বায়ু পুরাণ ২১-৩০

একবিংশ অধ্যায়

বায়ু বললেন–এবার ওঁকার প্রাপ্তির লক্ষণ বর্ণনা করছি। এতে তিনটি মাত্রা আছে ও ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে। এর প্রথম মাত্রা বৈদ্যুতী, দ্বিতীয় মাত্রা তামসী, আর তৃতীয় মাত্রা নির্গুণা। এইসব মাত্রাযুক্ত ওঁকার প্রযুক্ত হয়ে মাথায় লয়প্রাপ্ত হলে যোগী ওঁকারময় হয়ে অক্ষয়ত্ব লাভ করেন। প্রণবস্বরূপ ধনুতে আত্মস্বরূপ শরযোজন করে ব্রহ্মরূপ লক্ষ্যভেদ করতে হবে। তাই শরের মতো তন্ময়তা অবলম্বন করা দরকার। ‘ওঁ’ এই অক্ষরটি পরমপদ ব্ৰহ্মস্বরূপ। ‘ওঁ’ এটিই তিনবেদ, তিনলোক, তিনঅগ্নি, ঋক, সাম, যজু–এই তিনবেদ তিন বিক্রমের পদত্রয় স্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে এই ওঁকারের চারটি ‘উ’ কারে স্বরিত এবং ম-কার প্লত। অ-কার ভূর্লোক, উ-কার ভূবলোক ও ব্যঞ্জন সাথে ম-কার স্বলোক। সুতরাং ‘ওঁ’কার ত্রিলোকাত্মক। এর শিরো চন্দ্রবিন্দু ত্রিবিষ্টপ। চন্দ্র-রুদ্রালোকাত্মক, আর বিন্দু–শিবস্বরূপ এটি মাত্রাহীন। এইসব বিশেষত্ব মেনে তবে ধ্যানরত হবে। মহাত্মাযোগী যত্ন সহকারে ওঁকারের মাত্রাতত্ত্ব জেনে উপাসনা করবেন। এর প্রথম মাত্রা হ্রস্ব, দ্বিতীয় মাত্রা দীর্ঘ ও তৃতীয়মাত্রা প্লুত। তিনটি মাত্রা যথাযথভাবে ধারণা করবে। ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি ও আত্মা–এদের সাথে ঐ প্রবণকে আটমাত্রা যুক্ত করে সবসময় ধারণা অভ্যেস করবে। এই আটমাত্রার বিষয়ে উপদেশ লাভ করলে ফললাভ হয়।

এই মাত্ৰাজ্ঞানে যে ফল, তা একশ বছর ধরে অশ্বমেধযজ্ঞ করলেও তার তুল্য ফললাভ হয় না। প্রভুর জন্য জীবনপণ করে যুদ্ধ করলে যে ফল, মাত্ৰাজ্ঞানে সে ফল লাভ হয়। আবার উগ্রতপস্যা বা যজ্ঞ করেও মাত্ৰাজ্ঞানের ন্যায় ফল লাভ হয় না। সেই প্রণবর অর্ধমাত্রাও প্লুত মাত্রাটিই আবার গৃহস্থ যোগীদের বিশেষভাবে আশ্রয়স্থল। এটিই ঐশ্বর্য সাধন। হে দ্বিজগণ–সেই মাত্রাতত্ত্বের সাধনে সমাসক্ত হবেন। শুচি, দান্ত, জিতেন্দ্রিয় যোগী এই প্রণবসাধন দিয়ে আত্মজ্ঞান লাভ করে। ধ্যানপরায়ণ ব্রাহ্মণ যোগ সাহায্যে ঋক, সাম, যজু, সমগ্ৰবেদ ও উপনিষদ–এই সমসত্রে জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। তিনি সর্বভূতের লয়স্থানে লীন হয়ে লয়স্থানে পরিণত হন, তার আবার জন্ম হয় না। যে সমস্ত ব্রাহ্মণ এই চতুর্মুখী বিশ্বরূপ নামে প্রকৃতির সাহায্যে ধ্যান বলে দিব্যচক্ষু দিয়ে সেই অজা, লোহিত, শুক্ল-কৃষ্ণা আত্মতুল্য বহু প্রজা সৃষ্টিকারী সর্বাদিভূতা প্রভৃতি দেবীকে জানতে পারেন, তারা অমৃততত্ত্ব প্রাপ্ত হন। সেই প্রকৃতি দেবীকে অজ জীব উপভোগ করে তৃপ্তিলাভ করে। কিন্তু অন্য অজ শিব তাকে ভুক্তা জেনে ত্যাগ করে থাকেন।

এই ওঁকার নামে অক্ষয় রূপী ব্রহ্মাকে যথাযথ জেনে যিনি ধ্যান করেন তিনি সমস্ত দায় থেকে মুক্ত হয়ে সংসার যাত্রায় দায় থেকে মুক্তি পেয়ে থাকেন। তিনি অচল নির্গুণ শিবস্থান প্রাপ্ত হন। এতে সন্দেহ নেই। এতক্ষণ আপনাদের ওঁকার প্রাপ্তির কথা বললাম।

সর্বলোকাভিজ্ঞ লোকেশ্বরকে প্রণাম। সেই মহানের উপাসনা করা উচিত! সেই ব্রহ্মাকে প্রণাম ।করাই মঙ্গলজনক। সর্বব্যাপী, নির্গুণ, ভক্ত যোগীদের ঐশ্বর্য প্রদাতা, জল সম্পৃক্ত পদ্মপাত্রর মতো বিশুদ্ধ উপাসনা করবে। সকল পবিত্র আশঙ্কা পবিত্র, পবিত্র পরিপূরিত, পবিত্রাশয়, হ্রস্ব-দীর্ঘ, প্লুত–এই তিনটি স্বরবিশিষ্ট যোগীশ্বরকে নমস্কার। যে তাকে নমস্কার করে অবিদ্যা তার ওপর প্রভুত্ব করতে পারে না। যিনি অন্তরাত্মাকে উন্নত ও ভূমিকে দৃঢ় করেছেন, যিনি স্বর্গকে শূন্যমার্গে স্তম্ভিত করেছেন, যিনি দেবতাদের হৃদয়স্বরূপ, সেই পরম পুরুষই বিশ্বরূপ। এই ওঁকার নামে বিশ্বরূপী রুদ্রই যজ্ঞ, বেদ-ও নমস্কারাদিরূপে পরিণত হয়েছেন।

বাতাস যেমন গাছ থেকে ফলকে বৃন্তচ্যুত করে পক্ক ফল স্থানান্তরিত করে, রুদ্রকে নমস্কার করলে পাপরাশি দূর হয়ে যায়। রুদ্র প্রণাম যেমন সমস্ত ধর্মফল লাভ হয়, অন্য কোন দেবতার প্রণামে সেরকম ফললাভ হয় না। সেই প্রভু সর্বকালে সর্বমূল ভূত ওঁকারে নিবিষ্ট আছেন। মহাযশস্বী বিষ্ণুই নমস্কার স্বরপ নমস্কারমূর্তি বিষ্ণুকে সেই প্রণব স্তব করেন, প্রণব যজ্ঞকে, যজ্ঞ মনকে এবং মন রুদ্রকে স্তব করে সুতরাং রুদ্রপদই পরম মঙ্গলাস্পদ আশ্রয়নীয়।

.

দ্বাবিংশ অধ্যায়

সূত বললেন–নৈবিষারণ্যে অগ্নিকল্প ঋষিদের মধ্যে সাবৰ্ণি নামে শ্রুতিধর ঋষি ছিলেন। সেই বাক্য বিশারদ ঋষি বিনয়ের সাথে মহাদ্যুতি বায়ুকে জিজ্ঞাসা করলেন –প্রভু, আপনি সর্বদর্শী, আপনার কৃপায় আমরা পুরাণের কথা শুনতে ইচ্ছে করছি। ভগবান হিরণ্যগর্ভ নিজের কপাল থেকে অতি তেজস্বী নীললোহিত দেবকে কিভাবে পুত্ররূপে লাভ করলেন, কমলযোনি ব্রহ্মার উৎপত্তি হল কিভাবে? বিষ্ণুর রুদ্রের সাথে প্রীতিসঙ্টন হল কি করে? সব দেবতা বিষ্ণুময় বিষ্ণু ছাড়া অন্য গতি নেই–দেবতারাই সবসময় এই করে থাকেন, তবে সেই বিষ্ণু, ভবদেবকে সবসময় প্রণাম করেন কেন? সূত বললেন–একথা শুনে ভগবান বায়ু, সাবৰ্ণিকে বললেন–হে সাধু, আপনি খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছেন। ব্রহ্মার পুত্ররূপেই ভব-এর জন্ম। পদ্ম থেকে ব্রহ্মার উদ্ভব, শঙ্করের রুদ্রত্ব, বিষ্ণু ও ভবের পরস্পর প্রীতি, বিষ্ণু যে শঙ্করকে প্রণাম–তার কারণগুলো আমি বলছি। আপনারা শুনুন, ষষ্ঠকল্পে মনুর অধিকার কালের শেষে পদ্ম নামে সপ্তম কল্প শুরু হয়। বর্তমান কালে বরাহ কল্প চলছে। এক একটি কল্প কতকাল ধরে সম্পূর্ণ হয়? এর পরিমাণ বা কি? আমরা জানতে চাই। বায়ু বললেন–মন্বন্তর-এর কালসংখ্যা আমি যথাক্রমে বলছি–দুই হাজার আটশো কোটি, আর বাষট্টি কোটি আট নিযুত–এটি কল্পার্ধের পরিমাণ। এর পূর্ব ভাগ বর্ষ পরিমাণ। একশো আটাত্তর কোটি। দুই লক্ষ নব্বই নিযুত–এটি কল্পাধের পরিমাণ। এর পূর্ব ভাগ বর্ষ পরিমাণ। কল্পার্ধ মানের দ্বিগুণীভূত এই পরিমাণই কল্প পরিমাণ। আটান্ন নিযুত, আশী শত, চুরাশি প্রযুত কাল যাবত সপ্তর্ষি মনু ইন্দ্রাদি দেবতা–এরা বিদ্যমান থাকেন। এই কালই বট প্রমাণ। এই মন্বন্তর কালের শেষে মানুষদেরও অন্ত হয়। বর্তমান কল্প বরাহ কল্প নামে বিখ্যাত। এতে স্বয়ম্ভু প্রভৃতি চোদ্দজন মনু আবির্ভূত হন।

ঋষিরা জিজ্ঞেস করলেনএই কল্পের নাম বরাহ হল কেন? সেই দেব বিষ্ণুই বা বরাহ কীর্তিত হন। কেন? ভগবান বরাহ কে? তার স্বরূপ কি? কেমন করেই বা তিনি উৎপন্ন হলেন? বায়ু বললেন–যে জন্য, যেভাবে উৎপন্ন হলেন বরাহ, কল্পের স্বরূপ ও বিকৃতি–এ সমস্তই যেমন দেখেছি বা শুনেছি বর্ণনা করছি। সমস্ত সৃষ্টির প্রথম ‘ভব’ কল্প। সেই কল্পে আনন্দময় জ্ঞেয় ভগবান এবং দিব্যসম্ভব তার আধারভূত ব্রহ্মস্থান মাত্রের উপলব্ধি ছিল। দ্বিতীয় ‘ভুব’ কল্প, তৃতীয় তপঃ কুল্প, চতুর্থ ভাব’ কল্প, পঞ্চম রম্ভ’ কল্প, ষষ্ঠ ‘ঋতু’ কল্প, সপ্তম কুত’ কল্প, অষ্টম বহি’ কল্প, নবম ‘হব্যবাহন’ কল্প, দশম ‘সাবিত্র’ কল্প, দ্বাদশ ‘ঔষিক’ কল্প ত্রয়োদশ ‘কুশিক’ কল্প, চতুর্দশ ‘গন্ধর্ব’ কল্প, এই কল্পে গান্ধার স্বর উৎপন্ন হয়। গান্ধার স্বর থেকেই নাঙ্গ ও গন্ধর্বগণ সস্তৃত হয়। হে দ্বিজগণ! পঞ্চদশ কল্পের নাম ঋষভ। এই কল্পে দুজন প্রসিদ্ধ ঋষি ছিলেন তাদের নাম যথা–শিশির, বসন্ত, নিদাঘ, বর্ষা, শরত ও হেমন্ত। এরা ব্রহ্মার মানস সন্তান। ষোড়শ কল্পে এরা ষোড়শ থেকে উৎপন্ন হন। এই দুজনের জন্ম হওয়ায় সেই মহেশ্বরই যেন সদ্য জন্মগ্রহণ করেন, এজন্য সেই সাগরম গম্ভীর স্বরের ষড়জ নাম কল্পিত হয়। এরপর সপ্তদশ কল্প মার্জালীয় নামে প্রসিদ্ধ। পরে মধ্যম নামক অষ্টাদশ কল্প। এতে মধ্যম নামে ধৈবত কর্ম সৃষ্ট হয়েছিল। তারপর বৈরাজ নামে উনিশকল্প ঐ কল্পে ব্ৰহ্মনন্দন ভগবান বৈরাজ মনু সমুদ্ভূত হন। বৈরাজ মনুর পুত্র দধীচি-প্রজাতি, অতিকায় ধার্মিক, তেজস্বী ও ত্রিদশগণের প্রধান ছিলেন। একদা তিনি যজ্ঞ করলে গায়ত্রী দেবী তাকে কামনা করেন।

