১২. অনিচ্ছাকৃত শিবরাত্রি ব্রতের ফল

অনিচ্ছাকৃত শিবরাত্রি ব্রতের ফল

যজ্ঞদত্ত নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি মহাপণ্ডিত ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। তাঁর বাস কাগ্মিল্য নগরে। সকলের সঙ্গে রাজা তাকে খুব শ্রদ্ধা করত। খুশি হয়ে রাজা তাকে তার সভাপণ্ডিত করে দিলেন। যজ্ঞদত্তের এক পুত্র হল। তার নাম হল গুণনিধি। সে দেখতে সুন্দর। যথা সময়ে তার পিতা তাকে বিদ্যা অর্জনের জন্য পাঠালেন গুরুগৃহে। সে সকালে যায় বিকালে ফিরে আসে। যজ্ঞদত্ত রাজসভায় যান খুব সকালে, বাড়ি ফেরেন রাত্রিতে। তিনি যখন ফেরেন তখন ছেলে ঘুমিয়ে পড়ে। তাই সে ছেলেকে আদরও করতে পারে না কিংবা কথাও বলতে পারে না।

ধীরে ধীরে ছেলে বড় হল। সে বহু জ্ঞান অর্জন করে। কিন্তু তার সঙ্গী সাথীরা বড়ই খারাপ; বদ প্রকৃতির, তাদের কাজ হল জুয়া খেলা, নষ্টামী করা।

একদিন গুণনিধি তাদের সঙ্গে বসল জুয়া খেলতে, সর্বনাশা সেই খেলাতেই মজে যেতে লাগল সে। তার ফলে পড়াশোনা যা করেছিল অনভ্যাসের কারণে এবং অনুশীলনের অভাবে সব ভুলে যেতে লাগল। রাত দিন প্রায় সবসময়ই পড়ে থাকে জুয়ার আড্ডায়।

যজ্ঞদত্ত রাজসভায় যায় বলে সর্বদা সে তার ছেলের খোঁজ খবর নিতে পারে না। কেবল স্ত্রীর কাছে জেনে নেয়, ছেলে প্রত্যহ গুরুগৃহে যায় পড়তে। মন দিয়ে লেখাপড়া শিখছে এইটুকু শুনেই খুশি যজ্ঞদত্ত। ছেলে যে এদিকে জুয়াবাজ হয়েছে সে খবর তার মাও যানে না। আর বাবা জানবে কেমন করে।

গুণনিধি ধীরে ধীরে একজন বড় জুয়াড়ী হয়ে উঠল। জুয়া খেলতে হলে বাজি রাখতে হয়, তার জন্য টাকা পয়সা লাগে। তাই সে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ির জিনিস নিয়ে যায়। একদিন সে মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেল। গুণনিধি স্বীকার করে নিল যে, জুয়াখেলার জন্য সে এইসব জিনিস নিয়ে যায়। পুত্র আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে গেছে জানতে পেরে মায়ের মাথায় যেন বজ্রপাত হল। তিনি বহু ভৎর্সনা করল ছেলেকে। কিন্তু ছেলের যা মতিগতি সে মায়ের কথা শুনবে কেন? সে বাড়ির গহনা নিয়ে চলল জুয়ার আড্ডায়। সে জিততে পারে না, শুধু হেরে যায়। যত হারে তত তার জেদ বাড়ে, ভাবে এর পরের খেলায় নিশ্চয়ই সে জিতবে।

ব্রাহ্মণী মুস্কিলে পড়লেন। তার একমাত্র ছেলে সে কিনা এমন জুখোর হল, স্বামীকে ভয়ে তিনি কিছু বলতে পারলেন না। যিদি তিনি রাগের বসে কিছু করে ফেলেন।

ব্রাহ্মণী মনে মনে ভাবল–যদি ছেলের বিয়ে দিই, তাহলে তার মতিগতি ফিরতে পারে। যজ্ঞদত্তকে সে ছেলের বিয়ের কথা বলল। তিনি রাজী হলেন। একটি সুন্দরী মেয়ে দেখে খুব ঘটা করে তিনি ছেলের বিয়ে দিলেন।

এতে করেও ছেলের স্বভাব বদলালো না। মায়ের মন আরও খারাপ হল। স্বামীকে বলবে বলবে করেও বলতে পারছে না।

