ভাগবত পুরাণ – ০৫ম স্কন্ধ

ভাগবত পুরাণ – পঞ্চম স্কন্ধ
প্রথম অধ্যায়
জ্ঞানী প্রিয়ব্রতের রাজ্য পালন ও জ্ঞাননিষ্ঠা

মহারাজ পরীক্ষিৎ বললেন– হে মহামুনি, রাজা প্রিয়ব্রত বরণ ভগবৎ ভক্ত ও আত্মনিষ্ঠ ছিলেন।

সেই মহাজ্ঞানী জনের গৃহে আসক্তির কারণ কি? জীবের কর্মবন্ধন ও আত্মার স্বরূপ– জ্ঞান আবরণের মূল কারণই হল গ্রহ।

হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, গৃহাশ্রমে রতি ও সে বিষয়ে অভিনিবেশ দ্বারাই সম্ভব হয়। প্রিয়ব্রতের মতো মুক্তসঙ্গ ভগবৎগণের তো কখনও গৃহে অভিনিবেশ হতে পারে না।

মহৎ ব্যক্তিগণের চিত্ত উত্তম- শ্লোক ভগবানের চরণ যুগলের ছায়াতেই আবৃত থাকে। এর ফলে যেরকম পুরুষদের পুত্র কলত্রাদির প্রতি স্পৃহাযুক্ত মতি হবার সম্ভাবনা দেখতে পাই না।

হে ব্রাহ্মণ, স্ত্রী, পুত্র ও গৃহ প্রভৃতিতে আসক্ত হয়েও রাজা প্রিয়ব্রত সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। কিন্তু গৃহাসক্ত ব্যক্তির পক্ষে কিভাবে সিদ্ধিলাভ এবং ভগবানে অচলা ভক্তি সম্ভব, যে বিষয়ে আমার মনে সংশয়ের উদ্রেক হয়েছে।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে মহারাজ, ভগবদভক্ত মহাপুরুষদের চিত্ত কখনও গৃহ সংসারে অভিনিবেশিত হয় না, এটা তুমি ঠিকই বলেছ।

যেহেতু যাঁদের চিত্ত উত্তম শ্লোক ভগবানের শ্রীচরণপাদ পদ্মদ্বয়ের মধুরসে একবার আসক্ত হয়েছে, তারা ভাগবত পরমহংস ভিন্ন অপর কাউকে জানতে আগ্রহী হয় না।

ভগবান বাসুদেবের কথাতেই নিজের পরম মঙ্গলময় পথ মনে করে, এ পথ পরিত্যাগ করে না, সে পথে যত বাধা বিঘ্ন আসুক না কেন এ পথে তারা সর্বদাই একনিষ্ঠ থাকে।

হে মহারাজ, পরম ভাগবত রাজপুত্র প্রিয়ব্রত দেবর্ষি নারদের চরণসেবা করেছিলেন বলে অনায়াসে পরমার্থতত্ত্ব জ্ঞানলাভ করেছিলেন। এরপরে, তিনি যখন আধ্যাত্ম চিন্তায় নিজেকে নিযুক্ত করবেন বলে স্থির করলেন, তখন তাঁর পিতা মনু তাকে নিষেধ করলেন।

মনু, নিজ গুণবলে প্রিয়ব্রতকে ধরাধামে পালনের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু পিতৃআজ্ঞা প্রত্যাখ্যানের অযোগ্য হলেও, প্রিয়ব্রত প্রথমে তা অস্বীকার করেছিলেন।

কারণ, প্রথম থেকেই তার ইন্দ্রিয়াদির সমস্ত ক্রিয়াকলাপ নিরন্তর সমাধিযোগ দ্বারা পরম ভগবান বাসুদেবের চরণে সমর্পিত ছিল।

এই অবস্থায় রাজপদ গ্রহণ করলে মিথ্যা রাজ্য প্রপঞ্চ থেকে আত্মার পরভেব অর্থাৎ নিত্য-সত্য পরমার্থ থেকে বিচ্যুতি ঘটবে, তখন এটাই তাঁর মনে হয়েছিল। তারপরে আদিদেব ভগবান ব্রহ্মা, ত্রিগুণময় সৃষ্টির পরিবর্ধনের বিষয়ে নিরন্তর বিবেচনা করতে লাগলেন।

নিখিল বিশ্বের প্রাণীকুলের অভিপ্রায় বুঝতে পেরে, মূর্তিমান অখিল বেদ ও মরীচি প্রমুখ নিজ জনে পরিবেষ্টিত হয়ে নিজভবন সত্যলোক থেকে ভূতলে অবতীর্ণ হলেন। অবতরণের সময় স্থানে স্থানে চন্দ্রের ন্যায় তার জ্যোতি প্রকাশিত হতে লাগল।

পথিমধ্যে বিমানচারী ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ তার পূজা করতে লাগলেন। এই অবস্থায় জগদ্গুরু ব্রহ্মা স্বীয় দ্যুতিদ্বারা গন্ধমাদন পর্বতের গুহা উদ্ভাসিত করে, প্রিয়ব্রতের কাছে এসে উপস্থিত হলেন।

দেবর্ষি নারদ নিজ পিতা ভগবান ব্রহ্মাকে দেখে ভক্তিচিত্তে উত্থিত হলেন।

তিনি তৎক্ষণাৎ পূজার বিবিধ উপকরণ নিয়ে মনু ও প্রিয়ব্রতের সঙ্গে কৃতাঞ্জালিপুটে তাঁর স্তব করতে লাগলেন। নারদের কাছ থেকে যথা বিধি পূজা-উপহার প্রদত্ত হয়ে, অত্যন্ত প্রীত হলেন।

সবার দ্বারা মিষ্ট বাক্যে স্তুত হয়ে সাহয্যে অবলোকনে প্রিয়ব্রততে এরকম বলেছিলেন।

ব্রহ্মা স্নেহভরে বললেন–হে তাত, আমার বাক্য শ্রবণ কর। সত্যস্বরূপ অপ্রমেয় পরমেশ্বরের প্রতি দোষারোপ করে দর্শন করা উচিত হয় না।

শংকর, তোমার পিতা মনু, দেবর্ষি নারদ এবং আমি আমরা সকলেই বিবশ হয়ে তাঁর আজ্ঞা পালন করে থাকি।

প্রবৃত্তিমার্গের উপদেশ করলে, প্রিয়ব্রত তার প্রতি অসূয়া প্রকাশ করতে পারে, এই আশঙ্কায় ব্রহ্মা নিজ কথাকে ভগবান শ্রীহরির আদেশরূপে প্রকাশ করে, উপদেশে প্রবৃত্ত হলেন।

এই পৃথিবীর কোনও দেহধারী জীবই তপস্যা, বিদ্যা, যোগ, বুদ্ধি, অর্থ, ধর্মের সাহায্যে ভগবান কৃত কার্যের বিনাশ করতে পারে না। স্বয়ং যা বলবান, তা অপরের আশ্রয় গ্রহণ করেও কোনো রূপেই সেই পরম দেবতা শ্রীবিষ্ণুর কৃতকার্যের বিনাশ করতে পারে সমর্থ হয় না।

জীবগণ জন্ম মৃত্যু, শোক, মোহ, ভয়, দুঃখ, সুখ–এই সব কিছুর জন্য কর্ম করতে সবসময়ই সেই অব্যক্ত পরম দেবতার বিধানুরূপ জন্মগ্রহণ করছে, তার অন্যথা করার ক্ষমতা কারও নেই।

হে বৎস, চতুষ্পদ গবাদি পশুরা রঞ্জু দ্বারা নাসিকায় আবদ্ধ হয়ে, মানুষের অভিপ্রেত কার্যে নিযুক্ত হয়। আমরাও সকলে তেমনি পরমেশ্বরের বাক্যরূপ রঞ্জুতে সত্ত্বাদি গুণপূর্বক কর্ম ও বিবিধ

বন্ধন দ্বারা আবদ্ধ হয়ে তাকেই পূজা করতে থাকি।

বদ্ধ বলীবদের ন্যায় আমরাও পরতন্ত্র। পরমেশ্বরের ইচ্ছায় তার জন্যই কর্মে নিবেদিত।

হে বৎস, ভোগ বিষয়ে কারও কোনও স্বাতন্ত্র নেই। যেমন চক্ষুষ্মন ব্যক্তিগণ নিজেদের ইচ্ছামতে অন্ধ ব্যক্তিগণকে ছায়া অথবা রৌদ্রযুক্ত স্থানে নিয়ে যায়। আমরাও তেমনি পরমেশ্বরের ইচ্ছায় পশু পক্ষী ইত্যাদি যে-কোনও দেহ যযাজিত করতে বাধ্য হই। সেই অনুসারে আমাদের সুখ ও দুঃখ ভোগ হয়ে থাকে।

এতে ঈশ্বরের কোনো বৈষম্য নেই, কারণ আমাদের গুণ ও কর্মের সম্বন্ধ অনুসারে তিনি তা প্রদান করেন। পশু-পক্ষীরা প্রভুদত্ত কনিশ বা শষ্যকণা ভক্ষণ করতে বাধ্য হয়। তাদের স্ব-ইচ্ছায় কিছুই সম্ভব নয়। আমরাও তেমনি ঈশ্বর প্রদত্ত সুখ-দুঃখ ভোগ করতে বাধ্য হই, আমাদের নিজের ইচ্ছায় কিছুই হয় না।

মানুষ নিদ্রাভঙ্গের পর অভিমানশূন্য হয়ে স্বপ্নে অনুভূত বস্তুগণের ওপর অনুভব করে।

জীবন্মুক্ত পুরুষেরাও তেমনি অভিমানশূন্য হয়ে প্রারব্ধ কর্মের ফলভোগ করার দেহ-ধারণ অর্থাৎ পুনর্জন্ম গ্রহণের উপযোগী গুণ বা বাসনা সমূহের অনুগত হন না।

ইন্দ্রিয় জয় করতে যে ব্যক্তি সক্ষম নয়, সে যদি গৃহে স্ত্রী-পুত্রাদির সঙ্গ ভয়ে সংসার ত্যাগ করে বনে গমন করে, তাহলে সেখানেও তার নিস্তার নেই। কারণ সেখানেও মন এবং চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই ছটি রিপু তার সঙ্গেই থাকে।

কিন্তু যে ব্যক্তি জ্ঞানী, ও জিতেন্দ্রিয় গৃহাশ্রম তার কোনো ক্ষতিই করতে পারে না। যে ব্যক্তি ছটি রিপু জয় করতে ইচ্ছুক, তার উচিত প্রথমে গৃহাশ্রমে অবস্থান করে ইন্দ্রিয় জয়ের চেষ্টা করা উচিত।

কারণ দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেই বুদ্ধিমান লোক শত্রুকে জয় করার চেষ্টা করে থাকে। শত্ৰুকূল দুর্বল হলে, পরে ইচ্ছানুসারে সর্বত্র বিচরণ করে থাকে।

হে রাজনন্দন, সাধারণ লোকের পক্ষেই এই গৃহ– দুর্গাশ্রয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু, তুমি তো আগেই ভগবান পদ্মনাভের চরণপদ্ম আশ্রয় করে পূর্বোক্ত ছটি শত্রুকে পরাজিত করেছ।

তুমি এখন ধরাধামে অবস্থান করে ঈশ্বরদত্ত ভোগ্যবস্তু ভোগ কর। পরে মুক্তসঙ্গ হয়ে নিরন্তর আত্মনিষ্ট হবে।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– ভগবান ব্রহ্মা এরূপ বললে, মহাভাগবত প্রিয়ব্রত নিজেকে ক্ষুদ্ৰজ্ঞান করে ত্রিলোকগুরু ব্রহ্মার আদেশ নতমস্তকে শিরোধার্য করলেন। এরপরে মনু সন্তুষ্টমনে ব্রহ্মার পুজো করলেন। ব্রহ্মার তৎকালীন বাক্যে প্রিয়ব্রতর যোগহানি হল।

নারদের শিষ্যবিয়োগ হলেও তিনি পিতা ব্রহ্মাকে কিছু বললেন–না, কিন্তু ব্রহ্মা প্রিয়ব্রতকে নিবৃত্তিমার্গ থেকে প্রবৃত্তিমার্গে প্রবর্তিত করে নিজ ব্যবহারেই বিষণ্ণ হলেন।

এই অবস্থায় তিনি বাক্যের অগোচর মনের কিঞ্চিত বিষয়ীভূত, ব্যবহারমার্গের অতীত এবং স্ব ব্রহ্মাত্মক স্বরূপের ধ্যান করতে করতে সেখান থেকে অন্তর্হিত হলেন। তারপরে, মনুও ব্রহ্মার কার্যে নিজ অভিষ্ট সাধিত হলে অত্যন্ত প্রীত হলেন।

দেবর্ষি নারদের অনুমতি নিয়ে পুত্র প্রিয়ব্রতকে অখিল ভূমণ্ডলের স্থিতি ও প্রতিপালনের জন্য রাজপদে অধিষ্ঠিত করলেন। এরপরে মনু দুস্তর বিষয়– বিষাক্ত স্বরূপ ভব সংসারের ভোগবাসনা থেকে উপরত হলেন।

যে ভগবান আদিপুরুষের অনুভব নিখিল বিশ্বের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব হয়, সেই ভগবানের চরণাশ্রিত হওয়ায় প্রিয়ব্রত ছিলেন শুদ্ধিচিত্ত। তবুও ব্রহ্মার আদেশ পালনার্থে তিনি মহীতল শাসন করতে প্রবৃত্ত হলেন। হে মহারাজ, প্রিয়ব্রত নিবৃত্তিমার্গের পথিক হলেও শ্রীভগবানের ইচ্ছায় আবার তার কর্মধীকার প্রাপ্তি হল।

এর কিছুদিন পরে প্রিয়ব্রত বিশ্বকর্মার কন্যা বহিষ্মতীর পাণিগ্রহণ করলেন। নিজতুল্য শীল গুণ, কর্ম, রূপ ও বীর্য সম্পন্ন উদার মনোভাবাপন্ন দশ পুত্রের জন্ম হল।

প্রিয়ব্রতের একটি মাত্র কন্যা ছিল। সে অতি সুন্দরী। তার নাম ঊর্জস্বতী, অগ্নির নামেই প্রিয়ব্রতের দশ পুত্রের নামকরণ হয়েছিল। যেমন আগ্নীপ্র, হস্মৃজিত্ব, যজ্ঞবাহ, মহাবীর, হিরণ্যরেতাঃ, ঘৃতপৃষ্ঠ, সবন, মেধাতিথি, বীতহোত্র এবং কবি।

এই দশপুত্রের মধ্যে কবি, মহাবীর ও সবন– এই তিনজন ঊর্ধরেতাঃ ছিলেন। তারা বাল্যকাল থেকেই আত্মবিদ্যা অভ্যাস করে পরমহংস আশ্রমে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন।

সন্ন্যাসাশ্রমেই তারা তিনজন উপশম শীল ও পরম ঋষি হয়ে ভগবান বাসুদেবের চরণে মনস্থিত করলেন। শ্রীভগবান অখিল জীবের আবাসস্থল ও ভবভীতজনের রক্ষাকর্তা।

সেই ভগবান বাসুদেবের চরণকমলে হৃদয়স্থাপন করে, অবিচলিত পরম ভক্তিভরে নিজ নিজ অন্তঃকরণ শুদ্ধ ও পবিত্র করলেন। এর ফলে তাদের হৃদয়মধ্যে সর্বভূতাত্মা ভগবানের অধিষ্ঠান হল।

মহারাজ প্রিয়ব্রতের অপর ভার্যার গর্ভে উত্তম, তামস ও রৈবত নামক তিনটি পুত্রের জন্ম হয়। তারা মন্থরাধিপতি রূপে পরিচিত হয়েছিলেন।

প্রিয়ব্রতের তিনপুত্র নিবৃত্তিমার্গের আশ্রয় নিলেও তিনি একাদশ অর্বুদ বছর পৃথিবীতে রাজত্ব করেছিলেন। তার বাহুদ্বয় ছিল মহাবলশালী, টঙ্কার ধ্বনিতেই ধর্মদ্বেষীরা নিরস্ত হত।

নিরন্তর ভার্য্যা বহিষ্মতীর ক্রমবর্ধমান প্রমোদ লাস্য, লজ্জা সঙ্কুচিত সহাসাৎ অঙ্গভঙ্গী কটাক্ষে প্রিয়ব্রতর বিবেক যেন পরাভূত হয়েছিল। এই রকম বিষয়াসক্তিতে তিনি যেন নিজেকে ভুলেই গিয়েছিলেন।

ভগবান সুর্যদেব সুমেরু পর্বত পরিক্রমাকালে ভূমণ্ডলের অর্ধাংশ আলোকিত হয়েছিল। এতে অসন্তুষ্ট হলেন প্রিয়ব্রত। তিনি ভগবানের উপাসনা বলে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।

প্রিয়ব্রত স্থির করলেন যে রাতকে দিন করবেন। এই সঙ্কল্প করে, প্রিয়ব্রত নিজ জ্যোতির্ময় রথে আরোহণ করে প্রচণ্ড বেগে পরিভ্রমণ করতে শুরু করেন।

প্রিয়ব্রতর রথ ছিল সূর্যের রথের মতো অতি বেগবান। প্রিয়ব্রত রথে আরোহণ পূর্বক সূর্যের পশ্চাতে ভ্রমণ করতে শুরু করলেন। তিনি দ্বিতীয় সূর্যের মতো প্রতিভাত হয়েছিলেন। তখন ব্রহ্মা তার কাছে এসে বললেন– বৎস নিবৃত্ত হও! এই অধিকার তোমার নেই।

প্রিয়ব্রত পৃথিবী পরিভ্রমণের সময়ে রথচক্রের অগ্রভাগ দ্বারা যে সাতটি ঘাতে নির্মিত হয় ঐ সাতটি ঘাতই সপ্ত-সাগর রূপে প্রসিদ্ধ হয়েছে।

এই সাত সমুদ্র দ্বারাই পৃথক পৃথক ভাবে পৃথিবীর সাতটি সমুদ্র দ্বীপ রচিত হয়েছে তাদের নাম– জন্ধু, প্লক্ষ, শাল্মলী, কুশ, ক্রৌঞ্চ, শাক ও পুস্কর।

সমুদ্র সকলের বহির্ভাগে এক একটি দ্বীপ অবস্থিত আবার ঐ দ্বীপকে বেষ্টন করে বাইরে এক একটি সমুদ্র অর্থাৎ লবণজল, ইক্ষুরসজল, সুরাজল, ঘৃতজল, দধিজল, দুগ্ধজল এবং শুদ্ধজল –এই সপ্তসমুদ্র, ঐ সপ্ত দ্বীপের পরিখার মতো হয়ে রয়েছে।

ঐ সমস্ত সাগরে বেষ্টিত যে দ্বীপসকল রয়েছে, তাদের মোট পরিমাণ, তাদের তুল্য পূর্ব সাগরের পরিমাণের সমান।

ঐ সাগর সকল ভিন্ন ভিন্ন রূপে বহির্ভাগেই ব্যাপ্ত রয়েছে, অভ্যন্তরে নেই। মহারাজ প্রিয়ব্রত নিজ অনুগত আগ্নিধ, হস্মজিত্ব, যজ্ঞবাহু, হিরণ্যরেতাঃ, ঘৃতপৃষ্ঠ, মেধাতিথি ও বীতয়েত্র নামক সাতপুত্রের এক একজনকে এক একটি দ্বীপের রাজা করে দিয়েছিলেন।

তিনি উজস্বতী নাম্নী নিজ কন্যাকে দৈত্যাচার্য শুক্রের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন। তাঁর গর্ভে শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর জন্ম হয়েছিল।

হে মহারাজ, ভগবানের পাদপদ্ম রেণুর সংস্পর্শে যাদের ইন্দ্রিয়জ সিদ্ধ হয়েছে, সেই ভাগবত সিদ্ধ পুরুষদের এরূপ পুরুষকারে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ, কোনো অন্ত্যজ ব্যক্তিও যদি মাত্র একবার ভগবানের নাম উচ্চারণ করে তাহলে সে তৎক্ষণাৎ সংসার বন্ধনের থেকে মুক্তিলাভ করে।

বন্ধুর মঞ্জিল মহারাজ প্রিয়ব্রত জগতে এরূপ অতুলনীয় বল ও পরাক্রমের অধিকারী ছিলেন।

বেশ কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পরে আত্মাকে যেন নিরানন্দ মনে করতে লাগলেন। তিনি একদিন ভাবতে লাগলেন– বিবেকবান পুরুষ হয়েও এ কী অন্যায় কার্য করে চলেছি, ইন্দ্রিয়াদি সমূহ আমাকে অবিদ্যাময় এই বিষয়রূপ অন্ধকূপে নিক্ষেপ করেছে। আমার এই বিষয় ভোগে আমার আর প্রবৃত্তি নেই। হায় হায়! আমি এই বণিতার ক্রীড়ামৃগ হয়েছি, ধিক্ আমাকে, এভাবে প্রিয়ব্রত আত্মনিন্দায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

হে রাজন, পরমপুরুষ ভগবান শ্রীহরির অনুগ্রহে প্রিয়ব্রতর বিবেক উপস্থিত হল। তিনি অনুগত পুত্রদের মধ্যে বিষয় ভাগ করে দিয়ে, মহর্ষি নারদ প্রদর্শিত পথেই গমন করলেন। সেই সময় তিনি সাম্রাজ্যলক্ষ্মী ও নিজ পত্নীকেও মৃত শরীরের মতো ত্যাগ করে এলেন।

সে সময়ে মহারাজ প্রিয়ব্রতের হৃদয়ে নির্বেদ ও ভগবান হরির চিন্তা উদিত হয়েছিল। এই চিন্তাবলে যে বিশেষ প্রভাব এসেছিল তার ফলে প্রিয়ব্রত সহজেই ভার্য্যা ও সম্পত্তি ত্যাগ করতে পেরেছিলেন।

তার মহিমা বর্ণনাকারী কিছু শ্লোক বহুদিন থেকে প্রসিদ্ধ আছে যেগুলি হল– প্রিয়ব্রত যে কর্ম করে গেলেন, তা ঈশ্বর ব্যতীত কোনো ব্যক্তি করতে সমর্থ হবে না।

তিনি পৃথিবীর অন্ধকার দূরীকরণের জন্য সূর্যের পশ্চাতে ভ্রমণের সময়, রথের চাকার সাহায্যে সাত-সমুদ্রের উৎপত্তি হয়।

তিনি বিভাগক্রমে দ্বীপ রচনা করলেন।

তিনি প্রাণীগণের অধিকার বিষয়ে বিবাদ ভঞ্জনের নিমিত্ত নদী, পর্বত ও অরণ্যানীর দ্বারা প্রতিটি দ্বীপের সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।

তিনি পাতালজাত, অমর্ত, মর্তলোকস্থ সকল বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করতেন।

যোগবলে ও কর্মবলে অর্জিত সকল বৈভবকে তিনি নরকতুল্য বলে মনে করতেন। শুধুমাত্র ভগবদ্ভক্তগণই তার প্রিয়পাত্র ছিলেন।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়
আগ্নীধ্র চরিত্র বর্ণন

শ্রী শুকদেব বললেন– হে রাজন, প্রিয়ব্রত যখন জ্যেষ্ঠ পুত্র আগ্নীকে রাজ্যের দায়িত্বভার অর্পণ করে প্ৰবজ্যা গমন করলেন, তখন আগ্নীব্র সেই দায়িত্ব পালনে প্রবৃত্ত হলেন। যথাবিধি ধর্মবিচার করে তিনি জম্বুদ্বীপবাসী প্রজাদের নিজ পুত্রের ন্যায় প্রতিপালন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন।

কিয়ৎকাল রাজ্যশাসনের পর নিজ পুত্র কামনায় মন্দার পর্বতে গমন করলেন।

সেই মন্দার পর্বতে দেবরমণীরা ক্রীড়া– বিলাসে রত থাকতেন। তিনি সেখানে গিয়ে বিভিন্ন পুষ্প ও আরও বহুবিধ পূজাপকরণের সাহায্যে বিশ্বস্রষ্টা প্রজাপতি অধিপতি স্বয়ং ব্রহ্মার আরাধনায় নিমগ্ন হলেন।

আদিপুরুষ ভগবান ব্রহ্মা আগ্নীদ্রের তপস্যার কারণ অবগত হলেন। তখন তিনি স্বীয় সভার গায়িকা অপ্সরা “পূর্বচিত্তি” কে আগ্নীরে উপভোগাৰ্থে প্রেরণ করলেন।

ভগবান ব্রহ্মার নির্দেশানুসারে পূর্বচিত্তি আগ্নীর্ধের মনোরম উপবনে এসে ইতস্ততঃ বিচরণ করতে লাগলেন।

মন্দার পর্বত সংলগ্ন অঞ্চল আগ্নীর্ধের উপবন ছিল অতি রমণীয়। সেখানে নিবিড় সংবদ্ধ বৃক্ষজালে শোভিত ছিল। সেখানে উপবিষ্ট স্থলে ময়ুরাদি ও বিভিন্ন পক্ষীরা সুমধুর স্বরে গান করছিল।

কলকাকলিতে পরিবেশ মুখরিত হয়েছিল। পদ্মে পরিপূর্ণ নির্মল সরোবরগুলিকে প্রাণময় বলে মনে হচ্ছিল।

ঐ অপ্সরা পূর্বচিত্তি সেই মনোরম স্থানে সলাস্যে পদচারণ করছিলেন। তার পায়ের নূপুরের ধ্বনি শ্রবণ করে আগ্নীর্ধের সমাধিযোগ ভঙ্গ হল। তিনি নয়নদ্বয় ঈষৎ উন্মীলিত করে ধ্বনি অনুসরণ করে দৃষ্টিপাত করলেন।

সেই সময় ঐ অপ্সরা রাজা আগ্নীদ্রের কাছেই বিচরণ করছিলেন। তিনি ভ্রমরীর মতো ফুলের গন্ধ উপভোগ করতে করতে মনোরম বাক্যাবলী ও লাস্যময় বিভঙ্গে সর্বান্তকরণে কামদেবের উপযুক্ত প্রবেশদ্বার নির্মাণ করছিলেন।

তার মুখনিঃসৃত বাক্য যেন মদিরার মত মাদকতাময় অমৃতমধুর বলে শ্রুতিমধুর হয়েছিল। তাঁর সুগন্ধি নিঃশ্বাসে আকৃষ্ট হয়ে ভ্রমর তার মুখের চারপাশে বিচরণ করছিল। আর তাদের ভয়ে ভীত হয়ে যখন পূর্বচিত্তি দ্রুত পদচালনা করছিলেন তখন তার স্তনযুগল, কেশবন্ধন এবং নিতম্ব চন্দ্রহার সুন্দর ভাবে কম্পিত হচ্ছিল।

সেই অবস্থায় আগ্নী তাকে দর্শন করলেন। কামদেব সেই সুযোগে রাজার অন্তরে প্রবেশ করলেন। রাজা কামাভিভূত হয়ে পড়লেন। তিনি তখন ঐ সুন্দরীকে বশীভূত করার অভিপ্রায়ে জড়তাগ্রস্ত অচেতন ব্যক্তির মতো কখনও পুরুষ কখনও বা স্ত্রী বলে সম্বোধন করতে লাগলেন।

হে মুনিবর তুমি কে? এই পর্বতস্থ উপবনে তুমি কেন বিহার করছ? তুমি কি মায়া, পূর্বচিত্তির ভুযুগল দর্শন করে আগ্নীব্র তাকে বললেন– হে সখে, জ্যাহীন এই দুটি ধনু তুমি কেন ধারণ করেছ? তা কি নিজের কোন কাজের জন্য অথবা এই বনমধ্যে মৃগতুল্য অজিতেন্দ্রিয় আমাদের মতো পুরুষদের বশীভূত করার জন্য?

অপ্সরা অপরূপ দুটি নেত্রকে আগ্নীপ্র বাণের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন– হে সখে, এই দুটি নেত্রবাণের অগ্রভাগ অতি তীক্ষ্ণ আর এর পশ্চাৎভাগ অতি সুন্দর ও বিলাস মন্থর। এই দুটি বাণ তুমি কার প্রতি নিক্ষেপ করতে চাও?

তবে তোমার এই বিক্রম আমাদের মতো ভীত, জড়বুদ্ধি ব্যক্তিদের মঙ্গলের জন্য নিয়োজিত হোক!

অপ্সরা পূর্বচিত্তির দেহসৌরভে আকৃষ্ট ভ্রমরাদি আগ্নীর্ধের হৃদয়ে বিহ্বলতা সঞ্চারিত করে তিনি বলছেন– হে ঈশ! তোমার এই শিষ্যরা তোমার চারিদিকে বেষ্টন করে সরহস্য সামবেদ পাঠ ও গান করছে নাকি? তোমার শিখা থেকে এই যে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে, ঐ সকল ভ্রমরাদি বেদসেবনের মতো ঐ কুসুম সেবা করছে।

অতঃপর আগ্নীব্র ঐ সুন্দরীর নূপুরের ধ্বনি শ্রবণ করে বললেন– হে ব্রাহ্মণ। তোমার চরণ পিঞ্জরে আবদ্ধ পক্ষীকূলের শব্দ শুনলেও তাদের তো দেখতে পাচ্ছি না।

ঐ অপ্সরা পূর্বচিত্তির পরিধেয় বসন ছিল পীতবর্ণ। রাজা তাকে মনে করলেন সুন্দর নিতম্বদেশের উজ্জ্বল কান্তি। মেখলার দিকে তাকিয়ে বললেন– জ্বলন্ত অঙ্গারের রেখাযুক্ত ওটা কি? পরে বস্ত্র লক্ষ্য করতে না পেরে প্রশ্ন করলেন– –তোমার পরিধানের বল্কল কোথায় গেল?

অপ্সরা পূর্বচিত্তির উন্নত স্তনদ্বয় দেখে রাজা আগ্নীব্র লোলুপ দৃষ্টিতে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়লেন তিনি প্রশ্ন করলেন– হে দ্বিজ, তোমার ঐ মনোহর শৃঙ্গদ্বয়ের মধ্যে কি এমন মধুময় বস্তু পরিপূর্ণ আছে? কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি, মধ্যভাগে কৃশা হয়ে অতি কষ্টে তুমি তা বহন করে চলেছ।

তারপরে স্তনযুগলের উপর কুমকুমের প্রলেপ দেখে প্রশ্ন করলেন- হে সুভদ্রে, তোমার শৃঙ্গ যুগলে এই অরুণবর্ণ লেপন কিভাবে এল? হে সুহৃত্তম, তোমার বাসস্থান কোথায়? আমাকে একবার দেখাও, সেখানকার বাসিন্দাদের বক্ষস্থলে ধৃত এরূপ দুটি আশ্চর্য অবয়ব দেখে আমার মতো লোকের মন অতিশয় বিহ্বল হয়।

হে সখে, তোমার দেহধারণের জন্য প্রয়োজনীয় আহার কি? তুমি যে দ্রব্যবিশেষ চর্বণ করছ, সেখান থেকে সঞ্জীয় ঘৃতের মতো সৌরভ নির্গত হচ্ছে। আমার দৃঢ় ধারণা, তুমি নিশ্চয়ই বিষ্ণুর অংশ, কারণ তোমার কর্ণকুন্তল বিষ্ণুর ন্যায় মকরাকৃতি!

নিমেষাহত দুটি প্রশান্ত নয়ন, তোমার নির্মল মুখমণ্ডলে শোভিত হচ্ছে। তোমার চঞ্চল অক্ষিদ্বয়, হংসশ্রেণীর মতো দন্তপংক্তি ও কালো ভ্রমরের মতো কুঞ্চিত কেশকলাপ, আমার হৃদয়কে চঞ্চল করেছে।

তুমি স্বীয় করকমল দিয়ে যে পাদুকাটি চালনা করছ, তা চতুর্দিক পরিভ্রমণ করে আমার দু’নয়নকেও চঞ্চল করে তুলছে। তোমার কুঞ্চিত কেশরাশি বন্ধনমুক্ত! ধূর্ত লম্পট বায়ু তোমার কটিবন্ধন হরণ করেছে, তুমি কি এটাও অনুভব করতে পারছ না।

হে তপস্বী, কোন্ কঠিন তপস্যাবলে তুমি তপোবিঘ্নকারী রূপ ধারণ করেছ?

হে মিত্র! তুমি অনুগ্রহ করে আমার এখানে তপস্যা কর। অথবা সৃষ্টি– বিস্তারকারী ভগবান ব্রাহ্মণ আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে তোমাকে এখানে প্রেরণ করেছেন। আমি তোমাকে কখনই পরিত্যাগ করব না।

আমার হৃদয় শুধুমাত্র তোমাতে সংলগ্ন হয়ে আর নিবৃত্ত হচ্ছে না। হে সুস্তনী! তোমার মন যেদিকে যায়, আমাকেও সেদিকে নিয়ে চল। তোমার সখীগণও অনুকূল হয়ে আমাকে অনুসরণ করুক।

শ্রী শুকদেব বললেন– হে রাজ, রাজা আগ্নী দেবতুল্য বুদ্ধির ছিলেন। ললনাগণের অনুনয় সম্বন্ধেও তার বিলক্ষণ নৈপূণ্য ছিল। এইরকম প্রেম– বিদগ্ধ আলাপচারিতার মাধ্যমে অপ্সরা পূর্বচিত্তির মনে সন্তোষ উৎপাদন করতে লাগলেন।

বীরগণের অধিনায়ক এ জম্বুদ্বীপের অধীশ্বর মহারাজ আগ্নীর্ধের বিদ্যা, বুদ্ধি, বয়স, রূপ, ঔদার্য, প্রভৃতি চরিত্রগুণের লক্ষণ দেখে পূর্বচিত্তিও তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন। তখন তিনি বহু অযুত বৎসর পরিমিত কাল তার সাথে দিব্য ও ভৌম ভোগে আকৃষ্ট হয়ে রইলেন।

কালক্রমে তার গর্ভে–নাভি, কিংপুরুষ, হরিবৰ্ষ, ইলাবৃত, রম্যক, হিরন্ময়, কুরু, ভদ্রাশ্ব এবং কেতুমাল নামে পুত্রদের জন্ম হল। এইভাবে পূর্বচিত্তি প্রতি বছর একটি করে পুত্র প্রসব করলেন। এভাবে নটি পুত্র প্রসবের পর তাদের গৃহে রেখে, নিজে ব্ৰহ্মার সভায় গমন করলেন, সেখানে তিনি সঙ্গীত সাধনায় প্রবৃত্ত হয়ে ব্রহ্মার তপস্যা করতে লাগলেন।

মহীয়সী মাতার অনুগ্রহে আগ্নীর্ধের পুত্রগণ দৃঢ়াঙ্গ এবং বলশালী হয়ে ছিলেন। যথাকালে পিতা পৃথিবী ভাগ করে দিলেন। তখন আগ্নীর্ধের এই নয়জন পুত্র নিজ নিজ নামানুসারে বিভক্ত জম্বুদ্বীপের নটি বর্ষে রাজত্ব করেছিলেন।

রাজা আগ্নীব্র বিষয়াদি ভোগ করেও পরিতৃপ্ত হতে পারেন নি। তিনি নিরন্তর সেই অপ্সরা পূর্বচিত্তির কথা স্মরণ করতেন। তাকেই সর্বোত্তম মনে করে, তার কথা ভাবতেন। যথাকালে বেদোক্ত কর্মপ্রক্রিয়ার দ্বারা তার দেহাবসান হল। দেহান্তে তিনি অপ্সরাগণের লোকেই গমন করলেন।

অপ্সরা লোক হল সেই লোক যেখানে পিতৃগণ সর্বদা আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। পিতা আগ্নীর্ধের পরলোকগমনের পরে, তাঁর নয় পুত্র রাজ্যভার গ্রহণ করলেন। এরপর তারা মেরুর নয় কন্যার পাণিগ্রহণ করলেন।

নাভির পত্নী হলেন মেরুদেবী, কিংপুরুষের ভার্য্যা হলেন প্রতিরূপা, হরিবর্ষের সঙ্গে উগ্রদংষ্ট্ৰী, ইলাবৃতের সঙ্গে লতা ও রম্যকের সঙ্গে রম্যার বিবাহ হল। মেরুকন্যা শ্যামার পতি হলেন হিরন্ময়। কুরুর ভার্য্যা হলেন নারী। মেরু তনয়া ভদ্রাকে পত্নীরূপে বরণ করলেন ভদ্রাশ্ব। কেতুমালের স্ত্রী হলেন দেবদীধিতি বা দেববীতি।

.

