রাজা কুবলাশ্ব হলেন ধুন্ধুমার
সূর্যবংশের প্রথম ক্ষত্রিয় রাজা ইক্ষাকু। তিনি অযোধ্যার রাজা ছিলেন, এই বংশে বহু ধার্মিক, প্রতাপশালী। রাজা জন্মেছিলেন। আর স্বয়ং ভগবান রামচন্দ্রও এই বংশেই অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
এই বংশের এক প্রতাপশালী রাজা ছিলেন। শ্রাবন্ত তার নামানুসারে ওই রাজ্যের নাম হল শ্রাবন্তীপুর। তার পুত্র বৃহদশ্ব। তিনি বহুকাল বীরদর্পে সম্মানের সঙ্গে রাজত্ব করলেন। তার সুশাসনের ফলে দেশ সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রজারাও সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করছে। ক্রমে তার বৃদ্ধকাল উপস্থিত হল। বৃদ্ধাবস্থায় সকলেরই ভগবানের প্রতি মন যায়। তারও তাই হল। রাজকার্য আর ভালো লাগে না। তাই গৃহাশ্রম ত্যাগ করবার কথা চিন্তা করলেন। তার পুত্র কুবলাশ্ব গুণ জ্ঞানে বীরত্বে যোগ্য উত্তরাধিকারী হয়েছে। কাজেই তিনি সেই পুত্রের হাতেই রাজ্যের ভার দিয়ে বনে গমন করবেন এমন নির্ণয় নিলেন।
পুরাকালে মানবজীবনে চতুরাশ্রমের প্রথা ছিল। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ আর সন্ন্যাস। রাজা বৃহদ ঠিক করলেন পুত্রের হাতে রাজ্য দিয়ে বানপ্রস্থ অবলম্বন করবেন। তাই একদিন রাজ্যের প্রজাসকল এবং মহামান্য মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে মহা জাঁকজমক সহকারে কুবলশ্বকে রাজসিংহাসনে বসানো হল। বানপ্রস্থে যাবার সময় সমুপস্থিত–এমন সময় মহর্ষি উতঙ্গ “মহারাজের জয় হোক”–বলে রাজসভায় উপস্থিত হলেন। যোগবলে বলীয়ান, মহাশক্তিধর মহর্ষিকে দেখে বৃহদশ্ব একেবারে অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে মহাসমাদরে পাদ অর্থ্যাদি দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, তার আগমনের কারণ কি?
তদুত্তরে মহর্ষি বললেন–আমি শুনলাম, তুমি নাকি বানপ্রস্থে যাবে?
রাজা বৃহদ বললেন–হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন ঋষিবর।
মহর্ষি বললেন–কিন্তু মহারাজ দেশে এখনও উপদ্রব আছে। একে সম্পূর্ণ নিরুপদ্রব না করে আপনার বানপ্রস্থে যাওয়া উচিত হবে না।
উতঙ্গের কথা শুনে মহারাজ বৃহদশ্ব একেবারে অবাক।–সে কি! আমি তো চরমুখে জেনেছি যে আমার রাজ্যে কোথায় কোনো উপদ্রব নেই। হে মহর্ষি, আপনি বলুন আপনার তপস্যায় কি কেউ বিঘ্ন ঘটাচ্ছে?
ঋষি বললেন–আমি সমুদ্র তীরে আমার আশ্রমে বসে দীর্ঘকাল ধরে জপ-তপ করছি। জায়গাটি আমাদের পক্ষে বেশ মনোরম। এতাবৎকাল কোনও অসুবিধাই হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি আমার সাধনায় বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এবং আমার যোগশক্তিতে কোনো কাজ হচ্ছে না!
