জাম্ববান কথিত পুরাকল্পীয় রামায়ণ
মানুষের ২৪ ঘণ্টায় এক দিবা রাত্র। এক বৎসর হয় ৩৬৫ দিনে। ৪,৩২,০০০ বৎসর কলিযুগ, দ্বাপরযুগ ৮,৬৪,০০০ বৎসরে ১২,৯৬,০০০ বৎসরে ত্রেতাযুগ আর সত্যযুগ ১৭,২৮,০০০ বৎসরে। এই চারটি যুগ এক করে দিব্যযুগ। এইভাবে ব্রহ্মার একদিন হয় ১০০০ দিব্য যুগে। এর সমপরিমাণ সময়ে ব্রহ্মার এক রাত্রি। ব্রহ্মর এক দিবারাত্রকে এক কল্প বলে ভগবান শ্রীগোবিন্দ যিনি অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের মালিক তিনি প্রতি কল্পেতেই তার লীলার পুনরাবৃত্তি করেন। প্রতিবারেই কিন্তু তিনি একই রকম লীলা করেন না। রাম অবতারে দেখা যায় যে তিনি কুম্ভকর্ণকে আগে বধ করে পরে রাবণকে বধ করেছিলেন। কিন্তু অন্য কল্পে দেখা যায় তিনি রাবণকে আগে বধ করে পরে কুম্ভকর্ণকে বধ করেন। সবাই জানে যে সমুদ্র বন্ধনের জন্য পাথর জলে ভাসিয়ে তিনি লঙ্কায় গমন করেছিলেন, কিন্তু অন্য কল্পে দেখা যায় মহাদেবের ধনুর সাহায্যে সকল বানর সৈন্যাদি লঙ্কা পারাপার করে।
অন্য এক কল্পে ভগবান রামচন্দ্র যেভাবে লীলা বিলাস করেছিলেন, সেই কাহিনী কমলাগণ ব্রহ্মার শ্রীমুখ থেকে শ্রবণ করে ঋষরাজ জাম্ববান এই কল্পের শ্রীরামচন্দ্রের কাছে বর্ণনা করেন।
অযোধ্যার মহারাজ দশরথ সুমনা নামে এক সুন্দর রাজ্য জয় করবার প্রবল বাসনা নিয়ে গুরুদেব বশিষ্ঠাকে প্রণাম করে যুদ্ধের জন্য অনুমতি চাইলেন। অনুমতি লাভ করে ব্রহ্মার আরাধনা করে শত অক্ষৌহিনী সেনা নিয়ে একটি সুন্দর শ্বেতবর্ণ অশ্বের পিঠে চড়ে যুদ্ধে যাত্রা করলেন। ২১,৮৭০ রথ, ২১,৮৭০ গজ, ৬৫,৬১০ অশ্ব এবং ১,০৯,৩০৫ পদাতিক নিয়ে এক অক্ষৌহিনী হয়। সুমনা রাজ্যের রাজার নাম সাধ্য দশরথের সঙ্গে এক মাস ব্যাপী যুদ্ধ করে পরাজিত ও বন্দী হলেন। সাধ্য রাজার পুত্র ভূষণ কতিপয় সৈন্য নিয়ে দশরথের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলে, তার রূপ দেখে দশরথের মনে স্নেহ দয়ার উদয় হল। ভাবলেন এই বালকের সঙ্গে যুদ্ধ করলে এর পিতামাতা দুঃখ পাবে। আমারও এক পুত্র এমনি সুন্দর ছিল। সেই পুত্র ভল্লুকের আক্রমণে প্রাণ না হারালে তার এমনিই বয়স হত। একে দেখে আমার তার কথা মনে পড়ছে। আমি এর সঙ্গে যুদ্ধ করব না, তবে একে কৌশলে বন্দী করব।
এমন চিন্তা করে ভূষণকে রাজা দশরথ কৌশলে বন্দী করলেন। তারপর সাধ্য ও ভূষণের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে তাদের রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে সেই রাজপ্রাসাদেই এক মাস অবস্থান করলেন। প্রত্যেক দিন ভূষণকে দেখে আনন্দ পেতেন আর মনে মনে ভাবতেন, এ যদি আমার পুত্র হত, তা হলে না জানি আরও কত সুখ হত। আমার কিভাবে পুত্র লাভ হবে, সে বিষয়ে এই সাধ্যকে জিজ্ঞাসা করি।
