বণিক গোকর্ণ ও শুকপাখির কাহিনি
মথুরায় বসুকর্ণ নামে এক সম্ভ্রান্ত বণিক ছিল। তার স্ত্রীর নাম সুশীলা। সে বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করেছে। এইজন্য বণিকমহলে তার খুব খ্যাতি। তার রাজার মত সম্পদ ছিল। সে রাজার হালে থাকত। দাস-দাসী কিছুরই অভাব ছিল না। কিন্তু ভগবান সবাইকে সব সুখ দেয় না। বসুকর্ণের যশ, খ্যাতি, অর্থ, সম্পদ ছিল কিন্তু তাদের কেউ বাবা মা বলে ডাকার ছিল না। অর্থাৎ তাদের কোন সন্তান ছিল না। প্রাসাদের মত বাড়ি প্রচুর ঐশ্বর্য কিন্তু তা ভোগ করার কেউ ছিল না। তাদের প্রৌঢ় বয়স তবুও তাদের সন্তান হল না।
একদিন সুশীলা নদীতে স্নান করতে গেছে। সেখানে কত মেয়েই এসেছে। তাদের সকলেরই দু একটা করে ছেলেমেয়ে আছে। মনের আনন্দে তারা জলে ঝপাচ্ছে। সাঁতার কাটছে, জল ছুঁড়োখুঁড়ি করছে, আবার কেউ বা আদর করে ছেলে-মেয়েদের গা ধুইয়ে দিচ্ছে। যত্ন করে স্নান করিয়ে দিচ্ছে।
সুশীলার স্নান করার দিকে মন নেই। সে দেখছে, সেই মেয়েদের আদর যত্ন স্নেহ মাখা ভালবাসা ছেলে মেয়েদের প্রতি। তার মন এইসব দেখে কেঁদে কেঁদে উঠছে। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জল। সে কোনরকমে নদীর জলে একটা ডুব দিয়ে উঠে এল নদীর তীরে। একটা গাছের তলায় বসে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে সে কাঁদতে লাগল।
সেই সময় নদীর পাড়ের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন এক সাধু। গাছতলায় সেই মেয়েটিকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন–কি হয়েছে তোমার? তুমি কাঁদছ কেন?
সুশীলা মুখ তুলে দেখল। কিন্তু সে কোনো উত্তর দিতে পারল না। তার চোখ ভেসে গেল জলে। আবার শুরু করল কাঁদতে।
সাধু বললেন–মাগো তোমার অনেক দুঃখ। তুমি একটা কাজ কর। ওই যে সামনেই গোকর্ণের শিবলিঙ্গ দেখতে পাচ্ছ, ওর পূজা কর। মহেশ্বর যদি খুশি হন তাহলে তোমার মঙ্গল হবে।
এই বলে সাধু চলে গেল। তারপরে সুশীলা যখন মুখ তুলল তখন দেখল সেই ব্যক্তিটি আর নেই। বাড়িতে এসে সুশীলা স্বামীকে সেই সাধুর কথা বলল।
বসুকর্ণ ধর্মপ্রাণ ছিল। তাই তার স্ত্রী সুশীলার কথা শুনে গোকর্ণেশ্বরের পূজার আয়োজন করল মহাধুমধামে। তারা দুজনে মিলে মহেশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালো।
তারপর থেকে তারা নিত্য এসে গোকর্ণেশ্বরের পূজা দিয়ে যান। একদিন তারা শিবের পূজা করে চোখ বুজে তার ধ্যান করছেন, এমন সময় এক জ্যোতি দেখা গেল সেই মন্দিরে। সেই জ্যোতির মধ্যে আবির্ভূত হলেন দেবাদিদেব মহেশ্বর। হাত তুলে বরদান করলেন–তোমাদের মনোবাসনা পূর্ণ হবে।
আনন্দে প্রফুল্লিত হয়ে তাঁরা দুজনে জোড়হাতে প্রণাম করলো শিবকে। তারপরেই সুশীলা গর্ভবতী হলো এবং যথাসময়ে তাঁদের পুত্র হলো। গোকর্ণেশ্বরের কৃপায় এই পুত্র হয়েছে বলে বণিক তার নাম রাখলো গোকর্ণ। তারপর আস্তে আস্তে গোকর্ণ বড় হতে লাগল। লেখাপড়াও শিখল। এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হল।
