হরিশচন্দ্রের যজ্ঞে শুনঃশেফের কাহিনী
হরিশচন্দ্র সূর্য বংশের এক ধার্মিক রাজা। তার পিতা রাজা সত্যব্রত, যিনি ত্রিশঙ্কু নামে অমর হয়ে আছেন। বিশ্বামিত্রের চেষ্টায় সশরীরে স্বর্গে যাবার আগে তিনি পুত্র হরিশচন্দ্রকে সিংহাসনে অভিষেক করেন। সুখ্যাতির সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা করেন হরিশচন্দ্র। প্রজারা সবাই খুশি। কারও কোন অভিযোগ নেই। তার রাজ্য শাসনে রাজ্যের সকল প্রজারা অত্যন্ত খুশি, সেখানে স্বয়ং রাজার মনে কিন্তু সুখ নেই। তার সবই আছে, কিন্তু কোন পুত্র নেই।
একবার নারদ ও পর্বত ঋষি এলেন তার প্রাসাদে, যথাযোগ্য সমাদরে তাদের আপ্যায়ন ও সেবা করলেন রাজা হরিশচন্দ্র। মুনিদের সঙ্গলোভে রাজার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। এঁদের কাছেই জানিনা কেন কেমন করে পুত্র লাভ করা যায়? মুনিদ্বয় তার আপ্যায়নে সন্তুষ্ট জেনে কথাটা বলেই ফেললেন হরিশচন্দ্র।
ঋষিদ্বয় বললেন–রাজা তুমি এক কাজ কর। তুমি গোদাবরীতে স্নান করে বরুণদেবের উদ্দেশ্যে স্তব কর। তাতে তিনি যদি তুষ্ট হন, তাহলে তোমার পুত্র লাভ হতে পারে।
ঋষিদের কথামত হরিশচন্দ্র পবিত্র গোদাবরীতে অবগাহন করে স্তব শুরু করে দিলেন। বরুণদেব তুষ্টও হলেন। দর্শন দিয়ে বললেন–হরিশচন্দ্র, কি বর চাই তোমার?
রাজা বললেন–পুত্ৰ চাই আর কোন কিছুরই অভাব নেই আমার।
রাজা বললেন–তোমাকে আমি পুত্রলাভের বর দিতে পারি, কিন্তু একটা শর্ত তোমাকে মানতে হবে। খুব কঠিন সেই শর্ত, শুনলে তুমি হয়তো আঁতকে উঠবে।
রাজা ভাবলেন এমন কি শর্ত যা আমি পালন করতে পারব না? বললেন–বলুন আপনার শর্ত। আমি নিশ্চয় পালন করব।
বরুণদেব বললেন–আমার বরে তুমি যে পুত্র লাভ করবে, সেই পুত্রকে আহুতি দিয়েই তোমাকে যজ্ঞ করতে হবে। বরুণদেবের কথা শুনেই হরিশচন্দ্রের মাথায় যেন বজ্রাঘাত পড়ল। পুত্র পেয়ে সেই পুত্রকেই আহুতি দিতে হবে? তাহলে পুত্র লাভ হল কেমন করে? পুত্র নাই তাতে আমার দুঃখ আছে। কিন্তু পুত্র লাভ করে সেই পুত্রকে আবার ত্যাগ করতে হবে, এরফলে আমার দুঃখ ত শতগুণ বৃদ্ধি পাবে। কি দরকার এমন পুত্র লাভে?
কিন্তু নিঃসন্তান পিতার হৃদয়ে পুত্র আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয়ে পুনর্বার চিন্তা করলেন–আগে তো পুত্র সন্তান লাভ করি, তারপর কোনও কৌশলে পুত্রকে রক্ষা করার চেষ্টা করব। সে চেষ্টায় যদি সফল হতে পারি, তাহলে আর কোন চিন্তা থাকবে না। এই চিন্তা করে বরুণদেবকে বললেন–আমি আপনার শর্ত স্বীকার করলাম।
যথাসময়ে রানি এক অপরূপ সুন্দর পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। রাজা তার নাম রাখলেন রোহিত। রাজা রানির মনে কি আনন্দ! বহুকাল পরে পুত্রের মুখ দেখে অন্তরে যে কি আনন্দ, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু এ কি? অকস্মাৎ সেই আনন্দ মুখরিত ভবনে যেন নিবিড়ঘন অন্ধকার নেমে এল। বরুণদেব উপস্থিত বললেন– রাজা মনে কর শর্তের কথা, সহসা আকাশ ভেঙে যেন বজ্রাঘাত হল রাজার মাথায়। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বরুণদেবকে বললেন–সবে মাত্র শিশুর জন্ম হয়েছে, এই শিশু এখনও হাসতে শেখেনি। দাঁত বেরোয়নি। এর দাঁত বেরোক তখন আমি যজ্ঞ করব। বরুণদেব চলে গেলেন। শিশুর দাঁত বেরোল, এখন সে হাসতে পারে, আবার এলেন বরুণদেব। বললেন–কই গো রাজা, এবার যজ্ঞ কর।