মনে মনে এই কথা চিন্তা করে সাধ্যকে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি রাজা দশরথকে বললেন, একাদশীতে উপবাস, বিষ্ণু পূজা, বিষ্ণুর নামকীর্তন, বিষ্ণুর অঙ্গে ধৃত লেপন, তুলসী দ্বারা বিষ্ণুর সেবা ও বিভিন্ন পুষ্পের দ্বারা বিষ্ণুর পূজা করতে হবে। শ্রীহরির প্রতিকামনায় বিভিন্ন ব্রত করতে হবে। ভগবান বিষ্ণু প্রসন্ন হলে অভীষ্ট সিদ্ধ হবে।
মহারাজ দশরথ সাধ্যের উপদেশ শুনে অযোধ্যায় এসে উপদেশ মতো সমস্ত কাৰ্য্য করলেন। বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে পুত্র কামনায় যজ্ঞ করলেন, সেই যজ্ঞাগ্নি থেকে ভগবান নারায়ণ উত্থিত হয়ে দশরথকে বর প্রার্থনা করতে বললেন।
দশরথ বললেন–আমাকে দীর্ঘজীবি, লোকোপকারী অতি ধার্মিক চার পুত্র দান করুন। তারপর রাজার চার মহিষী কৌশল্যা, সুমিত্রা, সুরূপা ও সুযেশা বললেন–আমাদের গর্ভে এক এক করে পুত্রের জন্ম হোক, কৌশল্য বললেন–হে নারায়ণ, আপনি যদি আমার প্রতি প্রসন্ন থাকেন, তাহলে আপনিই আমার পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করুন।
শ্রীহরি প্রসন্ন হয়ে বললেন–তাই হবে। এই কথা বলে তিনি যজ্ঞীয় চরুতে প্রবেশ করলে রাজা সেই চরু চার ভাগ করে চার মহিষীকে দিলেন ভক্ষণ করবার জন্য। পরে কৌশল্যার গর্ভে রাম, সুমিত্রার গর্ভে লক্ষ্মণ, সুরূপার গর্ভে ভরত ও সুবেশার গর্ভে শত্রুঘ্ন জন্মগ্রহণ করেন। ব্রহ্ম চার পুত্রের নামকরণ করলেন।
একদিন এক ব্রহ্মরাক্ষস এসে রামকে গ্রহণ করলে রাম মুচ্ছিত হন। রাজা দশরথ কোলে নিলেও রামের মূচ্ছা ভঙ্গ হল না। মূচ্ছিত রামকে নিয়ে বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে গেলে মুনিবর রামের গায়ে মন্ত্রপুত্র ভস্ম নিক্ষেপ করে ব্রহ্মরাক্ষসের হাত থেকে মুক্ত করলেন।
তারপর বশিষ্ঠদের চার কুমারকে উপনয়ন দিয়ে নানাবিধ নীতিশাস্ত্র পাঠ দিলেন, ধনুর্বেদ, আয়ুর্বেদ, যুদ্ধবিদ্যাও শিক্ষা দিলেন।
পুত্রগণের যৌবনকালে রাজা দশরথ তাদের বিবাহের কথা চিন্তা করে নানা দেশে দূতদের পাঠালেন সুন্দরী কন্যার সন্ধানে। কিছুদিন পরে এক দূতের মুখে তিনি শুনলেন, বিদর্ভনগরে রাজা জনকের সীতা নামে এক কন্যা আছে, যাকে তিনি যজ্ঞের দ্বারা লাভ করেছেন। সর্বলক্ষণ সম্পন্না সেই কন্যা রামের উপযুক্ত এবং রাজা জনকও তার কন্যাকে রামকে দান করতে ইচ্ছুক আছেন।
এই সংবাদ পেয়ে রাজা দশরথ বিদর্ভনগরে বশিষ্ঠদেবকে পাঠিয়ে বিবাহের লগ্ন স্থির করে নির্দিষ্ট দিনে লোকজন সহ চার পুত্রকে নিয়ে মিথিলায় গমন করলেন।
তারপর মিথিলারাজ সপরিজনে ধান্য দূর্বা, দিয়ে সমাগত সবাইকে সম্বর্ধনা করে তার পুরীর কাছে নবনির্মিত বাসস্থানে নিয়ে এলেন।
এই সময়ে দেবর্ষি নারদ মিথিলায় আগমন করলে, বিদেহরাজ তাঁর চরণ পূজা করে জিজ্ঞাসা করলেন-হে দেবর্ষি কাল আমার জানকীর বিবাহ আপনি উপস্থিত থেকে বিবাহকাৰ্য্য সমাপন করবেন।