বসুকর্ণের এখন বৃদ্ধদশা চলছে। ঘরে অনেক সম্পদ থাকায় বাণিজ্যে তিনি আর যান না। কিন্তু বসে বসে খেলে নদীর জলও শেষ হয়ে যায়। তাই বসুকর্ণ গোকর্ণকে বাণিজ্যের সুবিদ্যা শিখিয়ে দিলেন নিজেই। যখন প্রয়োজন হবে বাণিজ্য করতে যেন পারে।
গোকর্ণের বিয়ে হয়েছে অনেকদিন। কিন্তু তার কোনও সন্তান হল না। বৃদ্ধ বসুকর্ণের বড় সাধ নাতি-নাতনিকে নিয়ে একটু আনন্দ করেন। কিন্তু বহুদিন অপেক্ষা করেও যখন তা হল না তখন তিনি আবার তার পুত্রের বিয়ে দিলো। এই ভাবে একে একে পাঁচটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন পুত্রের। কিন্তু যার কপাল খারাপ তার শত স্ত্রীতেও কি করবে?
তারপরে বসুকর্ণ আর গোকর্ণ দুজনেই মন দিলো দান-ধ্যানে। তারা দেশে যত দীন-দুঃখী ছিল সবাইকে দান করলো। কাউকে অর্থ, কাউকে বস্ত্র, আর কাউকে বা গরু, মাঝে মাঝে অন্ন ব্যয়ও করল প্রচুর। এইভাবে বসুকর্ণের সঞ্চিত অর্থ শেষ হতে থাকে।
গোকর্ণ দেখলো এবার বাণিজ্যে না গেলে আর সংসার চলবে না। তাই তিনি জিনিস নিয়ে নৌকায় বাণিজ্যে গেলো। পাঁচ স্ত্রীকে রেখে গেলো বাবা-মার সেবার জন্য।
তিনি বহুদেশ ঘুরে ঘুরে বাণিজ্য শুরু করলো। তিনি অর্থ লাভ করলেন। এবার তার বাড়ি ফেরার পালা। নৌকা মথুরার দিকে ফিরতে লাগল। নৌকার সামনের দিকে পাটাতনে বসলো গোকর্ণ এবং দু দিকের শোভা দেখতে দেখতে চললো। হঠাৎ এক জায়গায় গোকর্ণ মাঝিদের বললো–এইখানে নৌকা নোঙর কর। আমি নামব।
নৌকা বাঁধল মাঝিরা, গোকর্ণ নামলো। নদীর পাশেই একটি সুন্দর পাহাড় ছিল, কত সুন্দর গাছ। ছিল যা দেখে মন ভরে যায়। তিনি পায়ে পায়ে কিছুদুর চলে গেল। এক জায়গায় এক পাহাড়ী সৌন্দর্য দেখে গোকর্ণ দাঁড়িয়ে পড়লো।
এমন সময় তাঁর পিছন দিক থেকে যেন কেউ বলল–ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে কেন? আসুন আমার ঘরে, আপনি আমার অতিথি, আমার কি সৌভাগ্য।
গোকর্ণ চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালো। কে এমন করে ডাকছে তাকে? তিনি দেখলো একটা ঝুপড়ি ঘর। এবং খাঁচার মধ্যে একটা শুকপাখি এবং সেখানে কোন মানুষকে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কার গলার স্বর সে শুনল?
গোকর্ণ অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। তখন তিনি আবার শুনতে পেলেন কেউ যেন বলছে– অতিথি দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। আপনি ভিতরে এসে বসুন, এখানে আসন পাতা আছে আর সামনে ঢাকনা চাপা দেওয়া আছে খাবার। আপনি ইচ্ছামতো আহার করতে পারেন, মা-বাবা বাইরে গেছেন। তারা এলে আপনার সেবা করবে।
গোকর্ণ বুঝতে পারলো যে এই কথাগুলো খাঁচার ভিতরে থাকা শুকপাখিটিই বলছে। সে আরও অবাক হয়ে গেল কেমন করে পাখিটা নীতিকথা শিখল?
