শিবের অঙ্গে ভস্মলেপনের কারণ
কৈলাসে বসে হর-পার্বতী কথাবার্তা বলছেন। নানা কথা বলতে বলতে পার্বতী একসময় শিবকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে নাথ, তুমি অঙ্গে ছাই মাখো কেন?
মহাদেব বললেন–হে দেবী, এ বিষয়ে একটি কাহিনি বলব, তুমি শোন। ভৃগুবংশে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন–নাম বিদ্যা, একবার তিনি ঘোরতর তপস্যা করলেন। শীতে জলের মধ্যে বসে, গ্রীষ্মকালে চারপাশে আগুন জ্বেলে, বর্ষায় বৃষ্টিতে ভিজে তপস্যা করলেন। প্রথম প্রথম অল্পমাত্র একবারই খেতেন। তারপর শুধু গাছের পাতা খেয়ে থাকতেন। তারপর বায়ু খেয়ে ঘোর তপস্যা করলেন।
তারপর হে দেবী, শোন এক আশ্চর্য ঘটনা। তাঁর আশ্রমে যত জন্তু-জানোয়ার ছিল যেমন ভাল্লুক, শৃগাল, সিংহ, বাঘ, হাতি প্রভৃতি সকলেই হিংসা ছেড়ে কেবলমাত্র ঘাস খেতে আরম্ভ করল। আরও আশ্চর্য ঘটনা–তারা বন থেকে ফলমূল এনে সেই ব্রাহ্মণকে দিত। যেন তাঁর চাকরের মতোই কাজ করছে তারা। মাংশাসী জন্তুরা তৃণভোজী হয়ে গেল। তাঁর তপের প্রভাবে। তারা যত ফলমূল এনে দিত, ব্রাহ্মণ তার সামান্য মাত্র নিয়ে বাকি সব তাদেরকেই বিলিয়ে দিত।
প্রথমদিকে সেই ব্রাহ্মণ ফলমূল আহার করত। তারপর কেবল পর্ণ খেয়েই থাকত, সেজন্য তার নাম হল পর্ণাদ। ক্রমে ক্রমে তাও ছেড়ে দিয়ে কেবল বায়ুই আহার করত। এইভাবে তপস্যা করছে সে, সবসময়ই আমার চিন্তা হয়। আমার রূপ সে তার হৃদয়েমাঝে চিন্তা করে। ক্রমে ক্রমে আত্মা পবিত্র হল, তার দেহ থেকে এক জ্যোতি বের হতে লাগল। জ্বলতে লাগল ত্রিভুবন। আমি বর দিতে গেলাম সন্তুষ্ট হয়ে।
যোগবলে ব্রাহ্মণের তখন একেবারে শুকনো শরীর। আমাকে দেখেই লুটিয়ে পড়ে চেতনা হারাল সে। আমার স্পর্শে চেতনা ফিরে পেল। তার তপস্যায় ধন পেয়ে আনন্দে স্তব করল আমার।
তখন আমি তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বললাম, হে ব্রাহ্মণ, আমি তোমার স্তবে খুশি, বহু কষ্টে তপস্যা করলে, এখন বল কি চাই?
তারপর সেই বিপ্র ধীরে ধীরে উত্তর করল–হে দেব, আপনার যখন দেখা পেলাম, তাই আমার আর কোন চিন্তা নেই। কেবল একটাই মিনতি আমার, যেন অন্তিমে আপনার পাদপদ্মে ঠাঁই পাই। পুনরায় আর যেন ভবডোরে বন্দি না হই।
ব্রাহ্মণের এমন প্রার্থনা শুনে আমি বললাম, অতীব পবিত্র বর তুমি প্রার্থনা করলে, অবশ্যই তা পূর্ণ হবে। এখন নিজের ঘরে যাও।
এই কথা বলে আমি অদৃশ্য হয়ে গেলাম। তখন সেই ব্রাহ্মণ কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না, তারপর মনে মনে ভাবলো–ত্রিভুবনে আমার কীর্তি স্থাপন করব। তখন সে যোগাসনে বসে আবার তপস্যা শুরু করল।
তারপর হঠাৎ যোগের তেজ বের হয়ে তার সমস্ত দেহ পুড়িয়ে দিল। তখন তার অন্তরাত্মা আমার চরণে প্রবেশ করল। তার দেহ ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ার পর তার থেকে অপূর্ব ভস্ম বের হল। সেই ভস্ম দেহে মেখে আমার খুব আনন্দ হল, সেই ভস্ম আমি হাতে করে নিলাম। সেই ভস্মের স্পর্শ আমার সর্বাঙ্গে মেখে নিলাম।
ভক্তের দেহের ভস্ম মেখে, আমার দেহের শোভা অপূর্ব হয়ে গেল।
হে দেবী, তারপর সে এক অপূর্ব ঘটনা। সেই বিপ্র যোগবলে দেহকে ভস্ম করার পর দিব্য দেহ ধরে আমার সামনে উপস্থিত। আমার চরণতলে প্রণাম জানিয়ে বহু স্তব স্তুতি করল। তখন আমি আমার রূপ দেখালাম।
তারপর আমি বললাম, ওহে বিপ্র, আমি তোমার স্তবে তুষ্ট। তুমি গণশ্রেষ্ঠ হয়ে নিত্যকাল আমার আমাতেই থাকবে। হে দেবী, আমার বরে সেই সাধু গণধীপ হয়ে কৈলাসে বাস করছে পরম আনন্দে।
দেবী, আমি যে কারণে ভক্তের সুগন্ধ ভস্ম অঙ্গে মাখি, তার কারণ তোমায় বললাম। প্রয়াগে পুষ্করাদি তীর্থে সেই ফললাভ হয়, ভস্মস্থানেও সেই ফল। গায়ে ভস্ম মেখে তপস্যা করলে সহজেই সিদ্ধিলাভ হয়। রাক্ষস পিশাচাদির থেকে ভয়ে দূরে যায়। যার গায়ে ভস্ম থাকে যম তার কাছে যেতে পারে না।