২. প্রকৃতি খণ্ড

প্রকৃতি খণ্ড

প্রথম অধ্যায় শ্রীনারায়ণ বললেন–বৎস নারদ! প্রকৃতিতত্ত্ব সম্বন্ধে মহাদেবের কাছ থেকে আমি যতটুকু জ্ঞান লাভ করেছি, তা তোমাকে দান করছি, শোনো, প্রকৃতি কে? তিনি কোথা থেকে আবির্ভূত হয়েছেন? তার লক্ষণ কী? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া কারও সম্ভব নয়। সৃষ্টির ব্যাপারে যিনি প্রধান তিনি হলেন প্রকৃতি। “প্ৰ” শব্দের অর্থ “কৃত্তি’ মানে সৃষ্টি বেদ “প্রকৃতি” শব্দটিকে এইভাবে বিশ্লেষিত করেছে –“প্ৰ” –সত্ত্বগুণ, “কৃ” –মধ্যম রজোগুণ এবং “তি” –নিকৃষ্ট তমোগুণ। অর্থাৎ যিনি ত্রিগুণাত্মিকা ও সমস্ত শক্তিযুক্ত এবং সৃষ্টির প্রধান নায়িকা, তিনিই হলেন প্রকৃতি, পরমাত্মার সাথে সাথে প্রকৃতি ছায়ার মতো থাকেন। তাই মুনি ঋষিরা স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে কোনো আলাদা কিছু দেখেন না।

হে ব্রাহ্মণ। পরমাত্মা ঈশ্বর যখন সৃষ্টি করার ইচ্ছায় মেতে উঠলেন, তখনই মূল প্রকৃতি ঈশ্বরীর আবির্ভাব ঘটে। সৃষ্টির কাজের জন্য প্রকৃতির পাঁচটি প্রকার নির্ণীত হয়েছে- (১) দূর্গা, (২) রাধিকা, (৩) লক্ষ্মী, (৪) সরস্বতী এবং (৫) সাবিত্রী। ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবতারা, মুনিগণ এবং মনুগণ সকলের অধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মময়ী, সনাতনী দূর্গাদেবীর ধ্যান করে থাকেন। ধর্ম, সত্য, পুণ্য, কীর্তি, যশ ও মঙ্গল, দূর্গাদেবী দান করে থাকেন। যে তাঁর শরণ নেয়, দুঃস্থ পীড়িত, তিনি তাদের উদ্ধার করেন। সমস্ত শক্তির আধার এই প্রকৃতি। কৃষ্ণের সৃষ্টি সহায়িকা শক্তি। বুদ্ধি, নিদ্রা, ক্ষুধা, পিপাসা, ছায়া, তন্দ্রা, দয়া, স্মৃতি, জাতি, ক্ষান্তি, শান্তি কান্তি, শ্রান্তি, চেতনা, তুষ্টি, পুষ্টি, লক্ষ্মী, বৃত্তি সবই তিনি। তিনি জননী। শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত শক্তি স্বরূপা অনন্ত রূপিণী দূর্গার গুণের অন্ত নেই।

পরমাত্মার আর এক শক্তি লক্ষ্মী। তিনি শুদ্ধসত্ত্ব সম্পদ স্বরূপা। তিনি কান্তা। তিনি শান্ত স্বভাব ও সুশীলা। তিনি সকলের মঙ্গল করেন। কাম, ক্রোধ, অহংকার, লোভ, মোহ ইত্যাদি দোষে লক্ষ্মীদেবী দুষ্ট নন। তিনি পতিপ্রিয়া, প্রিয়ভাষিণী, শ্রীভগবানের প্রেমতুল্য প্রিয়পাত্রী, তিনি সকল জীবের শস্যস্বরূপা, তিনি মহালক্ষ্মী, পতি নারায়ণের মহালক্ষ্মী। পতি নারায়ণের পাশে তার অধিষ্ঠান। স্বর্গে তিনি স্বর্গলক্ষ্মী নামে বিরাজিতা, রাজার ঘরে রাজলক্ষ্মী এবং সাধারণ মানুষের ঘরে তিনি গৃহলক্ষ্মী রূপে অবস্থান করেন। বাণিজ্যে তার বাস। তিনি পাপীদের ক্ষমা করেন না। ভক্তদের প্রতি তিনি দয়া প্রদর্শন করেন, তার অভীষ্ট পূরণ করেন। লক্ষ্মীদেবী ব্যতীত জগৎ অন্ধকার। তিনি পূজনীয় এবং বন্দনীয়।

সর্বসম্মত তৃতীয় শক্তি বিদ্যার স্বরূপ সরস্বতী। তিনি সৎলোকের কবিতায় বাস করেন। তিনি শান্তরূপিণী, বীণা আর বই ধারণ করে আছেন। তিনি শ্রীহরিপ্রিয়া শুদ্ধসত্ত্ব স্বরূপা দেবী। তিনি তুষার চন্দনে চর্চিত। কুমুদ ও পদ্মফুল শুভ্রতায় তার গাত্রবর্ণের কাছে হার মানে। তিনি বিদ্যা ও সিদ্ধিদাত্রী তিনি ব্যাখ্যা ও বোধস্বরূপ। সন্দেহ দূরকারী, বিচারকারী, বই লেখিকা ও শক্তিরূপিণী। তিনি রাগ ও তালের দেবী।

চতুর্থ শক্তি শ্রীরাধিকা তিনি পঞ্চপ্রাণ স্বরূপা। তিনি মানিনী, শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় তাঁর গুণ ও তেজ। শ্রীকৃষ্ণের বাঁদিক থেকে তিনি উদ্ভূত। তিনি পরমানন্দ রূপিণী, তিনি পরাৎপরা সমস্ত রকম ব্ৰতযুক্ত দেবী পূজনীয়। কৃষ্ণ রাসলীলার কারণে শ্রীরাধিকে সৃষ্টি করেছিলেন। রাসমণ্ডলের অধিষ্ঠাত্রী ও সুরসিকা দেবী গোপিনীর রূপে গোলকে অবস্থান করেন।

তিনি সন্তোষ রূপিণী ও আনন্দময়ী। তিনি শান্ত ও নিরহঙ্করী। ভক্তদের কৃপা করেন। তিনি শুদ্ধবস্ত্র পরিহিত, নানাধরনের অলংকারে বিভূষিত। কোটি চন্দ্রের সৌন্দর্যও তার সৌন্দর্যের কাছে ম্লান হয়। তাঁর দয়াতেই হরিদাসত্ব লাভ করা যায়। স্ত্রী রত্নের শ্রেষ্ঠ অংশ থেকে এই দেবী ঘনকালো মেঘের মধ্যে চঞ্চল, বিদ্যুতের মতো কৃষ্ণের বক্ষে সবসময় অবস্থান করছেন। মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি কৃষভানু কন্যা হয়ে শূকরী রূপে জন্ম নিয়েছিলেন, তাঁর পাদস্পর্শে ভারতবর্ষের মাটি পবিত্র হয়েছে। যে দেবীকে ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবতারা প্রত্যক্ষ করতে পারেন না, মর্তবাসী তাঁর দর্শন পেয়ে ধন্য হয়েছে, পূর্বে ব্রহ্মা তার পায়ের নখ দেখার এবং নিজের শুদ্ধতার জন্য ষাট হাজার বছর ধরে তপস্যা করেন। কিন্তু সে নখের দর্শন তিনি পাননি, এমনকি স্বপ্নেও তার আবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু তপস্যার গুণেই বৃন্দাবনে শ্রীরাধিকার দর্শন লাভ তিনি করেছিলেন।

পঞ্চম প্রকৃতি সাবিত্রীর কথা এবার বলছি। ইনি চারবেদ, বেদাঙ্গ ও সমস্ত ছন্দের জননী। এই। বিচক্ষণ দেবী সন্ধ্যা বন্দনার মন্ত্রের ও তন্ত্রের মা। তিনি ব্রহ্মতেজ স্বরূপা। তাপসী। ব্রাহ্মণরা তার জপ করেন।

সংক্ষেপে এই হল পাঁচ প্রকৃতির কথা। পরিপূর্ণতম পাঁচ জন দেবী হলেন মূল প্রকৃতি। জগতের দেবী ও নারীগণ মূল প্রকৃতির অংশজাতা। ভূবনপাবনী প্রকৃতির প্রধান অংশস্বরূপা গঙ্গা বিষ্ণুর দেহ থেকে তার উৎপত্তি। দ্রবীভূত এই সনাতনী এই দেবী জ্বলন্ত কাঠের ন্যায় প্রাণীদের পাপের বিনাশ ঘটান। ভুবন পাবনীর জলে স্নান করলে, পান করলে, স্পর্শ করলে মোক্ষ লাভ হয়। সেরা নারীদের মধ্যে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ, মহাদেবের জটার মধ্যে তিনি মুক্তা শ্রেণীর মতো অবস্থান করছেন। ভারতের মাটি তার স্রোতধারায় পবিত্র হয়েছে। তিনি পদ্ম ও শাঁখের মতো শুভ্র। তিনি শুদ্ধসত্ত্ব স্বরূপা। দেবী গঙ্গা শুদ্ধ ও সতী সাধ্বী। তিনি নারায়ণের প্রিয়তমা। তিনি নিরাহঙ্করী।

প্রকৃতির প্রধান অংশ স্বরূপা তুলসী বিষ্ণুর প্রিয়া। তিনি বিষ্ণুর চরণ সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন। সর্বদা বিষ্ণুর পদসেবা করে চলেছেন। তপস্যা, সংকল্প, পুজো প্রভৃতি কাজে তুলসী ব্যস্ত থাকেন। যে তুলসীর দর্শন পায় বা তার স্পর্শ অনুভব করে, তার নির্বাগ লাভ হয়। কলিযুগের পাতাল ধ্বংস করতে তুলসী আগুনের মতো কাজ করেন। তিনি মুমূর্ষদের মুক্তি দান করেন, সকলের অভীষ্ট পূরণ করেন। তীর্থগুলি যাঁর স্পর্শ ও দর্শন লাভ করে আত্মশুদ্ধি লাভ করতে চায়, যিনি এই ভারতে কল্পবৃক্ষ স্বরূপ ও জগৎ স্বরূপ তিনিই তুলসী, মর্তবাসীদের উদ্ধার করার একমাত্র দেবী তিনি।

হে নারদ, প্রকৃতির অংশ স্বরূপিনী, মাতৃকাদের মধ্যে পূজ্যতম দেবী ষষ্ঠী। জগতের সমস্ত শিশুর লালন পালনের কাজে ব্যস্ত থাকেন। ইনি সমস্ত জগতের ধাত্রী ও সন্তানাদি দান করে থাকেন। তিনি দেব সেনাপতি কার্তিকের পত্নী। ইনি বিষ্ণুর তপস্যায় মগ্ন। এই দেবীর উদ্দেশ্যে শিশুর জন্মের ছয় দিনের দিন আঁতুর ঘরে এবং একুশ দিনে পুত্রের মঙ্গল কামনা করে যে পুজো করা হয়, তা নিত্য এ ছাড়া অন্যান্য সব পুজো কাম্য শিশুদের যেকোনো বিপদ থেকে তিনি রক্ষা করেন। মাতৃরূপা ও দয়ারূপা এই দেবীকে শিশুরা স্বপ্নে দর্শন করে। প্রকৃতির মুখ থেকে তার আবির্ভাব ঘটেছে।

প্রকৃতির আর এক অংশজাত দেবী মনসা। কশ্যপ মুনির কন্যা, মহাদেব প্রিয় শিষ্য অনুগামিনী। মনসাদেবীর জ্ঞানের সীমা পরিসীমা নেই। ইনি সাপদের সম্রাজ্ঞী। এই দেবীর বাহন সাপ। সাপ দ্বারা তিনি সুসজ্জিতা। নাগলোকে এই দেবীর বসবাস। মনসা বিষ্ণু ভক্ত। তার ফলে তিনি বিষ্ণু স্বরূপিনী। ইনি তপস্যা স্বরূপিনী। তিনলক্ষ বছর ধরে ইনি হরির ধ্যান করে তপস্যাবলে তপস্বী ও তপস্বিনীদের পূজনীয়াতে পরিণত হয়েছেন। ব্রহ্মতেজ স্বরূপিনী দেবী সাপ মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী। ইনি সর্বদা পরম ব্রহ্মের সেবায় নিয়োজিত। জরুকারু মুনির স্ত্রী মনসার ইষ্টদেব শ্রীকৃষ্ণ। শিব তার গুরু। ইনি আস্তিক মুনির মাতা।

প্রতি মঙ্গলবার পঞ্চ উপচারে রমণীরা যার পুজো করেন, যিনি মঙ্গলরূপা এবং ধ্বংসের সময় চণ্ডীরূপা, যিনি সকল নারীর সকল কামনা বাসনা পূর্ণ করেন, যিনি কুপিত হলে মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারেন, তিনি হলেন মঙ্গলচণ্ডী। তিনি পুত্র, পৌত্র, ধন, যশ ইত্যাদির দেবী। দুঃখ, শোক, পাপ, তাপ ও ব্যাধির হাত থেকে ভক্তকে রক্ষা করেন।

যিনি শুম্ভ নিশুম্ব যুদ্ধে দুর্গাদেবীর কপাল থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যিনি কোটি সূর্যের তেজের সমান উজ্জ্বল, তিনি হলেন কমললোচনাকালী, কালী কৃষ্ণের সমকক্ষ। শক্তিশ্রেষ্ঠা, সিদ্ধিধাত্রী ও শ্রেষ্ঠ সিদ্ধযোগিনী এই দেবীর দেহ শোভাময়। ইনি দূর্গার অর্ধাংশস্বরূপা। তিনি সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করেন। জগৎ রক্ষার জন্য তিনি অতি সহজেই দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ধর্ম, অর্থ, কাম ও নির্বাণ লাভ হয়। এই দেবীর আরাধনা করলে। এই মহাদেবীর স্তব করে চলেছেন শিব প্রভৃতি দেবতারা, মুনিরা, মনুরা এবং মানুষ।

প্রকৃতির প্রধান অংশস্বরূপ বসুন্ধরা শস্য স্বরূপিণী। তিনি সমস্ত রত্নের জন্মদাত্রী। জগৎবাসী বসুন্ধরার আশ্রয়ে বসবাস করে। তিনি দয়াবতী। সমস্ত সম্পদ দান করে সকলের জীবিকার সংস্থান করেন। প্রজা ও প্রজাপতিরা এই মহাদেবীর পুজো করেন।

হে নারদ, এবার শোনো প্রকৃতির কলাস্বরূপ দেবীদের কথা। অগ্নির স্ত্রী স্বাহাদেবী সর্বত্র পূজা লাভ করেন। আগুনে ঘি আহুতি দিলে এঁর নাম উচ্চারণ করতে হয়। নতুবা দেবতাদের গ্রহণীয় হয়। দক্ষিণা যজ্ঞের পত্নী ছাড়া জগতের সমস্ত কাজ স্তব্ধ হয়ে যায়। সর্বত্র ইনি পূজিত, গণপতির স্ত্রী পুষ্টি পৃথিবীতে পুজো পান। যে পুষ্টি সকলের স্বাস্থ্যের মঙ্গল করে। অনন্ত দেবের স্ত্রী তুষ্টি, অর্থাৎ এই দেবীকে বাদ দিয়ে পুজোপার্বণ করলে দেবতারা অসন্তুষ্ট হন। মুনি, মনু ও মানুষ সবাই যার পুজো করেন তিনি হলেন পিতৃদের পত্নী স্বধা। এই দেবীকে বাদ দিয়ে পিতৃদের উদ্দেশ্যে সমস্ত দানই নিষ্ফল হয়। বায়ুর স্ত্রী স্বস্তি ত্রিভুবনে ইনি পূজিতা। এই দেবীকে ছাড়া আদান প্রদান সফল হয় না। ঈশানের স্ত্রী সম্পত্তিকে তুষ্ট করতে না পারলে ধনহীন হতে হয়। কপিলের পত্নীর নাম ধৃতি এই দেবীকে পুজো করে খুশি করতে না পারলে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। সুশীলা ও সতীসাধ্বী ক্ষমা হলেন যমের স্ত্রী, ইনি জগতে পুজ্য, ইনি উন্মত্ততা রুষ্টের কারণ। কামদেবের স্ত্রী রতিকে পুজো করে সকলে। এই দেবীকে ছাড়া জগৎ ক্রীড়া আনন্দহীন হয়ে পড়ে।

সত্যের স্ত্রী মুক্তিদেবী সকলের প্রিয়। এর অভাবে জগতে মিত্রের অভাব ঘটে। দয়া হলেন মোহের পত্নী। সকলের পূজনীয়। এই দেবীকে তুষ্ট না করলে জগতে নিষ্ঠুরতা দেখা দেবে। পুণ্যের ভার্য্যা প্রতিষ্ঠা সকলের পুণ্য করেন। কারণ তিনি স্বয়ং পুণ্যময়ী। সুকর্মের ভার্য্যা কীর্তি ত্রিভুবনকে যশ ও খ্যাতিবান করে। উদ্যোগপত্নী ক্রিয়াকে জগতের সকলের পুজো করেন। ইনি সর্বত্র বিরাজিতা।

হে বৎস, এইসব ক্রিয়া ব্যতীত জগৎ রসাতলে যায়। অধর্মের ভার্য্যা মিথ্যা ধূর্তরাই অধর্মকে পুজো করে। মিথ্যার ক্রিয়ার ফলে বিধাতার এই সৃষ্টি উচ্ছন্নে যায়। প্রথম তিনটি যুগে ছদ্মবেশে মিথ্যা প্রবেশ করেছে জগতে। কখনও অদৃশ্যভাবে, কখনও সূক্ষ্ম রূপে। কখনও বা অর্ধেকাংশ। আর কলিযুগে সবকিছু মিথ্যার মুঠোবন্দী। সুশীলের দুই পত্নী শান্তি ও লজ্জা। এরা ছাড়া জগৎ উন্মাদের মতো হয়। বুদ্ধি, মেধা ও স্মৃতি — জ্ঞানের তিন স্ত্রী। এরা জগতের মানুষকে বুদ্ধি দান করে মেধা ও স্মৃতি সম্পন্ন হতে সাহয্য করে। ধর্মের স্ত্রী মূর্তি বিহনে পরমাত্মা ও বিশ্ব রূপধারণের কোনো অবলম্বন পেত না। ইনি হলেন মূর্তিমতী লক্ষ্মী।

জগতে এই সতীকে সকলে পুজো করে। নিদ্রা হলেন কালাগ্নিরুদ্রের ভার্যা। সিদ্ধ পুরুষদের কাছ থেকে পুজো গ্রহণ করেন। নিদ্রাদেবীর কোলে রাতে জগৎ আশ্রয় নেয়। কালের তিনজন পত্নী– সন্ধ্যা, রাত্রি ও দিন। এদের সাহায্যে বিধাতা পুরুষ সময় পরিমাপ করতে পারেন। ধন্য ও মান্য দুই সতী, ক্ষুধা ও পিপাসা হলেন লোভের দুই স্ত্রী। এঁরা জগতে পূজনীয়া। এঁদের মায়ার প্রভাবে জগৎ ক্ষুব্ধ ও চিন্তিত হয়। তেজের দুই পত্নীর নাম প্রভা ও দাহিকা। এঁরা বিধাতার জগৎ সৃষ্টির সহায়িকা। প্রচারের দুই প্রিয় পত্নী হলেন মৃত্যু ও জরা। এঁরা জগতকে কেবল ধ্বংসপ্রাপ্ত করেন। প্রীতি ও তন্দ্রা নিদ্রাদেবীর দুই কন্যা এবং সুখের দুই প্রিয় ভার্য্যা জগতের ব্যাপ্ত হতে সাহায্য করেন। শ্রদ্ধা ও ভক্তি নামে বৈরাগ্যের দুই স্ত্রী জগতে পুজো লাভ করেন।

চন্দ্রের পত্নী রোহিনী, সূর্যের স্ত্রী সংজ্ঞা, মনুপত্নী, শতরূপা, ইন্দ্রপত্নী শচী, বৃহস্পতি পত্নী তারা, বশিষ্ঠপত্নী অরুন্ধতী, কর্মপত্নী দেবহূতি, গৌতমপত্নী অহল্যা, অত্রিপত্নী অনসূয়া, পিতৃদের মানসকন্যা মেনকা, লোপামুদ্রা, আহুতি, কুবের পত্নী, বরুণ স্ত্রী বরুনানী, যমপত্নী –বলি পত্নী বিন্দ্যবলী, যশোদা, দেবী, সতী, দ্রৌপদী, গান্ধারী, শৈবা, সত্যবানের পত্নী সাবিত্রী, বৃষভাণু পত্নী কলাবতী (রাধার মা) মন্দোদরী, লক্ষ্মণা, জাম্ববতী, মিত্ৰবিন্দা, নাগ্নার্জিতী, রুক্মণী, সীতা — এঁরা প্রত্যেকেই লক্ষ্মী অংশ।

আরও কয়েকজনের নাম বলছি, যাঁরা প্রকৃতির অনেক অংশ। ব্যাসজননী মহাসতী যোজনগন্ধা বলরামের মাতা রোহিণী, শ্রীকৃষ্ণের ভগিনী দূর্গা, বাণের কন্যা ঊষা, তার সখী প্রভাবতী মায়াবতী, চিত্রলেখা, ভানুমতী, গুরুমা রেণুকা, ইত্যাদি। স্ত্রীকে অপমান করা মানে প্রকৃতিকে অপমান করা। কারণ জগতের প্রত্যেকটি নারী প্রকৃতির কলাংশ দ্বারা গঠিত। স্বামী পুত্র বেঁচে আছেন, এমন কোনো ব্রাহ্মণীকে চন্দন ও অলংকারে ভূষিত করে পুজো করলে প্রকৃতিদেবীর পুজো করাই হয়। আবার আট বছর বয়সী ব্রাহ্মণ কন্যাকে পুজো করলে আসলে প্রকৃতিদেবীর আরাধনা করা হয়।

পৃথিবীতে তিন ধরনের নারী দেখতে পাওয়া যায়–ভালো, মন্দের মিশেল এবং মন্দ। এরা সকলেই প্রকৃতি থেকে আবির্ভূত হয়েছে, প্রকৃতির সত্ত্ব অংশ থেকে যাদের জন্ম হয়েছে, তারা উত্তম বা ভালো, এরা সুশীলা ও পতিব্রতা। মধ্যম শ্রেণির নারী সৃষ্ট হয়েছে প্রকৃতির বর্জ্য অংশ থেকে। এরা হয় স্বার্থপর। নিজের সুখ ছাড়া অন্য কিছু জানে না। প্রকৃতির তমঃ অংশ থেকে সেসব নারীর জন্ম হয়েছে, তারা মন্দ বা অধম। এরা কোন বংশে জন্মেছে, তার হিসাব কেউ দিতে পারে না। এইসব নারী হয় কুলটা, পতির সঙ্গে বিবাদ করতে ভালোবাসে। এরা যখন তখন কুস্থানে চলে যেতে পারে। এরা ধূর্ত ও দুর্মুখও বটে। এইসব কুলটা নারী বেশ্যা নামে চিহ্নিত। স্বর্গের অপ্সরাও প্রকৃতির তমঃ অংশ থেকে উঠে এসেছে।

শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর সর্বত্র এইসব দেবীরা পুজো লাভ করে থাকেন। সর্বপ্রথম দূর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন রাজা সুরথ । ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, রাবণ বধের কামনা করে দ্বিতীয়বার দুর্গা পুজো করেছিলেন। তারপর থেকে জগতে এই পুজোর প্রচলন শুরু হয়। জগন্মাতা দুর্গা প্রথমে দক্ষপত্নীর গর্ভে জন্মলাভ করেন। দক্ষযজ্ঞে স্বামীর নিন্দা শুনে তিনি প্রাণত্যাগ করেন। তারপর আসেন হিমালয়ের কন্যা হয়ে। এই সময় তিনি শিবকে পতি রূপে গ্রহণ করেন। দূর্গার দুই পুত্র –গণেশ ও স্কন্দ। গণেশ শ্রীকৃষ্ণের এবং স্কন্দ বিষ্ণুর অংশ।

মর্ত্যে লক্ষ্মী পুজো শুরু করেন রাজা মঙ্গল। সেই থেকে ত্রিভুবনের সর্বত্র তার পুজো ও বন্দনা হয়ে থাকে। ভক্তি প্রথমে সাবিত্রীদেবীর পুজো করে তিন লোকেই তা প্রচলন করেন। দেবতা, মুনি এবং মানুষ তার বন্দনা করে থাকে। ব্রহ্মার সরস্বতী বন্দনার দেখাদেখি তিনলোকেই তাঁর পুজো প্রচলন হয়। গোলকে রাসমণ্ডলে কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় শ্রীরাধাকে প্রথমে পুজো করেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, সেই থেকে ত্রিভুবনের সর্বত্র দেবতা, মুনি ও মানুষরা তাকে পূর্ণাঘ্য নিবেদন করে।

হে নারদ! প্রকৃতির কলস থেকে আবির্ভূত দেবীরা এইভাবে ভারতের শহরে ও গ্রামে পূজিত। এই হল আগমন ও লক্ষণ অনুসারে প্রকৃতির মঙ্গলময় সব চরিত্র।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়

সৌতি বললেন–হে শৌনক, এখন আমি প্রকৃতি দেবীর সৃষ্টির কারণ তার কলারূপে যারা আর্বিভূত হয়েছেন তাদের জন্মবৃত্তান্ত, পুজোর নিয়মবিধি, মঙ্গলজনক মহিমা, স্তোত্র কবচ বর্ণনা করছি। ভগবান নারায়ণ মহর্ষি নারদকে এ বিষয়ে ব্যক্ত করেছেন, তাই শোনো।

নারায়ণ বলেছেন –পরমাত্মা, আকাশ, কাল দিকের মতো গোলোকও নিত্য। বৈকুণ্ঠ ধামও অনিত্য নয়। ব্রহ্মে লীন সনাতনী প্রকৃতিও অনিত্য নয়। সূর্যের সাথে তেজ যেমন যুক্ত থাকে, তেমনি প্রকৃতি আত্মার সাথে সংযুক্ত, এদের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। মাটি ছাড়া কুম্ভকার যেমন ঘট গড়তে পারে না, তেমনই প্রকৃতি সৃষ্টির জন্য পরম ব্রহ্মা ঈশ্বরকে প্রকৃতির সহায়তা নিতে হয়। সমস্ত শক্তির আধার হলেন প্রকৃতি। “শক” অর্থাৎ ঐশ্বর্য আর “তি” শব্দের অর্থ পরাক্রম। যিনি ঐশ্বর্য ও পরাক্রম পরমেশ্বর সর্বক্ষণ এই ভগবতীর সঙ্গে যুক্ত, তাই তার আর এক নাম ভগবান। ভগবান কারো অধীন নন। তিনি সাকার ও নিরাকার। যোগীর তার নিরাকারকেই সর্বদা ধ্যান করে থাকেন। তাদের মতে কৃষ্ণ পরমব্রহ্ম, সর্বজ্ঞ সমস্ত রূপবিশিষ্ট আবার রূপশূন্য। তিনি হলেন সকলের পোষণকারী কিন্তু সূক্ষ্ম বৈষ্ণবরা একথা স্বীকার করেন না। তাঁরা বলেন –তেজস্বী ব্যক্তি ছাড়া তেজ আসবে কোথা থেকে? এই তেজস্বী শ্রেষ্ঠ তেজোমণ্ডলের মধ্যে অবস্থান করছেন তিনি কারণের কারণ, তিনি বয়সে বালক, সুশীল মনোহর ও পরাৎপর।

বৈষ্ণবরা শ্রীকৃষ্ণের যে রূপ ব্যক্ত করেন তা হল এই রকম –সেই শ্যাম সুন্দরের চোখ দুটি শরৎকালের ফোঁটা পদ্ম, তার দন্ত মুক্তার শুভ্রতাকেও লজ্জা দেয়, তার মস্তকে মুকুট, সেখানে ময়ূরের শিখি শোভা পাচ্ছে, মালতীমালা হাঁটু পর্যন্ত ঝুলছে। তিনি স্মিত হাসিতে মনোহর মুখোনিকে আরও সুন্দর করে তুলেছেন। তার গলায় ঝুলছে কৌস্তভমণি। তিনি দুই হাতে বাঁশি ধারণ করেছেন। বিভিন্ন মূল্যবান অলংকারে তিনি বিভূষিত।

তিনি ভক্তদের কৃপা করার জন্য সর্বদা ব্যস্ত। তিনি ঐশ্বর্য দান করেন। তিনি সকল অভীষ্ট পূরণ করেন। তিনি পরিপূর্ণ স্বয়ং প্রসিদ্ধ। সিদ্ধ দান করে নিজে সিদ্ধির কারণ হন। যে সনাতন শ্রীকৃষ্ণ জন্ম, মৃত্যু, জরা ব্যধি, শোক-তাপ থেকে বৈষ্ণবদের রক্ষণ করেন, তারা সেই পরম পুরুষের পুজো করেন। কৃষ্ণ অর্থাৎ কৃষি ও ণ। তাঁর অর্থ ভক্তি ও দাসত্ব। যিনি ভক্তি ও দাসত্ব দান করে তিনিই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। আবার যিনি সমস্ত কিছুর মূল তিনিই কৃষ্ণ।

হে নারদ! সকল গুণের আধার হলেন ব্রহ্মা। সৃষ্টিকারিরা বাসনা প্রকাশ করতে শ্রীকৃষ্ণের অংশজাত কাল প্রভুকে সৃষ্টি করার প্রেরণা দান করেন, এসময় শ্রীকৃষ্ণ নিজের দেহকে স্বেচ্ছায় ছুটি ভাগে ভাগ করেন। বাঁপাশ স্ত্রী ডানপাশ পুরুষ। তার বাম পাশ থেকে আবির্ভূত হলেন প্রকৃতিদেবী। শ্রীকৃষ্ণ সেই রমণীয় সুন্দর চম্পক ফুলের ন্যায় শোভাযুক্ত নারীর দিকে তাকালেন। এই নারীর স্তনদুটি বেলের মতো মনোরম। কলা গাছের মতো সুন্দর তার দুটি শ্রোণি। তিনি উজ্জ্বল ও সুললিত। সুশীলা, মিষ্টহাসিনী, চোখ দুটি অল্প বাঁকা। তিনি আগুনরঙের বস্ত্র পরিধান করেছেন। নানা আভরণে আভিরিত তাঁর তনুবাহার, তার কপালে কস্তুরী বিন্দু, নীচে চন্দন আর সিঁদুরের ফোঁটা। তার গলায় ঝুলছে মালতী ফুলের মালা। মহামূল্যবান কণ্ঠহার ঝুলছে কণ্ঠে। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে দেখে পুলকিত হয়েছেন। তার মনে কামবাসনা জেগেছে। ব্রহ্মার বয়স পরিমিত কাল পর্যন্ত প্রকৃতি সুন্দরীর সঙ্গে শৃঙ্গারে মেতে উঠলেন। নানাভাবে রতিসুখ উপভোগ করলেন। দেবীগর্ভে জগৎপিতা শ্রীকৃষ্ণের বীর্য ধারণ করলেন। তিনি গর্ভবতী হলেন। ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন দেবীর গা থেকে ঘাম ঝরতে লাগল, তিনি ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন।