গোকর্ণ আনন্দের সঙ্গে এগিয়ে গেলো খাঁচার দিকে। তারপর জিজ্ঞাসা করল তুমি দেখতে একটা পাখি। আসলে তুমি কে? তোমার আসল পরিচয় কি বল? এখন তুমি যদি সত্যি পরিচয় না দাও তাহলে আমি তোমার অতিথি হতে পারব না।
শুকপাখি বলল–অতিথি ফিরে গেলে আমাদের অমঙ্গল হবে। তাই আমি আমার পরিচয় তোমাকে বলছি শোন।
আমি জাতিস্মর তাই আমার পূর্বজন্মের কথা সব মনে আছে। পূর্বজন্মে আমার নাম ছিল শকোদর। আমি ছিলাম মহর্ষি বামদেবের শিষ্য, তাঁরই আশ্রমে থাকতাম বিদ্যার্জনের জন্য। সেই গুরুদেবের কাছে বহু দেবর্ষি, মহর্ষি, আর রাজর্ষিরাও শাস্ত্র আলোচনার জন্য আসতেন। সেখানে মার্কণ্ডেয়, ভরদ্বাজ, অঙ্গিরা, ভৃগু প্রভৃতি ঋষিরা আসতেন।
আমার গুরুদেবের কাছে যেসব মুনি ঋষিরা আসতেন, তাদের শাস্ত্র আলোচনার মাঝে আমি ফোড়ন কাটতাম। গুরুদেব আমাকে শাসন করতেন। বলতেন, সন্মানীয় ব্যক্তিদের কথার মাঝে কথা বলতে নেই। তর্ক করার একটা নিয়ম আছে। আমি তখনকার মত গুরুদেবের নিষেধ মানলেও আবার পুনরায় তর্ক শুরু করে দিতাম।
আমাকে অবাধ্য হতে দেখে গুরুদেব অভিশাপ দেন–যা তুই শুকপাখি হয়ে পরের জন্মে জন্মাবি।
এই অভিশাপ বাক্য শুনে সেখানে উপস্থিত মুনি ঋষিরা হায় হায় করে উঠলেন। এইটুকু বালক সে কীই বা দোষ করেছে। তাকে এমন অভিশাপ দেওয়া উচিত হয়নি। আপনি এই অভিশাপ ফিরিয়ে নিন।
মহর্ষি বামদেব বললেন–অভিশাপ কখনও ব্যর্থ হবে না। তবে অমি আশীর্বাদ করছি–পাখি হয়েও তুমি মানুষের মতো কথা বলতে পারবে আর এ জন্মে যা জ্ঞান অর্জন করেছো, সব তুমি মনে রাখতে পারবে। আর তুমি মথুরায় মারা গেলে মুক্তি পাবে।
তারপর থেকেই শুরু হয় আমার পাখির জীবন।
একদিন একটা ব্যাধ আমাকে ধরে খাঁচায় পুরল। তারপর থেকে এই ব্যাধের কুটিরে আছি।
গোকর্ণ বলল–আমার, মথুরায় বাড়ি। বাণিজ্য সেরে আমি বাড়িতে ফিরছি। তুমি কি আমার সঙ্গে মথুরায় যাবে?