তাতে সেই দধীচির পুত্ররূপে স্নিগ্ধ স্বরের সমুৎপত্তি হয়। প্রজাপতি সেই স্বয়ম্ভ সঞ্জাত স্বরকে দেখে প্রজা সৃষ্টিতে বিরত হলেন। নিষাদ তখন তপস্যা করতে প্রবৃত্ত হয়ে নিরাহারে থেকে জিতেন্দ্রিয় দিবসহস্র বৎসর অতিবাহিত করলেন। ব্রহ্মা সেই ঊর্ধ্ববাহু, তপঃকৃশ, দুঃখিত, ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত শান্ত। পুত্রকে নিষাদ অর্থাৎ উপবেশন কর–একথা বললেন। এজন্য সেই স্বর নিষাদ নামে বিখ্যাত হয়। হে দ্বিজগণ! একুশ গল্প পঞ্চম নামে খ্যাত। ঐ কল্পে ব্রহ্মার প্রাণ, অপ্রাণ, সমান, উজান ও ব্যজ, এই পঞ্চ মানস সন্তান সমুৎপন্ন হয়। এরা মধুর বাক্যে সেই মহেশ্বরের স্তব করেছিলেন। স্নিগ্ধ পঞ্চম স্বর উক্ত প্রাণাদি পঞ্চকের সাথে মিলে গান করেছিল বলে সেই কল্পের পঞ্চম নাম বিখ্যাত হয়েছে।

বাইশ কল্প মেঘবাহন নামে খ্যাত। ঐ কল্পে মহাবাহু বিষ্ণু মেঘাকার নিয়ে মহেশ্বর-কৃত্তিবাসকে দিব্য হাজার বছর ধরে বহন করেছিলেন। কশ্যপমন্থন বিষ্ণু ভারাক্রান্ত হয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে থাকলে তার মুখ থেকে লোক সংহারক মহাকাল সমদ্ভূত হন। তেইশ কল্পের নাম চিন্তক। এর সাথে চিতি নামে এক কন্যাও জন্মে। ব্রহ্মা যখন চিন্তান্বিত ছিলেন, সেই অবস্থায় এর জন্ম হয় বলে ঐ কল্প চিন্তক নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। চব্বিশ কল্পের নাম আকূতি। ঐ কল্পে আকূত ও আকৃতি মিথুন:সমুদ্ভুত হয়। ব্রহ্মা সেই আকুতিকে প্রজা সৃষ্টি করতে বলেছিলেন। এইজন্য এই কল্প নামে খ্যাত। পঞ্চবিংশ কল্পে বিজ্ঞাত ও বিজ্ঞাতি নামে মিথুন জন্মে। ষড়বিংশ কল্প মন। এতে শঙ্করী দেবী একটি মিথুন উৎপন্ন করেন।

সাতাশ কল্প হল ভাব। এতে পৌৰ্ণমাসী দেবী মিথুন উৎপন্ন করেন। ব্রহ্মা পরমাত্মা ধ্যানে নিমগ্ন হলে সেই জ্যোতিমণ্ডল অগ্নিরূপে ভূর্লোক, দ্যুলোক আচ্ছন্ন করে প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। সহস্র বৎসরের শেষে সেই জ্যোতিপুঞ্জ পূর্বমণ্ডলের আকার নিয়েছে। সেই সময় ভগবান সোম, ব্রহ্মার মনোমধ্যে পূর্ণরূপে প্রকট হয়েছিলেন বলে একে পৌর্ণমাসী বলা হয়। সব ব্রাহ্মণদের দর্শ ও পৌর্ণ মাসে নিজের মঙ্গল কামনায় যোগানুষ্ঠান করা উচিত, অগ্নিই সোম, কাল ও রুদ্র–এরকম শ্রুতি আছে। তাই যে জন অগ্নিতে প্রবেশ করেন, তার রুদ্রত্ব প্রাপ্তি হয়ে থাকে। আঠাশ কল্পের নাম বৃহত। প্রজা উৎপাদনের ইচ্ছেতে ধ্যানপরায়ণ ব্রহ্মার অন্তরকরণ বৃহৎসাম ও রথন্তর প্রাদুর্ভূত হয়। ঐ কল্পে সর্বব্যাপী বৃহৎ উৎপন্ন হয়েছিল বলে ঐ কল্পকে বৃহৎ কল্প বলে। বৃহস্তব, সূর্যমণ্ডলের আয়তন অষ্টাশী হাজার যৌবনে পরিমাণ। এই জন্য সূর্যমণ্ডল ভেদ করা কঠিন। দৃঢ়চেতা যোগী একে এবং বৃহৎ সামকেও ভেদ করে চলে যান। আমি এতক্ষণ এই বিচিত্র অধ্যাত্মতত্ত্ব বর্ণনা করলাম। পুরাতন কাজের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ বিষয়ে সেই পুরাণ পুরুষ ছাড়া কোন গতি নেই।

.

ত্রয়োবিংশ অধ্যায়

ঋষিগণ বললেন–হে মহামুনি, আপনি মন্ত্র কল্পনা ও কল্পসমূহের অদ্ভুত বিবরণ বলেছেন। এবার কল্পসংখ্যা বৃত্তান্ত আমাদের সবিস্তারে বলুন। বায়ু বললেন–আমি ব্রহ্মার কল্পসংখ্যা যুগ, বর্ষসংখ্যা বলছি। এক হাজার কল্পে ব্রহ্মার এক বৎসর হয়। আট হাজার ব্রহ্ম অব্দে ব্রহ্মার একযুগ হয়। এক হাজার যুগে সেই প্রজাপতি এক সবন হয়। দুহাজার সবনে এক ত্রিবৃত হয়। এটাই ব্রহ্মার স্থিতিকাল পরিমাণ। এবার আটাশ কল্পের বিবরণ শুনুন। রথন্তর কল্পের শেষে, সাম ও মন্ত্রগুলির উৎপত্তি ও নাম নিরুক্তি হয়। উনত্রিশ কল্পের নাম শ্বেতলোহিত। এই কল্পে ধ্যানপরায়ণ ব্রহ্মার পাবকের মত তেজস্বীকুমার প্রাদুর্ভূত হন। তিনি সাদা উষ্ণীব, সাদা মালা, সাদা বস্ত্রধারী, শিখাযুক্ত, দীপ্তমূর্তি। পিতামহ ব্রহ্মা, সেই ভীমাকার শ্বেতলোহিত পুরুষকে দেখে লোকধাতা, বিশ্বরূপ, পুরাণপুরুষ, বিশ্বাত্মা, যোগীবর ভেবে তাকে নমস্কার জানালেন। সেই জগতপতি শ্বেতদেব, ব্রহ্মার মনোভাব জানতে পেরে আনন্দের সাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।

তখন কয়েকজন ব্ৰহ্মতেজ সম্পন্ন মহাত্মা ঋষিগণ প্রাদুর্ভূত হলেন। তাদের নাম সনন্দ, নন্দক, বিশ্বনন্দ, নন্দন। এরা শ্বেতদেবের শিষ্য। তারপর ব্রহ্মার সামনে মহামুনির আবির্ভাব হয়। এই শ্বেতমুনি থেকেই নরঋষি উদ্ভব হয়, যে সব ব্রহ্মনিষ্ঠ, যোগমুক্ত বিপ্র, সেই সদ্যোজাত বিশ্বেশ্বর দেবের শরণাপন্ন হন, তাঁরা পাপহীন বিমল ব্ৰহ্ম তেজোময় হয়ে ব্রহ্মলোক অতিক্রম করে থাকেন। বায়ু বললেন–তারপর ত্রিশ কল্প এটি রক্ত নামে প্রসিদ্ধ। এই কল্পে ব্রহ্মা পুত্র কামনার্থে ধ্যানমগ্ন হলে রক্তবর্ণ, রক্তনেত্র, এক পুরুষ প্রাদুর্ভূত হন। ব্রহ্মা সেই রক্তকুমারকে দেখে বিশ্বেশ্বর-এর অবতার মনে করে বিনম্র হয়ে প্রাণায়াম করে বামদেবকে চিন্তা করতে লাগলেন। ধ্যানরত ব্রহ্মাকে দেখে মহাদেব খুশী হয়ে পিতামহকে বললেন–হে মহাতপা, সভম–তুমি পুত্র কামনায় ধ্যানস্থ হয়ে পরম ভক্তি সহকারে ধ্যানযোগে আমাকে দেখতে পেয়েছ। এজন্য কল্পে কল্পে পরম ধ্যানাবলম্বনে ঈশ্বররূপী আমাকে জানতে পারবে। ভগবান সর্ব এই বলে অট্টহাসি হাসলেন। তাতে শুদ্ধবুদ্ধি চার কুমার প্রাদুর্ভূত হলেন। তাদের নাম বিরজ, বিবাহ, বিশোক ও বিশ্বভাবনা। তারা বীর, অধ্যবসায়ী, ব্রহ্মপরায়ণ। সকলেরই রক্তবস্ত্র, রক্তমালা শোভিত, রক্তভস্মমাখা, রক্তমুখ, রক্তলোচন। এই মহাত্মারা তারপর হাজার বছর ধরে লোকানুগ্রহের ইচ্ছায় শিষ্যদের হিত সাধনের জন্য সহস্র শৈবধর্মের আদেশ করে আবার মহাদেব রুদ্র অধ্যায়ে প্রবেশ করেছেন। সেই সব দ্বিজ শ্রেষ্ঠরা মহেশ্বর এর উপাসনাতে যোগানুষ্ঠান করে ঈশ্বর বামদেবের শরণাপন্ন হন। তারপর রুদ্রলোকে আবার জন্মহীন গতি পেয়ে থাকেন।

.

চতুর্বিংশ অধ্যায়

একত্রিশ কল্পের নাম পীতবামা। এই কল্পে মহাতেজা ব্রহ্মা পীতবর্ণ হয়েছিলেন। ব্রহ্মা যখন ধ্যান করছিলেন সেই সময় তার দেহ থেকে এক কুমার প্রাদুর্ভূত হন। ইনি পীতবস্ত্র ও পীতমালাধারী, অতি তেজস্বী এই কুমার–পীত উষ্ণীষধারী মহাভুজ। ধ্যানমগ্ন এই ব্রহ্মা কুমারকে দেখে লোকবিধাতা পরমেশ্বরকে বন্দনা করলেন। তারপর ধ্যাননিষ্ঠ ব্রহ্মা দেখলেন–মহেশ্বরী দেবী নিজের রূপ বিকৃত করে গোরূপে মহেশ্বর এর মুখ থেকে বিচ্যুত হলেন–এনার চার পা, চার মুখ, চার হাত প্রভৃতি। সর্বদেববন্দিত মহেশ্বর সেই মহেশ্বরী দেখে বললেন–হে দেবী। তুমিই মতি, তুমিই স্মৃতি, তুমি বুদ্ধি, তুমি এস। তুমি এই বিশ্বজুড়ে রয়েছে। যোগবলে সমস্ত জগৎ বশীভূত করো। আবার ভাবীকালে রুদ্রাণী হয়ে মহাদেবের সাথে বাস করতে হবে। এই বলে সেই চতুষ্পদী গোরূপিণী মহেশ্বরীকে ধ্যাননিষ্ঠ পুত্রপ্রার্থী ব্রহ্মার হাতে অর্পণ করলেন। ধ্যানযোগে সেই মহেশ্বরীকে জেনে তার শরণাপন্ন হলেন এবং তাকে গায়ত্রীজ্ঞানে ধ্যান করতে লাগলেন।

মহাদেবী গায়ত্রীর পর ধ্যানাসক্ত মনে মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন। মহাদেব ব্রহ্মাকে দিব্যযোগ ঐশ্বৰ্য্য জ্ঞানসম্পত্তি ও বৈরাগ্য দান করলেন। এরপর ঈশ্বর এক ভীষণ উজ্জ্বল অট্টহাসি হেসে উঠলেন। তাতে তার দেহ থেকে দীপ্তি সম্পন্ন অনেক কুমার প্রাদুর্ভূত হলেন। এই কুমারেরা সবাই পীতমালা ও বস্ত্রধারী, পীতকেশ, পীত উষ্ণীষধারী। এই বিশাল তেজসম্পন্ন কুমারেরা সহস্র বছর বাস করবার পর ঋষিদের যোগতত্ত্ব সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে জগদীশ্বর রুদ্রের দেহে প্রবেশ করেন। বায়ু বললেন–এর পর ব্রহ্ম সেই পীতবর্ণের কল্পশেষ হলে, আবার সিত নামে অন্য কল্প শুরু হল। তখন প্রজাসৃষ্টির কামনাতে দুঃখিত মনে চিন্তা করতে লাগলেন। চিন্তিত বলে তার বর্ণ কালো হয়ে গেলো। এর ফলে যে কুমার উৎপন্ন হল, ঐ কুমার কৃষ্ণবর্ণ, কৃষ্ণ মালাধারী, কৃষ্ণবস্ত্র পরিহিত, মাথায় কালো উষ্ণীষ। কুমারেরা সকলেই হুঙ্কার দিয়ে হেসে উঠলেন। তারপর সহস্র বছর পরে যোগবলে পরমেশ্বর পদের উপাসনা করে তাদের শিষ্যদের যোগরহস্য দান করলেন। তারপর বিশ্বেশ্বর এর নির্মল, নির্গুণ পদে আশ্রয় পেলেন, এভাবে কৃষ্ণরূপ কল্প শেষ হলে বিশ্বরূপ নামে অন্য কল্প শুরু হয়। আবার চরাচর জগতের সৃষ্টি শুরু হল।

