এক বণিক ও প্রেতের কাহিনি
এক বণিক ছিল। সে বয়সে যুবক ছিল। তার মা ও স্ত্রী ছিল। বাণিজ্য করে তার বাবা বহু সম্পদ করেছিল। একদিন কয়েকজন চোর এসে সব চুরি করে নিয়ে যায়। সেই থেকে তারা খুব গরীব হয়ে পড়ে। এখন সংসারের হাল ধরল তার ছেলে। তিনজনের সংসার। কেমন করে চলবে? সে ঠিক করলো বাণিজ্যে যাবে। ঘরে যে থালা বাসন ছিল সেগুলোকে সে বিক্রি করে দেয়। এছাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও ধার নেয়। এইভাবে কিছু জিনিস কিনে সে অন্য দেশে গেল বাণিজ্য করবার জন্য।
বনের মধ্যে দিয়ে একা একা যাচ্ছিল সে। সহসা এক প্ৰেত এসে দাঁড়াল তার সামনে। বিকট তার চেহারা, শরীরে মাংস নেই। চোখ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। দাঁতগুলো বেশ উঁচু। তাকে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠল সেই বণিক। সে থরথর করে কাঁপছে, ছুটে পালাতেও সে পারছে না।
প্রেত বলল–আমি তোকে খাব, আমার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।
যুবকটি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে–দোহাই, তুমি আমাকে খেয়ো না। ঘরে আমার মা বউ আছে। তাদেরকে বহুদিন কষ্টে রেখেছি। আমাদের সবকিছু চোর চুরি করে নিয়েছে। সামান্য কিছু জোগাড় করে বাণিজ্যে বেরিয়েছি। আমি যদি ফিরে না যাই, তাহলে আমার মা আর স্ত্রী দুজনেই মারা যাবে। আমাকে তুমি ছেড়ে দাও।
প্রেত বলল–খাবার যখন পেয়েছি তখন তা আমি ছাড়ব না। আমি ক্ষিদের জ্বালা সহ্য করতে পারছি না।
তারপরে প্রেতের কি মনে হল, সে যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করল–তোমার বাড়ি কোথায়?
বণিক যুবকটি ভয়ে ভয়ে বলল–আমি মথুরা থেকে আসছি।
মথুরার কথা শুনে প্রেত যুবকটিকে বলল–তুমি যদি আমার একটা কাজ করে দিতে পার, তাহলে তোমাকে আমি ছেড়ে দেবো।
যুবক সাহস করে বলল–বল কি কাজ?
প্রেত বলল–মথুরায় চাতুঃসামু দিক নামে একটা কূপ আছে। তুমি সেখানে গিয়ে যদি আমার নামে পিণ্ড দাও, তাহলে আমি এই প্রেতযোনি থেকে উদ্ধার পাব। তুমি যদি আমার কাছে কথা দাও, তুমি যদি এই কাজ কর, তাহলে আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো।
প্রেতের কথা শুনে বণিক যুবকের মনে সাহসের সঞ্চার হল। সে বলল–তা আমি করতে পারব। তবে সেই কাজ করতে গেলে অনেক অর্থ লাগবে, অত অর্থ আমার নেই, আমি বড়ই গরীব।
প্রেত বলল–তোমার অনেক অর্থ আছে, তুমি আমার শ্রাদ্ধ দিতে পারবে। এমনকি তোমার সংসারও চালাতে পারবে। তোমার সুখে দিন চলে যাবে, তোমাকে আর বাণিজ্য করতে যেতে হবে না।
প্রেতের কথা শুনে যুবক অবাক হল। যে দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করতে পারে না, প্রেত বলে কিনা অগাধ অর্থ আছে।
প্রেত যুবকের ভাবভঙ্গি দেখে বলল–আমি জানি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছ না। তোমার ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি কলসী ভর্তি সোনা আছে। তাড়াতাড়ি ফিরে যাও, মাটি খুঁড়লেই সেই কলসী পাবে।