প্রথমে সেই ঘাম গোল হয়ে ঝরে পড়ল, তা থেকে গোলাকার বিশ্বের সৃষ্টি হল। তার নিঃশ্বাস হল বায়ু, যা সমস্ত জগতকে জীবন দান করেছে, বায়ুর বাঁদিক থেকে এলেন তার প্রাণপ্রিয়া এবং পাঁচ পুত্র। প্রকৃতির ঘাম ঝরানো জল থেকে সৃষ্টি হল বরুণ দেবতার। তিনি হলেন জলের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। তার বাঁদিকে এসে দাঁড়ালেন বরুণপত্নী বা বরুণানী। তারপর সেই কৃষ্ণশক্তি কৃষ্ণের বীর্যতেজ গ্রহণ করে একশো মনুর সময়কাল পর্যন্ত গর্ভধারণ করলেন। তিনি কৃষ্ণ প্রাণেশ্বরী রাধিকা। কৃষ্ণের সঙ্গে সর্বক্ষণ বসবাস করেন। কৃষ্ণের রথে তার অবস্থান।

একশো মনু সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরে প্রকৃতিদেবী সর্বশ্রেষ্ঠ সোনালি রঙের বিশ্বের আধার স্বরূপ একটি ডিম প্রসব করলেন। ডিম দেখে তিনি অত্যন্ত হতাশ হলেন। রাগে দুঃখে সেটি জলে নিক্ষেপ করলেন। এ দৃশ্য দেখে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ মর্মাহত হলেন। তিনি রাধাকে অভিশাপ দিয়ে বললেন– হে কোপন স্বভাবা নারী, এই কৃতকর্মের জন্য তোমাকে ফল ভোগ করতে হবে। অপত্য সুখ থেকে তোমাকে বঞ্চিত করলাম। তোমার অংশ থেকে উদ্ভূত সুরস্ত্রীরা তোমার মতো সন্তানহীনা ও স্থির যৌবনা হয়ে দিন কাটাবে।

পীতবস্ত্র পরিহিতা এবং বই ও বীণা হস্ত যুক্ত এক নারীর সৃষ্টি হল ওই দেবীর জিভ থেকে। ইনি বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী। এমন সময় কৃষ্ণপত্নী দুভাগে বিভক্ত হলেন। বাঁদিকের অঙ্গ কমলা এবং ডানদিকের অঙ্গ রাধিকা। কৃষ্ণ তাঁর দেহ দুভাগে ভাগ করলেন। তার ডানদিকের অঙ্গ দুই হাত বিশিষ্ট এবং বাঁদিকের অঙ্গ চতুর্ভুজ। শ্রীকৃষ্ণ নারায়ণকে বললেন–তুমি সরস্বতী ও কমলার পাণিগ্রহণ করো। রাধাকে লাভ করার চেষ্টা করো না, তাহলে তোমার ভালো হবে না, লক্ষ্মী ও সরস্বতাঁকে সঙ্গে নিয়ে জগৎপতি নারায়ণ ফিরে এলেন তার বাসস্থানে। এই দুই দেবীও ছিলেন সন্তানহীনা, কারণ রাধার অংশ থেকে এরা সৃষ্ট হয়েছিলেন।

তারপর নারায়ণের অংশ থেকে চারহাত বিশিষ্ট বহু পার্ষদ আবির্ভূত হলেন। তেজ, বয়স, রূপ ও গুণে তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের সমান। লক্ষ্মীর অংশ থেকে কোটি কোটি দাসীর সৃষ্টি হল। এরা সবাই লক্ষ্মীর তুল্য।

হে মুনি, তার লোমকূপ থেকে অসংখ্য গোপের সৃষ্টি করলেন, যার তেজে ও বয়সে ভগবানের সমান। এইসব সহচরদের তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন, তারা ছিল তার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। মহাপ্রকৃতিও তার লোমকূপ থেকে অগুনতি গোপিনীর জন্ম দিলেন। তারা রূপে, চলনে, বলনে, রাধা তুল্য। তারাও নিত্য যৌবনা এবং সন্তানহীনা। এই সময় আবির্ভূত হলেন বিষ্ণুমায়া সনাতীন দূর্গা। তিনি কৃষ্ণের দেহ থেকে সৃষ্ট তিনি নারায়ণী, সর্বশক্তিরূপিণী। তিনি কৃষ্ণের বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি তেজস্বরূপিনী, তিনি লাবণ্যময়ী, তিনি প্রসন্না এবং শান্ত। তিনি সহস্র হস্তে নানা ধরনের অস্ত্র ধারণ করে আছেন। তিনি ত্রিনয়নী, পরিশুদ্ধপট্ট আগুন বর্ণের বসন পরিধান করেছেন। নানা ধরনের অলংকারে বিভূষিতা। তিনি শাস্ত্রস্বরূপিনী, তিনি কৃষ্ণভক্ত। বৈষ্ণবদের কৃষ্ণ ভক্তি বিতরণ করেন। সুখীকে তিনি সুখ এবং মুমুক্ষকে মোক্ষ দান করেন। তিনি স্বর্গে স্বর্গলক্ষ্মী এবং গৃহস্থের ঘরে গৃহলক্ষ্মী হিসেবে পূজিতা। রাজ গৃহে রাজলক্ষ্মী স্বরূপ তিনি, আগুনের বাহিকা শক্তি, সূর্যের প্রভাবে শক্তি, চাঁদ এবং পদ্মের মনোহর শোভাবৃদ্ধিকারী শক্তিস্বরূপ, প্রকৃতির সাহায্যে তিনি জগৎকে কৃপা করেন। তাঁকে ছাড়া জগৎ হয় প্রাণহীনের মতো। সংসার রূপ.বিশাল গাছের বীজস্বরূপ। সেই দূর্গা বিভিন্ন রূপে বিরাজ করেন –দয়া, শ্রদ্ধা, তন্দ্রা, পিপাসা, ক্ষুধা, ক্ষমা, ধৃতি, শান্তি, লজ্জা তুষ্টি, পুষ্টি, ভ্রান্তি, ক্লান্তি — এ সবই তার অংশে সৃষ্ট নারীজাতি। তার অংশের অংশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে সর্বেশ্বর কৃষ্ণের প্রশস্তি বর্ণনা করে তার আদেশে দূর্গাদেবী রত্নসিংহাসনে উপবেশন করলেন।

হে মুনিশ্রেষ্ঠ! ইতিমধ্যে কৃষ্ণের নাভিপদ্ম থেকে বেরিয়ে এলেন চতুর্মুখ ব্রহ্মা। পরম সুন্দর সেই পুরুষ জ্ঞানীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তাঁর হাতে কমন্ডলু। নিজের জ্যোতি তেজে নিজেই তিনি উদ্ভাসিত। তিনি শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা করতে লাগলেন। তার পাশ থেকে উঠে এলেন সুন্দরী শ্রেষ্ঠা, আগুনের মতো শুদ্ধবস্ত্র বসন পরিহিত নানা আভরণে সজ্জিতা এক নারী। তিনি ব্রহ্মপত্নী ব্রাহ্মণী। তিনিও জগৎ গুরুর বন্দনা করলেন। তারপর তারা দুজন সুন্দর উত্তম একটি সিংহাসনে বসলেন।

শ্রীকৃষ্ণ আবার দুটি ভাগে ভাগ হলেন। বামদিক থেকে উঠে এলেন মহাদেব তিনি ত্রিশূল ও পটিশধারী, বাঘের ছাল পরেছেন। মাথায় জটা ভার, কাঁচা সোনার রঙের ওপর ঈষৎ লালচে আভাযুক্তা। তিনি সর্বাঙ্গে ভস্ম লেপন করেছেন। তার মস্তকে চাঁদ শোভা পাচ্ছে। শুদ্ধ স্ফটিকের মতো শুভ্র তার গাত্রবর্ণ। তার দেহের উজ্জ্বলতার কাছে শত কোটি সূর্যও হার মানে। তিনি নীলকন্ঠ, তিনি দিগম্বর। সর্প তার দেহাভরণ, ডান হাতে সুসংস্কৃত রত্নের মালা ঘুরিয়ে পাঁচ মুখে ব্রহ্মজ্যোতির্ময় সত্যস্বরূপ পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের জপ করছেন। তিনি কারণগুলির কারণ। তিনি ভক্তের মঙ্গল করেন। জরা, ব্যাধি, শোক, তাপ তিনি দূর করেন।

মহাদেবের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে মৃত্যুঞ্জয় নামে অভিহিত করলেন, এবং উত্তম সিংহাসনে বসতে বললেন।

এইসময় শ্রীকৃষ্ণের ডান অঙ্গ থেকে যাদের আবির্ভাব ঘটেছিল তারা গোপিনীদের পতিতে পরিণত হল।

.

তৃতীয় অধ্যায়

নারায়ণ বললেন-–হে নারদ! ব্রহ্মার আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার পর জলে নিক্ষিপ্ত ডিমটি ফেটে গেল, সেখান থেকে বেরিয়ে এল এক সুন্দর শিশু, যার প্রভা শতকোটি সূর্যের মতো, সেই শিশু খিদের তাড়নায় কঁদছিল নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের যিনি রক্ষাকারী, তিনি তখন অসহায়ের মতো অন্য দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। তিনি স্কুল থেকেও স্থূলতর। পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের ষোলোভাগের এক ভাগে জাত। এই মহাবিষ্ণুকে প্রকৃতি থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। অসংখ্য বিশ্বকে তিনি ধরে আছেন। মহাবিষ্ণুর এক একটি লোমকূপ থেকে এক একটি বিশ্ব তৈরি হয়েছে এর সংখ্যা যে কত, তা সৃষ্টিকারী স্বয়ং কৃষ্ণও হিসাব রাখেন না। প্রতিটি বিশ্বেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি দেবতাদের অবস্থান। তাদের সংখ্যাও বলা মুশকিল।

পাতাল থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গা জুড়ে ব্রহ্মাণ্ড অবস্থিত। ব্রহ্মাণ্ডের ওপরে বহুঁকোটি যোজন দূরে বৈকুণ্ঠধাম। তার ওপরে পঞ্চাশ কোটি যোজন উঁচুতে গোলকধাম অবস্থিত। শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় এই গোলকধাম সত্য ও নিত্য।

অনেক সাগর, মহাসাগর, দ্বীপ, উপদ্বীপ, পাহাড় পর্বত, গাছপালা, অরণ্য নিয়ে পৃথিবী গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর নীচে সাতটি পাতাল। ওপরে সাতটি স্বর্গলোক ও ব্রহ্মলোক। এ সবই ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্গত।

এই পৃথিবীর যা কিছু সবই নিত্য, কারণ এসবের বিনাশ হয় জলের বুদবুদের ন্যায়, কাজ ফুরিয়ে গেলে মৃত্যু হবে। এটাই নিয়ম। হে নারদ! প্রত্যেকটি ব্রহ্মাণ্ডে শিব, ব্রহ্মা ও বিষ্ণু এবং তিনকোটি দেবতা, দিগশ্রী, দিগপাল, নক্ষত্র ও গ্ৰহসকল সর্বদা বিরাজমান। পৃথিবীতে চারটি বর্ণ, নীচে সাপের দল এবং চরাচর বর্তমান। ওই বিরাট পুরুষ বারংবার ওপরের দিকে তাকালেন, শূন্য ডিম দেখে চিন্তিত হলেন। খিদের জ্বালায় কেঁদে উঠলেন। সেখানেই তার জ্ঞান লাভ হয়। তিনি শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করেন, তাঁর মুদ্রিত চোখের সামনে ভেসে উঠল শ্রীকৃষ্ণের সেই মনোমুগ্ধকর মুখোনি। তিনি অল্প হাসছেন, ব্রহ্মজ্যোতিতে তার চারপাশ উদ্ভাসিত। পীতবর্ণের বস্ত্র পরিধান করেছেন। দুই হাতে বাঁশি বালকরূপী বিরাট পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের দর্শন পেয়ে আনন্দিত হলেন। পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বরদান করে বললেন–হে বৎস ক্ষুধা, তৃষ্ণা নিবৃত্তি করে তুমি আমার মতো জ্ঞানী হয়ে ওঠো। তুমি হবে কামনা শূন্য। অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ডের আধার হয়ে অবস্থান করে, মহাপ্রলয়কাল না আসা পর্যন্ত নির্ভয়ে থাকো।

শ্রীকৃষ্ণ তার জরা, মৃত্যু, রোগ, শোক ও পীড়া নাশ করলেন। তারপর প্রকৃতির গর্ভ থেকে, সৃষ্ট নিজের পুত্র মহাবিরাটের কানে মন্ত্র শোনালেন। বেদ ও তন্ত্রের ছয় অক্ষর বিশিষ্ট, সেই মন্ত্রের প্রথমে প্রণব, পরে কৃষ্ণ, তারপর স্বাহা, সর্ববিঘ্ননাশকারী সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র দিলেন, তারপর তার খিদে মেটাবার ব্যবস্থা করলেন।

বিষ্ণুর উদ্দেশে যে নৈবেদ্য দান করা হয়, তার ষোলো ভাগের এক ভাগ বিষ্ণু গ্রহণ করেন। পুজো শেষে দেবতাকে নিবেদন করা নৈবেদ্য, কিন্তু লক্ষ্মীদেবীর শুভ দৃষ্টিতে সেই দেবতার খাওয়া নৈবেদ্য একই রকম থাকে।

শ্রীকৃষ্ণ এবার জানতে চাইলেন –বৎস! তোমার আর কিছু জানার আছে?

মহাবিরাট বললেন– কতোদিন আমি বাঁচব, আমি জানি না। তবে আপনার কাছে আমার একটি প্রার্থনা, আমার আয়ুষ্কাল পর্যন্ত আপনার পাদপদ্মে যেন আমার মতি স্থির থাকে। এ জগতে যে আপনার পুজো করে না, সে হয় মৃত্যুর সামিল, আবার আপনার ভক্ত আপনার কৃপায় জীবন্মুক্ত হয়, যে জীবন কৃষ্ণ ভক্তিহীন, তার বেঁচে থাকা নিষ্প্রয়োজন। কৃষ্ণের ধ্যান যে করে তাকে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াতে হয় না, পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য যজ্ঞ হোম, তপস্যা জপ, ব্রত, উপবাস ইত্যাদি সবই নিষ্ফল হয়। শরীরে যতদিন আত্মা বর্তমান, ততদিন শক্তিও বর্তমান থাকে। আত্মা চলে গেলে, শক্তিও ছায়ার মতো তার পিছু পিছু গমন করে।

সেই বিরাট পুরুষ পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা করলেন হে মহাভাগ, আপনি স্বেচ্ছাধীন, আপনি সনাতন সবার আবির্ভূত ব্রহ্মজ্যোতি স্বরূপ।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পুত্রকে আশীর্বাদ করে বললেন– তুমি আমার মতো চিরকাল সুস্থির হয়ে অবস্থান করো। অসংখ্য ব্রহ্মার নাশ হলেও তুমি থাকবে অবিনাশী।

একথা বলে শ্রীকৃষ্ণ নিজের বাসভবন গোলোকধামে চলে গেলেন। তিনি ব্রহ্মা ও শিবকে ডেকে পাঠালেন। ব্রহ্মার ওপর সৃষ্টি এবং শিবের ওপর সংহারের দায়িত্ব ন্যস্ত করলেন। ব্রহ্মা ও শিব ভগবানকে প্রণাম করে তার আদেশ পালনে বেরিয়ে পড়লেন।

মহাবিরাটের লোমকূপে যা কিনা ব্ৰহ্মণ্ডের মতো গোলাকার জলরাশি, তার মধ্যে ব্রহ্মা প্রবেশ করলেন। সেই মহাবিরাট তখন ক্রমশ ক্ষুদ্র হতে থাকলেন, তাঁর যুবক চেহারা, শ্যামবর্ণ, পীতবস্ত্র পরিহিত, স্মিতহাসি, প্রসন্ন, ইনি বিশ্বরূপী জনার্দন। জলের ওপর শয্যা গ্রহণ করলেন, তার নাভিপদ্ম থেকে আবির্ভূত হলেন ব্রহ্মা। সেই পদ্মের মৃণালে লক্ষ যুগ ধরে ঘুরে বেড়ালেন, কিন্তু মৃণাল দন্তের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ব্রহ্মা পৌঁছাতে পারলেন না। ব্রহ্মা স্বস্থানে ফিরে এলেন। শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের ধ্যানে মগ্ন হলেন। মুদ্রিত দিব্য চোখে তিনি সেই পরাৎপরের ক্ষুদ্র রূপ প্রত্যক্ষ করলেন। ব্রহ্মা সেই শ্রীকৃষ্ণর স্তব করতে লাগলেন, যিনি তার প্রতিটি লোমকূপ থেকে এক একটি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন যিনি সারা গোলোক জুড়ে বিরাজমান। যিনি জলশয্যা গ্রহণ করেছেন, যিনি গোপ গোপিনীদের সাথে হাস্য রসিকতায় মেতে উঠেছেন। বন্দনা শেষে সৃষ্টি করার অনুমতি প্রার্থনা করলেন।

ব্রহ্মা সৃষ্টির কাজ শুরু করলেন, তার মন থেকে সণক প্রভৃতি পুত্রদের আবির্ভাব ঘটল। তার কপাল থেকে মহেশ্বরের অংশে সৃষ্টি হল এগারো জন রুদ্রের। সেই ক্ষুদ্র আকারের বিরাট পুরুষের বাম অঙ্গ থেকে শ্বেতদ্বীপের নিবাসী বিষ্ণুর আবির্ভাব হল। তার চার হাত। সেই ক্ষুদ্র মহাবিরাটের নাভিযোনিতে অবস্থান করে ব্রহ্মা একের পর এক সৃষ্টি করে চললেন। তিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ড, স্বর্গ, মর্ত, পাতাল — সমস্ত সৃষ্টি করলেন।

.

চতুর্থ অধ্যায়

সুতপুত্র বললেন–হে শৌনক, অমৃতের মতো, এইসব অপূর্ব বৃত্তান্ত শুনে মুনিশ্রেষ্ঠ নারদ অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তিনি এবার প্রভু নারায়ণের কাছে প্রকৃতিদের পুজো পদ্ধতির বিধি-নিয়ম জানতে আগ্রহী হলেন। তার প্রশ্ন শুনে নারায়ণ যা বলেছিলেন, সেকথাই আপনাকে ব্যক্ত করছি।

নারায়ণ বললেন– প্রকৃতির পাঁচ রূপের কথা তোমাকে পূর্বেই বলেছি। এই কাহিনী যে শ্রবণ করে, সে অমৃত লাভ করে। এঁদের প্রভাব যেমন আশ্চর্যজনক, তেমনই মঙ্গলময় এঁদের চরিত্র। পৃথিবী, গঙ্গা, তুলসী, মনসা, নিদ্রা, ষষ্ঠী, সকলে মঙ্গলচণ্ডী, সরস্বতী, স্বাহা, স্বধা ও দক্ষিণা–এঁরা রূপে, গুণে ও তেজে আমার সমতুল্য, এদের চরিত্র প্রথমে বর্ণনা করছি।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন–সরস্বতীর দয়ায় মূর্খও পন্ডিত হয়। শ্রীকৃষ্ণের পত্নী প্রকৃতি দেবীর মুখ থেকে সরস্বতীর আবির্ভাব ঘটে। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে দেখে তার প্রতি কামাসক্ত হয়ে পড়েন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মনের ভাব বুঝতে পেরে বলেছিলেন– হে নারী! তুমি নারায়ণের স্তব করো, যিনি আমার মতো চার হাত বিশিষ্ট সমস্ত গুণের আধার, নারায়ণ তোমার কামনা বাসনা পূর্ণ করবেন। কোটি কামদেবের মতো তিনি লাবণ্য মন্ডিত। আর তুমি যদি আমাকে পাওয়ার আশা করো, তাহলে ফল ভালো হবে না। কারণ আমার প্রাণাধিক প্রিয়া রাধা তোমার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। আমি ঈশ্বর, আমি সমস্ত শাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। কিন্তু রাধাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। সে রূপে, গুণে, তেজে আমার সমান। রাধা আমার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সেই প্রাণকে ত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কেন, কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই বলছি, নারায়ণকে তুমি পতিরূপে গ্রহণ করো। বহু কাল ধরে শৃঙ্গারে মেতে থাকো। সুখ লাভ করো।

এরপর শ্রীকৃষ্ণ সরস্বতী বন্দনার নিয়মবিধির কথা বললেন– হে কান্তা, মাঘ মাসের শুক্লপঞ্চমীর তিথিতে বিদ্যার শুরুতে সমস্ত বিশ্বের মানুষ, মনু, দেবতা মুনীন্দ্র, মৃত্যুপথযাত্রী, যোগী, সিদ্ধ, গন্ধর্ব, সাপ এবং কিন্নরা তোমাকে ভক্তিভরে ষোলোটি উপাচারে পুজো করবে। প্রলয় কাল

আসা পর্যন্ত তুমি এই ভাবে বিরাজ করবে। সোনার মাদুলি তৈরি করে, গন্ধ ও চন্দন লেপন করে সেই কবচ গলায় বা ডান হাতে বাঁধবে।

শ্রীকৃষ্ণ নিজে দেবী সরস্বতীর পুজো করলেন। শুরু হল সরস্বতী বন্দনা। বিষ্ণু শিব, ব্রহ্মা — সমস্ত দেবতারা সরস্বতী আরাধনা করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে সমস্ত লোকে বাগদেবী সরস্বতীর পুজোর প্রচলন হল।

শ্রীনারায়ণ বললেন–এবার সরস্বতীর কাম্বশাখা মত পুজোর বিধি বলছি, শ্রবণ করো, মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে এবং বিদ্যারম্ভ করার দিনে সরস্বতী পুজো করার নিয়ম। পুজোর আগের দিন সংযম পালন করতে হয়। ভক্তিভরে ঘট বসিয়ে বস্ত্র দিয়ে গণেশ, সূর্য, অগ্নি, বিষ্ণু, শিব, শিবা– এই ছয় দেবতার পুজো দিতে হয়। তারপর অভীষ্ট দেবতার পুজো করার কথা বলা হয়েছে। বেদ বলেছে– দুধ, দই, খই মাখন, তিলের ছাতু, আখ, আখের রস এবং তা থেকে প্রস্তুত সাদা গুড়, মধু, স্বস্তিক, চিনি, সাদা ধানের আতপচাল, আধীবন, আতপ চালের চিড়ে, সাদা মিষ্টি, ঘি এরু, সৈন্ধব লবণ দিয়ে রান্না করা নানারকম সবজির হবিষ্যান্ন, যব ও গমের গুড়োয় তৈরি পিঠে, স্বস্তিকের পিঠে পাকা কুলের পিঠে, ঘি দিয়ে তৈরি করা পোলাও, ভালো ঘিয়ে তৈরি করা মিষ্টি, নারকেল, নারকেলের জল, বকুল ফল মূলক, আদা, পাকা কলা, ভালো বেল, কুল, নানা ধরনের মিষ্টি ও পাকা ফল, সুবাসিত সাদা ফুল, সাদা চন্দন, নতুন সাদা কাপড়, উত্তম শাখ, সাদা ফুলের মালা, সাদা হার ও সাদা অলংকার –এইসব উপকরণ দিয়ে সরস্বতী বন্দনা করা উচিত।

সরস্বতী আগুনের মতো শুদ্ধবস্ত্র পরিধান করেন। তিনি শান্ত প্রকৃতির, তার অধরে মৃদু হাসি। কোটি চন্দ্রের প্রভা তার কাছে পরাভূত হয়, তিনি সামান্য হৃষ্টপুষ্ট গঠনের। তিনি সৌন্দর্যবতী, মহামূল্যবান রত্ন অলংকারে তিনি বিভূষিতা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরাদি দেবতারা তার পুজো করেন। বিচক্ষণ লোকেরা তার ধ্যান করে, মূলমন্ত্র সহযোগে তার নৈবেদ্য নিবেদন করে, স্তব ও কবচ পাঠ করে, তারপর সাষ্টাঙ্গে দেবীকে প্রণাম করে। সরস্বতী যার আরাধ্য দেবী, তার প্রত্যহ এই দেবীর পুজো করা কর্তব্য। সরস্বত্যৈ স্বাহা– এই আট অক্ষর বিশিষ্ট মন্ত্র কল্পবৃক্ষের মতো।

হে নারদ, পূর্বে কৃপা সাগর নারায়ণ পুণ্যভূমি ভারতের বুকে গঙ্গার তীরে বাল্মীকিকে এই মন্ত্র দান করেন। অমাবস্যা তিথিতে পুষ্কর তীর্থে ভৃগুর কাছ থেকে শুক্ল এই মন্ত্র লাভ করেন। পূর্ণিমা তিথিতে মারীচ এই মন্ত্র বৃহস্পতিকে প্রদান করেন। ভৃগুর ওপর সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা বদরিকাশ্রমে এই মন্ত্র দিয়েছিলেন। আস্তিক মুনি ক্ষীর সাগরের তীরে জরৎকারু মুনির কাছ থেকে এই মন্ত্র লাভ করেন। বিভাণ্ডক মুনি ঋষ্য শৃঙ্গকে পর্বত শিখরে এই মন্ত্র উপদেশ দিয়েছিলেন। কর্ণাদ মুনি ও গৌতমমুনি এই মন্ত্র শিবের কাছ থেকে লাভ করেন। যাজ্ঞবল্ক্য ও কাত্যায়ন মুনি সূর্যের কাছ থেকে এই মন্ত্র শুনেছিলেন। পাণিণি, ভরদ্বাজ এবং পাতালে বলির সভায় শাকটায়ন এই মন্ত্র অনন্তদেবের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। যে মানুষ চারলক্ষবার এই মন্ত্র জপ করে, সে সকল কাজে সিদ্ধ হয়। সে হয় বৃহস্পতি তুল্য।

এখন সেই কবচের কথা বলি, যা গন্ধমাদন পর্বতে স্বয়ং ব্রহ্মা তার পুত্র ভৃগুকে দান করেছিলেন।

ভৃগু সেই বিচক্ষণ, সর্বজ্ঞ, সর্বস্রষ্টা ব্রহ্মার কাছে সরস্বতীর বিশ্ববিজয়ী মন্ত্ৰকবচের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন –হে পুত্র, বেদে যার পুজো করা হয়েছে, যে কবচ সমস্ত কামনা বাসনা। পূরণকারী, সেই কবচের কথা গোলোকে, বৃন্দাবনের বনের মধ্যে রাসমন্ডলে রাসেশ্বর প্রভু শ্রীকৃষ্ণ প্রথম বলেছিলেন। এই কবচের মন্ত্র বড়ো অদ্ভুত এবং গোপনীর। যে কবচ ধারণ করে শুক্র দৈত্যদের দ্বারা পুজো পেয়ে থাকেন। এই কবচের মহিমায় ও প্রভাবে বাল্লীকি হয়ে উঠেছিলেন বাগ্মী ও শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে সেরা। স্বায়ম্ভুব মনুও এই কবচ ধারণ করে পুজো পেয়ে থাকেন। এই কবচের ক্ষমতায় শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদ বিভাগ ও পুরাণ গুলি অতি সহজেই রচনা করেছেন। ঋষ্যশৃঙ্গ, যাজ্ঞবল্ক্য, পরাশর, বশিষ্ঠ প্রভৃতি ঋষিরাও এই কবচ অঙ্গে ধারণ করে সকলের পূজ্য হয়েছেন।

হে মহান ব্রাহ্মণ এই কবচের ঋষি স্বয়ং প্রজাপতি, কৃষ্ণ নিজে তার দেবতা এবং ছন্দ বৃহতী। সমস্ত তত্ত্বপরিজ্ঞান বিষয়ে, সমস্ত অভিলক্ষিত বিষয় সাধনে এবং সমস্ত কবিতাতে এই কবচের বিনিয়োগ ঘটেছে। হ্রীং সরস্বত্যৈ স্বাহা ‘ওঁ’ আমার মাথার চারিদিক রক্ষা করুন, ‘শ্রীং বাগু দেবতায়ৈ স্বাহা’ এই মন্ত্রে আমার কপাল এই মন্ত্র রক্ষা করুন।

ঐং হ্রীং বাগবাদিন্যৈ স্বাহা –আমার নাক সবদিক দিয়ে রক্ষা করুন।

ওঁ সরস্বতৈ স্বাহা –আমার কানদুটিকে রক্ষা করুন।

ওঁ শ্রীং হ্রং ভারত্যৈ স্বাহা –আমার চোখ দুটিকে রক্ষা করুন।

শ্রীং বিদ্যাধিষ্ঠাত্রীদেবাৈ স্বহা –আমার ঠোঁট দুটিকে রক্ষা করুন।

ওঁ শ্রীং শ্রীং ব্রাহ্মৈ স্বাহা –আমার দাঁত গুলির রক্ষা করুন।

ওঁ হ্রীং হ্রীং –আমার ঘাড়, শ্রীং, কঁধ, হ্রীং, শ্রীং বিদ্যাধিষ্ঠতৃদেব্যে স্বাহা– বুক ওঁ হ্রীং হ্রীং বাণ্যৈ স্বাহা –আমার পিঠের দিক রক্ষা করুন।

ওং সার্বার্ণত্মিকায়ে স্বাহা– পা দুটিকে রক্ষা করুন।

ওঁ ওঁ সর্বকণ্ঠবাসিন্যৈ স্বাহা পূর্ব দিকে,

ওঁ হ্রীং জিহ্বাগ্রবসান্যৈ স্বাহা-অগ্নিকোণে

ওঁ ঐং হ্রীং শ্রীং সরস্বত্যৈ বুধজনন্যৈ স্বাহা দক্ষিণ কোণে

ওঁ ঐং হ্রীং নৈঋর্তকোণে, ওং কবিজিহ্বাগ্রেবাসিন্যৈ স্বাহা–পশ্চিমদিকে,

ওঁ সদাম্বিকয়ৈ স্বাহা –বায়ু কোণে

ওং গদ্যপদ্যবাসিন্যৈ স্বাহা –উত্তরদিকে

ওং সর্বশাস্ত্রবাসিন্যৈ স্বাহা –ঈশাণ কোণে

ওং সবপূজিততায়ৈ স্বাহা — ওপরের দিকে

ওং ঐং হ্রীং পুস্তকবাসিন্যৈ স্বাহানীচের দিকে

ওং গ্রন্থবীজরূপায়ে স্বাহা– আমাকে সব দিকে থেকে রক্ষা করুন,

হে ব্রাহ্মণ! বিশ্বজয় নামক নিখিলা মন্ত্রাত্মক কবচ তোমাকে দান করলাম। গন্ধমাদন পর্বতে ধর্মের কাছ থেকে ব্রহ্মস্বরূপ এই কবচের মাহাত্ম কথা আমি শুনেছিলাম। পাঁচ লক্ষবার জপ করলে এই কবচ সিদ্ধ হয়। এবং কবচ সিদ্ধকারী বৃহস্পতির সমান হয়। সে হয় মহাবাগ্মী, কবীন্দ্র এবং ত্রৈলোক্য বিজয়ী, প্রথমে গুরুকে বিধিমতো চন্দন, বস্ত্র, অলংকার দিয়ে পুজো করে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করবে, তারপর কবচ ধারণ করবে। এই হল সরস্বতী কবচ, স্তোত্র পুজোর বিধি, ধ্যান ও বন্দনা কথা–তোমাকে কাম্বশাখায় যা আমি দান করলাম।

.

