৩১.
অন্য অন্য পর্বত সমূহের বর্ণনা প্রসঙ্গে সূত বললেন, এই চক্ৰবাট গিরি প্রজাপতির অমরবৃন্দের দ্বারা পরিপূর্ণ। অতিউচ্চ প্রাকার ও তোরণে শোভিত এই গিরিটি বলদৃপ্ত দৈত্য, দানব ও রাক্ষসদের কাছেও দুর্ধর্ষ বলে বিবেচিত হয়। এই গিরিটি দেবতাদের শত শত দ্বার ও বলভি দ্বারা চিত্রত, শত শত প্ৰতোলী দ্বারা মণিজত, তপ্ত জাম্বনদে পরিপূর্ণ এবং সিদ্ধ মহাত্মাদের অসংখ্য কোটি কোটি নানা রত্ন দ্বারা চিত্ৰত বিশাল ভবনে বিভূষিত। এর উত্তর ও পূর্বদিকে যে অতিরিক্ত স্থানটুকু আছে তা সমান দীপ্তিময়, রত্ন বিভূষিত, মনোরম অমরগণে আকীর্ণ এবং শুভ্রকান্তি তরু বিমণ্ডিত। এখানে এই চক্ৰবাটের সামনে মনোহর অমরাবতী নামে এক পুরন্দর পুরী আছে। এই ইন্দ্রপুরী অমরাবতী রম্য সমৃদ্ধ। বৃহৎ বৃহৎ অট্টালিকায় সমাকীর্ণ এই পুরী শত শত বিমানে ও শত শত সুবৃহৎ জলাশয়ে পরিপূর্ণ। এখানে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত আছে বিশাল বিশাল দেব বিমান, পুষ্কর, সরোবর, সমস্ত নগরীই চিত্র-বিচিত্রিত পতাকা ও মালা দ্বারা শুশোভিত। নগরীর সর্বত্র এমনই একটি শান্তির ঐশ্বরিক বাতাবরণ সদা সর্বদা বিরাজ করে যে এখানকার বিবিধ আশ্রম সংলগ্ন যে তপঃস্থান সেখানে এসে পুণ্যবান মহাযজ্ঞ, মহানাগ, মহাগন্ধর্ব, মহাসাধু, মহা অপ্সরা, মহামুনি এবং আর আর সিদ্ধ মহাপুরুষগণ আশ্রয় নিয়েছেন।
এই মহাপুরীর মাঝখানে আছে মহেন্দ্রর বহু লোকপ্রসিদ্ধ মনোহর ‘সুধর্মা’ নামে এক সভা। ঐ সভায় দেবতা ও মহাত্মা ঋষিরা সুখে অবস্থান করেন। হেমজাল সংস্কৃত এই সভার সম্মুখভাগ তোরণ ও দ্বারে সুশোভিত। বহু দুর্মূল্য রত্নখচিত সহস্র স্তম্ভ ওই সভার ছাদকে ধারণ করে আছে। সভার মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ ভূমিভাগ বিবিধ রত্নে চিত্রিত। তার ওপর বিচিত্র এক তোরণবেদী রচিত হয়েছে। বেদীর উপরিভাগ মহামূল্য রত্নখচিত দুর্লভ আস্তরণে ও আসনে পরিবৃত। বিচিত্র সূত্রবদ্ধ রত্নসমূহ ও বিচিত্র রত্নবলয়ে সমুজ্জল এই সভা বহু মনোরম পুষ্পমালায় সুশোভিত। ওই মালা বায়ু দ্বারা ঈষৎ আন্দোলিত হতে থাকে। সভাটি বিশেষভাবে কনক-উজ্জ্বল-কান্তি পরিজাত কুসুমে বিরচিত লম্বমান মালায় সমুজ্জ্বল। ওই সভায় দ্যুতিমান রুদ্র, মরুৎ, বসু, আদিত্য, পক্ষীরাজ, পিতৃ, দেব, গন্ধর্ব, অপ্সরা, মহাসরীসৃপ, সাধ্য, ঋষি এবং ব্রহ্মা নিয়ত অবস্থান করেন। পরম বিভূতি ও দ্যুতিতে পরিপূর্ণ এই সভায় দেবতার অধিষ্ঠান ঘটান যে চতুর্দিকে দেবতেজঃ রাশি বিচ্ছুরিত হতে দেখা যায়।
ওই সভায় শ্রীমান শ্রীপতি সহস্রাক্ষ পুরন্দরদেব বসে আছেন। তারই পাশে অধিষ্ঠান করেছেন মহাযোগী দেবর্ষি ও দেবতারা। সূর্যসম তেজের অধিকারী লেকপতি মহারাজ, মহেন্দ্রর এই স্থানটিকে সমস্ত সিদ্ধরা পূজা করে থাকেন। দেবরাজ বিরাজিত এই স্থানটি প্রচুর সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ। শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ দেবতাদের নিত্য নৈমিত্তিক সেবায় স্থানটি প্রদীপ্ত। পূর্বোল্লিখিত ব্রহ্মসভার দক্ষিণ-পূর্বাংশের উচ্চতর দ্বিতীয় তটে একটি উদ্যান আছে। জাম্বুনদে সিঞ্চিত এই উদ্যানটি অসংখ্য রত্নময়, নানা ঋতুতে চিত্রত সুরম্য, অতি তেজোময়, অনেক অনেক স্তম্ভযুক্ত এবং সুন্দর সুন্দর বহু রত্নবেদীতে শোভিত।
এই উদ্যানে সূর্যের মতো দীপ্ত এক অতি উৎকৃষ্ট মহামণ্ডপ আছে। মণ্ডপটি হল অগ্নিদেবের তেজোময়ী মহাসভা। শত সহস্র শিখায় সমুজ্জল জ্বালাময়ী দেবশ্রেষ্ঠ সর্বদেবের মুখ স্বরূপ অগ্নিদেব সেখানেই বিরাজ করছেন। এই মহামণ্ডপের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা অগ্নিদেব সেখানে দ্যুতিমান দেবতা ও ঋষিগণের দ্বারা স্তুত ও আহূত হয়ে থাকেন। বিপ্রগণ তাঁকে দেবতা বিশেষ রূপেই অভিহিত করে থাকেন। কারণ তার সর্বত্রই অগ্নিকে তেজের বিভাগ রূপে দেখে থাকেন। সেই একই বিভুতেজ যুক্তি অনুসারে কার্যকারণ রূপে পৃথক পৃথক হয়ে থাকে। বীর্য ও পরাক্রমবশতঃ সেই অগ্নি বিবিধ লোকজ্ঞ, মহাসিদ্ধ, মহাভাগ ও মহাত্মাদের দ্বারা নমস্কৃত হন।
এই অগ্নিদেবের আভ্যন্তরীণ তৃতীয় তটে বৈবস্ততের সুসংযমা’ নামে একটি বিখ্যাত সভাগৃহ আছে। চতুর্থ দিকের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে নৈঋত্যা অধিপতির সভা আছে। সভাটির নাম, ‘কৃষঙ্গনা। এবং সভাটি ধীমান বিরূপাক্ষের। পঞ্চম দিকের তটেও অনুরূপভাবে জলধিপতি মহাত্মা বৈবস্বত বরুণের একটি ‘শুভবতী’ নামক সভা আছে। ষষ্ঠ তটে আছে পবনদেবের সর্বগুণোত্তম ‘গন্ধবতী’ নামক সভা। এটি বায়ু কোণে অবস্থিত। এছাড়া সপ্তম তটে উত্তরদিকে নক্ষত্রধিপতির শুদ্ধ বৈদুর্ষ বেদীময়ী ‘মহোদয়া এবং অষ্টম তটে বা শৃঙ্গে ঈশান কোণে মহাদেবের তপ্ত কাঞ্চনপ্রভ ‘যশোবতী’ নামে সভা প্রতিষ্ঠিত আছে।
এই সভাস্থলের আটদিকে ইন্দ্রাদি আটজন দেবপ্রধানের আটটি মহা বিমানযান সদা বিরাজমান থাকে। মহাভাগ বেদবেদাঙ্গবিদ ঋষি, দেব, গন্ধর্ব, অপ্সরা এবং মহা সরীসৃপেরা নিয়মিত এ সভাস্থলে এসে এই দেববিমানগুলির সেবা করে থাকেন। তাঁরা স্বর্গের পর্যায়বাচক শব্দ প্রয়োগ করে এই সভাকে সংযতাত্মা দেবগণের বামস্থান বলে বর্ণনা করে থাকেন। স্থানটি গিরিমধ্যবর্তী দেবলোক রূপেও সমস্ত শ্রুতিতে গীত হয়ে থাকে। সংযতাত্মা ব্যক্তিরাই বিবিধ নিয়ম, বহু যজ্ঞ ও অসংখ্য শত শত জন্মে অর্জিত পুণ্যের দ্বারা যে দেবলোক লাভ করে থাকেন, তাই-ই স্বর্গ বলে অভিহিত হয়ে থাকে। এই কারণেই এই মেরুপবত স্বর্গ বলে সর্বজন মাঝে বর্ণিত হয়ে থাকে।
.
৩২.
সূত বললেন, আপনাদের কাছে ইতিপূর্বে মেরুকর্ণিকার মূলের কথা বলেছি। এই মূলভাগ এক হাজার যোজন বিস্তৃত ও আটচল্লিশ হাজার যোজন পরিধি বিশিষ্ট, সেই হাজার হাজার পর্বতের মধ্যে যেসব পর্বত অতি-উচ্চ, কেবলমাত্র সেইসব পর্বত এই মেরুমূলের চারিদিকে অবস্থিত। এইসব পর্বতরাজি নিকুঞ্জ, কৃত্রিম গিরিগুহা, নদী ও নিঝর শোভিত। এছাড়া গিরিপ্রপাত, লম্বমান পুষ্পমালা, কুসুমসম উজ্জ্বল তটদেশ, ধাতুমণ্ডিত সানুদেশ এবং অনেক অনেক প্রস্রবণা বৃত হেম ও কপিল বর্ণের শিখরও এইসব উচ্চতম পর্বতরাজির শৃঙ্গে শোভা পায়। আবার বহুবিধ রত্ন ও শত শত বিহঙ্গে সেবিত অনুপমগুণ কুঞ্জ দ্বারাও এইসব পর্বত শোভমান হয়ে থাকে। পশুরাজ সিংহ, শার্দুল, শরভ, একাধিক চামর, বানর, পক্ষী, এদের দ্বারাও এই পর্বতগুলি সেবিত হয়। পূর্বদিকে অবস্থিত জঠর ও দেবকূট নামে মণিকর্ণিকার দুটি পর্বত উত্তর– দক্ষিণে বিস্তৃত নীল ও নিষধ পর্বতের সাথে সংযুক্ত। উত্তর দক্ষিণের দুটি স্বখ্যাত পর্বত হল কৈলাস এবং হিমালয়। আর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী পর্বত হল নিষধ এবং পরিপাত্র। এ দুটি পর্বতও পূর্বের মতো দীর্ঘ এমন একটি শ্রুতিবাক্য প্রচলিত আছে। উত্তরের দুটি উৎকৃষ্ট পর্বতশৃঙ্গ হল ত্রিশৃঙ্গ ও জরুথি এরা পূর্ব-পশ্চিমে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত।
মনীষীরা পূর্বোক্ত আটটি পর্বতকে মর্যাদা পর্বত’ বলে থাকেন। হে দ্বিজ শ্রেষ্ঠগণ, আমি এখন আপনাদের সমীপে দীর্ঘকায় কনক পর্বতের বিষয়ে তথ্য প্রদান করছি, আপনারা একাগ্র মনে শুনুন।
মেরুর চারিদিকে চারিটি পাদ বিদ্যমান আছে। তাদের আয়তন প্রায় দশ সহস্র যোজন। এদের দ্বারা বিধৃত বলেই সপ্তদ্বীপবর্তী পৃথিবী বিচলিত হয় না। এই সব পর্বতদেশ দেব, গন্ধর্ব ও যক্ষদের নানা রত্নে উপশোভিত। রত্ন-আকর বলে শুধু নয়, অসংখ্য সুন্দর নিঝর ও গিরিকর এই সকল পর্বতের শোভাবর্ধন করছে। এমনকি এইসব পর্বতের যেসব বিচিত্র সানুদেশ সেগুলিও নিতম্ব ও কদম্ব পুষ্পে শোভিত। এছাড়া এই সব পর্বত চতুর্দিক হতে মনঃশিলা, হরিৎ আভাযুক্ত তট, সুবর্ণ মণিচিত্রিত গুহা, শুদ্ধ হিলোক নামক ধাতুমণ্ডিত উৎকৃষ্ট কাঞ্চনচিত্রিত জলপ্রপাত দ্বারা সমলংকৃত। সুন্দর শত পর্বত বিশিষ্ট সিদ্ধ নিবাস, আনন্দময় এইসব পর্বত চারিদিকে শ্রীময় মহাবিমানে পরিবেষ্টিত এই সকল পর্বতই মেরুর পাদ নামে প্রসিদ্ধ।
