুর কাছে ভিক্ষা চাই না। আমরা দাতা, আমার অনেক বাণ আছে। আমি ইচ্ছা করলে দান করতে পারি।
ব্যাধ অর্জুনের কথা শুনে বলল, তুমি অজ্ঞ, ক্ষত্রিয় নও। আমাদের প্রভুকে তুমি চেনো। তার সঙ্গে যুদ্ধে কেউ পারবে না। তাই বলছি, বাণটি ফেরৎ দাও। তা না হলে তোমার কপালে কষ্ট আছে।
ক্রোধান্বিত হয়ে অর্জুন বললেন, তোমাদের রাজা এলে তাকে যুদ্ধের দ্বারা উপযুক্ত শাস্তি দেবো। সিংহ ও শৃগালের যুদ্ধ উপহাস করে। কিন্তু সেই যুদ্ধই এখানে হবে।
তখন শিবভৃত্য অর্জুনের কথা শুনে ফিরে গেল শিবের কাছে, শিব সব কথা শুনে মহানন্দে তার সৈন্যদের নিয়ে অর্জুনের কাছে গেলেন আর অর্জুন তাদের দেখে এগিয়ে এলেন। শিব তার একজন ভৃত্যকে অর্জুনের কাছে এই বলে পাঠিয়ে দিলেন যে, সৈন্যরাশি দেব আর বাণ ফেরৎ দাও। তুমি কিজন্য এই সামান্য জিনিসের জন্য মরতে চাইছো? তোমার ভাইরা দুঃখ পাবে।
শিবভৃত্য অর্জুনের কাছে গিয়ে সব বলল।
শিবের কথা শুনে অর্জুন ক্রুদ্ধভাবে বললেন, আমি এই বাণ কখনই দেব না, এটা আমার।
ভৃত্য গিয়ে শিবকে সব বলল। তারপর শুরু হলো শিব আর অর্জুনের যুদ্ধ। একা অর্জুন আর অন্য দিকে সৈন্যসহ শিব। সেনারা যত অস্ত্র মারে অর্জুন একাই সব বিনষ্ট করে দেন। তারপর সৈন্যগণ অর্জুনের বাণে পীড়িত হয়ে চারদিকে পালিয়ে যেতে লাগল। তখন শিব আর অর্জুনের মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু হল। শিব অর্জুনের সব অস্ত্র বিনষ্ট করে দিলেন, তার ধনুকের জ্যা ছিঁড়ে গেল, তখন অর্জুনের কেবল শরীরটাই থাকল।
তারপর শুরু হল দুজনের মধ্যে মল্লযুদ্ধ। তাতে পৃথিবী কেঁপে উঠল। দেবতারাও খুব ভয় পেল। তখন শিব অর্জুনকে নিয়ে আকাশে উঠে যুদ্ধ করতে লাগলেন, শিব আপনাকে ভক্তের অধীন জানাবার জন্য এইভাবে করতে লাগলেন।
তারপর হঠাৎ অর্জুনের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে মহেশ্বর আপন রূপ দেখালেন তাকে।
তখন অর্জুন লজ্জা পেয়ে বললেন, আহা! আমি যাকে ঈশ্বররূপে পূজা করলাম সেই শিব আমার সামনে, হায়! আমি কি করলাম।
এই মনে ভেবে অর্জুন শিবের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। বললেন, হে প্রভু, আমাকে ক্ষমা করুন। শিব শুনে বললেন, ভক্ত, আমি তোমার পরীক্ষা নেওয়ার জন্যই এমন করেছি। কাজেই দুঃখ করো, আমি তোমার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট, তুমি বর চাও। তুমি যে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছো আমায়, তা আমি পূজারূপে গ্রহণ করেছি। শত্রুদের কাছে তোমার যশ বিস্তারের জন্যই আমি এমন করেছি।
শিবের মুখে এই কথা শুনে অর্জুন হাতজোড় করে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন। তাতে শিব খুশি হয়ে বললেন–হে পুত্র, তোমার ভক্তিতে আমি সন্তুষ্ট, বল এখন কি বর চাও।
তখন অর্জুন প্রণাম করে বললেন, হে প্রভু, শত্রু হতে আমাদের যে ভয় তা আপনার দর্শনে দূর হয়েছে। এখন যাতে ইহলোকে যশলাভ করতে পারি, আপনি তাই বর দান করুন। শিব তখন অর্জুনকে পাশুপত নামে একটি অস্ত্র দান করলেন। আর বললেন–তুমি এই পাশুপত অস্ত্র দিয়ে শত্রুগণকে নাশ করে শুভফল ভোগ কর। শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধের সময় তোমাদের সাহায্য করবেন। শিব অর্জুনের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। অর্জুন কাম্যকরণে ফিরে এলেন। ভ্রাতাদের সব ঘটনা বললেন। তারা সকলে খুশি হলেন। শত্রু জয় করতে আর কোন সন্দেহ নেই।