পঞ্চম অধ্যায়

নারায়ণ বললেন–হে নারদ! পুরাকালে গুরুর অভিশাপে যাজ্ঞবল্ক্য বিদ্যাহীন হয়েছিলেন। তিনি ভারাক্রান্ত মনে পূণ্যদায়ক সূর্যের দ্বারস্থ হলেন। বিশেষ ভাবে তপস্যা করে কোণারকে সূর্যের দেখা পেলেন ও তিনি তার স্তব করলেন এবং কাঁদতে কাঁদতে তার মনদুঃখের কথা জানালেন। বেদ ও বেদাঙ্গ সমূহ জ্ঞান দান করে সূর্যদেব তাকে বাগদেবীর স্তব করতে বললেন। মুনি স্নান সেরে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে ভক্তি ভরে অবনত মস্তকে বাগদেবীর স্তব পাঠে মগ্ন হলেন। মুনি যাজ্ঞবল্ক্য দেবীর বন্দনা করলেন–হে মা, বাগেশ্বরী! শ্রী গুরুর অভিশাপে আমি স্মৃতিশক্তি হারিয়েছি, আমি এখন দুঃখ সাগরে নিমজ্জিত। আপনি আমাকে রক্ষা করুন। হে, বিদ্যা দেবী আমাকে জ্ঞান দিন, স্মৃতি শক্তি দিন, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, কবিতা দান করুন। আমি যেন গুরু হওয়ার সামর্থ্য লাভ করতে পারি। সৎশিষ্য লাভ করার, গ্রন্থ কবিতা রচনা করার ক্ষমতা আপনি আমাকে দান করুন। সব জ্ঞান আমার দুর্ভাগ্যবশত বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। আপনি কৃপা করে আমার হারানো স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে দিন। আপনি পরম ব্রহ্মা স্বরূপা, আপনি জ্যোতির্ময়ী, সনাতনী, সমস্ত বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী, আপনাকে প্রণাম নিবেদন করি। বাক্যে আপনার বসবাস, আপনাকে ছাড়া জগৎ বোবা ও মৃতপ্রায় হয়ে ওঠে। সেই বাণীকে আমি বন্দনা করি। অক্ষর স্বরূপা, শ্বেতবর্ণা ভারতাঁকে আমি প্রণাম জানাই। সেই কাল ও সংখ্যাস্বরূপা দেবীকে আমি প্রণাম জানাই। স্মৃতিশক্তি, জ্ঞানশক্তি বৃদ্ধি শক্তি, প্রতিভা শক্তি ও কল্পনাশক্তি যা কিছু আপনার আছে, ধ্যানের কল্যাণে তা আমার হোক।

একবার পুত্র সনৎকুমার পিতা ব্রহ্মার কাছে জ্ঞানের বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা এবিষয়ে সম্পূর্ণ জবাব দিতে পারবেন না ভেবে স্থবির হয়ে বসে রইলেন। তখন সেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটল। তিনি ব্রহ্মাকে বাগদেবীর বন্দনা করার আদেশ দিলেন। ব্রহ্মা আপনার স্তব করেছিলেন। এবং আপনার কৃপায় সেই মহান সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। এই ভাবে আপনি অনন্তদেব, মহামুনি বাল্মীকিকে অনুগ্রহ করেছিলেন। ব্যাসদেব আপনার কাছ থেকে কবীন্দ্র উপাধি লাভ করে চারখন্ড বেদ ও সমস্ত পুরাণ রচনা করেছিলেন। মহেন্দ্র পর্বতে দেবী দুর্গা তত্ত্বজ্ঞান বিষয়ক কিছু প্রশ্ন করলে শিব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আপনার কথা চিন্তা করেন এবং আপনার অনুগ্রহ লাভ করে মহাদেব দেবী দুর্গাকে তত্ত্বজ্ঞান দান করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

একদিন ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে শব্দশাস্ত্র বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আপনি বৃহস্পতিকে বর দান করেন, যার প্রভাবে বৃহস্পতি দিব্য হাজার বছর ধরে শব্দশাস্ত্রের জ্ঞান ইন্দ্রকে দান করেছিলেন। সেই শব্দশাস্ত্র থেকে আহরিত জ্ঞান তিনি মহেন্দ্রকে দিয়েছিলেন। অন্যান্য ঋষিরা এই শব্দশাস্ত্র অধ্যয়ন করে জ্ঞান লাভ করেন এবং শিষ্যদের তা দান করেন।

সমস্ত মস্তক বিশিষ্ট অনন্তদেব, পঞ্চানন শিব এবং চতুর্মুখ ব্রহ্মা যাঁর স্তব করতে গিয়ে সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেন, কেবলমাত্র হাত জোড় করে পুজো করেন, সেখানে আমার মতো একমুখ বিশিষ্ট সাধারণ লোকের কী ক্ষমতা আপনাকে স্তব করে তুষ্ট করি।

মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য মাথা নুইয়ে প্রণাম করলেন এবং অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। অচিরেই তিনি জ্যোতির্ময়ী দেবীর দর্শন পেলেন। তিনি যাজ্ঞবল্ক্যকে উত্তম কবি হওয়ার বর দান করলেন।

যে লোক যাজ্ঞবল্ক্যর করা স্তব পাঠ করে নিত্য সরস্বতীর বন্দনা করে সে কবিকুলের শ্রেষ্ঠ হয়, মহাবাগ্মী এবং জ্ঞানী হয় বৃহস্পতির তুল্য। মুখ ও অক্ষরাজ্ঞানহীন লোকও যদি এক বছর নিয়ম করে এই স্তোত্র, পাঠ করে, তাহলে সে নিশ্চয়ই ভাবে পন্ডিত, মেধাবী ও শ্রেষ্ঠ কবিতে রূপ পরিণত হয়।

.

ষষ্ঠ অধ্যায়

নারায়ণ বললেন–হে মুনি; একবার বৈকুণ্ঠধামে গঙ্গাদেবীর সঙ্গে সরস্বতীর ঝগড়া হয়। গঙ্গাদেবী। তাঁকে অভিশাপ দেন। সরস্বতী নদী হয়ে কলিযুগে ভারবর্ষের বুকে অবতীর্ণ হবেন। সরস্বতী স্বয়ং পুণ্যতীর্থ স্বরূপা। তিনি পুণ্য দান করেন। পুণ্যবান ব্যক্তিরা এই নদীর তীরে বসবাস করেন। এই নদী জ্বলন্ত আগুনের মতো পাপীদের পাপ পুড়িয়ে দেয়, সজ্ঞানে যে লোকের সরস্বতীর জলে মৃত্যু হয় সে বৈকুণ্ঠধামের যাত্রী হয়। পাপীরা এই নদীর জলে স্নান করে পাপ নাশ করতে পারে। যে কোনো পুণ্য দিনে এবং, চতুর্দশী, অক্ষয়াতিথি, পূর্ণিমা, ব্যাতীপাতযোগ গ্রহণে এই জলে স্নান করে, তাহলে সে বৈকুণ্ঠধামে গমন করে বংশীধারির চরণে ঠাঁই পায়। যে কোনো মহামূর্খ যদি একমাস সরস্বতীর মন্ত্র নিয়মমতো উচ্চারণ করে, তাহলে সে মহাকবি হতে পারে। স্নান করে মাথা ন্যাড়া হলে তাকে আর পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয় না।

সুতপুত্র বললেন–হে শৌণক, নারদ আবার শুনতে চাইলেন, কেন গঙ্গাদেবী সরস্বতাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন? এই ভারতে নিজের অংশে সরস্বতী কীভাবে পুণ্যদাতা হয়েছিলেন?

নারায়ণ বললেন–এই বৃত্তান্ত যে শোনে, সে পাপ মুক্ত হয়। শ্রীহরির তিন স্ত্রী গঙ্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতী, এরা স্বামীকে প্রেম নিবেদনের ব্যাপারে কেউ কারো অপেক্ষা কম ছিলেন না। তারা সর্বক্ষণ শ্রীহরিকে ঘিরে থাকতেন স্বামীর সান্নিধ্যলাভের আশায়।

একদিন গঙ্গা শ্রীহরির দিকে তাকিয়ে কটাক্ষপাত করলেন, উত্তরে শ্রীহরিও তার এই স্ত্রীর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন এবং মুচকি হাসতে লাগলেন। এই দৃশ্য দেখেও লক্ষ্মী দেবী কোনো প্রতিবাদ করলেন না। কিন্তু সরস্বতী তখন প্রচন্ড রেগে গেছেন। শ্রীহরি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বিফল হলেন। সরস্বতী ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ লাল করে রাগ প্রকাশ করে বললেন–অধার্মিক স্বামী তার সকল স্ত্রীর প্রতি সমান অনুরাগ দেখান না, কিন্তু সুবিবেচক, সৎ ও ধার্মিক স্বামী বিপরীত করে থাকেন। হে গদাধর! আমি বুঝতে পারলাম গঙ্গার প্রতি আপনি বেশি অনুরক্ত। লক্ষ্মীকেও ভালোবাসেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে আপনার ভালোবাসার ভাণ্ডার শূণ্য। যে স্ত্রী স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয় তার জীবনের কী দাম? বোকা, মূর্খ, মুনিরাই আপনাকে সত্ত্বময় বলে থাকেন। আপনার মতিগতি জানা নেই, তাই বেদ আপনার প্রশস্তি কীর্তন করেছে।

কুপিত সরস্বতীর কথা শুনে নারায়ণ চিন্তিত হলেন, তিনি সেই স্থান ত্যাগ করলেন।

গঙ্গাকে একা পেয়ে ক্রুদ্ধ সরস্বতী কটু বাক্যবাণ ছুঁড়ে দিলেন– নির্লজ্জ, বেহায়া তুই আমাকে কি বোঝাতে চাইছিস, স্বামী তোকে কত ভালোবাসে। তোর গুমোর আমি শ্রীহরির সামনেই ভাঙব। দেখি, তিনি আমার কী করেন। এই কথা বলে তিনি গঙ্গার চুল ধরার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

এই সময় লক্ষ্মীদেবী তাঁদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। সরস্বতাঁকে ঝগড়া করতে বারণ করলেন। এবার সরস্বতীর রাগ গিয়ে পড়ল লক্ষ্মীর ওপর। অভিশাপ দিয়ে বললেন–তুমি এই বিপরীত ভাব দেখেও চুপ করে আছ গাছ আর নদীর মতো। তুমি গাছ ও নদীর মতো অবস্থান করবে।

লক্ষ্মীদেবী একথা শুনে রাগ প্রকাশ করলেন না বা সরস্বতাঁকে অভিশাপ দিলেন না।

সরস্বতীর উগ্রভাব দেখে গঙ্গা বললেন–হে লক্ষ্মী, তোমাকে ওই কুমুখী সরস্বতী অভিশাপ দিয়েছে, আমিও ওকে শাপ দিচ্ছি, ও নদীর মতো অবস্থান করবে। সতী লক্ষ্মী, তুমি দেখো কার ক্ষমতা ও শক্তি বেশি। কলিকালে পাপীদের মাঝখানেও থাকবে।

রুক্ষ সরস্বতী বললেন–শুধু আমি কেন? তুমিও মর্তে যাও, পাপীদের সঙ্গে বাস করো।

এই সময় ঘটনাস্থলে পারিষদবর্গ নিয়ে চতুর্ভুজ নারায়ণ এসে প্রবেশ করলেন। তিনি সরস্বতীর হাত ধরে কাছে টেনে নিলেন, তাকে বুকে আলিঙ্গন করলেন। পুরানো সব জ্ঞানের কথা শোনালেন। তার অনুপস্থিতিতে ইতিমধ্যে যে ঝগড়া হয়েছে এবং শাপ-শাপান্ত চলেছে –তা শুনে ভগবান নারায়ণ মনে ব্যথা পেলেন। তিনি বললেন–হে লক্ষ্মী! তুমি পৃথিবীতে ধর্মধ্বজের ঘরে গিয়ে অযোনিসম্ভবা হয়ে তার কন্যা রূপে জন্ম নেবে। সেখানেই তুমি সরস্বতীর অভিশাপের কারণে বৃক্ষে পরিণত হবে, তুমি হবে ত্রৈলোক্য পাবণী তুলসী, আমার অংশ থেকে উৎপন্ন অসুর শঙ্খচূড়ের পত্নীরূপে বিরাজ করবে। এই ভাবে শাপ ভোগ করার পর আমার কাছে ফিরে আসবে। আমি তোমাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করব।

হে সুবদনা, তুমি সরস্বতীর শাপের প্রভাবে নদী হয়ে ভারতে জন্ম নেবে। সেখানে তুমি পদ্মাবতী নামে অভিহিত হবে। গঙ্গা তুমিও সরস্বতীর শাপে পতিতপাবণী হয়ে ভারতে অবতীর্ণ হবে। সেখানকার মানুষদের পাপ নাশ করো। ভগীরথ কঠোর সাধনা করে তোমাকে মর্ত্যে আনবে। তোমাকে সকলে ভাগীরথী নামে জানবে।

হে সুরেশ্বরী! গঙ্গার অভিশাপের প্রভাবে তুমিও ভারতে জন্ম নেবে। সেখানে আমার অংশ জাত সমুদ্র এবং আমার অংশ থেকে উৎপন্ন রাজা শান্তনুর স্ত্রী হয়ে দিন কাটাতে হবে। দুই সপত্নী লক্ষী ও গঙ্গার সাথে তুমি ঝগড়া করেছে তার ফল তোমাকে ভোগ করতেই হবে। তুমি স্বয়ং ব্রহ্মার কাছে। যাও। তাকে পতি হিসাবে গ্রহণ করো। গঙ্গাকেও আমি বিদায় জানাচ্ছি। লক্ষ্মী শান্ত, সে হিংসা করতে জানে না। সে মহাসতী, সুশীলা ও ধার্মিকা। তাই আমি তাকে নিজের কাছে রেখে দিলাম। লক্ষ্মীর অংশের অংশগত হিসেবে যে সব নারী জন্মাবে তারা হবে তার মতো সুশীলা শান্তরূপা ও ধর্মপরায়ণা এবং পতিব্রতা। বেদ বলেছে, তিন জন সতী, তিনজন চাকর ও তিনটি বাড়ি অমঙ্গলের কারণ। যে স্বামীর স্ত্রী কেবল ঝগড়া করে, দুর্বুদ্ধি মাথায় রাখে, তার বনে বাস করা উচিত। কারণ তারা ঘর থেকে বনেই শান্তি পায়। দুষ্ট স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস করা আর আগুনে ঝাঁপ দেওয়া সমান। যে স্বামী স্ত্রীর বশীভূত তার জীবন ব্যর্থ, সে নিজের মতো করে কোনো কিছু ভোগ করতে পারে না। যে পুরুষ অনেক স্ত্রী নিয়ে ঘর করে, সে অসুখী হয়। যশ ও কীর্তিহীন লোকের বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া সমান।

যার স্ত্রী স্বামীর বশীভূতা, শান্ত, সুশীলা ও পতিব্রতা, সে বেঁচে থেকে স্বর্গের সমান সুখ লাভ করে। পরলোকে সে ধর্ম ও নির্বাণ লাভ করে। পতিব্রতা স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী মুক্ত, শুদ্ধ ও সুখী জীবন কাটায়। কিন্তু দুশ্চরিত্র স্ত্রী স্বামীর জীবনে কেবল দুঃখ টেনে আনে।

জগন্নাথ নারায়ণের কথা বলা শেষ হলে তিনি সপত্নী, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। ভবিষ্যতের কথা স্মরণ করে তাঁরা ভয় ও শোকে কাঁপতে লাগলেন।

ব্যথিত কণ্ঠে সরস্বতী বললেন– হে জগৎপতি! দুষ্ট স্বভাবের স্ত্রীকে কোনো স্বামী পছন্দ করে, আমি জানি, আমার এই শাস্তি প্রাপ্য। স্বামী পরিত্যক্ত স্ত্রীর বেঁচে থাকার কী প্রয়োজন? আপনার আদেশে আমি ভারতে যাচ্ছি। যোগবলে সেখানেই প্রাণ ত্যাগ করব।

গঙ্গা বললেন–হে নাথ! আমি কি দোষ করেছি জানি না। তবুও নিজেকে আমি নিরাপরাধ বলছি। আপনি আমাকে আপনার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করলেন, নিশ্চয়ই করে বলছি, এ জীবন আমি বিসর্জন দেব। আর আপনি হবেন স্ত্রী হন্তারক। আপনি সর্বজ্ঞ। তবুও আমি বলছি, বিনা দোষে স্ত্রীকে ত্যাগ করলে স্বামীর কল্পান্তকাল পর্যন্ত নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।

লক্ষ্মীদেবী বললেন– হে প্রভু! আপনি সত্ত্বস্বরূপ, আপনার রাগ হওয়ার কথা নয়, ক্ষমা প্রদর্শন করা সৎপতির শ্রেষ্ঠ গুণ। তাই বলছি, আপনি আপনার পত্নীদের ওপর সদয় হোন। হে নাথ! সরস্বতীর অভিশাপের অংশের দ্বারা আমি ভারতে গেলে কতকাল সেখানে কাটাব, কবে আপনার পাদপদ্মে ঠাঁই পাব? পাপীরা আমার জলে স্নান করে সব পাপ আমাকে দিয়ে যাবে। সেই পাপ থেকে আমি কীভাবে মুক্ত হব? সরস্বতী ও গঙ্গা কীভাবে কত কাল পরে পাপ মুক্ত হবে, কৃপা করে বলুন।

লক্ষ্মীদেবী নারায়ণের চরণ দুটি জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তাদের ক্ষমা করার কথা বারবার বললেন।

ভক্তদের অনুগ্রহ করার জন্য কাতর পদ্মনাভ নারায়ণ লক্ষ্মীকে আলিঙ্গন করলেন। হেসে বললেন– হে সুরেশ্বরী! আমি এমন ব্যবস্থা করব, যার ফলে আমাদের দুজনের কথাই রাখা হবে। কীভাবে? সে কথা বলছি শোন। সরস্বতী নিজের অংশের দ্বারা নদীরূপে ভারতবর্ষে যাবে। ব্রহ্মার কাছে এবং স্বয়ং আমার কাছে অবস্থান করবে। গঙ্গাকে ভগীরথ নিয়ে এলে সেই প্রসিদ্ধ গঙ্গা প্রবাহিনী হয়ে ভারতবর্ষকে পুণ্যতীর্থে পরিণত করবে। এবং নিজে আমার কাছে থাকবে। শিবের অত্যন্ত দুর্লভ মস্তকে সে স্থান পাবে। এতে তার পবিত্রতার মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যাবে। হে লক্ষ্মী! তুমি মর্তে পদ্মাবতী নদী ও তুলসীগাছ হয়ে অবস্থান করবে। কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর পর্যন্ত তোমরা এই শাপ ভোগ করবে। তারপর শাপমুক্তি ঘটবে, ফিরে আসবে আমার কাছে। বিপদে পড়লেই লোকে ধর্মের আশ্রয় নেয়। আমার মন্ত্র, উপাসকদের স্নান ও অবগাহনের ফলে তোমরা পাপীদের দেওয়া পাপ থেকে মুক্তি লাভ করবে। মর্তের সমস্ত তীর্থে আমার ভক্তদের দর্শনে ও স্পর্শে পুণ্য লাভ করবে।

লক্ষ্মী ভগবান অনুগ্রহকারীদের লক্ষ্য জানতে চাইলে নারায়ণ বললেন–হে সাধ্বী নারী! আমার মন্ত্রের উপাসকরা ভারতের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা পৃথিবীকে পবিত্র করার কাজে ব্যস্ত। আমার ভক্তরা যে জায়গায় যাবে, সেই জায়গায় পাপ রোধ হবে, সেই জায়গা মহা তীর্থে পরিণত হবে, আমার ভক্তদের স্পর্শ ও দর্শন করে পাপীদের পাপের বিনাশ ঘটাবে। যে লোক পুজোআচ্চা মানে না, সন্ধা-আহ্নিক করে না, একাদশী তিথি পালন করে না, স্ত্রী বা গরু হত্যা করে, উপকারীর উপকার মনে না রেখে তার অপকার করে –সেই সব পাপীরা আমার ভক্তদের স্পর্শে ও দর্শনে পবিত্র হয়। ঋণী ব্যক্তি, সুদখোর, বিশ্বাসঘাতক বন্ধু হত্যাকারী এমন কোন লোক আমার ভক্তকে স্পর্শ ও দর্শন করে, তাহলে তাদের পাপ নাশ হয়। যে লোক অশ্বত্থ গাছের কাছে আমার ভক্তদের দুর্নাম করে, যে কন্যা বিক্রি করে, ব্রাহ্মণের দ্রব্য যে চুরি করে, যে পারদ বিক্রি করে, শ্বশুর-শাশুড়ির ভার যে গ্রহণ করে না, যে সাধু ব্যক্তির নিন্দা করে, যে সবসময় নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে, যে সংসারের প্রতি কোনো কর্তব্য পালন করে না, যার শ্রীহরির প্রতি কোনো ভক্তি নেই– তারা মহাপাপী। তারা আমার ভক্তদের স্পর্শে ও দর্শনে ধন্য হয়। আমার ভক্তরা যে স্থানে উপনীত হয়, সেই স্থান পবিত্রতা লাভ করে।

সেধতি বললেন–হে ঋষিশ্রেষ্ঠ শৌণক! নারায়ণের এই কথা শ্রবণ করে মহালক্ষ্মী জানতে চাইলেন, যে সব ভক্তদের পায়ের ধুলায় সেই স্থান পবিত্র হয়, যাদের স্পর্শ ও দর্শন পেলে মহাপাতকীরও পাপ নাশ হয়, সেইসব বিষ্ণুর লক্ষণচিহ্ন দয়া করে বলুন। নারায়ণ তখন হাসতে হাসতে সেই গোপন তত্ত্ব তাকে শোনালেন।

জনার্দন বললেন–হে লক্ষ্মী! আমার ভক্তদের লক্ষণ তত্ত্ব অত্যন্ত দুর্লভ ও গোপনীয়। তুমি আমার প্রাণের প্রাণ এবং অত্যন্ত পবিত্র। তাই তোমাকে বলতে আমার কোনো বাধা নেই। যে লোক সাধারণ বৈষয়িক কামনা করে না, হরিনাম শুনে যে পুলকিত হয়, যে সর্বদা হরিনাম সংকীর্তনে ব্যাপৃত থাকে, যে আমার পুজো করে, আমার প্রতি যার ভক্তি আছে, আমার গুণ-গুলি শ্রবণ করা মাত্র যে মনে প্রাণে আনন্দ লাভ করে, তারাই হল প্রকৃত বৈষ্ণব। আমার ভক্তস্বরূপ আমার ভক্তরা– ইন্দ্ৰত্ব, মনুত্ব, দুর্লভ দেবত্ব এবং স্বর্গরাজ্য প্রভৃতি ভোগের কথা কল্পনাও করতে পারে না। হে সতী, আমার ভক্তরা এই ভারতবর্ষকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে মানুষরূপে পৃথিবীতে আসে। তার নিজের নিজের কাজ সম্পূর্ণ করে ফিরে যায় বৈকুণ্ঠধামে। তারপর বললেন–হে পদ্মা তুমি তোমার প্রশ্নের জবাব পেলে, আশা করি আর কোনো কিছু জানার নেই। এবার তোমাদের বিবেচনায় যা হয় তাই করো। লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গাদেবী যার যার নির্দিষ্ট কাজে মনোনিবেশ করলেন।

.

সপ্তম অধ্যায়

নারায়ণ বললেন–হে নারদ! গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতী নদী রূপে এই পবিত্র ভারতের ভূমিতে অবতীর্ণ হলেন। এইসময় সরস্বতীর নাম হল–ব্রাহ্মী কারণ তখন তিনি ব্রহ্মার প্রিয়া। ভারতে আসার জন্য তিনি হন ভারতী। সরঃশয়ী শ্রীহরি সমুদ্রে সমস্ত বিশ্বব্যাপী অনেককাল ধরে শুয়ে ছিলেন। বাণী তার স্ত্রী, তাই তিনি সরস্বতী। আমার ইষ্টদেবী সরস্বতী হলেন তীর্থরূপা এবং জ্বলন্ত আগুন হয়ে তিনি পাপরূপ কাঠ পুড়িয়ে থাকেন।

পরে গঙ্গাকে মহারাজ ভগীরথ মর্ত্যে নিয়ে এলেন। গঙ্গা হলেন মঙ্গলময়ী ভাগীরথী, এসময় গঙ্গার বেগ এত প্রবল ছিল যে, পৃথিবীর পক্ষে তা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। শিবকে এইজন্য প্রার্থনা জানালে তিনি গঙ্গাদেবীকে নিজের মস্তকে ধারণ করতে সম্মত হলেন।

সরস্বতীর অভিশাপে লক্ষ্মীও অবতীর্ণ হলেন মর্তে। নাম নিলেন পদ্মাবতী, নিজে শ্রীহরির কাছে রয়ে গেলেন। লক্ষ্মীর অন্য এক অংশ ভারতে ধর্মধ্বজরাজের দুহিতা হয়ে তুলসী নাম নিয়ে থাকতে লাগলেন। তিনি হলেন বিশ্বপাবনী তুলসী গাছ। পাঁচ হাজার বছর সমাপ্ত হলে তিনি আবার নিজের রূপে ফিরে গেলেন বৈকুণ্ঠধামে।

কলিযুগে কাশী আর বৃন্দাবন ছাড়া পৃথিবীতে যে সমস্ত তীর্থ আছে তাঁরা সবাই লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গাদেবীর সঙ্গে বৈকুণ্ঠে চলে যাবেন। কলি যুগের দশ হাজার বছর অন্তে শ্রীহরির দুই মূর্তিরূপ শালগ্রাম আর জগন্নাথ ভারত ত্যাগ করে বৈকুণ্ঠে চলে যাবেন। তাদের সঙ্গে বিদায় নেবে বেদেবর্ণিত যে সব ক্রিয়াকলাপের কথা বলা হয়েছে তারা, পুরাণ, সাংখ্যা সমাজবিদ। ওই সময় পৃথিবী থেকে ব্রত উপবাস, তপস্যা, হরির পুজো, হরির সংকীর্তন, সত্য, ধর্ম, গ্রাম্যদেবতারা, সত্ত্বগুণ এসবও লোপ পাবে। মানুষ হবে মিথ্যাবাদী, কপটতায় পূর্ণ। কাম বিলাসে মত্ত হবে। পুজো পার্বনে মন দেবে না। যদিও পুজো করে, তাহলে তুলসী দেবে না। হরিকথা শুনলেই বিরক্তি প্রকাশ করবে। পৃথিবী শঠ, কুটিল, হিংসুটে, দাম্ভিক, চোর, ডাকাতে ভরে যাবে। রাশিচক্র বিচার করে বিয়ে করার প্রয়োজন বোধ করবে না। পুরুষ হবে স্ত্রীর বশীভূত। ঘরে পত্নীকে ফেলে রেখে বেশ্যার সঙ্গে সময় কাটাবে। মা-বাবাকে ত্যাগ করে পত্নী-কন্যা-পুত্রকে নিয়ে সুখে দিন কাটাবে। মা, বাবা শ্বশুর-শ্বাশুড়ি দাসীর মতো হবে। মা বাবা, শ্বশুড়-শাশুড়ির সঙ্গে দাসীর মতো ব্যবহার করবে। স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে পুরুষ কোনো কাজে ব্যাপৃত হবে না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আর বৈশ্যরা নিজেদের শাস্ত্র মানবে না। শূদ্রদের শাস্ত্র পড়বে। তাদের সাথে কুটুম্বিতা করবে।

পৃথিবীতে গাছপালা জন্মাবে না। থাকবে না শস্যের ক্ষেত্র। গাছে ফুল ফল ঝুলতে দেখা যাবে না। স্ত্রীরা সন্তানাদি লাভ করবে না। গরু দুধ দেবে না। ফলে ঘি পাওয়া যাবে না। বাড়িতে অশান্তি বিরাজ করবে, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসায় কপটতা থাকবে। সে ভালোবাসা খাঁটি হবে না। প্রতাপান্বিত রাজা তার ক্ষমতা হারাবে। করের ভারে প্রজারা জর্জরিত হবে।

কুৎসিত বিশ্রি চেহারা নিয়ে স্ত্রী পুরুষ, বালক, পুণ্যহীন, ধর্মহীন এই পৃথিবীতে জন্ম নেবে। জলাশয়গুলি শুকিয়ে যাবে। জলের অভাব হবে। মানুষ ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি রক্তপাতে মেতে উঠবে। বেশিরভাগ গ্রাম ও শহর হবে জনশূণ্য। সেই জনশূণ্য নগর অরণ্যে ভরে যাবে। মানুষ বনে গিয়ে বাস করবে। উর্বরা জমি ভালো ফলন আর দেবে না। নদী বা জলাশয়ের ধারে কিছু কিছু শস্যের চাষ হবে।

কলিযুগে সদ্বংশজাত মানুষ মিথ্যাবাদী, কপট, খারাপ লোকে পরিণত হতে বাধ্য হবে। বৈশ্যরা পতিব্রতাকে, পাপীরা তপস্বীদের, অবৈষ্ণবরা বৈষ্ণবদের উপহাস ও ঠাট্টা করবে। ধূর্তরা সন্ন্যাসীর বেশ ধরে ধর্মের নামে কুৎসা রটাবে। নির্বোধ, ঠগ, জোচ্চর, মাতাল, লম্পট ব্যক্তিরা সমাজে গণ্যমান্য হিসাবে পরিগণিত হবে। মানুষের আয়ু কমে যাবে। যৌবন বয়স অতিক্রান্ত হবার আগেই প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছাবে। মেয়ে পাচারকারীরা রমরমা ব্যবসা করবে। কালোবাজারী যত্রতত্র চলবে। ব্যাভিচারের মাধ্যমে মানুষ অর্থ উপার্জন করবে, আর সেই পয়সায় বিলাসিতায় ডুবে যাবে।