এই চারিটি পাদ চারিটি দিক অধিগ্রহণ করে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্বদিকে মন্দর, দক্ষিণে গন্ধমাদন, পশ্চিমে বিরুল এবং উত্তরে সুপার্শ্ব নামে পর্বত বিরাজমান। এই মেরুপাদেপর সহস্র শৃঙ্গে ব্রজের মতো কঠিন বৈদূর্যমণি নির্মিত বেদীর ওপর চারিটি মহাবৃক্ষ বিদ্যমান, বেদীগুলি সহস্র শাখায় বেষ্টিত, দৃঢ়মূল ও সুপ্রতিষ্ঠিত স্নিগ্ধ নীল পত্র ও বিশাল পুষ্প ফলে পরিপূর্ণ দ্বীপ পতাকাস্বরূপ এই চারটি মহাবৃক্ষ অনেক যোজন বিস্তীর্ণ। এই বৃক্ষ চতুষ্টয় যক্ষ, গন্ধর্ব, সিদ্ধ ও চারণদের দ্বারা সেবিত হয়ে থাকে।
হে মনুজ শ্রেষ্ঠ পূর্বোল্লিখিত মন্দর পর্বতের শৃঙ্গে কেতুশ্রেষ্ঠ যে কদম্ব মহাবৃক্ষটি আছে তার নাম ভদ্রাশ্ব। এর শাখা থেকে শুরু করে শিখর পর্যন্ত ফুলে ফুলে ভরা। ফুল গুলি মহাকুন্ত্রের মতো বিশাল কেশরগুলিও বিকশিত। সর্বকালীন মনোজ্ঞ মহাগন্ধে পরিশোভিত বৃক্ষটি মৃদুমন্দ বায়ুতে আন্দোলিত হলে সহস্রাধিত যোজন পর্যন্ত দিমণ্ডল এই পুষ্পগন্ধে পরিপূরিত হয়ে ওঠে। এই কেতুশ্রেষ্ঠ ভদ্রাশ্ব বৃক্ষে সাক্ষাৎ হৃষিকেশ সিদ্ধদের দ্বারা পূজিত হয়ে থাকেন। অশ্ববদন হরি সমস্ত দ্বীপ আলোকিত করে অনেক সময় এখানে অবস্থান করেন তাই অমরশ্রেষ্ঠ অশ্ববদন হরির নামানুসারেই এই বৃক্ষের ‘ভদ্রাশ্ব’ নাম হয়েছে।
মেরুর দক্ষিণ দিকস্থ পর্বতের দেবসেবিত শিখরে ও ‘জন্ধু’ নামক এক মহাবৃক্ষ বিদ্যমান আছে। বৃক্ষটিতে সতত পুণ্যফল সঞ্চিত আছে। বৃক্ষটি প্রায়শই মাল্য শোভিত, মহামূল মহা-স্কন্ধ স্নিগ্ধ পত্রে বিভূষিত, নব নব পুষ্প ও ফলপ্রদ এবং আরও অসংখ্য তরুতে উপশোভিত। সাধারণত এই বৃক্ষসমূহ হস্তী পরিমিত আয়তন সম্পন্ন অর্থাৎ একটু স্কুল প্রকৃতির হয়ে থাকে। এর স্বাদু, মৃদু ও অমৃতকল্প ফলগুলি গন্ধমাদন পর্বতের উপরিভাগে পতিত হয়। এই গিরিচূড়া থেকে স্যন্দনশীলা এক মধুবহিনী নদীর উৎপত্তি হয়েছে। এর নাম জাম্বু নদী। এই নদীতে অগ্নিবর্ণ, ‘জাম্বনদ’ নামক একপ্রকার সুবর্ণ উৎপাদিত হয়। এই দুর্লভ সুবর্ণ হতেই দেবতাদিগের ব্যবহার্য পাপনাশক অতুলনীয় অলংকাররাজি প্রস্তুত হয়ে থাকে। এই অমৃতস্বরূপ মধুর জম্বুরস দ্রবা দেবতা, দানব, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস ও পন্নগগণ সকলেই প্রিয় পানীয়। এই জম্বু নামক মহাবৃক্ষের নামানুসারেই দক্ষিণ দ্বীপের কেতুস্বরূপ লোকপ্রসিদ্ধ এই মনুষ্য নিবাস জম্বুদ্বীপ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।
মেরুর পশ্চিম দিকেও ‘বিপুল’ নামক এক সুউচ্চ পর্বত আছে। তার উপরিস্থিত এক শৃঙ্গে অতি সুমহান এক বৃক্ষ আছে। অশ্বথ নামেই এর ব্যাপক পরিচিতি। বৃক্ষটি দীর্ঘ এবং উৎকৃষ্ট মালায় সমৃদ্ধ। আর এক মূলদেশে আছে সুবর্ণ নির্মিত মণিবেদিকা। এর শাখাপ্রশাখা ও স্কন্ধরাজি অতি উচ্চ। সর্বোপরি বৃক্ষটি সুপ্রচুর সত্ত্বগুণের আশ্রয়স্থল। এই বৃক্ষ হতে সকল কালে সকল ঋতুতে সুখদায়ক কুন্তসদৃশ বৃহদাকার এবং শুভময় ফুল উৎপন্ন হয়। এই দেব-গন্ধর্ব সেবিত অশ্বত্থ বৃক্ষকে কেতুমাল দ্বীপের কেতু। স্বরূপ বলেই জ্ঞান করবেন।
হে বিপ্রগণ, যে কারণে এই দ্বীপের নাম কেতুমাল রাখা হয়েছে এবার সেই কারণটির কথাও জেনে রাখুন, ক্ষীরোদ সাগর মন্থন শুরু হলে দৈত্য পক্ষ পরাজিত হয়। দেব-দানবের এই মহাসমরে ক্ষীরোদ সাগরে মধ্যভাগে স্থাপিত এই বৃক্ষ ভীষণভাবে বিক্ষোভিত এবং মথিত হল। বৃক্ষটির এই ব্যাথার উপসম করার জন্য সহস্রাক্ষ ইন্দ্র নানাবিধ পুষ্পের সমাহারে একটি অনুপম মালা রচনা করলেন এবং সেটি এই অশ্বথ বৃক্ষের স্কন্ধে আরোপ করলেন। এই মালা সর্বদাই পূর্বের মতো মহাগন্ধময় আমোদকর ও মনোহর তাই মহাভাগ বিবিধ সিদ্ধচারণ দ্বারা পূজিত হয়ে সেই কেতুর মালা হয়ে বিরাজ করতে লাগলেন। দেবতাবৃন্দের প্রদত্ত এই অপূর্ব পুষ্পমাল্য কেতুর কণ্ঠে সর্বদাই শোভা পেত। মৃদুমন্দ বায়ুতাড়িত হয়ে মাটির মাতাল করা দিব্য গন্ধ বহু দূর পর্যন্ত প্রবাহিত হতে থাকে এইভাবে এই দ্বীপটি কেতুমালা সূত্রে পরিচিতি লাভ করে। শেষ পর্যন্ত কেতুমালায় নামাঙ্কিত হয়ে পশ্চিমে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত এই দ্বীপটি স্বর্গে পৃথিবীতে এবং অন্যান্য স্থানেও ‘কেতুমালা’ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে।
.
৩৩.
সূত এবার বললেন, হে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ মহাজ্ঞানী ঋষিবৃন্দ এবার আমি পূর্বোল্লিখিত চারটি শ্রেষ্ঠ পর্বতের বিষয়ে বলব। প্রথমেই আমি এদের সর্বকালাত্মক রম্যাবস্থার কথা বিবৃত করছি।
পূর্বোক্ত ওই চারটি পর্বতের সংলগ্ন প্রদেশে চারটি বিহারবন বিদ্যমান। ওই সব বনানীতে কত যে। পাখি, কত যে পুষ্পরাজি তার ইয়ত্তা নেই। সরিকা, ময়ূর, মদোকট, চকোর, শুক, ভৃঙ্গরাজ, চিত্রক। প্রভৃতি পাখিরা অবাধে চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জীবন্ধজীব, হেমকার, মত্ত কোকিল, বৰ্ত্তক, সুগ্রীবক ও কলঙ্ক এইসব পাখিরা সমস্ত সুরম্য বনভূমি মুখরিত করে তুলছে, পুষ্প প্রেমে মদোন্মত্ত ভ্রমরের গুঞ্জনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বনভূমি। স্থানে স্থানে কিন্নরগণ গান গাইছেন, কোথাও আবার চারু পল্লব শোভিত হয়ে পুষ্পবর্ষণ করে চলেছে। নানা ঋতুতে বিচিত্র বর্ণপ্রাপ্ত, কান্তিময় শত শত শিলাখণ্ড ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। সেখানকার সমুদয় পুষ্পস্তবক মঞ্জরী ও তাম্র কিশলয় মন্থরগামী পবনস্রোতে নিয়ত চঞ্চল ও দোদুল্যমান হয়ে আছে। সিদ্ধ মহাত্মা, অপ্সরা, দেব, দানব, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, পন্নগ ও উরগরা এই বনভূমির সেবায় নিরন্তর ব্যস্ত রয়েছেন, দেবতাদের বিচরণক্ষেত্র চতুর্দিকে বিস্তৃত মনোহর সেই চারটি বিশাল ক্রীড়াস্থলের কথা এবার আপনাদের বলছি।
পূর্বদিকে অরণ্যের নাম চৈত্ররথ, পশ্চিমদিকের অরণ্য বিভ্রাজ, উত্তর সবিতৃবন ও দক্ষিণে নন্দন এর অবস্থান। এই চারটি মহারণ্যে চারিটি মহা সরোবর আছে। সরোবরগুলি রম্য বিহঙ্গ-কূজিত এবং মহাপুণ্যতম। এইসব সরোবরের ঘাটগুলি বিস্তীর্ণ বনে সমাচ্ছন্ন হয়ে আছে। সরোবরগুলি নিরন্তর মহাত্মাগণের দ্বারা সেবিত হয়ে থাকে। ফলে এগুলি মঙ্গলময়তা ও সুখময়তার দ্যোতক হয়ে উঠেছে। সরোবরের স্বচ্ছ পবিত্র ও দেবভোগ্য জলে বিশাল বিশাল নাগেদের বসবাস। এই জলে শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ সিদ্ধ পুরুষ, দেব ও অসুরগণ আচমন করে থাকেন। ছত্র প্রমাণ, বিকশিত, মহাগন্ধ মনোহর পুণ্ডরীক আর মহাপাত্র উৎপল এই সব সরোবরের শোভা বর্ধন করে।
চারটি দিকে অবস্থিত এই মহাসরোবর চারটি চারটি সুনির্দিষ্ট নামে পরিচিত। পূর্বদিকের সরোবরের নাম অরুণোদ, পশ্চিমের নাম সিতোদ, উত্তরের নাম মহাভদ্র আর দক্ষিণের সরোবরের নাম মানস, এই প্রতিটি মহা সরোবরের চতুষ্পর্শ্বে অসংখ্য পর্বত বা মহাশৈল আছে। আমি এবার বিস্তারিতভাবে ওইসব পর্বতরাশির নাম আপনাদের কাছে বলছি, মন দিয়ে শুনুন।
অরুণোদ সরোবরের পূর্বদিকে শীতাম্ভ, কুমুঞ্জ, সুবীর, বিকঙ্ক, মণিশৈল, বৃষভ, মহানীল, রুচক, সবিন্দু মন্দর, বেনুমান, সুমেধ ও নিষেধ নামে কতকগুলি পর্বতশ্রেষ্ঠ আছে। এগুলি ছাড়া আরও কিছু পর্বত এখানে ছিল, মন্দরের পূর্বে এইসব সিদ্ধদের নিবাসস্থানের উদাহরণ দেওয়া হল। এবার মানস সরোবরের দক্ষিণে যে সকল মহাপর্বত আছে, যাদের কথা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি, তাদের নামসমূহ শুনুন। মানস সরোবর সংলগ্ন ত্রিশিখর, শিশির, কলিঙ্গ, পতঙ্গ, কীচক, সানমান, তাম্ৰভ, বিশাখ, সুমূল, শ্বেতোদয়, বিষাধার রত্নধার একশৃঙ্গ, মহামূল, গজ, পিশাচক পঞ্চশৈল, কৈলাস ও পর্বতশ্রেষ্ঠ হিমালয় প্রভৃতিতে দেবতাদের নিবাস রচিত হয়েছে। এরা উৎকৃষ্ট, পর্বতোত্তম, দেবতুল্য দীপ্তিমান ও মেরুর দক্ষিণে বিরাজমান। হে দ্বিজোত্তমগণ সিতোদ সরোবরের পশ্চিমে যে সমস্ত উত্তম মহাশৈল আছে তাদের কথা বলছি, শুনুন, সিতোদের পশ্চিমদিকে রয়েছে, সুরক্ষাঃ শিখী, কাল, বৈদুর্য, কপিল, রুদ্র, পিঙ্গল, কুমুদ, সুরস, মধুমান, অঞ্জন, মুকুট, কৃষ্ণ, পাণ্ডব, সহস্রশিখর, পরিপাত্র, বৈদুর্য, ভুতি পর্বতশৃঙ্গ।
মহাভদ্র সরোবরের জল অত্যন্ত নির্মল এবং পবিত্র। এর উত্তরদিকে যেসব পর্বত আছে ক্রমানুসরে তাদের নামগুলি হল–শঙ্কুকুট, বৃষভ, হংস, নাগ, কপিল, ইন্দ্র, সানমান, নীল, কনকশৃঙ্গ, শতশৃঙ্গ, পুষ্পক, মেঘ, বিরাজ ও জারুধি। এবার এইসব প্রধান প্রধান পর্বতের মধ্যে যেসব স্থানে দ্রোণী ও সরোবর আছে তাদের কথা বলছি, শুনুন।
.
৩৪.
