বহু রাজার অহঙ্কারের পরিণতি
অহঙ্কারের মত সর্বনেশে আর কিছু নেই, কথাতেই আছে অতি দর্পে হত লঙ্কা। রাবণ রাজার সবংশ বিনাশ হল অতি অহঙ্কারের ফলে।
বাহু হচ্ছেন সূৰ্য্যবংশের সুবিখ্যাত রাজা। ঐশ্বর্য, বীৰ্য্য, যশ, জ্ঞান–তার কোন কিছুরই অভাব নেই। প্রজারা তার সুশাসনে ছিল। কারো কোনো অভিযোগ ছিল না। সপ্তদীপা পৃথিবীর প্রত্যেকটি দ্বীপেই তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করালেন। রাজাকে সবাই সম্মান করত, কারণ তাঁর রাজ্যে দুর্ভিক্ষ ছিল না, কেউ অনাহারে মারা যায়নি। এমন প্রতাপশালী রাজারও একদিন পতন হল।
রাজা বাহু ঐশ্বৰ্য্য, বীর্য, জ্ঞানের গর্বে অহংকারী হয়ে উঠলেন। তার ফলে তিনি ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ বিচারের জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। রাজা প্রথমে প্রজাদের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই কাজ করতেন, যাতে প্রজাদের কোনোরকম অসুবিধা না হয়, সেটাই তার উদ্দেশ্য ছিল। মুনি-ঋষিদের ধ্যান, জপ, তপস্যার যাতে কোন বাধা-বিঘ্ন না ঘটে তার জন্য তিনি তাদের সাহায্য করতেন।
সেই রাজার এখন বিপরীত ভাব। ভোগ-বিলাসে মেতে উঠলেন। কোন সৎ কাজ করেন না। প্রজাদের সুখ-সুবিধার কথা চিন্তা না করে বেশি করে করের বোঝা চাপালেন। যে কর দিতে পারে না তার সম্পদ কেড়ে নেওয়া হত।
রাজা আগে রাজ্য পরিচালনার জন্য জ্ঞানবৃদ্ধ মন্ত্রীদের পরামর্শ নিতেন, কিন্তু এখন তাদের কথা কানেই তুললেন না। দুষ্ট বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আমোদ-প্রমোদে রাজা সময় কাটাতে লাগলেন। ব্রাহ্মণ, মুনি-ঋষিদেরও তিনি আর আগের মতো সম্মান করেন না। তাদের সুখ-সুবিধার কথাও ভাবেন না।
সবাই বুঝল রাজার পতন আসন্ন। রাজা বাহুকে যদুবংশ ও তালধ্বজ বংশের রাজারা কেউই পছন্দ করতেন না। কিন্তু বাহুবলে এঁটে উঠতে না পেরে এতদিন তার অধীনে সামন্ত রাজা হয়ে কাল কাটিয়েছে। কর দিয়েছে। কিন্তু এখন রাজার বাহুবল বিনষ্ট হয়েছে। যে রাজা নিজে আমোদ-স্ফুর্তিতে কাল কাটায়, তার কথা কে শুনবে?
সামন্ত রাজারা এই সুযোগের অপেক্ষায় এতদিন ছিল। বাহু রাজার প্রতি প্রজারা এখন বিমুখ হয়েছে। বাহু রাজার চতুরঙ্গ-সেনারাও রাজার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট। কাজেই রাজাকে এখন তারা আর কোনোভাবেই সাহায্য করবে না।
হৈহয় ও তালজষ্মের রাজারা এই সুযোগে শক, হুণ, যবনদের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়ে একদিন প্রচুর সেনা নিয়ে বাহু রাজার ওপর আক্রমণ করল।
এতদিন রাজা বাহু তার সৈন্যদলের কোন খোঁজ রাখেন নি। অনেকেই এখন তার বিরুদ্ধে। তবু রাজা বাহু তার সৈন্যদের নিয়ে শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করার জন্য চেষ্টা করলেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই হার হল রাজার। বহু সেনা মারা গেল। আত্মীয়-স্বজন সকলেই নিহত। তখন রাজা গোপনে রাত্রিবেলা রানিকে সঙ্গে নিয়ে প্রাণ বাঁচাবার জন্য বনে চলে গেলেন।
বাহু রাজার কাল শেষ হওয়াতে প্রজারা খুব খুশী। কারোর মনে এতটুকু দুঃখ নেই তার জন্য। যে রাজা কোমল শয্যায় শয়ন করতেন, চব, চোষ্য, ভোজন করতেন, রথ ছাড়া যিনি কোথাও যেতেন না; সেই তিনি ঘাসের ওপর শয়ন করছেন, বনের ফল-মূল খাচ্ছেন, খালি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কাটার আঁচড়ে দেহ ক্ষতবিক্ষত। তিনি তবু চলেছেন রানির হাত ধরে। কিন্তু রানি গর্ভবতী থাকার কারণে চলতে পারছেন না।