ব্রহ্মা আবার পুত্র কামনায় ধ্যান শুরু করেন। তখন মহানাদ শালী সরস্বতী প্রাদুর্ভূত হলেন। পিতামহ যোগাসক্ত মনে বিশ্বমাল্য, বিশ্ববসনধারী, বিশ্ব-উষ্ণীব কালী, মহাভুজ সর্বগামী ঈশানদেবকে মনে মনে ধ্যান করলেন। বললেন–হে ঈশান, তোমাকে নমস্কার, হে মহাদেব, তোমায় আমি নমস্কার করি। ধ্যানাসক্ত পিতামহকে দেখে ভগবান ঈশান বললেন–আমি খুশি হয়েছি। তোমার কি ইচ্ছে বল? ভগবান ব্রহ্মা প্রণত হয়ে মহেশ্বর এর স্তব করে খুশি হয়ে মহেশ্বরকে বললেন–দেব–আপনার বিশ্বেশ্বর, বিশ্বরূপ তা আমি জানতে চাই। কে এই পরমেশ্বর? আর সেই চতুস্পদা, চতুর্মুখী, চতুঃশৃঙ্গী, চতুৰ্ত্তনী, চতুনেত্রা ভগবতী দেবী আসলে কে? মহেশ্বর বললেন–এটি সমস্ত মন্ত্রের রহস্য, পবিত্র পুষ্টিবর্ধন। এই যে বর্তমান কল্প, এর নাম বিশ্বরূপ। এই কল্পের ছত্রিশ মনু। যখন থেকে তুমি ব্ৰহ্মপদ পেয়েছে। সেই থেকে এই তেত্রিশতম কল্প চলে আসছে। হে দেবেশ, তোমার কাছেই যে শত শত সহস্র সহস্র স্বয়ম্ভু অতীত হয়েছেন, তাদের কথা শুনুন, আগে তুমি আনন্দ নামে পরিচিত ছিলে। তখন তুমি বহু তপস্যা করেছো। তুমি গালব্য গোত্রে জন্মেছিলে।

তারপর তপোবনে আমার পুত্রত্ব পেয়েছো। যোগ, সংখ্যা, তপস্যা, বিদ্যা, ক্রিয়া, ঋত, সত্য, অহিংসা, সন্ততি, ধ্যান, বপু, শান্তি, স্মৃতিক, লজ্জা, মেধা, শুদ্ধি, সরস্বতী ইত্যাদি তোমাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই যিনি বত্রিশ অক্ষর, নামিকা, ছাব্বিশ গুণময়ী দেবী বিরাজিতা–হে ব্রাহ্মণ। এই মহেশ্বরী প্রকৃতিকেই তুমি তোমার প্রসূতি বলে জানবে। এই চতুর্মুখী জগৎযোনি, গোরুপিনী প্রকৃতি দেবী, ভগবতী তোমার প্রসূতি। এর জন্ম নেই, ইনি লোহিত শুক্ল কৃষ্ণতা, বিশ্ব সৃষ্টিকারিণী সুরূপা। এই গোরুপিণী গায়ত্রীকে দেখে আমি অজ ও বুদ্ধিসম্পন্ন হয়েছি। মহাদেব এই কথা বলে এক উচ হাসি হাসলেন। তারপর তার চারপাশ থেকে নানা রূপধারী কয়েকজন দিব্য কুমার প্রাদুর্ভূত হলেন। এই কুমারদের মধ্যে কেউ জটী, কেউ মুণ্ডী, কেই শিখণ্ডী ও অর্ধমুণ্ডী। এই মহা তেজস্বী কুমাররা পরে যথাবিহিত যোগানুষ্ঠান দিয়ে দিব্য হাজার বছর পর্যন্ত মহেশ্বর-এর উপাসনা করে ধর্মোপদেশ দান করে রুদ্রের দেহে প্রবেশ করলেন।

বায়ু বলতে লাগলেন, এরপর লোকপিতামহ ব্রহ্মা বিস্মিত হয়ে ভক্তিযুক্ত মনে মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন এবং বললেন– হে বিভো, আপনার এই শ্বেতবর্ণ হল কিভাবে? ভগবান বললেন–যখন শ্বেতকল্প হয়, তখন আমি শ্বেত হয়েছিলাম। আমার মালা, উষ্ণীষ, বস্ত্র, অস্থি, মাংস, রোম, ত্বক, রক্তও শ্বেতবর্ণের ছিল। সেইহেতু শ্বেত নামে খ্যাত হই। আমার প্রসাদে দেবাধিপ শ্বেতাঙ্গ, শ্বেতলোহিত এবং গায়ত্রীও শ্বেতবর্ণ হয়েছিলেন। হে দেবেশ, আমি যেহেতু আমিও আপনাদের সাথে গোপন রূপে ছিলাম, এজন্য আপনারা নিজের তপস্যার ফলে আমাকে সদ্যোজাত সনাতন পুরুষ বলেই জেনেছেন। আমার সদ্যোজাত মূর্তি গুহ্যব্রহ্ম বলে বিখ্যাত। যে ব্যক্তি আমার গুহ্যরূপ জানবেন, তিনি ব্রহ্মের কাছে যাবেন। এরপর তাদের আর জন্ম হবে না। যখন আমি লোহিত ছিলাম, তখন আমার নামে কল্পের নাম লোহিত হয়।

গোরূপিণী গায়ত্রীও তখন লোহিতাকার ছিলেন। তারপর বর্ণ বিপর্যয়ে আমার লোহিতত্ত্ব ও যোগের বামত্ব ঘটাতে আমি বাম দেবত্ব পেলাম। মহীতলে আমি বামদেব নামে খ্যাতি লাভ করলাম। যে পুণ্যবান ব্যক্তিরা আমার বামদেব স্বরূপ জানবেন, গায়ত্রী মাতার তত্ত্ব জানবেন, তারা সকলেই সব পাপ থেকে মুক্ত হবেন। তাদের আর পুনর্জন্ম হবে না। আমার দেহ যখন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয় তখন আমার কল্প কৃষ্ণ নামে অভিহিত হয়। হে ব্রাহ্মণ, তখন তুমি আমাকে ঘোর পরাক্রমী ঘোরাকৃতি বলেই জেনেছিলে। তাই মর্তে যারা আমাকে ঘোরাকারে জানবে, তাদের সম্বন্ধে সবসময়েই আমি অঘোর, অব্যয় ও শান্তরূপে থাকব। এভাবে ভূতলে যারা আমাকে বিশ্বরূপে দর্শন করবে তাদের প্রতি সবসময়ই আমি শিব ও সৌম্য হয়ে থাকব।

আমার বিশ্বরূপের জন্য এই কল্পের নাম বিশ্বরূপ। আমার তখন চারপুত্র উৎপন্ন হয়। মোক্ষ, ধর্ম, অর্থ, কাম–এরাই সেই চারপুত্র। এরা ধর্মের চতুষ্পদ স্বরূপ। চার রকম ভূতগ্রাম, চার আশ্রম, এরাও ধর্মের চতুষ্পদ স্বরূপ আমার চারপুত্র। সেই থেকে চরাচর জগৎ চারযুগে চারভাগে বিভক্ত। ভূর্লোক, ভুবর্লোক, স্বর্লোক, মহর্লোক, জল, অপ ও সত্যলোক, তারপর রুদ্রলোক–এই আটটি লোক–এদের মধ্যে কোনো কোনো লোক ক্ষয়শীল। ভূর্লোক ও স্বলোক প্রভৃতি চারপাদ, তার মধ্যে ভূর্লোক, প্রথম পাদ, ভূবলোক দ্বিতীয়, স্বলোক তৃতীয় ও মহলোক চতুর্থ। এই লোকগুলির মধ্যে রুদ্রলোকই পরম স্থান। যিনি, নিরহঙ্কার, ধ্যাননিষ্ঠ যোগী পুরুষ তিনি সেই লোকপ্রাপ্ত হন।

হে ব্রাহ্মণ, সমস্ত প্রাণীর প্রাণস্বরূপ সোম আমার মুখ থেকে বিনির্গত হয়, জীবেরা তা স্তনমণ্ডলে ধারণ করে। যেহেতু আপনি এই সাবিত্রী মহেশ্বরীকে দ্বিপদ আকারে দেখেছেন, এজন্যে আপনি সৃষ্ট নরগণ সকলেই দ্বিপদ বিশিষ্ট হবে। যিনি পরমা, জন্মরহিতা, মহেশ্বরী দেবী, তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করছেন, এজন্য অজদের বিশ্বরূপত্ব হবে। মহাতেজা অজও বিশ্বরূপ হবেন। যে সকল দ্বিজ আমাকে শিবরূপে দর্শন করবেন, তারা রজঃ গুণ মুক্ত হবেন। ভগবান পিতামহ ব্রহ্মাকে রুদ্র এরকম বললে তিনি প্রণত হয়ে তাঁকে বললেন–হে দেব দেবেশ, হে ভগবান, আপনি বিশ্বরূপধারী মহেশ্বর! হে মহাদেব! আপনার এইসব দেহ লোকপুজ্য; কিন্তু আমি জানতে ইচ্ছা করি- কোন্ কালে কোন্ যুগে দ্বিজাতিরা আপনাকে দেখতে পাবেন? কি রকম তত্ত্বযোগে বা ধ্যানে তারা আপনার দর্শন পাবেন? ভগবান বললেন–কি তপস্যা বা যোগ বা কি দান, ধর্ম, তীর্থ, সেবা, পূজা–একমাত্র ধ্যান ছাড়া কোনকিছুতেই মানুষ আমার সাক্ষাৎ পাবে না। ত্রিভুবনপতি বিষ্ণু নারায়ণই একমাত্র সাধনীয়। তিনি বরাহ নামে বিশ্রুত হবেন। তার চার হাত, চার পা, চারমুখ, চার চোখ হবে। তখন তিনি সম্বৎসর হয়ে যজ্ঞরূপী হবেন। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগে তার চার পা-ও প্রত্যঙ্গ সকল, তার অঙ্গ চার বেদ, চার বাহু ঋতু ও ঋতুসন্ধি, তার মুখ দুই অয়ন মুখ, তাঁর চার চোখ পর্ব সকল ফাল্গুনী, আষাঢ়ী ও কৃত্তিকা এবং দিবা, অন্তরীক্ষ ও ভৌম এই তিন স্থান তাঁর তিনমস্তক এবং উৎপত্তি ও প্রলয় এই দুটি তার আশ্রম। এই নারায়ণই বরাহরূপে সকলের আরাধ্য হবেন। আপনি চতুরানন হবে। নারায়ণ ব্রহ্মলোকবাসীদের কাছে নমস্য হবেন, তারপর সেই কল্পে আপনি পদ্মজন্মা, পদ্মনাভ ইত্যাদি বিপুল খ্যাতি প্রাপ্ত হবে। পরে বরাহকল্পে মহাতেজা বিষ্ণু কাল হয়ে লোক সংহার করবেন। তারপর আপনার বৈবস্বত মনু নামে এক পুত্র জন্মাবেন। আমি তখন সেসময় শ্বেতনামক শিখাযুক্ত মহামুনি হব। হিমালয়ের শিখরে রম্য পর্বতে আমার চারজন শিষ্য হবেন।

তারা সকলেই শিব অনুরক্ত মহাত্মা। তাদের নাম শ্বেত, শ্বেতশিম, শেতাশ্ব, শ্বেতলোহিত। তারপর সেই চারজন ব্রহ্মনিষ্ঠ শিষ্য ব্রহ্মতত্ত্ব দেখে আমার কাছে আসবেন। এখানে আগমনের কারণে আর তাদের পুনর্জন্ম হবে না। আবার যখন আমার দ্বিতীয় দ্বাপর যুগে প্রভু প্রজাপতি সত্য নামে ব্যাস হবেন। তখন আমি আবির্ভূত হব, চারপুত্র জন্ম নেবে যথা–দুন্দুভি, শতরূপ, ঋচীক ও কেতু জন। এরা ব্রহ্মজ্ঞান পেয়ে সনাতন রুদ্রলোকে যাবে। সেখান থেকে সংসারে আর ফিরে আসতে হবে না। তৃতীয় দ্বাপরে ভার্গব ব্যস হবেন। তখন আমি দমন নামে বিখ্যাত হব। সে সময় বিশোক, বিকেশ, বিলাপ, পাপনাশন এই চারপুত্র জন্মাবে। এই পুত্ররাও যোগমার্গ অবলম্বন করে রুদ্রলোকে যাবে। চতুর্থ দ্বাপরে অঙ্গিরা যখন ব্যাস হবেন, তখন আমি সুহোত্রী নামে বিখ্যাত হব। তখন তপোবন, যোগাত্মা, দুব্রত ও দ্বিজপ্রধান এই চারপুত্র উৎপন্ন হবে। এদের নাম, সুমুখ, দুর্মুখ, দুর্দম, দুরতিক্রম। এরা যোগাবলম্বন করে রুদ্রলোকে যাবেন, পঞ্চম দ্বাপরে সবিতা যখন ব্যাস হবেন, তখন আমি কষ্ক নামে মহাতপা হবেন। তখন গোত্মা, নিরহংকার চারপুত্র জন্ম নেবে। তাদের নাম–সন, সনন্দন, ঋভু ও সনৎকুমার, এরা সকলেই আমার কাছে আসবে। তাদের আর পুনর্জন্ম ঘটবে না। ষষ্ঠ দ্বাপরে মৃত্যু যখন ব্যাস হবেন, তখন আমি লেকাক্ষি নামে বিখ্যাত হব। সেই সময় আমার চারজন শিষ্য হবে। এরা হলো- সুধামা, বিরজা, শঙ্খপাত ও বর। তারা সকলেই যোগমার্গ অবলম্বন করে নিশ্চয়ই আমার লোকে যাবেন। আগে মহাতেজা বিভু শতক্রতু ছিলেন।