লোমহর্ষক সূত বললেন, পর্বতপ্রবর শীতান্ত ও কুমুঞ্জের মধ্যবর্তী স্থানে প্রায় তিনশত যোজন দীর্ঘ ও শত যোজন বিস্তৃত বহুতর দ্রোণী আছে। এগুলি বিবিধ প্রাণী কর্তৃক সেবিত এবং বিহঙ্গ কূজিত স্থান। এর মধ্যে সুমিষ্ট নির্মল সলিলপূর্ণ এক সুন্দর সরোবর আছে। এর জলে দ্রোণীর সমান দীর্ঘ সুগন্ধি পুণ্ডরীক এবং শত সহস্র পত্রবিশিষ্ট মহাপদ্মে অলংকৃত। এর জলে ভয়ংকর বিষধর বিশাল বিশাল সর্প বসবাস করে। দেব, দানব ও গন্ধর্বরা জলে আগমন করে থাকেন। এই পুণ্যসরোবর ‘শ্রী সরোবর’ নামে স্বর্গে এবং পৃথিবীতে প্রসিদ্ধ। এই সরোবরের মাঝখানে আছে পদ্মরন, এই পদ্মবনে কোটি জলশালী প্রস্ফুট তরুণ অরুণের দীপ্তিতুল্য এক মহাপদ্ম। দিব্যকান্তি এই মহাপদ্মটি কোশমুক্ত, অজর, চঞ্চল, মণ্ডলাকার, মনোহর, কেশরজালে সমৃদ্ধ মত্ত ভ্রমর গুঞ্জিত। এই পুণ্যপদ্মে মূর্তিমতী শ্রী ভগবতী নিত্যই অবস্থান করে থাকেন। তার আশীর্বাদ প্রসন্ন জলে পূর্ণ এই সরোবরটি সকল প্রাণীর আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।
সিদ্ধগণসেবিত এই শ্রীসরোবরের পূর্বতীরে সতত পুষ্পফল সমৃদ্ধ মনোরম এক বিশাল এক বিল্বন আছে। বিকাননটি তিনশত যোজন দীর্ঘ ও শত যোজন বিস্তীর্ণ। এতে সহস্র সহস্র বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষ বিরাজ করছে। সমস্ত বৃক্ষগুলি অর্ধকেশ পরিমিত উচ্চ শিখরবিশিষ্ট সহস্র শাখা মণ্ডিত এবং মহাস্কন্ধ। এইসব বৃক্ষের যেসব ভেরীপরিমিত সুগন্ধি ফল উৎপন্ন হয় তা সুবর্ণের মতো দীপ্ত পাণ্ডুর ও হরিৎবর্ণ এবং অমৃতের মতো স্বাদু হয়ে থাকে। বিশীর্ণ অবস্থায় ফলগুলি নিজে থেকেই পড়ে যায়। আর তাতেই এই বন প্রান্তর সর্বদা পরিকীর্ণ হয়ে থাকে। এই বিশ্ববন সর্বলোকে ‘শ্ৰীবন’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষ, মহানাগ, সিদ্ধ ও নিত্যামোদী প্রমুখ সকলেই এই সুমিষ্ট বিফলভোজী, তাই এই বর্ণ এধরনের বিবিধ ভূত সংঘে পরিপূর্ণ, এই বনে সিদ্ধ সংঘবন্দিতা শ্রীদেবী ভগবতী সাক্ষাৎ বিরাজ করেন। তাই দেবীর অনুগ্রহ ধন্য এই বন আদ্যন্ত পবিত্রভূমি।
শৈলশ্রেষ্ঠ বিকঙ্ক ও মণিশৈলের মাঝখানে প্রায় শত যোজন পরিমাণ বিস্তৃত ও দ্বিশত যোজন দীর্ঘ এক বিপুল রম্য গন্ধ ও গুণময় চম্পক বন আছে। এই বন সিদ্ধ চারণগণ দ্বারা সেবিত হয়ে থাকে। শোভামণ্ডিত হয়ে আছে। এই বন মনঃ শিলা চূর্ণাতুল্য পাণ্ডকে শরশালী, দুই হাত উচ্চ ও তিন হাত বিস্তৃত একপ্রকার মনোহর, মুক্তকেশে ও গন্ধময় কুসুমে পরিকীর্ণ, ভ্রমর গুঞ্জিত এই শ্ৰীবান দেব, দানব, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, কিন্নর, অপ্সরা ও মহানাগরা বিরাজ করছেন। এই শ্ৰীবনে ভগবান প্রজাপতি কশ্যপের সিদ্ধ সাধ্যগণের সমাকীর্ণ এক রমণীয় আশ্রম আছে। সেই আশ্রম নানাজনের দ্বারা সেবিত হয়ে থাকে।
এছাড়া মহানীল ও কুমুঞ্জ পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে সুখদায়িনী মহানদীর তীরে একটি সিদ্ধসেবিত মনোরম তালবন আছে। এই তালবনটির আয়তন দৈর্ঘ্য পঞ্চাশ যোজন ও বিস্তারে শত যোজন। এই তালবনে যত বৃক্ষ আছে সকলেই অর্ধ কেশে পরিমিত উচ্চ। বৃক্ষগুলি স্থির, অবিচল, শুভ মহাসাগর ও বিশাল মূল যুক্ত। এই বৃক্ষগুলি থেকে যে মহাফল উৎপন্ন হয় তা পরিপূর্ণ গোলাকার ও কৃষ্ণবর্ণ বিশিষ্ট। এই স্থান সবসময় দিব্য গন্ধরসে আমোদিত থাকে। সিদ্ধসেবিত এই তালবন মহেন্দ্রের শ্রেষ্ঠ গজ ঐরাবতের প্রিয় নিবাসস্থল।
বেনুমান ও সুমেধ পর্বতের উত্তরদিকেও সহস্র যোজন দীর্ঘ ও শত যোজন বিস্তীর্ণ এক বিশাল বন আছে। বৃক্ষ-গুল্ম, লতা-গুচ্ছ বেষ্টিত, দূর্বাচ্ছাদিত এই সকল প্রকার প্রাণীশূন্য।
ইহা ব্যাতিরেকে নিষধ ও দেবগিরির উত্তরদিকে সহস্র যোজন দীর্ঘ এবং শত যোজন বিস্তৃত বিস্তীর্ণ এক তরুলতাহীন প্রান্তরের অস্তিত্ব আছে। সর্বত্র পাদ পরিমিত জল দ্বারা আপ্লুত এই বনে শিলাময় নানা আকারের আভ্যন্তরীণ সানুদেশ আছে। এই বিপ্রশ্রেষ্ঠগণ, এখন মেরুর পূর্বদিকে অবস্থিত। এইসব সানুদেশের কথা বলছি, শুনুন।
.
৩৫.
সূত বললেন, এগুলি ছাড়া দক্ষিণদিকেও একাধিক সিদ্ধসেবিত সানুদেশ আছে। এবার আমি সেগুলির কথা আনুপূর্বিক ভাবে বলছি, শুনুন।
শিশির ও পতঙ্গ পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বিহঙ্গকূজন সেবিত রম্য উড়ম্বর অরণ্য আছে। অরণ্যাঞ্চল সমতল। এই অরণ্যে যেসব বৃক্ষ আছে তাদের শাখা প্রশাখা উচ্চতায় প্রায় আকাশকে ছুঁয়েছে। লতা দ্বারা আলিঙ্গিত এই বৃক্ষগুলো আকারেও বিশাল। এইসব বৃক্ষের পরিপক্ক ফল অত্যন্ত মধুময়। তারা দেখতে স্ফটিকের মতো নির্মল এবং মহাকুম্ভের মতো বিশাল। অনেক সিদ্ধ, যক্ষ, গন্ধর্ব, সর্প, কিন্নর এবং বিদ্যাধর আনন্দিত চিত্তে ওই বৃক্ষের ফলে নিত্যদিন জীবনধারণ করে থাকেন। এই অরণ্যকে চারিদিক থেকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য নদী। নদীগুলিতে সবসময় প্রচুর জল থাকে। সেই জল যেমন স্বচ্ছ, তেমনি স্বাদু। ভগবান প্রজাপতি এটি স্থাপন করেছেন। তার সেই সুন্দর আশ্রমটিতে দেবতাগণের নিত্য যাতায়াত এবং এর সবদিকে রয়েছে বিচিত্র কানন। এই কাননের চারপাশের পরিধি একশত যোজন প্রায়।
তাম্রবর্ণ পতঙ্গ পর্বতের মাঝখানে প্রায় শত যোজন বিস্তৃত এবং দুই শত যোজন দীর্ঘ একটি সরোবর আছে সরোবরে প্রান্ত বরাবর শ্বেত পদ্মের বাহার। বাকি সব জায়গায় রক্তলাল ও আকাশনীল বর্ণের অসংখ্য সুগন্ধির কমল প্রফুল্ল বদনে উদ্ভাসিত হয়ে আছে। এই কমলদলে কত যে উন্মানা ভ্রমর এসে বসে, তার ইয়ত্তা নেই। সরোবরটি পুণ্য সলিল দেবদানব নির্বিশেষে সেবিত হয়। এর জলে খেলা করে অসংখ্য মহাকায় সর্প ও বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য। এই সরোবরে ঠিক মাঝখানে আছে একটি জনপদ। রক্তধাতু বিভূষিত এই জনপদটির বিস্তার দৈর্ঘ্যে প্রায় শত যোজন এবং প্রস্থে প্রায় তিরিশ যোজন পর্যন্ত। এই জনপদস্থিত বিদ্যাধরপুরি উচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত, রাজপথ ও তোরণে শোভিত, অসংখ্য নরনারী প্রচুর ঐশ্বর্যের সাথে এখানে বাস করেন। এছাড়া এখানে আছে অসংখ্য বল্লভী, অসংখ্য মণি বিভাগ। সরোবরের জলে এই পুরীর রত্নময় প্রদীপ্ত মসৃণ চিত্রের প্রতিবিম্ব রচিত হয়। আর এই নগরীতে আছে বিশাল, উৎকৃষ্ট ও অত্যুচ্চ ভবনমালা। এই পুরীর খ্যাতনামা বিদ্যাধরপতি হলেন পুলোমা নামে এক বিখ্যাত ব্যক্তি। এখানে তার যা বিক্রম তা মহেন্দ্ৰতুল্য। মণিমালায় ভূষিত বিচিত্র ধরনের বেশভূষা তার। তিনি হলেন দীপ্ত বিচিত্রকেশ সূর্যসমতেজস্বী সহস্র সহস্র বিদ্যাধরের সম্রাট।
বিশাখ ও পতঙ্গ পর্বতের মাঝখানে তাম্রবর্ণ সরোবরের পূর্ণ তীরে এক সর্বকালীন ফলপ্রসূ মনোরম শাখাযুক্ত বর্ণাঢ্য আস্রবন আছে। আম্রবনটি পঞ্চবাণের ক্ষেপণে বিদ্ধ, স্ফীত এবং বিশাল। এই বনে যে ফলই জন্মায় তা সুবর্ণ বর্ণ, অতি স্বাদু, সুগন্ধি এবং মহাকুম্ভের মতো বিশাল হয়ে থাকে। বৃক্ষগুলোর চারপাশে ছড়িয়ে থাকে বিশাল বিস্তৃত শাখাপ্রশাখা। এইসব অমৃত ফলের অতি স্বাদু ও অমৃততুল্য পান করে গন্ধর্ব কিন্নর, যক্ষ, সর্প ও বিদ্যাধরগণ তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত হন। অমৃতরস পান করার পর হৃষ্ট ও তুষ্ট হয়ে এঁরা যে মহানাদ করেন বহু দূর থেকে সেই শব্দ শোনা যায়।
ত্রিশ যোজন বিস্তীর্ণ ও পঞ্চাশ যোজন দীর্ঘ এক বিল্ববন আছে সুমূল ও বসুধা পর্বতের মাঝখানে। এই বিশ্ববনের বৃক্ষগুলো শুদ্ধ এবং ফলভারে নত হয়ে আছে। এইসব বৃক্ষের বিশীর্ণ ফল অরণ্যের মৃত্তিকা তলকে কর্দমাক্ত করে তুলেছে। এই অরণ্যের বৃক্ষগুলো সুরভিত পর্ণে সমৃদ্ধ ও বিহঙ্গ পূর্ণ। নিত্য বিফলভোজী বহু যক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর, সিদ্ধ এবং নাগগণের উপজীবিকা হল এই বিশ্বস্থলী।
এরপর বসুধা ও রত্নধার পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে প্রায় ত্রিশ যোজন বিস্তৃত শতযোজন দীর্ঘ এক কিংশুক বন আছে। কিংশুক বৃক্ষগুলি নিত্য পুষ্পিত এবং গন্ধময় হয়ে থাকে। দূর থেকে বনটিকে দেখে মনে হয় যেন প্রদীপ্তের মতো শোভা পাচ্ছে। এর দিব্যপুষ্প গন্ধে সমগ্র পরিমণ্ডল সুরভিত হয়ে থাকবে। এই রমণীয় কিংশুক বনে বহু সিদ্ধচারণ ও অপ্সরারা বাস করে থাকেন। জলাশয় ভূষিত সেই বনে আদিত্যদেবের এক দীপ্ত মহাগৃহ আছে। সেখানে প্রতি মাসে প্রজাপতি সূর্য অবতীর্ণ হন। সিদ্ধগণ কালকর্তা সুরোত্তম সর্বলোক নমস্কৃত সেই সূর্যদেবকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে নমস্কার করেন।
পঞ্চকূট ও কৈলাশ পর্বতের মাঝখানে ছত্রিশ যোজন দীর্ঘ ও শত যোজন বিস্তীর্ণ যে স্থান আছে তা যেমন দুর্গম তেমনই লোমহর্ষক। হংসপাণ্ডুর এই স্থানটিকে ক্ষুদ্র প্রাণীরা সহসা আক্রমণ করতে পারে না। স্থানটি সাধারণভাবে সকল প্রাণীর পক্ষেই দুর্গম এবং এর শেষ কোথায় কেউই তা সঠিকভাবে বলতে পারেন না। দক্ষিণে অবস্থিত এই যে বিকৃত অঞ্চল সিদ্ধদের নিবাসস্থল। হে দ্বিজোত্তমবৃন্দ, পশ্চিমদিকে যে সকল অন্তর সানুদেশ আছে, এবার আমি সেগুলোর যথাযথ বর্ণনা প্রদান করছি, মন দিয়ে শুনুন।
সুরক্ষা ও শিখি পর্বতের মধ্যবর্তী অন্তর সানুদেশে শত যোজন দীর্ঘ এক শিলানির্মিত, সদা তপ্ত, মহাঘোর, দুঃস্পর্শ এক নিদারুণ স্থান আছে। এই স্থান যে কোনো প্রাণী এমনকি দেবতাদেরও অগম্য। এই শিলময় দেশে ত্রিংশৎ যোজন পরিধিযুক্ত সহস্ৰজ্বালাময় এক দারুণ বহ্নিস্থান আছে। এখানে বিরাজ করেন ইন্দনবিহীন, জ্বালা মালাময়, জাজ্বল্যমান হুতাশনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা এবং সংবর্তক অগ্নি। শৈলশ্রেষ্ঠ দেব ও পিঞ্জর পর্বতের অন্তর সানুদেশে চারিদিক থেকে দশ যোজন দীর্ঘ এক দাড়িম্ব বন আছে। সুবর্ণ বর্ণ মধুমাখা, রসময় দাড়িম্ব ফলের গন্ধে সেই বনস্থলী মথিত হয়ে থাকে। সেখানে শুদ্ধচেতা বৃহস্পতির এক মহাপুণ্য আশ্ৰম আছে। এই আশ্রমে বহু সিদ্ধ সংঘের নিবাস গড়ে উঠেছে। আনন্দময় এই আশ্রম কামনা অনুসারে ফল দান করে থাকে।