অতিথির মুখে এই কথা শুনে শুক খুব প্রফুল্লিত হল। বলল– হায়, তেমন সৌভাগ্য কি হবে আমার? এখানকার বাবা, মা কি আমায় ছাড়বে? যদি আমাকে নিয়ে যাও, আমি তোমার ছেলে হয়ে থাকব।
এমন সময় বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ব্যাধের বউ। এতক্ষণ সে ভিতরে ঘুমাচ্ছিল।
তাকে দেখে শুক বলল–মাগো আজ আমাদের বাড়িতে অতিথি এসেছেন। তুমি হাত-মুখ ধোওয়ার জল দাও, আর কিছু ফলমূল খেতে দাও।
শবরী অতিথিকে সমাদরে ঝুপড়ির ভিতরে নিয়ে গেল আসনে বসতে দিল। একটা পাথরের থালায় খাবার সাজিয়ে দিল। গোকর্ণ খেতে শুরু করল, এমন সময় ব্যাধ শুকপাখি শিকার করে ঘরে ফিরল। তাকে দেখে শুক বলল–বাবা আজ আমাদের কি সৌভাগ্য, আমাদের ঘরে অতিথি এসেছে।
অতিথিকে ঘরে ঢুকে দেখল শবর। তারপর তালপাতার পাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগল। খাওয়া শেষ হলে হাতে জল ঢেলে দিল হাত মুখ ধোওয়ার জন্য। অতিথি সেবা করে সে খুব খুশি হল।
তারপরে শবর অতিথিকে বললেন–আমরা মূর্খ গরীব মানুষ। আপনার ঠিকমত সেবাযত্ন করতে পারিনি। তবু বলুন, আপনার জন্য আমরা কি করতে পারি?
গোকর্ণ ব্যাধের কথা শুনে বলল–তোমাদের সেবায় আমি খুব খুশি হয়েছি। তবে আমার একটা প্রার্থনা আছে যদি অভয় দাও তো বলি।
ব্যাধ বলল–কি আপনার প্রার্থনা। গোকর্ণ বললেন–তোমাদের এই শুকপাখিটিকে দেখে আমার খুব ভাল লেগেছে। যদি আমাকে দাও, তাহলে খুশি হবো।
অতিথিকে না বললে মহাপাপ হবে। কিন্তু এই পাখিটি আবার তাদের কাছে অতি আদরের। তবু পাখিকে দিয়ে দিল গোকর্ণের হাতে। পাখিটিকে পেয়ে গোকর্ণ মনে করলেন তিনি যেন অমূল্য কোন ধন হাতে পেয়েছেন। তিনি মনের আনন্দে নৌকায় ফিরে এলেন। নোঙর তুলে দেওয়া হল, পালও তুলে দেওয়া হল। নৌকা চলল মথুরার দিকে। যথাসময়ে নামল মথুরার দিকে। তিনি তাড়াতাড়ি করে পৌঁছলেন নিজের ঘরে। প্রথমে বাবা ও মাকে প্রণাম করলেন, এবং শুকপাখিকে দেখিয়ে বললেন–দেখ বাবা, দেখ মা, এটা একটা শুকপাখি। এ মানুষের মত কথা বলে। এখন এই আমার ছেলে। আর আমার দুঃখ নেই।
শুক বলল–হ্যাঁ দাদু, ঠাকুমা, আমি আপনাদের নাতি।
গোকর্ণ বাণিজ্য করে অনেক সম্পদ এনেছেন। তিনি আবার দান করতে শুরু করলো। শুকপাখি বেশিরভাগ সময় থাকত দাদু-ঠাকুমার কাছে। সে বুড়ো বুড়িকে নানা শাস্ত্রকথা পুরাণ কাহিনি শোনাতে লাগল। তার কণ্ঠ মধুর ছিল। শাস্ত্রকথা শুনে তাঁদের খুব ভাল লাগল। সংসারে পুত্রের যে অভাবের জন্য একটা দুঃখ ছিল, সেই দুঃখ আস্তে আস্তে কেটে গেল। বেশ আনন্দেই দিন কাটতে লাগল। শুক এখন খাঁচায় বন্দি থাকে না। সে স্বাধীনভাবে থাকে। যেখানে খুশি উড়ে বেড়ায়।