সপ্তম যুগ পরিবর্তনে সেই শতক্রতু যখন ব্যস হবেন তখনকার সেই যুগান্তে আমি যোগীশ্রেষ্ঠ জিগীষা নামে বিখ্যাত হব। সেই যুগে আমার চার পুত্রের নাম হবে–সারস্বত, সুমেধা, বসুরাজ, সুবাহন। এই মহাত্মা পুত্রেরা সবাই ধ্যানযোগ অবলম্বনে আগের মতো রুদ্রলোকে উপনীত হবেন। অষ্টম পরিবর্তনে বশিষ্ঠ ব্যাস হবেন, তখন কপিল, আসুরি, পঞ্চলিখ ও রাসকলি–এই চারজন মহাত্মা তাঁর শিষ্য হবেন। তখন কপিল প্রভৃতিরা ধ্যানবলে মহেশ্বর যোগ পেয়ে দগ্ধপাপা হবেন। নবম যুগ পরিবর্তনে সারস্বত ব্যাস হবেন, তখন আমি ঋষভ নামে বিখ্যাত হব। এরপর পরাশর, গার্গ, ভার্গব ও অঙ্গিরা নামে আমার চারজন মহাপ্রভব পুত্র হবে। এরা সকলেই বেদপারঙ্গম, তপঃপ্রভাবে উৎকৃষ্ট। এই তপস্বী পুত্রেরা সবাই যোগপত্র আশ্রয় করে রুদ্রলোকে গমন করবেন।

দশম দ্বাপরে ত্রিধামা ব্যাস হবেন। তখন আমি গিরিরাজ হিমালয়ের ভৃগু নামের তুঙ্গ ও রম্য শিখরে আবির্ভূত হব। তখন আবার আমার চারপুত্র জন্ম নেবে। তাদের নাম বলবন্ধু, নিরমিত্র, কেতুশৃঙ্গ ও তপোধন। এরা তপস্যা করে পাপমুক্ত হয়ে দেবলোকে যাবে। এগারো দ্বাপরে ত্রিবৃত ব্যাস হবেন। তখন কলির প্রথমে আমি গঙ্গাদ্বারে আবির্ভূত হব। উগ্র নামের মহানাদশালী চার পুত্রের জন্ম হবে। এদের নাম–লম্বোদর, লম্ব ও লম্বাক্ষ ও লম্বকেশক। এরা সকলেই মাহেশ্বর যোগ লাভ করে রুদ্রলোকে যাবে। দ্বাদশ পরিবর্তনে মহামুনি শততেজা মহাকবি ব্যাস হবেন। তারপর ঐ যুগান্তে আমি অত্রি নামে বিখ্যাত হব। যোগ অবলম্বনে থৈমক বনে আশ্রয় নেব। তখন আমার চারপুত্র হবে। তাদের নাম সর্বজ্ঞ, সমবুদ্ধি, সাধ্য ও সর্ব। আমার পুত্রেরা পূর্বের ন্যায় রুদ্রলোকে গমন করবে।

তারপর ত্রয়োদশ যুগান্ত পরিবর্তন ঘটলে ধর্মনারায়ণ যখন ব্যাস হবেন, তখন আমি গন্ধমাদন পর্বতে পবিত্র বালখিল্য আশ্রমে বলি নামে মহামুনি হয়ে আবির্ভূত হব। তখন আমার সুধামা, কাশ্যপ, বশিষ্ঠ ও বিরজা নামে চার তপোধন পুত্র উৎপন্ন হবে। এরা উর্ধরেতা হবেন। রুদ্রলোকে গমন করবেন। চতুর্দশ পর্যায়ে সুরক্ষ যখন ব্যাস হবেন, সেই যুগান্তে আবার আমি, অঙ্গিরার বংশে গৌতম নামে শ্রেষ্ঠ যোগী উৎপন্ন হব। আমার আশ্রম পবিত্র গৌতমাশ্রম নামে পরিচিত হবে। পরে কলির শুরুতে আমার যে চারপুত্র হবে, তাদের নাম–অত্রি, উগ্রতপ, শ্রবণ, দ্রবিষ্টক। ঐ পুত্রেরাও ধ্যান নিষ্ঠ হয়ে আগের মতো যোগমার্গ অবলম্বন করে রুদ্রলোকে গিয়ে বাস করবে। এরপর পঞ্চদশ দ্বাপরে মহাত্মা আরুণি যখন ব্যাস হবেন, তখন আমি বেদশিরা নামে অস্ত্র আর বেদশীর্ষা নামে পৰ্বত হয়ে বিখ্যাত হব। সরস্বতী নদীর তীরে হিমালয়ের এক আশ্রমে আমি থাকব। তখন ভূমি, কুনির্বাহ, কুশরী ও কুনেত্র নামে চারপুত্র হবে। এরপর ষোড়শ পর্যায়ে মহাত্মা সঞ্জয় ব্যাস হবেন। আমি গোকর্ণ নামে বিখ্যাত হব। সেই সময় আমার কশ্যপ, উশনা, জ্ঞান ও বৃহস্পতি নামে আমার চারজন মহাত্মাপুত্ৰ উৎপন্ন হবে। এই পুত্রগণ পরমপদ লাভ করবেন।

এরপর সপ্তদশ যুগান্ত পরিবর্তনে দেব কৃতজ্ঞয় ব্যাস হবেন, তখন আমি গৃহবাসী নামে বিখ্যাত হব। হিমালয় শিখরে আমার ক্ষেত্র মহালয় নামে বিখ্যাত হবে। সেখানে চারজন যোগবেদী পুত্র উৎপন্ন হবে। এরা উতথ্য, বামদেব, মহাকাল ও মহালয়। ঐ কল্পে আমার সমস্ত পুত্রই ধ্যানযোগী হবে। এরা অব্যয় শিব শরীরে প্রবেশ করবে। এছাড়া অন্য যেসব মহাত্মা, বিমল বিশুদ্ধ হয়ে পবিত্র মহালয়ে গিয়ে মহেশ্বর-এর পা দর্শন করবেন, তারা ঊর্ধ্ব এবং অধস্তন দশ দশ পুরুষ সংসারচক্র থেকে উদ্ধার করতে পারবেন। আমার প্রসাদে তাদের রুদ্রলোক প্রাপ্তি হবে।

এরপর অষ্টাদশ যুগান্ত পরিবর্তনে যখন ঋতঞ্জয় ব্যাস হবেন তখন শিখণ্ডী নামে আবির্ভূত হব। তখন আমার বাচবা, ঋচীক, সাহায্য ও দৃঢ়ব্রত নামে চারপুত্র জন্মাবে। এরপর একুশতম যুগান্ত পরিবর্তনে ভরদ্বাজ ব্যাস হবেন। ঐ সময় হিমালয়ের আমি রম্য হিমাদ্রি শিখরে জটামালী নামে বিখ্যাত হব। আমার নামে জটায়ু পর্বত হবে। হিরণ্য, কৌশিল্য, কাক্ষীব, কুথুমি নামে আমার চারজন মহাতেজা পুত্র জন্মাবে। এরাও রুদ্রলোকে যাবে। বিংশতিতম যুগান্ত পরিবর্তনে সৃষ্টি বিস্তারে বাঁচাবশ্রবা ব্যাস হবেন। তখন আমার নাম হবে অট্টহাসী। সুমন্ত, বর্বরি, সুবন্দ ও কুশিকন্ধর নামে চারপুত্র জন্ম নেবে। জ্ঞাননিষ্ঠ, সত্যব্রত পুত্রেরা রুদ্রলোকে যাবে। একুশ পর্যায়ে বাচস্পতি ব্যাস হবেন। আমি দারুক নামে অবতীর্ণ হব। আমার প্লক্ষ, দাক্ষায়ণী, কেতুমালী ও বক নামে চারজন মহাপ্রভাব পুত্র হবে।

বাইশতম যুগান্ত পরিবর্তনে শুক্লায়ন যখন ব্যাস হবে তখন আমি বারাণসী ধামে লাঙ্গলী নামে এক মুনি হব। সেখানে আমার, তুল্যার্ধে মধুপিঙ্গাক্ষে ও শ্বেতকেতু নামে ধার্মিক পুত্র জন্মাবে। তারা মহেশ্বর এর যোগ পেয়ে রুদ্রলোক যাবে। তেইশতম যুগান্ত পরিবর্তনে তৃণবিন্দু ব্যাস হবেন। তখন আমি জন্মাব শ্বেত নামে মহামুনি হয়ে। উবিজ, বৃহদুকথ, দেবল ও কবি নামে মহাপ্রভাব পুত্র জন্ম নেবে। চব্বিশতম যুগান্ত পরিবর্তনে ঋক্ষ ব্যাস হবেন। আমি কলির শুরুতে শূলী নামে মহাযোগী হয়ে আবির্ভূত হব। তখন শালিহোত্র, অগ্নিবেশ্য, যুবনাশ্ব ও শরদ্বসুনামে চারপুত্র হবে। এই পুত্রেরা রুদ্রলাভ করবে। পঁচিশতম যুগান্ত পরিবর্তনে বশিষ্ট যখন ব্যাস হবেন তখন কোটিবর্ষ নগরে দণ্ডী মুণ্ডীশ্বর নামে প্রাদুর্ভূত হব। অর্নল, কুম্ভকবাশ্য, কুম্ভ ও প্রবাহক নামে চার পুত্র উৎপন্ন হবে। ছাব্বিশতম যুগান্ত পরিবর্তনে পরাশর ব্যাসের কালে তখন আমি সহিষ্ণু নামে বিখ্যাত হব। পবিত্র রুদ্রবনে আমার অবস্থান হবে, তখন উলুক, বৈদ্যুত, সার্বক ও অশ্বলায়ন নামে চার পুত্র হবে। এরা পূর্ববর্তী পুত্রদের মতোই রুদ্রলোকে যাবে। সাতাশতম যুগান্ত পরিবর্তনে জাতুকণ্য ব্যাসের কালে মুনি সোমশর্মা নামে বিখ্যাত হব। প্রভাসতীর্থে আমার স্থান হবে। অক্ষপাদ, কণাদ, উলুক, বৎসা নামে চারপুত্র যোগাত্মা বিশুদ্ধ হবে।

আটাশতম যুগান্ত পরিবর্তনে শ্রীমান বিষ্ণু যখন দ্বৈপায়ণ ব্যাস হবেন, তখন কৃষ্ণ যদুশ্রেষ্ঠ বাসুদেব রূপে বসুদেব থেকে প্রাদুর্ভূত হবেন, আমি যোগাত্মা হয়ে ব্রহ্মচারী দেহে প্রাদুর্ভূত হব। আমার নাম হবে নকুলী। ঐ সময় আমার কুশিক, গার্গ, মিত্রক ও রুষ্ঠ নামে চারজন তপস্বী পুত্র জন্ম নেবে। এরা রুদ্রলোকে যাবে। আমি যথাক্রমে আঠাশটি যুগান্ত মনু আদিকৃষ্ণ পর্যন্ত যাবতীয় অবতার লক্ষণ ও স্মৃতিগুলোর বিভাগ ও ধর্মলক্ষণ বললাম।

.