ঋষির কথা শুনে বৃহদশ্ব জিজ্ঞাসা করলেন–কে আপনার সাধনায় বাধা দিচ্ছে? আমাকে বলুন, আমি এখুনিই তাকে বিনাশ করব। কোথায় তার ধাম? কেমন করে উৎপাত করে আমাকে দয়া করে বিস্তারিত বলুন।
ঋষি বললেন–ধুপ নামে রাক্ষস, মধু রাক্ষসের ছেলে সে, তার অত্যাচারে ঋষিগণের সাধনা জপ-তপ সব লোপ পেতে বসেছে। যক্ষ-রক্ষ-গন্ধর্ব, এমন কি দেবতাগণেরও অবধ্য সেই ধুন্ধু। সমুদ্রের তীরে বালির নীচে সে থাকে। দেবতাদের বরে বলীয়ান হয়ে এমন মদমত্ত হয়ে উঠেছে যে, সে কাউকেই আর ভয় করে না। সবসময় সে সকলের ক্ষতি করতেই ব্যস্ত। তার প্রাসাদ থেকে বছরে একবার করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। এমন প্রবল বেগ তার নিঃশ্বাসে যে, সমুদ্রতীরের সব বালুর রাশি ঘূর্ণিঝড়ের মত পাক খেতে খেতে উপরে উঠতে থাকে। সূর্যের আলোকে সেই বালুরাশিকৃত ঘূর্ণিঝড় ঢেকে ফেলে। মনে হয় যেন অসময়ে সূর্য অস্ত গেল। আর ভূমিকম্পের মত কেঁপে উঠে পৃথিবী। দু-চার মিনিট বা দু-চার ঘণ্টা নয়, একেবারে সাতদিন সাতরাত ধরে এই ভয়ঙ্কর ব্যাপার চলে। মহারাজ এর ফলেই সকলেরই ক্ষতি হচ্ছে মুনি ঋষিরাও বাদ পড়ছে না। সূর্যের আলো না-পেয়ে কৃষিক্ষেত্র বৃক্ষ অরণ্যের বৃক্ষরাজি সব শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। তার ফলে ফসল, ফলমূল পুষ্পদি কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না। আপনি ধর্মের রক্ষক, কাজেই এই অত্যাচারের প্রতিকার না করে আপনার বাণপ্রস্থে যাওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়।
মহর্ষি উতঙ্কের কথা মন দিয়ে সব শুনলেন রাজা বৃহদ। তারপর সবিনয়ে বললেন–হে মহর্ষি! এখন তো ফেরার আর উপায় নেই, আমি সংকল্পে স্থির এবং গমনেও প্রস্তুত হয়েছি। তবে আপনার তপস্যার যোগ-সাধনায় যাতে কোনও বিঘ্নও না ঘটে, সে ব্যবস্থা আমি অবশ্যই করব। বর্তমানে আমার পুত্র কুবলাশ্ব এ রাজ্যের রাজা। বীর হিসেবে তার খ্যাতি আছে। আমি মনে করি, বীরত্বে কুবলাশ্ব আমার থেকে কোনও অংশে কম হবে না। সে নিশ্চয়ই ধুন্ধুকে বিনাশ করে রাজ্যে শান্তি রক্ষা করতে পারবে।
বৃহদশ্বের কথা শুনে মহর্ষি উতঙ্গ বললেন–মহারাজ, আমি যোগবলে জেনেছি ওই ধুন্ধু কেবল রাজশক্তির দ্বারা নিধন হবে না। দেববলে বলীয়ান ওই রাক্ষস। ওকে বধ করতে হলে আমার তপো শক্তি দিয়ে রাজশক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে হবে। তাই বলছিলাম, আপনি ধার্মিক, আপনিই পারবেন ওই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করতে।
