বিষ্ণুপুরাণ
অষ্টাদশ পুরাণ সমগ্র অখণ্ড সংস্করণ
উপদেষ্টা– শ্রী নরেশচন্দ্র শাস্ত্রী
সম্পাদনা • পরিমার্জনা • গ্রন্থনা– পৃথ্বীরাজ সেন
মহর্ষি বশিষ্ঠের পুত্র শক্তি। শক্তির পুত্র মহামুনি পরাশর। তিনি ধর্মশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত। মহামুনি মৈত্রেয় তারই শিষ্য। তার মনে জাগে নানা প্রশ্ন, যেমন–এই চরাচর জগৎ কেমন করে সৃষ্টি আর লয় হয়। সমুদ্র-পর্বতের স্থিতি, আকাশের পরিমাণ, সূর্যের অবস্থান, দেবতার বংশ বিস্তার, চতুর্যগের বিবরণ, দেবর্ষির চরিত, ব্যাসদেব দ্বারা বেদের শাখা বিভাগ ইত্যাদি।
সেই সব প্রশ্নের উত্তরে মহামুনি পরাশর বললেন– ভগবান বিষ্ণুর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি করলে, কখনও কোন বিপদে পড়তে হবে না। যদিও বা বিপদ হয় তিনি উদ্ধার করে দেন। ভূল করে পাপ কাজ করলেও তিনি ক্ষমা করে দেন। হরিস্মরণকারীকে যমালয়ে যেতে হয় না। শ্রীবিষ্ণুর মহিমাই এই পুরাণের মূল বিষয়, তাই এর নামকরণ করা হয়েছে বিষ্ণুর পুরাণ।
০১. ঋভু ও নিদাঘের কাহিনি
দেবিকা নদীর ধারে অপূর্ব এক নগর, যার নাম বীরনগর। বহুকাল আগে অগস্ত্য মুনি এই দেশে এসে সেখানে বসতি গড়ে তোলেন। এই দেশেরই এক প্রান্তে বাস করেন নিদাঘ মুনি। তিনি শিক্ষা লাভ করেন ব্রহ্মার পুত্র ঋভুর কাছে। মহা পণ্ডিত তিনি। পণ্ডিতের সকল গুণই তাঁর মধ্যে বর্তমান। গুরুদেবের অনুমতিক্রমেই তিনি বীরনগরে সংসার পাতলেন। প্রাতঃস্নান থেকে শুরু করে পূজা, আহ্নিক, জপ, হোম, শাস্ত্রের অনুশীলন সবই যথাযথ ভাবে পালন করে তিনি সংসার ধর্ম অতিবাহিত করেন।
কাল অতিক্রান্ত হয়, এর মধ্যে বহুদিন গুরু শিষ্যে দেখা হয়নি। নিদাঘের সর্বদা মনে পড়ে গুরুর কথা। গুরুও মনে ভাবেন শিষ্য কেমন আছে–।
নিত্যদিনের মতই নিদাঘ তাঁর করণীয় কাজ শেষ করে অপেক্ষা করছেন। পত্নী রান্না শেষ করেছেন। বিষ্ণুকে ভোগ নিবেদন করে, তারপর অতিথিগণকে আহার দিয়ে তবে নিজেরা আহার করবেন। কিন্তু আজ কোনো অতিথি এল না, অতিথিকে না দিয়ে নিজেদের আহার সম্ভব নয়। দুপুর গড়িয়ে যায়, এমন সময় তারা দেখলেন এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ সেই পথ দিয়ে চলছেন।
নিদাঘ দেখতে পেয়ে তাকে ডেকে আনলেন এবং বললেন, আজ আপনি আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করুন। আজ কোনো অতিথি আসেন নি। তাই আমরা অভুক্তই আছি।
নিদাঘের সাদর অভ্যর্থনা শুনে অতিথি ব্রাহ্মণ বললেন– মধ্যাহ্ন কাল অতীত প্রায়, এখনও আপনারা অভুক্ত, কাজেই আমাকে আতিথ্য গ্রহণ করতেই হবে।
এই কথা বলে অতিথি ব্রাহ্মণ নিদাঘের ঘরে এলেন। নিদাঘ জল দিয়ে অতিথির চরণ ধুইয়ে দিলেন। তারপর আহারে বসালেন।
ব্রাহ্মণ বললেন–তোমাদের বাড়িতে কী কী রান্না হয়েছে? আমার খাওয়ায় একটু বাচ বিচার আছে। যা তা খাদ্য গ্রহণ করতে আমি পছন্দ করি না।
নিদাঘ বললেন– আপনার জন্য কী ব্যবস্থা করব বলুন? বাড়িতে অন্ন, তরকারী, সামান্য ফলমূল আছে। বলুন আপনাকে কী দেব?
