০২. দেবরাজের অহঙ্কারের ফল
দুর্বাসা ঋষি ভীষণ রাগী। যখন তখন যাকে তাকে অভিশাপ দিয়ে বসতেন। তাই সকলেই তাকে সমীহ করে চলত। রাগে অন্ধ হয়ে একদিন ঋষি দুর্বাসা চলছেন এক বনের মধ্যে দিয়ে। চলতে চলতে হঠাৎই ফুলের সুগন্ধ এল নাকে। গন্ধ অনুসরণ করে এগিয়ে চললেন তিনি, দেখতে পেলেন এক বিদ্যাধরীর হাতে একটি সুন্দর ফুলের মালা। সেই মালা থেকেই এত গন্ধ বেরিয়ে আসছে। ঋষির খুব লোভ হল মালাটির ওপর। বললেন–তিনি–এই মালাটি খুব সুন্দর আর গন্ধে চারদিক আমোদিত। তাই এটি নিতে ইচ্ছা করছে। যদি কোন অসুবিধা না থাকে, তাহলে আমাকে মালাটি দাও।
ঋষির কথায় বিদ্যাধরী মহা সমস্যায় পড়লেন। এখন তিনি কি করবেন? এই ঋষি এত রাগী, না দিলে আবার শাপ দিয়ে দেবেন। অথচ এমন সখের জিনিস দিয়ে দিতে ইচ্ছা নেই, এখন না দিলেও নয়। তাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও প্রণাম জানিয়ে মালাটি দিয়ে দিলেন তিনি।
মহর্ষি দুর্বাসা মনের আনন্দে মালাটি নিয়ে চললেন। মালাটি গলায় পরে দেখলেন বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। তারপর ভাবলেন, না, আমি একজন ঋষি, ঋষির গলায় মানায় না এ মালা। তখন তিনি মালাটি খুলে মাথার ওপর জটায় ছড়িয়ে নিলেন। তারপর আবার নিজের পথ ধরলেন।
পথে যেতে যেতে দেখলেন, দেবরাজ ইন্দ্র আসছেন ঐরাবতে চড়ে। দেবরাজ কাছাকাছি আসতেই দুর্বাসা তাঁর জটা থেকে মালাটি খুলে নিয়ে ইন্দ্রের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। দেবরাজ সেই মালাটি হাতে ধরে নিয়ে ঐরাবতের গুঁড়ে জড়িয়ে দিলেন। পশুজাতি সুন্দর গন্ধযুক্ত অপরূপ মালার কদর করবে কেমন করে? ঐরাবত মালাটি ফেলে দিল মাটিতে। তারপর পা দিয়ে চলে গেল।
ইন্দ্র ও তার হাতীর এমন ব্যবহার দেখে দুর্বাসা রেগে গেলেন। এত বড় স্পর্ধা যে আমার দেওয়া মালাকে সম্মান না জানিয়ে ফেলে দিল হাতীর শুড়ে। আর সেই ঐরাবত কিনা তা মাটিতে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে চলে গেল। স্বর্গের রাজা হয়ে এত অহংকার ইন্দ্রের? আমি শাপ দিচ্ছি– তোর সর্বনাশ হবে। লক্ষ্মীহীন হবি তুই। আমাকে সাধারণ ব্রাহ্মণ ভেব না ইন্দ্র। আমি হলাম দুর্বাসা। ত্রিভুবনে সবাই আমাকে সম্মান দেখায়। আর তুমি কিনা আমাকে অসম্মান করলে।
দুর্বাসার অভিশাপ–বাণী শুনে ইন্দ্র যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। হাতীর পিঠ থেকে অবতরণ করে, ভূতলে মুনির পায়ে পড়ে বললেন–হে মহর্ষে, আমি মহা অপরাধ করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন।
দুর্বাসা বললেন–না, না, আমার কাছে কোনো ক্ষমা হবে না। আমাকে অসম্মান করে ক্ষমা চাইলেও পার পাবে না।
বিপদে পড়লেন ইন্দ্র। ঋষির বাক্য অব্যর্থ। সামান্য একটা ভুলের জন্য তাঁকে হতে হবে লক্ষ্মীহীন। লক্ষ্মীই তো সব। এতদিন স্বর্গে লক্ষ্মী অচঞ্চলা হয়ে ছিলেন। এবার তিনি ইন্দ্রকে ছেড়ে চলে যাবেন। এখন ঋষির শাপে ফলভোগ করতে হবে। তবু ভাবলেন, তাকে শান্ত করে যদি ফল ভোগটা কমান। যায়।
তাই হাতজোড় করে নতজানু হয়ে কাতর কণ্ঠে বললেন–হে ঋষিবর, এবারের মত আমাকে মার্জনা করুন, এমন ভুল আমি আর কখনও করব না। এই আমি আপনার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছি।
