দক্ষের পাপে চন্দ্রের ক্ষয় ও নিরোগ
ব্রহ্মার মানসপুত্র অত্রি। তিন হাজার বছর কঠোর তপস্যা করলেন। তখন তার দুই চোখ থেকে আলোকরশ্মি দশ ভাগে বিভক্ত হয়ে বেরোতে লাগল। ব্রহ্মা সেখানে এসে সকল দিককে বললেন– সেই রশ্মিগুলোকে ধরে রাখতে। তখন তারা তা চেষ্টা করল কিন্তু সফল হল না। সেই রশ্মিগুলি সবদিক আলোকিত করে মাটিতে পড়তে লাগল। ব্রহ্মা তা নিজের রথে তুলে নিলেন। সেই রথে একুশ বার ধরা প্রদক্ষিণ করলেন। সেই রশ্মির তেজে পৃথিবীতে ঔষধির জন্ম হল। ফল পাকলে যে গাছ মরে যায় তাকে বলে ঔষধি। তারপর ব্রহ্মা বীজৌষধি, বিপ্র ও মন্ত্র– এই তিনের রাজা করে সোমাক অভিষিক্ত করেন। তিনি অভিষিক্ত হয়ে নিজের কিরণ বিতরণ করে ত্রিজগতকে আলোকিত করছেন। প্রজাপতি দক্ষের চৌষট্টিজন কন্যা। তাদের মধ্যে রোহিণী আদি সাতাশ জন নক্ষত্র নামে বিদিতা, তাদেরকে বিয়ে করেন চন্দ্র। সোমদেব সাতাশজন পত্নীর মধ্যে রোহিনীকেই বেশি ভালোবাসতেন। সেই একজনই যেন তার বল্লভা, প্রাণাপেক্ষা প্রিয়া ও শ্রেষ্ঠা। অন্য ছাব্বিশজন পত্নীকে যেন দাসীর মতোই ভাবেন। রোহিণীকে নিয়ে নানা কানন দেশ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। চন্দ্রের এই ব্যবহার অন্য পত্নীরা সহ্য করতে পারল না। পিতা দক্ষের কাছে গিয়ে জানাল। বলল– বাবা, তোমার জন্যই সোমদেব আমাদের সকলকে ছেড়ে কেবল রোহিণীকে নিয়েই আমোদ-প্রমোদে মেতে আছেন। একটি রাত্রির জন্যও আমরা তাঁর সেবার সুযোগ পেলাম না। আমাদের কোন দোষ নেই। এখন আমাদের মরণ শ্রেয়। কন্যাগণের এমন দুঃখের কথা জেনে দক্ষ জামাতা চন্দ্রের কাছে গিয়ে বললেন– হে শশধর, তুমি আমার সাতাশটি কন্যাকে বিয়ে করেছ। কাজেই তোমার সকলের সঙ্গে সম ব্যবহার করাই উচিত। তা না হলে তুমি দোষভাগী হবে।
চন্দ্রদেব শ্বশুরের কথায় লজ্জা পেল। মাথা নিচু করেই বললেন– আমি শপথ করে বলছি, এবার থেকে সবার সঙ্গেই তুল্য ব্যবহারই করব।
চন্দ্রের কথায় দক্ষ খুশি হয়ে সকল কন্যাগণকে চন্দ্রের কাছে রেখে চলে গেলেন নিজের ভবনে। চন্দ্র কিন্তু ‘যথা পরং তথা পরং’, যেমন ছিল তেমনিই রইলেন। সেই রূপবতী রোহিণীতেই তাঁর মন, অন্য কাউকে চান না তিনি।
স্বামীর স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হল না দেখে, সেই ছাব্বিশজন দক্ষ কন্যা পুনরায় পিতা দক্ষের ভবনে উপস্থিত হল। তাদেরকে রুক্ষ, দীনা, কৃপা দেখে দক্ষ খুব দুঃখ ভরেই বলতে লাগলেন– তোমাদের এমন মলিন বেশ দেখছি কেন?