ব্রাহ্মণ বললেন– এসবে আমার মন ভরবে না, আমি বরং উঠি। অন্য কোথাও যাই।
নিদাঘ বললেন–এ সব খাদ্যে আপনার যদি তৃপ্তি না হয় বলুন কি জোগাড় করবো? ব্রাহ্মণ বললেন– ক্ষীর, পায়েস, দই, মিষ্টি– এইসব আমার আহার। এ সব যখন তোমার বাড়িতে নেই, তাহলে আমি উঠি।
এই বলে ব্রাহ্মণ আসন ছেড়ে উঠে পড়লেন। হায় হায় করে উঠলেন নিদাঘ, বললেন,–না, না, আপনি যাবেন না, অতিথি অভুক্ত অবস্থায় চলে গেলে গৃহস্থের অমঙ্গল হবে, আপনি অপেক্ষা করুন। এখুনি সব তৈরি করে দিচ্ছি।
তারপর স্ত্রীকে বললেন–অনেক বেলা হয়ে গেল তাড়াতাড়ি সব তৈরি করে দাও।
ব্রাহ্মণ পত্নী আর দেরি না করে ক্ষীর, পায়েসাদি তৈরি করলেন। বহু খাবার তৈরি হল অল্প সময়ে। নিদাঘ পুনরায় ব্রাহ্মণকে আসনে বসালেন। ব্রাহ্মণের পাতে দিলেন প্রচুর পরিমাণ ক্ষীর, মিষ্টি, পায়েস, পিঠে, পুলি। কিন্তু ব্রাহ্মণ অল্প খেলেন, একটু একটু মুখে দিলেন, তারপর উঠে পড়লেন।
ব্রাহ্মণের হাত ধুইয়ে দিলেন নিদাঘ। কর্পূর, এলাচ, সুপারি দেওয়া পান দিলেন ব্রাহ্মণের হাতে। ব্রাহ্মণ সেই পান চিবোতে চিবোতে বিছানায় বিশ্রাম করতে গেলেন।
নিদাঘ জিজ্ঞাসা করলেন– আপনার ক্ষুধার উপশম হয়েছে তো? আহারে তৃপ্তিলাভ করছেন তো? আপনার নিবাস কোথায়? এই পথ ধরে কোথায় যাচ্ছিলেন?
একসঙ্গে বহু প্রশ্ন করে শুনে ব্রাহ্মণ মুচকি মুচকি হাসেন। তারপর উত্তর দিলেন তোমার প্রথম প্রশ্ন হল– আমার ক্ষুধা মিটেছে কিনা? তার উত্তরে বলি- যার ক্ষুধা-তৃষ্ণার বোধ নেই, তার আবার খিদে মেটার প্রশ্ন ওঠে কেমন করে?