শৈলকেশর কুমুদ এবং অঞ্জনের মধ্যে একটি নাগকেশর বন বিদ্যমান আছে। বনটি চারিদিক থেকে বহু বহু যোজন দীর্ঘ। এই বনে যে নাগকেশর কুসুম জন্মায় কেবল তাদের আয়তনই অবাক করার মতো। এগুলি দুই হস্ত পরিমাণ উচ্চ তিন হস্ত বিস্তৃত এবং চন্দ্র রশ্মির মতো বর্ণশালী। এইসব প্রস্ফুটির প্রকাণ্ড কুসুমে চঞ্চল ভ্রমরেরা নিত্য ক্রিড়াশীল। ভ্রমরের গুঞ্জন এবং সর্বকালীন মনোহর এইসব নাগকেশরের মৃততুল্য গন্ধে বিচিত্র সেই বন সদা পরিশোভিত থাকে। এই বনেই দেবগুরু বিষ্ণুর ত্রিলোক খ্যাত সর্বলোক নমস্কৃত এক বিরাট শুদ্ধ ও পবিত্র আশ্রম গড়ে উঠেছে।
কৃষ্ণ ও পাণ্ডুর পর্বতের মধ্যবর্তী মসৃণ অংশে ত্রিশ যোজন বিস্তৃত নব্বই যোজন দীর্ঘ সম্পূর্ণভাবে বৃক্ষলতা বর্জিত সুখবিচরণ যোগ্য, এক শিলাময় সমতল প্রদেশ আছে। তার মধ্যে যে শুদ্ধ সলিল সরোবর আছে, তাতে একটি অত্যন্ত রমণীয় স্থলপদ্ম শোভমান। প্রস্ফুটিত এই স্থলপদ্ম ছত্রাকৃতি বিকশিত শতদলবিশিষ্ট মনোহর ও সৌগন্ধময়। এই পদ্মের চারিপাশে মধুলোলুপ, মদৌকট ভ্রমরের দল ঘুরে বেড়ায়। কিন্নরগণ গদগদকণ্ঠে মৃদু স্বরে গান গেয়ে চলেছেন। এই সুবিশাল স্থলপদ্মটিকে যক্ষ, গন্ধর্ব ও অন্যান্য সিদ্ধ চারণেরা নিত্য সেবা করে চলেছেন।
এই স্থলপদ্মিনীর মধ্যে পঞ্চ যোজন পরিধি বিশিষ্ট বিপুল স্কন্ধ, অসংখ্য শাখামণ্ডিত এক বিশাল বটবৃক্ষ আছে। যিনি চন্দ্রতুল্য দীপ্তিশালী, যিনি সহস্রবদন, নীলাম্বর, যিনি অসুরসংহারক, যাঁকে ত্রিভুবনের কেউই পরাজিত করতে পারে না; সেই মহাভাগ, জন্মমৃত্যুহীন, পদ্মমালাধারী শ্ৰীমান শ্রীহরি এখানে অধিষ্ঠান করেছেন। গন্ধর্ব যক্ষ, বিদ্যাধর ও সিদ্ধচারণগণ কমলপুষ্পসহযোগে তার অর্চনা করে থাকেন। সর্বলোক বিশ্রুত প্রসিদ্ধ লম্বমান বিবিধ প্রকারের পদ্মমালায় উপশোভিত এই স্থানটির নাম “অনন্তসদ”।
সহস্রশিখর কুমুদ পর্বতের মধ্যেও পক্ষীসেবিত এক বন আছে। ইহা পঞ্চম যোজন দীর্ঘ ও ত্রিশ যোজন বিস্তৃত। উচ্চ পরাদপরিবৃত সেই বনে গজদেহের মতো বিশালাকৃতি একাধিক মহাবৃক্ষ আছে। এইসব মহাবৃক্ষজাত ফলগুলি সুস্বাদু মধুরগন্ধি ও মধুস্রাবী। সেই বনে শুক্রাচার্যের একটি আশ্রম আছে। আশ্রমটি শুক্রাচর্যের আশ্রম নামেই খ্যাত। দেবর্ষিগণ সেবিত এই আশ্রমটিকে মহাপুণ্য ভস্বর ও সকল পুণ্যফলের ফলস্বরূপ রূপে বর্ণনা করা হয়। আশ্রমটি বৃষভ ও শৈলকূট পর্বতের মাঝখানে অবস্থিত। এর পাশেই বহু যোজন পরিধিযুক্ত দীর্ঘ সুন্দর এক ফলের বাগান আছে। এর এক-একটি ফলের আয়তন বিশ্ব প্রমাণ। এইসব সুগন্ধি, মহাস্বাদু, বৃন্তচুত ফলের কারণে এই বাগানের ভূমিতল সর্বদা আর্দ্র থাকে। এইসব বিল্ব প্রমাণ ফল দ্বারা গন্ধর্ব, কিন্নর, উরগ ও সিদ্ধগণ জীবিকা নির্বাহ করেন। এখানকার গণ্যমান্য চারণেরাও সেই ফলের রসে উন্মত্ত।
কপিঞ্জল ও নাগ পর্বতের মধ্যে প্রায় দুই শত যোজন দীর্ঘ এবং শত যোজন বিস্তৃত একটি মনোরম উদ্যান আছে। এখানে দ্রাক্ষা, নাগকেশর, খর্জর, নীলাশোক, দাড়িম্ব, স্বাদু অক্ষোটক, অতসী, তিলক, কদলী ও বদরীবন আছে। নানা বর্ণের নানা প্রজাতির পুষ্পফলশোভিত এই উদ্যান কিন্নর আর সর্পদের প্রিয় নিবাস ভূমি। এই স্থানের উপর দিয়ে বহু স্বাদু ও শীতল জলপূর্ণ নদী প্রবাহিত হয়েছে।
ষাট যোজন বিস্তীর্ণ ও শত যোজন দীর্ঘ এক দারুণ বনস্থলী পুস্পক ও মহামেঘ পর্বতশৃঙ্গের মাঝখানে আছে। মসৃণ এই স্থানটি জলের তলার মতো সমান, কঠিন ও পাণ্ডুবর্ণ। এখানে বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, তৃণ এমনকি কোনো প্রাণী–কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। স্থানটি দেখলেই শরীর রোমাঞ্চিত হয়।
. হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ, দক্ষিণদিকে অবস্থিত এই সমস্ত স্থানগুলিতে বহু মহাসরোবর, মহাবৃক্ষ, মনোহর মহাবন আছে। এগুলি ছাড়াও এখানে যত সাধারণ এবং ক্ষুদ্র সরোবর, সাধারণ বন ও প্রজাপতির দল আছে, সে সবের কোনোটারই সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এছাড়াও এখানে আরও অনেক স্থলী, পর্বত ও অন্তর সানুদেশ বা উপত্যকা আছে। আছে অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত সরোবর ও বন তাদের মধ্যে কারও আয়তনের পরিমাণ দশ, কারও বারো, কারও সাত বা আট, কারও আবার কুড়ি কিংবা ত্রিশ যোজন। হে দ্বিজোত্তমবৃন্দ, এছাড়া এখানে এমন কিছু পর্বত গুহা আছে যেখানে বছরের কখনও কোনোদিন সূর্যরশ্মিজাল প্রবেশ করতে পারে না। এগুলি মহাঘোর শ্যামবর্ণ, হিমশীতল দুর্গম স্থান হিসেবে সাধারণের অগম্য রয়ে গেছে। এরকম কোনো কোনো পর্বতের মধ্যে উত্তপ্ত জলরাশিময় শত সহস্র সরোবর চোখে পড়ে।
.
৩৬.
সূত বললেন, হে ভূর্লোকশ্রেষ্ঠ ঋষিবৃন্দ এবার আমি যে যে শিলাখণ্ডে যে যে বিবিধ দেবতাগণের উৎকৃষ্ট নিবাসগৃহ নির্দিষ্ট করা হয়েছে, সে বিষয়ে বলছি, শুনুন।
প্রথমেই আমি পর্বতপ্রবর শীতাম্ভ-র বিষয়ে বলব। শীতাম্ভ সবদিক দিয়ে সুদীপ্ত এক পর্বত। ইহা শত শত বিচিত্র ধাতু ও শত শত রত্নের উদ্ভব স্থান। অনেক সত্ত্বগুণের নিকেতন এই পর্বতের নিতম্বদেশ বিবিধ পুষ্পমাল্যে ভূষিত থাকে। পর্বতটি মহামূল্য মণিমাণিক্য ও প্রবালে চিত্রিত স্বর্ণাভরণে অলংকৃত। এক কুসুমাকীর্ণ গাত্রে মদোকট ভ্রমরেরা নিত্য ঝংকার করে। এই পর্বতে যেসব রত্নভূষিত অন্তর সানুদেশ আছে, তা লতালম্বিত চিত্র-বিত্রিত শত শত ধাতু দ্বারা আবৃত। পর্বতটির অসংখ্য প্রস্রবণ আছে। এদের জল যেমন নির্মল, তেমনি মধুর। কুসুমে কুসুমে সমাকীর্ণ, অসংখ্য নিকুঞ্জশোভিত এই পর্বতগাত্র পুস্পনির্মিত ভেলা শোভিত বহু নদী দ্বারা অলংকৃত। এই পর্বতের গৃহংকন্দরগুলি কন্দর্প ও যক্ষদের প্রিয় বিচরণভূমি। এই পর্বতে এমন বহু বিচিত্র বৃক্ষ বিদ্যমান যারা মুখসেব্য, নানা বন্য জীবজন্তুতে সমাকীর্ণ, পশুপাখিদের পক্ষে সুখকর আশ্রয় এবং নানা পুষ্প ফলে সমৃদ্ধ এই পর্বতেরই এক গোপন করে দেবরাজ ইন্দ্রের ক্রীড়াবনক্ষেত্র স্বরূপ বিশাল পারিজাত বন আছে। পারিজাত বনের বিশেষত্ব হল এখানে সমস্ত কামনাসঞ্জাত ধন, যা কিছু ত্রিলোক প্রসিদ্ধ এবং মনোরম–সেসব কিছুই পাওয়া যায়। শীতাম্ভ পর্বতে তরুণ অরুণের মতো দীপ্ত, সুবাসিত, মনোহর পুষ্পরাজির এক দুর্লভ সমাহার ঘটে গেছে। সর্বোপরি পারিজাত ফুলের সুগন্ধ মাহেন্দ্র কানন থেকে নির্গত বায়ুপ্রবাহে ওই পর্বতের চারিপাশে শত যোজন জুড়ে সুগন্ধ বিস্তার করছে। এখানে পর্বতশিখরে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট জলাশয়গুলিতে ভূষণরূপে শোভা পাচ্ছে। বৈদুৰ্য্যমণির মতো বর্ণবিশিষ্ট নীলোৎপল শোভা পাচ্ছে এমন আরও অনেক কোকোনদ, অপঙ্কজাত সুবর্ণ কমল যাদের কেশগ্ৰ বজ্রের মতো কঠিন, যার স্পর্শ ও গন্ধগুণে পরিপূর্ণ, যারা কেশমুক্ত, বিকশিত, যারা শত শত মনোহর মহাপত্রে শোভিত এবং মত্ত ভ্রমরের গুঞ্জনে ঝংকৃত। এইসব জলাশয়ের জলে সুবর্ণমণিমণ্ডত চক্ষুঃস্পন্দনতুল্য সহস্র সহস্র মীনযুথবদ্ধ হয়ে বিরাজ করছে। সেই সঙ্গে এই জলে বিচরণ করছে অনেক অবয়বসম্পন্ন হেমরতুবিভূষিত বহু কচ্ছপ–ফলে জলের রূপ বিচিত্রর শোভা ধারণ করেছে। আর ধীমান দেবরাজের ওই পারিজাত কাননে নানা বর্ণ ও নানা রত্নে ভূষিত পক্ষীদের পক্ষশ্রদেশ সুবর্ণরচিত, তাদের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত সুমধুর এরা সর্বদাই মত্ত অবস্থায় আকাশের বুকে ইচ্ছেমত উড্ডয়নরত। ভ্রমরকুলের মত্ত নিনাদে এবং বিহঙ্গ কূজনে দেবেন্দ্রের এই ক্রীড়াবন এককথায় নিত্য আনন্দিত। এই দেবসেবিত বন মণিমুক্তোমণ্ডিত মণিময় শৃঙ্গযুক্ত সুবর্ণপার্শ্ব হরিণ, শাখামৃগ ও নানা প্রকারের রত্নভূষিত বিচিত্র অঙ্গ অন্য অন্য প্রাণী দ্বারা পরিপূর্ণ। এই বনে জাললতায় আবৃত পারিজাত বৃক্ষসমূহ ধীরগতি পবণহিল্লোলে আন্দোলিত হয়ে পুষ্পবর্ষণ করে থাকে। হে দ্বিজবৃন্দ, এখানেই সেই বনের বিশিষ্টতার শেষ নয়। সেখানে স্থানে স্থানে রত্নমণ্ডিত শয়নাসন ও মঙ্গলময় বিহারভূমি নিষেধহীন বিস্তৃত রয়েছে।
পারিজাত কাননের আবহাওয়াও অতি মনোরম। এখানে একদিকে যেমন অতি শীত বা অতি গ্রীষ্ম নেই, তেমনি শ্রমবিমুখতাও নেই। সূর্য এখানে সর্বদা সমানভাবে কিরণ দান করে। সেই বনে প্রস্ফুটিত নানা পুষ্পের গন্ধে সুরভিত। মধুমদে উন্মাদিত হয়ে যে শীতল বায়ু প্রবাহিত হয়ে চলেছে তা স্পর্শ মাত্র শরীরে এক অত্যাশ্চর্য সুখানুভূতি দেখা দেয়। এবং শ্রমক্লান্তি দূরীভূত হয়। সেই চির সৌন্দর্যের বিরাজভূমি ইন্দ্রবনে দেব, দানব, পন্নগ, রাক্ষস, যক্ষ, গুহা, অমিত, তেজঃ গন্ধর্ব সিদ্ধ, কিন্নর, বিদ্যাধর এবং অপ্সরাগণ আনন্দের সঙ্গে নিত্যদিন ক্রীড়া করে থাকেন।
কুমুঞ্জ পর্বত এই শীতাম্ভ পর্বতশৃঙ্গের পূর্বদিকে অবস্থিত। কুমুঞ্জ পর্বতে অনেক নিঝর ও কন্দর আছে। আছে মহাত্মা দানবদের আটটি সুসমৃদ্ধ পুরী। এগুলি ধাতুবিচ শৃঙ্গ সমূহে তৈরি হয়েছে। আবার বজ্রক পর্বতের অসংখ্য শিখরশীর্ষে রাক্ষসদের নিবাসযোগ্য একাধিক পুরী নির্মিত হয়েছে। এগুলিতে রাক্ষসপ্রজাতির নরনারীগণ বসবাস করে থাকেন। এই পুরীর অধিবাসী রাক্ষসগণ “নীলক” নামে পরিচিত। এঁরা ভয়ানক স্বভাবের হয়ে থাকেন। আর ইচ্ছেমতো রূপ ধারণ করতে পারেন। মহাবলশালী তেজঃসম্পন্ন রাক্ষসেরা সেখানে সর্বদা ভ্রমণ করে থাকেন। মহানীল পর্বতেও কিন্নরগণের বাসোপযোগী পঞ্চদশটি পুরী আছে। মহাত্মা অশ্ববদন কিন্নরেরা এসব পুরীতে বাস করেন। তবে নানান বর্ণের কিন্নর নৃপতিরা গঠিত সুবর্ণ পার্শ্ব পঞ্চদশ বনে বিরাজ করেন। তারা ছাড়াও এইসব পর্বত এমন কিছু শত শত বিশালাকৃতি সর্প বাস করেন যাঁরা নিদারুণ প্রকৃতির। যাঁদের দৃষ্টিতে বিষ, যাঁরা অতি ক্রোধী, দুর্ধর্ষ এবং যাঁরা গরুড়ের বশবর্তী মহাশৈল সুনাগ পর্বতে আছে অনেকগুলি হর্মরাজি প্রাসাদ সমন্বিত উচ্চ প্রাচীর ও তোরণে সুরক্ষিত দৈত্যপুরী।