তৃতীয় অধ্যায়
নাভির চরিত্র বর্ণনা এবং তার পুত্ররূপে ভগবানের অবতরণ

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে মহারাজ, আগ্নীব্র পুত্র নাভি ও মেরুদেবী ছিলেন নিঃসন্তান। অপত্য কামনায় তারা একাগ্রমনে যজ্ঞপুরুষ শ্ৰী ভগবান বিষ্ণুর উপাসনায় রত হলেন।

নাভি বিশুদ্ধ চিত্তে শ্রদ্ধাসহকারে যজ্ঞকর্মে রত ছিলেন। সে সময়ে প্রবর্গ নামক ক্রিয়াদির অনুষ্ঠান চলছিল। তখন ভগবান বিষ্ণু স্বয়ং শোভনরূপ ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।

দ্রব্য, দেশ, কাল, মন্ত্র, ঋত্ত্বিক, দক্ষিণা, বিধি- এই সাত প্রকার উপায়েও দর্শন করা দুষ্পপ্য বিষয়, তিনি ভাগবতজনের প্রতি করুণাপরবশ হয়ে সেখানে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

হে রাজন, ভগবানের স্বরূপে আত্মপ্রকাশের তাৎপর্য এই যে, তিনি ভক্তজনের একান্ত পরতন্ত্র।

ভক্তগণের অভিপ্রেত বিষয় তিনি সম্পন্ন করে দেবেন, এই বাসনাতেই ভগবানের চিত্ত আকৃষ্ট হয়েছিল। নাভির সামনে তিনি নয়নসুখকর, মনোহর সুন্দর মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করলেন।

নিঃসহায়, হতদরিদ্র ব্যক্তিগণ উত্তম ধন লাভ করলে তার বহু সমাদর করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে তেমনি ঋত্বিক সদস্য এবং যজ্ঞে দীক্ষিত। গ্রহপতি রাজ্য লাভ প্রত্যেকেই সেই পুরুষোত্তমের প্রতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে প্রণিপাত করলেন।

চতুর্ভুজ তেজোময় সেই পুরুষকে বহু সমাদরে বিবিধ অর্ঘ্য সহকারে পূজার্চনা করলেন, তার পরিধানে কপিশবর্ণ কৌশেয় বস্ত্র বক্ষঃস্থলে শ্রীবৎস চিহ্ন বিরাজমান ছিল।

তিনি শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, বনামাল্য, কৌস্তুভ মণিতে শোভিত ছিলেন। তার মুকুট ছিল বহু তেজস্কর মাণিকে সজ্জিত। কুণ্ডল, কটক, কটিসূত্র, হার, কেয়ূর নূপুর প্রভৃতি সুন্দর অলংকার তিনি বিভূষিত ছিলেন।

ঋত্ত্বিকগণ বললেন– হে পূজ্যতম, আমরা তোমার ভৃত্য। তুমি স্বয়ং পূর্ণ। তবু আমাদের পূজা স্বীকার করতে যোগ্য হও! হে প্রভু, তোমাকে স্তব করার সাধ্য আমাদের নেই। তোমার স্বরূপ অতি দুজ্ঞেয়।

সাধুগণের কাছ থেকে আমরা শুধুমাত্র নমঃ, নমঃ– এই মন্ত্র উচ্চারণের শিক্ষালাভ করেছি। যার বুদ্ধি প্রকৃতিজাত এই প্রপঞ্চকের মধ্যে সীমাবদ্ধ, এরকম কোনও অসমর্থ ব্যক্তির পক্ষে, তার পরিচিত প্রকৃত প্রপঞ্চের নাম, রূপ ও আকৃতি দ্বারা প্রকৃতি ও পুরুষের অতীত পরমেশ্বরের স্বরূপ নির্ধারণে সমান হতে পারে না।

বস্তুত, তোমার যে সকল গুণ জনগণের অয়ঃ, কলুষ বিনাশকারী, তার একদেশের কথন ছাড়া সংসারাসক্ত চিত্ত ব্যক্তিগণ বেশি কিছুই বর্ণনা করতে পারে না।

হে পরম, তবুও ভক্তমণ্ডলীর কণ্ঠে জয়ধ্বনি শুনেই তুমি তৃপ্ত হও। সামান্য জল, পুষ্প– পল্লব, তুলসী, দুৰ্ব্বা ও সবান্ধুর প্রভৃতি উপাচারে পুজোর অনুষ্ঠান করলেই তুমি সন্তুষ্ট হও। বিবিধ অঙ্গযুক্ত আমাদের কৃত যজ্ঞ দ্বারা তোমার কোনও প্রয়োজন সিদ্ধ হয় না!

নিরন্তর সাক্ষাত্তাবে নিজ হতেই অনুগতরূপে যে সকল পুরুষার্থ সমাধিভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, তাদের সমষ্টিই তোমার স্বরূপ। তুমি স্বরূপতঃ, সর্বপ্রকার পুরুষার্থবলে, যজ্ঞাদি দ্বারা তোমার কোনও প্রয়োজন সাধনের অপেক্ষা করে না।

হে প্রভু, অজ্ঞ ব্যক্তিগণ নিজেদের শ্রেয়ঃ জানতে পারে না, দয়াবশত হয়ে তাদের তোমার মহিমারূপ মোক্ষপদ ও অন্যান্য কাঙ্খিত বস্তু দানার্থে এখানে তোমার আগমন হয়েছে।

কোনও যাগ– যজ্ঞ বা পূজায় অপেক্ষা তুমি করো না। সেজন্য বস্তুতঃ তুমি অপূজ্য। শুধুমাত্র সাধনের দৃষ্টিতে তোমাকে সাপেক্ষ দৃষ্টিতে অর্থাৎ পূজনীয় বা পূজা প্রার্থীর মতো দেখা যাচ্ছে।

হে পূজ্যতম, বর প্রদানকারীদের মধ্যে তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ। সেই তুমি যে রাজর্ষি নাভির যজ্ঞে স্বরূপ ধারণ ফেরতঃ আমাদের মতো ভক্তগণের দৃষ্টিগোচর হয়েছ, এটাই আমাদের কাছে বর-স্বরূপ।

হে প্রভু, তোমার দর্শন অতি দুর্লভ। যে সকল আত্মাবাম মুনিগণের বৈরাগ্য তীক্ষিনকৃত জ্ঞানের আগুনে অশেষ বার দগ্ধ হয়েছে, তাঁদের পক্ষেও শুধুমাত্র তোমার গুণকথন অতি কল্যাণকর।

সেজন্য তারা অনবরত তোমার গুণকীর্তন ও স্তব করে থাকেন। হে ভগবান, তোমার দর্শনলাভে আমরা ধন্য হয়েছি, কৃতার্থ হয়েছি, তবুও তোমার কাছে একটি বর প্রার্থনা করি।

হে ভগবান, পথিমধ্যে গমনকালে অজানা কোনো স্থান থেকে পতন, অথবা কোনও সঙ্কটজনক অবস্থায় এমনকি জুরাদি বা মৃত্যুদশাতেও তোমার নাম যেন আমাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়। স্মরণে অক্ষম হলেও সকল পাপনাশক তোমার পূর্ব-বিধৃত নামাবলী সততঃ যেন আমাদের ঘিরে থাকে।

দরিদ্র ব্যক্তিগণ অতি তুচ্ছ তুষকণার জন্যও ধনী লোকের দ্বারস্থ হয়। রাজর্ষি নাভি তেমনি তোমার তুল্য একটি পুত্র আকাঙ্ক্ষায় তোমার শরণাগত হয়েছে। তুমি ইহজগতের সমস্ত কাঙ্খিত বস্তুর অধীশ্বর।

হে প্রভু! মহাজনদের চরণসেবা ভিন্ন এ সংসারে পরাজিত হয়। তোমার পরাজিতা মায়ার গতিবিধি কেউই নির্ধারণ করতে পারে না। অতএব সকল ব্যক্তির মতি ও প্রকৃতি মায়া এবং বিষয় বিষে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

হে বহুকার্যকারি, আমরা তোমাকে অতি ক্ষুদ্র কার্যের জন্য আহ্বান করেছি। আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আমরা পুত্রকেই পরম পুরুষার্থ বোধ করেছি। হে দেব, আমাদের এই অবহেলন তুমি ক্ষমা কর। তুমি তো সর্বত্র সমদর্শী, সমবুদ্ধি, তাই আমার এই নির্যাতি করছি।

শ্রী শুকদেব বললেন– ভারতবর্ষের অধিপতি মহারাজ নাভি কর্তৃক বন্দিত ঋষিগণ এভাবে ভগবানকে গদগদ বাক্যে স্তুতি করলেন। ভগবান ঐ ঋষিদের স্তবে তুষ্ট হয়ে বলেছিলেন– হে ঋষিগণ! তোমাদের প্রার্থিত বর অতি দুর্লভ!

কারণ তোমরা রাজর্ষি নাভির আমার সদৃশ পুত্রলাভ হোক এই কথা বলেছ। আমিই আমার সদৃশ, আমার তুল্য দ্বিতীয় কেউ নেই। কিন্তু তবুও, তোমরা ব্রাহ্মণ, তোমাদের প্রার্থিত বর না প্রদান করলে, তোমাদের বাক্য মিথ্যা হয়ে যাবে। কিন্তু তা হতে পারে না। যেহেতু ব্রাহ্মণই আমার মুখস্বরূপ। অতএব আত্মতুল্য কাউকে এখন দেখছি না বলে আমি স্বয়ং মহারাজ নাভির মধ্যে অংশত অবতীর্ণ হব।

শ্ৰীশুকদেব বললেন– ভগবান মেরুদেবীর শ্রুতিগোচরে মহারাজ নাভিকে এরকম বলে অন্তর্হিত হলেন। হে বিষ্ণুদত্ত মহারাজ, পরীক্ষিৎ ঐ যজ্ঞে মহিষীগণের দ্বারা প্রসাদিত ভগবান, নাভির প্রিয় সাধনার্থে তপস্বী জ্ঞানীও নৈষ্ঠিক ব্রহ্মর্থেরত দিগবসন সাধুগণের ধর্ম শিক্ষাদানের কামনায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। নাভির অন্তঃপুরে তিনি মেরুদেবীর গর্ভে বিশুদ্ধ– সত্ত্ব মূর্তি ধারণ পূর্বক ঋষরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

.

চতুর্থ অধ্যায়
ঋষভদেবের অলৌকিক চরিত্র বর্ণনা

শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে রাজ, জন্মলগ্ন থেকেই নাভির ঐ পুত্রের পায়ের তলদেশে ভগবৎ– লক্ষণ প্রকাশিত হতে লাগল।

দিনে দিনে সমদর্শিতা উপশম, বৈরাগ্য ঐশ্বর্য, মহৈশ্বর্যসহ তার প্রভাব বৃদ্ধি পেতে লাগল।

এইরূপ মঙ্গল লক্ষণ দর্শন করে অমাত্য, ব্রাহ্মণ ও প্রজাদের মনে মনে এই বাসনার জন্ম হল– ইনিই যেন রাজা হয়ে এই ধরণীতল শাসন করেন।

কালক্রমে তিনি কবিগণের পদ্য-দ্বারা প্রশংসনীয় উত্তম শরীর, তেজ, শ্রী, কীর্তি, প্রভৃতি গুণের অধিকারী হলেন।

পিতা নাভি পুত্রের মধ্যে এতদ্ভিন্ন গুণের সমাহার দেখে তার নাম রাখলেন “ঋষভ”। একবার দেবরাজ ইন্দ্র স্পর্ধিত অহংকারে তার রাজ্যে বৃষ্টিপাত ঘটালেন না। যোগেশ্বর ভগবান ঋষভ তা

বুঝতে পেরে, স্মিত হাস্যে তার প্রতিবিধান করতে উদ্যত হলেন।

তিনি যোগমায়া বিস্তার করে নিজ রাজ্য অজনাভ বর্ষে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ছিলেন। পুরাণপুরুষ ভগবান স্বেচ্ছায় মনুষ্যদেহ ধারণ করলে, মহারাজ নাভি ইঙ্গিত সুপুত্র লাভ করে অতি আনন্দিত হলেন।

তিনি অতিশয় আবেগে আনন্দে নিজ পুত্রকে অনুরাগ ভরে গদগদ বাক্যে “হে বৎস, হে তাত”– এই বলে সম্বোধন করতে লাগলেন। মহারাজ নাভি এইভাবে পুত্রের লালন পালন করে পরমানন্দ বোধ করতেন।

মহারাজ নাভি, পুরবাসী ও অন্যান্য প্রজাদেরই প্রমাণরূপে বিবেচনা করতেন। তিনি যখন জানতে পারলেন, তাঁর পুত্র ঋষভের প্রতি প্রজাগণ অনুরক্ত, তিনি ধর্মমর্যাদা ক্রমে তাকে রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন।

পুত্র ঋষভকে অভিষেকের পর ব্রাহ্মণদের কাছে সমর্পণ করে, নিজ পত্নী মেরুদেবীকে সঙ্গে নিয়ে বদরিকা আশ্রমে গমন করেন।

সেখানে অপরের অনুদেহ- জনক কঠিন তপস্যা ও সমাধিযোগ অবলম্বন করে নর-নারায়ণ নামক ভগবান বাসুদেবের উপাসনা করে যথাসময়ে তাঁর পাদ মহিমাপ্রাপ্ত হলেন। এভাবে তিনি জীবন্মুক্তি লাভ করলেন।

হে পান্ডবেয়, তার সম্বন্ধে মহর্ষিগণ দুটি শ্লোক পাঠ করেন। অসামান্য ব্যক্তি ছিলেন এই রাজা নাভি। তার তুল্য কর্ম পরে আর কোনো পুরুষ করতে পারে নি।

তাঁর শুদ্ধ কর্মে প্রসন্ন হয়ে স্বয়ং ভগবান শ্রীহরি তার পুত্রত্ব স্বীকার করেছিলেন তার মঞ্চে আহুত ব্রাহ্মণাদি দক্ষিণা প্রভৃতিতে সম্মানিত হয়ে যজ্ঞেশ্বর শ্রীহরির দর্শনপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

পিতা নাভির প্রব্রজ্যা গ্রহণের পর ভগবান ঋষভদেব নিজ অজনাভ বর্ষকে কর্মক্ষেত্র জ্ঞান করলেন। অপরকে গুরুকুলবাদের প্রয়োজনীয়তা জানাবার জন্যই নিজে গুরুকুলে বসবাস করতে লাগলেন। পরে, দক্ষিণালব্ধ গুরুগণের আজ্ঞা গ্রহণপূর্বক লোকেদের ধর্মশিক্ষা প্রদান ও শ্রুতিস্মৃতি উভয় প্রকার কর্মের আচরণ করতে লাগলেন।

দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে জয়ন্তী নামক একটি কন্যাদান করেছিলেন। দেবদত্ত সেই ভার্যার গর্ভে

ঋষভদেব আত্মতুল্য গুণবান একশো সন্তানের জন্ম দিলেন।

হে রাজন, ঐ শতপুত্রের মধ্যে ভরত জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন সর্বোত্তম। সেজন্য ঋষভদেবের রাজ্য পরে ভারতবর্ষ বলে পরিচিত হয়।

ঋষভদেবের অন্যান্য সন্তানদের অন্যতম ছিলেন কুশাবর্ত, ইলাবর্ত, ব্রহ্মবর্ত, মলয়, কেতু, ভদ্রসেন, ইন্দ্রক ভরতের অনুগত ছিলেন।

এদের পরবর্তী নয়জন ছিলেন কবি, হবি, অন্তবীক্ষ, প্রবুদ্ধ, পিপ্পলায়ন, আর্বিহোত্র, দ্রবিড়, চমস এবং করভাজন, এরা প্রত্যেকেই ভগবত ধর্মের প্রবর্তক ও মহাভাগবত ছিলেন। তাদের সুচরিত ভগবান মহিমায় সমৃদ্ধ এবং জনগণ তা থেকে বিষয় নিবৃত্তির শিক্ষা লাভ করতে পারে।

বাকি প্রত্যেক সন্তান পিতার আজ্ঞানুবর্তী অতি বিনীত, মহাশ্রোত্রিয়, যজ্ঞানুষ্ঠান অনুসারি, ও কর্মবিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ ছিলেন।

ভগবান ঋষভদেব স্বয়ং সর্বদা অনর্থ, পরম্পরা অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু, ধর্ম-অধর্ম, সুখ-দুঃখাদি থেকে বিমুক্ত ছিলেন। তিনি সর্বদা জ্ঞানানন্দময় স্বতন্দ্র ঈশ্বর –স্বরূপ ছিলেন।

তবুও তিনি স্বীয় আচরণের সাহায্যে অজ্ঞ ব্যক্তিদের শিক্ষার জন্য কর্মসকলের অনুষ্ঠান করতেন। এজন্য তিনি লোক-সমাজকে ধর্ম, অর্থ, যশ, সন্তান ভোগ ও মোক্ষ সংগ্রহ দ্বারা গার্হস্থাশ্রমে নিয়ন্ত্রিত করলেন।

তিনি স্বয়ং সর্বত্র সমদর্শী, সমভাবাপন্ন, উপশমযুক্ত, সর্বজীবে মৈত্রীপরায়ণ ও দয়াবান হয়ে অবস্থান করতেন।

যেহেতু, শ্রেষ্ঠ লোকেরা যে কর্মানুষ্ঠান করেন, অপরাপর লোকেরা তারই অনুসরণ করে থাকে, এজন্য ভগবান ঋষভদেব ঐরূপ কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

ভগবান ঋষভদেব সর্বধর্ম প্রতিপাদক বেদরহস্য স্বয়ং অবগত ছিলেন, তবুও ব্রাহ্মণদের প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করেই সাম-দানাদি উপায়ের মাধ্যমে প্রজাগণকে শাসন করতেন।

তিনি যথাবিধি দেশ, কাল, যৌবন, শ্ৰদ্ধ, ঋত্ত্বিক ও নানা দেবতার উদ্দেশরূপ সামগ্রীর সমাবেশে সুখসমৃদ্ধ সর্ববিধ যজ্ঞদ্বারা একশোবার যজ্ঞেশ্বরের পূজা করেছিলেন।

ভগবান ঋষভদেব এই অজনাভ বর্ষের অধীশ্বর হয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করতে লাগলেন। এখানকার কোনো লোকের অন্যের কাছ থেকে আকাশকুসুম কিছুই প্রার্থনা করতে হয়নি।

প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের প্রাপ্ত বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন। অপরের বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাতও করতেন না। বস্তুতঃ ঋষভদেবের রাজত্বকালে প্রজারা তাদের প্রভুর প্রতি স্নেহাতিশয় ছাড়া কিছুই কামনা করত না।

একসময় ভগবান ঋষভ দেব সমগ্র বিশ্ব পর্যটন করতে করতে ব্রহ্মাবর্ত দেশে এসে উপস্থিত হলেন।

সেখানে উপস্থিত ব্রহ্মর্ষিগণের সভায় প্রবেশ করে দেখলেন নিজ পুত্রেরা সেখানে অধিষ্ঠান করছে। তিনি প্রজাদের অনুশাসনের জন্য বলতে লাগলেন।

.

পঞ্চম অধ্যায়
পুত্রগণের প্রতি ঋষভদেবের জ্ঞানোপদেশ নিজের অবধূত বৃত্তি গ্রহণ

শ্রী ঋষভদেব বলতে লাগলেন– হে পুত্রগণ, এই মনুষ্যলোকে দেহধারী প্রাণীগণের মধ্যে যারা এ মানবজন্ম লাভ করে, তাদের ক্ষুদ্র বিষয়ে আসক্ত হওয়া উচিত নয়।

তুচ্ছ প্রাণী এমনকি বিষ্ঠাভোজী শূকরও একইরকম দুঃখ বিষয়াদি ভোগে প্রবৃত্ত হয়।

হে পুত্রগণ, তপস্যাই একমাত্র উৎকৃষ্ট বস্তু। কারণ তপস্যার ফলে অন্তঃকরণ শুদ্ধ হয় এবং শুদ্ধসত্ত্ব থেকেই অনন্ত ব্রহ্মানন্দ লাভ করা সম্ভব হয়।

মনীষীগণ এবং যোষিগণের সাহচর্যকে সংসারের কারণ বলে থাকেন। যে সকল ব্যক্তি সদাচারী, সর্বত্র সমদর্শী, প্রশান্ত স্বভাবা, ক্রোধহীন, এবং সকল প্রাণীর সুহৃদ তারাই মহান ব্যক্তি বলে পরিচিত হন।

অপর দিকে যে ব্যক্তিগণ নিজেকে ঈশ্বর, নিজমধ্যে প্রীতিজ্ঞান করে পরম পুরুষার্থ বোধে তৃপ্তিলাভ করেন, তারাই মহান।

যারা বিষয়াসক্ত ব্যক্তিদের প্রতি পুত্র-কলত্রাদিতে আকৃষ্ট না হয়ে শুধুমাত্র দেহধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ধনলাভে সন্তুষ্ট হন, তারাই জগতে মহাত্মা বলে পরিচিত হন। মানুষ যখন দুঃখবশত ইন্দ্রিয় সন্তুষ্টির জন্য ব্যাপ্ত, তখন প্রমত্ত হয়ে বিকর্ম বা পাপ কাজে রত হন।

একবার বিরুদ্ধ কর্মের কারণে আত্মার এই ক্লেশাদি দেহের উৎপত্তি হয়েছে, আবার সেই কর্ম করা কখনই উচিত নয়। আমি সেরকম আচরণ অনুচিত বলে মনে করি।

যে পর্যন্ত জীব আত্মতত্ত্বের স্বরূপের জিজ্ঞাসা না করে তাবৎ পর্যন্ত অজ্ঞানকৃত স্বরূপের পারভব হয়ে থাকে। আত্মার প্রকৃত রূপ তার কাছে সর্বদাই থেকে যায়। কারণ যে পর্যন্ত ক্রিয়া থাকে, ততদিন এই মন কর্মস্বভাব রূপে প্রকাশিত হয়।

এই কর্মাত্মক মন জীবের দেহবন্ধের কারণস্বরূপ। অবিদ্যার উপাধি দ্বারা আত্মার বাস্তব স্বরূপ আবৃত হলে, এইরূপ পূর্বকর্ম মনকে বশীভূত করে, কর্মানুষ্ঠানে নিযুক্ত করে।

অতএব যে পর্যন্ত কামদেব-রূপী আমার মধ্যে জীবের প্রীতির জন্ম না হয় ততদিন দেহবন্ধন থেকে তার মুক্তি সম্ভব নয়।

এই বিবেকবুদ্ধির অভাবে যতকাল মানুষ স্বার্থসাধনে অর্থাৎ পরমপুরুষার্থ-রূপ ভগবৎসাধনে অমনোযোগী হয়, ততদিন আত্মস্বরূপ উপলব্ধিতে ব্যর্থ হয়। যে ব্যক্তি ইন্দ্রিয়াদির চেষ্টাকে মিথ্যা বা আত্মসম্বন্ধশূন্য মনে না করে ততদিন সে অজ্ঞের মতো মৈথুন সুখপ্রধান গৃহকে আশ্রয় করে সন্তাপ ভোগ করে।

বিবেকীগণ বলে থাকেন, স্ত্রী ও পুরুষের যে মৈথুনভাব, এটাই তাদের পারস্পরিক হৃদয়ের গ্রন্থি স্বরূপ। স্ত্রী এবং পুরুষের প্রত্যেকের নিজস্ব একটি হৃদয় গ্রন্থি থাকে। তদুপরি স্ত্রী-পুরুষের এই যুগলস্বভাবের জন্য তন্মধ্যে আর একার্য স্থূল ও দুচ্ছেদ্য হৃদয়গ্রন্থি থাকে।

এই মিথুনভাব থেকেই জীবের গ্রহ, ক্ষেত্র, পুত্র, আত্মীয় ও ধন বিষয়ে মোহ জন্মায়।

যখন জীবের কর্ম দ্বারা অনুবদ্ধ দৃঢ়তর মনোরূপ প্রাপ্ত হৃদয়গ্রন্থি শিথিলতাপ্রাপ্ত হয় তখন সে অহংকার পরিত্যাগ-পূর্বক মুক্ত হয়ে পরমপদ লাভ করে।

এবারে অহংকার ত্যাগের পঁচিশটি উপায়ের কথা বলেছেন ভগবান ঋষভদেব। তিনি পুত্রদের উদ্দেশ্যে বলছেন– হে পুত্রগণ, হংসের ন্যায় বিবেকী ও শুদ্ধরূপ এবং গুরুস্বরূপ আমার মতো ভক্তি, একনিষ্ঠতা, ভোগ বিতৃষ্ণা সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্ব সহ্য করার ক্ষমতা, জীব সততঃ দুঃখ ভোগী –এরূপ নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন।

তোমরা সর্বদা তপস্যারত হবে। তোমাদের মনে তত্ত্বজ্ঞানের উন্মেষ ঘটুক। কাম্যকর্মের প্রতি মোহহীন হয়ে সর্বদা আমার প্রতি কর্মানুষ্ঠান, আমার চরিত্রাদি কথনে প্রবৃত্ত হও।

সদা আমার ভক্ত অর্থাৎ ভগবৎ সঙ্গ, আমার গুণকীর্তন করবে। সর্বত্র তোমার সমদৃষ্টি হোক। আত্মদেহ এ গৃহাদিতে “আমি ও আমার”– এই রকম বুদ্ধি পরিত্যাগ কর। নির্জনে অবস্থান পূর্বক প্রাণ ইন্দ্রিয়াদি ও মনের বশীকরণ করে আধ্যাত্মিক শাস্ত্রাভ্যাস করা প্রয়োজন।

উত্তম শ্রদ্ধা, কর্তব্য কর্মের অপরিত্যাগ, বাক-সংযম, সর্বত্র আমার ধ্যান-বিষয়ে নিপুণতা, বিজ্ঞান অর্থাৎ অনুভব-যুক্ত জ্ঞান ও সমাধি–এই সকলের দ্বারা ধৈর্য, যত্ন ও বিবেকবান হয়ে অহংকার ত্যাগ করবে।

এইভাবে অহংকারমুক্ত হয়ে কর্ম সকলের আধাররূপ হৃদয় গ্রন্থি বন্ধন, যা অবিদ্যার দ্বারা উপস্থিত হয়েছিল, প্রমাদশূন্য হয়ে এই সকল উপায়ের দ্বারা যেমন- উপদেশ করলাম, সেভাবে সম্যক করা প্রয়োজন, সর্বশেষে ঐ সকল উপায় থেকে বিরত হবে।

হে পুত্রগণ, আমার লোককামনার্থে, আমার অনুগ্রহরূপ প্রয়োজনের উদ্দেশ্যে পিতা পুত্রকে, গুরু শিষ্যকে ও রাজা প্রজারগর্ভে ঐ শিক্ষাদান করবেন। কিন্তু উপদেশানুসারে কর্ম না করলেও, তাদের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করা উচিত নয়। কিন্তু, সে সকল ব্যক্তি তত্ত্ব সম্পর্কে ভীত নয়, কর্মে মুগ্ধ হয় তাদের যেন পুনর্বার কর্মে নিযুক্ত না করা হয়।

যে ব্যক্তি মূঢ়বুদ্ধি, অন্ধলোককে কাম্য কার্যে নিযুক্ত করে, পরিণামে সংসারকূপে নিক্ষেপ করে, তার কোনো স্বার্থসিদ্ধি হয় না। সাধারণ লোক স্বয়ং পারমর্থিক কল্যাণের পথে অন্ধ বলে, অতিমাত্রায় কামনা পরবশ হয়ে শুধুমাত্র অর্থসংগ্রহের চেষ্টাই করে থাকে।

সে নিজের সুখলাভের জন্য পরস্পরের প্রতি বিবাদে লিপ্ত হয়। সে মূঢ়, পরিণামে সে নিজের দুঃখ হবে তাও জানতে পারে না। অবিদ্যার গহ্বরে অবস্থিত কুবুদ্ধি ব্যক্তিকে দেখে। স্বয়ং অভিজ্ঞ, বিদ্বান, দয়াশীল কোনও ব্যক্তি তাকে পুনরায় প্রবৃত্তিমার্গে নিযুক্ত করতে পারেন না।

বিপথগামী অন্ধলোককে দেখে কোনো দয়ালু বিজ্ঞজন তাকে সে পথে যেতে নির্দেশ করেন না। যিনি সংসারী ব্যক্তিকে ভক্তিমার্গের উপদেশ দানে মুক্ত না করেন তিনি স্বজন হলেও স্বজন নন। সে পিতা, পিতা নয়। সে মাতা, মাতা নয়। সে দেবতাও দেবতা নন।

হে পুত্রগণ, আমার এই মনুষ্যশরীর অপরিত্যক্ত অর্থাৎ আমার ইচ্ছায় অধীন। এই দেহ প্রাকৃত মনুষ্য-তুল্য নয়। আমার এই হৃদয় শুদ্ধ-সত্ত্ব- স্বরূপ, যাতে ধর্ম অধিষ্ঠিত রয়েছে।

যেহেতু, আমি ধর্মকে অনুসরণ করে, অধর্মকে দূরে নিক্ষেপ করি, সেজন্য, অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ আমাকে ‘ঋষভ’ উপাধি দান করেছেন। এই ‘ঋষভ কথাটির অর্থ শ্রেষ্ঠ! তোমরা সকলেই আমার শুদ্ধ সত্ত্বযুক্ত হৃদয় থেকে উৎপন্ন হয়েছে।

মাৎসর্য পরিত্যাগ করে স্থির বুদ্ধি হয়ে তোমাদের সহোদর এই মহোত্তম ভরতের উপাসনা কর। এতেই তোমাদের পিতৃসেবা ও প্রজাপালন সিদ্ধ হবে।

তিনি বললেন– ব্রাহ্মণগণের সেবা অবশ্য কর্তব্য কারণ তারা শ্রেষ্ঠ! হে পুত্রগণ কারণ, চেতন ও অচেতন পদার্থের মধ্যে স্থাবর পদার্থ শ্রেষ্ঠ! তদপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর হল বুদ্ধিসংযুক্ত পশুরা। মানুষগণ তাদের থেকে শ্রেষ্ঠতর। মনুষ্যগণ অপেক্ষা ভূত– প্রেতাদি শ্রেষ্ঠ, তদপেক্ষা গন্ধর্বগণ শ্রেষ্ঠ। সিদ্ধগণ তাদের চেয়েও উন্নত। আবার দেব– অনুচর কিন্নরগণ সিদ্ধদের চেয়ে উন্নত। অসুরগণ তাদের চেয়ে উন্নত, অসুরগণ অপেক্ষা দেবগণ শ্রেষ্ঠ।

দেবতাদের শ্রেষ্ঠ বা রাজা হলেন ইন্দ্র! ইন্দ্রের চেয়ে ব্রহ্মপুত্র দক্ষ প্রভৃতি প্রজাপতিগণ উন্নত। তদপেক্ষা শঙ্কর শ্রেষ্ঠ।

ব্রহ্মা হলেন এই শংকরের উৎপত্তির কারণ। তাই তিনি শংকর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সেই ব্রহ্মা অপেক্ষা আমি উন্নততর। ব্রাহ্মণগণ আমারও পুজ্য বলে আমারও শ্রদ্ধার যোগ্য। তাই তারা সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বপূজ্য। সর্বদা তাদের সেবা করবে।

তারপরে উপস্থিত ব্রাহ্মণদের শ্রদ্ধাসহকারে সম্বোধন করে বললেন– হে দ্বিজগণ, আমি আপনাদের তুল্য, কোনো প্রাণীই দেখছি না। তাই ব্রাহ্মণ অপেক্ষা কেউ শ্রেষ্ঠ নয়।

মানবগণ শ্রদ্ধাসহকারে ব্রাহ্মণের মুখে অন্নাদি আহুতি দান করলে, আমি পরম পরিতৃপ্তিতে সব আহার করি। তার ফলে আমার যে তৃপ্তিলাভ হয় অগ্নিহোত্র যজ্ঞে প্রদত্ত আহুতিও সেভাবে পরিতৃপ্ত হয়ে ভোগ করি না।

যে ব্যক্তিগণ আমার পরম পূজণীয় রমণীয় বেদমূর্তি ধারণ করেছেন, যাদের মধ্যে পরম পবিত্র সত্ত্বগুণ এবং শম (অন্তঃকরণে নিগ্রহ), দাম, সত্য, অনুগ্রহ, তর্প, তিতিক্ষা, অনুভব –এই আটটি গুণ প্রতিষ্ঠিত– তারাই এ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ।

সেই ব্রাহ্মণ তুল্য কারওকে দেখতে পাই না আমি অনন্ত ও পরাৎপর তত্ত্ব এবং স্বর্গ অপবর্গের অধিপতি। আমার কাছেও তারা ভক্তি ভিন্ন অন্য কিছু প্রার্থনা করেন না। আমার প্রতি ভক্তিমান সেই অকিঞ্চন ব্রাহ্মণাদি রাজ্য প্রভৃতি অন্য পদার্থে আকৃষ্ট হন না।

হে পুত্রগণ, তোমরা শুদ্ধদৃষ্টি হয়ে স্থাবর-জঙ্গম সকলের মধ্যে আমার অধিষ্ঠান জেনে প্রতিপদে তাদের সম্মান করবে। সকল প্রাণীকে সম্মান ও সমদৃষ্টিতে দর্শন করাই আমাকে পূজা করার সমতুল। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সকল কর্মের সমর্পণই আমার আরাধনা। তা জীবের মন, বাক্য চক্ষু এবং ইন্দ্রিয় ব্যাপারের ফল স্বরূপ। আমার উপাসনা ব্যতীত কোনও পুরুষ মোহময় কৃতান্ত পাশ থেকে কখনও মুক্ত হতে পারে না।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে মহারাজ, ঋষভদেবের নিজ পুত্রগণ স্বভাবত সুশিক্ষিত ছিলেন, সংযমী ছিলেন। তবুও লোক শিক্ষার্থে ঋষভদেব তাদের এইরূপ জ্ঞানপ্রদান করলেন। উপশম স্বভাব, কর্মনিবৃত্ত মহামুনিদের ও ভক্তি, জ্ঞান ও বৈরাগ্যে –রূপ শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে নিজের শতপুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ্য ভগবৎপরায়ণ পরমভাগবৎ ভরতকে পৃথিবী পরিচালনার জন্য রাজপদে অভিষিক্ত করলেন।

তারপরে, স্বয়ং কেবলমাত্র নিজ শরীরকে পরিজনরূপে স্বীকার করে উন্মাত্তের মতো নগ্ন ও বিক্ষিপ্ত কেশ হয়ে, হোমাগ্নিকে আত্মমধ্যে সংস্থাপিত করলেন।

সে সময় তিনি জড়, অন্ধ, মূক, বধির, পিশাচ ও উন্মত্তের মত নিকৃষ্ট বেশ-ধারণ করেছিলেন। তখন তিনি অবধূতের ন্যায় বেশ ধারণ করেছিলেন।

এভাবে তিনি একাকী বিশ্বভ্রমণ করতে শুরু করলেন। পুর, গ্রাম, আকার, ক্ষেত বা কৃষকদের গ্রাম, পুষ্পেদ্যান, পর্বত-প্রান্তে অবস্থিত গ্রাম, ঘটি, শিবির ব্রজ, ঘেষে বা গোপপল্লী, সার্থ বা যাত্রীনিবাস, পর্বত, বন, আশ্রম ইত্যাদি স্থানে ভ্রমণ করতে লাগলেন।

মক্ষিকাকুল, মদস্রাবী বন্য হস্তীকে উৎপীড়ন করে, তেমনি তাঁর ভ্রমণকালে দুরাত্মা জনগণ তাঁর গায়ে প্রস্রাব ও শ্লেষ্মা নিক্ষেপ, প্রস্তর খণ্ড ও বিষ্ঠা, ধূলি প্রক্ষেপণ করে তাকে উৎপীড়ন করতে লাগলেন।

ভীতি প্রদর্শন ও দুর্বাক্য প্রয়োগ করেও তাঁকে কেউ ব্যাকুল করতে পারল না। তিনি সমস্ত বিষয় অগ্রাহ্য করে পথ চলতে লাগলেন।

ভ্রমণকালে তিনি সৎ ও অসৎ এই দুই তত্ত্বের অনুভব করে নিজ স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।

বস্তুতঃ অনিত্য এই শরীরের প্রতি তার অহংকার লুপ্ত হয়েছিল। সেজন্য কোনোপ্রকার তাপমান, উৎপীড়নেই তাঁর কোনোপ্রকার চিত্তবিকার উৎপন্ন হয়নি।

তার দেহের প্রতিটা অঙ্গ যেমন-হাত, পা, বক্ষ প্রভৃতির বিন্যাস অতি সুগঠিত ও সুন্দর ছিল। প্রশান্ত, হাস্যময় মুখমণ্ডলে আনত নয়নদ্বয় সদ্যপ্রস্ফুটিত কমলের মতো রক্তাভ, আয়ত ও স্নিগ্ধ হয়ে তার সৌন্দর্যবর্ধন করছিল। তার গন্ডদেশ, কর্ণদ্বয়, কণ্ঠ ও নাসিকা সুন্দর ও সুগঠিত ছিল।

তাঁর গম্ভীর হাস্যময় মুখ পুরনারীদের চিত্তে কামের উদ্রেক করত।

তবে, যে সময় অগ্রদেশে কুটিল জটাযুক্ত কেশভার লম্বা হয়েছিল। তখন তাঁকে গ্রহগ্রস্ত উন্মাদের মতো মনে হতে লাগল।

ঋষভদেব অনুভব করলেন, লোকগণ তাঁর যোগানুষ্ঠানের প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে, এবং তার এই ব্যাপারে প্রতিকার করতে যাওয়াও শোভন নয়।

তখন তিনি অজগর ব্রত অবলম্বন করলেন। অর্থাৎ এক জায়গায় অবস্থান করে শায়িত অবস্থায় ভোজন, চর্বন এমনকি মলমূত্র ত্যাগ করতেন।

এ সময় বিষ্ঠার উপরে লুণ্ঠিত থাকায়, তার দেহের স্থানে স্থানে বিষ্ঠা লিপ্ত হত। কিন্তু অত্যাশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঐ বিষ্ঠার দুর্গন্ধ ছিল না। বরং তা এত সুগন্ধি ছিল যে, তার সৌরভে আমোদিত বায়ু দশদিককে সুরভিত করে তুলত।

তিনি গোরু, হরিণ ও কাকের মতো চলমান অবস্থায়, কখনও দণ্ডায়মান বা শয়নরত অবস্থাতেই পান, ভোজন ও মূত্রত্যাগ করতেন।

হে মহারাজ– ঋষভদেব এ ভাবে লোকযাত্রা পরিহার করে, অর্থাৎ যোগীদের যে রকম আচরণ করা কর্তব্য, তা দেখাবার জন্য যোগচর্যার আচরণ করলেন।

প্রকৃতপক্ষে তাঁর নিজের কোনো প্রয়োজন ছিল না। তিনি স্বয়ং ভগবান ও কৈবল্যপতি ছিলেন। পরমানন্দের স্বরূপ ছিলেন তিনিই।

সকল ভূতের আত্মা ভগবান বাসুদেবে উপাধিভাব পরিত্যাগ করে সতঃসিদ্ধ ফলে পরিপূর্ণ ছিলেন।

এজন্য আকাশগতি, মনের ন্যায় দৈহিক দ্রুতগতি, অন্তর্ধান, পরদেহে প্রবেশ প্রভৃতি যোগ ঐশ্বর্যও উপভোগ করতেন না।

.

ষষ্ঠ অধ্যায়
ঋষভদেবের দেহত্যাগ

মহারাজ পরীক্ষিৎ বললেন– হে ভগবান, যে ব্যক্তিগণ আত্মারাম অর্থাৎ আত্মাতেই যাদের রতি, যৌগশ্বর্যসমূহ নিজের থেকেই তাঁদের কাছে ধরা দিলেও তাতে তাদের কোনরূপ আসক্তি জন্মায় না।

যোগবলে উদ্দীপ্ত তাদের কর্মবীজ রাগাদি দগ্ধ হয়। তাহলেও কেন ভগবান ঋষভদেব স্ব-ইচ্ছায় ঐ সব যোগৈশ্বর্য গ্রহণ করলেন না?

