ভাগবত পুরাণ – সপ্তম স্কন্ধ
প্রথম অধ্যায়
নারদ ও যুধিষ্ঠিরের সংবাদ, জয় ও বিজয়ের দৈত্যজন্ম লাভ
পুরাণের দশটি লক্ষণের মধ্যে এই সপ্তম স্কন্ধে উতির বর্ণনা করা হয়েছে। উতি শব্দের অর্থ বাসনা। এই বাসনা জন্মান্তরীয় শুভ ও অশুভ কর্ম অনুসারে দুই প্রকার অর্থাৎ শুভ বাসনা ও অশুভ বাসনা, মহত্ব্যক্তিদের কোপে অশুভ বাসনা এবং মহতের অনুগ্রহে শুভ বাসনার উদয় হয়ে থাকে। যেমন সনকাদির কোপে বৈকুণ্ঠের দ্বারপালদ্বয় জয় ও বিজয়ের অশুভ বাসনা এবং দেবর্ষি নারদের অনুগ্রহে দানবীগর্ভস্থ প্রহ্লাদের ভগবান শ্রীনৃসিংহে সদ্ভাক্তির উদয় হয়।
আর ভক্ত প্রতিকুলাচারী হলেও শ্রীভগবান তাদের রক্ষা করেন। যেমন বৈকুণ্ঠবাসী দ্বারপালদ্বয়ের তৃতীয় জন্মে পুনরায় আত্মসাৎ করেন। অতএব মহতের অনুগ্রহ লাভের জন্য সকলেরই যত্ন করা কর্তব্য।
সপ্তম স্কন্ধের প্রথম দশটি অধ্যায়ে দৈত্য ও দৈত্যপুত্র প্রহাদের প্রতি মহতের কোপ ও অনুগ্রহ হেতু বাসনা ভেদ বর্ণিত হয়েছে। শুভ কর্ম দ্বারা বিশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তিরই সবাসনা সমুৎপন্ন হয়। অতি পর পাঁচটি অধ্যায়ে আশ্রয় ধর্মোক্ত কর্ম সকল বর্ণিত হবে।
পূর্ব স্কন্ধের শেষে ভগবান বিষ্ণুর সাহায্যে দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক পুত্র বিনষ্ট হওয়ায় দিতি পরিতাপ, করছিলেন ঘটনাবলী শ্রবণ করে মহারাজ পরীক্ষিৎ জিজ্ঞাসা করলেন –হে ব্রাহ্মণ, ভগবান বিষ্ণু স্বয়ং প্রাণিগণের হিতকারী বন্ধু, পক্ষপাতহীন ও প্রিয় হয়ে, বিষম (অর্থাৎ পক্ষপাতাদি –বিশিষ্ট) জীবের মত ইন্দ্রের স্বার্থে দৈত্যদের কী করে বধ করলেন? আর, হে মুনি, যার দ্বারা প্রয়োজন সিদ্ধি হয়, সে তার পক্ষপাতী হয়ে থাকে এবং যা থেকে ভয়ের সম্ভাবনা হয়। বিদ্বেষ বশতঃ তাকে বধ করে থাকে — এটা ঠিক। কিন্তু এখানে পক্ষপাত অথবা ভয়ের কারণ কিছুই দৃষ্ট হয় না। যে ভগবান সাক্ষাৎ পরমানন্দস্বরূপ তার দেবগণ হতে কি প্রয়োজন সিদ্ধ হবে? আর যিনি অগুণ, (অর্থাৎ প্রাকৃত গুণকার্য দৈদিতে আমি আমার –এরূপ অধ্যাস –রহিত) তাঁর অসুরগণের থেকে ভয়ের সম্ভাবনা কি? অপরপক্ষে, তার কারো সাথে দ্বেষভাবও নেই। তবে ইন্দ্রের সাহায্যের জন্য ভগবান এরূপ গহিত কর্ম কেন করলেন? হে মহাভাগ, নারায়ণের অনুগ্রহ– নিগ্রহাদি গুণের প্রতি আমাদের সুমহৎ সংশয় জন্মেছে। আপনি অনুগ্রহ করে সে সংশয় নিরসন করুন।
শ্ৰী শুকদেব বললেন– মহারাজ, ভগবান হরির অদ্ভুত চরিত্র সম্বন্ধে তুমি যা প্রশ্ন করেছ, তা অতি সুন্দর হয়েছে। যে চরিত্রে পরম পুণ্য (সকল পাপ –নিবর্তক) ও ভগবানের ভক্তিবর্ধক পরম ভাগবত প্রহ্লাদের মাহাত্ম্য নারদাদি ঋষিগণ কর্তৃক কীর্তিত হয়েছে।
অতএব মহামুনি কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন বেদব্যাসকে নমস্কার করে শ্রীহরির কথা বলব ভগবান বিষ্ণু প্রকৃতির পর অর্থাৎ অতীত। অতএব নিগুণ, অজ ও অব্যক্ত অর্থাৎ রাগ– দ্বেষাদির নিমিত্ত ভূত দেহেন্দ্রিয়াদি রহিত। কিন্তু এরূপ হয়েও স্বীয় মায়ার গুণ যে সত্ত্বাদি তাতে অধিষ্ঠান করে বাধ্য ব্যক্তিদের প্রতি বাধ্যকতাপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, অথবা দেব ও দানবদের পরস্পর যে বাধ্য-বাধকতা, তার হেতু হন। হে রাজন, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ- এই তিনটি গুণ- মায়ার, আত্মার নহে। অতএব গুণসকল স্বকীয় না হওয়ার, ভগবানকে প্রাকৃত পুরুষের মত বিষম বলতে পারা যায় না। হে মহারাজ, এই গুণসকলের একেবারে হ্রাস অথবা বৃদ্ধি হয় না। সত্ত্বগুণ নিজের বৃদ্ধি সময়ে দেব ও ঋষিগণকে ভজনা করে অর্থাৎ সেই দেহে প্রবিষ্ট হয়ে তাদের বর্ধিত করে এইরূপ রজোগুণ নিজের বৃদ্ধিকালে অসুরদের এবং তমোগুণ নিজের উন্নতি সময়ে কালের অনুগুণ হয়ে যক্ষ, রাক্ষস প্রভৃতিকে অবলম্বন করে থাকে।
যদিও ভগবান সকলের প্রতি সম, তথাপি নিমিত্তভেদে তার বৈষম্য হতে পারে। যেমন কাষ্ঠাদিতে অগ্নি, পাত্ৰাদিত জল, ঘট –পটাদিতে আকাশ নানারূপে প্রকাশ পায়, তেমনি গুণভেদে সেই ভগবান নানারূপে প্রকাশ পান। দেবাদিব দেহ হতে পৃথকরূপে তিনি বিবেচিত হন না। তবে তিনি সকলকে আশ্রয় করে আছেন–ইহা কি করে জানা যাবে? উত্তর–নিপুণ ব্যক্তিরা স্বভাব ও কর্ম দ্বারা আত্মস্থ ঐ আত্মাকে মন্থন করে অর্থাৎ কার্যদর্শন লিঙ্গ–দ্বারা বিচার করে জানতে পারেন। যেমন সূর্যকান্ত মণি প্রভৃতির দাহ দেখে জ্যোতিঃ জানা যায়, তেমনি নিপুণ ব্যক্তিগণ–দেহে কার্য দেখে পরমাত্মার স্থিতি অনুমান করেন।
মায়ার গুণবশতঃ এরূপ পরমশ্বেরের স্বাভাবিক নয়। তথাপি গুণ–পরতন্ত্র বলে তাঁর অবিনশ্বরতা আকাঙ্ক্ষা করা যায় না। কারণ সেই পরমেশ্বর জীবের ভোগের জন্য যখন নিজের মায়ার দ্বারা পুর বা দেহ সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করেন, তখন সাম্যাবস্থায় স্থিত রজোগুণকে পৃথক সৃষ্টি করেন। পরে ঐ সকল বিচিত্র দেহে ক্রীড়া করতে ইচ্ছা করে সত্ত্বগুণকে পৃথকরূপে সৃষ্টি করেন, তারপর শয়ন (অর্থাৎ সংহার) করতে ইচ্ছা হলে তমোগুণের সৃষ্টি করেন। হে নরদেব, সেই পরমাত্মা কালেরও পরতন্ত্র নহেন, কারণ তিনি ঈশ্বর। এবং সত্যকৃৎ অর্থাৎ অমোঘকর্তা। প্রকৃতি ও পুরুষ–এই দুইটির নিমিত্ত দ্বারা অর্থাৎ এদের সহাকারত্ব–হেতু আশ্রয়–রূপে বর্তমান যে কাল, তাকেও তিনিই সৃষ্টি করেন। অতএব কাল তার চেষ্টাস্বরূপ হওয়ার তিনি কালের অধীন নন। এই কাল সত্ত্বগুণকে বর্ধিত করে।
সেজন্য তাহা ঈশ্বর হয়েও সত্ত্ব প্রধান দেবতাদের বর্ধিত করে এবং তাদের প্রতিপক্ষ অসুর– সকলকে হিংসা করে থাকে। এই কারণে ঐ কালের যশঃ অতিশয় মহৎ। এই তাৎপর্য এই যে– কোন শক্তির দ্বারা গুণসকল ক্ষুরিত হলে, তজ্জন্য যে বৈষম্য হয়, সেই বৈষম্য সন্নিধান–মাত্রে তার অধিষ্ঠাতায় স্ফূর্তি পেয়ে থাকে। (দেবতাগণ প্রায় ভক্ত বলে তাদের প্রতি ভক্তজনপ্রিয় ভগবানের এই বৈষম্য ভূষণই, দূষণ নয়। আবার কখন কখন অসুরগণের দ্বারা দেবতাদের পরাভব ঘটিয়ে, তাদের মত্ততা নিবারণ করে থাকেন। তিনি সর্বপ্রিয় ও সর্বসুহৃৎ–এজন্য পুতনাদির বধে তার ধাত্রীর উচিত গতিদান–ভগবানের মহৎ যশ ঘোষিত হয়েছে।)।
হে রাজন, রাজসূয় মহাযজ্ঞে দীক্ষিত মহারাজ যুধিষ্ঠিরের জিজ্ঞাসায় পূর্বে দেবর্ষি নারদ এই বিষয়েই একটি ইতিহাস দৃষ্টান্তরূপে বলেছিলেন। –হে রাজন, রাজসূয় মহাযজ্ঞে চেদিদেশোধিপতি শিশুপালের ভগবান বাসুদেবে অদ্ভুত সাযুজ্য দেখে পাণ্ডুপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির সেই মহাযজ্ঞে সমাসীন দেবর্ষি নারদকে সকল মুণিগণের সমক্ষে এই প্রশ্ন করেছিলেন। যুধিষ্ঠির বললেন–অহো, পরমতত্ত্ব ভগবান বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণে যে সাযুজ্য লাভ ঐকান্তিক ভক্তগণেরও দুর্লভ, তা এই বিদ্বেষী শিশুপাল কি করে লাভ করল? ইহা অত্যন্ত আশ্চর্য। হে মুনে, এ বিষয় জানার জন্য আমাদের সকলেরই ইচ্ছা হয়েছে। ও আপনি অনুগ্রহ করে বলুন। পূর্বে আপনার কাছে শুনেছি–ভগবানের নিন্দার ফলে বেণ ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক নরকে পতিত হয়েছিল। এই দমঘোষের পুত্র শিশুপাল মহাপাপী। বাল্যকালে খল ভাষণ থেকে আরম্ভ করে এখন পর্যন্ত গোবিন্দের প্রতি মৎসরী এবং দুর্মতি দন্তবক্রও সেরূপ। অব্যয় (অপক্ষয় শূন্য), পরমব্রহ্ম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বার বার নিন্দাকারী এই দুইজনের জিহ্বায় শ্বেতকুষ্ঠ হল না, কিংবা এরা ঘোর অন্ধ নরকেও পতিত হল না। দুর্লভস্বরূপ সেই ভগবানে সাক্ষাৎ (সাধনাদি ব্যতীতই) সকল লোকের সামনেই লয় প্রাপ্ত হল। হে ব্রাহ্মণ, ইহা অতি অদ্ভুত, বায়ুর দ্বারা যেমন দীপশিখা অস্থির হয়, তেমনি আমার চিত্ত ব্যাকুল হয়েছে। আপনি সর্বজ্ঞ, অতএব এই আশ্চর্য বিষয়ের কারণ কি, বলুন।
শ্রীশুকদেব বললেন–সর্বজ্ঞ ঋষি নারদ রাজা যুধিষ্ঠিরের ঐ সকল কথা শুনে অত্যন্ত প্রীত হলেন এবং সভার সকলকে শুনিয়ে মহারাজকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন। নারদ বললেন–ভগবানের নিন্দাকারীর নরকপাত হওয়া উচিত ছিল–এটা বলার তোমার অভিপ্রায় কি? ভগবানের পীড়াকর বলে? অথবা সুরাপানাদির মত নিষিদ্ধ বলে? কিংবা নিন্দনীয় আচরণের জন্য? দেহাভিমানাদি থাকলেই নিন্দাদি হতে পারে। আর, ভগবানের পীড়াদিরও কোনো আশঙ্কা নেই। নিন্দন, স্তব, সৎকার, তিরস্কার–ইত্যাদি প্রকৃতি পুরুষের অবিবেকী অর্থাৎ দেহাভিমানী জীবদেরই দেহের প্রতি হয়ে থাকে। এই দেহের অভিমানবশতঃই অন্যান্য প্রাণিদের ‘আমি, আমার” ইত্যাদির বৈষম্য এবং তাড়ণা ও নিন্দা এই দুটির কারণে হিংসা ও পীড়া হয়। যে দেহে এই অভিমান নিবদ্ধ তার বধে প্রাণিদের বধ হয়ে থাকে, কিন্তু পরমেশ্বরের দেহও নাই, তদভিমানও নাই। যেহেতু তিনি অদ্বিতীয়, সুতরাং তার অভিমন্তব্য নাই। আর তিনি সর্বাত্মা, এজন্য তার বৈষম্যও সম্ভবপর নয়। তবে যে দানবাদির বধ করেন, সেটি তাদের মঙ্গলের জন্য দণ্ডমাত্র, তাকে তার হিংসা বলা যায় না। (সকল প্রাণীর যেরূপ অনাত্মা দেহ এবং আত্মা জীব–এদুটি আছে, সেরূপ যদি কৃষ্ণেরও থাকত, তা হলে ভগবান কৃষ্ণেরও জীবের মত অবিদ্যাকৃত অভিমান থাকত। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেহ তদভিন্ন পরমাত্মাই, সেই স্বরূপভূত দেহে ‘আমি কৃষ্ণ’ এই অভিমানও তন্ময়ই। তিনিই অখিলাত্মা, অতএব জীবদেহের মত তার কোন অভিমান নাই।) তিনিই পরতত্ত্ব অর্থাৎ মায়া, মায়িক বস্তু ও জীব প্রভৃতি থেকে ভিন্ন, অতএব অ– স্বরূপভূত বস্তুতে তার অভিমান নেই বলে তার দ্বেষই বা কে, আর তার দ্বেষ্টাই বা কে? পরমাত্মা স্বরূপ নিজ দেহে তার যে অভিমান, সেটা আমি পরমাত্মা’–এইরূপেই অভিমান। সেজন্য সেই পরমাত্মা কাকে বিদ্বেষ করবেন? আর তাকে পরমাত্মা জেনে কেই বা তাঁকে বিদ্বেষ করবে? তবে তিনি কিজন্য নিজ-বিদ্বেষ্টা শিশুপালাদির বিনাশ করেছেন? দণ্ডধর পরমেশ্বরের সে দণ্ডদান কার্য তাদের মঙ্গলের জন্যই, যেহেতু তিনি সকলের সুহৃৎ। ভগবানের-নিন্দাদি করার জন্য তার কোন বৈষম্য হয় না। অতএব যে কোন উপায়েই হোক, তার ধ্যান করলে নিন্দাদিকৃত পাপেরও বিনাশ এবং তার সাযুজ্য লাভ হতে পারে। ফলতঃ বৈরানুবন্ধ অথবা নির্বে অথবা নির্বের অর্থাৎ ভক্তিযোগ কিংবা ভয়, লোভ নেই কিংবা কাম ইত্যাদি যে কোনো কারণে হোক, কোনোরূপে ভগবানের প্রতি মনঃসংযোগ করা কর্তব্য। কোনো প্রকারে তাকে পৃথক দেখা উচিত নয়। হে রাজন, আমার বোধহয়, ঐ সকল উপায় মধ্যে বৈরানুবন্ধ শ্রেষ্ঠ কারণ বৈরানুবন্ধের (অর্থাৎ বৈরের মত চিত্তের অভিনিবেশের) দ্বারা মানবগণ যেরূপ অনায়াসে তন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হয়, ভক্তিযোগের দ্বারা সেরূপ সহজে তন্ময়ত্ব পাওয়া যায় না–আমি আত্মবুদ্ধিতে এ বিষয় এক প্রকার নিশ্চয় করেছি। (জীবের মধ্যে প্রকাশমান অদৃশ বস্তুশক্তি যুক্ত ভগবদবিগ্রহের আভাসের কথা দূরে থাকুক প্রাকৃত জগতেও প্রাকৃতিক ভাবমাত্রেরও এরও চিন্তিত বস্তুর আবেশের মহৎ ফল দেখা যায়)। যেমন ভ্রমর কর্তৃক অবরুদ্ধ কীট (তেলাপোকা) ভিত্তির অভ্যন্তরস্থ গর্তে অবরুদ্ধ হয়ে দ্বেষ ও ভয়যোগ একাগ্রচিত্তে স্মরণ করতে করতে অচিরেই ভ্রমরের স্বরূপত্ব প্রাপ্ত হয়ে থাকে। এইরূপ যিনি কৃপাপূর্বক নিজ মায়াকে অবলম্বন করে নরাকৃতি পরব্রহ্মরূপে অবতীর্ণ সেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণে বদ্ধবের ব্যক্তিগণ বৈর দ্বারা তার.যে একান্ত চিন্তা করে তাতেই তাদের পাপরাশি পবিত্র হয়ে যায় এবং পরে তাঁর অনুধ্যানে তাকে লাভ করে থাকি।
বহু বহু ব্যক্তি ভক্তি অনুসারে কাম, ভয় অথবা স্নেহ হেতু ভগবান পরমেশ্বরে মনোনিবেশ করে কামাদি নিমিত্ত তাপ পরিত্যাগপূর্বক তার গতি প্রাপ্ত হয়েছে। (ভদ্র ও অভদ্র, যে কোনো ভাবেই সকলেই তাকে লাভ করে কিন্তু সাধনের তারতম্যে ফলের তারতম্য অবশ্যই রয়েছে। এখানে দ্বেষশূন্য পাপ ভগবাদাবেশের দ্বারাই বিনষ্ট হওয়ায় ভগবৎ প্রাপ্ত হয়েছে। কাম ও সেই পাপ নহে তা শ্রীভগবানে প্রেম-বিশেষ। এজন্য গোপীগণের শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কামের (প্রেমের) সর্বশাস্ত্রে প্রশংসা করা হয়েছে)। এর প্রমাণ স্বরূপ বলছেন– গোপীগণ কামহেতু কংস ভয় জন্য শিশুপালাদি নৃপতিগণ দ্বেষহেতু, যাদবগণ সম্বন্ধবশতঃ তোমরা স্নেহ প্রযুক্ত এবং আমরা ভক্তির দ্বারা তার গতি প্রাপ্ত হয়েছি। যদি বল, বেনরাজ কিজন্য নরকে পতিত হয়েছিল? উত্তর, কামাদিহেতু যে পাঁচ প্রকার চিন্তার কথা বলা হয়েছে, বেন তাদের মধ্যে কোনোভাবেই ভগবানের চিন্তা করে নাই। এজন্যে তাঁর গতি প্রাপ্ত হয় নাই। অতএব, হে রাজন, যে কোন উপায়েই হোক ভগবান শ্রীকৃষ্ণে মন অভিনিবিষ্ট করতে হবে। হে পাণ্ডবে তোমাদের মাতৃস্বসার পুত্র শিশুপাল ও দন্দবক্র–এই দুই জনে পূর্বে ভগবান বিষ্ণুর প্রধান পার্ষদ ছিল, বিপ্র শাপে এরা বৈকুণ্ঠ থেকে পরিচ্যুত হয়েছে।
শ্ৰীযুধিষ্ঠির বললেন–হে দেবর্ষি, সেই শাপ কি প্রকার? কোন্ ব্রাহ্মণই বা শাপ দিয়েছিলেন? ঐ শাপ এরূপ যে হরিদাসদেরও অভিভূত করেছিল? যে সকল ব্যক্তি ভগবান হরির একান্ত ভক্ত, তাদের তো জন্মই হতে পারে না। অতএব আপনার ঐ কথা অনাদরের মত প্রকাশ পাচ্ছে। বস্তুতঃ প্রাকৃত দেহ, ইন্দ্রিয় এবং প্রাণই জন্মের হেতু, হরিভক্তগণ বৈকুণ্ঠবাসী, তাদের দেহ শুদ্ধসত্ত্বময়, তাদের প্রাকৃত ইন্দ্রিয় ও প্রাণ নেই। ওই দুই জনের প্রাকৃত দেহ সম্বন্ধ সংক্রান্ত এই আখ্যান আপনি বর্ণনা করুন।
দেবর্ষি নারদ বললেন–হে রাজন, এক সময় ব্রহ্মার পুত্র সনন্দনাদি মহর্ষিগণ ত্রিভুবন পর্যটন করতে করতে যদৃচ্ছাক্রমে বিষ্ণুলোকে গমন করেছিলেন। তাঁর মরীচি প্রভৃতি পূর্বতন মহর্ষিগণেরও পূর্বজ, তথাপি তাদের পাঁচ বা ছয় বছরের বালকের মত দিগম্বর শিশু দেখে মনে করে, বৈকুণ্ঠপুরীর ঐ দুই দ্বার পালকে এরূপ অভিশাপ ছিলেন-”ওহে, ভগবান মধুসূদনের পাদমূল রজঃ ও তমো গুণের সম্পর্ক রহিত। অতএব তোমরা এখানে বাসেরই যোগ্য নও, আর তো তার সেবার কথা দূরে থাক, অতএব, হে মুখ তোমরা এখনই পাপীয়সী আসুরী যোনি প্রাপ্ত হও। হে রাজন, তারা এরূপ অভিশপ্ত হয়ে তখুনি বৈকুণ্ঠ হতে পতিত হয়েছিল। তখন কৃপালু সেই মুনি আবার বললেন–তিনি জন্মের পর তোমাদের আবার স্বস্থান প্রাপ্তি হবে। তারপর ঐ দুই ব্যক্তি দিতির গর্ভে জন্মগ্রহণ করে হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষ নামে বিখ্যাত এবং দৈত্য-দানবদের বন্দিত হন।
হে যুধিষ্ঠির, ভগবান হরি নৃসিংহ মূর্তি ধারণ করে ঐ হিরণ্যকশিপুর প্রাণসংহার করেন। আর, ধরার রসাতল থেকে উদ্ধারকালে ভগবান বরাহ মূর্তি ধারণ করেন, তখন হিরণ্যাক্ষ প্রতিঘাত করায় তার হস্তে নিহত হন। কেশবপ্রিয় ভগবদ্ভক্ত নিজ পুত্র প্রহ্লাদকে হত্যা করার জন্য হিরণ্যকশিপু নানা যাতনার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভগবানের তেজে ব্যাপ্ত প্রশান্ত রোগ–দ্বিষাদিশূন্য, সকল প্রাণীর আত্মতুল্য, সমদর্শন সর্বত্র যিনি ভগবানকে দর্শন করেন, সেই প্রহ্লাদকে শস্ত্রাদির দ্বারা চেষ্টা করেও বধ করতে পারেন নি। তারপর তারা দুইজন কেশিনীর গর্ভে বিশবসের পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করে। ঐ দ্বিতীয় জন্মে তারা রাবণ ও কুম্ভকর্ণ নামে রাক্ষস হয়ে সকল লোকের সন্তাপ দিত। তারপর ভগবান বিষ্ণু রাঘবরূপে অবতীর্ণ হয়ে শাপ মোচনের জন্য তাদের বিনাশ করেন। হে মহারাজা, তুমি মার্কণ্ডেয় ঋষির মুখে রামচন্দ্রের শৌর্য-বীর্যের কথা শুনতে পাবে।
তারপর ঐ দুইজন তোমার মাতৃবস্বার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে দুর্ধর্ষ ক্ষত্রিয় হয়েছিল। এটি তাদের। তৃতীয় জন্ম, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাদের চক্র প্রহারে হত করেন। তাতে তাদের পাপ ধ্বংস হওয়ায় এক্ষণে তারা শাপমুক্ত হল। বৈরানুবন্ধ জন্য তীব্র ধ্যানের দ্বারা ঐ দুই জন বিষ্ণুভক্ত হয়ে বিষ্ণুর পার্ষদ হওয়ায় আবার ভগবানের পার্শ্বে গমন করল। মহারাজ যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন —-হে ভগবান, মহাত্মা প্রিয় পুত্রের প্রতি হিরণ্যকশিপুর কি জন্য বিদ্বেষভাব হয়েছিল? আর যে কারণে প্রহ্লাদের ভগবান অচ্যুতে একচিত্ততা হয়, তাও কৃপাপূর্বক বলুন।
.
দ্বিতীয় অধ্যায়
বিষ্ণুর প্রতি ক্রুদ্ধ হিরণ্যকশিপু সাধুদের প্রতি অত্যাচার করিতে নিজ দৈত্যদের আদেশ দান এবং তত্ত্বকথনের দ্বারা ভ্রাতৃপুত্রগণের শোকাপনোদন
শ্রী নারদ বললেন–ভগবানের প্রতি বিদ্বেষই প্রহ্লাদের প্রতি বিদ্বেষের কারণ –এটা বলার জন্য প্রথমতঃ হিরণ্যকশিপুর ভগবৎ বিদ্বেষের কারণ বলছেন) –হে মহারাজ, ভগবান বরাহমূর্তি ধারণ করে দেবতাদের প্রতি পক্ষপাতপূর্বক হিরণ্যকশিপুর ভ্রাতা হিরণ্যাক্ষকে নিহত করলে, হিরণ্যকশিপু শোকে ও রোষে অত্যন্ত সন্তপ্ত হলেন। ক্রোধে পরিপূর্ণ হয়ে বারবার নিজের দন্তদ্বারা ওষ্ঠাধর দর্শন করতে লাগলেন। ক্রোধদীপ্ত দুই চক্ষুর দ্বারা রোষাগ্নির ধূমে ধূমায়িত আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। করালদন্ত, উগ্রদৃষ্টি, দুর্দম ভুকূটিযুক্ত মুখে শূল উত্তোলন করে সভামধ্যে দানবগণকে বললেন–হে দৈত্য-দানব–সকল, অহে দ্বিমুর্ধ, ত্যক্ষ, শম্বর, শতবাণু, হয়গ্রীব, নমুচি, পাক, ইন্বল, বিচিত্তি, পুলোমা, শকুন প্রভৃতি দানবগণ, তোমরা আমার কথা শোন এবং যা কর্তব্য শীঘ্র কর, বিলম্ব করো না।
ক্ষুদ্র শত্রুগণ আমার প্রিয় ও পরম সুহৃৎ সহোদরকে বিনষ্ট করেছে। ভগবান হরি সর্বত্র সম বলে পরিচয় দেন বটে, কিন্তু তিনি উপাসনাকে নিমিত্ত করে লোভবশতঃ আমাদের শত্রু দেবতাদের সাহায্য করেছেন। হরির এখন আর সেই সমত্ব স্বভাব নেই। যদিও তিনি শুদ্ধ ও তেজময় তথাপি মায়াবশতঃ বরাহরূপী হয়েছেন। (তিনি পরমাত্মা বলে প্রসিদ্ধ হলেও, পরমার্থ পরিত্যাগ করে পশু হয়েছেন।) এখন বালকের মত অব্যবস্থিত চিত্ত, যে কেউ তার উপাসনা করলে তিনি তার বশীভূত হন (যেমন বালক খণ্ড লড়ুক প্রভৃতির লোভে বশীভূত হয়)। আমি এই নিজের শূল দিয়ে তার গ্রীবা বিভিন্ন করে তার রক্তে রক্তপ্রিয় ভ্রাতা হিরণ্যাক্ষের তর্পণ করব, তা হলে আমার মনোব্যথা দূর হবে। সেই কপট হরি আমার প্রতিপক্ষ, ঐ দুরাত্মা বিনষ্ট হলেই, ছিন্নমূল বৃক্ষের শাখা যেমন শুকিয়ে যায়, তেমনি দেবগণ উৎপাটিত হয়ে যাবে। কারণ ঐ হরিই দেবতাদের প্রাণ।
হে দৈত্যগণ, সম্প্রতি তোমরা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণের দ্বারা সম্বর্ধিত ভূমণ্ডলে যাও। সেখানে গিয়ে তপস্যা, যজ্ঞ বেদাধ্যয়ন, ব্রত, ও দানাদিযুক্ত মানবদের সংহার করতে থাক। যদিও যজ্ঞাদি সম্পন্ন জনগণের কোন অপরাধ নেই, তথাপি দ্বিজগণের যজ্ঞাক্রিয়াই বিষ্ণুপ্রাপ্তির মূল কারণ। আর, বিষ্ণু স্বয়ং যজ্ঞ ও ধর্মময় এবং দেবর্ষি, পিতৃ, ভূতগণের ও ধর্মের পরম আশ্রয়। অতএব ঐ সকল ব্যক্তি, যজ্ঞমূর্তি বিষ্ণুর মূল। তারা আমাকে অনাদর করে বিষ্ণুর আশ্রয় গ্রহণ করেছে। অতএব আমার বধ্য। তাদের নাশে বিষ্ণু নিজেই বিনষ্ট হবে। ব্রাহ্মণগণের বিনাশে যজ্ঞক্রিয়া সমূহ লোপ হবে, তা হলে বিষ্ণুর মূল উৎখাত হবে। আর যজ্ঞ ও ধর্মের নাশে বিষ্ণুর স্বরূপই নষ্ট হবে। হে দানবগণ, এ বিষয়ে আমার একটি পরামর্শ শোন। যেখানে যেখানে গো, ব্রাহ্মণ্য, বেদ ও বেদবিহিত আশ্রমোচিত ক্রিয়া দেখবে, সেই সেই জনপদে গিয়ে তা জ্বালিয়ে দাও। তা হলে সেখানকার লোকদেরও বিনাশ হবে। আর, তাদের উপজীব্য বৃক্ষসকল ছেদন করে ফেল।
হে মহারাজ যুধিষ্ঠির, দৈত্যাধিপতি হিরণ্যকশিপু এই প্রকার আদেশ করলে কলহপ্রিয় দানবগণ তাঁর নির্দেশ মস্তকে গ্রহণ করে সাগ্রহে প্রজাদের নিগ্রহ করতে আরম্ভ করল। পুর (হেট্টাদিযুক্ত নগর), গ্রাম (হট্টাদিরহিত স্থান), ব্রজ ( গো–সকলের বাসস্থান), উদ্যান, ধান্যাদি ক্ষেত্র, আরাম (অকৃত্রিম বর্ণ) ঋষিদের আশ্রম, রত্নাদির আকর খেট (কৃষকদের বাসস্থান), খর্ব (পাবতীয় উপত্যকাস্থ গ্রাম) ঘোষ (আভীরদের বাসস্থান) এবং পত্তন (রাজধানী)–এই সকল দগ্ধ করল। কেউ কেউ খনন যন্ত্রের দ্বারা সেতু, প্রাচীর, পুর বিদীর্ণ করে ফেলল, কেউ বা কুঠার দ্বারা উপজীব্য বৃক্ষসকল ছেদন করল। কোনো কোনো দানব জলন্ত অঙ্গার নিক্ষেপ করে প্রজাদের গৃহগুলি দগ্ধ করতে লাগল। দৈত্যেন্দ্র হিরণ্যকশিপুর অনুচরবর্গ এই প্রকারে পৃথিবীর লোকদের উপর উপদ্রব করতে থাকলে, যজ্ঞভাগের অভাবে দেবগণ স্বর্গরাজ্য পরিত্যাগ করে পৃথিবীতে ভ্রমণ করতে লাগলেন।
এইরূপ দৈত্যগণ প্রজাদের উপর অত্যাচার করতে থাকলে, হিরণ্যকশিপু স্বর্গরাজ্যাদি কামনায় তপস্যা করতে অভিলাষ করে প্রথমতঃ মৃত ভ্রাতার উদ্দেশে শ্রাদ্ধ–তৰ্পণাদি সম্পন্ন করলেন। পরে দেশকালজ্ঞ ও সকল লোকের প্রভু হিরণ্যকশিপু, ভ্রাতুস্পুত্র শুকনি, শম্বর, ধষ্টি, ভূতসন্তাপন, বৃক, কালনাভ, মহানাভ, হরিশ্মশ্রু ও উৎকচকে বেং তাদের জননী, নিজের ভ্রাতৃবধূ ও ভ্রাতা –পুত্রগণ, আমার বীর ভ্রাতার জন্য তোমাদের শোক করা উচিত নয়। বীর পুরুষদের শত্রুর অভিমুখে বধ শ্লাঘ্য, (বিশেষতঃ এ শত্ৰু স্বয়ং বিষ্ণু)। সকল বীরই ঐরূপ বধ কামনা করে থাকে। হে সুব্রতে, পানীয়শালায় যেমন প্রাণিসকল মিলিত হয়, তেমনি এই সংসারে জীবগণ প্রাচীন কর্মবশতঃ ঈশ্বর কর্তৃক একত্র সংযযাজিত হয়, আবার নিজ নিজ কর্মদ্বারা নিয়োজিত হয়।
হে ভদ্রে, আত্মার মৃত্যু নেই, আত্মা অব্যয় (অক্ষয় শূন্য), শুদ্ধ, সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ এবং দেহাদি থেকে পৃথক। সেই আত্মা (জীবাত্মা) ভগবানের মায়ার (অবিদ্যা–শক্তির) দ্বারা মোহিত হয়ে সেই সেই বিষয় সম্পাদন করে তার জন্য লৌকিক ও অলৌকিক কর্মাদি করার জন্য লিঙ্গশরীর ধারণ করে অর্থাৎ দেহ, ইন্দ্রিয়, অন্তঃকরণে ‘আমি, আমার’ –এইরূপ অধ্যাস করে থাকে। এই লিঙ্গ শরীরোপাধিই সংসার। জলসকল চঞ্চল হলে, তাতে প্রতিবিম্বিত বৃক্ষগুলিও যেমন চঞ্চল হয়, আর চক্ষু ভ্রাম্যমান হলে যেমন ভূমি ভ্রমশীলের মত দৃষ্ট হয়, সেইরূপ মায়ার সত্ত্বাদি গুণের দ্বারা মন ভ্রাম্যমান হলে পরিপূর্ণ স্বরূপ পুরুষ (অর্থাৎ আত্মা) লিঙ্গদেহ বিহীন হয়েও লিঙ্গ–শরীরীর ন্যায় ঐ মনের সমান হয়ে থাকে। লিঙ্গ দেহ না থাকলেও লিঙ্গদেহের যে ভাবনা (লিঙ্গদেহাভিমান) এটাই আত্মার বিপর্যস (অর্থাৎ অন্যথাভাব), এর ফলেই প্রিয়ের সাথে বিয়োগ, অপ্রিয়ের সাথে সংযোগ, কর্ম ও সংসার অর্থাৎ নানা গর্ভে প্রবেশ হয়ে থাকে। আর, এই বিপর্যাস হতেই জন্ম, মৃত্যু, বিবিধ শোক, অবিবেক, চিন্তা ও বিবেকের অস্মরণ হয়।
শোকের হেতু না থাকায় তোমাদের এই শোক বৃথা, এ বিষয়ে পণ্ডিতগণ একটি পুরাতন ইতিহাস রচিত করেছে, তা আমার কাছ থেকে শোন। উশীনর দেশে সুযজ্ঞ নামে এক বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তিনি যুদ্ধে শত্রুদের দ্বারা নিহত হলে, জ্ঞাতিগণ তার নিকট গিয়ে ঘিরে বসেছিলেন। তৎকালে তার রত্নময় কবচ, বিশীর্ণ এবং আভরণ ও মাল্য বিভ্রষ্ট হয়েছিল। আর তীক্ষ্ণ বাণে তাঁর বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ হওয়ায় রক্তাপ্লুত ছিল। কেশগুলি বিকীর্ণ, চক্ষুদ্বয় বিধ্বস্ত এবং ক্রোধভরে যে ওষ্ঠ দংশত করেছিলেন তা সেরূপেই ছিল। ধূলির দ্বারা মুখকমল আবৃত ছিল এবং আয়ুধ ও ভুজদ্বয় ছিন্নভিন্ন হয়েছিল। দৈববশতঃ উশীনরেন্দ্রকে ঐ ভাবে ধরাশায়ী দেখে তার মহিষীগণ অতিশয় দুঃখিত হয়ে, নিজ নিজ বক্ষঃস্থলে আঘাত করতে করতে ‘হা নাথ, আমরা হত হলাম’–বলে তার পদতলে পতিত হলেন। কুচকুঙ্কুম–দ্বারা অরুণিত অশ্রুজলে প্রিয় পতির পাদপদ্ম সিক্ত করতে উচ্চস্বরে রোদন করতঃ বিলাপ করতে লাগলেন। শোকে তাদের কেশ ও ভূষণ বিধ্বস্ত হয়েছিল। তাদের ক্রন্দন দেখে সচেতন প্রাণীমাত্রেরই হৃদয় শোকাকুল হল।
তাঁরা বিলাপ করতে করতে বললেন–অহো বিধাতা কি নির্দয়, হে প্রভো, তুমি পূর্বে এই উশীনরদের বৃত্তিপ্রদ পিতা ছিলেন, অকরুণ বিধি এখন তোমাকে আমাদের নয়নের অগোচর দশায় উপনীত করে আমাদের শোকবর্ধন করাচ্ছে। হে মহীপতে, তুমি কৃতজ্ঞ এবং আমাদের পরম সুহৃৎ, তোমাকে ছাড়া আমরা কিরূপে জীবন ধারণ করব? হে বীর, তুমি যেখানে গিয়েছ, সে পথ আমাদের বলে দাও, আমরাও তোমার অনুগমন করে তোমার পাদদ্বয়ের সেবা করব। ঐ রাজমহিষীগণ মৃত পতিকে বেষ্টন করে এই প্রকার বিলাপ করতে থাকল, তাদের ইচ্ছা হল না যে স্বামীর মৃতদেহ সকারের জন্য নিয়ে যায়। এর মধ্যে সূর্য অস্তাচলে চলে গেল। মৃত রাজার বন্ধুগণ ঐরূপ রোদনধ্বনি নিজপুরী হতে শ্রবণ করে, যমরাজ স্বয়ং বালকের রূপ ধরে সেখানে এলেন।
যমরাজ বললেন–অহো, এই সকল ব্যক্তি আমা অপেক্ষা বয়সে বড়, এরা লোকদের জন্ম-মরণ। ব্যাপার বার বার দেখছে, তবুও এদের কি মোহ! মানুষ যেখান থেকে এসেছে, সেখানেই চলে গেছে, তার জন্য বৃথা শোক করে কেন? এরাও তো ঐ মৃত ব্যক্তির সমানধর্ম অর্থাৎ এদেরও একদিন মরতে হবে, তবে শোক করা কেন? কি আশ্চর্য আমরা বালক হলেও আমাদের যে প্রকার বিবেক রয়েছে এদের তাও দেখছি না। অতএব আমরাই ধন্য। যেহেতু আমরা মাতৃ-পিতৃ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছি, কখনও মনে এসব কথা চিন্তাও করি না। যখন অতি দুর্বল ছিলাম, তখন ব্যাঘ্রাদি, হিংস্ৰজন্তু আমাদের ভক্ষণ করে নাই। তার কারণ এই যে যিনি গর্ভে রক্ষা করেছেন, তিনি বিশ্বের রক্ষক এবং আমাদেরও রক্ষা করছেন। হে অবলা, যিনি ইচ্ছানুসারে এই বিশ্বের সৃষ্টি করছেন, যাঁর হাতে এর পালন হচ্ছে এবং প্রলয়কালে এই সকল সংহার করবেন; সেই অব্যয় পরমেশ্বরের এই চরাচর বিশ্ব ক্রীড়া-সাধনমাত্র। তিনিই সংহার ও পালনে প্রভু।
হে অবলাগণ, পথে পতিত ব্যক্তিও পরমেশ্বর কর্তৃক রক্ষিত হলে রক্ষা পায়, গৃহে স্থিত পুরুষও পরমেশ্বর কর্তৃক হত হলে বিনষ্ট হয়। আর, বনে অনাথ জনও তার দ্বারা রক্ষিত হলে বাঁচে, গৃহে সুরক্ষিত পুরুষও তাহা কর্তৃক উপেক্ষিত হলে বাঁচে না। জীবের জন্ম-মরণাদি ঈশ্বরের অধীন বলে শোক করা উচিত নয়। এখন দেহাদিরই জন্মাদি আত্মার নয়–এই বিষয়ে বলছেন। প্রাণীদের দেহ নিজ নিজ কারণীভূত যে লিঙ্গশরীর, তার নিমিত্তস্বরূপ কর্মবশতঃ উৎপন্ন হয় এবং কালক্রমে বিনষ্ট হয়ে যায়। দেবাদি দেহেরও এইভাবে উৎপত্তি ও বিনাশ হয়ে থাকে। কিন্তু ঐ দেহে অবস্থিত হয়েও আত্মা, দেহের ধর্ম যে জন্মাদি, তার সাথে মিলিত হয় না, কারণ আত্মা দেহ থেকে অত্যন্ত ভিন্ন। অর্থাৎ দেহে স্থিত হয়েও পরমাত্মা দেহের ধর্ম-জন্মাদির দ্বারা আবদ্ধ হন না, কেবল সেই দেহের দ্বারা অনুষ্ঠিত শুভ ও অশুভ কর্মের ফল নিজের সন্নিধান মাত্রে দিয়ে থাকেন–ইহাই তার অপেক্ষা ও উপেক্ষা।
এই শরীর অবিবেচক হেতু আত্মতত্ত্বরূপে জন্মেছে, অতএব অত্যন্ত অবিবেকীর কাছে গৃহ যেমন এ আত্মত্বরূপে (আমার গৃহ এরূপে) প্রতীয়মান হয়, তেমনি ‘আমি কৃশ, আমি স্কুল’ ইত্যাদি প্রয়োগস্থলে এই দেহ অবিবেকীর পক্ষে আত্মবৎ প্রতীত হয়, বস্তুতঃ উহা আত্মা হতে পৃথক; যেহেতু দেহ দৃশ্য ও পাঞ্চভৌতিক। যেমন জলীয় পরমাণু হতে উৎপন্ন বুদবুদ, পার্থিব পরমাণু হতে জাত ঘটাদি, এবং তৈজস পরমান্ধর নির্মিত কুণ্ডলাদি কালবশতঃ বিনাশ প্রাপ্ত হয়, তেমনি এই তিন প্রকার পরমাণু হতে উৎপন্ন এই দেহই কালবৃশতঃ বিকৃত (অর্থাৎ পরিণত) হয়ে বিনষ্ট হয়ে থাকে, কিন্তু আত্মার বিনাশ নেই। অগ্নি যেমন কাষ্ঠ সকলে অবস্থিত হয়েও দাহকত্ব ও প্রকাশকত্বরূপে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে প্রকাশ পায়, যেমন বায়ু দেহের অভ্যন্তরবর্তী হওয়ায় নাসাদি পৃথক স্থানে প্রকাশ পায় এবং আকাশ যেমন সর্বগত হয়েও কারও সঙ্গপ্রাপ্ত হয় না, তেমনি পুরুষ (আত্মা) সকল দেহ ও ইন্দ্রিয়ের আশ্রয় হয়েও পৃথকই থাকেন।
হে মূঢ়, তোমরা যার জন্য শোক করছ, তোমাদের পতি সুযোগ্য তো তোমাদের সামনে শয়ন করে আছে, তবে শোক করছ কেন? ইনি এখন শুনছেন না এবং কথাও বলছেন না এবং তোমরা একে দেখতে পাচ্ছ না বলে যদি শোক কর পুর্বেও তো দেখতে পাও নি, কারণ যিনি শ্রবণ করেন এবং প্রত্যুত্তর দেন তিনি এ সংসারে কোন কালেও দৃশ্য হ’ন না। দেহের মধ্যে সকল ইন্দ্রিয়ের চেষ্টাশালী যে মুখ্য প্রাণ আছে, তিনিও বক্তা বা শ্রোতা নন, এর মধ্যে যে আত্মা আছেন, তিনিই সকল ইন্দ্রিয়ের সাথে সেই বিনয়ের ভ্রষ্ট। ঐ আত্মা অচেতন প্রাণ ও দেহ হতে ভিন্ন পদার্থ এবং চেতন–স্বরূপ, যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মা লিঙ্গশরীর যুক্ত হয়ে তদভিমানী হন, ততক্ষণ পর্যন্তই কর্মসকল বন্ধের কারণ হয়। তারপর বিপর্যয় (অর্থাৎ দেহধর্ম) এবং ক্লেশ অনুবর্তমান হয়ে থাকে। কিন্তু ঐ বিপর্যয়াদি মায়ামাত্র, বাস্তবিক নহে। গুণকার্য যে সুখাদি, তাতে পরমার্থবোধক যে দৃষ্টি এবং ঐরূপ যে বাক্য তা মিথ্যা অভিনিবেশ মাত্র; মনোরথ ও স্বপ্ন মিথ্যা, তেমনি ইন্দ্রিয়জাত সুখাদিও মিথ্যা। অতএব যে সকল ব্যক্তি নিত্য ও অনিত্য পদার্থ জানেন, তাঁরা নিত্য (আত্মা) অথবা অনিত্য (দেহাদি) বস্তুর জন্য শোক করেন না। তবে যে কখন কখন উপদেষ্টাদেরও শোক করতে দেখা যায়, তার কারণ এই যে–স্বভাবের অন্যথা করা অসাধ্য। অর্থাৎ জ্ঞানের দৃঢ়তা না থাকায় ঐরূপ শোককারীদের স্বভাব নিবৃত্ত হয় না।
হে অবলাগণ, তোমরা নিজেরাই মৃতের সমান ধর্ম হয়ে কেন শোক করছ–এই যা বলেছি সে বিষয়ে একটি ইতিহাস বলছি, শোন। কোনো ব্যাধ পরমেশ্বর কর্তৃক পক্ষিদের হন্তারকরূপে সৃষ্ট হয়ে যেখানে যেখানে পক্ষিরা থাকত, সেখানে গিয়ে জাল বিস্তার করে, লোভ দেখিয়ে তাদের ধরে নিয়ে যেত। এত সময় কুলিঙ্গন নামে কনভক্ষী এক জাতীয় পক্ষী, স্ত্রী পুরুষে বিচরণ করতে করতে ব্যাধের দৃষ্টিগোচর হল। তাদের মধ্যে পক্ষিণী প্রলুব্ধ হয়ে প্রথমে ব্যাধের জালে বদ্ধ হল। কুলিঙ্গ সেই স্ত্রী পক্ষীকে বিপদে পড়তে দেখে অত্যন্ত দুঃখিত হল এবং স্নেহবশতঃ কাতর হয়ে স্ত্রীর জন্য বিলাপ করতে লাগল। অহো, আমার এই স্ত্রী দীনা হয়ে, কাতর আমার জন্য করুণা প্রকাশ-পূর্বক শোক করছে। নির্দয় বিধাতা আমার ভার্যাকে নিয়ে কি করবে? এই প্রেয়সী আমার দেহর তাতে বিরহিত হওয়ায় আমার অপর-দেহার্ধ অতিশয় দুঃখে থাকবে। দৈব’ আমাকে ত গ্রহণ করুক, আমার শাবকগুলির এখনও ডানা গজায় নি, তারা মাতৃহীন হল, এখন আমি কিরূপে তাদের পালন করব? এতক্ষণ হতভাগ্য শাবকগুলি নীড়–মধ্যে তাদের মায়ের প্রতীক্ষা করছে। কুলিঙ্গ পক্ষী প্রিয়ার বিয়োগে ঐ রূপ ব্যাকুল হয়ে ঐ প্রকার বিলাপ করতে থাকলে সেই পক্ষিহন্তা-ব্যাধ কালপ্রেরিত হয়েই যেন গোপনে বাণ দ্বারা তাকে বিদ্ধ করল। তোমরাও কুলিঙ্গ পক্ষির মত অবোধ, এই প্রকার শোকে তোমরা নিজেরাই যে বিনাশ হবে, তা দেখছ না। যদি শত শত বছর ধরেও শোক কর তবুও তোমাদের ঐ পতিকে আর জীবিত পাবে না, অতএব কেন শোক করছ?
