বায়ু পুরাণ ৯১-৯৮

একানব্বইতম অধ্যায়

সূত বললেন–প্রভার গর্ভে পাঁচজন স্বর্ভানু তনয় জন্ম গ্রহণ করলেন। এঁরা সবাই মহীপতি, মহাত্মা। এদের মধ্যে নরপতি নহুষ সবার থেকে বড়। তার ছেলে পুত্রধর্মা, তার ছেলে ধর্মবৃদ্ধ, তার ছেলে সূতহোত্র। এঁর তিনজন ধার্মিক পুত্র ছিল– কাস, সল ও গৃৎসম্পদ, গৃৎসম্পদের ছেলে সুনক। তার ছেলে শৌনক। এই শৌনকের বংশে নানা কাজের ফলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণ উৎপন্ন হয়েছিল। সনের ছেলে অষ্টির্ষেণ, তার ছেলে চরন্ত। কাসের ছেলে কাসয়, রাষ্ট্র দীর্ঘতপা। দীর্ঘতপার ছেলে বিদ্বান ধর্ম, তার ছেলের নাম ধন্বন্তরী। ধর্মেৰ বার্ধক্যের সময় তপস্যার ফলে এই মহাতেজা ধন্বন্তরী জন্ম নেন।

ঋষিরা জিজ্ঞাসা করলেন –দেবল ধন্বন্তরী মানুষ লোকে কিভাবে জন্ম নেন। সূত বললেন– দ্বিজগণ! ধন্বন্তরি সম্ভব কথা শুনুন। আগে সমুদ্র মন্থন কালে ধন্বন্তরী উৎপন্ন হয়েছিলেন। সমুদ্র গর্ভে যার যার উৎপত্তি হয়েছিল, তার উৎপত্তি প্রথম। তিনি পরম রূপ সম্পন্ন। ব্রহ্মা তাকে বলেছিলেন- তুমিই অজ। সেই থেকেই তিনি অজ নামে প্রসিদ্ধ। অজ বিষ্ণুকে বললেন– আমি তোমার ছেলে, তুমি আমার যজ্ঞ বিভাগ ঠিক করে দাও। বিষ্ণু বললেন– বিধিমতো বেদে যজ্ঞ বিভাগ সব ঠিক করা আছে। এখন যজ্ঞভাগীদের মত তোমায় কোনও অধিকার দিতে পারবো না। তুমি পরে জন্মেছো। তুমি দ্বিতীয় জন্মে জগতে খ্যাতি লাভ করবে।

তুমি গর্ভাবস্থায় দেবত্ব লাভ করবে। ব্রাহ্মণরা বরুণ মন্ত্র, ঘি ও গন্ধ দিয়ে তোমার অর্চনা করবে। তারপর তুমি আয়ুর্বেদের প্রবর্তক হবে। বিষ্ণু এইভাবে ধন্বন্তরিকে বর দান করে অন্তর্হিত হলেন। দ্বিতীয় দ্বাপরে রাজা দীর্ঘতপা পুত্র কামনায় তপস্যা করেন। তখন তার বিশিষ্ট বুদ্ধিশালী পুত্র রূপে ধন্বন্তরি তার গৃহে জন্ম নেন। ধন্বন্তরী আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের প্রবক্তা। ভরদ্বাজ সেটি চিকিৎসা প্রণালীর সাথে আট ভাগে ভাগ করে শিষ্যদের শিক্ষা দেন। ধন্বন্তরীর ছেলে কেতুমান, তারপর নরপতি ভীমরথ, ইনি দিবোদাস নামে বারাণসীতে অধিপতি ছিলেন।

তার সময়ে ক্ষেমক নামে এক রাক্ষস বারাণসী পুরী ধ্বংস করে ফেলে। আসলে নিকুম্ভ অভিশাপ দিয়েছিলেন, বারাণসী হাজার বছর পর্যন্ত বার বার ধ্বংস হয়ে শূন্য হয়ে যাবে। এই অভিশাপ থেকে দূরে থাকবার জন্য দিবোদাস গোমতীর তীরে তার সুন্দর পুরী তৈরি করলেন।

ঋষিরা একথা শুনে সূতের কাছে জানতে চাইলেন—কেন ধর্মাত্মা নিকুম্ভ বারাণসীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। সূত বললেন– মহাতেজা রাজর্ষি দিবোদাস রাজধানী বারাণসী ধামে বাস করতেন। ঐ সময় মহেশ্বরের বিবাহ হয়। পত্নী পার্বতীর জন্য তিনি কিছুদিন শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে লাগলেন। মহেশ্বরের আদেশে তাঁর পারিষদরা বিশেষ বিশেষ রূপ ধরে মহেশ্বরীকে আনন্দ দিতে লাগলেন। কিন্তু মেনকার তাতে আনন্দ হল না। তিনি দেব, দেবী সকলেরই নিন্দে করতে লাগলেন। কন্যাকে বললেন– তোমার স্বামী দরিদ্র কিন্তু সবসময় এইসব নৃত্য গীত নিয়ে রয়েছে, তিনি অনাচারী বলেই আমার মনে হচ্ছে। উমা শিবের কাছে মন খারাপ করে একথা জানালেন। আর এবার পিত্রালয় ছেড়ে মহেশ্বরের বাড়িতে যেতে চাইলেন।

মহাদেব দেখলেন, পৃথিবীতে একমাত্র বারাণসী ধামেই বসবাস করা যায়। কিন্তু সেখানে দিবোদাস নামে এক বিক্রমশালী রাজার বাস। তিনি তখন ক্ষেমক নামে তার এক পার্শ্বচরকে ডেকে বললেন– তুমি বারাণসী পুরী শূন্য করো মহাদেবের আদেশে গণপতি নিকুম্ভ বারাণসী গিয়ে সেখানে মস্কন নামে এক নাপিতকে স্বপ্ন দিয়ে বললেন– এখানে আমার মূর্তি বসিয়ে একটি মন্দির স্থাপন কর।

নাপিত রাজার আদেশ নিয়ে নগরদ্বারে মন্দির স্থাপন করল। সেখানে রোজ রোজ মহাসমারোহে পূজা হতে লাগল। গণাধিপতি এভাবে রোজ পূজা পেতে থাকলেন। আর নগরবাসীদের হাজার হাজার বর দিতে লাগলেন। ধন, দৌলত, পুত্র আয়ু সবাইকে তিনি দান করতে লাগলেন। রাজমহিষী সুমনা সেখানে বর নিতে এলেন।

পুত্র লাভের জন্য রাজপত্নী মহাসমারোহে গণেশ্বরের পূজা করলেন। কিন্তু নিকুম্ভ তাকে কোনও কারণে পুত্র দান করলেন না। তিনি ভাববেন, মহিষীকে পুত্র দান না করলে রাজা যখন রেগে যাবেন, তখনই আমার কার্য সিদ্ধি হবে। বাস্তবিক তাই হল। রানির প্রার্থনা নিষ্ফল হল দেখে, রাজা ভাবলেন আমার নগরের দ্বারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এই ভূত রোজ রোজ এত পূজা পায় আর নগরবাসীদের বর দেয়। কিন্তু রানি পুত্রের জন্য এতবার এর অর্চনা করল, তখন ঐ ভূত প্রার্থনা কানে তুলল না। আমি এর মন্দির ধ্বংস করব। এ পূজা পাওয়ার যোগ্য নয়। এইভাবে রাজা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ঐ জায়গা ধ্বংস করলেন।

গণেশ্বর নিজের মন্দির ধ্বংস হয়েছে দেখে রাজাকে শাপ দিলেন– তোমার পুরী ঠিক এই ভাবে শূন্য হবে। তখন মহাদেবের ইচ্ছামত রাজার পুরী ধ্বংস হল। সেই জায়গায় মহেশ্বর নিজের ইচ্ছায় তখনই এক ঐশ্বর্য মণ্ডিত ভবন তৈরি করে নিলেন। মহেশ্বর ও মহেশ্বরী আনন্দে সেখানে দিন কাটাতে লাগলেন। কিন্তু কিছুদিন পর আর দেবী ঐ বাড়িতে থাকতে আনন্দ পেলেন না। কিন্তু মহেশ্বর হাসিমুখে বললেন–আমি এখানেই থাকব। এ জায়গা থেকে যাব না। তুমি যেতে হয় যাও। এভাবে তিন যুগে ধর্মাত্মা সর্বদেব নমস্কৃত মহাদেব ঐ পুরেই বাস করতে থাকেন।

কলিযুগে আবার নতুন পুরী স্থাপিত হয়। এভাবে বারাণসী অভিশপ্ত ও পরে আবার পুনর্নির্মিত হয়েছিল। দিবোদাস একবার ভদ্রাগণ্য রাজার একদা ধনুকধারী বীর ছেলেদের হত্যা করে রাজ্য অপহরণ করেন। ভদ্রাগণ্য-এর দুর্দৰ্ম নামে একটি বালক পুত্র ছিল। সে নিতান্ত ছোট ছেলে বলে রাজা দিবোদাস তাকে অবজ্ঞা করেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। দিবোদাসের, দৃষদ্বতী গর্ভে প্রতর্দন নামে এক বীর পুত্র জন্মায়।

এদিকে ভদ্রাগণ্য-এর সেই বালক পুত্র পরবর্তীকালে মহারাজ হয়ে শত্রু নিধন করে প্রতদনের কাছ থেকে তার পিতৃরাজ্য আবার অধিকার করলেন। প্রতদনের দুই ছেলে বৎস ও গর্গ। তার মধ্যে বৎসের ছেলে অলর্ক, তার ছেলে সন্নতি। রাজর্ষি অলকের প্রতি আগে শ্লোকে বলা হয়েছিল এই রাজা লোপামুদ্রার প্রসাদে ষাট হাজার ষাট শত বছর পরমায়ু পাবেন। ইনি শাপ থেকে মুক্ত হয়ে ক্ষেমক রাক্ষসকে হত্যা করে আবার সুরম্য বারাণসী ধামে বসবাস করবেন।

অলর্কের পুত্র সন্নতির সুনীথ নামে এক ধার্মিক পুত্র জন্মে। এঁর পুত্র সুকেতু, সুকেতু পুত্র ধর্মকেতু, তাঁর পুত্র মহারথ সত্যকেতু, তাঁর পুত্র প্রজাপালক বিভু। বিভুর পুত্র সুবিভু। তাঁর পুত্র সুকুমার এঁর পুত্র ধার্মিক ধৃষ্টকেতু। এঁর পুত্র বেণুহোত্র, তার পুত্র গাৰ্গ, তার ছেলে ভর্গভূমি এবং বৎসের পুত্র বাৎস্য। এই ভর্গ ও বৎস থেকে বহু সুধার্মিক ব্রাহ্মণ বলবীর্যশালী ক্ষত্রিয় উৎপন্ন হন। এই আমি কাশীপতিদের বিবরণ বললাম।

এরপর রজি রাজার বংশতালিকা বলছি। রজির একশো ছেলে। এর মধ্যে পাঁচ ছেলে জগৎবিখ্যাত। সেই পুরাকালে ভীষণ দেবাসুর সংগ্রাম শুরু হলে দেব অসুর দুই পক্ষই একসাথে পিতামহের কাছে গিয়ে বললেন–আমাদের মধ্যে কে বিজয়ী হবে, বলে দিন। ব্রহ্মা বললেন–যাঁদের পক্ষে যুদ্ধে রাজা অস্ত্র ধারণ করবেন, সেই পক্ষই ত্রিলোকজয়ী হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।

যে পক্ষে রজি সেই পক্ষেই বিজয়লক্ষ্মী, যেখানে লক্ষ্মী, সেখানে ধৃতি আর সেখানেই ধর্ম, ধর্মেরই জয় হয়। তখন দেব দানব সকলে রজির স্তব করতে লাগলেন। তারা সকলেই রাজাকে বললেন–তুমি আমাদের হয়ে যুদ্ধ কর। রজি বললেন–আমি তোমাদের সকলকেই যুদ্ধে জয়ী করব। ইন্দ্র প্রভৃতি সব দেবতাদের পরাস্ত করে আমিই ধর্মাত্মা ইন্দ্র হব। যদি সম্ভব হয়, তাহলেই আমি অস্ত্রধারণ করতে পারি।

ঐ কথার উত্তরে দানবরা বলল– আমাদের ইন্দ্র প্রহ্লাদ। আমরা তাঁরই জন্য যুদ্ধ জয় করে থাকি। তাই হে রাজন! আপনি দেব পক্ষের কথায় বাধ্য হবেন না। কিন্তু সেই সময় দেব পক্ষ বলে উঠলেন রাজন, আপনি সবাইকে জয় করে ইন্দ্র হবেন। আমাদের আপত্তি নেই। এরকম আমন্ত্রণে রাজা ইন্দ্রের সামনে সমস্ত দানবদের বিনাশ করলেন। রজি রাজা দানবদের হত্যা করে দেবতাদের স্ত্রী সকলকে উদ্ধার করলেন। তখন শতক্রতু দেবতাদের সঙ্গে রজি রাজাকে বললেন–আমি আপনার ছেলে, এই বলে আবার বললেন–আপনি দেবতাদের ইন্দ্র হলেন সন্দেহ নেই। আমি ইন্দ্র আপনার পুত্র রূপে বিখ্যাত হব। দেবমায়ায় বঞ্চিত হয়ে রাজা বললেন–তথাস্তু।

পরে রাজা রজি স্বর্গধামে এলে তার পুত্রেরা ইন্দ্রের কাছ থেকে সমস্ত সম্পত্তি হরণ করে নিল। সাত পুত্র নানাভাবে স্বর্গলোক আক্রমণ করল। হৃত গৌরব মহাবল ইন্দ্র নিজের ভাগ্য বিপর্যয়ে ব্যাকুল হয়ে বৃহস্পতিকে বললেন–হে ব্রাহ্মণ! আমি রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়েছি। আমি নিস্তেজ, দুর্বল ও বিমূঢ় হয়ে পড়েছি। রজি রাজার ছেলেদের জন্যই আমার এমন অবস্থা। আপনি প্রসন্ন হন। বৃহস্পতি বললেন–হে শতক্রতু। তুমি যদি আগে আমাকে এই বলতে, তা হলে তোমার এরকম অবস্থা হত না। তোমার মঙ্গলের জন্য আমি এবার চেষ্টা করব। তোমার রাজ্য, যজ্ঞভাগ তুমি তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবে।

তারপর বুদ্ধিমান বৃহস্পতি রজি পুত্রদের বুদ্ধি ভ্রংশ করলেন। তারা নিজেদের ভ্রাতাদের সঙ্গে বিবাদে মেতে উঠল অধার্মিক, ব্রহ্মবিদ্বেষী হয়ে উঠল। সে কারণে তাদের বীর্যবল সবই নষ্ট হয়ে গেল। ইন্দ্র সেই সুযোগে রাজপুত্রদের বিনাশ করে স্বর্গরাজ্য উদ্ধার করলেন। ইন্দ্র পুনরায় দৈব ঐশ্বর্য লাভ করলেন।

.