এই যুগে মানুষের সংসারে বনিবনা থাকবে না। শাশুড়ী-বউ, বোনে-বোনে, ভাইয়ে-ভাইয়ে বিবাদ করবে। কেউ কেউ হরিনাম বিক্রি করে স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা করবে। যশ ও অর্থ লাভ করবে। কেউ ছেলের বউয়ের কাছে শাশুড়ির কাছে অথবা কন্যা, বোন, সত্মায়ের কাছে যাবে। মায়ের সঙ্গ ছেড়ে সকলে স্ত্রীর সঙ্গে ঘুরবে এবং নিজের স্ত্রীর কোনো ঠিক থাকবে না। এই রকম স্বামীরা লাগামছাড়া হবে। দয়ামায়া, বিবেক, বিসর্জন দিয়ে মানুষ মানুষকে হত্যা করবে। ব্রাহ্মণরা অনাচার, অধর্মের কাজ করবে। শূদ্রদের মৃতদেহ পোড়াবে। তাদের কাছ থেকে আহার গ্রহণ করবে, শূদ্র পত্নীর সাথে সম্ভোগে রত হবে। বেশ্যা, স্বামী ও পুত্রহীনা রমণী, বৃদ্ধা ও মনমরা নারী ব্রাহ্মণের ঘরে রাঁধুনির কাজ করবে। আশ্রম ও জনসমাজের মধ্যে কোনো প্রভেদ থাকবে না। কলিযুগে পৃথিবী ম্লেচ্ছতে পরিপূর্ণ হবে। গাছের উচ্চতা এবং মানুষের উচ্চতা কমে কমে একহাত ও এক আঙুল সমান হবে।

কলিযুগে এই সময় ভগবান কল্কি নারায়ণের অংশে ব্রাহ্মণের পুত্র হয়ে জন্মাবেন। তাই নাম হবে বিষ্ণু-যশা। তিনি বলবানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ম্লেচ্ছপূর্ণ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে বিশাল তরোয়াল উচিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ভ্রমণ করবেন। তিন রাতের মধ্যে সমস্ত পৃথিবীকে ম্লেচ্ছ শূন্য করে বিদায় নেবেন। এর ফলে অরাজকতা বাড়বে। দুঃখ কবলিত পৃথিবীতে তারপর প্রবল ধারায় বৃষ্টি হবে। ছয় দিন-রাত সমানে বৃষ্টি হওয়ায় সবকিছু ডুবে যাবে। জলের তলায় পড়ে থাকবে পৃথিবীর মানুষজন, গাছপালা, ঘরবাড়ি সবকিছু।

এই সময় আকাশে বারোটি সূর্যের উদয় হবে। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে সেই বিপুল জলরাশি শুকিয়ে যাবে। কলিকাল রসাতলে গিয়ে শুরু হবে সত্যযুগ। এই সময় পৃথিবীতে ধর্ম নেমে আসবে। আসবে সত্য। জগতে জ্ঞানী, ব্রাহ্মণ ও বেদজ্ঞদের বাসস্থান হবে। ঘরে ঘরে পতিব্রতা ও ন্যায় পরায়ণা স্ত্রীর জন্ম হবে। ব্রাহ্মণ সমাজে অগ্রগণ্য ভূমিকা নেবে। এই সময় পৃথিবী হবে অধর্ম লেশশূণ্য। এখানে মিথ্যা থাকবে না।

ত্রেতা যুগে ধর্ম তিন পাদ, ধর্ম দ্বিপদ হচ্ছেন দ্বাপর যুগে, কলিযুগে ধর্ম হন একপাদ এবং কলিযুগের শেষে বিদায় নেয়। হে নারদ! সাতটি বার, ষোলোটি তিথি, বারোটি মাস, ছয়টি ঋতু, দুইটি পক্ষ, দুইটি অয়ন, চার প্রহর ও এবং চার প্রহরে একদিন একরাত্রি, তিরিশ দিনে একমাস ও বারো মাসে এক বছর হয়। বিধির ক্রমানুসারে বছরের পাঁচটি প্রকার। বছর যেভাবে চার যুগ সম্পন্ন হয় –সত্য, ত্রেতা দ্বাপর ও কলি। মানুষের একবছর দেবতাদের একদিনের সমান। মানুষের তিনশো ষাট যুগ দেবতাদের এক যুগের সমান। দেবতাদের একাত্তর যুগ অন্তে আসে একটি মন্বন্তর। এই সময়সীমা ইন্দ্রের আয়ুষ্কাল। আঠাশ জন ইন্দ্রের পতন হলে ব্রহ্মার একদিন ও একরাত্রি হবে। এই ভাবে একশো আট বছর পর্যন্ত ব্রহ্মার আয়ু। ব্রহ্মার পতনের সাথে সাথে পৃথিবী লুপ্ত হবে। তখন শ্রীকৃষ্ণের অংশ, অংশের অংশ, এমনকি তার কণার দ্বারা সৃষ্ট দেবতা, ঋষি, মুনি, প্রাণীরা বৃষ্টিতে আবার বিলীন হয়ে যান। স্বয়ং প্রকৃতিও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে এক হয়ে যান। একে বলা হয় প্রাকৃতিক বলয়। প্রাকৃতিক বলয় ও ব্রহ্মার পতন কালকে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের এক নিমেষকাল বলা হয়ে থাকে। জগতের বিলুপ্তি ঘটলে শ্রীকৃষ্ণ বৈকুণ্ঠলোকে অবস্থান করেন। নতুন এক নিমেষকাল এলে আবার সৃষ্টির কাজ শুরু হয়। এইভাবে প্রলয় ও ধ্বংসের মধ্য দিয়ে পৃথিবী এগিয়ে চলেছে।

হে মুনি! স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই হলেন বিধাতা। তার নির্দেশেই ত্রিভুবন পরিচালিত হয়। ব্রহ্মা থেকে শুরু করে প্রকৃতি, ক্ষুদ্র, মহা বিরাট, সকলেই তার অংশজাত। ব্রহ্মা থেকে শুরু করে সামান্য ঘাস সবই প্রকৃতি হতে উৎপন্ন হয়েছে। প্রকৃতি থেকে আসা যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে সবই অনিত্য, নশ্বর। একমাত্র পরমব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণ, নিত্য, সনাতন, স্বেচ্ছাধীন, নির্লিপ্ত, তিনি সাকার এবং নিরাকার। ভক্তদের দর্শন দেবার ইচ্ছায় তিনি রূপ ধারণ করেন। অত্যন্ত মনোহর তার সে রূপ। চালক রাখাল বেশে সজ্জিত, হাতে বাঁশী, বিভিন্ন অলংকারে তিনি সজ্জিত। তিনি সর্বজ্ঞ, তিনি অক্ষয়, তিনি পরমাত্মা বিধাতা পুরুষ। যার জ্ঞান, তপস্যা, ভক্তি ও সেবায় মহামায়া প্রকৃতি সর্ব শক্তির আধার পরমেশ্বরী হয়েছেন, যাঁর জ্ঞান ও সেবায় দেবী সাবিত্রী বেদমাতা, যার সেবা, তপস্যা ও জ্ঞানে দেবী সরস্বতী বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী, যাঁর সেবা ও তপস্যায় লক্ষ্মী বাণিজ্য ও শস্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, যিনি সমস্ত ঐশ্বর্য দান করে মহালক্ষ্মী দেবী রূপে বিখ্যাত হয়েছেন। যার সেবা ও তপস্যায় দুর্গাদেবী সকলের পূজনীয়, যাঁকে সবাই পুজো ও বন্দনা করে তিনি সর্বজ্ঞা ও দুর্গতিনাশিনী হয়ে সর্বেশ্বর শিবকে পতিরূপে পেয়েছেন। কৃষ্ণের সেবায় যিনি শ্রীকৃষ্ণের বাম অঙ্গ থেকে আবির্ভূত হয়েছেন, তিনি কৃষ্ণ প্রাণাধিকা দেবী রাধা।

পুরাকালে দিব্য হাজার যুগ ধরে তপস্যা করার ফলে রাধিকা দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস শূন্য এবং চাঁদের অংশের মতো ক্ষীণ হয়ে পড়েছিলেন। এ দৃশ্য দেখে শ্রীকৃষ্ণের মনে দুঃখ জাগে। তিনি রাধিকাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দুর্লভ সেই বরদান করলেন হে দেবী, তুমি হও আমার প্রিয়া। আমার বক্ষ মাঝে তোমার স্থান হোক সর্বক্ষণ। তুমি হও আমার শ্রেষ্ঠ অভিলষিত। রমণীদের মধ্যে তুমি হবে সেরা। আমি সর্বদা তোমার বশে থাকব। হব তোমার আরাধ্য দেবতা। তুমি হবে আমার আরাধ্য দেবী।

দেবী দুর্গা দিব্য হাজার বছর ধরে হিমালয় পর্বতে তপস্যা করে শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্ম লাভ করেছেন। তিনি সকলের পুজো পেয়ে থাকেন। গন্ধমাদন পাহাড় দিব্য লক্ষ বছর তপস্যার ফলে দেবী সরস্বতী সুকলের পুজো পেয়েছেন। দিব্য ষাট বছর হিমালয় পর্বতে শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করে দেবী সাবিত্রী ব্রাহ্মণদের ইষ্টদেবীতে পরিণত হয়েছেন। বিষ্ণু একশো মন্বন্তর কাল ধরে শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করে সিদ্ধি লাভ করেছেন। তিনি হলেন জগতের রক্ষাকর্তা, এইভাবে সমস্ত দেব এবং দেবীরা শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্ম বন্দনা ও ধ্যান করে পূজনীয়া হয়েছেন।

.

অষ্টম অধ্যায়

সুতপুত্র বললেন–হে শৌনক, সমস্ত কাজের যিনি মঙ্গল করেন, যিনি বাধা বিপত্তি নাশ করেন, যিনি পুণ্যের কলস পূর্ণ হতে সাহায্য করেন, যিনি পাপের মৃত্যু ঘটান, সেই বসুধার অদ্ভুত জন্ম বৃত্তান্ত শুনুন। এই কাহিনি স্বয়ং নারায়ণ ব্রহ্মপুত্র মহর্ষি নারদকে শুনিয়েছিলেন।

নারায়ণ বললেন–অনেকের অভিমত মধু কৈটভনামে এক অসুরের মেদের থেকে পৃথিবীর আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু কেউ কেউ বলে থাকেন, তেজস্বী বিষ্ণুর যুদ্ধ তৎপরতা দেখে মধু কৈটভ মুগ্ধ হন। পৃথিবী যেখানে ডুবে যায়নি, সেই রকম কোনো স্থানে তাদের বধ করার বাসনা পোষণ করলেন। অর্থাৎ মধু কৈটভ এই পৃথিবীর বুকে সেসময় বেঁচে ছিলেন। তাদের বধ করা হলে তাদের মেদ জমে জমে পৃথিবী পরিপূর্ণ হয়। পৃথিবী আগে জলমগ্ন ও কৃশ ছিল। তাই তার অন্য নাম মেদিনী। অর্থাৎ পৃথিবী আগে ছিল জলপূর্ণ সেখানে শুধু মধু কৈটভের মেদ পড়ে জমা হয়েছে। তবে এসব মত একেবারেই যুক্তিসম্মত নয়। শ্রুতি প্রসিদ্ধ ও সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে তোমাকে আমি এখন বর্ণনা করছি। যা আমাকে পুষ্করতীর্থে ধর্মরাজ দান করেছিলেন।

বহুকাল জলের মধ্যে মগ্ন থাকার পর মহাবিরাটের শরীরে মল জন্মায়। সেই মল সারা শরীর হয়ে লোম কূপে আসে। অনেক কাল পরে সেই লোমকূপ থেকে পৃথিবীর সষ্টি হয়েছে। এইভাবে তার আবির্ভাব ঘটে। তিরোভাব কালে জলমগ্ন হয়। বিলীন হয়ে যায়। আবার তার আগমন ঘটে। এই পৃথিবীর যা কিছু সবেতেই ব্রহ্মা বিষ্ণু ও শিব প্রভৃতি দেবতারাও তাতে যুক্ত আছেন। এখানে অনেক সংখ্যক তীর্থস্থান আছে। নীচের সাতটি পাতাল এবং ওপরে আছে পৃথিবী, তার ওপরে ব্রহ্মলোক। তারও ওপরে আছে গোলোকধাম ও বৈকুণ্ঠধাম। এ দুটিলোকে যা কিছু আছে, সবই অবিনশ্বর ও অকৃত্রিম। নিত্য বিশ্বের সাথে এই দুটিলোকের প্রভেদ আছে।

হে ব্রহ্মা! প্রাকৃতিক প্রলয়ে সব ধ্বংস হয়ে আবার সৃষ্টির সময়কাল এসে গেল। প্রথমে তিনি মহাবিরাটকে সৃষ্টি করলেন। বরাহ রূপে ক্ষিতির অধিশ্বরী দেবী পৃথিবীর সকলের কাছ থেকে পুজো পেয়েছিলেন। সেইসময় হিরণ্যক্ষে প্রভৃতি অসুরদের দ্বারা পৃথিবী তাড়িত হয়েছিল। ব্রহ্মা ভগবানের স্তব করেন। শ্রীকৃষ্ণ বরাহ অবতার হয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। সমস্ত অসুরদের বধ করে পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। এবং সাগরে ভেসে থাকা পদ্মপাতার মতো জলে ভাসিয়ে ছিলেন, সেই স্থানেই সৃষ্টি হল সুন্দর এক বিশ্ব। পৃথিবীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী বরাহরূপী সেই ভগবান শ্রীহরিকে দেখে ভালোবাসা দান করতে উন্মুখ হলেন। শ্রীকৃষ্ণও তাঁর প্রতি দুর্বল হলেন। নির্জনে তারা দিব্য একবছর রতিক্রিয়া উপভোগ করলেন। বছরের শেষে কামার্ত বিষ্ণু চেতনা ফিরে পেয়ে সকামা বসুন্ধরাকে পরিত্যাগ করলেন। তিনি আবার শূকররূপ ধারণ করলেন। তিনি সতী বসুন্ধরার স্তব করে তার পুজো করলেন। তারপর থেকে সকলের কাছে তিনি পুজো পেতে থাকলেন।

শ্রীকৃষ্ণের আদেশে বসুধা বরাহরূপ ধারণ করে পৃথিবীময় বেড়াতে লাগলেন। মুক্তো, শুক্তি, শিবলিঙ্গ, শিলা, শঙ্খ, প্রদীপ, রত্ন, যজ্ঞসূত্র, ফুল, বই, তুলসী, জপমালা, ফুলমালা, সোনা, কর্পূর চন্দন, শালগ্রাম শিলার স্নানের জল যে বসুন্ধরার ওপর নিক্ষেপ করে সে কালসূত্র নামক নরকে বাস করে, দিব্য একশো বছর তারা নরক যন্ত্রণা ভোগ করবে।

এই সময় পৃথিবী থেকে তেজস্বী মঙ্গল গ্রহের জন্ম হল। কান্তশাখায় বর্ণিত দেবীর মন্ত্রোচ্চারণ করে শ্রীহরির আদেশে দেবতারা পৃথিবীর পুজো করলেন। এইভাবে বসুন্ধরা জগতে পূজনীয় হলেন। বরাহরূপী বিষ্ণুর পর পৃথিবী দেবীর পুজো করেছিলেন ব্রহ্মা। তারপর একে একে পৃথ্বিরাজ, শ্রেষ্ঠ মুনি, মনু এবং সবশেষে মানুষ তার পুজো করেন।

স্বয়ং বরাহ রূপী শ্রীকৃষ্ণ ‘ওঁ হ্রীং শ্রীং, বাং বসুধায়ৈ স্বাহা’ মন্ত্রে বসুধারাকে বন্দনা করেছিলেন। তিনি তার গুণকীর্তন করেছেন এইভাবে –হে জয় স্বরূপ দেবী জয়া! তুমি জয়ের আধার, তুমি বিজয় দান কর, যজ্ঞকর বরাহের পত্নী। আমাকে বিজয়ী করো। হে দেবী! তুমি সমস্ত কিছুর আধার। সকল অভীষ্ট পূরণ করো। আমার মনোবাসনা পূর্ণ করো। তুমি রাজাদের ধনস্বরূপ, অহঙ্কার স্বরূপ। হে দেবী! তুমি শস্য ও ভূমি প্রদায়িনী। তুমি আমাকে ভূমি দান করো।

এই স্তব পাঠ করে যে পৃথিবী পুজো করে সে রাজা হয়, কোটি কোটি বছর ধরে রাজত্ব করে। এই স্তব পাঠ করলে ভূমি দানের সমান পুণ্য লাভ হয়। অম্বুবাচীর দিন মাটি খনন করলে ও অন্যের জমিতে শ্রাদ্ধকাজ করলে যে পাপ হয় এই স্তব পাঠের ফলে তার বিনাশ হয়। মাটিতে প্রদীপ রাখলে যে পাপ হয়, এই স্তব পাঠ করলে শত অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পুণ্য হয়।

.

নবম অধ্যায়

সৌতি বললেন– হে শৌনক! পৃথিবী অন্যান্য যে সব কারণে পাপ দেন এবং সেই পাপ থেকে উদ্ধার পাবার উপায়ের কথা আপনাকে এখন বলছি। নারদ এ প্রশ্ন নারায়ণের কাছে রেখেছিলেন। নারায়ণ যা বলেছিলেন, তাই অভিব্যক্ত করছি।

বেদাঙ্গ শ্রেষ্ঠ নারায়ণ বললেন–যে লোক শস্যপূর্ণ জমি ব্রাহ্মণকে দান করে, সে জমি ধুলিকণা পরিমিত বছর পর্যন্ত বিষ্ণু সঙ্গ লাভ করে। গ্রাম, ভূমি এবং ধান দান যে করে এবং যে গ্রহণ করে তারা দুজনেই পাপ থেকে মুক্তি পায় এবং বিষ্ণুপদে অবস্থান করে। নিজের দেওয়া বা পরের দান করা ব্রহ্মত্ব চুরি করলে কালসূত্র নামক নরকে বাস হয়। গরুর যাতায়াতের পথ বন্ধ করে জমিদান করলে কুম্ভীপাক নরকে গমন হয়। দিব্য শত বছর সে ওই নরকে যন্ত্রণা ভোগ করে। গরুর চারণভূমি এবং জলাশয় বুজিয়ে দিয়ে পথ ও শস্য দান করলে চৌদ্দজন ইন্দ্রের আয়ুষ্কাল পর্যন্ত অসিপত্র নরক বাস হয়। যে বোকালোক জমির মালিকের বাবাকে পিন্ড দেয় না, নিজের বাবাকে পিন্ডদান করে, সে অবশ্যই নরকে যাবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মাটিতে শাঁখ রাখলে যে পাপ হয়, তার দোষে পরের জন্মে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়। মাটিতে সোনা, রূপা হীরে, মানিক্য রাখলে সাতজন্ম পরপর দরিদ্রতা ভোগ করে। জপমালা, ফুলের মালা, কর্পূর মাটিতে রাখার ফলে সেই পাপীকে নরকে যেতে হয়। যজ্ঞসূত্র ও বই মাটিতে রাখা ব্রহ্মহত্যা সমান পাপ। ভূমিকম্পের সময় এবং গ্রহণের সময় যে মাটি কোপায় সে মহাপাপী হয়। তাকে বিকলাঙ্গ হয়ে পরেরবারে জন্মাতে হয়।

যিনি সকলকে ধরে আছেন তিনি ধরা, ধরিত্রী ও ধরণী। হরির উরু থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি। তাই তিনি উর্বী। নানারকম যাগযজ্ঞের ক্রিয়ার আধার বলে এই দেবীর নাম ইজ্যা। খন্ড প্রলয় কালে ইনি ক্ষীণ হয়ে যান বলে তিনি ক্ষৌণী। মহাপ্রলয়কাল পৃথিবী ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। তাই তাকে ক্ষিতি নামেও ডাকা হয়। পৃথিবী হলেন কশ্যপের কন্যা কাশ্যপী। তিনি নড়চড়া করেন না, তাই অচলা। বিশ্বকে ধারণ করে নাম নিয়েছেন, বিশ্বম্ভক। অনন্ত রূপ তাঁর তাই তিনি অনন্তা। মহারাজ পৃথুর কন্যা হিসাবে পৃথিবী এবং বিস্তৃত বলে পৃথ্বী নামে অভিহিত।

.

দশম অধ্যায়

নারদ বললেন–হে ভগবান! আমি আপনার কাছ থেকে অত্যন্ত মনোহর পৃথিবীর উপাখ্যান শ্রবণ করলাম। এখন আপনি সেই পুণ্যদানকারী, পাপনাশকারী সুরেশ্বরী গঙ্গার মর্ত্যে আগমনের কাহিনি বিবৃত করুন।

নারায়ণ বললেন–সূর্যবংশে জাত রাজ চক্রবর্তী রাজা সগরের দুই পত্নী শৈব্যা ও বৈদভী। রাজা সগর সত্য যুগে জন্মেছিলেন। তিনি ছিলেন ধার্মিক ও ন্যায় পরায়ণ। সত্যকথা শুনতে বা বলতে ভালোবাসতেন। শৈব্যার গর্ভে অসমজ্ঞ নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। অন্য স্ত্রী পুত্র কামনা করে ভগবান শিবের পুজো করেন। দীর্ঘ একশো বছর পর তিনি এক মাংস পিন্ডের জন্ম দেন। তা দেখে বৈদভী কেঁদে উঠলেন। তখন সেখানে বিপ্রের বেশ ধরে স্বয়ং শিব এসে হাজির হলেন। তিনি ওই মাংসপিন্ডটিকে ষাটটি টুকরো করলেন। এক একটি টুকরো থেকে মহা পরাক্রমশালী পুত্রের জন্ম হল। কপিল মুনির কোন্ দৃষ্টিতে পড়ে সগরের ষাট হাজার ছেলে ভস্মে পরিণত হল। ছেলেদের শোকে কাঁদতে কাঁদতে সগর রাজার মৃত্যু হল। তার পুত্ৰ অসমজ্ঞ তপস্যায় বসলেন। লক্ষ বছর অতিক্রান্ত হলে তিনি প্রাণত্যাগ করলেন। তার পুত্র অংশুমান মর্তে গঙ্গাকে আনয়নের উদ্দেশ্যে তপস্যায় বসে লক্ষ বছর পর মারা গেলেন। তাঁর পুত্র দিলীপও গঙ্গা আনয়নে অকৃতকার্য হলেন।

দিলীপের পুত্র ভগীরথ। তিনি ছিলেন খাঁটি বৈষ্ণব। মহাপরাক্রমশালী অজেয় এবং অমর। একই উদ্দেশ্যে তিনিও তপস্যায় বসলেন। দিব্য চক্ষে বংশী বাদনরত কিশোর গোপীবেশধারী শ্রীকৃষ্ণের দর্শন পেলেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং অন্যান্য দেবতারা তার জপ করছেন। প্রসন্ন সেই রূপ, আগুনের মতো শুদ্ধ বস্ত্র পরিহিত, নানা রত্নে বিভূষিত।

রাজা ভগীরথ তাঁকে বারংবার প্রণাম নিবেদন করলেন। তার স্তুতিবন্দনা করলেন। শ্রীকৃষ্ণ প্রসন্ন হলেন। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তাঁর অভীষ্টমনোবাসনা পূরণ করলেন। শ্রীকৃষ্ণের আদেশে গঙ্গাদেবী সেখানে এসে দাঁড়ালেন এবং ভগবানের বন্দনা করলেন।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন–হে সুরেশ্বরী গঙ্গে, সরস্বতীর অভিশাপ ফলপ্রসু করতে তোমাকে এখনই ভারতে যেতে হবে। তোমার পবিত্র বায়ু ও স্পর্শে সগরের ষাট হাজার পুত্রকে বাঁচিয়ে তোলো। তারা দিব্যদেহে রথে চড়ে আমার ভবনে ফিরে আসবে। তাঁরা তাদের কর্মফল ভোগ করবে ও চিরকাল নিরাময় রূপে পারিষদ হয়ে আমার কাছে থাকবে।

গঙ্গার স্পর্শ ও তার বায়ুর ছোঁয়ায় মানুষের কোটি জন্মের পাপের বিনাশ ঘটে। গঙ্গাজলে স্নান করে কতখানি পুণ্য হয়, তা বলা বেদেরও সম্ভব হয়নি। ব্রহ্মহত্যার মত পাপও গঙ্গাজলে ধুয়ে মুছে যায়। মাথা ডুবিয়ে গঙ্গাজলে স্নান করলে সংক্রান্তিতে তিরিশগুণ পুণ্য হয়। দক্ষিণায়ন সংক্রান্তিতে গঙ্গায় অবগাহনে যে পুণ্য হয়, উত্তরায়ণে তার দশগুণ ফল পাওয়া যায়। যুগাদ্যা, মাঘীসপ্তমী, ভীমাষ্টমী, অশোকাষ্টমী, রামনবমী, দশহরা, দশমী, মহাবারুণীতে গঙ্গাস্নান অসংখ্য পুণ্যলাভের জন্ম দেয়। অর্ধোদয়যোগের গঙ্গাস্নান সূর্যগ্রহণে স্নানের থেকে শতগুণ বেশি পুণ্যবান।

বৈষ্ণব ছাড়া সকলেই গঙ্গাস্নান কালে সংকল্প করে থাকেন। হরিভক্তরা কেবল বিষ্ণুর প্রীতি লাভ করতে চায়। বেদের মত অনুসারে, গুরুর মুখ থেকে বিষ্ণুমন্ত্র শ্রবণ করলে শিষ্য হয় এবং বৈষ্ণবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিষ্ণুমন্ত্র জীবন্মুক্ত। সে বৈষ্ণবের পিতার কুলের উপরের দিকের একশো পুরুষ এবং মাতার কুলের একশো পুরুষ, নিজের সঙ্গে উদ্ধার পায়। বৈষ্ণবদের পা ধোয়া জল যেখানে পড়ে সেই স্থান

তীর্থস্থানের মত পবিত্র হয়। বৈষ্ণবরা বিষ্ণুকে অন্নজল নিবেদন করে নিজ আহারে নিযুক্ত হন, নতুবা। সেই অন্ন-জল বাহ্য-মূত্রের সমান হয়। বিষ্ণুর পা ধোয়া জল যে রোজ পান করে তার পায়ের স্পর্শে ত্রিভুবন পবিত্র হয়। যারা সন্তান, বিষয় আশয় সকলই বিষ্ণুকে উৎসর্গ করেন তারা বৈষ্ণবদের মধ্যে অগ্রগণ্য। যারা বিষ্ণুর গুণগানে আনন্দিত হন, চিত্তে পুলকিত হন, অশ্রুসিক্ত হন বিষ্ণুনামে তারাই বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ। ব্রহ্মা থেকে চরাচর সকলই বিষ্ণু হতে সৃষ্ট। মহাপ্রলয়ের সময় অসংখ্য কোটি ব্রহ্মান্ড, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব সকলেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণে মিলিয়ে যান। একথা যারা জানেন ও মানেন তারাই বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ।

সুরেশ্বরী গঙ্গা জানতে চাইলেন হে নাথ, আপনার আদেশে, সরস্বতীর অভিশাপে এবং রাজেন্দ্র, ভগীরথের তপস্যাঁতে আমি নিশ্চয়ই মর্তে যাব। কিন্তু আমি পাপীদের পাপ গ্রহণ করে কিভাবে মুক্ত হব! আমাকে এভাবে কত সময় ধরে পৃথিবীর বুকে পড়ে থাকতে হবে? কবে আমি আবার আপনার চরণে ঠাঁই পাব! আমাকে বলুন। শ্রী কৃষ্ণ বললেন–হে দেবী, তুমি লক্ষ্মী স্বরূপা। আমারই অংশ স্বরূপ লবণাক্ত সমুদ্র হবে তোমার স্বামী। কলিযুগের পাঁচ হাজার কাল ব্যাপী তুমি নদীরূপে ভারতে অবস্থান করবে। তুমি নিজে রসিকা, তাই শ্রেষ্ঠ রসিক সমুদ্রের সঙ্গে তোমার রতিসুখ, সম্পন্ন করবে। তুমি মর্তবাসীদের কাছ থেকে পুজো পাবে। কৌথুমশাখায় বর্ণিত তোমার ধ্যানই তোমার পুজোর স্তব হবে।

প্রতিদিন যে গঙ্গাস্তব ও প্রণাম করে সে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান ফল লাভ করে। গঙ্গানামে পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। হাজার হাজার পাপীর পাপ গ্রহণ করে তুমি পূর্ণ হবে। আমার ভক্তের স্পর্শে সেই পাপ লীন হয়ে যাবে। যেখানে যেখানে আমার গুণকীর্তন করা হবে, সেখানে সেখানেই নিজের পাপ মোচনের জন্য সরস্বতী ইত্যাদি শ্রেষ্ঠ নদীগুলির সঙ্গে তুমি যুক্ত থাকবে। সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে কেউ যদি হরিনাম নিয়ে তোমার জলে ডুবে মরে, তবে সে বৈকুণ্ঠধামে যাত্রা করবে। অন্য কোথাও কেউ তোমার নাম স্মরণ করে মারা গেলে, সে পাপ মুক্ত হয়ে যাবে। হরিনামের নৈবেদ্য দান করলে মানুষ সত্যিকারের মুক্তি লাভ করবে। জীবমুক্ত হয়ে যাবে ও স্বর্ণরথে চেপে মৃত্যুর পর গোলোকধামে যাত্রা করবে।

তারপর শ্রীহরির আদেশে রাজেন্দ্র ভগীরথ কৌথুমশাখায় বর্ণিত ধ্যানে গঙ্গাদেবীর পুজো করলেন। শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হলেন।

নারায়ণ বললেন– হে নারদ! রাজা ভগীরথ কোন ধ্যান, স্তব ও বিধি মেনে গঙ্গাদেবীর পুজো করেছিলেন, এখন তবে তা বলছি। স্নান সেরে নিত্য ক্রিয়া শেষে শুদ্ধ কাপড়ে গণেশ, সূর্য, অগ্নি, বিষ্ণু, শিব ও শিবা– এই ছয় দেবতার পুজো করতে হবে। জ্ঞান ও বুদ্ধি লাভের কামনা করে মানুষ শিব দূর্গার পুজো করে।