রাজা বললেন–দুধে দাঁত, ওগুলি পড়ে আবার নতুন দাঁত উঠুক। আমি যজ্ঞ করব।
বরুণদেব ফিরে গেলেন, রোহিতের দাঁত পড়ে আবার নতুন দাঁত বেরল। আবার রাজার কাছে বরুণদেব এলেন।
রাজা বললেন–রোহিত ক্ষত্রিয় সন্তান। ক্ষত্রিয়মতে পুত্রের সংস্কারাদি হল না। অস্ত্রবিদ্যা শিখল না। এ অবস্থায় বালককে যজ্ঞে অনুমতি দিলে যজ্ঞের হানি হবে। আপনিও দেবতা একজন, এসব আপনার অজানা নেই।
বরুণদেব রাজার কথা স্বীকার করে চলে গেলেন। রোহিতের অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা শুরু হল, ক্রমে শিক্ষা সমাপ্ত হল। তখন রোহিত ষোল বৎসরের পরিপূর্ণ যুবক। তার সেই নয়ন মনোহর রূপ নেই দেখে, আর সেই চোখ ফেরাতে পারে না।
এমন পুত্রকে যজ্ঞে বলি দিতে কোন মা-বাবার মন চায়? হরিশচন্দ্র ভুলে গেলেন বরুণদেবের কথা। তিনি রোহিতকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। বরুণদেব কিন্তু ভোলেন নি। রাজার কাছে এসে যজ্ঞের কথা কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। এতদিন হরিশচন্দ্র নানান ফিকির তুলে পুত্রকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু এবার কি করেন? বরুণদেব সামনে, রাজা কিছু বলতে পারছেন না। চুপ করে বসে আছেন। ক্রমে ক্রমে ছেলের প্রতি তাদের বাৎসল্যে মায়া বসেছে। অন্তর জেগে উঠছে। কিন্তু মুখে কিছু বলছেন না।
বরুণদেব বললেন–কি হল? চুপ করে বসে আছ কেন? বল, এবার যজ্ঞ কবে করছ?
রাজা বললেন–রোহিত এখন যুবক, তাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেছি। তার উপর এখন আমার আর প্রভুত্ব চলে না। তার নিজের একটা মতামত আছে। রোহিতকে ডেকে জিজ্ঞাসা করি দেখি সে কি বলে?
রোহিতকে ডেকে আনা হল রাজসভায়, রাজা সন্তান লাভ করার আনুপূর্বিক কাহিনী সব আদ্যোপান্ত খুলে বললেন।
সব শুনে রোহিত অবাক। এতদিন সে তো জানতে পারে নি যে তাকে এভাবে চলে যেতে হবে যজ্ঞের আহুতি হিসেবে। বেঁকে বসল সে। –আমি এই বয়সে কিছুতেই মরতে পারব না। রাজাও পুত্রস্নেহে কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলেন।
রাজার কপটতা এতদিন সহ্য করেছেন বরুণদেব, কিন্তু আর নয়। ধৈর্যের তো একটা সীমা আছে? অভিশাপ দিলেন রাজাকে। –তুমি উদরী রোগে ভুগবে।
দেবরাজ ইন্দ্র গোপনে রোহিতকে নিয়ে বনে গেলেন। বহু ঋষির তপোবন সেখানে। গঙ্গার তীরে মনোরম শোভা, তার উপর ঋষিদের আশ্রম, খুব ভালো লাগল রোহিতের। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল সেইসব আশ্রম।
একদিন উপস্থিত হল ঋষি আজীগর্ভের আশ্রমে। বয়সে বৃদ্ধ ঋষির দেহ, জীর্ণ শীর্ণ। ঋষি পত্নীর দশাও তেমনি। দেখে মনে হয় কোন ভাবনা-চিন্তায় ঋষি দম্পতির এমন দুঃখের অবস্থা। খুব দয়া হল রোহিতের, জিজ্ঞাসা করে জানল-ঋষির তিন পুত্র শুনঃপুচ্ছ শুনঃশেফ ও শুনঃলাঙ্গল পাঁচজনের সংসার। কিন্তু সংসার নির্বাহের কোন সংস্থান নেই। রোহিত খুব চিন্তায় পড়ল। কেমন করে দুঃখ মোচন করা যায়।
এমন সময় খবর এল অযোধ্যা থেকে। রাজার উদরী রোগে প্রাণ বুঝি যায়। কুলগুরু বশিষ্ঠদেব পরামর্শ দিলেন, বরুণদেবের কাছে প্রতিশ্রুতি মত নরমেধ যজ্ঞ না করলে রাজাকে সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়। রোহিত মহাচিন্তায় পড়লেন। পিতাকে বাঁচাতে তাঁকেই এখন মরতে হয়। কিন্তু এই অল্প বয়সে তাঁর নিজের প্রাণের উপর এমন মায়া রয়েছে যে তাঁর প্রাণ বিসর্জন দিতে রাজি নয়, তাহলে নিজেকে বাঁচাবে কেমন করে?