বেণুমান মহাশৈলশিখরে তিনটি বিদ্যাধরপুরী আছে। এগুলি প্রত্যেকটি ত্রিশ যোজন বিস্তৃত ও পঞ্চাশ যোজন দীর্ঘ। এই পুরী তিনটি তিনজন শ্রেষ্ঠ বিদ্যাধরের নিয়ন্ত্রণাধীন। ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী সেই তিনজন বীর্যবান বিদ্যাধর হলেন–উলুক, রোশন ও মহানেত্ৰ।
শৈলবৃষভ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য করঞ্জ পর্বতে বিশাল বিশাল নিঝর ও কন্দর আছে। এগুলি বিবিধ রত্নধাতুতে বিচিত্রত। এই করঞ্জ পর্বতেই পরণগতি সম্পন্ন দুর্দান্ত দুর্ধর্ষ গরুরপুত্র এবং নিত্যসৰ্পৰ্শত্রু সুগ্রীবের আবাস। এই পর্বত এরকম অনেক মহাবল পরাক্রান্ত সপশত্রু পক্ষীদের দ্বারা পরিপূর্ণ। করঞ্জ পর্বতের উত্তরদিকে ভূতপতি বৃষভবাহন যোগিবর প্রভু শংকর অবস্থান করছেন আর তাকে কেন্দ্র করে এই পর্বতের চতুর্দিকে নানাবেশধারী দুর্ধর্ষ প্রেতেরা বিচরণ করেন। বসুধারা পর্বতে অমিততেজা ধনশালী অষ্টবসুর আটটি বাসস্থান আছে। এগুলি মহাত্মাগণ দ্বারা পূজিত হন। রত্নধাতু পর্বতেও মহাত্মা সপ্তর্ষিদের সিদ্ধনিবাস আছে। এখানে সাতটি মহাত্মাপূজিত পুণ্য আশ্রমও আছে। নগশ্রেষ্ঠ হেমশৃঙ্গ পর্বতে চতুর্মুখ প্রজাপতি ব্রহ্মার সর্বলোক পূজিত বাসস্থান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গজশৈল পর্বতে ভগবান রুদ্রদেবগণ বহুবিধ ভূতগণের সাথে সানন্দে অবস্থান করেন। এতসব পর্বতের মাঝে সুমেঘ পর্বতের একটি স্বাতন্ত্র্য আছে। এই মেঘতুল্য শৈলেন্দ্রটি একদিকে যেমন সুন্দর সুন্দর মেঘে শোভমান অন্যদিকে তেমনি বিচিত্র ধাতুতে সমৃদ্ধ। পর্বতটি বহু গর্ভকন্দর অন্তর সানুদেশ এবং নিকুঞ্জ নিকুঞ্জে শোভমান। এই পর্বতদেশ অমিত তেজা আদিত্য ও বসু এবং রুদ্রগণের প্রিয় আবাসস্থল। এছাড়া এখানে দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং সিদ্ধ দেবতাবৃন্দের বিশাল বিশাল রমণীয় গৃহ স্থাপিত হয়েছে। যাঁরা নিত্যপূজাপরায়ণ, সেই সকল যজ্ঞ গন্ধর্ব-কিন্নরগণ এখানে নিত্য বসবাস করে থাকেন। এই ধরনের মহিমা থেকে হেমকক্ষ পর্বতটিও বঞ্চিত নয়। এই পর্বত উচ্চ থেকে উচ্চতর প্রাচীর ও তোরণ দ্বারা সুরক্ষিত। দেবপুরীর সমতুল্য আশিটি উৎকৃষ্ট বিলাসবহুল গন্ধর্বপুরী এই শৈলশৃঙ্গের শোভা বর্ধন করছে। আশিজন গন্ধর্ব নারী এইসব পুরীতে অধিষ্ঠান করেন। তারা ছাড়াও যুদ্ধবিশারদ গন্ধর্ব ও অপত্তন নামে কয়েকজন সিদ্ধ এখানে বাস করেন। রকাজ শ্রেষ্ঠ কপিঞ্জল এঁদের অধিপতি হিসাবে বিশেষ সম্মান পেয়ে থাকেন।
আরও অন্য অন্য পর্বতে যাঁদের বসবাস পর্বতটিকে পবিত্র ও শোভনসুন্দর করে তুলেছে। সংক্ষেপে তাদের কথা বলে নিই।
শতশৃঙ্গ পর্বতে অমিত-তেজাঃ বীর্যশালী যক্ষগণের একশত পুরী এবং তাম্রাভ পর্বতে রুদ্রতনয় তক্ষকের একটি অতি মনোহরপুরী বিদ্যমান। অনল পর্বতে মহাবলশালী রাক্ষসগণ এবং পঞ্চকূট পর্বতে দেবারিশ্রেষ্ঠ মহাবলপরাক্রান্ত তথা উদৃপ্ত দানবগণ বাস করে বিশাল পর্বতের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল অসংখ্য গুহা ও বহু অন্তর সানুদেশের অবস্থিতি। গুহনিবাসপ্রিয় গুহ তাই বিশাখ পর্বতের গোপন গুহ্যকন্দরে বিরাট বাসস্থান গড়ে তুলেছেন। শ্বেতোদর মহাশৈলটি অনেক উত্তম ভবনে মণ্ডিত। এখানে রয়েছে গরুড়পুত্র মহাত্মা সুনাভের পবিত্র বাসস্থান। পিশাচক পর্বতে রয়েছে। কুবেরের বিরাট ভবন। হর্মপ্রাসাদ মণ্ডিত এই ভবনে যক্ষ-গন্ধর্বরাও অবাধে বিচরণ করে থাকেন। হরিকূট পর্বতের গাত্র হতে অত্যন্ত, দীপ্তি সম্পন্ন আভা প্রকাশিত হতে থাকে। সর্বলোকপূজিত দেবতা হরি এখানে অবস্থান করে থাকেন। তার প্রভাবেই ওই দীপ্তি বিচ্ছুরণ। কিন্নর, মহাসর্প ও গন্ধর্বদের জন্য যথাক্রমে কুমুদ পর্বত, অঞ্জন পর্বত ও কৃষ্ণ পর্বতের শীর্ষদেশে উত্তম ও বিলাসবহুল গৃহবিশিষ্ট নগরী বিরাজ করছে। একইভাবে মনোহর খিরশালী পাণ্ডুর পর্বত বিদ্যাধরবৃন্দের মহাভবনমালায় শোভিত হয়ে আছে। এই বিদ্যাধর পুরী মহাপ্রাচীর ও মহাতোরণ দ্বারা বেষ্টিত। বলদৃপ্ত দেবতারা নিজেদের জন্য সহস্য-শিখর পর্বতের সুউচ্চ শিখরশীর্ষ নির্দিষ্ট করেছেন। এখানে হেমমালাধারী উগ্রকর্মা বলশালী দেবতাবৃন্দের এক সহস্র মনোশোভা নিকেতন বিদ্যমান। মুকুট পর্বত অনেক অনেক সৰ্প নিবাসের জন্য বিশিষ্ট। মহাত্মা দৃঢ়তার মুনিগণ তাদের সাধনার উপযুক্ত স্থল হিসেবে পুষ্পক পর্বতে সানন্দে বাস করেন। বৈবস্তব, সোম, বায়ু ও নগাধিপতির চারটি আলাদা আলাদা পুরী সুপক্ষ পর্বতের শোভা অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে। এইসব স্থানে শুদ্ধচিত্ত গন্ধর্ব, যক্ষ, কিন্নর নাগ বিদ্যাধর ও সিদ্ধগণ নিয়মিত পূজাপার্বণ করে থাকেন।
.
৩৭.
মহর্ষি সূত বললেন, হে পুণ্যাত্মা ঋষিবৃন্দ, আরও শুনে রাখুন, সেই গিরিশ্রেষ্ঠ সুমেরুর বিস্তীর্ণ মধ্যবর্তী স্থলে মহাপুণ্যবান আরও একটি পর্বত আছে। পর্বতটির নাম মর্যাদা পর্বত। মর্যাদা পর্বতমালার একটি শুভ্র পর্বতকূটের নাম হল দেবকূট। এই দেবকূট শৃঙ্গে শত যোজন বিস্তৃত স্থান জুড়ে বিরাট একটি অনিন্দ্য ভবনমণ্ডিত স্থান আছে। বিনতানন্দন ধীমান গরুড় এই ভবনেই জন্ম নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে গরুড় শাল্মলিদ্বীপনিবাসী হন। সেই হিসেবে মহাবায়ুবেগশালী সেই মহাত্মা গরুড়ের এটিই প্রথম বাসস্থান। এখানেই তিনি শীঘ্রগামী সম্পূর্ণ বীর্য, দুর্গম, দুর্দান্ত সৰ্পৰ্শ অসংখ্য নিজ বংশীয় মহাপক্ষীদের সাথে বসবাস করতেন।
শ্বেত শুভ্র দেবকূটের দক্ষিণদিকে বিচিত্র মনোরম এবং মহাসমৃদ্ধিসম্পন্ন সাতটি উত্তুঙ্গ শৃঙ্গ বর্তমান আর সাতটি শৃঙ্গেই ত্রিশ যোজন বিস্তৃত ও চল্লিশ যোজন দীর্ঘ সাতটি গন্ধর্ব নগরী আছে। দেবনির্মিত বিশাল বিশাল ভবনরাজিতে শোভিত এই গন্ধর্ব নগরীগুলি সুবর্ণ নির্মিত প্রাচীর ও তোরণে পরিবৃত। তাই দূর থেকে এইসব গন্ধর্ব নগরীগুলিকে দেখলে মনে হত বুঝি সন্ধ্যার মেঘ ঘনীভূত হয়ে আছে। এখানে বহু স্ত্রী ও পুরুষ একত্রে বাস করেন। এই সপ্তপুরীর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এখানে যেসব পরাক্রান্ত গন্ধর্বরা বাস করেন আগ্নেয় নামে প্রসিদ্ধ তারা সকলেই হলেন উত্তম আলয়ের অধিকারী।
দেবকূট মহাশৈলের দক্ষিণদিকে এই সপ্তগন্ধর্ব নগরী থাকলে উত্তরদিকে কেবলমাত্র একটি নগর আছে। নগরটি দেবকূট মহাগিরির উত্তরদিকের একটি শৃঙ্গের উপর অবস্থিত। নগরটির আয়তন চতুর্দিকে ত্রিশ যোজন পরিমাণ। বিবিধ হর্মরাজি প্রাসাদ উদ্যান কাননে শোভিত এই নগরটি উচ্চ প্রাকার ও তোরণ দ্বারা সুরক্ষিত। এখানকার বাতাসে সবসময় শত শত বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে।
হে দ্বিজগণ, এই নগরী সিংহীকাত নয়, দেবতা ও সিদ্ধদের প্রিয় নিবাসস্থল। তাই এই নগরটি দেবশত্রুদের পক্ষে দুঃসহ নিদারুণ। তারা এই নগরটি সম্পর্কে বিশেষভাবে অনাসক্তি প্রকাশ করে থাকেন।
হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ, এ তো গেল প্রথম মর্যাদা পর্বতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এবার দ্বিতীয় মর্যাদা পর্বতের কথা বলি। এখানে কালকেয় অসুরদের এক নগর আছে। নগরটির বিস্তার প্রস্থে তাই যোজন ও দৈর্ঘ্যে শত যোজন পর্যন্ত। এই নগরটিতে সারাদিন বহু নরনারীর সমাগম ঘটে থাকে। প্রাচীর ঘেরা তোরনালংকৃত এই দুর্গম নগরটি কনক ও মণিমাণিক্য দিয়ে বিচিত্র বর্ণে চিত্রিত। নানা বর্ণের বিশাল ভবনমালায় আবৃত প্রশস্ত পথবিশিষ্ট নিত্য আনন্দময় ও মঙ্গলময়। রমণীয় দেবকূটতটে সন্নিবিষ্ট সুদুর্জয় মহামেঘাকৃতি এই নগরটি “সুনাসত” নামে পরিচিত।
এই দ্বিতীয় মর্যাদা পর্বতের দক্ষিণদিকস্থ শৃঙ্গশীর্ষে ত্রিকশ যোজন বিস্তৃত এবং বাষট্টি যোজন দীর্ঘ এক মহানগর আছে। সুবর্ণ প্রাচীরে শোভিত আনন্দময় এই নগরটি কামরূপী দুর্ধর্ষ, হৃষ্টপুষ্ট ও গর্বিত রাক্ষসদের প্রিয় নিবাসস্থল।
দেবকূট পর্বতের মধ্যম মহাকূটে ভূতবট নামে একটি সুদৃশ্য বৃক্ষ আছে। অসংখ্য ভূতপ্রেত এই বৃক্ষে বাস করে থাকেন। বৃক্ষটি আগাগোড়া কনক ও মণিমাণিক্য পাষাণে চিত্রিত। মসৃণ মঙ্গলকর এই বৃক্ষ শত সহস্র শাখায় বিভক্ত এবং প্রচুর আরোহে সমাকুল। এর মূলদেশ বিশাল। স্কন্ধ অসংখ্য আর পত্ররাশি স্নিগ্ধ। সুন্দর পবিত্রতার প্রতীক এই বৃক্ষটির অবিচ্ছিন্ন ছায়া প্রায় দশ যোজন বিস্তৃত ভূমিতলকে অধিকার করে থাকে। এই ভূতবট বৃক্ষের কাছেই মহাত্মা ত্র্যম্বক মহাদেবের সর্বলোকসিদ্ধ দীপ্তিমান আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ভূতবৃক্ষতলে অসংখ্য ভূত মহাপারিষদরূপে নিত্য অবস্থান করে থাকেন। বাঘ, সিংহ, শূকর, ভালুক, শকুনি, করভ, পেরচক, মেষ, উট এবং ছাগলের যেমন উগ্র ধরনের মুখ হয়, এদের মুখেও সেই আদল দেখা যায়। এরা বিরাট, বিকট, দীর্ঘকেশী, খুললোম, নানা বর্ণ ও নানা আকৃতিধারী হয়ে থাকেন। এঁরা কোনো এক জায়গায় ঘনসন্নিবদ্ধভাবে না থেকে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। এঁরা যেমন দীপ্ত তেমনই উগ্র পরাক্রমশালী, ঝঝর, শঙ্খ, পটহ, ভেরী, ভিণ্ডিম, গোমুখ শত-শত বিস্ফুর্জিত এবং তালঝংকার সহ নানা উচ্চস্বরের গীতবাদ্য সহযোগে সর্বলোকপূজিত ভূতপতির নিত্য পূজা আরাধনা করেন। তবে তাদের এই পূজায় কোনো বলি ব্যবস্থা ছিল না। ত্রিপুরারি মহাদেবের অনুচরবর্গ গণপতি ভূতেরা আনন্দিত ও প্রীত চিত্তে সর্বদা এই ভূতবটতলে ক্রীড়ারত থাকতে পছন্দ করেন। দেবর্ষি, মহর্ষি, যক্ষ, গন্ধর্ব, নাগ ও সিদ্ধশ্রেষ্ঠগণ সর্বদা এই ভূতবটবৃক্ষতলে তাদের পরম আরাধ্য সেই লোকমঙ্গল শিশু মহাদেবের নিত্যপূজা করে থাকেন।
.
