প্রণবেশ্বরের সাধনার মুক্তি লাভ
দমন মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র। নানা ধর্মগ্রন্থ পড়ে দমন জানতে পারল মায়ার সংসারে শান্তি নেই। তাই শান্তিলাভের জন্য বেরিয়ে পড়ল সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে। সে তীর্থে তীর্থে ঘুরতে লাগল। বেশ কিছুদিন তপস্যাও করল। সে কয়েকজন পণ্ডিতের কাছে অনেক উপদেশ পেল। কিন্তু হায় শান্তি কোথায়? ভাবতে লাগল শান্তিকে কিভাবে ধরব? শাস্ত্রের কথামত শান্তি নিশ্চয় আছে। যেমন করেই হোক তা লাভ করতে হবে। সে আবার তীর্থে তীর্থে ঘোরার জন্য বেরিয়ে পড়ল। একদিন পৌঁছে গেল অমরকন্টক তীর্থে। এক আচার্যকে ঘিরে সবাই বসে তার উপদেশ শুনছে। সবার গায়ে ভস্মমাখা, মাথায় জটা, তারা শিবভক্ত। যুবক দমন দূর থেকে আচার্যকে দেখে ভাবল ইনিই পারবেন তাকে শান্তির পথ দেখাতে। সেখানে ধীরে ধীরে তার কাছে গেল। এবং জোড়হাত করে তাঁকে প্রণাম জানাল। আমাকে এতক্ষণ গর্গাচার্য উপদেশ দিচ্ছিলেন শিষ্যদের। দমনকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন–কে তুমি বাবা? তোমার নাম কি? কি চাও তুমি? তোমাকে দেখে বিষণ্ণ মনে হচ্ছে।
দমন বলল– আমি ভরদ্বাজ মুনির ছেলে। প্রকৃত শান্তির সন্ধানে বেরিয়েছি, আজ পর্যন্ত অনেক তীর্থ ঘুরলাম, তপস্যা করলাম, কিন্তু শান্তি পেলাম না।
দমন আরো বলল– আমার মনে হচ্ছে, সংসারে মায়া না ছাড়লে শান্তি পাওয়া যায় না। আমার মুক্তিলাভের ইচ্ছা, তাই যদি আপনি সেই পথের নির্দেশ দেন। আচার্যদেব বললেন– দমন তুমি ঠিক কথা বলেছে। এত অল্প বয়সেই তুমি সংসারকে অসার বুঝেছ। সেজন্য আমি খুব খুশি হয়েছি, এই দেহের মুক্তি দিতে পারেন একমাত্র মহেশ্বর। বারাণসী ধামে প্রণবেশ্বর লিঙ্গ নামে তিনি আছেন। মন প্রাণ দিয়ে সেই লিঙ্গের অর্চনা কর। তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে।
গর্গাচার্যের কথা শুনে দমনের মনে আশার আলো দেখা দিল।
আচার্য আবার বললেন– তোমাকে একটা আশ্চর্য কাহিনি বলি শোন। আচার্যরা স্বচক্ষে দেখেছে। প্রণবেশ্বর লিঙ্গের কাছে একটা ব্যাঙ থাকত। দিনেরবেলায় ভক্তরা শিবের পূজা করে যেত। তারা পূজা করত ফুল মালা আতপ চাল দিয়ে। তারা চলে যাওয়ার পর সেই ব্যাঙ এসে সেই সব খেত। এইভাবে সেই ব্যাঙটি একদিন মনের আনন্দে সেইসব খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল। এমন সময় এক কাক এসে তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। এইভাবে ব্যাঙ গেল কাকের পেটে।
তারপর অনেকদিন কেটে গেল। একদিন এক সুন্দরী মেয়ে এল সেই প্রণবেশ্বর লিঙ্গের কাছে পূজা অর্চনার উদ্দেশ্যে। তার সব সুন্দর, মুখটা কেবল শকুনের মতো। ভাল নাচতে জানে সে, গাইতে পারে, কিন্তু মেয়েটির মুখ এমন হলো কেন? আচার্যরা ভাবতে লাগলেন। ধ্যানের দ্বারা জানতে পারলেন। এটা সেই ব্যাঙ, এক শিবভক্ত পুষ্পবন্ধুর কন্যারূপে সে জন্মেছে, নাম তার মাধবী। পূজার ফুল আর আতপ চাল খাওয়ার পাপে তার মুখটা হয়েছে শকুনের মত।
পূর্বজন্মের সংস্কার বশত শিবালয় মার্জনা করতে লাগল। আর নাচে-গানে শিবকে খুশি করত। প্রণবেশ্বর লিঙ্গই তার ধ্যান জ্ঞান। সব সময়ই শিবের নামগান গেয়ে শিবের পূজা করত। শিব-চতুর্দশী তিথিতে সারাদিন রাত উপবাসে থেকে লিঙ্গ পূজা করে নাচ-গানে কাটিয়ে দিল সারারাত। তারপর প্রভাতের আগেই সেই লিঙ্গ যেন হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আলোতে সবার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আচার্যগণ সকলেই চোখ বন্ধ করে দিলেন। তারপর চোখ খুলে কেউ মাধবীকে দেখতে পেলেন না।
পরবর্তী গর্গাচার্য এইভাবে একটা ব্যাঙ থেকে মাধবী ও তার জীবনের মুক্তিলাভের কাহিনি বর্ণনা করলেন। দমনকে বললেন– আমি বিশ্বাস করি, প্রণবেশ্বর শিব তোমার বাসনা পূর্ণ করবেন। তুমি বারাণসীতে গিয়ে সেই শিবলিঙ্গের উপাসনা কর। আমিও তোমার সঙ্গে যাব। তারপর তাঁরা দুজনেই চললেন বারাণসীর সেই প্রণবেশ্বর লিঙ্গের কাছে। লিঙ্গ দেখে দমন তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ল। তারপর গুরুদেব গর্গাচার্যের উপদেশ মতো সাধনা শুরু করল। অনেকদিন পর একদিন দমনও মাধবীর মত মুক্তি পেল।