একদিন একটি গাছের তলায় বসে রাজা চিন্তা করছেন যে কেন এমন হল। তার তো বাহুবল, অর্থবল জ্ঞানবল কোনোকিছুই অভাব ছিল না। তাহলে আজ তার এ অবস্থা হল কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দেবার কেউ নেই। রানি ছাড়া তার পাশে আর কেউ নেই। জ্ঞানী রাজা নিজের মনেই বিচার করলেনক্ষমতার গর্বে তিনি মোহগ্রস্ত হয়েছেন। এই মোহের কারণে অন্যায়ের পথে চলতে গিয়ে তার আজ এখন সর্বহারা ভিখারীর বেশ। যত কষ্টই হোক তাকে মেনে নিতে হবে।
ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়লেন রাজা রানি। পথ আর চলতে পারছেন না। রাজা ভাবলেন এর থেকে মৃত্যু ভালো। আবার ভাবলেন তা করা মহাপাপ। তার উপর রানি গর্ভবতী, তিনি যদি আত্মহত্যা করেন তাহলে রানির কি হবে? তাহলে তাঁকেও তো অনাগত সন্তানসহ মরতে হবে।
রাজার আর তাই জন্য মরা হল না। কিন্তু রানি আর সহ্য করতে পারছেন না এই কষ্ট। তিনি ঠিক করলেন স্বামীর অসাক্ষাতে বিষফল খেয়ে মরবেন। সন্তান প্রসব হলে তাকে কি খেতে দেবে, তাই মরার কথা চিন্তা করলেন। গোপনে একদিন সেই বিষ ফল খেলেন। কিন্তু তার মৃত্যু হল না। শুধুমাত্র অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। বহু কষ্টে রাজা রানির জ্ঞান ফেরালেন। কষ্টে পথ চলতে চলতে একটি সুন্দর শীতল জলের সরোবর দেখতে পেলেন।
রাজা রানি ঐ সরোবরের জলে স্নান করলেন। ঐ জল পান করলেন। তখন তাদের উভয়েরই ক্লান্তি দূর হল। তারপর সেই সরোবরের তীরে একটি পাতার কুটির তৈরি করে তাতে বসবাস করতে লাগলেন।
এই অবস্থার জন্য রাজা মনে মনে অনুশোচনা করতে করতে একদিন মারা গেলেন। রানি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। অনেক কষ্টে শুকনো ডালপালা সংগ্রহ করে চিতা সাজিয়ে স্বামীর মৃতদেহে আগুন ধরালেন। নিজেকে রানি এবার ঐ চিতার আগুনে আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত হলেন।
হঠাৎ সেখানে ঔর্ব নামের এক ঋষি উপস্থিত হয়ে রানিকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনলেন।
রানি ঋষিকে প্রণাম করে বললেন–আমার স্বামী রাজ্যহারা হয়ে বহু কষ্টে এখানে দিন যাপন করছিলেন। আমি তার অবর্তমানে কি করে থাকব? তাছাড়া সতীর জীবনে এটাই তো পরম মঙ্গলের পথ।
ঋষি বললেন–রাজা বহু পাপ করেছিলেন জীবনে। তাই তার প্রায়শ্চিত্ত করে স্বর্গে গেলেন। অনুশোচনা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ প্রায়শ্চিত্ত। কিন্তু মা, তুমি যদি নিজের আত্মাহুতি দাও, তাহলে তোমার গর্ভে যে সন্তানটি আছে, সেও মরবে। সেই সন্তান তো কোনো অন্যায় করেনি। তাকে মারবে কেন তুমি? এতে তো তোমার মহাপাপ হবে। এমন কোরো না মা, তোমার কোনো ভয় নেই মা, আমার আশ্রমেই তুমি থাকবে।
স্বামীর দাহের কাজ শেষ করে রানি ঔর্ব ঋষির সঙ্গে চলে গেলেন তার আশ্রমে। যথাসময়ে তার এক পুত্রের জন্ম হল। গর (বিষ) ফল খেয়ে যে শিশুর মৃত্যু হল না, সেই শিশুর নাম রাখা হল সগর।
কপিল মুনির অভিশাপে এই সগরের ষাট হাজার পুত্র ভস্মীভূত হলে, ভগীরথ গঙ্গাকে মর্ত্যে এনে তাদেরকে উদ্ধার করেছিলেন।