মথুরানগরে অনেক রত্ন ব্যবসায়ী আছে। গোকর্ণ পাকা জুহুরী, তিনি কোনও রত্ন দেখলে বলে দিতে পারতেন সেই রত্নটি আসল না নকল এবং তার দামও নির্ধারণ করে দিতেন। তাই সকল রত্ন ব্যবসায়ী নকল রত্ন কিনে ঠকে যেত। তাই তারা সবাই ঠিক করল, এবার যখন তারা রত্ন কিনতে বিদেশে যাবে, তখন তারা সঙ্গে গোকর্ণকে নেবে। তাদের প্রস্তাবে গোকর্ণ রাজী হয়ে গেলেন। তিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চললেন নৌকায় চড়ে, সঙ্গে নিলেন তার সখের শুকপাখিটিকে। বাতাসের জোরে নৌকা চলল তাড়াতাড়ি; বহুদূর চলে গেল নৌকা। নৌকাটি গিয়ে পড়ল একেবারে লবণ সমুদ্রে, এই প্রথম নয়, ইতিপূর্বে অনেকবার লবণ সমুদ্রে তারা এসেছে।
একদিন হঠাৎ ভীষণ ঝড় উঠল। নৌকা ভীষণভাবে টাল খাচ্ছে, যে কোন সময় ডুবে যেতে পারে। মাঝি-মল্লারা নৌকা সামলাতে পারছে না। হাল-দাঁড় সব ছেড়ে দিয়ে কেবল বলতে লাগল, হে মধুসূদন, রক্ষা কর, রক্ষা কর।
কিন্তু ঝড় আর থামে না। নাবিক ও বণিকরা ভাবল–এ যাত্রায় কেউ রক্ষা পাবে না। বণিকদের মধ্যে একজন বলল–এবারে আমাদের মধ্যে নিশ্চয় কোনও মহাপাপী আছে। তা না হলে এতোবার আমরা এখান দিয়ে গেছি এসেছি, আগে তো এমন হয়নি। তাকে এক্ষুনি সমুদ্রে ফেলে দাও।
কথাটা শোনামাত্রই গোকর্ণের বুকটা কেঁপে উঠল। তার মনে হল তাকে উদ্দেশ করে বলছে সবাই। মনে মনে গোকর্ণ নিজেকে পাপী মনে করেন। তার কারণ পাপী না হলে ছেলের মুখ দেখতে পেলেন না কেন তিনি? মহাপাপী বলেই তিনি আজ পুত্রহীন। ভাবতে ভাবতে গোকর্ণ বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। কোলের উপর বসেছিল শুক। তার গায়ে হাত বুলাতে লাগলেন।
গোকর্ণের মনের কথা শুক বুঝতে পারল। বলল–তুমি কিছু চিন্তা করো না। আমি বুঝতে পারছি তোমার বিপদের কথা। তুমি শ্রীহরির শরণ নাও। আর আমি দেখছি কি করা যায়।
শুক উড়ে গেল আকাশে, দুরন্ত ঝড়ের গতির মধ্যে ছোট্ট শুক টাল খেতে লাগল। সে কিছুক্ষণ যাওয়ার পরে দেখল একটা পাহাড়। আর তারই উপরে একাট বিষ্ণুমন্দির সেখানে ঝড়-ঝঞ্ঝা কিছুই নেই।
সেই মন্দিরে শুক থামল। সে চুপি চুপি করে মন্দিরের ভিতরে ঢুকে পড়ল। মন্দিরে চতুর্ভুজ মূর্তি দেখে প্রণাম করল। তারপর সে দেখল সেখানে কয়েকটা মেয়ে এল। যাদের হাতে ফুলের মালা ছিল, আবার কারো হাতে ফুল, কারো হাতে ফল-মূল। তারা এসে সেগুলো শ্রীবিষ্ণুর চরণে দিলো। এবং আনন্দে নাচ গান করে চলে গেল।
তারপর শুক দেখল বিশাল বড় বড় জটায়ু পাখি সেখানে উপস্থিত হল। তাদের মধ্যে একজন ছোট শুককে দেখে জিজ্ঞাসা করল–এইটুকু পাখি তুমি কেমন করে সমুদ্রে পেরিয়ে এখানে এলে।
জটায়ুর আদর স্নেহ মাখা কথা শুনে শুকপাখির সাহস সঞ্চয় হল এবং সে সব কথা বলল–কেমন করে তার বাবা বিপদের মধ্যে পড়ে আছে।
