শিব কর্তৃক বিষ্ণুকে সুদর্শন চক্র দান
প্রজাপতি কশ্যপের প্রথমা পত্নী অদিতির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন দেবতাগণ এবং দ্বিতীয়া পত্নী দিতির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন অসুরগণ। দেবতা অসুরগণ বৈমাত্রেয় ভাই। ফলে তাঁদের মধ্যে কখনও সদ্ভাব ছিল না, বরাবর যুদ্ধ লেগেই থাকত। বর্তমান জগতেও ধার্মিক এবং অধার্মিকের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে আছে।
একবার অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে দেবতারা বাণ, শক্তি, মুষল ও কুন্তাদি অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে এবং দারুণভাবে পরাজিত হয়ে ভয়ে রণস্থল থেকে পালিয়ে বাঁচলেন।
পরাজিত দেবতারা তখন তাঁদের রক্ষাকর্তা হিসাবে শ্রীবিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন।
দেবগণকে বিষণ্ণ দেখে বললেন–হে দেবগণ, এমন দশা তোমাদের করল কে? এমন বিক্রমশূন্য অবস্থা কেন? সত কথা নেই খুলে বল। আমি তোমাদের দুঃখ দূর করার চেষ্টা করব।
এই আশ্বাসবাণী শুনে দেবতারা তাকে প্রণাম জানিয়ে সবকথা খুলে বললেন। হে ভগবান, আপনি আমার আমাদের গতি, এ জগতের কর্তা। আপনি শরণাগতবৎসল। আমরা দানবদের দ্বারা পরাজিত হয়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। দানবদের বিনাশ করে আমাদের আপনি রক্ষা করুন। দৈত্যরা অজেয় হওয়ার বর লাভ করেছে। বৈষ্ণবাস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র, মাম্যাস্ত্র, বারণ, পাৰ্জন্য, ঐশান, প্রভৃতি অস্ত্র ব্যবহার করেও আমরা তাদের মারতে পারলাম না।
হে দেবেশ, আপনার সূর্যমণ্ডলে উৎপন্ন যে চক্র দীচ মুনিকে নিক্ষেপ করেছিলেন, সেটি সেই মুনি কুক্ষিগত করে রেখেছে। দণ্ড, ধনু, প্রভৃতি আপনার অস্ত্রগুলিও দৈত্যগণ লাভ করেছে। তাহলে এখন ঐ দুষ্ট দৈত্যরা বিনষ্ট হবে কিভাবে? দেবাদিবের মহেশ্বর জল-রাসুরকে বিনাশ করবার জন্য সুতীক্ষ্ণ এক সুদর্শন চক্র সৃষ্টি করেন। আপনি যদি সেই চক্রটি লাভ করতে পারেন তবে এর দ্বারা দৈত্যের বিনাশ করতে পারবেন।
ব্রহ্মাদি দেবতাদের এই কথা শুনে শ্রীহরি তখন বললেন– হে দেবগণ, আর কালবিলম্ব না করে এস আমরা মহেশ্বরের কাছে গিয়ে এই অভিলাষ পূর্ণ করব। সেই সুতীক্ষ্ণ সুদর্শন চক্র লাভ করে অসুরগণকে সবান্ধবে নিধন করে তোমাদের পরিত্রান করব।
এই কথা বলে শ্রীহরি বিশ্বকর্মার দ্বারা মেরু পর্বতের তুল্য শিবলিঙ্গ স্থাপন করে ত্বরিতাখ্য রুদ্রমন্ত্রে আর রূদ্রমুক্ত দ্বারা স্নান করিয়ে যথা বিধিমত পূজা করলেন। তারপর শঙ্করের সহস্র নাম পাঠ করে প্রণাম জানালেন।
মহাদেবের সহস্র নাম স্তব করে বিষ্ণু শিবলিঙ্গকে স্নান করালেন। এরপর একশো আটটি পদ্মফুল নিয়ে, একটি একটি করে পদ্ম নিয়ে রুদ্রায় নমঃ বলে শিবলিঙ্গের উপর দিচ্ছেন। তখন মহেশ্বর বিষ্ণুকে পরীক্ষা করার জন্য পদ্মগুলি থেকে একটি ফুল হরণ করে নিলেন।
একটি পদ্মের অভাবে শিবপূজা সম্পূর্ণ না হওয়ার জন্য চিন্তায় পড়লেন শ্রীহরি। শিবই আমাকে ছলনা করেছে এই কথা ভেবে তিনি নিজের একটি নেত্ৰকমল উৎপাদন করে মহেশ্বরের পূজা করলেন।
এই দেখে মহেশ্বর আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি সেখানে আবির্ভূত হলেন। কোটি সূর্য যেন একত্রে মিলেছে, এই রকম শিবের দেহ থেকে জ্যোতি বের হল।
দিব্যাকার ভস্মমাখা মহেশ্বরকে দেখে শ্রীহরি আনন্দে উন্মত্তের মত হয়ে নমস্কার করলেন।
শিবের ঊর্ধ্ব দেহভাগে দ্বীপিচর্ম উত্তরীয় আকারে, দন্তরাশি তীক্ষ্ম–ত্রিলোচনের এই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ইন্দ্রাদি দেবতাগণ সেখানে থেকে পালিয়ে গেলেন। সেই মূর্তির চারিদিকে তেজের দ্বারা সাতযোজন পর্যন্ত দগ্ধ করে ফেলল। তখনও শ্রীহরি জোড়হাতে মহেশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
এই অবস্থা দেখে ঈষৎ হেসে মহাদেব বললেন–হে জনার্দন, দেবকাৰ্য্য সাধন করার জন্য আমি আপনাকে এই সুদর্শন চক্র দান করলাম। আপনি গহণ করুন।
এই কথা বলে মহেশ্বর শত সূর্যতুল্য সুদর্শন চক্র আর তার পদ্মের সদৃশ নয়নও দান করলেন। সেই থেকে নারায়ণ কমলনয়ন নামে অভিহিত হন।