বিরানব্বইতম অধ্যায়

ঋষিরা এবার মহাত্মা মরুত্তের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। সূত বললেন– মহাতেজা রাজা অন্ন কামনায় ষাট বছর ধরে প্রতি মাসে মরুৎসোমের যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন। মরুগণ তাঁর প্রতি তুষ্ট হয়ে সর্বকাম সমৃদ্ধ অক্ষয় অন্নদান করলেন। যে অন্ন একবার রান্না করা হলে অহোরাত্র মধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত হত না। সূর্যোদয় হবার পর কোটিবার দেওয়া হলেও নিঃশেষ হবার সম্ভাবনা ছিল না।

মরুত্তের কন্যার গর্ভে যে সব ছেলেরা জন্মেছিলেন তারা সকলেই ধার্মিক মোক্ষদসী, তাঁরা সংসার ধর্ম ত্যাগ করে বৈরাগ্য অবলম্বন করেন। তারপর ব্রহ্মস্বরূপ লাভ করেন। এরপর অনপায় জন্মগ্রহণ করেন। তার থেকে প্রতাপবান ধর্মের উৎপত্তি হয়। ধর্ম থেকে ক্ষাত্রধর্ম ও তার থেকে মহাতপা প্রতিপক্ষ জন্মগ্রহণ করেন। প্রতিপক্ষের ছেলে বিশ্ব বিশ্রুত সজ্ঞয়, তার ছেলে জয়। তার পুত্র বিজয়, তার ছেলে দ্বিতীয় জয়, তার পুত্র হর্ষত, তাঁর পুত্র প্রতাপবান সহদেব, তাঁর পুত্র ধর্মাত্মা বিখ্যাত অদীন, তাঁর পুত্র জয়ৎ সেন। তাঁর পুত্র সস্কৃতি, তার পুত্র কৃতবর্মা– এঁরা সকলেই ক্ষত্ৰধর্মী ছিলেন।

এবার নহুষ বংশের বিবরণ বলছি। রাজা নহুষের সকল পুত্ৰই ইন্দ্রের মত তেজঃশালী, পিতৃ কন্যা বিরজার গর্ভে ঐ সব ছেলে জন্মায়। তাঁরা হলেন– যতি, যযাতি, সংযাতি ও আয়তি প্রভৃতি। এদের মধ্যে যতি জ্যেষ্ঠ এবং যযাতি সবার ছোট। যতি কাকুৎস্থ কন্যার পানিগ্রহণ করেন। সংযাতি মোক্ষমার্গ অবলম্বন করে মৌনভাবে ব্রহ্মের কাছে থাকেন।

যযাতি ছিলেন পৃথিবীর অধিপতি তিনি উশনার কন্যা দেবযানিকে বিবাহ করেন। অসুররাজ বৃষপর্বার নন্দিনীও তার প্রণয়িনী ছিলেন। দেবযানীর গর্ভে যযাতির যদু ও তুর্বসুর জন্ম হয়। আর শমিষ্ঠার গর্ভে হ্য, অনু ও পুরু জন্ম গ্রহণ করেন। যযাতি দেবকুমারের মতো সব পুত্রের জন্মদাতা, রুদ্র খুশি হয়ে যযাতিকে একটি সোনার রথ ও অক্ষয় মহৌষধি দান করেন। ঐ রথ বেগবান ঘোড়া দ্বারা চালিত, এদের দ্বারা তিনি জগৎ জয় করেন।

দেব-দানবদের অপেক্ষা দুধর্ষ ছিলেন রাজা যযাতি। তার সেই রথ পুরু বংশীয় রাজারাও ব্যবহার করেছিলেন। পরীক্ষিতের ছেলে জনমেজয়ের রাজত্বকালের কিছুদিনের পরেও ঐ রথ পুরুবংশীয়দের দখলে ছিল। তারপর মহর্ষিগণের শাপে তা নষ্ট হয়ে যায়। রাজা জনমেজয় গর্গপুত্রকে হিংসা করেন। তাতে গর্গের শাপে রক্ত গন্ধ যুক্ত দেহে এদিকে ওদিক বিচরণ করতে থাকলেন। নগরবাশীরা তাকে পরিত্যাগ করল। কোথাও শান্তি পেলেন না। তখন দুর্দশার কারণ স্বরূপ সেই ঋষিকে অভিসম্পাত করতে লাগলেন। ইন্দ্র নামে এক উদারচেতা মুনি ছিলেন। তিনি জনমেজয়ের জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন, তাঁর আশ্রমে গিয়ে জনমেজয় শাপমুক্ত হন।

আগের সেই দিব্যরথ কুরুবংশীয়দের হাত থেকে চেদিপতি বসুর অধিকারে আসে। তারপর আবার সেই রথ ইন্দ্রের আয়ত্তে এলে তিনি তুষ্ট হয়ে বৃহদ্রথকে দান করেন। তারপর জরাসন্ধের অধিকারে আসে। ভীম জরাসন্ধকে হত্যা করে সেই রথ বাসুদেবকে দান করেন। নহুষের পুত্র রাজা যযাতি নিজের পুত্র যদুকে বললেন– শুক্রাচার্যের শাপে জরা আমায় আক্রমণ করেছে, যৌবন ভোগে এখনও আমি তৃপ্ত হইনি। তুমি আমার জরা সহ পাপ গ্রহণ কর। যদু বললেন–আমি এক ব্রাহ্মণকে ভিক্ষা দান করব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।

জরা গ্রহণ করলে আমি ভিক্ষা করতে যেতে পারবো না। জরায় শরীর শিথিল হয়ে যায়, আকৃতি দুর্বল হয়ে যায়, দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ হয়ে যায়। তাই আমি আপনার জরা গ্রহণ করতে পারছি না। আমি ছাড়া আপনার অনেক প্রিয় পুত্র আছে, তাদের কাউকে অনুরোধ করুন। যযাতি একথা শুনে ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, আমাকে অগ্রাহ্য করে তোমার কি বা কাজ থাকতে পারে আর ধর্ম বিধিই বা কি হতে পারে।

তিনি যদুকে অভিশাপ দিলেন। রাজ্যচ্যুত করলেন। তারপর তিনি তুর্বসুকে বললেন–তুমি আমার জরা গ্রহণ করো। আমি তোমার যৌবন দ্বারা বিষয় ভোগ করব। পরে এক হাজার বছর পূর্ণ হলে পুনরায় আমার পাপ ও জরা ফিরিয়ে নেবো। তুর্মু বললেন–আমি জরা গ্রহণ করতে চাই না। বিশেষত পান বা ভোজনের পক্ষে জরা একেবারেই উপযুক্ত নয়। সুতরাং রাজন, আমি আপনার জরা গ্রহণ করতে উৎসুক নই। যযাতি বললেন–তুমি আমার হৃদয় থেকে জাত হয়েও নিজের বয়স দান করলে না, তোমার প্রজা উচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী আর তোমার অধঃপতন ঘটবে।

এবার যযাতি শর্মিষ্ঠার পুত্র দ্রুহ্যকে বললেন–আমার জরা গ্রহণ করো। হাজার বছর পূর্ণ হলে আবার তোমায় যৌবন ফিরিয়ে দেব। দ্রুহ্য বললেন, জরাক্রান্ত ব্যক্তি গজ অশ্ব, রথ বা রমণী কিছুই ভোগ করতে পারে না। সুতরাং আমি জরা নিতে চাই না। যযাতি বললেন–তুমি আমার হৃদয় জাত হয়েও আমার জরা নিতে চাইলে না। এজন্য তোমার কোন প্রিয় কামনাই পূর্ণ হবে না।

যে দেশে কোনও যান নেই, শুধু ভেলা বা নৌকায় যাতায়াত করতে হয়, সেখানে অরাজবংশে তোমায় থাকতে হবে। এই বলে যযাতি অনুকেও একই কথা বললেন। অনু বলল–হে পিতা, আমি এখন শিশু, এখনই আপনার জরা গ্রহণ করে আমি জীর্ণ ও অশুচি হয়ে যাব। তাই আমি আমার বয়স দান করতে পারবো না। যযাতি শাপ দিলেন–তুমি অম্মিদগ্ধ হবে, তোমার প্রজারাও অকালে বিনষ্ট হবে।

এবার যাতি পুরুকে বললেন–শুক্রচার্যের শাপে জরা আমায় আক্রমণ করেছে, তুমি আমার জরা নিয়ে তোমার হাজার বছরের যৌবন দাও। পুরু তখন বললেন–আপনি যা অনুমতি করবেন। আমি তাই করব। আমি আপনার পাপ ও জরা গ্রহণ করছি। আপনি আমার যৌবন নিয়ে যথেচ্ছো ভোগ করুন। যযাতি বললেন–পুরুবৎস আমি খুশি হলাম। আমি তোমায় বর দিচ্ছি, তোমার রাজ্যের প্রজারা সর্বকাম সমৃদ্ধ হবে। তোমার মঙ্গল হবে।

সূত বললেন–রাজা যযাতি নিজের জরা পুরুর মধ্যে সংক্রমিত করলেন। যযাতি খুশি হয়ে ইচ্ছেমতো নিজ যোগ্য সুখ ভোগ করতে থাকলেন। তিনি দেবতা, ব্রাহ্মণ, দীন, দরিদ্র, বৈশ্য শুদ্র সবাইকে সন্তুষ্ট করলেন। দস্যুদের দমন করে ইন্দ্রের মতো প্রজাদের পালন করতে লাগলেন। কিন্তু রাজার ভোগের আশা উত্তরোত্তর বেড়ে যেতে থাকলে, নিজেই একসময় পুরুর কাছ থেকে জরা চেয়ে নিলেন। তিনি পার্থিব সমস্ত ভোগ করে তৃপ্ত। পুরুকে বললেন–আমি তোমার যৌবন নিয়ে বিষয় ভোগ করেছি।

তোমার মঙ্গল হোক। একমাত্র তুমিই আমার প্রিয় পুত্র। তুমি নিজের রাজ্য ও যৌবন গ্রহণ কর। যযাতি খুশি হয়ে কনিষ্ঠ পুত্র পুরুকে রাজ্যের রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করতে চাইলে ব্রাহ্মণ প্রভৃতিরা বললেন– হে প্রভু! শুক্রাচার্যের দৌহিত্র দেবযানীর ছেলে যদুই সকলের বড়। তাকে সিংহাসন দান না করে সর্বকনিষ্ঠ পুরুকে কিভাবে রাজ্য দান করবেন? যদু হলেন সবার বড়, তারপর তুর্বসু, তারপর শর্মিষ্ঠার পুত্রগণ, দ্রুহ্য, অনু, এবং পুরু। আপনাকে আমরা ধর্ম স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি এবার। আপনি আপনার ধর্ম পালন করুন।

যযাতি বললেন–হে ব্রাহ্মণে ইত্যাদি বর্ণগণেরা! আমি জ্যেষ্ঠ পুত্রকে কখনোই রাজ্য দান করব না। যে পুত্র পিতা-মাতার কথা শোনে তাকেই শ্রেষ্ঠ পুত্র বলে। কিন্তু জ্যেষ্ঠ পুত্র হয়েও, সে আমার আদেশ পালন করেনি, সে পুত্র পদের অযোগ্য, তুর্বসু, দ্রুহ্য অণুও আমাকে অবজ্ঞা করেছে। একমাত্র কনিষ্ঠ পুত্র পুরুই আমার জরা গ্রহণ করে পুত্রের কাজ করেছে। ইন্দ্র আমায় বর দিয়েছিলেন, যে পুত্র তোমার বাধ্য হবে, সেই হবে রাজা।

তাই আপনারাও অনুমতি দিন, পুরুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করি। যে পুত্র গুণবান। পিতামাতার হিতৈষী, সে কনিষ্ঠ হলেও কল্যাণ লাভের যোগ্য। তখন সকলেই বললেন–আপনার প্রিয় পুত্র পুরুই রাজ্যের অধিকারী। বিশেষ করে শুক্রাচার্য যখন বরদান করেছেন, এ বিষয়ে আমাদের কোন বক্তব্য নেই। তখন রাজা যযাতি পুরুকে নিজের রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন।

এভাবে রাজা যযাতি সপ্তদ্বীপা পৃথিবী জয় করে, পুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দেন। যযাতির পুত্ররা সমস্ত মেদিনীতে রাজত্ব করতে থাকেন। তার ধর্মজ্ঞ রাজা এবং ধর্ম অনুসারেই প্রজাপালন করেন। যে যযাতি কামভোগের জন্য নিজের পুত্রের যৌবন নিয়েছিলেন, তিনিই পুরাকালে বলেন–কামের দ্বারা কাম ভোগের তৃপ্তি হয় না, আগুনে ঘি সংযোগের মত তা আবার বাড়তেই থাকে। তাই কামে হতজ্ঞান হওয়া উচিত নয়।

যখন কোনো কাজ মন ও বাক্য দিয়ে সর্বভূতে সমভাব স্থাপন করা যায়, তখনই ব্রহ্মস্বরূপ লাভ হয়ে থাকে, যখন কারোর থেকে কোন ভয় থাকে না, বা নিজে অন্যের ভয়ের কারণ না হতে হয়, যখন রাগ, দ্বেষ, ইচ্ছা কিছুই থাকে না, তখন ব্রহ্ম স্বরূপ হওয়া যায়। জগতে যা কিছু কামসুখ বা যা কিছু দিব্য মহৎ সুখ আছে, তা পরম সুখের যোগ্য নয়। সমস্ত সুখের থেকে বাসনা ত্যাগ করাই পরম সুখ।

এই বলে রাজা যযাতি সস্ত্রীক বনে গেলেন এবং তপস্যা করে শত শত ব্রত পালন করে সেখানেই স্বর্গলাভ করেন।

.

তিরানব্বইতম অধ্যায়

সূত বললেন–আমি এবার বিস্তৃত বিবরণ দিচ্ছি যযাতি পুত্র যদুর বংশের। যদুর পাঁচ পুত্র হয়। তার মধ্যে সহস্রজিৎ শ্রেষ্ঠ, সহস্র জিতের পুত্র শ্রীমান সৎজিৎ, সৎজিতের তিন পুত্র। তিন জনই পরম ধার্মিক বলে বিখ্যাত। তাঁদের নাম হৈহয়, হয়, ধনু হয়। হৈহয়ের পুত্র ধর্মতত্ত্ব, তাঁর পুত্র কীর্তি, তার পুত্র সংজ্ঞেয়, তার পুত্র মহিম্মান, তাঁর পুত্র প্রতাপবান ভদ্ৰশ্রেন। ইনি বারাণসীর অধিপতি ছিলেন। ভদ্ৰশ্রেন্যের পুত্র দুর্দম, তার পুত্র ধীমান কনক। কনকের চার পুত্র উৎপন্ন হয়। তাদের নাম কৃতবীর্য, কৃতবর্ম ও কৃতজাত। তার মধ্যে কৃতবীর্যের ছেলে কার্তবীর্য অর্জুন। এই অর্জুন সাত দ্বীপের অধিপতি ছিলেন। ইনি অনযুতবর্ষ পর্যন্ত তপস্যা করে অত্রি পুত্র দত্তাত্রেয়ের আরাধনা করেন। তিনি অর্জুনকে চারটি মহান বর দান করেছিলেন।

অর্জুন প্রথমে নিজের হাজার বাহু লাভের বর প্রার্থনা করেন। তাঁর দ্বিতীয় বর প্রার্থনা অধার্মিক লোকেদের ধর্ম পথে নিয়ে আসা। তৃতীয় ধর্মানুসারে পৃথিবী জয় ও পালন। চতুর্থ বর বহু সংগ্রাম জয় করে, বহু শত্রু নিধন করে, নিজের থেকে প্রধান ব্যক্তির হাতে সংগ্রামে নিজের মরণ। এভাবে বর লাভ করে সাতদ্বীপ শাসন করেছিলেন। তার সঙ্গে যুদ্ধকালীন স্থানে মায়ার বশে বহু হাজার রথী আবির্ভূত হত। তিনি রাজা হয়ে সাতদ্বীপে দশ হাজার যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। সেই রাজার সব যজ্ঞ সুসম্পন্ন হয়েছিল। তার যজ্ঞের সব বেদী সব ঘূপই ছিল সোনার তৈরি।

তিনি যজ্ঞ আরম্ভ করলে স্বর্গের দেবতারা, গন্ধর্ব ও অপ্সরারা যজ্ঞভূমিকে শোভা দান করতেন। সে সময় নারদ নামে জনৈক গন্ধর্ব, রাজা কার্তবীর্য অর্জুনের মাহাত্ম গান করেছিলেন মানুষের মধ্যে কেউ যজ্ঞ, দান, তপস্যা, বিশ্রাম ও শাস্ত্র জ্ঞান দিয়েও অর্জুনের সমকক্ষ হতে পারবে না। সেই অর্জুন সাতটি দ্বীপেরই রথী, খড়গী ও ধনুর্বানধারী হয়ে বিচরণ করতে দেখা যেত। তিনি ধর্মানুসারেই সমস্ত প্রজাপালন করতেন। তিনি সাতাশী বছর রাজত্ব করেন। তার রাজ্যে তিনি পশুপাল ও ক্ষেত্রপাল রূপে বিরাজ করতেন। তিনি হাজার বাহু দিয়ে হাজার রক্ষীযোগে প্রভাত সূর্যের মত প্রতিভাত হতেন। তিনি সহস্রবাহু নাগের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, তিনি অনায়াসে সমুদ্রের বেগ রোধ করতে পারতেন।

পুরাকালে তিনি একদিন নর্মদাকে অনুসরণ করে সমুদ্রে উপনীত হয়ে সেখানে স্নান করেন, তখন তার হাজার বাহু থেকে যে জল পড়েছিল তাতে বেলা ভূমি প্লাবিত হয়েছিল। পাতালের মহাসুরেরা ভয়ে জড়সড় হয়ে লুকিয়ে পড়েছিল। হাজার হাতের আলোড়নে জল জন্তুরা ভয় পেয়ে যায়। তিনি লঙ্কাপুরে গিয়ে লঙ্কাপতি রাবণকে মূচ্ছিত অবস্থায় বেঁধে নিয়ে, আসেন। পুলস্ত্য তাঁকে খুশি করলে তবে অর্জুন পুলস্ত্যের পৌত্র রাবণকে মুক্ত করেন। জমদগ্নির পুত্র মহাবীর্য পরশুরাম অর্জুনের সহস্রবাহু যুদ্ধক্ষেত্রে তালপাতার মতো ছিঁড়ে ফেলেন। তিনি চিত্রভানুকে পৃথিবী ভিক্ষা দিয়ে দিয়েছিলেন।

সূর্য পৃথিবীকে তাপ আলো দান করতে লাগলেন। হৈহয়-এর সাহায্যে সূর্য সমস্ত পৃথিবীকে দুগ্ধ করলে, সে সময় বরুণের ছেলের একটি শূন্য অবগ্রম পুড়ে যায়। বরুণ দেবের অশ্বিন নামে এক পুত্র ছিল, এই পুত্ৰই পরে বশিষ্ঠ নামে বিখ্যাত হন। আশ্রম পুড়ে যাওয়াতে তিনি শাপ দিয়েছিলেন। তুমি যত বড় বীর হও, অন্যের হাতে তুমি বিনষ্ট হবে। পরবর্তীকালে পরশুরাম অর্জুনের বাহু কেটে তাঁকে হত্যা করেন। সুতরাং বশিষ্ঠের শাপেই তার মৃত্যু হয়। তার একশো ছেলের মধ্যে পাঁচ জন মহাবলী ছিলেন, তাঁদের নাম শূর, শূরসেন, বৃষ্ঠাঙ্গ, বৃষ ও জয়ধ্বজ। পুত্রেরা অবন্তী দেশ থেকে রাজ্য পরিচালনা করতেন। জয়ধ্বজের ছেলে প্রতাপবান তালজঙঘ তাঁর একশো ছেলে। তারা সকলেই তালজঙ্ঘ নামে বিখ্যাত ছিলেন।

কালক্রমে মহাত্মা হৈহয় পাঁচ সম্প্রদায়ে বিভক্ত হলেন। যথা- বীরহোত্র, ভোজ, আবর্তি, তুন্ডিরেক ও তালজঙ্। এরা সমষ্টিতে অসংখ্য, সকলেই বিক্রমশালী। বীরহোত্রের পুত্র রাজা অনন্ত। তার ছেলে দুর্জয়। তাঁর পুত্র অমিদানি। রাজা অর্জুন নিজের প্রভাবে সমস্ত প্রজাপালন করতেন।

.

