১. মহামুনি মৃকুণ্ডের তপস্যা

নারদীয় পুরাণ (পৃথ্বীরাজ সেন)
অষ্টাদশ পুরাণ সমগ্র অখণ্ড সংস্করণ
উপদেষ্টা– শ্রী নরেশচন্দ্র শাস্ত্রী
সম্পাদনা • পরিমার্জনা • গ্রন্থনা– পৃথ্বীরাজ সেন

অষ্টাদশ পুরাণের দুটি সাত্ত্বিক পুরাণ এর মধ্যে নারদীয় পুরাণ একটি। নৈমিষারণ্যে কঠোর তপস্যায় রত ছিলেন শৌণকাদি মুণিগণ। তপস্যার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তি। সকল মুনিই ছিলেন জিতেন্দ্রিয়। ঈর্ষা অহঙ্কার এবং কাম-(ক্রোধশূন্য)। সেই মুনিরা ছিলেন প্রায় ছয় হাজার জন। শৌণকাদি মুনিগণ লোমহর্ষণ সূত মুনিকে নারদীয় পুরাণ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি তাদের সবিস্তারে এই পুরাণটি বর্ণনা করেন। এই পুরাণে শ্রীহরির এবং শ্রীহরিনামের মাহাত্ম্য বিশেষভাবে বর্ণিত। একাদশী ব্রতকথা, দেবমালীর উপাখ্যান, যজ্ঞমালী ও সুমালীর উপাখ্যান, নানাবিধ পাপের প্রায়শ্চিত্ত, মোক্ষের উপায় প্রভৃতি বিভিন্ন কাহিনির মাধ্যমে হরিভক্তির কথাই বারবার সূচিত হয়েছে এই মহাপুরাণে।

.

মহামুনি মৃকুণ্ডের তপস্যা

প্রলয়কাল উপস্থিত হলে শ্রীহরি ছাড়া তখন আর কিছুর অস্তিত্ব থাকেনা। শ্রীহরির দয়াতেই সকলের আত্মা লীন হয়ে যায়। এ কথা সবাই জানে। কিন্তু মহামুনি মার্কণ্ডেয়ের ব্যাপার আলাদা। কল্পকালে তার জন্ম হয় না, প্রলয়কালেও তার বিনাশ নেই। এই কথা শুনে শৌনকাদি মুনিগণ বিস্ময় প্রকাশ করলে তার উত্তরে মহর্ষি লোমহর্ষণ বললেন–মৃকণ্ডু নামে একজন মহা তপোধন শালগ্রামক্ষেত্রে গিয়ে অনাহারে ও অনিদ্রায় কঠোর তপস্যা করেন। এক এক করে দশ হাজার বছর কেটে গেল। ক্ষমাশীল, শান্ত, বিনীত, দয়াবান, মহাশূন্য, জিতেন্দ্রিয়, মূকুণ্ডুমুনি এত বছর তপস্যা করেও সিদ্ধিলাভ করতে পারলেন না। ইন্দ্রাদি তাঁর এই কঠোর তপস্যা দেখে ভয়ে ভীত হয়ে শ্রীহরির শরণাপন্ন হলেন। উত্তর ক্ষীরোদ সাগরে দেবতাদের স্তবে জাগ্রত হলেন শ্রীহরি। তিনি বললেন–তোমরা অযথা ভয়ে ভীত হচ্ছ। যে কারণে মৃকুণ্ডু মুনি তপস্যা করছেন, তাতে তোমাদের সুখে কোন বাধার সৃষ্টি হবে না, তোমরা নিশ্চিন্তে থাক। প্রকৃত সজ্জন যাঁরা, তারা কখনই অন্যের সুখের অন্তরায় হন না, তোমরা নির্ভয়ে গমন কর।

এই কথা বলে শ্রীহরি অদৃশ্য হলেন। দেবতারা শ্রীহরিকে প্রণাম জানিয়ে দেবলোকে ফিরে গেলেন।