ব্রাহ্মণের উত্তর শুনে নিদাঘ আর তার পত্নী তো অবাক, কি বলবেন বুঝতে পারছেন না।
তাই দেখে ব্রাহ্মণ বললেন– তোমরা আমার কথায় অবাক হয়েছে বলে মনে হচ্ছে? যে মনে করে দেহাদি রয়েছে, তখন তার খিদে পাওয়ার কথা। শরীরের দিকে যার মন নেই, তার তো ক্ষুধা-তৃষ্ণাও নেই। আমি ওই দ্বিতীয় শ্রেণীর।
তোমার দ্বিতীয় প্রশ্ন- ভোজন করে আমি তৃপ্তি লাভ করেছি কিনা? তার উত্তরে বলি- তোমার দেওয়া অন্ন, ব্যঞ্জনাদি না খেয়ে আমার মনোমত আহার গ্রহণ করেছি, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমার তৃপ্তি লাভ করার কথা। আচ্ছা তুমি বল, ভাল খাবার আর মন্দ খাবার বলে জগতে কি কিছু আছে? যখন খুব খিদে পায় তখন ভালো-মন্দের বিচার থাকে না। সকল আহারই তৃপ্তিদায়ক লাগে। আর যদি পেট ভর্তি থাকে তখন যে কোন সুস্বাদু খাবারই তৃপ্তি জনক লাগে না।
এখন প্রশ্ন হতে পারে তাহলে আমি, ভাল ভাল খাবারের কথা বললাম কেন? সেটা কেবল তোমাদেরকে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য।
অতিথি ব্রাহ্মণের কথা শুনে নিদাঘ খুব আশ্চর্য বোধ করলেন।
ব্রাহ্মণ আবার বললেন– তোমার তৃতীয় প্রশ্ন আমার বাড়ি কোথায়? তার উত্তরে বলি, এই যে তুমি আজ এই ঘরটাতে বাস করছ এটা কার? আজ বলবে–এটা তোমার। কিন্তু যখন তুমি এখানে থাকবে না, তখন অন্য কেউ বাস করবে। তাহলে প্রকৃতপক্ষে মরণশীল কোন জীবেরই কোন ঘর নেই, ভগবান যখন যাকে যে ঘরে থাকতে দেবেন, তখন সে সেই ঘরেই থাকবে। আমরা এই সব গৃহের গৃহকর্তা নই, ভাড়াটে বলতে পার।
আসলে আমাদের প্রত্যেকের দৃষ্টি আলাদা। তুমি আমাকে একরকম দেখছ, আর আমি তোমাকে অন্যরকম দেখছি, জগতে সকল জীবেরই দৃষ্টি আলাদা। তাই এত বিভ্রান্তি, এত অশান্তি, এত গন্ডগোল। বাইরের শরীরটাকে না দেখে আমাদের ভেতরটাকে দেখো, তখন বুঝতে পারবে আমরা সবাই সেই এক বাসুদেবেরই অংশ।
অতিথি ব্রাহ্মণের মুখে এমন সব আধ্যাত্মিক তত্ত্বকথা শুনে স্থির থাকতে পারলেন না নিদাঘ। ঝড়ে গাছ পড়ার মত লুটিয়ে পড়লেন অতিথির চরণতলে। তখন ব্রাহ্মণ তাকে স্নেহ ভরে তুলে বললেন–নিদাঘ আমি তোমার গুরু, বহুদিন হল আমার তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি, তাই একবার দেখতে এলাম, তুমি কেমন আছো। সুখে আছ জেনে খুব ভাল লাগল। আর অতিথি সেবা- সে তো নিজের চোখেই দেখলাম! এখন আমি আসি, ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন।
এইকথা বলে গুরুদেব বিদায় নিলেন। এরপর অনেকটা সময় কেটে গেল। দেবিকা নদীর তীরে বীর নগর এখন আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। নিদাঘের পোবন আজও বিদ্যমান।
বহুদিন পরে গুরুদেব ঋভুর আবার মনে পড়ল প্রিয় শিষ্য নিদাঘের কথা। তিনি চললেন এক ব্রাহ্মণের বেশ ধরে। উপস্থিত হলেন বীরনগরে। দেখলেন–সারা দেশ জুড়ে এক মহান উৎসব। কত হাতী, কত ঘোড়া, কত পতাকা, কত লোক তার সীমা নেই। সবার পরণে নতুন পোশাক ঝলমল করছে। নানারকম বাজনা বাজছে। ছদ্মবেশী মুনি ঋভু সেই মহা কোলাহলের মধ্যে নিদাঘকে খোঁজ করছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছেন, হঠাৎ দেখতে পেলেন পথের ধারে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে এক বোঝা কাঠ নিয়ে। তার মুখটি দেখেন শুকনো। তার মনে কোনো আনন্দ নেই। ঋভু তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন–সবাইকে আজ আনন্দে মেতে উঠতে দেখছি, কিন্তু তুমি এমন মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
ঐ ব্যক্তি নিদাঘ। তিনি বললেন, ওই সব হৈ চৈ আমার ভাল লাগে না। তাই দূরে দাঁড়িয়ে আছি। ওইসব লোক জন চলে গেলে আমি তারপর যাব।
ঋভু বললেন–ও কিসের উৎসব?