হিরণ্যকশিপু বললেন–সেই বালক এরূপ বললে। জ্ঞাতিরা সকলেই বিক্ষিপ্তচিত্ত হবে এই মনে করতে লাগল। সকল বস্তুই অনিত্য এবং মিথ্যা আবির্ভূত হয়েছে বালকরূপী যম এই উপাখ্যান বলে সেখানেই অন্তর্হিত হলেন। তারপর সুযজ্ঞ রাজার জ্ঞাতিগণ শোক পরিত্যাগ কল্পে রাজার পারলৌকিক কার্য সম্পন্ন করলেন। অতএব তোমাদেরও পরের অথবা নিজের জন্য শোক করা উচিত নয়। এই সংসারে আত্মাই বা কে? পরই বা কে? কোন ব্যক্তি নিজের। কোন ব্যক্তিই বা পরের? এ আত্মীয় এ পর এই অভিনিবেসই অজ্ঞান। এই অজ্ঞান ব্যতিরেকে আত্মীয় বা পর–এরূপ বিচার হতে পারে না। শ্রীনারদ বললেন–দৈত্যপতি হিরণ্যকশিপুর এইরূপ কথা শুনে তুষার সহিত দিতি ক্ষণকালের মধ্যে পুত্রশোক ত্যাগ করে পরমাত্ম তত্ত্বে চিত্ত ধারণ করলেন।
.
তৃতীয় অধ্যায়
হিরণ্যকশিপুর তপস্যা ও বরপ্রাপ্তি
শ্রী নারদ বললেন–হে মহারাজ যুধিষ্ঠির হিরণ্যকশিপু –নিজেকে অজেয়, অজর, অমর ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী অদ্বিতীয় রাজা হবার কামনা করেছিলেন, এজন্যে তিনি মন্দার পর্বতের কন্দরে গিয়ে দারুণ তপস্যা আরম্ভ করলেন। তার ধ্যানে পাদাঙ্গুষ্ঠর দ্বারা ধরণী অবলম্বনপূর্বক ঊর্বাহু হয়ে আকাশে দৃষ্টি অর্পণ করে থাকতেন। প্রলয়কালীন সূর্য যেমন নিজের ভয়ংকর কিরণে বিরাজিত হয়, তার মত ঐ দৈত্য নিজের জঠরে কান্তির দ্বারা বিরাজিত হতে লাগলেন। হিরণ্যকশিপু তীব্র তপস্যা করতে আরম্ভ করলে, দেবগণ আবার স্বর্গরাজ্যে ফিরে এলেন। কিছুকাল পরে ঐ দৈত্যের মস্তক থেকে সমুদ্ভুত তপোময় সধূম অগ্নি-সর্বত্র প্রসূত হয়ে তির্যক ঊর্ধ্বে ও অধঃ লোকসকলকে সন্তপ্ত করতে আরম্ভ করল। তার তীব্র তপস্যার প্রভাবে নদ, নদী, সাগর ক্ষুভিত দ্বীপ সাথে পৃথিবী বিচলিত, গ্রহ, তারকাগণ পতিত এবং ব্রহ্মাকে জানালেন –হে দেবদেব, হে জগৎপতে দৈত্যেন্দ্র হিরণ্যকশিপুর তপস্যায় তপ্ত হয়ে আমরা স্বর্গে থাকতে পারছি না। হে ভূমন, যদি আপনার অভিমত হয়, তবে তার শান্তি বিধান করুন, হে সর্বাধিপতে, আপনার করপ্রদ লোকসকল যাবৎ বিনষ্ট হয়, তার মধ্যেই শীঘ্র কোনো উপায় করুন।
হে প্রভো, দুশ্চর তপস্যায় প্রবৃত্ত হিরণ্যকশিপুর যা সংকল্প, তা আপনার বিদিত আছে, তবুও আমরা নিবেদন করছি, শুনুন। তার মনের অভিপ্রায়– যেমন পরমেষ্ঠ্য ব্রহ্মা বিশ্ব চরাচর সৃষ্টি করে, তপস্যা ও যোগের দ্বারা সত্যলোকাধিষ্ঠান সাধন করব। (ব্রহ্মা দীর্ঘায়ু, দীর্ঘকাল তপস্যা করে যা করেছেন, তা অন্যের পক্ষে দুষ্কর। মানুষ অল্পায়ু, বারবার মৃত্যুমুখে পতিত হয়।) তথাপি কালও নিত্য, আত্মাও নিত্য, এক জন্মে না হয় বহু বহু জন্মের তপস্যার দ্বারা তা সাধন করব। যদি সত্যলোক সাধন করতে না পারি, আমার সামর্থে পাপ-পুণ্যাদির ব্যত্যয় ঘটিয়ে এই জগৎকে বিপর্যস্ত করে ফেলব। অন্য ধ্রুবাদি পদের আমার কোনো প্রয়োজন নেই, আমি সত্যলোকেরই সাধন করব। আপনার পদ হরণ করাই হিরণ্যকশিপুর নিবন্ধ–এটা আমরা শুনেছি। এই জন্যই সে উগ্র তপস্যায় অবস্থিত হয়েছে। আপনি স্বয়ং ত্রিভুবনের ঈশ্বর যা উপযুক্ত মনে করেন, অবিলম্বে তা বিধান করুন। হে ব্রাহ্মণ, আপনার স্থান ভ্রংশ হলে সাধুদের মহৎ অনিষ্ট হবে, কারণ আপনার এই পরমেষ্ঠ্য আসন থেকেই গো ও ব্রাহ্মণদের উদ্ভব, সুখ, ঐশ্বর্য, ক্ষেম (লব্ধবস্তুর পালন) এবং উৎকর্ষে হয়।
হে নৃপ, দেবগণ এই প্রকার জানালে, ভগবান আত্মযোনি (ব্রহ্মা) ভৃগু, দক্ষ প্রভৃতি মুনিবৃন্দে পরিবৃত হয়ে, দৈত্যেশ্বর হিরণ্যকশিপুর আশ্রমে গমন করলেন। প্রথমে ব্রহ্মা তাকে দেখতে পাননি, কারণ সে বল্মীক, তৃণ ও কীচকে আচ্ছন্ন হয়েছিল, আর চারদিকে বহু পিপীলিকা তার ত্বক, মাংস, মেদ ও রক্ত ভক্ষণ করছিল। অনেকক্ষণ পরে তাকে তপস্যার দ্বারা লোকসকল সন্তাপিত করতে দেখলেন। মেঘাচ্ছন্ন সূর্যের মত তাকে দেখে বিস্মিত হয়ে হংসবাহন ব্রহ্মা হাস্য করতে করতে তাকে বললেন– ওহে, কশ্যপনন্দন, উঠ, উঠ, তোমার মঙ্গল হোক, তুমি তপস্যায় সিদ্ধ হয়েছ। আমি বর দিতে এসেছি, তোমার অভিলষিত বর প্রার্থনা কর। তোমার অতি আশ্চর্য ধৈর্য দেখলাম, দংশ–সকলে তোমার সমস্ত দেহ ভক্ষণ করছে, কেবল অস্থিতে প্রাণমাত্র অবশিষ্ট রয়েছে বৎস, পূর্বে কোনো ঋষিগণ, এরূপ তপস্যা করতে পারেননি। পরেও কেউ পারবেন না। জল পর্যন্ত পরিত্যাগ করে দিব্য শত বছর প্রাণ ধারণ করা আর কারও পক্ষে সম্ভব? হে দিতিনন্দন, তোমার এই কার্য মনস্বীগণেরও অতি দুষ্কর, তোমার এই কর্ম আমাকে জয় করেছে, তপোনিষ্ঠার কথা কি তাতে তো জিতই হয়েছি। হে অসুরশ্রেষ্ঠ, তুমি মর্ত হলেও তোমাকে সকল কামনাই প্রদান করব। আমি অমর্ত্য, আমার দর্শন কখনও বিফল হয় না।
শ্রীনারদ বললেন–হে রাজা যুধিষ্ঠির, এই বলে আদিজন্মা ব্রহ্মা অমোঘবল দিব্য কমণ্ডলু হতে জল নিয়ে হিরণ্যকশিপুর পিপীলিকার দ্বারা ভক্ষিত অঙ্গে ছিটিয়ে দিলেন। তৎক্ষণাৎ দৈত্যপতি সর্বাবায়ব সম্পন্ন ও বর্জতুল্য দৃঢ়াঙ্গ হয়ে সামর্থ্য, বল ও তেজের সাথে সেই বল্মীক ও কীচকের মধ্য হতে উত্থিত হলেন। যেমন কাষ্ঠরাশি হতে অগ্নি উত্থিত হয়। পরে তপ্ন কাঞ্চনের তুল্য তার শরীরের প্রভা প্রকাশ পেতে লাগল। তিনি আকাশের দিকে চেয়ে হংসবাহন দেব ব্রহ্মাকে উপস্থিত দেখে আনন্দে উল্লসিত হয়ে ভূমিতে নতমস্তকে প্রণাম করলেন। তারপর উঠে কৃতাঞ্জলিপুটে বিনীতভাবে নয়নের দ্বারা ঐ বিভুকে দেখতে দেখতে গদগদ বাক্যে তার স্তব করতে লাগলেন।
হিরণ্যকশিপু বললেন–যিনি স্বয়ংজ্যোতিঃ কল্পান্তে প্রকৃতির গুণরূপ গাঢ়তমের দ্বারা আবৃত ওই জগৎকে নিজপ্রভাবে প্রকাশ করেছেন এবং যিনি ত্রিগুণ আত্মার দ্বারা ঐ জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়। করছেন, সেই রজঃ, সত্ত্ব ও তমোগুণের আশ্রয় অপরিচ্ছন্ন পরমেশ্বরকে প্রণাম করছি। হে স্বপ্রকাশত্ব, জগৎ প্রকাশকত্ব, তার কারণত্ব, সৃষ্টাদি কার্যের কর্তৃত্ব,মহত্ব ও পরমেশ্বরত্ব–(এই ছয় প্রকার বলে, তা বিকৃত করে প্রণাম করছেন)। সেই আদিপুরুষ জগতের বীজ (কারণ) জ্ঞান ও বিজ্ঞান যার মূর্তি, তাকে নমস্কার করি। প্রাণ, ইন্দ্রিয়, মন বুদ্ধি ইত্যাদি যে সমস্ত বিকার এবং সেই সকল রূপের দ্বারা যিনি কার্য–রূপ হয়ে থাকেন, তাঁকে নমস্কার করছি। প্রভো, আপনি মুখ্য, প্রাণস্বরূপ অর্থাৎ সূত্ৰাত্মরূপে এই সকল স্থাবর জঙ্গমের নিয়ন্তা, অতএব প্রজাদের পতি এবং তাদের চিত্তের, তৎপরিণাম স্বরূপ চেতনার মনের এবং তাদের নিয়মও ইন্দ্রিয়সকলের পতি। আপনি মহান, আকাশাদি ভূত, শব্দাদি বিষয় ও তদ্বাসনাসকলের ঈশ্বর।
এখন যজ্ঞের প্রবর্তক ও অন্তর্যামীরূপে জগতের পালকত্ব বর্ণনা করছেন। আপনার বেদত্রয়রূপ যে মূর্তি, তাহা হোতৃ–চতুষ্টয়–যুক্তকর্ম বিষয়ক বিদ্যাস্বরূপ, সেই বেদময় শরীরের দ্বারা আপনি অগ্নিষ্টোমাদি বিবিধ যাগ যজ্ঞের বিস্তার করে থাকেন। আপনিই প্রাণীদের আত্মা, তাদের অন্তরাত্মা অর্থাৎ অন্তর্যামীও আপনিই। যেহেতু আপনি সর্বজ্ঞ, অখণ্ড এবং অনাদি। আপনার কালবশতঃ অন্ত (বিনাশ) ও দেশতঃ পরিচ্ছদ নেই। আপনিই কালস্বরূপ, অতএব আপনি নিমেষশূন্য হয়ে ক্ষণকালাবধি অবয়ব দ্বারা জনগণের আয়ু ক্ষয় করে থাকেন। কিন্তু এরূপ সৃষ্ট্যাদি কর্তৃত্ব থাকলেও আপনি নির্বিকার, যেহেতু আপনি আত্মা (জ্ঞানরূপ), পরমেষ্ঠী (পরমেশ্বর)। অজ (জন্মশুন্য) এবং মহান (অপরিচ্ছিন্ন) এই জীবলোক কর্মবশতঃ বিকার প্রাপ্ত হয়, আপনি তার জীবনহেতু এবং তার আত্মা।
আপনা হতে পর (কারণ) ও অপর (কার্য) স্থাবর জঙ্গম কিছুই নেই। আপনি ছাড়া অন্য শব্দাদিও নেই, যেহেতু বেদ উপবেদ প্রভৃতি যে সকল কলা (বেদাঙ্গ) সে সকল আপনারই শরীর। আপনি হিরণ্যগর্ভ, হিরণ্যরূপ ব্রহ্মাণ্ড আপনার উদরে বর্তমান এবং আপনি ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতির পৃষ্ঠে অবস্থিত, অতএব আপনিই বৃহৎ ব্রহ্মা। হে বিভো, এই ব্রহ্মাণ্ড আপনার স্কুল শরীর সত্য এবং এই শরীর দ্বারা আপনি ইন্দ্রিয়, প্রাণ ও মনের বিষয়সকল ভোগ করে থাকেন, এটাও সত্য, কিন্তু আপনি সর্বদা পরমেশ্বর স্বরূপে অবস্থিত আছেন। ঐরূপে অবস্থিত থেকেই ঐ সকল ভোগ করেন অতএব আপনি নিরুপাধি ব্রহ্ম এবং পুরাণ পুরুষ।
হে অনন্ত, আপনি মন ও বাক্যের অগোচর রূপের দ্বারা এই অখিল বিশ্ব ব্যাপ্ত করেছেন, সেই অনন্ত ঐশ্বর্যযুক্ত ভগবান আপনাকে নমস্কার। আপনি চিৎশক্তি (বিদ্যা) এবং অচিৎ শক্তি (মায়া) উভয়ে মিলিত। হে বরদোত্তম, আপনি যদি আমার অভিলাষিত বর দিতে চান, তবে এই বর দিন আপনার সৃষ্ট কোন প্রাণী হতে যেন আমার মৃত্যু না হয়। আর, অভ্যন্তরে বা বহির্ভাগে, দিনে বা রাতে আপনার সৃষ্ট ভিন্ন অন্য হতেও যেন আমার মৃত্যু না হয়। সেরূপ নর কিংবা মৃগ (পশু) –দ্বারা। আমার যেন মৃত্যু না হয়। আমি যেন ভূমিতে বা আকাশেও না মরি, অপ্রাণ অথবা সপ্রাণ কিংবা দেবতা, অসুর, মহারথ–এ সকল হতেও যেন আমার মৃত্যু না হয়। নিজে অমর হতে ইচ্ছা করে আরও বর প্রার্থনা করছেন–যুদ্ধে প্রতিপক্ষ শূন্যত্ব এবং সকল দেহীর উপর একাধিপতিত্ব, সেরূপ সকল লোকপালের মাহাত্ম্য যা যা আপনার আছে, আমাকে সে সকলও দিন। তপস্যা ও যোগের দ্বারা যাদের প্রভাব জন্মে তাদের যে অণিমাদি ঐশ্বর্য, যা কখনও বিনষ্ট হয় না, তাও কৃপাপূর্বক আমাকে প্রদান করুন।
.
চতুর্থ অধ্যায়
বিষ্ণুদ্বেষী হিরণ্যকশিপু কর্তৃক লোকপালদের উপর অত্যাচার
শ্রীনারদ বললেন–হিরণ্যকশিপুর তীব্র তপস্যায় প্রীত হয়ে ব্রহ্মা তার প্রার্থনানুযায়ী দেবদুর্লভ বর প্রদান করলেন। ব্রহ্মা বললেন–তাত, তুমি আমার নিকট যে সকল বর প্রার্থনা করেছ, তা পুরুষদের দুর্লভ। হে দৈত্যেন্দ্র, যদিও ঐ সকল বর অত্যন্ত দুর্লভ, তথাপি আমি তোমাকে তা দিচ্ছি। ভগবান ব্রহ্মার অনুগ্রহ অমোঘ, তিনি ঐ প্রকার বর দিয়ে অসুরশ্রেষ্ঠ হিরণ্যকশিপুর দ্বারা পূজিত এবং প্রজেশ্বরগণের দ্বারা স্থূয়মান হয়ে নিজধামে গমন করলেন। এদিকে হিরণ্যকশিপু ঐ প্রকার বর পেয়ে স্বর্ণময় দেহ ধারণ করলেন এবং ভ্রাতৃবধ স্মরণ করে ভগবানের প্রতি দ্বেষ করতে আরম্ভ করলেন। ঐ মহান অসুর, সমস্ত দিক্, তিন লোক, দেবতা, অসুর, নরপতি, গন্ধর্ব গরুড়, উরগ, সিদ্ধ, চারণ, বিদ্যাধর, ঋষি, পিতৃপতি, মনু, যক্ষ, রাক্ষস, পিশাচগণের ঈশ্বর, প্রেত পতি, ভূতপতি এবং অন্যান্য সকল প্রাণীর যে যে অধিপতি, তাদের জয় করে নিজের বশবর্তী করলেন। ঐ প্রকারে বিশ্বজয়ী হয়ে পরে তেজের সহিত লোকপালদের স্থান হরণ করে নিলেন।
তারপর হিরণ্যকশিপু দেবোদ্যানের শোভায় সুশোভিত স্বর্গে গিয়ে, বিশ্বকর্মার দ্বারা নির্মিত, ত্রৈলোক্য লক্ষ্মীর পতি আশ্রয়স্থল ও সকল প্রকার সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ ইন্দ্রভবনে বাস করতে লাগান। সেখানকার সোপানগুলি বিদ্রুম (প্রবাল) নির্মিত, ভূমি–মহামূল্য মরকত, ময় (পান্না), ভিত্তি সকল স্ফটিক–রচিত এবং স্তম্ভগুলি বৈদূর্যমনির দ্বারা নির্মিত। সেখানে বিচিত্র চন্দ্রাতপ, আসনগুলি পদ্মরাগ মণির দ্বারা রঞ্জিত, শয্যাসকল দুগ্ধফেনতুল্য এবং মুক্তাদাম তাদের পরিচ্ছদ। সেখানে শব্দায়মান নুপূরের দ্বারা শব্দ করত শোভনদশনা দেবরমণীগণ ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করতে করতে রত্নস্থলীসকলে নিজেদের সুন্দর বদন দর্শন করে থাকেন। সেই মহেন্দ্র ভবনে মহাবলী হিরণ্যকশিপু ত্রিভুবন জয় করে একাধিপতি হয়ে বিহার করতে লাগলেন। দেব প্রভৃতি সকল প্রাণী তার প্রতাপে সন্ত্রস্ত হয়ে নিরন্তর তার পদযুগলের বন্দনায় নিযুক্ত ছিলেন, তথাপি তার প্রচণ্ড শাসন দিন দিন বেড়ে চলতে লাগল। হে রাজন, দৈত্যরাজ উগ্রগন্ধ সুরা পান করে সব সময় মত্ত হয়ে থাকতেন, এজন্য তার চোখ দুটি ঘূর্ণিত হয়ে থাকত। তিনি তপস্যা,যোগবল ও সাহসের আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর ব্যতীত সকল লোকপালগণ উপায়ন হস্তে তার উপাসনা করতে লাগলেন।
হে পাণ্ডব, হিরণ্যকশিপু নিজ বীর্যে ইন্দ্রাসনে অধ্যাসীন হলে, বিশ্বাবসু, তুম্বুরু, আমি (নারদ) প্রভৃতি সকল গন্ধর্ব, সিদ্ধ, বিদ্যাধর ও অপ্সরাগণকে তার নিকট সঙ্গীত পরিবেশন করতে হত। আর, ঋষিগণ বার বার তার স্তব করতেন। সেই দৈত্য নিজের তেজে বর্ণশিষ্য-যুক্ত ব্যক্তিগণের অনুষ্ঠিত বহু দক্ষিণ অযুক্ত যজ্ঞের হবির ভাগ গ্রহণ করতে লাগল। তার প্রভাবে সপ্তদ্বীপবতী ভূমি বিনা কর্ষণে বিবিধ শস্য প্রসব করতে লাগল। গাভীগণ তার অভিলাষ অনুসারে দুধ দিতে লাগল, আর আকাশ মণ্ডল নানা আশ্চর্যের আস্পদ হয়ে উঠল। লবণ, ইক্ষু, সুরা, ঘৃত, দুগ্ধ এবং অমৃত জলযুক্ত রত্ন দ্রব্যসকল এবং তাদের পত্নী নদীসমূহ তরঙ্গের সাথে রাশি রাশি রত্ন বহন করে দিতে লাগল। গহ্বর-সহ পর্বতসকল তার ক্রীড়াস্থান হল এবং তরুগণ তার জন্য সকল ঋতুতে নিজ নিজ জুন (অর্থাৎ পুষ্প কলাদি) ধারণ করল। সে একাকীই সকল লোকপালদের গুণ (বর্ষণ, দহন ও শোষণাদি) ধারণ করল।
হে পাণ্ডবেয়, অজিতেন্দ্রিয় সেই দানব এই প্রকার সকল দিক্ জয় করে একাই ধনপতি হয়ে যদৃচ্ছাক্রমে ভোগ করেও পরিতৃপ্ত হতে পারেনি। এই প্রকারে শাস্ত্রমর্যাদা লঙঘনকারী ঐশ্বর্যমত্ত, গর্বিত (সনকাদি) ব্রাহ্মণজনের দ্বারা শাপগ্রস্ত সেই দৈত্যের সুমহৎ কাল অতিক্রান্ত হল। ঐ দানবের উগ্রদন্তে লোকপালের সহিত সমস্ত লোক উদ্বিগ্ন হয়ে অন্য কোনও আশ্রয় না পেয়ে ভগবান অচ্যুতের স্মরণ গ্রহণ করে প্রার্থনা করলেন। সেই দিকের প্রতি শত শত নমস্কার, যেখানে স্বয়ং আত্মা ঈশ্বরও বর্তমান। নির্মল শান্ত সন্ন্যাসিগণ যেখানে গিয়ে আর নিবৃত্ত হন না। এজন্য ঐ সকল নির্মল লোকপালগণ, সমাহিত চিত্ত ও সংযতাত্মা হয়ে নিদ্রা পরিত্যাগ পূর্বক বায়ুক্ষেত্রে ভোজন করত সেই হৃষীকেশের উপাসনা করতে লাগলেন।
এইরূপে লোকপালগণ কিছু কাল ভগবানের উপাসনা করতে থাকলে, তাদের উদ্দেশে বক্তৃরহিতা সোদর ধ্বনির মত অশরীরী ধ্বনী আবির্ভূত হল। ঐ ধ্বনি এরূপ গম্ভীর যে তার দ্বারা দিক্সকল প্রতিধ্বনিত হল এবং তা যেন সাধুদের অভয় দান করতে লাগল। ঐ বাণী এরূপ– হে বিপ্র শ্রেষ্ঠ, তোমরা ভীত হয়ো না, তোমাদের মঙ্গল হোক। যেহেতু আমার দর্শন সকল প্রকার কল্যাণের জন্যই হয়ে থাকে। এই দৈত্যপতির দৌরাত্ম আমার জ্ঞাত, আমি তার শাস্তি বিধান করব, তোমরা কিছু কাল প্রতীক্ষা কর। যখন দেবে, বেদে, জোমকলে, ব্রাহ্মণে, সাধুতে ও আমার্তে কেশ ব্যক্তির বিদ্বেষ হয়। তখন সে শীঘ্রই বিনাশপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। যদিও হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার বরে তেজস্বী। তথাপি যখন সে নির্মল, প্রশান্ত, মহাত্মা, নিজপুত্র প্রহ্লাদের প্রতি দ্রোহাচরণ করবে, তখন আমি তাকে বধ করব। (কারণ–আমি সব কিছু সহ্য করি, কিন্তু আমার ভক্তের প্রতি দ্রোহ কখনও সহ্য করি।)
শ্রীনারদ বললেন–লোকগুরু ভগবান এইরূপ বললেন, স্বর্গবাসী দেবগণ নিরুদ্দেশ হয়ে নিজ নিজ স্থানে চলে গেলেন। তারা মনে করলেন–হিরণ্যকশিপুর বিনাশের আর বিলম্ব নেই, (কারণ ভগবদ্ভক্ত প্রহ্লাদের প্রতি তার বিদ্বেষভাব প্রবৃত্ত হয়েছে)। হে রাজ, সেই দৈত্যপতির পরম অদ্ভুত চারটি পুত্র ছিল। তাদের মধ্যে প্রহ্লাদ জ্ঞানের দ্বারা মহান ছিলেন। তিনি মহতের উপাসক, জিতেন্দ্রিয়, সুশীল, ব্রহ্মণ্য ও সত্য প্রতিজ্ঞ ছিলেন। সকল প্রাণীর নিকট আত্মার মত অতিকায় প্রিয় ও সুহাত্তম ছিলেন। আর দাসের ন্যায় মান্যজনের প্রতি প্রণত হতেন এবং দীনজনে পিতার ন্যায় বাৎসল্য প্রকাশ করতেন। সমান ব্যক্তির প্রতি স্নেহ এবং (ভগবন্মন্ত্রোপদেষ্ঠা) শ্রীগুরুদেবের প্রতি ঈশ্বর বুদ্ধি করতেন। তিনি বিদ্যা, ধন, রূপ ও আভিজাত্য সম্পন্ন ছিলেন, কিন্তু তার জন্য অহংকার বা অভিমান করতেন না।
বিপদে তার চিত্ত উদ্বিগ্ন হত না, তিনি দৃষ্ট ও প্রভুত্ব এক বিষয়ে অরম্ভ দেখতেন (অর্থাৎ এসকল বিষয়ে তার কোন প্রয়োজন বৃদ্ধি ছিল না)। এজন্য ঐ সকল বিষয়ে কোন স্পৃহা ছিল না। তার শরীর, ইন্দ্রিয়, প্রাণ, বুদ্ধি সংযত এবং কামনা প্রশান্ত ছিল। যদিও তিনি অসুরকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তথাপি অসুর ভাব (মাৎসবাদি) ছিল না। হে রাজন, তাঁর মহৎগুণ সকল জ্ঞানীদের বার বার গ্রহণ করতেন। ভগবান ঈশ্বরে যেমন গুণ সকল নিত্য বর্তমান থাকে, তেমনি প্রহ্লাদে ঐ সকল গুণ আজও তিরোহিত হয় নি। হে নৃপ, শত্রু হয়েও দেবগণ নিজেদের সভায় সাধু-কথা প্রসঙ্গে প্রহ্লাদের দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকেন, আর তোমাদের মত লোকের কথা কি বলব? হে রাজন, ভগবান বাসুদেবের তাঁর স্বাভাবিক মতি, তার অসংখ্য জুক্ষের গণনা করে কার সাধ্য, আমি কেবল তার মাহাত্মের সূচনা করলাম।
হে মহারাজ, প্রহাদের ভগবানের প্রতি নৈর্সজেকী রতির নিদর্শন এই যে–তিনি বাল্যকালেই ব্রীড়া পরিত্যাগপূর্বক ভগবানের একচিত্ত হয়ে জড়ের মত থাকতেন (অর্থাৎ লোকে তাকে জড় বলে মনে করত)। কৃষ্ণরূপ গ্রহের দ্বারা তার মন গৃহীত হওয়ায় জগৎ কিরূপ তা জানতেন না। (অর্থাৎ কোন গ্রহ যেমন লভ্য বস্তু গ্রহণ করে, তেমনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণই ভক্ত প্রহ্লাদের মন আকর্ষণ করে নিয়েছিলেন। কৃষ্ণমনা প্রহ্লাদ ব্যবহারময় জগৎ জানতেন না বটে, কিন্তু সর্বত্র কৃষ্ণময় জগৎ দেখতেন)। সব সময় গোবিন্দ কর্তৃক আলিঙ্গিত হওয়ায় (অর্থাৎ আত্মরূপী ভগবানের সাথে একীভূত থাকায়) তিনি উপবেশন, পর্যটন, ভোজন, পান ও কথা বলার সময়–ঐ সকল কর্মের কখনও অনুসন্ধান করতেন না। ভগবান বৈকুন্ঠের চিন্তায় যখন তার চিত্ত (বিরহে) ক্ষুব্ধ হত, তখন রোদন করতেন, আবার কখন ভগবানের চিন্তায় আনন্দে হাস্য করতেন, কখন বা গান করতেন। কখন মুক্ত কণ্ঠ হয়ে শব্দ করতেন, কখন বিলজ্জ হয়ে নৃত্য করতেন, আবার কখন ভগবানের ভাবনায় অতিনিবিষ্ট হওয়ায় তন্ময় হয়ে তার চেষ্টাদির (ভগবানের লীলার) অনুকরণ করতেন।
কখন ভগবানের ভাব প্রাপ্তির দ্বারা নির্বত ও পুলকিত হয়ে স্থির হয়ে থাকতেন। কখন স্থিরতর প্রমথ আনন্দ হেতু তার নয়নদ্বয় সজল হয়ে ঈষৎ নিমীলিত হত। প্রহ্লাদ অকিঞ্চন ভগবদ্ভক্তজনের সঙ্গবশতঃ উত্তমঃ শ্লোক ভগবানের চরণকমলের সেবা লাভ করে। মুহুর্মুহু পরম আনন্দ বিস্তরাকরতঃ এইসঙ্গ অন্যান্য দীনজনেরও মন শান্ত করতেন। দূরসঙ্গী অন্যান্য খেলার সাথীদের মনকেও ভাবন্নিষ্ঠ করেছিলেন হে রাজন মহাভাগবৎ, মহাভাগ্যবান, মহাত্মা তাদৃশ নিজ পুত্র প্রহ্লাদের প্রতিও হিরণ্যকশিপু দ্রোহ আচরণ করতে লাগলেন।
শ্ৰী যুধিষ্ঠির বললেন–হে দেবর্ষে, হে সুব্রত, হিরণ্যকশিপু পাপী হয়ে, সেইরূপ শুদ্ধচিত্ত পুত্রের প্রতিও দ্রোহ করেছিল। এ আশ্চর্যের বিষয় আপনার নিকট হতে বিস্তৃত জানবার ইচ্ছা করি। পুত্র বৎসল পিতৃগণ উর্দুপথ গামী পুত্রদের শিক্ষার জন্য তিরষ্কার করে থাকেন, কিন্তু শত্রুর মত কখনও অনিষ্ট চেষ্টা করেন না। যে সকল পুত্র প্রহ্লাদের মত অনুকূল (বশ্যতাপন্ন), সাধু, অগাধ বোধসম্পন্ন এবং যারা পিতাকে পরম দেবতা বোধ করেন, তাদের প্রতি পিতা অনিষ্ট চেষ্টা করবেন–এটা কি করে সম্ভবপর? হে ব্ৰহ্মণ, পুত্রের প্রতি পিতার এমন বিদ্বেষ হল, যা পুত্রের মরণের জন্য প্রবর্তিত হয়েছিল। অথবা পুত্রের প্রতি বিদ্বেষ পিতার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল –এ বিষয়ে আমাদের মহৎ কৌতূহল আপনি নিবৃত্ত করুন।
.