এদিকে মৃকুণ্ডু মুনির তপস্যায় তুষ্ট হয়ে সেখানে নারায়ণ এলেন। ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু ভগবানকে দেখে আনন্দে মুনিবর প্রণাম জানিয়ে বহু স্তবস্তুতি করলেন।

শ্রীহরি মৃকুণ্ডুর স্তুতিতে খুশি হয়ে তাকে আলিঙ্গন করে জানতে চাইলেন যে ঋষি কি বর প্রার্থনা করছে।

শ্রীহরির চরণতলে পতিত হয়ে ঋষি বললেন–আমি কৃতার্থ হলাম। আমার জীবন সফল হল। স্বল্প পুণ্যে আমি যে তোমার দেখা পেলাম এর থেকে সৌভাগ্যের আর কি আছে। তোমার পাদপদ্মে আমি কোটি কোটি নমস্কার জানাই।

শ্রীহরি ঋষির স্তুতিতে প্রীত হয়ে বললেন–তোমার বাক্যে আমি তুষ্ট। আমার দর্শন কখনো বিফল হবেনা, আমি তোমার পুত্ররূপে জন্ম নেব। দীর্ঘজীবী হবে সে পুত্র।

এই কথা বলে মৃকুণ্ডুর মাথায় হাত দিয়ে শ্রীহরি অদৃশ্য হলেন। বর লাভ করে মৃকুণ্ডু মুনি নিজের গৃহে ফিরলেন। শ্রীহরির আরাধনায় তিনি মগ্ন হলেন। এই ভাবে কিছুদিন কেটে যাবার পর একদিন তার একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করল। তার নাম দিলেন মার্কণ্ডেয়। হরিকে তুষ্ট করতে শান্ত, বিনীত, জ্ঞানী মার্কণ্ডেয় বনে গেলেন তপস্যা করতে। দীর্ঘকাল তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শ্রীহরি তাঁকে চিরজীবী হওয়ার বর দিলেন।

তারপর বিশ্ব যখন জলে মগ্ন হল স্থাবর জঙ্গম বলে কিছুই থাকলনা তখনও সেই জলের ওপর মার্কণ্ডেয় ভাসতে লাগলেন। প্রলয়কালব্যাপী হরি শয়ন করে থাকেন। মার্কণ্ডেয় তেমন থাকেন।

তিনশ পঁয়ষট্টি দিনে যখন মানবের এক বছর হয়, তখন দেবতাদের সেই সময় হয় এক দিনরাত্রি। এই পরিমাণ হাজার বছরে দিনে এক দৈববর্ষ। এইভাবে এক দিব্যযুগ হয় বারো হাজার বছরে। সত্যযুগের বয়স ১৭, ১৮,০০০ বছর, দ্বাপর যুগের বয়স ৮,৬৪,০০০ বছর, ত্রেতাযুগের বয়স ১২, ৯৬,০০০ বছর, এবার কলিযুগের ৪,৩২,০০০ বছর। এই চার যুগ একসাথে এক দিব্যযুগ হয়। এইভাবে এক হাজার দিব্যযুগে ব্রহ্মার একদিন হয়। তাকেই এক কল্প।

সকল জীবের সৃষ্টি হয় বহ্মার দিবসকালে, আবার সমান সময় ব্রহ্মার রাত্রিতে প্রলয় হয়। প্রলয় সবকিছু বিনষ্ট হলেও মার্কণ্ডেয় ঋষি জলের ওপর শয়ন করে থাকেন। আবার প্রলয়কাল শেষে ব্রহ্মা জাগ্রত হয়ে সৃষ্টি কাজে মন দেন, আর মার্কণ্ডেয় ঋষি নিদ্রাত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রীহরির চরণাপন্ন বন্দনা করে স্তুতি করলেন।

মার্কণ্ডেয় মুনির স্তব শুনে শ্রীপরি বললেন–যাঁরা হরিভক্ত হয়, তাদের উপর আমি সদাই সন্তুষ্ট থাকি। সকলের কাছে আমি প্রচ্ছন্ন থাকলেও, আমি কিন্তু ভক্তগণকে সবসময় রক্ষা করি।