নারদ বললেন–আগামীকাল বিবাহের লগ্ন ভাল নয়। এই শুনে বিদেহরাজ গর্গ মুনিকে ডেকে পুনরায় লগ্ন স্থির করবার জন্য বললে, নারদ ও গর্গচার্য্যের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হল।
অবশেষে স্থির হল, আগামীকাল ক্ষত্রিয় বিবাহ হতে পারে। তা স্বয়ম্বর নিয়মেই সাধিত হওয়া দরকার।
এই কথা শুনে জনকরাজ ভাবলেন, বর বাড়িতে উপস্থিত, এদিকে কন্যার স্বয়ম্বর হবে কিভাবে? এতে বরকে অপমান করা হবে। চিন্তায় পড়লেন তিনি। দশরথকে গিয়ে দুঃখিত ভাবে সবকথা বললেন–জনকরাজ। দশরথ কোন আপত্তি করলেন না। তখন রাজা দিকে দিকে স্বয়ম্বরের বার্তা পাঠালেন।
কিন্তু জনকরাজা মনে মনে ভাবছেন এ আমি কি করলাম। রামকে কন্যা দেব স্থির করেও স্বয়ম্বরের উদ্যোগ করা উচিত হয়নি। তখন তিনি পার্বতীসহ মহেশ্বরের ধ্যান করতে লাগলেন।
সেই ধ্যানে তুষ্ট হয়ে মহেশ্বর দর্শন দিলেন, বললেন–আমি বর দান করবার জন্য এসেছি। তুমি বর প্রার্থনা করো।
জনকরাজা তার বিপদের কথা মহেশ্বরকে জানিয়ে বললেন–হে মহেশ্বর, এই অবস্থায় রাম যাতে আমার জামাতা হয়, যাতে বিবাহকাৰ্য্য নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়, তার ব্যবস্থা করুন। এই আমার নিবেদন।
মহাদেব বললেন–এই আমার পিনাক ধনু তুমি রেখে দাও। যে জন এই ধনুতে জ্যা রোপণ করবে, তাকেই কন্যাদান করবে। এই কাৰ্য্য রাম ছাড়া আর কেউ করতে পারবেনা।
এই কথা বলে মহেশ্বর পিনাক ধনুটি রেখে অন্তর্হিত হলেন। মিথিলায় সকলের মনে জনকনন্দিনী সীতাকে বিবাহ করবার ইচ্ছা জাগল। ইন্দ্র, সূর্যদেব, অন্যান্য দেবতাগণ, অসুর, রাক্ষস সবাই ধনুতে জ্যা রোপণ করতে ব্যর্থ হল।
তারপর রাজা দশরথ সকলের শেষে রামকে পাঠালেন। রাম পিতার চরণবন্দনা করে উপস্থিত সর্বজনকে নমস্কার করে সেই ধনুকে স্পর্শ করলেন। তারপর প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করে বাম হস্তদ্বারা সেই ধনু তুলে তার অগ্রভাগ নত করে তার মধ্যভাগ জানু রেখে এক হাতে অগ্রভাগে জ্যা রোপণ করলেন। এই দৃশ্য দেখে সকলেই আশ্চৰ্য্য হল। তখন রাজা জনক রামকে কন্যা সম্প্রদান করলেন। অন্যান্য রাজারা এতে অপমানিত বোধ করে রামের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন। রাম যুদ্ধে তাদের পরাজিত করে সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে গেলেন।
দশরথ রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলে সবাই যখন খুশি হলেন, তখন ভরতের মা কেকয় রাজের কন্যা সুবেশা রামের প্রশংসায় খুশি হতে পারলেন না। তিনি পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুসারে দশরথের কাছে দুটি বর চাইলেন। এক, রাম চৌদ্দ বৎসরের জন্য বনে বাস করবে। দুই, ভরত অযোধ্যার রাজা সিংহাসনে বসবে।