পঞ্চম অধ্যায়
প্রহ্লাদের বিষ্ণুস্তবে মতি দেখে হিরণ্যকশিপুর প্রহ্লাদ বধের প্রয়াস
শ্রীনারদ বললেন–হে রাজন, অসুরগণ ভগবান শুক্রাচার্যকে পৌরোহিত্য পদে বরণ করেছিল। তার শন্তু অমর্ক নাম্নে দুটি পুত্র দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর গৃহের নিকটে বাস করতেন। দৈত্যপতি তার শিশুপুত্র নীতিনিপুণ প্রহ্লাদকে দণ্ডনীতি প্রভৃতি শিক্ষার জন্য তাদের নিকট পাঠালেন। তারা প্রহ্লাদকে ও অন্যান্য বালকদের পাঠ্য বিষয়সমূহ পড়াতেন। গুরু যা শিক্ষা দিতেন, প্রহ্লাদ তা শুনতেন এবং তারপর তা পড়তেনও, কিন্তু ঐ সকল উপদেশের মধ্যে এ আত্মীয়, এর পর — এ সকল আশ্রয় করে থাকায়, তা উত্তম বলে মনে করতে পারলেন না। হে পাণ্ডব শ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির, একদিন দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর নিজ পুত্র প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–বৎস, বলত তুমি কি ভাল মনে কর? প্রহ্লাদ বললেন– হে অসুরবর্গ, ‘আমি, আমার” ইত্যাদি মিথ্যা অভিনিবেশ হেতু মানুষ সব সময়। উদ্বিগ্ন। অতএব আত্মার অধঃপাতের নিমিত্ত রূপ, অন্ধকূপ তুল্য মোহবহ গৃহ পরিত্যাগ করে, বনে গিয়ে শ্রীহরির আশ্রয় গ্রহণই আমি উত্তম বলে মনে করি। দেবর্ষি নারদ বললেন–হে রাজন, হিরণ্যকশিপু নিজ পুত্রের মুখে নিজের শত্রু বিষ্ণুর প্রতি ভক্তি প্রকাশক ঐ সকল কথা শুনে হাস্য করলেন। তারপর বললেন–এই প্রকারেই বালকদের বুদ্ধি পরবুদ্ধিতে নষ্ট হয়ে থাকে। এই বালককে এখন গুরুগৃহে নিয়ে যাক্। ব্রাহ্মণগণ যত্নপূর্বক এর রক্ষণাবেক্ষণ করুক যাতে ছদ্মবেশী বিষ্ণু পক্ষাশ্রিত কারোর বুদ্ধিভেদ জন্মাতে না পারে।
তারপর প্রহ্লাদকে গুরুগৃহে নিয়ে গেলে, দৈত্যজনগণ প্রথমে তার প্রশংসা করে, পরে কোমল বচনে সান্ত্বনাপূর্বক জিজ্ঞাসা করলেন। বৎস প্রহাদ, তোমার মঙ্গল হোক সত্য বল, মিথ্যা বলো না। এখানে যে সকল বালক রয়েছে তাদের অতিক্রম করে, তোমার এইরূপ বুদ্ধির বিপর্যয় কোথা হতে হল? তোমার এ বুদ্ধি ভেদ পরের দ্বারা হয়েছে। অথবা নিজে হতে জন্মেছে, হে কুলনন্দন, আমি তোমার গুরু, আমাদের এ বিষয়ে শুনতে ইচ্ছা হয়েছে, যথার্থ বল।
প্রহ্লাদ বললেন–যে ভগবানের মায়ার দ্বারা আত্মস্বরূপের বিস্মৃতিবশতঃ দেহাদিতে আত্মবুদ্ধির ফলে, যাদের বুদ্ধি বিমোহিত হয়ে নিজ এবং পর’ এরূপ অসৎ বস্তুতে আগ্রহ জন্মে, সেই অচিন্ত্য মায়ার অধিশ্বর ভগবানকে নমস্কার করি। সেই ভগবান যখন কারও প্রতি অনুকূল হন, সাধারণ লোকেরই পশুবুদ্ধি (ভেদবুদ্ধি) দূর হয়ে যায়। সেই বুদ্ধি ‘এটা অন্য আমি অন্য’ এরূপ ভেদ জন্মায় বলে, তা মিথ্যা। নির্বুদ্ধি লোক সেই পরমাত্মাকেই আত্মীয় ও পর’ বলে নিরূপণ করে থাকে। তাদের এরূপ করা অসঙ্গত নয়, যেহেতু ব্ৰহ্মাদিও তাঁকে জানতে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে থাকেন। কারণ তার বর্ণন দুটি। হে ব্ৰহ্মণ, তিনিই আমার বুদ্ধিভেদ করছেন, তিনি নির্বিকার, কারও বুদ্ধিভেদ করেন না। তথাপি লৌহ যেমন অয়স্কান্ত খনির (চুম্বকের) সন্নিধানে স্বয়ং ভ্রমণ করে তেমনি চক্রপাণির যাদৃচ্ছিক সন্নিধানই আমার চিত্ত আপনা হতেই এরূপ ভেদ-প্রাপ্ত হয়েছে। (চুম্বকের স্বভাবই হল নিজের শক্তিতে লৌহকে আকর্ষণ করে সংযুক্ত করা। সেখানে কোন কারণ বা প্রয়োজন নাই। তেমনি ভগবান চক্রপাণির স্বভাবই হচ্ছে কৃপা পরবশ হয়ে নিজভক্তের চিত্তকে নিজেতে আকর্ষণ করা–এতে আমার কি স্বাতন্ত্র আছে?)।
নারদ বললেন–মহামতি প্রহ্লাদ ব্রাহ্মণকে এরূপ বলে বিরত হলেন। তা শুনে সুদীন রাজসেবক (অর্থাৎ প্রহ্লাদের শিক্ষক) অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে তিরস্কার করে বলতে লাগলেন। আর বেত আনত এ আমাদের নিন্দার কারণ, এ কুলাঙ্গার অতিশয় দুর্বুদ্ধি একর প্রতি (সাম, দান, ভেদ, দণ্ড এই উপায়ের মধ্যে) চতুর্থ দণ্ডবিধানই একমাত্র উপায়। দানবরূপ চন্দনবনে এ একটি কন্টক-বৃক্ষ হয়ে জন্মেছে। প্রহ্লাদের আচার্য এইভাবে তর্জনাদি বিবিধ উপায়ে ভয় দেখিয়ে আবার কিছুকাল ধর্ম, অর্থ, কাম–এই ত্রিবর্গের প্রতিপালন শাস্ত্র পাঠ করালেন।
তারপর গুরু যখন জানতে পারলেন, এই বালকের সাম–দানদি জ্ঞাতব্য উপায় চতুষ্টয় জানা হয়েছে, তখন তাকে রাজগৃহে নিয়ে এলেন। সেখানে প্রহ্লাদের জননী স্নান করিয়ে অলংকৃত করে দিলে, দৈত্যপতির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ করালেন। পিতার নিকট গিয়ে প্রণামের জন্য চরণে পতিত হলে দৈত্যপতি হিরণ্যকশিপু আর্শীবাদ করে দুই বাহুর দ্বারা আলিঙ্গন করে আসঙ্গ অনুভব করলেন। তারপর কোলে তুলে নিয়ে শিরম্বনপূর্বক অশ্রুজলে অভিষেক করতে করতে প্রফুল্ল বদনে জিজ্ঞাসা করলেন–বৎস, এতদিনে গুরুগৃহে আচার্য যা যা শিক্ষা করালেন, তার মধ্যে যেটা উত্তম, তার কিছুটা শোনাও তো।
প্রহ্লাদ বললেন– পিতঃ, শ্রবণ, কীর্তন, বিষ্ণুর স্মরণ, পাদসেবন (পরিচর্যা), অৰ্চন (পূজা), বন্দন, দাস্য (কর্মাপন), সখ্য (তার বিশ্বাস উৎপাদন) এবং আত্মনিবেদন (দেহ সমর্পণ অর্থাৎ যেমন বিক্রিত গো, অশ্বাদি পশু ভরণ — পালনাদির চিন্তা করে না, সেরূপ ভগবান দেহাদি সমর্পণ করে ভরণ পোষণের চিন্তাও পরিত্যাগ কর্তব্য।) — এই নব লক্ষণ বিশিষ্ট ভক্তি অধীত ব্যক্তি যদি ভগবান বিষ্ণুতে সমর্পণপূর্বক অনুষ্ঠান করেন, আমরা মনে হয় তাহাই উত্তম অধ্যয়ন। কিন্তু আমাদের গুরুর নিকট সেরূপ অধ্যয়ন কিছুই নেই)। পুত্রের এরূপ কথা শুনে ক্রোধে কম্পিত অধর হয়ে হিরণ্যকশিপু গুরুপুত্রকে বললেন–ওহে দুর্মতি ব্রহ্মবন্ধন, এ কি? আমাকে অনাদর করে আমার বিপক্ষের পক্ষ আশ্রয় করতে এ বালককে শিক্ষা দিয়েছ? এ জগতে অনেক ছদ্ম বেশধারী অসাধু লোক মিত্রতার ভান করে থাকে। কালক্রমে যেমন পাতকিদের রোগ প্রকাশ পায়, তেমনি তাদের পাপকর্ম (বিদ্বেষাদি) কালে প্রকট হয়ে থাকে।
এই সকল কথা শুনে গুরুপুত্র ভয়ে কল্পিত কলেবর হয়ে নিবেদন করল– হে দৈত্যরাজ, আপনার পুত্র যে বাক্য বলল, তা আমরা শেখাই নি, কিংবা অন্য কোন ব্যক্তিও শেখায় নি। এই বালকের স্বাভাবিক এরূপ বুদ্ধি। হে শত্রো, ক্রোধ সংবরণ করুন। আমাদের প্রতি অনর্থক দোষারোপ করবেন না। শ্রীনারদ বললেন–হিরণ্যকশিপু পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন —-এই অভদ্র মতি যদি গুরুপদেশে জন্মেনি, তবে কোথা থেকে ঐ বুদ্ধি পেয়েছ, বল।
প্রহ্লাদ বললেন–পিতঃ তোমাদের মত বিষয়াসক্ত ব্যক্তির কথা দূর থাক্, যে সকল ব্যক্তি গৃহাসক্ত, তাদের বুদ্ধি গুরু হতে অথবা আপনা হতে কিংবা পরস্পর হতে কোন প্রকারেই কৃষ্ণোমতি সম্পন্ন হয় না। তারা অজিতেন্দ্রিয়, দুর্দমনীয় ইন্দ্রিয়ের আসক্তির ফলেই বারংবার সংসারে প্রবেশ করে। তাতে তাদের চর্বিত বিষয়েরই পুনরায় চর্বণ হয়ে থাকে। আর যে সকল ব্যক্তি দুরাশয় (অর্থাৎ যাদের চিত্ত বিষয়েই আসক্ত), তারা ভগবান বিষ্ণুকে জানতে পারে না। যাদের স্বার্থবুদ্ধি রয়েছে, তারাই কেবল ভগবানকে জানতে পারে। বিষয়াসক্ত ব্যক্তিগণ গুরুপদেশ হতেও তাকে জানতে পারে না, অন্ধের দ্বারা সাহায্য প্রাপ্ত অন্ধ যেমন পথ দেখতে পায় না, বরং বিপথে গিয়ে গর্তেই পতিত হয়, তার মত গুরুপদেশ দ্বারা বেদরূপ যে দীর্ঘরজু, যাতে ব্রাহ্মণাদি নাম রূপ বিস্তর বস্তু রয়েছে, তাতে ভুরি ভুরি কাম্য কর্মের দ্বারা বদ্ধই হয়ে থাকে। যদিও এক বিষ্ণু সকল প্রাণীতে গূঢ়, সর্বব্যাপী এবং সর্বভূতের অন্তর্যামী সত্য।
নিষ্কিঞ্চন অর্থাৎ বিষয়াভিমান শূন্য মহত্তম পুরুষদের পদধূলির দ্বারা যাবৎ অভিষিক্ত না হয়, তাবৎ বেদবাক্যের দ্বারা ওইরূপ বিষ্ণু জ্ঞাত হলেও গৃহাসক্ত পুরুষের মতি ভগবানের চরণ স্পর্শ করতে পারে না। অধিকন্তু অসম্ভাবনাদির দ্বারা ব্যাহত হয়। অনর্থ অর্থাৎ সংসারের অপগমের জন্য যে চরণস্পর্শী মতির প্রয়োজন, তা মহতের অনুগ্রহের অভাব, তাদের তত্ত্ব নিশ্চয় কিংবা মোক্ষও হয় না। প্রহ্লাদ এই প্রকার বলে বিরত হলে, হিরণ্যকশিপু ক্রোধান্ত হয়ে ক্রোড় হতে তাকে ভূতলে ফেলে দিলেন। অসহ্য রোষে আবিষ্ট হওয়ায় দৈত্যপতির চোখ দুটি তাম্রবর্ণ হল। তিনি বললেন–ওহে অসুরগণ, এ বালক আমার বধের যোগ্য, একে শীঘ্রই বধ কর, এখুনি এখান থেকে দূর করে দাও। এ আমার সেই ভ্রাতৃহন্তা এর আত্মীয় ও সুহৃৎ। আমাদের পরিত্যাগ করে এ অধম পিতৃব্যহন্তা বিষ্ণুর চরণ (রাজপুত্র হয়ে) দাসের মতো অর্চন করে। অতএব এ দুষ্ট পিতৃব্যঘাতীর পক্ষপাতী হওয়ায় আমাদের বধ্য। কি আশ্চর্য, অবিশস্ত এ অধমকে বিষ্ণুই বা কি করে গ্রহণ করেছে? এ দুরাত্মা তারই বা কি ভালো করবে? যে পাঁচ বছর বয়সে মাতাপিতার দুস্ত্যজ স্নেহ পরিত্যাগ করেছে, এমন ব্যক্তি কি বিশ্বাসের যোগ্য হতে পারে? (যদি বল, ও তোমার পুত্র। এ কি করে বধ্য হতে পারে? তার উত্তরে বলছেন)–শত্রুও যদি ঔষধের মতো হিতকারী হয়, তাহলে সেই পুত্রের মতো, আর নিজের আত্মজ পুত্ৰও যদি অহিতকারী হয় তাকে মমতার কথা দূরে থাক, রোগের মতো সে পরিত্যজ্য। নিজের কর চরণাদি কোনো অঙ্গ যদি রোগাদির দ্বারা দূষিত হয় তার ছেদন করা কর্তব্য। কারণ তার পরিত্যাগে অবশিষ্ট অঙ্গসকল সুখে জীবন ধারণ করতে পারে। অতএব ভোজন, শয়ন ও আসনে বিষাদি প্রয়োগপূর্বক বিবিধ উপায়ের দ্বারা, এ পামরের বধের চেষ্টা কর। দুষ্ট ইন্দ্রিয় যেমন মুনিদের পরম শত্রু, এমনি সুহৃদের চিহ্নধারী এ দুষ্ট আমার শত্রু, অতএব একে উপেক্ষা করা যায় না।
ওই সকল অসুরের তীক্ষ্ণ দন্ত, করাল বদন, শ্মশ্রু ও কেশ তাম্রবর্ণ। তারা প্রভুর আদেশ পাওয়া মাত্র, শূল-হস্তে ভয়ংকর সিংহনাদ করতে করতে এবং মার মার, কাট কাট’–এরূপ বলতে বলতে উপবিষ্ট প্রহ্লাদের মর্মস্থলে শূল দিয়ে আঘাত করতে লাগল। কিন্তু প্রহ্লাদের মন ঈশ্বরে সমাহিত থাকায় তার উপর অসুরদের প্রহার বিফল হল। যেমন অপুণ্য ব্যক্তির সৎ ক্রিয়ার ফল নিষ্ফল হয়ে থাকে। কারণ ঈশ্বর নির্বিকার অনিদেশ্য অর্থাৎ শলাদির অগোচর, নিরতিশয় ঐশ্বর্যশালী এবং নিয়ন্তা, তাতে যাঁর চিত্ত সমাহিত থাকে তাকে অন্য বিষয় স্পর্শ করতে পারে না। হে যুধিষ্ঠির। সকলের ওই সকল প্রয়াস বিফল হলে, হিরণ্যকশিপুর অতিশয় শঙ্কা জন্মাল। তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে প্রহ্লাদের বধের জন্য বহু উপায় করতে প্রবৃত্ত হলেন।
দিগহস্তী, সর্প, অভিচারিক ক্রিয়া, পর্বতশৃঙ্গ হতে প্রক্ষেপ, মায়া, গর্তাদিতে নিক্ষেপ, বিষদান, অনাহারে রাখা, হিম, বায়ু, অগ্নি, জল, পর্বতে ক্ষেপণ–এ সকলও যখন সেই নিষ্পাপ পুত্রের প্রাণবধ করতে সমর্থ হল না এবং নিজেও কোনো প্রকারে তার বিনাশ করতে পারলেন না, তখন তার দীর্ঘ চিন্তা উপস্থিত হল। হিরণ্যকশিপু মনে মনে ভাবলেন, একে বহু কঠোর বাক্যে বলেছি এবং এর বধের জন্য বহু অসৎ উপায় অবলম্বন করেছি, কিন্তু এ নিজের তেজেই সকল দ্রোহাচরণ ও অপকার থেকে নিস্তার পেয়েছে। কি আশ্চর্য! আমার অদূরে বর্তমান থেকে এবং বালক হয়েও এরূপ নির্ভয় চিত্ত। এ কখন আমার শত্ৰুত্ব ভুলতে পারবে না, যেমন শুনঃশেফ তার মাতা-পিতার অপকার ভুলতে পারেনি। (অজগতের মধ্য পুত্র শুনঃশেফ মাতাপিতা কর্তৃক রাজা হরিশ্চন্দ্রের নিকট বিক্রীত হয়ে, সে পিতার অপকার স্মরণ করে তার বিপক্ষ বিশ্বামিত্রের আশ্রয় নিয়ে গোত্রান্তর প্রাপ্ত হয়েছিল)। কিংবা শত্রুতাই এর স্বভাব। কুকুরের লেজের বক্রতার মতো স্বভাব দুষ্পরিহার্য। যা হোক এর অনুভব অপরিমেয়, কোথা থেকেও এর ভয় নেই এবং এ অমর-এর সঙ্গে বিরোধে আমারই মৃত্যু হবে না কি?
এ প্রকার দুশ্চিন্তায় দৈত্যপতি ম্লান ও অধোবদন হয়ে রইলেন। তারপর শুক্রাচার্যের নীতিজ্ঞ দুই পুত্র ও অমক তার নিকট এসে নির্জনে এরূপ বললেন– হে প্রভো, আপনি একাকী ত্রিভুবন জয় করেছেন। আপনার ভঙ্গি মাত্রে সমস্ত লোকপাল অতিশয় ত্রস্ত হয়। হে নাথ, আপনার এরূপ প্রভাব, আপনার চিন্তার বিষয় তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তবু এরূপ চিন্তিত রয়েছেন কেন? প্রহ্লাদের আচরণের জন্য চিন্তা করা উচিত হয় না। কারণ সে বালক, বালকদের ব্যবহার গুণ বা দোষের বিষয় হতে পারে না। গুরুদেব শুক্রাচার্যের ফিরে না আসা পর্যন্ত এ বালক যাতে ভীত হয়ে পলায়ন করতে না পারে, সেজন্য বরুণের পাশে বদ্ধ করে রেখে দিন। যেহেতু মানুষের বুদ্ধি বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মহতের সেবার দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে থাকে, গুরুপুত্রদের বাক্য অনুমোদন করে হিরণ্যকশিপু বললেন–বেশ, তাই হোক। ততদিন আপনারা একে গৃহস্থ রাজাদের ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা দান করুন।
তারপর শণ্ডামর্ক প্রহ্লাদকে যথাক্রমে ধর্ম, অর্থ ও কাম উপদেশ দিতে থাকলেন, আর প্রহ্লাদও প্রশিত ও অবনত হয়ে তা গ্রহণ করতে লাগলেন। কিন্তু ত্রিবর্গ (ধর্ম, অর্থ ও কাম) যথাসময়ে গুরু সমীপে শিক্ষিত হলেও ওই সকল তার উত্তম বোধ হল না। কারণ ওই সকল যাঁরা উপদেশ দিতেন, তাঁদের চিত্ত রাগ–দ্বেষাদির দ্বারা আসক্ত ছিল। যা হোক, কিছুদিন পর আচার্য যখন গৃহমেধীয় কর্মে অন্যত্র গমন করলেন, তখন সমবয়স্ক বালকেরা অবকাশ পেয়ে প্রহ্লাদকে আহ্বান করল। মহাবুদ্ধিমান। প্রহ্লাদ সুমিষ্ট বাক্যে তাদের ডাকলেন এবং তাদের জন্ম-মরণাদিরূপ সংসার নিষ্ঠা অবগত হয়ে কৃপাপূর্বক সহাস্যে তাদের বললেন। সেই সকল বালক তার গৌরব ক্রীড়াদি পরিত্যাগ করল। তারা অতি অল্পবয়স্ক। সুখ-দুঃখে আসক্ত সংসারী মানুষের মতো তাদের বুদ্ধি দূষিত ছিল না। হে রাজেন্দ্র যুধিষ্ঠির। অসুর বালকগণ প্রহ্লাদের প্রতি আসক্ত হৃদয় এবং তার দিকে দৃষ্টি রেখে তাকে ঘিরে বসে থাকত। করুণ স্বভাব, হিতকারী মহাভাগবত অসুর বংশজাত প্রহ্লাদ তাদের উপদেশ দিতে লাগলেন।
.
ষষ্ঠ অধ্যায়
প্রহ্লাদ কর্তৃক অসুর বালকদের প্রতি উপদেশ
প্রহ্লাদ বললেন–হে বন্ধুগণ, এই মনুষ্য জন্মে বিবেকী মাত্রেরই কৌমার বয়স থেকেই ভাগবত ধর্মের আচরণ করা উচিত। কারণ এ মনুষ্য জন্ম অত্যন্ত দুর্লভ, তাতে আবার ক্ষণস্থায়ী কিন্তু পরমার্থ লাভের উপযোগী। এই মনুষ্য জন্মে সকল জীবেরই যে কোনো প্রকারই হোক, ভগবান বিষ্ণুর চরণ আশ্রয় করা কর্তব্য। যেহেতু তিনি সকল জীবেরই প্রিয়, আত্মা, বন্ধু এবং ঈশ্বর। হে দৈত্য বালকগণ। মনুষ্য জন্ম পেয়ে সুখভোগ লালসার জন্য উদ্যম করা উচিত নয়। এই ঐন্দ্রয়িক (ইন্দ্রিয় সন্নিকর্ষ জাত) সুখ বা দুঃখ দেহধারী (পশু প্রভৃতির দেহেও) জীব মাত্রেরই দৈব অর্থাৎ প্রাচীন কর্মবশতঃ ভোগ করতে হয়। দুঃখ যেমন ইচ্ছা না থাকলেও বিনা চেষ্টাতেই আসে, তেমনি সুখেও বিনা চেষ্টাতেই জীবের ভোগ হয়, কারণ উভয়ই কর্মফল। অতএব তার জন্য প্রয়াস করা উচিত নয়। যেহেতু তার প্রয়াসে কেবল পরমায়ুর ক্ষয়ই হয়ে থাকে। মুকুন্দের চরণকমলের ভজনের দ্বারা যে পরম মঙ্গল (অশেষ দুঃখ নিবৃত্তিপূর্বক পরম আনন্দ অনুভব রূপ) লাভ হয়। বিষয়ের সুখ-লালসায় চেষ্টা করেও সেরূপ মঙ্গল লাভ হয় না। অতএব বিবেকী পুরুষ সংসার দুঃখ থেকে ভীত হয়ে, যতদিন শরীরের শক্তি থাকে এবং মৃত্যু এসে গ্রাস না করে, তার মধ্যেই ভগবানের ভজনানন্দরূপ পুরুষার্থ লাভের চেষ্টা করবে।
সাধারণত মানুষের শত বছর পরমায়ু নির্দিষ্ট তার মধ্যে তার অর্ধেক অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর নিষ্ফলে চলে যায়। কারণ অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি নিদ্রারূপ অজ্ঞান অন্ধকারে পতিত হয়ে রাত্রিতে শয়ন করে কাটায়। সেই অর্ধ পরমায়ুর মধ্যেও বাল্য ও কৈশোর মুগ্ধ হয়ে বিশ বছর ক্রীড়ায় চলে যায় এবং বৃদ্ধাবস্থায় দেহ জ্বরাগ্রস্ত হওয়ার অসমর্থ অবস্থায় আরও বিশ বছর গত হয়ে থাকে। অবশিষ্ট যে পরমায়ু থাকে, তা দুঃখে অপূর্ষর্মন কাম ও বলবান মোহের দ্বারা গৃহে আসক্ত প্রমত্ত (কর্তব্যসু সন্ধানশূন্য) ব্যক্তির বৃথাই অতিবাহিত হয়। (যদি বল যৌবনকালে গৃহাসক্ত হলেও পরে বিরক্ত হওয়ায় কৈবল্য লাভ হতে পারে তার উত্তরে তিনি বলছেন–তা অসম্ভব।)
অজিতেন্দ্রিয় কোন্ ব্যক্তি স্ত্রী-পুত্র-গৃহাদিতে আসক্ত ও দৃঢ় স্নেহপাশে বদ্ধ আত্মাকে (ভগবৎ কৃপা ব্যতীত) মোচন করতে উৎসাহী হয়েছে? আর কোন্ ব্যক্তিই বা ধন তৃষ্ণা পরিত্যাগ করেছে? ওই অর্থ প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়তর। তস্কর, সেবক এবং বণিক–সকলেই প্রাণহানি স্বীকার করেও অর্থ উপার্জন করছে। অনুকম্পিতা প্রিয়তমার সঙ্গে রহস্য ও মনোহর আলাপাদি স্মরণ করলে কোন্ ব্যক্তি তা ত্যাগ করতে পারে, বন্ধুজনের স্নেহপাশে বদ্ধ কোন্ ব্যক্তি তাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে পারে? আর শিশুদের মধুর কথায় যাদের চিত্ত অনুরক্ত, তারাই বা কেমন করে তাদের সঙ্গ পরিত্যাগ করবে? আর পুত্র, শ্বশুরালয়ে স্থিত হৃদয়ঙ্গমা কন্যা, ভ্রাতা, ভগিনী, অসহায় মাতা, পিতা, সুমহৎ মনোজ্ঞ পরিচ্ছদযুক্ত গৃহ, পরম্পরাগত জীবিকা, পশু, ভৃত্যবর্গ–এদের কোন ব্যক্তি ত্যাগ করতে পারে? কোনাকার কীট (গুটি পোকা) যেমন নিজের গৃহ নির্মাণ করে বাহির পথও অবশেষ রাখে না, তেমনি ওই সকলে আসক্তচিত্ত পুরুষ অতৃপ্ত কাম হয়ে লোভবশত কর্মই করতে থাকে। দোষ দর্শন দ্বারা কখনও বিরক্ত হয়ে ওই সকল ত্যাগ করবে তার সম্ভাবনা কোথায়? উপস্থ ও জিহ্বার জন্য সুখকেই যে ব্যক্তি বহু করে মানে, তার মোহ অতি দুরন্ত, সে কি করে বিরক্ত হবে? অপর, গৃহাসক্ত দুরন্ত মোহে এরূপ প্রমত্ত যে কুটুম্ব পোষণে নিজের পরমায়ু যে ক্ষয় হচ্ছে এবং সকল পুরুষার্থ বিনষ্ট হচ্ছে, তাও জানতে পারে না। অতএব তাপত্রয়ে (আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক) দুঃখিত চিত্ত হয়েও তার নির্বেদ আসে না (অর্থাৎ দুঃখ বোধই হয় না) সে নিজ কুটম্বতেই আসক্ত হয়ে থাকে। অজিতেন্দ্রিয় কুটুম্বী পুরুষের চিত্ত ধনাদির প্রতি এরূপ অভিনিবিষ্ট যে, পরস্ব হরণে পরলাকে নরক এবং ইহলোকে রাজদণ্ডাদিরূপ মহৎ দোষ জ্ঞানও অশান্ত কামনায় পর বিত্ত হরণ করে থাকে।
হে দৈত্যবালকগণ, এই প্রকারে বিদ্বান পুরুষও গৃহাদিতে আসক্ত হয়ে কুটুম্ব পোষণে প্রবৃত্ত হলে, ভগবানের পরম আনন্দ প্রাপ্তিতে কখনই সমর্থ হয় না। অধিকন্তু এটা আমার, এটা পরের–এরূপ বিভিন্ন ভাবনায় বিমূঢ় হয়ে অন্ধতম নরকাদি প্রাপ্ত হয়। হে বয়স্যগণ, ওই প্রকার গৃহাসক্ত পুরুষ কখন কোথাও নিজ আত্মাকে মোচন করতে সমর্থ হয় না। কারণ সে কামিনীদের ক্রীড়ামৃগ তুল্য অথবা তাদের বিহারের সাধন হয়ে শৃঙ্খলতুল্য পুত্র কন্যার বন্ধনে পতিত হয়। অতএব হে দৈত্যবালকগণ, বিষয়াসক্ত দৈত্যসকলের সঙ্গ দূরে পরিত্যাগ করে, আদিদেব নারায়ণের শরণাপন্ন হও। যেহেতু তার শরণেই মোক্ষ লাভ হয়। নিঃসঙ্গ মুনিগণও তাই যাঞ্ছা করে থাকেন। হে অসুরনন্দনগণ, আমরা বালক, নারায়ণের উপাসনায় সমর্থ হব না–এরূপ আশঙ্কা করো না, ভগবান অচ্যুত সকল প্রাণীর আত্মা এবং সর্বত্র প্রসিদ্ধ, তাকে প্রীত করা বহু প্রয়াসের কর্ম নয়।
স্থাবরাদি ব্রহ্ম পর্যন্ত ক্ষুদ্র-মৃহৎ যত জীব এবং ভৌতিক বিকার ঘটাদি যত অজীব ও আকাশাদি যত মহৎ ভূত, সত্ত্বাদি গুণ ওই সকলের মমত্বরূপ প্রকৃতি এবং গুণ ব্যতিকর মহত্তত্ত্বাদি যত আছে সব কিছুতেই ব্রহ্ম-স্বরূপ ভগবান ঈশ্বর এক আত্মা রূপ বর্তমান আছেন। ভগবানের মায়ার দ্বারাই দ্রষ্টা ও দৃশ্য, ভোক্তা ও ভোগ্য প্রকৃতি ভেদ দেখা যায়। এক পরমেশ্বরই প্রতিপাত্মা ও দৃশ্যরূপে, ব্যাপ্য ও ব্যাপকরূপে বিকল্পের অতীত হয়েও তিনি নির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট রূপে প্রতিভাত হন। তিনি কেবল অবিমিশ্র অনুভাবাত্মক আনন্দ স্বরূপ। সর্বত্র তার সর্বজ্ঞত্বাদির অনুভব না হওয়ার কারণ, তিনি গুণময় সৃষ্টিকারিণী মায়ার দ্বারা নিজের ঐশ্বর্য অন্তর্হিত করে রাখেন।
অতএব হে অসুর বালকগণ, তোমরা আসুর ভাব পরিত্যাগ করে সর্বভূতে দয়া কর। সকল প্রাণীতে দয়া করলেই ভগবান আধোজ পরিতুষ্ট হবেন। তিনি তুষ্ট হলে কি অলভ্য থাকে? সব কিছুই লভ্য হয়। কিন্তু গুণ-পরিণাম হেতু দেববশত বিনা যত্নে যে সকল ধর্মাদি সিদ্ধ হয়, তাতে কি ফল? আর অগুণ মোক্ষের আকাঙ্ক্ষাই বা কেন? আমরা নিরন্তর তার নাম কীর্তন এবং তার চরণ কমলের সুধা পান করে থাকি, আমাদের মোক্ষেরই বা কি প্রয়োজন? ধর্ম, অর্থ, কাম–এই যে ত্রিবর্গ এবং তাদের অর্থ যে আত্মবিদ্যা, কর্মবিদ্যা, তর্ক, দণ্ডনীতি এবং বিবিধ জীবিকা, এ সমস্ত ত্রিগুণবিষয়ক বেদ প্রতিপাদ্য, ইহা ভগবান সমর্পিত হলে সত্য, কিন্তু পরম পুরুষ যে আত্মার্পণ–উহাই পরম সত্য এবং নৈস্ত্রেগুণ্য লক্ষণ। হে ভ্রাতৃগণ, তোমাদের আমি নূতন বিষয় বলছি না। পূর্বে নরসখা ভগবান নারায়ণ এই দুর্লভ অমর জ্ঞান নারদের উপদেশ করেছিলেন। তোমরা নারদের মতো শ্রোতা নও বলে নিজেদের অনধিকারী আশঙ্কা করো না, কারণ ভগবানের একান্ত ভক্ত অকিঞ্চন পুরুষদের চরণধূলিতে যে যে দেহী আপ্লুত হয়, তাদের সকলেরই এই জ্ঞান লাভ হতে পারে। কেবল উত্তম পুরুষদেরই এই জ্ঞান হবে, এমন কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। অনুভব পর্যন্ত এই জ্ঞান এবং শুদ্ধ ভাগবত-ধর্ম, আমিও পূর্বে দেবর্ষি নারদের নিকট শ্রবণ করেছিলাম। দৈত্যবালকগণ এ সমস্ত শুনে বিস্মিত হয়ে বললেন–প্রহ্লাদ, এই দুই গুরুপুত্র (শামৰ্ক) ব্যতীত অন্য গুরু তুমিও জান না, আমরাও জানি না। এখানে আসবার পূর্বে তুমি নারদের কাছে গিয়েছিলে, ইহাও বোধ হয় না। কারণ আমরা সকলেই বালক প্রথম থেকে এই দুইজনকেই আমাদের নিয়ন্তা দেখছ, কবে তুমি অন্যত্র গেলে? দেবর্ষি নিজেই তোমার কাজে এসেছিলেন। এটাও সম্ভব নয়, কারণ বালকরা অন্তঃপুরে থাকে তাদের মহৎসঙ্গ দুর্ঘট। হে সৌম্য, এ বিষয়ে বিশ্বাসের কোনো হেতু থাকলে, তুমি আমাদের সংশয় ছেদন কর।
.