৩৮.
ত্রিকালদর্শী লোমহর্ষক সূত বললেন, হে ভূর্লোক শ্রেষ্ঠ দ্বিজবৃন্দ, নির্জন চারুশিখর শঙ্খদীপ্ত যে কৈলাসপর্বত, তা সুকর্মশীল দেবভক্তদের আলয়–একথা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। এই মহান পর্বতের মধ্যবর্তী কোনো এক কুন্দ শুভ্র মনোহর শিখরদেশে ধনাধাক্ষ মহাত্মা দেবতা কুবেরের এক সুন্দর নগর ছিল। নগরটির বিস্তার ছিল খুব বেশি। কেবলমাত্র দৈর্ঘ্যেই তা ছিল দেড়শত যোজন। সুবৰ্ণ মণিচিত্রিত বহু বিশালাকৃতি হর্সরাজিতে ভূষিত এই নগরকটি সদা আনন্দময় ও সমৃদ্ধির প্রতীক বলে মনে করা হত। অনাক্রম্য সেই শহরে বিবিধ কনকমণ্ডিত বিপুল স্তম্ভতোরণে সমৃদ্ধ “বিপুলা” নামক এক মনোরম সভা ছিল। পুস্পক নামে নানা রত্নভূষিত সকল কামনার পরিপূরকাদি গুণযুক্ত মনোহর এক মহাবিমান সেখানে সর্বদা বিরাজ করত। যধিপতি মহাত্মা কুবেরের বাহনস্বরূপ হেমজাল ভূষিত এই মহাবিমানটি মনের গতির মতো ত্বরিৎ গতিতে নিজের ইচ্ছানুসারে গমনাগমন করতে পারে। ওই সভাতেই দেবপ্রবর মহাত্মা কুবের বহুসংখ্যক অপ্সরা, যক্ষ, গন্ধর্ব, সিদ্ধ ও চারণদের সঙ্গে বসবাস করতেন। কুবের দেবতা ব্যতীত সর্বভূত নমস্কৃত একপিঙ্গল নামে এক যক্ষেন্দ্র সেই সভায় বাস করতেন। যেখানে ধনেশ্বর কুবেরের আবাসস্থল সেই মহাশৈল কৈলাস ছিল আমি, যম প্রমুখ দেবতা এবং অনিন্দ্যসুন্দরী অপ্সরাদের নিবাসস্থল।
বিপুলা এই সভায় আটটি মহানিধি সযত্নে সঞ্চিত ছিল। এগুলি ধনেশ্বর কুবেরের ধন সম্পদ। এগুলি হল পদ্ম, মহাপদ্ম, মকর, কচ্ছপ, মুকুন্দ, শঙ্গ, নীল ও নন্দন।
কৈলাস শিখরদেশে যক্ষেন্দ্র কুবের ও তার সেবকবৃন্দের জন্য স্থান নির্দিষ্ট করা আছে। এর পূর্বদিকে যক্ষেশ্বর কুবের দেবতার আলয় আর পশ্চিমদিকে তার পরিচারকদের আবাসস্থান।
সুরম্য বিপুলোদকা সুবর্ণমণি সোপানা নানাপুষ্প রেণু সুরভিত মন্দাকিনী নদী এই কৈলাস পর্বতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। নীলাভ বৈদূৰ্য্যমণির মতো দ্যুতিমান পত্ৰশোভিত গন্ধময় বিশাল বিশাল উৎপল এবং পদ্ম ও কুমুদ খণ্ডে অলংকৃতা এই মন্দাকিনী নদীতে যক্ষরমণী, গন্ধবনারী ও অপ্সরাদের জলকেলি এক বিশেষ শোভা সৃষ্টি করত। এই নদীতে যেসব পদ্ম প্রস্ফুটিত হত, সেগুলি জাম্ব নদের পদ্মের মতো প্রস্ফুটিত হল। সেগুলি জাম্বনদের পদ্মের মতো গন্ধ-স্পর্শ-সুখ সমৃদ্ধ হত। মন্দাকিনী ছাড়াও কৈলাস শৃঙ্গে যে জলাশয় ছিল দেব-দানব-গন্ধর্ব-যক্ষ রাক্ষস কিন্নরেরা সেই জলাশয় আর মন্দাকিনীর জল মহানন্দে স্পর্শ করতেন এখানে অলকানন্দা ও নন্দা নামে আরও দুটি নদী প্রবলবেগে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। দুটি নদীই দেবর্ষি সেবিত মন্দাকিনীর স্রোতধারায় যে যে গুণ আছে সেইসব গুণ এই নদী দুটিতেও ছিল।
শৈলবর কৈলাসের পূর্বশৃঙ্গে দশটি নির্মল আনন্দমগ্ন নগর ছিল। এর আয়তন দৈর্ঘ্যে সহস্র যোজন এবং প্রস্থে ত্রিশ যোজন পর্যন্ত। অত্যন্ত সমৃদ্ধিসম্পন্ন এই নগরগুলিতে বিশাল বিশাল বহু শ্রেণীবদ্ধ প্রসাদ দূর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করত। সুবাহু, হরিকেশ, চিত্রসেন, জর প্রথম দশজন গন্ধর্বরাজা ওই নগরগুলি শাসন করতেন। তারা সকলেই ছিলেন দীপ্তবহ্নির মতো পরাক্রমশালী।
কৈলাসশৃঙ্গের পশ্চিমশৃঙ্গে আশি যোজন দীর্ঘ ও চল্লিশ যোজন বিস্তৃত বিশাল ভবনমালায় সজ্জিত আনন্দ ও সমৃদ্ধি সম্পন্ন আরও ত্রিশটি নগর ছিল। কৈলাসের এই পশ্চিম শৃঙ্গটি ছিল কুকুসুম ও চন্দ্রের ন্যায় শুভ্রবর্ণ সিদ্ধ দেবর্ষি দ্বারা সেবিত ও নানা বর্ণের ধাতুতে চিত্রকবিচিত্ত। বায়ু ও অগ্নির মতো তেজস্বী, মহামানী, সুনেত্র, মুনিবর প্রভৃতি ত্রিশজন ছিলেন ওই ত্রিশটি নগরের রাজা শ্রীমান প্রভুস্বরূপ বৈশ্ববৰ্ণদেব ছিলেন এঁদের সকলের অধিপতি।
এই কৈলাস পর্বতের দক্ষিণ দিকেই রয়েছে সুমহান হিমালয় পর্বতমালা। এতে বহুবিধ নিকুঞ্জ, নিঝর, উপত্যকা ও গুহা-গহুর আছে। এর আয়তন পূর্বসাগর থেকে পশ্চিমসাগর পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। হিমালয় পর্বত অসংখ্য শৃঙ্গময় এর কোথাও কোথাও হৃষ্টপুষ্ট নরনারীপূর্ণ কিন্নরনগর আছে এরকম প্রায় একশত কিন্নর নগরের সন্ধান পাওয়া গেছে। তেজস্বী, সুগ্রীব, ভগদ ও দ্রুম প্রমুখ একশত ব্যক্তি হলেন দৃপ্ত ও বলশালী ওই সব কিন্নরদের রাজা।
সর্বলোক প্রসিদ্ধ যে উমাবন তাও হিমালয়েই অবস্থিত। এই বনেই মহাদেবী উমার সাথে রুদ্রের বিবাহ হয়েছিল। এখানেই বারাঙ্গনা গৌরী দেবদেব রুদ্রকে পতিরূপে পাবার জন্য ঘোর তপস্যা শুরু করেছিলেন। এখানেই রুদ্রদেব কিরাতরূপ ধারণ করে গৌরীর সাথে ক্রীড়া করেছিলেন, এখান থেকে হরগৌরী প্রসিদ্ধ জম্বুদ্বীপ দর্শন করেছিলেন। এখানেই রুদ্রদেবের বিচিত্র ভূতপ্রেত পরিবেষ্টিত রং বেরং-এর আনন্দিত ক্রীড়াভূমি। এই উমাবনেই বহু গিরিগুহাবাসিনী কৃশোদরী সুলোচনা মনোরমা সুন্দরী কিন্নরনারী বিশাললোচনা যক্ষবধূগণ বারাঙ্গনা অপ্সরারা এবং গন্ধর্বাঙ্গ-নারীবৃন্দ সানন্দে সারাক্ষণ রমন করতেন। এই স্থানেই ভগবান শিবশংকর অর্ধনারীদেহ ধারণ করেছিলেন। সর্বোপরি ষড়ানন কার্তিকেয় যে শরবনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেটিও এই উমাবনের মধ্যেই অবস্থিত।
হে দ্বিজগণ, এখানে কার্তিকেয় সম্বন্ধে কটি কথা আপনাদের জানিয়ে রাখব। ক্রেঞ্চৈ ঘাতী কার্তিকেয়র প্রিয় ক্রীড়াভূমি হল পাণ্ডশিলা। এই ভূমিটি নানাভুতগণে সমাকুল হিমালয়ের মঙ্গলময় পূর্বদেশেই অবস্থিত। শুধু হিমালয় পর্বতমালার পূর্বদেশেই শ্রীমান কার্তিকেয়র বিচরণ সীমাবদ্ধ নয়। এই হিমালয়ের পৃষ্ঠদেশেই এমন একটি স্থান আছে যেখানে কার্তিকেয় ক্রৌঞ্চবিদারণে উৎসাহিত হন। যেখানে তার বহুবিধ ধ্বজপতাকা ও কিঙ্কিনীমণ্ডিত সিংহরথ অবস্থিত থাকে। এছাড়া এই হিমালয়ের পৃষ্ঠদেশেই বিচিত্র পুষ্পময় নিকুঞ্জশোভিত ক্রৌঞ্চগিরির তটে দেবারিপীড়ক স্কন্দদেব শক্তি অস্তর বিমোচন করেন। এই সুখ্যাত ক্রৌঞ্চগিরিতটে দ্বাদশ সূর্যের প্রতাপশালী দৈত্যরিগুহ অর্থাৎ বুদ্ধিমান কার্তিকেয়কে ইন্দ্র উপেন্দ্র সহ অন্যান্য সুরশ্রেষ্ঠগণ পরমাদরে দেব সৈনাপত্যে অভিষিক্ত করেছিলেন।
হিমালয় পর্বতের সুরম্য পূর্বশৃঙ্গে সিদ্ধ আনন্দময় আবাসভূমি আছে। ইহা পণ্ডিতগণের কাছে। ‘কলাপগ্রাম’ নামে খ্যাত। শুধু সিদ্ধগণ নন, এই হিমালয় শৈলশিখরে শত-সহস্র উগ্রতপা শুদ্ধাত্মা ঋষিবরের আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশিষ্ট বিশ্বমিত্র, মৃকণ্ড, উদ্দালক, নল, ভরত প্রমুখ সকলেরই এই স্থানে এক একটি পবিত্র ধার্মিক আশ্রয় গড়ে উঠেছে। এই হিমালয় শৈলে এমন বহু আশ্রয় আছে যেখানে বিশিষ্ট সিদ্ধ, যক্ষ, গন্ধর্ব ও নানা স্লেচ্ছ জাতি বসবাস করে থাকেন। এই হিমালয় পর্বতমালারই অগনন গিরিশৃঙ্গ এমন বহুপ্রকার রত্নের আকর আছে, এমন বহু উৎসমুখ আছে যেখান থেকে কত যে পুণ্যসলিলা নদী নির্গত হয়েছে, তা সংখ্যায় নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
.
৩৯.