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে রাজন, তুমি সত্য বলেছ। তবুও ব্যাধগণ মৃগকে জালে আবদ্ধ করেও বিশ্বাস করতে পারে না, অথবা মৃগেরাও ব্যাধকে কখনও বিশ্বাস করতে পারে না। তেমন ভাবেই কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি চঞ্চল মনকে কখনও বিশ্বাস করেন না।

এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ বলে থাকেন মন চঞ্চল থাকলে কখনও কারো সাথে সখ্য করবে না। ঐভাবে মনকে বিশ্বাস করায় স্বয়ং মহাদেবেরও বহুকালের সঞ্চিত তপস্যা বিষ্ণুর মোহিনীরূপ দর্শনে বিনষ্ট হয়েছিল। ব্যভিচারিণী স্ত্রী উপপতিকে আগমনের সুযোগ দিয়ে, পরে তার দ্বারাই নিজের প্রতি বিশ্বাসাসক্ত স্বামীকে হত্যা করায়।

তেমনি যে যোগীব্যক্তি মনের সাথে সখ্যতা করেন, তাঁর মন সর্বদা কাম ও কামানুগত ক্রোধাদি রিপুগণের আগমনের সুযোগ দিয়ে থাকে। পরিণামে সেই মনই কামাদি দ্বারা যোগীর সর্বনাশের কারণ হয়। কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ বা গর্বমোহ, শোক, ভয়াদি, কর্মবন্ধ– এ সকল যার নিমিত্ত হয়, সেই মনকে কোনও জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের বশীভূত বলে স্বীকার করেন না।

যাই হোক ভগবান ঋষভদেব নিখিল লোকপালগণের ভূষণ– রূপ হলেও, সে সময় তাঁর কোনো অনুচর ছিল না। অবধুতের মত বিবিধ ভাষা ও বিভিন্ন বেশ –ভূষা অবলম্বন করার জন্য তন্নিষ্ঠ ভগবৎ প্রভাবও লক্ষিত হলো না।

তিনি ঐরূপে বেশ কিছুদিন ভ্রমণ করে কিভাবে দেহত্যাগ করতে হয়, তা যোগীদের শিক্ষা দেবার জন্য স্বীয় কলেবর ত্যাগ করতে ইচ্ছা করলেন।

তিনি স্বীয় আত্মার মধ্যে অব্যবহিত রূপে বিরাজিত পরমাত্মাকে অভিন্নরূপে দর্শন করে, লিঙ্গ দেহগত আত্মাভিমান পরিত্যাগ করলেন।

যদিও তার ঐ প্রকারে দেহাভিমান পরিত্যক্ত হল, তবু মোহমায়ার বাসনার কারণে তার দেহটি ঘুরতে লাগল।

কুলালচক্র, যেমন সংস্কার বশতঃ কিছুক্ষণ স্বয়ং ঘুর্ণায়মান হয়, তেমনি সংস্কার বশতঃ পুনর্বার ভ্রমণ করতে করতে কোঙ্ক, বেঙ্কট, কটুক এবং দক্ষিণ কর্ণাটক দেশে যদৃচ্ছাক্রমে গিয়ে উপস্থিত হল।

সেখানে কূটকাঁচলের উপবনে গিয়ে তিনি কোনো বাসনার কয়েকটি প্রস্তরখণ্ড নিয়ে নিজে মুখের মধ্যে দিলেন। পরে উন্মত্তের মতো মুক্তকেশ হয়ে নগ্নদেহেই বিচরণ করতে লাগলেন।

অনন্তর সেখানে বায়ুবেগে পরিচালিত বেণুবনে পরস্পর সংঘর্ষণে তীব্র দাবানলের উদ্ভব হলো। সেই দাবাগ্নি সর্বগ্রাসী হয়ে ঋষভদেব সহ সমগ্র অরণ্যানীকে ভস্মীভূত করল।

হে রাজন, ভগবান ঋষভদেব অবধূত বেশে ভ্রমণ করতে করতে যে রকম আচরণ করে ছিলেন, তা লোকমুখে চতুর্দিকে প্রচারিত হল।

এই আচরণের কথা জ্ঞাত হয়ে কোঙ্ক, বেঙ্কট কটক দেশের রাজা অর্থাৎ নিজে ঐরূপ শিক্ষা গ্রহণ করবেন।

অকুতোভয় নিজ ধর্মমত পরিত্যাগ করে নিজ বুদ্ধিবলে পাষণ্ডরূপ কুপথ প্রবর্তন করবেন। কলিযুগে অধর্মই প্রবল হয়ে উঠবে। অতএব ভবিতব্য অর্থাৎ প্রাণীগণের পূর্বসঞ্চিত পাপ ফলের দ্বারা ঐ রাজার মতি বিমোহিত হবে।

এই রাজা স্বয়ং অধর্মের প্রবর্তক হলে, কলিযুগে কুবুদ্ধি ব্যক্তিগণ দেবমায়ায় বিমূঢ় হয়ে স্বধর্মসম্মত আচার ব্যবহার পরিত্যাগ করবে। ক্রমে তারা দেবগণকে অবজ্ঞা, অস্নান, অশৌচ, কেশ উৎপাটন রূপ অপব্রত স্বেচ্ছায় গ্রহণ করবে।

অধর্মবহুল কলিযুগে ঐ সকল ব্যক্তির বুদ্ধিনাশ হবে। তারা প্রায় সবসময়েই বেদ, যজ্ঞপুরুষ, এবং পরলোকের প্রতি দোষারোপ করতে থাকবে। ঐ লোকগণ অন্ধ বিশ্বাসে সেই অবেদমূলক স্বেচ্ছাচাররূপ নবীন মতবাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে নিজেরাই মহাঘোর নরকে পতিত হবে।

রজঃ গুণে পীড়িত লোকগণের মুক্তিমার্গ শিক্ষাদানের জন্যই ভগবান ঋষভদেব– রূপে অবতীর্ণ হয়ে ছিলেন। মনীষীগণ তাঁর গুণানুরূপ এই সকল শ্লোকের কীর্তন করে থাকেন। অহো!– সাত সাগর পরিবেষ্টিত এই ভূমণ্ডলবর্তী দ্বীপের মধ্যে এই ভারতবর্ষ সমধিক পুণ্যভূমি।

এই ভারতবর্ষের জনগণ সর্বদা ভগবান শ্রীহরির অবতার যুক্ত মঙ্গলময় কর্মকাণ্ডের কীর্তন করে থাকেন। অহো, রাজা প্রিয়ব্রতের বংশ কীর্তির দ্বারা বিশুদ্ধি লাভ করেছে। যেহেতু পুরাণপুরুষ ভগবান বিষ্ণু এই বংশে ঋষভদেব রূপে অবতীর্ণ হয়ে মোক্ষসাধক ধর্মের আচরণ করেছিলেন।

অজ অর্থাৎ জন্মরহিত ঋষভদেবের ঐ আচরণ, অন্য যোগীগণ মনোরথ দ্বারাও অনুসরণ করতে পারে না। কারণ তিনি তুচ্ছ বা অবস্তু বলে যে সকল যোগসিদ্ধিকে উপেক্ষা করেছেন অন্যান্য যোগীপুরুষেরা তা লাভ করার আকাঙ্ক্ষায় নানাবিধ প্রচেষ্টা করে থাকেন।

হে রাজন, সকল বেদ, লোক, দেব, ব্রাহ্মণ ও গো-সমূহের পরম গুরু ঋষভদেবের যে আচরণ বর্ণিত হল, তা পুরুষগণের দুশ্চরিত্র অপরণ অপদারক। পরম আনন্দময়। মহৎ কল্যাণের আহ্বায়ক।

যে ব্যক্তি একাগ্রমনে নিয়ত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শ্রদ্ধাসহকারে এই চরিত্র কথা শ্রবণ বা বর্ণন করেন, ভগবান বাসুদেবের প্রতি তাদের প্রত্যেকরই ঐকান্তিক ভক্তির উদয় হয়।

বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ সেই ভক্তিস্রোত বিবিধ পাপসঙ্কুল সংসার যন্ত্রণায় সন্তপ্ত আত্মাকে সতত স্নান করিয়ে পরম তৃপ্তি লাভ করেন।

এজন্য মুক্তিরূপ আত্যন্তি পরম পুরুষার্থে– ভগবানের দানরূপে স্বয়ং উপস্থিত হলেও তারা তার সমাদর করেন না। কারণ পূর্বেই ভগবৎসম্বন্ধীয় হওয়ায় সর্বপ্রকার পুরুষার্থ পরিপূর্ণভাবে লাভ করেছেন।

হে মহারাজ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তোমাদের অর্থাৎ পাণ্ডবদের এবং যাদবদের পালক। তিনিই তোমাদের গুরু, তিনিই দেব, তিনিই তোমাদের কুলপতি।

কোনো কোনো ক্ষেত্রবিশেষে তিনি দৌত্যাদি কার্যে তোমাদের আজ্ঞাকারীও হয়েছেন। এরকম হলেও তিনি অন্য ভজনকারীদের মুক্তিই দান করেন। কখনই তিনি তাঁদের প্রেম বা ভক্তিযোগ দান করেন না।

আমি সেই পরমভাগবৎ ভগবান ঋষভদেবের চরণে প্রণিপাত করি। নিত্য যে আত্মস্বরূপ তিনি উপলব্ধি করতেন, তা লাভ করার ফলেই তার সকল তৃষ্ণা দূরীভূত হয়েছিল। দেহাদির নিমিত্ত মনোরথের কারণে মঙ্গলজনক বিষয়ে যে ব্যক্তিগণের বুদ্ধি সুষুপ্ত ছিল, তিনি তাদের প্রতি করুণা প্রকাশ করেছিলেন।

তিনি তাদের একান্ত দয়া করে অভয়রূপ নিজলোক অর্থাৎ আত্মতত্ত্ব বা আত্মস্বরূপের উপদেশ দান করেছিলেন।

.

সপ্তম অধ্যায়
মহারাজ ভরতের উপখ্যান

শ্ৰী শুকদেব বললেন, — ভগবান ঋষভদেব পৃথিবী পালনার্থে পরম ভাগবৎ ভরতকে রাজারূপে নিযুক্ত করলেন। তখন তিনি ভগবানের নির্দেশ অনুসারে বিশ্বরূপের কন্যা পঞ্চজননীকে বিবাহ করেছিলেন। অহংকার থেকে যেমন শব্দ– স্পর্শাদি পঞ্চভূতের উৎপত্তি হয়, তেমনি ঐ ভার্যার গর্ভে ভরতের পঞ্চপুত্রের জন্ম হল। তাদের নাম সুমতি, রাষ্ট্রভৃৎ, সুদর্শন, আবরণ এবং ধূম্রকেতু।

এই অজনাভ বর্ষ মহারাজ ভরতের নাম থেকেই ভারতবর্ষ রূপে পরিচিত হয়েছে। সর্বজ্ঞ মহারাজ ভরত পিতৃ-পিতামহের ন্যায় স্বধর্মনিষ্ঠ হয়ে, নিজ নিজ কর্মে নিযুক্ত প্রজাদের বাৎসল্যজ্ঞানে প্রতিপালন করতে লাগলেন।

চাতুহোত্র বিধি অনুযায়ী নিজ অধিকার অনুসারে অগ্নিহোত্র দর্শ, পূর্ণমাস, চাতুর্মাস্য পন্ডযোগ ও সোমযোগের সর্বাঙ্গযুক্ত অনুষ্ঠান এবং কখনও বিকলাঙ্গ বা অঙ্গহী রূপে বৃহৎ ও ক্ষুদ্র বহু যাগযজ্ঞ দ্বারা শ্রদ্ধাসহ ভগবান যজ্ঞমূর্তি ও ক্রতুরূপী শ্রীহরির আরাধনা করেছিলেন। যূপহীন যাগকে যজ্ঞ এবং যুপযুক্ত যাগকে ক্রতু বলা হয়।

হে মহারাজ, অঙ্গক্রিয়া-সমূহের অনুষ্ঠান যুক্ত বিবিধ যজ্ঞ শুরু হলে অধবর্য বা যজুর্বেদজ্ঞ ঋত্বিকেরা যখন আহুতি দানার্থে হবি গ্রহণ করতেন, তখন যজমান ভরত ঐ সকল ক্রিয়ার ফল ধর্ম নামক অপূর্ব বস্তুটিকে যজ্ঞপুরুষ-রূপী পরব্রহ্ম ভগবান বাসুদেবের মধ্যেই অবস্থিত বলে চিন্তা করতেন।

মহারাজ ভরতের ঐরূপ চিন্তাকৌশলের দ্বারা তাঁর চিত্তের রাগ-দ্বেষাদি দোষ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছিল। মীমাংসা শাস্ত্রে অপূর্ব। অর্থাৎ ক্রিয়ার ফলধর্ম সম্পর্কিত দুটি মত প্রসিদ্ধ রয়েছে। একটি মতবাদে ক্রিয়ার ফলকে যজমানের আশ্রিত বলা হয়েছে। অপর মতানুসারে, ঐ ক্রিয়াকলকে যজ্ঞে আবাধ্য ইন্দ্রাদি দেবতাশ্রিত বলা হয়েছে।

এই অবস্থায় ভরত ঐ ক্রিয়াফলকে বাসুদেবের আশ্রিত রূপে চিন্তা করার কারণ এই যে– ভগবান বাসুদেবই সাক্ষাৎ যজ্ঞকতা। কারণ তিনিই অন্তর্যামীরূপে যজমানকে যজ্ঞাদিতে প্রবৃত্ত করেন, বলে মুখ্য কর্তা।

আবার তিনিই যজ্ঞে পরম দেবতা, যেহেতু যজ্ঞে বিভিন্ন মন্ত্রের অর্ঘরূপে ইন্দ্র প্রভৃতি যে দেবতাগণ আমাদের বোধে উপস্থিত হন। ভগবান বাসুদেব তাদেরও নিয়ামক। এই কারণেই রাজা ভরত যজ্ঞের অংশভাগী সূর্যাদি অন্য দেবতাগণকে ভগবান বাসুদেবের চক্ষু প্রভৃতি ভবসরের মধ্যে অবস্থিত রূপে ধ্যান করেছিলেন।

তিনি তাদের ভগবান বাসুদেবের থেকে পৃথক অনুধ্যান করেননি এটাই মহারাজ ভরতের উপাসনার কৌশল। এইপ্রকার ভগবানে ফলাদি ভাবনারূপ বিশুদ্ধ কর্মের অনুষ্ঠান দ্বারা মহারাজ ভরতের চিত্ত বিশুদ্ধ হল। তখন ভরতের শুদ্ধ হৃদয়পদ্মে ভগবান বাসুদেবের আবির্ভাব ঘটল।

পরমব্রহ্ম ভগবান বাসুদেব জীবের হৃদয়াকাশে বিরাজ করেন। তিনি শ্রী কৎসচিহ্ন, কৌস্তুভ মণি, বনমাল্য, শঙ্খ, চক্র, গদা প্রভৃতি মাঙ্গলিক চিহ্নযুক্ত হয়ে ভরতের মনের মধ্যে প্রকাশিত হলেন।

তখন ভরতের মনে সেই পরমপুরুষের প্রতি প্রবল ভক্তিভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো। মহারাজ ভরত এইভাবে অযুতবর্ষ রাজত্ব করলেন। অতঃপর তিনি মনে করলেন, এতদিনে তাঁর রাজত্বভোগের উপযোগী অদৃষ্টের অবসান ঘটেছে।

তিনি নিজে পিতৃ-পিতামহের যে ধনরাশি-সম্পদ ভোগ করছিলেন তা যথাযথ ভাবে নিজ পুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন।

সেখান থেকে নিজের ভবন ত্যাগ করে পুলহাশ্রমে গমন করে সন্ন্যাস অবলম্বন করলেন। সেই পুলহাশ্রমে বিদ্যাধর কুণ্ডে ভগবান শ্রীহরি অদ্যাবধি নিজ ভক্তদের প্রতি করুণাপরবশ হয়ে তাদের আকাঙিক্ষত মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে থাকেন।

সেই স্থানে সরিৎশ্রেষ্ঠা গন্ডকী নদী শিলামধ্যগত চক্ৰদ্বারা আশ্রম স্থানসমূহে সর্বতোভাবে পবিত্র করেছে। সেই শিলাগঠন এমনই আশ্চর্য যে প্রতিটি শিলার উপরদিকে ও নিম্নভাগে একটি করে নাভি রয়েছে।

পুলহাশ্রমে স্থিত উপবনে মহাত্মা ভরত একাকী নির্জনে অবস্থান করতে লাগলেন। তিনি নানাবিধ পুষ্প, কিশলয়, তুলসী, জল এবং ফল, কল-মূল প্রভৃতি উপাচারে ভগবানের আরাধনা করতে করতে নিবৃত্তি প্রাপ্ত হলেন।

তিনি সর্বদা শুদ্ধ হয়ে থাকতেন, এবং তার বিষয়াভিলাষ নিবৃত্ত ও শমগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিল। পরম ভাগবৎ মহারাজ ভরত এইরূপে অবিরত পরমপুরুষের পরিচয়তায় রত হলে ভগবানের প্রতি তাঁর অনুরাগে অতিশয় বৃদ্ধি পেতে লাগল।

সেই অনুরাগের আতিশয্যে তার হৃদয় দ্রবীভূত হয়ে গেল, তাতে আর কোনো উদ্যম অবশিষ্ট রইল না। হর্ষবশতঃ তার শরীরে রোমাঞ্চরাজির উদ্ভব হল।

ঔৎসুক্যের কারণে প্রেমা নির্গত হয়ে নয়নদ্বয়ের দৃষ্টি নিরুদ্ধ করে দিল। ঐ প্রকার অবস্থায় তখন তিনি সেই ভাগবতসেবার কথাও আর স্মরণ করতে পারলেন না।

নিজের প্রেমদাতা সেই পরম দেবতার রক্তাভ চরণদ্বয়ের ধ্যান করার ফলে, তাঁর ভক্তিযোগ প্রগাঢ় হয়ে উঠল। তাতে হৃদয়রূপ প্রগাঢ় হয়ে উঠল। তাতে হৃদয়রূপ হ্রদের সর্বত্র পরম আনন্দ ব্যাপ্ত হয়ে পড়ল। সেই আনন্দে তার মন নিমগ্ন হয়ে রইল।

এইভাবে ভরত ভাগবত্রত ধারণপূর্বক মৃগচর্ম পরিধান করে থাকতেন। ত্রিসন্ধ্যা তিনি স্নান করতেন। বারংবার স্নানের ফলে তাঁর কুটিল ও কপিশবর্ণ জটারাশি আর্দ্র থাকার কারণে সমধিক শোভা বিস্তার করেছিল।

তিনি সূর্যমণ্ডলের উদয়কালে সূর্যবিষয়ক ঋকমন্ত্র দ্বারা সূর্যমণ্ডলস্থ ভগবান হিরন্ময় পুরুষের আরাধনা করতেন। তিনি বলতেন– প্রকৃতির পর ও শুদ্ধসত্ত্ব স্বরূপ সূর্যদেবের সেই ভর্গ অর্থাৎ তাঁর আত্মস্বরূপ তেজ, আমাদের কর্মফলের দাতা তাঁহার থেকেই মন দ্বারা আমাদের এই বিশ্বের সৃষ্টি।

তিনিই স্বসৃষ্টে জগতের সর্বত্র অন্তর্যামী রূপে প্রবেশ করে নিজস্ব চির্দ-শক্তি দ্বারা কামপুষ্পযুক্ত জীবদের প্রতিপালন করেন। তাদের বুদ্ধিবৃত্তির চালক হয়ে কর্মফল প্রদান করেন। আমরা সেই ভর্গেরই অর্থাৎ তেজোময় শক্তিরূপেণ পদার্থের শরণাগত হয়েছি।

.

অষ্টম অধ্যায়
ভরতের মৃত্ব প্রাপ্তি

শ্ৰী শুকদেব বললেন–হে মহারাজ, একদিন মহামতি ভরত গন্ডকী নদীতে স্নান ও নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াদি সমাপন করে প্রণামাদি মন্ত্র জপ করতে করতে তিনমুহূর্ত কাল ঐ গন্ডকী নদীর তীরে অধিষ্ঠান করেছিলেন।

সেই সময়ে একটি হরিণী জল পান করার ইচ্ছায় সেই নদীর তীরে উপস্থিত হল। হরিণীটি ছিল গর্ভবতী। সে অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে জল পান করতে লাগল। এমন সময়ে অত্যন্ত কাছেই এক সিংহ গর্জন করে উঠল।

সিংহের গর্জন সেই নির্জন স্থানে অতি ভয়ংকর মহাশব্দরূপে শ্রুত হল। হরিণী সততই ব্যাকুল স্বভাবা। এই মহাগর্জন যুক্ত সিংহনাদে সে আরও ব্যাকুল হয়ে উঠল।

তখন সে দিভ্রান্ত হয়ে অর্ধপিপাসু অবস্থাতেই ভয়ে লাফ দিয়ে নদী পার হতে গেল। উল্লম্ফনের সময়ে হরিণীর গর্ভস্থ সন্তানটি স্থানচ্যুত হয়ে নদীর স্রোতে পতিত হল।

তখন সে হরিণী গর্ভপাত ও ভয়ে কাতর হয়ে পড়ল। একাকিনী, দলচ্যুতা সেই হরিণীর আর একটু পরেই মৃত্যু হল।

এদিকে সদ্যোজাত হরিণশাবকটি নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল। তাকে দেখে ভরতের মনে করুণা সঞ্চারিত হল।

মাতৃহীন, বন্ধুহীন সেই হরিণ-শাবকটিকে তিনি নিজেই জল থেকে তুলে আনলেন। তার অন্য আশ্রয় না থাকায় নিজের আশ্রমে নিয়ে এলেন।

ক্রমে সেই হরিণশিশুর প্রতি ভরতের এক অত্যাশ্চর্য মায়ার উদ্রেক হল। তিনি সর্বদা তার প্রতি “এ আমার”–এরূপ অভিমান করতেন। সেজন্য রাজর্ষি ভরত তৃণাদি আহরণ করে তার পোষণ করতেন।

বৃক প্রভৃতি হিংস্র জন্তু থেকে রক্ষণ ও যত্ননাদির সাহায্যে তার প্রীতি সম্পাদন করতেন। স্নেহ চুম্বনের দ্বারা ভরত ঐ মৃগশিশুটির লালন– পালনের অতীব আসক্ত হয়ে পড়লেন।

তার ফলস্বরূপ মহাত্মা ভরতের নিজের স্নানাদি নিয়ম, অহিংসা এমনকি ভগবানের পরিচর‍্যা প্রভৃতি ক্রিয়া এক এক করে বিচ্যুত হতে লাগল। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে হরিণশিশুর প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়লেন।

তার সর্বদা মনে হতো, অহো এই দীন হরিণশাবকটি কালচক্রের গতিবেগে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু– বান্ধব, থেকে পরিভ্রষ্ট হয়ে আমারই শরণ নিয়েছে। আমিই ওর একমাত্র আশ্রয়, আমিই ওর পিতা, মাতা, ভ্রাতা, জ্ঞাতি ও স্বজন।

আমার প্রতি এ অতি বিশ্বাসযুক্ত, আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে জানে না।

সুতরাং, এই শরণাগত হরিণশাবককে রক্ষা করা আমার কর্তব্য, এজন্য আমার কোনো অসূয়া থাকাও উচিত নয়। শরণাগতকে উপেক্ষা করা দোষণীয়।

দীনবন্ধু, নিবৃত্তিপরায়ণ আর্যসাধুবৃন্দ এইরূপ অবস্থায় নিজেদের গুরুতর স্বার্থে সকলের প্রতি নিশ্চয়ই উপেক্ষা করে থাকেন।

রাজর্ষি ভরত এইরকম আসক্তিযুক্ত হলে, উপবেশন, শয়ন, ভ্রমণ, অবস্থান ও আহারাদি মৃগশিশুর সাথে নিবিড় স্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ হল।

ভরতকে কুশ, পুষ্প, যজ্ঞকাষ্ঠ, পত্র, ফল, মূল ও জল আনার জন্য বনে যেতে হত। তখন তিনি ঐ মৃগশাবকটিকে সঙ্গে নিয়েই যেতেন, পাছে বৃক, কুকুরাদি এসে তাকে আক্রমণ করে এই আশংকায়।

হরিণশাবকটির প্রতি ভরতের হৃদয় স্নেহভরে পরিপূর্ণ হয়েছিল। বনপথে চলতে চলতে সে কণ্টকে আবদ্ধ হতো অথবা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ত, তখন তাকে কোলে– কাঁখে নিয়ে বহন করতেন। এভাবে কখনও বুকে জড়িয়ে আদর করে ভরত পরম আনন্দ লাভ করতে লাগলেন।

এমন কি নিজ কার্য ভগবৎ পরিচর‍্যা শুরু করেই, অসমাপ্ত রেখে মাঝে মাঝে এসে হরিণটিকে দেখে যেতেন। তাকে দেখে সুস্থ মনে আশীর্বাদ প্রার্থনা করতেন–হে বৎস, তোমার কল্যাণ হোক।

দৈবাৎ তাকে দেখতে না পেলে ধর্মবিনাশে কৃপণ ব্যক্তি যেমন কাতর হয়, তেমনই অতি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন। ভরত তখন হরিণ শাবকটির বিচ্ছেদ-আশংকায় বিহ্বল হয়ে পড়তেন।

অনুশোচনা করতে করতে বলতেন–হায়, হায়, এই মাতৃহীন হরিণশিশুটি অতি দীন। আমি মন্দভাগ্য, অনার্য। আমার চিত্ত ধূর্ত ও কীরাতের ন্যায় প্রবঞ্চনাপূর্ণ হৃদয়। এই অবস্থায় কি সে আমার কাছে ফিরে আসবে? সে অতি সুজন, তার শুদ্ধ চিত্তে সে আমার অপরাধ মার্জনা করে, আবার কি ফিরে আসবে?

দেবগণ কর্তৃক রক্ষিত সেই হরিণশিশু দৈবাৎ আমার কাছে এসে পড়েছে। এই আশ্রমের উপবনে সুকোমল তৃণরাশি ভক্ষণরত অবস্থায় তাকে আবার দেখতে পাব কি? কোনও হিংস্র জন্তু, নেকড়ে বাঘ, বন্য কুকুর, কিংবা যূথবদ্ধ শূকর প্রভৃতি তাকে ভক্ষণ করে নি তো?

যে সূর্যোদয়ে সকল জগতসংসারের কল্যাণ সাধিত হয়, তিনি এখন অস্তাচলে গমন করছেন। হায় হায়, ঐ মৃতা হরিণীর গচ্ছিতা ধনটি এখনও আমার কাছে ফিরে এল না। আহা সেই হরিণ শিশু কি আবার এখানে ফিরে এসে আমাকে সুখী করবে?

আমি তো কোনো পুণ্য করিনি। আমার ভাগ্যে কি এরকম ঘটবে? খেলার সময়ে আমি সমাধির অভিনয় করে নয়ন মুদ্রিত রাখলে সে প্রণয়কোপে মাঝে মাঝে এসে জলকণার ন্যায় সুকোমল শৃঙ্গ দিয়ে। আমাকে স্পর্শ করতো।

ভগবানের পরিচর্যার সময়ে আমি কুশের ওপর হোমের জন্য প্রয়োজনীয় ঘৃতাদি দ্রব্যাদি রাখতাম। সে খেলা করতে করতে চঞ্চল হয়ে কুশ আকর্ষণ করে যদি পবিত্র দ্রব্যাদি দূষিত করে ফেলত, তখন আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতাম। আমার বিরক্তিস্বরে –“আহ! কি করলি” শুনলে সে ভীত হয়ে ঋষিকুমারদের মতো নিশ্চল হয়ে থাকতো।

এইরূপ স্বরে বিলাপ করতে করতে ভরত আশ্রমের বাইরে বেরিয়ে এলেন।

সেখানে মৃগশিশুর পদচিহ্ন অঙ্কিত ভূমিভাগ দেখে বিলাপ করতে লাগলেন। তিনি বলতে লাগলেন– কী ভাগ্যবতী এই বসুন্ধরা। না জানি কোন্ তপস্যাবলে এখন সেই কৃজ্ঞসার মিথ্যা হয়ে যায়। তুমি যা যা বললে অ-মিথ্যা না হলেও অসঙ্গত নয় কি? তুমি আমাকে ভুলদেহ বললে এরকম কথা বিদ্বান ব্যক্তিরা কোনও চেতন পদার্থের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেন না। মূর্খ অজ্ঞান লোকেরাই এরূপ বাক্যের ব্যবহার করে থাকে। কারণ এরকম উপমা দেহের প্রতিই প্রযুক্ত হতে পারে আত্মার ওপরে প্রযুক্ত হয় না। বস্তুতঃ আমার দেহ স্থূল হতে পারে কিন্তু আমার আত্মা স্থল নয় অর্থাৎ আমি স্কুল নই।

হে মহারাজ, দেহাভিমান নিয়ে যার জন্ম হয়, তাঁরই স্থূলত্ব, কৃশত্ব ন-ব্যাধি, মনঃপীড়া, ক্ষুধা তৃষ্ণা, ভয়, কলহ, ইচ্ছা জরা, নিদ্রা, আসক্তি, ক্রোধ, অহংকার, গর্ব এবং শোধক সম্ভব। কিন্তু দেহাভিমান না থাকার কারণে আমার স্কুল ত্বাদি কিছুই নেই। তুমি এই যে আমাকে জবিত বললে এ বিষয়ে বলা যায় শুধু আমিই জীব নই। বিকারী অর্থাৎ পরিণাম শীল পদার্থ মাত্রেরই আদি ও অন্ত আছে। সেজন্য সকল রকম বস্তুই জীবমৃত বলে অনুভূত নয়। আবার এই যে বললে– স্বামী বা প্রভুর আদেশ অমান্য করছিস তার সম্বন্ধেও আমার কিছু বক্তব্য আছে। হে মান্যবর! যে স্থানে স্বত্ব– স্বার‍্যা ভাব অর্থাৎ প্রভু– ভৃত্যের সম্পর্ক– চিরস্থায়ী হয়, একমাত্র সেখানেই আদেশ ও তার অনুরূপ কর্ম স্থির থাকতে পারে। কিন্তু তোমার এই রাজ– অধিকার তো চিরস্থায়ী নয়! যদি তুমি রাজ্যভ্রষ্ট হও, আমি রাজা হই, তাহলে প্রভু– ভৃত্য সম্বন্ধেরও বিপর্যয় ঘটতে পারে। ভরত একটু থেমে আবার বলতে থাকেন অবশ্য তুমি বলতে পারো যতদিন রাজত্ব আছে ততদিন তুমি আমার প্রভু। তাও বলতে পারা যায় ব্যবহার ব্যতিরেকে রাজা ও ভৃত্য এই ভেদবুদ্ধির কোনও অবকাশ দেখা যায় না। বস্তুতঃ প্রভু কে? কার ওপরেই বা তার প্রভুত্ব? তবু যদি তোমার প্রভুত্বের অভিমান থাকে, তাহলে কোন কার্য করতে পারি?

তুমি আমাকে প্রমত্ত বলছ এজন্য তুমি আমার যথোচিত চিকিৎসা করবে বলেছ! এ বিষয়ে আমি বলছি– হে রাজন, আমি উন্মত্ত বা জড়বৎ ব্যবহার করলেও বস্তুতঃ আমি ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয়েছি, তুমি চিকিৎসা কর বা শাস্তিই দাও, তার ফলে আমার অর্থ বা অনর্থ কিছুই হবে না। আর তোমার কথার সূত্র ধরেই বলতে পারি, যদি আমি জড় বা প্রমত্তই হয়ে থাকি, তবে তোমার দণ্ড বা শিক্ষাদান ব্যর্থ হবে, কারণ প্রমত্ত বা জড় ব্যক্তিকে শিক্ষার দ্বারা কর্মপটু করা সম্ভব নয়।

শুকদেব বললেন– হে রাজন, সেই উপশমশীল ভরত এভাবে রাজার তিরস্কারের উত্তরে তাঁকে উত্তর দিলেন। উত্তর দানের পর আবার প্রবন্ধ কর্মক্ষয়ের জন্য আগের মতোই শিবিকা বহন করতে উদ্যত হলেন। দেহে আত্মবুদ্ধির কারণ যে অবিদ্যা, তা তাঁর নিবৃত্ত হয়েছিল। রাজার শিবিকা বহন করার জন্য তার ক্লেশ বা অপমান কিছুই অনুভূত হল না। হে পাণ্ডবেয়, সিন্ধু ও সৌরীর দেশের অধিপতি রহূগণ সম্যকশ্রদথার দ্বারা পূর্বেই তত্ত্বজিজ্ঞাসার অধিকার প্রাপ্ত হয়েছিলেন, এখন হৃদয়গ্রন্থি বিমোচন ও বহুবিধ যোগগ্রস্থ সন্মত ভরতের এবিধ বচন শ্রুত হয়ে তিনি শিবিকা থেকে নেমে এলেন। নিজের রাজগরিমা বিসর্জন দিয়ে তিনি জড়বৎ ভরতের পায়ে মাথা রেখে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন।

নৃপতি রহূগণ বলতে লাগলেন- হে দেব! আপনি যজ্ঞসূত্র ধারণ করছেন, অতএব আপনি তো ব্রাহ্মণ! এমন গূঢ়ভাবে কেন বিচরণ করছেন? দত্তাত্রেয় প্রভৃতি অবধূতগণের কে আপনি? হে দেব! আপনি কার সন্তান? কোথায় বাস আপনার? এখানে আগমনের কারণ কি? আপনি যদি আমাদের কল্যাণার্থে এসে থাকেন, তাহলে আপনি কি স্বয়ং কপিলমুনি? হে ব্রাহ্মণ, আমি দেবরাজ ইন্দ্রের বর্জকে ভয় পাই না। ভগবান শূলপানির ত্রিশূলও আমার কাছে ভীতপ্রদ নয়। যমরাজের দণ্ডকে আমি ভয় পাই না। সেরকম অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, সূর্য ও কুবেরের অস্ত্র থেকেও আমার ভয়ের কারণ কোনো দেখি না। কিন্তু, ব্রাহ্মণগণের প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করলে যে মহাপাপ হয়, তাকে আমি ভয় করি। হে মহাপুরুষ, অজান্তে এই অপরাধ করে আমি অত্যন্ত ভীত। আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আপনি দয়া করে নিজ পরিচয় উন্মোচন করুন। আপনি নিজ বিজ্ঞানরূপ প্রভাব প্রচ্ছন্ন রেখে সঙ্গ–ত্যাগ করে জড়বৎ বিচরণ করছেন। আমাদের কাছে আপনার অনন্ত মহিমা প্রকাশিত হয়েছে। আপনি যোগগ্রথিত যে বাক্যসকল বললেন, আমরা তার তাৎপর্য অনুভব করতে পারি না, সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন জ্ঞানী মনীষীগণও তা করতে পারেন না।

আমার গুরু হলেন আত্মতত্ত্বজ্ঞ মুনিশ্রেষ্ঠ কপিলদেব। তিনি জ্ঞানশক্তি দ্বারা অবতীর্ণ সাক্ষাৎ শ্রীহরির স্বরূপ। আমি এই শিবিকায় আরোহণ করে তাঁর সকাশে গমন করছিলাম। “এ সংসারে আশ্রয় কি?” আমার জিজ্ঞাস্য এটাই।

আপনি কি সেই কপিলদেব, লোকসমুদয় পরিদর্শনের জন্য ছদ্মবেশে পরিভ্রমণ করছেন? আমার মতো গৃহাসক্ত মূঢ়বুদ্ধি ব্যক্তি, কিভাবে আপনাদের গতিপ্রকৃতি অবগত হতে পারি? হে প্রভু, আপনি আগে আমার যে সকল বাক্যের উত্তর দিলেন, তা আমার সঙ্গত বোধ হচ্ছে না। আপনি বললেন– “আমার শ্রম নেই”– তা কিভাবে সম্ভব? যে ব্যক্তির কোনো কর্মের কর্তা হয়, তাঁর কর্ম ও শ্রম অবশ্যই থাকা উচিত। যখন আমার নিজের প্রভুত্ব ও যুদ্ধাদি ক্রিয়ার কর্তৃত্ব সহজেই কর্ম ও শ্রম দেখছি, তখন সহজেই অনুমান করতে পারি, আপনারও ভার বহনে যথেষ্ট শ্রম হয়েছে।

আর আপনি যে বলছেন–একমাত্র ব্যবহার ভিন্ন অন্য কিছুরই পার্থক্য দেখছি না। তারও তো কোনো সঙ্গত ব্যাখ্যা পাচ্ছি না। বস্তুতঃ ব্যবহারবত্ম অলীক, এমন বোধ হয় না। বরং সত্য বলেই অনুভূত হয়। যেহেতু ঘটাদি পদার্থ মিথ্যা হলে, তাতে কি জল আনয়ন প্রভৃতি ক্রিয়া ঘনমান হয়? ইহা মিথ্যা, সত্তাহীন হলে এর দ্বারা কোনো কার্য সাধন সম্ভব হয় না। ঘট যদি অসৎ অর্থাৎ সত্তাহীন পদার্থ হোত, তাহলে তা দিয়ে জল আনয়ন প্রভৃতি কার্য সম্ভবপর হতো কি?

আবার, আপনি যে বলছেন- “স্থূলাত্বাদি ভাবসমূহ দেহাদি উপাধির হয়, আমি আত্মা, আমার উহা নেই”– এককথাতেও আমার সংশয় হয় এই যে — ঐ সকল উপাধির ধর্ম হলেও তা সত্য হবে না হবার কি আছে?

অগ্নি দ্বারা যখন রন্ধনপাত্র উত্তপ্ত হয়, তখন তার মধ্যস্থ জলও উত্তপ্ত হয়। এই উত্তপ্ত জলের তাপে তন্ডুলের বহির্ভাগ তপ্ত হয় এবং তা থেকে তন্ডুলের পাক সম্পন্ন হয়। এরকম যখন দেহ, ইন্দ্রিয়, প্রাণ ও মন পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত তখন পরপর সংক্রমণের ফলে পুরুষ অর্থাৎ আত্মারও সংসারভাব সম্ভবপর হয়। গ্রীষ্মকাশে যখন দেহ সন্তপ্ত হয়, তখন ইন্দ্রিয়াদি, প্রাণ, মনের সন্তাপও দৃষ্ট হয়। তখন দেহ যদি স্থূল হয়, আত্মাও কেন ভুল হবে না?