জটায়ুর মধ্যে একজন বলল, আমি তোমার বাবাকে পিঠে করে এখানে নিয়ে আসতে পারি। তোমার বাবাকে চিনব কেমন করে? তুমিও আমার সঙ্গে চল।
তারপর জটায়ুকে নিয়ে চলল শুক সেই নৌকার দিকে। জটায়ু সেই নৌকার পাশে সমুদ্রের জলে ভাসতে লাগল। আর শুক গোকর্ণের কানে কানে বলল–বাবা, আর দেরী নয়, ওই জটায়ুর কাঁধে চড় ও তোমাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবে।
শুকের কথামতো গোকর্ণ নৌকা থেকে ঝাঁপ দিলেন এবং চড়ে বসলেন জটায়ুর পিঠে। তারপর জটায়ু উড়ল আকাশে। বেশ কিছুক্ষণ পরে তারা পৌঁছে গেল সেই পাহাড়ে, যেখানে বিষ্ণুমন্দির আছে।
এখানে ঝড়ের লেশ নেই। মন্দিরের পাশে একটা সরোবর আছে। তার জল পরিষ্কার ও স্বচ্ছ। শুঁকের কথামতো গোকর্ণ সেই সরোবরে স্নান করলেন। এবং তারপরে মন্দির প্রদক্ষিণ করলেন। তারপর ঢুকলেন মন্দিরের ভেতরে। দেখলেন বিষ্ণুমূর্তির সামনে বসে আছে এক সুন্দরী ফুলপরী, আরও কতকগুলি ফুলপরী গান গেয়ে গেয়ে নাচছে। কি অপূর্ব সেই নাচ আর গান। দেখলে ও শুনলে প্রাণ যেন জুড়িয়ে যায়।
নাচ-গান বন্ধ হওয়ার পরে মেয়েটি ওদের মধ্যে থেকে একজনকে ডেকে বলল গোকর্ণ খুব ক্ষুধার্ত। আগে ওর জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা কর।
তারপরে সেই মেয়েটি গোকর্ণকে নানান খাবার খাওয়াল। তারপরে ফুলপরী সব সেখান থেকে চলে গেল। যাবার আগে সেই মেয়েটি গোকর্ণকে বলল–তুমি এই মন্দিরেই থাক আর নিত্য নিত্য শ্রীবিষ্ণুর পূজা কর। একদিন না একদিন তোমার মনের বাসনা পূর্ণ হবে।
সবাই চলে গেল। সেখানে থাকল কেবল গোকর্ণ আর শুকপাখি। ফুলপরীর কথামতো গোকর্ণ নিত্য নারায়ণের পূজা করে। আর প্রতিদিন সেইসব ফুলপরীরাও আসে নৃত্য-গীত করতে, তারপরে তারা চলে যায়। তারা যে কোথা থেকে আসত তা গোকর্ণ জানতে পারে না।
এদিকে গোকর্ণ চলে আসার পর সামুদ্রিক ঝড় ধীরে ধীরে শান্ত হল। সূর্য উঠল। বণিক ও নাবিকরা স্বস্তি পেল। তারা যেন নবজীবন লাভ করল। কিন্তু গোকর্ণ কোথায়? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না। সেকি তাহলে নৌকার ছাউনির বাইরে গিয়েছিল? জোরে নৌকা দোলার জন্য হয়তো সমুদ্রে পড়ে গেছে। সে চিৎকার করে আমাদেরকে ডাকলেও ঝড়ের দাপটে আমরা শুনতে পাইনি। আমরা বাড়ি ফিরে গিয়ে তার মা-বাবার কাছে কি করে এই খবর দেব? তারপর নাবিকরা দিক ঠিক করে চলল। তারা গিয়ে ঠেকল এক দ্বীপে। নৌকা নোঙর ফেলল। সেই দ্বীপে রাশি রাশি রত্ন, যার যত ইচ্ছা করে, সে তত থলে ভর্তি করে নিল। তারপর তারা মনের আনন্দে মথুরায় ফিরল।
গোকর্ণের বাবার কাছে গেল বণিকরা। অকপটে সব কথা স্বীকার করল তারা। গোকর্ণ কোথায় কিভাবে আছে তারা কেউ জানে না। খুব দুঃখ প্রকাশ করে তারা প্রত্যেকেই কিছু কিছু রত্ন বসুকর্ণকে দিয়ে চলে গেল।
