অজ্ঞানে শিবরাত্রি পালনের ফল
এক বনে এক হিংসুক ব্যাধ বাস করত, সে মৃগ হত্যা করত। আবার চুরিও করত। সে জীবনে কখনো ভালো কাজ করেনি। কেবল পাপ করেছে।
একদিন শিবচতুর্দশী মহাতিথি এল, ব্যাধ ওসবের কিছুই জানে না। সকাল হতেই সে বেরিয়ে পড়ল শিকারে। সেদিন তার ঘরে খাবার কিছুই ছিল না, তাই না খেয়ে বেরিয়ে গেল বনের ভেতরে। সেদিন তার ভাগ্যে একটাও শিকার জুটল না। বনে ঘুরে ঘুরে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল তখন তার খেয়াল হল যে সে সারাদিন ঘুরে একটাও শিকার পায় নি। ঘরে খাবার নেই তাই বাচ্চারা না খেতে পেয়ে কত কষ্ট পাচ্ছে! যত রাত্রি তোক শিকার করে তবেই সে ঘরে ফিরবে।
ঘুরতে ঘুরতে একটা জলাশয় দেখতে পেল। মনে ভাবল, হরিণ নিশ্চয়ই জল খেতে আসবে, তখনই শিকার করব। কিন্তু যদি বাঘ আক্রমণ করে, তাহলে কি করব? এই চিন্তা করে, যদি তেষ্টা পায়, তাই খানিকটা জল নিয়ে জলাশয়ের কাছাকাছি একটা বেলগাছে চড়ে বসল। সব সময় সে জলাশয়ের পাশে কোন জঙ্গলের মধ্যে বসে অপেক্ষা করাতে নিরাপদ বলে মনে করল না। তারপর ভাবল, অপেক্ষা করার সময় লক্ষ্য করছে কখন কোন্ প্রাণী আসছে। সারাদিন তার কোন খাবার জোটেনি, তবুও রাত্রিতে গাছে বসে থাকল।
হঠাৎ ব্যাধ দেখতে পেল একটা হরিণ লাফাতে লাফাতে সেই জলাশয়ের দিকে আসছে, তাকে দেখে ব্যাধ আনন্দে ধনুকে শর যোজনা করল। এই সময় নড়াচড়ার ফলে একটু জল নীচে পড়ল। সেই সাথে গাছের শুকনো পাতাও নীচে পড়ল। সেই গাছের নীচে ছিল শিবলিঙ্গ, সেই জল আর পাতা পড়ল শিবলিঙ্গের উপর। এইভাবে অজ্ঞাতসারে ব্যাধের দ্বারা প্রথম প্রহরের শিবপূজা সম্পন্ন হল। শিব সেই ব্যাধের সকল পাপ নাশ করলেন।
তখন সেই হরিণী দূর থেকে ব্যাধকে গাছের ডালে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে গেল। আর ব্যাধকে বলল–হে ব্যাধ, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমায় বধ করবে? ব্যাধ হরিণীর মুখে মানুষের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। তারপর বলল–তুমি ঠিক বলছো। আমার বাড়িতে আজ সকলে ক্ষুধার্ত। তোমাকে মেরে ক্ষুধা নিবারণ করব।
তখন সেই হরিণী বলল, আজ আমার পরম সৌভাগ্য। আমার বৃথা এই মাংসে যদি কারুর ক্ষুধা নিবারণ হয় আমি ধন্য হব। ইহলোকে পরোপকারীর যে পুণ্য কোন লোক তা শত বছরেও বলতে পারে না, কিন্তু আমার ঘরে অনেক বালক-সন্তান আছে, তাদেরকে আমার ভগ্নী ও স্বামীর কাছে রেখে আমি আবার এখানে ফিরে আসব, তখন তুমি আমায় বধ কোরো।
ব্যাধ বলল–বিপদে পড়লে এরকম কথা সকলে বলে। তখন হরিণী বলল–আমি সত্যই বলছি, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমি যদি পুনর্বার এই স্থানে ফিরে না আসি তাহলে ব্রাহ্মণ বেদ বিক্রী করলে, ত্রিকালে সন্ধ্যা না করলে যে পাপ হয় সেই পাপ আমার হবে। স্বামীর আজ্ঞা লঙ্ঘন করলে স্ত্রীর যে পাপ হয়, আপন কর্ম লঙ্ঘন করলে সে পাপ হয়। এই সব পাপে আমি লিপ্ত হব।
এসব শুনে ব্যাধ বলল, যাও তুমি ঘরে যাও কিন্তু ফিরে এসো।
তখন হরিণী আনন্দে জল খেয়ে ঘরে ফিরে গেল, কিছুক্ষণ পরে সেই হরিণীর ভগ্নী আর একটি হরিণী তার খোঁজ করতে সেখানে এল। ব্যাধ তাকে দেখে মনের আনন্দে ধনুক তির জুড়ল। তখন বেলগাছটা একটু নড়ল আর বেলপাতা সহ কিছু জল শিবের মাথায় পড়ল। এই ভাবে ব্যাধের দ্বিতীয়বার শিবপূজা করা হল।
সেই হরিণী ব্যাধকে দেখে বলল, তুমি কি করছ?