আবার আপনি যে বলছেন– “স্বত্ব স্বামীত্ব ভাব অনিত্য”– সে বিষয়েও আমার চিন্তা পৃথকতর, কারণ স্বত্ব স্বামীত্ব ভাব অস্থায়ী হলেও যখন যিনি রাজা হন, তখন তিনিই প্রজাদের শাসন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন।

আবার আপনি যে বললেন– “স্তব্ধ ব্যক্তিকে শিক্ষাদান বিফলশ্রম”– সে বিষয়েও আমার দ্বিমত আছে, কারণ, যে ব্যক্তি ভগবান অচ্যুতের দাস, সে কখনও নিষ্ফল কর্ম করতে পারে না। তার সকল কর্মই সদর্থক হতে বাধ্য।

স্তব্ধ বা জড় ব্যক্তিকে শিক্ষাদানের ফলে যদি প্রত্যেক ফল লাভ নাও হয়, অর্থাৎ তার জড়তা দূর নাও হয়, তবু পরমেশ্বরের আদেশ সম্পাদন করাতে সেই যত্ন বিফল হয় না।

পরমেশ্বরের আরাধনা করাই স্বধর্ম। রাজা ঈশ্বরের আজ্ঞাক্রমে প্রজাগণের শাসনাদিরূপ নিজ ধর্ম পালন করলে, তাই হয় ভগবানের আরাধনা। এভাবেই তিনি পাপমুক্ত হতে পারেন।

হে আর্তবন্ধু! আমি নিজেকে রাজা বা প্রভু বলে অভিমান করে আপনাকে অবজ্ঞা করেছি। আপনার মতো মহাত্মা, সাধুপুরুষের প্রতি এমত অবমাননা, মত্ততারই নামান্তর মাত্র ব্যতীত আর কিছু নয়! হে মহৎ, আপনি আমার প্রতি দিব্যদৃষ্টি দান করুন। যার ফলে আমি সাধুপুরুষগণের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনজনিত মহাপাপ থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে পারি।

হে প্রভু, আপনি এই নিখিল জগতসংসারের সুহৃদ ও সখা। সুতরাং, সর্বত্র তুল্য দর্শন নিমিত্ত নিজ দেহেও আপনার কোনো আত্মাভিমান নেই। এর ফলে, আমি যে আপনার অপমান করেছি, তাতে আপনার কোন বিকার নেই। তবুও আমার ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তিরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, মহৎ ব্যক্তির প্রতি অবমাননার ফলে অতি শীঘ্র বিনষ্ট হয়।

.

ভাগবত পুরাণ (দুই)
পঞ্চম স্কন্ধ
একাদশ অধ্যায়
রহুগণের প্রতি জড়ভরতের জ্ঞানোপদেশ

জড়রূপী ভরত বললেন– হে মহারাজ, তুমি বিদ্বান লোক হয়েও অবিদ্বানের মতো কথা বলছ! এজন্য তুমি বিদ্বানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হতে পারো না। এই যে তুমি, প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ককে অর্থাৎ তাদের লৌকিক ব্যবহারকে সত্য বলছ, মনীষী ব্যক্তিগণ তত্ত্ব বিচারের সঙ্গে কখনও এরকম বলেন না। তত্ত্ববিচার না করলেই ব্যবহারও সত্য নয়। হে রাজন, গৃহস্থগণের জন্য যে সকল উত্তম যজ্ঞের বিধান রয়েছে, তাদের সুবিস্তৃত অনুষ্ঠান বিষয়ক বিদ্যাদির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল বেদ। সেই বেদবাক্য সমূহও প্রায়শই হিংসাদিশূন্য ও আসক্তিশুন্য এবং অযথার্থ, এখানে প্রায়শঃ বলার কারণ এই যে, বৈদিক কর্মবিদ সাধারণত হিংসাত্মক ও আসক্তিমূলক বলে শুভফল প্রদান না করলেও, হিংসাদিশূন্য যে সকল বৈদিক কর্ম ঈশ্বরে সমর্পিত হয়, তা পরমার্থ ফল দান করে।

যে ব্যক্তি বেদান্তবাক্য শ্রবণ করছেন, এরূপ পুরুষেরও বৈদিক কর্মে প্রবৃত্তি দেখা যায়। অতএব বৈদিক কর্মবাদ অযথার্থ হবে কেন? এই আশংকার উত্তরে দ্বিজবর ভরত বলছেন– স্বপ্নলব্ধ সুখ মিথ্যা বলে হেয় প্রতিপন্ন হয়। তেমনি স্বপ্ন দৃষ্টান্ত অনুসারে গৃহস্থগণের প্রাপ্য ঐহিক ও পারলৌকিক সুখমাত্রকেই যে ব্যক্তি হেয় বলে অনুমান করতে পারে না, প্রধান প্রধান বেদবাক্য সকলও সে ব্যক্তির যথার্থ তত্ত্বজ্ঞান উৎপাদনে সমর্থ হয় না। রহূগণ রাজা প্রপঞ্চ-বিশ্বকে সত্য বলে মনে করেন। ভরত তাকে খন্ডন করে বলছেন– জীবের সংসার–ভাবও মনের কার্য। অতএব তা সত্য নয়। জীবের মন যতকাল সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের বশীভূত থাকে, ততকাল সেই মন নিরঙ্কুশ হয়ে, জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের দ্বারা পুরুষের ধর্ম অথবা অধর্ম বিস্তার করে।

ধর্মাধর্ম বাসনাযুক্ত আত্মা অর্থাৎ মনই বিষয়ের সম্বন্ধেহেতু সত্ত্বাদি গুণ দ্বারা ইতস্ততঃ বলমান হয়ে কামাদি পরিণামযুক্ত হয়। ষোড়শ কলা অর্থাৎ পঞ্চভূত, জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, এবং মনের মধ্যে প্রধানতম হল মন।

সে ভিন্ন ভিন্ন নাম ও ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ পূর্বক সেই সেই দেহের উৎকৃষ্টত্ব ও নিকৃষ্টত্ব হেতু আত্মার উৎকৃষ্টত্ব বা নিকৃষ্টত্ব প্রকাশ করতে পারে। সংসার চক্রে প্রবঞ্চনাকারী এই মনই মায়ার দ্বারা জীবের উপাধির দেহ প্রভৃতি রচনা করে। মায়াই এই উপাধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দেহী অর্থাৎ জীবকে আলিঙ্গন করে কালপ্রাপ্ত সুখ, দুঃখ ও মোহরূপ দুর্নিবার ফল প্রদান করে।

যতদিন মন ও জীবের সম্বন্ধ বলবৎ থাকে, ততদিন সর্বদা জাগ্রৎ ও স্বপ্নরূপ ব্যবহার প্রকাশিত হয়ে ক্ষেত্রজ্ঞ জীবের প্রত্যক্ষ হয়। তত্ত্বজ্ঞগণ এই মনকেই জীবের নিগুণত্ব ও সগুণত্বরূপ উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট অবস্থার কারণ বলে বর্ণনা করে থাকেন।

হে রাজন, প্রাণীগণের গুণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হলে তা বিপদের কারণ হয়। প্রদীপ যখন ঘিয়ের সলতে দগ্ধ করে, তখন ধূমযুক্ত শিখা ধারণ করে, কিন্তু অন্য সময়ে অর্থাৎ ঘি নিঃশেষ হলে, তা স্বীয় পদ অর্থাৎ শুক্লতাই ধারণ করে থাকে। মনও তেমনি গুণকর্মের সম্বন্ধযুক্ত হয়ে বিভিন্ন বৃত্তি আশ্রয় করে, আবার গুণকর্মের সম্বন্ধ হতে মুক্ত হলে যথার্থতত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে।

হে বীর! মনের মোট বৃত্তি হল এগারো ধরনের। তার মধ্যে পাঁচটি ক্রিয়ারূপ, পাঁচটি জ্ঞানরূপ ও পাঁচটি অভিমান রূপ। তার মধ্যে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের গন্ধাদি অর্থাৎ গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ ও শব্দ ইত্যাদি পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়ের বিসর্গাদি অর্থাৎ বাক্যোচ্চারণ, গ্রহণ, গমন, মলমূত্রাদি ত্যাগ ও আনন্দ উৎপাদন ইত্যাদি পঞ্চ এবং অভিমানের (দেহ গেহাদি) এক– এই একাদশটি যথাক্রমে একাদশ প্রকার বৃত্তির বিষয়।

বুদ্ধিবৃত্তির বিষয় নির্ণীত হয় পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় অর্থাৎ গন্ধ, রূপ, স্পর্শ, রস ও শব্দের দ্বারা। তেমনভাবে, মলমূত্রাদি ত্যাগ, রতি, গমন, বাক্যোচ্চারণ ও গ্রহণমূলক শিল্প সাহায্য কর্মকার বৃত্তির বিষয় হয়। একাদশ স্থানীয় দেহটি –‘এটি আমার’ –এই স্বীকৃতিহেতু অভিমানের বিষয়রূপে জ্ঞাতব্য। কোনও কোনও ব্যক্তি দেহকে বিবেকীগণের অভিমানের বিষয় বলে থাকেন, মূঢ়দের নয়। তারা বলে থাকেন, যে মূঢ়গণের অহংকার নামক দ্বাদশতম বৃত্তিটি শয্যা নাম গ্রহণ করে অহংকারের বিষয় হয়।

শরীরের অপর নাম হল পুর। তাতে জীব অহংকার দ্বারা শয়ন করাতে পুরুষ বলে পরিচিত হন। এজন্য জীবের শয্যারূপ দেহকে অহংকারের আশ্রয় বলে। উক্ত একাদশ বৃত্তিই মনের বিকারমাত্র। পরমেশ্বরের শক্তি অনন্ত। দ্রব্য, স্বভাব, সংস্কার, কর্ম ও কাল অনুযায়ী ঐ একাদশ বৃত্তিই শত, সহস্র, বা কোটি প্রকারের হয়ে থাকে। পারস্পরিক সহযোগিতায় বা নিজ থেকে তা হয় না।

মন অর্থাৎ মায়া রচিত জীব, অর্থাৎ অবিশুদ্ধ কর্তা, ঐ বৃত্তিসকল তার বিভূতি। ঐ সকল প্রবাহরূপে অবিচ্ছিন্ন। কখনও জাগ্রত, কখনও স্বপ্নবস্থায় তাদের আবির্ভাব ঘটে। কখনও বা সুষুপ্তি অবস্থায় তিরোহিত থাকে। ক্ষেত্রজ্ঞ আত্মা সাক্ষী এ কারণ সকল অবস্থাতেই ঐ সকলকে দেখতে পান।

মহারাজ, ক্ষেত্রজ্ঞ দুই, এক মুত্মদশব্দবাচ্য জীব, দ্বিতীয়টি তৎপদার্থের প্রতিপাদ্য, ঈশ্বর উভয়ের মধ্যে জীবের স্বরূপ পূর্বেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখন দ্বিতীয় ঈশ্বরের স্বরূপ বর্ণনা করা হচ্ছে।

ক্ষেত্রজ্ঞ ঈশ্বর সর্বব্যাপী। তিনি জগৎ সংসারের আদি কারণ। তিনি পরিপূর্ণ স্বরূপ, অপরোক্ষ এবং স্বয়ং জ্যোতির্ময় বস্তু। তিনি স্বয়ম্ভু। তিনি ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবগণের অধিপতি, ষড়ৈশ্বর্যশালী বাসুদেব এবং সর্বজীবের আশ্রয়। তিনি স্ব-অধীনস্থ মায়ার সাহায্যে সর্বজীবের নিয়ামকরূপে তাঁদের আত্মমধ্যে বিরাজ করেন। সর্বব্যাপী বয়ে প্রাণরূপে স্থাবর-জঙ্গম প্রতিটি পদার্থমধ্যে প্রবেশ করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। তেমনি ক্ষেত্রজ্ঞ আত্মা পরমপুরুষ ভগবান বাসুদেব এই জগতমধ্যে অনুপ্রবেশ করে সকলের নিয়ন্ত্রণকর্তা রূপে বিরাজ করছেন।

হে মহারাজ, যতদিন পর্যন্ত জীবসকলের জ্ঞানের উন্মেষ না ঘটে, যতদিন পর্যন্ত এই মায়া দূরীভূত না হয়, ততদিন সে সংসারচক্রে আবর্তিত হয়। যখন সে সর্বসঙ্গবিমুক্ত হয় ও ষড়রিপু জয় করতে সক্ষম হয়, তখনই সে এই জগতসংসার থেকে মুক্তিলাভ করে। এই মনই শোক, মোহ, রোগ, আসক্তি, লোভ, শত্রুতা ও মমতার জন্ম দেয়। এই মনই আত্মার উপাধিরূপে বর্তমান থেকে জীবের সংসারতাপের ক্ষেত্ররূপ পরিগণিত হয়। যতদিন না জীবের এই আত্মোপলব্ধি হয়, ততদিন তাকে এই জগতসমুদ্রে বাস করতে হয়।

হে রাজন, এই মনরূপ শত্ৰু স্বভাবতই অতিশয় বীর্যশীল। বিশেষতঃ উপেক্ষা করলে আরও প্রবল হয়। বস্তুতঃ সে স্বয়ং মিথ্যা পদার্থ হয়েও আত্মা হরণকারী।

অতএব, সতর্কভাবে গুরুরূপী ভগবান শ্রীহরির চরণ আরাধনারূপ অস্ত্রের সাহায্যে এই মনরূপী বৈরীকে তুমি নিজেই বিনাশ করো।

.

দ্বাদশ অধ্যায়
রহুগণের সংশয় নিরসন

রহূগণ বললেন– হে যোগেশ্বর, আপনাকে প্রণাম করি। কেবলমাত্র লোকগণের রক্ষার্থে দেহধারণ করেও পরমানন্দময় নিজস্বরূপ প্রকাশ করার জন্য দেহকে তুচ্ছ জ্ঞান করছেন।

আপনি নিজের অগাধ নিত্যজ্ঞানকে প্রচ্ছন্ন রেখে নিন্দিত ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করেছেন। আপনি মহান, তাই আপনি নিশ্চয়ই আমায় অজ্ঞানতা ক্ষমা করবেন। হে ব্রাহ্মণ, এই কুৎসিত দেহ-বিষয়ক অহংকাররূপ সর্প আমায় বিশেষভাবে দংশন করছে। এ অবস্থায় আপনার এই বাক্য আমার কাছে অমৃতবৎ মহৌষধ। প্রখর গ্রীষ্মে সন্তপ্ত তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি যেমন সুশীতল জলে স্নিগ্ধ হয়, তেমনি আপনার বাক্য শ্রবণ করে, আমার অন্তরাত্মাও তৃপ্ত হয়েছে।

হে ব্রাহ্মণ, যে যে বিষয়ে আমার সংশয় বর্তমান, তা পরে আপনাকে জিজ্ঞাসা করব।

হে প্রভু, আপনি অধ্যাত্মযোগ বিস্তার করে যে বাক্যসমূহ বললেন, তা অমৃতবৎ হলেও অতি দুর্বোধ্য।

আমি বিশেষভাবে তা বুঝতে পারিনি। আপনি সরলভাবে এগুলি ব্যাখ্যা করুন। যাতে আমার কাছে তার মর্মার্থ সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়, এই বিষয়ের নিমিত্ত আমার হৃদয় অতিশয় কৌতূহলী হয়ে উঠছে।

হে যোগেশ্বর, ভার বহন প্রভৃতি ক্রিয়া এবং তার ফল পরিশ্রম সাধারণভাবে বাস্তব ব্যবহারের তোরণরূপে দৃষ্ট হয়। কিন্তু, আপনি ঐ সকলকে তত্ত্ববিচারের অযোগ্য অর্থাৎ অবাস্তব বলছেন– এতে আমার মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

দ্বিজবর ভরত বললেন– হে রাজন, পৃথিবীর বিকারস্বরূপ এই পদার্থ অর্থাৎ শরীরটি কোনও কারণে চলমান হলেই সে ভারবাহক বলে পরিচিত হয়। যে সকল পদার্থ পৃথিবীতে চলনশীল নয় তাদেরকে জড় বস্তু বলা হয়।

উভয়ের মধ্যে শুধুমাত্র এটুকু ভেদ দেখা যায়।

এই ভারবহনের কারণে শরীরের পরিশ্রম দেখা গেলেও, জড় বলে পাষাণাদির ভারবোধ বা পরিশ্রম নেই।

আবার বাস্তব বিচার করে দেখা যায়, এই শরীরটিরও দুটি পায়ের উপরে গুল্ফ, জঙঘা, জানু, ঊরুভাগ, মধ্যদেশ, বক্ষঃস্থল, গ্রীবা ও স্কন্ধ- এই সকল অবয়ব বর্তমান। এদের বাদ দিয়ে পরিশ্রমের আশ্রমরূপে কোনো অবয়বী পদার্থ পাওয়া যায় না। সুতরাং পরিশ্রম কার উপর প্রযোজ্য হবে, তাই সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয় না।

জড়ভরতরূপী ব্রাহ্মণ বলতে লাগলেন– এভাবে আমাদের স্কন্ধে যে শিবিকা বাহিত হচ্ছে, তা শুধুমাত্র কতগুলি অবয়বের সমষ্টি এই অবয়বগুলিকে বাদ দিয়ে সেখানে কোনও ভিন্ন অবয়বী পদার্থের সত্তা অনুভূত হয় না।

এই শিবিকামধ্যে ‘সৌরীররাজ’ –এই নাম–মাত্র ধারণ করে যে পদ অর্থাৎ শরীরটি উপবিষ্ট রয়েছে তা পৃথিবীরই বিকারমাত্র।

তুমি অকারণে গর্বভরে অন্ধ হয়ে এই শরীরকেই আত্মা বলে মনে করছ।

‘আমি সিন্ধুদেশের রাজা’- এই অভিমানে বদ্ধ হয়েছ। প্রকৃতপক্ষে এই শরীররূপী তোমার মধ্যেও কোনোও অবয়বী পদার্থ উপলব্ধি হয় না।

তুমি বিনা বেতনে এই বাহকদের দিয়ে কষ্টসাধ্য কাজ করিয়ে নিচ্ছ। এতে তুমি যে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে চলেছ– এর পরে জনগণের রক্ষক হিসেবে তোমার আত্মশ্লাঘার কোনও অবকাশ নেই।

বস্তুতঃ তুমি অতি ধৃষ্ট। তোমার কোনো লাজ নেই। মহৎ ব্যক্তিগণের সভায় তোমার কোনও স্থান নেই।

হে রাজন, এই পৃথিবী থেকেই সকল চরাচর পদার্থের উৎপত্তি হয়। এই পৃথিবীতেই তাদের লয় ঘটে। সেহেতু পৃথিবী ভিন্ন ঘট প্রভৃতি অন্য কোনও বিকার পদার্থ না থাকায়, ঘট প্রভৃতি পদার্থের ব্যবহারের কারণ।

ঘট প্রভৃতি পদার্থ কেবলমাত্র জল আনয়ন প্রভৃতি ক্রিয়া দ্বারাই সৎ বলে অনুমান করা হয়, এটা তুমি অনুধাবন কর।

বস্তুতঃ মৃত্তিকা ব্যতিরেকে ঘট প্রভৃতির কোনো সত্তা থাকে না। এজন্য ব্যবহার ক্ষেত্রে ঘটাদিকে ‘সৎ’ বললেও, তা সৎ নয়।

এভাবে পৃথিবীও বিনাশকালে নিজ আকার স্বরূপ সূক্ষ্ম পরমাণু সমূহের মধ্যে লয় প্রাপ্ত হয় বলে, পরমাণু ব্যতীত পৃথিবী শব্দবাচ্য দৃশ্য পদার্থটির কোনো সত্তা নেই।

‘তাহলে পরমাণু-সমূহকে সত্য বলা হোক’– এই কথার উত্তরে বলছেন, যাদের সমষ্টি দ্বারা পৃথিব্যাদি এক একটি স্কুল পদার্থের সৃষ্টি হয়েছে, এই পরমাণু নামক সূক্ষ্ম পদার্থ।

যদিও তারা অদৃশ্য, তবুও তাদের স্বীকার না করলে পৃথিবী প্রভৃতি স্কুল কার্য পদার্থ সিদ্ধ হয় না বলেই বৈশেষিক প্রভৃতি বাদিগণ মন দিয়েই ওদের কল্পনা করেছেন।

বস্তুতঃ প্রপঞ্চ ভগবানের মায়ার বিলাসমাত্র বলে, পরমাণুসমূহও অজ্ঞানেরই কল্পনামাত্র, কিন্তু সত্য নয়।

হে রাজ, আত্মাতে কখন হ্রস্ব, কখন দীর্ঘ, কখন সূক্ষ্ম, কখন স্থূল করতে হয় তা সম্যক জ্ঞাত হতে হবে। ধর্ম দর্শনের ফলে যে দ্বৈত প্রতীয়মান হয়, তাও মিথ্যা। সবই মায়ার প্রভাব বলে জ্ঞান করবে।

এই মায়াই দ্রব্য, স্বভাব, কাল, আশয়, কর্ম ইত্যাদি বিবিধ নাম দ্বারা উপলক্ষিত হয়।

‘তাহলে সত্য বস্তু কি’–এই প্রশ্নের উত্তরে তৃষ্ণা বলছেন। প্রকৃত পরমার্থ সত্য বস্তু হল জ্ঞান। তা বিশুদ্ধ, এক–স্বরূপ, বাহ্যাভ্যন্তর–রহিত, পরিপূর্ণ, বিষয়াকারে অপরিণত ও নির্বিকার, ঐশ্বর্যাদি ষড়গুণবিশিষ্ট এই জ্ঞানকেই ভগবান বলা হয়।

তাকেই পণ্ডিতগণ বাসুদেব বলে থাকেন।

হে রহূগণ, মহাপুরুষদের চরণকমলরেণু দ্বারা নিজেকে অভিষিক্ত না করলে, কোনও লোকই তপস্যা, বৈদিক যজ্ঞাদি কর্ম, অন্নাদি বিতরণ, গৃহস্থােচিত পরোপকার, বেদ অভ্যাস কিংবা জল, অগ্নি ও সূর্য-উপাসনা দ্বারা এই জ্ঞান লাভ করতে পারে না।

হে নরেন্দ্র, সাধু ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বদা ভগবাদ উত্তমশ্লোকের গুণানুবাদেরই প্রস্তাব হয়ে থাকে, ওতে গ্রাম্যকথার সম্পর্কমাত্র নেই। সেই ভগবানের গুণকথন নিরন্তর সাদরে শ্রুত হলে, তাই ভগবান বাসুদেবের প্রতি মুমুক্ষুগণের সবুদ্ধি প্রদান করে।

হে রাজন, আমি পূর্বজন্মে রাজা ছিলাম। আমার নাম ছিল ভরত। মহৎ দর্শন ও শ্রবণের ফলে বন্ধনমুক্তির উদ্দেশ্যে ভগবানের আরাধনা করতাম।

পরে দৈববশত একটা মৃগের প্রতি আসক্ত হই। ফলে তার পরজন্মে আমার মৃগজন্মে শ্রীকৃষ্ণ সাধনার ফলে স্মৃতি অটুট ছিল। এজন্মেও আমি জনসঙ্গ থেকে ভীত হয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে আত্মগোপন করে পর্যটন করছি।

যেকোনো মানব ইহলোকেই নিঃসঙ্গ মহাপুরুষদের উত্তম সঙ্গ থেকে উৎপন্ন জ্ঞানের দ্বারাই মোহবন্ধন ছিন্ন করতে সক্ষম হতে পারে।

শ্রীহরির পুণ্যচরিত কথা একা ও কীর্তন করে যে স্মৃতিলাভ করা সম্ভব, তাতেও সংসার অতিক্রম করে শ্রীহরিকে লাভ করা সম্ভবপর হয়।

মহৎসঙ্গেই ভগবানের কর্মসকল দৃষ্ট ও শ্রুত হয়, তার ফলেই স্মৃতিলাভ হয়ে থাকে।       

.

এয়োদশ অধ্যায়
ভরত কর্তৃক ভটাটবী বর্ণনা

জড়রূপী ভরত বললেন– হে রাজন, বণিকের দল অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে নানা স্থান ভ্রমণ করতে করতে বনের মধ্যে উপস্থিত হলে নানা বিপত্তি ভোগ করতে বাধ্য হয়।

তেমনি জীবেরাও সুখের আশায় মায়াচালিত হয়ে দুস্তর সংসারে প্রক্ষিপ্ত হয়। সেখানে রজঃ ও সত্ত্বগুণের দ্বারা বিভক্ত কর্ম সমূহকে কর্তব্যরূপে জ্ঞান করে ভ্রমণকালে সংসার অরণ্যে উপস্থিত হয়। কিন্তু সেখানে কোনওরূপ সুখ লভ্য হয় না বরং বিপদগ্রস্ত হয়।

হে নরদেব, এই জগত–অরণ্যে ছয়টি দুর্দান্ত দস্যু আছে। তারা ইন্দ্রিয়রূপে কথিত হয়।

তারা ঐ বণিকস্বার্থের নায়ককে কুৎসিত বিবেচনা করে বা অযোগ্য দেখে বণিক দলের ধর্মার্জিত ধনরাশি লুণ্ঠন করতে প্রবৃত্ত হয়। সেখানে বহুসংখ্যক দারা–অপত্যাদি রূপ শৃগাল আছে, যারা বণিকদলের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের হরণ করে নিয়ে যায়।

ঐ বনে প্রচুর তৃণলতা ও গুন্মাচ্ছাদিত অতি দুর্গম গহুর আছে।

বণিকদল সেখানে উপস্থিত হয়ে তীব্র দংশন মশক দ্বারা উৎপীড়িত হয়। তারা অরণ্যমধ্যেই কোথাও গন্ধর্বপুর দেখতে পায়, আবার কোনো অতিশয় বেগবান উন্মুকাকার গ্রহ দেখে সুবর্ণ বোধ করে তার প্রতি পরম লোভনীয় দৃষ্টিতে অবলোকন করে তার জন্য স্পৃহা অনুভব করে।

কোনো স্থানে নিবাসস্থান, জল ও ধনের প্রতি মমতা পরবশ হয়ে তারা বনের মধ্যে ধাবিত হয়। যখন চক্রাকার বায়ুবেগে উত্থিত ধুলিরাশিতে দিকসকল সমাচ্ছন্ন হয়, তখন তাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়।

ঐ বনমধ্যে কোনস্থানে ঝিল্লীর কঠোর ধ্বনিতে তাদের কর্ণপীড়া উপস্থিত হয়।

কোথাও বা পেচকের কুৎসিত ডাকে তাদের অন্তরে ব্যথার উদ্রেক হয়।

ঐ বণিকেরা যখন ক্ষিপ্র হয় ক্ষুধার্থ হয়, তখন তারা অপুণ্য বৃক্ষ সকলকে আশ্রয় করে। কোথাও বা মরীচিকা দর্শন করে, পিপাসার্ত হয়ে জলপানের জন্য সেদিকেই ধাবিত হয়।

তারা কোনস্থান জলহীন নদীর দিকে ধাবিত হয়। সেখানে পতিত হলে, জললাভ অপেক্ষা অর্থ হানির সম্ভাবনা যে বেশি, এ বিষয়ে তারা অবহিত থাকে না। কখনও তারা নিরন্ন হয়ে পরস্পরের কাছে অন্নাদি যাজ্ঞা করে, কখনও তারা দাবানলে পতিত হয় অগ্নিদগ্ধ হয়। কখনও যক্ষগণ তাদের মত রাজাদির দ্বারা প্রাণতুল্য ধন হরণ করার ফলে খেদগ্রস্ত হয়ে থাকে। কখনও বা বলবান ব্যক্তিগণ সর্বস্ব হরণ করলে তারা বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। সেজন্য শোক করতে মুছিত হয়ে পড়ে। কোথাও বা গন্ধর্বপুরে প্রবেশ করে পিতৃ পুত্রাদির সমাগমে মুহূর্তকাল আমোদ– প্রমোদে মত্ত হয়।

কখনও তারা পর্বতারোহণের জন্য পথ চলতে গিয়ে কন্টক ও শর্করাবিদ্ধ হলে বিক্ষুব্ধ হয়। বহু পোষ্যযুক্ত কোনও ব্যক্তি জঠরাগ্নির জ্বালায় পীড়িত হয়ে ক্ষণে ক্ষণে অপরের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করে।

হে রাজন, ঐ অরণ্যমধ্যে কোনও স্থানে, কোনও সময়, কোনও কোনও ব্যক্তি নিদ্রারূপ সর্প দ্বারা গিলিত হয়ে পরিত্যক্ত শবের ন্যায় পতিত থাকে। কখনও বা হিংস্র জন্তুরা তাদের দংশন করে। তখন তারা অন্ধ হয়ে অন্ধকূপে পড়ে অন্ধকারে নিমগ্ন হয়। কেউ কেউ ক্ষুদ্ররস অম্বেষণার্থে কারও কাছে। অবজ্ঞাত হয়ে অতিশয় ব্যথিত হয়। যদি কখনও অতি কষ্টে ঐ বিষয়ে মান লভ্য হয় অর্থাৎ ক্ষুদ্ররস লভ্য হয়, তবু তা ভোগ করতে পারে না। অপর কোনও ব্যক্তি এসে বা বলপূর্বক অপহরণ করে নেয়।

ঐ অরণ্যমধ্যে তারা শীত, তাপ, রৌদ্র, প্রবল বায়ু ও বর্ষার প্রতিকার করতে সমর্থ হয় না। কখনও প্রবঞ্চনা করতে গিয়ে অপরের বিরাগভাজন হয়ে থাকেন। কখনও নিজ ধন ক্ষয় হলে অপরের কাছে তা প্রার্থনা করে অপমানিত হয়। সেই অরণ্যপথে তারা পরস্পর ধন সম্পত্তির বিনিময় করতে গিয়ে চিরকালের জন্য প্রবল শত্রুতার সৃষ্টি হলেও পরস্পর বিবাহাদি সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়। এই অরণ্যপথে চলতে গিয়ে তারা বহু কষ্ট, শ্রম, অর্থহানি ও বিদ্বেষাদি উপসর্গের ফলে মৃতবৎ হয়ে পড়ে।

হে বীর, সেই সেই বিপন্ন অর্থাৎ মৃত ব্যক্তিদের পরিত্যাগ করে নূতন ব্যক্তিদের গ্রহণ করে যারা পথ চলতে শুরু করেছিল, তন্মধ্যে কোনও সমর্থ ব্যক্তিও অদ্যাবধি পূর্বস্থানে ফিরে আসেনি।

আর ঐ বণিক–স্বার্থ মধ্যে কোনো ব্যক্তি অদ্যাবধি ঐ পথের পরেও পায়নি। অর্থাৎ কেউ এখনও সেই পথের ধারে যাবার উপায়স্বরূপ ভক্তি বা জ্ঞানযোগ লাভ করতে পারেনি।

হে রাজন, যে ব্যক্তিগণ শূর এবং দিহস্তি সকলের জয়কারী, তারাও অভিমান বশত ঐ ভটাটবীতে আত্মাধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে পরস্পর বৈরীভাবাপন্ন হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে শায়িত হয়।

কিন্তু এতে তারা শ্রীভগবানের পরমপদ লাভ করতে পারে না।

হে রাজন, ভটাটবী ভ্রমণকারী জনগণের আরও বৃত্তান্ত তোমাকে বলছি- শ্রবণ করো।

কোনও কোনও ব্যক্তি লতাশাখা স্বরূপ স্ত্রীগণের বাহুকে আশ্রয় করে তথাস্থিত পক্ষীরূপ অপত্যাদির কলভাষণ শ্রবণার্থে সম্পৃক্ত হয়ে সেখানে আসক্ত হয়। কোনো স্থানে কখনও কখনও সিংহারূপ ভয়ানক কালচক্র থেকে ভীত হয়ে কঙ্ক, গৃধ্রু, বক প্রভৃতির সঙ্গে সখ্যতা করে। তারা

প্রবঞ্চনা কালে সেই বণিকগণ হংসের দলে প্রবেশ করে।

কিন্তু, সেখানে আচারে অরুচি হলে, বানরগণের কাছে অর্থাৎ ভ্রষ্টাচারী শূদ্রগণের কাছে গমন করে। সেখানে বানরোচিত ক্রিয়ার ইন্দ্রিয়সুখ প্রাপ্ত হলে পরস্পরের মুখ সন্দর্শনেই তৃপ্তি লাভ করে। তখন তারা অন্তিম কাল বা মৃত্যুকালের কথা বিস্মৃত হয়।

কখনও বা ব্যক্তিগণ কেবল বৈষয়িক প্রয়োজনে গৃহাদিস্বরূপ বিষয়ে প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। তখন স্ত্রী-পুত্রের প্রতি বাৎসল্যযুক্ত ও সম্ভোগ ইচ্ছায় অতি কাতর হয়। নিজবন্ধনে বিবশ হয়ে কখনও তা ত্যাগ করতে সমর্থ হয় না। কোনো সময় অসাবধানতা বশতঃ রোগাদি– দুঃখরূপ পর্বত গহ্বরে পতিত হয়। সেখানে হস্তীরূপ মৃত্যুভয় লতা অর্থাৎ পূর্বকৰ্ম অবলম্বন করে অবস্থান করে। কোনোভাবে সেই বিপদ থেকে মুক্তি পেলে আবার নিজের দলেই অর্থাৎ প্রভৃত্তিমার্গে প্রবেশ করে। হে অরিন্দম, মায়া কর্তৃক এই অরণ্যপথে প্রেরিত হয়ে সেখানে ভ্রমণরত কোনও ব্যক্তিই অদ্যাবধি যথার্থ তত্ত্বজ্ঞান অবগত হতে পারেনি।

হে রহূগণ, তুমিও মায়ার পরিচালনায় এই সংসার অরণ্যে প্রবেশ করেছ। অতএব সম্প্রতি অহিংস ভাবে সকল প্রাণীর প্রতি মিত্রসুলভ মনোভাব পোষণ কর। নিরাসক্ত মনে ভগবান শ্রীহরির সেবার মাধ্যমে লব্ধ তীক্ষ্মীকৃত জ্ঞানরূপ … ধারণ করে, এই ভাবারণ্য অতিক্রম করো।

রাজা রহূগণ বললেন– অহহ! সকল জন্মের মধ্যে এই মানবজন্মই শ্রেষ্ঠ! স্বর্গলোকে দেবতাদিরূপ অপরাপর শ্রেষ্ঠ। জন্মেরই বা কি প্রয়োজন? কারণ– ভগবান হৃষীকেশের যশ– শ্রবণে বিশুদ্ধচিত্ত মহাপুরুষদের সঙ্গলাভ স্বর্গে সম্ভব হয় না।

হে ব্ৰহ্মণ, আপনার পাদপথ রেণুর নিরন্তর সেবার দ্বারা যার পাপ বিনষ্ট হয়েছে, তার যে ভগবান হরির প্রতি বিশুদ্ধ ভক্তির উদয় হবে–তা বিচিত্র নয়। যেহেতু, মুহূর্তকাল আপনার সঙ্গলাভের ফলে আমার কুতর্কদ্বারা বদ্ধমূল অবিবেক দূরীভূত হয়েছে। ক্রীড়ারত বালক থেকে শুরু করে সকল মহৎ ব্যক্তিগণ, শিশু ও যুবকগণকে প্রণাম করে যাঁরা অবধূত বেশে পৃথিবী বিচরণ করছেন, সেই ব্রাহ্মণগণকে আমি প্রণাম করি। তাদের করুণাঘন অনুগ্রহে রাজাগণের সার্বিক কল্যাণ হোক!

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে উত্তরানন্দন পরীক্ষিৎ ব্রহ্মর্ষির পুত্র মহাপ্রভাবশালী ভরত নিজ অপমান অগ্রাহ্য করে, সিন্ধুদেশাধিপতি রহূগণকে আত্মতত্ত্ব উপদেশ করলেন। রহূগণ কাতরভাবে তার পাবন্দনা করলেন।

অনন্তর ভরত আবার এই পৃথিবীতে ভ্রমণ করতে লাগলেন। সেসময় পরিপূর্ণ সাগরের ন্যায় তার চিত্তের ইন্দ্রিয়জাত বৃত্তিসমূহ সম্পূর্ণভাবে শান্ত ছিল। হে রাজ। সৌরীররাজ রহূগণও মহামতি ভরতের কাছে থেকে পরমাত্মার তত্ত্ব অবগত হয়ে তখনই অবিদ্যা কর্তৃক আরোপিত দেহাত্ম বুদ্ধি পরিত্যাগ করেছিলেন। ভগবানের আশ্রিত মহাপুরুষের চরণাশ্রিত ব্যক্তির প্রভাব এরূপ।

মহারাজ পরীক্ষিত এতক্ষণ নিবিষ্ট মনে শুকদেবের কথা শ্রবণ করছিলেন।

তিনি এক্ষণে বললেন– হে ভাগবতোত্তম, আপনি বহুজ্ঞ। পরোক্ষ বচনের দ্বারা অর্থাৎ রূপকের মাধ্যমে আপনি জীবলোকের সংসার পথের বর্ণনা করলেন। কিন্তু, একমাত্র বিবেকজ্ঞানসম্পন্ন র্যক্তিগণের পক্ষেই তার বিষয়সমূহ কল্পনা করা সম্ভবপর। কিন্তু, অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পক্ষে তার বিষয়বস্তু নিরূপণ করা সম্ভবপর হয় না। অতএব, এই প্রার্থনা করি, আপনি দয়া করে তার অনুরূপ অর্থ কল্পনা করে ব্যাখ্যা করুন।

.