মহর্ষি সূত বললেন, হে ভূর্লোকশ্রেষ্ঠ দ্বিজবৃন্দ, আমি এক্ষণে পশ্চিমের নিষদ শৈলশিখরের যথাযথ এবং নিঃশেষ বিবরণ দিচ্ছি, আপনারা বিশেষভাবে শ্রবণ করুন।
নিষধ গিরির মধ্যম শৃঙ্গটি স্বর্ণ ও ধাতু ভূষিত। এখানে বিষ্ণুর একটি দীপ্ত আশ্ৰম আছে। আশ্রমটি সিদ্ধ ও ঋষিগণের দ্বারা নিত্য সেবিত হয়ে থাকে। যক্ষ, গন্ধর্ব ও অপ্সরারা পরমানন্দে এইসব আশ্রমে বাস করেন। সেই আশ্রমে প্রতিষ্ঠিত পীতাম্বরধারী বরদ সনাতন লোকবিধাতা দেবশ্রেষ্ঠ হরি সিদ্ধ সম্প্রদায়ের দ্বারা ভক্তিভরে পূজিত হন। এই মধ্যম শৃঙ্গেই উল্লঙঘন পরিধিবিশিষ্ট অতি-বিস্তীর্ণ এক বিশাল পুরী আছে। এই পুরীতে বহু হ্যরাজি, তপ্তকাঞ্চন তোরণ, অসংখ্য চূড়াময় প্রাসাদ শত-শত রাজপথ শেষ না হওয়া উদ্যানমালা আছে। পুরীটি সর্পতুল্য শত্রুপক্ষের কাছেও যেন অত্যন্ত দুঃসহ।
নিষধশৈলের দক্ষিণ শৃঙ্গদেশে বহু বহু দৈত্যপরিপূর্ণ এক দুর্গম নগর আছে। গুহার মধ্য দিয়ে এই নগরে প্রবেশ করতে হয়।
নিষধশৈলের পশ্চিম শৃঙ্গদেশে পরিপাত্র নামে দেব, দানব ও নাগদের সমৃদ্ধিসম্পন্ন বহু শিলাময় পুরী আছে, এখানেই সোমশিলা নামক একটি পুরীতে ভগবান সোমদেব প্রত্যেক পর্বে পর্বে অবতরণ করে থাকেন। এই স্থানে বসেই ঋষি, গন্ধর্ব এবং কিন্নরগণ তমোনাশক অনিন্দিত সাক্ষাৎ দেবতা স্বরূপ তারাপতি চন্দ্রদেবের উপাসনা করে থাকেন।
এরই উত্তরদিকের শৃঙ্গদেশে “ব্রহ্মপার্শ্ব” নামে এক পবিত্র স্থান আছে। সুরেশ্বর ব্রহ্মা এখানে বিরাজ করেন। এই স্থান স্বর্গের দেবতাদের মধ্যেও প্রসিদ্ধ। সিদ্ধ, দানব, যক্ষ, গন্ধর্ব–এঁরা সকলেই যজ্ঞ-পূজা-নমস্কারে সেই স্বায়ম্ভব মহাত্মার আন্তরিক উপাসনা করে থাকেন। এই শৃঙ্গেই বিরাজ করছে সর্বলোক প্রসিদ্ধ বহ্নিদেবতার মন্দির। সেখানে চারণেরা সিদ্ধ সম্প্রদায়ের ভক্তরা বিগ্রহবাণ। বহ্নিদেবতার সেবা করে থাকেন।
এরও উত্তরে আছে “ত্রিশৃঙ্গ” নামে এক পর্বত। এই মনোহর পর্বতে নানা ভূতগণেরালয় ত্রিলোক প্রসিদ্ধ “হেমচিত্র” নামে এক পুরী আছে। এই পুরী নানা সিদ্ধচারণ ও ঋষি দ্বারা সেবিত হয়ে থাকে। হে দ্বিজোত্তমগণ, এই “হেমচিত্র” পুরীতে তিনজন প্রধান প্রধান দেবতার মন্দির আছে। যেমন–পূর্বদিকে ভগবান নারায়ণ শংকরের মন্দির বিরাজমান। দৈত্য, দানব, রাক্ষস, পন্নগ, গন্ধর্ব, যক্ষ সকলেই ত্রিশৃঙ্গস্থিত মহাবল দেবদেব এই তিনজন দেবতার উদ্দেশ্যে নিত্যদিন যজ্ঞ ও পূজা, আরাধনা করে থাকেন। এই পর্বতরাজ ত্রিশৃঙ্গের কোনো কোনো গুপ্ত স্থানে গন্ধর্ভ, যক্ষ ও নাগেদের অনেক রমণীয় পুরী আছে।
ত্রিশৃঙ্গ পর্বতের উত্তরদিকে জারুথ নামে একটি দেবসেবিত পর্বত আছে। পর্বতটি অসংখ্য শৃঙ্গ বিশিষ্ট। সিদ্ধ ও সাধুগণ দ্বারা সেবিত এই মহাবল পর্বতে সহস্র সহস্র যক্ষ, নাগ গন্ধর্ব, রাক্ষস, কিন্নর ও দৈত্যরা বাস করে থাকেন। রত্নধাতুভূষিত সিদ্ধ দেবর্ষি সেবিত এই পর্বতটির রমণীয় মধ্যম শৃঙ্গে আনন্দৰ্জল নামে এক সরোবর আছে। প্রস্ফুটিত সুগন্ধিত পদ্ম ও কুমুদবন এর শোভাবর্ধন করে চলেছে। এছাড়া বহু জলজ প্রাণী, হংস ও কারণ্ডবাদি পক্ষী ও মওত ভ্রমরের গুঞ্জন ও বিহঙ্গ কূজনে এই সরোবর সদা মুখরিত। সরোবরটির জলরাশি সম্পূর্ণভাবে জলদোষবর্জিত ও পুণ্যবতী। সিদ্ধগণ ভক্তিভরে এর জলে আচমণ করেন। সরোবরটির ঘাটসকল অতিশয় মনোরম। এর মণ্ডলাকার পরিধি ত্রিংশত যোজন বিস্তৃত। মন্দ নামে এক দুর্ধর্ষ নাগপতি আছে।
এই সরোবরে দীর্ঘকাল ধরে বাস করছেন। এই মহাভাগের মস্তক এক শত এবং শরীর বিষ্ণু চক্রে অঙ্কিত।
এই যে আটটি বিচিত্র পর্বতের বিবরণ দিলাম, এগুলি সবই দেবপর্বত বলে জ্ঞেয়।
সমগ্র বসুন্ধরা এই রকম এই রকম বিশাল আয়তনের বহু পুণ্যপ্রদ সরোবর, অসংখ্য সুবর্ণগিরি, রকজতকিরি, হরিতাল পর্বত, হৈঙ্গলক পর্বত, মনঃশিলাদি, বিবিধ ধাতুতে বিচিত্র ভাস্বর ভাস্করপ্রভ, একাধিক মণিপর্বত এবং আরও অনেক বিশালায়তন পর্বতরাজিতে পরিপূর্ণ। এই যেসব সহস্র সহস্র পর্বত নানাবর্ণের পৃষ্ঠদেশ–তাতে যে কত নদী, কত কন্দর, কত শত বিচিত্ররূপা অন্তর সানুদেশ আছে তার ইয়ত্তা নেই। বসুন্ধরার এইসব পুণ্যপ্রদ পর্বতপৃষ্ঠে দৈত্য, দানব, রাক্ষস, কিন্নর, গন্ধর্ব, উরগ, বিচিত্র সিদ্ধ, ও অপ্সরাগণের বাস, যে সকল পর্বত কেসরাকৃতি সেগুলি পুণ্যবান ব্যক্তিতে সমাকুল। মেরুপ্রদেশে যে গিরিজাল, তা সিদ্ধলোক রূপে প্রসিদ্ধ। এই বিচিত্র গিরিজাল পুণ্যাত্মাদের আশ্রয়, যাঁরা কখনও অত্যুগ্রকর্ম করেননি, অর্থাৎ যাঁরা সকাম কর্ম করে থাকেন, তাদের কাছেই এই সিদ্ধলোক স্বর্গরূপে খ্যাত।
প্রাচীন ঋষিরা এই স্বর্ণগর্ভা পৃথিবীকে “চতুর্মহাদ্বীপবর্তী” বলে নির্দেশ দিয়েছেন প্রত্যেক দ্বীপই বিবিধ বর্ণে চিত্রিত। প্রত্যেক দ্বীপই বিবিধ ভক্ষ্য, অন্ন-পানীয়, নানাপ্রকার বস্ত্র ও ভূষণে পরিপূর্ণ। এইসব বিবিধবর্ণ দ্বীপে বিধি বিচিত্র অদ্ভুত অদ্ভুত পরানীরা বাস করেন। এই মহান চারটি দ্বীপের নামে ভদ্রাশ্ব, ভরত, কেতুমাল ও উত্তর কুরু। এর মধ্যে কেতুমাল দ্বীপ পশ্চিমদিকে এবং পুণ্যাশ্রয় ব্যক্তিদের বাসভূমি কুরুদ্বীপ উত্তরদিকে অবস্থিত।
চতুমহাদ্বীপবিশিষ্ট পদ্মাকার এই পৃথিবীতলে আরও বহু দ্বীপ আছে। হে দ্বিজবৃন্দ, সেই সকল দ্বীপসমুদয়ের কথা আমি আগেই বলেছি। মনে রাখবেন, সেইসব দ্বীপগুলি কিন্তু এই চারটি মহাদ্বীপেরই অন্তর্গত। শৈলশিখর বনাঞ্চল ও কাননে-কাননে শোভিত বহুদূর বিস্তৃত এই সমগ্র পৃথিবীলোক “পদ্ম” নামে পণ্ডিত সমাজে অভিহিত হয়ে থাকে। এই পৃথিবীতলেই সর্বপ্রাণীর ব্যবহার্য ব্রহ্মলোক, দেবাসুর লোক ও মনুষ্য লোক নামে তিনটি লোক প্রতিষ্ঠিত আছে। লোকপদ্মের যে স্থান শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ, বর্ণ ও রসে পরিপূর্ণ যে স্থান চন্দ্র-সূর্যের কিরণছটায় পরিব্যাপ্ত সেই স্থানকে “জগৎ” নামে অভিহিত করা হয়। ‘শ্রুতি’ তে এই লোকপদ্মই ‘পদ্ম’ নামে চিহ্নিত বা নির্দেশিত হয়েছে। হে ঋষিগণ সকল পুরাণেই এই ক্রম অত্যন্ত সুপরিচিত বলে জানবেন।
.
৪০.
