রাজা সুমতির উপাখ্যান – বিষ্ণুমন্দির ধ্বজারোপণের ফল
সোমবংশে সুমতি নামে এক ধার্মিক এবং মহা পুণ্যবান রাজা ছিলেন। শ্রীহরির পূজা ও অতিথির সেবা না করে তিনি জল গ্রহণও করতেন না। যেমন রাজা, তেমনি রানি। রাজকার্যে যাবার আগে রাজা নারায়ণ মন্দিরে ধ্বজা পুঁতে চারিদিক প্রদক্ষিণ করে, মন্দিরে প্রবেশ করে বিধিমত পূজা করতেন। তারপর রাজপ্রাসাদে এসে অতিথিদের সেবা করে সাধ্যমতো দান দিয়ে তাদের সম্মানের সঙ্গে বিদায় দিতেন।
সে দেশের প্রজারাও সদ, নির্মল চরিত্রের এবং হরিপরায়ণ। রাজার কথা শুনে বিভাণ্ডক মুনি অবাক হলেন। আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন–একজন রাজা হয়ে এমন বিষ্ণুভক্ত। দেখবার ইচ্ছায় একদিন তিনি সশিষ্য হাজির হলেন রাজা সুমতির কাছে।
রাজা দেখতে পেলেন সশিষ্য বিভাণ্ডক মুনি তাঁর সভায় এসেছেন। রাজা সিংহাসন থেকে উঠে এসে মুনির চরণস্পর্শ করে বললেন–আমার কি সৌভাগ্য। আপনি এসেছেন, আমার জীবন সার্থক হলো।
মুনিকে এবং তাঁর শিষ্যদের রাজা সমাদরে প্রাসাদের ভিতরে নিয়ে এলেন। তাদের আহারের জন্য ফল-মূল দুগ্ধের ব্যবস্থা করলেন। বিশ্রামের জন্য সুসজ্জিত গৃহের ব্যবস্থা করলেন।
মহারাজের আচরণ দেখে শিষ্যসহ মুনি আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন–যিনি রাজা হবেন, তার গর্ব থাকবে। কিন্তু এ যে দেখছি বিপরীত। রাজার বিনয় দেখে তিনি খুশি হলেন।
সেই দিন মুনি রাজবাড়ির অতিথি হয়ে রয়ে গেলেন। পরদিন সকালে তিনি রাজা-রানির শ্রীবিষ্ণুর নিত্য দিনের মত মন্দিরে ধ্বজা পুঁতে পরিক্রমা ও পূজা দেখলেন। দেখে অভিভূত হলেন।
আতিথ্য গ্রহণ করে মুনিবর বিভাণ্ডক রাজসভায় এলেন রাজার সঙ্গে। সেখানে রাজা মুনিকে সোনার সিংহাসনে বসিয়ে নিজে বসলেন তাঁর পায়ের কাছে।
রাজা বললেন–হে মুনিবর, আপনার আগমনে আমার প্রাসাদ আজ পবিত্র হল। আমার জীবন সার্থক হল। বলুন আমি আপনার কি সেবা করতে পারি?
বিভাণ্ডক মুনি বললেন–হে রাজন, আপনার ভক্তির তুলনা হয় না। আমার মনে একটা প্রশ্ন-নারায়ণ মন্দিরে গিয়ে আপনি রানির সঙ্গে মন্দিরে ধ্বজা পেতেন কেন? আর রানি নাচেন কেন?