চতুর্দশ অধ্যায়
ভটাটবীর প্রকৃতার্থ কথন

শ্ৰী শুকদেব বললেন– পর্বে এই যে বলেছি, দুর্গম বত্মে মায়ার দ্বারা সংস্থাপিত বণিকসমূহ, তার অর্থ এই যে, এই সংসার বাটীতে জীবগণ অথোপার্জনরত বণিকদের মতো তারা ভগবানের মায়ায় শ্মশানসদৃশ অকল্যাণদায়ক সংসার অরণ্যে পতিত হয়েছে।

অতএব, গুরুরূপী যে ভগবান শ্রীহরি তার চরণপদ্মের মকরন্দ দেবী সেবকদের পদবী অর্থাৎ ভাগবতজনের অনুষ্ঠিত ভক্তিমার্গ এখনও একটি প্রাপ্ত হচ্ছে না সংসার–মার্গ সুগম নয়, যে সকল ব্যক্তি দেহে আত্মাভিমান করে, তার সত্তাদি বিশেষ গুণ দ্বারা বিভক্ত কর্মাদি কুশল অকুশল ও উভয় মিশ্রিত হয়। তাতে বিবিধ দেহাবলি নির্মিত হওয়ায়, তার দ্বারা সংযোগ বিয়োগাদি রূপ অনাদি সংসার হয়।

সেই সংসার অনুভূতির ছটি দ্বার হল ছয়টি ইন্দ্রিয়। তার ফলে ঐ সংসার মার্গ, দুর্গম মার্গের মতো অতি ক্লেশকর গম্য হয়েছে।

হে রাজন, ঐ দুর্গম পথের কেউই পথ চলতে প্রবৃত্ত হবে না, এমন নয়। ভগবান বিষ্ণুর মায়ায় মুগ্ধ হয়ে সবাই তাতে প্রেরিত হয়, স্ব স্ব দেহদ্বারা নিম্পাদিত কর্মের ফল ভোগ করে। কোনোসময়ে তাদের চেষ্টা সফল হয়, কখনও বহুবিধ বিঘ্ন দ্বারা বিফল হয়। হে রাজ, ঐ ভটাটবীতে যে বিভিন্ন রকম তাপ আছে, ভগবৎ চরণসেবীদের পদবী তার বিনাশ করতে অক্ষম নয়। কিন্তু, স্বয়ং শ্রীহরির মায়াপ্রভাবে জীবলোকে তা সহজলভ্য হতে পারে না।

এই সংসার অরণ্যে ইন্দ্রিয় নামে পরিচিত চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মন–এই ছয়টি দস্যুর মতো কর্ম করে বলে, এদের দস্যু বলা হয়। তস্করগণ বনমধ্যে কুনায়ক বণিকদের ধন লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত হয়। ইন্দ্রিয়গণ তেমনি দস্যুর মতো, অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিগণের বহু কষ্টার্জিত ও পারলৌকিক কর্মের উপযোগী ধনাদি হরণ করে।

এই সংসাররূপ অরণ্যে স্ত্রী-পুত্রাদি প্রভৃতি পোষ্যবৰ্গই প্রকৃত পক্ষে নেকড়ে বাঘ ও শৃগাল তুল্য, এরাই অভিলোভী গৃহস্থের মেষশাবকের মতো সযত্নরক্ষিত বস্তু বলপূর্বক লুণ্ঠন করে।

এই ভটাটবীর মধ্যে প্রচুর তৃণ গুল্মচ্ছাদিত দুর্গম গহ্বর আছে,বলতে এটাই বোঝান হয়েছে যে শস্যক্ষেত্র প্রতি বছর কর্ষণ করলেও তার মধ্যে অবস্থিত তৃণাদির বীজ দগ্ধ হয় না। ফলে শস্য বপনের পর ঐ ক্ষেত্রটি গুল্ম, তৃণ ও লতায় আচ্ছন্ন হয়ে গহ্বরের মতো দেখায়। সে রকম, গৃহাশ্রমও কর্মক্ষেত্র বলে, এখানে কর্মসমূহ একেবারে উচ্ছেদ হয় না, কারণ, এই গৃহাশ্রমই হল সকল কামনার আধারস্বরূপ।

পাত্রস্থিত কর্পূরের ক্ষয় হলেও যেমন পাত্রে তার গন্ধ থেকে যায়, তেমনি এই গৃহাশ্রমেও বাসনার ক্ষয় হয় না। তাই কর্মপ্রবাহ অক্ষুণ্ণ থাকে। এই গৃহাশ্রমে যে পুরুষ রত হয়, তার বহিঃপ্রাণ অর্থাৎ ধনসম্পত্তি দংশ মশকতুল্য নীচ ব্যক্তির এবং শলভ, শহন্ত, তস্কর, মৃষিক দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই সংসারপথে চলতে গিয়ে মানুষের মন অজ্ঞানমূলক কামনা ও কর্ম দ্বারা রঞ্জিত হয়। তখন সেই অবাস্তব দৃষ্টিধারী ব্যক্তি গন্ধর্ব নগরের মতো অঘটমান অর্থাৎ বাস্তব সত্তাহীন নরলোককে সত্য বলে দর্শন করে। আবার, কোনও স্থানে পান, ভোজন ও স্ত্রী–সঙ্গাদি কাম– মূলক দোষে লোলুপ হয়ে মৃগতৃষ্ণার জলতুল্য বিষয়াদির প্রতি ধাবিত হয়।

‘কোনও কোনও স্থানে উন্মুখাকার গ্রহ দেখে, তা উপাদেয় সুবর্ণ বোধে তার জন্য সম্পূহ হয়’–এই কথার মর্মার্থ এই যে, জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো পিশাচ যখন অরণ্যপথে বিচরণ করে, তখন শীতার্ত ব্যক্তি অগ্নি ভ্রমে তার কাছে গমন করে।

তেমনি রক্তাভ রজঃগুণের দ্বারা পুরুষের বুদ্ধি সুবর্ণের জন্য প্রলোভিত হলে, সেই সকল দোষের আশ্রয় ও অগ্নির বিষ্ঠারূপ সুবর্ণ লাভ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু ঐ বস্তু অশেষ দোষের আস্পদ। অপবিত্র কারণ শ্রুতি অনুসারে অগ্নির পুরীকে পুরুষের তার প্রতি ধাবিত হবার কারণ, এই যে স্বর্ণতুল্য লোহিতবর্ণ রজঃগুণ, তার চিত্তকে অভিভূত করে ফেলে।

নিবাস, জন, ধন– ইত্যাদির তাৎপর্য এই যে কখনও বা মানুষ বাসস্থান, জল ও ধন প্রভৃতি নানাপ্রকার দ্রব্যে আসক্ত হয়ে সংসারে বিচরণ করে।

আবার ‘রজঃব্যাপ্ত নেত্র হওয়ার কারণে বায়ুতে উথিত ধূলিকণার ধূম্ৰাদিক দর্শনে অক্ষম হয়’ এই কথার অর্থ– চক্রাকারে প্রবাহিত ঘূর্ণীবার্তা মানুষকে বেষ্টন করে তার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে। এই সংসারেই তেমনি কোনও নারী পুরুষকে নিজে ক্রোড়ে আরোহণ করালে, সে তৎকালীন অনুরাগে তমোময় হয়ে পড়ে। অর্থাৎ মাঝে মাঝে অন্ধ হয়ে সর্বপ্রকার মর্যাদা লঙঘন করে। রাত্রিকালীন ন্যায় দিদেবতাগণ তার অপকর্মের সাক্ষীস্বরূপ হয়ে বর্তমান থাকলেও ধূলিতে সমাচ্ছন্ন দৃষ্টি ব্যক্তির মতো সে তা জানতে পারে না।

কোন স্থানে সূর্যকিরণে জল রোধ করে, তার প্রতি ধাবমান হয়– ইত্যাদি যা বলেছি, তার অর্থ –সংসার মাঝে জীব কখনও কখনও বিষয় সমূহকে ব্যর্থ বলে নিশ্চিত করে জানলেও দেহাভিমানের কারণে অবিলম্বে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়। তখন মৃগতৃষ্ণ তার জল তুল্য সেই বিষয় সকলের জন্যই আবার কাতর হয়।

মহারাজ, কোন কোন স্থানে ঝিল্লী নামক কীট বিশেষের ধ্বনিতে কর্ণমুল–এই কথার তাৎপর্য হল এই, যে সংসার পথে কখনও শত্রুগণ বা রাজা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে পেচক ও ঝিল্লীর ন্যায় কঠোর ভর্ৎসনা করলে, মানুষের কর্ণকুহরে বা অন্তঃস্থলে বেদনা অনুভূত হয়।

যে সকল ছায়া পাপের কারণ– একথার মমার্থ এই যে, এই সংসারে পূর্ব-সঞ্চিত পুণ্যকর্মের ফলভোগ সমাপনের পর, মানুষ জীবন্ত হয়ে যায়। তখন অপুণ্য বিষতিদুকপাপলতা, কৃপতুল্য বিষময় স্থানে গমন করে। ঐহিক ও পারলৌকিক প্রয়োজনশূন্য ধনে পরিপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে ধনলাভের প্রত্যাশায় সে গমন করে।

হে রাজন, এই ভব –অরণ্যে বণিকগণ কখনও কখনও জলহীন নদীতে গমন করে’–এই উক্তির সারার্থ এই যে– সংসার মধ্যে কোন অসৎ ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে পুরুষের বুদ্ধি লুপ্ত হয়। জলশূন্য নদীমধ্যে পতনের ফলে যেমন তখন অঙ্গহানির আশংকা থাকে। ফলতঃ সেই মুহূর্তে শুধু নয়, পরেও বহু কষ্ট পেতে হয়।

তেমনি পুরুষ পাষণ্ডের নিকট গমনের ফলে ব্যক্তিকে ইহকাল ও পরকালে দুঃখ পেতে হয়। ‘কখনও নিরন্ন অবস্থায় অপরের কাছে অন্ন প্রার্থনা করে তার সারমর্ম এই যে সময়ে কোনো ব্যক্তি ভাগ্য দোষে বা শত্ৰুকৃত হয়ে অথবা কালকৃত ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ে তখন সে নিজের অন্ন অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। তখন তাকে নিজের দেহধারণের জন্য অপরের কাছে অন্নের জন্য প্রার্থনা করতে হয়।

‘কখনও কখনও দাবানলে পতিত হয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়’–এই কথাটির অর্থ এই যে গৃহ হল অগ্নিকুণ্ড তুলনীয়। পুরুষ যখন এখানে আশ্রয় নেয়, সে শোকাগ্নিতে দগ্ধ হতে হতে খেদগ্রস্ত হয়।

‘কখনও কখনও যক্ষগণ প্রাণতুল্য ধন হরণ করাতে নির্বেদ প্রাপ্তি হয়’–তার অর্থ এই যে সংসার অরণ্যে কোনসময়ে রাজগণ কালপ্রভাবে প্রতিকুল হয়ে রাক্ষসের মতো ব্যবহার করে। সে তখন প্রিয়তম ধন মানুষের প্রাণ হরণ করতে উদ্যত হয়, তখন পুরুষকে মৃতেদের ন্যায় জীবনের আনন্দাদি লক্ষণে বঞ্চিত হয়ে থাকতে হয়।

‘কোথাও গন্ধর্বপুরে প্রবিষ্ট হয়ে নিবৃতিতুল্য হওয়ায় মুহূর্তকাল আমোদ-আহ্লাদ করে’–ইত্যাদির তাৎপর্য এই যে পুরুষ কখনও কখনও পিতৃপিতামহ প্রভৃতি অতীত ব্যক্তিদের চিন্তাযোগে প্রাপ্ত হয়। তখন তাদের জীবনের অস্তিত্ব স্মরণ করে যশকালের জন্য স্বপ্নতুল্য সুখ অনুভব করে।

‘কোথাও চলার পথে কন্টকাদি বিদ্ধ হওয়ায় পর্বতারোহণের বাসনায় বিমনস্কের ন্যায় হয়ে থাকে’–এই কথার অর্থ এই যে– গৃহাশ্রমে যে সকল কর্ম-বিধি অনুসৃত হয়, তা অতি দুরূহ। তাই তাদের পর্বৰ্ততুল্য দুর্গম বলা হয়েছে। অর্থাৎ অতি আড়ম্বরপূর্ণ যাগাদি কর্মসমূহ নিঃশেষভাবে অনুষ্ঠানের ইচ্ছা করে, বিবিধ লৌকিক বিপত্তি হেতু ক্ষুণ্ণ চিত্তে কন্টক ও শর্করা পূর্ণ ক্ষেত্রে প্রবেশিত ব্যক্তির মতো অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কোনোসময় সেই গৃহস্থ দুঃসহ জঠরানলে দগ্ধ হয়ে ধৈৰ্য্যহীন হয়ে পড়ে। তখন তার পোয্য বর্গের ও পরেই ক্রোধের প্রকাশ ঘটে।

আবার, ‘সংসারবাটীতে কোথাও অজগর সাপ কর্তৃক গিলিত হয়ে মৃতবৎ পতিত থাকে, কিছুই জানতে পারে না’– এই কথার সারার্থ এই যে, পুরুষ কোনও সময় নিদ্রারূপ অজগরের গ্রাসে পড়ে ঘোর অন্ধকারে নিমগ্ন হয়। তখন সে শূন্যারণ্যে পরিত্যক্ত শবের ন্যায় শয়ন করে থাকে, কিছু জানতে পারে না।

হে রাজন, ‘ভটাটবীর কোনও কোনও স্থানে অন্ধলোকেরা অন্ধকূপে পতিত হয়ে নিমগ্ন থাকে’– এই কথার অর্থ হল, সংসার মধ্যে কখনও বা দুর্জনরূপ সর্পগণের আক্রমণে গর্বরূপ দণ্ড ভগ্ন হয়। সংসারী মানুষও নিদ্রার অবসর পায় না। তখন নিরবিচ্ছিন্ন চিত্তক্ষোভে তার বিবেকবুদ্ধির ক্ষয় হতে থাকে। এ অবস্থায় সে যেন অজ্ঞানান্ধ হয়ে অন্ধের মতো অন্ধকূপে পতিত হয়।

‘কখন কখন পুরুষ ক্ষুদ্ররসের অন্বেষণ করতে গিয়ে তার স্বামী বা মক্ষিকার নিকট অবজ্ঞাত হওয়ায় অতিশয় ব্যথিত হয়’– এই ভক্তির সারমর্ম এই যে, সংসারবর্গের কাম হল ক্ষুদ্র মধুকণার সঙ্গে তুলনীয়। পুরুষ কখনও মধুকণার ন্যায় ক্ষুদ্র কাম্য বস্তুর অন্বেষণ করতে গিয়ে সে সময় পরস্ত্রী বা পরদ্রব্য গ্রহণে প্রবৃত্ত হয়। তখনই রাজা বা ঐ সকল দ্রব্যের আধিকারিকগণ কর্তৃক নিহত হয়ে দুস্তর নরকে পতিত হয়।

অতএব পণ্ডিতেরা এই প্রবৃত্তিমার্গের কর্মকেই জীবের ঐহিক ও পারলৌকিক জন্মক্ষেত্র বলে থাকেন, অর্থাৎ কর্মই জীবের ও পারলৌকিক জন্মের কারণ স্বরূপ।

‘ক্ষুদ্ররস লাভ করতে পারলেও ভোগ করতে পারে না, অন্য ব্যক্তি এসে বলপূর্বক কেড়ে নেয়’–এই কথার সারমর্ম এই যে, যদিও পরদ্রব্য লাভ করতে পারে তবু তা ভোগ করতে পারে না, অন্য কেউ তা কেড়ে নেয়। আবার তার কাছে থেকে অন্য কোনো ব্যক্তি এসে তা কেড়ে নেয়। উহা পরপর অপরের হস্তগত হতে থাকে।

হে রাজন, ‘কোনো কোনো স্থানে কোনো কোনো লোক শীত, গ্রীষ্ম, বায়ু, বর্ষা ইত্যাদির প্রতিকার করতে না পেরে অসহায় ভাবে অবস্থান করে’–এই উক্তির তাৎপর্য এই যে কখনও এই সংসারী পুরুষ শীত ঝঞ্ঝা প্রভৃতি নানারূপ আধিদৈবিক, আধিভৌতিক ও আধ্যাত্মিক বিপত্তিসমূহের প্রতিকারে অসমর্থ হয়ে দুরন্ত চিন্তায় বিষণ্ণ হয়ে থাকে।

কখনও বা সংসারী ব্যক্তি পরস্পর কোনোরূপ আর্থিক ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয়ে অপর লোকের কুড়িটি কড়ি বা তার চেয়েও কম বন আরোহণ করলেও, সে অপরের কাছে বিদ্বেষভাজন হয়ে থাকে।

মহারাজ, এই সংসার বক্সে অর্থকষ্টাদি প্রভৃতি নানা বিধ উপসর্গ নিত্যই বর্তমান। এছাড়া সুখ, দুঃখ, অনুরাগ, বিদ্বেষ, ভয়, অভিমান, অসাবধানতা, উন্মত্ততা, শোক, মোহ, লোভ, মাৎসর্য, নার্ষা, অপমান প্রভৃতি আরও উপসর্গ রয়েছে।

‘কোথাও কোথাও অন্য ব্যক্তি লতাশাখা আশ্রয় করে’– ইত্যাদি যা বলেছি তার অর্থ হল এই সংসারে পথে কোথাও কোথাও পুরুষ দেবমায়ারূপিণী নারীর ভূজলতাবন্ধনে, আবদ্ধ হয়ে বিবেক জ্ঞান ভ্রষ্ট হয়।

সেই অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি ঐ নারীর বিলাস– গৃহ রচনার জন্য ব্যস্তচিত্ত হয়। পরে এই গৃহের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত পুত্র, কন্যা, ঐ নারীর বাক্য, দৃষ্টিপাত ও বিবিধ আচরণে আকৃষ্ট চিত্ত হয়ে নিজেকে ঘোর নরকে নিক্ষিপ্ত করে।

‘কোথাও কখন কখন হরিচক্র থেকে ভীত হয়ে কঙ্ক গৃভ্রাদির সঙ্গে সদ্য বিধান করে’–এই কথার সারবত্তা হল এই যে, হরিচক্র হল ভগবান বিষ্ণুর চক্র। ভগবান বিষ্ণুর চক্র অতি সূক্ষ্ম ক্ষণ থেকে আরম্ভ করে পরাব পরিমিত যে কাল, তৎ-স্বরূপে নিজ কার্যে সর্বদা জাগ্রত থাকে। সেটি প্রান্ত বেগে পরিভ্রমণ করে ব্রহ্মা থেকে শুরু করে তৃণসম প্রাণীদের বাল্যাদি যে কোনো বয়সে সংহার করে। কোনো ব্যক্তির পক্ষে তার কোনোরূপ প্রতিকার করা সম্ভব নয়।

সংসারী পুরুষ কখনও বা সেই বিষ্ণুচক্র হতে ভীত হয়ে, কালচক্ররূপ অস্ত্রধারী সাক্ষাৎ নশ্বর স্বরূপ ভগবান যজ্ঞ পুরুষের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে। তার আশ্রয় না নিয়ে, বেদবিরুদ্ধ পাষণ্ডদের আশ্রয় করে।

‘তাদের নিকট বঞ্চিত হয়’–এই উক্তির তাৎপর্য হল– পাষণ্ডগণ স্বয়ং অসৎপথে প্রবৃত্ত। তারা নিজেদের বঞ্চনা করছে। এই অবস্থায় অপর কোনো লোক, যে তাদের দ্বারা বঞ্চিত হবে তা বলাই বাহুল্য। ঐ পুরুষ যখন তাদের কাছে গিয়ে বঞ্চিত হয়, তখন ব্রাহ্মণদের মধ্যে আশ্রয় নেয়।

কিন্তু সেখানেও ব্রাহ্মণোচিত আচার-বিচার, বেদ ও শাস্ত্রোজ্ঞদের মতে, যজ্ঞপুরুষ ভগবানের আরাধনাদি, তার কাছে রুচিকর মনে হয় না, তখন সে শূদ্রকুলের আশ্রয় নেয়। বৈদিক আচারের অভাবে সেই শূদ্রকূল অশুদ্ধ বলে বানরের ন্যায় স্ত্রী সঙ্গ ও পোষ্যবর্গের পরিপোষণই তাদের কর্ম।

এই সকল ব্যক্তি শূদ্রতুল্য হওয়ায় প্রতিবন্ধকতা রহিত হয়ে স্বেচ্ছাবিহার করে থাকে। সে অতি মন্দবুদ্ধি হয়ে পরস্পর মুখ-সন্দর্শনাদি রূপ গ্রাম্য কর্মে এরূপ অনুরাগী হয় যে, তাতে নিজের মৃত্যুকালের কথা পর্যন্ত ভুলে যায়। স্ত্রী ও সন্তানাদির প্রতি বাৎসল্যযুক্ত বানর যেমন মৈথুনমত্ত হয়ে বৃক্ষশাখে অবস্থান করে, তেমনি সংসারী পুরুষগণও ঐহিক প্রয়োজনীয় গৃহে আসক্ত হয়ে স্ত্রী-পুত্রাদির প্রতি বাৎসল্যযুক্ত ও মৈথুনরত হয়ে, সংসারবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সমর্থ হয় না।

হে রাজন, কোন কোন ব্যক্তি গিরিকরে পতিত হয়ে তত্রস্থ হস্তি-ভয়ে লতা অবলম্বন-পূর্বক অবস্থান করে’–ইত্যাদি বাক্যের অভিপ্রায় এই যে পুরুষ সংসার মার্গে অবরুদ্ধ হওয়ায় মৃত্যুতুল্য হস্তীভয়ে ভীত হয়, তখন সে গিরিকর তুল্য ঘোর অন্ধকারে অর্থাৎ রোগ শোক প্রভৃতি আপদে পতিত হয়।

কখনও শীত, বাত প্রভৃতি আধিভৌতিক, ও আধ্যাত্মিক বিবিধ দুঃখ নিবারণে অসমর্থ হয়ে ক্লেশ ভোগ করে। এরা তখন দুস্তর বিষয়-বাসনায় বিষণ্ণতা অনুভব করে।

কোনোসময় পরস্পর ক্রয়-বিক্রয়াদি ব্যবহার করতে গিয়ে যে যৎকিঞ্চিৎ ধন উপার্জন করলেও প্রবঞ্চনের জন্য অপরের বিদ্বেষ ভোগী হয়। কোনো কোনো সময়ে তার ধনক্ষয়ের কারণে উপভোগ্য বস্তু সকলের উপভোগ ব্যাহত হলে, সে অসদুপায়ে ঐ বস্তুসকল অপরের নিকট থেকে গ্রহণ করতে চায়। তখন সেই সকল ব্যক্তির নিকট তাকে অপমানিত হতে হয়। বিত্ত বিনিময়ে হেতু পরস্পর চিরস্থায়ী বৈরীভাব অতিশয় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলেও পূর্ব বাসনার প্রেরণায় সে ব্যক্তি অপরের ধন লুণ্ঠন করতে উদ্যত হয়। কখনও বা বিবাহসূত্রে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক গঠন করে আবার তা ত্যাগও করে থাকে।

হে মহারাজ, ঐরূপ সংসারমার্গে নানাবিধ ক্লেশ ও বিভিন্ন উপসর্গের দ্বারা বাধিত হয়ে যে ব্যক্তি আপদগ্রস্ত বা মৃত্যুমুখে পতিত হয়, আত্মীয়রূপে ব্যক্তিবর্গ তাকে সেখানেই পরিত্যাগ করে নবজাত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে কখনও শোক প্রকাশ করে, কখনও মুগ্ধ হয়, কখনও ভীত হয়। এভাবে সে ক্রমশঃ সংসারমধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সাধুপুরুষদের অনুগ্রহ ব্যতীত কেউই আজ এ পর্যন্ত ঐ সংসার বৰ্ম্মের পার উত্তীর্ণ হতে পারেনি। বণিকগণের মতো এই মানবকুল যে স্থান থেকে এই সংসার মার্গে চলতে আরম্ভ করেছে, অদ্যাবধি সাধুসঙ্গ ব্যতীত কেউ সে স্থানে প্রত্যাবর্তন করেনি। আর, পণ্ডিতগণই এই পারের উপায় উপদেশ করে থাকেন অর্থাৎ জীবগণ পরমেশ্বরের সম্বন্ধচ্যুত হয়েই তার নিকট হতে এই সংসারে এসেছে।

অতএব পরমেশ্বরই সংসারমার্গের পার প্রাপ্তির একমাত্র উপায়। শুধুমাত্র সাধুসঙ্গ করলেই এই উপায় লাভ করা সম্ভব।

বাস্তবিকই, যোগানুষ্ঠানের দ্বারাও এই সংসারপথ অবরুদ্ধ করতে পারা যায় না। বিষয় নিবৃত্ত শান্ত স্বভাব দণ্ড ত্যাগী মুনিগণই এই সংসার মার্গের পথ প্রাপ্ত হন। যে সকল রাজর্ষি দিগবিজয়ী, সর্বদা যাগ-যজ্ঞ করেন, তাঁরাও এই মার্গ অবরুদ্ধ করতে অপারগ, তারা ভূমির ওপর অভিমান বশতঃ চিরকাল অপরের সঙ্গে শত্রুতা লিপ্ত হন। কিন্তু এর পরিণামে যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন পূর্বক এই ভূমিসত্ত্ব ত্যাগ করে মৃত্যু বরণ করেন।

কোন কোনও ব্যক্তি কর্মরূপ লতা অবলম্বন করে নরকরূপ আপদ থেকে উদ্ধার পেলেও আবার সংসার পথে চলতে চলতে নরলোকে এসে উপস্থিত হয়। স্বৰ্গতঃ ব্যক্তিদেরও এই গতি হয়ে থাকে অর্থাৎ পুনরায় নরলোকে আসতে হয়ে থাকে।

যোগীবর শুকদেব উক্ত প্রকারে, ভরতবর্ণিত ভটাটবীর প্রকৃত অর্থ ব্যাখ্যা করে রাজা পরীক্ষিৎকে সম্বোধন পূর্বক বললেন– মহারাজ, মনীষীগণ ভরতের চরিত্র সম্বন্ধে এরূপ শ্লোক গান করেন। মক্ষিকা কখনও পক্ষীরাজ গরুড়ের গতিপথ অনুসরণ করতে পারেন না। তেমনি এই ধরাতলে অন্য কোনও রাজা মনের দ্বারাও ঋষভনন্দন রাজর্ষি মহাপুরুষের ভরতের অনুগামী হতে সমর্থ হবেন না। এই মহাত্মা ভরত উত্তমশ্লোক ভগবানের প্রাপ্তির ইচ্ছায় যৌবনেই স্ত্রী, পুত্র, সুহৃৎ ও রাজ্যত্যাগ। করেছিলেন।

রাজর্ষি ভরত যে দুস্ত্যজ ভূ-সম্পত্তি, পুত্র, স্বজন সবাইকে ত্যাগ করেছিলেন– ইহা সঙ্গত। মহাত্মাদের যে চিত্ত ভগবান মধূসূদনের সেবায় অনুরক্ত, তাদের নিকট মোক্ষও অতি তুচ্ছ পদার্থ।

মহারাজ, ঐ রাজর্ষি ভরত মৃগদেহ পরিত্যাগের সময় যে ভগবান যজ্ঞরূপী নারায়ণের স্তব উচ্চস্বরে সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছিলেন, কেউ তার অনুগামী হতে পারবেন না।

রাজা ভরতের গুণ ও কর্ম অতি পবিত্র। ভগবদ্ভক্ত ব্যক্তি মাত্রেই উহার সমাদার করে থাকেন। অতএব ঐ মহাত্মার এই চরিত্র পরম মঙ্গলজনক পরমায়ু বর্ধক, শূন্য শস্য ও স্বর্গ ও মোক্ষের সাধক।

যে মানব ভক্তিভরে ইহা শ্রবণ, কীর্তন বা অভিনন্দন করবেন, তিনি নিজেই সমস্ত কল্যাণের অধিকারী হবে। অপরের কাছে তাকে পাণিপ্রার্থী হতে হবে না।

.

পঞ্চদশ অধ্যায়
ভরতবংশ-জাত নৃপতিদের বর্ণনা

শ্ৰী শুকদেব বললেন–মহারাজ, ভরতের এক পুত্রের নাম ছিল সুমতি। তিনি ভগবান ঋষভদেবের মার্গ অনুসরণ করে জীবমৃত পুরুষের ন্যায় আচরণ করতেন।

কলিযুগে তার এইরূপ আচরণ দেখে কয়েকজন দুর্বুদ্ধি বেদাচার বিমুখ পাষণ্ড নিজেদের পাপবুদ্ধি অনুসারে তাকে বৈদিক দেবতারূপে কল্পনা করে। অর্থাৎ তাকে বুদ্ধের অবতার বলে প্রচার করে। সুমতির পত্নী ছিলেন বৃদ্ধসেনা। তার গর্ভে ‘দেবজিৎ’ নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। সেই ‘দেবজিৎ এর আসুরী নাম্নী স্ত্রীর গর্ভে ‘দেবদ্যুন্ম’ নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। সেই দেবদ্যুম্নের পত্নী ধেনুমতীর গর্ভে পরমেষ্ঠীর জন্ম হয়। পরমেষ্ঠীর পত্নী সুবর্চলার গর্ভে ‘প্রতীহ’ নামক পুত্রের জন্ম হয়। এই প্রতীহ অপরকে আত্মবিদ্যার উপদেশ দিতেন। এর ফলে তিনি নিজে তাতে পবিত্র হয়ে সাক্ষাৎ ভগবান বিষ্ণুকে দর্শন করেছিলেন। প্রতীহের পত্নীর নাম ছিল সুর্বচলা। কলিযুগে মাতৃ নাম্নী কন্যাকে বিবাহ নিষিদ্ধ হলেও, পুরাকালে এ বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। প্রতীহের এই পত্নীর গর্ভে প্রতিহর্তা, প্রস্তোত্য এবং ‘উদগাতা’ নামক তিনটি পুত্রের জন্ম হয়। এই তিনজনই যজ্ঞানুষ্ঠান বিষয়ে অতিশয় নিপুণ ছিলেন।

প্রতিহর্তার পত্নীর নাম ছিল স্তুতি। তার গর্ভে ‘অজ’ ও ‘ভূমা’ নামক দুটি পুত্রের জন্ম হয়। ভুমার দুই ভার্য্যা ছিল, তাদের নাম ঋষিকুল্যা ও দেবকুল্যা। ভূমা তার জেষ্ঠ পত্নী ঋষিকুল্যার গর্ভে উদগীথ নামে এক পুত্রের জন্ম দেন। পরবর্তীকালে কনিষ্ঠা পত্নী দেবকুল্যার গর্ভে দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়। এই সন্তানের নাম ছিল প্রস্তাব। প্রস্তাবের পত্নী বিরুসার গর্ভে ‘বিভু’ নামে এক পুত্রের জন্ম হয়।

ঐ বিভুর পত্নী রতির গর্ভে ‘পৃথুষেণ’ নামক সন্তানের জন্ম হয়। পৃথুষেণের পত্নী আকুতির গর্ভে ‘নক্তের’ জন্ম হয়। নক্ত, তার পত্নী ঋতির গর্ভে উদারকীর্তি রাজশ্রেষ্ঠ গয় নামক পুত্রের জন্ম দেন।

ইনি জগত রক্ষার কারণে সত্ত্বগুণাশ্রয়ী ভগবান বিষ্ণুর অংশাবতার। তিনি আত্মতত্ত্বাদি লক্ষণের দ্বারা মহাপুরুষত্ব লাভ করেছিলেন। মহারাজ গয় রাজপদে অভিষিক্ত হয়ে প্রজাগণের পালন, পোষণ, প্রীতি উৎপাদন, লালন ও শিক্ষাদান রূপ রাজধর্ম পালন করতেন। গৃহাশ্রমে থাকাকালীন তিনি যাগ যজ্ঞাদি ধর্মেরও আচরণ করতেন। তার ঐ দ্বিবিধ ধর্ম ভগবানের চরণে অর্পিত হওয়ায় পরমার্থ স্বরূপ হয়েছিল।

এভাবেই সর্বজীবাত্মা, পরাবর, ব্রহ্মাস্বরূপ ভগবান পরম-পুরুষ ও ব্রহ্মজ্ঞানের চরম সেবার দ্বারা চিত্ত বিশুদ্ধ হওয়ায় তার দেহাদি বিষয়ে অহংভাবের অবসান হলো। তখন সেই বিশুদ্ধ চিত্তমধ্যে ব্রহ্ম বস্তুর স্বয়ং প্রকাশ ঘটল। তারপরে তিনি নিজ আত্মাকে ব্রহ্মস্বরূপ বলে অবগত হলেন। তিনি এবিধ গুণের অধিকারী হয়েও নিরভিমান হয়েই পৃথিবী প্রতিপালন করতেন।

হে পাণ্ডবেয়, পুরাবৃত্তান্তজ্ঞ পণ্ডিতগণ মহারাজ, গয়ের সম্পর্কে এ সকল গাথা কীর্তন করে থাকেন। মহাত্মা গয় যজ্ঞাদির অনুষ্ঠাতা। তিনি মনস্বী, বহুজ্ঞ, ধর্মরক্ষক, শ্রীমান, সৎসকলের সভাপতি এবং সাধু লোকদের সেবক ছিলেন।

ভগবানের অংশ ব্যতিরেকে অন্য কোনো নৃপতি তাকে অনুসরণ করতে পারেন না। যে সকল সাধ্বীগণের আশীর্বাদ অব্যর্থ সেই শ্রদ্ধা, মৈত্রী, দয়া প্রভৃতি দক্ষকন্যারা নদীসকলের সঙ্গে পরম আনন্দমনে তার অভিষেক ক্রিয়া করেছিলেন।

পৃথিবী যার গুণরূপ বৎস দ্বারা স্তন আকৃষ্ট হলে অযাচিতভাবেই তার প্রজাদের যাবতীয় কাম্যবস্তু বিতরণ করতেন। অন্য কোনও রাজা তার অনুকরণ করতে সমর্থ হবেন না। তিনি কল্যাণবিষয়ে। আকাঙ্ক্ষাহীন হলেও বেদ– সকল অথবা বেদরহিত কর্মসকল, তার জন্য স্বয়ং নানাবিধ কাম দোহন করে দিতেন। নৃপতিগণ সমরাঙ্গনে শর- দ্বারা প্রতিপূজিত হয়ে তাকে করদান করতেন। বিপ্রগণ পালন ও দক্ষিণা দ্বারা পূজিত হয়ে স্ব-স্ব ধর্মফলের ষষ্ঠাংশ তার জন্য আহরণ করতেন।

মহারাজ ‘গয়’ অনুষ্ঠিত যজ্ঞে প্রচুর সোমরস পানের ব্যবস্থা থাকায় দেবরাজ ইন্দ্র অতিশয় মত্ত হতেন। যজ্ঞমূর্তি ভগবান বিষ্ণু যাঁর শ্রদ্ধাপূত নিশ্চল ভক্তিযোগের দ্বারা সমর্পিত যজ্ঞফুলই পুজোর ন্যায় গ্রহণ করতেন। অন্য কোন্ রাজার পক্ষে তাকে অনুকরণ করা সম্ভব?

যে ভগবান। তুষ্ট হলে ব্রহ্মাদি দেবতাগণ, তির্যক প্রাণী, মানুষ তৃণ-লতা সকলেই প্রীতি অনুভব করে, সেই সর্বান্তর্যামী সাক্ষাৎ প্রীতি স্বরূপ ভগবান বিষ্ণু, ‘গয়’ রাজার যজ্ঞে ‘তৃপ্তোহস্মি’ অর্থাৎ তৃপ্ত হলাম, এই বলে প্রত্যক্ষভাবেই প্রতি প্রকাশ করেছিলেন।

অপর কোনো রাজা তাঁর অনুকরণ করতে সমর্থ হয় না।

‘গয়’ রাজার পত্নী গায়ভীর গর্ভে চিত্ররথ, সুগতি এবং অধিরোধন নামক তিনটি পুত্রের জন্ম হয়। চিত্ররথের ভার্য্যা ছিলেন উণা। তার গর্ভে ‘সম্রাট’ নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। সম্রাটের পত্নী উৎকলার

গর্ভে মরীচির জন্ম হয়। মরীচির পত্নী বিন্দুমতীর গর্ভে ‘বিন্দুমান’ নামে এক পুত্রের জন্ম হয়।

‘বিন্দুমান’ তাঁর পত্নী সরমার গর্ভে ‘মধু’ নায়ক পুত্রের জন্ম দেন। মধু পরবর্তীকালে রাজা হয়েছিলেন। মধুর পত্নী ছিলেন সুমনাঃ। তার গর্ভে বীরব্রতের জন্ম হয়। ঐ বীরব্রত স্বীয় ভার্য্যা ভোজার গর্ভে ‘মন্থ’ ও ‘প্রমন্থ’ নামক দুই পুত্রের জন্ম দেন। মন্থ তার ‘সত্যা নামক স্ত্রীর গর্ভে ‘ভৌবন’ নামক পুত্রের জন্ম দেন।

ভৌবন-পত্নী ভূষণার গর্ভে ‘তৃষ্টা’র জন্ম হয়। তৃষ্টা’র পত্নী বিরোচনার গর্ভে ‘বিরহ’ নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। এই বিরহ অতি মহাত্মা ছিলেন। তার পত্নী বিরহের শতপুত্র এবং একটি কন্যার জন্ম হয়। তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন জেষ্ঠ্যপুত্র শতজিৎ।

এ সম্পর্কে প্রচলিত শ্লোক –প্রিয়ব্রত বংশের শেষ রাজা বিরহ নিজ গুণ ও কীর্তির দ্বারা ঐ বংশকে ভূষিত করেছিলেন। ভগবান বিষ্ণু যেমন দেবলোককে অলংকৃত করেন, বিরজও তেমনি নিজ বংশকে অলংকৃত করেন।

.