দেবী গঙ্গা শ্রীকৃষ্ণের দেহ থেকে তৈরি হয়েছিলেন। শ্রেষ্ঠ সতী, শ্রীকৃষ্ণ তুল্য। তার গাত্র বর্ণ চাপা ফুলের মতো। তিনি পাপ নাশকারী। আগুন রঙা শুদ্ধ বস্ত্র পরিহিতা। মূল্যবান অলংকারে ভূষিতা। তাঁর দেহের জ্যোতি শরৎকালের একশ পূর্ণ চন্দ্রকেও হার মানায়। স্বল্প স্মিতহাসিনী, সুস্থিরা ও নিত্যযৌবনা। তার মাথায় মস্ত বড় খোঁপা, মালতী ফুলে সজ্জিতা। কপালে চন্দনের তিলক ও সিন্দুর বিন্দু। দুটি বাঁকানো চোখে বিদ্যুৎ দৃষ্টি। পদপদ্মে শোভিত নূপুর ও আলতা রাঙা চরণ কমল যা মুমুক্ষুদের মুক্তি দান করে। কামীদের স্বর্গ ও ভোগ দেন। এই দেবী বরণীয় ও দয়াবতী। ইনি ভক্তদের কৃপা করেন।

যে মানুষ মঙ্গলময়ী ত্রিপথ গামিনী গঙ্গার ধ্যান করে আসন, পাদ্য, অর্ঘ্য, স্নানীয়, অনুলেপন, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, তাম্বুল, ঠান্ডাজল, কাপড়, অলংকার, মালা, সুগন্ধী, শয্যা ও আচমনীয় –এই ষোলো উপাচারে গঙ্গা পুজো করেন, তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল ও পুন্য লাভ করেন।

নারদ বললেন– হে ভগবান, আপনি আমাকে বিষ্ণুপদী গঙ্গার পাপ নাশক ও পুন্যকরণ স্তোত্রের কথা বলুন। শ্রীনারায়ণ বললেন, শ্রীকৃষ্ণের ও রাধার অঙ্গ গলে যে গঙ্গার উৎপত্তি, আমি তাকে বন্দনা করি। আমি সেই গঙ্গা দেবী কে স্মরণ করি, যিনি পুণ্য রাধা মহোৎসবে গোপ গোপীতে পরিব্যাপ্ত হয়ে কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে জন্মেছিলেন। আপনি লক্ষ্য যোজোন বিস্তৃত, দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ যোজোন দীর্ঘ এবং সমগ্র বৈকুণ্ঠধাম পরিবেষ্ঠিত হয়ে আছেন, আপনাকে প্রণাম জানাই। চন্দ্রলোক, সূর্যলোক, তপোলোক, জনলোক পরিবেষ্টিত, গঙ্গাদেবীকে আমি প্রণাম জানাই। হাজার যোজোন বিস্তৃত কৈলাস পর্বতকে যে গঙ্গাদেবী আবৃত করে আছেন, তাকে আমি প্রণাম জানাই। যিনি দশ যোজোন বিস্তৃত, ও একশ যোজন দীর্ঘ হয়ে ভোগবতী নামে প্রবাহিত সেই গঙ্গাদেবীকে আমি প্রণাম জানাই। একশো ক্রোশ ব্যাপী বিস্তৃত হয়ে অলকানন্দা নামে পরিচিত গঙ্গা দেবীকে আমি প্রণাম জানাই। সত্যযুগে যিনি ক্ষীরবর্ণা, ক্রেতা যুগে যিনি চাঁদের মতো, দ্বাপরে চন্দনের মতো শুভ্র, সেই গঙ্গাকে আমি নমস্কার জানাই।

কলিযুগে আপনি ভারতের মাটিতে প্রবাহিনী রূপে বিরাজমান, আপনি পাপ বিনাশিনী, আপনি পুন্য দানকারী– আপনাকে প্রণাম জানাই। আপনার জলকণা স্পর্শে ব্রহ্মাহত্যার ন্যায় কোটি জন্মের পাপের বিনাশ ঘটে, আপনি সেই দেবী গঙ্গা, আপনাকে জানাই শত কোটি প্রণাম।

নারায়ণ বললেন–এইভাবে একুশটি শ্লোকে গঙ্গা দেবীর স্তোত্রকথা কৌধুমশাখায় বর্ণিত হয়েছে। এই সকল স্তব পুণ্য বীজস্বরূপ সকল পাপের বিনাশ ঘটায়। যে লোক নিত্য গঙ্গাদেবীর অর্চনা করে এবং ভক্তিভরে তার স্তব পাঠ করে, তার অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পুণ্য লাভ হয়। এই স্তব পাঠের গুণে পুত্রহীন পুত্র পায়, স্ত্রীহীন স্ত্রী পায়, রোগী হয় সুস্থ সবল, মুখ পান্ডিত্য অর্জন করে, কীর্তিহীন কীর্তি লাভ করে। প্রাতঃকালে নিত্য গঙ্গাস্তব পাঠ নিত্য গঙ্গাস্নানের সমান সুফল দেয়।

ভগীরথের স্তব পাঠে গঙ্গাদেবী তুষ্ট হলেন। সগরের ছেলেরা যেখানে ভঙ্গ হয়ে পড়ে আছে, সেখানে গঙ্গা গেলেন। তার বায়ুর স্পর্শে সগরের আট হাজার পুত্র উদ্ধার পেলেন। তাদের আশ্রয় মিলল, বৈকুণ্ঠধামে। মর্ত্যে গঙ্গাদেবীকে এনেছিলেন ভগীরথ, তাই গঙ্গাদেবীর অপর নাম ভাগীরথী।

নারায়ণ বললেন–পুণ্যদায়ক ও মোক্ষদায়ক গঙ্গাদেবীর উপাখ্যান তোমাকে বললাম। শিবের সঙ্গীতে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ ও মহাপ্রকৃতি রাধাদেবী দ্রবীভূত হওয়ার পর কী ঘটনা ঘটেছিল তা এখন বর্ণনা করছি শোনো। –হে নারদ! কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে গোলোকধামে মহা ধুমধামের সঙ্গে রাধা মহোৎসব পালিত হল। শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে প্রথম পুজো করলেন। তখন ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবতারা রাধাকে পুজো নিবেদন করেন। সরস্বতী তার বীণার তারে ঝংকার তুললেন। শ্রীকৃষ্ণ শুরু করলেন কীর্তন। হরিগান শুনে ব্রহ্মা তুষ্ট হলে তিনি সরস্বতাঁকে শ্রেষ্ঠ রত্নের তৈরি হার ও মুকুট উপহার দেন। কৃষ্ণ কৌস্তভমনি, রাধা অমূল্য রত্ন নির্মিত হার, ভগবান নারায়ণ মনোহার বনমালা এবং লক্ষ্মী অমূল্য রত্নের মকারাকার কুন্ডল সরস্বতাঁকে উপহার দিলেন। দূর্গা দিলেন অত্যন্ত দুর্লভ ভক্তি, ধর্ম দিলেন ধর্ম, বুদ্ধি ও যশ। আগুনের মতো পট্টবস্ত্র, দান করলেন অগ্নিদেব। মণিনির্মিত নূপুর বায়ু তাঁকে দিলেন।

শিব ব্রহ্মার অনুরোধে গাইলেন রসোল্লাস মিশ্রিত শ্রীকৃষ্ণের গান। সেই গানে দেবতারা সম্মোহিত হলেন। দেবতারা সকলেই হলেন একেবারে স্থির মূর্তি। কিছুক্ষণ পর তাদের হুশ হ’ল। দেখলেন রাসমন্ডলের স্থলভাগ জলে পরিপূর্ণ। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা হয়েছিলেন অন্তর্হিত। ধ্যানযোগে ব্রহ্মা জানতে পারলেন শিবগানের মহিমায় শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা দ্রবীভূত হয়েছেন। ব্রহ্মা, শিব ও সকল দেবতারা তখন শ্রীকৃষ্ণের স্তব করতে শুরু করলেন। হে বিভু! আপনি স্বমূর্তি ধারণ করুন। আমাদের অভীষ্ট পূরণ করুন।

হঠাৎ দৈববাণী শোনা গেল– আমি সকলের পরমাত্মা স্বরূপ। আর দেবী রাধা শক্তিস্বরূপিনী। তাই আমাদের শরীর ধারণ নিষ্প্রয়োজন। বৈষ্ণব, মনু, মুনি, মানব — সকলেই আমার মন্ত্র বলে পবিত্র হয়ে আমার ভবনে আসবে। হে দেবতারা তোমরা যদি আমার মূর্তি প্রত্যক্ষ করার জন্য উতলা হও, তাহলে অপেক্ষা কর। হে ব্রহ্মা, তুমি স্বয়ং বিধাতা। জগৎ গুরু শিব অতি মনোহর বেদাঙ্গ স্বরূপ শাস্ত্র রচনা করবেন। সেই শাস্ত্রে পুজোর বিধি, মন্ত্র, ধ্যান, স্তব, স্তোত্র, কবচ সব কিছুর কথা লেখা থাকবে। যা অভিলষিত বস্তু দান করবে। আমার মন্ত্র, কবচ, ধ্যান, তোমরা লাভ করবে। এই মন্ত্র অত্যন্ত দুর্লভ ও গোপনীয়। হাজার জনের মধ্যে একজন এই মন্ত্রের উপাসক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে। সে আমার মন্ত্র উচ্চারণে পবিত্র হয়ে গোলোকধামে প্রবেশ করবে।

এই আকাশবাণী শ্রবণে ব্রহ্মা অত্যন্ত উল্লসিত হলেন। তার অনুরোধে শিব বেদাঙ্গ শাস্ত্র রচনা করতে স্বীকার করলেন। মহাদেব প্রতিজ্ঞা করলেন, বিষ্ণুমায়াদি ও মন্ত্র প্রভৃতি যুক্ত বেদসার উত্তম শাস্ত্র রচনা করে আমি শ্রীকৃষ্ণের আদেশ ও আমার কথা রাখব।

এই কথা শুনে গোলোকপতি শ্রীকৃষ্ণ সন্তুষ্ট হলেন। তিনি রাধাকে সঙ্গে নিয়ে দেবসভায় আবির্ভূত হলেন। দেবতারা আনন্দিত হলেন। রাধা ও কৃষ্ণের দেহ থেকে বিগলিত গঙ্গা গোলোকে উৎপন্ন হল। গঙ্গাদেবী সমগ্র গোলোকে ও ব্রহ্মান্ডে পূজিতা হলেন।

.

একাদশ অধ্যায়

সৌতি বললেন– হে মুনিশ্রেষ্ঠ নারদ! আপনার ইচ্ছা অনুসারে নারায়ণ সুরশ্রী গঙ্গার শাপমোচনের কথা শোনাবেন। নারায়ণ বললেন–কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর শেষ হলে গঙ্গার অভিশাপ কেটে যাবে। তিনি বৈকুণ্ঠধামে ফিরে যাবেন। শ্রীহরির কাছে। গঙ্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী ছাড়াও অপর শ্রীহরির স্ত্রী তুলসীর কথাও বেদে বলা হয়েছে। তুলসী রাধাকৃষ্ণ স্বরূপা। ইনি অসামান্যা সুন্দরী। নানা অলংকারে ভূষিতা। মুখশ্রী যেন শরতের দুপুরে ফোঁটা পদ্ম। তিনি স্নিগ্ধ ও স্মিতহাসিনী। তার গায়ের রঙ যেন গলানো সোনা। কপালে অতি সুন্দর চন্দন ও সিঁদুর ফোঁটা। বন্দুক ফুলের মতো লাল দুটি ঠোঁট। দুটি বসনে তার দেহ আবৃত। শ্রীকৃষ্ণের রূপ সৌন্দর্য্যে তিনি আলোড়িত হলেন ও অপলক চোখে সেই রূপ সুধা পান করলেন। অতঃপর তিনি বাহ্যজ্ঞান শূন্য হলেন। সে সময়ে রাধিকা তার তিরিশ কোটি গোপিনীকে সঙ্গে করে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। রাধিকার আঁখি পল্লব কোটি চন্দ্রের মতো, তার গলায় দুলছে অমূল্য রত্নহার। কটিবন্ধে পীত রঙের দুটি কাপড়। কপালে তার কস্তুরি বিন্দুযুক্ত গোলাকার চন্দন তিলক ও সিন্দুর ফোঁটা সুসজ্জিত। খোঁপায় পারিজাত ফুলের মালা। তিনি রাগে কুঁসছিলেন। তিনি এসে শ্রীকৃষ্ণের পাশে রত্নসিংহাসনে উপবেশন করলেন। সখীরা সাদা চামর দিয়ে বাতাস করতে লাগল।

শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্তব করলেন। সভাস্থ সকলে তাঁর বন্দনা গাইলেন। গঙ্গা ভয়ে ভয়ে শ্রীরাধাকে, সম্ভাষণ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ গঙ্গাকে অভয় দিলেন।

গঙ্গা কিছু সময় পর অপর এক রাধাকে দেখলেন। এ রাধা ব্রহ্মতেজে উদ্ভাসিতা নবযৌবনা শান্ত। ও কোমল। ইনি অনন্ত স্বরূপা, আদি ও অন্তহীন প্রকৃতি। তিনি কৃষ্ণের প্রাণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, প্রাণাধিকা প্রিয়া। এই রাধা নিত্যা মাননীয়া এবং ধন্যা, এই রাধার রূপ সৌন্দর্য দেখে যেন গঙ্গার আশা মিটছে না। তিনি অপলক চোখে রাধার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

শান্ত বিনয়ী রাধা শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে বললেন–হে প্রাণনাথ, এই নারীর পরিচয় কি? ও যেভাবে তোমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, তাতে পরিষ্কার বুঝতে পারছি, এই নারী তোমার প্রতি কামাসক্ত হয়ে পড়েছে। তাই বারবার কাপড়ের আড়ালে মুখ ঢাকছে। তুমিও ওকে দেখে মুচকি হাসছ! কিন্তু আমি থাকতে তোমার এই রকম দুবৃত্তাচরণ কিছুতেই সহ্য করব না। নারীর মন নরম হয়। আমিও এর

একদিন তুমি চন্দনবনে বিরজার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলে। আমার সাড়া পাওয়া মাত্র, তুমি সেখান থেকে অন্তর্হিত হয়েছিলে। আর বিরজা নদী রূপ ধারণ করে। তোমার হাহাকার শুনে বিরজা স্বমূর্তি ধারণ করে। তোমরা পুনরায় মিলিত হও। তোমার বীর্যে বিরজার গর্ভে সাত সাগরের সৃষ্টি হল। আজও বিরজা কোটি যোজন বিস্তৃত ও চার যোজন দীর্ঘ নদী হয়ে বয়ে চলেছে।

আরও একদিন চন্দন বনে তুমি শোভা নামে এক গোপিনীর সঙ্গে দেহ সম্ভোগে লিপ্ত হও। আমার উপস্থিতিতে তুমি অদৃশ্য হও। আর শোভা প্রাণ ত্যাগ করে চন্দ্রমন্ডলে চলে যায়। তার দেহরূপের স্নিগ্ধতা তেজে পরিণত হল। তোমারই কৃপায় সেই তেজ পাকা ফল, রত্ন, সোনা, চন্দন, নতুন পাতা, শষ্য, উত্তম বস্ত্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গিয়ে বিলীন হয়ে গেল।

একদিন বৃন্দাবনে গোপিনীর সঙ্গে তোমাকে ঘনিষ্ঠ হতে দেখেছিলাম। এরপর তুমি অদৃশ্য হলে প্রভা প্রাণ ত্যাগ করে সূর্যমণ্ডলে গমন করেছিলো। প্রভার তেজ তুমি বক্ষে ধারণ করে আগুন, রাজা, মানব, মুনি, দস্যু, সাপ, দেবতা, তপস্বী, ভাগ্যবতী নারী, কীর্তিমান পুরুষের মধ্যে বিলিয়ে দিলে। সকলেই তোমার দান গ্রহণ করে শক্তিশালী হয়ে উঠল।

এরপর রাসমন্ডলে শান্তি গোপিনীর সাথে তোমাকে প্রেমালাপে মগ্ন থাকতে দেখেছি। তুমি ফুলের শয্যায় শায়িত। পুষ্প অলংকারে সজ্জিত তুমি! রত্ন অলংকারে ভূষিতা ওই গোপিনীর সাথে সোনার মন্দিরে বিহার করছিলে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তুমি অদৃশ্য হলে। শান্তি দেহত্যাগ করে তোমার সঙ্গে মিশে গেল। তুমি তার দেহ থেকে লব্ধ শ্রেষ্ঠ গুণ গুলির কিছু কিছু বিষ্ণু, লক্ষ্মী, বৈষ্ণব, তপস্বী, ধার্মিক ও ভক্তদের মধ্যে ভাগ করে দিলে।

আর একদিনের কথা। কন্যার সঙ্গে সঙ্গম সুখে তৃপ্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। আমি তোমাদের ঘুম ভাঙাই। রাগে তোমার ভূষণ, বাঁশি কেড়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু সখিদের অনুরোধে আর প্রেমের বশে আবার সেগুলি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। লজ্জায় তুমি মুখ লুকিয়েছিলে। ক্ষমা দেহত্যাগ করলে তার দেহের গুণ গুলি তুমি বিলিয়ে দিলে বিষ্ণু, বৈষ্ণব, ধার্মিক, দুর্বল তপস্বী, ও দেবতাদের মধ্যে।

রাগে রাধা ফুসছিলেন। গঙ্গার মাথা লজ্জায় অবনত হল। রাধা তাঁকে কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় গঙ্গা সিদ্ধ যোগে তা বুঝে ফেললেন ও দেবসভা ছেড়ে জলের মধ্যে মিশে গেলেন। রাধাও নাছোড়। যোগ বলে তিনিও সব জেনে ফেলে এখান সেখান থেকে গঙ্গার জল গন্ডুষ ভরে পান করলেন। গঙ্গা যোগবলে তা জানতে পেরে শ্রীকৃষ্ণের পদকমলে আশ্রয় নিয়ে লীন হয়ে গেলেন। রাধা গোলোক, বৈকুণ্ঠ ধাম, ব্রহ্মলোক সর্বত্র গঙ্গাকে খুঁজে বেড়ালেন, কিন্তু দেখা পেলেন না।

এদিকে জল সঙ্কট দেখা দিল। রাধা জল পান করেছেন। সব জায়গা শুকিয়ে কাঠ। জীবজন্তু, গাছপালা সব একে একে জলাভাবে মরতে শুরু করল। দেবতাদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল। ব্রহ্মা শিব বিষ্ণু সকল দেবতা যোগী, তপশী সকলে শ্রীকৃষ্ণের স্মরণ নিলেন। শ্রীকৃষ্ণ যিনি সকলের প্রভু, প্রকৃতি থেকে আলাদা। যিনি নির্লিপ্ত, নিরাশ্রয়, নির্গুণ, নিরুৎসাহ, নিরঞ্জন। যিনি সাকার, স্বেচ্ছাধীন, ভক্তবৎসল, অশ্রুসজল, শক্তিময় রূপ সনাতন। দেবতারা ভগবান শ্রীহরির স্তব করলেন। তারা প্রত্যক্ষ করলেন রত্ন খচিত সিংহাসনে উপবিষ্ট সেই মনোহরা রূপময় জ্যোতির্ময় শ্রীকৃষ্ণ। গোপরা তাকে চামর দিয়ে বাতাস সেবন করছে। গোপিনীরা তাকে পরিবেষ্টন করে আছেন। নৃত্য প্রদর্শন করছেন। সেই মূর্তি কিশোর, আর শ্যামবর্ণের। পরণে তার পীত বস্ত্র। শ্রীকৃষ্ণ যেন এক বারো বছরের বালক। গোপাল রূপ ধারণ করেছেন। প্রভু যেন নিজের প্রভায় সমুজ্জ্বল গোপীরা তার রূপসুধা পান করছেন। রাধিকা তার বুকে প্রাণাধিক প্রিয়া হয়ে শোভা পাচ্ছেন। রাসমন্ডলের সর্বত্র দেবতারা এই দৃশ্যই প্রত্যক্ষ করলেন।

সকলে আনন্দে মেতে উঠলেন। দেবতারা ঠিক করলেন, ব্রহ্মা পরমাত্মার সঙ্গে কথা বলবেন। ব্রহ্মা এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, শ্রীকৃষ্ণের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছেন বিষ্ণু। শিব দুটি আসনে বসে আছেন। রাসমন্ডলের সর্বত্র কৃষ্ণময়। সবাই সমান বেশ ধারণ করেছেন। সকলের পোশাক, অলংকার, গুণ, তেজ বয়স, কার্য, কীর্তি, যশ সবই একরকম, কোনো প্রভেদ নেই। এর মধ্য থেকে প্রভুকে খুঁজে বের করা কঠিন। কখনও কৃষ্ণ রাধার রূপ ধরছেন, কখনও রাধা কৃষ্ণ হয়ে যাচ্ছেন।

ব্রহ্মা পড়লেন ধাঁধায়। তিনি মনকে ধ্যানস্থ করে হৃৎকমলের শ্রীকৃষ্ণকে ভক্তিভরে ধ্যান করলেন। নিজের অপরাধের জন্য দোষ স্বীকার করে নিলেন। শ্রীকৃষ্ণের আদেশে তিনি চোখ মেললেন। দেখলেন রাধার বুকে শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণ পরিব্যপ্ত হয়ে আছেন সহচর ও গোপীদের দ্বারা। সকল দেবতা কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালেন। কৃষ্ণের স্তব পাঠ করলেন।

শ্রীকৃষ্ণ সকল দেবতাদের মনের কথা বুঝতে পারলেন। বললেন–আমি জানি কেন আপনারা সকলে মিলে আমার কাছে এসেছেন। রাধার ভয়ে ভীত হয়ে গঙ্গা আমার চরণ কমলে স্থান নিয়েছে। কিন্তু আপনারা যদি অভয় দেন তবে গঙ্গাকে আমি সম্মুখে আনতে পারি।

শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে সকল দেবতাগণ রাধার স্তব করতে শুরু করলেন। পরম ভক্তিতে চতুর্মুখ ব্রহ্মা রাধার স্তুতি বন্দনা করলেন। তারপর ব্রহ্মা বললেন–রাসমন্ডলের যথোৎসবে শিব সংগীত আপনাকে ও শ্রীকৃষ্ণকে এতই মুগ্ধ করে যে, আপনারা গলে জল হয়ে যান। আর সেই জলস্রোতই হ’ল গঙ্গা। তাই গঙ্গা আপনার দুহিতা তুল্য। সে আপনার মন্ত্র পাঠ করে আপনাকে পুজো করবে ও চার হাত বিশিষ্ট নারায়ণের পত্নী হবে। বৈকুণ্ঠ হবে তার বাসস্থান। অতঃপর গঙ্গা অংশ স্বরূপ হয়ে মর্তে অবতীর্ণ হলে, তখন সে হবে লবণ সমুদ্রের পত্নী। হে দেবী, জগদম্বিকা! আপনিই যেই দেবী যিনি বিস্তৃত জায়গা জুড়ে গোলোকে অবস্থান করছেন। গঙ্গা কেবল আপনার দেহ জাত, আপনার অংশেই যার জন্ম। আপনার কন্যা।

ব্রহ্মার কথা শুনে রাধা সন্তুষ্ট হলেন। রাধার শান্ত ও স্মিত হাস্যে পরিবেশ সহজ হয়ে উঠল। শ্রীকৃষ্ণের পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের ডগা থেকে বেরিয়ে এল গঙ্গা। জলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী গঙ্গা শান্ত ভাবে জল ছেড়ে উঠে এলেন। ব্রহ্মা নিজের কমন্ডলুতে কিছুটা জল ধরে রাখলেন। শিব, তার জটায় কিছুটা জল ধারণ করলেন। গঙ্গা লাভ করলেন রাধামন্ত্র ও রাধার স্তব ধ্যান করা পূজোর বিধি অনুসরণ করে রাধার স্তব করলেন। তারপর ফিরে গেলেন নিজের জায়গায়। এইভাবে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গঙ্গা এবং বিশ্বপাবনী তুলসী এই চার কন্যাই হলেন নারায়ণের পত্নী।

শ্রীকৃষ্ণ এবার উপস্থিত দেবতাদের দুর্বোধ কালের কাহিনী শোনালেন। বললেন– হে ব্রহ্মা, হে শিব, হে বিষ্ণু, হে দেবতাগণ, মুনি, তপস্বীগণ যাঁরাই আমার স্মরণ নিয়েছেন, তারাই আমার কাছে ঠাঁই পেয়েছেন। কিন্তু এখন কালচক্রের নিয়মানুসারে প্রকৃত প্রলয় শুরু হতে চলেছে। সমস্ত বিশ্ব জলে ডুবে যাবে। সকল দেবতারা পতনের ভয়ে আমার মধ্যে লীন হয়ে যাবে। হে পদ্মযোনি ব্রহ্মা, গঙ্গার পথ রুদ্ধ করো। বৈকুণ্ঠ ছাড়া অন্যান্য সব লোকই জল প্লাবিত হয়ে গেছে। হে ব্রহ্মা, আপনি নিজ জায়গায় ফিরে যান। সৃষ্টির কাজ শুরু করুন। ব্রহ্মলোক সমেত এক একটি স্বতন্ত্র বিশ্ব সৃষ্টি হবে। ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি হলে আমিও নিজ কার্যে ব্রতী হব।

শ্রীকৃষ্ণ সভাস্থল ত্যাগ করলেন। দেবতারা ফিরে গেলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে। শুরু হল সৃষ্টির কাজ। পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের আদেশে গঙ্গাকে পূর্বের দেহ ধারণ করেই প্রবাহিত হতে হল। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বৈকুণ্ঠ, গোলোক, শিবলোক ও ব্রহ্মলোক জুড়ে অবস্থান করতে থাকলেন। শ্রী বিষ্ণুর পাদপদ্ম থেকে গঙ্গার জন্ম হয়েছে বলে, গঙ্গার অপর নাম বিষ্ণুপদী। নারায়ণ বললেন–হে দেবর্ষি নারদ, এই হল মোক্ষ ও সুখ প্রদায়িনী গঙ্গার বৃত্তান্ত, বলো, আর কিছু জানতে চাও।

.

দ্বাদশ অধ্যায়

নারদ জানতে চাইলেন, “গঙ্গা বৈকুণ্ঠে যাত্রা করলে ব্রহ্মাও তার সঙ্গে গেলেন। তারা জগতের প্রভু বিষ্ণুর পাদপদ্ম বন্দনা করে প্রণাম জানালেন। গঙ্গার প্রশস্তি করে ব্রহ্মা বললেন, হে প্রভু শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণের অবগলিত জলে এই গঙ্গার উৎপত্তি। এই গঙ্গা শান্ত, নবযৌবনা, ক্রোধ ও অহংকার শূন্য। ইনি শ্রেষ্ঠ শুদ্ধ সত্ত্বস্বরূপা। গঙ্গা শ্রীকৃষ্ণকেই পতি রূপে বরণ করতে চাইছেন। কারণ, শ্রীকৃষ্ণ থেকেই তার উৎপত্তি। কিন্তু শ্রীরাধা তাতে বাদ সাধছেন। মহা তেজস্বিনী রাধা গঙ্গাকে গন্ডুযে পান করতে চাইলে গঙ্গা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে আশ্রয় নেন। ফলতঃ সমগ্র গোলোক ও ত্রিভুবন জলশূন্য হয়ে পড়ে। অতঃপর দেবতাদের অনুরোধে ও শ্রীরাধার কৃপায় শ্রীকৃষ্ণ তার পাদপদ্ম থেকে গঙ্গাকে মুক্তি দেন। আমি গঙ্গাকে তখন রাধামন্ত্র দান করি। গোলোক ধাম থেকে তাকে নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। হে প্রভু, আপনি এই রসিকা সুরেশ্বরী গঙ্গাকে গান্ধর্ব মতে বিবাহ করুণ। সমস্ত দেবতা এবং পুরুষের মধ্যে আপনি রত্ন স্বরূপ আর এই গঙ্গাও স্ত্রীরত্ন স্বরূপ, আপনারা সুখী হবেন। যে পুরুষ এই কন্যাকে বিবাহ না করে অহংকার বশতঃ দূরে সরিয়ে দেন, সে পুরুষ মহালক্ষ্মীর কোপে পড়বে। পন্ডিতেরা জানেন প্রকৃতিই সমগ্র পুরুষের সৃষ্টি দাতা। নারী সেই মাতা প্রকৃতিরই অংশ। তাই নারী মাতা প্রকৃতির অংশ স্বরূপা। আপনি এমত নারীকে অবহেলা করবেন না। তিনি আরও বললেন––হে ভগবান! পরমাত্মার দুই ভাগের বাম অঙ্গ দুই হাত বিশিষ্ট কৃষ্ণরূপ ধারণ করে আর ডান অঙ্গ চার হাত বিশিষ্ট শ্রীবিষ্ণুর রূপ ধারণ করে। তার বামদিক থেকে রাধা ও কমলার উৎপত্তি। সেইরকম ডান দিক থেকে গঙ্গার আবির্ভাব। আপনিই গঙ্গার জন্মদাতা। সুতরাং গঙ্গা আপনাকে পতিরূপে গ্রহণ করতে চায়।

গঙ্গাকে শ্রীবিষ্ণুর হাতে সমর্পণ করে এরপর ব্রহ্মা ফিরে আসেন। বিষ্ণু গঙ্গাকে গান্ধবৰ্মতে মন্দিরে বিবাহ করে ভার্যারূপে গ্রহণ করেন। ফুল সজ্জিত চন্দন চর্চিত শয্যায় তাঁরা রতিসুখে প্রবৃত্ত হলেন।

‘গাং’ শব্দের অর্থ স্বর্গ। নির্দিষ্ট কাল মর্ত্যে যাপন করে তিনি আবার স্বর্গে ফিরে গিয়েছিলেন, তাই তিনি গঙ্গা। বিষ্ণুর পা থেকে উৎপত্তি বলে তার অপর নাম বিষ্ণুপদী। বিষ্ণুর সঙ্গে রতিসুখে মিলিত হবার পর গঙ্গা সুখ শিহরণে মূচ্ছা গেলেন। এমতাবস্থায় গঙ্গার সতীন লক্ষ্মীদেবী ঈর্ষান্বিতা না হলেও অপর সতীন দেবী সরস্বতী তা মেনে নিতে পারলেন না। নারায়ণ পরে তুলসীকেও বিবাহ করেন। ফলে তাঁর পত্নীর সংখ্যা হয় চার লক্ষ্মী, সরস্বতী, গঙ্গা ও পতিত পাবনী তুলসী।

.