ব্যাধ আগের মতই উত্তর দিল। হরিণী বলল–আমি ধন্য হলাম, এতদিনে আমার জীবন সফল হল। সেও আগের হরিণীর মত জবাব দিয়ে বাড়ি যেতে চাইল।
এখন ব্যাধ বলল, আমি কিছুক্ষণ আগে এক হরিণীকে মারতে গেলে সেও একথা বলে পালিয়ে গেছে, তুমিও তেমন চেষ্টা করছ। কিন্তু আমি তোমায় ছাড়ব না, তোমাকে মারবই।
ব্যাধের কথা শুনে হরিণী বলল, যদি আমি ফিরে না আসি তাহলে যে পুরুষ পতিব্রতা স্ত্রীকে ত্যাগ করে অন্য স্ত্রীতে আসক্ত হয়, তাতে যে পাপ হয় সে পাপ আমায় ধরবে। বেদবিহিত ধর্মত্যাগে যে পাপ, সেই পাপে লিপ্ত হব আমি। যে বিষ্ণুভক্ত হয়ে শিবকে নিন্দা করে তার যে পাপ হয়, যে মাতা-পিতার মৃত তিথিতে শ্রাদ্ধ না করে তাতে যে পাপ হয়, যে পরের সন্তান সৃষ্টি করে তাকে বঞ্চনা করে যে পাপ হয় সেই সমস্ত পাপ আমাকে আশ্রয় করবে। বিশেষ করে যার বাক্য লঙ্ঘন হয়, তার সকল পুণ্যও নষ্ট হয়ে যায়। পৃথিবী তার পাপে বারবার কেঁপে ওঠে।
ব্যাধ তার কথা শুনে তাকে ঘরে গিয়ে আবার ফিরে আসতে বলল।
হরিণী জল খেয়ে চলে গেল। তারপর ব্যাধ চিন্তা করল–সেই হরিণী দুটো কোথায় গেল? কখন আসবে? এই চিন্তায় ব্যাধ না ঘুমিয়ে দ্বিতীয় প্রহর উপবাসে কাটাল।
তারপরে একটা হরিণ দুটো হরিণীকে খোঁজ করতে সেখানে এলে ব্যাধ আনন্দে নড়েচড়ে বসল। তখন আবার একটু জল আর বেলপাতা পড়ল শিবের মাথায়। এইভাবে তৃতীয় প্রহরে শিবের পূজা হল।
ব্যাধকে দেখে হরিণ জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি করছ? ব্যাধ আগের মত উত্তর দিল। আর হরিণটিও আগের হরিণীদের মত জবাব দিল।
তখন ব্যাধ বলল, আগের দুই হরিণী আমায় কথা দিয়েও ফিরে এল না। তারা আমাকে ঠকিয়েছে। তাই তোমাকে আমি ছাড়ছি না।
ব্যাধের কথা শুনে হরিণ বলল, আমি কখনও মিথ্যা বলি না, সমস্ত চরাচর সত্যের আশ্রয়েই চলেছে। হে ব্যাধ, আমি যদি তোমাকে বঞ্চনা করে পুনর্বার এখানে ফিরে না আসি, তাহলে সন্ধ্যার সময় মৈথুনকালে, শিবরাত্রির দিনে আহার করলে, মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে, গচ্ছিত ধন চুরি করলে যত পাপ হয়, সেইসব পাপ সকলই আমায় আশ্রয় করবে। দ্বিজগণ সন্ধ্যা না করলে যে পাপ হয়, শিব নাম উচ্চারণ না করলে যে পাপ হয়, সক্ষম হয়েও যে পরের উপকার না করে, ব্রতদিনে মৈথুনকারীর যে পাপ হয়, অখাদ্য খেলে যে পাপ হয় সে সকল পাপ আমার দেহেই আশ্রয় লাভ করবে।