ষোড়শ অধ্যায়
ভুবনকোশ– বর্ণনা

রাজা পরীক্ষিৎ প্রশ্ন করলেন- হে ব্রাহ্মণ, সূর্য যত দূর পর্যন্ত আলোকদানে সক্ষম, ততদূর পর্যন্ত এই ভূ-মণ্ডলের বিস্তার এবং শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের যে যে স্থান পর্যন্ত চন্দ্র ও নক্ষত্রগণের প্রকাশ দেখা যায়, আপনি বললেন–ভুমণ্ডল ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।

হে ভগবন, এই ভূমণ্ডলের মধ্যেও মহারাজ প্রিয়ব্রতের রথচক্রের সাতটি ঘাত দিয়ে সাত সাগরের উৎপত্তি হয়েছে। আপনি আগেই সংক্ষেপে বলেছেন যে, ঐ সাত সমুদ্র থেকেই পৃথিবীর সাতটি দ্বীপ বিশেষ রচিত হয়েছে। আমি এখন আপনার কাছে পরিমাণ ও লক্ষণ অনুসারে এই সকল দ্বীপের সমুদয় তত্ত্ব জানতে ইচ্ছা করছি।

হে গুরুদেব, এই ভূমণ্ডল ভগবানের গুণময় স্থলরূপ। এতে মন নিবিষ্ট করলে পরে সেই মনকে নির্গণ, আত্মজ্যোতি, স্বরূপঃ বাসুদেব নামক পরব্রহ্মেও নিবিষ্ট করা সম্ভব। অতএব, হে ভগবান, আপনি এই ভূমণ্ডল রূপ স্থূল রূপের বর্ণনা করুন।

শ্ৰী শুকদেব বললেন–মহারাজ, মানুষ যদি দেবতুল্য পরমায়ুও পায়, তথাপি বিশেষ বিশেষ স্থানের নাম দ্বারা ভগবানের মায়া– বিভূতির অন্ত, বাক্য ও মনের দ্বারাও অবগত হতে সক্ষম হবে না। অতএব, প্রধান প্রধান দ্বীপসমূহের নাম, সন্নিবেশ ও চিহ্ন বর্ণনা করেই তোমার কাছে ভূ-গোলস্থ স্থান বিষয়ে ব্যাখ্যা করছি।

হে রাজন, এই ভূমণ্ডল একটি প্রকাণ্ড পদ্মস্বরূপ। সপ্ত-দ্বীপ তার কোশ। এই সপ্ত– দ্বীপরূপ কোশমধ্যের অভ্যন্তর কোশ হল জম্বুদ্বীপ। এই দ্বীপ প্রক্ষল, তার দীর্ঘ নিযুত যোজন এবং বিস্তার লক্ষ যোজন। এই জম্বুদ্বীপ পদ্মপত্রের ন্যায় চারদিকে সমান বর্তুলাকার।

এই জম্বুদ্বীপে নয়টি বর্ষ অর্থাৎ দেশ আছে। তন্মধ্যে ভদ্রা ও কেতুমাল বর্ষ ব্যতীত প্রত্যেকের বিস্তার নয় হাজার যোজন। এই নটি বর্ষ আটটি সীমারক্ষক পর্বত দ্বারা পরস্পর সুন্দরভাবে বিভক্ত হয়ে আছে।

ইলাবৃত নামক বর্ষ এই নটি বর্ষের মধ্যস্থলে অবস্থিত। এরা যথাক্রমে রম্য, হিরন্ময় ও কুরুবর্ষের সীমারূপে বিদ্যমান রয়েছে। এরা পূর্বদিকে দীর্ঘ। লবণসাগরে এদের সীমানা নির্দেশক রূপে পূর্ব– পশ্চিম দুদিকেই অবস্থিত। এদের প্রত্যেকেরই বিস্তার দুই হাজার যোজন, কিন্তু পূর্ব অপেক্ষা পর পরেরটি দৈর্ঘ্যে একাদশ অংশে নুন অর্থাৎ পূর্বদিকের অপেক্ষা পরটির দৈর্ঘ্য এগার ভাগের এক ভাগ কম। এভাবে ইলাবৃত বর্ষের দক্ষিণে বিষধ, হেমকূট ও হিমালয় নামে তিনটি পর্বত আছে। এই তিনটি পর্বত নীল, শ্বেত ইত্যাদি পর্বতের মতো পূর্বদিকে আয়ত এবং প্রত্যেক দশ হাজার যোজন বিস্তৃত। এরা যথাক্রমে হরিবৰ্ষ, কিংপুরষবর্গ এবং ভারতবর্ষের সীমানারক্ষক।

এইরূপে ইলাবৃত বর্ষের পশ্চিম ও পূর্বদিকে মূল্যবান ও গন্ধমাদন–এই দুটি পর্বত উত্তর দিকে নীল এবং দক্ষিণ দিকে নিষধ পর্বত পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে দু’হাজার যোজন বিস্তৃতি লাভ করেছে। ওই দুটি পবর্তই কেতুমাল বর্ষ ও ভদ্রাশ্বর বর্ষের সীমা নির্দেশ করছে। মেরু পর্বতের চারদিকে অযূত যোজন বিস্তৃত ও উন্নত মন্দর, মেরুমন্দর, সুপাশ ও কুমুদ — এই চারটি, অষ্টরম্ভ পর্বত অবস্থিত। এই চারটি পর্বতের উপরিভাগের আম্র, জম্বু, কদম্ব ও বট এই চারটি মহাবৃক্ষ ধ্বজার মতো অবস্থান করছে। ওদের উচ্চতা ও চারদিকে শাখাসমূহের বিস্তৃত এগারোশত যোজন এবং ওদের বিস্তৃতি শতযোজন।

হে ভরতশ্রেষ্ঠ ভক্ত, চারটি বৃক্ষের অদূরে চারটি হ্রদ আছে, তার মধ্যে একটি দুগ্ধ জল, দ্বিতীয়টি মধুজল, তৃতীয়টি ইক্ষুরস জল এবং চতুর্থটি শুদ্ধ জল। ঐ চারটি হ্রদের জল অতি চমৎকার। উপদেবগণ, তা সেবন করে স্বাভাবিক যোগৈশ্বর্য ধারণ করেছেন। ঐ স্থানে চারটি হ্রদ ব্যতিরেকেও চারটি উৎকৃষ্ট দেবোদ্যান আছে। তাদের নাম হল নন্দন, চৈত্ররথ, বৈভ্রাজক এবং সর্বতোভদ্র। এই সব উদ্যানে শ্রেষ্ঠ দেবগণ, উপদেবতা কর্তৃক পরিবেষ্টিত হয়ে পরম রমণীয়া রমণীগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে বিহার করে থাকেন।

মন্দার পর্বতের ক্রোড়দেশে দেবত নামক একটি স্বর্গীয় আবৃক্ষ আছে। এগারো শত যোজন উচ্চ ঐ বৃক্ষের অগ্রভাগ থেকে সর্বদা প্রচুর অমৃতরূপ ফল পতিত হয়। এই ফলগুলি পর্বতশৃঙ্গের মতো। স্থল বিদীর্ণ হয়ে সেই ফল থেকে অতি সুগন্ধ, সুমধুর, রক্তবর্ণ রসরূপ জলধারা নির্গত হয়। ঐ জলধারায় পরিপূর্ণ অরুনোদ– নাম্নী একটি নদী মন্দর পর্বতের অগ্রভাগ থেকে নিম্নদিকে প্রবাহিত হয়ে ইলাবৃত বর্ষের পূর্বভাগকে প্লাবিত করেছে। এই আসর যুক্ত নদীর জল সেবনের ফলে ভগবতী পার্বতীর অনুচরী যক্ষরমণীগণের দেহ সুরভিত হয়। তাদের অঙ্গস্পর্শে সংযুক্ত বায়ু সুরভিত হয়ে ওঠে।

এইরূপ জম্বুবৃক্ষের এক একটি ফল হস্তীর শরীরের ন্যায় বৃহৎ এবং তার বীজ অতি সুক্ষ্ম। অতি উচ্চস্থান থেকে পতনের ফলে উহার ফল বিদীর্ণ হয়ে অম্বুনদী নামক এক রসনদীর সৃষ্টি হয়েছে। সেই স্রোতস্বিনী নদী অযুতযোজন উচ্চ মেরুমন্দর পর্বতের অগ্রভাগ থেকে ভূমিতলে এসে দক্ষিণ দিক ইলাবৃত বর্ষ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। জম্বুনদীর উভয়তীরস্থ মৃত্তিকা তার জলারসে অনুবিদ্ধ হওয়ায় বায়ু ও সূর্য কিরণের সংযোগে বিশেষ পাক-প্রাপ্ত হয়ে সুবর্ণে পরিণত হয়েছে। দেবতাগণ এই সুবর্ণকে আভরণ রূপে ব্যবহার করেন, তারা স্ব-স্ব যুবতীগণের সঙ্গে মুকুট, বলয়, কটিসূত্র, কুণ্ডল প্রভৃতি আভরণ ধারণ করেন।

সুপার্শ্ব পর্বতের পাদদেশে যে মহাবৃক্ষটি অবস্থিত, তার নাম মহাকদম্ব। তার কোটর থেকে পঞ্চব্যাম পরিমিত, পাঁচটি মধু ধারা ঐ পর্বতের শিখর থেকে নিঃসৃত হয়েছে। সেটি নিজের পশ্চিমে ইলাবৃত বর্ষকে নিজস্ব সুগন্ধে আমোদিত করছে। ঐ পর্বতের মধুধারা পান করলে, মুখ, নির্বাসিত বাম শতযোজন পর্যন্ত সুবাসিত করে। এইরূপ কুমুদ পর্বতে শাতবশ নামে যে বটবৃক্ষ আছে, তার কাণ্ড সমুদয় থেকে নিম্নভিমুখে বিভিন্ন কাম্যবস্তু যেমন দুধ, ঘি, মধু, অন্ন গুড়, বস্ত্র অলংকারাদি ইচ্ছা অনুসারে নির্গত হয়। ঐ পর্বতের অগ্রভাগ থেকে উৎপন্ন হয়ে বহু নদ, যার উত্তরে ইলাবৃত বর্ষ বামে জনগণের পরম উপকার সাধন করে চলেছে। ঐ সকল বস্তু যারা উপভোগ করে সেই সকল লোকের কখনও বলী, পলিত, ক্লান্ত, ঘর্ম, রোগ, অপমৃত্যু, অন্যান্য উপসর্গমূলক সন্তাপ বিশেষ উৎপন্ন হয় না। তারা যাবজ্জীবন সুখেই বসবাস করে।

হে রাজন, কুরঙ্গ, কুবর, কুশুম্ভ, বৈকঙ্ক, ত্রিকুট, শিশির, পতঙ্গ, রুচক, নিষধ, শিতিবাস, কপিল, শঙ্খ, বৈদূর্য, জারুধি, হংস নাগ, কালঞ্চর প্রভৃতি সেনাসমূহ সুমেরুর মূল দেশের চতুর্দিকে বেষ্টন করে অবস্থান করে আছে। তাদের সুমেরু পর্বতের কেশরের ন্যায় প্রতীয়মান বোধ হয়। মেরুর পূর্বদিকে জঠর ও দেবকূট নামে দুটি পর্বত আছে।

তারা উত্তর ও দক্ষিণদিকে আঠারো হাজার যোজন দীর্ঘ, দু হাজার যোজন বিস্তৃত এবং সেই পরিমাণে উচ্চ। এইরকম পশ্চিমদিকে পবন ও পরিমাত্র নামক দুটি, পর্বত এবং দক্ষিণদিকে কৈলাস ও করবীর নামক দুটি পর্বত বিদ্যমান রয়েছে। এরা পূর্ব ও পশ্চিমদিকে দীর্ঘ।

উত্তরদিকে ত্রিশৃঙ্গ ও মকর পর্বত অবস্থিত, এইভাবে মূল থেকে হাজার যোজন পরিত্যাগ করে চারদিকে অগ্নির পরিধির ন্যায় ঐ আট পর্বতে বেষ্টিত হয়ে কাঞ্চনগিরি অর্থাৎ সুমেরু পর্বত সর্বতোভাবে শোভিত রয়েছে। ইতিবৃত্তজ্ঞ পণ্ডিতগণ বলে থাকেন এই সুমেরুর মস্তকের উপরে ভগবান ব্রহ্মার পুরী বিরাজমান। তার বিস্তার সহস্ৰ অযুতযোজন। ঐ পুরী সুবর্ণ দ্বারা নির্মিত এবং চতুর্দিকে সমচতুষ্কোণ।

ব্রহ্মার ঐ পবিত্র পুরীর চতুষ্পর্শে এবং চতুর্কোণে ইন্দ্র প্রভৃতি অষ্টলোকপালগণের আটটি পুরী কল্পিত রয়েছে। লোকপালগণের যার যে দিক এবং যেরূপ, বর্ণ তার পুরীটিও সেই রূপ বর্ণাবিশিষ্ট ও সেদিকেই অবস্থিত। এদের পরিমাণ ব্রহ্মার পুরীর চতুর্থাংশ অর্থাৎ তারাই হাজার যোজন। পূর্বদিকস্থ ইন্দ্রের পুরীর নাম অমরাবতী, অগ্নিকোণে স্থিত অগ্নিদেবের পুরীর নাম তেজোবতী, দক্ষিণদিকে যমরাজের পুরীর নাম সংযমনী, বায়ুকোণে বায়ুদেবতার গন্ধবতী পুরী, উত্তরদিকে ধনদেবের মহোদয়া পুরী এবং ঈশাণকোস্থিত ঈশাণদেবের পুরীটির নাম যশোবতী।

.

সপ্তদশ অধ্যায়
ইলাবৃত বর্ষের চারদিকে গঙ্গার গমন এবং রুদ্র কর্তৃক সংকর্ষণদেবের স্তব

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে মহারাজ, ভগবান বিষ্ণু বলিরাজের যজ্ঞক্ষেত্রে ত্রিবিক্রম মূর্তি ধারণ করেছিলেন। তিনি দক্ষিণ চরণ ভূমিতে স্পর্শ করিয়ে বামচরণ উধ্বদিকে উৎক্ষেপণ করছিলেন। সেই বামচরণের অঙ্গুষ্ঠ নখাগ্রের অন্তকটাহের উপরিভাগ বিদীর্ণ হয়েছিল। সেই ছিদ্রপথে ব্রহ্মাণ্ডের বাইরের জলধারা ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে। ঐ সময় ভগবানের পাদপদ্ম প্রক্ষালন করায় ঐ বারিধারা পাদপদ্ম সংলগ্ন রক্তবর্ণ কুঙ্কুমরূপ কেশরের সংস্পর্শে রঞ্জিত হয়ে স্নানাদিরত প্রাণীমাত্রেরই সর্বপ্রকার পাপ বিনষ্ট করেও স্বয়ং দূষিত হয়নি। তিনি পরম পবিত্র ছিলেন। তখন সেই জলধারা বিষ্ণুপদী নামে পরিচিত ছিল। তখন জাহ্নবী, ভাগীরথী ইত্যাদি নাম প্রকাশিত হয়নি। একের পর এক সহস্র যুগ পরিমিত সুদীর্ঘকালে মূল স্থান হতে স্বর্গের মস্তকে অবতীর্ণ হল। পণ্ডিতেরা সেই অবতরণ ক্ষেত্রটিকে বিষ্ণুপদী বলে অভিহিত করেছেন।

দৃঢ়সংকল্প উত্তানপাদে তনয় পরম ভাগবত ধ্রুব ঐ বিষ্ণুপদে অবস্থান করেন। প্রতিদিন তিনি পরম ভক্তিভরে ভগবান হরির চরণোদক রূপে, এই জলধারায় মস্তক স্পর্শ করান। তখন তার ভগবদ্ভক্তিযোগ অতিশয় উৎকর্ষ লাভ করলে হৃদয়ের অভ্যন্তর ভাগ বিগলিত হয়। উকণ্ঠায় নয়নযুগল অবশ হয়ে পদ্মকলির ন্যায় অর্ধনিমীলিত হয়ে যায়। তার সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চিত হয়।

হে মহারাজ, এরপর সপ্তর্ষিগণ গঙ্গাদেবীর প্রভাবে জ্ঞাত হয়– ইনিই তপস্যার পরমসিদ্ধি’। তখন সেই মুক্তিকামীগণ সমাগত মুক্তিকে যেমন সমাদরে গ্রহণ করেন, সেরূপ এই গঙ্গাকেও নিজ জটাধারে ধারণ করে আছেন। কারণ, তার সর্বাত্মা ভগবান বাসুদেবের প্রতি অক্ষয় ভক্তিযোগ লাভ করায় অন্য সর্বপ্রকার পুরুষার্থ এমনকি আত্মজ্ঞানকেও উপেক্ষা করেন।

এরপরে, বিষ্ণুপাদোদ্ভবা গঙ্গা ঐ স্থান থেকে অনেক সহস্ৰকোটি বিমানসমূহ দ্বারা পরিব্যপ্ত আকাশ মার্গপথে অবতীর্ণ হয়ে চন্দ্রমণ্ডল প্লাবিত করে প্রথমে মেরুপর্বতের উপরিস্থিতি ব্রহ্মার আলয়ে পতিত হন। সেখানে তিনি ভিন্ন ভিন্ন চারটি ধারায় বিভক্ত হয়ে চতুর্দিকে প্রবাহিত হয়ে, অবশেষে সমুদ্রে মিলিত হয়েছেন। এই চারটি ধারার নাম হলো–সীতা, অলকানন্দা, বংক্ষা ও ভদ্রা। তন্মধ্যে সীতা ব্রহ্মলোক থেকে কেশব পর্বতের আদিশৃঙ্গ সমূহ আশ্রয় করে ক্রমশ নিম্নভাগে অবতীর্ণ হয়ে গন্ধমাদন পর্বতের শৃঙ্গসমীহে পতিত হন। সেখান থেকে ভদ্রাশ্ব বর্ষের মধ্য দিয়ে পূর্বদিকে লবণ সাগরে প্রবেশ করেন। বংক্ষু মুল্যবান পর্বতের অগ্রভাগ হতে কেতুমাল বর্ষের দিকে প্রবাহিত হয়ে শান্তভাবে পশ্চিমদিকে সমুদ্রে প্রবিষ্ট হয়েছে। ভদ্রা সুমেরু পর্বতের অগ্রভাগ থেকে উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়েছে। এই প্রবাহপথে এক পর্বতের ওপর থেকে অপর পর্বতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শৃঙ্গবান পর্বতের শৃঙ্গ থেকে নিম্নভাগে অবতরণ করে কুরুবর্ষের নিকট দিয়ে উত্তরদিকে লবণ সমুদ্রে প্রবেশ করেছে।

এইভাবে অলকানন্দা ব্রহ্মলোকে অর্থাৎ সুমেরু পর্বত থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এই প্রবাহপথে বহু গিরিশৃঙ্গ অতিক্রম করে অতি তীব্রবেগে হেমকুট ও হিমকুটের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে দক্ষিণ দিকে লবণ সমুদ্রে প্রবেশ করেছে। এই অলকানন্দায় অবগাহন করলে অশ্বমেধ রাজসূয়াদি যজ্ঞের ফললাভ হয়।

হে মহারাজ, সুমেরু প্রভৃতি পর্বতসমূহ থেকে উৎপন্ন এরূপ আরও বহু নদনদী প্রতিটি বর্ষে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এই বৰ্ষসমূহের মধ্যে একমাত্র ভারতবর্ষই হল কর্মক্ষেত্র। বাকি আটটি বর্ষকে পার্থিব স্বর্গ বলা হয়। এগুলি স্বর্গগত ব্যক্তিদের স্বর্গভোগের পর অবশিষ্ট পুণ্যাংশে উপভোগের স্থান।

এই আটটি বর্ষে বিষয়সুখের উৎকর্ষতার কারণে কাল ত্রেতা যুগের তুল্যরূপে প্রকটিত রয়েছে। সেখানকার অধিবাসী জনগণের পরমায়ু মানুষের কালের পরিমাণে অযুত বৎসর। এজন্য তাদের দেবতুল্য বলা হয়। তাদের বল অযুত হস্তীর তুল্য এবং শরীরও চিরকাল ব্রজের মতো সুদৃঢ় থাকে। এজন্য সেখানে স্ত্রী-পুরুষের মিলনোৎসব অতিসুখময় হয়ে থাকে। নিরন্তর এই রকম সম্ভোগ ক্রিয়ার পরে মাত্র এক বৎসর নিজ পরমায়ু অবশিষ্ট থাকাকালীন রমণীগণ গর্ভ ধারণ করে।

প্রকৃতপক্ষে ঐ সকল বর্ষের লোকেরা দেবপতি। তারা সেই সেই স্থানে নিজ নিজ সেবকগণ কর্তৃক মহা মহাউপাচারে অর্চিত হয়। এভাবে তারা নিজ ইচ্ছায় আশ্রমস্থ আয়তনসমূহে গিরিগহ্বরে ও নির্মল সরোবরে পরম সুখে ক্রীড়ারত অবস্থায় অবস্থান করেন। সেখান সুরাঙ্গনাদের জলক্রীড়া ও অন্যান্য বিচিত্র ব্যাপার ও কামোন্মুক্ত সুন্দরীর বিচিত্র বিভঙ্গ ও লাস্য, পুরুষদের মনকে আকৃষ্ট করে। ঐ আশ্রমস্থিত বৃক্ষাদির শাখা, সমস্ত ঋতুর পুষ্পস্তবক, ফলাদি ও নবকিশলয়ের সমৃদ্ধিতে আনত। সেই শাখায় বহু পক্ষী আশ্রয় নিয়েছে, এজন্য ঐ বৃক্ষ সকলের অবস্থান হেতু আশ্রমের শোভা বৃদ্ধি পেয়েছে। জলাশয়ে প্রস্ফুটিত বিভিন্ন পুষ্পের সুগন্ধে এবং তথাস্থিত পাখিদের কলরবে ও ভ্রমরাদির গুঞ্জনধ্বনিতে সেই শোভা আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে।

উক্ত নয়টি বর্ষেই মহাপুরুষ ভগবান নারায়ণ পুরুষদিগের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শনের জন্য নিজ অভিন্ন মূর্তিসমূহ দ্বারা অদ্যাপি সন্নিহিত রয়েছেন। কিন্তু ইলাবৃত বর্ষে ভগবান ভবই একমাত্র পুরুষ! সেখানে অন্য কোন পুরুষ নেই। ভবানীর অভিশাপের তত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত কোনও পুরুষ সেখানে প্রবেশ করেন না। অজান্তে প্রকাশিত হলে স্ত্রী– ভাব প্রাপ্তি ঘটে। সেখানে ভগবান শঙ্কর, ভবানী ও তার অনুগতা অযুত সহস্র সংখ্যক রমণী কর্তৃক সেবিত হয়ে, চতুমূর্তিধারী ভগবান সংকর্ষণ মূতিটি নিজ চিত্তমধ্যে স্থাপন পূর্বক উপাসনা করেন।

ভগবান শঙ্কর বলেন- আমি সেই ভগবান মহাপুরুষকে প্রণাম করি। সকল গুণের প্রকাশক সেই অনন্ত, অব্যক্ত, স্বরূপ ভগবানের চরণে আমি প্রণিপাত করি।

হে পরম পুরুষ, অতএব আপনাকেই ভজনা করি। আপনার পাদপদ্মে সকল জীবের একমাত্র অবলম্বন এবং ঐশ্বর্যাদি সমস্ত ষড়গুণের পরম আশ্রয়। আপনি ভক্তজনের কাছে নিজ স্বরূপ প্রকটিত করে তাদের সংসার ভয় বিনষ্ট করেন। কিন্তু অভক্তদের সংসার বন্ধনে আবদ্ধ করে থাকেন।

হে দেব, ক্রোধবেগ জয় করতে সমর্থ হওয়ায় আমাদের দৃষ্টি যেমন মায়াময় বিষয়াদি দ্বারা লিপ্ত হয়, আপনি চরাচর সমূহের নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বদা দৃষ্টিপাত করেন। কিন্তু আপনার দৃষ্টি মায়াময় বিষয় ও চিত্তবৃত্তি দ্বারা তার অনুমাত্রও লিপ্ত হয় না। অতএব ইন্দ্রিয় জয়ে অভিলাসী কোন মুমূর্ষ ব্যক্তি আপনার সমাদর না করবেন? যিনি কুদৃষ্টিশালী ব্যক্তিগণের নিকট নিজ মায়ার দ্বারা মধু ও আসব পানে রক্ত চক্ষু মত্ত পুরুষের মত প্রতীয়মান হন এবং নাগবধূগণ চরণার্চনা সময়ে যাঁর পাদস্পর্শে মোহিতচিত্ত হয়ে লজ্জায় ভুদু প্রভৃতি অঙ্গের সেবা করতে সমর্থ হয় না, সেই আপনার রূপ না সমাদর করবেন?

বেদমন্ত্র সকল যাঁকে এই বিশ্বের সৃষ্টি স্থিতি সংহারের কারণস্বরূপ, অথচ স্বরূপতঃ সৃষ্টি- স্তিতি সংহারহীন তিনিই পরমপুরুষ। তিনি নিজ সহস্র মস্তকরূপে আশ্রয়স্থানের যে কোন এক জায়গায় অবস্থিত এই পৃথিবীর কথা অনুভব করতে পারেন না। সুবিশাল মস্তক শ্রেণীর মধ্যে অতিক্ষুদ্র ভূমণ্ডলের সত্তা বুঝতে পারেন না– আমি সেই আপনাকে প্রণাম করি। সংকর্ষণ রূপে আপনার প্রথম সৃষ্টি ছিল মহত্ত্ব নাক গুণময় বিগ্রহ। উক্ত বিগ্রহই সত্ত্ব-গুণাশ্রিত হয়ে ভগবান ব্রহ্মারূপে পরিচিত হন। ব্রহ্মা পৃথকভাবে রজোগুণাশ্রিত হলেও বিষ্ণুর সঙ্গে তাঁর অভেদ জ্ঞাপনের জন্য সত্ত্বগুণাশ্রিত রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। আমি এই ব্রহ্মা থেকেই উদ্ভূত হয়ে নিজ নিজ বিভূতি স্বরূপ, অহংকার দ্বারা দেবতাবর্গ, ভূতবর্গ এবং ইন্দ্রিয়বর্গকে সৃষ্টি করি। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়াদির বিষয় স্পর্শাদির আধার আকাশ বায়ু, প্রভৃতি, ভূতাদি, ইন্দ্রিয়াদির অধিপতি দেবগণ ও ইন্দ্রিয়াদি প্রকটিত করে থাকি। “ সূত্রে আবদ্ধ পক্ষীগণের মতো আমরা অর্থাৎ মহত্ত্ব, অহংকার, ভূতগণ ও ইন্দ্রিয়গণ যাঁর ক্রিয়াশক্তি দ্বারা আবদ্ধ থেকে, যাঁর বশীভূত হয়ে এবং যাঁর অনুগ্রহে এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে চলেছি– আপনিই তিনি! আপনাকে প্রণাম করি। যে মায়ার দ্বারা জীবের কর্মগ্রন্থি রচিত হয়, জীব মায়াকেই শুধু জানতে সক্ষম। কিন্তু মায়ায় মোহিত হয়ে থাকার জন্য তা থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার যথার্থ উপায় জানতে পারে না। ভগবান সংকর্ষণ দেব স্বয়ং সেই মায়ার উদয় ও লয়ের একমাত্র কারণস্বরূপ। আমি সেই সংকর্ষণরূপী দেব ভগবানকে প্রণাম করছি।

.

অষ্টাদশ অধ্যায়
বিভিন্ন বর্ষসকলের এবং সেখানকার উপাসনাসমূহের বর্ণনা

শ্রী শুকদেব বললেন– ভদ্রাশ্ববর্ষে ধর্মপুত্র অধিপতি ভদ্র শ্রবা এবং তার প্রধান সেবকরা বাসুদেবের ধর্মময় প্রিয় মূর্তি হয়শীর্ষ’- দেবকে পরম সমাধিযোগে হৃদয়ে স্থাপন পূর্বক উপাসনা করেন। ভদ্রশ্রবা প্রভৃতি বললেন– আমরা সেই ভগবান ধর্মমূর্তিকে নমস্কার করি, যাঁহার হতে আত্মার সংশোধন সম্ভব হয়। অহো! ভগবানের কি বিচিত্র লীলা! মৃত্যু সকলকে গ্রাস করলেও এই জীবলোক তা দেখেও দেখে না। কখনও শিশু সন্তানসহ তার পিতা মৃত্যুর করাল গ্রাসে পতিত হলে তাদের দেহ দাহ করে এসে মধ্যবর্তী জন এই দুই মৃত ব্যক্তির ধনে জীবনধারণ করতে ইচ্ছা করে। তাতে ধর্মের সঞ্চয় না করে, অতি তুচ্ছ বিষয়ভোগের লালসায় পাপ– কার্যের চিন্তা মধ্যবর্তী জন ঐ দুই মৃত ব্যক্তির ধনে জীবনধারণ করতে ইচ্ছা করে। তাতে ধর্মের সঞ্চয় না করে, অতি তুচ্ছ বিষয়ভোগের লালসায় পাপ– কার্যের চিন্তা করে থাকে।

হে অজ, শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিরা এই বিশ্বকে নশ্বর বলেন। মনীষীরাও সমাধিযোগে এই বিশ্বের নশ্বরত্ব প্রত্যক্ষ অনুভব করেছেন, তথাপি তারাও তোমার মায়ায় মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তোমার এই লীলা বস্তুতঃ অতি বিচিত্র।

অতএব, আমরা শাস্ত্রাদির অনুশীলনে বৃথা শ্রম না করে তোমাকেই প্রণাম করি।

হে দেব, তুমি সর্ববিধ আকর্ষণ মুক্ত ও অকর্তা হলেও, এই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কর্তা বলে বেদে তোমায় বর্ণনা করা হয়েছে, তা যুক্তিযুক্ত। তোমাতে কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। তুমি স্বীয় মায়ার দ্বারা সকলের আত্মস্বরূপ ও কার্যমাত্রের পালক, এতে তোমারই কর্তৃত্ব যুক্তযুক্ত। তুমি সকল হতে ভিন্ন বস্তুর স্বরূপ, এতে তোমার অকর্তৃত্ব ন্যায্য হতে পারে।

হে ভগবান, প্রলয়কালে তামস দৈত্যগণ কর্তৃক বেদসমূহ অপহৃত হয়েছিল। যিনি হয়শীর্ষমূর্তি অর্থাৎ অশ্বমস্তক ও মনুষ্যশরীর যুক্ত মূর্তি ধারণ করে রসাতল থেকে তা উদ্ধার করে ব্রহ্মার প্রার্থনানুসারে তাকেই প্রত্যর্পণ করেছিলেন, সেই সত্য-সংকল্প-স্বরূপ তোমাকে আমারা প্রণাম করি।

এইরকম হরিবংশেও ভগবান বিষ্ণু নৃসিংহ’ রূপে বিরাজ করছেন। যার শীল ও আচার দৈত্য– দানবকুলকে পবিত্র করে, মহাপুরুষদের গুণভোগী পরমব্রত প্রহ্লাদ মহারাজ, হরিবর্ষ বাসী জনগণের সাথে নিষ্কাম একনিষ্ঠ ভক্তিযোগের দ্বারা নিজের পরমপ্রিয় সেই নৃসিংহমূর্তির উপাসনা করছেন।

উপাসনাকালে, তিনি এইরূপ মন্ত্র উচ্চারণ করে থাকেন– হে সখা, হে প্রভু! আপনি নৃসিংহরূপী ভগবান। আপনি তেজঃসকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠরূপ প্রতীয়মান হন।

হে বজ্ৰনখ, হে ব্ৰজংদংষ্ট্র, আমাদের কর্মবাসনা সকল দগ্ধ করে। অন্ধকার বিনাশ করুন। হে ভগবান আপনি আমাদের অভয় দান করুন। আপনাকে প্রণাম করি।

হে ঈশ! এ বিশ্বের কল্যাণ হোক। খল ব্যক্তিগণ ক্রুরতা ত্যাগ করুক। প্রাণীগণ পরস্পরের মঙ্গল চিন্তায় রত হোক। তাদের মন শান্ত হোক। আমাদের ও প্রাণীবর্গের চিত্ত নিষ্কাম হয়ে ইন্দ্রিয়মার্গের অতীত ভগবানে নিবিষ্ট হোক।

হে দেব, আমাদের সকল আসক্তি দূর হয়। যদি না হয়, তবে তা যেন গ্রহাদি, স্ত্রী-পুত্র পরিজনে লক্ষিত না হয়ে ভগবৎপ্রিয় জনের প্রতি হয়। কারণ অনাসক্ত বিবেকী পুরুষ দেহরক্ষার উপযোগী দ্রব্যাদি দ্বারা পরিতুষ্ট হয়ে যেমন সত্ত্বর সিদ্ধিলাভ করতে পারে। গৃহাদিতে আসক্ত ইন্দ্রিয়পরায়ণ ব্যক্তির তেমন সিদ্ধিলাভ সক্ষম হয় না।

হে প্রভু, ভগবদ্ভক্তজনের সঙ্গ থেকে ভগবান মুকুন্দের বিক্রম অবগত হওয়া যায়। সেই বিক্রমের অসাধারণ প্রভাব যে সকল পুরুষ শ্রবণ করেন, শ্রী ভগবান তাদের অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে মানবিক গ্লানি দূর করেন। বারংবার তীর্থাদির সেবা করলে দৈহিক মল– রূপ গ্লানি দুর হলেও চিত্তবাসনা দূর হয় না। অতএব ভগবদ্ভক্তজনের সেবা করা অবশ্য কর্তব্য।

যাঁর বিশুদ্ধ চিত্তে ভগবান বাসুদেবের প্রতি নিষ্কাম ভক্তির উদ্রেক ঘটে, ভগবানের অনুগ্রহে সকল দেবগণ তার মধ্যে বাস করেন। গৃহাদি বিষয়াসক্ত হরি ভক্তিহীন, ব্যক্তি মনোরথ দ্বারা অতি তুচ্ছ বিষয়সুখের প্রতি ধাবিত হয়। এজন্য তাদের মধ্যে মহৎ ব্যক্তিসুলভ জ্ঞান-বৈরাগ্য- গুণের সম্ভাবনা নেই।

জলকে মৎস্যগণের অভিলষিত আত্মা বলা হয়, কারণ জল ছাড়া তাদের জীবনধারণ সম্ভব নয়। তেমনি ভগবান হরিই প্রতিটি প্রাণীর আত্মা।

কোনও মহৎ ব্যক্তি যদি হরি পরিত্যাগ করে গৃহাদিতে আসক্ত হন, তাহলে শুধুমাত্র বয়স দ্বারাই তার মহত্ত্ব নির্ণয় করা হয়, জ্ঞান দ্বারা নয়।

বস্তুতঃ জল ছাড়া যেমন জলচর মৎস্যাদি মারা যায়, হরিবিমুখ ব্যক্তিগণও তেমনি সর্বপ্রকার পুরুষার্থ থেকে বঞ্চিত হয়।

অতএব, হে দৈত্যগণ, তোমরা গৃহ ত্যাগ পূর্বক নির্ভয়ে নৃসিংহদেবের চরণের আরাধনা কর। গৃহাসক্তি হল তৃষ্ণা, রাগ-বিষাদ, মান, স্পৃহা, ভয়, দৈন্য প্রভৃতির মূল কারণ, এবং নিরবিচ্ছিনাদি জন্ম মরণাদি সংসারপ্রবাহের আশ্রয় স্বরূপ।

এইরূপ কেতুমালবর্ষেও ভগবান স্বয়ং কামদেব’ রূপে লক্ষ্মীদেবী ও সংবৎসরূপ প্রজাপতির পুত্র কন্যাগণের প্রিয়কার্য সাধনের জন্য বিরাজ করছেন। প্রজাপতি পুত্রগণ অর্থাৎ দিবাসভমনী দেবগণ এবং কন্যাগণ অর্থাৎ রাত্রির অভিমানী দেবীগণ এরাই ঐ বর্ষের অধিপতি তাদের সংখ্যা ছত্রিশ হাজার।

হে রাজ, সংবত্রগণের প্রিয় সাধনের জন্য ভগবানের ইচ্ছায় বিশেষ কারণ এই যে, মহাপুরুষের চক্রের তেজঃপ্রভাবে প্রজাপতির সেই কন্যাদের সাথে এবং দিব্যভাগে ঐ সকল কন্যার স্বামীগণের অর্থাৎ দিবযাধিষ্ঠাতৃ দেবগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে পরম সমাধিযোগে ভগবানের এই মায়াময় রূপের উপাসনা করে থাকেন, এবং এরূপ মন্ত্রবাক্য উচ্চারণ করেন।

হে ভগবন্ মনোরম কামদেব স্বরূপ আপনাকে প্রণাম করি। আপনি হৃষীকেশ আপনার স্বরূপ বা মূর্তি সর্ব প্রকারের গুণবিশেষ দ্বারা বিলক্ষণই হয়।

আপনি কর্মেন্দ্রিয়। জ্ঞানেন্দ্রিয়, সংকল্পাদি, চিত্তবিদ ও তৃতীয় বিষয় সমূহের অধিপতি। আপনি ষোড়শকলা, অর্থাৎ একাদশ ইন্দ্রিয় ও পাঁচটি বিষয় আপনার কলা বা অংশ। আপনি বৈদিক কর্মসমূহের প্রাপ্য বস্তু বলে বেদময়। আপনি অন্নাশয়বলে অন্নময় পরমানন্দের আবিষ্কারক বলে আনন্দময় এবং সকলের প্রাপ্য বলে সর্বময়। এইরূপ আপনি মনোবল, ইন্দ্রিয়বল ও শরীরবল এবং মনোরম। উভয়লোকে সর্বদা আপনাকে প্রণাম করে।

হে প্রভু, আপনি হৃষীকেশ, অর্থাৎ জীবের ইন্দ্রিয়াদির পতি। যে রমণীগণ বিবিধ ব্রত দ্বারা নিজ পতিকামনার্থে আপনার উপাসনা করে, সেই পতিগণ সন্তান, ধন, মান কিছুই রক্ষা করতে পারে না। যিনি স্বয়ং নির্ভয় এবং কালাদি ভয় থেকে কাতর জনকে সর্বতোতাবে রক্ষা করতে পারেন, আপনিই সেই যথার্থ পতি।

আত্মলাভেই সন্তুষ্ট বলে অপর কোনো বিষয় আপনার কাম্য হয় না, অতএব আপনি স্বাধীন। অন্যথায়, যাদের সুখ পরাধীন, তারা অস্বতন্ত্র ও বহু। এজন্য এক সম্রাটের অধীন সামন্ত রাজগণের ন্যায় তাদেরও পরস্পরের নিকট হতে ভয় থাকে।

হে ভগবন্‌, যে স্ত্রী স্বতন্ত্র পুরুষরূপী আপনারই পাদপদ্মের সেবা করেন, তিনি সমস্ত কাম অর্থাৎ সুখই লাভ করেন। যে স্ত্রী অন্য কোনো ফল কামনায় আপনার পুজো করে, আপনি তাকে অভীষ্ট বস্তুই দান করেন। সে সকল বস্তু অনিত্য বলে ভোগের দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হলে, তাকে অনুতাপ করতে হয়। হে অজিত, ব্রহ্মা, শঙ্কর, দেব, অসুর প্রভৃতি সকলেই আমাকে লাভ করার জন্য কঠোর তপস্যা করেন। কিন্তু আপনার চরণামিশ্রিত ব্যক্তি ছাড়া কেউই আমাকে লাভ করতে পারে না। যেহেতু আপনাতেই আমার হৃদয় নিহিত রয়েছে, অতএব আমি আপনার অধীনা সেজন্য আপনার সেবকগণের প্রতিই আমি দৃষ্টিপাত করে থাকি। হে অচ্যুত, যাঁর ভজনা ছাড়া কোনো পুরুষার্থই সিদ্ধ হয় না, আপনি সেই পুরুষ। আপনার যে করকমল হতে সকল কাম বর্ষিত হয়, এজন্য ভক্তগণ সর্বদা তার স্তব করে থাকেন। আপনি ভক্তগণের মস্তকে কৃপা করে যে হস্তকমল বিন্যস্ত করেন, অনুগ্রহ করে আমার মস্তকে তা সংস্থাপন করুন।

হে বরেণ্য, আমার প্রতি আপনার অনাদর লক্ষিত হয় না, কারণ আপনি শ্রীবৎস চিহ্নরূপ আমাকে নিজ বক্ষঃস্থলে ধারণ করছেন। কিন্তু আমার প্রতি আদর থাকলেও ভক্তদের প্রতি আপনার অপার করুণা। আপনি ঈশ্বর, আপনার মায়ার চেষ্টা বোঝার সাধ্য কারও নেই।