ত্রয়োদশ অধ্যায়

সৌতি বললেন–হে শৌনক, এবার আপনাকে সতী তুলসীর উপাখ্যান বলছি। নারদের অনুরোধে নারায়ণ এই উপাখ্যান শুনিয়েছিলেন।

বিষ্ণু অংশ হতে এক মনু উৎপন্ন হন। নাম তার দক্ষ সাবর্ণি। তিনি বিষ্ণুভক্ত, পবিত্র, যশস্বী, কীর্তিমান ও পুণ্যবান। তাঁর পুত্র ধর্মসাবর্ণিও বিষ্ণুর উপাসক ও ধার্মিক ছিলেন। তাঁর পুত্র বিষ্ণু সাবর্ণি, তাঁর পুত্র দেব সাবর্ণি ও তার পুত্র রাজ সাবৰ্ণি — এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক ও ধার্মিক। রাজ সাবৰ্ণির পুত্রের নাম বৃষধ্বজ। তিনি ছিলেন ভগবান শিবের অনুগামী। মহাদেব বৃষধ্বজকে নিজের পুত্রের ন্যায় স্নেহ করতেন। তাঁর কাছে মহাদেব দিব্য তিন যুগ কাটিয়েছিলেন।

রাজা বৃষধ্বজ ভগবান শিবের প্রতি ছিলেন অন্ধবিশ্বাসী। তার আদেশে রাজ্যে অন্যান্য দেবদেবীর পুজো বন্ধ করা হ’ল। ভাদ্রে লক্ষ্মী, মাঘে সরস্বতী পুজো সব বন্ধ হ’ল। বিষ্ণুর নিন্দায় তিনি মুখর হয়ে উঠলেন। দেবতারা তার প্রতি রুষ্ট হলেন। কিন্তু শিবউপাসক বলে দেবতাদের শাপশাপান্ত থেকে তিনি মুক্তি পেলেন। সূর্যদেব কিন্তু এ অপমান সহ্য করলেন না। তিনি রাগতঃ হলেন ও বৃষধ্বজকে অভিশাপ দিলেন–তুমি শ্রীহীন হও। শিব তখন ত্রিশুল উঁচিয়ে সূর্যদেব কে আক্রমণ করে বসলেন। ভীত সূর্য তখন পিতা কশ্যাপকে সব কথা জানালেন। পিতা পুত্র উভয়েই ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ক্রুদ্ধ শিব ত্রিশূল হাতে তাদের পিছু পিছু এলেন ব্রহ্মলোকে। শিবের তখন রণংদেহি মূর্তি। ব্রহ্মা, সূর্য ও কশ্যপ ভয়ে কাঁপতে থাকলেন। তারা অতঃপর বৈকুণ্ঠধামে শ্রীনারায়ণের কাছে এলেন। নারায়ণের স্তব করে প্রণাম জানালেন এবং আগমনের কারণ ব্যক্ত করলেন।

নারায়ণ তাঁদের অভয় দান করে বললেন– হে দেবতাগণ তোমরা শান্ত হও। আমার দ্বারাই জগৎ পালিত হয়। আমি একাধারে ব্রহ্মার রূপ ধরে সৃষ্টি করি আবার শিবের রূপ ধরে সংহার করি। বিপদে পড়ে যে আমার স্মরণ নেয়, আমি সুদর্শন চক্র নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হই। ভক্তকে আমি বিপদমুক্ত করি। তোমরা ভয় দূর করো। আমি তোমাদের বর দান করলাম। আজ থেকে মহাদেব তোমাদের আর ভয় দেখাবে না।

হে ব্রহ্মা! শিব হলেন শঙ্কর, আশুতোষ। তিনি সৎ লোকের মঙ্গল করেন। তিনি ভক্তের ঈশ্বর। শিব এই সুদর্শনচক্রের মত আমার কাছে প্রিয়। সে সারাক্ষণ আমার ধ্যান নাম ও গুণ কীর্তন করে। আমিও শিবের মঙ্গল চিন্তায় ব্যস্ত থাকি। কল্যাণের অধিষ্ঠাতা শিবকে জ্ঞানী লোকেরা পুজো করে থাকেন।

ঠিক এ সময়ে শিব সভাস্থলে এসে হাজির হলেন। তার চোখ দুটি রাগে রক্তজবা হয়ে আছে। বৃষের পিঠ থেকে শিব নেমে এলেন। অবনত মস্তকে নারায়ণকে প্রণাম জানালেন।

নারায়ণ রত্নসিংহাসনে বসে আছেন। নতুন মেঘের শ্যামবর্ণ তার গায়ের রঙ। মাথায় কিরীট, হাতে চক্র। গলায় বুনোফুলের মালা! সহচরেরা তার সেবা করছে। চামর দুলিয়ে বাতাস দিচ্ছে।

হে নারদ! পীতবস্ত্র পরিহিত চন্দন চর্চিত সেই দেবতা তখন লক্ষ্মীর দেওয়া তাম্বুল খাচ্ছিলেন। আর নৃত্য গীত উপভোগ করছিলেন।

শিব নারায়ণের পরে ব্রহ্মাকেও প্রণাম জানালেন। সূর্য ভীত চিত্তে শিবকে প্রণাম জানালেন। কশ্যপ শিবের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করলেন। তার স্তব করে তাকে নমস্কার করলেন।

সর্বেশ্বর নারায়ণের আদেশে শিব এক উত্তম আসনে উপবেশন করলেন। শ্রী বিষ্ণুর পারিষদবর্গেরা তাঁকে চামর দুলিয়ে বাতাস দিতে লাগল। শিব শান্ত হলেন। প্রসন্ন হলেন। পঞ্চমুখে। শিব নারায়ণের স্তব গান শুরু করলেন।

নারায়ণ শিবমুখে নিজ প্রশংসা শুনে অতীব তুষ্ট হলেন। তিনি অমৃততুল্য মধুর ভাষায় বললেন–হে শিব! তোমার কল্যাণের কথা জানতে চাওয়া মুখামি, কারণ তুমি নিজেই মঙ্গলময়। যে নিজে সমস্ত তপস্যার ফল দান করে, তার কাছে তার তপস্যার কথা জানতে চাওয়া নিরর্থক। যে নিজে জ্ঞান দান করে, তার কাছে তার জ্ঞান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করাও বৃথা। তোমার নিশ্চয় কোনো বিপদ হয় নি, কারণ তুমি নিজেই মৃত্যুঞ্জয়ী। সুতরাং, কুশল জিজ্ঞাসা না করেই জানতে চাইছি। কেন এমন হন্তদন্ত হয়ে তুমি এখানে ছুটে এসেছ!

শ্রীমহাদেব বললেন, হে ভগবান! আপনি তো সর্বজ্ঞ। আপনার কাছে কিছুই অজানা থাকবার কথা নয়। আমি যাকে প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসি আমার অন্ধ উপাসক বৃষধ্বজকে সূর্য অভিশাপ দিয়েছে। পুত্রকে অভিশাপ দিলে কোন পিতা স্থির থাকতে পারে বলুন। তাই সূর্যকে বধ করার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। সূর্য তার বাবা কাশ্যপের শরণাপন্ন হয়। কাশ্যপ ও সূর্য যান ব্রহ্মার কাছে। এখন সকলে মিলে আপনার আশ্রয়ে এসেছে। আপনার শরণাগতরা নিরাপদ ও নিঃশঙ্ক হয়। কিন্তু সূর্যের অভিশাপে শ্রীহীন বৃষধ্বজের কথা একবার চিন্তা করুন।

শ্রী ভগবান বললেন–শিব, তুমি আর দেরি না করে শীঘ্র রাজবাড়ি চলে যাও। বৈকুণ্ঠের অর্ধ ঘটিকা সময়েই একুশটি দিব্য যুগ অতিক্রম কালে বৃষধ্বজের মৃত্যু হয়েছে। তার ছেলে পুংসধ্বজ্ঞও শ্রীহীন অবস্থায় মারা গেছে। তার দুই ছেলে ধর্মধ্বজ ও কুশধ্বজ পরম বৈষ্ণব হওয়ায় প্রাণে বেঁচে গেছে। কিন্তু তারাও শ্রীহীন ও রাজ্যহীন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থাতেও তারা তপস্যায় রত রয়েছে। লক্ষ্মী অচিরেই তার অংশে তাদের স্ত্রীদের গর্ভে জন্ম নেবে। ফলতঃ তারা তাদের হৃত শ্ৰী ও রাজ্য পুনরায় ফিরে পাবে। শিব তুমি আর, দেরি কর না। এই বলে ভগবান নারায়ণ লক্ষ্মীকে নিয়ে অন্তর্ধান হলেন।

.

চতুর্দশ অধ্যায়

নারায়ণ বললেন–ধর্মধ্বজ ও কুশধ্বজ লক্ষ্মীদেবীর কঠিন তপস্যা করে তাদের হৃতরাজ্য ফিরে পেলেন। সন্তান ও ধনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল তাদের সংসার। কুশধ্বজের শ্রী সতী মালাবতী যথাসময়ে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেন। সে কন্যা লক্ষ্মী দেবীর অংশ স্বরূপা। সে কন্যা ছিল উত্তম জ্ঞান স্বরূপা। আতুর ঘরেই তিনি বেদমন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন। মনীষীরা-তার নাম রাখলেন বেদবতী। তপস্যা করার জন্য সে নির্জন অরণ্যে প্রবেশ করল। তাকে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু সে ছিল নারায়ণ পরায়ণা, সকলের কথা অগ্রাহ্য করে সে দীর্ঘকাল পুষ্কর তীর্থে তপস্যায় রত ছিলেন। তপস্যার ফলে তার শরীর ক্ষীণ হল না। উপরন্তু সে হল নবযৌবনা। তার উদ্দেশ্যে আকাশ থেকে দৈববাণী ভেসে এলহে সুন্দরী! আগামী জন্মে তুমি শ্রীহরির পত্নী হবে।

একথা শুনে বেদবতী রেগে গেলেন। তিনি গন্ধমাদন পর্বতে বসে গভীর তপস্যা শুরু করলেন। সেখানে একদিন দুর্নিবার রাবণ এসে উপস্থিত হলেন। বেদবতী অতিথি ভেবে তাকে বসতে বললেন। সুমিষ্ট ফল ও ঠান্ডা জল দিয়ে অতিথির সেবা করলেন। পাপিষ্ঠ রাবণ বেদবতীর প্রতি কামাসিক্ত হয়ে পড়ল। বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে সে বেদবতীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সতী বেদবতী তার দিকে কোপ দৃষ্টিতে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে রাবণ এক জড়জীবে পরিণত হল।

বেদবতী অভিশাপ দিয়ে বলল–আমার কোপে তোমার বংশে বাতি দেওয়ার কেউ থাকবে না। তোমার মত পাপিষ্ঠ কামাতুর পুরুষ আমার দেহ স্পর্শ করেছে। এ দেহ আমি বিসর্জন দেব।

রাবণ তার ভুল বুঝতে পারলেন। মনে মনে বেদবতাঁকে বন্দনা করলেন। বেদবতী তুষ্ট হলেন। বেদবতীর দয়ায় রাবণ আবার সচল হলেন। তারপর যোগসিদ্ধ বেদবতী দেহ ছেড়ে চলে গেলেন। রাবণ তাকে গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করলেন।

এই সতী বেদবতীই পরজন্মে জনক রাজার কন্যা হয়ে জন্মেছিলেন। যার নাম ছিল সীতা। পূর্বজন্মের তপস্যার ফল তিনি পরজন্মে পেয়েছিলেন। পরিপূর্ণতম হরি শ্রীরামকে তিনি স্বামী রূপে লাভ করেছিলেন। তিনি ছিলেন জাতিস্মর। তাই পূর্বজন্মের সকল প্রেম তার মনে পড়ে গেল। শ্রীরামের স্ত্রী হয়ে পরজন্মে তিনি নানান বৈভবে সময় কাটাতে লাগলেন। শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন পরম গুণবান, রসিক, শান্ত, মনোহর রূপের অধিকারী, স্ত্রীর প্রতি তার প্রেম ছিল একনিষ্ঠ। পিতৃসত্য পালনের জন্য রামচন্দ্রকে বনবাসী হতে হল। সঙ্গে গেলেন স্ত্রী সীতা ও ছোটো ভাই লক্ষ্মণ। সেই সময়ে তারা সমুদ্রতীরে পর্ণকুটিরে বাস করতেন। একদিন অগ্নিদেব ব্রাহ্মণের রূপ ধরে শ্রীরামচন্দ্রের সামনে এসে দাঁড়ান। দুঃখিত রামচন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি মর্মাহত হলেন। রামকে তিনি সত্য ও প্রিয় কথা শোনালেন।

অগ্নিদেব বললেন–হে ভগবান! কাল তার নিজস্ব পথে এগিয়ে যাবে। সেই কালের কাছে কেউ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। আপনিও পারবেন না। এতে দুঃখ বা শোকের কিছু নেই। সীতা হরণের সময় আগত। তাই আমার অনুরোধ সীতা মাকে আপনি আমার আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিন। আর মায়া সীতাকে নিয়ে আপনি থাকুন। অগ্নি পরীক্ষা দিয়ে সীতা আবার আপনার কাছে ফিরে আসবে।

অতঃপর ব্রাহ্মণ নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন–আমি অগ্নিদেব। সকল দেবতাদের পক্ষ থেকে আমি আপনার কাছে দরবার করতে এসেছি।

রাম সম্মতি জানালেন। অগ্নিদেব যোগবলে সীতার মধ্যে থেকে মায়া সীতার সৃষ্টি করলেন। সে সীতার মতই রূপবতী ও গুণবতী। মায়া সীতাকে রামের হাতে তুলে দিয়ে আসল সীতাকে নিয়ে অগ্নিদেব চলে গেলেন। যাবার সময় তিনি রামকে সাবধান করলেন যেন তৃতীয় কেউ এ সত্য জানতে না পারে।

এই সময় সীতা এক সোনার হরিণ দেখতে পেয়ে রামের কাছে আবদার ধরলেন, ওই সোনার হরিণ তার চাই। লক্ষ্মণের ওপর সীতার দেখাশোনার ভার দিয়ে রাম গেলেন সেই হরিণ ধরতে। বাণ। মেরে হরিণকে বিদ্ধ করলেন। সে ছিল মায়া হরিণ মারীচ। সে মায়া বলে ত্রাহি ডাক ছাড়ল –‘লক্ষণ।

রামচন্দ্র মারীচের সামনে এসে দাঁড়ালেন। স্বয়ং নারায়ণকে চোখের সামনে দেখে মারীচ হরিণরূপ ত্যাগ করে বৈকুণ্ঠে ফিরে গেল।

জয় ও বিজয় ছিল বৈকুণ্ঠের দ্বার রক্ষক। আর ছিল জিত নামের এক পরাক্রমশালী কিঙ্কর। জিত, সনক প্রভৃতি ঋষিদের শাপে রাক্ষস হয়ে জন্মায়। তারপর রামচন্দ্রের হাতে তার মৃত্যু হয়। জয় বিজয়ের আগেই সে বৈকুণ্ঠে ফিরে আসে।

মায়াবী রাক্ষসের ডাকা লক্ষ্মণ’ ‘লক্ষ্মণ’ সীতার কানে এসে পৌঁছোলো। তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি দাদাকে রক্ষার জন্য লক্ষ্মণকে পাঠিয়ে দিলেন। এই অবসরে পাপিষ্ঠ রাবণ ছলনা করে সীতাকে চুরি করে নিয়ে পালাল। লক্ষ্মণকে দেখে রামচন্দ্র বিষণ্ণ হলেন। দুই ভাই পর্ণকুটিরে ফিরে এলেন। কিন্তু সীতার দেখা পেলেন না। বহু খোঁজ করেও সীতাকে রামচন্দ্র পেলেন না। প্রিয় পত্নী সীতার অদর্শনে রামচন্দ্র বারংবার জ্ঞান হারালেন। চৈতন্য ফিরে পেয়ে পুনরায় সীতার খোঁজ করলেন। নদীতীরে দেখা হল জটায়ুর সাথে। জটায়ুর কাছ থেকে সীতা হরণ সম্পর্কে রামচন্দ্র জানতে পারলেন। অতঃপর রাবণের রাজ্য লঙ্কা আক্রমণ করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বানর সেনার শরণাপন্ন হলেন। বানর সৈন্যের সাহায্যে রামচন্দ্র সাগরের উপর সেতু বন্ধন করলেন। অতঃপর সেতু পেরিয়ে লঙ্কা আক্রমণ করলেন শ্রী রামচন্দ্র। ভয়ংকর সেই যুদ্ধে লঙ্কায় রাবণের বংশের আর কেউ বেঁচে রইল না। স্বয়ং রাবণও প্রাণ হারালেন। দুঃখিনী সীতা উদ্ধার হলেন। কিন্তু অগ্নিপরীক্ষা ছাড়া রামচন্দ্র সীতাকে গ্রহণ করতে পারলেন না। এই সময় প্রকৃত সীতাকে নিয়ে এসে অগ্নিদেব হাজির হলেন। রামের হাতে আসল সীতাকে সমর্পণ করলেন।

রামচন্দ্র ও অগ্নিদেবের কাছে ছায়া সীতা জানতে চাইলেন এখন তার কি করা উচিত?

অগ্নিদেব বললেন, তুমি মহাপুন্য স্থান পুস্কর তীর্থে গমন কর। সেখানে বসে তপস্যা কর। তপস্যার ফলে তুমি স্বর্গ লক্ষ্মী লাভ করবে।

ছায়া সীতা তখনি চলে গেলেন পুস্কর তীর্থে। কঠোর তপস্যার বলে তিনি স্বর্গলক্ষ্মী হলেন। অতঃপর তিনি দ্রুপদের কন্যা দ্রৌপদী হয়ে জন্মেছিলেন। সত্যযুগে যিনি ছিলেন বেদবতী, ত্রেতা যুগে তিনিই ছিলেন সীতা এবং দ্বাপর যুগে তিনি হলেন দ্রৌপদী।

নারায়ণকে চুপ থাকতে দেখে নারদ সুপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। বললেন– ভগবান, দ্রুপদ রাজার কন্যা দ্রৌপদী একই সঙ্গে পঞ্চ পান্ডবের অর্থাৎ পাঁচ পুরুষের ঘরনী ছিলেন। এটা কী করে সম্ভব সে বৃত্তান্ত আমাকে বলুন।

নারায়ণ বললেন–হে দেবর্ষি ছায়াসীতা অগ্নিদেবের আদেশে পুস্কর তীর্থে চলে গেলেন। তপস্যায় তিনি শিবের কাছে বর প্রার্থনা করলেন ত্রিলোচন হে! “আমাকে স্বামী দান করুন। রামচন্দ্রের রূপে ছায়াসীতা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং কামাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি পাঁচবার ‘স্বামী দান করুন’ বলেছিলেন। শিব স্মিতহাস্যে বলেছিলেন তথাস্তু”। পরজন্মে ছায়াসীতা দ্রৌপদী হন ও পঞ্চস্বামীর ঘরনী হন।

এদিকে রামচন্দ্র রাবণ কে বধ করে তার ভাই হরিভক্ত বিভীষণের হাতে লঙ্কার ভার তুলে দিয়ে সপত্নী ফিরে এলেন অযোধ্যায়। রামচন্দ্র দীর্ঘ এগারো বছর প্রজাবৎসল, ধর্ম পরায়ণ, নিরহংকারী রাজা হিসেবে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। তারপর তিনি পরিবারবর্গ, দাসদাসী সকলকে নিয়ে বৈকুণ্ঠধামে গমন করলেন।

বেদবতী ছিলেন লক্ষ্মীর অংশ। তাই তিনি লক্ষ্মীতেই মিশে গেলেন। যার জিভে সর্বদা চর্তুবেদ অবস্থান করে তিনিই হলেন বেদবতী।

.

পঞ্চদশ অধ্যায়

সৌতি বললেন–হে মুনিশ্রেষ্ঠ শৌনিক কুশধ্বজ কন্যা বেদবতী উপাখ্যান সংক্ষেপে আপনাকে বললাম। এবার শুনুন ধর্মধ্বজের কন্যা তুলসীর কাহিনী। নারায়ণ দেবর্ষি নারদকে এই কথা শুনিয়েছিলেন। তাঁর কথাতেই আপনি শুনুন।

নারায়ণ বললেন–রাজা ধর্মধ্বজের পত্নী মাধবী ছিলেন স্ত্রীরত্নস্বরূপা। তিনি ছিলেন কামবতী ও রসিকা। গন্ধমাদন পাহাড়ে ফুল চন্দন যুক্ত রতি শয্যা রচিত হল। যেখানে তিনি রাজার সঙ্গে রতিসুখে কাল কাটাতে লাগলেন। তারা দুজনেই ছিলেন রমণ বিষয়ে অভিজ্ঞ। তারা এইভাবে দৈব একশ বছর কাটিয়ে গেলেন। শেষে রাজার চেতনা হল। তিনি রতি ক্রিয়া থেকে বিরত হলেন। কিন্তু কাম তাড়িত মাধবীর তৃপ্তি এল না। সতী সাধ্বী নারী সেই সময় গর্ভবতী হলেন। কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে শুক্রবারে তিনি মনোহর এক কন্যার জন্ম দিলেন। সেই কন্যার পায়ে ছিল পদ্মের চিহ্ন। সে লক্ষ্মীর অংশস্বরূপা। শরৎকালের পদ্মের মতো আঁখি পল্লব মেলে যে আতুর ঘরের চারিদিকে দেখছিল আর মুচকি হাসছিল। কন্যার হাত পায়ের তালু রক্তের মতো লাল। সুন্দর নাভিটি নীচের দিকে মুখ করে আছে। সাদা চাপা ফুলের মতো তাঁর গাত্রবর্ণ। মাথায় সুন্দর কালো চুল। তার দেহের জ্যোতি গোল হয়ে চারিদিকে ঘুরছিল। এই মনোমুগ্ধকর রূপের তুলনা না পেয়ে পন্ডিতেরা তাঁর নাম দিলেন তুলসী। বনে গিয়ে কঠোর তপস্যা করলেন তুলসী। নারায়ণের কাছে প্রার্থনা করলেন ভালো স্বামীর জন্য। দৈব একলক্ষ বছর ধরে তিনি তপস্যা করলেন। এই সময় তিনি ফল, জল, ঝরা পাতা, বায়ু খেয়ে ও উপবাসে কাটিয়ে দিলেন। শেষে এক পায়ে দাঁড়িয়ে তপস্যা করতে লাগলেন। হংসের পিঠে চড়ে ব্রহ্মা সেখানে হাজির হলেন।

তুলসী বললেন–হে তাত! আপনি সর্বজ্ঞ, আপনার অজানা কিছু নেই।

হে নারদ! তুলসীর আসল পরিচয় তোমায় আগেই দিয়েছি। গোলোকধামে থাকাকালীন তিনি ছিলেন এক গোপকন্যা। একদিন গোবিন্দের সঙ্গে রতিক্রিয়ায় আসক্ত হয়ে অতৃপ্ত অবস্থায় তিনি মূচ্ছা যান। রাধা সেই সময়ে সেখানে আসেন ও অভিশাপ দেন। রাধার অভিশাপে তিনি মানবযোনিতে জন্ম লাভ করেন। শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেন, তুমি মর্তে গিয়ে তপস্যা করে ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত হবে এবং আমার অংশস্বরূপ নারায়ণকে পতি রূপে পাবে।

ব্রহ্মা তুলসী কে বললেন–গোলোকধামে সুদামা নামের এক গোপ ছিল। সেও শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গজাত। সে ছিল অত্যন্ত পরাক্রমশালী ও তেজস্বী পুরুষ। রাধার অভিশাপে সে দৈত্য বংশে জন্ম নিয়ে শঙ্খচূড় নামে অভিহিত হয়েছে। গোলোকে থাকাকালীন সুদামা তোমার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু রাধার প্রভাবে কিছু করতে পারে নি। সে জাতিস্মর। তপস্যা করে সে তোমাকে লাভ করবে। তুলসী, তুমিও জাতিস্মর। তোমারও অজানা কিছু নেই। তাই বলছি শঙ্খচূড়কে পতি করে সুখে দিন কাটাও। অন্য জন্মে দৈবযোগে তুমি নারায়ণের অংশরূপে তুলসীগাছ হয়ে জন্মাবে। তুমি হবে সমস্ত গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ফুলেদের মধ্যে তুমিই হবে শ্রেষ্ঠ। বিষ্ণুর প্রাণাধিকা। সমস্ত দেবতার পুজোতে তুমি থাকবে। নয়তো পূজো ব্যর্থ হবে। তুলসী পাতা দিয়ে গোপ গোপীরা মাধবের পুজো দেবে। তুমি সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের সাথে বিহার করবে। ব্রহ্মার কথা শুনে তুলসী খুশি হলেন।

বললেন–হে তাত! আপনার দয়ায় আমি আবার দুর্লভ গোবিন্দের কাছে ফিরে যাব। কিন্তু রাধা ভীতি আমি কাটাব কি করে!

ব্রহ্মা বললেন– রাধার স্তব করবে। ষোলো অক্ষরের রাধামন্ত্র তোমায় দান করছি। রাধাস্তব করে তুমি রাধার প্রাণাধিক প্রিয় হয়ে উঠবে।

এই কথা বলে ব্রহ্মা তাঁর বাহনে চড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তুলসী রাধামন্ত্র স্তব করতে শুরু করল। কেটে গেল বারো বছর। অবশেষে রাধা সন্তুষ্ট হলেন। তুলসী মনের মত বর লাভ করে বিশ্ব সংসারে আনন্দে বিচরণ করতে লাগল।

.

ষোড়শ অধ্যায়

নারায়ণ বললেন– নবযৌবনা রমণীশ্রেষ্ঠ তুলসী তখন ফুল চন্দনে পরিব্যাপ্ত শয্যায় শুয়ে মনে মনে পতি বাসনা করতে লাগলেন।

এই সময়ে কামদেব তাকে লক্ষ্য করে পঞ্চশরে বিদ্ধ করলেন। ক্ষণে ক্ষণে তুলসী দেহমনে পুলকিত হতে থাকলেন। তিনি মূচ্ছা যাচ্ছিলেন ঘন ঘন। কখনও তিনি সুখে নিদ্রা যাচ্ছেন। কখনও মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন। আবার কখনও শয্যা ত্যাগ করে হাঁটতে শুরু করছেন আপন মনে। কিছুটা হাঁটছেন, আবার বসে পড়ছেন। প্রায় উন্মাদিনী অবস্থা। দিনে দিনে এই অসুস্থতা বেড়ে চলল। পুষ্পশয্যা কন্টকিত হতে থাকল। সুস্বাদু ফল যেন বিষময় হয়ে উঠল। কপালের সিঁদুর বিন্দু যেন অসহ্য মনে হল।

একদিন তুলসী তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় এক সুবেশধারী যুবককে দেখতে পেলেন। স্মিত হাস্যে যুবকটি এগিয়ে এল। চন্দন চর্চিত তার দেহ। গলায় মালা। তুলসীর পাশে সে শয্যা গ্রহণ করল। রতিক্রিয়ায়

এগিকে উদ্দীপ্ত করল।ভায় যুবকটি ফিরে যেতেই প্রাণনাথ, আমাহেল।

কিন্তু তুলসী স্তব্ধ থাকায় যুবকটি ফিরে যেতে উদ্যত হল। সেই মুহূর্তে যুবকটিকে তুলসীর অতি প্রিয় মনে হল। তুলসী কেঁপে উঠলেন। বললেন–হে প্রাণনাথ, আমাকে ত্যাগ করে তুমি কোথায় যাচ্ছ! এভাবেই বিলাপ করতে করতে তুলসীর সময় অতিবাহিত হয়ে গেল।

এদিকে মহাযোগী শঙ্খচূড় মুনিবর ইতিমধ্যে কৃষ্ণ মন্ত্র লাভ করেছেন। পুস্করতীর্থে মন্ত্রসিদ্ধ হয়ে গলায় দুলিয়েছেন বর্ণমালা কবচ। ব্রহ্মার কাছ থেকে বর লাভ করে তিনি এলেন বদরিকা আশ্রমে।

হে নারদ! শঙ্খচূড় কে আসতে দেখে তুলসী স্তম্ভিত হলেন। কামদেবের মতোই তিনি মনোমুগ্ধকর কান্তি মনে গাত্রবর্ণ সাদা চাপা ফুলের মতো। নবযৌবনের দীপ্তি তার দেহে। নানা ভূষণে ভূষিত। পদ্মের ন্যায় দুটি আঁখি। গলায় পারিজাত ফুলের মালা। কস্তুরি ও কুমকুম চর্চিত। রত্নকুন্ডল গন্ডদেশে শোভা পাচ্ছে।

তুলসী তাকে দেখে কামাসক্ত হলেন। কাপড়ের আড়ালে মুখ ঢেকে সেই পুরুষের রূপসুধা পান করতে লাগলেন।

শঙ্খচূড় জানতে চাইলেন, হে সুন্দরী! তুমি এই নির্জন আশ্রমে একাকী বসে আছ কেন? তুমি রমণী শ্রেষ্ঠা, মায়ার আধার, তোমার রূপে মুনিদেরও মোহ জন্মাতে পারে। চুপ করে থেক না। বল তুমি কে? আমার কথার উত্তর দাও।

তুলসী বললেন––ধর্মধ্বজের কন্যা আমি। তপস্যার কারণে এই আশ্রমে আমার আগমন। কিন্তু আপনার পরিচয় জানার আগ্রহ আমার নেই। আপনি যেখানে খুশি যেতে পারেন। যে পুরুষ অধার্মিক এবং লম্পট, তারাই কামুক হয়! কামিনীর সঙ্গ লাভ করতে চায়। সৎ বংশে জাত কোনো পুরুষ নারীকে প্রশ্ন করে না। নারীজাতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। তারা ওপরে মিষ্টি মধুর কথা বলে আর অন্তরে ক্ষুরধারে পুরুষকে বধ করে। তাদের চরিত্র নিরূপণ করতে বেদ পুরাণ হিমসিম খায়। কোনো বিদ্বান লোক কামিনীকে বিশ্বাস করে না। কামিনী পুরুষকে স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করে। নারী প্রকাশ্যে লজ্জাশীলা। কিন্তু গোপনে তারা সুপুরুষকে গ্রাস করতে চায়। তারা সর্বদা কামাতুর থাকে আর মৈথুনে অংশ নিতে চায়। অল্প মৈথুন তাদের তৃপ্ত করতে পারে না। সর্বদা মনের মধ্যে ঝগড়ার বীজ বপন করে। রতিদাতা পুরুষ পেলে এরা নিজেদের গর্ভজাত সন্তানের কথাও ভুলে যায়। মৈথুনে অক্ষম বা বৃদ্ধ এদের কাছে শত্রু বিশেষ। রতিদাতা পুরুষের এরা রক্ত শুষে খায়। মোহময়ী রূপবতী কামিনীর ছল চাতুরী ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরও উপেক্ষা করতে পারেন না। এরা হরি উপাসনায় বিঘ্ন ঘটায়। এদের অন্তর দূষিত, এদের রক্ত অসংস্কৃত। বিধাতা এইসব কামিনীদের মায়াবী রূপের সৃষ্টি করেছেন।