নিদাঘ বললেন–রাজা আসছেন হাতীর পিঠে চড়ে।
ঋভু অবাক হয়ে বললেন–কোথায় রাজা? কই আমি তো দেখতে পাচ্ছি না? নিদাঘ বললেন, ওই তো নীচে হাতী, আর হাতীর পিঠের ওপর গদিতে বসে রাজা। মাথায় পাগড়ী, গায়ে ঝলমলে পোশাক। গলায় ঝুলছে মুক্তার হার।
ঋভু বললেন–আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, নীচ-উপর সব কি বলছ? আমার যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, কে রাজা? কোথায় তিনি?
ব্রাহ্মণের এমন কথায় নিদাঘ বিরক্ত হয়ে বললেন–এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না? এই দেখুন আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি।
এই কথা বলে নিদাঘ তাঁর কাঠের বোঝাটা নামিয়ে রেখে সেই ব্রাহ্মণের কাঁধের উপর চড়ে বসলেন। তারপর বললেন–এবার বুঝতে পারছেন? আপনি নীচে আর আমি উপরে।
ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণ বললেন–ও বুঝেছি। আমি নীচে অর্থাৎ হাতী, আর তুমি ওপরে অর্থাৎ রাজা। কিন্তু এখনও আমার বোঝাটা ঠিক হল না। আচ্ছা তুমি কি আরও একটু সরল করে দেখতে পারো নীচে আমি হাতী কে? আর উপরে তুমি রাজাই বা কে?
ব্রাহ্মণের কথা শুনে নিদাঘ চমকে উঠলেন। এ কি, আমি যাঁকে এতক্ষণ গবেট মুখ বলে মনে করছিলাম, তিনি এখন কি বলছেন?
সঙ্গে সঙ্গে তার কাধ থেকে লাফিয়ে নীচে পড়লেন, তারপর তাঁর চরণতলে লুটিয়ে পড়লেন। মনে মনে ভাবছেন, তবে কি ইনি আমারই গুরুদেব? প্রভু এ জগতে যিনি সবাইকে এরূপ অভিন্ন রূপে দেখেন, এমন জগৎ দর্শন জগতে আর কারও নেই।
গুরুদেবের দুটি চরণ ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন– হে গুরুদেব, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।
মহর্ষি ঋভু তখন নিজের আসল রূপ ধারণ করে সস্নেহে নিদাঘকে তুলে বললেন, নিদাঘ, বহুদিন আগে তোমার অতিথি সেবায় আমি তুষ্ট হয়েছিল তাই তোমাকে আমি কখনই ভুলতে পারিনি। চলে এলাম তোমাকে দেখব বলে। মনে করে দেখ, তুমি কে আর আমি কে। কে রাজা আর কে প্রজা, আমরা সবাই সেই ভগবান বাসুদেবেরই অংশ।
তারপর ঋভু নিদাঘকে আশীর্বাদ করে ফিরে গেলেন। নিদাঘ গুরুদেবের চরণ চিন্তা করতে করতে যেন আত্মভোলা হয়ে গেলেন।