সূত বলে চললেন, যে সমস্ত পুণ্যদা দেবনদী ও অন্যান্য মহাবেগা নদী পূর্বে উল্লিখিত ওই সকল সরোবর থেকে বিনির্গত হয়েছে। এবার ক্রমানুসারে তাদের বিবরণ প্রদান করছি, আপনারা মনোনিবেশ সহকারে শুনুন।
আমরা আকাশতলে যাকে জলবিধি রূপে দেখি তার নাম হল সোম। এই সোম হল দেবতাদের অমৃতের আকর, সকল প্রাণীর আধার। পুণ্যপ্রদ সরোবর থেকে বিনির্গত হয়ে পুণ্যসলিলা বিমলোদক নদীটি বায়ুর সপ্তম পথে বিচরণপূর্বক জ্যোতির্গণ নিষেধিত হয়ে এবং স্বয়ং জ্যোতিষ্ক পদার্থ দ্বারা সেবা করতে করতে আকাশপথে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এই ভাবে চলতে চলতে কোটি-সহস্র বছর অতিক্রান্ত হল। তার মধ্যে আকাশপথেই মাহেন্দ্র, গজেন্দ্র, ঐরাবতের সাথে ক্রীড়াস্থলে তার বিপুল জল হল বিক্ষিপ্ত। তারপর সেই নদীবিদ্যমান জল ও তৈজস বায়ুর সাহায্যে মেরুপর্বতের উত্তরাংশের শৃঙ্গে পতিত হল। সেই মেরুকূটের তট প্রান্ত থেকে এই নদীর জল দিকে দিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে প্রথমে চারিভাগে বিক্ষিপ্ত হল এবং তারপর ষাট হাজার যোজন বিলম্ব হয়ে চলতে চলতে একসময় মেরুর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আকাশপথে প্রবাহিত হওয়ার সময় বিমানযোগে গমনশীল সিদ্ধদের স্পর্শে নদীটির জল প্রথম থেকেই অতিশয় পুণ্যপ্রদ তথা মঙ্গলপ্রদ হয়েছিল। মেরুপ্রদেশের পৃষ্ঠতলে নিপতিত হওয়ার পর সেই সিদ্ধস্পর্শিত পুণ্যসলিলা মহানদী মন্দরের পূর্বদিক দিয়ে এসে পড়েছে। মন্দরপর্বতের স্থানে স্থানে বহু পর্বত নিঝর ও মনোহর কন্দর আছে। মন্দর পর্বতের পার্শ্বভাগ সুবর্ণ চিত্রিত। তার ওপর পর্বতটি দেব ও সিদ্ধগণের প্রিয় আলয়। নদীটি রোগপ্রশমক অসংখ্য স্ফটিকজল। প্রবাহে সেই মন্দর পর্বতের পূর্ব ভাগ প্লাবিত করে প্রবাহিত হচ্ছে। এই একই গতিপথে অম্বর নামক নদীটি প্রদক্ষিণ অন্তে রম্য চৈত্ররথ উদ্যান প্লাবিত করে অরুণোদ সরোবরে প্রবেশ করেছে। তারপর সেই শীণগামিনী নদী অরুণোদ সরোবর থেকে নির্গত হয়ে রমণীয় নিঝরময় সিদ্ধনিবাস শীতান্ত শৈলশিখরে এসে পড়েছে। শীতাম্ভ শৈলের নিকুঞ্জ গুঞ্জে ওই নদীর বেগ তীব্রভাবে নিরুদ্ধ হলে তা বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যে স্থানে ওই মহাপুণ্যা নদী শ্রেষ্ঠা বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়েছে, সেই স্থানে তা “সীতা” নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে। শীতাম্ভ শিখর হতে এই তীব্র বেগবতী নদী প্রথমে পর্বতশ্রেষ্ঠ সুকুঞ্জে এসে পড়ল। সেখান থেকে সুসমঞ্জস পর্বতে, তারপর মাল্যবান পর্বতের উচ্চশিখরে পতিত হল কিন্তু ওই নদীশ্রেষ্ঠার দুঃসাহসী বেগ মাল্যবান পর্বতও ধারণ করতে না পারায় সেখান থেকে ভ্রষ্ট মণিপর্বতে, মণিপর্বত থেকে অসংখ্য কন্দরময় মহাশৈল বক্ষে এসে পড়েছে।
এইভাবে সব স্থান প্লাবিত করতে করতে, বহু শৈল-শিখরকে বিদীর্ণ করতে করতে সেই মহানদী সিদ্ধসেবিত মহাশৈল জঠর পর্বতে উপনীত হল। তারপর সেই মহাশৈলের কুক্ষি থেকে নির্গত হয়ে বিশাল বিশাল জলকণায় সহস্র বনস্থলী, শত শত শৈলরাজ, বিচিত্র বিবিধ সরোবর প্লাবিত করে সেই বিমল সলিলা মহাভাগা মহানদী ক্রমে ক্রমে সমুদ্ৰান্তা পৃথিবীতে এসে মিলিত হল। এই মহাভাগ নদী শ্রেষ্ঠকে সহস্র সহস্র নদী অনুসরণ করে চলল।
এবার সেই মহানদী ভদ্রাশ্ব নামে মহাদ্বীপকে এবং অন্যান্য পর্বতকেও প্লাবিত করে পুবদ্বীপবর্তী সমুদ্রে প্রবেশ করল। বিভিধ বিচিত্র বেগে ও কলকল ধ্বনিতে নদীটির জল বিস্ফারিত হতে লাগল। ক্রমে নদীটি দক্ষিণদিকে বাঁক নিয়ে গন্ধমাদন পর্বতশৃঙ্গে এসে পতিত হল এবং অচিরেই গুহাময় আনন্দজনক গন্ধমাদন বন প্রদক্ষিণ ও প্লাবন সম্পূর্ণ করল।
এরপর এই নদীশ্রেষ্ঠ সর্বলোক প্রসিদ্ধ অলকানন্দা নাম গ্রহণ করে উত্তরদিকের দেবসেবিত মানস সরোবরে প্রবিষ্ট হল। তারপর সরোবর থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে কলিঙ্গ শিখরে, কলিঙ্গ শিখর থেকে রুচক পর্বতে, রুচক পর্বত থেকে নিষধে, নিষধ থেকে তাম্ৰাভশৈলে এবং সেখান থেকে শ্বেতোদর পর্বতে এসে সাময়িকভাবে স্তব্ধ হল। তারপর আবার সেখান থেকে সমূল ও বসুধার শৈলখণ্ডে, বসুধার থেকে হেমকূটে, হেমকূট থেকে দেবশৃঙ্গে, সেখান থেকে মহাশৈলে এবং মহাশৈল থেকে পিশাচক শৈল, পিশাচক থেকে পঞ্চকূট শৈল এবং পঞ্চকূট থেকে দেবগণের আবাসভূমি শিলাময় কৈলাস শিখরে এসে পতিত হল। কৈলাস পর্বতের চমৎকারিত্ব এর বহু বিচিত্র কন্দর-এ সানুম্য কৈলাস উদর পরিভ্রমণ করে শৈলরাজ দেবগিরি হিমালয়ের শিখরগুলিতে এসে পড়েছে। এইভাবে এই ত্বরিতগতি মহাভাগা মহানদী সহস্র সহস্র শৈলশিখর থেকে ভ্রষ্ট হয়ে শত-সহস্র বনস্থলী ও কন্দর বিদারিত ও প্লাবিত করে দক্ষিণদিকে এগিয়ে চলল। হে দ্বিজ শ্রেষ্ঠগণ, বহু যোজন বিস্তীর্ণ শৈলোদরে আশ্রিত এই পুণ্যসলিলা বেগবতী নদীকে মহাত্মা দেবাদেব শংকর মস্তকে ধারণ করেছিলেন। সর্বলোক প্রসিদ্ধ এই নদী শ্রেষ্ঠা খোরক পাপ রাশিকেও পবিত্র করে। ধীমান শংকর মহাদেবের অঙ্গ স্পর্শ করায় এর জল অতি পবিত্র হয়ে উঠেছে।
একটি পর্বতশীর্ষ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে অপর শৈলশিখরে পতিত হতে হতে বিভিন্ন গুহা কন্দর সানু মরু প্লাবিত করতে করতে এইভাবে এই পুণ্যপ্রদ নদী পর্বতগুলির বিভিন্ন স্থানকে চারিদিক থেকে বেষ্টন ও প্লাবিত করে বহু মুখে প্রবাহিত হয়েছে এবং সহস্র সহস্র ভিন্ন ভিন্ন নামে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। পূর্বোল্লিখিত হিমালয় শীর্ষ থেকে নিপতিতা সিদ্ধসেবিতা এ মহানদী প্রথমেই “গঙ্গা” নামে প্রকাশিত হল। রুদ্রসাধ্য-অনিল-অদিত্য সেবিত যশস্বিনী গঙ্গা নামী এই মহানদী যেসব দেশে বিরাজমান, সেইসব দেশ এর পুণ্য স্পর্শে ধন্য।
মেরুর পশ্চিমে অবস্থিত মহাপাদ নামক বিপুল শৈলরাজের কথা এবার বলছি, শ্রবণ করুন। এই পুণ্যপ্রদ শৈলরাজ নানাবিধ রত্নের আকর ইহা পুণ্যবানদের দ্বারা সেবিত। এর উদর ও কন্দর মহাভাগা নদীর সলিলে প্লাবিত। আবার এই শৈলরাজের যে উদর দেশ, তা বিমল কটক কুঞ্জেও সুশোভিত। এই স্থানে ওই বিমলোদক নদীটির জলরাশি মহাদেব ইন্দ্রাদি দেবতা স্পর্শ করে থাকেন। বায়ুবেগাহত এই নদী সে স্থানে লতার মতো কম্পিত হয়। মেরুপর্বতের কূটতট থেকে মহাভাগা এই, নদীটি যখন নীচের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে তখন এর জলরাশি ক্রমশ বিস্তারিত হতে থাকে। আর নদীটিকে ঠিক একটি নির্মল বসনের মতো দেখায়।
মেরুকুটের অম্বর নদী সিদ্ধ ও চারণের দ্বারা পূজিত হয়ে দেবভ্রাজ, মহাভ্রাজ ও বৈভ্রাজ বনকে প্রদক্ষিণ করে প্লাবিত হতে থাকে। তারপর সেই মহাভাগা নদী নানা পুষ্পফলেশোভিত ও নানা বনাঞ্চলে বিভূষিত হয়ে নানা দিক প্রদক্ষিণ করতে করতে “সিতোদ” নামে নির্মল এক পশ্চিম সরোবর এসে প্রবিষ্ট হল। অতঃপর এই সরোবর থেকেও নিষ্ক্রান্ত হয়ে সেই নদী সুপক্ষ শৈলে অবতরণ করল। এখানেও নদীর গতি রুদ্ধ হল না। তাই দেবর্ষি সেবিত সুপক্ষ পর্বত থেকেও নদীটি নিষ্ক্রান্ত হল। তারপর সেখান থেকে রমণীয় শিখিশৈলে, শিখিশৈল থেকে কঙ্কশৈলে, কঙ্কশৈল থেকে বৈদূৰ্য্যশৈলে, বৈদুৰ্য্য থেকে কপিল এবং কপিল থেকে গন্ধমাদন শৈলশিখরে পতিত হল। এরপরও গন্ধমাদন অতিক্রম করে নদীটি পতিত হল পিঞ্জর শৈলে, পিঞ্জর থেকে সুরস শৈলে, সুরস থেকে কুমুদাচলে, কুমুদাচল থেকে মধুমান শৈলে এবং মধুমান থেকে অঞ্চাজন শৈলে। আবার সেখান থেকে মুকুট শৈলে, মুকুট থেকে কৃষ্ণ শৈলে, কৃষ্ণ থেকে মহানাগসেবিত শ্বেতশৈলে এবং শেতশৈল থেকে সহস্রশিখর শৈলে গিয়ে পড়ল। অবশেষে বহু নরনারী সেবিতা মঙ্গলদায়িনী দ্রুতবেগা মহানদী অসংখ্য নিটর, নদী, গুহা ও সামুতে বিভূষিতা হয়ে সহস্র শৈলশিখর বিদীর্ণ কয়েক পরিজাত মহাশৈলে এসে আপতিত হল। কিন্তু পারিজাত মহাশৈলের অসংখ্য কুক্ষিতে তরঙ্গিত নীর জল বারেবারে বিভ্রান্ত হতে লাগল। তার ফলে নদীটির বেগ বারবার গণ্ডশৈলে ব্যাহত হতে লাগল, তার বিপুল জলরাশি মথিত হতে লাগল। এইভাবে বারে বারে স্রোত পরিবর্তন করতে করতে ধরণীতলের নানা স্লেচ্ছ পরিপূর্ণ কেতুমাল মহাদ্বীপে উপনীত হল।
এইভাবে বিচিত্র প্রবাহপথে প্রবাহিত হয়ে সেই মহাভাগা মহানদী উত্তরাংশের মেরুর বিচিত্র মহাপাদ এসে পড়ে। এই মহাপাদের পার্শ্ববাহ সুবর্ণখোচিত হওয়ায় এর নাম রাখা হয়েছে সুপার্শ্ব। এই সুপার্শ্বে বিরাট বিরাট প্রাণীরা বাস করে।
এদিকে মেরুকূটতট ভ্রষ্টা সেই পুণ্যপ্রদ নদীর জল যতই বায়ুতাড়িত হতে লাগল ততই আকাশপথে নদীটি ক্ষিপ্ত হতে লাগল। ষাট হাজার যোজন নিরালম্ব শূন্য পথ অতিক্রম করে সেই নদীটি বিকীর্ণ মালার মতো ভূপতিত হল।
এইভাবে মেরুকূট তট ভ্ৰষ্টা অসংখ্য দেবর্ষিসেবিতা বিকীর্যমান জেলা, পুষ্প ও উড়প শোভিতা মহাভাগা মহানদী সুপার্শ্বের শৃঙ্গ থেকে বিনির্গত হয়ে নানরত্নভূষিত সবিতবন নামে এক মহাবন প্রদক্ষিণ ও প্লাবিত করে মহানাগসেবিত ‘মহাভদ্র’ নামে মহাপুণ্যবতী মঙ্গলময় নির্মলোদক সরোবরে প্রবেশ করল। অতীব দ্রুতগামিনী এই নদী সেই স্থান থেকে নির্গত হবার পর ‘ভদ্রসোমা নামে অতিবেগবতী ও মহাপারা হয়ে অনেক নিঝর ও পর্বতপ্রাচীরে সমৃদ্ধ শঙ্কুট শৈল প্রান্তে উপনীত হয়ে সেখান থেকে গিরিবর চিত্রকূটে পদার্পণ করল। ক্রমে চিত্রকূটের তলদেশ থেকে বৃষ পর্বতে, বৃষ পর্বত থেকে বৎস পর্বতে, বস্ পর্বত থেকে, নাগশৈলে, নাগশৈল থেকে নীলনামধেয় বর্ষ পর্বতে, সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে কপিঞ্জও শৈলে, ইন্দ্ৰশৈলে, সুনগে এসে পড়ল। আবার সেই সুনগ পর্বতের চূড়া থেকে নদীটি এল শতশৃঙ্গ শৈলে, শতশৃঙ্গ গিরিচূড়া থেকে পুষ্পমণ্ডিত মহাশৈল পুষ্করে, পুষ্করে শৈল থেকে বিরাজ শৈলে, বিজার শৈল থেকে বরাহ শৈলশিখরে। এই এক শিখর থেকে অন্য শিখরে আসার প্রতিটি ক্ষেত্রে নদীটির বেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। বরাহ থেকে ময়ূর, ময়ূর থেকে একশিখর এবং একশিখর থেকে জারুমি পর্বতে পতিত হওয়ার সময় সেই মহাভাগা নদীটি দ্রুততম বেগে উপনীত হল।
এইভাবে সহস্র সহস্র পর্বত বিদীর্ণ করে সেই মহানদী যখন বহু শৃঙ্গবিশিষ্ট ত্রিশৃঙ্গ নামে মর্যাদা শৈলশৃঙ্গে এল তখন তার বিস্তৃতি অনেক বেড়ে গেল। এবার সে ওই ত্রিশৃঙ্গ শৈল তটকে পরিত্যাগ করে মেরুশৃঙ্গ তটে এল। আবার মেরুশৃঙ্গ থেকে বিচ্যুতা অবস্থায় বায়ুচালিত হয়ে অমল সলিলা সেই নদী এসে পড়ল বীরুধ পর্বতে। এবং বীরুধ পর্বত প্লাবিত করা শেষ হলে সে পশ্চিম সমুদ্রে এসে মিলিত হল। নদীটি এইভাবে মহাপ্রাণীপরিপূর্ণ সুপার্শ্ব নামক মেরুর উত্তরপাদে এসে পড়ল এবং সেখানকার গুহা থেকে বিনির্গত হয়ে তরঙ্গিণী পৃথিবীতে এসে পড়ল। এরপরে বিচিত্র পুষ্পরাজি ও উড়পশোভিতা আনন্দিতা মঙ্গলময়ী সেই নদী উত্তরদিকের কুরুদ্বীপ প্লাবিত করে এবং সেই মহাদ্বীপের মধ্যভাগ দিয়ে উত্তর সাগরে গিয়ে পড়ল।
এইভাবে মহাগিরিতট থেকে বিচ্যুত হয়ে স্বচ্ছ সলিলা ওই চারটি মহানদী চারটি ভিন্ন ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়ে চলল।
এতক্ষণে এই যে বহুবিস্তৃত পৃথিবীর কথা বললাম, সেই পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে আছে মেরু নামক মহাশৈল, চারটি মহাদ্বীপ, চুরাশিটি কানন-উদ্যান, চারটি শ্বেত মহাবৃক্ষ, চারটি সরোবর, চারটি নদী, চারটি সর্প, আটটি উত্তর মহাশৈল এবং অন্যান্য শ্রেষ্ঠ পর্বতরাজি।