একদিন রাজসভা থেকে যজ্ঞদত্ত বাড়ি ফিরছেন, তিনি দুরে দেখতে পেলেন দুই জুয়াড়িকে তারা কি যেন বলাবলি করছে। তিনি জুয়াখোরদের খুব ঘৃণা করতেন। তাই পথে তিনি জুয়াখোরদের দেখলে কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতেন। সেদিনও পাশ কাটিয়ে যেতে যাবেন, হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন এক জুয়াড়ির হাতে একটা আংটি। তিনি সেই জুয়াড়িকে ডেকে বললেন–তোমার হাতে ওই আংটিটা দেখি। জুয়াড়ি হাত তুলে ধরল যজ্ঞদত্তের সামনে। যজ্ঞদত্ত চিনতে পারল– এ আংটিতে তাঁর নিজের। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন –কোথায় পেলি এটা?

জুয়াড়ি বলল- তোমার ছেলে জুয়ায় এটা হেরে গেছে। আমি এটা জিতেছি। জুয়াড়ির মুখে এমন কথা শুনে যজ্ঞদত্তের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বললেন, আমার ছেলে গুণনিধি জুয়া খেলে?

জুয়ারি বলল– সে তো একজন মস্ত জুয়াখোর। কিন্তু আজ পর্যন্ত জিততে পারেনি। সব সময়ই হারে। কত দামী জিনিস যে হেরেছে তার সীমা নেই।

কোন কথা না বলেই যজ্ঞদত্ত চলে গেলেন নিজের ঘরে। পেটের খিদে ভুলেই গেলেন। ডাকলেন স্ত্রীকে, জিজ্ঞাসা করলেন –গুণনিধি কোথায়?

স্ত্রী বললেন– পড়তে গেছে। আর কিছু না বলে ব্রাহ্মণী ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন স্বামী ছেলের বিষয় জানতে পেরেছে। আজকেই তো বউ-এর গয়না খুলে নিতে গিয়ে এত ঝগড়াঝাটি। কেমন করে বলব ছেলের কাণ্ড, যজ্ঞদত্ত ছাড়ার পাত্র ছিলেন না।

আবার ডাকলেন। আমার কথাটা পুরো না শুনেই যে চলে গেলে ঘরের মধ্যে? বাইরে এসো বলছি, আমাদের বিয়ের সময় তোমাকে যে সোনার আংটিটা দিয়েছিলাম সেটা কোথায় রেখেছ? তাতে বহু দামী রত্ন বসানো ছিল।

ব্রাহ্মণী এবার বিপদে পড়ে গেলেন। বললেন– এখন আমার খিদে পেয়েছে। আগে খেয়ে নাও। তারপর ধীরেসুস্থে দেখাব। কোথায় রেখেছি খুঁজে দেখতে হবে।

ব্রাহ্মণ বললেন– তুমি কেন আমার কাছে লুকাচ্ছ? ঘরের জন্য আমি অনেক জিনিস এনেছিলাম। রাজকাজে ব্যস্ত থাকায় ওগুলোর খোঁজ নেওয়া হয়নি। তোমার কাছেই ছেলের খবর নিতাম। তোমার গুণনিধি যে সত্যিই গুণের নিধি হয়ে উঠেছে তা আমার কাছে গোপন করলে কেন?

ব্রাহ্মণী আর কী বললেন? তিনি ধরা পড়ে গেছেন স্বামীর কাছে। তিনি মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। ব্রাহ্মণী তুমি আমাকে তো ভালোভাবেই চেনো, আমি মিথ্যাকে ভীষণ ভাবে ঘৃণা করি। অনাচার সহ্য করতে পারি না। আর তুমি আমাকে এতোদিন ধরে মিথ্যা কথা বলে আসছ। আমার বাড়িতেই এতোদিন ধরে অনাচার চলছে। তুমি সব জেনেশুনে এইসব প্রশ্রয় দিচ্ছ। ছেলেকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ব্রাহ্মণী চুপ করে থাকলেন। কেননা স্বামীতো ঠিক কথাই বলছেন। একটা মাত্র ছেলে কিছু বললে যদি সে কিছু অঘটন ঘটায় তাই তিনি স্বামীকে কিছু বলেনি। ফলে এখন তিনি স্বামীর কাছে মুখ তুলে কিছু বলতে পারলেন না।

ব্রাহ্মণী শোন আমার কথা। আজ থেকে ওই ছেলেকে আমি ত্যাগ করলাম। তুমি ওকে ঢুকতে দেবে না আমার গৃহে।