চুরানব্বইতম অধ্যায়

ঋষিরা বললেন–আমরা শুনেছি, কার্তবীর্য অর্জু, প্রজাপালক ও প্রজা অনুরাগী ছিলেন, কিন্তু তাহলেও কেন মহাত্মা বশিষ্ঠের আশ্রম পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই ঘটনার বিবরণ আমাদের কাছে বলুন। তখন সূত বললেন–একবার সূর্যদেব অর্জুনের কাছে উপস্থিত হয়ে খাদ্যবস্তু ও অন্ন ভিক্ষা করলেন। রাজা জানতে চাইলেন, কি ধরনের ভোজ্যবস্তু দান করবেন। সূর্য বললেন, আমাকে সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি খাদ্য রূপে দান কর। আমি তাতেই তৃপ্ত হব। রাজা বললেন–আমি মানুষ হয়ে সমস্ত স্থাবর বস্তু দান করতে পারব না। আপনাকে তাই এখন প্রণাম করতে হল। সূর্য তখন সন্তুষ্ট হয়ে তার নিজের সর্বগামী অক্ষয় শরগুলি দান করলেন। এই শর আদেশ পাওয়া মাত্র মেঘ, সাগর শোষণ করবে।

এরপর আদিত্য অর্জুনকে শরগুলি দান করলেন, পরে অর্জুনের কাছ থেকে স্থাবর বস্তুগুলি পেলেন। তখন আশ্রম, গ্রাম, নগর, জনপদ, তপোবন, রম্য কানন– সবই তিনি দগ্ধ করলেন। সূর্য তেজে পুড়ে গিয়ে ধরিত্রী, গাছপালা তৃণহীন হয়ে গেলেন। এই সময় মহর্ষি বশিষ্ঠ নিয়ম পালনের জন্য দশ হাজার বছর ধরে জলের তলায় বাস করছিলেন। মহাতেজ ঋষি তপস্যা শেষ হয়ে গেলে জল থেকে উঠে আশ্রমে এসে দেখলেন সব পুড়ে গেছে। তখনই ঋষি বশিষ্ট রেগে গিয়ে অভিশাপ দিয়েছিলেন।

এবার রাজর্ষির ক্রোফ্টর বংশ বিবরণ শুনুন। এই বংশে ধনুর্ধর বৃষ্ণি জন্মগ্রহণ করেন। ক্রোষ্টুর এক ছেলে, তার নাম স্বাহি। স্বাহির ছেলের নাম রসাদু। রসাদুর যজ্ঞের ফলে চিত্ররথ নামে এক বীর পুত্র জন্মায়। চিত্ররথও রাজা হয়ে বাহু যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। পরবর্তীকালে তিনি শশবিন্দু নামে বিখ্যাত হন। এই শশবিন্দু মহাবল, মহাবীর্য, প্রজাঅনুরাগী, চক্রবর্তী লক্ষণযুক্ত রাজা ছিলেন। রাজা শশবিন্দুর একশোজন গুণশালী পুত্র ছিলেন।

এদের মধ্যে ছয়জন বিখ্যাত হন এঁরা হলেন–পৃথুশবা, পৃথুযশা, পৃথুবর্মা, পৃথুজ্ঞয়, পৃথুকীর্তি, ও পৃথুদাতা। তারা সকলেই শশবিন্দু নামে বিখ্যাত হন। পৃথুশ্রবার অন্তর নামে এক পুত্র হয়। এই অন্তর প্রাচীনকালে ধর্মাত্মা উশনা হয়ে পৃথিবী শাসন করেন। এঁর পুত্রের নামই মরু ও তার পুত্র কম্বলবাই, তাঁর পুত্র বরুক্সকবচ। এঁর পাঁচটি পুত্র ছিল। তাদের নাম রুক্সেযু, পৃথুরুক্স, জ্যামর্থ, পরিখ ও হরি। ভাই জ্যামখকে অন্যান্যরা নির্বাসিত করছে তিনি বনে কাটাতে লাগলেন। জ্যামথের পত্নীর নাম শৈব্যা। ইনি তেজস্বিনী ছিলেন।

রাজা অপুত্রক ছিলেন কিন্তু বিয়ে করে অন্য পত্নী আনেননি। যুদ্ধ জয় করে তার একটি কন্যা লাভ হয়। রাজা তার পত্নীকে বললেন–তোমার যে পুত্র হবে তার সঙ্গে এই কন্যার বিবাহ হবে। রানি শৈব্যা উগ্র তপস্যা করে বিদর্ভ নামে পুত্র প্রসব করেন। এই কন্যার সঙ্গে বিদর্ভের বিয়ে হয়। তখন তার দুই পুত্র জন্ম নেয়। ক্ৰথ ও কৌশিক দুই রাজপুত্রের নাম। তৃতীয় পুত্রের নাম লোমপাদ। এই ধার্মিক লোমপাদের ছেলের নাম বস্তু। তার ছেলে আহুতি।

কৌশিক থেকে চেদির জন্ম। চেদি থেকে চৈদ্য রাজারা খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ক্ৰথ থেকে কুন্তী নামে পুত্র জন্মে। কুন্তীর ছেলে ধৃষ্ট। ধৃষ্টের ছেলে প্রতাপশালী নিবৃতি। এর পুত্র দশাই। তার ছেলে ব্যোমা, তার ছেলে জীমূত। তার ছেলে বিকৃতি, ধার্মিক। রথবর পুত্র নবরথ। এঁর ছেলে দশরথ। তার ছেলে একাদশ রথ। তাঁর পুত্র শকুনি। এইভাবে যথাক্রমে করম্ভক, দেবরথ, দেবক্ষত্র, দেবেন, মধু, মনু, মনুবশ, নন্দন ও মহাপুরুবশ, পুরুব্বান, পুরুব্বহ, সত্ত্ব এবং কীর্তিমান সাদ্ভূত জন্ম নেন। এই জল জ্যামখের বংশ বিবরণ।

.

পঁচানব্বইতম অধ্যায়

সূত বললেন–রূপবতী কৌশল্যা কয়েকজন পুত্র জন্ম দেন। তাঁদের নাম ভজিন, ভজমান, দিব্য, দেবাবৃধ, অন্ধক, মহাভোজ ও যদু নন্দন বৃষ্ণি। এঁদের মধ্যে মৃঞ্জরীর গর্ভে ভজমানের বাহ্য ও উপরিহাব্য নামে দুই পুত্র জন্মে। তার মধ্যে বাহ্যক মৃঞ্জয়ের দুইকন্যাকে বিবাহ করেন। সেই দুই বোন অনেক পুত্রের জননী হন। বাহ্যক থেকে বড় পত্নী গর্ভে নেমি, প্রণব, পুরপুরঞ্জয় বৃষ্ণি জন্ম নেন, বাহ্যকের কনিষ্ঠা পত্নীর গর্ভে কোটিজিৎ, সহস্রজিৎ, সত্যজিৎ ও বামক নামে চারপুত্র জন্মে।

পুরাণজ্ঞ দ্বিজেরা মহাত্মা দেবাবৃধের পুণ্যরাশির কীর্তন করেছেন। দেবতুল্য দেবাবৃধর পুত্র মানবসমাজে শ্রেষ্ঠ। তিনি দানবীর, সত্যবাদী, বিচক্ষণ ও কীর্তিমান। এঁরই বংশে সুমহান ভোজ ও মার্তিকাবতগণ উৎপন্ন হয়েছেন। বৃষ্ণির স্ত্রী গান্ধারী ও মাদ্রী। গান্ধারীর গর্ভে সুত্রি জন্ম নেন। মাদ্রীর পুত্ররা হল যুধাজিৎ, দেবমীয়ষ ও অনমিত্র। এঁদের মধ্যে অনমিত্র এক পুত্র লাভ করেন। তাঁর নাম নিগ্ন। নিম্নের দুই পুত্র অগ্রসেন ও শত্রুজিৎ। সূর্য শত্রুজিতের সখা। একদিন শত্রুজিৎ রাতে ভ্রমণ করতে করতে তোয়কুল্যা নদীর জল স্পর্শ করে রবির আরাধনা করে থাকেন। তখন ভগবান সূর্য তেজপুঞ্জময় হয়েও উপাসক শত্রুজিতের সামনে অস্পষ্ট রূপে দেখা দেন। রাজা বললেন–আপনার বিশেষ রূপ কিছুই দেখছি না।

তখন ভাস্কর তাঁকে সাম্যক মণি কণ্ঠে পরিয়ে দিলেন। রাজা শত্রুজিৎ সেটি গলায় পরে নগরে ঢুকলেন। নগরবাসীরা তাঁকে সূর্য মনে করে পিছন পিছন গেলেন। সকলে তাঁকে দেখে বিস্মিত হয়ে গেল। রাজা শত্রুজিৎ ভাস্কর প্রদত্ত এই মণি তার ভাই প্রসেনজিৎকে স্নেহবশে পরিয়ে দিলেন। সেই স্যমন্তক মণির গুণ এই যে, যেখানে এটি থাকবে সেখানে রোগ ভয় থাকবে না। কৃষ্ণের একবার এই মণি সম্পর্কে খুব লোভ হয়। কিন্তু তিনি লোভ সংবরণ করে থাকেন।

এদিকে প্রসেনজিৎ ঐ মণি গলায় পরে মৃগয়ায় যান, সেখানে একটি সিংহের হাতে তার মৃত্যু হয়। এক জাম্বুবান সেই মণি নিয়ে নিজের গুহায় চলে যায়। সকলে তখন এই মণি রত্ন হরণটি কৃষ্ণের কাজ বলে মনে করে। কারণ কৃষ্ণ মণির প্রতি লালসা দেখিয়েছিলেন। এই মিথ্যা অপবাদ গোবিন্দের খুব অসহ্য হয়ে উঠল। তিনি মণির খোঁজে অনুসরণ করতে করতে জাম্বুবানের গুহায় এলেন।

সেখানে দেখলেন জাম্বুবানের শিশু পুত্রকে তার ধাত্রী সেই মণিটি দেখিয়ে কাঁদতে নিষেধ করছে। সে বলছে– হে কুমার, তুমি কেঁদোনা, এই সামন্ত্যক মণি এখন তোমারই। এরপর জাম্বুবানের সঙ্গে কৃষ্ণের একুশ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। জাম্বুবান পরাজিত হয়ে তার হাতে মণিরত্নটি এবং নিজের কন্যা জাম্বুবতাঁকে অর্পণ করেন। কৃষ্ণ শত্রুজিতের মনি তাঁকে ফেরৎ দিয়ে নিজের অপবাদ মোচন করলেন। জাম্ববতাঁকে বিধিসম্মত ভাবে বিবাহ করলেন এবং মিথ্যা অপবাদ থেকে মুক্ত হলেন।

শত্রুজিতের একশো পুত্র জন্মায়। তার মধ্যে তিনজন খ্যাতি সম্পন্ন। বড় ছেলে ভঙ্গকারের দ্বারবতী নামে স্ত্রীর গর্ভে তিনটি সুন্দরী কন্যা জন্ম নেয়। তাদের একজন সত্যভামা। ইনি ব্রতচারিণী তপস্বিনী। ইনি কৃষ্ণের পত্নী হন। শত্রুজিৎ থেকে পুত্র ভঙ্গকার মণিটি পেয়ে থাকেন। কালক্রমে ঐ মণি শতধন্বার কাছ থেকে অর পেয়ে যান। সত্যভামার পাণিপ্রার্থী হতে চান শতধন্থা। অক্রুর স্যমন্তক মণি পাবার আশায় এ ব্যাপারে শতধ্বনাকে সাহায্যে করার প্রতিশ্রুতি দেন।

মহাবলী শতধন্বা রাত্রিবেলা গোপনে ভঙ্গকারকে মেরে সেই মণি এনে অক্রুরকে দেন। অক্রুর প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে, শতধন্বা এ ঘটনা কারোকে বলবে না। কৃষ্ণ যদি জানতে পেরে অত্যাচার করেন তাহলে সবাই মিলে শতধন্বকে সাহায্য করবে। সমস্ত দ্বারকাপুরী অরের বশে থাকবে।

এদিকে পিতার মৃত্যুতে দুঃখিত হয়ে সত্যভামা বারণাবত নগরে এসে শতধন্থার নিষ্ঠুর কাজের কথা স্বামীকে বলে কাঁদতে লাগলেন। হরি তখন দ্বারকায় এসে জ্যেষ্ঠ হলধরকে বললেন, স্যমন্তকের জন্য সিংহ প্রসেনজিৎকে হত্যা করেছিল। আর এখন শতধন্বও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটাল। এজন্য আপনি তাকে শাস্তি দিতে প্রস্তুত হন। শতধন্বার হত্যাতে সাহায্য করুন। তারপর তুমুল যুদ্ধ বাধল। শতধন্ব যুদ্ধক্ষেত্রেও কোথায় অরকে দেখতে পেলেন না, সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েও অক্রুর সাহায্য করলেন না। তিনি ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাবেন ঠিক করলেন। সিন্ধু ঘোটকে চড়ে পালানোর সময় ঘোটকটির মৃত্যু হল। কৃষ্ণ বলরামকে ডেকে বললেন, শত্রুরা নিহত হয়েছে। এবার পায়ে হেঁটে আমি মণিরত্ন নিয়ে আসি। এই বলে কৃষ্ণ হেঁটে গিয়ে মিথিলাপতি শতধন্থাকে হত্যা করলেন। কিন্তু মণি পেলেন না।

শুনে বলরাম রেগে গিয়ে কৃষ্ণকে বললেন– তুমি ভাই বলে তোমাকে ক্ষমা করলাম আমি দ্বারকায় থাকবো না, তোমার মঙ্গল হোক, আমি মিথিলায় চলে যাবো। এই সময় বুদ্ধিমান ব আত্মরক্ষার জন্য কবচ ধারণ করে নানাবিধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান শুরু করলেন। স্যমন্তক মণি রক্ষার জন্য বস্তু অর্থাৎ অরকে রক্ষাকবচ ধারণ করেছিলেন। তিনি ষাট বছর কাল ধরে যজ্ঞে অন্ন ও বহু দ্রব্য দান করলেন। রাজা দুৰ্য্যোধন একবার মিথিলায় বলভদ্রের কাছে গদাযুদ্ধ শিক্ষা নেন। অনেকদিন পর বৃষি ও অন্ধক বংশীয় প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা বলরামকে অনেক অনুনয় করে দ্বারকায় ফিরিয়ে আনলেন। অক্রুর ভঙ্গকারের দুই পুত্র বন্ধুমান ও শত্রুঘ্নকে হত্যা করে দ্বারকা ত্যাগ করলেন। অকুরের প্ররোচনায় শতবহুবার দ্বারা ভঙ্গকারের মৃত্যুতে কৃষ্ণ খুশি ছিলেন না। এদিকে অনাবৃষ্টিতে রাষ্ট্র নষ্ট হতে চলল।

তখন অঙ্কুরকে আবার দ্বারকায় ফিরিয়ে আনা হল। তখন সহস্রাক্ষ বারিবর্ষণ করতে লাগলেন। সব জায়গায় বৃষ্টি হল। কৃষ্ণ যোগবলে জানতে পারলেন, সামন্ত্যক মণি অকুরের কাছেই আছে। তিনি সভার মধ্যে সকলের সামনেই তাকে বললেন–আপনার কাছে যে সামন্ত্যক মণি রয়েছে তা এবার ফেরৎ দিন, দীর্ঘ ষাট বছর ধরে আমার মধ্যে যে রাগের সঞ্চয় হচ্ছে তাকে আর বাড়তে দেবেননা। তখন অক্রুর কৃষ্ণের কথায় মণি ফেরৎ দিলে কৃষ্ণ আবার বড়ুকেই মণিটি দান করেন। এই ভাবে বড়ু অর্থাৎ অক্রুর কৃষ্ণের কাছ থেকে স্যমন্তক মণি লাভ করে স্বমহিমায় বিরাজ করতে লাগলেন। বৃষ্ণির পুত্র অনমিত্র থেকে শিনির জন্ম। শিনির পুত্র সাত্যক। সাত্যকের পুত্র সাতকীর নাম যুযুধান। তার পুত্র ভৃতি। ভৃতির পুত্র যুগন্ধর। যুগন্ধরের বংশধরেরা ভৌত্য নামে বিখ্যাত। মাদ্রীর পুত্র যুধাজিতের পৃস্নি নাম এক পুত্র উৎপন্ন হয়। পৃস্নির দুই পুত্র– স্বকল্কর ও চিত্রক। স্বকল্ক কাশীরাজ এর কন্যা গান্দিনীকে বিয়ে করেন। এই কন্যাটি বহু বছর মাতৃগর্ভে ছিলেন। গর্ভস্থ অবস্থায় পিতাকে বললেন– গোদান করতে। এই গান্দিনী হলেন অঙ্কুর-এর মা। এছাড়া গন্দিনীর অনেক পুত্র হয়। অক্রুর ও উগ্রসেনীর দেব ও অনুদেব নামে দুই পুত্র ছিল। চিত্রকের পুত্রদের নাম পৃথু, বিপৃথু, অশ্বগ্রীব প্রভৃতি। মেয়েরা হলেন– অভূমি, বহুভূমি প্রভৃতি।