তুলসীর কথা শুনে শঙ্খচূড় মৃদু হাসলেন। তিনি বললেন–হে দেবী! তুমি এতক্ষণ যা বললে তার সবই সত্যি। এবার আমার কথা শোনো।

বিধাতা পুরুষ বাস্তব ও কৃত্যা দুই ধরণের নারীরূপ সৃষ্টি করেছেন। বাস্তব প্রশংসা পায় আর কৃত্যা নিন্দা পেয়ে থাকে। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, সাবিত্রী ও রাধা আদি সৃষ্টি স্বরূপ। কিন্তু এরা ব্রহ্মার দ্বারা সৃষ্ট হন নি। এদের অংশ স্বরূপ যে সকল স্ত্রীলোক, তারাই হল বাস্তব।

যুগে যুগে বহু নারীর আবির্ভাব ঘটেছে। শতরূপা, দিতি, অদিতি, স্বধা, স্বাহা, লোপামুদ্রা, মনসা, পুষ্টি, তুষ্টি, শচী, বরুণানী, দক্ষিণা, ছায়াবতী, রোহিনী, দেবাহুতি, অনুসূয়া, কেতকী, কালিকা, স্মৃতি, মেধা, বসুন্ধরা, ষষ্ঠী, ধর্মপত্নী, শ্রদ্ধা, কান্তি, নিদ্রা, তন্দ্রা, বিপাসা, ক্ষুধা, দিন, রাত্রি, প্রভা, শোভা, ক্রিয়া, প্রভৃতি নারীরা বাস্তব স্ত্রী রূপে খ্যাতি লাভ করেছেন। কৃত্যা স্ত্রীরূপী নারীরা কুলটা হন। তারা নিন্দার যোগ্য। রজো ও তমো দুই গুণ বিশিষ্ট কৃত্যা নারী দেখা যায়। রজোরূপী কৃত্যা নারীর সতীত্ব উৎপন্ন হয়। তাদের জীবনে উপযুক্ত প্রার্থীর ও স্থানের অভাব ঘটে। তারা দেহের কষ্ট ও ব্যাধিতে ভোগেন। বহুলোকের মধ্যে বাস। তাদের জীবনে রাজার ও শত্রুর ভয় থাকে।

হে সুন্দরী! ব্রহ্মার আদেশে তোমাকে আমি বিবাহ করে সুখী হতে চাই। আমি সেই গোলোক ধামের সুদামা। রাধার অভিশাপে শঙ্খচূড় হয়ে দৈত্যবংশে জন্ম লাভ করেছি। শ্রীকৃষ্ণ মন্ত্রের প্রভাবে আমার সব মনে আছে। তুমি শ্রীহরির উপযুক্ত গোলোক বাসিনী। তুলসী, তুমিও আমার মতোই জাতিস্মর।

তুলসী বললেন, নারীরা পন্ডিত লোককে পছন্দ করে। তুমি সেই পন্ডিত লোক নও। স্ত্রীর কাছে যে স্বামী হার স্বীকার করে সে জগতের কাছে নিন্দনীয় হয়ে থাকে।

ব্রাহ্মণেরা দশদিন অশৌচ পালন করে, ক্ষত্রিয়েরা বারো দিন, বৈশ্যেরা পনেরো দিন আর শূদ্রেরা এক মাস। কিন্তু যে পুরুষ স্ত্রীর কাছে পরাজিত তাকে আজীবন অশৌচ পালন করতে হয়। দেবতারা তার নিবেদিত অন্ন জল গ্রহণ করেন না। এমন কি পূর্বপুরুষেরাও তার দেওয়া পিন্ড-অন্ন-জল গ্রহণ করেন না। যে পুরুষ স্ত্রীর মন জয় করতে পারে, তার ধ্যান, জল, হোম, যশ, বিদ্যা কিছুরই প্রয়োজন। হয় না। আসলে, এইসব কথার মধ্য দিয়ে আমি তোমার জ্ঞান প্রভাব ও বিদ্যা যাচাই করে নিলাম।

যে পিতা গুণহীন, বুড়ো, মুখ, গরীব, যোগী, পঙ্গু, অঙ্গহীন, জড়, কালা, বোবা, অন্ধ, কদাকার, রাগী, বা নপুংসক পুরুষের সাথে মেয়ের বিয়ে দেয় সে পিতা ব্রহ্মহত্যার সমান পাপ করে। শান্ত, গুণী, সুশীল, বৈষ্ণব, ও পন্ডিত পুরুষের হাতে কন্যাদান করলে পিতা অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পুণ্য লাভ করে। যে পাপিষ্ঠ অর্থলোভে কন্যাকে বিক্রি করে তাকে কুম্ভীপাক নরকে গমন করতে হয়। যেখানে সে চোদ্দজন ইন্দ্রের আয়ুষ্কাল পর্যন্ত কাক আর কৃমির যন্ত্রণা ভোগ করে। মেয়ের মলমূত্র খেতে বাধ্য হয়। সেই পাপের ফলে সে ব্যাধের ঘরে জন্মায়। মাংসের বোঝা কাঁধে নিয়ে পথে পথে বিক্রি করে।

তুলসী আর শঙ্খচূড় যখন তর্কে বিতর্কে মগ্ন তখন সেখানে ব্রহ্মার আবির্ভাব ঘটল। তারা দুইজন ব্রহ্মাকে প্রণাম জানালেন। আসন গ্রহণ করে ব্রহ্মা তাদের কিছু উপদেশ দান করলেন।

ব্রহ্মা বললেন– শঙ্খচূড়! তুমি পুরুষ শ্রেষ্ঠ আর তুলসী স্ত্রী শ্রেষ্ঠ। তোমরা উভয়ে বিবাহ করে অবশ্যই সুখী হবে। যে পুরুষ সহজেই এই সুখ ত্যাগ করে সে পশুর সমান। তুলসীকে বললেন– তুলসী! দেবতা ও দানবদের বিমর্দনকারী মহা শক্তিশালী সর্বগুণসম্পন্ন এই প্রিয়জনকে তুমি কেন গুরুত্ব দিচ্ছ না। নারায়ণের সঙ্গে যেমন লক্ষ্মী, কৃষ্ণের সঙ্গে যেমন রাধা শঙ্কর-ভবানী, হিমালয়-মেনকা, চন্দ্র রোহিনী, কাম-রতি, বশিষ্ঠ-অরুন্ধতী, গৌতম-অহল্যা, ইন্দ্র-পুষ্টি, মনু-শতরূপা, যেমন রতি মিলনে প্রবৃত্ত হয়েছেন তুমিও তেমনি শঙ্খচূড়ের সঙ্গে মিলনে প্রবৃত্ত হও। শাপমোচনের পর তুমি আর শঙ্খচূড় ফিরে যাবে গোলোকে আর তুমি বৈকুণ্ঠে নারায়ণের সঙ্গে মিলিত হবে।

একথা বলে ব্রহ্মা অদৃশ্য হলেন। তুলসী ও শঙ্খচূড় গন্ধর্বমতে বিবাহ করলেন। তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি হল। প্রিয়তমের সঙ্গে নবসঙ্গমে মিলিত হলেন তুলসী। চৌষট্টি কলায় পারদর্শী শঙ্খচূড়ের সঙ্গে রতি মিলনে তুলসী বিরামহীন সুখ ভোগ করতে লাগলেন।

তুলসী এবার তার প্রিয়তমকে সাজাতে বসলেন। শঙ্খচূড়ের কপালে এঁকে দিলেন কুমকুম ও চন্দনের তিলক। সুগন্ধী দ্রব্য দ্বারা তার দেহ মার্জনা করলেন। আগুনের মতো বিশুদ্ধ দুটো কাপড় পরিয়ে দিলেন। পারিজাতের মালা পরালেন গলায়। আঙুলে পরিয়ে দিলেন অমূল্য রত্নের এক সুন্দর আংটি। দান করলেন এক দুর্লভ মনি। তুলসী স্বামীকে প্রণাম জানিয়ে বললেন, হে প্রিয়তম, আমি তোমার দাসী।

শঙ্খচূড় দান হিসেবে বরুণের কাছ থেকে দুটি বিশুদ্ধ কাপড় ও রত্নের মালা পেয়েছিলেন। স্বাহা তাকে দিয়েছিলেন এক জোড়া পায়ের নুপুর। ছায়া দিয়েছিলেন একজোড়া রত্নের আংটি, বিশ্বকর্মা দিয়েছিলেন উত্তম অলংকার ও বিচিত্র ও সুন্দর শঙ্খ। শঙ্খচূড় এইসব প্রীতি উপহার তুলসীর হাতে তুলে দিলেন। তুলসীকে বুকে টেনে নিয়ে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিলেন তার ঠোঁট গাল, দেহ। প্রিয়ার খোঁপায় পরিয়ে দিলেন পারিজাত ফুলের মালা। প্রিয়ার গালে চন্দনের প্রলেপ দিলেন। কপালে দিলেন সিঁদুরের ফোঁটা। আলতা দিয়ে হাত ও পায়ের পাতা রাঙিয়ে দিলেন। তারপর পদ্মের মতো প্রিয়ার দুটি পা নিজবক্ষে ধারণ করে বললেন, ওগো প্রিয়া, আমি তোমার দাস।

তারপর তাঁরা রত্ন খচিত রথে চড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। দেবালয়ে, পাহাড়, পুষ্প উদ্যান, নদীর তীর, নন্দন কানন, গন্ধমাদন পর্বত, সুন্দর ঝর্ণার ধার। কখনও তাদের দেখা গেল কেতকীবনে, কখনও আবার মাধবী বনে। কখনও সোনার পাহাড়ের কোনো নির্জন স্থানে, কখনও আবার পারিজাত বনে। যে স্থান তাদের পছন্দ হ’ল, সেখানেই তারা চন্দন ও ফুলশয্যা রচনা করলেন। শঙ্খচূড় ও কামাতুর তুলসী সুরতক্রিয়া সুসম্পন্ন করলেন। তবুও তারা রইলেন অতৃপ্ত। তাদের কামনাবাসনা আরও বেড়ে গেল।

একসময় তুলসী ও শঙ্খচূড় তপোবনে ফিরে এলেন। সেখানে শঙ্খচূড় মনের সুখে রাজ্যভোগ করতে লাগলেন। মহাবলশালী শঙ্খচূড় এক মন্বন্তর কাল পর্যন্ত দেবতা, দানব, অসুর কিন্নর, রাক্ষস, গন্ধর্ব সকলের ওপর অত্যাচার চালাতে থাকলেন। গায়ের জোরে দেবতাদের পুজো, হোম, যজ্ঞ, অস্ত্র শস্ত্র অলংকার সব কেড়ে নিলেন। দেবতারা হয়ে উঠলেন অসহায়। চিন্তিত ও দুঃখিত দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। শঙ্খচূড়ের কীর্তিকাহিনী শুনে ব্রহ্মার কপালে চিন্তা রেখা ফুটে উঠল। তিনি সকল দেবতাদের নিয়ে গেলেন শিবলোকে। শিব ও অন্যান্যরা এসে হাজির হলেন বৈকুণ্ঠধামে।

জরা ও মৃত্যুহীনের পরম আশ্রয় এই বৈকুণ্ঠধাম। দেবতারা সকলে শ্রীহরির মন্দিরের সর্বোত্তম দরজায় নিয়ে হাজির হলেন। সেখানে দ্বার রক্ষকেরা রত্ন সিংহাসনে বসে আছে। দ্বার রক্ষকের অনুমতি নিয়ে দেবতারা সকলে ষোলোটি দরজা অতিক্রম করে শ্রীহরির সভায় এসে উপস্থিত হলেন।

সভাস্থল তখন চর্তুভুজ পারিষদে পরিপূর্ণ। তাদের বেশভূষা, অলংকার, আকৃতি সবই নারায়ণের সমান। শ্রীহরি তার ইচ্ছে মত শ্রেষ্ঠ মণি ও হীরে দিয়ে সভাটি তৈরি করেছেন। অমূল্য সব রত্ন সভার শোভা বৃদ্ধি করছে। সামন্তক মণি দিয়ে তৈরি হয়েছে সেই সভার একশোটা সিঁড়ি। তাতে পদ্মরাগ মণি দিয়ে কৃত্রিম পদ্ম সিঁড়ির শোভা বৃদ্ধি করেছে। সভাকক্ষের চারিদিকে সুগন্ধি চন্দন আর কুমকুমের সুবাস। বিদ্যাধরীরা সুন্দর নাচ গান পরিবেশন করছে।

ব্রহ্মা, শিব ও অন্যান্য দেবতারা দেখলেন, সভার মধ্যস্থলে অমূল্য রত্ন সিংহাসনে চন্দ্রের ন্যায় বসে আছেন শ্রীহরি। তিনি চতুর্ভুজ। শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম ধারী। মৃদু হাস্যে সুগন্ধ যুক্ত তাম্বুল সেবন করছেন। লক্ষ্মীদেবী তার চরণপদ্ম ক্রোড়ে নিয়ে বসে আছেন। গঙ্গাদেবী পরম ভক্তিভরে সাদা চামর দুলিয়ে তাকে বাতাস করে সেবা করছেন। ভক্তরা তাঁর বন্দনা গান গাইছেন।

পরমাত্মার এমন মনোমুগ্ধকর রূপ দেখে ব্রহ্মা শিব ও অন্যান্য দেবতারা দেহ মনে পুলক বোধ করলেন। তাদের চোখ থেকে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ল। দেবতারা সকলে মিলে শ্রী হরিকে প্রণাম জানালেন। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা হাতজোড় করে সবিনয়ে তাদের আগমনের কারণ বর্ণনা করলেন।

শ্রী ভগবান বললেন– হে পদ্মযোগি ব্রহ্মা, শঙ্খচূড়ের সকল ঘটনা আমার অবগত আছে। আমি এক পুরোনো কাহিনী শোনাই। যা পাপনাশকারী ও পুণ্যদানকারী। রাধার অভিশাপে সুদামাশঙ্খচূড় নামে দানবে পরিণত হয়েছে। আমি একদিন রাসমন্ডলে গিয়েছিলাম। রাধা এক দাসীর মুখে খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত হলেন। আমি সেখানে বিরাজা নামের এক গোপিনীর সাথে মিলিত হয়েছিলাম। আমি তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হলে বিরজা নদীতে পরিণত হয়। রাধা অতিমাত্রায় রাগান্বিতা হন ও সখাদের নিয়ে স্বগৃহে ফিরে যান।

একদিন মন্দিরে সুদামার সঙ্গে আলাপ চারিতায় সময় কাটাচ্ছিলাম। সেজন্য রাধা আমাকে তিরস্কার করল। সুদামা এ ঘটনায় গেলেন রেগে। রাধাও পাল্টা রাগ প্রদর্শন করলেন। রাধা সুদামাকে আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে আদেশ জানালেন। সুদামাও রাধার উদ্দেশ্যে কটুক্তি করতে লাগলেন। রাধা অধিক রুষ্ট হয়ে সুদামাকে অভিশাপ দিলেন– তুই দানব বংশে দানব হয়ে জন্ম নিবি।

প্রচন্ড দুঃখে সুদামা মর্মাহত হল। আমায় প্রণাম করে তিনি বিদায় নিতে উদ্যত হলে রাধার মনে দয়ার সঞ্চার হ’ল। রাধা তাকে যেতে মানা করলেন। কিন্তু সুদামা রাধার কথা কানে তুললেন না। সুদামার বিদায়ে দাস দাসী সখীগণ চোখের জল ফেলল। আমি অতঃপর রাধাকে শান্ত করলাম।

রাধা অতঃপর সুদামার উদ্দেশ্যে বললেন– হে সুদামা! তোমাকে আমি বর দান করছি ও শাপমুক্ত হয়ে তুমি গোলোকে এসে অবস্থান করবে।

কৃষ্ণ বলতে থাকেন- হে দেবতাবৃন্দ! আমার এই ত্রিশূল গ্রহণ করো। তোমরা মর্ত্যে যাও। দানব শঙ্কচূড়কে বধ করবার দায়িত্ব আমি শিবের উপর ন্যস্ত করলাম। কিন্তু শঙ্খচূড়ের গলায় আমার সর্বমঙ্গল কবচ আছে। যার প্রভাবে সে সমগ্র জগৎকে মুষ্টিবদ্ধ করতে পেরেছে। যতক্ষণ ওই কবচ ওর দেহে থাকবে ততক্ষণ কেউ ওর ক্ষতি করতে পারবে না। তাই আমি নিজে ব্রাহ্মণের বেশ ধরে ওই কবচ শঙ্খচূড়ের কাছ থেকে চেয়ে নেব।

তাছাড়া ব্রহ্মার বর অনুযায়ী শঙ্খচূড় কে হারাতে গেলে তার স্ত্রী তুলসী কে অসতী হতে হবে। আমি তুলসীর গর্ভে বীর্যপাত ঘটাব। তুলসী হবে অসতী। তখন শঙ্কচূড়কে বধ করতে অসুবিধা হবে না। পরে তুলসী তার স্ত্রীদেহ ছেড়ে আমার কাছে চলে আসবে।

.

সপ্তদশ অধ্যায়

নারায়ণ বললেন– হে দেবর্ষি নারদ! শঙ্খচূড় দানবকে বধ করবার দায়িত্ব শিবের উপরে দিয়ে ব্রহ্মা নিজের বাসস্থানে ফিরে গেলেন।

চন্দ্রভাগা নদীর তীরের একটি মনোহর বটগাছের নীচে শিব এসে দাঁড়ালেন। গন্ধর্বরাজ পুঞ্জদন্তকে দূত হিসেবে পাঠিয়ে দিলেন শঙ্কচূড়ের কাছে।

দশ যোজন দীর্ঘ এবং পাঁচ যোজন চওড়া বিস্তৃত জায়গা জুড়ে শঙ্খচূড়ের রাজত্ব। অত্যন্ত দুর্গম সাতটি পরিখা দ্বারা সে নগর বেষ্টিত। চারপাশে স্ফটিক আকারের মণি দিয়ে তৈরি পাঁচিল। মণিমানিক্য খচিত বেদি, পরিবেষ্টিত শত শত উপবন, শত কোটি আশ্রম। দেবরাজ ইন্দ্রের নগর অমরাবতী আর কুবেরের ভবন শঙ্খচূড়ের নগরের কাছে সৌন্দর্য্যে নগণ্য।

পুঞ্জদন্ত নগরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। পূর্ণিমার চাঁদের মত গোলাকার ভবন চারটি পরিখা দিয়ে ঘেরা। জ্বলন্ত আগুনের শিখা রূপ আকাশ সমান উঁচু পাঁচিলের মাঝখানে ভবনটি দন্ডায়মান। বারোটি দরজায় প্রহরী সদা জাগ্রত। শত্রুরা কোনো ক্রমেই সে ভবনে প্রবেশ করতে পারবে না। ফটকের দরজায় দরজায় নানা রত্ন দিয়ে তৈরি কৃত্রিম পদ্ম শোভা পাচ্ছে। শঙ্খচূড়ের বাসভবনের সিঁড়ি, থাম, মন্দির এমন কি দেয়ালের ছবি গুলোও মূল্যবান রত্ন নির্মিত।

বাড়ি সুরক্ষার দায়িত্বে আছে শতকোটি দানব, প্রত্যেকেই মহা পরাক্রমশালী। নানা অলংকার ও অস্ত্রে তারা সজ্জিত।

পুঞ্জদন্ত বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেখানে যে দানবটি পাহারায় ছিল, তার গায়ের রং তামাটে, কটা চোখ, বীভৎস চেহারা, দেখলে ভয়ে কাঁটা দেয়। তার হাতে শূল। পুঞ্জদন্ত জানালেন, তিনি দূত হিসেবে এসেছেন। রাজার সঙ্গে দেখা করতে চান।

প্রধান দরজা পেরিয়ে দ্বিতীয় দরজায় এলেন। সেখানেও তিনি তার আগমনের হেতু জানালেন। এইভাবে নয়টি দরজা পার হয়ে এসে দশম দরজার দ্বাররক্ষী পুঞ্জদন্ত বললেন– রাজাকে গিয়ে জানাও যুদ্ধের বার্তা নিয়ে দূত এসেছে।

দ্বাররক্ষক ভিতরে প্রবেশ করল। খানিক বাদে এসে পুঞ্চদন্তকে জানাল– আপনি ভিতরে যেতে পারেন। গন্ধর্বরাজ পুঞ্জদন্ত সভাগৃহের মধ্যে প্রবেশ করলেন।

সভার মাঝখানে এক রত্ন বিশিষ্ট সিংহাসনে পারিষদবর্গের মাঝে বসে আছেন রাজা। এক দাস তাঁর মাথায় ছাতা ধরে আছে। অন্য দুই পার্ষদ সাদা চামর দুলিয়ে বাতাস করছে।

অতীত সুন্দর অলংকারে সুসজ্জিত রাজা শঙ্খচূড় এইভাবে সেবা নিচ্ছিলেন। পুঞ্জদন্ত বিস্মিত হলেন।

পুঞ্জদন্ত শঙ্খচূড়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন– ভগবান শিবের দূত হয়ে আপনার কাছে। এসেছি। দেবাদিদেব শিবের ভাষাতেই তাঁর কথা ব্যক্ত করছি। শিব বলেছেন, শঙ্খচূড়ের অত্যাচারে দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তারা সর্বশ্রেষ্ঠ হরির দ্বারস্থ হয়েছেন। তুমি আমাদের রাজ্য ও সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছ। সব ফিরিয়ে দাও। নয়তো যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী।

গন্ধর্বরাজ পুঞ্জদন্ত বলতে থাকলেন– এখন চন্দ্রভাগা নদীর তীরে ত্রিলোচন শিব অপেক্ষারত। আপনি কী জবাব দেবেন দিন, আমি শিব কে গিয়ে জানাব।

শঙ্খচূড় বললেন– বেশ, তুমি ফিরে যাও। দেবাদিদেব শিবকে গিয়ে বল, কাল সকালে আমি তার সঙ্গে দেখা করব।

পুস্পদন্ত ফিরে এল বটগাছের নীচে। শঙ্খচূড়ের জবাব ও তার বৈভবের কথা সবিস্তারে শিবকে জানাল।

ইতিমধ্যে দেবতারা অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সেই স্থানে একে একে উপস্থিত হতে শুরু করেছেন। প্রথমে এলেন রূপবীর কার্তিক, তারপরে নন্দী, মহাকাল, সুভদ্রক, বিশালাক্ষ, বীরভদ্র, কপিলক্ষি, মণিভদ্র, দুর্জয়, বিকট, বাণ, বিকম্পন, বিরূপ, বিকৃতি, তালোচন, কালঙ্কট, বলীভদ্র, কুটিচর, কালজিষকা, দুর্গম, দীর্ঘদংষ্ট্রা, বলোম্মত্ত ও বলীভ। এলেন আট ভৈরব। এগারোজন রুদ্র। কী বিকট তাদের চেহারা, আটজন বসু, বারোজন আদিত্য, ইন্দ্র, অগ্নি, চন্দ্র, অশ্বিনীকুমার দ্বয়, বিশ্বকর্মা, যম, কুমেরী, জয়ন্ত, নলকুবের, বায়ু, বরুণ, মঙ্গল, বুধ, ধর্ম, শনি, ঈশান ও কামদেব উপস্থিত হলেন। উগ্রচন্ডা, উগ্রদংষ্ট্রা, কোট্টরী, কৈটভী এবং ভয়ংকরী ভদ্রকালী সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। শ্রেষ্ঠ তৈরী একটি বিমানের উপর ভদ্রকালী বসে আছেন। শত হাতে তিনি অস্ত্র ধারণ করেছেন। তাঁর ত্রিশূল আকাশ ছুঁয়েছে। তার শক্তি যোজন বিস্তৃত। শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, বাণ, মুগুর, মুষল, বজ, খ, ভয়ঙ্কর চাপ, উজ্জ্বল ফুলক বৈষ্ণবাস্ত্র, বারুনাস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র, নারায়ণস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্রে, নাগপাশ, গারুড়াস্ত্র, পাশুপতাস্ত্র, জ্বম্ভনাস্ত্র, মহেশ্বরাস্ত্র, দম্ভ, বায়ব্যাস্ত্র, সন্মোহনাস্ত্র এবং শত শত দিব্য ও অব্যর্থ অন্যান্য অস্ত্রে তিনি সজ্জিত।

সেই ভয়ংকরী দেবীর বিরাটকার জিহু বহু যোজন ব্যাপ্ত। তার হতে গোলাকার ও গভীর যোজন ব্যাপ্ত। তার হাতে গোলাকার ও গভীর যোজন আয়তন যুক্ত নরমুন্ড। তিনি লাল রঙের বস্ত্র পরিহিতা। লাল রঙের মালা ঝুলছে তার গলায়। লালরঙের সুবাস অনুলেপন করেছেন। তিনি কখনও গান গাইছেন। কখনও নৃত্য পরিবেশন করছেন। কখনও হুংকার তুলে শত্রুদের ভয় দেখাচ্ছেন। নতুবা হাতের মুদ্রাতে ভক্তদের অভয় দিচ্ছে।

সেখানে এসে জমা হল বিরাটাকার তিনকোটি যোগিনী, ভূত, পেত্নি, পিশাচ, ব্রহ্মরাক্ষস, বেতাল, যক্ষ, রাক্ষস, ও কিন্নরের দল। কার্তিক শিবকে প্রণাম জানালেন। অন্যান্য শক্তিরাও শিবকে প্রনাম জানালেন। পিতার আদেশে কার্তিক তার পাশে বসলেন।

এদিকে শঙ্খচূড়ের দূত পুষ্পদন্ত চলে যাওয়ার পর অন্দরে গেলেন তুলসীর কাছে। যুদ্ধের কথা তাকে জানালেন। এ সংবাদ শুনে দুশ্চিন্তা ও ভয়ে তুলসীর হাত পা সেঁধিয়ে গেল। তিনি বললেন– হে প্রভু! আমার অধিষ্ঠাতা দেবাতা! আমাকে রক্ষা করো। দুশ্চিন্তায় আমার হাতপা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। এসো যতটুকু সময় আছে, আমি, প্রাণভরে তোমার রূপ সৌন্দর্য পান করি। তুমি আমার বুকে এসো প্রিয়। জানো, আজ ভোর রাতে আমি একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি। আমার প্রাণের বাসনা পূর্ণ কর প্রিয়।

রাজা শঙ্খচূড় ছিলেন বুদ্ধিমান দানব। তিনি সত্য ও মঙ্গলজনক কিছু উপদেশ তুলসীকে দান করে বললেন– হে প্রিয়া! তুমি সত্যক অস্বীকার কর না। কালের নিয়মে যা ঘটতে চলেছে তাকে তুমি অমান্য করতে পার না। জীবের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, ভয়-শোক, মঙ্গল-অমঙ্গল সব কিছুই কর্মফলের সঙ্গে জুড়ে থাকে। যেমন গাছ জন্মায় বেড়ে ওঠে, ফুল-ফল দান করে। তারপর একদিন তার কাজ শেষ হলে গাছটি শুকিয়ে মরে যায়। প্রতিটি জীবের ক্ষেত্রেই একই নিয়ম। এর কোনো ব্যাতিক্রম হয় না। কালের হাত ধরেই বিশ্বের সব কিছু সৃষ্টি হয়। আবার তা কালের গহ্বরেই হারিয়ে যায়। যেমন সময় হলে স্রষ্টা সৃষ্টি করেন। রক্ষাকর্তা রক্ষা করেন এবং সময় হলে ধ্বংসকর্তা তার কাজ সম্পন্ন করেন। কালের আবর্তেই সবকিছু ঘুরছে।

হে আমার প্রাণাধিকা প্রিয়া তুলসী! তুমি সেই ত্রিগুণাতীত, সত্যস্বরূপ, সর্বেশ্বর, সর্বাত্মা অনন্ত, পরমেশ্বর, পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের শরণ নাও। যিনি সৃষ্টি, পালন ও সংহারের অধিকর্তা। সেই শ্রীহরির ভজনা করো। যিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবাদি দেবতাদের ঈশ্বর প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্র। সেই বিশ্বপিতা শ্রীকৃষ্ণের চরণ বন্দনা করো। যাঁর আদেশে বায়ু দ্রুতগামী হয়ে সর্বদা প্রবাহিত হয়, যাঁর আদেশে সূর্য উদিত হয় ও অস্ত যায়, যাঁর আদেশে ইন্দ্র সঠিক সময়ে বৃষ্টি দান করে, অগ্নি সব কিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়, যাঁর আদেশে চন্দ্রোদয় হয়, তুমি সেই পরমব্রহ্মের শরণাপন্ন হও। তিনিই আমাদের সব। পিতা, মাতা, বন্ধু, সখা, পত্নী কেউ কারো নয়, তারই নির্দেশে আমরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়েছি। আবার তাঁরই নির্দেশে আমরা একে অন্যকে ছেড়ে চলে যাব। শ্রীকৃষ্ণ সকলের পরম বন্ধু। তুমি তার পাদপদ্মে অর্ঘ্য নিবেদন করো।

তুলসী! বিপদের সময় যারা শোকে কাতর হয়ে পড়ে তারা জ্ঞানহীন। জ্ঞানী লোকে কখনও এরকম আচরণ করবে না। কারণ সে জানে সুখদুঃখ কখনও হাত ধরাধরি করে আসে না। সুখ দুঃখ চক্রাকারে ঘোরে। তাই বলছি, তুমি শ্রীহরির পাদপদ্ম বন্দনা কর। যাকে লাভ করবার জন্য বদারিকা আশ্রমে কঠোর তপসা করেছিলে। তুমি গোলোকে গোবিন্দের দেখা পাবে। আমিও এই দানব দেহ থেকে মুক্তি পাব। ঠাঁই পাব গোলোকধামে। যেখানে আবার আমরা পরস্পরকে সম্পূর্ণ ভাবে দেখব। তাই দুঃখ কর না। এই নশ্বর দেহ ছেড়ে আবার আমরা গোলোকেই ফিরে যাব।

দিন তখন অতিক্রান্ত হতে চলেছে। শঙ্খচূড় তাঁর পত্নীকে নিয়ে রত্ন প্রদীপ যুক্ত রত্ন মন্দিরে প্রবেশ করলেন। ফুলে ফুলে সজ্জিত শয্যা সুবাসিত চন্দনের গন্ধে বাতাস আমোদিত। শঙ্খচূড় ও তুলসী সুরত কার্যে লিপ্ত হলেন। কিন্তু তুলসীর মন তখনও ভারাক্রান্ত। তিনি কাঁদছেন। শঙ্খচূড় তুলসীকে বুকের মাঝখানে টেনে নিলেন। তাকে আদর করতে করতে অনেক তত্ত্বজ্ঞান শোনালেন। যে জ্ঞান স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে তিনি লভে করেছিলেন। উৎকৃষ্ট সেই জ্ঞান সমস্ত শোক দূর করে তুলসীর মুখে আনন্দের প্রকাশ ঘটাল। তিনি স্বামীর সঙ্গে আবার সুখ সাগরে ডুব দিলেন। হে মুনি! স্বামী স্ত্রীর দেহে এইভাবে পুলক জাগল। সুরতের সময় তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমন ভাবে সন্নিবিষ্ট ছিল যেন হরগৌরীর প্রতিমূর্তি। কখনও নিদ্রায়, কখনও একে অপরের দেওয়া তাম্বুল খেয়ে, কখনও গল্প করে, কখনও নানা রসের ভাব অবলম্বন করে তাদের সে রাত কেটে গেল। তার দুজনেই ছিলেন রতিক্রিয়ায় পারদর্শী।

.