এই বর প্রার্থনায় রাজা দশরথ দুঃখিত হলেও মিথ্যাবাদী হবার ভয়ে অতিকষ্টে স্বীকার করলেন।
রঘুনাথ পিতা-মাতার চরণ বন্দনা করে বনে যাত্রা করলেন। সীতাদেবী ও লক্ষ্মণও রামের সঙ্গে বনে গমন করল। প্রথমে একদিন উদ্যানে অবস্থান করে জানিৰ্মাণ করলেন। বসন ত্যাগ করে গাছের ছাল পরলেন। সর্বাঙ্গে ভস্ম মাখলেন। তার পর তারা বনে প্রবেশ করলেন। সেখানে তারপর রাক্ষস বধ করে বহু অদ্ভুত কর্ম সাধন করলেন। তারপর মারীচের সাহায্য রাবণ সীতাকে হরণ করলে, রাম পঞ্চবটী বন থেকে ঋষ্যমূক পর্বতে গমন করলেন। তারপর ক্লান্তি দূর করবার জন্য লক্ষ্মণের কোলে মাথা রেখে শয়ন করলেন। তখন শুনতে পেলেন কাছাকাছি কেউ মধুর গান গাইছে। উপর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, স্বর্ণবর্ণের একটি বানর যার কর্ণে কুণ্ডল, গলায় যজ্ঞোপবীত। সেই বানরকে দেখে রাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কে? তোমার নাম কি?
বানর বলল–আমার নাম হনুমান। সুগ্রীবের লোক আমি। এই বলে রামকে প্রণাম করে সে সুগ্রীবের কাছে গিয়ে বলল দেব, দ্বিতীয় নারায়ণের মতো এক সুন্দর ঘনশ্যাম যুবা পুরুষকে দেখলাম। মাথায় জটা, অজানুলম্বিত বাহু, দেখে মনে হল তিনি পরম যশস্বী। আর একজন যুবকও আছেন সাথে । মনে হয় তারা কোনো রাজার পুত্র।
হনুমানের মুখে সব শুনে সুগ্রীব জল আর পূজার দ্রব্য নিয়ে রামের কাছে এসে, তাদের পদ প্রষালন করে আহারের জন্য ফল দিয়ে বললেন–কে আপনারা? এখানে কিসের জন্য এসেছেন?
সুগ্রীবের প্রশ্নের উত্তরে লক্ষ্মণ বললেন–মহারাজ দশরথের পুত্র আমরা, আমাদের নাম রাম ও লক্ষ্মণ। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য আমরা বনে এসেছি। বর্তমানে আমার অগ্রজের ভাৰ্য্যাকে কেউ অপহরণ করেছে, তার খোঁজে এসেছি, তাকে উদ্ধারের জন্য আমরা সমুদ্র পার হতে পারি, পাতালে প্রবেশ করতে পারি, এমনকি ইন্দ্রকেও রাজ্যচ্যুত করতেও প্রস্তুত আছি।
তার উত্তরে সুগ্রীব বললেন–কয়েকদিন পূর্বে এক রমণীকে লঙ্কার রাজা হরণ করে নিয়ে যায়। যাবার সময় সেই রমণী কাঁদতে কাঁদতে এই অলঙ্কারগুলি ফেলে দিয়ে যান। এইগুলি তার কিনা দেখুন।
রাম সেই অলঙ্কারগুলি দেখে বুঝতে পারলেন, সেগুলি সীতারই অলঙ্কার। তখন সুগ্রীবকে বললেন–রাবণ কোন্ দিকে গেছে? উত্তরে সুগ্রীব বললেন–দক্ষিণ দিকে রাবণ গেছে।
তারপর সুগ্রীব রামকে বললেন–যে, সে স্থানহীন, ভাৰ্যাহীন হয়ে এই বনে অবস্থান করছে। তার রাজ্য ও পত্নীকে তার ভাই বালী হরণ করেছে। তখন রাম বালীকে বধ করে কিষ্কিন্ধ্যার সিংহাসন সুগ্রীবকে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন। তারপর বালী ও সুগ্রীবের মধ্যে মল্লযুদ্ধের সময় রাম বালীকে বধ করলেন।
সমুদ্রতীরে এসে রাম সুগ্রীবকে জিজ্ঞাসা করলেন–কত দূরে লঙ্কা? সীতা কোথায়? কিভাবে শত্রুকে বধ করব?