সহসা মনে হল সেই দুঃখী ঋষি আজীগর্ভের কথা। তার তিন পুত্রের মধ্যে কোনো একজনকে যদি তিনি বিক্রি করেন, তাহলে তাঁকেও মরতে হয় না। যজ্ঞের দ্বারা বরুণদেবকেও তুষ্ট করা যাবে আর পিতাও আরোগ্য লাভ করবেন।
ছুটে চলল আজীগর্ভের আশ্রমে। ঋষিকে বলল–ঋষিবর আপনার একটি ছেলেকে যদি বিক্রি করেন, তাহলে আপনাদের দুঃখ দূর হতে পারে।
ক্ষুধায় জ্বালায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ঋষি বললেন–আমি আমার ছেলেকে বিক্রি করব। তবে আমার জ্যেষ্ঠ ছেলে শুনঃপুচ্ছকে আমি দেব না। ঋষিপত্নী তার ছোট ছেলে শুনঃলাঙ্গুকে দিতে চাইলেন না। কাজেই ঠিক হল, শুনঃশেফকেই বিক্রয় করা হবে। শুনঃশেফের মূল্য ধার্য হল এক হাজার গাভী, এক হাজার সোনার মুদ্রা, এক হাজার বস্ত্র আর প্রচুর ধান। একজন ঋষিবালকের জন্য এত যেন একটু বেশিই হয়েছে। হোক তাতে কি? রাজার তো কোনও অভাব নেই।
আজীগর্ভের প্রার্থনামত সব কিছু দিয়ে রোহিত শুনঃশেফকে কিনে নিয়ে গেল পিতার কাছে। হরিশচন্দ্র কিন্তু খুশি হতে পারলেন না। হাজার হোক ব্রাহ্মণ সন্তান, তাকে যজ্ঞ আহুতি দান করে তিনি নিজের প্রাণরক্ষা করতে চান না।
গুরু বশিষ্ঠদেব বুঝিয়ে বলতে অবশেষে রাজী হলেন রাজা। যজ্ঞবেদী সাজানো হল, পুরোহিতগণ মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন। বন্দি হয়ে আছে ব্রাহ্মণ পুত্র শুনঃশেফ, বাঁচার কোন আশা নেই। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল তার, গোদাবরী নদীতে তাকে স্নান করানো হল। যজ্ঞবেদীর সামনে দাঁড় করান হল।
বালকের মুখের দিকে তাকিয়ে বিশ্বামিত্রের খুব দয়া হল, প্রাণটা কেঁদে উঠল, চিন্তা করলেন, কেমন করে বাঁচানো যায়? তারপর বালকের উদ্দেশ্যে বললেন–বৎস তুমি বরুণদেবকে স্তব কর।
একটু পরেই যার মৃত্যু হবে, বুকের ভেতর দুরু দুরু করছে। সে কি পারবে স্তব করতে? বালক মাত্র সে, স্তবের কি জানে? তথাপি নিজের প্রাণ বাঁচাতে দুটি হাত তুলে বরুণদেবের উদ্দেশ্যে আকুল প্রার্থনা জানাল।
দেবতারা মন্ত্রের ভাষা শোনেন না অন্তরের ভাষা শোনেন। বরুণদেব আবির্ভূত হলেন। সেখানে বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র আদি ব্রাহ্মণদের সামনেই বললেন–শুনঃশেফকে আহুতি দিতে হবে না। তথাপি এই যজ্ঞ পূর্ণ হবে। যজ্ঞের ফল পুরোপুরিভাবে লাভ করবে।
এই কথা বলে বরুণদেব অন্তর্হিত হলেন। যজ্ঞ সমাপ্ত হল। মুক্ত হল শুনঃশেফ, রাজাও রোগ মুক্তি হল। শুনঃশেফ এখন কোথায় যাবে, যে মা-বাবা পুত্রকে মূল্যের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে। তাদের কাছে যেতে ইচ্ছে হল না তার।
তার মনের ভাব বুঝতে পেরে বিশ্বামিত্র মুনি বললেন–আমি এই শুনঃশেফকে আমার জ্যেষ্ঠপুত্র হিসাবে গ্রহণ করছি। স্নেহভরে নিয়ে গেলেন আপন আশ্রমে। ছেলেদের ডেকে বললেন–আজ থেকে শুনঃশেফ হল তোমাদের বড় ভাই। দেবতার অনুগ্রহে আমি পেয়েছি একে। যদিও এর নাম শুনঃশেফ, তবে আজ থেকে এর নাম রাখলাম দেবরাজ। তোমরা একে যথাসাধ্য সম্মান দেবে।