বৃহদশ্ব বললেন–হে ঋষিবর, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। আপনার সাহায্যে আমার পুত্রই ওই রাক্ষসকে বধ করবে। তারপর তিনি তাঁর পুত্র কুবলাশ্বকে ডেকে বললেন–”শোন পুত্র, এই ঋষিবর যাতে নির্বিঘ্নে যোগ সাধনা আর তপস্যাদি করতে পারেন, সকল প্রজাগণের মন থেকে যাতে আতঙ্ক দূর হয়, তা তুমি প্রাণপণে সে চেষ্টা করবে। তুমি সেই পাপাচারী ধুন্ধু রাক্ষসকে বধ কর। বানপ্রস্থে আমি যাবার জন্য প্রস্তুত।
এই কথা বলে বৃহদশ্ব রাজপ্রাসাদ থেকে অরণ্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। বাকি জীবনটা তপস্যা করে কাটিয়ে দেবার জন্য। আর তাঁর পুত্র কুবলশ্ব পিতার আদেশ ও রাজার কর্তব্য, উভয়েই পালন করবার জন্য তার শত সংখ্যক বীরপুত্রকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলেন। তারপর সেই সমুদ্রতীরে উতঙ্গ ঋষির আশ্রমে গেলেন, যেখানে ধুন্ধুকে পাওয়া যাবে।
কিন্তু কোথায়? কোনো রাক্ষসকে তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে মস্ত উঁচু বালির স্তূপ ছিল। কুবলাশ্ব তার পুত্রদের বললেন–সরিয়ে ফেল এই স্তূপ, খুঁড়ে ফেল সমুদ্রের খাত। খুঁজে বের কর কোথায় সেই রাক্ষস ধুন্ধু লুকিয়ে আছে।
ওদিকে আপন আশ্রমে বসে মহর্ষি উতঙ্ক বিষ্ণুর ধ্যানে রত। আহ্বান করছেন শ্রীহরিকে–এসো এসো হে সর্বশক্তিমান শ্রীহরি। তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা কর। কুবলাশ্বকে দাও তোমার অমিত শক্তি। যাতে সে ধুন্ধুকে বিনাশ করতে পারে।
উতঙ্কের এই আকুল আহ্বানে বিষ্ণুর আসন নড়ে উঠল। তিনি স্মরণ করলেন তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা। তখন তিনি সবার অলক্ষেই কুবলাশ্বের শক্তিকে মহাতেজসম্পন্ন করে তুললেন।
আর এদিকে কুবলাশ্বের শত পুত্র বালি খুঁড়তে খুঁড়তে দেখতে পেল ধুন্ধুর বাসস্থান। আর কি সে আত্মগোপন করে থাকতে পারে? আক্রোশে ও ক্রোধে ভীষণ হুঙ্কার ছাড়ল সে।
কালবিলম্ব না করেই আক্রমণ করল কুবলাশ্বের পুত্রদের। একাই শত বীরের সঙ্গে সংগ্রামে মাতল, দেববলে মহাবলীয়ান সে! তার আক্রমণে একে একে সব বীরপুত্র ধরাশায়ী হতে লাগল। কাউকে তোয়াক্কা করে না সে রাক্ষস। প্রায় সকলেই যখন নিহত, কুবলাশ্বের শত পুত্রের মধ্যে তিনজন মাত্র জীবিত, এমন সময় ধুন্ধুর চোখ পড়ল কুবলাশের দিকে। তার চোখ দিয়ে যেন আগুনের ঝলক বেরিয়ে পড়তে লাগল। ছুটে চলল কুবলাশের দিকে।
এদিকে তখন কুবলাশ্ব কিন্তু বিষ্ণুর তেজে অমিত শক্তির অধিকারী। তারপর ভীষণ যুদ্ধ শুরু হল। ধীরে ধীরে ধুন্ধুর তেজ কমে এল। অবশেষে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
ঋষি উতঙ্ক পরম আনন্দ লাভ করলেন। নিঃশঙ্ক হল সকল দেশবাসী। দেশে ফিরে এল আবার শান্তি। ঋষিবর কুবলাশ্বকে আশীর্বাদ করলেন। আর তাঁর যে সাতানব্বই জন পুত্ৰ ধুন্ধুর হাতে নিহত হয়েছিল, তারা সকলেই ঋষির আশীর্বাদের প্রভাবে সদগতি লাভ করল। ধুন্ধুকে বধ করে কুবলাশ্ব “ধুন্ধুমার” নামে বিখ্যাত হলেন।