সত্যকের চার পুত্র–ককুদ, ভজমান, সমী, কম্বল। বর্হিককুদের ছেলে বৃষ্টি, তার ছেলে কপোত রোথ, তার ছেলে বেরত, তার ছেলে বিদ্বান, তাঁর পুত্র অভিজিত, আর অভিজিতের ছেলে পুনর্বসু, অশ্বমেধের বেদী থেকে পুনর্বসুর জন্ম, বিদ্বান, ধার্মিক। পুনর্বসুর যমজ পুত্র কন্যার নাম আহুক আহুকী, আহুকের বংশে সকলেই সত্যবাদী, বিদ্বান, ধার্মিক। আহুক একুশ হাজার রথী নিয়ে ভোজ রাজ্য আক্রমণ করেন। আহুক তার বোন আহুকীকে আহুকন্ধের হাতে সম্প্রদান করেন। এদের এক ছেলে দু মেয়ে। ছেলেদের নাম দেবক ও উগ্রসেন।

দেবকের ছেলেদের নাম দেবদেব, সুদেব, দেবরঞ্জিত, এদের সাত বোনকেই বসুদেবের হাতে, সম্প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে এক বোনের নাম দেবকী। উগ্রসেনের ছয় ছেলের মধ্যে বড় কংস। ভজমানের ছেলে বিদুরথ। তার তিন পুত্র, নাম রাজর্ষিদেব, শূর ও বিদুর। শূরের ছেলে শমী। শমীর পুত্র স্বয়ম্ভাজ, তার ছেলে হৃদিক। হৃদিকের দশ পুত্র। এঁদের মধ্যে দেবাহেদ কম্বলবহি নামে পুত্র জন্মে। এঁর দুই পুত্র, অসযৌজা ও সুমমৌজা। অসমৌজা অপুত্রক ছিলেন বলে কৃষ্ণ তাঁকে সুদ্রংষ্ট্র ও সূরপা নামে ছেলে দান করেন। এরাই অন্ধক নামে বিখ্যাত। শূর থেকে অস্মকীর গর্ভে দেবমীতুষ, মাধীর গর্বে দেবমানুষ, ভামীর গর্ভে বসুদেবদি দশ পুত্র জন্মে, বসুদেবের জন্ম সময়ে স্বর্গে দুন্দুভি বেজে উঠেছিল এবং পুষ্পবৃষ্টি হয়েছিল। সমস্ত মানবলোকে তার মত সুন্দর কেউ ছিল না। এদের চার বোনের মধ্যে পৃথা অন্যতম।

কুন্তীরাজ পৃথাকে কন্যাত্বে বরণ করলে তার নাম হয় কুন্তী। কুরুবীর পাণ্ডুরাজা কুন্তীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেন। পৃথার গর্ভে ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র থেকে যথাক্রমে যুধিষ্ঠীর, বৃকোদর ও ধনঞ্জয়- এই তিন পুত্র জন্মে। এই তিন পুত্ৰই অগ্নির মতো তেজস্বী ও বীর্যশালী ও পরাক্রমী ছিলেন। দুই অশ্বিনীকুমার থেকে মাদ্রীর গর্ভে নকুল ও সহদেবের জন্ম বলে শোনা যায়। পৃথার বোন শ্রুতশ্রবার গর্ভে চেদিরাজ শিশুপাল জন্মে। এই শিশুপাল পূর্বজন্মে দশগ্রীব হয়ে জন্মগ্রহণ করেন, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ এঁর ভাই। বসুদেবের তেরোজন পত্নীর মধ্যে রোহিণী ছিলেন তাঁর প্রিয়তমা। ইনি বাল্মীকের কন্যা, রোহিণীর গর্ভে বলরাম, সারণ প্রভৃতি পুত্র ও এক কন্যা জন্মে। বলরামের আবার অনেক পুত্র কন্যা জন্মে। বলরামের ছোট ভাই সারণের পুত্ররা হলেন– ভদ্ৰাস্ব, ভদ্রবাহু ইত্যাদি। বৈশাখী নামে এক পত্নীর গর্ভে বাসুদেব কৌশিক নামে এক পুত্র উৎপাদন করেন। বসুদেব থেকে দেবকীর গর্ভে সুষেণ, কীর্তিমান, ভদ্রসেন, ইত্যাদি ছয় পুত্র জন্ম নেয়। এদের সকলকেই কংস হত্যা করেন। ঐ সময় বিষ্ণু দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হন। এর পরে সুভদ্রা নামে কন্যা জন্মে, সুভদ্রা কৃষ্ণা নামেও পরিচিত। পার্থ থেকে সুভদ্রার গর্ভে অভিমন্যুর জন্ম।

বসুদেব পত্নীদের গর্ভে বীর পুত্ররা জন্মায়। কিন্তু বসুদেবের পুত্রেরাই কংসের হাতে নিহত হন। যুগন্ধী ও বনরাজী নামেও বসুদেবের প্রণয়িনী ছিলেন। তাদের গর্ভেও পুণ্ড্র ও কপিল নামে দুই পুত্র জন্মে। পুণ্ড্র রাজা হয়েছিলেন আর কপিল বনে গিয়েছিলেন, দেবকীর সপ্তম পুত্র হলে শ্রাদ্ধদেব। এই পুত্র নিষেধ নামে রাজা হয়েছিলেন। এই শ্রাদ্ধদেবই নিষধদের আদি পুরুষ ইনিই মহাবীর একলব্য। কৃষ্ণ তুষ্ট হয়ে পুত্রহীন গঙুষের হাতে চারুদেষ্ণ ও শাম্ব নামে পুত্র দান করেন।

মহাতেজা দেবদেব প্রজাপতি কৃষ্ণ আগে লীলার জন্য মনুষ্যলোকে জন্ম নেন। বসুদেবের তপস্যার ফলে দেবকীর গর্ভে আসেন। তিনি যোগীপুরুষ, দিব্য সুন্দর, তিনিই হলেন সনাতন হরি। ইনিই প্রাচীনকালে প্রজাপতিকে সৃষ্টি করেন। যযাতির বংশধর শ্রীমান বসুদেবের বংশ সত্যিই পবিত্র। কেননা এই বংশে জন্ম নিয়ে নারায়ণ লৌকিক কাজে তৎপর হয়েছিলেন। নারায়ণের জন্মে সাগর কেঁপে উঠেছিল। মঙ্গল বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছিল। তার জন্মকালে অভিজিত নক্ষত্র, জয়ন্তী নামে শর্বরী ও বিজয় নামে মুহূর্ত ছিল। হরি, নারায়ণ ভগবান কৃষ্ণ নয়ন দিয়ে দৃষ্টিপাত করে সকলকে বিমোহিত করে আবির্ভূত হন।

বসুদেব সেই রাত্রিতে জন্মগ্রহণ করা পুত্রের রূপ ও লক্ষণ দেখে বললেন–প্রভু তোমার এই রূপ সংবরণ করো। কংস আমার অপূর্ব সুন্দর দিব্যকান্তি পুত্রদের সকলকেই হত্যা করেছে। বসুদেবের কথা শুনে ভগবান তার রূপকে সম্বরণ করলেন। পরে উগ্রসেনের আদেশে বসুদেব পুত্রকে নিয়ে– নন্দগোপের বাড়ি গেলেন। নন্দ গোপের স্ত্রী যশোদাও দেবকীর সঙ্গে গর্ভবতী হয়েছিলেন। সেই রাতেই তাঁর একটি কন্যা জন্ম নেয়। বসুদেব ঐ কন্যাকে নিজের বাড়ি নিয়ে এলেন আর কৃষ্ণকে যশোদার হাতে দান করলেন। বাড়ি এসে তিনি কংসকে বললেন– তোমার ভগ্নীর এই কন্যা হয়েছে। মেয়ে হয়েছে। জেনে কংস তাকে ত্যাগ করলেন। কৃষ্ণের কথা জানতে পারল না।

সেই কন্যা বসুদেবের ঘরে বড় হতে লাগল। দেবতারা প্রজাপতির কাছে গিয়ে বললেন– কেশবকে রক্ষার জন্য একানংশা জন্মগ্রহণ করেছেন। যাদবেরা আনন্দের সাথে তাকে পূজা করছেন। দিব্যদেহ বিষ্ণু এই একানংশা দেবী দ্বারাই রক্ষিত হচ্ছেন। ঋষিরা বললেন–ভোজবংশধর কংস কিজন্যে বসুদেবের পুত্রদেরকে সবলে হত্যা করেছিল তা আমাদের কাছে প্রকাশ করে বল। মৃত বললেন– কথিত আছে যুবরাজ কংস প্রায়ই বসুদেব ও দেবকীর সারথি হতেন। একদিন আকাশে কোনও এক অদৃশ্য প্রাণীর এরকম একটি বাণী শোনা গেল, তুমি যাঁদের রথে নিয়ে বেড়াও তাঁদের সপ্তম গর্ভের পুত্রের হাতে তোমার মৃত্যু হবে।

শোনা মাত্র খড় নিয়ে দেবকীকে বিনাশ করতে গেল কংস। অনেক অনুনয় করে বসুদেব কংসকে। শান্ত করলেন। বললেন–দেবকীর গর্ভে সমস্ত সন্তানকেই তিনি কংসের হাতে দান করবেন, এ কথা কখনো মিথ্যা হবে না। পাপী কংস সমস্ত পুত্রদেরই হত্যা করেছিল। বিষ্ণু দেবকীর কামনা পূর্ণ করেছিলেন। যোগাত্মা বিষ্ণুও যোগমায়া দ্বারা সমস্ত প্রাণীকে বিমোহিত করে তিনি মানুষী তনু গ্রহণ করেন। বাসুদেবের সত্যভামা, গৈজা, সুদেবী, অত্রী, সুশীলা কালিন্দী ইত্যাদি অনেক রাজার কন্যার সঙ্গে বসুদেবের বিবাহ হয়। এঁরা সব স্বর্গলোকের অঙ্গরা, বাসুদেবের পত্নীপদ লাভ করে এঁরা ধন্য। এঁদের গর্ভে অসংখ্য পুত্র কন্যার জন্ম হয়। শিনিংশীয় মহাত্মা বৃহদুথের কন্যা বৃহতী গুনয়ের সাথে মিলিত হল। সুনয়ের অঙ্গদ, ককুদ, শ্বেত নামে শ্বেতা নামে কন্যা জন্মে। এভাবে যাদবদের তিনকোটি ষাট হাজার মহাবল বীর্যবান পুত্র জন্মে অত্যাচারী অসুরদের বিনাশ করার জন্য যাদব নন্দনরা জন্মায়। তারমধ্যে বিষ্ণুর কুলকেই সবাই অমুজন করে। তারা একই কুলে পরিণত হন।

.

ছিয়ানব্বইতম অধ্যায়

সূত বললেন–এবার মনুষ্য প্রকৃতি দেবতাদের বৃত্তান্ত বলছি। যদুবংশীয় প্রখ্যাত বীর সঙ্কর্ষণ, বাসুদেব, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব ও অনিরুদ্ধ এবং সপ্তর্ষিরা কুবের যক্ষ মণিবর, শালকী বদর, বিম্বন, ধন্বন্তরী, নন্দী প্রমুখেরা মহাদেব শালক্কায়ন ও আদিদেব বিষ্ণু এরা সবাই দেবতাদের সাথে পতিন্ন। ঋষিরা জিজ্ঞেসা করলেন বিষ্ণু কেন জন্ম গ্রহণ করলেন? কতবার অবতার হয়েছেন? যুগ যুগ ধরে কি জন্যে তিনি মানুষ সমাজে অবতার হিসাবে জন্মেছেন? ভগবানকে মানবী কিভাবে গর্ভে ধারণ করেছিলেন?

আমরা জানতে চাইছি তার কথা, যিনি নিজের দেহকে দ্বিধাবিভক্ত করে নরসিংহ রূপে আদি দৈত্য হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করেন। যাকে যুগে যুগে পণ্ডিতরা সহস্রপদ, সহস্রাক্ষ, সহশ্রাংশু ও সহস্রাশিরা বলে কীর্তন করেন। একনির জলে যার নাভি থেকে ব্রহ্মা উদ্ভূত হয়েছিলেন। যিনি কালনেমিকে হত্যা করেন। পুরাকালে অদিতি যাঁকে গর্ভে ধারণ করেন। যিনি পুরাকালে যুপ, শমিধ, সোম, যজ্ঞীয় দ্রব্য, : যজমণি ও যজ্ঞশ্রেষ্ঠ অশ্বমেধ সকল প্রবর্তিত করেন। যিনি ক্ষণ, নিমেষ, কাষ্ঠা, কাল, ত্রিসন্ধ্যা, মুহূর্ত, তিথি, মাস, দিন, বৎসর, ঋতু, আয়ু, ক্ষেত্র, বৃন্দা, সৌষ্ঠব, মেধা, শৌর্য, তিনলোক, তিন অগ্নি, ত্রিগুণ ইত্যাদি সৃষ্টি করেছেন। যিনি চার বর্ণ, চার বিদ্যা ও চার আশ্রম সৃষ্টি করেন, আকাশ, ভূমি, জল, বায়ু, ‘অগ্নি, চন্দ্র, সূর্যকিরণ প্রভৃতি যাঁর রূপ। যাঁকে পরম দেব ও পরম তপস্যা বলে জানা যায়, যিনি বেদবিদগণের বিদ্যা, প্রভুদেরও প্রভু, তেজঃ পুত্রের অগ্নি, তপস্বীদের তপস্যা, বিগ্রহীরীদের বিগ্রহ ও গতিশীলাদের গতি, তিনিই দেব মধুসূদন, বায়ুর প্রাণ আকাশ, অগ্নির প্রাণবায়ু, দেবগণের প্রাণ অগ্নি এবং অগ্নির প্রাণ মধুসূদন।

রস থেকে রক্ত, রক্ত থেকে মাংস, মাংস থেকে মেদ, মেদ থেকে অস্থি, অস্থি থেকে মজ্জা, মজ্জা থেকে শুক্র, এবং শুক্র থেকে গর্ভোৎপত্তি, গর্ভের রস বা জল সৌৰ্য্য রাশি বা উষ্ণা বাপ ও শোণিত তৃথা দ্বিতীয়রাশি বলে উল্লিখিত। কৃষ্ণ বর্গে শুক্র ও পিত্ত বর্গে শোণিত প্রতিষ্ঠাতা কক্ষের ঋণ হৃদয় এবং পিত্তের স্থান নাভি। নাভি পেটের ভেতরে হুতাশানদেব রয়েছেন মন প্রজাপতি, কথ্য সোম, পিত্ত অগ্নি এবং সমস্ত জগতই অগ্নিষেমাত্মক আখ্যায় অভিহিত। এভাবে গর্ভসৃষ্টি হয়। বায়ু এই গর্ভে পরমাত্মার সঙ্গে মিলে প্রবেশ করে ঐ বায়ু পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে শরীরে থেকে গর্ভস্থ প্রাণকে পরিপুষ্ট করে।

প্রাণ, আপান, সমান, উদান ও ব্যান গর্ভের এই পঞ্চ প্রাণ পরমাত্মাকে ধরে রাখে। তারপর পৃথ্বী, বায়ু, আকাশ, জল ও জ্যোতি পঞ্চভূতে গর্ভের সঙ্গে মেশে। সমস্ত ইন্দ্রিয় নিবিষ্ট হয়ে নিজ নিজ শক্তি প্রকাশ করতে থাকে। এই দেহের ছিদ্রগুলি আকাশ যোনি, সে সব ছিদ্রপথে জল নিঃসৃত হয়। জ্যোৎস্না হল চোখের রশ্মি। এইভাবে গর্ভস্থ পুরুষ থেকেই যুদ্ধ প্রভৃতি কঠোর কাজ ও সম্ভোগ প্রভৃতি কোমল কাজ প্রবর্তিত হয়ে থাকে। এভাবে সমস্ত লোককে যে সনাতন পুরুষ সৃষ্টি করেছেন, সেই বিষ্ণু কিভাবে নরত্ব পেলেন? এটি বিস্ময়কর বটে যে তিনি কিবাবে মানুষী শারীর পেলেন। আমরা বিষ্ণুর কৃতকর্ম ও আশ্চর্য উৎপত্তি বার্তা শুনতে চাই।