সপ্তম অধ্যায়
প্রহ্লাদ কর্তৃক মাতৃগর্ভ থেকে প্রাপ্ত নারদোপদেশের বর্ণন
শ্রীনারদ বললেন–এই প্রকার দৈত্য পুত্রদের দ্বারা পৃষ্ট হয়ে মহাভাগবত প্রহ্লাদ আমার (নারদের) পূর্ব উপদিষ্ট তত্ত্ব স্মরণ করে সহাস্যে তাদের বললেন। প্রহ্লাদ বললেন–আমাদের পিতা হিরণ্যকশিপু তপস্যার জন্য মন্দরাচলে গেলে, ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ দানবদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর যুদ্ধের উদ্যম করতে লাগলেন। তখন তারা বলতে লাগলেন–পিপীলিকার দ্বারা যেমন মহাসর্প ভক্ষিত হয় তেমনি সকল লোকের সন্তাপকারী এই হিরণ্যকশিপু নিজের পাপেই বিনষ্ট হল। সে সময় অসুরদের যে সকল দলাধিপতি ছিল, দেবতাদের যুদ্ধোদ্যম দেখে এবং তাদের দ্বারা বধ্যমান হয়ে ভয়ে তারা পলায়ন করতে লাগল। তারা নিজ নিজ প্রাণ রক্ষার জন্য এরূপ ব্যস্ত হয়েছিল যে স্ত্রী, পুত্র, বন্ধু, বান্ধুব, সম্পদ, পশু, গৃহ ও গৃহহাপকরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করতেও সময় পেল না। জয়াকাঙ্ক্ষী দেবগণ সর্বস্ব অপহরণপূর্বক দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর আবাসও বিনষ্ট করে ফেলল। আর দেবরাজ ইন্দ্র আমার জননী দৈত্যরাজ মহিষীকে গ্রহণ করলেন।
ইন্দ্র যখন ভয়োদ্বিগ্না কুরবী পক্ষীর মতো রোরুদ্যমানা আমার মাতাকে নিয়ে যায়। তখন যদৃচ্ছাক্রমে পথে সমাগত দেবর্ষি নারদ সেখানে তাকে দেখতে পেলেন। দেবর্ষি দেবরাজকে সম্বোধন করে বললেন–হে সুরপতি, এ অবলার কোনো অপরাধ নেই। এঁকে নিয়ে যাওয়া তোমার যোগ্য নয়। ইনি পরমা সাধী, পরস্ত্রী, এঁকে ত্যাগ কর। ইন্দ্র বললেন– এর জঠরে বেদশত্ৰু হিরণ্যকশিপুর দুঃসহ বীর্য আছে, যতদিন প্রসব না হয়, ততদিন তিনি আমার আবাসে থাকুন। পুত্র জন্মালে তার প্রাণবধ করে, এঁকে পরিত্যাগ করব। নারদ বললেন–এর গর্ভস্থ সন্তান নিষ্পাপ মহাভাগবত, নিজের গুণেই অতিমহৎ এবং অনন্তের অনুচর। সুতরাং মহাবলী, তুমি কখনই তাকে বধ করতে পারবে না। দেবর্ষি এরূপ বললে, দেবরাজ ইন্দ্র তার বাক্য মান্য করে আমার জননীকে ছেড়ে দিলেন এবং ভগবান অনন্তের প্রিয় আমার প্রতি শ্রদ্ধায় তাকে প্রদক্ষিণ করে নিজস্থানে চলে গেলেন।
তারপর দেবর্ষি আমার মাতাকে নিজ আশ্রমে নিয়ে গিয়ে আশ্বাস প্রদান পূর্বক বললেন–বৎসে যতদিন তোমার ভর্তার আগমন না হয়, ততদিন ওই আশ্রমে অবস্থান করুন। তারপর তাই হোক’-এই বলে আমার জননীও যতদিন দৈত্যপতি ঘোর তপস্যা থেকে ফিরে না আসেন, ততদিন দেবর্ষির নিকটেই বাস করেছিলেন। আমার পতিব্রতা মাতার ইচ্ছা অনুসারে সন্তান প্রসব করার উদ্দেশ্য এবং গর্ভস্থায় সন্তানের মঙ্গল কামনায় পরম ভক্তির সহিত ঋষির শুশ্রূষা করতেন। দেবর্ষি অতিশয় সামর্থবান এবং পরম কারুণিক, এজন্য তিনি আমার জননীকে উভয় বরই (গর্ভের মঙ্গল ও ইচ্ছাপ্রসব) প্রদান করলেন। আর মাতার শোক-শান্তির জন্য আমাকে উদ্দেশ্য করে ভক্তিলক্ষণ ধর্মতত্ত্ব ও আত্ম-অনাত্মা বিবেক এই দুই নির্মল বস্তু উপদেশ করলেন। কিন্তু আমার মাতা স্ত্রীজাতি এবং দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ায় তার ওই জ্ঞানবাণী তিরোহিত হয়েছে। আমার প্রতি ঋষির বিশেষ অনুগ্রহ থাকায় এখনও সেই স্মৃতি আমাকে পরিত্যাগ করেনি।
হে বন্ধুগণ, তোমরা যদি আমার বাক্যে শ্রদ্ধাবান হও, আমার মতো তোমাদেরও এবং স্ত্রী, বালকদের ও বৈশারদী (অর্থাৎ দেহাদির অহংকার ছেদ নিপুণা) বুদ্ধির উদয় হতে পারে। বিকার সমর্থ। ঈশ্বরমূর্তিরূপ কালের দ্বারা, যেমন বৃক্ষ বর্তমান থাকলেও উৎপত্তি প্রভৃতি ছয়টি বিকার ফলেরই দেখা যায়, তেমনি দেহের জন্মাদি (উৎপত্তি, স্থিতি, বুদ্ধি, পরিণাম, অবক্ষয় এবং বিনাশ) ছয়টি বিকার দৃষ্ট হয়, আত্মার নয়। আত্মা (পরমাত্মা) নিত্য (অর্থাৎ উৎপত্তি বিনাশ রহিত) অব্যয় (অপক্ষয়শূন্য), শুদ্ধ, অদ্বিতীয়, বিজ্ঞাতা, সর্বশ্রয়, বিকারবর্জিত স্বপ্রকাশ, হেতু (কারণ), ব্যাপক, অসঙ্গী ও অনাবৃত। এই দ্বাদশটি আত্মার লক্ষণ। এই সকল লক্ষণ দ্বারা বিদ্বান পুরুষ দেহাদিতে ‘আমি আমার’–এই মোহজাত অসদ্ভাব (অর্থাৎ মিথ্যাবুদ্ধি) পরিত্যাগ করে থাকেন। হে বন্ধুগণ, যে সকল ক্ষেত্রে স্বর্ণের আকর আছে, তাতে স্বর্ণকণারূপ প্রস্তরে অগ্নি সংযোগদির দ্বারা সেই উপায়ভিজ্ঞ স্বর্ণকারগণ যেমন স্বর্ণপ্রাপ্ত হয়ে থাকে, তেমনি এই দেহে ব্রহ্ম-প্রাপ্তির উপায় আত্মযোগ দ্বারা অধ্যাত্মবিদ (অর্থাৎ আত্মাধিকৃত কার্যকারণ সমূহের জ্ঞাতা) পুরুষ ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হতে পারেন।
অষ্টপ্রকৃতি (মূল প্রকৃতি, মহতত্ত্ব, অহংকার তত্ত্ব ও পঞ্চ তন্মাত্র) তার তিনটি গুণ (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ) এবং ষোড়শ বিকার (একাদশ ইন্দ্রিয় ও পঞ্চ মহাভূত), আর পরম পুরুষ আত্মা। যিনি সাক্ষীরূপে ওই সকলে বর্তমান–এই জন্য কপিলাদি আচার্যগণ যাঁকে এক বলেছেন। আর স্থাবর ও জঙ্গম–এই দুই প্রকারে দেহ, যা সকলের সংঘাত স্বরূপ। এই সর্বসংঘাতক দেহেই সেই পুরুষের অন্বেষণ করা কর্তব্য। এটা নয়, এটা নয়’–এইরূপে বিচার করে, অনাত্ম সমস্ত পদার্থ হতে পৃথক সেই পুরুষের উপলব্ধি হয়ে থাকে। মণিময় মালার মধ্যগত সূত্র যেমন সকল খনিতে অনুসূত এবং যেমন ওই সূত্রসকল মণি হতে ভিন্ন, তেমনি অন্বয় ব্যতিরেকে (অর্থাৎ প্রত্যগাত্মার অস্তিত্বে সংঘাতের স্থিতি–ইহা অন্বয় এবং প্রত্যগাত্মা হতে নির্গত হলে সংঘাতের বিনাশ–ইহা ব্যতিরেক)–বিবেচনা করলে যখন অন্তঃকরণ শুদ্ধ হবে। তখন অব্যগ্র হয়ে সেই অন্তঃকরণের দ্বারা সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কারণ বিচারপূর্বক সেই পুরুষের অন্বেষণ করা কর্তব্য।
হে বন্ধুগণ, জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি–এগুলি বুদ্ধির বৃত্তি, এ সকল যাহা কর্তৃক অনুভূত হয়, তিনি পরম পুরুষ, তিনিই সাক্ষী। ওই বৃত্তিসকল বুদ্ধির পরিণাম মাত্র, আত্মার ধর্ম নহে। আর এ সকল বৃত্তি কর্মজন্য, অতএব ত্রিগুণাত্মক ও কর্মজন্য হওয়ায় বুদ্ধিরই জাগ্রতাদি অবস্থা জানবে। যেমন গন্ধ পুষ্পের ধর্ম, বায়ুর সাথে মিলিত হওয়ার বায়ুর ধর্ম বলে প্রকাশ পায়। তার মত আত্মা বুদ্ধির সাথে যুক্ত হওয়ায় বুদ্ধির অবস্থা জাগ্রতাদি বিশিষ্ট বলে বোধ হয়। বস্তুত আত্মার ওই সকল অবস্থা হয় না। এই প্রকারে পুষ্পধর্ম গন্ধ দ্বারা গন্ধাশ্রয় বায়ুর ন্যায় আত্মস্বরূপ অবগত হবে। (পুষ্পপাধিক বায়ুর গন্ধকে পৃথক জানালেও তার গন্ধ নিবৃত্তি হয় না। সেরূপ আত্মাকে গুণাতীত জানলেও সংসার নিবৃত্তি হতে পারে না–এরূপ শঙ্কা করো না, কারণ) সংসার কেবল বুদ্ধির দ্বারা হয়, বুদ্ধির গুণ ও কর্মই সংসারের বন্ধন এবং অজ্ঞানই তার মূল, সুতরাং তার স্বরূপ মিথ্যা হলেও স্বপ্নবৎ অর্পিত হয়ে থাকে। এইরূপে আত্মার সংসার নিবৃত্তি ঘটতে পারে, অতএব তোমরা গুণাত্মক কর্মর্সকলের বীজ যে অজ্ঞানতার দাহক যে তা, যাতে বুদ্ধির জাগ্রতাদি অবস্থা প্রবাহ বিনষ্ট হয়, সেই যোগ অনুষ্ঠান কর। হে বালকগণ, অধ্যাস নিবৃত্তির হাজার হাজার উপায়ের মধ্যে এই ভক্তিযোগ রূপ উপায় শ্রীভগবান নিজে বলেছেন। এই ধর্মানুধানের দ্বারা ভগবান ঈশ্বরে বর্ণানুসন্ধান রহিত হয়। সেই ভক্তির অন্তরঙ্গ ধর্ম বলছেন–গুরু শুশ্রূষা, গুরুভক্তি, গুরুর প্রতি লব্ধ বস্তু সমৰ্পণ। সাধু ও ভগবদ্ভক্তজনের সংসর্গ এবং ঈশ্বরের আরাধনা। আর ভগবানের কথায় শ্রদ্ধা, তার গুণ কর্মসমূহের কীর্তন, তাঁর চরণকমলের ধ্যান, তার মূর্তি সকলের দর্শন ও অর্চনাদি। সেরূপ ভগবান হরিকে সর্বভূতে বর্তমান জানা এবং সকল ভূতকে সাধু বলে গ্রহণ করা। এই সকল কর্মের দ্বারা ষড়বর্গ (অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মৎসৰ্থ) জয় করে ভগবান বাসুদেবে ভক্তি করতে হয় এবং তার সবাই ভগবত বিষয়ে রতি লভ্য হয়।
(ভগবান রতি হলে সাধকের কি অবস্থা হয়, তা বলছেন)–যখন অতিশয় হর্ষোদয় হওয়ায় পুলকোদগম ও অশ্রুপাত হয়, তাতে গদগদ স্বরে ঊৰ্ধকণ্ঠ হয়ে কখন নৃত্য, গীত ও আনন্দধ্বনি করে। কখন গ্ৰহজম্ভের মতো হাস্য করে, কখন ক্রন্দন করে, কখন ধ্যান করে, কখন লোকের বন্দনা করে, কখন বা বারবার শ্বাস ত্যাগ করতে করতে নির্লজ্জ হয়ে “হে হরে, হে জগৎপতি, হে পরায়ণ”–এইরূপ বাক্য উচ্চারণ করতে থাকে। তখন সমস্ত বন্ধন হতে মুক্ত হয় এবং ভগবানের চেষ্টাদি ভাবনায় পুরুষের মন ও শরীর তার অনুকৃত হতে থাকে। সে সময় গুরুতর ভক্তি হেতু সেই ব্যক্তির অজ্ঞান ও বাসনা নিদগ্ধ হয়ে যায়। অতএব সম্যক প্রকারে ভগবানকে প্রাপ্ত হয়। অর্ধেক্ষজের আশ্রয় গ্রহণই রাগাদি দূষিত আত্মবান পুরুষদের সংসার নাশের উপায় এবং তাই পরব্রহ্মে লয়রূপ মোক্ষ ও তাই মুখ্য বলে পণ্ডিতগণ বলে থাকেন। অতএব তোমরা হৃদয়ে অন্তর্যামী ঈশ্বরের উপাসনা কর।
হে অসুরবালকগণ, হরির উপাসনা করা খুব পরিশ্রমের কার্য নয়, ভগবান হরি হৃদয়মধ্যে আকাশের ন্যায় বর্তমান রয়েছেন, তিনি আত্মার সখা, তবে দেহধারী ব্যক্তি সাধারণ শূকরাদি জীবের মতো শুধু বিষয়ের প্রতি আসক্ত হবে কেন? ধন, কলত্র, পশু, পুত্রাদি, গৃহ, ভূমি, হস্তী, ধনাগার, ঐশ্বর, অর্থ, কাম–এ সমস্তই চঞ্চল। আর মানুষের পরমায়ু ক্ষণভঙ্গুর, কাজেই ওই সকল বস্তু তার কতটুকু প্রীতি সম্পাদন করতে পারে, আর স্বর্গাদি লোকসকল পুণ্য তারতম্যে অপেক্ষাকৃত উত্তম হলেও পরমার্থতঃ নির্মল নহে। ওই সকল লোক যাগাদির দ্বারা প্রাপ্য, সুতরাং ক্ষয়িষ্ণু, অতএব ওই সমস্ত লোকও সেবার যোগ্য নয়। ওই সকল পরিত্যাগ করে পূর্বোক্ত ভক্তিযোগের দ্বারা ভগবান হরির আরাধনা কর, তাতে কোনো প্রকার দোষ দৃষ্ট হয় না, তার সেবায় আত্মলাভ হবে।
পণ্ডিতাভিমানী ব্যক্তি এই সংসারে যে বৈষয়িক সুখলাভের জন্য বারবার লৌকিক ও অলৌকিক কর্ম করে, তার দুঃখাত্মক ফল অবশ্যই লাভ করে। এই কর্মমার্গে সুখপ্রাপ্তি ও দুঃখ নিবৃত্তির জন্য কর্মী পুরুষের সংকল্প হয়। তাতে পূর্বে ক্রিয়ার অভাবহেতু সুখাকাঙ্ক্ষী যে পুরুষ, তাকে ক্রিয়া দ্বারা অসংশয় দুঃখ প্রাপ্ত হতে হয়। এ সংসারে পুরুষ দেহের নিমিত্ত কাম্য কর্মতভাগ প্রার্থনা করে, কিন্তু সেই দেহও পারক্য (অর্থাৎ কুকুর শৃগালদির ভক্ষ) ক্ষণভঙ্গুর এবং নিত্য নয়, কখন যায়, কখন আসে। যখন হস্তপদাদিযুক্ত দেহেরই এই অবস্থা, আর দেহের সম্বন্ধে সম্বন্ধান্বিত মমতাস্পদ পুত্র, কলত্র, গৃহ, ধন, জন, রাজ্য, কোষ, হস্তী, অমাত্য, ভৃত্য আপ্ত প্রভৃতি যে পারক্য তার কথা আর কি বলব? এই সকল পদার্থ দেহের সাথে নশ্বর এবং অনর্থ অর্থের মতো প্রকাশ পায় বটে, কিন্তু অতি তুচ্ছ। এ সকলের দ্বারা নিত্য আনন্দরসের সাগরস্বরূপ আত্মার কি উপকার হতে পারে? হে অসুরগণ, প্রাচীন কর্মবশত নিষেকাদি অবস্থাতেও যখন দেহীকে দৃশ্যমান দেখা যায়। তখন আবার কর্ম করলে, তার দ্বারা কি স্বার্থ হবে তা তোমরা নিজেরাই বিচার কর। কর্ম সমাপ্ত হলে যে ভোগের অবসর হবে, তারও সম্ভাবনা নেই। কারণ দেহী আত্মার অনুবর্তী দেহের দ্বারা কর্ম আরম্ভ করে, সেই কর্মের ফলে আবার দেহ ধারণ করে, এইরূপ অজ্ঞানের দ্বারা কর্ম ও দেহ উভয়েরই বিস্তার হয়ে থাকে। অতএব হে বন্ধুগণ, অর্থ, কাম ও ধর্ম–এই তিনটি যাঁর অধীন, তোমরা কামনা শূন্য হয়ে সেই নিরপেক্ষ হরির উপাসনা কর।
ভগবান হরি সকল ভূতের আত্মা, প্রিয় এবং ঈশ্বর। সমস্ত প্রাণী তার নিজকৃত মহৎ ভূত সকলের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে, অতএব তিনি অন্তর্যামী। আমরা অসুর, আমাদের ওই বিষয়ে অধিকার নেই–এরূপ আশঙ্কা করো না। সুর, অসুর, মনুষ্য, যক্ষ, অথবা গন্ধর্ব–যে কেউ হোক, ভগবান মুকুন্দের চরণকমল ভজন করলে সকলেই কল্যাণভাজন হয়। হে অসুর বালকগণ, দ্বিজত্ব অথবা দেবত্ব, কিংবা ঋষিত্ব অথবা সদ্বৃত্ত কিংবা বহুঞ্জতা–কিছুই মুকুন্দের প্রীতির নিমিত্ত হতে পারে না। আর দান, তপস্যা যজ্ঞ, শৌচ ও ব্রত–এগুলিও ভগবানের প্রীতির কারণ নয়। কেবল নিষ্কাম ভক্তির দ্বারাই ভগবান প্রীত হন। ভক্তি ব্যতীত অন্য সবকিছু বিড়ম্বনা মাত্র (অর্থাৎ তিরস্কারের কারণ) হে দানবগণ, এইজন্য সর্বত্র আত্মতুল্য দর্শন করে সর্বভূতের আত্মা, ঈশ্বর, ভগবান হরিকেই ভক্তি কর। হে দৈত্যগণ, যক্ষ, রাক্ষস, স্ত্রী, শূদ্র, ব্রজৌকাস (গবোপজীবী নীচজাতি আভীর) এবং পশু, পক্ষী প্রভৃতি বহু পাপী জীবও ভক্তিযোগের দ্বারা অচ্যুতত্ত্ব অর্থাৎ অচ্যুতের মতো চিন্ময় শরীরত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। হে ভ্রাতৃগণ, ভগবান গোবিন্দে একান্ত ভক্তি করে সর্বত্র তার নিরীক্ষণ করাই ইহলোকে জীবের পরম পুরুষার্থ।
.
অষ্টম অধ্যায়
(নৃসিংহ দেবের আবির্ভাব। হিরণ্যকশিপুর বিনাশ এবং ব্ৰহ্মাদি দেবগণ কর্তৃক ভগবানের স্তুতি)
শ্রীনারদ বললেন–দৈত্যবালকেরা প্রহ্লাদের কথা শুনে উৎকৃষ্টবোধে তার উপদেশই গ্রহণ করল। গুরু (সন্তু ও অমর্ক) যা শিখিয়েছিলেন, তা গ্রহণ করল না। তারপর গুরুপুত্রদ্বয় যখন দেখলেন–প্রহ্লাদের দোষে সকল বালকের বুদ্ধি ভগবান বিষ্ণুতে নিষ্ঠা প্রাপ্ত হয়েছে। তখন ভীত হয়ে সত্ত্বর রাজার নিকট গিয়ে সমস্ত নিবেদন করলেন। শোনামাত্রই রাজা হিরণ্যকশিপু কোপবিষ্ট হয়ে কম্পিত কলেবরে পুত্রকে হত্যা করতে সংকল্প করে কঠোর বাক্যে তাকে তিরস্কার করতে লাগলেন। যদিও প্রহ্লাদ তিরস্কারের অযোগ্য, তবুও স্বভাবত নিষ্ঠুর পদাহত সর্পের ন্যায় বারবার নিশ্বাস ত্যাগ করতে করতে প্রশ্রয়াবনত দন্তে কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান পুত্রের প্রতি সরোষ বক্রদৃষ্টি নিক্ষেপপূর্বক নিরীক্ষণ করে বলতে লাগলেন। হিরণ্যকশিপু বললেন–ওরে, দুর্বিনীত মন্দবুদ্ধি, তুই অধম, কুলভেদকারক, জড়, আমারও শাসন লঙ্ঘন করছিস, যাক আজই তোকে যম–সদনে পাঠিয়ে দেব। ওরে, মূঢ়, আমি ক্রুদ্ধ হলে লোকপালদের সাথে ত্রিভুবন ভয়ে কম্পিত হয়। সেই আমাকে কিছুমাত্র ভয় না করে, কার বলে বলীয়ান হয়ে আমার শাসন অতিক্রম করছিস?
প্রহ্লাদ বললেন–হে রাজন, তিনি কেবল আমারই বল নন, আপনারও এবং অন্যান্য বলশালীদেরও বল। আর যে সকল ব্রহ্মাদি স্থাবরজঙ্গম রয়েছে, সকলকেই তিনি নিজ বলে বশীভূত করেছেন। কারণ তিনিই ঈশ্বর, তিনিই কাল, তার পরাক্রম অসীম। তিনিই সামর্থ্য, সাহস, ধৈর্য এবং ইন্দ্রিয়স্বরূপ। সেই পরম পুরুষই নিজ শক্তির দ্বারা সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় করছেন, যেহেতু তিনি সত্ত্বাদি গুণত্রয়ের ঈশ্বর। হে রাজন, আপনি আপনার আসুরিক স্বভাব পরিত্যাগ করুন এবং মনকে সমানভাবে ধারণ করলে; আর কেউ আপনার বিদ্বেষ্টা থাকবে না। উৎপথগামী মন ব্যাতীত অন্য কোনো শত্রু নেই, আর সমত্বরূপে মন ধারণাই (অর্থাৎ শত্রু-মিত্রাদির অনুসন্ধানরহিত হয়ে সর্বত্র ভগবদ দর্শনই) ভগবানের মহৎ আরাধনা। পিতঃ, আপনার মতো কতকগুলি লোক, ছয় ইন্দ্রিয়স্বরূপ শত্রুগণ যাদের সর্বস্ব হরণ করেছে, প্রথমে তাদের জয় না করে, আমরা দশ দিক জয় করেছি’–বলে অভিমান করে থাকে। কিন্তু যিনি সাধু বিদ্বান, সকল দেহীতে সমবুদ্ধি এবং মনকে জয় করেছেন, তার অজ্ঞান কল্পিত শত্রু কোথা হতে হবে?
হিরণ্যকশিপু বললেন–ওরে মন্দবুদ্ধি, তুই অতিমাত্র নিন্দা আরম্ভ করলি, মনে হয় তোর মরবার ইচ্ছা হয়েছে কারণ মুমূর্য লোকদেরই বাক্য এরূপ অসংলগ্ন (বিপ্লব) হয়ে থাকে। আর মন্দভাগ্য, তুই যে বললি–আমি ছাড়া অন্য কেউ জগতের ঈশ্বর আছেন, আর দুর্বুদ্ধি, যদি থাকেন কোথায় আছেন? যদি সর্বত্র থাকেন, তবে এই স্তম্ভে কেন দেখা যাচ্ছে না? (প্রহ্লাদ স্তম্ভে ভগবানকে দেখে নমস্কার করে বললেন–দেখা যাচ্ছে।) কিন্তু হিরণ্যকশিপু (দেখতে না পেয়ে) অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন–তুই বৃথা গর্ব করছিস, এখনই তোর শরীর থেকে মস্তক হরণ করছি, দেখি তোর অভীপ্সিত হরি আজ তোকে রক্ষা করুক। (প্রহ্লাদ মস্তকোপরি অঞ্জলিবন্ধন করে সেই স্তম্ভের দিকেই চেয়েছিলেন), দুরাত্মা হিরণ্যকশিপু ওই প্রকার দুর্বাক্যের দ্বারা বারবার মহাভাগবত পুত্রকে তর্জনপূর্বক খঙ্গগ্রহণ করে নিজ সিংহাসন হতে উঠলেন এবং প্রহ্লাদ যে স্তম্ভের দিকে চেয়েছিলেন, সেই স্তম্ভে অতি বলে মুষ্টির আঘাত করলেন।
নারদ বললেন–হে মহারাজ যুধিষ্ঠির। সেই মুষ্টির আঘাত করা মাত্রই সেই স্তম্ভ হতে এমন একটা ভয়ংকর শব্দ নির্গত হল, যেন ব্রহ্মাণ্ড–কটাহ স্ফুটিত হয়ে গেল। ব্রহ্মাদি দেবগণ নিজ নিজ ধামে বসে ওই অদ্ভুত ধ্বনি শুনে মনে করলেন যেন তাদের স্থান বিনষ্ট হল। হিরণ্যকশিপু পুত্রের বধ করতে ইচ্ছা করে বল–বিক্রম প্রকাশ করছিলেন, সেই অভূতপূর্ব ভয়ংকর ধ্বনি শুনে সভার দিকে চেয়ে দেখলেন, কিন্তু যে ধ্বনিতে দেবগণের শত্রু হয়েছিল, তার মূল আশ্রয় কি, তা দেখতে পেলেন না। তারপর ভগবান নিজভৃত্যের বাক্য (প্রহাদ যে বলেছিলেন-স্তম্ভে দেখা যাচ্ছে, তা) এবং ভগবান যে সমস্ত পদার্থে ব্যেপে আছেন, তাও সত্য করার জন্য দৈত্যঘাতক ঘোর রূপ ধারণ পূর্বক সভার মধ্যে সেই স্তম্ভেই দৃষ্ট হলেন, তাঁর সেই রূপ মৃগও (পশুও) নয়, মানুষও নয়, অতিশয় অদ্ভুত।
হিরণ্যকশিপু প্রথমত, ওই মূর্তি দেখতে পাননি। ওই ধ্বনি শুনে তার আশ্রয় কোনো প্রাণী ভেবে চারদিকে তাকাতে লাগলেন। তখন স্তম্ভ হতে নির্গমনশীল মিশ্রিত নর-সিংহরূপ দেখে আশ্চর্য হয়ে বললেন–অহো, একি অদ্ভুত, এ মৃগও নয়, মানুষও নয়, এ কোন্ প্রাণী? পরে নিজেই মীমাংসা করলেনএটি নৃ-মৃগেন্দ্র রূপ (অর্থাৎ নৃসিংহ রূপ)। যখন হিরণ্যকশিপু সেই ভয়ানক, নৃসিংহ রূপের মীমাংসা করছিলেন, তখুনিই ভগবান নৃসিংহরূপী শ্রীহরি তার সামনে এসে উপস্থিত হলেন। তার লোচন প্রত্যপ্ত স্বর্ণের মতো পিঙ্গলবর্ণ, বদন দেদীপ্যমান জটা ও কণ্ঠলোমে অতিশয় বিজম্ভিত। আর করাল দন্ত করবাল (খ) তুল্য চঞ্চল ও ক্ষুরধার সদৃশ তীক্ষ্ণ জিহ্বা দৃষ্ট হচ্ছিল, আর জাকুটিযুক্ত মুখ ঘোরতর উত্থান (ভয়ংকর) বোধ হল। তার কর্ণদ্বয় উন্নত ও শঙ্কুর (গোঁজের) মত ঊর্ধ্ব এবং মুখ ও নাসিকা পর্বতের গহরতুল্য অদ্ভুতরূপে বিস্তীর্ণ। কপোলের দুই প্রান্তভাগ বিদীর্ণ হওয়ায় অতিশয় ভীষণ হয়েছিল। তার শরীর গগনস্পর্শী, গ্রীবা অদীর্ঘ অথচ স্কুল, বক্ষঃস্থল বিশাল কিন্তু উদর অতিশয় কৃশ। আর ওই শরীরে সকল অংশ চন্দ্রকিরণ সদৃশ গৌরবর্ণ লোমে ব্যাপ্ত ছিল এবং শত শত ভুজ সকল দিকে প্রসারিত হয়েছিল। এ ছাড়া তিনি নিজ চক্র ও বজ্ৰাদি উত্তম আয়ুধের দ্বারা দৈত্য ও দানবদের বিতাড়িত করছিলেন।
হিরণ্যকশিপু ওই রূপ দেখে তার আবির্ভাবের প্রয়োজন বিচারপূর্বক বলতে লাগলেন–এতো মনে হচ্ছে, মহামায়াবী হরিই এই প্রকার আমার মৃত্যুর হেতু চিন্তা করে রেখেছেন। যা হোক, এর উদ্যমে কি হতে পারে? দৈত্য কুঞ্জর (হিরণ্যকশিপু) এই কথা বলে গদা ধারণপূর্বক সিংহনাদ করতে করতে সেই নৃসিংহের প্রতি উৎপতিত হলেন। পতঙ্গ যেমন অগ্নিতে পতিত হয়ে অদৃশ্য হয়, তেমনি সেই অসুর নৃসিংহের তেজোমধ্যে পতিত হয়েই অদৃশ্য হলেন। সত্ত্বপ্রকাশ সেই হরিতে পতিত তমোময় অসুরের অদর্শন হওয়া কিছু আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। কারণ যে হরি সৃষ্টির পূর্বে প্রলয়কালীন প্রগাঢ় অন্ধকার পান করেছিলেন। তারপর সেই মহাসুর শ্রীনৃসিংহকে আক্রমণ করে অত্যন্ত বেগে গদার দ্বারা আঘাত করতে লাগলেন। তা দেখে গরুড় যেমন মহাসর্প ধারণ করে, তেমনি ভগবান গদাধর হরি গদার সহিত ইতস্তত প্রহারকারী সেই দানবকে ধরলেন। হে ভারত, হিরণ্যকশিপু একবার নিজেকে নিযুক্ত করে গরুড়ের আক্রমণ হতে বিমুক্ত সর্পের ন্যায় বিক্রম প্রকাশ করতে লাগলেন। তা দেখে স্থানচ্যুত সকল লোকপালের সাথে ইন্দ্রাদি দেবগণ ভয়ে ভীত হয়ে মেঘের অন্তরালে লুক্কায়িত হলেন এবং তা অমঙ্গলজনক মনে করলেন। (কারণ একবার তারা স্থানভ্রষ্ট হয়েছেন, এবার যদি এ অসুর জীবিত থাকে, তবে তাদের প্রাণও হরণ করবে।) হে রাজন, হিরণ্যকশিপু যাঁর হস্ত হতে মুক্ত হলেন, পরে তাকেই নিজের ক্ষমতায় শঙ্কিত মনে করে যুদ্ধক্ষেত্রে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে, খঙ্গ-চর্ম ধারণ পূর্বক আবার তাকে আক্রমণ করলেন। তিনি শ্যেণতুল্য বেগবান হয়ে খঙ্গ-চর্মের মার্গ দ্বারা নিচ্ছিদ্ররূপে উপরে ও নীচে ভ্রমণ করছিলেন। নৃসিংহরূপী ভগবান হরি তীক্ষ্ণ ও মহাশব্দে ভয়ংকর অট্টহাস্য করে বেগে তাকে গ্রহণ করলেন। সেই হাস্যজন্য ভয়ে ও ভগবান হরির প্রভাবে ওই অসুরের নয়নদ্বয় নির্মীলিত হতে লাগল।
সর্প মূষিককে ধরলে, সে যেমন পালাবার জন্য সর্বপ্রকারে চেষ্টা করে তেমনি সেই অসুর নিঃসৃত হবার জন্য সর্বতোভাবে যত্ন করল। কিন্তু ধারণা মাত্রই বিবশ হয়ে পড়ল। পূর্বে যুদ্ধে ইন্দ্রের রজ নিক্ষেপেও যার গাত্রের ত্বক ক্ষত হয়নি, সেই হিরণ্যকশিপুকে ভগবান নৃসিংহ অবলীলাক্রমে তার সভামধ্যে নিজের ঊরুর উপরে নিপতিত করল গরুড় যেমন মহাবিষ বিষধরকে বিদারণ করে তেমনি নখ দ্বারা বিদীর্ণ করলেন। (ব্রহ্মার প্রদত্ত বর অনুসারে ভিতর ও বাইরে নয় সভাদ্বারে, ভূমিতে বা আকাশ নয় ঊরুর উপর, অস্ত্র নয়, প্রাণহীন বস্তু নখের দ্বারা, দিনেও নয়, রাতেও নয় সন্ধ্যাকালে ভগবান তাকে বধ করলেন।) সেই নৃসিংহের করাল লোচন ক্রোধে দুপ্রেক্ষ্য হয়েছিল এবং তিনি নিজ জিহ্বার দ্বারা বিস্তারিত বদনের প্রান্তভাগ বার বার অবলেহন করছিলেন। হস্তী বধ করে সিংহ যেমন শোণিতাক্ত হয়, তার মতো রক্তবিন্দুর দ্বারা তার কেশর ও আনন সিক্ত হয়ে অরুণবর্ণ হল এবং তিনি অস্ত্রের মালা গলদেশে ধারণ করেছিলেন।
নৃসিংহ নিজ নখাঙ্কুরের দ্বারা দৈত্যপতির হৃৎপদ্ম উৎপাটন করে তাকে পরিত্যাগ করলেন। পরে উদ্যতাস্ত্র দৈত্যের অনুচরদের এবং তাদের পক্ষপাতী অন্যান্য হাজার হাজার অসুরদের নখরাঘাতে নিহত করলেন। সে সময় ভগবান বহু-বহু বাহুদন্ত প্রকট করেছিলেন এবং সমস্ত হস্তেই নখরূপ প্রখর অস্ত্র দেদীপ্যমান ছিল। দৈত্যবধের জন্য ব্যগ্র হয়ে নৃসিংহদেবের ভয়ংকর আড়ম্বর বর্ণনা করছেন–মেঘসকল তার জটার স্পর্শে প্রকম্পিত হয়ে বিশীর্ণ, গ্রহগণের জ্যোতিঃ এঁর দৃষ্টির দ্বারা তিরস্কৃত, সাগর সকল নিঃশ্বাসপবনে আহত হয়ে ক্ষুধিত হয়েছিল এবং দিক-হস্তিসকল নিহ্রাদ শব্দে ভীত হয়ে কাতর ধ্বনি করছিল। আর তার জটার দ্বারা বিমানসকল এরূপে উৎক্ষিপ্ত হচ্ছিল যে স্বর্গপুরী যেন বিমান সংকুলা হয়ে স্বস্থান হতে ঊর্ধ্বে গমন করছিল। পৃথিবী যেন তার পদাঘাতে পীড়িত হয়ে স্বস্থান হতে বিচলিত ও পর্বতসকল তার বেগে যেন উৎপতিত আর আকাশ ও দিকসকল যেন তার তেজে দীপ্তিশূন্য হল।
ওই প্রকারে নৃসিংহরূপ ভগবান অনুচরগণ সহ হিরণ্যকশিপুর বধ করে, পরে নিজভৃত্যের ঐশ্বর্য, আশ্চর্যের ন্যায় বোধ করত কৌতূহলে সেই অনুত্তম নৃপাসনে উপবেশন করলেন। কিন্তু ভয়ে কেউ তাঁর নিকট গিয়ে রাজবৎ সেবা করতে সমর্থ হলেন না। কারণ যদিও তিনি নিজের কোনো প্রতিযোদ্ধা দেখতে পাননি, তথাপি কোপে প্রজ্জ্বলিত হয়ে রইলেন। তাঁর তেজঃপূর্ণ বদন অতিশয় ভীষণ হয়েছিল। ত্রিভুবনের শিরঃপীড়া স্বরূপ দুঃসহ সেই আদিদৈত্য হিরণ্যকশিপু যুদ্ধে নৃসিংহ কর্তৃক নিহত হয়েছে দেখে হর্ষাবেদে দেবরমণীগণের বদন প্রফুল্ল হওয়ায় তারা সকালে তার উপর বারবার পুষ্প বর্ষণ করতে লাগলেন। তখন দর্শনাভিলাষী দেবগণের বিমানসমূহে গগনমণ্ডল ব্যাপ্ত হল। দেবতারা দুন্দুভি ও পটহ বাদ্য করলেন। আর গন্ধর্বগণ সঙ্গীত আরম্ভ করল এবং অপ্সরাগণ আহ্লাদে নৃত্য করতে লাগলেন।
তারপর ব্রহ্মা, ইন্দ্র, গিরিশ প্রভৃতি প্রধান প্রধান দেবগণ, ঋষিগণ, পিতৃগণ, সিদ্ধসঙ্, বিদ্যাধরগণ, মহা মহা উরগসমূহ, মুনিগণ, প্রজাপতিগণ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, চারণ, যক্ষ, কিংপুরুষগণ, বেতাল, কিন্নর, সুনন্দ, কুমুদ প্রভৃতি বিষ্ণুপার্ষদগণ–এরা সকলে সেখান এসে নিজ নিজ মস্তকে কৃতাঞ্জলিপুটে সিংহাসনে সমাসীন তীব্ৰতেজঃযুক্ত সেই নৃসিংহদেবের অনতিদূরে দাঁড়িয়ে পৃথক পৃথকভাবে স্তব করতে লাগলেন। ব্রহ্মা বললেন–ভগবান অনন্তকে প্রসন্ন করার জন্য আমি তার চরণে প্রণত হই। তার শক্তি অতিশয় দুরন্ত, প্রভাব অতি বিচিত্র এবং কর্মসকল পরম পবিত্র। তিনি অবলীলাক্রমে গুণদ্বারা প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান এই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় করছেন, কিন্তু এরূপ হয়েও স্বয়ং অপ্রচ্যুত স্বরূপ। রুদ্র বললেন–হে ভগবান, সহস্র যুগান্ত আপনার কোপ কাল, এখন এই ক্ষুদ্র অসুর নিহত হল, এখন তো আপনার কোপের সময় নয়। যদি ভক্তরক্ষার জন্য অকালে এই কোপ করে থাকেন, তবে তা সংহার করুন। এখন তার পুত্র আপনার শরণাগত ভক্ত প্রহ্লাদকে আপনি পালন করুন।
ইন্দ্র বললেন–হে পরম, আমাদের যজ্ঞভাগসকল দৈত্যগণ হরণ করে নিয়েছিল। আপনি আমাদের রক্ষা করে সে সকল আবার ফিরিয়ে আনলেন। হে প্রভো, ওই সকল ভাগ আপনারই, কারণ আপনি অন্তর্যামী ও যজ্ঞের ভোক্তা। হে বিভো, আমাদের এই হৃদয় কমল আপনারই গৃহ স্বরূপ, সেই গৃহ এতদিন পর্যন্ত ভয় হেতু আমাদের স্মৃতিপথে নিত্য অবস্থিত দৈত্যের দ্বারা আক্রান্ত ছিল, সম্প্রতি সেই ভয় দূর করে আপনি তা বিকশিত করলেন। হে নাথ, তোমার শুশ্রূষাকারী সেবকদের নিকট এই কালগ্রস্ত ত্রিলোকের ঐশ্বর্য কতটুকু, উহা অতি তুচ্ছ। হে নৃসিংহ, তোমায় যাঁরা সেবা করেন, তারা মুক্তিকে বহুজ্ঞান করেন না। অতএব যজ্ঞভাগ লাভ আমাদের পুরুষার্থ নয় আপনার পরিচর্যা লাভই আমাদের পুরুষার্থ। আপনার এই কোপ-প্রকাশে সেই কার্য সাধন হয়েছে, এক্ষণে এই ক্রোধ উপসংহার করুন।
ঋষিগণ বললেন–হে আদিপুরুষ, আপনি আপনার প্রভাবরূপ যে পরম (ধ্যান লক্ষণ) তপস্যা বলেছিলেন, যার দ্বারা আপনি আপনাতে লীন এই বিশ্ব সৃষ্টি করে থাকেন, সেই তপস্যা এতদিন এই দৈত্য কর্তৃক কুণ্ঠিত হয়েছিল। হে শরণ্যপালক, তা রক্ষার নিমিত্ত আপনি এই শরীর গ্রহণ করে আবার ‘তপস্যা কর’-বলে আমাদের যে আদেশ করলেন, তাতে অনুগৃহীত হয়ে আমরা আপনাকে নমস্কার করছি। পিতৃপুরুষেরা বললেন–আমাদের পুত্রগণের দ্বারা প্রদত্ত শ্রদ্ধাযুক্ত পিন্ডাদি যে দুরাত্মা বলপূর্বক নিজে ভক্ষণ করত ও তীর্থাদিতে স্নানকালে তাদের প্রদত্ত তিনোদকও যে পান করত, আপনি প্রখর নখের দ্বারা তার উদর বিদীর্ণ করে ওই সকল আহরণ করে দিলেন। শ্রাদ্ধাদির উদ্ধারের দ্বারা আমাদের পরম উপকারী ও অখিল ধর্মের রক্ষক সেই নৃসিংহ দেবকে আমরা নমস্কার করি। সিদ্ধগণ বললেন–হে নৃসিংহ, আমাদের যোগসিদ্ধা অনিমাদি গতি, যে দুরাত্মা যোগতপোবলের দ্বারা হরণ করেছিল এবং ধনাভিজনাদি নানা দর্পে দর্পিত সেই দুষ্টকে আপনি নখের দ্বারা বিদীর্ণ করে আমাদের সেই সিদ্ধি পুনরায় উদ্ধার করলেন, সেই আপনাকে আমরা নমস্কার করি। বিদ্যাধরগণ বললেন–আমরা পৃথক পৃথক ধারণার দ্বারা অন্তর্ধানদিরূপ যে বিদ্যালাভ করেছিলাম, যে মূঢ় বলবীর্য দীপ্ত হয়ে তা নিষেধ করেছিল, তাকে যিনি যুদ্ধে পশুর মতো নিহত করলেন, সেই মায়া-নৃসিংহকে আমরা নিত্য প্রণাম করি। নাগগণ বললেন–যে পাপাত্মা আমাদের কণাস্থিত রত্নসমূহ ও উত্তম উত্তম রমণীগণকে বলপূর্বক হরণ করেছিল, তার বক্ষ বিদীর্ণ করে যিনি সেই স্ত্রীগণের আনন্দ দান করলেন, আমরা সেই নৃসিংহদেবকে নমস্কার করি। তারপর ভগবান নৃসিংহ মনুগণের প্রতি অবলোকন করলে তারা নিজ নিজ মস্তকে অঞ্জলিবন্ধন পূর্বক বললেন–ভগবন আমরা মনু। আপনার আদেশ পালনকারী ভৃত্য দুরাত্মা দৈত্য আমাদের বর্ণাশ্রম ধর্মমর্যাদা উচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল, আপনি ওই খলকে সংহার করে আবার ধর্মসেতু স্থাপন করলেন। প্রভো, আমরা আপনার কিঙ্কর, কি করব, আদেশ করুন। প্রজাপতিগণ বললেন–হে পরেশ, আমরা আপনার সৃষ্ট প্রজাপতি। যে দৈত্যের দ্বারা নিষিদ্ধ হয়ে আমরা এতকাল প্রজা সৃষ্টি করিনি, সে এখন আপনার নখে বিদীর্ণ হয়ে মৃত অবস্থায় শয়ন করছে। এরপর আমরা সৃষ্টি করতে পারব। আপনি সত্ত্বমূর্তি, আপনার এই অবতার জগতের মঙ্গলের জন্য।
তারপর তিনি গন্ধর্বগণের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করায় তারা বললেন–হে বিভো, আমরা আপনার নট এবং নৃত্যকালীন শৌর্যবীর্য ও শক্তির দ্বারা প্রভাবশালী হয়ে আমাদের অধীন করেছিল, সম্প্রতি আপনি তার এই দশা প্রাপ্ত করলেন। এটা ঠিকই হয়েছে, যেহেতু উৎপথগামী কোন্ ব্যক্তি মঙ্গল লাভ করে থাকে? চারণগণ বললেন–হে হরে, সংসার নিবর্তক আপনার চরণ কমলের আমরা আশ্রয় গ্রহণ করলাম। এই দুরাত্মা সাধুগণের হৃদয়ে ভয়জনক হয়ে অবস্থান করত, আপনি এ অসুরের অন্তপ্রাপ্ত করালেন। যক্ষগণ বললেন–মনোজ্ঞ কর্মের দ্বারা আমরা আপনার অনুচরগণের মধ্যে প্রধান ছিলাম। এই দিতি পুত্র বলে আমাদের তার বাহক করেছিল। হে চতুর্বিংশ, তত্ত্বনিয়ামক ভগবন ওই দুরাত্মা কর্তৃক জনগণের পরিতাপ অবগত হয়ে আপনি নৃসিংহের রূপে তার পঞ্চত্ব প্রাপ্ত করলেন। আপনাকে নমস্কার।
কিংপুরুষগণ বললেন–আমরা কুৎসিত পুরুষ। আর আপনি পুরুষোত্তম সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বর, আমরা আপনার কি স্তব করব? সাধুগণের নিন্দনীয় এই কুপুরুষ (দৈত্য) আপনার দ্বারা নিহত হয়েছে, অতএব তার বধ্যে কি মাহাত্ম্য বর্ণনীয়, বৈতালিকগণ বললেন–ভগবন, সভায় এবং যজ্ঞস্থলে আপনার অমল যশ গান করে, আমরা মহতী পূজা লাভ করতাম। যে দুর্জন দৈত্য ওই পূজা নিজের আয়ত্ত করে নিয়েছিল, ভাগ্যক্রমে রোগের ন্যায় সে আপনার দ্বারা নিহত হল। এক্ষণে আমরা পূর্বের মতো সর্পয়া লাভ করতে পারব। কিন্নরগণ বললেন–হে ঈশ, আমরা আপনার অনুগত কিন্নর, এই দৈত্য বিনা বেতনে আমাদের দ্বারা কর্ম করিয়ে নিত। সম্প্রতি সেই পাপ আপনা কর্তৃক অবসাদিত হল। হে নৃসিংহ, হে নাথ, এরপর আপনি আমাদের সমৃদ্ধির নিমিত্ত হোন। শ্রীবিষ্ণুপার্ষদগণ বললেন– হে আশ্রয়প্রদ, সকল লোকের সুখাবহ আপনার এই অদ্ভুত নৃসিংহরূপ আজই আমরা দেখলাম, পূর্বে কখন দেখিনি। এই দৈত্যও আপনারই কিঙ্কর, সনকাদি ব্রাহ্মণগণের দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে সে দৈত্য হয়েছিল। এক্ষণে তার এই নিধন, তার প্রতি অনুগ্রহের (শাপমুক্তির ও নিজধাম প্রাপ্তির) নিমিত্ত বলে আমরা জানলাম।
.