এভাবে কাতর কণ্ঠে ইন্দ্র বললেও দুর্বাসা মুনির ক্রোধ কিন্তু এক বিন্দুও কমল না বরং আরও বেড়ে গেল। তিনি বললেন– এ তোমার ভুল নয়, এতো স্বর্গে সিংহাসন পাওয়ার অহংকার। অহংকারী লোকের কাছে লক্ষ্মী থাকবে কেমন করে? কোনো মার্জনা পাবে না আমার কাছে।
তখন দেবরাজ ভাবলেন এই রাগী মুনির রাগ দমন করা সম্ভব নয়, বেশি জোর করলে আরও বিপদ বাড়বে। তাই কথা না বাড়িয়ে দুঃখিত মনে ফিরে গেলেন স্বর্গে। স্বর্গ এখন লক্ষীহীন। স্বর্গের সব সৌন্দর্য ঐশ্বর্য নষ্ট হয়েছে। মণি মানিক্য খচিত প্রাসাদগুলিও শ্রীহীন হয়েছে, নন্দন-কাননে আর সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটে না। সব যেন ঝরে পড়ে যাচ্ছে। প্রাসাদগুলো যেন প্রেতের বাড়ি, সকল দেবতারা শ্রীহীন, মনে কারও আনন্দ নেই। শুধু স্বর্গে নয়, পৃথিবীতেও তার প্রভাব পড়েছে। অসৎ পথে লিপ্ত হয়েছে মানুষজন। পরস্পর পরস্পরের প্রতি কত ভালোবাসা ছিল, তা যেন একদম উঠে গেছে। সবাই যেন হিংস্র হয়ে উঠেছে।
এতে অপূর্ব সুযোগ এল অসুরদের। স্বর্গে এখন আর লক্ষ্মী নেই। দেবতাদের আর শক্তি নেই। এমন সুযোগের সদ্ব্যবহার করাই উচিত। অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে দানবরা স্বর্গ আক্রমণ করতে চলল। না, যুদ্ধ হল না, দেবতারা বুঝতেই পারছেন এ যুদ্ধে তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, কাজেই অযথা বলক্ষয় করে কি লাভ? তাই পালিয়ে বাঁচলেন।
কিন্তু দেবতারা যাবেন কোথায়? অগ্নিকে সঙ্গে নিয়ে দেবতারা চললেন ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মার সঙ্গে দেখা করতে, সেখানে গিয়ে ব্রহ্মাকে সব কথা বললেন।
ব্ৰহ্ম সব কথা শুনে বললেন– মুনির অভিশাপ খণ্ডন করার সাধ্য কারও নেই, তবে লক্ষ্মীকে আবার পেতে হলে এ বিষয়ে স্বয়ং বিষ্ণুর পরামর্শ নেওয়া ভাল।
এই সব কথা বলে ব্রহ্মা সকল দেবতাকে নিয়ে চললেন ক্ষীরোদ সাগরে, যেখানে বিষ্ণু অনন্ত শয্যায় শুয়ে আছেন। সেখানে উপস্থিত হয়ে তারা শ্রীবিষ্ণুর বহু স্তব-স্তুতি করলেন, তাতে নিদ্রা ভেঙে গেল নারায়ণের। শুকনো মুখে কেন দেবতাগণ, কি বিপদ উপস্থিত হয়েছে, সবিস্তারে আমাকে বলুন।
তিনি বললেন–শ্রীবিষ্ণুকে আদ্যপ্রান্ত সকল কথাই বললেন– লক্ষ্মীছাড়া হয়েছি আমরা সবাই, কি ভাবে স্বর্গে লক্ষ্মীকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারব, বলুন।
বিষ্ণু বললেন– লক্ষ্মীকে লাভ করতে হলে বহু কষ্ট করতে হবে। দেবগণ, কেবল আপনাদের শক্তিতে তা সম্ভব হবে না। অসুরদেরও সাহায্য নিতে হবে। আপনারা এখন বলহীন, এই ক্ষীরোদ সাগর মন্থন করতে হবে। কাজেই আপনারা এখন অসুরদের কাছে গিয়ে অমৃতের লোভ দেখিয়ে তাদের রাজি করান সাগর মন্থন করতে। মন্দারগিরিকে দণ্ড করে নাগরাজ বাসুকিকে মন্থন দড়ি করে সমুদ্র মন্থন করতে হবে। সাগর মন্থন করার পর অমৃতসমা লক্ষ্মীদেবী সাগর থেকে উত্থিত হবেন। এই কাজে আমিও সাহায্য করব। তারপর দেবতারা অসুরদের সাহায্যে সমুদ্র মন্থন করে অমৃত সহ লক্ষ্মী লাভ করে পুনরায় স্বর্গরাজ্য অধিকার করলেন।