সূত বললেন–আমি সেই মহাতপা যোগীর আবির্ভাব বিবরণ এবং যে রূপে তিনি নরলোকে উৎপন্ন হলেন তা আপনাদের বলছি। বিষ্ণুর অবতার সংখ্যা অনেক তাঁর দিব্য শরীরের বিবরণ বলছি। কালক্রমে যুগ ধৰ্ম অতিক্রান্ত হলে ধর্ম ব্যবস্থার জন্য সুর-অসুরদের মধ্যে সুসম্পর্ক কি ছিল দেব-অসুর সবাই বলীর শাসনাধীন ছিল। কিন্তু পরে সম্পত্তি কারণে দেব-অসুরদের মধ্যে ভীষণ বিবাদ সৃষ্টি হয়। সে বিবাদ, সংগ্রাম দিন দিন বাড়তে থাকে। এভাবে বরাহ কল্পে তাদের বারোটি সংগ্রাম হয়। প্রথম নরসিংহ সংগ্রাম, দ্বিতীয় বাসন তারপর যথাক্রমে বরাহ, অমৃত যখন, তারকাময়, আড়ীবক, ত্রৈপুর, অন্ধাকর, ধ্বজ, দশমবতি।

একাদশ সংগ্রামের নাম হলাহল ও দ্বাদশ ঘোর কোলাহল। নরসিংহ অবতার অসুররাজ হিরণ্যকশিপুকে নিহত করেন, বামন ত্রৈলোক্য আক্রমণ করে। বলিকে বন্দি করেন। দেবতাদের সাথে যুদ্ধে মহাবল হিরণ্যাক্ষ নিহত হয়। বরাহ দাঁতে করে সমুদ্রগর্ভ থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করেন। অমৃত মন্থনের ব্যাপারে যে সুর-অসুর সংগ্রাম হয় যেখানে ইন্দ্রের হাতে প্রহ্লাদ পরাজিত হন। প্রহ্লাদের পুত্র বিরোচন ইন্দ্র বধের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু ইন্দ্র তারকাময় সংগ্রামে তাকে হত্যা করেন। এই দৈত্য বিরোচন ভবের বর পেয়ে অস্ত্রশাস্ত্র সজ্জিত হয়ে থাকতেন, একে বিনাশ করার অধিকার ইন্দ্রের ছিল না। তখন বিষ্ণু ইন্দ্র দেহে আবিষ্ট হয়ে বিরোচনকে বিনাশ করেন, দেবাসুরের এই যুদ্ধই ষষ্ঠ যুদ্ধ।

অসুরদের ত্রিপুর নামে সুরক্ষিত দুর্গ ছিল। এই দুর্গের সমৃদ্ধি দেবতাদের কাছে অসহ্য মনে হয়েছিল। তখন এ্যম্বক ঐ ত্রিপুরের সাথে সেখানকার সমস্ত দানবদের হত্যা করেন। অসুর ও অন্ধকার নামে রাক্ষসদের সঙ্গে অষ্টম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পিতৃগণ দানব পক্ষে যোগদান করেন, তখন মহেন্দ্র, বিষ্ণুর সাহায্য গ্রহণ করে পিক্ষ দলভুক্ত সমস্ত অসুর ও রাক্ষসদের বিতাড়িত করেন। বিচিত্তির সাথে দেবতাদের নবম যুদ্ধ হয়। তিনি মায়াচ্ছন্ন হয়ে যুদ্ধ করতে থাকেন। মহেন্দ্র তার রথধ্বজ লক্ষ্য করে বাণ নিক্ষেপ করে। বিচিত্তির মৃত্যু হয়।

রাজা রাজ কোলাহল নামে সংগ্রামে দেবতা পরিবৃত্ত হয়ে সমস্ত দেবতাদানব নিধন করেন। অসুর পুরোহিত ষণ্ড ও অথর্বকে দেবতার যজ্ঞীয় অমৃত দিয়ে বাধ্য রেখেছিলেন। এইভাবে পুরাকালে সুরাসুর যুদ্ধে প্রজাগণের অমঙ্গলকারী বারোটি সংগ্রাম হয়েছিল। রাজা হিরণ্যকশিপু একটানা এক অবুদ এক লক্ষ আশী হাজার বাহাত্তর বছর ধরে ত্রৈলোক্যের আধিপত্য করেন। তারপর পর্যায় ক্রমে বলী রাজা হন। তিন শাসন করেন এক অবুদ ষাট হাজার বিশ নিযুত বছরে। অসুরদের মধ্যে হিরণ্যাক্ষ প্রহ্লাদ, বলী তিনজনই প্রসিদ্ধ অসুর। দশযুগ পর্যন্ত তিলোক অসুরদের আয়ত্তেই ছিল। রাজ্য ছিল শত্রুহীন। তারপর ইন্দ্র ত্রিলোকের ভার নেন। সমস্ত কিছু থেকে অসুরদের পরিত্যাগ করেন। নিজেরা আধিপত্য পেয়ে সমস্ত কিছু ভোগ করতে লাগলেন। তখন এই দেখে অসুররা শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে বলল– প্রভু! দেবতারা আমাদের অবজ্ঞা করে রাজ্য নিয়েছে, যজ্ঞ ভাগও নিয়েছে, আমরা আর থাকতে পারছি না, এবার আমরা রসাতলে প্রবেশ করব। দুঃখিত শুক্রাচার্য সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–তোমরা ভয় পেয়ো না। আমি নিজে তোমাদের রক্ষা করব। দেখ বৃষ্টি, ওষধি, পৃথ্বী এবং অন্যান্য বীরত্ব সমস্তই আমাতে বিরাজিত। আমি দেবতাদের তা থেকে সামান্য দিয়েছি। তোমাদের মঙ্গলের জন্য তোমাদের সবই দান করব।

তখন দেবতারা দেখলেন শুক্রাচার্য অসুরদের রক্ষা করছেন, ভরসা দিচ্ছেন। তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। তারা আলোচনা করলেন এই অসুর গুরু শুক্রাচার্য দৈত্যদের শক্তিশালী করে তুলছে, সুতরাং তাড়াতাড়ি অসুরদের আবাস নষ্ট করে তাদের নিধন করতে হবে। আর অবশিষ্টদের পাতালে পাঠাতে হবে। দেবতারা সুসজ্জিত হয়ে দানবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলেন। বহু দৈত্য নিহত হল আর অবশিষ্টরা আহত অবস্থায় শুক্রাচার্যের কাছে গেল। দেবতারাও তাদের পিছনে পিছনে আসতে লাগল। অসুর গুরু তখন তাদের রক্ষা করার ইচ্ছায় বললেন– আগে সমস্ত সংগ্রামে দেবতারাই জয়ী হয়েছে আর অসুররা অধিকাংসই নিহত হয়েছে। এখন তোমরা এই যুদ্ধে যে কয়েকজন অবশিষ্ট আছ,

তাদের জন্য আমি কোন্ ভালো নীতি প্রয়োগ করব। তোমাদের বিজয়ী করার জন্য আমি মহাদেবের কাছে যাবো। আমি জানি বৃহস্পতি ওদিকে দেবপক্ষ নিয়ে যজ্ঞ করছেন। আমাকেও মন্ত্রলাভের জন্য দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে যেতে হবে। তোমাদের ভয় নেই। তোমরা বল্কল গায়ে তপস্যা করো। আমার আসা যাওয়ার মাঝে দেবতারা তোমাদের হত্যা করতে পারবে না। আমি মহেশ্বরের কাছে মন্ত্র পেয়ে দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করব। তাতে তোমাদেরই জয় লাভ হবে।

অসুরেরা তখন বলল- তোমরা সমস্ত লোক অধিকার করে নাও। আমরা বনে গিয়ে বল্কল পরে তপস্যা করব। একথা বললেন–দৈত্যদের প্রতিনিধি প্রহ্লাদ। দেবতারাও তখন যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করে নিশ্চিন্ত হলেন। দৈত্যরাও অস্ত্র পরিত্যাগ করলেন। অসুর গুরু শুক্রাচার্য বললেন–তোমরা কিছুদিন এখন কার্য সিদ্ধির জন্য তপস্যা করো। তারপর তিনি মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন। প্রণাম করে বললেন–দেবতাদের পরাভব ও অসুরদের জয়ের মন্ত্র আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করতে এসেছি। মহাদেব বললেন– তুমি ব্রহ্মচারী হয়ে পরম নিষ্ঠায় ব্রতচারণ কর। এক হাজার বছর ধরে যদি তুমি অধোমুখে তপস্যা করো তবে তোমার মঙ্গল হবে।

মহাতপা শুক্র খুশি হয়ে মহাদেবকে বললেন–আমি তাই করব। এদিকে দেবতারা বুঝতে পেরে গেলেন শুক্র মহাদেবের কাছে গেছে মন্ত্র লাভের প্রার্থনা করতে। অসুররা যখন তপস্যা করে, তখনই তাদের নিরস্ত্র পেয়ে দেবতারা আক্রমণ করলেন। অসুররা বিচলিত হয়ে উঠে পড়লেন। আমরা বল্কল ধারণ করে তপস্যা করছি এভাবে যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়, আমরা এখন গুরু শুক্রের জননীর কাছে আশ্রয় চাই, একথা পরস্পর আলোচনা করে ভীত হয়ে শুক্র জননীর শরণ নিল। তিনি বললেন– দানবরা তোমাদের কোনও ভয় নেই।

দেবতারা অসুরদের ভীত হয়ে শুক্ৰমাতার শরণাপন্ন দেখেও কোনও কিছু বিচার না করে আশ্রমের মধ্যে প্রবেশ করে নির্বিচারে তাদের মারতে লাগলেন। জননী প্রচণ্ড রেগে বললেন–আমি দেবতাদের ইন্দ্র বিহীন করব। ইন্দ্রকে স্তম্ভিত করে দেবতারা যে যার পালিয়ে গেলেন। বিষ্ণুও ইন্দ্রকে বললেন, তুমি আমার দেহে প্রবেশ কর, তোমায় এখান থেকে নিয়ে যাব, একথা শুনে ইন্দ্র বিষ্ণুর দেহে প্রবেশ করলেন। শুক্রমাতা রেগে গিয়ে বললেন–তোমাকে বিষ্ণুর সঙ্গেই দগ্ধ করব। আমার তপস্যার ক্ষমতা দেখুন। তারা দুজনেই শুক্ৰমাতার প্রভাবে অভিভূত হয়ে আলোচনা করতে লাগলেন কিভাবে এই দেবীর কাছ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ইন্দ্র বললেন–আপনি এঁকে এখনই বিনাশ করুন। বিষ্ণু একথা চিন্তা করা মাত্র তার হাতে চক্র এসে গেল। বিষ্ণু চক্রের আঘাতে দেবীর শিরোচ্ছেদ করলেন। এভাবে স্ত্রী বধ হওয়ায় ভৃগু রেগে গিয়ে বিষ্ণুকে অভিশাপ দিয়ে বললেন– মহর্ষি স্ত্রী জাতিকে হত্যা করা-পাপ, তুমি জেনেশুনে যখন স্ত্রী জাতিকে হত্যা করলে তখন এই অপরাধে তোমায় সাতবার মনুষ্যলোকে বাস করতে হবে।

ভৃগু তখন স্ত্রীর ছিন্ন মস্তক এনে দেহের সাথে যোগ করে হাতে জল নিয়ে বললেন–বিষ্ণু তোমাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে, আমি তোমায় সত্য বলে জীবিত করব। যদি আমি সমস্ত ধর্ম আচরণ করে থাকি, সত্য বাক্য বলি ও সত্যের সেবা করে থাকি তবে দেবী তুমি জীবিত হও। ভৃগুর সত্যবাক্যে তখনই তাঁর পত্নী জীবিত হলেন। সমস্ত প্রাণীর সামনে ভৃগুর তপঃ প্রভাবে তাঁর পত্নী জীবন ফিরে পেলেন। এটি তখন অদ্ভুত ব্যাপার হয়ে পড়ল। ইন্দ্র এই দেখে শুক্রের ভয়ে তখন থেকে আর শান্তি লাভ করতে পারলেন না।

দেবরাজ ইন্দ্র নিজের কন্যা জয়ন্তীকে বললেন–শুক্রাচার্য ইন্দ্রপদ লোপ করার জন্য কষ্টের তপস্যায় নিরত রয়েছেন, তাই আমি ব্যাকুল হয়েছি। তুমি সেই শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে তার সেবা কর, তাঁকে প্রীত কর। শুভচারিণী জয়ন্তী শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে বাবার কথামতো সেবা করতে লাগলেন। তিনি শুক্রাচার্যের সেবার কাজে বহু বছর কাটিয়ে দিলেন। তারপর ভৃগু নন্দনের কঠোর ব্রত সাঙ্গ হল। মহাদেব খুশি হয়ে বর দিলেন। বললেন– আমার বরে তুমি দ্বিজশ্রেষ্ট হবে। আমার যা কিছু মন্ত্র শক্তি তা দিয়ে তুমি সুরসমাজকে অভিভূত করবে। ভৃগুপুত্র বর লাভ করে খুশি হলেন। তার মুখ থেকে মহেশ্বরের স্তোত্র উচ্চারিত হল। তিনি নীললোহিতের স্তব করতে লাগলেন। তুমি শিতিকণ্ঠ, স্বরূপ, সুরর্চা, রিরিহান, লোপ ও বৎসর তোমাকে নমস্কার।

তুমি কপদী, উৰ্দ্ধরোমা, হয়, করণ, সংস্কৃত, সুতীর্থ, দেবদেব, দ্র, তপঃ চীরবাস, হ্রস্ব, মুক্তকেনা, সেনালী, রোহিত, কবি, গিরিমা, অর্কনেত্র যতি ধন্বী, ভার্গব, সহস্রচরণ, সরশিরা, বিশ্বরপা, ভীমউগ্র, শিব, বদ্র, অনিল, মহাদেব, উগ্র ত্রিনেত্র, পুন্য, ধার্মিক, শুভ, অবধ্য, অমৃতাঙ্গ, নিত্য, শাশ্বত, শরভলী, ত্রিচক্ষু, সত্য, তপবন, দীপ্ত, চক্র, খর্ব মেঘ, নিশি, তাপখণ্ড, স্ফীত, দুর্গম, দক্ষ, জঘন্য, গর্মণ, সচক্ষু, বামদেব, ঈশান, ভৃগুনাথ, ধীমান, বিপ্রিয়, কৃথ্বিকসা।

আপনি পশুপতি ও ভৃগুপতি, আপনি প্রণব, ঋক্‌ যজু, সাম, ঋধা, যুধা স্রষ্টা, ধাতা, হোতা, হর্তা ভূত, ভব্য, ভব আঘানাকে নমস্কার। আপনি বসু, মাঠ্য, রুদ্র, দেবাত্মা, ঋত্বিক, যজ্ঞাত্মা, আপনাকে প্রণাম। আপনি তপ, যোগ, অহিংসা অলোভ, সত্য, লোকাত্মা যোগাত্মা আপনাকে নমস্কার। আপনি ত্রৈলোক্যস্বরূপ, এই স্তবে আপনাকে কীর্তন করলাম। আমাকে ভক্ত মনে করে আমার ঐ দোষ ক্ষমা করুন।

.