পঞ্চবিংশ অধ্যায়

বায়ু বলে চলেছেন — মুনিরা বলেন, ভারতবর্ষে চারটি যুগ আছে। যথা–সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। প্রত্যেক যুগের পরিমাণ দিব্য হাজার বছর। এই সহস্র বর্ষ ব্রহ্মার এক দিন। মন্বন্তর অতীত হলে প্রভাবশালী সমস্ত দেবই এভাবে ঊর্ধ্বগামী হন। সেখানে কল্পবাসী দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হন, দহন ও বর্ষণ দ্বারা যুগ ক্ষয় সংঘটিত হলে ব্রহ্মা সে সমস্ত সংহার করে আবার দেব, ঋষি ও দানবের সংস্থান করেন। সাতটি কল্প শেষে সপ্তসাগর একীভূত হয়ে এই বিশ্ব জগৎ ঘোর একার্ণব আকারে পরিণত হয়েছিল। কোথাও কোনও ভাগ ছিল না। সবই তমোময় ছিল।

শঙ্খ, চক্র, গদাধর নারায়ণের মুখ থেকে তার আবির্ভাব সেই অষ্টম পুরুষোত্তম, যোগবিদ হরি ঐ সমুদ্রে মায়াবলে সহস্র কণা সংকলিত অনন্ত শয্যায় শয়ন করলেন। সে সময় তার নাভিদেশ থেকে এক পদ্ম প্রাদুর্ভুত হল। ঐ পঙ্কজের বিস্তার একশ যোজন পর্যন্ত। বিষ্ণুর খেলাচ্ছলে উৎপন্ন পদ্ম দেখে আকর্ষিত হয়ে চতুরানন ব্রহ্মা কাছে এসে দেখলেন, শ্রীহরি সেই সুগন্ধ পদ্ম নিয়ে খেলা করছেন। ব্রহ্মা আরো কাছে এসে সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন–কে তুমি? জলের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে শুয়ে আছো? ব্রহ্মার প্রশ্ন শুনে তিনি বললেন–এই ভূমি, অন্তরীক্ষ ও স্বর্গ–এসব কিছুর কার্য-কারণ আমি। আমিই প্রভু পরমপাদ ভগবান বিষ্ণুঃ।

তিনি আরো জিজ্ঞাসা করলেন –আপনি কে ভগবান?–আপনি কোথা থেকে আমার কাছে এলেন? কোথায় যাবেন, কে আপনি বিশ্ব মূর্তিধর? পিতামহ তার জিজ্ঞাসার উত্তরে বললেন–আপনার মত আমিও নারায়ণ। আদিকর্তা প্রজাপতি। এ কথা শুনে সবিস্ময়ে শ্রীহরি, কৌতূহলবশতঃ অনুমতি নিয়ে তার মুখমধ্যে প্রবেশ করলেন। মহাতেজা বিষ্ণু সেখানে প্রবেশ করে দেখলেন ব্রহ্মর উদারে পর্বত, সাগর নিয়ে আঠারোটি দ্বীপ, চার আশ্রমে বিভক্ত সাতটি সনাতন লোক রয়েছে। ব্রহ্মার উদরস্থ নানা লোক, আশ্রম দেখেও সীমা খুঁজে পেলেন না। হাজার বছর কেটে গেল।

ব্রহ্মার মুখ থেকে বেরিয়ে শ্রীহরি তাঁকে বললেন–আমি আদি-অনন্ত কিছুই উপলব্ধি করতে পারলাম না। এরপর শ্রীহরি পিতামহ ব্রহ্মাকে বললেন–এবার আমার উদরে প্রবেশ করুন। পিতামহ এবার শ্রীপতির কথা শুনে উৎফুল্ল মনে তার উদার প্রবেশ করলেন। উদরের ভিতর বহু ভ্রমণ করেও দেবতার আদি-অন্ত পেলেন না। এদিকে ভগবান বিষ্ণু তখন পিতামহ উদরে প্রবেশ করার পর সমস্ত ইন্দ্রিয় দ্বার বন্ধ করে রাখলেন। অতঃপর পিতামহ বিষ্ণুর নাভিদেশ দিয়ে বাইরে এলেন। পদ্মগর্ভা ব্রহ্মা পদ্মের মধ্যে বিরাজ করতে লাগলেন। ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে এই কৌতুক লীলা চলতে লাগল। অতঃপর সেখানে তখন ভূতপতি শূলপাণি মহাদেব এলেন। তাঁর দুপায়ের আঘাতে অতি উষ্ণ ও অতি শীত স্থূল জলবিন্দুগুলি আকাশে উঠে গেল। প্রবল বাতাস বয়ে গেল। ব্রহ্মা বিষ্ণুকে বললেন–এক মহান আশ্চর্যের ব্যাপার! এই পদ্মও ভীষণ কাঁপছে। এর কি কারণ? আমার সংশয় দূর করুন।

শ্রীহরি ব্রহ্মার কথা শুনে বললেন–আমার নাভিদেশে কোন প্রাণী এসে আশ্রয় নিয়েছে? আপনি আমার সঙ্গে প্রিয়কথা বলছেন, এমন আমি কি উত্তম কাজ করেছি। ব্রহ্মা প্রত্যুত্তরে বললেন–আমি বহুপূর্বে আপনারই ইচ্ছায় আপনার উদরে প্রবেশ করেছিলাম। আমি আপনার ভেতর সমস্ত লোক দর্শন করেছি। কিন্তু সহস্র বছর পরও বার হতে পারিনি, আপনি সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার বন্ধ রেখেছিলেন। তাই আমি নাভিদেশে প্রবেশ করে, নাভি পঙ্কজের সূত্র পথে নির্গত হয়েছি। আমার এই কাজে আপনি আহত হবেন না।

বিষ্ণু বললেন–হে ব্রাহ্মণ, আমি আপনাকে বাধা দেবার জন্যই লীলাচ্ছলে একাজ করেছি। আপনার মঙ্গলের জন্যই একাজ করেছি। ব্রহ্মা বললেন–বিষ্ণো, আপনি বর গ্রহণ করুন। আমি পদ্ম থেকে নামছি। বিষ্ণু বললেন–হে অরিসূদন, আমার ইচ্ছে আপনি আমার পুত্র হন। আপনি শ্বেত উষ্ণীষ শোভাধারী পদ্মযোনি নামে বিখ্যাত হবেন। ভগবান ব্রহ্মা আনন্দের সাথে বললেন– আচ্ছা তাই হোক। তারপর বললেন– হে বিষ্ণু! কে ইনি প্রদীপ্ত তেজ পুজ্ঞবৎ মূর্তিতে চারদিক ও অন্তরীক্ষ ব্যাপ্ত করে এদিকে আসছেন? বিষ্ণু উত্তরে বললেন–যাঁর পদক্ষেপে আকাশ, বাতাস, জল আলোড়িত হল, সেই জলের ঢেউ আপনাকে পর্যন্ত স্পর্শ করছে, নিঃশ্বাস বায়ুতে মহাপদ্ম পর্যন্ত কাঁপছে। তিনি সংহার কর্তা, দেবাদিদেব। এনাকে আমরা দুজন স্তোত্র পাঠ করে পূজা করব। ক্রুদ্ধ ব্রহ্মা বললেন– কে এই শঙ্কর? যাকে আপনি জগতের নিমিত্ত বলছেন? তার ক্রুদ্ধ বাক্য শুনে বিষ্ণু বললেন–এই দেব শঙ্কর লীলাচ্ছলে জীব নিয়ে খেলা করছেন। একমাত্র জ্যোতি রূপ প্রকাশমান। ইনি বীজি, আপনি বীজ, আমি সনাতন যোনি। ব্রহ্ম এর অর্থ জানতে চাইলেন। বিষ্ণু বললেন–ইনি মহেশ্বর, এর থেকে মহত্তম বস্তু আর কিছু নেই। মহেশ্বর পূর্বে একলিঙ্গ আদিস্বর্গীয় বীজরূপে বিভাত।

সেই বীজ আমার স্বরূপ যোনিতে সমাযুক্ত হয়েছিল। কালক্রমে তা থেকে একটি সোনার অণ্ড প্রাদুর্ভূত হয়। দশশত বছর জলের মধ্যে এই অণ্ড থাকে। পরে বায়ু দ্বারা দ্বিধাবিভক্ত হয়। এর এক অর্ধে স্বর্গ, অন্য অর্ধে ক্ষিতির উৎপত্তি ঘটে। অণ্ডের সোনার আবরণটি সুমেরু রূপে প্রকাশ হয়। তারপর তা থেকে হিরণ্যগর্ভ আপনি, আমি চতুর্ভুজ বিষ্ণু–আবির্ভূত হই। আপনি দ্বিধাবিভক্ত অণ্ডকে শূন্য স্বরূপে অবলোকন করে ‘এটি কি’–এই চিন্তায় নিবিষ্ট হলেন। আপনার কয়েকজন কুমার প্রাদুর্ভুত হল। তার মধ্যে শ্রীমান সনকুমার ও ঋভু- এরা ঊর্ধরেতাঃ। এছাড়া সনাতন, সনক, সনন্দন, এরাও একই সময়ে উৎপন্ন হয়। এরা উৎপন্ন হয়েই আত্মজ্ঞ হয়ে বলেন– আমরা কাজ শুরু করব না।

তিন তাপ থেকে মুক্ত থাকব। জীবনে অল্পই সুখ আছে, কিন্তু তা দুঃখ-কষ্টময়, জরা ও শোকপূর্ণ, মৃত্যু পুনর্জন্ম বড়ই দুঃখাবহ। স্বর্গসুখ স্বপ্নের মতো, নরকভোগই অনিবার্য, এইভাবে ঐ আত্মভারা ভবিতব্য জেনে থাকেন। ঋভু ও সনৎকুমার আপনার বশীভূত দেখে অন্য তিনজন নিবৃত্তমার্গ আশ্রয় করেন। তখন তুমি শঙ্করের মায়ায় মোহিত থাকেন। এভাবে কল্পে কল্পে আপনি সংজ্ঞা লোপ পায়। এ জগতে এটাই ঐশ্বরী মায়া বলে অভিহিত। আপনার আত্মা দিয়ে আত্মাকে দেখো জানো এবং আমি অম্বুজাক্ষ, আমাকে এবং মহাযোগী মহাদেবকে জানো। ইনি যদি তোমার আমার ওপর ক্রুদ্ধ হন নিশ্বাসেই আমাদের দগ্ধ করবেন।

আসুন, আগে ভূতপতিকে স্তব করি। সূত নির্বিশেষে পূজ্য, উপজীব্য, সত্যাসত্য, আপনাকে আমার নমস্কার। আপনি পিনাকী, প্রসিদ্ধ, স্ফীত, সুমেধা, অক্ষমালা, কৃতান্ত, প্রণব, মৃগব্যাধ, দক্ষযজ্ঞহর, ক্ষান্ত শান্ত, সর্বভূত–আপনাকে নমস্কার। আপনি জটী দণ্ডী বাদ্যনৃত্যপ্রিয় বিভীষণ, ভীম, নর্তনকারী, মুদ্রা মণিধর, স্তোক, তনু, গম্য ও গমন আপনাকে আমার নমস্কার। এই লোক ধাত্রী, পৃথিবী আপনার সজ্জন সেবিত পদযুগল। নিখিল সিদ্ধ যোগীদের অধিষ্ঠান আপনার উদরে। তারা বিভূষিত অন্তরীক্ষ আপনার মধ্যদেশ।

তারা দল আপনার বক্ষস্থলে হারের মতো শোভা পাচ্ছে। দশ দিক আপনার দশ ভূজ স্বরূপ বিস্তীর্ণ, আকাশ আপনার হেমসূত্র কণ্ঠদেশ, পদ্মমালা শোভিত আপনার উষ্ণীষ। সূর্যমণ্ডলে দীপ্তি, চন্দ্রে বপু, পৃথিবীতে স্থৈর্য, অনিলে বল, অগ্নিতে তীক্ষ্ণতা, চন্দ্রে প্রভা, আকাশে শব্দ ও জলে শৈত্য রূপে আপনাকেই কীর্তন করি, হে দেব, আপনি জপ্য আপনিই মহাদেব মহেশ্বর, সুরেশ্বর, গৃহবাসী, খেচর, তপোনিধি, বিধাতা, ধনঞ্জয়, ছত্রী, পতাকী, পঙ্খী, পরভৃত, শূর। আপনাকে প্রসাদিত করে আমরা রনে শত্রু নিধন করেছিলাম। আপনি অগ্নিরূপে সমস্ত সাগর পান করেও তৃপ্ত হননি। হে মহাদেব, আপনি প্রীত হলে আমরা খুশী। আপনি ঈশ, অনাদি, তেজোরাশি, আপনি লোককর্তা, সাংখ্যা যোগীরা আপনাকে প্রকৃতি থেকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে। তাই মৃত্যুমুখে পতিত হন না। যোগীরা যোগবলে আপনাকে জানতে পেরে ভোগগুলি ত্যাগ করেন। যেসব মর্তে আপনার সাক্ষাত লাভ করে বিশুদ্ধ হয়েছে, তারা ইহলোকে দিব্য ভোগ করে। আপনি যেখানেই থাকুন; আমার স্তবে তুষ্ট হন, মঙ্গল বিধান করুন। আপনার তত্ত্ব জানা সাধ্যের অতীত।

.