রাজা বললেন–আমার চোখের সামনে যেন সেই সব ঘটনা ভাসছে।
মুনির সঙ্গে শিষ্যরা এবং সকল সভাসদগণ রাজার কথা অবাক হয়ে শুনতে লাগলেন।
রাজা বলতে লাগলেন–বহুকাল আগের কথা। মালী ছিল মা-বাবার একমাত্র ছেলে। একমাত্র ছেলে হওয়ায় মা-বাবা খুবই স্নেহ করতেন। কিন্তু ছেলে যত বড় হয়, ততই অনাচারী হয়ে ওঠে। বাবা-মার মনে অশান্তি, চোখে তাদের ঘুম নেই।
কুসঙ্গের ফলে মালী নানারকমের নেশা ধরল। চুরি করা, জুয়া খেলা, সব অপকর্মই করতে লাগল। তাকে সদ পথে ফিরিয়ে আনবার জন্য তার মা-বাবা অনেক চেষ্টা করলেন।
কিন্তু মালী তাদের কোনো কথাই কানে তুলল না। উল্টে তাদেরকেই লাঞ্ছনা করল। আজ এর বাড়ি, কাল অন্য কারোর বাড়ি গিয়ে চুরি করতে লাগল। গ্রামের মানুষরা অতিষ্ট হয়ে তার বাবা-মায়ের কাছে এসে সব জানাল। ছেলের জন্য তারা অপমানিত হলেন। ছেলেকে শোধরাবার বহু চেষ্টা করেও কোন ফল হল না।
ছেলেকে তখন তারা ঘর থেকে বের করে দিলেন। মালী তার বন্ধুদের কাছে গেল। কিন্তু বন্ধুরা তাকে পাত্তা দিল না। কেউ যখন আশ্রয় দিল না তখন মালী বনে চলে গেল। ভাবতে লাগল–হায়। এ কি করলাম আমি? মা-বাবার কথা না শুনে ভুল করেছি। এখন ক্ষিদের জ্বালা সহ্য করতে পারছি না। সামনে একটি হরিণ শিশুকে দেখতে পেয়ে তাকে ধরে, তার গায়ের ছাল ছাড়িয়ে কাঁচা মাংস খেল।
তারপর সে চিন্তা করল–ফিরে গিয়ে লজ্জায় আর কারোকে মুখ দেখাতে পারবে না। তার চেয়ে এখানে থাকাই ভালো। শিকার করেই যতদিন বাঁচা যায়।
এই ভাবে সে গভীর বনের মধ্যে এগোতে লাগল–হঠাৎ সেখানে একটি জীর্ণ ধুলা-বালিতে ভরা মন্দির দেখতে পেল।
মালী সেই মন্দির পরিষ্কার করে সেখানেই থেকে গেল। সামান্য কিছু শিকার করে পেট ভরাতে লাগল; কিন্তু নেশা করার জন্য সে বহু গাছের রস খেয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। একটা গাছের সন্ধান পেয়ে গেল। আর কি? সবই হল, আহার জুটল, নেশাও হল, একটা আস্তানাও পেয়ে গেল।
মালী কুড়ি বছর একা একা সেই মহাবনে রয়ে গেল।
প্রতিদিনের মতো মালী মন্দির পরিষ্কার করছে–এমন সময়ে সেখানে একটি মেয়ে এল। পরনে ময়লা কাপড়। সেটির বহু জায়গা ছেঁড়া। শুকনো মুখ। মাথায় এক রাশ রুক্ষ চুল। এমন রোগা যেন গায়ে মাংস নেই। চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে। মালী তাকে দেখেই চমকে উঠল। একি কোন মানবী না পেত্নী।
মালী তাকে জিজ্ঞেস করল–কে তুই? এখানে কোথা থেকে এলি?
ধীরে ধীরে মেয়েটি বলল–আমি ব্যাধের মেয়ে, আমার নাম কোকিলিনী। আমার স্বামী আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তোমাকে এখানে দেখে চলে এলাম।
মালীর ভালোই লাগল মেয়েটির কথা শুনে। এতদিন একা একা ছিল। কথা বলার একটা লোকও তো পাওয়া গেল। মালী তাকে ঘরে বসিয়ে মাংস ও জল খাওয়াল। তারপর বলল, আচ্ছা কোকিলিনী, তোকে তাড়িয়ে দিল কেন?