সাতানব্বইতম অধ্যায়

সূত বললেন– শুক্রাচার্য এভাবে মহাদেবের স্তব আরাধনা করে তাকে প্রণাম করলেন। ভবদেব তাকে স্পর্শ করে দর্শন দিয়ে অন্তর্হিত হলেন। তারপর ইন্দ্র কন্যা জয়ন্তীকে সেখানে বসে থাকতে দেখে হাতজোড় করে বলতে লাগলেন–হে দেবী! তুমি কার পত্নী, কেনই বা আমার দুঃখে কাতর? তোমার ভক্তি ও বিনয় দেখে আমি খুশি হয়েছি। তোমার কি বাসনা বল, সে একান্ত দুর্লভ হলেও, আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করব। জয়ন্তী বললেন–আপনি তপস্যা দিয়ে আপনার অভিলাষ জানুন। শুক্র দিব্য দৃষ্টিতে তা জানতে পেরে বললেন–তুমি ইন্দ্রের কন্যা আমার কল্যাণ কামনায় এখানে এসেছো, তুমি অদৃশ্য হয়ে আমার সাথে দশ বারে থাকতে চেয়েছো। তোমার সেই ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। তুমি আমার গৃহে চল। শুক্র জয়ন্তীর সাথে অদৃশ্য হয়ে দশ বছর একসাথে বাস করলেন।

অসুররা গুরুকে দেখে শুক্রগৃহে এলেন। কিন্তু জয়ন্তীর মায়ায় আচ্ছন্ন শুক্রকে অসুররা দেখতে পেলো না। বৃহস্পতি এই সুযোগে শুক্রের বেশ ধারণ করে তাদের সঙ্গে কথা বললেন। তিনি বললেন–তোমাদের মঙ্গলের জন্য আমি সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করেছি, তোমাদের সেই বিদ্যা দেখাবো। এদিকে জয়ন্তীর মোহ দূর হলে শুক্রাচার্যের দিব্য জন্তান জয়মালো এবং দেবযানী নামে কন্যার জন্ম হল। শুক্রাচ্য ভাবলেন এবার তাঁর শিষ্যদের দর্শন দিয়ে আসবেন। কিন্তু অসুরদের কাছে এসে দেখলেন বৃহস্পতি শুক্রের বেশ ধারণ করে অসুরদের প্রতারিত করেছেন। তিনি অসুরদের বললেন–আমিই শুক্রাচার্য, ইনি অঙ্গিরা পুত্র বৃহস্পতি। কিন্তু এই সব বিবাদে অসুররা বিচলিত হয়ে বললেন–ইনি আমাদের দশ বছর ধরে শাসন করছেন, ইনিই আমাদের গুরু, তুমি নও, তুমি বনে যাও।

অসুররা শুক্রাচার্যের কথা অগ্রাহ্য করে বৃহস্পতির অনুগমন করলো। তখন শুক্র অভিশাপ দিলেন–আমার আদেশ তোমরা অগ্রাহ্য করলে, সেহেতু তোমাদের পরাজয় নিশ্চিত। বৃহস্পতিও অভিশাপ বাণী শুনে খুশী হয়ে নিজরূপ ধারণ করে অদৃশ্য হলেন। অসুররা বুঝতে পারলেন, তারা কি রকম ভাবে প্রতারিত ও বঞ্চিত হয়েছে বৃহস্পতির কাছে। তখন দেবতাদের আক্রমণের ভয়ে ভীত অসুররা প্রহ্লাদকে সঙ্গে নিয়ে গুরুর কাছে গেলে শুক্র বললেন–আমাকে তোমরা অপমান করেছে, তোমাদের পরাজয় সুনিশ্চিত।

প্রহ্লাদ বললেন–বৃহস্পতি আমাদের মোহচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন। আপনি অভিমান ত্যাগ করুন। ভক্তদের রক্ষা করুন, না হলে আমরা রসাতলে প্রবেশ করব। শুক্র তখন রাগ সম্বরণ করলেন। বললেন– আমি যে অভিশাপ দিয়েছি তা ফলবেই। এটি ব্রহ্মাই নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। আমার অনুগ্রহে তোমরা দশ যুগ ধরে যে ত্রৈলোক্য রাজ্য ভোগ করেছ, আবার সার্বনিক মন্বন্তরে তোমরা দশযুগ রাজ্য পাবে। হে প্রহ্লাদ! তোমার বলী নামে এক পৌত্র জন্মাবে। যে কথা ব্রহ্মা স্বয়ং বলেছেন আমায়। তারপর সেই রাজার রাজ্য অপহৃত হবে। সেই রাজা বলী আবার কামনা বিহীন হয়ে তপস্যা করবে, এজন্য ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে সার্বনিক মন্বন্তরে অমরত্ব দান করবেন। তখন ঐ বলীই দেবরাজ্য পাবেন। তাই প্রহ্লাদ তুমি নিরাশ হও না। সময়ের জন্য অপেক্ষা করো। তখন অসুররা অস্ত্রশাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দেবতাদেরকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। তারপর একশ বছর যুদ্ধ করে দেবতাদের পরাজিত করলেন। দেবগণ বললেন–আমার ষণ্ডমার্কের প্রভাবে পরাজিত। তাদের আহ্বান করে বললেন–হে দ্বিজদ্বয় আপনারা অসুরদের ত্যাগ করুন। তখন জয়ী এবং অসুররা পরাস্ত হল। তারা শুক্র-এর শাপে রসাতলে প্রবেশ করল।

তারপর বিষ্ণু নানা অবতারের রূপে অধর্ম নাশ করতে প্রাদুর্ভূত হলেন। চাক্ষুষ মন্বন্তরে প্রহ্লাদের সামনে যে সব অসুরদের অত্যাচার চলছিল তাদের নিহত করার জন্য মানুষ রূপী বিষ্ণুর অবতার এলেন। বৈবস্বত মন্বন্তরেও অন্য এক দৈত্যের উপদ্রব বাড়লে যজ্ঞ শুরু হয়, সেই যজ্ঞের প্রধান হোতা ছিলেন ব্রহ্মা। চতুর্থ যুগে অসুরের আবির্ভাব হলে বিষ্ণু সমুদ্র থেকে উঠে আসেন। হিরণ্যকশিপুর বধ করার জন্য ভীষণ নরসিংহ রূপে দ্বিতীয় অবতার আবির্ভূত হন। ত্রেতার সপ্তম যুগে বলি যখন ত্রিলোকের অধিপতি, তখন অসুররা ত্রিলোক আক্রমণ করলে বামন অবতার হিসেবে বিষ্ণুর আর্বিভাব। ঐ সময় অদিতি নন্দন বামন নিজের অঙ্গ খর্ব করে বৃহস্পতিকে সামনে রেখে দৈত্য বলীর সামনে উপস্থিত হন। ব্রাহ্মণ বেশধারী বামন সময় বুঝে বলীকে বললেন–হে রাজন! আপনি ত্রিভুবনের রাজা, আমায় ত্রিপদ পরিমিত স্থান দান করুন।

এত ক্ষুদ্র আকার দেখে বলি তার এই প্রস্তাব অনুমোদন করলেন। তখনই ত্রিপাদ দিয়ে স্বর্গ, আকাশ, পৃথিবী আক্রমণ করলেন সেই মহাযশা ব্রাহ্মণ। সূর্যের থেকেও অধিক তেজে যেন জ্বলতে লাগলেন। নমুচি, শাম্বর ও প্রহ্লাদ প্রভৃতি অসুরদের পাতালে পাঠালেন। তখন সকলে সেই অদ্ভুত দর্শন বিষ্ণুকে দর্শন করলেন। দেব-দানব অদ্ভুত শরীর দর্শন করে বিষ্ণুর তেজে মোহচ্ছন্ন হয়ে রইলেন। বিষ্ণু ইন্দ্রকে ত্রৈলোক্য রাজ্য দান করলেন। আরও সাতটি অবতার আছে, তা শুনুন। ত্রেতাযুগের দশম যুগে ধর্ম সকল নষ্ট হয়ে গেলে, তিনি দত্তাত্রেয় রূপে জন্মগ্রহণ করেন। এটি তার চতুর্থ অবতার। ত্রেতার ঊনবিংশ যুগে বিশ্বামিত্র পুরঃসর ষষ্ঠ অবতার জামদগ্ন। ত্রেতার চতুর্বিংশ যুগে রাবণ বধের জন্য দশরথের পুত্র রাম অবতার। এটি সপ্তম অবতার। অষ্টম হল বেদব্যাস অবতার। ইনি দ্বাপর যুগে পরাশর থেকে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বাপরের শেষ যুগে যখন ধর্ম বিনাশ হতে থাকে, তখন বসুদেবরূপী কশ্যপের ঔরসে দেবতী রূপিণী অদিতির গর্ভে বিষ্ণু জন্ম নেন। এটি নবম অবতার।

এঁর প্রভাব বাক্য দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। মহাবাহু মধুসূদনের রূপ অদ্বিতীয়। তিনি মানুষ রূপে পৃথিবীতে তার লীলা করেছেন। পাঠশালায় বিদ্যাভ্যাস করেছেন। ইনি মানুষ শরীরেই মহাসুর কংস, দ্বিবিদ, আরষ্ট, বৃষভ, পুতনা, কেশী, হয়, কালীয় নাগ প্রভৃতি দানবদের হত্যা করেন। ইনি বানরাজের সহস্র বাহু ছিন্ন করেন। লোকহিতের জন্য এইসব মহাত্মার আবির্ভাব। এই যুগের শেষে বিষ্ণু কল্কি রূপে জন্মগ্রহণ করেন। এইটি ভাবী দশম অবতার। ইনি অনেক সেনা নিয়ে, রথী, অস্ত্রশস্ত্র সহ যুদ্ধ করতেন। ম্লেচ্ছদের নিধন করেন। বিষ্ণু পূর্বজন্মে যে বীর্যবান প্রমিতি নামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি দেবাংশে মানবরূপে কলির পূর্ণবিদ্যায় কল্কি অবতার পরিগ্রহ করবেন নিজের ভাবী প্রয়োজনের বশবর্তী হয়ে কল্কি গগা ও যমুনার নামে এসে নিজের কর্তব্যের অবসান করবেন। তারপর কল্কি অতীত হলেও রাজাদের মৃত্যুর পর আশ্রয়হীন প্রজারা আত্মরক্ষায় অসমর্থ হয়ে দুঃখিত ভাবে নগর পরিত্যাগ করে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিহত হবে। তখন বেদ ধর্ম ও আশ্রয় ধর্ম লুপ্ত হবে। প্রজাবর্গ স্থুলকায়, বাকল পরিধায়ী বনবাসী, অল্পায়ু হবে। কলিসন্ধ্যাংশে প্রজারা কলিযুগের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। তারপর কলিযুগ একেবারে নিঃশেষিত হলে, আবার সত্যযুগ প্রবর্তিত হবে।

.

আটানব্বইতম অধ্যায়

সূত বললেন–এবার আমি আপনাদের কাছে তুর্বসু, পুরু, দ্রুহ্য ও অণুর বংশের কথা বলছি। তুর্বসুর পুত্র বহ্নি, তাঁর পুত্র ভোগাহু, তাঁর পুত্র ত্রিশানু, ইনি বীর ও অজেয় ছিলেন। এঁর পুত্রের নাম কনন্ধম, তাঁর ছেলে অবিক্ষিৎ, তার মরুত্ত নামে আরো একজন পুত্রের কথা শোনা যায়। পুত্র মরুও রাজ্য হয়েছিলেন। তিনি অপুত্রক ছিলেন। পুরবাসীরা পুরুবংশীয় দুষ্কৃতকে তাঁর পুত্র রূপে কল্পনা করেন। যযাতি জরাজীর্ণ অবস্থায় তুর্বসুকে অভিশাপ দান করার বহুকাল পরে এভাবে তুর্বসু বংশের সাথে পুরু বংশের সংস্রব ঘটেছিল।

দুষ্কৃতের পুত্র মরুথ, তাঁর পুত্র জলাপীড়। এঁর চার পুত্র- পাণ্ড্য, কেয়ল, চোল এবং কুল্য। এঁদের অধিষ্ঠিত জনপদগুলি এঁদের নামানুসারেই খ্যাত। হ্যের দুই পুত্র, ব ও সেতু। এঁদের মধ্যে সেতুর অরুদ্ধ ও বভ্রর রিপু নামে পুত্র হয়। অরুদ্ধের পুত্র গান্ধার নামে রাজা হন। এঁদের নামানুসারেই বিশাল গান্ধার দেশ। গান্ধার পুত্র ধর্ম, তার পুত্র ধৃতি, তার পুত্র দুর্মদ, তার পুত্র প্রচেতা৷ প্রচেতার একশ পুত্র। এঁরা সবাই ম্লেচ্ছ রাজ্যের অধিপতি হন। মহাত্মা মনুর বংশধর সভানর। সভানরের পর তার পুত্র বিদ্বান কালনন হন, তাঁর পুত্র ধার্মিক সৃঞ্জয়, তার পুত্র বীর পুরুজ্ঞয়, তার পুত্র মহাবীর্য জনমেজয়, তাঁর পুত্র নরপতি মহাশাল, ইনি ইন্দ্রের মত প্রখ্যাত কীর্তি রাজা ছিলেন। এঁর পুত্রের নাম মহামনা, তার পুত্র দুজনের নাম উশীনর ও তিতিক্ষু। এই দুই রাজপুত্রই ছিলেন ধর্মজ্ঞ ও ধার্মিক।

রাজা উশীনর পাঁচ রাজকন্যার পাণি গ্রহণ করেছিলেন। এইসব পত্নীর গর্ভে মৃগ, নব, কৃমি, সুব্রত ও শিবি নামে পাঁচ পুত্র জন্মে। এঁদের মধ্যে শিবির শিবপুরী, মৃগের মৌধেয়পুর, নবের নবরাষ্ট্র, কৃমির কৃমিনাপুরী আর সুব্রতের অন্বষ্ঠা পুরী। এবারে শিবির পুত্রদের কথা বলছি। বৃষার্ভে, সুবীর, কেকয় ও মদ্র– এই চারপুত্রকে শিবি বলা হয়। তিতিক্ষুর পুত্র মহাবাহু ঊষদ্রথ একজন পূর্বদেশীয় বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তার পুত্রের নাম হেম, তার পুত্র বলি। এই বলিই বিষ্ণুর দ্বারা বন্দী হন। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুক্ষ ও পুণ্ড্র বলির পাঁচ পুত্র।

এঁদের নাম অনুসারে পাঁচটি সুসমৃদ্ধ জনপদ প্রসিদ্ধ হয়। বলির পুত্ররা মুনি দীর্ঘতমার ঔরসে বলি মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভে জন্ম নেয়। অশিজ ঋষির স্ত্রী মমতার গর্ভে দীর্ঘতমার জন্ম। তিনি তেজস্বী ও কীর্তিমান। এই দীর্ঘতমা তার কনিষ্ঠ ভাই উতথ্যের স্ত্রীকে কামনা করেছিলেন। উতথ্যের স্ত্রী এই গর্হিত কাজে বাধা দেন। ঋষি শরদ্বান প্রচণ্ড রেগে তিরস্কার করে বললেন–তুমি ভ্রাতৃবধূকে কামনা করেছো, তুমি যেখানে খুশি চলে যাও। তিনি দীর্ঘতমাকে সমুদ্রে ফেলে দেন। সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে একসপ্তাহ পরে ঋষিবর তটে উপস্থিত হলেন। সেখানে বলি রাজা খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে মুনিকে রক্ষা করেন। ঋষি দীর্ঘতমা বলিকে বর দিতে চাইলে, তিনি নিজের স্ত্রীর গর্ভে ঋষিকে পুত্রোৎপাদন করতে অনুরোধ করেন।

কিন্তু রানি সুদেষ্ণা নিজে না গিয়ে দাসীকে রানির পোশাক দ্বারা সজ্জিত করে ঋষির নিকট পাঠালেন। দাসী গর্ভে দুই পুত্র হল। তিনি বৃদ্ধ ও অন্ধ বলে রাজমহিষী তাকে অবমাননা করেছেন। এই কারণে ঋষিবর দীর্ঘতমা রানিকে অভিশাপ দিলেন। রানি অশ্রুজল সিক্ত হয়ে কাতর কণ্ঠে অনুরোধ করলেন। তখন ঋষি বললেন–দেবকুমারের মতো তোমার পাঁচ পুত্র জন্মাবে। সকলেই তেজস্বী, ধার্মিক হবে। এইভাবে বলির রাজার মহিষীকে দীর্ঘতমা পাঁচ পুত্র দান করেন। এই দীর্ঘতমা ঋষির ওপর বৃহস্পতির অভিশাপ কেটে গেলে তিনি আয়ুষ্মন, বহহুম্মান ও যুবা পুরুষ হয়ে উঠলেন।

এই ঋষিই পরবর্তীকালে গৌতম নামে প্রসিদ্ধ। পিতার সাথে গিরিব্রজে গিয়ে পিতার তৃপ্তির জন্য তপস্যা করলেন। কক্ষীবান, তুমি যশস্বীপুত্র, তোমার জন্য কৃতার্থ হলাম– এই বলে দীর্ঘতমা ব্রহ্মপদে বিলীন হলেন। কক্ষীবান ব্রাহ্মণ এক হাজার পুত্রের জন্ম দেন। তার পুত্রেরা কৃষ্ণাঙ্গ গৌতম নামে খ্যাত। বলি ও দীর্ঘতমার সংবাদ উভয়ের পুত্র লাভের বৃত্তান্ত শুনলেন। বলি তার পাঁচ পুত্রকে রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন এবং পরে যোগ অবলম্বনে সর্বভূতের অদৃশ্য হয়ে তপস্যা করতে লাগলেন।

রাজা অঙ্গের পুত্র রাজা দধিবাহন। এর পুত্র দ্বিবিরথ, তার ছেলে রাজা ধর্মরথ। এই রাজা বিষ্ণুপদ পর্বতে এক যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন। ধর্মরথের পুত্রের নাম রাজা চিত্ররথ। তার পুত্র দশরথ। ইনি লোমপাদ নামেও বিখ্যাত। প্রথম শান্তা নামে এঁর এক কন্যা জন্মেছিল। দশরথের পুত্র চতুরঙ্গ, এঁর পুত্র পৃথুলাম্ব, তার পুত্র চম্প, চম্পের পুরীর নাম চম্পাবতী। রাজা চম্প এখানে ষাট হাজার বছর বাস করেছিলেন, এঁর রাজত্বকালে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা–নিজ নিজ ধর্মে অনুরক্ত ছিল। সবাই বিষ্ণুপরায়ণ। চম্পের হর্ষঙ্গ নামে এক পুত্র হয়।