ষড়বিংশ অধ্যায়

সূত বলতে লাগলেন–উমাপতি, দক্ষযজ্ঞ সংহারকারী, পিনাক পাণি, ত্রিলোচন, পিঙ্গল আয়তচোখে দৃষ্টিপাত করে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে পান করতে উদ্যত হচ্ছিলেন। কিন্তু নিজের স্তুতি শুনে তার বদন প্রসন্ন হল। দেবাদিদেব এঁদের স্বরূপ জানতে পেরেও জিজ্ঞাসা করলেন–কে তোমরা? পুণ্ডরীকাক্ষ মহাপুরুষ পরস্পরের জন্যে এই ভীষণ প্লাবনেও এক হয়ে রয়েছো? দুই মহাত্মা বললেন–একথার কি প্রয়োজন? আপনি ছাড়া আর কোথায় অনন্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আছে? তখন মহাদেব মধুর স্বরে বললেন–ওহে হিরণ্যগর্ভে, আপনাকে এবং ওহে কৃষ্ণ, আপনাকেও বলছি–আপনাদের সত্য বাক্য শুনে এবং ভক্তিতে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। আপনারা দুজন আমারও মাননীয় ও পূজনীয়। কোন্ বর চান বলুন? ব্রহ্মা বললেন–আমি একজন যোগ্য পুত্র চাই। বিষ্ণু একথা শুনে বললেন–আপনি সুযোগ্য বীরপুত্র ইচ্ছে করছেন। আমার মতে এই মহেশ্বরকেই পুত্ররূপে প্রার্থনা করুন। পিতামহ তখন বিষ্ণুর সাথে একযোগে পুত্র কামনায় হাতজোড় করে বললেন–হে ভগবান! আমার প্রতি যদি আপনি প্রীত ।হয়ে থাকেন তাহলে আমার সুযোগ্য পুত্ররূপে প্রতিভাত হন। ব্রহ্মার সেই প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে মহেশ্বর বললেন–আপনার যখন ক্ৰোধ জন্মাবে, তখন তখন আমি একাদশ রুদ্র হয়ে শূলপাণি রূপে আপনার ললাট থেকে প্রাদুর্ভূত হব। বিষ্ণুকে বললেন–আমি আপনাকে বর দেব।

বিষ্ণু একথা শুনে বললেন–আপনি আমার প্রতি তুষ্ট হন, আপনার প্রতি আমার ভক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হোক, এই আমার প্রার্থনা। মহাদেব তাকে বললেন–শুনুন, আমি যেরূপে আপনার প্রতি প্রীত হয়েছি, এই ব্যক্ত-অব্যক্ত স্থাবর জঙ্গম যা কিছু পরিদৃশ্যমান হয় এসবই রুদ্র-নারায়ণত্মক। আমি অগ্নি, আপনি সোম, আপনি রাত্রি আমি দিন, আপনি ঋত, আমি সত্য, আপনি ক্রতু, আমি ফল, আপনি জ্ঞান, আমি জ্ঞেয়, এই জ্ঞেয় বস্তুর জপ করেই যোগীরা আমাতে প্রবেশ করে। আমরা দুজনে মিলিত গতি ছাড়া যুগয়ে অন্য গতি নেই। আপনি আপনার আত্মাকে প্রকৃতি এবং আমি শিব আমাকে পুরুষ বলেই জানবেন। আপনি আমার অধদেহ। আমিও আপনার তাই। আমি আপনার শ্যামল দক্ষিণদিক। তাই আমি নীললোহিত। হে বিষ্ণু, আপনি আমার হৃদয়। আর আমি আপনার হৃদয়ে অবস্থিত।

আপনি সমস্ত কাজের কর্তা আর আমি তার অধিদেবতা। এখন আপনার মঙ্গল হোক। আমি চললাম। এই বলে মহাদেব অন্তর্হিত হলেন। তিনি চলে যাবার পর শ্রীহরি আনন্দিত মনে আবার জলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নিজের অনন্ত শয্যার শয়ন করলেন। ব্রহ্মাও হৃষ্টমনে পদ্মগর্ভে আশ্রয় নিলেন। তারপর বহুকাল কেটে গেল। মধু ও কৈটভ নামে মহাবল মহাবীর্য দুই ভাই নির্ভয়ে হাসতে হাসতে পদ্মকে কাঁপিয়ে তুলল ও পদ্মগুলি ভেঙে ফেলল। ব্রহ্মাকে ভক্ষণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করল। এইভাবে তারা সেখানে লুকিয়ে রইল। পদ্মযোনি ব্রহ্মা তাদের পরিচয় জানার জন্য উৎসুক হলেন। মধু কৈটভের গতিবিধি বুঝতে পারলেন না। রসাতলে গিয়ে বিষ্ণুর নিদ্রাভঙ্গ করে বললেন–আপনি আমাকে রক্ষা করুন। ভগবান বিষ্ণু হেসে বললেন–সেই দুই দৈত্যকে তুমিই নাশ করবে, ভয় নেই।

তারপর ত্রিলোক সেই অযোনিজ সমাসীন ব্রহ্মদেবকে প্রদক্ষিণ করে তাতে প্রবেশ করল। তিনি অন্তর্ধান করলেন। এই সময় অনন্ত তার মুখ থেকে বিষ্ণু ও হিষ্ণু দুই ভাই উৎপাদন করে বললেন– তোমরা দুজনে ব্রহ্মাকে মধু কৈটভের হাত থেকে রক্ষা কর। তখন একদিকে মধু ও কৈটভ এবং অন্যদিকে বিষ্ণু ও জিষ্ণু স্বরূপ ধারণ করে ব্রহ্মাকে বলল– আমরা যুদ্ধ করব। আপনি আমাদের মধ্যে মধ্যস্থর কাজ করুন। তারপর তারা জলে প্রবেশ করে তুমুল যুদ্ধ করতে লাগলো। একশত বৎসর কেটে গেল, কিন্তু কেউ যুদ্ধ থামালো না।

ব্রহ্মা ব্যাকুল মনে ধ্যানস্থ হলেন। ধ্যানে দিব্য নেত্রে তাদের পার্থক্য বুঝতে পারলেন না। তিনি দৈত্য দুজনের নাভির ঊর্ধ্ব দিকে এক সূক্ষ্ম কবচ বন্ধন করলেন। তারপর মন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন। বিশ্বরূপী ব্রহ্ম জপ সাধনায় নিমগ্ন হলে তার মাথা থেকে এক পদ্ম ও ইন্দু বদনা প্রিয়দর্শনা কন্যার আবির্ভাব হয়। তাকে দেখে এই দৈত্য ভাইরা ভয়ে বিবর্ণ হল; না মধুর বাক্যে সেই কন্যাকে সম্বোধন করে বললেন–তোমাকে আমি কোন নামেন্ িজানব? তখন সেই কন্যা হাতজোড় করে বললেন–আমাকে আপনি বিষ্ণু আজ্ঞাকারিণী মোহিনী মায়া বলেই জানবেন। আপনার সংকীর্তনে আজ আমি তাড়াতাড়ি এসেছি। ব্রহ্মা বললেন–তুমি যখন এসে উপস্থিত হয়েছে, তখন তুমি মহাব্যাহৃতি নাম প্রখ্যাত হবে। তুমি আমার শিরোভেদ করে উঠেছে। তাই সাবিত্রী নামও হল। তুমি অনেকাংশে এজন্য তোমার নাম একানাংশা। এগুলি তোমার গঠন নাম। তুমি অন্য অনেক নামে প্রসিদ্ধ হবে। এদিকে দুই দৈত্য যুদ্ধ করে আহত হল, বিষ্ণুর কাছে বর প্রার্থনা করল। যেন অনাবৃত স্থানে তাদের মৃত্যু হয়। বিষ্ণু তাড়াতাড়ি কৈটভকে যমের কাছে পাঠালেন এবং জিষ্ণু মধুকে নিহত করলেন, ব্রহ্মা খুশী হলেন।

ঈশ্বর যেরূপ পুত্ররূপে আত্মদান করেন, তা শুনুন। বিষ্ণু ও জিষ্ণুর সঙ্গে মধু কৈটভের যুদ্ধের মাপণের পর ব্রহ্মা বিষ্ণুকে বললেন–আজ শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। এবার সময় উপস্থিত, আপনি এই ঘোরকল্প সংহার করে নিন। আমি স্বস্থানে প্রস্থান করি। প্রভু বিষ্ণুও ব্রহ্মার কথার কল্প সংহার করলেন। ব্রহ্মা আবার বললেন–হে গোবিন্দ, আপনার মঙ্গল হোক, আপনি জলধিকে আলোড়িত করেছেন এবার আমার দ্বারা আপনার যদি কিছু করণীয় থাকে তবে তা আমায় প্রকাশ করে বলুন। বিষ্ণু বললেন–হে পদ্ম যোনি। বাস্তবিকই আমার কথা শুনুন। আপনি পুত্র কামনায় ঈশ্বরের কাছ থেকে যে প্রসাদ লাভ করেছেন, তা সফল করে আমার কাছে অঋণী হন। আপনি চার রকম ভূতবৃদ্ধকে সৃজন ও বিসর্জন করুন। সূত বললেন, পদ্মযোনি পিতামহ ব্রহ্মা গোবিন্দের কথায় সংজ্ঞা লাভ করে প্রজা সৃষ্টি কামনায় কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন হলেন। এরূপ তপস্যায় তার কোন কার্যসিদ্ধি হল না।

বহুকাল পরে অতি দুঃখে তাঁর ক্রোধ জন্মাল। তার রোষ নেত্র থেকে অনেক অশ্রুবিন্দু পড়ল। সেই সব অশ্রু বিন্দু থেকে বাত, পিত্ত, কফাত্মক মহা ফণাশালী, স্বস্তিকাদি, প্রকীর্ণকেশ, বিষধর সাপ প্রাদুর্ভূত হল। ব্রহ্মা নিজের নিন্দা করলেন। বললেন–তপস্যার ফল এই হলে আমি তপস্যাকে ধিক্কার দিই। এরকম বলতে বলতে তিনি ক্রোধে মুচ্ছা গেলেন সেই মূচ্ছার আঘাতে তার দেহত্যাগ ঘটল। তখন ব্রহ্মার দেহ থেকে সকরুণ ভাবে কাঁদতে কাঁদতে একাদশ রুদ্র প্রাদুর্ভুত হলেন। রোদন করতে করতে এলেন বলে তার নাম রুদ্র নামে খ্যাত হলেন। এই রুদ্রগণই দেহীদের হৃদয়ে প্রাণরূপে রয়েছে। নীললোহিত ত্রিশূলী আবার ব্রহ্মার প্রাণদান করলেন। এভাবেই প্রভু রুদ্র আগে ব্রহ্মায় প্রাণদান করেন, পরে তার আত্মজ হন। তারপর রুদ্র ব্রহ্মাকে এই পরমবাক্য বললেন–যে–হে ব্রাহ্মণ! আত্মাকে স্মরণ কর। আমাকে পুত্ররূপে প্রার্থনা করো। জানবে আমিই তোমার আত্মজ রুদ্র।

–হে প্রভো! আমার প্রতি প্রসন্নতা প্রকাশ করো পিতামহ রুদ্রের মুখে তার সেই মনোমত বাক্য শুনে প্রসন্ন হলেন। তার চোখ আনন্দে অম্বুজের মত প্রতিভাত হল। তারপর প্রাণপ্রাপ্ত শুদ্ধ স্বর্ণকান্তি ব্রহ্ম, স্নিগ্ধ গম্ভীর বাক্যে বললেন–“ওহে মহাভাগ। কে তুমি বিশ্ব জুড়ে একদশাত্মক রুদ্ররূপে অবস্থান করে আমার মনে আনন্দ উৎপাদন করছে। আমায় প্রকাশ করে বল। রুদ্র আত্মজ সাথে এক যোগে তাকে অভিবাদন করে প্রত্যুত্তরে বললেন–হে ব্রাহ্মণ। বিষ্ণুর সাথে একযোগে আমার কাছে বর চেয়েছিলে যে, হে দেব তুমি আমার পুত্র হও অথবা তোমার তুল্য কোন সুযোগ্য পুত্র আমার হোক। হে দেবেশ, তুমি সে বর পেয়েছে, এখন বিষাদ পরিত্যাগ কর, লোক সৃষ্টির ব্যাপারে প্রবৃত্ত হও।

ভগবান ব্রহ্মা খুশী হয়ে নীললোহিত রুদ্রকে বললেন–আপনি আমায় সাহায্য করুন। আমার সাথে প্রজাসৃষ্টি করুন। আপনি সর্বভূতের বীজ। তাই আপনার সাহায্য চাই। শঙ্কর ব্রহ্মার প্রস্তাব স্বীকার করে নিলেন, তারপর ক্রমশঃ ভগবান ব্রহ্মা প্রথমে মনকে সৃজন করলেন, পরে ভূতসমূহের ধারণা ও সরস্বতী উৎপাদন করলেন। তারপর ভৃগু, অঙ্গীরা-দক্ষ, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও বশিষ্ঠ এই সাত মানসপুত্রকে সৃষ্টি করলেন। তারপর ওঙ্কার প্রভৃতি দেবগণ ও অভিমানিনী দেবতাগণ আর্বিভূত হলেন। এভাবে সৃষ্টির বিস্তার হলে, ব্রহ্মা দক্ষ প্রভৃতি মানস পুত্রদের বললেন–হে পুত্রগণ! তোমরা ধীমান রুদ্রের সাথে একযোগে প্রজা সৃষ্টি কর। তখন প্রজাপতিরা রুদ্রের অনুগামী হয়ে বললেন–হে দেব। আমরা আপনার সাথে প্রজা সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করি। হে মহেশ্বর, আপনার প্রতি ব্রহ্মার এটাই বার্তা।

প্রজাপতিদের একথায় ভগবান রুদ্র তাদেরকে বললেন–হে ব্ৰহ্মনন্দন! আপনাদের যিনি অগ্রজ, তিনি আমার কাছ থেকে প্রাণ সকল গ্রহণ করে, ব্রহ্মর শ্রেষ্ঠ পুত্রদের সাথে নিয়ে ব্রহ্মাদি স্তম্ভ পর্যন্ত সপ্তলোক সৃজন করুন। আমার আদেশ আপনারা সকলেই সৃষ্টি কাজে নিযুক্ত হন। আপনাদের মঙ্গল হোক। প্রজাপতিরা বললেন–যেমন আজ্ঞা করলেন তাই হবে। মহাত্মা দক্ষ প্রজাপতিগণকে বললেন–আপনি আমাদের শ্রেষ্ঠ প্রজাপতি। আপনাকে অগ্রবর্তী করে আমরা প্রজা সৃষ্টি করতে ইচ্ছে করি। আপনার মঙ্গল হোক। দক্ষ প্রজাপতি সেই কথায় তাই হোক’ বলে অনুমোদন করলেন। তারপর প্রজা কামনায় একযোগে প্রজাসৃষ্টি করতে লাগলেন। তাতে অতীত সপ্তম কল্পে ঋভু ও সনৎকুমার উৎপন্ন হন।

.