নবম অধ্যায়
প্রহ্লাদ কর্তৃক নৃসিংহদেবের স্তব
নারদ বললেন–হে মহারাজ যুধিষ্ঠির, ব্রহ্মা, রুদ্র প্রভৃতি সকল দেবগণ এই প্রকারে দূর থেকে স্তব করেও ক্রোধাবিষ্ট দুষ্প্রাপ্য ভগবানের নিকট যেতে সমর্থ হলেন না। তখন দেবগণ সাক্ষাৎ লক্ষ্মীদেবীকে প্রেরণ করলেন। কিন্তু তিনিও সেই ভগবানের অদৃষ্ট ও অশ্রুতপূর্ব ভয়ংকর নৃসিংহরূপ দেখে ভীত হয়ে আর তার নিকটে গেলেন না। তারপর ব্রহ্মা নিকটে অবস্থিত প্রহ্লাদকে এই বলে প্রেরণ করলেন-হে তাত, নিকটে যাও। তোমার পিতার প্রতি কুপিত প্রভুকে প্রসন্ন কর। হে রাজন যুধিষ্ঠির, ব্রহ্মার বাক্য অঙ্গীকার করে মহাভাগবত বালক প্রহ্লাদ ধীরে ধীরে নৃসিংহদেবের নিকট গিয়ে মস্তকে অঞ্জলি বন্ধনপূর্বক ভূমিতে দণ্ডবৎ পতিত হয়ে প্রণাম করলেন। তারপর নিজ পাদমূলে পতিত বালক প্রহ্লাদকে দেখে ভগবান নৃসিংহদেবের কৃপায় পরিপ্লুত হয়ে তাকে উঠিয়ে তার মস্তকে নিজ করকমল অর্পণ করলেন। এই করকমল কালরূপ সর্পের ভয়ে ভীত জনগণের অভয়প্রদ। ভগবান নৃসিংহ দেবের করকমলের স্পর্শে প্রহ্লাদের সমস্ত অশুভ দূরীভূত হল এবং তখুনিই ভগবানের অপরোক্ষ যথার্থ জ্ঞান তিনি লাভ করলেন। তিনি নিবৃত হয়ে হৃদয়মধ্যে ভগবানের পাদপদ্মে ধ্যান করতে লাগলেন। তখন তার শরীর রোমাঞ্চিত, হৃদয় বিগলিত এবং লোচনদ্বয় অশ্রুপূর্ণ হল। তারপর তিনি সুসমাহিত হয়ে একাগ্রমনে সেই ভগবানে হৃদয় ও মন অর্পণ করে, প্রেম গদগদ বাক্যে হরির স্তব করতে লাগলেন।
প্রহ্লাদ বললেন–ব্রহ্মাদি দেবগণ, মননশীল মুনিগণ এবং জ্ঞানীসকল, যাঁদের মতি সত্ত্বগুণেই একতান (অনবচ্ছিন্ন), তারা বহুকাল ধরে এখন পর্যন্ত বাক্যপ্রবাহ ও বহু বহু গুণ দ্বারাও যাঁর আরাধনা করতে সমর্থ হননি, সেই হরি আমার স্তবে কি প্রকারে তুষ্ট হবেন? আমি ঘোর অসুর কুলে উৎপন্ন হয়েছি, হরির পরিতোষণে আমার যোগ্যতা কোথায়? আমার মনে হয়–ধন, সকুলে জন্ম, শরীরের সৌন্দর্য, তপস্যা, পাণ্ডিত্য, ইন্দ্রিয় পটুত্ব তেজঃ (কান্তি), প্রতাপ, শারীরিক বল, পৌরুষ (উদ্দ্যম), প্রজ্ঞা, অষ্টাঙ্গ যোগ–এ সকল গুণও সেই পূৰ্ণানন্দ পরমপুরুষের আরাধনায় সমর্থ নয়, যেহেতু দেখা যাচ্ছে–সেই ভগবান কেবল ভক্তির দ্বারাই গজেন্দ্রের প্রতি পরিতুষ্ট হয়েছিলেন। আমার মনে হয়–পূর্বোক্ত দ্বাদশ গুণযুক্ত ব্রাহ্মণও যদি অরবিন্দনাভ ভগবানের চরণকমলে বিমুখ হন, তবে তা অপেক্ষা চণ্ডালও শ্রেষ্ঠ, যার মন বাক্য কর্ম ধন ও প্রাণ ভগবানেই অর্পিত হয়েছে। কারণ ওই প্রকার চণ্ডাল নিজবংশের সহিত নিজ আত্মাকে পবিত্র করতে পারে। ভূবি গর্বিত ব্রাহ্মণ নিজের আত্মাকেই পবিত্র করতে পারে না, আর কুলকে কি করে পবিত্র করবে? বস্তুত ভক্তিহীন ব্যক্তির গুণ কেবল গর্বের নিমিত্তই হয়ে থাকে, আত্মশোধনের জন্য হয় না, অতএব সে চণ্ডাল অপেক্ষাও হীন।
ভগবান হরি সর্বদা নিজের আনন্দস্বরূপেই পূর্ণ, তিনি নিজের জন্য অবিদ্বান ক্ষুদ্র ব্যক্তিদের পূজা গ্রহণ করেন না, কিন্তু করুণাবশত ওই সকল ব্যক্তির কল্যাণের জন্য তা স্বীকার করেন। যেহেতু নিজের মুখে তিলকাদি শ্রী রচিত হলেই প্রতিবিম্বের শোভা হয়ে থাকে, প্রতিবিম্বে ওই শ্ৰী করতে পারা যায় না, তেমনি লোকে ধনাদির দ্বারা ভগবান যে সম্মান বিধান করে, তা নিজেদের সম্মানের নিমিত্তই হয়ে থাকে। অতএব আমি নীচ সর্বগুণহীন হলেও অনধিকারের শঙ্কাশূন্য হয়ে সর্বপ্রযত্নে যথাজ্ঞানে ঈশ্বরের মহিমা বর্ণন করি। কারণ ভগবানের মহিমা বর্ণন করলে, অবিদ্যাবশত সংসার প্রবিষ্ট পুরুষও পবিত্র হয়, এতে আমি অজ্ঞ হলেও তার স্তুতি করে শুদ্ধ হতে পারব। হে ঈশ, আমাদের মতো ভীত এই সকল ব্রহ্মাদি দেবগণ সত্ত্বমূর্তি আপনার আত্মাপালন কারী ভক্তই, অসুরজাত আমাদের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন নয়। আপনার এই প্রকার বিবিধক্রীড়া বিশ্বের মঙ্গলের জন্য, ভূতির জন্য ও নিজসুখের জন্য, কিন্তু ভয় উৎপাদনের জন্য নয়।
অতএব এখন আপনি ক্রোধ সংবরণ করুন। যার জন্য এই ক্রোধ সেই অসুর আপনার দ্বারা হত হয়েছে। অহো, বৃশ্চিক, সর্পাদির বিনাশ সাধুজনও যেমন আনন্দিত হন, তেমনি সকল লোক সুখপ্রাপ্ত হয়ে আপনার ক্রোধোপসংহারের প্রতীক্ষা করছে। হে নৃসিংহ, ভয়নিবৃত্তির জন্য জনগণ আপনার এই রূপের স্মরণ করবে। অর্থাৎ আপনার এই রূপ স্মরণ করলেই সকলের ভয় নিবৃত্তি হবে, অতএব আর ক্রোধ ধারণের প্রয়োজন নেই। হে অজিত, আপনার এই রূপ দেখে আমি ভীত নই। আপনার এই ভয়ংকর বদন, সূর্যসদৃশ নয়ন ও কুটি এবং ভয়ানক দন্ত, গলায় অস্ত্রমাল্য, কর্ণদ্বয় ও কেশর শোণিতাক্ত হয়ে উন্নত হয়েছে, আর আপনার গর্জনে দিগগজ সকল ভীত হয়ে পলায়ন করছে এবং এই শরীরের নখাগ্র দ্বারা শত্রুর হৃদয় নির্ভিন্ন হয়েছে, তবুও আমার ভয় হয় না। (আপনার এই উগ্ররূপ দর্শনে আমি ভীত নই, আমার ভয়ের কারণ, শুনুন)–উগ্র সংসারচক্রে যে দুঃসহ দুঃখ, তা থেকেই আমি ত্রস্ত হয়েছি। কারণ আমি নিজ কর্ম দ্বারা ওই সংসারচক্র হিংস্র জন্তুমধ্যে বদ্ধ হয়ে নিক্ষিপ্ত রয়েছি। হে কৃপা বৎসল, হে উশত্তম, আপনি কবে প্রীত হয়ে আপনার অপবর্গ–স্বরূপ চরণমূলে আমাকে আহ্বান করবেন?
হে দেব, আমি দেব, তির্যগ, মনুষ্যাদি সকল যোনিতেই প্রিয়জনের সাথে বিয়োগ ও অপ্রিয়জনের সাথে সংযোগ দেখে শোকানলে অতিশয় দগ্ধ হচ্ছি। ভগবান ওই বিষয়ে যে দুঃখ প্রাপ্ত হই, তার প্রতিকার করতেও আমার ইচ্ছা হয় না, যেহেতু দুঃখের প্রতিকারও দুঃখই। হে বিভো, এইরূপে দেহাদিতে অহংবুদ্ধি করে আত্মাভিমানে মুগ্ধ হয়ে আমি ভ্রমণ করছি। অতএব আপনি কৃপাপূর্বক আমার নিস্তারের উপায় আপনার দাস্যবেগে বলে দিন। হে নৃসিংহ, আমি আপনার দাস হলে, প্রিয়, পরম সুহৃৎ ও পরদেবতা আপনার লীলাকথা উচ্চারণ করত সুমহৎ দুঃখসকলও গণ্য করব না। তখন আপনার পদযুগলই যাঁদের আলয়, সেই সকল ভক্তস্বরূপ যে সমস্ত হংস (অর্থাৎ সারাসার–বিবেকী জ্ঞানী) তাদের সাথে সঙ্গ হওয়ায় নানাপ্রকার বিষয়াসক্তি হতে বিশেষরূপে পরিত্রাণ পাব। প্রভো, আপনার লীলাকথা অবগত হওয়া আমার পক্ষে কঠিন হবে না, ব্রহ্মা ওই সকল কথা গান করেছিলেন। তাতে তা সম্প্রদায় প্রবৃত্ত হয়ে আসছে।
তপ্তজনের দুঃখের প্রতিকারক বলে যেগুলি এ জগতে প্রসিদ্ধ রয়েছে। সেগুলি তোমা কর্তৃক উপেক্ষিত দেহধারী প্রাণিদের কি সাক্ষাৎনিবর্তক হয়? না, তা হয় না। কারণ ইহলোক মাতা পিতা বালকের রক্ষক সত্য কিন্তু তাদের বর্তমানে, এমন কি কখন তাদের দ্বারাই বালকের মৃত্যু ঘটে থাকে, আর্ত রোগীর ঔষধ ব্যবহার করলেও মৃত্যু হতে দেখা যায়। আবার সমুদ্রে নিমজ্জমান ব্যক্তির নৌকা শরণ নয়। কারণ নৌকার সহিত নিমজ্জিত হতে দেখা যায়। কখন কখন যে অপর রক্ষক দেখা যায়, সেখানে সেই সেই রূপে আপনিই রক্ষক–ইহাই প্রতিপাদন করছেন, ভগবান, পৃথক পৃথক স্বভাব বিশিষ্ট অপর কর্তা, অথবা পরকর্তা ব্রহ্মাদি যাহা কর্তৃক প্রেরিত হয়ে, যে অধিকরণে, যে নিমিত্ত হতে, যে কালে, যে হেতুতে, যার সম্বন্ধে যে অপাদান হতে, যার নিমিত্ত, যে প্রকারে, যে যে অভীপ্সিত বিষয় উৎপন্ন করেন অথবা রূপান্তর ঘটিয়ে থাকেন, সে সকল আপনারই স্বরূপ। হে ঈশ, আপনার অংশ পুরুষের ইক্ষণরূপ অনুগ্রহে কালবশত মায়ার গুণ ক্ষুব্ধ হলে, ওই মায়া মনঃপ্রধান লিঙ্গ শরীর সৃজন করেন। কর্তৃস্বরূপ ওই মন দুর্জয় বেদোক্ত কর্মময় (অর্থাৎ অনন্ত কর্মময় বাসনা-বাসিত), যাতে জীবের অবিদ্যা ভোগের জন্য ষোড়শ বিকার (একাদশ ইন্দ্রিয় ও পঞ্চ মহাভূতাত্মক অরবিশিষ্ট) অর্পণ করেছে। হে অচ্যুত, এইরূপ সংসারচক্রে পতিত কোন ব্যক্তি, মনকে পৃথক করে আপনার ভজনে নিযুক্ত না করে নিস্তার পেতে পারে?
হে ভগবন, আপনি সেই পুরুষ, যিনি চিৎশক্তির দ্বারা বুদ্ধির গুণসকলকে নিত্য জয় করেছেন। আর, যেহেতু আপনি কালস্বরূপ, অতএব কার্য ও কারণ সকলের শক্তি আপনার বশীভূত। হে ঈশ্বর, আমি এই ষোড়শচক্রে মায়া কর্তৃক নিক্ষিপ্ত হওয়ায় ইক্ষুদণ্ডের মতো নিপীড়িত হচ্ছি। আপনি কৃপাপূর্বক আমাকে উদ্ধার করুন। আমি আপনারই প্রপন্ন, আমাকে কাছে টেনে নিন। লোকপালদের ঐশ্বর্যে অথবা পিতৃক রাজ্যে আমার প্রয়োজন নেই। লোকে স্বর্গে অখিল লোকপালদের যে যে আয়ু, সম্পদ এবং উদ্ভব প্রভৃতির অভিলাষ করে থাকে, আমি সে সকলের তত্ত্ব বেশ ভালোভাবেই দেখেছি। আমার পিতার কোপ, হাস্য ও বিকৃত ভঙ্গি মাত্রে অনেকের ওই সকল বিধ্বস্ত হয়েছিল। প্রভো, আমার সেই প্রভাবশালী পিতাও আপনার নিকট পরাভূত হয়েছে। আর, শরীরদের ওই সকল ভোগের পরিণাম আমি জানি। এই জন্য, আয়ুশ্রী, বিভব, কিংবা ব্রহ্মার ভোগ পর্যন্ত ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়সকল কিছুই বাঞ্ছা করি না। অনিমাদি সিদ্ধিতেও আমার স্পৃহা নেই। কারণ, মহাবিক্রমশালী কালরূপী আপনার দ্বারা ওই সকলও বিনষ্ট হয়ে যাবে। আমার এইমাত্র প্রার্থনা–আপনার নিজ সেবকগণের নিকটেই আমাকে স্থাপন করুন। ভগবন শ্রেয়ঃসকল শ্রবণমাত্রেই সুখজনক, কিন্তু ওই সকল মৃগতৃষ্ণার (মরীচিৎকার) ন্যায় মিথ্যা, অতএব সে সকল কোথায়, আর অশেষ রোগের উদ্ভব স্থান এই কলেবরেই বা কোথায়? এ সকল বিষয় সকলে জানালেও তা থেকে তারা বিযুক্ত হয় না। কারণ দুষ্পপ্য মধুতুল্য বৈষয়িক সুখলেশের দ্বারাই তারা নিজ নিজ অভিলাষরূপ অনল শান্ত করতে ব্যগ্র (অর্থাৎ অভিলাষানল শমনের জন্য ব্যগ্রতাবশতঃ তাদের নির্বেদেরও অবকাশ হয় না।) আপনার অনুকম্পাতেই আমার নির্বেদ এসেছে। হে ঈশ, রজোগুণ হতে যার উৎপত্তি এবং তমোগুণই যাতে প্রচুর, সেরূপ অসুরকুলে উৎপন্ন আমিই বা কোথায়? আর আপনার অনুকম্পাই বা কোথায়? পদ্মের মতো সকলের সন্তাপহারী আপনার যে করকমল আমার মস্তকে অর্পিত হল, এই অনুকম্পা ব্রহ্মা, ভব ও লক্ষ্মীদেবীও লাভ করেননি।
হে প্রভো, আপনি জগতের আত্মা ও সুহৃৎ, এজন্য প্রাকৃত জন্তুর মতো পরাবর মতি (অর্থাৎ পর ব্রহ্মাদি উত্তম এবং এ অসুর অবর নীচ এরূপ বুদ্ধি) নেই। সুতরাং আমার প্রতি আপনার এই অনুকম্পা বিচিত্র নয়। কল্পবৃক্ষের ন্যায় সেবানুরূপই আপনার প্রসাদ হয় এবং যে যেমন সেবা করে, তার সেই অনুসারে ধর্মাদির উদয় হয়ে থাকে (অর্থাৎ কল্পবৃক্ষ যেমন সেবকেরই সংকল্প অনুসারে ফল দান করে, কারও প্রতি বিষম হয় না, তেমনি সেবাই আপনার প্রসন্ন। তার কারণ, উত্তমত্ব অথবা অধিমত্ব তার কারণ নয়)। সর্বতোভাবে কামনার অভিলাষী হয়ে লোকে জন্মরূপ কালসর্পযুক্ত সংসার কূপে পতিত হচ্ছে, আমিও তাদের অনুসরণ করে তাদের সঙ্গবশত সেখানেই পতিত হয়েছিলাম। পূর্বে দেবর্ষিনারদ নিজ জ্ঞান দান করে এরূপ অনুকম্পা করেছিলেন এবং এক্ষণে আপনিও আমার প্রতি অনুগ্রহ করলেন। ভগবন, আমি এইরূপে অনুগৃহীত হওয়ায় আপনার ভৃত্যসেবা কি করে পরিত্যাগ করি? অতএব আমাকে নিজ ভৃত্যপার্শ্বে স্থান দিন।
হে অনন্ত, আমার এই যে প্রাণরক্ষা এবং আমাকে বধ করতে উদ্যত আমার পিতার প্রাণবধ–এই উভয়ই কেবল আপনার নিজভৃত্য ঋষির বাক্য সত্য করার নিমিত্ত, এ আমার নিশ্চয় বোধ হচ্ছে। কেননা, আমার পিতা হিরণ্যকশিপু (তোমার ভক্ত, স্বপুত্র আমার বধরূপ) অযুক্ত কার্য করতে ইচ্ছুক হয়ে, খঙ্গ গ্রহণ পূর্বক বলেছিলেন, “মদ্ব্যতিরিক্ত অন্য ঈশ্বর আছে, বলছিস। যদি থাকে, তোকে রক্ষা করুক, এই আমি তোের শিরচ্ছেদ করছি”। পক্ষপাতপূর্বক এইরূপ ভৃত্যরক্ষা ও দৈত্যহত্যা করা আপনার স্বাভাবিক নয়, উহা আপনার মায়াগুণের উপাধিমাত্র। কারণ এই অখিল জগৎ এক আপনারই স্বরূপ, যেহেতু এর প্রথমে ও চরমে আপনিই বিরাম করেন (অর্থাৎ কারণত্ব ও অবধিত্বরূপে বর্তমান থাকেন), অতএব মধ্যেও আপনি বর্তমান। হে ঈশ্বর, আপনিই নিজ মায়ার দ্বারা গুণপরিণাম স্বরূপ এই জগৎ সৃষ্টি করে এতে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছেন। সুতরাং সেই সকল গুণের কারণ (নানারূপে অর্থাৎ কখন রক্ষক, কখন বা হস্তা) বলে আপনিই প্রতীত হয়ে থাকেন।
হে ঈশ, সৎ, অসৎ (অর্থাৎ কার্য-কারণাত্মক) এই জগৎ আপনিই। এ জগৎ আপনা থেকে পৃথক নয়। কিন্তু আপনি এ জগৎ থেকে ভিন্ন। যেহেতু প্রথমে ও শেষে আপনি পৃথক অবস্থান করেন। অতএব এ আত্মীয়, এ পর’–এই যে বুদ্ধি তা মিথ্যা মায়ামাত্র। প্রভো, এই জগতের যে প্রকাশ ও সৃষ্টি, স্থিতি, বিনাশ–উহা বীজ ও বৃক্ষের, পৃথ্বী ও ভূতসূক্ষ্মের ন্যায়। (অর্থাৎ বৃক্ষ যেমন বস্তুতঃ পৃথ্বীময় বীজমাত্র এবং সেই বীজ যেরূপ ভূতসূক্ষ্ম মাত্র, তেমনি কার্য-কারণাত্মক সকল জগৎ, পরম কারণ যে আপনি, আপনারই স্বরূপ।) হে ভগবান, এই জগৎ নিজের দ্বারাই নিজেতে নিক্ষেপ করে, নিজসুখ অনুভব করতে আপনি নিষ্ক্রিয় হয়ে প্রলয় হলে শয়ন করে থাকেন। যোগের দ্বারা আপনার নয়নদ্বয় নিমীলিত এবং স্বরূপ প্রকাশ নিদ্রা নিপীতা (নিরস্তা) হয়, অতএব জীবের মতো আপনার তমোবৃত্তিরূপা নিদ্রা নেই। আর, আপনি (জাগ্রতাদি) অবস্থায়তিরিক্ত হয়ে স্বরূপে অবস্থিত, এজন্য সুষুপ্তের ন্যায় তমোগুণে সৃষ্ট নন এবং জাগ্রৎ-স্বপ্নের তুল্য বিষয়সকলও আপনার দৃষ্টিগোচর হয় না। ভগবন যে আপনি প্রলয়কালীন সমুদ্রজলে শয়ন করেন, এই জগৎ সেই আপনারই স্বরূপ। অন্যকারো নয়। নিজ কালশক্তির দ্বারা প্রকৃতির ধর্ম সত্ত্বাদিকে আপনি প্রেরণ করে থাকেন। হে ঈশ্বর, শেষরূপে শয়নকালে সমাধি হতে বিরত হবার সময় আপনার নাভি থেকে (একটি বোদকে) একটি মহাপদ্ম হয়েছিল তা আপনাতেই গুঢ়রূপে ছিল, সূক্ষ্ম বটবীজ হতে মহাবৃক্ষ যেমন হয়। তার ন্যায় ওই পদ্ম হতে এই সমস্ত লোক হয়েছে। সেই পদ্ম হতে উদ্ভূত ব্রহ্মালদ্ভিন্ন অন্য কোনো বস্তু দেখতে পান নাই। যদিও উপাদান কারণরূপী আপনি তার দেহে ব্যপ্ত ছিলেন তথাপি আপনাকে জানতে পারেননি, শত বৎসর জলে নিমগ্ন ছিলেন।
ব্রহ্মা কি করে জানবেন, অঙ্কুর উৎপন্ন হলে কি কখন বীজ দৃষ্ট হয়? কিন্তু আপনার উপাসনায় কি হয়? পরে ব্রহ্মা বিস্মিত হয়ে সেই পদ্ম আশ্রয় করে দীর্ঘকাল তীব্র তপস্যা করলে শুদ্ধচিত্ত হয়ে যেমন ভূমিতে সূক্ষ্ম গন্ধ ব্যাপ্ত থাকে তেমনি ভূত ইন্দ্রিয় মায়াময় আত্মায় সন্মাত্র রূপে বর্তমান আপনাকে দেখতে পেলেন। “তখন আপনার সহস্র বদন, সহস্র চরণ, সহস্র হস্ত, সহস্র উরু, সহস্র নাসিকা, সহস্র কর্ণ এবং সহস্র নয়ন প্রকাশ পেয়েছিল। আপনি সহস্র সহস্র আভরণ ও অস্ত্রে সমৃদ্ধ ছিলেন। ওই রূপ আপনার মায়া প্রধান, যেহেতু পাতলাদি প্রত্যাহত দ্বারা পদাদি রচনা হয়েছিল। মহাপুরুষ আপনার এরূপ দর্শন করে ব্রহ্মার মহৎ আনন্দ হয়েছিল। হে ভগবান, তৎকালে আপনি ব্রহ্মার প্রতি বিস্তর অনুগ্রহ করেন, কেননা হয়গ্রীব মূর্তি ধারণ করে দেবদ্রোহী মধুকৈটভ নামক অসুরদ্বয়ের বধ করে তাকে শ্ৰশ্বতিগণ ও রজঃ, তমঃ সমর্পণ করেন। ঋষিগণ বলেন সত্ত্বগুণ আপনার প্রিয়তম তনু। হে মহাপুরুষ, আপনি এই প্রকারে মনুষ্য, তির্যক, ঋষি। দেব, মৎস্যাদি–অবতার সমূহের দ্বারা লোক সকলের পালন এবং যারা জগতের প্রতিকূল, তাদের বিনাশ করেন। আর যুগে যুগে যে ধর্ম অনুবৃত্ত, তা রক্ষা করেন। কিন্তু কলিযুগে আপনি ছন্ন হয়েছিলেন, বস্তুত তিন যুগে আবির্ভূত হন, এজন্য আপনি ত্রিযুগ বলে প্রসিদ্ধ। (কলিযুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের নামরূপ আচ্ছন্ন করে গৌরাঙ্গরূপে প্রকটিত হয়ে সংকীর্তন যজ্ঞের প্রকটন করেন। তা একাদশ স্কন্ধে নবযোগীন্দ্র সংবাদ কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাকষ্ণ ইত্যাদি শ্লোকে বর্ণনা করবেন।)
হে বৈকুণ্ঠনাথ, আমার এই মন অধর্মে দূষিত। সদাই বহির্মুখে প্রবৃত্ত, দুর্ধর্ষ কামাতুর, নিরন্তর হর্ষ, শোক, ভয় এবং আধ্যাত্মিক আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক এই ত্রিবিধ দুঃখে পীড়িত হয়েও আপনার কথায় প্রীত হয় না। এ প্রকার মন নিয়ে অতি দীন আমি কি করে আপনার তত্ত্ব বিচার করব? হে অচ্যুত, আমার অবিতৃপ্ত জিহ্বা মধুরাদি রসের দিকে আমাকে আকর্ষণ করছে। এইরূপ শিশ্ন অন্য দিকে, ত্বক আর এক দিকে আকর্ষণ করছে। আর, উদর ক্ষুধায় সন্তপ্ত হয়ে সদ্যই যে কোনো প্রকার আহারের প্রতি এবং শ্রবণ, ঘ্রাণ ও চঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের দিকে, সেরূপ কর্মন্দ্রিয়সকল অন্য কোনো স্থান, যেমন সপত্নীগণ গৃহপতিকে আকর্ষণ করে ব্যতিব্যস্ত করে, তেমনি আমাকে টেনে বিব্রত করছে। হে ভগবন, এইরূপ সংসাররূপ বৈতরণী মধ্যে নিজকর্মদোষে পতিত হয়েছি। বারবার জন্ম-মৃত্যুর ভয়ে ভীত জনকে স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করে অনুগ্রহপূর্বক রক্ষা করুন। প্রভো, এ জন নিজের ও পরের বিগ্রহে যথাযথ বৈরী ও মিত্ৰতা করে। অতএব হে ভবনদীর পারে স্থির নিত্যমুক্ত এ ব্যক্তি অতি দীন ও অতি মূঢ়, আপনি আমাকে রক্ষা করুন।
হে ভগবন, আপনি অখিলের গুরু এবং এই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের কারণ, আপনার? আয়াস কি? অর্থাৎ সকল জনকে নিস্তার করা আপনার পক্ষে দুষ্কর কর্ম নয় আপনি আর্তজনের বন্ধু, মূঢ়জনেও আপনার মহৎ অনুগ্রহ। আমরা আপনার ভক্তজনের সেবক, আমাদের উদ্ধার তো আপনার অতি তুচ্ছ কর্ম। হে সর্বোত্তম, আপনার বীর্য-গানরূপ মহৎ অমৃতে আমার চিত্ত মগ্ন হয়েছে, তাতে আমি দুম্পার সংসার বৈতরণীকেও ভয় করি না। কিন্তু আমার শোক হয় তাদের জন্য, যে সকল মূঢ় ওই মহামৃত হতে বিমুখ হয়ে বিষয় সুখের জন্য কুটুম্বাদির ভার বহন করছে। হে দেব, মুনিগণ প্রায় নিজ নিজ মুক্তি কামনা করে নির্জনে বিচরণ করে থাকেন, অন্যের জন্য তাদের কোনো যত্ন দেখতে পাই না। আমার এই সঙ্গী বালকগণ অতি দীন, এদের পরিত্যাগ করে একাকী মুক্ত হতে আমার ইচ্ছা হয় না। আপনি ছাড়া অন্য কাউকে পদ্মযোনিতে ভ্রমণরত জীবের পরিত্রাতা দেখতে পাই না, অতএব এদের উদ্ধারের জন্য আপনার নিকটই প্রার্থনা করছি।
গৃহাশ্রমে স্ত্রীসঙ্গাদির দ্বারা গৃহস্থ যে সুখ বোধ করে, তা অতি তুচ্ছ-করদ্বয়ের সংঘর্ষে যেমন দুঃখের পর দুঃখই আনয়ন করে এটা সেরূপ। এরূপ বহু দুঃখভোগী গৃহমেধী যে জন, সে সুখে তৃপ্তও হয় না, আবার তাদের নির্বেদও আসে না। আপনার প্রসাদে কেবল কোনো কোনো ধীর ব্যক্তি কস্তুরির ন্যায় কাম সহ্য করতে পারে। হে অন্তর্যামী, মৌন, ব্রত, শত্ত্বত, (উপদেশ শ্রবণ) তপস্যা, অধ্যয়ন, স্বধর্ম ব্যাখ্যা, নির্জনে বাস, জপ এবং সমাধি–এগুলি মোক্ষসাধনের উপায় বলে প্রসিদ্ধ, কিন্তু এগুলি প্রায় অজিতেন্দ্রিয় পুরুষদের বিষয়ভোগের জন্য জীবিকার উপায় বলে ব্যবহৃত হয়। দম্ভের ফল নিয়ত একরূপ নয়, এজন্য দাম্ভিক লোকদের পক্ষে ওই সকল মৌনাদি কখন জীবনোপায় হতে পারে, কখনও নাও হতে পারে। আপনার জ্ঞান-ভক্তি ব্যাতীত সকাম মৌনাদির দ্বারা কখনই হতে পারে না, তাই বলছি–হে দেব, বীজ ও অঙ্কুরের ন্যায় এই সৎ ও অসৎ (অর্থাৎ কারণ ও কার্য) আপনার রূপ বলে বেদে প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুত আপনি প্রাকৃত রূপাদি শূন্য, এতে দেবদত্তাদির গৌরত্বাদি রূপের ন্যায় আপনার অন্যরূপ নেই। অতএব জিতেন্দ্রিয় জনগণ ভক্তিযোগের দ্বারা কাষ্ঠে বহ্নির প্রায় কার্য ও কারণ উভয়েই আপনাকে অনুগত দেখে থাকেন। অভক্ত জনগণ আপনাকে দেখতে পায় না। হে উরুগায়, এই উভয় (অর্থাৎ কার্য ও কারণ) প্রধান অথবা পরমাণু প্রভৃতি হতে কখন হতে পারে না, অতএব আপনিই সকলের কারণ, আপনি সকল বস্তুতে অনুস্ত হয়ে আছেন।
বস্তুত বায়ু, অগ্নি, পৃথিবী আকাশ, জল পঞ্চতন্মাত্র, প্রাণ, ইন্দ্রিয়, মন, চিত্ত ও অহঙ্কার। এ সমস্তই আপনি। হে ভূমন, স্কুল, সূক্ষ্ম–এ সকলও আপনি, অধিক কি মন ও বাক্যের দ্বারা প্রকাশিত কোনো বস্তুই আপনা থেকে ভিন্ন নয়। কিন্তু আপনি এই প্রকারে নিজেতে অনুগত থাকলেও অভক্তগণ আপনাকে জানতে পারে না, তাই বলছেন–গুণসকল (গুণাধিষ্ঠাত্রী দেবতা), গুণিগণ (ব্রহ্মাদি), মহাদাদি, মন প্রভৃতি এবং দেবতা, মনুষ্য–এরা সকলেই জড়োপাধি, আদি ও অন্তবিশিষ্ট সুতরাং নিরূপাধি আপনাকে জানতে পারে না। এই কারণে বিদ্বান ব্যক্তিগণ বিচার করে অধ্যয়নাদি ব্যাপার থেকে বিরত হয়ে থাকেন অর্থাৎ অধ্যয়নাদি বিসর্জন দিয়ে ভক্তিসমাধিযোগে আপনার উপাসনা করেন। অতএব হে পূজ্যতম, নমস্কার, স্তব, কামার্পণ, অৰ্চন, চরণ-স্মরণ ও কথা-শ্রবণ–এই ষড়ঙ্গ সেবা ব্যতিরেকে, পরমহংসগমের প্রাপ্য আপনাতে কি প্রকারে ভক্তিলাভ করাব? প্রভো, এই প্রকারে যেহেতু ভক্তি ব্যতিরেকে মুক্তি হয় না এবং বিনা সেবায় ভক্তি দুঃসাধ্য, অতএব আমি প্রথমে যে দাস্য প্রার্থনা করেছি, তাই আমাকে প্রদান করুন। . শ্রীনারদ বললেন–ভক্ত এই প্রকারে ভক্তিপূর্বক গুণ বর্ণন করলে, সেই নির্গুণ নৃসিংহ কোপ উপসংহার করে প্রীত হয়ে প্রণত প্রহ্লাদকে বলতে লাগলেন। ভগবান বললেন–হে ভক্ত প্রহ্লাদ, তুমি অসুরদের মধ্যে উত্তম, তোমার মঙ্গল হোক, আমি তোমার প্রতি প্রীত হয়েছি তোমার অভিলষিত বর প্রার্থনা কর। আমিই মানবদের কামনা পূর্ণ করে থাকি। হে আয়ুষ্মন, আমার প্রতি উৎপন্ন না করে, কেউ আমার দর্শন লাভ করতে পারে না। কিন্তু আমার দর্শন পেলে, অপূর্ণকাম বলে কোনো ব্যক্তিকে শোক করতে হয় না। অতএব হে মহাভাগ, ধীর সাধুগণ শ্রেয়স্কাম হয়ে সকল কল্যাণপতি আমার সর্বতোভাবে সন্তোষ জন্মিয়ে থাকেন। নারদ বললেন–যে সকল বরে সকল লোকেরই লোভ জন্মে, সেরূপ বহু বর দ্বারা প্রলোভিত হলেও একান্ত (নিরুপাধিক) ভক্ত অসুরোত্তম প্রহ্লাদ ওই সকলের কিছুই চাইলেন না।
.