হনুমান বলল-লঙ্কায় প্রবেশ করে সীতার খোঁজ করব, সবকিছু জানব, তারপর হয় সন্ধি না হয় যুদ্ধ, যা হবার হবে। অনুমতি দিন, আমি লঙ্কায় যাই। রামের অনুমতি নিয়ে হনুমান লঙ্কায় প্রবেশ করে অশোক কাননে সীতাকে দেখতে পেল। তারপর লঙ্কায় বহু বন ভেঙে বন রক্ষকদের বধ করলে, রাক্ষসেরা হনুমানকে বেঁধে তার লেজে আগুন ধরিয়ে দিল। হনুমান লঙ্কা দগ্ধ করে আবার রামের কাছে। ফিরে এসে সকল ঘটনা জানাল।
জাম্ববান বললেন–আমি নারদের মুখে শুনেছি বানর সেনার সাহায্যে রাম লঙ্কাপুরী ছারখার করবেন। তাহলে আমাদের এখন সমুদ্র পার হতে হবে।
কিভাবে সমুদ্র পার হবেন, এই কথা চিন্তা করে রাম শঙ্করের আরাধনা করলেন। তখন শিবলিঙ্গ থেকে তেজোময় মূর্তি আবির্ভূত হলেন। তাঁর মাথায় কিরীট, সর্বাঙ্গে অলঙ্কার, অঙ্গের জ্যোতিতে দশদিক আলোকিত, তিনি পদ্মাসনে বসে। তার কোলের উপর পার্বতী।
মহাদেবকে দর্শন করে রাম তাঁকে প্রণাম জানিয়ে বললেন–আমি সীতাকে উদ্ধারের জন্য লঙ্কায় যাব। সমুদ্র পার হবার একটা উপায় বলে দিন।
শঙ্কর বললেন–কোন চিন্তা নেই, আমার পিনাক ধনু আছে। সেই বিশাল ধনুকের এক প্রান্ত এপারে রেখে অন্য এক প্রান্ত লঙ্কায় রাখবে। তাহলেই তার উপর দিয়ে সকলে সহজেই পার হয়ে যেতে পারবে। রাম সেই ধনুক পূজা করলেন। মহাদেব সেই ধনুক রামকে দিলে ধনুকটিকে তিনি লঙ্কা অভিমুখ সমুদ্র ফেলে দিলেন। সেই ধনুকের অগ্রভাগ সমুদ্রের অপরপারে লঙ্কার তটে গিয়ে লাগল। তখন রাম। লক্ষ্মণ সহ সুগ্রীবের সকল সৈন্যবল খুব সহজে পিনাক ধনুর ওপর দিয়ে লঙ্কা গিয়ে পৌঁছলেন।
সুগ্রীবের বানর সৈন্যরা লঙ্কার প্রাচীরে উঠে গাছের ডালপালা, অট্টালিকা সমস্ত কিছু ভাঙচুর আরম্ভ করল। রাক্ষসেরা তাদের তাড়া করল। রাক্ষসেরা অট্টালিকার ভাঙা স্তম্ভ নিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দিল। এই যুদ্ধে রাক্ষস জাতির বহু বালক, বৃদ্ধ, বণিতা হতাহত হল। তখন রাবণের আদেশে ইন্দ্রজিৎ এসে বানরদের সঙ্গে যুদ্ধ করলে বানরেরা ভয়ে পালিয়ে গেল।
হনুমান ভীত বানরদের যুদ্ধে উৎসাহ দিয়ে তাদের দশ ভাগে বিভক্ত করল। তখন ইন্দ্রজিৎ আকাশের অলক্ষ্যে থেকে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। কেউ তাকে দেখতে পায় না। তখন হনুমান আর জাম্ববান লাফ দিয়ে আকাশে উঠে পর্বতের শৃঙ্গ দিয়ে প্রহার করে ইন্দ্রজিৎকে মাটিতে ফেলে। দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে বাণ মেরে লক্ষ্মন ইন্দ্রজিৎকে বধ করলেন।