বৈতণ্ডিক নামে এঁর এক হাতি ছিল। ইনি মন্ত্রবলে ইন্দ্রের বাহন ঐরাবতকে ভূতলে এনেছিলেন। এর পুত্র ভদ্ররথ। তার পুত্র বৃহকর্মা, তার পুত্র বৃহদ্রথ। এঁর পুত্র জয়দ্রথ জয়দ্রথের দৃঢ়রথ নামে এক পুত্র হয়। এঁর পুত্র বিশ্ববিজয়ী জনমেজয়। এঁর অঙ্গ থেকেই কর্ণ নামে এক পুত্র হয়। কর্ণ হলেন অঙ্গ দেশের রাজা। তার পুত্রের নাম শূরসেন। তার ছেলে ধ্বজ। ঋষিরা তখন প্রশ্ন করলেন–কর্ণ সূত পুত্র হলেন কিভাবে? সূত্র তখন বললেন–বৃহদ্ভানুর পুত্র রাজা বৃহমানা, তার দুই পত্নী যশোদেবী ও সত্যা। দুই পত্নী থেকেই বংশ দুভাগে ভাগ হয়। জয়দ্রথ যশোদেবীর গর্ভজাত। সত্যা দেবী থেকে বিজয় উৎপন্ন হয়। বিজয়ের পুত্র ধৃতি, তাঁর পুত্র ধৃতব্রত, তার পুত্র মহাযশা সত্যকর্মা, তার পুত্র সূত অধিরথ। এই অধিরথ কর্ণকে পরিগ্রহ করেন, তাই কর্ণ সূত পুত্র বলে খ্যাত।

এবারে পুরুর প্রজাবৃত্তান্ত শুনুন। পুরুর পুত্র মহাভুজ রাজা জনমেজয়, তার পুত্র অবিদ্ধ, ইনি প্রাচী দিক জয় করেছিলেন। এই বংশের রাজা রৌদ্রাস্বের দশ কন্যা জন্মেছিল। অত্রিবংশীয় প্রভাকর, এই কন্যাগণের পাণি গ্রহণ করেন। রাজর্ষি অনুদৃষ্টের পুত্রের নাম রিবেয়ু। রিবেয়ুর স্ত্রী তক্ষক কন্যা জ্বলনা, এঁর গর্ভে পুত্র রন্তিনার জন্ম। রন্তিনা সরস্বতীর গর্ভে–এসু, ধ্রুব, অপ্রতিরথ নামে তিন ধার্মিক পুত্র ও গৌরী নামে এক কন্যা উৎপাদন করেন। গৌরী মান্ধাতার মাতা। এঁদের মধ্যে অপ্রতিরোধের ধূর্য নামে এক পুত্র হয়, ধূর্যের পুত্র কণ্ঠ। তার পুত্র মেধাতিথি। রন্তি পুত্র অসুর প্রিয় পুত্র ইলিন। ইলিন থেকে। উপদানবী চারপুত্র লাভ করে। সুষ্মন্ত, দুষ্মন্ত, প্রবীর ও অনঘ। দুষ্মন্ত থেকে শকুন্তলার গর্ভে ভরত জন্মগ্রহণ করেন। দুষ্মন্তের পুত্র ভরত থেকেই ভারতবর্ষ নাম প্রসিদ্ধ হয়। ভরত তার স্ত্রীদের গর্ভে নয় পুত্র উৎপাদন করে। কিন্তু এই পুত্রগণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলী রাজা ভরতের মনঃপুত না হওয়ায় তাদের মাতার রেগে গিয়ে সমস্ত পুত্রকেই যমালয়ে পাঠালেন। তাই ভরতের মানবজন্ম বিফলে গেল। তারপর যজ্ঞের ফলে মরুতেরা বৃহস্পতি পুত্র ভরদ্বাজকে এনে ভরতকে দিলেন।

রাজা ভরত পুত্র কামনায় যজ্ঞ করেছিলেন, কিন্তু পুত্র লাভ করতে পারছিলেন না। পরে প্রকৃতপক্ষে যজ্ঞ করে মরুদগণকে তুষ্ট করেন, আর ভরদ্বাজকে পুত্ররূপে লাভ করেন। এভাবে ভরদ্বাজ ব্রাহ্মণ হয়েও ক্ষত্রিয়ত্বে উপনীত হয়েছিলেন। পুত্র লাভ করবার পর ভরত স্বর্গে গিয়েছিলেন। ভরদ্বাজের ভূমন্যু নামে এক পুত্র হয়, তার চারজন মহাপ্রাণ পুত্র জন্মাল। এঁদের নাম–বৃৎক্ষেত্র, মহাবীর্য, নর ও গাগ্র্য। নরের পুত্র সাস্কৃতি। সাস্কৃতির দুই পুত্র–নাম গুরুবীর্য ও ত্রিদেব। মহাবীর্যের পুত্রের নাম ভীম, তার ছেলে উপক্ষয়, উপক্ষয়ের স্ত্রীর নাম বিশাখা। বিশাখার তিনপুত্র–ত্রয্যারুণি, পুষ্করী, কপি।

বৃহৎক্ষেত্রের পুত্র ধার্মিক সুহোত্র। তার ছেলে হস্তী। হস্তিনাপুরীর নির্মাতা এই হস্তী। হস্তীর তিন ধার্মিক পুত্র। অজামীয়, দ্বিজামীয়, পুরুমীয়। অজমীয়ের তিন সুন্দরী পত্নীর নাম-নলিনী, কোপিণী, ধূমিণী। এইসব পত্নীর গর্ভে অজমীরের কয়েক জন পুত্র জন্মায়। কোপিণীর গর্ভে কণ্ঠনাম পুত্র জন্মায়। কণ্ঠের ছেলে মেধাতিথি। এই মেধাতিথি থেকেই কণ্ঠায়ন দ্বিজদের উৎপত্তি। ধুমিণীর গর্ভে অজমীরের বৃহদসু নামে পুত্র হয়। এঁর পুত্র বৃহদ্বিষ্ণু, তার ছেলে বৃহকর্মা। তার পুত্র বৃহদ্রথ, তার পুত্র বিশ্বজিৎ, তাঁর পুত্র সেনজিৎ, সেনজিতের লোক বিখ্যাত চার পত্রের নাম রুচিরাশ্ব, কাব্য, রাম ও বৎস।

কনিষ্ঠ বৎস অবন্তক নামে রাজা হয়েছিলেন। এই বৎসরের নামানুসারে পরিবৎসর গণনা করা হয়। রুচিরাশ্বের পুত্র মহাযশা পৃথুসেন, তার পুত্র পার, তার পুত্র নীপ। কথিত আছে, নীপ রাজার একশো পুত্র হয়েছিল। তারা সবাই নীপা নামে খ্যাত। এঁদের মধ্যে একজন কীর্তিমান রাজা ছিলেন নাম সমর, তিনি সত্যিই যুদ্ধ প্রিয় ছিলেন। এঁর তিন পুত্র পর, পার, সত্ত্বদস্ব। এঁরা সর্বগুণসম্পন্ন। পরের ছেলে বৃষ, বৃষুর ছেলে সুকৃতি। ইনি সুকর্মের অনুষ্ঠাতা। এঁর সর্ব গুণযুক্ত পুত্রের নাম বিভ্রাজ। বিভ্রাজের পুত্র মহাযশা রাজা অনুহ। এঁর পুত্র ব্রহ্মদত্ত। তাঁর পুত্র যোগসুনু, এঁর পুত্র রাজা বিশ্বক সেন।

বিশ্বক সেনের পুত্র রাজা উদক সেন। এঁর পুত্র ভল্লাট। ভল্লাটের পুত্র রাজা জনমেজয়। এই জনমেজয়ের জন্য উগ্ৰায়ুধ সমস্ত নীপদের বিনাশ করেছিলেন। ঋষিরা বললেন–উগ্ৰায়ুধ কার পুত্র? কি জন্যে নীপদের বিনাশ করলেন? সূত বললেন– যবনীর নামে এক বিদ্বান পুত্র হয়। এই যবনীরের ছেলে ঋতিমান, তার ছেলে সত্যধৃতি। এই বংশে মহৎপৌর নামে এক পুত্র উৎপন্ন হয়। তার পুত্রের নাম রাজা রক্লরথ। রক্লরথের পুত্র রাজা সুপার্শ্ব। সুপার্শ্বের পুত্র ধার্মিক সুমতি, তার পুত্র ধর্মাত্মা সন্নতিমায়, তার ছেলে সনতি, এর পুত্র কৃত। ইনি চব্বিশ প্রকার সাম সংহিতার প্রবক্তা। এনার উগ্ৰায়ুধ নামে বীর পুত্র জন্মায়।

মহার্যশা ক্ষেম এর পুত্র। এই বংশে পুরুজানুপুত্র যক্ষ থেকে পাঁচ পুত্র জন্মে। এই পাঁচ পুত্রই সুবিখ্যাত, মুন্সলের বংশধরেরা। মৌদগল্য নামে পরিচিত। মুদগলের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহাযশা ব্ৰক্ষিষ্ট। এর পুত্রের নাম বধ্য। এর পুত্র কন্যা দিববাদাস ও অহল্যা। এর পুত্র সদানন্দ। এর পুত্র সত্যধৃতি ধনুর্বেদে । পারদর্শী। এঁর পুত্র কন্যা হল কৃপ আর কৃপী বা গৌতমী। এই শ্বারদ্বতের বংশীয়রা গৌতমগোত্রীয়। দিবোদাসের পুত্র রাজা মিত্ৰয়ু। এঁর পুত্রের নাম মৈত্রেয়। এই বংশের পুত্ররা ভার্গব নামে পরিচিত। এই বংশের সুবামের পুত্র সহদেব। তার পুত্র সোমক। রাজা, অজমীর আবার সোমক হয়ে জন্ম নেন। সোমকের পুত্র হল জন্তু।

সোমকরূপী মহাত্মা অজমীরের একশো পুত্ৰ উৎপন্ন হয়। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পৃষত। ইনি দ্রুপদের পিতা। দ্রুপদের পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন। তার ছেলে ধৃষ্টকেতু। অজমীরের মহিষী ধূথিনী একশ বছর ধরে দুশ্চর তপস্যা করেন। তপস্যা করতে করতে তিনি ধোঁয়ার মত রঙ ধারণ করেছিলেন। ঋক্ষ নামে তার এক ধূম্রবর্ণ পুত্র হয়। ঋক্ষ থেকে সম্বরন, সম্বরন থেকে কুরু। এই কুরু পদব্রজে প্রয়াগ হয়ে কুরুক্ষেত্রে পৌঁছান। ইন্দ্রের বরে ঐ স্থান পুণ্যতীর্থ স্থানে পরিণত হয়।

এই কুরু বংশের রাজারা সবাই কুরু নামে বিখ্যাত। কুরুর পাঁচ পুত্র সুধা, জহ্ন, পরীক্ষিত, পুত্রক ও অরিন্দম। সুধার পুত্র সুহোত্র। তার ছেলে চ্যবন। এঁর পুত্র কৃত। কৃতের বিশ্রুত নামে এক পুত্র হয়। সে ইন্দ্রের সখা হয়েছিলেন। বিদ্যোপরিচয় নামে এক অন্তরিক্ষচর বসু থেকে গিরিশ সাতটি পুত্র উৎপাদন করেন। এর মধ্যে অন্যতম বৃহদ্রথ। এই বংশে জন্মায় জর্জ, তার পুত্র নভস। ইনি অতি বীর্যবান ছিলেন। ইনি ঘটনাচক্রে দুভাগে জন্ম নেন। জরা নামে রাক্ষসী এদের এক করেন। এজন্য এঁকে জরাসন্ধ বলা হয়। মহাবল জরাসন্ধ ক্ষত্রিয় জাতিকে জয় করেন। এঁর পুত্রের নাম সহদেব। সহদেবের পুত্র শ্রীমান সোমাধি। ইনি একজন বিশিষ্ট তপস্বী। সোমাধির পুত্র শ্রবা। এঁরা মগধ নামে বিখ্যাত।

সূত্র বললেন–পরীক্ষিতের ছেলে জনমেজয়, তার পুত্র রাজা সুরথ, তার ছেলে ভীমসেন। জহুর পুত্র রাজা সুরথ। তাঁর পুত্র বীর বিদূরথ। এঁর পুত্র সার্বভৌম। জয়ৎসেন সার্বভৌমের পুত্র। জয়ৎসেনের পুত্রের নাম আবধি। এই বংশের প্রতীপের তিন পুত্র দিবাপি, শান্তনু, বাহ্লীক। বাহীকের পুত্র মহাযশা সোমদত্ত। এঁর তিন পুত্র ভূরি, ভূরিশ্রবা ও শল। দেবাপি একজন বিশিষ্ট মুনি। চ্যবন ও ইষ্টক এঁর পুত্র। শান্তনু মহাভিষ নাম ধারণ করে রাজা হন। বলা হয় এই রাজা যে জীর্ণ পুরুষকে স্পর্শ করবেন সে পুরুষ আবার যুবক হয়ে যাবেন। এই মহাত্মা শান্তনু জাহ্নবীর পাণিগ্রহণ করেন। জাহ্নবীর গর্ভে শান্তনুর ভীষ্ম নামে পুত্র জন্মায়।

এই ভীষ্ম পাণ্ডবদের পিতামহ। কালক্রমে দাস কন্যার গর্ভে আরও এক পুত্র উৎপন্ন হয়। ঐ পুত্রের নাম বিচিত্রবীর্য। বিচিত্রবীর্য শান্তনুর প্রিয় পুত্র ও প্রজা হিতৈষী রাজা ছিলেন। ঐ বিচিত্রবীর্য ক্ষেত্রে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণে থেকে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর নামে তিন পুত্র জন্মে। গান্ধারীর ধৃতরাষ্ট্র থেকে একশ পুত্র জন্মায়। ঐ পুত্রদের মধ্যে দুর্যোধন সবার বড়। পাণ্ডুর দুই স্ত্রী মাদ্রী ও কুন্তী। এই দুই মহিষীর গর্ভে পাণ্ডুর বংশরক্ষার্থে দেবপ্রদত্ত পাঁচ পুত্ৰ উৎপন্ন হয়। তার মধ্যে ধর্ম থেকে যুধিষ্ঠির, বায়ু থেকে ভীম, ইন্দ্র থেকে ধনঞ্জয় এই তিন পাণ্ডব পৃথা গর্ভজাত। মাদ্রীর গর্ভে অশ্বিনীকুমারদ্বয় থেকে নকুল ও সহদেব জন্মগ্রহণ করে।

পঞ্চপাণ্ডব থেকে দ্রৌপদীর গর্ভে পাঁচ পুত্ৰ উৎপন্ন হয়েছিল। তার মধ্যে যুধিষ্ঠির থেকে দ্রৌপদী প্রতিবিন্ধ্য নামে এক পুত্র প্রসব করেন। ভীমসেন ও হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচ নামে পুত্র হয়। ঐ পুত্রের নাম সর্ববৃক। সহদেব ও বিজয়ার সুহোত্র নামে এক পুত্র হয়। নকুল ও কর্ণবতীর গর্ভে নিরমিত্র নামে এক পুত্র হয়। পার্থ থেকে সুভদ্রার গর্ভে বীর অভিমুন্য জন্মগ্রহণ করেন। উত্তরা ও অভিমন্যুর পরীক্ষিৎ নামে এক পুত্র হয়।

পরীক্ষিতের পুত্র রাজা জনমেজয়। জনমেজয় বাজসনেয়ক ব্রাহ্মণদের মর্যাদা স্থাপন করেছিলেন। এতে বৈশম্পায়ন রেগে গিয়ে তাকে শাপ দিয়েছিলেন– হে দুর্বুদ্ধি, জগতে তোমার কথা স্থির থাকবে না, অন্তত আমি যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন ঐ কথার কোন মূল্য থাকবে না। জনমেজয় উভয় সঙ্কটে পড়ে পৌর্ণমাস যজ্ঞে শ্রীহরি হার দিয়ে প্রজাপতিকে অর্চনা করলেন। জনমেজয় বাজসনেয়ক ব্রহ্ম প্রবর্তিত করে ত্রিখর্বী হয়ে পড়লেন। ত্রিখর্বী অর্থাৎ অস্মকগণ, অঙ্গদেশবাসিনীগণ ও মধ্যদেশীয়গণ ত্রিবিধ লোকের কাছেই খর্ব হয়েছিলেন। পরে তিনি অভিশপ্ত হয়ে বিষাদ ভরে তার প্রবর্তিত ব্রাহ্মণের সাথে ক্ষয়প্রাপ্ত হন। তার পুত্র শতানীক। ইনি সত্য বিক্রম। সতানীকের পুত্র বীর্যবান অশ্বমেধ দত্ত। এঁর থেকেই মহাত্মা অধিসামকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন। এঁরই অধিকারকালে আপনারা তিন বছর ব্যাপী দুর্লভ দৃশ্য যজ্ঞ শুরু করেছেন। হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ। কুরুক্ষেত্র দৃষদ্বতী তীরে আপনাদের যজ্ঞের দুই বছর মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে।