কন্যারা বলল– আমাদের স্বামী সেই আগের মতোই রয়েছে। রোহিণীকে নিয়েই তার সময় কাটে। সেই চন্দ্র, আপনার কাছে কথা দিলেন শপথ করে। কিন্তু সেই শপথের কথা ভুলে গিয়ে অর্থাৎ আপনাকে অবজ্ঞা করেই আমাদের সঙ্গ থেকে দূরে রয়েছেন। কন্যাদের মুখে এমন কথা শুনে দারুণভাবে কুপিত হলেন দক্ষ। তাড়াতাড়ি চন্দ্রের কাছে গিয়ে শাপ দিলেন। চন্দ্র তুই আমার বাক্যে অনাদর করে সকলকে বাদ দিয়ে কেবল রোহিণীতেই রত হলি। যক্ষা গ্রাস করবে তোকে, আমার বাক্য কখনও মিথ্যা হবে না।
দক্ষের শাপে চন্দ্রের দেহে যক্ষা ব্যাধি প্রবেশ করল। দিন দিন ক্ষয় পেতে লাগলেন। দাঁড়িয়ে থাকবার মতো ক্ষমতাও হারিয়ে ফেললেন। পড়ে গেলেন ভূমিতে। রোহিণীকে বললেন– দেবী এখন আমি কি করব? তোমার বাবার শাপে আমি-ব্যাধিগ্রস্ত। রোহিণী কাঁদতে কাঁদতে বলল– প্রভু আপনাকে যিনি শাপ দিয়েছেন তারই শরণ নিন। তিনিই আপনার রোগমুক্তির ব্যবস্থা বলে দেবেন। তিনি যদি তুষ্ট হন তাহলে দেবদুলভ আবার সুন্দর দেহ লাভ করবেন।
রোহিণীর কথামতো চন্দ্র শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন– পিতা আপনি আমার প্রতি ক্রোধ ত্যাগ করে আমাকে কৃপা করুন, আমার রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা করুন।
চন্দ্রের দুঃখ দেখতে না পেরে দক্ষ তখন বললেন–হে সোম, আমি শাপ দিলে দেবতারা তা রোধ করতে পারবে না। দেখ আয়ু, কম, বিঙ্গ, বিদ্যা ও নিধন– এ সকল পূর্ব নির্দিষ্ট। কারুরই ক্ষমতা নেই তাকে খণ্ডন করা। একমাত্র মহেশ্বর পারেন। তাঁর দয়ায় এই শাপ মুক্ত হতে পারে। দক্ষের উপদেশ শুনে চন্দ্র হাতজোড় করে, বললেন– আপনি যখন আমার প্রতি কৃপা করে এই উপদেশ দিলেন, এবার বলুন তিনি কোথায় বিরাজ করেন? কোথায় আমি তার দেখা পাব? দক্ষ বললেন– পশ্চিম সাগরে তীরে পরম লিঙ্গ বিরাজ করছেন। তা হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে। সেখানে তুমি গিয়ে কঠোর তপস্যা কর। শরীরকে তুষ্ট করে তুমি নির্মল হও, অজর দেহ লাভ কর। এইরূপ দক্ষের উপদেশ লাভ করে চন্দ্র প্রভাসতীর্থে উপনীত হলেন। সাগরের দক্ষিণ তীরে কৃতস্মর নামে সুন্দর একটা পর্বত দেখতে পেলেন। নানা বৃক্ষ শোভিত, নানা পক্ষীর কলরব মুখরিত, সেখানে বহুমুনি বাস করেন। চন্দ্র সেখানে গিয়ে স্বয়ম্ভ লিঙ্গ দর্শন করে সাতবার প্রদিক্ষণ করলেন। তারপর প্রতিজ্ঞা করলেন, হয় মরণ, না হয় শিবের শরণ, এই নিশ্চয় করে ফলমূল খেয়ে এক হাজার বছর তপস্যা করলেন।
প্রসন্ন হলেন মহাদেব। বর দিতে এলেন– হে চন্দ্র, বল কি চাই তোমার? তুমি বল আমি নিশ্চয় তা পূরণ করব।
সবশেষে বললেন– প্রজাপতি পুত্র দক্ষ আমায় শাপ দিয়েছেন, তাই আমি আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। এখন আপনি এই ক্ষয়রোগগ্রস্ত পাপ রোগীকে রক্ষা করুন।
দেবাদিদেব মহাদেব বললেন– হে চন্দ্র, তুমি দক্ষের যে সকল কন্যাকে বিবাহ করেছ সকলের সঙ্গে সমান ব্যবহার করবে। তুমি জ্ঞানবান হয়ে এ বিষয়ে আর শোক করো না। এই যে সাগরের তীরে একটি লিঙ্গ আছে। লিঙ্গের ন্যায় আমার আরো একটি লিঙ্গ ধরণীর গভীরে চলে গেছে। মুরগীর ডিমের মতো দেখতে, সর্পের খোলায় ঢাকা, এটা আমার পরম আদি তেজ। ওই সাগরের মধ্যে তিনশত ধনু নিম্নে ওই লিঙ্গ আদিকল্পে মহর্ষিগণের শাপে পতিত হয়েছিল। তুমি ওই লিঙ্গটি এনে স্পর্শ লিঙ্গের কাছে স্থাপন কর। বিশ্বকর্মার দ্বারা বিশেষভাবে তৈরি করে মহর্ষিগণের সঙ্গে ব্রহ্মাকে এনে যজ্ঞ করে ওই লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করবে।
এই কথা বলে মহেশ্বর চন্দ্রের ক্ষরিত দেহ নিজ মস্তকে ধারণ করে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। চন্দ্রও শিবের বর লাভ করে আপন প্রভা লাভ করলেন বলে ওই স্থানের নাম প্রভাস। দক্ষের শাপ একেবারে বৃথা হল না, সেইজন্য চন্দ্রের গায়ে কলঙ্ক চিহ্ন আছে। চন্দ্র মহেশের কাছেই বর লাভ করে জগতে প্রভা দান করতে লাগলেন।
তারপর মহাদেবের উপদেশ অনুসারে চন্দ্র দেব যথাবিস্মিত সেই পতিত লিঙ্গ উদ্ধার করে বিশ্বকর্মার দ্বারা নবরূপে নির্মিত করে ব্রহ্মার দ্বারা যথাবিহিত যজ্ঞ দ্বারা প্রতিষ্ঠা করলেন। চন্দ্র ব্রহ্মার সঙ্গে সেই প্রভাস ক্ষেত্রেই লিঙ্গ আরাধনা করলেন।