পুত্রের খবর পেয়ে বাবা-মা কেঁদে অস্থির। সেই সঙ্গে তার পাঁচ স্ত্রীও কান্নায় ভেঙে পড়ে। এমন সময় সেখানে শুকপাখি এসে হাজির হয়। এবং সে খবর দেয়–কয়েকদিন বিষ্ণুমন্দিরে কাটাবার পর গোকর্ণ তার মা-বাবা ও পত্নীদের জন্য মন চঞ্চল হয়ে পড়ে।
গোকর্ণকে চিন্তিত দেখে শুক বলল–বাবা, এই বিশাল সমুদ্র, আর আমি একটা ছোট্ট পাখি। নয়তো আমিই তোমাকে পিঠে করে নিয়ে যেতে পারতাম। এখন আর সেই জটায়ুও আসে না। তাহলে তাদেরকে বলা যেত। তোমার জন্য দাদু ও ঠাকুরমা খুব চিন্তা করছে। আমি বরং একা গিয়ে খবরটা দিয়ে আসি।
গোকর্ণের মন কিছুতেই চাইছে না। তবুও মা-বাবার কথা ভেবে রাজী হয়ে যায়। তারপর শুক উড়তে উড়তে চলে আসে মথুরায়। সব কথা খুলে বলে। পুত্র বেঁচে আছে শুনে বাড়ির সকলেই স্বস্তি পেল। কিন্তু তাকে কোনদিন দেখতে পাবে কিনা তা নিয়ে তাদের সন্দেহ হতে থাকে। তাই তাদের মনে দুঃখ লেগেই থাকে।
বসুকর্ণ শুককে আর ছাড়ল না। নিজের কাছে রেখে দিল। তারা তার মুখ থেকে ধর্মকথা শুনতে থাকে এবং পুত্রের বিরহ কিছুটা ভোলার চেষ্টা করে।
এইভাবে তেরোটা দিন কেটে গেল। এদিকে গোকর্ণ নিত্য বিষ্ণুপূজায় রত আর সেই ফুলপরীরাও সেখানে এসে পূজা করে চলে যায়। কিন্তু গোকর্ণ লক্ষ্য করলেনসেই পরীদের দেহের সৌন্দর্য যেন হারিয়ে গেছে। তারা যেন ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। তার নিজের শরীরও ক্রমে ক্রমে ক্ষীণ হচ্ছে এর পিছনে একটা কারণ আছে। আত্মীয়স্বজনদের ছেড়ে থাকতে মন চাইছে না। আর তাদের সাথে কোনদিন দেখা হবে সে আশাও নেই।
কিন্তু এদের অবস্থা এরকম কেন?
সেই পরীদের প্রধানা বললেন–আমরা স্বর্গলোক থেকে এখানে প্রত্যেকদিন এসে বিষ্ণুপূজা করি। আমাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে। আর এখানে আসতে পারব না। সেই দুঃখে আমাদের এই অবস্থা।
গোকর্ণ জিজ্ঞাসা করলেনকেন তোমরা আসতে পারবে না?
সেই রমণী বলল–এখানে বিষ্ণুর যারা সেবাইত, তারা খুব ভাল, এই মন্দিরের চারপাশে কি সুন্দর সুন্দর ফুলগাছ আর ফলের গাছ ছিল। যা দেখে আমরা নিত্য আসতাম। এখানে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে আনন্দ করতাম। কিন্তু সেই সব সেবাইতদের নিষেধ সত্ত্বেও রাজার লোকেরা এসে সেইসব গাছ। কেটে ফেলেছে। যার আকর্ষণে আসতাম তা যখন নেই, তাহলে আর আসব কেন?
তাদের কথা শুনে গোকর্ণ খুব দুঃখ পেলেন, তারপর বললেন–তোমরা যদি আর না আস, তাহলে আমি একা থাকব কেমন করে?
মেয়েটি বলল–তুমি দেশে ফিরে যাও।
গোকর্ণ বললেন–কেমন করে যাব? সে যে অনেক দূর।
মেয়েটি বলল তোমার দেশের নাম কি?