ব্যাধ হরিণের কথা শুনে বলল, তুমি এখন যেতে পার। তবে আবার এসো। তখন হরিণ জল খেয়ে চলে গেল। তারপর দুই হরিণী আর একটা হরিণ ঘরে মিলিত হল, পরস্পর পরস্পরের কথা শুনল, পরে তারা বলল–যেহেতু আমরা সত্যপাশে আবদ্ধ আছি, তাই আমাদের ব্যাধের কাছে নিশ্চয় যাওয়া উচিত। এই ভেবে তারা সন্তানদের ছেড়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হল। এখন প্রথম হরিণী হরিণকে বলল–হে স্বামী, বালকেরা কেমন করে পিতামাতা হীন হয়ে বাঁচবে? যেহেতু আমি আগে প্রতিজ্ঞা করেছি সেজন্য আমিই যাব, তোমরা দুজনে এখানে থাক।
তখন দ্বিতীয় হরিণী বলল–আমি তোমাদের দাসী, অতএব তুমি থাক আমি যাই। তারপর হরিণটি বলল–আমি সন্তানের কিছুই জানি না, তোমরা দুজনে থাক, আমি যাই।
হরিণী দুজন হরিণের এই কথা শুনে বলল, বিধবার জীবনে ধিক!
তারপর তারা সন্তানদের আশ্বস্ত করে সহবাসীর কাছে রেখে ব্যাধের কাছে গেল। ব্যাধ এতক্ষণে তাদের অপেক্ষায় পথপানে চেয়েছিল। এমন সময় সেই তিন হরিণ আর হরিণীকে দেখে ব্যাধ আনন্দে ধনুক ধরে তাতে বাণ জুড়ে দিল। ব্যাধের নড়াচড়ায় বেলপাতা ও জল পড়ল। চতুর্থ প্রহরের পূজা সম্পন্ন হল। এদিকে হরিণ সন্তানরা তাদের কি হবে এই ভেবে তাদের পিছু পিছু চলল।
তারপর তারা বলল–হে ব্যাধ, তুমি আমাদেরকেও বধ করে আমাদের মাংস খেয়ে আমাদের জীবন সার্থক কর।
তখন ব্যাধ তাদের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। শিবপূজার ফলে তার দিব্যজ্ঞান জাগল। সে ভাবল–এই জ্ঞানহীন হরিণরাই ধন্য। এরা নিজেদের শরীর দিয়ে পরের উপকার করে আর আমি মানুষ হয়ে কি করলাম। আমি কেবল পরের শরীর নষ্ট করে নিজের দেহের পুষ্টি করি। আমি অন্যকে বহু কষ্ট দিয়ে আজও অন্যের ভরণপোষণ করছি। আমার কি হবে? জীবনের প্রতি ধিক্!
এইভেবে সে তির গুটিয়ে নিল। তারপর বলল–হে মৃগগণ, তোমরাই ধন্য। তোমাদের আমি হত্যা করব না, সন্তানদের নিয়ে নিজেদের ঘরে যাও।
মৃগদল চলে গেল। শিব সেই ব্যাধের প্রতি প্রসন্ন হয়ে দিব্য মূর্তিতে দর্শন দিল এবং বললেন–হে পুত্র, তোমার দ্বারা এই মহাব্রত পালিত হওয়ায় আমি সন্তুষ্ট। কি বর চাও?
ব্যাধ বলল, আমি আপনার দর্শন পেয়ে ধন্য, এই বলে প্রণাম করল।
এখন শিব বললেন–তুমি ‘গৃহ’ নামে প্রসিদ্ধ হবে। এখন মনের ইচ্ছামত সুখ ভোগ কর। মহারাজ দশরথের পুত্র শ্রীরামচন্দ্র তোমার ঘরে আসবেন। তুমি সেই শ্রীরামের পূজা করে মুক্তিলাভ করবে। তোমার পুত্র, পৌত্রেরা আমার পূজা করে বলবান হবে।
এমন সময় মৃগদল শিবের দিব্যরূপ দর্শন করে মৃগযোনি ত্যাগ করে স্বর্গে চললেন।
অজ্ঞানত শিবের এই পুণ্যব্রত সাধন করে ব্যাধ শিবের সাযুজ্য মুক্তিলাভ করল। তাহলে ভক্তিভরে এই ব্রত করলে যে পরম পুণ্য হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।