সন্ধ্যার সময় গুণনিধি ঘরে ফিরল। ব্রাহ্মণী স্বামীর কঠোর নির্দেশে তখন তাকে দূর করে দিল ঘর থেকে। সে যাবে কোথায়? কেউ তাকে আশ্রয় দিল না। সে পথে পথে ঘুরতে থাকে। ক্ষুধার জ্বালায় সে বুনো ফলমূল খায়। ভাবতে থাকে, হায় এ কি করলাম, মহাপণ্ডিতের ছেলে হয়ে শেষ পর্যন্ত জুয়াড়ি হলাম। বাড়ির দামি জিনিস সব জুয়ায় হারালাম। কিন্তু এখন আমি কোথায় যাই? কি করি? ক্ষুধায় কাতর হয়ে এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন আর সে ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু সামনে কোন খাবার দেখতে পেল না। সে কি করবে ভাবছে? এমন সময় সে দেখতে পেল একজন ভক্ত নানা ধরনের নৈবেদ্য সাজিয়ে রাস্তা দিয়ে চলছে। সেই খাবার দেখে ক্ষুধার্থ গুণনিধি সেই লোকটির পিছু নিল।

সেদিন ছিল শিবরাত্রি, এক শিবভক্ত সেই সব নৈবেদ্য নিয়ে শিবালয়ে যাচ্ছিল। সে শিবের সামনে নৈবেদ্যর ডালা নিবেদন করল। গুণনিধি রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল বাইরে, দেখল যে লোকটি শিবের পূজা করছে। নৈবেদ্যদি নিবেদন করল শিবঠাকুকে। আরও অনেকে এসেছে শিবের পূজা করতে, শিবরাত্রিতে সবাই মিলে নাচ-গান করল। গুণনিধি বাইরে দাঁড়িয়ে সব দেখল কিন্তু মাঝে মাঝে তার খিদের জ্বালা প্রবল হল, এতোই প্রবল হল যে সে সহ্য করতে পারল না।

প্রভাত হওয়ার পূর্বে সবাই ক্লান্ত হয়ে মন্দিরে একধারে সবাই ভূমিতলেই শুয়ে পড়ল। এই সুযোগে গুণনিধি ধীরে ধীরে মন্দিরে ঢুকল, এবং ঢুকেই নৈবেদ্যর থালা খুঁজতে লাগল। তখন টিম টিম করে প্রদীপ জ্বলছিল, তাই সবকিছু ভালভাবে দেখা যাচ্ছে না। তখন সে প্রদীপের শিখা এগিয়ে দিতে উজ্জ্বল আলোতে ভরে গেল শিবালয়। সে নৈবেদ্যর থালা দেখতে পেল। তারপর থালাটা তুলে নিতে যাবে; তখনই এক ভক্তের গায়ে তার পা লাগল। সেই ভক্ত তখন জেগে উঠল। চোর, চোর বলে চিৎকার করতে শুরু করে দিল। সবাই উঠে পড়ল, এবং গুণনিধিকে সবাই মারতে লাগল। দিনের পর দিন অনাহারে থাকায় সে এমনিতেই দুর্বল ছিল। তারপর মার খেয়ে তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। শিবরাত্রির দিন সে উপবাসে মরল। শিবালয়ে প্রদীপের বাতি উঁকিয়ে আলোর জ্যোতি পড়ল, অজ্ঞানতভাবেই তার ব্রত পালন করা হল। এতে তার সকল পাপ নষ্ট হল। শিবের দূতেরা এসে তাকে নিয়ে গেল শিবলোকে। কৈলাসে সে বহুদিন কাটালো। এর পর তার জন্ম হয় পৃথিবীতে কলিঙ্গ রাজার পুত্র রূপে। তারপর রাজার মৃত্যুর পর সে রাজা হল, এবং সে রাজকার্য পরিচালনা করতে লাগল ন্যায় নিষ্ঠাভাবে। রাজা হয়ে গেলেও সে শিবপূজা করতে ভোলেনি। সে নিত্য শিবপূজা না করে জলস্পর্শ করত না। যতদিন সে জীবিত ছিল ততদিন সে শিবাত্রির দিন উপবাস করত। নিত্য শিবালয়ে বাতি দিত। তারপর মৃত্যুর পর শিবের অনুগ্রহে অলকপুরীর রাজা হল সে, অজ্ঞানতঃ শিবরাত্রি ব্রত পালনের ফলে যদি এই ফল পাওয়া যায়, তাহলে জ্ঞানতঃ ভক্তিভরে যদি ঠিকমতো ব্রত পালন করা হয় তাহলে কি ফল হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।