গোকর্ণ বললেন–মথুরা।
শুনেই মেয়েটি চমকে উঠল। তারপর জিজ্ঞেসা করল–কেমন করে এখানে এলে?
তখন তাদের সব কথা বলল গোকর্ণ।
মেয়েটি বলল–মথুরায় যাওয়ার জন্য আমাদের খুব ইচ্ছা। গোকর্ণ, তুমি যদি যেতে চাও, আমরা সে বন্দোবস্ত করে দিতে পারি। তোমার সঙ্গে আমরাও যাব। তবে আমরা স্বর্গের পরী। তাই সকলের সামনে বেরোতে পারবো না।
মেয়েটির কথাতে গোকর্ণ রাজী হলেন। অনেকদিন বাবা-মা আর পত্নীদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি, তাই তার মন আনচান হতে লাগল। তিনি সেখানে যেতে পারবেন অর্থাৎ মথুরায় সেকথা ভেবে তিনি আনন্দিত হলেন।
এমন সময় দেখতে পেলেন এক সুন্দর বিমান আকাশ থেকে নামছে। সেই রথটি মণি মাণিক্য খচিত নানা রঙের ফুল দিয়ে সাজানো। তার মধ্যে কত নামী-দামী বহু সামগ্রী।
মেয়েটি গোকর্ণকে বলল–এই যে বিচিত্র জিনিসগুলো দেখছ ওগুলো তোমাদের রাজার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। এখনি এস এই বিমানে করে মথুরায় যাই।
সেই বিমানে ফুলপরীদের সঙ্গে গোকর্ণও বসলেন। তারপর আকাশের মধ্য দিয়ে যেতে শুরু করল সেই দিব্য বিমান। সুবিশাল সমুদ্র পার হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে সেই বিমান এসে উপস্থিত হল মথুরায় রাজপ্রাসাদের সামনে।
বিমান থেকে নেমে গোকর্ণ রাজসভায় চলে গেলেন। রাজা মশায়ের খুব আনন্দ গোকর্ণকে দেখে। তার কুশল জিজ্ঞাসা করে আলিঙ্গন করলেন।
তারপর গোকর্ণ বিমান থেকে সেই উপহারগুলো রাজাকে দিলেন। সকলেই গোকর্ণের প্রসংসা করলেন। তারপর গোকর্ণ কেবলমাত্র রাজাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন সেই বিমানের কাছে। ফুলপরীরা বিমান থেকে বেরিয়ে এল। রাজার বিমানে চড়ে মথুরা দর্শন করানোর জন্য গোকর্ণকে ধন্যবাদ জানিয়ে, ধীরে ধীরে সেই বিমান অদৃশ্য হয়ে যায়।
গোকর্ণের এই কীর্তি দেখে রাজা তাঁকে ধন্যবাদ দিলেন এবং তাঁর রাজ্যের একাংশ দান করেছিলেন। এবং গোকর্ণ হল মথুরার দ্বিতীয় রাজা।
তারপরে গোকর্ণ গেলেন মা-বাবার কাছে। তাঁদেরকে প্রণাম জানিয়ে সে সব বললেন। গোকর্ণকে ফিরে পেয়ে তাঁদের আর আনন্দের সীমা থাকে না। গোকর্ণকে দেখবার জন্য আত্মীয়স্বজন সবাই ছুটে এল। মথুরাতে যেন আনন্দের হাট বসে গেল।
গোকর্ণ শুককে নিয়ে আদর করতে লাগলেন, চুমু খেলেন। তারপর সে সবাইকে বললেন–আমাকে সব বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছে আমার এই ছেলে শুক।
গুরুদেব বামদেবের অভিশাপের দিন এবার শেষ। আশীর্বাদ অনুসারে মথুরায় মৃত্যুতে শুঁকের হল মুক্তি।
তারপরে গোকর্ণের পাঁচ পত্নীর গর্ভে অনেক সন্তান জন্মাল। সকলেই খুব আনন্দিত হল। বসুকর্ণ আর তার স্ত্রী সুশীলার আনন্দের সীমা থাকল না।