দশম অধ্যায়
প্রহ্লাদের রাজ্যাভিষেক ও ত্রিপুর দহনের বৃত্তান্ত
নারদ বললেন–বালক প্রহ্লাদ ভগবানের কথিত বরগুলি ভক্তির অন্তরায় (প্রতিবন্ধক) মনে করে, বিস্মিত হয়ে নৃসিংহদেবকে বললেন। প্রহ্লাদ বললেন–ভগবন, আমি স্বভাবত কামাসক্ত আবার এই সকল বর দিয়ে কামনার প্রতি লোভ দেখাবেন না। আমি কামসঙ্গ থেকে ভীত হয়ে নির্বিঘ্নচিত্তে মুক্তি বাসনায় আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আমার মনে হয় ভৃত্যের লক্ষণ (অসাধারণ ধর্ম) লোকে জানানোর জন্য সংসারের বীজ এবং হৃদয়ের গ্রন্থির মতো বন্ধক কাম সকলে আমাকে প্রেরণ করছেন। আপনি অখিলগুরু (সর্বজনের হিতোপদেষ্টা), করুণাত্মা, আপনার এ প্রকার অনর্থসাধন প্রবৃত্তিদান সম্ভব নয়। দুর্লভ দর্শন আপনাকে লাভ করে, যে ব্যক্তি সাংসারিক মঙ্গল প্রার্থনা করে সে আপনার ভৃত্য নয়, সে ব্যবসায়ী বণিক। কামনা পূরণের দ্বারা সেবকদের যে স্বামী ভৃত্য ভাব লোকে প্রসিদ্ধ রয়েছে, তা সোপধিকমাত্র বাস্তবিক নয়। যেহেতু যে ব্যক্তি প্রভুর নিকট নিজের কল্যাণ অপেক্ষা করে সে ভৃত্য নয়, আর যিনি ভৃত্যের নিকট থেকে প্রভুত্ব ইচ্ছা করত তাকে অর্থাধি দেন। তিনিও প্রভু নন। আমাদের প্রভু-ভৃত্য ভাব সেরূপ সোপাধিক নয়, আমিও আপনার নিষ্কাম ভক্ত, আর আপনিও অনভিসন্ধি (অনন্য প্রয়োজন) স্বামী। অতএব রাজা ও সেবকের ন্যায় কাম ও অভিসন্ধিতে আমাদের প্রয়োজন নেই।
হে বরদৰ্ষভ, আপনার সন্তোষের জন্য যদি আমার অভিলষিত বর নিতান্তই দিতে ইচ্ছা করেন, তবে আপনার কাজে এই বর প্রার্থনা করি–যেন আমার হৃদয়মধ্যে কামাঙ্কুরের উৎপত্তি না হয়। কামাঙ্কুরের উৎপত্তি মাত্রই ইন্দ্রিয়, মন, প্রাণ, দেহ, ধর্ম, ধৈর্য, বুদ্ধি, লজ্জা, সম্পদ, তেজ, স্মৃতি এবং সত্য এ সকল নষ্ট হয়ে যায়। হে পুন্ডরিকাক্ষ যখন মানব মনস্থিত কামনাসকল পরিত্যাগ করে তখন আপনার মতো জ্ঞান ও ঐশ্বর্য লাভের যোগ্য হয়। তারপর ভগবান যেন নির্দোষ কামসকল দিতে ইচ্ছা করছেন–এটা মনে করে তা নিবারণের জন্য ভগবানকে প্রণাম করতে লাগলেন–”প্রভো আপনি ভগবান পরমপুরুষ মহাত্মা হরি, অদ্ভুত সিংহ, পরম ব্রহ্ম, পরমাত্মা আপনাকে নমস্কার।
শ্রীভগবান বললেন–বৎস, যদিও তোমার মতো একান্ত ভক্তগণ ইহকাল ও পরকালের কোনো কল্যাণ কখনই প্রার্থনা করে না, তবুও তুমি আমার আদেশে এই মন্বন্তর কাল পর্যন্ত এখানে থেকে দৈত্যেশ্বরগণের অধিপতি হয়ে তাদের ঐশ্বর্য ভোগ কর। এক অদ্বিতীয় সর্বভূতে অবস্থিত যজ্ঞের অধিষ্ঠাতা ঈশ্বর আমাকে তোমার নিজচিত্তে নিবেশপূর্বক আমার প্রিয় কথা শ্রবণ করতঃ আমাতে অপর্ণরূপ যোগের দ্বারা কর্ম পরিত্যাগ করে যজ্ঞ কর। সুখানুভবের দ্বারা প্রারব্ধ পূণ্য, সুকৃত আচরণের দ্বারা পাপ এবং কালগতিতে কলেবর পরিহার করে মুক্তবন্ধ (গ্রীবন্মুক্ত) হয়ে আছো, এখন লোকের প্রতি অনুগ্রহের জন্য সুরলোকগীত বিশুদ্ধ কীর্তি বিস্তার করে আমাকে প্রাপ্ত হবে। (প্রহাদের প্রারব্ধ পাপ বা পুণ্য কিছুই নেই। ভগবানের দ্বারা কৃতার্থ হবার পর একথা বলছেন লোকসংগ্রহের জন্য। প্রহ্লাদ নারদাদির মতো অংশে সাধনসিদ্ধ এবং অংশে নিত্যসিদ্ধ জানতে হবে।) বৎস, তুমি আমার এই যে স্তব করলে, যে ব্যক্তি তোমাকে, আমাকে এবং আমার এই চরিত্র স্মরণ করে, যথাকালে তোমার এই স্তব কীর্তন করবে, সেও কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হবে, আর তোমার বন্ধনের আশঙ্কা কোথায়?
প্রহ্লাদ বললেন–হে মহেশ্বর, আপনি বর দিতে চেয়েছেন। বরদাতাগণের অধীশ্বর আপনার নিকট হতে অন্য বর চাইছি–আমার পিতা আপনার ঐশ্বরিক তেজ না জেনে আপনার নিন্দা করেছেন। ক্রোধযুক্ত চিত্ত হয়ে তুমি ভ্রাতৃহন্তা এই মিথ্যাদৃষ্টিবশতঃ আমার পিতা সর্বলোকগুরু পরম প্রভু আপনাকে যে কটুক্তি করেছেন এবং আমি তোমার ভক্ত বলে আমার প্রতি দ্রোহ করেছেন, এই সকল দুস্তর পাপ থেকে তিনি পবিত্র হোন। হে কৃপা বৎসল, আপনার অপাঙ্গদৃষ্টিতে তিনি নিশ্চর পবিত্র হয়েছেন, তবুও আমি অজ্ঞ বলে প্রার্থনা করলাম।
শ্রীভগবান বললেন–হে নিষ্পাপ, কেবল তোমার পিতাই পবিত্র হয়নি, যদি একবিংশতিবার তোমার পিতার জন্ম হয়, তবে তারাও পবিত্র হবে। যেহেতু তুমি তার কুলে জন্মগ্রহণ করেছ। হে সাধো, তুমিই তোমার মাতাপিতার কুলতারণ। যেখানে যেখানে সমদর্শী, প্রশান্ত, সাধু সদাচার–সম্পন্ন আমার ভক্তগণ থাকে, সেখানে কীটতুল্য হীন বংশীয়েরাও পবিত্র হয়। আমার ভক্তিহেতু যারা স্পৃহাশূন্য হয়েছে, ছোট-বড় কোনো প্রাণীকে হিংসা করে না, যারা তোমার মতো ভক্তগণের অনুব্রত, তারাই আমার ভক্ত। তুমি আমার ভক্তগণের উপমাস্থল অর্থাৎ তুমি সকলের শ্রেষ্ঠ। হে তাত, আমার অঙ্গসংস্পর্শে তোমার পিতা সর্বতোভাবে পূত হয়েছে। এক্ষণে তুমি পুত্রের কর্তব্য প্রেতকৃত্যাদি (দাহ, শ্রাদ্ধ, অর্পণাদি) কর। তোমার পিতা সুপ্রজ্যাঃ (অর্থাৎ তোমার মতো পুত্র লাভ করেছেন) আমার অঙ্গ-স্পর্শের দ্বারা তার সদগতি হবে। তারপর তুমি পৈতৃকপদে (দানবদের অধিপতিরূপে রাজসিংহাসনে) অধিষ্ঠিত হয়ে মুনিগণের নির্দেশ অনুসারে আমাতে মনোনিবেশপূর্বক যৎপর হয়ে তদনুরূপ কর্ম করতে থাকে। নারদ বললেন–হে রাজন, ভগবানের আদেশ অনুসারে দ্বিজগণ কর্তৃক অভিষিক্ত হয়ে প্রহ্লাদ পিতার পারলৌকিক কার্যাদি সম্পন্ন করলেন। তারপর প্রজাপতি ব্রহ্মা সেই নৃসিংহরূপী হরিকে প্রসাদসুমুখ দর্শন করে, পবিত্র বাক্যে বহু স্তব করলেন, পরে দেবগণের দ্বারা পরিবৃত হয়ে বলতে লাগলেন-হে দেবদেব, হে অখিলপাতি, হে ভূতভাবন, হে পূর্বজ, দুরাত্মা হিরণ্যকশিপু আমার কাছে বর নিয়েছিল আমার সৃষ্ট কোনো প্রাণীর দ্বারা বধ্য হবে না, আর তপস্যা যোগ ও শক্তিতে উদ্ধত হয়ে সমস্ত ধর্ম উচ্ছেদ করতে প্রবৃত্ত হয়েছিল। লোকসন্তাপকারী ওই পাপ অসুর আপনার দ্বারা নিহত হলো, এটা পরম ভাগ্য। আর ঐ দৈত্যের পুত্র মহাভাগবত বালক প্রহ্লাদের যে মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা করলেন, ইহাও সুমহৎ ভাগ্য। ওই প্রহ্লাদ এক্ষণে যে আপনাকে প্রাপ্ত হলেন, ইহাও অতিশয় ভাগ্য, আপনি পরমাত্মা আপনার এই নৃসিংহরূপের ধ্যানকারী ব্যক্তি সমস্ত ভয় ও মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা পাবে।
ভগবান বললেন–হে বিভো, হে পদ্মসম্ভব, অসুরগণ অতি ক্রস্বভাব, সর্পদের দুগ্ধ দানের ন্যায়, আপনি তাদের এরূপ বর আর দেবেন না। নারদ বললেন–হে মহারাজ যুধিষ্ঠির, ভগবান এই প্রকার পরমেষ্ঠী ব্রহ্মার দ্বারা পূজিত হয়ে সকল প্রাণীর অদৃশ্য হয়ে অন্তর্হিত হলেন। তারপর প্রহ্লাদ ভগবানের অংশ ব্রহ্মা, মহেশ এবং প্রজাপতি প্রভৃতি সকল দেবগণের পূজা করে মস্তক দ্বারা বন্দনা করলেন। তারপর পদ্মযোনি ব্রহ্মা, শুক্রাদি মুনিগণের সাথে মিলিত হয়ে প্রহ্লাদকে দৈত্য ও দানবদের অধিপতি করলেন। হে রাজন, তারপর ব্রহ্মাদি দেবগণ প্রহ্লাদের প্রতি আহ্লাদ প্রকাশ ও আশীর্বাদ প্রয়োগ করে, তার পূজা গ্রহণপূর্বক নিজ নিজ ধামে গমন করলেন।
হে রাজন, বিষ্ণুর ওই দুইজন পার্ষদ এই প্রকারে দিতির পুত্রত্ব প্রাপ্ত হয়ে পরে হৃদয়াস্থিত হরি কর্তৃক বৈরীভাবে নিহত হয়। তারাই আবার বিপ্ৰশাপে কুম্ভকর্ণ ও দশগ্রীব রাবণ রূপে দুই রাক্ষস হয়েছিল; শেষে রামচন্দ্রের বিক্রমে নিধনপ্রাপ্ত হয়। তারা রামচন্দ্রের বাণে যুদ্ধে নির্ভিন্নহৃদয় হয়ে ধরাশায়ী হলে, পূর্ব জন্মের মতো তার চিন্তা করতে করতে দেহ পরিত্যাগ করেছিল। হে যুধিষ্ঠির, সেই দুই ব্যক্তিই শিশুপাল ও দণ্ডবক্র নামে পুনরায় জন্মেছিল এবং তোমাদের চোখের সামনেই বৈরানুবন্ধের দ্বারা (যোগাদি সাধন ব্যতীতই) ভগবান সাযুজ্যে প্রাপ্ত হল। এইরূপে কৃষ্ণবৈরী রাজগণ শ্রীকৃষ্ণের নিন্দাদির দ্বারা পূর্ববৃত নিজ নিজ পাপের অনুধ্যান দ্বারা, ভ্রমর বিশেষের ধ্যানের দ্বারা কীটের তন্ময়ত্ব প্রাপ্তির ন্যায়, তন্ময় হয়ে আত্মদাহ ত্যাগ করেছিল। যেরূপ অভেদের দ্বারা জ্ঞানীভক্তগণ শ্রীহরির সারূপ্য লাভ করেন, শিশুপালাদি নৃপতিগণও তেমনি তার ধ্যানের আবেশের ফলেই ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। হে মহারাজ, তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে, সে সকল তোমাকে বললাম। দক্ষঘঘাষের পুত্রাদি যদিও হবির বিদ্বেষী ছিলেন, তবুও তারা ওই প্রকারে ভগবানের সাযুজ্য লাভ করেছিলেন। ব্রহ্মণ্যদেব মহাত্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই পবিত্র কথা কথিত হল, যাতে দুইজন আদি দৈত্যের বধ-বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে। আর, মহাভাগবত প্রহ্লাদের চরিত্র, তার ভক্তি, জ্ঞান, বৈরাগ্য এবং কর্তৃক স্তুত সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের ঈশ্বর ভগবান হরির গুণানুবর্ণন। আর দেব-দৈত্যাদির স্থান সকলের কাল কর্তৃক মহান বিপর্যাস (পরিবর্তন) নিরূপিত হয়েছে। যে ধর্মের দ্বারা ভগবানকে পাওয়া যায়, সেইরূপ ভাগবত ধর্মের কথা এবং আত্মা অনাত্মাদির অশেষ বিবরণ এতে বর্ণিত হয়েছে। বিষ্ণুর পরাক্রম পূর্ণ এই আখ্যান শ্রদ্ধাপূর্বক শ্রবণ করে যে কীর্তন করবে, সে কর্মপাশ থেকে মুক্ত হবে। যে ব্যক্তি আদিপুরুষ বিষ্ণুর এই নৃসিংহ লীলা, দৈত্যাধিপতি হিরণ্যকশিপু ও যূথপতিদের বধ এবং ভগবদ্ভক্তগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দৈত্যাত্মজ প্রহ্লাদের অনুভব শ্রবণ করে সংযতভাবে পাঠ করবে, সে অকুতোভয় (যে স্থান থেকে কোনো ভয় নেই) বৈকুণ্ঠলোক প্রাপ্ত হবে। হে রাজন, প্রহ্লাদ ভাগ্যবান, আমরা মন্দভাগ্য–এই বলে বিষণ্ণ হয়ো না। মনুষ্যলোকে তোমরাও অতিশয় ভাগ্যবান, কারণ যে সকল লোক ভুবন পবিত্র করেন, তারা সর্বদাই তোমাদের গৃহে গমনাগমন করেন। তাদের আগমনের কারণ–সেখানে শ্রীকৃষ্ণোম্য পরব্রহ্ম নরাকারে সাক্ষাৎ বাস করছেন। মহদগণের অন্বেষণীয় যে কৈবল্য নির্বাণসুখ অর্থাৎ নিরুপাধি পরমানন্দ তার অনুভবরূপ যে ব্রহ্ম, সেই এই শ্রীকৃষ্ণ তিনি তোমাদের প্রিয়, সুহৃৎ, মাতুলপুত্র, আত্মা, পূজণীয়, আজ্ঞাবহ এবং গুরু। যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তত্ত্ব মহাদেব, ব্রহ্মা, প্রভৃতিও বুদ্ধির দ্বারাও যথার্থরূপে সাক্ষাৎ বর্ণনা করতে সমর্থ হন নাই, তিনিই তোমাদের প্রতি স্বয়ং প্রসন্ন। আমরা মৌনাদি সাধন দ্বারা তার প্রসন্নতা প্রার্থনা করে থাকি, এখনও প্রার্থনা করে থাকি, এখনও প্রার্থনা করছি। মৌনব্রত, ভক্তি এবং উপশম দ্বারা পূজিত হয়ে, সেই ভক্তগণের পালক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। (ওহে যুধিষ্ঠির, প্রহ্লাদের গৃহে পরম ব্রহ্ম বাস করে নাই এবং মুনিগণও তাঁর দর্শনের জন্য তার গৃহে যান নাই। আর পরম ব্রহ্ম তার মাতুল পুত্রাদিরূপে বর্তমান থাকেন নাই, কিন্তু তোমাদের প্রতি ওই সকল করেছেন, অতএব তোমরা প্রহ্লাদ অপেক্ষা এবং আমাদের অপেক্ষাও মহাভাগ্যবান) হে রাজন, পূর্বে অনন্ত মায়াবী ময়দানব, দেবদেব রুদ্রের যশ বিনষ্ট করলে, সেই এই ভগবান পুনরায় তার কীর্তি বিস্তার করেন।
রাজা যুধিষ্ঠির বললেন–ময়দানব কোন্ কার্যে জগতের ঈশ্বর মহাদেবের যশ বিনষ্ট করেছিল এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণও কিভাবে তার কীর্তি বিস্তার করেন, তা বলুন। নারদ বললেন–রাজন, দেবতা ও অসুরদের যুদ্ধের সময়ে, এই শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক সম্বর্ধিত হয়ে দেবগণ অসুরদের পরাজিত করলে, তারা মায়াগণের পরম আচার্য ময়দানবের শরণাপন্ন হয়। ওই ময়দানব স্বর্ণ, রৌপ্য ও লৌহময় তিনটি পুরী নির্মাণ করে তাদের অর্পণ করেন। সেই পুরীতে তারা কখন যাতায়াত করত তা কেউ লক্ষ্য করতে পারত না। হে রাজন, সেই সকল বিমানতুল্য পুরীর দ্বারা অসুর সেনাপতিগণ অলক্ষিত ভাবে পূর্ব বৈরী স্মরণ করে লোকপালসহ লোকত্রয় বিনাশ করতে লাগলেন।
তারপর ইন্দ্রাদি লোকপালদের সাথে সমস্ত লোক ভগবান রুদ্রের নিকট গিয়ে প্রণত হয়ে সকাতরে বললেন–হে দেবদেব, আমরা আপনারই লোক, ত্রিপুরবাসী অসুরগণ আমাদের বিনাশ করছে, আপনি রক্ষা করুন। তাদের কাতর বচন শুনে ভগবান শংকর, “তোমরা ভয় করো না” এই কথা দেবতাদের বলে, নিজ ধনুতে শরসন্ধান পূর্বক ওই সকল পুরীর উদ্দেশে অভিমন্দ্রিত শর নিক্ষেপ করলেন। সূর্যমণ্ডল হতে যেমন রশ্মি সমূহ উৎপতিত হয়, তেমনি সেই বাণ হতে অগ্নিবর্ণ বাণসমূহ উৎপতিত হয়ে ওই তিনটি পুরী আচ্ছন্ন করল। এই তিনটি পুরীতে যে সকল অসুরগণ বাস করত, তারা সেই বাণ দ্বারা সৃষ্ট হওয়া মাত্রই গতাসু হয়ে সেখান থেকে নিপতিত ইল। ইহা দেখে মহামায়া ময়দানব ওই সকল মৃত দানবদের নিয়ে নিজের নির্মিত অমৃতময় কূপে নিক্ষেপ করল। সেই সিদ্ধ অমৃত রসে সংস্পৃষ্ট হওয়ায় অসুরগণ বজের মতো দৃঢ়াঙ্গ ও বলশালী হয়ে মেঘভেদী বিদ্যুৎদ্রুপ বহ্নির ন্যায় পুনরায় উত্থিত হল।
এই ব্যাপারে সংকল্প ভঙ্গ হল বলে বিমনস্ক বৃষধ্বজকে দেখে ভগবান বিষ্ণু একটি উপায় উদ্ভাবন করলেন। তখন তিনি ব্রহ্মাকে বৎস করে এবং নিজে গাভীরূপ ধারণপূর্বক মধ্যাহ্নকালে সেই ত্রিপুরমধ্যে প্রবেশ করে সেই অমৃতময় কূপের সমস্ত অমৃত পান করলেন। সেখানকার রক্ষক অসুরগণ তা স্বচক্ষে দেখেও ভগবত্সয়ায়, বিমোহিত হয়ে নিষেধ করল না। মহাযোগীময় তা জানতে পেরে, দৈবগতি স্মরণপূর্বক হাস্য করতে করতে রসপালকদের বলল–আপনার অথবা অন্যের, কিংবা আত্মপর উভয়ের প্রতি যা দৈব কর্তৃক উপকল্পিত হয়, তার অন্যথা করতে কি সুর, কি অসুর, কি নর, কি অন্য কোনো ব্যক্তি কারও সামর্থ্য নেই। তারপর ভগবান হরি নিজ শক্তি, ধর্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্যসম্পত্তি, তপস্যা বিদ্যা ও ক্রিয়াদির দ্বারা শম্ভর সংগ্রাম সাধন–রথ, সারথি, অশ্ব ধ্বজ, ধনুর্বাণ, বর্ম প্রভৃতি রচনা করে দিলেন। পরে মহেশ্বর বর্ম পরিধানপূর্বক ধনুর্বাণ গ্রহণ করলেন। হে নৃপ, ভগবান শংকর, ধনুতে বাণ সন্ধানপূর্বক অভিজিৎ মুহূর্তে (অর্থাৎ মধ্যাহ্নকালে) সেই দুর্ভেদ্য পুরত্রয় অনায়াসে দগ্ধ করে ফেললেন। এইভাবে ত্রিপুর দগ্ধ হলে শত শত বিমান আচ্ছন্ন আকাশে দুন্দুভির ধ্বনি হতে লাগল এবং দেবতা, ঋষি, পিতৃগণ ও সিদ্ধেশ্বরগণ “জয়যুক্ত হও” বলে পুষ্প বর্ষণ করতে লাগল। আর গন্ধর্বগণ হৃষ্ট হয়ে গান এবং অপ্সরা সকল নৃত্য করতে আরম্ভ করল। হে মহারাজ যুধিষ্ঠির, ভগবান ত্রিপুরারি এই প্রকারে তিনটি পুরী দগ্ধ করে, ব্রহ্মাদির দ্বারা স্তুত হয়ে নিজধামে প্রত্যাগমন করলেন। ভগবান হরির এই প্রকার কার্য, তিনি নিজ মায়ার দ্বারা আপনার নাকরের অনুকরণ করেন। জগদ্গুরু ভগবানের লোকপাবন সেই সকল লীলাবলী ঋষিগণ গান করেছেন। ওই সকল তোমার কাছে বললাম, আর কি বলব, বল।
.
একাদশ অধ্যায়
মনুষ্যধর্ম, বর্ণধর্ম ও স্ত্রীধর্মের বর্ণন
স্ত্রী শুকদেব বললেন–দৈত্যপতি প্রহ্লাদের মন সব সময় ভগবানেই অর্পিত থাকত, এজন্য তিনি মহত্তমগণের অগ্রগণ্য। সাধু সভায় সকৃত। তাঁর পবিত্র চরিত্র শ্রবণে মহারাজ যুধিষ্ঠির অতিশয় আনন্দিত হয়ে ব্রহ্মতনয় নারদকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন। যুধিষ্ঠির বললেন–ভগবান ব্রাহ্মণাদি বর্ণ ও ব্রহ্মচর্যাদি আশ্রমের আচার যুক্ত সনাতন (অনাদি পরম্পরাগত) মনুষ্যদের ধর্ম শুনতে ইচ্ছা করছি। যে ধর্মের দ্বারা মানবের জ্ঞান ও ভক্তি লাভ হয়। হে ব্রাহ্মণ, আপনি প্রজাপত ব্রহ্মার সাক্ষাৎ পুত্র এবং তপস্যা জ্ঞান ও সমাধির দ্বারা তার অন্য সকল পুত্রের সম্মত, অতএব আপনি সমস্তই জানেন। যদিও স্মৃতিকারেরা ধর্ম বলেছেন, তথাপি কৃপালু, সাধু, শান্ত, নারায়ণ-পরায়ণ আপনার মতো ব্রাহ্মণগণ যেরূপ উৎকৃষ্ট অতিশয় গুহ্য ধর্ম যেমন জানেন, অপারে সেরূপ জানেন না। অতএব আপনি কৃপাপূর্বক বলুন।
নারদ বললেন–লোকসকলের ধর্মের প্রবর্তক ভগবান নারায়ণকে প্রণাম করে তার শ্রীমুখ থেকে শক্ত সনাতন ধর্ম আমি বলছি। সেই ভগবান নিজের অংশের দ্বারা ধর্ম ও দাঙ্গায়ণীর সন্তানরূপে অবতীর্ণ হয়ে লোক সকলের কল্যাণের জন্য বদরিকাশ্রমে বসে আজও তপস্যা করছেন। হে রাজন, সর্ববেদময় ভগবান হরিই সকল ধর্মের মূল (প্রমাণ)–ইহা বেদবেত্তাদের স্মৃত। যে ধর্মের দ্বারা আত্মা (পরমাত্মা) প্রসন্নতা লাভ করেন। (অর্থাৎ শুত্ত্বতি, স্মৃতি, সদাচার ও আত্মার সন্তোষ–সব কিছুরই মূল প্রমাণ ভগবান হরি।) হে যুধিষ্ঠির, নরমাত্রের সাধারণ ধর্ম কি, প্রথমত বলছি। সত্য (যথার্থ ভাষণ), দয়া (স্বার্থাশূন্য) হয়ে পরের দুঃখনাশের ইচ্ছা, তপস্যা (একাদশ প্রভৃতি উপবাস), শৌচ (স্নানাদিজনিত পবিত্রতা) তিতিক্ষা (শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্ব-সহিষ্ণুতা, ঈক্ষা (যুক্তাযুক্ত-বিবেক), শম (মনের সংযম) দম (বাহ্যন্দ্রিয়ের জয়), হিংসা (পরপীড়ন করা বর্জন), ব্রহ্মচর্য (উপস্থ-সংযম) ত্যাগ (লোভ-রাহিত্য), স্বাধ্যায়, (ইষ্টমন্ত্র জপ) ও আর্জব (সরলতা)–এই একুশটি ভক্তির উপকরণীভূত ধর্ম।
আর, সন্তোষ (যদৃচ্ছালাভে যথেষ্ট বুদ্ধি), সমদৃক সেবা (সমদর্শী মহদগণের সেবা) প্রবৃত্তিমূলক কর্ম হতে নিবৃত্তি, মানুষের নিষ্ফল ক্রিয়ার পর্যালোচনা, মৌন (বৃথা আলাপ ত্যাগ) ও আত্মবিমৰ্শন (দেহতিরিক্ত আত্মার অনুসন্ধান)। অপর, যথাযোগ্যরূপে প্রাণিদের মধ্যে অন্নবস্ত্রাদির বিভাগ করে দেওয়া, সকল ভূতে আত্মা ও দেবতা জ্ঞান, অতএব সকল মানবের প্রতিও এইরূপ ভাব। এখন শ্রবণাদি নয়টি সাক্ষাৎ ভক্তির ধর্ম বলছেন। ভক্তগণের আশ্রয় স্বরূপ ভগবানের গুণ-কর্মের শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, সেব্য, ধজ্যা (পূজা), অবনতি (নমস্কার), দাস্য, সখ্য ও আত্মসমর্পণ। হে রাজন, এই ত্রিশটি মনুষ্যমাত্রের পরম ধর্ম বলে কথিত হয়েছে। এই ত্রিশটি লক্ষণ-বিশিষ্ট হলে এর দ্বারা সর্বাত্মা ভগবানের সন্তোষ সাধন হয়।
হে রাজন, বর্ণধর্ম সকল বলব, তার মধ্যে প্রথমে দ্বিজলক্ষণ বলছি। যে ব্যক্তির সমন্ত্রক গর্ভাধানাদি সংস্কারসকল অবিচ্ছিন্ন এবং ব্রহ্মা যার প্রতি এ প্রকার সংস্কারসকল বিধান করেছেন, তিনিই দ্বিজ। আর ব্রহ্ম শূদ্রকে মন্ত্রবৎ সংস্কারযুক্ত করে বলেন নাই এবং তার উপনয়নের বিধান নেই–এজন্য শূদ্র দ্বিজ নহে। শুদ্ধ কুল ও শুদ্ধ আচারে পরিশুদ্ধ যে সকল দ্বিজাতি, তাদের যজন, অধ্যয়ন, দান এবং ব্রহ্মচর্যাদি আশ্রমোদিত ক্রিয়া আবশ্যক ধর্মা। ব্রাহ্মণের অধ্যয়নাদি অর্থাৎ অধ্যায়ন, অধ্যাপন, যজন, যাজন দান ও প্রতিগ্রহ–এই ছয়টি কর্ম বিহিত হয়েছে। ক্ষত্রিয় জাতির প্রতিগ্রহ ভিন্ন আর পাঁচটি কর্ম। কিন্তু যে ক্ষত্রিয় প্রজাপালনে অধিকৃত। তার ব্রাহ্মণ ভিন্ন সকল প্রজা হতে কর গ্রহণ ও দন্তশুল্কাদির দ্বারা জীবিকা বিহিত হয়েছে। বৈশ্য জাতির কৃষি বাণিজ্যাদি জীবিকা এবং সর্বদা ব্রাহ্মণকুলের অনুগত থাকা কর্তব্য কর্ম। শূদ্র জাতির প্রতি দ্বিজ শুশ্রূষা মাত্র বিহিত এবং দ্বিজ সেবার দ্বারাই তারা জীবিকা অর্জন করবেন।
হে রাজন, বিপ্র জাতির মুখ্য ও অনুকল্প ভেদে অপর বৃত্তির কথা বলছি। বিচিত্র বার্তা (অর্থাৎ কৃব্যাদি) শালীন (অযাচিত প্রাপ্তি) যাযাবর প্রত্যহ ধান্য যাঞ্চা) এবং শীল ও উঞ্ছ (অর্থাৎ শীল শব্দের অর্থ ধানক্ষেত্রাদিতে স্বামিত্যক্ত শস্যমঞ্জরী এবং ঊঞ্ছ শব্দের অর্থ দোকানের ধারে পরিত্যক্ত শস্যকণা সংগ্রহ)। ওই গুলির মধ্যে পরস্পর বৃত্তি উত্তম। নীচ জাতীয় মনুষ্যের বিপদকাল ব্যতীত অধ্যাপনাদি উত্তম বৃত্তি অবলম্বন করা বিধেয় নয়। কিন্তু আপকালে ক্ষত্রিয় ব্যতিরেকে সকল জাতিই সকল বৃত্তি অবলম্বন করতে পারে। ক্ষত্রিয় জাতি আপকালে প্রতিগ্রহ ভিন্ন অন্য সকল বৃত্তি গ্রহণ করবে। ব্রাহ্মণ জাতির যে চারটি বৃত্তি বলা হল তার মধ্যে ক্ষত ও অমৃতের দ্বারা অথবা মৃত/মৃতের দ্বারা কিংবা সত্যামৃত (বাণিজ্য) দ্বারা সকল জাতিই জীবন ধারণ করতে পারে, স্ববৃত্তির (নীচসেবার) দ্বারা কখন জীবিকা নির্বাহ কর্তব্য নয়। ঋত শব্দের অর্থ উঞ্জ ও শিল, অমৃতের অর্থ অযাচিত, ঘৃত শব্দের অর্থ নিত্য যাঙ্ক্ষা, প্রমৃতের অর্থ কৃষি, সত্যামৃতের অর্থ বাণিজ্য এবং স্ববৃত্তির অর্থ নীচে সেবা।
হে রাজন, স্ববৃত্তি (নীচ সেবা) অতিশয় নিন্দিত, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় জাতি সর্বদাই উহা পরিত্যাগ করবে। কারণ ব্রাহ্মণ সর্ব বেদময় এবং ক্ষত্রিয় সর্বদেব স্বরূপ। এক্ষণে বর্ণসকলের অভিব্যঞ্জক স্বরূপ ধর্ম বলছেন–শম, দম, তপস্যা, শৌচ, সন্তোষ, ক্ষমা, ঋজুতা, জ্ঞান, দয়া, বিষ্ণুপরত্ব এবং সত্য–এই সকল ব্রাহ্মণ জাতির লক্ষণ। শৌর্য (যুদ্ধোৎসাহ), ধৈর্য, তেজ, দান, আত্মজয়, ক্ষমা, ব্রহ্মণ্যতা এবং সত্য–এই সকল ক্ষত্রিয় জাতির লক্ষণ। দেব, গুরু এবং বিষ্ণুর প্রতি ভক্তি, ধর্ম, অর্থ ও কাম–এই ত্রিবর্গের পরিপোষণ, আস্তিক্য, নিত্য উদ্যম এবং নৈপুণ্য–এই সকল বৈশ্য জাতির লক্ষণ। সাধু, বিপ্রাদির প্রতি প্রমাণ, শৌচ অকপটে প্রভুর সেবা, অমন্ত্রযজ্ঞ (অর্থাৎ নমস্কার মন্ত্র দ্বারা পঞ্চ-যজ্ঞানুষ্ঠান) অস্তেয় (চুরি না করা, সত্য এবং গো, ব্রাহ্মণের রক্ষা–এই সকল শূদ্রের লক্ষণ। এক্ষণে স্ত্রীধর্ম বলছেন–পতিশুশ্রষা, পতির অনুকূলবর্তিনী হওয়া, পতিবন্ধুর (পতির পিতা, ভ্রাতা, প্রভৃতির) অনুবৃত্তি, নিত্য পতির নিয়ম ধারণ–এই চারটি পতিব্রতা রমণীগণের লক্ষণ ও ধর্ম। সাধ্বী স্ত্রী স্বয়ং মণ্ডিত হয়ে সম্মার্জন উপালপন, গৃহমণ্ডল, এবং গৃহসুগন্ধীকরণ। আর পতির কামনা অনুসারে বিনয়, দম, সত্য অথচ প্রিয়বাক্য এবং প্রেম–এই সকল দ্বারা সময়ে সময়ে পতির সেবা করবে এবং গৃহের উপকরণ সকল সর্বদা পরিষ্কার করে রাখবে। যথালাভে সন্তুষ্ট তন্মাত্র ভাগেও আলোগুলা, সর্বদা অলস্য শূন্যা ও ধর্মজ্ঞা হবে। সতত সত্য অথচ প্রিয় বাক্য বলবে। সকল বিষয়ে অপ্রমত্তা (সাবধানী) সব সময় শুচি ও স্নিগ্ধা হয়ে মহাপাতকশূন্য পতির ভজনা করবে। যে নারী লক্ষ্মীর ন্যায় তৎপরা হয়ে হরিভাবে পতির সেবা করেন, তিনি লক্ষ্মীর তুল্য হয়ে হরিস্বরূপ সেই পতির সাথে হরিলোকে আমোদিত হন।
এক্ষণে অনুলোমজ ও প্রতিলোমজ জাতিগণের ধর্ম বলছি। আলাপ ও অচৌর সঙ্কর জাতিদের। অন্ত্যজ (রজক, চর্মকার, নট, বরুও, কৈবর্ত, মেদ ও ভিল্লাদি) এবং অন্ত্যেবসায়ি। (অর্থাৎ চণ্ডাল, পুষ্কশ, মাতঙ্গাদি) জাতিদের নিজ নিজ কুল পরম্পরা প্রাপ্ত বৃত্তিই বৃত্তি, (অপাপ ও অচৌর বলার তাৎপর্য হল–চৌর ও হিংসাদি তাদের পরম্পরা প্রাপ্ত বৃত্তি হলেও তা নিষেধ করছেন। কারণ তা ধর্মীয় বৃত্তি নয়।) হে যুধিষ্ঠির, মনুষ্যদের স্বভাব (অর্থাৎ সত্ত্বাদি প্রকৃতি) দ্বারা যুগে যুগে যে ধর্ম বিহিত হয়েছে, বেদদর্শীগণ বলেন–প্রায় সেই ধর্মই ইহকাল ও পরকালে তাদের সুখহেতু হয়ে থাকে। (প্রায় বলার তাৎপর্য–দুর্জাতিদের দুরাচারত্ব ত্যাগ তাদের অমঙ্গলজনক নহে।) স্বকর্মকারী যে ব্যক্তি স্বভাব অনুসারে বৃত্তি অবলম্বন করে জীবন যাপন করেন। তিনি নিজ স্বভাবজ কর্ম পরিত্যাগ করে ক্রমে ক্রমে নিগুণত্ব প্রাপ্ত হয়ে থাকেন।
হে রাজন, কাম্য কার্যকারী পুরুষের তকাল ভোগ তৎপরত্ব প্রযুক্ত নৈগুণ্য হয় না–এরূপ আশঙ্কা করো না। যেমন উর্বরা ক্ষেত্রে বার বার বীজ বপন করলে, তা নিজেই নিবীর্য হয়ে পড়ে, আর শস্য উৎপাদন সমর্থ হয় না। বরং বপন করা বীজও বিনষ্ট হয়ে যায়, তেমনি যে চিত্তে কামরূপে বাসনা সকল অবস্থিতি করে, সেই চিত্ত কামসকলের অতিশয় সেবার দ্বারা যেরূপ বিরক্ত হতে পারে, কামবিন্দু সেবায় সেরূপ হয় না। অগ্নি যেমন অল্প ঘৃতবিন্দুর দ্বারা শান্তি হয় না। একেবারে অধিক দিলে নির্বাণ হয়, তার ন্যায় অল্প অল্প কামসেবার দ্বারা চিত্ত বিরক্ত হয় না। অধিক সেবা করলেই বিরক্ত হতে পারে। হে রাজন, যে পুরুষের বর্ণাভিব্যঞ্জক যে লক্ষণ বললাম, যদি অন্য বর্ণে সেই লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়, তবে সেই ব্যক্তিকেও সেই লক্ষণ নিমিত্ত সেই বর্ণদ্বারা নির্দেশ করা উচিত। (অর্থাৎ শম, দমাদি লক্ষণ দ্বারা ব্রাহ্মণাদি ব্যবহার মুখ্য। কেবল জন্মমাত্র ব্রাহ্মণাদি ব্যবহার প্রশস্ত নহে)।
.