ঋষিরা বললেন–অতীত নয়। এখন রাজা, প্রজাদের বিষয়ের বিবরণ বলুন। সূত বললেন–ব্যাস আমার কাছে ভাবী কলিযুগ ও মন্বন্তর সম্পর্কে যেভাবে বলেছেন, তা আপনারা শুনুন। এখন যে অধিসামকৃষ্ণ রাজ্য শাসন করেছেন, এই বংশের ভাবীকালের নরপতিদের নাম বলছি। এঁর এক পুত্র হবেন, তার নাম নির্বক্ত। হস্তিনাপুরী ধ্বংস হয়ে গেল, সেখান থেকে তিনি কৌশাম্বী নগরীতে গিয়ে বাস করতেন। উষ্ণ নামে তার এক পুত্র হবে। উষ্ণের পুত্র চিত্ররথ। তার পুত্র শুচিদ্ৰথ। তার পুত্র ধৃতিমান। তার পুত্র সুষেণ, এঁর পুত্রের নাম রাজা সুতীর্থ, সুতীর্থ থেকে রুচ, রুচ থেকে ছিচক্ষ জন্ম নেবেন। এঁর পুত্র মুখীবল, তার পুত্র রাজা পরিপ্লত, তার পুত্র সুনয়, সুনয়ের পুত্র মেধাবী, তার পুত্র দণ্ডপানী, তার পুত্র নিরামিত্র, এঁর থেকেই রাজা ক্ষেমক জন্মগ্রহণ করবেন।

এরপর মহাত্মা ইক্ষবাকু বংশের বিবরণ বলছি। বৃহদ্রথের বীর পুত্র রাজা বৃহৎক্ষয়, তার পুত্র ক্ষয়, তার ছেলে বৎস ব্যুহ, তাঁর পুত্র প্রতিব্যুহ, দিবাকরণ এঁর পুত্র। এই দিবাকরণ অযোধ্যা নগরীতে এখন রাজা হয়েছেন। দিবাকরণের এক যশস্বী পুত্র হবে, তাঁর নাম সহদেব, সহদেবের পুত্র হবেন বৃহদশ্ব, তার পুত্র ভানুরথ, তার পুত্র প্রতিতাশ্ব, তার পুত্র সুপ্রতীত, তার পুত্র সহদেব, সহদেবের পুত্র সুনক্ষত্র, এঁর পুত্র কিন্নর, কিন্নরের পুত্র অন্তরীক্ষ। তাঁর পুত্র সুপর্ণ, তার ছেলে অমিত্ৰজিৎ। এঁর পুত্রের নাম ভরদ্বাজ, ভরদ্বাজের পুত্র ধর্মী, ওঁর পুত্র কৃতঞ্জয়, তার ছেলে ব্রাত, ব্রাতের ছেলে রণজয়, এঁর ছেলে বীর সঞ্জয়। সঞ্জয়ের পুত্র শাক্য। শাক্য থেকে শুদ্ধোদনের উৎপত্তি। শুদ্ধোদনের পর রাহুল, তার পরবর্তী সুমিত্র পর্যন্তই বংশের বিস্তৃতি।

কলিযুগে এই সমস্ত উল্লেখিত রাজারাই রাজত্ব করবেন। এরা সকলেই বীর, যোদ্ধা, সত্যানুরাগী ও জিতেন্দ্রিয়। কলিকালে রাজা, সুমিত্রকে পেয়েই এই বংশ শেষ হবে।

এখন মগধের রাজাদের কথা বলছি। যুদ্ধে জরাসন্ধের পুত্র সহদেব নিহত হলে, তার পুত্র সৌমাধি গিরিব্রজের সিংহাসন আরোহণ করেন। ইনি আটান্ন বছর রাজত্ব করেন। তার ছেলে শ্রুতশ্রবা চৌষট্টি বছর ধরে রাজত্ব করেন। তার ছেলে নিরামিত্র। ইনি একশো বছর কাল রাজ্য ভোগ করেন। তার পুত্র সুকৃত্য, তিনি ছাপ্পান্ন বছর রাজত্ব করেন। তার পুত্র বৃহকর্ম তেইশ বছর ধরে রাজ্য শাসন করেন। এঁর ছেলে সম্প্রতি মগধে রাজ্য শাসন করছেন। ইনিও তেইশ বছর পর্যন্ত রাজ্য শাসন করবেন। এঁর পুত্র শ্রুতজ্ঞয় চব্বিশ বছর, তার ছেলে মহাবল মহাবাহু পঁয়ত্রিশ বছর, এঁর পুত্র শুচি আটান্ন বছর, তার পুত্র ক্ষেম আটাশ বছর, তার ছেলে ভুবন চৌষট্টি বছর। এইভাবে বৃহদ্রথ থেকে মোট বত্রিশ জন রাজা এক হাজার বছর প্রায় রাজত্ব করবেন।

এঁদের বংশের অবসান হলে বীতিহোত্র বংশের রাজত্বকালে মুনিক নামে জনৈক কর্মচারী সমস্ত ক্ষত্রিয়দের অবজ্ঞা করে নিজের প্রভু রাজা প্রদৌৎকে হত্যা করে তাঁর পুত্রকে সিংহাসনে বসাবেন। সমস্ত রাজারা সেই ভাবী নতুন রাজাকে মান্য করবে। ঐ রাজা কোনো নীতি বিরুদ্ধ কাজ করবেন না। প্রদৌতের বংশধর পাঁচ রাজকুমার একশো আটত্রিশ বছর রাজ্য শাসন করবেন। এরপর আসবেন শক্তিশালী, পরাক্রমী রাজা শিশুনাগ। এঁর পুত্র বারাণসীর রাজা হবেন। তাঁর পুত্র সুকর্ণ ছত্রিশ বছর রাজত্ব করবে। এরপর কুড়ি বছর ক্ষেত্রবর্মার শাসন থাকবে। এরপর পঁচিশ বছর ধরে রাজত্ব করবেন অজাতশত্রু। তারপর রাজা ক্ষতৌজা চল্লিশ বছর পর্যন্ত রাজ্য ভোগ করবেন। তারপর রাজা বিম্বিসার আঠাশ বছর, উদায়ী তেত্রিশ বছর রাজত্ব করলেন।

এভাবে দশজন শিশুনাগ বংশীয় রাজা মোট তিনশো বাষট্টি বছর রাজত্ব করবেন। ইক্ষাকু বংশের চব্বিশজন পঁচিশ, কানকদের চব্বিশ, হৈহয় বংশীয়দের চব্বিশজন, কলিঙ্গদেশীয়দের বত্রিশ, শকদের পঁচিশ কুরুবংশীয় ছত্রিশ। মৈথিলিদের আঠাশ ও সুরসেনদের তেইশ ও বীতিহোত্র বংশের কুড়িজন রাজা একই কালে রাজত্ব করবেন।

সমস্ত ক্ষত্রিয় রাজার রাজত্বকাল শেষ হলে মহানদীর শূদ্রার গর্ভজাত পুত্র মহাপদ্ম রাজা হবেন। এই মহাপদ্ম থেকেই শূদ্রযোনিজাত পুত্ররা রাজা হতে থাকবেন। রাজা মহাপদ্ম আটাশ বছর ধরে পৃথিবী পালন করবেন। ঐ রাজার এক হাজার পুত্র জন্মাবে। তাদের মধ্যে মোট বারোজন মাত্র আট বছর করে রাজত্ব করবেন। সব শেষে আসবেন নন্দ রাজা। তিনি একশো বছর রাজ্য ভোগ করবেন। তারপর একসময়ে কৌটিল্যের কৌশলে ঐ সব রাজাই রাজ্যচ্যুত হবেন। কৌটিল্য তারপর চন্দ্রগুপ্তকে রাজ সিংহাসনে স্থাপন করবেন। চন্দ্রগুপ্তর রাজত্বকাল হবে চব্বিশ বছর। তারপর ভদ্রসর রাজা হবেন। ইনি পঁচিশ বছর রাজ্য শাসন করার পর তাঁর পুত্র ছাব্বিশ বছর রাজত্ব করবেন। অশোকের পুত্র কুনাল আট বছর রাজত্ব করবেন। তারপর বন্ধ উপাতিত আট বছর পর্যন্ত রাজ্য ভোগ করবেন। তারপর পুত্র ইন্দ্র পালিত দশ বছর তারপরে নরাধিপা দেববর্মা সাত বছর ও তার ছেলে রাজা শতধর ও তারপর বৃহদ এই নয় রাজার পর ঐ রাজ্য শুঙ্গ বংশীয়রা ভোগ করবেন।

শুঙ্গবংশীয় দেবভূমি নরকাঠায়ন নাম নিয়ে রাজত্ব করবার পর তার পুত্র ভূতিমিত্র চব্বিশ বছর রাজত্ব করবেন। নরপতি নারায়ণ বারো বছর ও পুত্র সুগম দশ বছর। এই চারজন ভাবী রাজা কাঞ্চায়ন দ্বিজ বলে বিখ্যাত। এঁদের সময় শেষ হয়ে গেলে অন্ধ্র রাজারা রাজ্য অধিকার করবেন।

এবার বৈদেশিক বৃষ রাজাদের কথা বলছি। নাগরাজ নষের পুত্র ভোগী বিদেশ রাজ্যের প্রথম রাজা হবেন। তারপর সদাচ, চন্দ্রাংশ, নখবান, ধন ধর্মা, বিংশজ ও ভূতিনন্দ– যথাক্রমে এঁরা রাজা হবেন। অঙ্গবংশীয় রাজার পর রাজা মধুনন্দী, ছোট ভাই নন্দিশা রাজত্ব করবেন। এরপর এঁর বংশের তিন রাজা রাজত্ব করবেন। তাদের নাম দৌহিত্র, শিশুক, বীর্যবান। রাজা শিশুক পূরিকা নগরীতে ও অন্য দুই রাজা কাঞ্চন পুরীতে রাজঐশ্বর্য ভোগ করবেন। মেলায় সাতজন প্রসিদ্ধ নরপতি রাজত্ব করবেন। এরপর পুষ্যমিত্র ও পট্টমিত্র নামীয় তেরোজন রাজা রাজত্ব করবেন। মেঘ নামে নয়জন বিখ্যাত বৃদ্ধিশালী রাজা হবেন। তারপর মগধ বিশ্বস্কানি রাজা হবেন। ইনি তখনকার বিভিন্ন পার্থিবদের উচ্ছেদ করে অন্তবলীয় কয়েকজন ব্যক্তিকে রাজ্য দান করবেন।

এরপর নয়জন রাজা চম্পাবতী ভোগ করবেন। তারপর গুপ্তবংশীয় রাজারা গঙ্গার তীরে প্রয়াগ সাকেত, মগধ প্রভৃতি জনপদে বাস করবেন। মনিধান্য বংশীয় রাজারা নিষধ, যদুক, শৈশীত ও কাল পৌতকে, গুহরাজন কোশল, অন্ধ্র, পৌ, তাম্রলিপ্ত, কলিঙ্গ মহিষ, মহেন্দ্র নিলয় কনক রাজারা সৌরাষ্ট্র, ভক্ষক প্রভৃতি জনপদে একই সাথে রাজত্ব করবেন। এরপর কিছু ক্ৰোধী, অধার্মিক রাজা রাজত্ব করবেন। যুগের দোষে এইসব রাজারা খুব দুরাচার করবে। স্ত্রী, শিশু বধ করবে। যে সব জনপদে তারা বাস করবে সেই সব জনপদে ম্লেচ্ছাচার হবে। এরা লোভী, অসত্যবাদী হবে। এজন্য তাদের আয়ু, রূপ, জ্ঞান, বল সবই একটু একটু করে ক্ষয় পাবে। প্রজাদেরও চরম দুর্দশা হবে। এই সময় এইসব অধার্মিক রাজারা কল্কির প্রভাবে ইতস্ততঃ পালিয়ে যাবে। প্রজারাও অনাহারে, ব্যাধিতে, অনাবৃষ্টিতে, পরস্পর বিবাদে কষ্ট পাবে। তখন তারা গ্রাম বা নগর ত্যাগ করে বনে চলে যাবে। অবশিষ্ট মৃতপ্রায় প্রজারা পর্বতে গিয়ে বাস করবে। আর্যরা, ম্লেচ্ছরা একসঙ্গে হিমালয়ের পৃষ্ঠে গভীর অরণ্যে বাস করবে। মানুষেরা মৃগ, মীন, ফলমূল, বিহঙ্গ, মধু, শাক ইত্যাদি খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করবে। ছাগ, মেষ, উট প্রভৃতির পালন করবে।

প্রজারা নিকৃষ্ট ধর্ম পালন করবে। লোকেরা দুর্বল, জরাজীর্ণ হবে। তারা জীবিকা নির্বাহের জন্য পৃথিবীর সর্বত্র বিচরণ করবে। কলিযুগ শেষ হলে কৃতযুগ শুরু হবে।

সপ্তর্ষিরা প্রতি নক্ষত্রে এক এক শত বছর বাস করবেন। এইভাবে তাদের এক একটি যুগ। ঐ যুগ দিব্যসংখ্যায় নির্ণীত হয়। সপ্তর্ষিদের প্রথমত ক্ষেত্রমণ্ডলের পূর্বদিকে এবং পরে উত্তর দিকে দেখা যায়। অন্তরীক্ষের সম মধ্যভাগে যে নক্ষত্র দেখা যায়, তার সাথে সপ্তর্ষি মিলিত হলে তাদের শতবর্ষের পূর্ণতা কাল জানা যায়। তারপর অন্ধ্র রাজাদের রাজত্বের শেষে তারা শতভিষা নক্ষত্রে গিয়ে মিলিত হবেন। সেসময় পৃথিবীর প্রজাসাধারণ বিপন্ন হয়ে পড়বে। সকলেই ধর্ম, অর্থ, কাম হীন হয়ে পড়বে। বর্ণাশ্রম ধর্ম শিথিল হয়ে পড়বে।

শ্রীকৃষ্ণ যেদিন স্বর্গারোহণ করেছেন সেদিন থেকে কলি প্রবেশ করেছে। সেই কলিযুগের সংখ্যা বলছি। তিন লক্ষ ষাট হাজার বছর কলিকালের পরিমাণ নির্ধারিত। দিব্য হাজার বছর এর সন্ধ্যাংশ বলা হয়ে থাকে। কলিযুগ সমস্ত শেষ হয়ে গেলে কৃতযুগ প্রবর্তিত হবে। ইক্ষবাকু থেকে ক্ষত্রিয় বংশের আবির্ভাব, সেই বংশের সুমিত্র পর্যন্ত তার পরিশেষ, বুধ গণ বলে থাকেন ক্ষেমক পর্যন্তই হল ক্ষত্রিয় বংশের শেষ।

এবার ক্ষত্রিয় উৎপত্তির কথা বলছি। পুরুবংশীয় রাজা দেবাপি কঠোর যোগবল অবলম্বন করে কল্পগ্রামে অবস্থান করবেন। ইক্ষবাকু কুলে সোম থেকে সুর্বা নামে এক পুত্র জন্মাবে। এরাই ক্ষত্রিয় কুলের প্রবর্তন করবেন। দেবাপি ওই বংশের আদি রাজা হবেন। কলিযুগ ক্ষীণ ও ভাবী কৃতযুগের প্রবর্তন হলে ঐ দুই রাজা ভাবী সপ্তর্ষির সাথে আবির্ভূত হবেন। ত্রেতাযুগের আদিতে তারাই ক্ষত্রিয় বংশের প্রবর্তক।

দ্বাপরে কি ঋষি, কি ক্ষত্রিয় কেউই থাকবেন না। কৃত ত্রেতা যুগে ঋষি ও রাজর্ষি ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বংশের বীজভূত হবেন। সব মন্বন্তরেই থাকবে ক্ষত্রিয় বংশের উপস্থিতি। সন্তানের জন্য সপ্তর্ষিরা যুগে। যুগে রাজাদের সাথে এভাবেই অবতীর্ণ হয়ে থাকেন। মন্বন্তরের ক্ষয়কাল পর্যন্ত তাদেরকে এভাবেই উৎপন্ন হতে হয়। পরশুরাম ধরিত্রীর সমস্ত ক্ষত্রিয় কুলের উচ্ছেদ সাধন করলে চন্দ্র, সূর্য উভয় বংশীয় ক্ষত্রিয়গণের পুনরুৎপত্তি হয়। এবার সেই বৃত্তান্তই বলছি। জমদাগ্নকৃত সংহারের পর ঐল ও ইক্ষবাকু উভয় বংশেই আবার সন্তান বিস্তার হয়। ধারাবাহিক ক্রমে ক্ষত্রিয়রা আবার রাজা হয়ে থাকেন। এই দুই বংশে বিখ্যাত রাজা জন্ম নেন।

এর মধ্যে অতীত হয়েছেন একশো প্রতিবিন্ধ্য, একশো নাগ, একশো ঘোড়া, একশো ধৃতরাষ্ট্র, আশি জন জনমেজয়, একশো জন ব্ৰহ্মদত্ত, একশো ধারী, একশো পৈল, একশো শ্বেত, কাশ কুসাদি নামীয় নরপতি ও শতবিন্দু নামে এক হাজার রাজা। এঁরা সকলেই অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। বৈবস্বত মনুর অধিকার কালে যাঁরা রাজা হয়েছেন তাদের বহু সংখ্যক সন্তান সন্ততি রয়েছে। বৈবস্বত মন্বন্তরে আঠাশ যুগ অতীত হয়েছে। ভাবীকালে এই যুগে আরও চল্লিশ জন বিশিষ্ট রাজা রাজত্ব করবেন। পরে বৈবস্বত মন্বন্তরের অবসান হবে। এই সব রাজবংশ বিবরণ শুনলে আয়ু, কীর্তি, ধন ও পুত্র ইত্যাদি লাভ হয়।