তারপর অতিকায় আর মহাকায় নামে দু’জন রাক্ষসের সঙ্গে রাম ও সুগ্রীবের যুদ্ধ হল। শেষে হনুমান ও জাম্ববান এর সঙ্গে যুদ্ধ করে দুই রাক্ষস তাদের হাতে বন্দী হল।
রাম বন্দী দুই রাক্ষসকে বললেন–রাবণ আর তার মন্ত্রীগণকে গিয়ে বল, যেন সীতাকে ফিরিয়ে দেয়, তা না হলে আমরা লঙ্কাপুরের কাউকে জীবিত রাখব না।
অতিকায় রাক্ষস তখন বলল–আমরা স্থির করেছি আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করব। বিদ্যুৎম্মানী নামে এক মহারাক্ষস সৈন্য পরিচালনা করে তখন দৃশ্য বা অদৃশ্য ভাবে যুদ্ধ করবে। কিছু পরে দেখবেন রাবণ যুদ্ধক্ষেত্রে অন্য দিক থেকে এসে আপনাকেই নিধন করবেন। কুম্ভকর্ণ প্রভৃতি পরাক্রমশালী রাক্ষসগণ ভীষণমূর্তি ধারণ করে আপনাকে বন্দী করে সীতার কাছে নিয়ে গিয়ে তার সামনেই আপনাকে বধ করবে।
তার উত্তরে রাম বললেন–ও হে, বলবানের অসাধ্য কি? তোমরা কি জান যে তোমাদের বিষম বিপদ খুব কাছেই?
তখন অতিকায় বলল–হে রাম, কোনমতেই রাবণকে আপনি বধ করতে পারবেন না। কারণ লঙ্কাদ্বারে যে পঞ্চানন মূর্তি আছে, যে তাকে এক বাণে পাঁচ খণ্ডে ছেদন করতে পারবে, তারই হাতে রাবণের মৃত্যু হবে, অন্যথায় রাবণকে কেউ মারতে পারবে না।
রাবণের মৃত্যুর উপায় জানতে পেরে রাম সঙ্গে সঙ্গেই ধনুতে শর সন্ধান করে লঙ্কাদ্বারের শিব মূর্তিকে পাঁচখণ্ড ছেদন করে দিলেন। এই দেখে রাক্ষস দুজন বুঝতে পারল যে রাক্ষস বংশ এবার নির্মূল হবে, তখন তারা রামের চরণে শরণ নিয়ে বলল–মহাশয়, অনুগ্রহ করে আমাদের বালক পুত্রগুলিকে রক্ষা করবেন। তাদের কথায় সম্মতি জানিয়ে রাম তাদের ছেড়ে দিল।
তারপর সুগ্রীবের সৈন্যরা রাবণের প্রথম প্রাচীরটি ভেঙে দ্বিতীয় প্রাচীর ভাঙবার উপক্রম করলে রাবণ নিজে এসে বহু বাণ মারতে মারতে রামের সামনে উপস্থিত হলেন। প্রথমে রাবণ রামকে পাঁচবাণে বিদ্ধ করলেন। তাদের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হল। শেষে রামের বাণে রাবণ ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহ নিয়ে পালিয়ে গেলেন।
পরের দিন রাবণ রাজসভায় বসে মন্ত্রীদের সঙ্গে যখন শলাপরামর্শ করছেন তখন বিভীষণ তাঁকে বললেন–শত্রুর এবং নিজের শক্তি ভালভাবে বুঝে শত্রু শক্তির অপেক্ষা নিজের শক্তির অধিক হলে, তবেই যুদ্ধ করা উচিত। নতুবা প্রাণ নাশের সম্ভাবনা থাকে। আপনি দুর্বল তাই বলবান রামের সঙ্গে আপনার যুদ্ধ করা কোনমতেই উচিত নয়। বালী, মারীচ প্রত্যেককেই রাবণ যমালয়ে পাঠিয়েছেন। একবাণে পঞ্চানন মূর্তি ছেদন করেছেন রাম। কাজেই সীতাকে আপনি প্রত্যর্পণ করে রামের চরণে আশ্রয় নিন। অন্যথায় তার হাতে বিনাশ হবেন।