সপ্তবিংশ অধ্যায়

সূত বললেন–হে মহাভাগ! আপনি লোকহিতের জন্য যে সব আশ্চর্য গোপনীয় বিষয় আমাদের কাছে। যথাযথ বলেছেন, তার মধ্যে শূলীর অবতার বিষয়ে আমাদের সংশয় আছে। কিজন্যে তিনি পূর্বযুগ পরিত্যাগ করে কলিকালে অবতীর্ণ হলেন? ইহলোক বা পরলোক কিছুই আপনার অজানা নয়, তাই জানতে চাইছি। যদি আমাদের শোনাবার মত হয়, তবেই ভক্ত জনের উপদেশের জন্য প্রকাশ করুন। লোমশ বললেন–মহাতেজ ভগবান বায়ুকে একথা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন–তুমি যা প্রশ্ন করলে তা খুবই গোপনীয়। আমি ক্রমশঃ বলছি, শোন। পূর্বে জগৎ দিব্য হাজার বছর ধরে জলের অভ্যন্তরে ছিল। প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তিত হলেন। তখন এক দিব্যগন্ধী যুধাপেক্ষী কুমার শ্রুতি উচ্চারণ করতে করতে তার সামনে এলেন। তিনি ঐ স্পর্শরূপা গন্ধ রস জর্জিতা শ্রুতি উচ্চারণ করলে ভগবান চতুর্মুখ তা লাভ করলেন। সে সময় তিনি বললেন–এই পুরুষ কে?

এই চিন্তার ফলে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রহিত, রস, গন্ধ বর্জিত অক্ষর প্রাদুর্ভূত হল। তারপর ভগবান ব্রহ্মা সেই অনুত্তম অক্ষয় ও স্বীয় মূর্তি নিরীক্ষণ করলেন। ধ্যানাবস্থায় বার বার দেখলেন। ঐ দেবস্বরূপ অক্ষয় শ্বেত, কৃষ্ণ, রক্ত ও পীত বৰ্ণস্থ এবং তা অস্ত্রী ও অনপুংসক ভাবে বিভাত। এভাবে তিনি অক্ষরের সমস্ত স্বরূপ জেনে চিন্তাপরায়ণ হলে তার কণ্ঠদেশ থেকে আবার এক মহাঘোষ শ্বেতবর্ণ ও সুনির্মল অক্ষর আবির্ভূত হল। ঐ অক্ষরই বেদ, ওঙ্কার এবং সাক্ষাৎ মহেশ্বর স্বরূপ। তারপর ভগবান স্বয়ম্ভু আবার অক্ষর বিষয়ক চিন্তা করলে এক রক্ত অক্ষর উদ্ভূত হল। ঐ রক্তাক্ষরই আদি দেবতা। ঐ অক্ষরই ঋকবেদ। ঋকের উৎপত্তি দেখে লোককৃত, ব্রহ্মায় আবার এটা কি? এরকম চিন্তা করতে থাকলেন। তখন দ্বিমাত্র অক্ষর রূপ মহেশ্বর আবির্ভূত হলেন। আবার তিনি ঐ দ্বিমাত্র অক্ষরের বিষয় চিন্তা করলে ঋকবেদ যুক্ত রক্তাক্ষরই প্রাদুর্ভূত হল। এর সংশ্লিষ্ট ঋই যজু। ব্রহ্মা আবার দ্বিমাত্র বেদ ও অক্ষর দেখে তারই বিষয়ে চিন্তা করলেন। এর ফলে ওঙ্কার আবির্ভূত হল। তিনি ওঙ্কার অক্ষরে ধ্যান করতে লাগলেন। তিনি আদিতে ওঙ্কার সৃষ্টি করেই স্বয়ম্ভু নামে প্রসিদ্ধ হন।

তার মুখ থেকে চতুর্দশ স্বর ও সেই দিব্য আদ্য অক্ষর আবির্ভূত হল। অ-কারই প্রথম স্বর। পূর্বে। চতুর্দশ স্বর থেকে মন্বন্তর অধিপতি দিব্য প্রধান চতুর্দশ মনু প্রাদুর্ভূত হন। এই রকমভাবে দ্বিতীয় মুখ থেকে আকার স্বরূপ মনুর আবির্ভাব হয়। ইনি পাণ্ডুর বর্ণ। তৃতীয় মুখ থেকে ই-কার, ইনি যজুঃ, শ্রেষ্ঠ আদিত্য স্বরূপ ইকার–প্রতাপবান সাক্ষাৎ মনু স্বরূপ। ইনি রক্তবর্ণ চতুর্থ মুখ থেকে ঈ-কার’ উৎপন্ন হয়, উকার’ তাম্রবর্ণ ও তামস মনু বলে কথিত। পঞ্চম মুখ থেকে ‘উ’ কার আবির্ভূত। এটি পীতবর্ণ ও চরিষ্ণব মনু বলে বিখ্যাত। তারপর ষষ্ঠ মুখ থেকে কপিলবর্ণ ওঙ্কার উৎপন্ন। ইনি মহাতপা বরিষ্ঠ বিজয় মনু বলে প্রসিদ্ধ। সপ্তম মুখ থেকে ‘ঋকার’ রূপ বৈবস্বত মনুর জন্ম। ইনি কৃষ্ণবর্ণ। অষ্টম মুখ থেকে ঋকারাত্মক শ্যামবর্ণ সাবর্ণির আবির্ভাব। নবম মুখ থেকে ৯ কারের জন্ম।

এটি ধূম্রবর্ণ, ধূম্র মনু নামে বিখ্যাত। দশম মুখ থেকে ‘৯৯ কারের জন্ম। এটি সারণিক মনু। একাদশ থেকে ‘এ কার’ জন্মে। এটি পিঙ্গশ বর্ণ, পিঙ্গশী মনু নামে খ্যাত, ত্রয়োদশ মুখ থেকে পঞ্চবর্ণ সমাযুক্ত উত্তম বর্ণ ও কারের’ উৎপত্তি। এটি উত্তম মনু। চতুর্দশ মুখ থেকে ‘কবুরবর্ণ’ ‘ঔ কারের জন্ম, এটি সাবৰ্ণি নামে নিরুপিত। কল্পে কল্পে মনুগণ এভাবে স্বর ও বর্ণরূপে অবস্থিত। স্বর ও বর্ণানুসারে এদের বিবরণ যথাযথভাবে জানা যায়। কল্পকালে এরা সকলেই জন্মেছে। তখন একে সদৃশ বলা হয়। এ সংসারে প্রজাদের মধ্যে সকলেই সবর্ণ ও সর্বসন্ধি অর্থাৎ একটা না একটা স কযুক্ত।

.

অষ্টবিংশ অধ্যায়

ঋষিগণ বললেন–হে সূত, আপনি এই কল্পের সাধক মুনিদের সাথে ভগবান রুদ্রের আবির্ভাব-এর কথা বললেন। সূত বললেন–আমি এবার আদি স্বর্গের উৎপত্তির বিবরণ সংক্ষেপে বলছি। অষ্টম কল্পে ভগবান পার্বতীপতি নিজের পত্নীসমূহের গর্ভে বহুপুত্র উৎপাদন করেন। প্রভু স্বয়ম্ভ কল্পাদিকালে আত্মতুল্য পুত্র কামনা করে ধ্যানস্থ হলে, নীললোহিত নামে এক কুমার আবির্ভূত হন। তাকে হঠাৎ কাঁদতে দেখে ব্রহ্মা বললেন–কুমার তুমি কঁদছ কেন? তখন কুমার বলল–হে পিতা, আপনি আমাকে প্রথম নাম প্রদান করুন। তখন স্বয়ম্ভ কুমারকে বললেন–হে দেব, তোমার প্রথম নাম হল রুদ্র। আবার কুমার কাঁদতে থাকলে, ব্রহ্মা আবার জিজ্ঞাসা করলেন –কাঁদছ কিজন্য?

কুমার বলল–আমায় দ্বিতীয় নাম দিন। আবার পিতামহ বললেন–তোমার দ্বিতীয় নাম হবে ভব। এভাবে কুমার কাঁদতে কাঁদতে আটবার নিজের জন্য নাম প্রার্থনা করলেন। এবং যথাক্রমে রুদ্র, ভব, শৰ্য, পশুপতি, ঈশ, ভীম, উগ্র ও মহাদেব–এই আটটি নাম প্রাপ্ত হলেন। নীললোহিত পিতামহের কাছে এইসব নাম পেয়ে বললেন–আপনি আমার সমস্ত নামের আকার মূর্তি নিরুপণ করে দিন। তখন স্বয়ম্ভু তার সূর্য, মহী, জল, বহ্নি, বায়ু, আকাশ, দীক্ষিত ও চন্দ্র–এই আট নামের আটটি মূর্তি সৃষ্টি করলেন। এই মূর্তি সকল ব্রহ্মধাতু। এইসব মূর্তিতে রুদ্রদেব পূজিত হলে তিনি পূজকদের আর হিংসা করেন না। তারপর ভগবান ব্রহ্মাদেব নীললোহিতকে বললেন–আমি যে তোমার ‘ভব’ এই দ্বিতীয় নাম প্রদান করেছি, জল–এই ভব দেবের তনু হবে। তোমার ভবমূর্তির অপর নাম হবে–জল। এই কথা বলে তার দেহস্থ রসাত্মক যে জল ছিল তাতে প্রবেশ করলেন। জলও ভবের মূর্তি হল।

জলকে নিখিল ভূতসম্ভব বলে। সমুদ্র জলের উৎপত্তি স্থান জলরাশি সমুদ্রকে কামনা করে। তাই জলের গতিরোধ করা কাম্য নয়। ভগবান বললেন–হে নীললোহিত, আপনাকে শর্ব এই তৃতীয় নাম দিয়েছি। ভগবতী এই নামের তনু। নীললোহিতকে ব্রহ্মা বললেন–আমি ঈশান এই চতুর্থ নাম তোমায় প্রদান করছি। বায়ু এই নামের তনু। তাই শরীরস্থ পঞ্চধা বিভক্ত যে প্রাণবায়ু, তাতে বায়ু প্রবেশ করে তা ঈশান বলে কীর্তিত। যে ব্যক্তি বায়ুর স্তুতি করে, ঈশান তাকে হিংসা করে না। ব্রহ্মা বললেন–হে নীললোহিত, আপনাকে পশুপতি এই পঞ্চম নাম দেওয়া হয়েছে। ঐ নামের তনু অগ্নি। তখন ঐ অগ্নি পশুপতি হলেন। চন্দ্রমা সোম নামে প্রসিদ্ধ। ওষধিরা তার আত্মা। এই কারণে মহেশের বন্দনা করা উচিত। আদিত্য দিবা ভাগে চন্দ্রমা রাত্রিভাগে প্রজাপালন করে থাকেন।

সূর্য ও চন্দ্রমা একসাথে রাত্রিতে থাকেন তখন অমাবস্যা বলে। অমাবস্যা তিথিতে পরমযোগী নীললোহিত বাস করেন। লোকেরা সূর্য প্রকাশ চোখে দেখতে পায়। শুক্লাত্ম রূপে রুদ্র সূর্যমধ্যে থেকে কিরণ দিয়ে জলশোষণ করেন। ভগবান দেবদেব যে তনু দিয়ে প্রজা ধারণ করেন তাই তার সার্বী, পৃথিবী তনু। আর যে তনু প্রাণবৃত্তি ভূতদের শরীরে অবস্থান করে, তাই তার বায়ুবাত্মিক ঈশানী তনু। যে মূর্তি জীবদের জঠরে পীত ও ভুক্ত দ্রব্য পাক করে থাকে, তাই তার পাচিকা শক্তিরূপিণী পাশুপতী মূর্তি। বৈতানদীক্ষিত ব্রহ্মবাদী যে বৃত্তি তাই তার পাচিকা শক্তিরূপিণী পাশুপতী মূর্তি ভগবান দেবদেবের যে সঙ্কল্প নিখিল প্রজায় সমভাবে বর্তমান। ঐ সঙ্কল্প তার প্রাণিস্থিত সোমরূপিণী মানসী তনু। ঐ অমৃতময় তনুই দেব ও পিতৃগণ কর্তৃক যথেচ্ছ নীত হয়, ভগবান মহাদেবই জলমা চন্দ্রমা। তার প্রথমা রৌদ্রী তনুর পত্নী সুবর্বলা। সুবর্বলার পুত্র শনেশ্বর। তার ‘ভব’ নামের দ্বিতীয় তনু জল, জলের পত্নী ঊষা, ঊষার পুত্র উশনা। মহাদেবের শর্ব নামের মূর্তি ভূমি, এই মহাদেবের পত্নী শিবা। শিবার পুত্র মনোজব। পাশুপতী মূর্তি অগ্নিপতি স্বাহা। স্বাহার পুত্র স্কন্দ।

তার ভীম এই নামের তনু আকাশ। আকাশের পত্নী দিকপুঞ্জ আর তার পুত্র স্বর্গ। তার ‘উগ্র’ নামের তনু দীক্ষিত অর্থাৎ যজমান। যজমানরূপী মহাদেবের পত্নী দীক্ষা আর তার সন্তান পুত্র। অষ্টম নামের তনু চন্দ্রমা, চন্দ্রমার পত্নী রোহিণী, তার পুত্র বুধ। ভগবান মহাদেবের এই আট প্রকার তনু সম্পর্কে বলা হল। যেসব মানব সূর্য, অপ, পৃথিবী, বায়ু, অগ্নি, ব্যোম, দীক্ষিত ও চন্দ্রমা–এইসব হর তনুতে ভক্তি স্থাপন করে, তারা নিশ্চয়ই প্রজাবান হয় ও হর সাযুজ্য লাভ করে। এই আমি আপনাদের কাছে গুহ্য, যশস্য, হরতত্ত্ব বললাম। এর ফলে সমস্ত দ্বিপদ ও চতুষ্পদের মঙ্গল হোক। এই আমি দেব মহাদেবের তনু ও নামের বর্ণনা করলাম।

.