প্রেতের কথা শুনে যুবকটি খুব আনন্দিত হলো। মনে মনে ভাবল প্রেতের কথা যেন সত্যি হয়। তারপর প্রেতকে বলল–আচ্ছা তুমি পূর্বজন্মে কে ছিলে? কি কারণে তোমাকে প্রেত হতে হলো? যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমাকে বলতে পার।
প্রেত বলল–আমার প্রতিষ্ঠানগরে বাড়ি ছিল। আমার পেশা ছিল বাণিজ্য করা। প্রচুর ধন সম্পদ ছিল। আমি ভীষণ কৃপণ ছিলাম। নিজের বাড়ির লোক ছাড়া অন্য কারোর জন্য একটা পয়সা খরচ করতাম না। গরীব-দুঃখীদের সামান্য ভিক্ষাও দিতাম না। ভিখারীদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতাম।
সেই পাপের জন্য আমার এই প্রেজন্ম। কত ক্ষুধার্তকে তাড়িয়ে দিয়েছি তখন, আর এখন ক্ষুধার জ্বালায় ঘুরে ঘুরে মরছি। তবে দু-একটা পুণ্য কাজও করেছি। যার ফলে তোমাদের মত দু-একজনকে মাঝে মাঝে পাই। যুবকটি বলল–তুমি কি পুণ্য কাজ করেছিলে?
প্রেত বলল–আমার দু-একজন বন্ধু ছিল। একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে এসে উপস্থিত হলাম এক বিষ্ণু মন্দিরে। তখন সেখানে বসে এক ব্রাহ্মণ পুরাণ পাঠ করছিল। অনেকেই শুনছিল সেই পাঠ। বন্ধুও সেখানে বসে গেল পাঠ শুনতে। অগত্যা আমি কি করি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসে পড়লাম।
তখন পাঠক ব্রাহ্মণ বললেন–মথুরায় চাতুঃসামুদ্রিক কূপ একটি তীর্থক্ষেত্র সেখানে কারও উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করা হলে তার পিশাচত্ব নাশ হয়।
তারপর পুরাণ পাঠ শেষ হলো। সকলে ব্রাহ্মণকে প্রণাম করে চলে গেল। আমার বন্ধুও প্রণামী হিসাবে কিছু অর্থ দিল। কিন্তু আমি কিছু দিলাম না, অপব্যয় ভেবে।
তখন বন্ধুটি আমায় বলল–পুরাণ পাঠ শোনার পর পাঠককে কিছু দিয়ে প্রণাম করতে হয়। না হলে পাপ হয়।
বন্ধুটি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হবে ভেবে অনিচ্ছায় সামান্য অর্থ দিলাম। আমার বিশ্বাস অবহেলা করে সেই অর্থ দিলেও তার জন্যই আমি মাঝে মাঝে খাবার পাই।
প্রেত নিজের কাহিনি বলার পরে, যুবককে বলল–তুমি বাড়ি ফিরে যাও। তোমার কাছে যে অর্থ আছে, তাকে খরচ করলেও সেই অর্থ কোনদিন শেষ হবে না। আমার নিবেদন তুমি মথুরায় গিয়ে আমাকে উদ্ধার কর।
যুবকটি প্রেতের কথা বিশ্বাস করে নিজের ঘরে ফিরে গেল। একটা শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে। সে কাউকে কিছু বললো না। তার স্ত্রী তাকে মাটি খুঁড়তে দেখে ভাবল–সে বুঝি পাগল হয়ে গিয়েছে। তারা অনেক নিষেধ করল। বলল কেন এভাবে ঘরের মেঝেটা নষ্ট করছ।
বণিক কোনো কথা না বলে মাটি খুঁড়তে থাকল। অবশেষে সে দেখতে পেল একটা কলসী পোঁতা আছে সেখানে। সে বহু যত্নে তুলল সেটাকে। কলসীর মুখের ঢাকনা খুলে দেখেই অবাক হল সকলে। মোহরে সেটা ভর্তি ছিল। তারপরে যুবকটি সব কথা তার মা ও স্ত্রীকে বলল, আর মহা ধূমধামে প্রেতের শ্রাদ্ধ দিল।