বিভীষণের সৎ উপদেশ শুনে রাবণ ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন–বিভীষণ তুমি বীর নও, রাক্ষস নও। রাজার কর্তব্য তুমি জান না। পররাজ্য, পরস্ত্রী, পরদ্রব্য বলপূর্বক হরণ করা বীর পুরুষের ধর্ম, তোমার ক্লবদের জন্য সে ধর্ম নয়। তোমার একান্ত ইচ্ছা থাকলে যাও, শত্রুর পদতলে গিয়ে পড়। আমি তোমার কথা মানতে পারছি না।
তখন বিভীষণ রামের চরণে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন রাম। তারপর হল মহাসংগ্রাম। কিছুতেই রাবণকে বধ করা যাচ্ছে না। তখন বিভীষণের দিকে রাম দৃষ্টিপাত করলে, যে বাণে রাবণের মৃত্যু হবে সেটি বিভীষণ দেখিয়ে দিলে সেই বাণের দ্বারা রাম রাবণকে বিনাশ করলেন।
তারপর অসময়ে রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙিয়ে তাকে যুদ্ধে পাঠালে, যুদ্ধে এসেই সে বহু বানরকে খেয়ে ফেলল, গদা হাতে রামের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসে, রামকে আঘাত করার চেষ্টা করলে একটি মাত্র বাণের দ্বারা তার ভবলীলা শেষ করে দিলেন রাম।
তারপর রাম বিভীষণের দ্বারা রাবণের শ্রাদ্ধাদি কর্ম করে রাবণের নামে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। লঙ্কারাজ্যে বিভীষণকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। সীতাকে অগ্নি পরীক্ষার দ্বারা শুদ্ধি করে উমা মহেশ্বরের চরণে উভয়ে প্রণাম করলেন।
তারপর মহাসমরোহে সকলে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করে বশিষ্ঠ মুনির চরণে প্রণাম করে নাগরিকদের অভিনন্দন গ্রহণ করে স্বগৃহে প্রবেশ করলেন।
দেবতারা রাবণ বধের জন্য পরমানন্দ লাভ করে শ্রীরামের বহু স্তব স্তুতি করে ফিরে গেলেন। অযোধ্যাবাসী প্রজাবৃন্দ রামকে বললেন–যে, আপনি শত্রু নিধন করে ফিরে এসেছেন, আপনি আমাদের সর্বদা পালন করুন।
রঘুনাথ তাদের কথায় খুশি হয়ে বস্ত্রাদি দান করে সকলকে সমাদৃত করলেন। তারপর মুনিগণ রামকে আশীর্বাদ করে স্ব স্ব আশ্রমে ফিরে গেলেন।
তারপর বিভিন্ন সৎকর্মানুষ্ঠানের দ্বারা ভগবান রামচন্দ্র সর্বজনে প্রিয় হয়ে সমগ্র রাজ্যকে শান্তিময় করে তুললেন।
যিনি এই উপাখ্যান শ্রবণ ও কীর্তন করবেন, তার সকল দুর্গতি নষ্ট হবে।