দ্বাদশ অধ্যায়
ব্রহ্মচারী ও বাণপ্রস্থর অসাধারণ ধর্ম এবং আশ্রম চতুষ্টয়ের সাধারণ ধর্ম কথন
নারদ বললেন–হে রাজন, ব্রহ্মচারী গুরুগৃহে বাস করে ইন্দ্রিয়দমন ও গুরুতে দৃঢ় সৌহৃদ হয়ে দাসবৎ গুরুর হিত আচরণ করবে। আর গুরু, অগ্নি, সূর্য ও বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতাদের উপাসনা এবং গায়ত্রী জপ করত ত্রিসন্ধ্যা-বন্দনা করবে। সকাল ও সন্ধ্যা উভয়কালে মৌনী হয়ে থাকবে। গুরু বদি আহ্বান করেন, তাঁর নিকট গিয়ে সংযত ভাবে বেদ অধ্যয়ন করবে। অধ্যয়নের আরম্ভে ও শেষে প্রত্যহ মস্তক দ্বারা পাদ স্পর্শপূর্বক গুরুকে প্রণাম করবে। আর কুশ হস্তে মেঘলা অজিন (মৃগচর্ম), বমন, জটা, দন্ড, কমভুলু এবং উপনীত–উপনয়ন কালে যে প্রকার বিহিত আছে, সেই প্রকারে ওই সকল ধারণ করবে। সন্ধ্যা ও প্রাতঃকালে ভিক্ষা আচরণ করবে এবং ভিক্ষালব্ধা বস্তু গুরুকে নিবেদন করবে। গুরুর অনুজ্ঞা পেলে ভোজন করবে, নচেৎ উপবাস করবে। সুশীল, পরিমিত আহার, কার্যদক্ষ, শ্রদ্ধাশীল ও জিতেন্দ্রিয় হয়ে স্ত্রীলোকদের এবং স্ত্রীজিত ব্যক্তিদের নিকট যতটুকু প্রয়োজন, কেবল ততটুকুই ব্যবহার করবে। তাদের কাছে বেশি সময় থাকবে না।)
হে রাজন, গৃহস্থ ভিন্ন ব্রহ্মচারী ও বৃহদ ব্রতধারী সকলের পক্ষে স্ত্রী প্রসঙ্গ পরিত্যাগ করা উচিত। কারণ ইন্দ্রিয়গণ অত্যন্ত বলবান, যতি ব্যক্তিদেরও মন হরণ করে, যুবা ব্রহ্মচারী যুবতী গুরুপত্নীদের দ্বারা কখন কেশপ্রসাধন, গাত্রমর্দন, স্নান ও অভ্যঞ্জনাদি কর্ম করাবে না। (গুরুপত্নীগণ শিষ্যকে পুত্রের মতো বাৎসল্যে দেখে, যদি কেশপ্রসাদনাদি স্বেচ্ছায়ও করেন, তবুও তা করাবে না। কারণ যুবতী স্ত্রী অগ্নির সমান এবং পুরুষ ঘৃতকুম্ভ তুল্য, অতএব নির্জনে কন্যার সহিতও অবস্থান করবে না। আর অনির্জন স্থানে তার নিকট যতটুকু মাত্র প্রয়োজন, ততটুকু কালমাত্র অবস্থান করবে। যদিও স্ত্রী প্রভৃতি মিথ্যা ও পাপজনকত্ব হেতু স্বয়ং ত্যক্তপ্রায় হয় সত্য, তথাপি স্বরূপ সাক্ষাৎকার দ্বারা ইন্দ্রিয়াদিকে আভাসমাত্র নিশ্চয় করে যতক্ষণ জীব স্বতন্ত্র না হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত দ্বৈত (অর্থাৎ আমি পুরুষ, ইনি স্ত্রী–এইরূপ ভেদ) বুদ্ধি বিরত হয় না। ওই দ্বৈতবুদ্ধি থেকেই এই বিপর্যয় (অর্থাৎ গুণধ্যাসে দ্বারা ভোজ্যতা বৃদ্ধি হয়ে থাকে) অতএব স্ত্রীলোকের সাথে অবস্থানাদি ত্যাগ করা অত্যন্ত আবশ্যক। ব্রহ্মচারীর পক্ষে সুশীলত্বাদি যে সকল বলা হল, উহা গৃহস্থ যতি ও সন্ন্যাসীদেরও পালনীয়। যে গৃহস্থ কেবল ঋতুকালে স্ত্রীর সহিত মিলিত হয়, সেটাই তার গুরুবৃত্তি অর্থাৎ গুরুর আনুগত্য ধর্ম।
যে সকল ব্যক্তি ব্রহ্মচর্য ব্ৰতশালী, তারা চোখে কাজল দেওয়া, মাথায় তেল মাখা, গাত্র মার্জন, স্ত্রীলোকের ছবি আঁকা, মৎস্য মাংসাদি ভোজন, মধু, মালা, গন্ধ, অনুলেপন এবং অলংকরণ–এই সকল পরিত্যাগ করবেন। ব্রহ্মচারী এই প্রকারে গুরুকুলে বাস করে, শিক্ষাদি অঙ্গ ও উপনিষদের সহিত বেদত্রয় অধ্যায়নপূর্বক নিজের অধিকার অনুসারে যথাসামর্থ্য তার অর্থ বিচার করবেন। পরে যদি সমর্থ হয়, গুরু যা চান, সেরূপ দক্ষিণা দিয়ে তার অনুমতি নিয়ে যেমন ইচ্ছা–গৃহস্থাশ্রম অবলম্বন করবেন। অথবা বাণপ্রস্থ হবার জন্য বনে প্রবেশ করবেন, কিংবা পরিব্রাজক হওয়ার জন্য প্রবজ্যা গ্রহণ করবেন, অথবা নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী হয়ে গুরুকুলেই বাস করবেন। কিন্তু যে আশ্রমেই প্রবেশ করুন –অগ্নি, গুরু, আত্মা ও নিজের আশ্রয় জীবগণের সহিত ভগবান অধ্যক্ষজকে সর্বভূতে নিয়তৃত্বরূপে। (অপ্রবিষ্ট হলেও) প্রবিষ্টের মতো দর্শন করবেন। হে রাজন, ব্রহ্মচারী অথবা বাণপ্রস্থী কিংবা যতি অথবা গৃহী–সকলেই এই প্রকার আচরণ করতঃ বিজ্ঞের বস্তু জাত হয়ে পরম ব্রহ্ম অনুভব করবেন।
এরপর বাণপ্রস্থাশ্রমীর মুনি সম্মত নিয়ম সকল বলছি। যা অবলম্বন করে ওই ব্যক্তি যথাযথ মহল্লোক প্রাপ্ত হন। যে সকল শস্য ভূমি কর্ষণের দ্বারা উৎপন্ন হয়ে পক্ক হয়ে (শালী ধান্যাদি) কিংবা বা অকালে (অর্থাৎ পরিপাক কালেই পূর্বেই) নিষ্পন্ন হয় ফলমূলাদি, যে সকল শস্য অগ্নিপক্ক এবং অপক্ক ফলাদি ভোজন করবে না। কেবল সূর্যপক্ক ফলাদি আহরণ করবে। আর বন্য নীবারাদি ধান্য দ্বারা নিত্য চরা ও পুরোত্তাশাদি নির্বাহ করবে। নূতন নূতন অন্নাদি লব্ধ হলে পূর্ব সঞ্চিত অন্নাদি পরিত্যাগ করবে। বাণপ্রস্থাশ্রমী কেবল অগ্নিস্থাপনের জন্যই গৃহ অথবা পর্ণকুটির অথবা গিরিগর আশ্রয় করে থাকবে। নিজে হিম, বায়ু, অগ্নি, বর্ষা ও সূর্যাতপ সহ্য করবে। আর কেশ, রোম, নখ আশ্রত্ত্ব ও জটা ধারণ করবে। শরীরের মলিনতা দূর করবে না। এবং কমভুলু, অজিন (মৃগমর্চ) দণ্ড, বল্কল ও অগ্নিরক্ষার অনুকূল বস্ত্রাদি ধারণ করবে। কিন্তু তপস্যার ক্লেশে বুদ্ধি বিনষ্ট না হয়, এ বিষয়ে সাবধান থাকবে। যখন ব্যাধি অথবা জরাদিবশতঃ কর্তব্যকর্ম সম্পাদনে কিংবা জ্ঞানাভ্যাসে অসমর্থ হবে তখন অনশনাদি ব্রতের দ্বারা দেহত্যাগ করবে।
অনশনাদির দ্বারা দেহত্যাগের প্রকার বলছেন–প্রথমে আত্মাতে অগ্নি সমারোপণ করে ‘আমি, আমার” ইত্যাদি অভিমান পরিত্যাগপূর্বক দেহকে কথাযোগ্য নিজ নিজ কারণ আকাশদিতে বিলীন করাবে অর্থাৎ যেরূপ ক্রমে উৎপন্ন, সেই অনুসারে দেহগত ছিদ্র–সকলকে আকাশে, নিশ্বাস–সকলকে বায়ুতে, উম্মাকে (দেহের তাপকে) তেজে, শত্রু, শোণিত এবং শ্লেম্মাদিকে জলে, আর অস্থি মাংস প্রভৃতি দেহের কঠিন অংশকে পৃথিবীতে লয় করাবে। তারপর বাক্যের সহিত বাণিন্দ্রিয়কে অগ্নিতে, শিল্পের (আদানাদিরূপ ব্যাপারের) সাথে হস্তদ্বয়কে ইন্দ্রে, গতির সহিত পদদ্বয়কে বিষ্ণুতে এবং রতির সহিত উপস্থাকে প্রজাপতিতে লয় করাবে। বিসর্গের (পুরীযোৎসর্গের) সহিত পশুকে মৃত্যুতে, শব্দসহিত শ্রোত্রকে দিকসকলে, স্পর্শ-সহ ত্বগিন্দ্রিয়কে বায়ুতে লয় করাবে। চক্ষুর সহিত রূপকে তেজে, বরুণের সহিত জিহ্বাকে জলে এবং অশ্বিনী কুমারের সহিত ঘ্রাণকে ভূমিতে বিলয় করাবে।
পরে মনোরথের সাথে মনকে চন্দ্রে, বোধ্য পদার্থের সহিত বুদ্ধিকে ব্রহ্মাতে অহংকার, সহ কর্মসকলকে রুদ্রে লয় করাবে, এই রুদ্র হতে ‘আমি, আমার” ইত্যাদি জ্ঞানপূর্বক ক্রিয়া হয়ে থাকে। তারপর চেতনার সহিত চিত্তকে ক্ষেত্রজ্ঞ এবং গুণকার্য দেবগণের সাথে ভোক্তৃত্বাদি বিকারবান ক্ষেত্রজ্ঞকে (জীবকে) নির্বিকার ব্রহ্মে বিলয় করাবে। পরে পৃথিবীকে জলে, জলকে তেজে, তেজকে বায়ুতে, বায়ুকে আকাশ, আকাশকে কূটস্থ অহঙ্কার-তত্ত্বে, অহংকার-তত্ত্বকে মহতত্ত্বে, মহতত্ত্বকে প্রধান (প্রকৃতিতে) এবং প্রধানকে পরমাত্মাতে লয় করাবে, এই প্রকারে সকল উপাধির লয় হলে, অবশিষ্ট ত্ৰিন্মাত্ৰ ক্ষেত্রজ্ঞ আত্মাকে অক্ষয়–স্বরূপে অবগত হয়ে দ্বৈতরহিত হওয়ায় দগ্ধ কাষ্ঠ অগ্নির ন্যায় সর্বতোভাবে বিরাম করবে।
.
ত্রয়োদশ অধ্যায়
যতির এবং অবধূতের ইতিহাস কথন
নারদ বললেন–হে রাজন, জ্ঞানাভ্যাসে সমর্থ ব্যক্তি ওই প্রকার চিন্তা করে সন্ন্যাস আশ্রম অবলম্বনপূর্বক দেহমাত্র অবশোষিত হবেন। তিনি যদি গ্রামে যান, তবে একরাত্রি মাত্র সেখানে অবস্থান। করবেন, নচেৎ নিরপেক্ষ (আকাঙ্ক্ষাবর্জিত) হয়ে পৃথিবী বিচরণ করবেন। যদি বসন ধারণ করেন তবে শুধুমাত্র কৌপীন আচ্ছাদিত হতে পারে, কৌষেয় বস্ত্র ধারণ করবেন। আর দণ্ডাদি চিহ্ন ছাড়া অন্য যা কিছু তিনি পরিত্যাগ করবেন বিপৎকাল ছাড়া আবার তা গ্রহণ করবেন না। ভিক্ষাজীবী হয়ে একাকী ভ্রমণ করবেন, কোথাও আশ্রয় গ্রহণ করবেন না। নিজে আত্মারাম, সর্বভূতের সুহৃৎ, শান্ত ও নারায়ণ-পরায়ণ হয়ে থাকবেন। আর এই বিশ্বকে কার্য-কারণ ব্যতিরিক্ত অব্যয় আত্মাতে দর্শন করবেন। এবং পরব্রহ্ম স্বরূপ আত্মাকেও কার্য কারণময় সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত দেখবেন। যোগী সুষুপ্তি ও জাগরণ–এই দুই অবস্থার সন্ধিসময়ে যখন তম অথবা বিক্ষেপ উভয়ই না থাকে, তখন আত্মাকে লক্ষ্য করে অবস্থিত হওয়ায় আত্মতত্ত্ব দর্শন করেন। অতএব বন্ধ ও মোক্ষ মায়ামাত্র, কিছুই নয় ইহা বিবেচনা করে সর্বত্র ব্রহ্ম দর্শন করবেন। দেহের মৃত্যু নিশ্চয় এবং জীবন অনিত্য–এটা জেনে সেই দেহের জন্য আনন্দিত হবেন না। যা থেকে প্রাণিসকলের উৎপত্তি ও বিনাশ, কেবল সেই কালেরই প্রতীক্ষা করে থাকবেন।
আত্মতত্ত্ব বর্ণনাময় গ্রন্থ ব্যতীত অন্য অসৎ শাস্ত্রে আসক্ত হবেন না। নক্ষত্র বিদ্যা (জ্যোতিষ) দ্বারা নিজের জীবিকা নির্বাহ করবেন না। জন্ম বিতণ্ডাদি–নিষ্ঠ তর্কসকল পরিত্যাগ করবেন এবং অত্যন্ত কুকুজি সহকারে কোনও পক্ষে আশ্রয় করবেন না। প্রলোভনাদির দ্বারা কাউকে শিষ্য করবেন না। বহু গ্রন্থ অভ্যাস করবেন না। শাস্ত্রাদি ব্যাখ্যাকে উপজীবিকা করবেন না এবং কোথাও মধ্যাদি নির্মাণ কার্য আরম্ভ করবেন না। শান্ত ও সমচিত্ত যে পরমহংস, তার আশ্রম প্রায় ধর্মের প্রয়োজনে হয় না। অতএব যতদিন পর্যন্ত জ্ঞানোৎপত্তি না হয়, ততদিন সত্ত্বশুদ্ধির জন্য যম ও নিয়ম আচরণপূর্বক জ্ঞানোৎপত্তির বিষয়ে যত্ন করবেন। জ্ঞান উৎপন্ন হলে নিয়মাদির আবশ্যক নেই, তখন ইচ্ছে হলে লোকশিক্ষার জন্য নিয়মাদি ধারণ করলে, ইচ্ছা না হলে তা পরিত্যাগ করবেন। বাইরে কোনো আশ্রম চিহ্ন ধারণ করবেন না, কেবল নিজের প্রয়োজন অর্থাৎ আত্মানুসন্ধান ব্যক্ত হবে। আর তিনি মনীষী হয়েও নিজেকে উন্মত্ত বা বালকের মতো দেখাবেন। স্বয়ং পণ্ডিত হয়েও লোকের সামনে নিজেকে মূখের ন্যায় প্রকাশ করবেন (অর্থাৎ লোকে তাকে দেখে যাতে উন্মত্ত অথবা বালক কিম্বা বাগিন্দ্রিয় হীন মনে করে, সেই প্রকারে থাকবেন)।
হে রাজন, এ বিষয়ে প্রহ্লাদ ও অজগরব্রতী মুনির সংবাদে একটি প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। তা তোমার নিকট উদাহরণ স্বরূপ বলছি, শোন। একসময় অজগর ব্রতী এক মুনি কাবেরী নদীর ধারে সহ্য পর্বতের ভূপৃষ্ঠে শয়ন করেছিলেন। তার শরীরের অবয়ব সকল ধূলি ধূসরিত হওয়ায় তার আসল তেজ নিগূঢ় ছিল। সেই সময় ভগবানের প্রিয় ভক্ত প্রহ্লাদ কতিপয় অমাত্য পরিবৃত হয়ে লোকতত্ত্ব জানবার জন্য ভ্রমণ করতে করতে সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে ওই মুনিকে দেখতে পেলেন। কর্ম, আকৃতি, বাক্য এবং বর্ণাশ্রমাদির চিহ্ন দ্বারা লোকে যাঁকে ‘ইনি সেই কিনা’–এই বলে নিশ্চয় করতে পারে না, মহাভাগবত প্রহ্লাদ দেখামাত্র তাকে চিনতে পারলেন এবং নমস্কার করে যথাবিধি মস্তক দ্বারা তার চরণ স্পর্শ করত বিশেষ পরিজ্ঞানের জন্য জিজ্ঞাসা করলেন।
হে ব্রাহ্মণ, আপনি উদ্যম শীল ও ‘ভগবানের ন্যায় এই যে স্থূল শরীর ধারণ করছেন, এর কারণ কি? কর্ম নিয়ত উদ্যমশীল লোকেরই ধনসম্পদ, ধনবান লোকের ভোগ এবং ভগবানদের স্থূল দেহ হয়ে থাকে। বিনা ভোগে কখনো এরূপ স্থূল দেহ দেখা যায় না। হে ব্রাহ্মণ, আপনি নিরুদ্যম হয়ে শয়ন করে আছেন, এতে যে বিত্ত হতে ভোগ হয়, সে বিত্ত আপনার নেই–এটা আমার নিশ্চর বোধ হচ্ছে। বিনা ভোগে আপনার এই দেহ যে কারণে স্কুল হয়েছে, তা যদি আমার জানার যোগ্য হয়, কৃপা পূর্বক বলুন। আপনি বিদ্বান, দক্ষ, চতুর, লোক রঞ্জক কথা বলতে জানেন, লোকেরা কর্ম করছে–এটা স্বচক্ষে দেখেও স্বয়ং এরূপ হয়ে শয়ন করে আছেন কেন? (অর্থাৎ, এই সকল লোক বিত্ত অর্জনাদিতে অসমর্থ হয়েও তার জন্য কত উদ্যম করছে, আর আপনি সমর্থ হয়েও নিরুদ্যম হয়ে রয়েছেন কেন?)।
নারদ বললেন–দৈত্যপতি প্রহ্লাদ এরূপ বলল। অজগরব্ৰতী সেই মহামুনি (দত্তাত্রেয়) তার বাক্যরূপ অমৃতে বশীকৃত হয়ে ঈষৎ হাস্য করে উত্তর প্রদান করলেন। ব্রাহ্মণ বললেন–হে অসুর শ্রেষ্ঠ, তুমি জ্ঞানীগণের সম্মত, এতে অন্তদৃষ্টির দ্বারা মানবগণের প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির সকল ফলই জানতে পারে, ভগবান নারায়ণদের কেবল ভক্তির দ্বারা তোমার হৃদয়ে প্রবিষ্ট হয়ে, সূর্য যেমন অন্ধকার বিনষ্ট করে, তেমনি অজ্ঞান সকলকে দূর করেছেন। এতে যদিও তোমার কিছুই জ্ঞাতব্য নেই, তথাপি কেমন শুনেছি, তোমার প্রশ্নগুলির উত্তর দিতেছি। কারণ যে ব্যক্তি নিজের শুদ্ধি কামনা করে, তার পক্ষে তোমার সহিত সম্ভাষণ করা কর্তব্য কর্ম। রাজন, সংসার প্রবাহ কারিণী যে তৃষ্ণাকে যথোচিত বিষয় সকলের দ্বারাও পূরণ করতে পারা যায় না, সেই তৃষ্ণার দ্বারা কর্মর্সকালে প্রবর্তিত হয়ে আমি পূর্বে নানা যোনিতে প্রবিষ্ট হয়েছিলাম। পরে স্ত্রীর কর্মের দ্বারা ভ্রমণ করতে থাকলে সেই তৃষ্ণাই আমাকে যদৃচ্ছাক্রমে এই মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত করিয়েছে। এই দেহ ধর্মের দ্বারা স্বর্গের সাধন, অধর্মের দ্বারা কুকুর, শূকরাদি তির্যক যোনির দ্বারা। মিশ্রিত ধর্মাধর্মের দ্বারা মনুষ্যত্বের দ্বার এবং সর্ব নিবৃত্তির দ্বারা মোক্ষের দ্বার। কিন্তু এই মনুষ্যত্বের সুখপ্রাপ্তি ও দুঃখ নিবৃত্তির জন্য কর্মকারী স্ত্রী-পুরুষদের বিপর্যয় দেখে, আমি নিবৃত্তির পথ অবলম্বন করেছি।
রাজন, জীবের স্বরূপই সুখ, যখন সকল ক্রিয়ার নিবৃত্তি হয়, তখন ওই সুখরূপ আপনা হতেই প্রকাশ পায়। আমি ভোগসকলকে মনোরথ মাত্র (অর্থাৎ অনিত্য) বিবেচনা করে। নিরুদ্যম হয়ে পারদমাত্র ভোগের জড়ঋ শয়ন করে আছি। যদিও সুখই আত্মার স্বরূপ এবং সেই আত্মা নিজেতেই বর্তমান রয়েছে। তথাপি পুরুষার্থ বিস্মৃত হওয়ার, দ্বিত না থাকলেও পুরুষ ঘোরতর বিচিত্র সংসার প্রাপ্ত হয়ে থাকে। যেমন অজ্ঞ ব্যক্তি জলজ তৃণশৈবালাদির দ্বারা আচ্ছন্ন জল পরিত্যাগ করে জল কামনার মতো-তৃষ্ণার প্রতি ধাবমান হয়, তেমনি আত্ম-স্বরূপ হতে অন্য পদার্থে পুরুষার্থে দর্শনকারী পুরুষ সংসারপ্রাপ্ত হয়। দৈব্যজ্ঞান দেহাদির দ্বারা যে ব্যক্তি নিজের সুখ ও দুঃখ নিবৃত্তির ইচ্ছা করে। সেই দৈবশূন্য ব্যক্তির প্রারদ্ধ সকল কর্মই বিরল হয়ে থাকে। যদিও ক্রিয়ার বল হয়, তথাপি সেই বল তার কোন উপকারে আসে না। কারণ যে ব্যক্তি আধ্যাত্মিকাদি দুঃখে কোন প্রকারে মুক্ত হতে পারে না, সুতরাং ম্রিয়মান পুরুষের পক্ষে দুঃখোঁপার্জিত অর্থ বা কাম কি হতে পারে?
বিনা ক্লেশে অর্থ ভাল করেও দুঃখ পেতে হয়। কোন না লুব্ধ অজিত প্রিয় ঋণী ব্যক্তিরা প্রচুর অর্থ লোভেও ক্লেশ ভোগ করে। তারা ভয়ে রাতে নিদ্রা যেতে পারে না। সব সময় সকল দিক্ হতে তাদের শঙ্কা। প্রাণবাণ অর্থবান্ লোকদের রাজা হতে, চোর হতে, শত্রু হতে, স্বজন হতে, পশু-পক্ষী হতে, যাচকগণ হতে, কাল হতে এবং আপনা হতে সব সময় বিনাশ ভয় আছে। অতএব অর্থও প্রাণ-শোক, মোহ, ভয়, ক্রোধ, অনুরাগ, ক্লীবতা এবং শ্রমাদির মূল। সেই অর্থের প্রতি পণ্ডিত ব্যক্তির স্পৃহা পরিত্যাগ করা উচিত। ইহলোকে মধুমক্ষিকা ও অজগর সর্প আমাদের উত্তম গুরু, আমরা তাদের বৃত্তি পর্যালোচনা করেই এই বৈরাগ্য ও পরিতোষ প্রাপ্ত হয়েছি। মুধমক্ষিকার নিকট আমি সর্বকাম বিষয়ে বিরাজ শিক্ষা করেছি। কারণ অন্যান্য ব্যক্তিরা বিত্ত পতিকে বধ করে মধুকরের ন্যায় তাদের কৃষ্ণলব্ধ বিত্ত হরণ করে থাকে। আর অজগয়ের নিকট শিক্ষা পেয়ে আমি নিশ্চেষ্ট ও যদৃচ্ছালাভে পরিতুষ্ট থাকি৷ যদি কখন কিছু না পাওয়া যায়, তবু অজগরের মত ধৈর্যবান হয়ে বহুদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকি।
কখনও অল্প, কখনও বেশি, যখন যেরূপ পাই ভোজন করি। কখনও সুস্বাদু অন্ন খাই, আবার কখনও বিষাক্তযুক্ত অন্ন খেয়ে, কখন বহুনযুক্ত অন্ন, কখনওবা পূর্ণহীন আহার মিলে। কখন কেউ শ্রদ্ধা করে অন্ন এনে দেয়, কখনও বা অপমান করে যৎকিঞ্চিৎ দিয়ে থাকে। কোনদিন ভোজনের ভোজন আবার কোনও দিন উপবাসী থেকে রাতে অল্প কিছু পেয়ে সেটার দ্বারাই ক্ষুধার নিবৃত্তি করে থাকি। পরিধেয় সম্বন্ধেও কখন ক্ষৌম বসন, কখন দুকূল কখন বা মৃগচর্ম, কখন কৌপীন, কখন বল্কল, কখন বা অন্য যা কিছু পাই, তাই পরিধান করি। এইভাবে তুষ্টচিত্ত হয়ে সর্বদা প্রায় ভোজ করছি। শয়নেরও কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই–কোন সময় ভূমিতে, কখনও তৃণ বা শুষ্ক পাতার, অথবা পাথরের উপর কিংবা ছাই-এর উপর শুয়ে থাকি। আবার কেউ যত্ন করে অট্টালিকায় খাটের উপর নরম গদীতে শয়ন করালে, সেখানেই নিদ্রা যাই। ভ্রমণেরও কোন নিয়ম নেই–কখন উত্তম বস্তু, মাল্য চন্দনাদি অভিলিপ্ত হয়ে রথ, হস্তী বা অশ্বপৃষ্ঠে বেড়িয়ে থাকি, আবার কখনওঁ দিগম্বর হয়ে গ্রহের মত ঘুরে বেড়াই।
হে রাজন, যে ব্যক্তি স্বভাবতঃ বিষম। আমি তার নিন্দাও করি না, স্তবও করি না, সকলেরই কল্যাণ কামনা করি এবং মহাত্মা বিষ্ণুতে আপনার ঐকাত্ম প্রার্থনা করে থাকি। এই প্রকারে অবস্থিত হবার উপায় বলছেন–ভেদগ্রাহক মনোবৃত্তিতে বিকল্পকে (অর্থাৎ, জাতিরূপাদি ভেদকে) হোম করবে অর্থাৎ ঐক্য ভাবনা করবে, পরে সেই মনোবৃত্তিকে যাতে অর্থরূপ বিভ্রম অর্থাৎ দেহাত্মাদি পদার্থের বিপর্যয়) আছে তাদৃশ মনে হোম করবে। তারপর সেই অহংকারকে মহত্ত্ব-দ্বারা মায়াতে হোম করবে। শেষে সত্যদর্শী ও মননশীল হয়ে মায়াকে আত্মানুভূতিতে হোম করবে। তারপর পরমাত্মায় অবস্থিত হয়ে আত্মানুভাবে নিরীহ (অর্থাৎ সকল ক্রিয়াশূন্য) হয়ে সমস্ত কার্য থেকে বিরত হবে।
হে রাজন, তুমি ভগবৎ প্রিয়–এই নিমিত্ত আমার এই আত্মবৃত্তান্ত অত্যন্ত গোপনীয় হলেও তোমার নিকট বর্ণনা করলাম। মন্দদৃষ্টিতে শ্লোক ও শাস্ত্রের বিধান হতে পৃথক মনে হলেও তত্ত্বদৃষ্টিতে ইহা সেরূপ নয়। নারদ বলালন-হে যুধিষ্ঠির, অসুরেশ্বর প্রহ্লাদ অজগরব্রতী মুনির নিকট ঐরূপ পরমহংস ধর্ম শ্রবণ করে তাকে পূজা করলেন। তারপর প্রীত হয়ে মুনির অনুমতি গ্রহণ পূর্বক নিজের গৃহাভিমুখে গমন করলেন।
.
চতুর্দশ অধ্যায়
গৃহস্থের উৎকৃষ ধর্ম এবং দেশ-কালভেদে বিশেষ ধর্মের বিবরণ
যুধিষ্ঠির বললেন–হে দেবর্ষি, গৃহস্থ ব্যক্তি যে বিধির দ্বারা এই পদবী (গতি) অনায়াসে লাভ করতে পারে অনুগ্রহপূর্বক তা বলুন। কারণ আমার মত জনের গৃহে অবস্থিত ব্যক্তি বাসুদেব সমর্পণপূর্বক যথোচিত ক্রিয়াকলাপের অনুষ্ঠান করে। যাকালে (অপরাহ্নাদি সময়ে) মহামুনিদের সেবা করবে। আর সর্বদা ভগবানের অবতার বলের কথামৃত অবহিত ও শ্রদ্ধান্বিত হয়ে শ্রবণ করবে এবং শান্ত-দান্ত জনগণের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকবে। ঐ প্রকার সাধুমনের সঙ্গহেতু ক্রমে ক্রমে নিজের দেহ, স্ত্রী ও পুত্ৰাদিতে স্নেহ ছিন্ন হয়ে যাবে। তখন সুপ্তোঙ্খিত পুরুষ যেমন স্বপ্নদৃষ্ট পুত্রাদির সঙ্গ ত্যাগ করে, তেমনি ঐ ব্যক্তি ঐ সকলের সঙ্গ ত্যাগ করে। যে পরিমাণ অর্থের একান্ত প্রয়োজন, তা গ্রহণ করে, দেহ ও গৃহের প্রতি বিরক্ত হবে এবং বাহিরে লোকমধ্যে অসক্তের মত দেখাবে। কোথাও আগ্রহ না করে জ্ঞাতিজন পিতা, মাতা, ভ্রাতা, পুত্র, সুহৃৎ এবং অন্যান্য ব্যক্তি যা ইচ্ছা করে, তাই নিজে অনাসক্ত হয়ে অনুমোদন করবে। আর দিব্য (বৃষ্টাদির দ্বারা জাত ধান্যাদি ভৌম (ভূমি ঘন্যা প্রাপ্ত নিবি প্রভৃতি), অন্তরীক্ষ (অকস্মাৎ লব্ধ ধন) এবং দৈবলব্ধ ধনাদির রক্ষণাবেক্ষণ করে পূর্বোক্ত সকল কর্ম করবে।
–যদি দৈবাৎ অধিক লাভ হয় তাতে অভিমান করবে না, কারণ যে পরিমাণ ধনাদিতে উদর পূর্তি হয়, ততটুকুই দেহিদের স্বত্ব। যে ব্যক্তি তার অধিক দ্রব্যের অভিযান করে, সে চোর, অতএব দণ্ড পাবার যোগ্য। মৃগ, উষ্ট্র, গর্দভ, মর্কট, ইঁদুর, সর্প, পক্ষী, মক্ষিকা ইত্যাদি যে কোন প্রাণ গৃহে অথবা ক্ষেত্রে প্রবেশ করে যদি শস্যাদি ভোজন করে, তাকে নিবারণ করবে না, বরং তাদের নিজের পুত্র সমান দেখবে। বস্তুতঃ পুত্ৰাদি হতে ঐ সকল মৃগাদির কতটুকু পার্থক্য? গৃহস্থ ব্যক্তি অতিকষ্টে ধর্ম, অর্থ, কাম–ওই ত্রিবর্গ উৎপন্ন করে সতত তার সেবা করবে না। কিন্তু যে স্থানে, যে কালে, দৈবাধীন যাবৎ লব্ধ হয়, তার সেবা করবে। আর কুকুর, পতিত এবং চণ্ডাল পর্যন্ত সকল প্রাণিকে যথাযোগ্য ভোজ্যবস্তু ভাগ করে দিবে। এমন কি নিজের শুশ্রূষার ব্যাঘাত হলেও নিজের একমাত্র ভার্যাকেও অতিথি সেবায় নিযুক্ত করবে।
হে রাজন, লোকে যে ভার্যার নিমিত্ত নিজের গ্রাম পর্যন্ত পরিত্যাগ করে এবং পিতা ও পুত্রকেও বধ করতে উদ্যত হয়, যে ব্যক্তি সেই ভার্যাতেও স্বত্বপরিত্যাগ করেন, তাহা কর্তৃক অজিত ঈশ্বরও বিজিত হন। যদিও ভার্যাতে স্বত্বাভিমান ত্যাগ করা কঠিন, তথাপি তত্ত্ববিচার দ্বারা অসাধ্য সাধন করতে পারা যায়। বস্তুতঃ এই দেহ অন্তে কৃমি, বিষ্ঠা অথবা ভস্মে পর্যবসিত হবে। তখন এই তুচ্ছ দেহই বা কোথায়? আর এই দেহে যার সঙ্গে রতি,সেই ভার্যাই বা কোথায়? আর যে আত্মা নিজ মহিমার দ্বারা গগনমণ্ডলকেও আচ্ছন্ন করেন, সেই আত্মাই বা কোথায়? এভাবে তত্ত্ববিচার করলে দেহ বা ভার্য্যা কোন পদার্থেই আসক্তি থাকবে না।
গৃহস্থ ব্যক্তি দৈবলব্ধ অর্থের দ্বারা পঞ্চযজ্ঞের অনুষ্ঠান করে, যা অবশিষ্ট থাকবে, তার দ্বারা নিজের জীবিকা নির্বাহ করবে। এইভাবে জীবন দ্বারা করতঃ যিনি ব্যয়ের অবশিষ্ট অংশে নিজের স্বত্ব পরিত্যাগ করেন, তিনিই প্রাজ্ঞ, তিনি মহাজনদের নিবৃত্তিময় পথের অধিকারী হন। দেব, ঋষি, মনুষ্য, ভূত ও পিতৃগণ–এই সকল পঞ্চ যজ্ঞের দেবতার ও আত্মার নিজবিত্তের দ্বারা যথাবিধি অর্চনা করবে। এই প্রকার পৃথক প্রতিদিন অন্তর্যামির অর্চনা করবে। যদি নিজের অধিকারে সমস্ত যজ্ঞের সমপদ থাকে, তবে বৈতনিক (বিতান অর্থাৎ স্রোত কল্প সূত্রাদি রূপ যজ্ঞ গ্রন্থের) বিধান অনুসারে অগ্নি হোত্রাদির দ্বারা যজ্ঞ করবে।
হে রাজন্য, যজ্ঞের জন্য অতিশয় নিবন্ধ করার প্রয়োজন নেই। যৌথ সর্বযজ্ঞের ভোক্তা ভগবান হরি ব্রাহ্মণমুখে হত অন্নাদির দ্বারা যেরূপ তুষ্ট হন, অগ্নিতে প্রদত্ত হবির দ্বারা সেরূপ হন না। অতএব ব্রাহ্মণ, দেব ও মানব প্রভৃতিতে যথাশক্তি সেই সেই ভোজ্যের দ্বারা ক্ষেত্র আত্মার যজ্ঞ করবে। (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য) বৈভব অনুসারে ভাদ্র মাসে মাতা পিতার এবং বিত্তমান হলে তার বন্ধুদের ও অপর পক্ষী (অর্থাৎ মহালয়) শ্রাদ্ধ করবে। এরূপে অয়নদ্বয় (কর্কট সংক্রান্তি), ব্যতিপাত দিনে নিদনক্ষয় (ত্র্যহ স্পর্শ), চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ, দ্বাদশ তিথি এবং শ্রবণা নক্ষত্রে শ্রাদ্ধ করবে।
এইরূপ বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের অক্ষয়তৃতীয়া, কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী, হেমন্ত ও শিশিরে (অর্থাৎ অগ্রহায়ণাদি চার মাসে) চারটি অষ্টকা শ্রাদ্ধ করবে মাসের শুক্লা পঞ্চমী মঘা নক্ষত্র ও পূর্ণিমায় সঘাতীর্থ (অর্থাৎ মঘা নক্ষত্রযুক্ত পূর্ণিমা) এবং যে যে নক্ষত্র হতে যে যে মাসের নাম হয় সেই সকল নক্ষত্র যখন সম্পূর্ণ চন্দ্রবিশিষ্ট পৌর্ণমাসির অথবা কিঞ্চিত নূন চন্দ্র যুক্ত অনুমতি তিথির সাথে মিলিত হয়, সেই সময় শ্রাদ্ধ করবে। যখন দ্বাদশ তিথিতে অনুরাধা, শ্রবণা এবং উত্তরফাল্গুনী। উত্তরাষাঢ়া ও উত্তরভাদ্রপদ এই তিন নক্ষত্রে যদি উপবাসের পর্যোতা, একাদশী হয় (অর্থাৎ, তিথিতে একাদশী ব্রত হলে পরদিন দ্বাদশীতে), জন্মনক্ষত্রের অথবা শ্রবণা নক্ষত্রের যোগযুক্ত দিন–এই সকল শ্রাদ্ধের কাল। এই সকল কাল কেবল শ্রাদ্ধের জন্যই প্রশস্ত নয়, ইহা মানবগণের শ্ৰেয়মাত্রের বর্ধক, অতএব এই সকল সময়ে সর্ব প্রযত্নে শ্রেয়স্কর সকল কার্যই করবে। এই সকল ধর্মীয় কর্ম করলেই পরমায়ুর সাফল্য হয়। এই সকল সময়ে স্নান, জপ, হোম, ব্রত এবং দেব, ব্রাহ্মণের যাহারা পূজা করে ও পিতৃদেব, মনুষ্য ও প্রাণীদের যাহা প্রদান করা তাহা অবীনশ্বর। হে রাজন, ভার্যার পুংসবনাদির সংস্কার কাল পুত্র, কন্যার জাত কর্মাদি, সময়, নিজের যজ্ঞ দীক্ষাদি সময়ে, প্রেতের দাহনাদিতে, মৃতা এবং অন্যান্য অভ্যুদায়িক কর্ম সময়ে শ্ৰেয়োজনক শ্রাদ্ধ আদি ক্রিয়া কর্তব্য।
এরপর যে যে দেশ ধর্মাদি শ্রেয়জনক তা বলছি শোন। যাঁতে এই সমস্ত চরাচর বিশ্ব বর্তমান সেই ভগবানের প্রতিবিম্ব রূপ সৎপাত্র যে দেশে লাভ হয় সেই দেশ অতিশয় পুণ্যতম। আর, যেখানে তপস্যা, বিদ্যা ও দয়াতে বিভূষিত ব্রাহ্মণকুল থাকেন এবং যেখানে ভগবান হরির প্রতিমা রয়েছেন, সেই সকল দেশ মঙ্গলের নিকেতন। আর যেখানে পুরাণ প্রমিভূ গঙ্গাদি, সয়িত, পুষ্করাদি সরোবর এবং যে সকল ক্ষেত্র উত্তম জন কৰ্ত্তীক। আশ্রিত তথা কুরুক্ষেত্র, গরশীরঃ প্রয়াগ, পুলহ মুনির আশ্রম, নৈমিষ্যরাণ্য, ফনদী, সেতুবন্ধ, প্রভাসতীর্থ, কুশথিলী (দ্বারকা) বারাণসী, মধুপুরী, পদ্মা সরোবর, বিষ্ণু সরোবর, নারায়ণাশ্রম বদরিকাশ্রম) পদ্মা নদী এবং সীতা ও রামের আশ্রম প্রভৃতি স্থান সকল। হে রাজ, মহেন্দ্র, মলয়াদি সকল কুলীন (শ্রেষ্ঠ পতি)–এই সকল দেশ পুণ্যতম, আর যে যে স্থানে হরির স্থির প্রতিমা (জগন্মাতাদি) অবস্থিত সে সকলও অতিশয় পবিত্র স্থান। হে রাজন, যে ব্যক্তি সর্বপ্রকারে শ্রেয়স্কামনা করেন, তিনি স্বত্বততঃ ঐ সকল স্থানের সেবা করবেন। কারণ ঐ সকল স্থানে কর্ম করলে, তা হতে পুরুষদের সহস্রপূর্ণ অধিক ফলোদয় হয়। হে পৃথিবী পতি, পাত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণ একমাত্র তাকেই পূজ্যতম পাত্র বলে নির্ণয় করেছেন, যেহেতু এই চরাচর বিশ্ব তন্ময়। হে রাজন, তুমি যে রাজসূয় যজ্ঞ করেছিলে তাতে দেবগণ তথাযোগাদি সিদ্ধ ব্রাহ্মণনাদন সনকাদি মহর্ষি উপস্থিত ছিলেন, তারা সম্মুখে থাকতেও অগ্রপূজায় ভগবান অচ্যুতেই পাত্ররূপে সম্মত হয়েছিলেন। তোমার যজ্ঞে তিনি কেন পাত্র বলে সম্মত হয় তার কারণ বলছি শোন–জীব রাশিতে ব্যপ্ত এই যে ব্রহ্মাণ্ড কোষরূপ মহান মহীরূহ, এয়ও মূল সেই ভগবান, অতএব তার অর্চনাই সকল জীবের আত্মা পরমতৃপ্ত হয়, সেই ভগবান, মনুষ্য, পশু, পক্ষী ঋষি ও দেবতারূপ শুরু (শরীর) প্রভৃতি সমস্ত সৃষ্টি করেছেন এবং নিজে সেই সকল শুনে (শরীরে) অন্তর্যামী রূপে ও প্রত্যাগতাংশে শয়ন করেন। এইজন্য তিনি পুরুষ বলে প্রসিদ্ধ। ভগবান সেই সকল পশু প্রভৃতিতে তারতম্যভাবে অবস্থান করেন এবং পুরুষে অধিকরূপে থাকেন বলে পুরুষকেই পাত্র বলা হয়েছে। তার মধ্যেও তপস্যা যোগাদির দ্বারা যেখানে তার যেরূপ অধিকাংশের বিকাশ সেখানে সেই পরিমাণ পুরুষের পাত্র তার যোগ্যতার অধিক।
হে রাজ, তৎপরে ঐ সকল মনুষ্যের পরস্পর অসম্মানকরণে বুদ্ধি হওয়ায় কবিগণ তাদের ভার দেখে। একাদি যুগে উপাক্ষণার জন্য ভগবানের প্রতিমায় শ্রেষ্ঠ পাত্র বলে নির্দেশ করেন। তারপর কিছু লোক শ্রদ্ধার সহিত প্রতিমার (অধা বিগ্রহে) শ্রীহরিকে অর্চনা করে থাকেন কিন্তু মানুষের প্রতি দ্বেষ করে বিগ্রহ উপাসনায় প্রদত্ত হলে, তাতে অভীষ্ঠ স্থির হয় না। সকল পুরুষের প্রতি দ্বেষশূন্য হয়ে অর্চনা করলে অতি নিম্নাধিকারীও পুরুষার্থ লাভ করতে পারে। হে রাজেন্দ্র, পুরুষগণের মধ্যে ব্রাহ্মণকেই সুপাত্র বলে জানবে। তাদের মধ্যে যিনি আস্যাবিদ্যা ও অসন্তোষ দ্বারা হরির মূর্তি বেদ ধারণ করণে তিনি অতিশয় উত্তম পাত্র, হে রাজন জগদত্মা ভগবান হরি ব্রাহ্মণগণের পদধূলির দ্বারা ত্রিভুবন পবিত্র করেন। এতে ব্রাহ্মণগণ যে পরমপাত্র তাতে সংশয় কি?