এইরূপ রম্যক বর্ষে ভগবান নিজ প্রিয়তম মৎস্যাবতার’ মূর্তিটি পূর্বে ঐ বর্ষের অধিপতি সত্যব্রত রাজা দর্শন করেন। এখানে তিনি শ্রাদ্ধদেব নামে মনুরূপে বর্তমান। সেই মনু এখনও পরম ভক্তিভরে তার আরাধনায় রত থাকেন। তিনি যে মন্ত্র উচ্চারণ করেন, তা হল- সেই মহা-মৎস্যরূপী ভগবানকে প্রণাম করে। তিনি সত্ত্বপ্রধান এবং মুখ্যতম প্রাণ অর্থাৎ সূত্ৰাত্মা, সাহস, বল ও সামর্থ্য ইত্যাদির স্বরূপ, তাঁকে প্রণাম করি।

হে ভগবন্‌, আপনার সুমহান ধ্বনি বেদরূপে প্রকাশিত হয়েছে। আপনি প্রাণরূপে জগতের অন্তরে ও বাহিরে বিচরণ করছেন, কিন্তু লোকপালগণও আপনার রূপী দেখতে পান না। মানুষ যেমন কাষ্ঠনির্মিত পুতুলকে রজ্জবদ্ধ করে নাচিয়ে থাকে। তেমনিও আপনিও এই বিশ্বের সকল কার্য নিয়ন্ত্রণ করেন। হে ঈশ, ইন্দ্রাদি লোকপালগণ মৎস্যরূপে জ্বরে অভিভূত, তারা পরের উৎকর্ষ সহ্য করতে পারেন না, যাঁকে পরিত্যাগ করে, তারা ভিন্ন ভিন্ন রূপে অথবা সকলের মিলিত প্রচেষ্টাতেও এ জগতে স্থাবর জঙ্গম কোন বস্তুই পালন করতে সমর্থ হন না, আপনিই সেই ঈশ্বর, আপনিই সকলের পালক, পরম ঈশ্বর।

হে অজ, আপনি আমার সহিত ওষধি এবং লতারাজির আধার স্বরূপ এই পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য মহাতরঙ্গায়িত প্রলয়ে সাগরে মহাপরাক্রমে বিচরণ করেছিলেন। আপনি এই জগতের প্রাণসমষ্টির নিয়ন্তা, আপনাকে নমস্কার।

এইভাবে, হিরন্ময় বর্ষেও ভগবান হরি ‘কূর্মমূর্তি ধারণ করে বিরাজ করছেন। পিতৃগণের অধিপতি অর্যমা সেই বর্ষবাসী পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হয়ে, ভগবানের সেই প্রিয়তম মূর্তির আরাধনা করেন। এই মন্ত্র তারা নিরন্তর জপ করতে থাকেন– আমরা ভগবান কূর্মদেবকে প্রণাম করি। হে প্রভু, সমস্ত সত্ত্বগুণ আপনার বিশেষণ অর্থাৎ আকার, আপনাকে প্রণাম।

জলচর বলে যাঁর স্থিতি লক্ষ্য করা যায় না, সেই আপনাকে প্রণাম করি। হে দেব, আপনি অতিশয়ে বর্ষীয়ান, কাল দ্বারা আপনার অবচ্ছেদ ঘটে না। হে প্রভু! আপনি সর্বগত, সকলের আধার, আপনাকে প্রণাম করি।

হে ভগবান, আপনি নিজে মায়ার দ্বারা যে আকৃতি প্রকাশ করেছেন, দৃশ্য-পৃথিব্যাদি পদার্থ- সমুহ এরই প্রকৃতি।

আপনার এই রূপ বিভিন্ন রূপ দ্বারা নিরূপিত হলেও তা মিথ্যা কল্পিত। হে প্রভু, আপনার আকারের বিশেষ কেউ নিরূপণ করতে পারে না। আপনি এক অদ্বিতীয় বস্তু–এই নিখিল বিশ্বে আপনি একমাত্র সার বস্তু। জরায়ুজ, স্বেদজ, অণ্ডজ, উদ্ভিদ, দেবতা, ঋষি, পিতৃগণ, ভূতগণ ইন্দ্রিয়াদি, স্থাবর, জঙ্গম, গ্রহ নক্ষত্র প্রভৃতি নাম আপনারই।

হে ভগবন্‌, আপনার রূপ, নাম ও আকৃতির প্রভেদ যে তা সংখ্যাতীত। তবুও, কপিল প্রভৃতি মনীষীগণ আপনার মধ্যে চতুর্বিংশত্যাদি তত্ত্ব সংখ্যা কল্পনা করেছেন। যে তত্ত্বজ্ঞানের সাহায্যে ঐ সকল কাল্পনিক সংখ্যার নিরিখে হয়, সেই পরমার্থ জ্ঞানরূপী আপনাকে প্রণাম করি।

এই রূপ উত্তর কুরুবর্ষে ভগবান যজ্ঞপুরুষ ‘বরাহমূর্তি ধারণ করে বিরাজ করছেন। এই পৃথিবীদেবী কুরুবর্ষবাসী জনগণের সাথে অস্থালিত ভক্তিযোগ দ্বারা তার সেবা করেন, এবং এই পরমা উপনিষদ আবৃত্তি করে থাকেন– আমরা শ্রী ভগবানকে প্রণাম করি। হে প্রভু, আপনি মন্ত্রদ্বারা প্রকাশিত হন। দৃশ্যমান স্যুপ অজ্ঞ, অযুপ যজ্ঞ কর্মের দ্বারা শুদ্ধ, অর্থাৎ যজ্ঞানুষ্ঠাতা ও ত্রিযুগ স্বরূপ অর্থাৎ কলিকালে আপনার অবতার প্রচ্ছন্নরূপে প্রকাশ পায়।

হে দেব, আপনাকে প্রণাম করি।

হে ভগবন, অগ্নি যেমন কাষ্ঠমধ্যে অপ্রকাশিত অবস্থায় বিরাজ করে, আপনার স্বরূপও তেমনি দেহেন্দ্রিয়গণের মধ্যে নিহিত রয়েছে। নিপুণ পণ্ডিতগণ, বিবেক– সাধন, মন, কর্ম ও ফল দ্বারা আপনাকে দর্শনের ইচ্ছায় সতত অন্বেষণ করে থাকেন। এরূপ অন্বেষণে যাঁর স্বরূপ প্রকাশ পায়, সেই ভগবানকে আমি প্রণাম করি।

মায়ার কার্য যে বিষয়, ইন্দ্রিয়াদির ব্যাপার, ইন্দ্রিয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, দেহ, কাল, কর্ম– এই সমুদয় আপনার উপলক্ষণ মাত্র। এইসকল গৌণলক্ষণ দ্বারা যাঁকে বস্তুরূপে অবগত হওয়া যায়, আপনি সেই আত্মা, যম, নিয়ম প্রভৃতি যোগাঙ্গ সকলের দ্বারা যাদের বুদ্ধি তত্ত্ব নির্ণয়ে সক্ষম হন, বিচারের দ্বারা সেই তত্ত্বজ্ঞ মহাপুরুষেরা আপনার মায়িক রূপের নিবাস করেন। সেই নির্গুণস্বরূপ আপনাকে প্রণাম করি।

যেমন, অয়স্কান্তমণির সন্নিকর্ষের কারণে লৌহ সেই অভিমুখে গমন করে, তার মতো মায়া– যে দ্রষ্টা পরমেশ্বরের লক্ষণ হেতু জীবের নিমিত্ত নিজের ইঙ্গিত না হলেও জীবের ইঙ্গিত এই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় করেছেন, সেই গুণকর্ম এবং অদৃষ্টের সাক্ষীস্বরূপ ভগবানকে আমি নমস্কার করি।

যিনি জগতের কারণস্বরূপ বরাহমুর্তি প্রকট করেছেন, যিনি নিজ দম্ভাগ্রে আমাকে ধারণ করে মত্ত হস্তীর মতো রসাতল থেকে উদ্ধার করেছেন, তাঁকে প্রণাম করি। তিনি প্রলয় সাগরতল থেকে আমাকে উদ্ধারের সময় প্রতিদ্বন্ধী হিরণক্ষ দৈত্যকে ধ্বংস করে ক্রীড়ারত ছিলেন যে এই ভগবান বিভুর চরণে আমি প্রণিপাত করি।

.

ঊনবিংশ অধ্যায়
কিম্পুরুষ কর্তৃক ভারতবর্ষের বর্ণনা এবং
ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠত্ব কথন

শ্ৰী শুকদেব বললেন–হে মহারাজ, ভগবান আদিপুরুষ সীতাপতি রামচন্দ্রের চরণস্পর্শ করে শ্রী হনুমান তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

তিনি রামচন্দ্রের প্রতি ভক্তিযোগ অবলম্বন করে কিংবা কিংপুরুষ শ্রেষ্ঠ অষ্টিষেণের সঙ্গে শ্রীরামচরিত শ্রবণ ও গায়ন করছেন। তারা বলছেন- ভগবান উত্তমশ্লোকের নমস্কার করি।

তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ চিহ্নাদি, শীল ও ব্রত নিত্য বিরাজমান। তিনি সর্বদাই সংযত চিত্ত। সকল লোকের বিষয় তার জ্ঞাত। নিকষ প্রস্তরের ন্যায় সাধুত্ব প্রসিদ্ধির নির্ধারণ স্থান। সেই ব্ৰহ্মণ্যদেব মহাপুরুষ মহারাজ ভগবান শ্রীরামচন্দ্র চরণে প্রণত হই। বেদান্ত শাস্ত্রসিদ্ধ অদ্বিতীয় তত্ত্ব সেই পরমাত্মাস্বরূপ শ্রী রামচন্দ্রের শরণাপন্ন হই। তিনি স্বপ্রকাশ বলে জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তিরূপ তিন অবস্থা দূর করে প্রশান্ত ও বিশুদ্ধরূপে বিরাজিত।

তিনি নাম– রূপ বর্জিত হওয়ার কারণে নিখিল দৃশ্য পদার্থের অতিরিক্ত, জ্ঞানরূপ নিরহংকার বস্তু। এ অবস্থায় শুদ্ধচিত্তে সাধকপুরুষ তাকে ব্রহ্মরূপে অনুভব করতে পারেন। তিনি স্বরূপতঃ পরম ব্রহ্ম হয়েও রাবণের বধের জন্য মানুষরূপে ধরাতলে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কারণ ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত রাবণ, মনুষ্যভিন্ন অন্য সবার কাছে অবধ্য ছিলেন।

এছাড়াও সংসারে স্ত্রী সঙ্গজনিত কারণে দুঃখ প্রাপ্তি অনিবার্য এ বিষয়ে তিনি সংসারাশ্রয়ী লোককে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। নতুবা, জগতাত্মা ঈশ্বরের পক্ষে সীতা বিরহে দুঃখ প্রাপিত কখনও স্বাভাবিক

আচরণ নয়। অপরকে শিক্ষা দিতেই তিনি ঐ মায়ার আশ্রয় নিয়েছিলেন।

শ্রীরামচন্দ্ৰ মহাপুরুষগণের আত্মা এবং পরম সুহৃদ স্বরূপ। তিনি ত্রিভুবনের কোনো বিষয়েই আসক্ত নন। সেই পরমাত্মার পক্ষে স্ত্রী বিরহজনিত মোহ ও লক্ষণ বর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

অপরদিকে মহকুলে জন্ম, অথবা সৌন্দর্য, কিংবা বাক্য অথবা বুদ্ধি, জাতি কিছুই থাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। শুধু মাত্র ভক্তিতেই তিনি তুষ্ট হন। আমরা বনচর বানর, শুধুমাত্র আতলান্তিক ভক্তিতে তাকে তুষ্ট করেছি। তিনি আমাদের তো সৌন্দর্য, মহৎগুণাদি কিছুই নেই।

সেজন্য সুর, অসুর, নর, বানর–সবারই সেই মনুষ্যরূপী শ্রীহরির সেবা করা কর্তব্য। তিনি অতি অল্পেই সন্তুষ্ট হন। তার উপাসনার এমনই মহিমা যে, তিনি অযোধ্যাবাসী সকলকেই নিজধাম বৈকুণ্ঠে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

এই ভারতবর্ষেও ভগবান নর-নারায়ণ’ রূপে প্রলয়কাল পর্যন্ত তপস্যায় নিরত হয়েছেন, সেই তপস্যার ফলে ধর্ম, জ্ঞান ঐশ্বর্য, ইন্দ্রিয় সংযম বৃদ্ধি পেলে ও অহংকার লুপ্ত হয়ে আত্মজ্ঞানের উদয় হয়। তার আচরণ দুয়ে, তিনি করুণাপরবশ হয়ে আত্মতত্ত্ব-জিজ্ঞাসু-ব্যক্তিদের প্রতি অনুগ্রহ বিতরণের জন্য তপস্যা করেছেন নতুবা তার কোনও নিজস্ব প্রয়োজন নেই।

দেবর্ষি নারদ, শ্রী ভগবান নর– নারায়ণের মুখ থেকে সংখ্যা ও যোগতত্ত্ব অবগত হয়ে সাবর্ণি মানুকে তা উপদেশ করতে ইচ্ছা করেন। সেজন্য সেখানে তিনি বর্ণাশ্রম আচার নিষ্ঠ ভারতীয় প্রজাদের সঙ্গে ভগবানের উপাসনা করছেন।

তিনি বলছেন– আমি ঋষিশ্রেষ্ঠ ভগবান নর-নারায়ণকে প্রণাম করি। যিনি উপশমশীল, নিরহংকার ও অকিঞ্চন পরমগুরু ও আত্মারাম জনের অধিপতি, তাঁকে প্রণাম করি। তিনি আরও বলেছেন– তিনি এই নিখিল বিশ্বের কর্তা হয়েও অভিমানহীন। তিনি দেহস্থিত হয়েও দেহধর্মাদি ক্ষুধা পিপাসায় অভিভূত হন না। দ্রষ্টা হয়েও তার দৃষ্টি দৃশ্য বিষয়ে আসক্ত হয় না।

তিনি সকলের সাক্ষী হয়েও সবার থেকে বিযুক্ত, সে যোগীপুরুষ জন্মাবধি ভক্তির অনুষ্ঠান করে, অন্তকালে অসৎদেহ অভিমান ত্যাগ করে তোমাতে মনঃসংযোগ করেন। এই যোগকৌশলকেই ভগবান হিরণ্যগর্ভ পুরুষযোগ বলেছেন।

ঐহিক ও পারলৌকিক বিষয় সুখ-ভোগের ইচ্ছায় মূর্খ ব্যক্তি তুচ্ছাতিতুচ্ছ ক্ষুদ্র বিষয়ের সংগ্রহ ও সংরক্ষণে চিহ্নিত হয়। তেমনি বিদ্বান ব্যক্তিও যদি ভয়কাতর হয় তাহলে তার শাস্ত্রপাঠ বৃথা শ্রম মাত্র।

হে অবোজ, আপনার প্রতি যে স্বাভাবিক অনুরাগ সেই অনুরাগময় যে যোগবলে আমরা এই অসৎ দেহবিষয়ে আপনার মায়াময় অহংকার ও মমতাময় দুচ্ছেদ্য বন্ধন ছেদন করতে পারি, আপনি সেই যোগের উপদেশ করুন।

হে রাজন, এই ভারতবর্ষে বহু নদী ও পর্বত আছে। যথা–মলয়, মঙ্গলপ্রস্থ, মৈনাক, ত্রিকূট, ঋষভূ, সহ্য, দেবগিরি, ঋষ্যমূক, শ্রীশেল, বিন্ধ্য, দ্রোণ, চিত্রকূট গোবর্ধন, রৈবর্তক প্রভৃতি।

এই পর্বতাদির পাদদেশ থেকে উৎপন্ন বহু নদ-নদী আছে।যার নামোচ্চারণেই লোকে পবিত্র হয়। ভারতবাসী জনগণ ঐ সকল নদ-নদীর জলে অবগাহন ও পানাদি ক্রিয়া সম্পাদনা করেন। তার মধ্যে গোদাবরী, যমুনা, গোমতী, সরস্বতী, তুঙ্গভদ্রা, আম্রপর্ণী, চন্দ্ৰবশা, কাবেরী, মন্দাকিনী, বিতস্তা প্রভৃতি মহানদী। ব্রহ্মপুত্র, শোন প্রধান দুইটি মহানদ বর্তমান।

কর্ম অনুযায়ী মানুষের সকল গতি নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিগণ নিজেদের অনুষ্ঠিত সাত্ত্বিক, রাজস ও তামস বর্মের দ্বারা স্বর্গীয় মানবীয় ও নারকীয় –এই তিন প্রকার গতি প্রাপ্ত হয়।

আবার ব্রাহ্মণাদি যে বর্ণের যে প্রকারে মুক্তির বিধান রয়েছে, সেই অনুসারে তাদের এখানে মুক্তিলাভ সম্ভব হয়। যে সমান মহাপুরুষ শ্রীহরির ভক্তগণের প্রকৃষ্ট সঙ্গলাভ সম্ভব হয়, তখনই বিভিন্ন সংসারগতির কারণস্বরূপ অবিদ্যাগ্রন্থির ছেদন হয়ে থাকে, এবং সে অবস্থায় রাগদোরহিত, বাক্যের অগোচর, নিরাধার ও সর্বজীবাত্মা পরম পুরুষ ভগবান বাসুদেবের প্রতি যে স্বাভাবিক ভক্তিযোগের উদয় হয়, তাই মুক্তির স্বরূপ।

অতএব, ভারতবর্ষে মানবজন্ম সকল পুরুষার্থের সাধন বলে, দেবতারাও গান করে থাকেন– অহহ! এই মানবগণের অনির্বচনীয় পুণ্য বলে ভগবান শ্রীহরি এদের সাধনা ছাড়াও এদের প্রতিপুষ্ট। এই ব্যক্তিগণ ভারতভুমির মধ্যে মানবকুলে মুকুন্দসেবার উপযোগী জন্ম লাভ করেছে। এদের পক্ষে ভগবান শ্রীহরির অনায়াস কৃপালাভ অসম্ভব নয়।

আমরা ভারতবর্ষে জন্মাবার আকাঙ্ক্ষা মনে পোষণ করলেও, তা ভাগ্যে ঘটে না। আমাদের দুষ্কর যজ্ঞ, তপস্যাদি নিরর্থক কারণ স্বর্গে ভগবানের শ্রীচরণের স্মরণ হয় না। যদি বা কোনোভাবে তা সম্ভব হয়, তবু আমাদের ইন্দ্রিয়গণ প্রবলভভাগে আসক্ত থাকায়, তা লুপ্ত থেকে যায়। প্রলয়কাল পর্যন্ত পরামায়ুযুক্ত দেবগণের স্বর্গস্থান লাভ করার চেয়ে স্বল্পায়ু মানব হয়ে ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করাই শ্রেয়।

কারণ চিরজীবী দেবগণেরই পুনরায় সংসারে জন্মগ্রহণ করতে হয়। কিন্তু ভারতবাসী মরণশীল হওয়া সত্ত্বেও যশকালের মধ্যেই কৃতকর্মের পরিহার করে। শ্রীহরির অভয়পদ লাভ করতে পারে।

যেখানে শ্রীহরির কথারূপ অমৃতনদীর প্রবাহ নেই, যে স্থানে সাধু ভাগবতগণ অবস্থান করেন না। এবং যে স্থানে নৃত্যাদি মহোৎসব যুক্ত ভগবৎপূজার প্রবর্তন হয় না, সে স্থান ব্ৰহ্মলোক হলেও আশ্রয়যোগ্য হয় না।

যারা এই ভারতবর্ষে জ্ঞান, জ্ঞানের উপযোগী ক্রিয়া ও তার উপকরণে পরিপূর্ণ জন্ম লাভ করেও মুক্তির জন্য যত্ন করে না, তারা পুনরায় বন্ধনপ্রাপ্ত হয়।

জালবদ্ধ পাখীরা ব্যাধ কর্তৃক মুক্ত হয়েও আবার সেখানে বিহার করতে গেলে, অসাবধানতা বশতঃ বদ্ধ হয়। তেমনি এই ব্যক্তিগণ ভারতভূমিকে মোক্ষর্থ জন্মলাভে সক্ষম হয়েও নিজ নিজ কর্মদোষে আবার সংসারে আবদ্ধ হয়।

অহো, ভারতবাসীগণের কি অসীম সৌভাগ্য! তারা বিভিন্ন যজ্ঞে নানাবিধ মন্ত্র, বস্তু দ্বারা বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে দান করলেও, স্বয়ং ভগবান শ্রীহরি সেগুলো গ্রহণ করেন। ভগবানের নিকট প্রার্থনা করলে সকল বাঞ্ছিত বস্তু লাভ করা সম্ভব হলেও পরমার্থ লভ্য হয় না।

সেজন্য বাঞ্ছিত বস্তু লাভ করলেও লোকে বারংবার প্রার্থনাই করতে থাকে। কিন্তু পরমার্থ লাভ করলে, জীবকে আর ভিন্ন কিছু প্রার্থনা করতে হত না।

যে ব্যক্তিগণ ভগবান শ্রীহরির কাছে প্রার্থনা করেন না, তিনি স্বয়ং তাদের সর্বকামনার পরিপূরক নিজ চরণপদ্ম দান করেন।

স্বর্গসুখ ভোগের পর যদি আমাদের পূর্বকৃত উত্তম শাগ শাস্ত্র পাঠ ও অন্যান্য সৎ কর্মের পুণ্য কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকে, তা হলে ভগবান শ্রীহরিই একমাত্র আরাধ্য এজন্য কামনা করি, ভারতবর্ষে যেন আমরা জন্মলাভ করতে পারি। কারণ শ্রীহরিই সেবকদের পরম সুখ দান করেন।

শ্রী শুকদেব বলেন- হে মহারাজ, জম্বুদ্বীপে আটটি উপদ্বীপ আছে। কোনো কোনো পণ্ডিতগণ বলে থাকেন, সাগরের পুত্রগণ যজ্ঞীয় অশ্বের অন্বেষণ কালে পৃথিবীর চতুর্দিকে মনন করেছিলেন। তার ফলে উপদ্বীপ সকলের সৃষ্টি হয়েছিল।

ঐ দ্বীপ সকলের নাম– স্বর্ণপ্রস্থ, চন্দ্ৰশুক্ল, আবর্তন, রমণক, মন্দহরিণ, পাঞ্চজন্য, সিংহল ও লঙ্কা। এই ভারততত্তম, জম্বু –দ্বীপের বর্ষবিভাগ উপদেশানুসারে তোমার কাছে বর্ণনা করলাম।

.

বিংশ অধ্যায়
প্লক্ষাদি ছয়টি দ্বীপ ও লোকালোক পর্বতের বর্ণনা

শ্ৰী শুকদেব বললেন– মহারাজ, অনন্তর আমি প্লক্ষ প্রভৃতি ছয়টি দ্বীপের প্রমাণ, লক্ষণ ও আকৃতি অনুযায়ী তাদের বর্ষবিভাগ করব।

মেরুপৰ্বত যেমন জম্বুদ্বীপ দ্বারা পরিবেষ্টিত, সেরূপ জম্বুদ্বীপও নিজের ন্যায় বিস্তৃতি যুক্ত (অর্থাৎ সেটি লক্ষযোজন বিস্তৃত) লবণসাগর দ্বারা বেষ্টিত। আবার পরিখা যেমন বাইরে উপবন দ্বারা বেষ্টিত থাকে, তেমন লবণ সাগরও দ্বিগুণ বিস্তৃত প্লক্ষদ্বীপ দ্বারা পরিবেষ্টিত রয়েছে।

অর্থাৎ প্লক্ষদ্বীপ, জম্বুদ্বীপ অপেক্ষা দ্বিগুণ বিস্তীর্ণ। জম্বুদ্বীপের জন্ধু বৃক্ষটির যা পরিমাণ প্লদ্বীপেও সেরূপ পরিমাণ বিশিষ্ট একটি প্লক্ষবৃক্ষ বা পাকুড় আছে। এই গাছটির নাম অনুসারেই ঐ দ্বীপের নাম হয়েছে প্ল-দ্বীপ। তার নিকটেই সপ্ত জিহ্বাযুক্ত অগ্নি বিরাজমান। প্রিয়ব্রত তনয় ইমজিহ্ এই দ্বীপের অধিকারী তিনি এই দ্বীপকে সাতটি বর্ষে ভাগ করেছিলেন। ঐ বর্ষসকলের অনুরূপ নাম বিশিষ্ট নিজের সাত পুত্রকে অর্পণ করেছিলেন। তারপরে, তিনি স্বয়ং সমষ্টিযোগে দেহ নিবৃত্ত হয়েছিলেন।

ঐ বৰ্ষসকলের নাম– শিব, বয়স, সুভদ্র, শান্ত, ক্ষেম, অমৃত ও অভয়।

ঐ সপ্তবর্ষে সাতটি পর্বত ও সাতটি নদী অতি প্রসিদ্ধ। প্রসিদ্ধতম সপ্ত পর্বতের নাম– মণিকুট, বজ্ৰকুট, ইন্দ্রসেন, জ্যোতিষ্মন, সুবর্ণ, হিরণ্যষ্ঠীব ও মেঘমাল। প্রসিদ্ধতম সপ্তনদীর নাম হল– অরুণা, নৃম্না, আঙ্গিরসী, সাবিত্রী, সুপ্রভাতা, খাতম্ভরা, এবং সত্যম্ভরা। এই নদীর জলে স্নান আচমনাদি করলে রজঃ ও তমোগুণ নিবৃত্ত হয়।

হংস, পতঙ্গ, উদ্বায়ন ও সত্যাঙ্গ নামক ব্রাহ্মণ স্থানীয় সেই চারবর্ণের প্রজাগণ বেদবিদ্যার দ্বার স্বর্গের দ্বারসদৃশ জগতাত্মা বেদময় সূর্যদেবের উপাসনা করেন। তাঁদের পরমায়ু সহস্র বছর এবং রূপ ও প্রজনন ক্রিয়া দেবতুল্য। তাদের উপাসনা মন্ত্র হলো এরকম– আমরা পুরাণ পুরুষ ভগবান বিষ্ণুর মূর্তিস্বরূপ সূর্যদেবের শরণ গ্রহণ করছি। তিনি সত্য, ঘাত, দেব, শুভ, ও অশুভ ফলের অধিষ্ঠাতা।

প্লক্ষ প্রভৃতি পাঁচটি দ্বীপের প্রজাগণের আয়ু, ইন্দ্রিয়শক্তি, ওজঃ, সামর্থ্য, বল, বুদ্ধি, ও বিক্রম এই সকল জন্ম থেকে সিদ্ধ হয়ে একই ভাবে বর্তমান থাকে।

প্লক্ষদ্বীপ সমান পরিমাণ অর্থাৎ দুলক্ষ যোজন বিস্তৃত ইক্ষুরস সাগর দ্বারা বেষ্টিত। শাল্মল দ্বীপ তেমনি প্লক্ষ দ্বীপ অপেক্ষা দ্বিগুণ অর্থাৎ চারলক্ষ যোজন পরিমাণ সুরারস সগর দ্বারা বেষ্টিত।

সেই দ্বীপে একটি বিরাট শাল্মলী বৃক্ষ আছে। যেখানে গরুড়ের আবাস স্থান বিদ্যমান। এই দ্বীপের অধিপতি প্রিয়ব্রত তনয় যজ্ঞবাহু। তিনি এই দ্বীপটি নিজের সাত পুত্রের মধ্যে সাতটি বর্ষে ভাগ করে দেন। তাদের নাম হল– সুরোচন, সৌমনস্য, রমণক, দেববহ, পরিভদ্র, আপ্যায়ন ও অভিজ্ঞাত।

ঐ সকলবর্ষে সাতটি বর্ষপর্বত এবং সাতটি নদী প্রসিদ্ধতম। পর্বতাদির নাম– সুরস, শতশৃঙ্গ, বামদেব, কুন্দ, কুমুদ, পুষ্পবর্ষ ও সহস্ৰশ্রুতি। নদীগণের নাম– অনুমতি, সিনীবালী, সরস্বতী, কুহু, রজনী, নন্দা ও রাকা।

এই বর্ষসমূহের অধিবাসী শ্রুতিধর, বীর্যধর, বসুন্ধর, ইয়ুন্ধর নামক পুরুষেরা বেদমন্ত্রের দ্বারা জগতাত্মা বেদময় ভগবান সোমদেবকে আরাধনা করেন এবং এই মন্ত্রের স্তব করেন। যিনি কৃষ্ণ ও শুক্লপক্ষে নিজ রশ্মির সাহায্য পিতৃ ও দেবগণকে অন্নদান করেছেন। সেই রাজা সোম আমাদের সকল প্রজাদের অনুকূল হোন।

এইভাবে সুরাসাগরের বহির্ভাগে শাল্মল দ্বীপ অপেক্ষা দ্বিগুণ বিস্তৃত আট লক্ষ যোজন পরিমিত কুশদ্বীপ বর্তমান।

উহা সমপরিমাণ ঘৃতোকে সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। ঐ দ্বীপে দেবনির্মিত একটি বিশাল কুশস্তম্ভ থাকতে উহার নাম ‘কুশদ্বীপ’ হয়েছে। সেই কুশস্তম্ভ দ্বিতীয় অনলের ন্যায় কোমল দীপ্তিতে দিক্ সমূহকে উদ্দীপিত করছে।

হে রাজন, উক্ত কুশদ্বীপের অধিপতি প্রিয়ব্রত পুত্র হিরণ্যদেবতা। তিনিও নিজের সাত পুত্রের মধ্যে দ্বীপটিকে বিভক্ত করে, নিজে তপস্যায় রত হয়েছিলেন। তার এই সাত পুত্রের নাম– বসু, বসুদাম, দৃঢ়রচি, নাভিভপ্ত, সত্যব্রত, বিপ্রনাম ও দেবনাম। তাদের নামযুক্ত ঐ সকল বর্ষে সাতটি বর্ষে সীমাপর্বত ও সাতটি নদী প্রসিদ্ধ। ঐ সাত পর্বতের নাম– বভ্রু, চুতঃশৃঙ্গ, কপিল, চিত্রকুট, দেবানীক, উর্ধ্বরোমা ও দ্রাবণ।

নদীর নাম– রসকুল্যা, মধুকল্যা, মিরিন্দা, শ্রুতবিন্দা, দেবগর্ভা, ঘৃতচ্যুতা ও যন্ত্রমালা।

কুশদ্বীপবাসী কুশল কোবিদ, অভিমুক্ত ও কুলক নামক প্রজাগণ এই নদীর জল সেবন করে বিশেষ আচারে ভগবান অগ্নিদেবের উপাসনা করেন। তারা বলেন- হে অগ্নে, তুমি সাক্ষাৎ পরব্রহ্মের হব্য বহন কর। অতএব সেই পরমপুরুষের অঙ্গস্বরূপ দেবগণের যজ্ঞ দ্বারা অঙ্গীপুরুষ শ্রীহরির আরাধনা কর।

কুশদ্বীপের বহির্ভাগে ক্রৌঞ্চদ্বীপ অবস্থিত। এই দ্বীপ আবার কুশদ্বীপ অপেক্ষা দ্বিগুণ আয়তনযুক্ত, ক্ষীরজল-সাগর দ্বারা বেষ্টিত। এই দ্বীপস্থিত প্রকাণ্ড পর্বত ক্রৌঞ্চের নাম অনুসারে, এই দ্বীপের নামকরণ হয়েছে। পুরাকালে কার্তিকের রাগে এই পর্বতের কিয়দংশ বিধ্বস্ত হলেও ক্ষীর সাগরের সংস্পর্শে ও জলদেব বরুণের দ্বারা এই দ্বীপ সর্বতোভাবে রক্ষিত হয়েছিল। প্রিয়ব্রত পুত্র জ্ঞানী ঘৃতপৃষ্ঠই এই দ্বীপের আধিপত্য লাভ করেন।

তিনিও পরে নিজ সাতপুত্রের মধ্যে এই দ্বীপটিকে ভাগ করে দেন। পরে তিনি নিজে জ্ঞানী রূপে ভগবান শ্রীহরির চরণকমলের আশ্রয় গ্রহণ করেন।

ঘৃত পৃষ্ঠের ঐ পুত্রগণের নাম হলো– আত্মা, মধুরুহ, মেঘপৃষ্ঠ, সুধামা, ভ্রাজষ্ঠ, লোতিতার্ণ ও বনস্পতি। তাদের মধ্যে সাতটি পর্বত ও সাতটি নদী বিখ্যাত। পর্বতগণের নাম হল- শুক্ল, বর্ধমান, ভোজন, উপবহন নন্দ, নন্দন ও সর্বতোভদ্র।

নদীগণের নাম– অভয়া, অমৃতৌখা, আর্ষকা, তীর্থবতী, রূপবতী, পবিত্রবতী ও শুক্লা। ঐ নদীগুলের জল ব্যবহার করে ঐ সকল বর্ষের অধিবাসী পুরুষেরা জলময় ভগবানের অর্চনায় রত হন। তখন তারা এইরূপ মন্ত্র উচ্চারণ করেন- হে জল সকল, তোমরা নিজ হতেই পাপ বিনাশক, বিশেষতঃ পরমেশ্বরের নিকট থেকে শক্তিলাভ করেছ।

অতএব, ভুলোক, ভুর্বলোক এবং স্বর্গলোকরূপ ত্রিভুবন পবিত্র করছ। আমরা তোমাদের স্পর্শ করছি, তোমরা আমাদের শরীর পবিত্র কর।

এইরকম ক্ষীরোদ সাগরের পর তার চতুর্দিকে বত্রিশলক্ষ যোজন বিস্তৃত শাকদ্বীপ অবস্থিত উহার সমপরিমাণ দধি সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত ঐ দ্বীপে শাক নামক একটি বিশাল তরু আছে, তার পত্ৰসকল অন্তরে ঘনস্পর্শ, বাহিরে মৃদুস্পর্শে সেই বৃক্ষের অবস্থিতির কারণে এই দ্বীপের নাম হয়েছে শাকদ্বীপ।

ঐ বৃক্ষের মনোরম সৌরভে সমগ্র দ্বীপটি সুবাসিত হয়ে থাকে।

প্রিয়ব্রতের আত্মজ মেধাতিথি ঐ দ্বীপের অধিপতি ছিলেন, তিনি নিজের সাত পুত্রের মধ্যে দ্বীপটিকে ভাগ করে দিয়েছিলেন। তাদের নাম ছিল– পুরোজব, মনোজব, বেপমান, ধূম্রানীক, চিত্ররেফ, বহুরূপ ও বিশ্বাধার।

ঐ সকল বর্ষে সাতটি সীমাপর্বত ও সাতটি বিখ্যাত নদী আছে। তাদের নাম যথাক্রমে– ঈশাণ, উরুশৃঙ্গ, বনভদ্র, শতকেশর, সহস্রস্রোতা দেবপল ও মহানস।

নদীগুলির নাম– অনঘা, আয়ুদা, উভয় সৃষ্টি, অপরাজিতা, পঞ্চনদী, সহস্রসুতি ও নিজধৃতি সে সকলবর্ষে অধিবাসী শতকুত, সত্যব্রত, দানব্রত ও অনুব্রত নামক পুরুষেরা পরম সমাধিযোগে বায়ুরূপী ভগবানের পূজা করেননি। তাদের পূজার স্তুতিমন্ত্র এরকম– যিনি স্থাবর– জঙ্গমাত্মক সকল ভূতাদির অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে নিজ প্রাণাদি বৃত্তি দ্বারা তাদের রক্ষা করেছেন এবং সমগ্র বিশ্ব যাঁর বশীভূত সেই অন্তর্যামী সাক্ষাৎ ঈশ্বর স্বরূপ বায়ু দেবতা আমাদের রক্ষা করুন।

এইরূপ দধিসমুদ্রের পর তার চতুর্দিকে শাকদ্বীপের দ্বিগুণ বিস্তার যুক্ত ‘পুষ্কর দ্বীপ’ বর্তমান। সেটি সমপরিমাণ স্বাদু জল সমুদ্রের দ্বারা বহির্ভাগে পরিবেষ্টিত। ঐ পুষ্কর দ্বীপে একটি অতিবৃহৎ পদ্মপুষ্প সরোবর ছিল। সেখানে অযুত-নিযুত পরিমাণ পদ্ম সুবর্ণময় ও অগ্নিশিখার মতো নির্মল। এই প্রকার পদ্মের উপরে স্বয়ং ব্রহ্মা উপবেশন করেন। ঐ দ্বীপে মানসোত্তর নামে একটি পর্বত আছে। তা পূর্ব ও পশ্চিবর্ষের সীমা-গিরি।

এই দ্বীপের চারদিকে ইন্দ্রাদি লোকপালগণের চারটি পুরী আছে। এর উপরিভাগে সূর্যদেবের রথের সংবৎসর রূপ চক্রটি মেরুপবর্ত পরিক্রমার সময়ে দেবগণের অহোরাত্র অর্থাৎ উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ণ দ্বারা একবার পরিভ্রমণ করছে।

ঐ দ্বীপের অধিপতি প্রিয়ব্রতপুত্রে বীতিত্ৰোহ। পরে তিনি রমণক ও ধাতব নামক দুই আত্মজকে দুটি বর্ষের অধিপতিরূপে নিযুক্ত করেন। ব্রহ্মার সঙ্গে স্বর্ণলোকে উপবেশনের প্রত্যাশায় ঐ বর্ষদ্বয়ের অধিবাসীগণ ভগবানের আরাধনা করেন, তারা এই মন্ত্র বলেন–ব্রহ্মার উপাসক ও কর্মফলরূপী যে প্রসিদ্ধ তত্ত্বকে জনগণ ভেদরূপে অৰ্চনা করে, কিন্তু যা পরমেশ্বরেই, পরন্তু যা বস্তুত অদ্বৈত, আমরা সেই ভগবানকে প্রণাম করি।

এই শুদ্ধোদক সমুদ্রের পরে তোক ও অলোক নামে দুটি দেশ আছে, ঐ দুটি দেশের সীমানা রক্ষার্থে মধ্যে সর্বদিকে বিস্তৃত মালাকার পর্বত ‘লোকালোক’ বিদ্যমান, দুই পর্বতের মধ্যভাগে এক কোটি সাড়ে সাতান্ন লক্ষ যোজন পরিমিত ভূমি শুদ্ধোদক সমুদ্রের পরে অবস্থিত। এখানে বিভিন্ন প্রাণীদের বসতি রয়েছে। এরপরে দর্পণের মতো নির্মল স্বর্ণময় ভু-ভাগ বিরাজমান হয়। তার পরিমাণ আটকোটি উনচল্লিশ লক্ষ। তার মধ্যে কোন দ্রব্য নিক্ষিপ্ত হলে, উহা আর দৃষ্টিগোচর হয় না। অতএব, ঐ স্থানে কোনরূপ প্রাণীরই বসতি নেই।

হে রাজন, উক্ত বর্ষদ্বয়ের মধ্যবর্তী পর্বতের নাম লোকালোক, ঐ পর্বত মধ্যস্থলে বিরাজ করে সূর্যাদির আলোকবিশিষ্ট দেশ লোক এবং সূর্যের আলোকহীন দেশ আলোককে পৃথকভাবে ব্যবস্থাপিত করেছে।

পরমেশ্বর ত্রিলোকের প্রান্তভাগে সেই লোকলোক পর্বত সংস্থাপন করেছেন। এই পর্বতটির উচ্চতা ও বিস্তৃতি এরূপ যে সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি এই পর্বত দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে ত্রিলোকের বাইরে যেতে সমর্থ হয় না। পন্ডিতগণ পরিমাণ, লক্ষণ ও আকৃতি অনুসারে এ পর্যন্ত লোকস্থিতি বিচার করেছেন। এই ভূর্লোক পঞ্চাশ কোটি যোজন পরিমিত এবং এই লোকালোক পর্বতটি পরিমাণে তার এক চুতর্থাংশ অর্থাৎ আয়তনে সাড়ে বারো কোটি যোজন।

লোকালোক পর্বতের উধ্বভাগে জগদগুরু ব্রহ্মা চারটি দিকগজ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাদের নাম ঋষভ, পুষ্করচুড়, বামন ও অপরাজিত। এরা লোকসকলের স্থিতির কারণ। যে ভগবান মহাপুরুষ প্রাণীগণের অন্তর্যামী তিনি সকলের মঙ্গলার্থে ঐ পর্বতে অধিষ্ঠিত আছেন। তিনি সেই বিশুদ্ধ সত্ত্ব, যাতে জ্ঞান, বৈরাগ্য অষ্টেশ্বর্য ও অষ্ট মহাসিদ্ধি উপলক্ষিত আছে, তা প্রকাশ করেন। তার চারদিকে বিস্বক সেনাদি প্রধান প্রধান পার্ষদগণ বেষ্টন করে থাকেন। যদিও ভগবান ও গিরিতে অধিষ্ঠানপূর্বক বিশুদ্ধ সত্ত্ব আবিষ্কার করেন। তবুও সে সময়ে তার হাতে বিভিন্ন দোর্দন্ড অস্ত্র শোভিত থাকে। অন্তর্যামী হওয়া সত্ত্বেও নিজ মায়াচরিত বিবিধ লোকমাত্রা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই তিনি লীলা দ্বারা এই মূর্তি ধারণ করেছেন।

হে মহারাজ, লোকালোক পর্বতের ন্যায় বর্হিভাগস্থিত আলোকের পরিমাণও সাড়ে বারো কোটি যোজন। এরপরে পণ্ডিতগণ যোগেশ্বর গণের বিশুদ্ধ গন্তব্য স্থলের কথা বলেন। দ্বিজপুত্রকে আনয়নের সময়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঐ স্থান অর্জুনকে দেখিয়েছিল এই কারণে এই স্থান অতি শুদ্ধ।

হে ভরতশ্রেষ্ঠ, পূর্বেবিস্তৃতিরূপ যে ব্রহ্মাণ্ডের বর্ণনা করেছি, এখন তার পরিমাণ বলছি, শোনো! সূর্য এবং ব্রহ্মাণ্ড গোলোকের মধ্যবর্তী স্থানের পরিমাণ সমগ্রভাবে পঁচিশ কোটি যোজন। যেহেতু, সূর্য বৈরাজরূপে এই অচেতন ব্রহ্মাণ্ডে প্রবেশ করেছেন, তাই তার নাম মার্তণ্ড। তুমিই হিরণ্যগর্ভ, অর্থাৎ সমষ্টি জীবের সূক্ষ্ম উপাধি। কারণ তার থেকেই হিরন্ময় আণ্ডের অর্থাৎ তৃতীয় স্থলদেহের অস্তিত্ব সিদ্ধ হচ্ছে।

হে রাজন, সূর্য দ্বারাই দিসকল, আকাশ, পৃথিবী এবং অন্যান্য বিভাগ বিভক্ত হয়। ভোগস্থল, মোক্ষস্থল, নরক এবং আতনাদি এই সর্বপ্রকার লোকসকলেও সূর্য পরস্পর থেকে ভিন্ন করে বিভক্ত করেছেন। অতএব, সূর্যদেবের উপাসনা করা অবশ্য কর্তব্য। তিনি দেব, মনুষ্য সকলের আত্মরূপ, তিনি পশু, পক্ষী, লতা ও বীজসকলের আত্মা ও নেত্রাধিষ্ঠাত্রী দেবতা স্বর্ণাদি তাকে প্রণাম করি।

.