কোকিলিনী বলল-কি আর বলব সে কথা, সবই আমার ভাগ্যের দোষ। আমি ছোটবেলা থেকেই খুব মুখরা ছিলাম। যাকে যা ইচ্ছা বলতাম। আমার মা-বাবা এক ব্যাধের ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দিল। স্বভাবের দোষ। সেই ব্যাধের সঙ্গে সব সময়েই আমার ঝগড়া লেগে থাকত। একদিন রাগের বশে সেই ব্যাধটাকে আমি খুন করলাম। তাই গ্রামের সবাই আমাকে মারতে মারতে তাড়িয়ে দিল। সেই থেকে বনে বনে ঘুরছি।
মালী মেয়েটির কথা শুনতে শুনতে ভাবল–পূর্বে আমি যেমন ছিলাম, এই মেয়েটিও তাই। আমার বন্ধুবান্ধবেরা আমাকে তাড়িয়েছে, এও সবার দ্বারা বিতাড়িত হয়েছে।
মালী তখন তাকে বলল–এখানে তুই থেকে যা, আর কোথাও যেতে হবে না। এই বলে মালী তাকে বিয়ে করে নিজের কাছে রাখল। প্রথমে মেয়েটি খুব রোগা ছিল। কিন্তু এখন মালীর কাছে থেকে মাংস, রস খেয়ে বেশ ভালো চেহারা হয়েছে।
এইভাবে কিছুদিন কাটল। একদিন দুজনে প্রচুর রস খেয়ে ভীষণভাবে মাতাল হয়ে পড়ল। এমন সময় মালী নিজের পরনের ছেঁড়া কাপড়টি ছিঁড়ে একটা ধ্বজার মত করে নাচতে লাগল। তার দেখাদেখি–কোকিলিনীও নাচতে লাগল। নাচতে নাচতেই এক সময় তারা দুজনেই মারা গেল।
যমদূতেরা এল তাদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আষ্টেপৃষ্ঠে তাদের বেঁধে নিয়ে গেল যমপুরীতে। চিত্রগুপ্ত তাদের খাতা বের করল। যমরাজ বললেন–এদের পাপের পরিমাণ কত?
চিত্রগুপ্ত বললেন–দুজনেই মহাপাপী। এদের পাপের সীমা নেই। কিন্তু এদের মৃত্যুর সময়টা ভেবে দেখার আছে। এরা মৃত্যুর আগে হরিমন্দিরে ধ্বজা নিয়ে নেচে নেচে ক্লান্ত হয়েছিল।
যমরাজ বললেন–আর কোন কথা নয় চিত্রগুপ্ত। এদেরকে বিষ্ণুলোকে পাঠিয়ে দাও। ওদের বিচার করার কোন অধিকার আমার নেই।
মালী আর কোকিলিনী তো অবাক। সারা জীবন পাপ কাজ করে সামান্য ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোকে ধ্বজা করে নেচেছিল বলে, তার এই পরিণতি? শ্রীহরির জয়গান করতে করতে তারা বিষ্ণুলোকে চলে গেল। তারা বিষ্ণুলোকে বহুকাল সুখ ভোগ করল, তারপর এল ব্রহ্মলোকে। সেখান থেকে এল ইন্দ্রলোকে, সব দেবতাদের সম্মান লাভ করে বহুদিন পরে জন্মাল মর্ত্যভূমিতে, রাজার ঘরে। পরে হল। স্বয়ং রাজা রানি। সেই ধ্বজারোপণের পুণ্য প্রভাবে তারা আজ জাতিস্মর হয়ে জন্মেছে।
রাজা সুমতি তারপর বললেন–হে মুনিবর, সেই মালীই এখন সুমতি। আর সেই কোকিলিনী আমার মহিষী। আমাদের মনে সেই স্মৃতি আজও জাগ্রত। তাই নিত্য নিত্য ধ্বজা রোপণ, প্রদক্ষিণ, পূজা ও নৃত্য আমরা জীবনে কখনও ত্যাগ করতে পারব না।
রাজা সুমতির এই কাহিনী শুনে বিভান্তক মুনি মনের সংশয় দূর করে, শিষ্যদের নিয়ে নিজের আশ্রমে ফিরে গেলেন।