.
পঞ্চদশ অধ্যায়
সকল প্রকার বর্ণাশ্রম ধর্মের সার বর্ণন ও মোক্ষের লক্ষণ-নিরূপণ
নারদ বললেন–হে রাজন, কতকগুলি ব্রাহ্মণ কর্মনিষ্ঠ, কেউ তপোনিষ্ঠ, কেউ সাধ্যায়ে বেদাধ্যয়কে নিরত, অন্য কতকগুলি প্রবচনে (বেদার্থ–ব্যাখ্যানে) নিপুণ, আর কতকগুলি জ্ঞান ও যোগে পরিনিষ্ট। ব্যক্তিদানের অনন্তফল ইচ্ছা করেন তার পক্ষে জ্ঞাননিষ্ঠ বিপকে কব্য (অর্থাৎ পিতৃ উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধির দ্রব্য) ও হব্য (অর্থাৎ দেবতার উদ্দেশ্যে দেয় দ্রব্য) দান করা উচিত। যদি ঐরূপ ব্রাহ্মণ পাওয়া যায়, তবে জ্ঞান-তারতম্য বিবেচনা করে অন্য ব্যক্তিদেরও হব্য ও কব্য দেওয়া যেতে পারে।
পিত্রাদির শ্রাদ্ধে দৈবপক্ষে দুজন এবং পিতৃপক্ষে তিনজন, অথবা উভয় স্থলেই এক একটি ব্রাহ্মণ ভোজন করাবে। অত্যন্ত সমৃদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হলেও শ্রাদ্ধে অধিক ব্রাহ্মণ ভোজন করাবে না। স্বজনের অনুরোধে অধিক ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রণ করে শ্রাদ্ধ অর্পণ করলে, দেশ-কালের অনুরূপ শ্রদ্ধা, দ্রব্য, পাত্র যে অৰ্চন–এ সকল প্রায় উত্তমরূপ হতে পারে না। উপযুক্ত দেশকাল প্রাপ্ত হলে মুন্ন্যন অর্থাৎ অরণ্যজাত নীবারাদি অথবা ন্যায়র্জিত যৎকিঞ্চিৎ অন্নাদি ভগবান হরিকে নিবেদন করে শ্রদ্ধাপূর্বক সৎপাত্রে অর্পণ করলে তাই অক্ষয় ও কাম ফলদায়ক হয়।
যা হোক, দেবতা ঋষি, পিতৃগণ এবং প্রাণীসকল সেরূপ আত্মা ও আত্মীয়দের প্রতি যথাযোগ্য অন্ন বিভাগ করে দিয়ে তাদের ঈশ্বরতুল্য দর্শন করবে। হে নৃপ, শ্রাদ্ধে মৎস্য মাংসাদি আমিষ দ্রব্য প্রদান করবে না এবং ধর্মতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি তা ভোজনও করবে না। কারণ নীবারাদির দ্বারা যেরূপ পরম প্রীতি হয়, পশুহিংসায় সেরূপ প্রীতি হতে পারে না। সদ্ধর্মাকাক্ষী মানবগণের জ্ঞায়, মন ও বাক্যের দ্বারা প্রাণীসকলের প্রতি হিংসা পরিত্যাগের মত আর পরম ধর্ম নাই (যেহেতু অহিংসাই পরমধর্ম। অতএব প্রধান প্রধান নিষ্কাম জ্ঞানীগণ জ্ঞানদীপিত আত্মসংযমন অগ্নিতে যজ্ঞ সকলের হোম করে থাকেন অর্থাৎ উত্তম অধিকারিদের প্রায় বাহ্য কর্ম সকল পরিত্যাগ হয়। হে রাজন, যে ব্যক্তি দ্রব্য যজ্ঞের দ্বারা যাগ করে, তাকে দেখে প্রাণীসকল ভয় পেয়ে থাকে। তারা মনে করে এ ব্যক্তি আত্মতত্ত্বে অনভিজ্ঞ, কেবল প্রাণের তৃপ্তিকারী এর করুণা নেই, এ আমাদের বধ করবে, এতে সংশয় নেই। এইজন্য ধর্মজ্ঞজনের উচিত–সন্তুষ্ট হয়ে দৈবপ্রাপ্ত নীবাবাদির দ্বারাই অহরহঃ নিত্য নৈমিত্তিক ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন করবে না।
হে নৃপ, ধর্মজ্ঞ ব্যক্তি বিধর্ম, পরধর্ম, ধর্মাভ্যাস, উপধর্ম এবং ছল ধর্ম–এই পাঁচটি অধর্মশাখাকে অধর্মের ন্যায় (অর্থাৎ নিষিদ্ধবৎ জ্ঞান করে) পরিত্যাগ করবেন। ধর্মবৃদ্ধিতে ক্রিয়মান হলেও যাতে স্বধর্মের বাধ্য হয়, তা বিধর্ম, অন্যের উপদিষ্ট ধর্ম অন্যের নিকট পরধর্ম। যেমন ক্ষত্রিয়াদির বিহিত ধর্ম ব্রাহ্মণদের পক্ষে পরধর্ম পাষণ্ড বেদবিরুদ্ধ আগমুক্ত ধর্ম, অথবা পরের বঞ্চনায় দম্ভের জন্য যে কর্ম তা উপধর্ম এবং যা নামে ধর্ম, কাজে অন্য তা ছল ধর্ম। আর পুরুষেরা নিজের ইচ্ছায় বা ধর্মবলে অনুষ্ঠান করে (অর্থাৎ স্বেচ্ছাবশতঃ কল্পিতদেব পূজাদি) তা ধর্মাভ্যাস, যেহেতু তা আশ্রয়ধর্ম হতে পৃথক। স্বভাব অনুসারে বিহিত যে ধর্ম কোন ব্যক্তির প্রশান্তি নিমিত্ত না হয়? অতএব স্বধর্ম অনুষ্ঠান করে ধর্ম বাহুল্যের জন্য পরধর্ম আচরণ করা উচিত নয়।
নির্ধন ব্যক্তি ধর্মের জন্য অথবা দেব নির্বাহের জন্যও যদি অর্থ কামনা না করে ন্যায় তবে তার এই নিচেষ্টতাই মহাসর্পের জীবিকা সম্পন্ন করে দেয়। বস্তুতঃ সন্তুষ্ট আত্মারাম ব্যক্তি নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকলে তার অন্তঃকরণে যে সুখ হয়, কামলোভে অর্থ চেষ্টায় দিকে দিকে ধাবমান লোকের সে মুখ কোথায়? যে ব্যক্তির মন সর্বদা স্পষ্ট, তার পক্ষে সকল দিক্ সর্বদাই মঙ্গলময়, যেমন যে ব্যক্তির পায়ে পাদুকা থাকে, তার শর্করা ও কণ্টকাদি হতে কল্যাণ হয়ে থাকে। হে রাজন, সন্তুষ্ট চিত্ত ব্যক্তি কোনরূপে একটু জল পেয়েও সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু যে ব্যক্তির মন অসন্তুষ্ট, সে উপস্থ, জিহ্বা ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের বশীভূত করে কুকুরের মত ব্যবহার করে। অসন্তুষ্ট বিপ্রের ইন্দ্রিয়–লোলুপতায় তেজ, বিদ্যা, তপস্যা, যশ সমস্ত কিছুই বিনষ্ট হয় এবং জ্ঞানও চলে যায়। ক্ষুধা ও তৃষ্ণার পূর্তির দ্বারা কামের অন্ত হতে পারে। ক্রোধের ফল যে হিংসা, তার নিষ্পত্তির দ্বারা ক্রোধেরও শান্তি হতে পারে, কিন্তু সকল দিক্ জয় ও পৃথিবী ভোগ করেও লোভের কখনও শেষ হয় না। হে মহারাজ, বহুজ্ঞ এবং সংশয়চ্ছেত্তা বহু বহু পণ্ডিত, আর সভাপতি বলে গণ্য অনেক মহাজন অসন্তোষের জন্য অধঃপতিত হয়ে থাকেন।
এখন কামাদি জয়ের উপায় বলছেন–সংকল্প পরিত্যাগ করে কাম জয় করবে। কাম-বিসর্জনের দ্বারা ক্রোধকে জয় করবে। অর্থ নানাপ্রকার অনর্থের মূল–এ বিবেচনা করে লোভ জয় করবে। আর তত্ত্বাবমর্শনের (অর্থাৎ প্রারব্ধ ফল অবশ্যই ভোক্তব্য–এজন্য কে কার দুঃখের হেতু এইরূপ, অথবা সকলেই পরমেশ্বরের অধীন, তাঁর কৃপায় অদ্বৈত অনুসন্ধানের দ্বারা) ভয়কে জয় করবে। আর, আত্মা ও অনাত্ম বিবেকের দ্বারা শোক ও মোহকে দূর করবে। মহতের সেবার দ্বারা দম্ভকে নিরস্ত করবে। মৌন অবলম্বনের দ্বারা যোগের প্রতিবন্ধক লোকবাতাদি পরিত্যাগ করবে এবং কামাদি বিষয়ের চেষ্টা পরিত্যাগ করে হিংসা জয় করবে।
ভূতজ দুঃখ অর্থাৎ কোনো প্রাণী হতে দুঃখ উৎপন্ন হলে তাদের প্রতি কৃপা অর্থাৎ তাদের হিত আচরণ করে তজ্জনিত দুঃখ দূর করবে। দৈবোপসর্গজনিত দুঃখ (অর্থাৎ বৃথা মনঃপীড়াদি), সমাধির (অর্থাৎ ভগবানে চিত্তের একাগ্রতার) দ্বারা পরিত্যাগ করবে। আত্মজন্য দুঃখ (অর্থাৎ আধ্যাত্মিক ক্লেশাকে) প্রাণায়ামাদি যোগবলে জয় করবে এবং নিদ্রাকে সত্ত্বগুণের সেবার দ্বারা (অর্থাৎ সাত্ত্বিক অল্প আহার অথবা প্রাণীমাত্রের পরিচর্যার দ্বারা) দূর করবে। আর ঐ সত্ত্বগুণের দ্বারা রজোগুণ ও তমোগুণকে জয় করবে এবং সেই সত্ত্বকে উপশমের দ্বারা জয় করবে। হে রাজন, গুরুর প্রতি ভক্তি থাকলে পুরুষ ঐ সকলকেই যথার্থরূপে জয় করতে সমর্থ হয়।
হে রাজন, জ্ঞানদীপদ গুরু সাক্ষাৎ ভগবানের স্বরূপ, “যে ব্যক্তি তাঁকে মনুষ্য”–এইরূপ দুবুদ্ধি করে, তার সমুদয় শাস্ত্রশ্রবণ হস্তিস্নানের ন্যায় ব্যর্থ হয়। গুরুর পিতা, পুত্রাদি এবং প্রতিবেশীগণ সকলেই তাকে মানুষ বলে মনে করে। অতএব কি করে একমাত্র শিষ্যই তাকে পরমেশ্বর বলে মনে করবে? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং রামচন্দ্রকেও অবতারকালে সেই সময়ের জাত লোকেরা মানুষ বলেই মনে করত, কিন্তু তাদের মনে করার জন্যই কি ভগবানের পরমেশ্বরত্ব নষ্ট হয়েছে? সেইরূপ লোকে মনে করলেই কি গুরু ভগবান হবেন না? তাই বলছেন)–হে যুধিষ্ঠির ঐ গুরুদেব সাক্ষাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ এবং প্রধান ও পুরুষের ঈশ্বর যোগীশ্বরগণ সেই শ্রীকৃষ্ণেরই চরণ অন্বেষণ করে বেড়ান, লোকেরা তাকে মনুষ্য বলে গণ্য করে, তা তাদের ভ্রান্তি মাত্র।
এইপ্রকারে সমস্ত উপায়ের দ্বারা কামাদিবেগ জয় করে, সংযতেন্দ্রিয় হয়ে ধ্যানপর হবে; নতুবা তার শাস্ত্রাদি অনুশীলন বিফল হবে। তাই বলছেন–ইষ্টাপূজাদি যত বিধি আছে, কেবল ষড়বর্গের (অর্থাৎ ছয় ইন্দ্রিয়ের) সংযমেই তাদের পযবসান (অর্থাৎ সকল বিধিই কেবল ষড়বর্গ অর্থাৎ পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মন) বশীকারের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে। কিন্তু ঐ সকল বিধি ষড়বর্গ-সংযমপর হয়েও যদি যোগ অর্থাৎ ধারণা, ধ্যান, সমাধি ইত্যাদি সাধন করতে না পারে, তা হলে কেবল পরিশ্রম মাত্র। যেমন কৃষি কার্যের ফল, যোগসাধনের ফল যে মোক্ষ, তা দান করতে পারে না, তেমনি বহির্মুখ–প্রবৃত্ত ব্যক্তির ইষ্টাপূজাদি কর্ম মোক্ষসাধক হতে পারে না, বরং সংসার–প্রবর্তক হয়ে থাকে। যোগরত হয়েও যদি কোনো ব্যক্তির কুটুম্বাদির সঙ্গবশতঃ চিত্ত বিক্ষিপ্ত হয়, তার কর্তব্য কি বলছেন–যে ব্যক্তি চিত্ত-বিজয়ের উদ্যোগী তিনি গৃহাদি পরিত্যাগপূর্বক নিঃসঙ্গ হয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন এবং একাকী নির্জনে বাস ও ভিক্ষালব্ধ পরিমিত আহার করে দেহযাত্রা নির্বাহ করবেন।
পবিত্র সমান প্রদেশে নিজের সুখবোধ্য আসন স্থাপন করে স্থির ও সমানভাবে উপবেশন করবেন। তখন নিজের শরীর ঋজু অর্থাৎ সমান হবে এবং মুখ “ওঁ”–এই প্রণব মন্ত্র উচ্চারণ করবেন। পরে পূরক, কুম্ভক, রেচক–ওই সকল প্রাণায়াম দ্বারা প্রাণ ও অপান বায়ুকে বিরুদ্ধ করে থাকবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত মন সকল কামনা (শব্দাদি সমস্ত বিষয়) ত্যাগ না করে, ততক্ষণ নিজের নাসাগ্রে নিরীক্ষণ করে থাকবেন। কামমত ভ্রমণশীল মন যে যে স্থান হতে নিঃসৃত হয়ে যায়, সেই সেই স্থান হতে তাকে ধারণ করে ক্রমে ক্রমে হৃদয় মধ্যে নিরুদ্ধ করে রাখবেন। যিনি নিরন্তর এই প্রকার অভ্যাস করেন, অল্প কালের মধ্যেই সেই ব্যক্তির চিত্ত কাষ্ঠহীন অগ্নির ন্যায় নির্বাণ (শান্তি) প্রাপ্ত হয়। যে চিত্ত কামাদির দ্বারা ক্ষুব্ধ হয় না, তা আর কখনও উদ্বিগ্র (অর্থাৎ বিক্ষুব্ধ) হয় না। কারণ ব্রহ্মসুখে (অর্থাৎ ভগবৎস্বরূপ–পরমানন্দে) সংস্পৃষ্ট হওয়ায় চিত্তের সমস্ত বৃত্তি প্রশান্ত হয়ে যায়।
গৃহাশ্রম ধর্ম, অর্থ, কাম–এই ত্রিবর্ণের বপন স্থান, সেই গৃহাশ্রম হতে প্রব্রজিত হয়ে, যদি কেউ আবার সংসারের সেবা করেন, তা হলে সে ব্যক্তি বান্তাশী (অর্থাৎ আগে বমি করে আবার তার ভক্ষণকারী ঘৃণিত কুকুরের মত) ও নির্লজ্জ। প্রব্রজ্যা অর্থাৎ সন্ন্যাস গ্রহণ করে আবার গৃহী হওয়া অসম্ভব মনে করো না। যে সকল ব্যক্তি অতিশয় অসৎ, তারা একবার নিজ দেহকে অনাত্মা, জড় ও মরণধর্মশীল, অন্তে কৃমি, বিষ্ঠা বা ভস্মের সমান মনে করে সন্ন্যাস গ্রহণ করে, আবার এই দেহকেই সার আত্মা মনে করে এবং সংসারে প্রবেশ করে। গৃহস্থ ব্যক্তির ক্রিয়াত্যাগ, ব্রহ্মচারীর ব্রত ত্যাগ, তপস্বীর গ্রামে বাস এবং ভিক্ষুর ইন্দ্রিয়চাপল্য–এই সকল আশ্রম-বিড়ম্বনা। অতএব ঐ সকল ব্যক্তি আমাধম। তারা পরামেশ্বরের মায়ার বিমূঢ়, অতএব অনুকম্পা করে তাদের প্রতি উপেক্ষা করা কর্তব্য। আত্মতত্ত্বজ্ঞ সন্ন্যাসীর ইন্দ্রিয়চাপল্য কি দোষ–একথা বলতে পারো না–কারণ, আত্মা যে পরব্রহ্ম এটা যিনি জানতে পারেন, তার সমস্ত বাসনা নিরস্ত হয়ে যায়। তবে তিনি কি অভিলাষে এবং কিসের জন্যই বা লোলুপ হয়ে দেহ পোষণ করবেন? অর্থাৎ ব্রহ্মতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তির ইন্দ্রিয়চাপল্য কোনরূপেই সম্ভবপর নয়। হে রাজন, পণ্ডিতগণ এই শরীরকে রথ, বুদ্ধিকে সারথি এবং চিত্তকে দেহব্যাপী বন্ধন বলে বলেছেন। ঐ বন্ধন ঈশসৃষ্ট অর্থাৎ ঐ বন্ধনের কর্তা পরমেশ্বর। এইরূপ প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান ও উদান–এই পাঁচটি এবং নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয়–এই পাঁচটি সমুদায় দশবিধ প্রাণকে ঐ রথের অক্ষ (স্মল) ধর্ম ও অধর্মকে চক্র এবং অহংকারের সাথে বর্তমান জীবকে রথী বলেছেন। আর প্রণব ঐ রথের ধনু শুদ্ধ জীব তার শর এবং পরব্রহ্মই তার লক্ষ্য। অর্থাৎ যেমন ধনুর দ্বারা শর লক্ষ্যে নিপাতিত হয়, তেমনি প্রণব কর্তৃক জীব ব্রহ্মে নিপাতিত হন। রাগ, দ্বেষ, লোভ, মোহ, শোক ভয়, মদ, মান, অবমান, অসূয়া, মায়া, হিংসা, মাৎসর্য, অভিনিবেশ, অনবধানতা, ক্ষুধা ও নিদ্রা–এই সকল এবং এইরূপ অন্যান্য বিষয়সকল জীবের শত্রু। তারা কোথাও রজঃ ও তমঃ প্রকৃতির হয়, কোথাও সত্ত্ব প্রকৃতিরও হয়। (রাজাদিকে জয় করতে হবে। রজঃ অর্থ অভিনিবেশ) কিন্তু সত্ত্ব প্রকৃতি হলেও আরূঢ় সমাধি যতির পক্ষে পরোপকারাদি প্রবৃত্তি শত্ৰুস্বরূপ, অতএব তারও ঐ সকলকে জয় করা কর্তব্য।
হে যুধিষ্ঠির, ইন্দ্রিয় সকল ওই মানবদেহস্বরূপ রথের উপকরণ, ঐ সকলকে নিজের বশীভূত করে যতদিন এই রথ (দেহ) ধারণ করবে, ততদিন পর্যন্ত পূজনীয় জনগণের চরণ সেবার দ্বারা অপেক্ষাকৃত জ্ঞান রূপ খঙ্গ ধারণপূর্বক ভগবান অচ্যুতকে আশ্রয় করে শত্রু জয় করতঃ উপশান্ত হবে। পরে আনন্দ অনুভবে সন্তুষ্ট হয়ে ঐ রথাদিকে উপেক্ষা করবে। ভগবান অচ্যুতের আশ্রয় না করলে ইন্দ্রিয়রূপ অশ্বগণ ও সারথি সেই প্রমত্ত ব্যক্তিকে মার্গে) নিয়ে গিয়ে বিষয় নামক বিষয় দস্যুর মধ্যে নিঃক্ষেপ করবে। তারপর সেই দস্যুগণ অশ্ব ও সারথির সাথে সেই ব্যক্তিকে যেখানে গুরুতর মৃত্যুভয় রয়েছে। সেই অন্ধকারময় সংসার-কূপে নিক্ষেপ করবে।
হে রাজ, বেদবিহিত ইষ্টাপূৰ্বাদি কর্মকারী পুরুষের এইরূপ অর্থ হবার কারণ শোন- বেদোক্ত কর্ম দুই প্রকার প্রবৃত্ত ও নিবৃত্ত। প্রবৃত্ত কর্মে তৎপর হলে তার দ্বারা পুনরাবৃত্তি হয়। আর নিবৃত্ত কর্মের অনুষ্ঠানে অমৃত (মুক্তি) ভোগ করে। দ্রব্যময় কাম্য কর্ম অগ্নিহোত্রাদি, দর্শ, পৌর্ণমাস, চাতুর্মাস্য পশুগ–এই সকল অত্যন্ত আসক্তিযুক্ত, এ সমুদয় হতে শান্তি হতে পারে না। বৈশ্যদেব ও বলিহরণ ইত্যাদি কর্ম ইষ্ট-পদ বাচ্য, কিন্তু এ সকল যদি কাম্য হয় তবে অশান্তিপ্রদ ও প্রবৃত্তাস্য। আর, দেবালয়, উপবন, কূপ, পানীয়শালা নির্মাণ ইত্যাদি কর্ম পূৰ্ত্ত।
প্রবৃত্ত কর্মের দ্বারা যে প্রকারে আরোহণ ও অবরোহণ–ক্রমে সংসারে আবৃত্তি হয়, তা বলছেন–এ জন্মে যে যাগ-যজ্ঞ করে চরু ও পুরোত্তাশ (হবিবিশেষ) ইত্যাদি আহুতি দেওয়া হয়, তার সূক্ষ্ম পরিণাম (মৃত্যুর পর যা দেহান্তরের আরম্ভক হয়), আর ধূম (অর্থাৎ ধূমাভিমানী দেবতা) রাত্রি (রাত্যাভিমানী দেবতা) কৃষ্ণপক্ষ, দক্ষিণায়ন এবং চন্দ্রলোক–এই সকল যথাক্রমে মরণের পর জীব আরূঢ় হয়ে থাকে। (অর্থাৎ মৃত্যুর পর স্বকৃত চরু পুরোজাশাদি সূক্ষ্ম পরিণাম হতে আদৌ জীবের দেহান্তর প্রাপ্তি হয়। তারপর যথাক্রমে ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ এবং দক্ষিণায়ন–এই সকলের অভিমানী দেবতা কর্তৃক চন্দলোকে নীত হয়, সেখানে যথাক্রমে ভোগ হয়ে থাকে।) চন্দ্রলোকে ভোগের অবসান হলে, জীবের ঐ দেহ লয় প্রাপ্ত হয়, তাতে আদৌ অদর্শন হয়ে পরে বৃষ্টির দ্বারা যথাক্রমে ওষধি লতা, শস্য, ও শুক্র হয়ে পরিণত হয়; এইরূপে প্রবৃত্তি কর্মমার্গ পুনর্ভবের হেতু। ফলতঃ চন্দ্রলোকে ভোগাবসানে প্রথমতঃ দেহ বিনাশে অদর্শন হয়, তারপর ক্রমে বৃষ্ট্যাদির দ্বারা ওষধি প্রভৃতির প্রত্যেকের সান্নিধ্য প্রাপ্ত হয়ে এই পৃথিবীতে আবার উৎপন্ন হয়ে থাকে। তারপর নিষেকাদি শ্মশাসান্ত সংস্কার দ্বারা সংস্কৃত হলে তাকে দ্বিজ বলা হয়।
কিন্তু নিবৃত্ত কর্মনিষ্ঠদের ঐ প্রকারে আবৃত্তি হয় না, তাদের অর্চিরাদি মার্গ দ্বারা ব্ৰহ্মলোক প্রাপ্তি হয়। নিবৃত্তি পথের সঠিক জীবনকালেই জ্ঞানদীপিত ইন্দ্রিয়সকলে ক্রিয়াসকলকে হোম করেন, (অর্থাৎ ইন্দ্রিয় ব্যাপার যে ইষ্টাপূর্তাদি, সে সকলকে একমাত্র ইন্দ্রিয় রূপে চিন্তা করে থাকেন)। পরে সে সকলকে দর্শনাদি সংকল্পরূপে মনে এবং বিকারযুক্ত সেই মনকে বিধ্যাদি লক্ষণ বাক্যে হোম করেন। কারণ বিদ্যৈাদিলক্ষণ বাক্য দ্বারাই মন কর্তৃত্বাদি বিকারপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। সেই বাক্য বর্ণ-সমুদায় বিশেষ–স্বরূপ। এজন্য সেই বাক্যকে বর্ণ–সমুদায়ে হোম করে, তারপর সেই বর্ণ-সমুদায়কে আকারাদি (অ, উ, ম)–স্বরত্রয় স্বরূপ ওঙ্কারে হোম করেন। পরে সেই ওঙ্কারকে বিন্দুকে এবং বিন্দুকে সূত্ৰাত্মা প্রাণে হোম করতঃ সেই সূত্রাত্মাকে ব্রহ্মে হোম করে থাকেন।
নিবৃত্ত কর্মে রত পুরুষ যথাক্রমে অগ্নি, সূর্য, দিবস, প্রাহ্ন (দিবসের অন্ত), শুক্লপক্ষ, রাকা (শুক্লপক্ষের অন্ত) উত্তরায়ণ এবং ব্রহ্মা-এই সকলের অভিমানিনী দেবতা প্রাপ্ত হন (অর্থাৎ প্রথমতঃ) অগ্ন্যাভিমানী দেবতার নিকট নীত হয়ে পরে সূর্যাদ্যিভিমানী দেবসন্নিধানে নীত হয়ে থাকেন)। এই প্রকারে ব্রহ্মলোকে প্রাপ্ত ব্যক্তির ভোগাবসানে অগ্রে স্থলোপাধি বিশ্ব হয়। তারপর সেই স্কুলকে সূক্ষ্ম লয় করায়ে সূক্ষোপাধি তৈজস হয়। পরে সেই সূক্ষ্মকে কারণে লয় করায়ে কারণোপাধি প্রাপ্ত হয়, তারপর (সর্বত্র সাক্ষিস্বরূপ অন্বয়হেতু) সেই কারণকে সাহ্মিস্বরূপে লয় করায়ে তুরীয় হয়। পরিশেষে সেই সাক্ষিত্বের বিলয়ে শুদ্ধ আত্মস্বরূপ হয়। এই বঝুঁকে পণ্ডিতগণ দেবযান বলেছেন। প্রবৃত্ত পথে পুরুষ যেমন ক্রমে অগ্রসর হয়েও জন্মগ্রহণ করতে আবার ফিরে আসে, নিবৃত্ত পথে দেবযানে সেরূপ হয় না। আত্মরাজী উপান্তাত্মা আত্মস্থ পুরুষ উক্তপ্রকারে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়ে তদ্রপ আর নিবৃত্ত হন না।
হে রাজন, পিতৃযান ও দেবযান নামে দুই ধবত্ম বেদনির্মিত (অর্থাৎ বেদে প্রকাশিত), যে ব্যক্তি ঐ দুই অয়ন (পথ) শাস্ত্র চক্ষুর দ্বারা অবগত হন, তিনি দেহস্থ হয়েও মুগ্ধ হন না। কারণ–দেহারম্ভের পূর্বে কারণরূপে পরে সর্বশেষ অবধি (সীমারূপে) যে সস্তু বর্তমান থাকেন, তাকে অবলম্বন করে ভোগ্য ও ভোক্তা, উচ্চ ও নীচ, অপ্রকাশ ও প্রকাশ, নাম ও রূপ–সে সকলই বাসুদেব ভিন্ন আর কিছুই নয়, অতএব কার মোহ হবে? যেমন যুক্তিতর্কের বিরুদ্ধ হলেও প্রতিবিম্বকেও বস্তু বলে বলা হয়, তেমনি ইন্দ্রিয়সমূহাত্মক দেহ ও তৎসম্বন্ধ–বিষয়সমূহকে পদার্থবলে কল্পনা করা হয় বটে, বস্তুতঃ পরমার্থ বিচারে উহারা পদার্থ নয়, কারণ উহা দুর্ঘট (অর্থাৎ যুক্তি বিরুদ্ধ)।
ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম–এই পঞ্চভূতের ছায়া (ঐক্যবদ্ধ্যাবলম্বন) অর্থাৎ এরা একত্র হয়ে এই দেহ তৈরী করেছে। অথবা এদের কোনও পরিণত অবস্থায় দেহ হয়েছে–এরূপ মনে হতে পারে। কিন্তু এই দুই প্রকারের একটিও নয়। যেরূপ বৃক্ষ-সকলের সংঘাতে বড়, সেরূপ পঞ্চভূতের সংঘাতে দেহ নহে, কারণ দেহের একদেশের আকর্ষণে সকলের আকর্ষণ দেখা যাইতেছে। কিন্তু একটা বৃক্ষের আকর্ষণে সকল বন আকৃষ্ট হয় না। এইরূপ পঞ্চভূতের বিকার এই দেহ, তাও বলা যায় না। কারণ অবয়ব দেহের অংশবিশেষ এবং অবয়বী দেহধারী অত্যন্ত পৃথকও নয়। কারও সহিত কেহ অন্বিতও থাকে না; সুতরাং মিথ্যা পদার্থই জানবে। দেহাদি যেরূপ মিথ্যা, সে সকলের হেতুস্বরূপ পৃথিব্যাদিও সেরূপ মিথ্যা, কারণ পঞ্চভূতের ধাতু অর্থাৎ সূক্ষ্ম তন্মাত্র ভিন্ন পঞ্চভূত মিথ্যা। পঞ্চভূত অবয়বী, আর সূক্ষ্ম তন্মাত্র অবয়ব। অবয়বী মিথ্যা হলে, অবয়বও অসৎ অর্থাৎ মিথ্যা হয়ে পড়ল।
যদি বল অবয়বীর অসত্তা স্বীকার করলে আগমাপারি বাল্যাদি অবস্থায় ‘ইনি সেই দেবদত্ত’–এইরূপ প্রত্যাভিজ্ঞান কিরূপে হবে? উত্তর–অবিদ্যার বিকল্প থাকাতে পূর্ব পূর্ব আরোপ–সাদৃশ্য-হেতু ‘ইনি সেই’–এই প্রকার ভ্রমণ হতে পারে, কিন্তু যাবৎ পর্যন্ত অবিদ্যা নিবৃত্তি না হয়, তাবৎ পর্যন্তই ঐ ভ্রম থাকে। যদি সকলই মিথ্যা হয়, তবে শাস্ত্রের বিধিনিষেধ কি প্রকারে থাকতে পারে? এরূপ আশংকার উত্তরে বলছেন–স্বপ্নের মধ্যেও যেমন জাগ্রত ও নিদ্রাবস্থার স্বপ্ন দেখা যায়, শাস্ত্রের বিধি-নিষেধও তেমনি অজ্ঞান অবিদ্যার অবস্থায় হতে পারে। অতএব মননশীল যোগী ভাবনার অদ্বৈত ক্রিয়ার অদ্বৈত এবং দ্রব্যের অদ্বৈত আলোচনা করে, আত্মতত্ত্বের অনুভবের দ্বারা জাগ্রত প্রভৃতি অবস্থাত্ৰয় নিবারণ করে থাকেন।
ভাবনার অদ্বৈত কাকে বলে? তা বলছেন — বিকল্প (অর্থাৎ ভেদ) অবস্তু, এই হেতু বস্ত্র ও সূত্রের ন্যায় কার্য ও কারণকে যে এক বস্তুরূপে আলোচনা করা, তাকেই ভাবনাদ্বৈত বলা হয়। আর মন, বাক্য এবং কার্যের দ্বারা সাক্ষাৎ পরব্রহ্মে যে সমস্ত কর্ম সমর্পণ, তার নাম ক্রিয়াদ্বৈত। আর, নিজের সঙ্গে পুত্র, কলত্র, বা অন্যান্য দেহধারীর অভিন্নতা আলোচনা করে, ধন, সম্পদ বা কামনার যে ঐক্য দর্শন, তার নাম দ্রব্যাদ্বৈত। হে রাজন, যে দ্রব্য যে উপায়ে যে স্থানে যাহা হতে যে মনুষ্যের পক্ষে অনিষিদ্ধ হয় সেই মনুষ্য সেই দ্রব্যের দ্বারা কার্যের চেষ্টা করবে, অনোপকালে তদ্ব্যতীত অন্যদ্বারা কোন কর্ম করবে না। এই সকল এবং বেদবিহিত অন্যান্য বিধান অনুসারে স্বকর্ম অনুশীলন করে ভক্তিমান গৃহস্থও ভগবানের গতি লাভ করতে পারে।
হে নরদেব, তোমরা যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হতে বহু বহু দুস্ত্যজ আপদ উত্তীর্ণ হয়েছ এবং তার পাদপদ্ম সেবার দ্বারা দিগগজ জয়পূর্বক ভূরি ভূরি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছ। তেমনি সেই আত্মস্বরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় অন্যেও এই সংসার হতেও উত্তীর্ণ হতে পারে। হে রাজ, মহাজনের অবজ্ঞায় শ্রীকৃষ্ণসেবা হতে ভ্রষ্ট হয় এবং তাদের কৃপায় তাহা সিদ্ধ হয়ে থাকে। আমার পূর্ব বৃত্তান্ত শ্রবণ কর, তাতেই এ বিষয়ের প্রমাণ পাবে। পূর্বকালে অতীতকল্পে আমি উপবহন নামে গন্ধর্ব হয়েছিলাম। সকল গন্ধর্ব আমাকে মানগন্য করত। সৌন্দর্য, মাধুর্য, সৌকুমার্য, সৌগন্ধ ইত্যাদির দ্বারা আমি সকলের অতিশয় প্রিয়দর্শন ছিলাম। সকল যুবতীই আমাকে ভালবাসত। আমি সব সময় মদন্ত ও লম্পট হয়ে স্বপ্নের মধ্যে কালযাপন করতাম।
একসময় দেবতাদের যজ্ঞে হরিগাথা গানের নিমিত্ত বিশ্বস্রষ্টাদের দ্বারা গন্ধর্ব ও অপ্সরাগণ আহূত হল। ঐ আহ্বান জানতে পেরে আমিও উন্মত্ত হয়ে গাইতে গাইতে স্ত্রীগণে পরিবেষ্টিত হয়ে সেখানে গেলাম। আমার এই ধৃষ্টতা দেখে বিশ্বস্রষ্টাগণ ক্রুদ্ধ হয়ে নিজেদের প্রভাব দ্বারা আমার প্রতি এই অভিশাপ দিলেন—’যেহেতু আমাদের অবহেলা করছ, অতএব শীঘ্র নষ্টশী হয়ে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হও।‘ এরূপ অভিশপ্ত হয়ে আমি দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। সেই শূদ্র জন্মেও ব্রহ্মবাদী মুনিগণের সেবা ও সঙ্গলাভ করে পুনরায় ব্রহ্মার পুত্র হয়ে জন্মলাভ করেছি। হে রাজ, তোমার নিকট গৃহস্থগণের ধর্ম বর্ণনা করলাম, ঐ ধর্ম পাপনাশক, গৃহী ব্যক্তি ঐ ধর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা সন্ন্যাসীদের পদবী প্রাপ্ত হতে পারে।
হে রাজেন্দ্র, এই দ্যুলোকে তোমরা অতিশয় ভাগ্যবান, যেহেতু লোকপাবনকারী মুনিগণ তোমাদের গৃহে আগমন করছেন। আর তোমাদের আলয়ে মনুষ্যচিহ্নধারা সাক্ষাৎ পরম ব্রহ্ম গূঢ়রূপে অবস্থান করছেন। মহব্যক্তিগণের পরম অন্বেষণীয়, কৈবল্য নির্বাণসুখের অনুভূতি স্বরূপ। সেই পরম ব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণ তোমাদের প্রিয়, সুহৃৎ, মাতুলপুত্র, পূজ্য, বিধিকৃৎ (আজ্ঞানুবর্তী) এবং গুরু। তোমাদের সমান ভাগ্যবান কে আছে? হে রাজন, সাক্ষাৎ শিব ও ব্রহ্মাদি দেবগণ নিজ নিজ বুদ্ধির দ্বারা যার রূপ যথার্থরূপে বর্ণন করতে পারেন নাই, আমি তার কি বর্ণনা করব? সেই সাত্বতগণের পতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মৌন, ভক্তি এবং উপশমের দ্বারা পূজিত হয়ে আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন।
শ্রীশুকদেব বললেন–হে ভরতশ্রেষ্ঠ, রাজা যুধিষ্ঠির দেবর্ষি প্রাক্ত ঐ সকল বাক্য শ্রবণ করে অতিশয় প্রীত হলেন এবং প্রেমে বিহ্বল হয়ে নারদ ও শ্রীকৃষ্ণের পূজা করলেন। তারপর পূজিত মুনি (নারদ) শ্রীকৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরের সহিত সম্ভাষণ করে স্বস্থানে প্রস্থান করলেন। ‘শ্রীকৃষ্ণ পরম ব্রহ্ম’–এই বাক্য নারদের মুখে শুনে যুধিষ্ঠির পরম বিস্মিত হলেন। হে পরীক্ষিৎ, তোমার নিকট দাক্ষায়ণীদের (দক্ষকন্যাদের) পৃথক পৃথক্ বংশের কথা বর্ণনা করলাম। ঐ বংশে দেবতা, অসুর, মনুষ্য প্রভৃতি এবং সম্পূর্ণ চরাচর জগৎ সৃষ্ট হয়েছে।