ঊনত্রিংশ অধ্যায়

সূত বললেন–ভৃগু থেকে খ্যাতির গর্ভে সুখ, দুঃখের প্রভু, প্রাণীমাত্রের শুভাশুভ, ধাতা ও বিধাতা নামে দুই দেবতা জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীদেবী এদের বড় বোন। ইনি নারায়ণকে বিবাহ করেন। এই রমণীর গর্ভে নারায়ণের বল ও উৎসাহ নামে দুই পুত্র উৎপন্ন হয়। যারা স্বর্গচারী ও যাঁরা পুণ্যকর্মা ও দেবগণের বিমান বহনকারী, তারা সকলেই ঐ দেবীর মানসপুত্র। ধাতা ও বিধাতার স্ত্রী আয়তি ও নিয়তি। তাদের পুত্ররা হলেন পাভূ ও মৃকণ্ডু। মূকণ্ডু থেকে মনস্বিনীর গর্ভে মার্কণ্ডেয় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুত্র বেদশিরা, বেদশিরা মূৰ্দান্যার গর্ভে মার্কণ্ডেয় থেকে জন্ম নেন। পীবরীর গর্ভে তার বহু বংশধর জন্মে। তাঁরা সকলেই মার্কণ্ডেয় নামে পরিচিত। পুণ্ডরীকার গর্ভে পাণ্ডুর দ্যুতিমান, দ্যুতিমন্ত ও সৃজবান নামে তিনপুত্র জন্মগ্রহণ করেন। মনুর অধিকার কাল অতীত হলে ভগবান মরীচীর থেকে পূর্ণ মাস নামে একপুত্র ও কয়েকটি কন্যা প্রসব করেন, তাদের বিবরণ শুনুন।

ঐ কন্যাদের নাম কুষ্টি, পুষ্টি, ত্বিষা ও অপচিতি। পূর্ণবাস সরস্বতীর গর্ভে দুই পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। দুই পুত্রদের নাম বিরজ ও পর্যস। বিরজের পুত্র সুধামা। তার পুত্র ধার্মিক প্রতাপী বৈরাজ। পর্যম গৌরীর পুত্র। ইনি সুধার্মিক প্রতাপবান, লোকপাল হয়ে প্রমথদেব অন্যতম স্থান নিয়েছিলেন। পর্যম, পর্বসার গর্ভে দুই পুত্র যজ্ঞবাস ও কশ্যকা, অঙ্গীরার পত্নী স্মৃতি। স্মৃতির গর্ভে দুই পুত্র ও চারকন্যা জন্মে। এরা হলেন–সিনীবালী, কুহু, রাকা ও অনুমতি। আর ভরতাগ্নি ও কীর্তিমন্ত, এই দুজন পুত্র। অগ্নি থেকে প্রভু পর্জন্যকে প্রসব করেন। পর্জন্য মরীচীর গর্ভে একপুত্র উৎপাদন করেন। ধেনুকা ও কীর্তিমান থেকে বরিষ্ট ও ধৃতিমন্ত নামে দুই পুত্র জন্ম দেন। এঁদের আবার হাজার হাজার পুত্র পৌত্র অতীত হয়েছেন।

তাদের মধ্যে অনুসূয়া অত্রি থেকে পাঁচটি নিষ্পাপ পুত্র কন্যা প্রসব করেছিলেন। ঐ কন্যার নাম শ্রুতি। তিনি শঙ্খপদের মা ও কর্ম ঋষির পত্নী। অনসূয়া যে পাঁচটি পুত্র প্রসব করেন তাদের নাম– সত্যনেত্র, হব্যা, তপোমূর্তি, শনৈশ্বর ও সোম। পুলস্ত্য থেকে প্রীতির গর্ভে দত্তালি জন্মগ্রহণ করেন। ইনিই পূর্বজন্মে মনুর অধিকারে অগস্ত্য ছিলেন। পুলস্ত্যের মধ্যমপুত্র দেববাহু ও কনিষ্ঠ বিনীত, এদের ভগ্নী নাম সদ্বতী। পর্জন্য জননী শুভ্রা অগ্নির পত্নী, পৌলস্ত্য ঋষির জ্যেষ্ঠপুত্র ধীমান দত্তালি থেকে তার পত্নী সুজঙঘ প্রভৃতি বহু পুত্র প্রসব করেন। পুলহের পত্নী স্বাহা। তাদের অগ্নিতুল্য প্রখ্যাত পুত্রেরা হল– কর্দম, অম্বরীষ, সহিষ্ণু প্রভৃতি। এদের ভগ্নী হল পীবরী। কর্দমের পত্নী অত্ৰিনন্দিনী শ্রুতি শঙ্খপদ নামে এক পুত্র ও কাম্যা নামে এক কন্যা প্রসব করেন। শঙ্খপদ রাজা প্রিয়ব্রতের হাতে কন্যাকে দান করে দক্ষিণ দিকে বাস করেছিলেন। কাম্যা প্রিয়ব্রত থেকে দশটি পুত্র, দুটি কন্যা প্রসব করেন। এই পুত্রদের থেকেই ক্ষত্ৰকুল বর্ধিত হয়। ধনকপীবান সহিষ্ণু নামে বিখ্যাত, এর কামদেব নামে পুত্র হয়। ক্রতুর শুভ বংশবিস্তৃতি ঘটে। এদের স্ত্রী, পুত্র ছিল না। এরা উর্বরে। এরা সংখ্যায় ষাট হাজার। প্রলয় কাল পর্যন্ত এরা সূর্যের সাহচর্য করে থাকেন। এদের দু-বোনের নাম পুণ্যা ও আত্মযুমতী। এরা শর্বস-এর পুত্রবধূ। বশিষ্ঠের সাতপুত্র হয়। এদের এক বোনের নাম পুণ্ডরীকা। ইনি দ্যুতিমান-এর মা, পাণ্ডুর স্ত্রী। এর গর্ভের সাত বশিষ্ঠের জন্ম। এরা হল–রজ, পুত্র, অর্ধবাহ, সবন, অধন, সুতপা ও শুক্ল–এরাই সপ্তর্ষি।

.

ত্রিংশ অধ্যায়

মনুর অধিকারে অভিমানী হয়ে অগ্নি ব্রহ্মার মানস পুত্র রূপে উৎপন্ন হয়েছিলেন। তার থেকেই স্বাহা তিন পুত্রের জন্ম দেন। ঐ পুত্রদের নাম পাবক, পবমান, শুচি। শুচি অগ্নি সৌর বলে বিখ্যাত। পবমানের আত্মজ-কব্যবাহন পাবক থেকে মহরক্ষ এবং শুচি থেকে হব্যবাহন জন্ম নেয়। হব্যবাহন দেবতাদের কব্যবাহন, পিতৃদেবের এবং মহরক্ষ অসুরদের অগ্নি বলে বিখ্যাত। এদের পুত্র পৌত্রাদি সংখ্যায় উনপঞ্চাশ। প্রথমতঃ ব্রহ্মার সন্তান লৌকিকাগ্নি বৈদ্যুত, তাঁর পুত্র ব্রহ্মো দনাগ্নি, তাঁর পুত্র ভরত। পুষ্কারোদধি মন্থন অমৃতোৎপত্তির পর অথবর্ণ অগ্নির উৎপত্তি। এই অথবর্ণ লৌকিকাগ্নির পুত্র দধ্যঙ্গ। অর্থ ভৃগু বলে বিদিত। এর পুত্র অঙ্গীরা, অঙ্গীরা থেকেই অথর্বার পুত্র দধ্যঙ্গ লৌকিকাগ্নি বলে অভিহিত। পবমান নামক অগ্নি কবিদের দ্বারা নিমর্থ্য। এই অগ্নি গাৰ্হপত্য নামে পরিচিত। এর দুই পুত্র। তার মধ্যে একের নাম শ্যস্য। ইনিই হব্যবাহন নামে পরিচিত। দ্বিতীয়ের নাম শুক্রাগ্নি শংস্যের দুই পুত্র–নাম সত্য ও আবসখ্য। দ্বিজগণ যে হব্যবাহনকে অগ্নি বলে জানেন, তিনিই বিখ্যাত ষোড়শ নদীকে কামনা করেন। ঐ নদীসকলের নাম–কাবেরী, কৃষ্ণাবনী, নর্মদা, যমুনা, গোদাবরী, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী, বিপাশা, কৌশিকী, শতদ্রু, সরফু, সীতা, সরস্বতী, হ্লাদিনী ও পাবনী। এই নদীগুলিতে নিজের শরীর ষোলোভাগে ভাগ করে হব্যবাহন, সকল আধারভূত নদীতে আসক্ত হলেন। অগ্নি নিজেও ধিষ্ণু, সেই সব সাধ্বী কিষ্ঠীর গর্ভে তার থেকে অনেক পুত্র সন্তান উৎপন্ন হয়। পুত্রেরা ধিষ্ণী নামে। নিরূপিত। এই সকল নদীনন্দন অগ্নির মধ্যে যারা পুজ্য, তাদের কথা বলছি।

ঋতু, প্রবাহন, অগ্নী, অপর অপর ধিষ্ণীগণ যজ্ঞদিবসে সবন ক্রমে সামনে সন্নিবেশিত হয়ে থাকেন। সে সব অগ্নির স্থান নির্দেশ হয়নি। অগ্নির সম্রাট কৃশানু উত্তর দিকের, যজ্ঞের দ্বিতীয় বেদি তার স্থান, অগ্নি আটরকম। দ্বিজগণ এদের পূজা করে থাকেন। পর্ষৎ হল অগ্নির মধ্যে দ্বিতীয়। নভ অগ্নির চতুৰ্দ্ধা ভাবনীয়। সমুদ্ৰাগ্নি ব্রহ্মস্থানে নিহিত। অজৈকপাদ অগ্নি পূজনীয়। শংস্যসূত ও অগ্নিপাদ ব্রাহ্মণের উপাস্য। ঋতু প্রবাহন ও অগ্নীব্র এদের নিয়ে ধিষ্ণীমান যজ্ঞদিনে যথাক্রমে ক্রীড়া করে থাকেন। হব্যবাহন নামে অগ্নি পৌত্রেয় বলে বিখ্যাত। শান্তি নামে অগ্নি প্রচেতা স্বরূপ। সত্য নামক অগ্নি দ্বিতীয় স্থানের, বিশ্বদেব নামে অগ্নি বক্ষস্থানে স্থাপনীয়। অচক্ষু ও আচ্ছাবাক অগ্নি ভূমিতে স্থাপনীয় বলে বিভাবিত। পাবক নামে অগ্নিই জলরাশির গর্ভ মনে করা হয়। যে অগ্নিকে জলে আবাহন করা হয় তাই অবyথ অগ্নি। এর পুত্রের হৃদয় অগ্নি। এই অগ্নিই প্রাণীদের জঠরে বাস করেন। এই জঠর অগ্নির পুত্র মন্যমান। এই অগ্নি ভূতগণের প্রভু ও পরস্পর উচ্ছিত। মনুমানের পুত্র ঘোর সংবর্তক। এই অগ্নি সমুদ্রে বড়বা মুখে বাস করে সমুদ্রবাসী অগ্নির পুত্র সহরক্ষ, তাঁর পুত্র ক্ষাম। ইনিই মানুষের গৃহদাহ করে থাকেন। তাঁর পুত্র ক্রব্যাদি অগ্নি, এই অগ্নি শবদেহ পুড়িয়ে ফেলেন। পাঁচকাগ্নির সব পুত্রদের কথা বলা হল। এরপর শুচির পুত্রদের কথা বলা হচ্ছে। শুচির পুত্র সৌরি অগ্নি। আয়ু নামে ভগবান অগ্নি পশু শরীরে রয়েছেন। আয়ুর পুত্র মহিমান। পাকযজ্ঞে অগ্নি সবন, সবনের পুত্র অদ্ভুত, তাঁর ছেলে বিবিচি। এই বিবিচি যজ্ঞের প্রায়শ্চিত্ত হবি ভোজন করেন। এঁর পুত্র অর্ক। অর্কের পুত্রেরা হলেন অনীকবান, বাস্থজবান, সুরভি প্রভৃতি। এঁরা শুচি অগ্নির সন্তান এবং সংখ্যায় চোদ্দ। এর আগে মন্বন্তর শেষ হলে প্রথম মনুর সময় মহাত্মা যাম দেবতাদের সঙ্গে ছিলেন। এইসব অতীত অনাগত অগ্নিদের কথা আমি বললাম।