একবিংশ অধ্যায়
গোলক বিবরণ ও সূর্যের রথ ও তার গতি বর্ণনা

শ্ৰী শুকদেব বললেন–হে রাজা, আমি তোমাকে পরিমাণ ও লক্ষণ অনুসারে পৃথিবীর অবস্থান ব্যাখ্যা করলাম। যার বিস্তার পঞ্চাশ কোটি যোজন এবং উচ্চতায় পঁচিশ কোটি যোজন।

যে সকল ব্যক্তি তত্ত্বজ্ঞানী তারা স্বর্গমণ্ডলের পরিমাণও এই ভূমণ্ডলের পরিমাণ দ্বারা ব্যক্ত করেন। যেমন দুটি দলের পরিমাণ সমান হয় তেমনি ভূ-মণ্ডল ও স্বর্গমণ্ডলের পরিমাণ সমান হয়।

উভয়ের মধ্যস্থলে অবস্থানকারী আকাশ, উভয়ের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে। ভগবান সূর্য এই আকাশের মধ্যস্থলে বিরাজমান। তিনিই ত্রিলোককে রৌদ্রদান করে উত্তপ্ত রাখেন এবং স্বীয় দীপ্তিকে আলোকিত করেন। তিনিই উত্তরায়ণ, দক্ষিণায়ন ও বিষুব নামক মন্দগতি, দ্রুত গতি এবং সমগতি দ্বারা যথাসময়ে আরোহণ, অবরোহণ এবং সমান স্থান প্রাপ্ত হন। এভাবেই তিনি দ্বাদশ রাশিতে বিচরণ করেন। সেসময়ে বিভিন্ন রাশিতে অবস্থান কালে দিন ও রাত্রিকে দীর্ঘ, হ্রস্ব ও সমান করেন।

যে সময়ে সূর্যদেব তুলা ও মেষ রাশিতে অবস্থান করেন, তখন দিন ও রাতের পরিমাণ সমান সমান হয়। যে সময়ে তিনি বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ ও কন্যারাশিতে অবস্থান করেন, সে সময়ে দিবাভাগ ক্রমবর্ধিত হয় এবং প্রতিমাসে রাত্রির এক ঘণ্টা করে হ্রাস পায়। সে সময়ে সূর্যদেব, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন- এই পাঁচটি রাশিতে ভ্রাম্যমান, সেসময়ে দিনের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকে এবং রাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যত কাল পর্যন্ত সূর্যের গতি দক্ষিণ দিকে থাকে, তত কাল পর্যন্ত দিনের পরিমাণ দীর্ঘ হয়। আবার যতসময় পর্যন্ত উত্তরদিকে গতি থাকে, তত সময় পর্যন্ত রাতের পরিমাণ দীর্ঘ হয়। পণ্ডিতগণের মতে, মানসোত্তর পর্যন্ত সূর্যের যাত্রাপথের পরিমাণ নয়কোটি পঞ্চাশ লক্ষ যোজন। মানসোত্তর পর্বতে সুমেরুর পূর্বদিকে দেবযানী নামক ইন্দ্রপুরী বর্তমান।

দক্ষিণে অবস্থানকারী যমপুরীর নাম সংযমনী। পশ্চিমদিকে নিম্নোচনী নামক বায়ুপুরী এবং উত্তরদিকে বিভাবরী নামক চন্দ্রপুরী বিদ্যমান। সুমেরুর চতুর্দিকে অবস্থানকারী পুরীগুলিতে বিশেষ বিশেষ সময়ে সূর্যোদয়, মধ্যাহ্ন, সায়ং-সন্ধ্যা, এবং অর্ধরাত্রি হয়ে থাকে।

সূর্যোদয়ের সময় অনুসারে প্রাণীগণ বিভিন্ন কাজে প্রবৃত্ত ও নিবৃত্ত হয়। যারা মেরুর দক্ষিণদিকে অবস্থান করে তাদের পূর্বদিকে ও যারা উত্তরদিকে থাকে তাদের পশ্চিমদিকে থেকে পূর্বাদি দিকসকল পরিগণিত হয়। যারা পশ্চিমদিকে অবস্থানকারী তাদের দক্ষিণ দিক এবং যারা পূর্বদিকে অবস্থানরত তাদের উত্তরদিক থেকে পূর্বাদি দিক গণনা করা হয়।

সুমেরু পর্বতবাসীদের কাছে সূর্যের তাপ, দিনের মধ্যভাগেই পৌঁছে যায়। তাদের কাছে সূর্যদেব সবসময়ই দিনের মধ্যগতরূপে প্রকাশিত। সূর্যের গতি নক্ষত্রাভিমুখী তাই তিনি মেরুপর্বতকে বাঁদিকে রেখেই ভ্রমণ করেন। তবুও প্রবাহ নামক বায়ু দ্বারা জ্যোতিশ্চক্রের পরিভ্রমণের কারণে প্রত্যহ, সুমেরুকে দক্ষিণেই রেখে থাকেন। অর্থাৎ দক্ষিনাবর্তের প্রবাহ’ নামক বায়ু জ্যোতিশ্চক্রকে ভ্রাম্যমান করানোর জন্য প্রতিদিন একবার করে দক্ষিণদিকে গমন করেন।

চক্রগতির কারণে অতি দূর থেকে সূর্যকে যখন ভূমি সংলগ্ন বলে প্রতীয়মান হয়, তাকেই সূর্যোদয় বলে। তাকে আকাশ রূঢ়ের ন্যায় দর্শন করাকে মধ্যাহ্ন বলে। ভূমি প্রবিষ্টরূপে সূর্যের অবস্থানকে সূর্যাস্ত বলা হয়। সূর্য সেখান থেকে যখন অতি দূরে গমন করেন তাকে অর্ধরাত্রি বলা হয়। বেদেরও সমুদ্রতীরস্থ দৃষ্টিক্রমে কথিত আছে, সূর্যদেব প্রত্যুষে জলমধ্য থেকে উদিত হন। সায়ংকালে তিনি আবার জমধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে থাকেন। বাস্তবে, এই কথন, শ্রুতির ব্যবহার মাত্র, সম্পূর্ণ সত্য নয়।

সূর্যদেব যেখানে উদিত হন, তার সমসূত্রপাত স্থানেই অস্তাচলে গমন করেন। যেস্থানে তিনি রৌদ্র দ্বারা প্রাণীদের সন্তাপ করেন, তারই সামসূত্রপাত স্থানের প্রাণীদের নিদ্রামগ্ন করেন। ঐ স্থানে তখন মধ্যরাত, যে সময়ে সূর্যদেব ইন্দ্রপুরী থেকে যাত্রা শুরু করেন, তার পঞ্চদশ ঘটিকায় দু’কোটি সাঁইত্রিশ লক্ষ পঁচাত্তর হাজার যোজনে পথ অতিক্রমের পর যমপুরীতে উপস্থিত হন। এভাবে প্রদক্ষিণ করতে করতে তিনি ক্রমশঃ বরুণের পুরী এবং চন্দ্রের পুরীতে ভ্রমণ করে পুনরায় ইন্দ্রপুরীতে ফিরে আসেন।

চন্দ্রসহ অন্যান্য গ্রহাদিও নক্ষত্রাদির সঙ্গে একই সময়ে জ্যোতিশ্চক্রে উদিত হয়ে একই সময়ে অস্তমিত হন। এভাবেই বেদময় সূর্যরথ এক মুহূর্তে ইন্দ্রাদি চারটি পুরীর চতুর্দিকে চৌত্রিশ লক্ষ আটশো যোজন পথ ভ্রমণ করে। সূর্যরথের একমাত্র চাকার নাম সংবৎসর। এই চাকার বারোটি অরা অর্থাৎ মধ্যস্থিত শলাকাগুলি হল বারো মাস। ছটি ধাতু হলো এই চক্রের ছটি নেমি এবং তিনটি চাতুর্মাস্য হল এই চক্রের নাভি। এই চক্রর একটি প্রান্ত সুমেরুতে এবং অপর প্রান্তটি মানসসাত্তর পর্বতে সংলগ্ন। এভাবেই সূর্যের পথ চক্রটি তেলের খনির চাকার মতো মানসোত্তর পর্বতে পরিভ্রমণ করছে।

সূর্যরথের চাকাটির একটি প্রান্ত, অপর প্রান্তের নীচের দিকে সংযুক্ত। ঐ প্রান্তটির ঊর্ধ্বভাগ তৈলযন্ত্রের প্রান্তের মতো বায়ুপাশ দ্বারা ধ্রুবলোক সংযুক্ত আছে। প্রথম প্রান্তের পরিমান এক কোটি সাড়ে সাত লক্ষ যোজন এবং দ্বিতীয় প্রান্তের পরিমাণ তার এক চতুর্থাংশ। রথমধ্যে উপবেশনের জন্য নির্ধারিত স্থানের পরিমাণ ছত্রিশ লক্ষ যোজন। ঐ রথের যুগ অর্থাৎ জোয়ালি–যার সঙ্গে অশ্ব সংযুক্ত থাকে, তা নয় লক্ষ যোজন দীর্ঘ।

ঐ সূর্যরথে অরুণ কর্তৃক যোজিত গায়ত্রী প্রভৃতি বিভিন্ন ছন্দ নামক সপ্তঘোড়া সূর্যদেবকে বহন করেছে। অরুণ ঐ রথে সূর্যের সারথিরূপে নিযুক্ত। তিনি বিপরীত মুখে অর্থাৎ পূর্বদিকে মুখ করে ঐ রথের অগ্রভাগে অধিষ্ঠিত।

এরকম অঙ্গুলির পর্বতপ্রমাণ ষাট হাজার ঋষি, সূর্যের স্তব করার জন্য সূর্যের সম্মুখভাগে অধিষ্ঠিত। তারা বালখিল্য নামে পরিচিত। সূর্যের সম্মুখভাগের উপবেশন করে তারা, সুমধুর ভাষায় সূর্যদেবের বন্দনা করে চলেছেন। এরকম ঋষি, গন্ধর্ব, অপ্সরা, নাগ, গ্রামণী, রাক্ষস ও দেবতারা বিভিন্ন উপায়ে সূর্যের উপাসনা করেন। তারা পৃথকভাবে চোদ্দটি গণে বিভাজিত হয়েও দুই-দুই মিলে সাতটি দল গঠন করেন। বিভিন্ন নাম ধারণ করে। বিভিন্ন নামধারী সূর্যের উপাসনা করেন। তাদের কর্ম পন্থাও বিভিন্ন রকমের হয়।

হে মহারাজ, সূর্যদেব এভাবে ঋষিগণ পরিবৃত হয়ে ভূ-মণ্ডলের নয়কোটি একান্ন লক্ষ যোজন পরিমিত পরিধি ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণের সময়ে প্রতিমুহূর্তে দুই হাজার যোজন দুই ক্রোশ পথ অতিক্রম করে থাকেন।

.

দ্বাবিংশ অধ্যায়
বিভিন্ন গ্রহের স্থান ও গতি বর্ণনা

শ্ৰী শুকদেব বললেন–হে রাজ, স্বয়ং ভগবান নারায়ণ লোকের কামনা হেতু নিজের বেদময় বপুকে বারোভাগে ভাগ করেছেন। তিনি সূর্যরূপে বিরাজ করছেন। সূর্যদেবকেই ইন্দ্রাদি দেবতারূপে এবং অষ্টাঙ্গ যোগক্রিয়ার দ্বারা অন্তর্যামী রূপে, আরাধনা করা হয়। স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝে অবস্থিত আকাশমণ্ডলের কেন্দ্রে কালচক্রে দ্বাদশ মাস রয়েছে, বা সংবৎসরের অবয়ব।

মাসগুলি ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। ভগবান আদিত্য যতৎকালে সংবৎসরের ষষ্ঠভাগ বা দুইরাশি ভোগ করেন, সেই কালকে বলা হয় ঋতু। একইভাবে সূর্যদেব আকাশ মণ্ডলের অধভাগে ভ্রমণ। করার কালকে বলা হয় অয়ন কাল। সূর্য, স্বর্গ ও ভূমণ্ডলের সম্পূর্ণ ভোগ করার কাল হল সংবৎসর।

সূর্যমণ্ডল থেকে চন্দ্রের অবস্থান লক্ষ যোজন দূরে। চন্দ্রমণ্ডলের কালগুলি যখন বৃদ্ধিশীল হয়, তখন দেবগণের দিন ক্রমে ক্ষীণ হলে, তা হয় পিতৃলোকের দিন।

সোমগ্ৰহ তিরিশ মুহূর্তে এক নক্ষত্র ভোগ করেন। অন্নময় ও অমৃতময় এই গ্রহ সকল জীবের প্রাণস্বরূপ। অর্থাৎ ষোড়শ কলাবিশিষ্ট চন্দ্ররূপী ভগবান পরমপুরুষ মনোময়, অন্নময় ও অমৃতময়।

চন্দ্রমণ্ডলের দুই লক্ষ যোজন দূরে আছে নক্ষত্র মণ্ডল। এর দু’লক্ষ যোজন উপরে আছে শুক্রগ্রহের অবস্থান। এই সূর্যের মতো শীঘ্র, মন্দ, ও সমান গতি লাভ করে। শুক্ৰদেবের আনুকূল্যে বৃষ্টি হয়। তিনি বৃষ্টির প্রতিবন্ধক অন্য গ্রহের উপশম ঘটিয়ে থাকেন।

শুক্রগ্রহের দুই লক্ষ যোজন দূরে অবস্থিত বুধ গ্রহ সূর্যের অগ্র ও পশ্চাৎ অথবা একই সঙ্গে সঞ্চারণ করে থাকে। চন্দ্রপুত্র বুধ লোকেদের পক্ষে শুভ।

দুঃখসূচক মঙ্গল গ্রহ অবস্থান করছে বুধ গ্রহের দুই লক্ষ যোজন ওপরে।

ভগবান বৃহস্পতি অবস্থান করছেন মঙ্গলের দুই লক্ষ যোজন ওপরে। এই গ্রহ ব্রাহ্মণদের প্রতি অনুকূল হয়ে থাকেন।

অশান্তিকর শনি বিরাজ করছেন বৃহস্পতির থেকে দু’লক্ষ যোজন ওপরে।

এগারো লক্ষ যোজন উত্তরে অবস্থান করছেন সপ্তর্ষি মণ্ডল। জগতের সকল লোকের কল্যাণ চিন্তায় রত থেকে ধ্রুবলোকে প্রদক্ষিণ করছেন।

.

ত্রিবিংশ অধ্যায়
পরমপদ ও শিশুমার চক্র

ভগবান বিষ্ণুর পরমধাম সপ্তর্ষিলোকের ওপরে তেরো লক্ষ যোজন দূরে অবস্থিত। রাজা উত্তানপাদের পুত্র মহাভাগবত ধ্রুব সেখানে ভগবানের আরাধনায় রত, যিনি কল্পজীবী পুরুষদের আশ্রয়স্বরূপ। ধ্রুব আকাশমণ্ডলে ভগবান বিষ্ণুর স্তম্ভ স্বরূপ বিরাজ করছেন। গ্রহ, নক্ষত্র এবং অন্যান্য জ্যোতিষ্ক কালচক্রের মধ্যভাগ ও বহির্ভাগে আবদ্ধ থেকে ধ্রুবকে অবলম্বন করে কল্পকাল পর্যন্ত আকাশমণ্ডলে নির্দিষ্ট পথে পরিভ্রমণ করছে।

শিশুমার রূপে ভগবান বিষ্ণুর যোগধারায় জ্যোতিশ্চক্রের অবস্থান। অনেকে শিশুমার রূপে ভগবানের উপাসনা করে থাকেন। তার মস্তক নিম্নগামী, তাঁর পুচ্ছের অগ্রভাগ ধ্রুব, লাঙ্গুলের অগ্রভাগের প্রান্তদেশে প্রজাপতি, অগ্নি, ইন্দ্র ও ধর্ম, পুচ্ছস্থলে ধাতা ও বিধাতা এবং কটিদেশে সপ্তর্ষিগণ বিরাজিত। শিশুমারের কুণ্ডলাকৃতি দেহটি দক্ষিণাবর্ত অভিজিৎ থেকে পুনর্বসু অর্থাৎ চোদ্দটি নক্ষত্র তাঁর দক্ষিণপাশে এবং দক্ষিণায়ণের মোট চোদ্দোটি নক্ষত্র বাঁ পাশে রয়েছে। শিশুমারের পৃষ্ঠভাগে রয়েছে দক্ষিণমার্গের প্রথমভাগ অর্থাৎ অজবীথী এবং আকাশগঙ্গাকে তার উদরে কল্পনা করা হয়েছে।

এই অবয়বের বামপার্শ্বের অস্থিসমূহে দক্ষিণায়নের আটটি নক্ষত্রকে ধরা হয়েছে। তার দক্ষিণ স্কন্ধে জ্যেষ্ঠাকে সংলগ্ন করা হয়েছে। এই শিশুমারকেই ভগবান বিষ্ণুর সর্বদেবতাময় রূপ বলে জানতে হবে এবং ত্রিসন্ধ্যায় তার মন্ত্র জপ করতে হয়। শিশুমাররূপী ভগবান বাসুদেব প্রসন্ন হয়ে সকল পাপের থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

.

চর্তুবিংশ অধ্যায়
রাহু আদির অবস্থান ও সপ্ত তলাদির বর্ণনা

সিংহিকার পুত্র রাহু অসুরেরও অধম হলেও ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় অমরত্ব ও গ্রহত্ব লাভ করেছে। সূর্যমণ্ডল থেকে অযুত যোজন দূরে তার অবস্থান। দেবগণের অমৃত পানকালে রাহু ছলনা করে চন্দ্র ও সূর্যের মাঝে দেবতাদের পংক্তিতে উপবেশন করেন। পরে তারা ঐ কথা জানিয়ে দিলে রাহু ক্ষিপ্ত হয়ে চন্দ্র সূর্যকে আক্রমণ করার জন্য ধাবিত হয়। সাদা ঘূর্ণমান অতিশয় দুঃসহ তেজধারী সুদর্শন চক্র তার পথ রোধ করেন। রাহু নিবৃত্ত হয়।

রাহুগ্রহের বারো লক্ষ যোজন নীচে সিদ্ধ, চারণ ও বিদ্যাধরগণের অবস্থান। তার নীচে যে গ্রহ-নক্ষত্র বিহীন আকাশ আছে সেখানে ভূত-প্রেত, রাক্ষস, যক্ষের বাস। আকাশভাগের আধোভাগে শতযোজন দূরে পৃথিবীর অবস্থান। ভূর্লোক সীমার মধ্যে শ্যেন, হংস, ভাস প্রভৃতির শ্রেষ্ঠ পাখিদের অবস্থান।

পৃথিবীর নিম্নভাগে সাতটি ভূ-বিবরের মধ্যে আছে অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল ও পাতাল। অযুত ব্যবধানে প্রত্যেকটি তলের অবস্থান। এইসব ভোগস্থানে ইন্দ্র অপেক্ষাও সমধিক সুখের অধিপতি দৈত্যদানব ও নাগজাতীয় অধিবাসীর পরিবারবর্গের নিয়ে বসবাস করছে, এরা মায়াবলে নানা বিলাস বিস্তার করে থাকে। এই ভূ-বিবরের চন্দ্র-সূর্যের উদয় হয় না, ফলে কাল বিভাগের কোনো অস্তিত্ব নেই। মহাসপ্রবর অনন্তের মধ্যস্থিত মণিরাজির প্রকাশের দ্বারাই অন্ধকার বিদূরিত হয়।

সপ্ততলের অধিবাসীরা ওষধিরস ও রসায়ন জাতীয় ওষুধ সেবন করে। নানারকমের অন্ন, পান ও স্নানাদির জন্য তাদের কোনো রোগ হয় না, ভগবানের তেজোময় সুদর্শন চক্র ছাড়া কেউ, এমনকি যমদেবও কর্তৃত্ব ফলাতে পারে না।

ময়দানবের পুত্র বলাসুরের অতল নামক ভূ-বিবরে বাস। তার হাই থেকে সৃষ্টি হয়েছে স্বৈরিণী, কামিনী ও পুংশ্চলী নামক তিন শ্রেণীর রমণী। কোনো পুরুষ সেখানে প্রবেশ করলে তারা তাকে হটিক অর্থাৎ ধুস্তর রস দিয়ে সম্ভোগ সমর্থ করে তোলে।

ভগবান হাটকেশ্বর শিব তার ভূত পার্ষদদের নিয়ে ভবানীর সাথে অতলের নিম্ন দিকে বিতলে অবস্থান করেন।

বিতলের নিচে সুতল মহাযশস্বী বিরোচন-পুত্র বলি এখানে অবস্থান করছেন। আত্মারাম ও পরমাত্মা-স্বরূপ বামনরূপী ভগবানের নিমিত্ত মহারাজ বলি শ্রদ্ধাপূর্বক সমাহিত চিত্তে সাদরে যে ভূমিদান করেন, তা সাক্ষাৎ মোক্ষের দ্বার স্বরূপ।

বলির পিতামহ প্রহ্লাদ ছিলেন ভগবানের চিরদাস্য। তিনি পিতা হিরণ্যকশিপুর মৃত্যুর পর পিতৃরাজ্য গ্রহণ করলেন না। কারণ ভৌগেশ্বর্য মায়াময় মাত্র তার দ্বারা জীব ভগবানের নাম স্মরণ করতে ভুলে যায়।

সুতলের নিম্নভাগে তলাতল-এ তিনটি পুরীর অধিপতি দানব রাজময় অবস্থান করছেন। ত্রিজগতের মঙ্গলকারী ভগবান শংকর তার তিনটি পুরী ধ্বংস করে দিলেও, পরে তা আবার রূপা করে ফিরিয়ে দেন। সুদর্শন চক্রের ভয় থেকে মুক্ত হয়ে এবং মহাদেবের দ্বারা পরিরক্ষিত হয়ে ময়দানব তলাতলে সকলের পূজ্য।

তলাতলের নীচে যে মহাতল বিবর আছে, সেখানে কুহক, তক্ষক, কালিয়, সুষেণ ইত্যাদি নামের ফণাধারী ক্রোধপরবশ রুদ্রর সন্তানদের বসবাস। অতিশয় দীর্ঘ দেহধারী এই সব ফণাধারী সর্বদা ভগবানের বাহন গরুড়ের ভয়ে তটস্থ থাকে।

মহাতলের নীচে রসাতলে দেবতাদের চিরশত্রু দৈত্যদানব ও অসুরদের বিহার স্থান। তারা জন্ম থেকেই মহা প্রতাপত্তি প্রভাবশালী হলেও শ্রীহরির তেজের প্রভাবে তার বলদর্পহীন হয়ে নির্বিষ সাপের ন্যায় অবস্থান করছে।

মহাশয় মহাক্ৰোধী বাসুকী প্রমুখ শঙ্খ, কুলিক, মহাশঙ্খশ্বেত, ধনঞ্জয়, ধৃতরাষ্ট্র, শঙ্খচূড়, কম্বল অশ্বতর ও দেবদত্ত প্রভৃতি নাগলোকের অধিপতিদের বাসভূমি রসাতলের নিম্নভাগ পাতালে সহস্র মস্তকযুক্ত সেই মহাসর্পগণের ফণাসমূহে বিরাজমান অতুজুল মহামণিরাজি নিজ দীপ্তির দ্বারা সপ্ত ভূ বিবরের অন্ধকার দূর করেছে।

.

পঞ্চবিংশ অধ্যায়
ভগবান সংকর্ষণ দেবের অবস্থান ও স্তুতি

পাতালের মূল দেশে তিরিশ হাজার যোজন দুরে ভগবান বাসুদেবের তমোময় কলা অনন্ত নামে বিরাহিত। তিনি দ্রষ্টা ও দৃশ্যে উভয় পদার্থকে সম্যকরূপে আকর্ষণ করেন। তাই তিনি সংকর্ষণদেব। সহস্ৰমস্তক সেই ভগবান অনন্তদেবের একটি মস্তকে এই ভূমণ্ডল ধরা হয়েছে।

রজতস্তম্ভ সদৃশ এই অনন্ত মূর্তির ভূজযুগল সুবিশাল, সুনির্মল, ধবলবর্ণ, সুন্দর ও মনোরম। রাজকন্যারা নানা কল্যাণ কামনা করে এই ভূজ দুটিতে অগরু, চন্দন ও কুমকুম চর্চিত করে। তাকে স্পর্শ করে মনে মনে আবেশে আপ্লুত হয়, অনন্ত গুণরাশির আধার আদিদেব ভগবান, অনন্ত, অসহিষ্ণুতা ও ক্রোধাবেগে সংবরণ করে জগতের কল্যাণ সাধনের জন্য সেখানে অবস্থান করছেন।

তিনি সুলক্ষণ ও সুন্দর একটি হস্তলাঙ্গুলের পৃষ্ঠভাগে উপবিষ্ট, নীলবস্ত্র পরিহিত, কুণ্ডল শোভিত দুটি কর্ণ, ঘূর্ণিত ও বিহ্বল ভাবাপন্ন দুটি নয়ন, গলার বৈজয়ন্তী নামক বলমালা। অনন্তদেবের গুণ যে কীর্তন করে এবং যে শ্রবণ করে, তার মোক্ষলাভ হয়।

ব্রহ্মার মানসপুত্র মহাপ্রভাবশালী দেবর্ষি নারদ তুম্বুর নামক গন্ধর্বের সাথে ব্রহ্মার সভায় অনন্তদেবের মহিমাকীর্তন করেছেন। যাঁর কটাক্ষ মাত্রে জগতের স্থিতি, সৃষ্টি ও প্রলয়ের কারণস্বরূপ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ প্রকৃতির সৃষ্টি, যার বাস্তব স্বরূপ অনাদিত অনন্ত যিনি সৎ ও অসৎ, যাবতীয় বস্তুমাত্র যার মধ্যে প্রকাশ পায়, যিনি আমাদের প্রতি কৃপাহেতু বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক মূর্তি ধারণ করেছেন, সেই শ্রী ভগবানে প্রণাম নিবেদন করি।

মহাপাপী ব্যক্তিও যদি শ্রী ভগবানের নামকীর্তন কারো মুখে শোনে বা, পরিহাস করে তার নাম একবার উচ্চারণ করে, তাহলে তখনই তার শুদ্ধিলাভ ঘটে।

প্রতাপশালী শ্রীভগবান অনন্তদেব দুরন্তবল, মহান, গুণ ও প্রভাব সমূহের অধিকারী হয়েও ভূ মণ্ডলের তলদেশে নিজেকে আধার করেই অবস্থান করছেন এবং লোকের স্থিতির জন্য এই পৃথিবীকে অনায়াসে নিজের মস্তকে ধারণ করেছেন।

.

ষষ্ঠবিংশ অধ্যায়
পাপানুসারে নরকযন্ত্রণাভোগ

রাজা পরীক্ষিৎ জানতে চাইলেন- হে মহর্ষে, নরক কী? এর অবস্থান কোথায়? লোকে কেন ভিন্ন ভিন্ন গতি লাভ করে? এসব প্রশ্নের উত্তর শুনতে আমি আগ্রহী। আপনি দয়া করে তা বলুন।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে রাজন, সত্ত্ব, রজঃ ও তম গুণের তারতম্য হেতু কর্তা তিন প্রকার এবং তাদের শ্রদ্ধার বিভিন্নতায় কর্মর্সকলের ফলও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। অর্থাৎ কর্ম একরূপ হলেও শ্রদ্ধার ভেদহেতুই কর্ম হতে বিভিন্ন প্রকার গতি হয়ে থাকে।

ত্রিজগতের দক্ষিণদিকে ভুমির নীচে এবং জলের উপরিভাগে নরকের অবস্থিতি। সূর্যপুত্র যমরাজ সেখানকার অধিপতি। তিনি ভগবানের আজ্ঞাবহ দাস। নিজ অনুচরবৃন্দের সাহায্যে তিনি যমালয়ে মৃত প্রাণীদের নিয়ে আসেন এবং তাদের কর্মদোষ যথাযথ বিচার করে দোষের অনুরূপ দণ্ডবিধান করেন।

তামিস্র, অদ্ধতামিশ্র, রৌরব, মাহারৌরব, কুম্ভীপাক, বৈতরণী, প্রাণরোধ, বিশসন, তপ্তশূর্মি, অবীচি ইত্যাদি নামে একুশটি নরকগর্ভ আছে। অনেকে আঠাশ রকমের নরকের কথা বলে থাকেন।

পরধন, পরস্ত্রী ও পরের পুত্র অপহরণকারী তামিস্র নামক নরকে নিক্ষিপ্ত হয়। সেই অতিশয় অন্ধকার গহ্বরে পড়ে তারা ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় এবং যমদূতের প্রহারে চিৎকার করে।

অপরকে বঞ্চিত করে স্ত্রী ও ধনসম্পত্তি ভোগ করার ফলে অন্ধ– তামিস্র নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।

হিংসাশ্রয়ী মানুষ পরলোকে গিয়ে রৌরব নরকে গমন করে। যে ব্যক্তি, প্রাণী পীড়ন করে কেবল আত্মদেহের ভরণপোষণ করে, সে মহারৌরব নামক নরকে পতিত হয়। সেখানে মাংস ভোজী পশুরা তার মাংস খুবলে খায়। ব্যক্তি জীবন্ত পশুপাখিকে বধ করে পাক করে ভক্ষণ করার ফলে কুম্ভীপাক নরকে যায়। সেখানে যমের অনুচরেরা তাকে তপ্ততলে পাক করে থাকে।

ব্রাহ্মণদ্রোহী পাপী পুরুষ তাম্রময় উষ্ণ কাল সূত্র নামক নরক লাভ করে। লোমশ পশুর শরীরে লোকসংখ্যার সমান হাজার কাল সেখানে ক্ষুধাতৃষ্ণায় শরীরের অভ্যন্তরে ও বাহ্যভাগে দগ্ধ হয়ে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।

স্বধর্ম ত্যাগী ব্যক্তি অমিতপবন নামক নরকে নিক্ষিপ্ত হয়। সেখানে অসির ন্যায় ধারালো তালপাতা দিয়ে তাকে প্রহার করা হয়। তীব্র যন্ত্রণায় সে বারে বারে মুচ্ছা যায়।

বিনা দোষে দণ্ড দিলে বা ব্রাহ্মণজাতির ওপর দৈহিক নির্যাতন করলে রাজা বা রাজপুরুষ পরলোকে শূকর মুখ নরকে যায়। ইক্ষুদণ্ড দিয়ে তাকে প্রহার করা হয়। কাতর কণ্ঠে পাপী চিৎকার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যায়।

যে ব্যক্তি পঞ্চমহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান শেষে দেবতা, পিতৃলোক, ব্রাহ্মণ, আত্মীয়স্বজনকে অন্ন দান না করে নিজে একাই সব খায়, সে মহাপাপী। তাকে যমের অনুচররা কৃমিভোজন নরকে নিক্ষেপ করে। সহস্র যোজন ব্যাপী কৃমিকুণ্ডে সে কৃমি খায় এবং কৃমিরাও তাকে ভক্ষণ করে। যতদিন তার কর্মফল শেষ না হবে তাকে এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।

জোর করে ব্রাহ্মণের অর্থ, গয়নাগাটি কেড়ে নেওয়ার ফলে পাপী সন্দশ নামক নরক প্রাপ্ত হয়। সেখানে আগুনে মতো গনগনে লাল তপ্ত শলাকা দিয়ে যমদূতেরা তার দেহে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

যে ব্যক্তি পশ্বাদি যোনিতে উপগত হয়, যমদূতরা তাকে বজ্রকন্টক শাল্মলী নরকে নিক্ষেপ করে। বজ্রতুল্য কন্টকময় শাল্মলী বৃক্ষে চড়িয়ে নীচের দিকে টানতে থাকে।

ধর্মমর্যাদা লঙঘনকারী ক্ষত্রিয় বা রাজপুরুষ পরলোকে বৈতরণী নামক নরকে পতিত হয়। হিংস্র জলজন্তুরা তাকে আক্রমণ করে। তাঁর বিষ্ঠা, মূত্র, রক্ত, পুঁজ, নখ, অস্থি, মেদ ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকে।

ব্রাহ্মণকুলে জন্ম নিয়ে যে ব্যক্তি কামমোহিত হয়ে স্ববর্ণ ভার্যাকে রেতঃপান করায়, যমকিঙ্করগণ সেই পাপাত্মাকে রেতঃপূর্ণ কৃত্রিম ক্ষুদ্র নদীতে নিক্ষেপ করে রেতঃপালন করিয়ে থাকে। এরা নরকের নামে লালাভক্ষ।

যমালয়ে শত শত নরক আছে। পাপকারী লোক পাপানুসারে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। ধর্মপালনকারী লোকেরা নিজ নিজ কর্মানুসারে স্বর্গ লাভ করে। যারা পরলোকে ধর্ম ও অধর্মের ফল ভোগ করে, তাদের ভোগ একেবারে শেষ হয় না। অবশিষ্ট ফলভোগ করার জন্য তাদের জীবনরূপে পৃথিবীতে জন্ম নিতে হয়।

মহাপুরুষরূপী সাক্ষাৎ ভগবান নারায়ণের নিজ মায়াগুণময় স্থূলতর রূপ যে পাপ, কীর্তন বা শ্রবণ করে, শ্রদ্ধা ও ভক্তি হেতু তার চিত্ত শুদ্ধ হয়। ভূতলাস্থিত দ্বীপ, বর্ষ, নদী, পর্বত, সমুদ্র, আকাশ, পাতাল, জ্যোতিষ্কমণ্ডলী নরকসমষ্টি সবই ঈশ্বরের বিভিন্ন স্থূলদেহ এবং জীবজগতের পরম আশ্রয়।