অষ্টাদশ অধ্যায়

নারায়ণ বললেন– কৃষ্ণভক্ত শঙ্খচুড় বিছানা থেকে ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে পড়লেন। শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করলেন মনে মনে। বাসি জামাকাপড় ছেড়ে স্নান করে পবিত্র হলেন। কপালে কাটলেন তিলক। তারপর বিধি সম্মত ভাবে সন্ধ্যা আহ্নিক সারলেন। ইষ্টদেবতার পুজো করলেন। দই, ঘি, মধু, খই, ইত্যাদি দিয়ে পুজো করলেন। অন্যান্য দিনের মত ব্রাহ্মণদের দান ধ্যান করতে লাগলেন।

মণিমাণিক্য, ধনরত্ন, কাপড়, সোনা ভক্তিভরে দান করলেন। যুদ্ধের মঙ্গল কামনা করে গুরুদেবকে অমূল্য রত্ন এবং মণিমুক্ত ও হীরে দান করলেন। সাধারণ ব্রাহ্মণেরা পেল হাতি, ঘোড়া, গোরু, মোষ আরও কত কী।

তিন লক্ষ নগর ও একশ কোটি গ্রাম স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে বিলিয়ে দিলেন। রাজসিংহাসনে ছেলে সুচন্দ্রকে বসিয়ে তার হাতে তুলে দিলেন রাজ্যভারের দায়িত্ব। প্রজা দাসদাসী, রাজকোষ, বাহন সবকিছুই সমর্পন করলেন।

এবার তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার জন্য তৈরি হলেন। গলায় দোলালেন মৃত্যুঞ্জয়ী কবচ। হাতে নিলেন ধনুক।

ইতিমধ্যে সৈন্যসামন্ত এসে হাজির হয়েছে। এসেছে পাঁচলক্ষ হস্তি বাহিনী, তিন লক্ষ অশ্ববাহিনী, দশ হাজার রথ, ধনুকধারী সৈন্য। সব সমেত দানব সংখ্যা নয় কোটি অর্থাৎ অপরিমিত সৈন্যসংখ্যা। তাদের মধ্যে একজনকে শঙ্খচূড় সেনাপতি নির্বাচন করলেন। তিনি ছিলেন বীর, রণকুশলী, সাহসী ও বুদ্ধিমান। তিন লক্ষ অক্ষৌহিনী সেনা তার অধীনে দেওয়া হল। তারা যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে সকলকে হুঁশিয়ারি দেবে।

শঙ্খচূড় শিবির থেকে বেরোবার আগে শ্রীহরির বন্দনা করলেন। তারপর রত্ন-নির্মিত রথে উঠে বসলেন। শঙ্খচূড় চন্দ্রভাগা নদীতীরে এসে পৌঁছোলেন।

এই নদীর উৎস হিমালয়। এই জল প্রবাহ গোমস্তক পাহাড়ের কোল ঘেঁষে পশ্চিম সাগরে গিয়ে পড়েছে। এই নদীর তীরে সিদ্ধক্ষেত্র নামে যোদ্ধাদের একটি সিদ্ধাশ্রম আছে। এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সেই পবিত্র অক্ষয়বট গাছ। সেই পবিত্র অক্ষয় বট গাছ, পাঁচশ যোজন ও পাঁচ যোজন বিস্তৃত লম্বা ও চওড়া। এই জায়গার পশ্চিম দিকে পশ্চিম সাগর, পূর্বে মলয় পর্বত, দক্ষিণে শ্রীশৈল এবং উত্তরে গন্ধমাদন পাহড়। চন্দ্রভাগা ও শাশ্বতী নদী শান্ত ভাবে বয়ে চলেছে।– শঙ্খচূড় অক্ষয় বটের সামনে এলেন। দেখলেন, যেখানে শিব যোগাসনে বসে আছেন। ব্রহ্মতেজে তিনি উজ্জ্বল। বিশুদ্ধ স্ফটিকের মত সাদা তার গায়ের রং। তিনি সদা আনন্দময় এবং স্মিতহাস্য। পরণে বাঘের ছাল। গলানো সোনার মত জটাজাল মাথা থেকে নেমে এসেছে। তিনি ত্রিলোচন ও পঞ্চানন ত্রিশূল ও কুড়াল ধারী। সাপই তার অঙ্গের ভূষণ। তিনি মৃত্যুঞ্জয়, শান্ত ও সুন্দর। তিনি বিশ্বের পালক। তিনি ভক্তবৎসল ও বিশ্বপ্রণেতা।

শঙ্খচূড় শিবকে প্রণাম করলেন। তার সমস্ত সৈন্যরাও ভোলা মহেশ্বরকে ভক্তিভরে প্রণাম জানাল। শিবের সামনে ছিলেন কার্তিক ও বাঁদিকে ভদ্রকালী। শঙ্খচূড় তাঁদের উদ্দেশ্যেও প্রণাম জানালেন।

শিবের পার্ষদবৃন্দ উঠে দাঁড়িয়ে শঙ্খচুড়কে সম্মান জানালেন। মহেশ্বর শঙ্খচূড়কে হাত তুলে তথাস্তু বললেন। তারপর তাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হল।

শিব বললেন– শঙ্খচুড়। তোমাকে অতীতের এক কাহিনী বলছি শোনো। জগতের সৃষ্টিকারী ধর্মজ্ঞ ব্রহ্মা ছিলেন ধর্মের পিতা। তার পুত্রের নাম মরীচি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং বিষ্ণুর উপাসক।

মরীচির পুত্রের নাম ধার্মিক কশ্যপ। কশ্যপ প্রজাপতি দক্ষের তেরো জন মেয়েকে স্ত্রী রূপে পান। তাদের একজন ছিলেন পরমসৌভাগ্যবতী সতী। তাঁর নাম দনু। দনুর গর্ভজাত চল্লিশ জন পুত্রও অত্যন্ত পরাক্রমশালী। দনুর নাম থেকেই এই পুত্ররা দানব নামে পরিচিত। চল্লিশজন দানবের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন বিচিত্তি। তার ছেলের নাম দম্ভ। তিনি ছিলেন ধার্মিক, জিতেন্দ্রীয় এবং শ্রীহরির অনুগামী, তার গুরু ছিলেন শুক্রাচার্য। দম্ভ পুষ্করতীর্থে এক লক্ষ বছর ধরে শ্রীকৃষ্ণের তপস্যায় ডুবে ছিলেন। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেন এবং শ্রীহরির আশীবাদে দম্ভ যে পুত্র সন্তান লাভ করেন, সে হলে তুমি, শঙ্খচূড়। রাধার অভিশাপে দানব বংশে জন্মের আগে তুমি ছিল গোলোকে। শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় আটজন গোপের মধ্যে তুমি ছিলে একজন, তুমি এখনও বৈষ্ণব, তবে প্রত্যেক বৈষ্ণব এক অভির্ষক পোষণ করে যে ব্ৰহ্ম থেকে শুরু করে স্তম্ভ পর্যন্ত সবকিছুই মিথ্যা।

তারা শ্রীহরির সালোক্য, সৃষ্টি, সারূপা সামীপ্য ও ঐক্য-এসব সম্পর্কে তারা তত্ত্বজ্ঞান শুনতে চায় না। ব্রহ্মত্ব বা অমরত্ব তাদের কাছে মূল্যহীন। আর ইন্দ্রত্ব বা কুবেরত্বের কথা বাদই দাও। হে রাজা! তুমি কৃষ্ণের ভক্ত, তোমার ওই ভ্রমমূলক দেবতাদের রাজ্যের অধিকার নিয়ে কি লাভ? তুমি ওদের অধিকার ও রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে, নিজের রাজ্য নিয়ে সুখে দিন কাটাও, আর কৃষ্ণ ভজনা করো, দেবতাও দানব– সকলেই কাশ্যপের বংশধর। দেবতা ও দানব সম্পর্কে ভাই। নিজেদের মধ্যে বিবাদ ঘটিয়ে কি লাভ হবে, বলতে পারো, জ্ঞাতির সাথে ঝগড়া বিবাদ করা এক মস্ত বড়ো পাপ, যা ব্রহ্মহত্যার পাপের ষোলো ভাগের বেশি। তুমি হয়তো ভাবছ এতে তোমার সম্পদ ও সম্মানহানি হবে। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। কোনো জিনিসই অক্ষয়ও অমর নয়, প্রাকৃতিক প্রলয়ে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মেরও পতন ঘটে।

আর তুমি তো সামান্য। পরমেশ্বরের অনুগ্রহে আবার সৃষ্টির কাজ শুরু হয়। এইসব সৃষ্টি প্রাণীদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি আগের জন্মের তপস্যার ফল অনুসারে হয়ে থাকে। সত্য যুগে ধর্মত্ত সত্য পাশাপাশি পরিপূর্ণ ভাবে ছিল। ত্রেতা যুগে তা হয় তিন ভাগ, দ্বাপরে দুই ভাগ এবং কলিযুগে তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ধীরে ধীরে তা হ্রাস পেয়ে অমাবস্যার চাঁদের মতো কলামাত্র বর্তমান থাকে। গ্রীষ্মকালে সূর্যের তেজ যেমন থাকে শীতকালে তা থাকে না। আবার সন্ধ্যাবেলা বা সকাল বেলার সূর্যের তাপ দুপুর বেলার মতো হয় না। সূর্য প্রত্যহ নির্দিষ্ট নিয়মে উদিত হয়, সময়ের সাথে তার প্রকান্ডতা বেড়ে যায়। আবার যথা সময়ে পশ্চিমাকাশে ডুবে যায়। ঘন বর্ষায় সূর্যের মুখ দেখা যায় না। আবার রাহুর কোপে সূর্য ঢাকা পড়ে যায়, রাহু সরে গেলে সূর্য কিরণ দেয়।

পূর্ণিমা তিথিতে চাঁদ সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু অন্যান্য তিথিতে তা হয় না। চাঁদ রাহুগ্রস্ত হলে বা কালো মেঘে ঢাকা পড়লে চাঁদের জ্যোৎস্না দেখা যায় না। কালক্রমে সেই চাঁদই পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ কালের ভেদে সবকিছু ঘটে চলেছে। স্বয়ং ইন্দ্রও কালের অধীন, কখনও ঐশ্বর্যশালী এবং কখনও ঐশ্বর্যহীন। সম্পদ শূণ্য হয়ে যে বলি সুতলে অবস্থান করবে কালের হাত ধরে সেই একদিন ইন্দ্রের রত্ন সিংহাসনে বসার অধিকার লাভ করবে। ব্রহ্মা, শিবা প্রভৃতি দেবতারা, দানব, মুনীন্দ্র, যোগীন্দ্র, মানব– সকলেই কালক্রমে সৃষ্টি হয়ে বিনাশের পথে চলে যায়। একমাত্র পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ হলেন অবিনশ্বর। তাঁর সৃষ্টি যেমন নেই তেমন ধ্বংসও নেই। তিনি অনিত্য। শ্রীকৃষ্ণই প্রকৃত রূপধারী এবং প্রকৃত পুরুষ। তিনিই আত্মা ও জীব। শ্রীকৃষ্ণপদে যে স্থির মতি রাখে সে কাল ও মৃত্যুকে জয় করতে পারে। শ্রীকৃষ্ণের আজ্ঞা ও ইচ্ছানুসারে ব্রহ্মা হয়েছেন সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু পালনকর্তা এবং আমি, মহাদেব, সংহারকারী।

হে রাজা! আমি ধ্বংসের কাছে কালাগ্নি রুদ্রকে নিয়োগ করি এবং তার গুণগান করি, তাই মৃত্যুজ্ঞয় মৃত্যু আমার ধারে কাছে আসতে ভয় পায়।

সর্বভাবন, সর্বজ্ঞ শিবের উপদেশ শুনে রাজা শঙ্খচুড় মুগ্ধ হলেন। ধীর স্থির কণ্ঠে শঙ্খচুড় বললেন– হে নাথ! আপনি এতক্ষন যে তত্ত্বজ্ঞান দিলেন, তা সবই সত্যি। তবুও কয়েকটি প্রশ্ন আমার মনে জেগেছে, আপনার কথা অনুসারেই বলছি জ্ঞাতি বিরোধ যদি পাপ হয় তাহলে কেন দেবতারা ভাই হিরণ্য কশ্যপের সঙ্গে হিরণক্ষকে বধ করলেন? কেন বলিরাজকে চুরি করে নিয়ে পাতালে পাঠানো হল, আমি নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে সুতল থেকে যে সব ঐশ্বর্য নিয়ে এসেছি, তা নারায়ণের পক্ষেও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। দেবতারা কেন স্তম্ভ প্রভৃতি অসুরদের একের পর এক হত্যা করেছেন?

সমুদ্র মন্থনের সময় দেবতারা পেলেন অমৃত। আর আমরা পেলাম কষ্ট। জগতের সবখানে শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র। তিনি যা করতে চান তাই করেন। দেব দানবদের বিবাদ রোজই লেগে আছে, কখনও এরা মিশ খায় না, জল আর তেলের মতো। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি, আত্মীয় ও বন্ধুজ্ঞান করি, আমাদের বিরোধের মধ্যে আপনার থেকে কাজ নেই। তবে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি, যুদ্ধের সন্ধি করার কথা বলতে আপনি এসেছেন দেখে আপনার অপমান বোধ করা উচিত। আর যদি যুদ্ধ হয় এবং সে যুদ্ধে দেবতারা হেরে যায়, তাহলে আপনার মান, যশ, কীর্তি, সব ধুলোয় মিশে যাবে। তাই বলছি, আপনি আপনার সু-কীর্তি নিয়ে ফিরে যান নিজের ভবনে।

মহাদেব রাজা শঙ্খচূড়ের কথা শুনে স্থিত হাসলেন, মিষ্ট সুরে বললেন– শোনো রাজা, তোমরা আর আমরা একই ব্রহ্মার সৃষ্টি। অতএব লড়াই করে তোমাদের কাছে হেরে গেলে লজ্জা পাব কেন? আর আমার যশ, কীর্তির হানির সম্ভাবনাও নেই। এর আগে বহুবার দানবদের সঙ্গে দেবতারা যুদ্ধ করেছেন। শ্রীহরি স্বয়ং যুদ্ধ করেছিলেন মধু ও কৈটভের সঙ্গে, বিষ্ণুর সঙ্গে হিরণ্যকশিপুর, হিরণ্যাক্ষের সঙ্গে নারায়ণের, আমার সঙ্গে ত্রিপুরের যুদ্ধ হয়েছিল। এমন কি প্রকৃতিদেবী ও স্তম্ভ প্রভৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে ছিলেন। তবে এইসব যুদ্ধে যেসব দানবেরা মারা গেছে, তাদের সঙ্গে তোমার তুলনা করা উচিত নয়। তুমি পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের এক অন্যতম পার্ষদ। অতএব তোমার সাথে যুদ্ধ করতে আমি এতটুকু লজ্জিত নই। তাছাড়া স্বয়ং শ্রীহরি আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন, দেবতাদের অধিকার তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। নতুবা যুদ্ধ অনিবার্য। আর কোন কথা নয়।

.

ঊনবিংশ অধ্যায়

সুতপুত্র বললেন– মহাদেবের কথা শুনে রাজা শঙ্খচূড় পারিতবর্গকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, শিবকে প্রণাম জানালেন। তারপর রথে চড়ে চলে গেলেন। সৈন্যদের সঙ্গে মিলিত হলেন। হে শৌণক, তারপর কি ঘটেছিল তা নারায়ণের মুখ থেকে শুনুন।

নারায়ণ বললেন– হে নারদ! রাজা শঙ্খচূড় যখন সৈন্যদের সঙ্গে মিলিত হলেন তখন শিব তাড়াতাড়ি, উঠে দাঁড়ালেন। তার নির্দেশে রণভেরী বেজে উঠল। শুরু হলো দানব ও দেবতাদের মধ্যে ভয়ংকর যুদ্ধ।

স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র বৃষপর্বার সঙ্গে যুদ্ধ করলেন। বিচিত্তির সঙ্গে সূর্য, দম্ভাসুরের সঙ্গে চন্দ্র, কাল, কালেশ্বর, অগ্নি গোকর্ণে, বিশ্বকর্মা-ময়, কুবের কালকেয়, যম সংহার, বরুণ কলাবিঙ্ক, বায়ু চঞ্চল, বুধ ঘৃত পৃষ্ঠ, জয়ন্ত রত্নসার, শনৈশ্বর রক্তাক্ত, অশ্বিনী কুমারদ্বয় দীপ্তিমান, ধর্ম– দুজন, নলকুবের ধুম্রাপুর, ঈশান শোভাকর, মন্মথ পীঠর, মঙ্গল মন্ডুকাক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ, শুর হল। বসুরা বৰ্চাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করলেন। আদিত্যদের সাথে উল্কামুখ ধুম্র খড়গ, ধ্বজ, পিন্ড, সহানন্দী, বিশ্ব কাঞ্চীমুখ, পলাশ প্রভৃতি দানবদের প্রচন্ড যুদ্ধ চলতে লাগল। এগারো জন ভয়ংকর অসুর তখন এগারো জন মহারুদ্রের সাথে সংগ্রামে রত। দেবী মহামারী উগ্রচন্ড বা নন্দীশ্বরা প্রভৃতি দানবদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছেন।

দেবী কালী এবং পুত্র কার্তিককে নিয়ে মহাদেব বট গাছের গোড়ায় বসে ছিলেন। আর দৈত্যরাজ শঙ্খচূড় রত্ন, অলংকারে সজ্জিত হয়ে কোটি দানবদের সঙ্গে সুন্দর রত্নসিংহাসনে বসে ছিলেন।

যুদ্ধ করতে করতে দেবতারা ক্ষত-বিক্ষত হলেন। তখন শিবের দলের শক্তি কমে এসেছে। দৈত্যদের যুদ্ধের প্রচন্ডতায় দেবতারা ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলেন। তখন স্কন্দ রেগে গিয়ে দেবতাদের অভয় দিলেন। তাঁর তেজের প্রভাবে মিত্রদের তেজ বেড়ে গেল। তিনি একা দৈত্যদের সঙ্গে লড়াই চালাতে লাগলেন। শত্রুপক্ষের একশো অক্ষৌহিনী সেনার মৃত্যু হল। আর কমললোচনা কালী নিজের হাতে নরকপাল পাতিত করে তা দিয়ে দানবদের রক্ত একশো নরকপালে পান করলেন। দশলক্ষ শ্রেষ্ঠ হাতি ও একশো লক্ষ ঘোড়া। তিনি তখন একহাতে ধরেছেন আর অতি সহজে মুখে ভরে দিচ্ছেন।

হে নারদ! হঠাৎ রণস্থানে পড়ে থাকা গলাকাটা দেহ উঠে দাঁড়াল। তারা নেচে বেড়াতে লাগল। স্কন্দ তার বাণ নিক্ষেপ করে দানবদের এত ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন যে, তারা পড়িমরি করে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচল। এবার স্কন্দের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এগিয়ে এল বৃষপর্বা তারপর বিচিত্তি। এই ভাবে দম্ভ ও বিকঙ্কণ প্রভৃতি দানবের সঙ্গে তার ভীষণ যুদ্ধ চলতে লাগল। মহামারী তখনও বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করে চলেছেন। স্কন্দের সঙ্গে যুদ্ধে আহত হয়ে সব দৈত্যরা রেগে গেল। স্বর্গে দুন্দুভি বেজে উঠল। আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি ঝরে পড়ল স্কন্ধের উপর। কাতারে কাতারে দানব ধরাশায়ী হল। যুবক দানবেরা ধ্বংস হল।

রাজা শঙ্খচূড় আর চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না। তিনি রথে বসেই একের পর এক তীর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। তাঁর নিক্ষিপ্ত বাণ থেকে অন্ধকার আর আগুন সৃষ্টি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র রণাঙ্গন জুড়ে। এ দৃশ্য দেখে দেবতারা ভয়ে যে যার মতো পালিয়ে গেল। দেখা গেল শিবের দলের সেনাপতি কার্তিক ছাড়া আর কেউ নেই। রাজা শঙ্খচূড় তাকে লক্ষ করে বাণ ছুঁড়তে লাগলেন। তার নিক্ষিপ্ত বাণে পাহাড়, সাপ, বরফ, গাছ আরও কত কিছু সৃষ্টি হল। মেঘে ঢাকা সূর্যের মতো কার্তিক পড়ে গেলেন। শঙ্খচূড়ের শক্তিশালী তীর এসে স্কন্দের ভয়ংকর ও দুরুহ ধনুক ভেঙ্গে টুকরো হল। তার দিব্য রথ হল ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো। রথের ঘোড়া গুলি মারা পড়ল, শঙ্খচূড়ের নিক্ষিপ্ত দিব্যবাণ এসে লাগল কার্তিকের বুকে। তিনি চেতনা হারালেন। ওখানে লুটিয়ে পড়লেন, খানিক বাদে উঠে বসলেন। তিনি অন্য একটি রথে চড়ে আবার যুদ্ধ শুরু করলেন। বিষ্ণু তাঁকে দিলেন এক দিব্য ধনুক।

কার্তিক তখন ভীষণ ক্ষেপে গেছেন। তার অস্ত্র দানবদের ছোঁড়া সমস্ত সাপ, পাহাড়, গাছ ও পাথরকে কেটে টুকরো টুকরো করে দিল। পাৰ্জন্য অস্ত্রের সাহায্যে তিনি আগুন নিভিয়ে দিলেন। শঙ্খচূড়ের ধনুক, রথ বর্ম, সারথি এবং তার মাথার মুকুট সব চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন। উল্কার বেগে শক্তিশালী এক বাণ ছুটে এল শঙ্খচূড়ের দিকে সেটি তার বুকে আঘাত করল, তিনি জ্ঞান হারালেন। অল্পক্ষণ পরেই তিনি হুঁশ ফিরে পেলেন। নতুন একটি রথে চড়ে আবার যুদ্ধ করার জন্য তৈরী হলেন।

হে দেবর্ষি নারদ! তখন মায়াবীদের শ্রেষ্ঠ শঙ্খচূড় মায়াবলে বাণের জাল সৃষ্টি করে তা দিয়ে কার্তিককে আবৃত করলেন এবং এমন এক অব্যর্থশক্তি প্রয়োগ করলেন যা বিষ্ণুতেজে তেজিয়াল এবং প্রলয়কালের আগুনের শিখার সমান। সেই শক্তির প্রভাবে মহাবলী কার্তিক মুচ্ছা গেলেন। দেবীকালী তাকে তুলে নিলেন কোলে। শিবের কাছে নিয়ে এলেন। শিবের সাহায্যে কার্তিক আবার সুস্থ হয়ে উঠলেন এবং অর্জিত শক্তি লাভ করলেন।

নন্দীশ্বর প্রভৃতি বীর, সমস্ত দেবতা, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, সমস্ত দেবতা গন্ধব যক্ষ, রাক্ষস, কিন্নর শতকোটি বক ও অনেক রকম বাদ্যমন্ত্র সঙ্গে নিয়ে কালী নিজে রণক্ষেত্রে এসে প্রবেশ করলেন। তার রণ হুংকারে দৈত্যরা পটাপট মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সংজ্ঞা হারালেন। তাঁর বীভংস হাসিতে বিশ্বচরাচর কেঁপে উঠল। তিনি আনন্দিত হয়ে মাধ্বীকসুরাপান করতে থাকলেন এবং নৃত্য করতে লাগলেন। উগ্রচন্ডা, উগ্রদংষ্ট্র, কোট্টরী, ডাকিনী যোগিনী ও সমস্ত দেবতারা তখন সেই অমৃতসুরা পান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রাজা শঙ্খচূড়কে লক্ষ্য করে কালী প্রলয় কালীন আগুনের শিখার সামনে অগ্নিবাণ ছুঁড়ে দিলেন। শঙ্খচূড়ের পাৰ্জন্য অস্ত্র সহজেই তা প্রতিরোধ করল। এবার মহেশ্বরের অস্ত্র ছুটে এল। রাজার বৈষ্ণব অস্ত্র তাকে কেটে ফেলল। এবার দেবী কালী মন্ত্রপুত নারায়ণ অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। শঙ্খচূড় রথ থেকে নেমে এসে ওই শক্তিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই অস্ত্র শক্তিপথ পালটে ওপর দিকে চলে গেল। শঙ্খচূড় সাষ্টাঙ্গে নারায়ণের উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করলেন।

কালীর নিক্ষিপ্ত ব্রহ্মাস্ত্র ফিরে গেল শঙ্খচূড়ের পাঠানো ব্রহ্মাস্ত্রের কাছ থেকে। এবার দুই পক্ষেই দিক থেকে ছুটে এল দিব্যাস্ত্র। সেগুলো শত্রদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল, কারোকে আঘাত করল না। যোজন বিস্তৃত শক্তিকে শঙ্খচূড়ের ধারালো অস্ত্র একশো টুকরো করে দিল। বার বার ব্যর্থ হয়ে দেবী কালী প্রচন্ড রেগে গেলেন। পাশুপত শক্তি প্রয়োগ করার জন্য তিনি তৈরি হলেন।

ঠিক এইসব আকাশবাণী ধ্বনিত হল– হে দেবী! পাশুমতাস্ত্রও বিফলে যাবে। রাজা শঙ্খচুড়ার গলায় আছে হরিকবচ যতদিন ওই কবচ আর ওর স্ত্রীর তুলসীর সতীত্ব অটুট থাকবে ততদিন রাজা শঙ্খচূড়ের মৃত্যু হবে না। ব্রহ্মা তাকে এই বর দিয়েছেন।

দেবীকালী তখন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে রণাঙ্গন জুড়ে লাফালাফি করতে লাগলেন, আর শত শত দানো ধরে মেরে ফেললেন, এবার ছুটে এলেন শঙ্খচূড়ের দিকে। শঙ্খচূড় সঙ্গে সঙ্গে ধারালো দিব্য অস্ত্র দিয়ে তাকে প্রতিহত করলেন। তা দেখে দেবী একটা খড় শত্রুকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলেন। রাজার নিক্ষিপ্ত ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সেই খড়গ ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। দেবী তাকে গিলে খাওয়ার জন্য তেড়ে গেলেন। রাজা তাঁকে বারণ করলেন। দেবী রেগে গিয়ে দানবরাজের রথ ভেঙে টুকরো করে দিলেন, রথের সারথিকে ধ্বংস করলেন এবং প্রলয়কালীন আগুনের শিখার ন্যায় শূল নিক্ষেপ করলেন। অনায়াসেই সেইখুল দানবরাজের মুঠোবন্দি হল। দেবী ক্রোধে ফেটে পড়লেন। এক ঘুসি লাগিয়ে দিলেন। দুটির আঘাতে রাজা শঙ্খচূড় সাময়িক ভাবে জ্ঞান হারালেন। পরক্ষণেই উঠে বসলেন। দেবীর উদ্দেশ্যে প্রণাম করলেন এবং দেবীর ছোঁড়া সমস্ত অস্ত্র নিজের শক্তি দিয়ে কাটলেন ও নিয়ে নিলেন।

দেবীকে লক্ষ্য করে আর কোন শক্তি প্রয়োগ করলেন না। কালী তাকে তুলে ধরলেন। পাক খাইয়ে খাইয়ে ওপরে দিকে ছুঁড়ে মারলেন। শঙ্খচূড় পাক খেতে খেতে সজোরে নীচে এসে পড়লেন। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ভদ্র কালীর উদ্দেশ্যে নমস্কার জানালেন। তারপর এক রত্ন রথে উঠে বসলেন।

এদিকে ভদ্রকালী ছুটে এলেন শিবের কাছে। তিনি বললেন– হে প্রভু! আমি দানবদের রক্ত পান। করে মাংস খেয়ে সবাইকে শেষ করে দিয়েছি। রাজা শঙ্খচূড়ের মাত্র এক লক্ষ দানব বেঁচে আছে। রাজাকে বধ করার জন্য শক্তিশালী অস্ত্র ছুঁড়েও বারবার ব্যর্থ হয়েছি। এই সময় দৈববাণী শুনতে পাই– পদ্মযোনি ব্রহ্মার বরে রাজা শঙ্খচূড় অমর হয়ে আছে। রাজেন্দ্র-মহাজ্ঞানী ও মহাপরাক্রমশালী শঙ্খচূড় আমাকে একবারও আক্রমণ করেনি। সে কেবল আমার পাঠানো শক্তিগুলিকে ধারালো অস্ত্রের দ্বারা প্রতিহত করেছে।

.

বিংশ অধ্যায়

নারায়ণ বলে চললেন– যুদ্ধের খবরাখবর শুনে স্বয়ং মহাদেব রণাঙ্গনে এসে হাজির হলেন। দানবরাজ রথ থেকে নেমে দাঁড়ালেন। সাষ্টাঙ্গে শিবের সামনে প্রণাম জানালেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার রথে উঠে বসলেন। গায়ে বর্ম পরে নিয়ে দুর্বহ এক ধনুক হাতে তুলে নিলেন। শুরু হল শঙ্খচূড় ও মহাদেবের মধ্যে যুদ্ধ। টানা এক বছর ধরে এই সংগ্রাম চলছিল। জয় পরাজয় কারোরই হল না, শেষ পর্যন্ত দুই মহান শক্তিধর রথী হাতের অস্ত্র নামিয়ে রেখে যে যার বাহনে উঠে বসলেন।

যুদ্ধক্ষেত্রের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল মৃত সৈন্যের দেহ। তখন জীবিত অসুরসৈন্যের সংখ্যা মাত্র একশো, শিবের তেজবলে মৃত দেবতারা প্রাণ ফিরে পেলেন।

একময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে মায়াবলে স্বয়ং বিষ্ণু যুদ্ধক্ষেত্রে এসে দাঁড়ালেন। তিনি শঙ্খচূড়কে বললেন– হে অসুরপতি! আমি ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত, দয়া করে এই বুড়ো ব্রাহ্মণকে কিছু ভিক্ষে দাও। শুনেছি, তুমি নাকি, কল্পতরু, যে যা চায়, তাই-ই তুমি দিয়ে থাকো।

রাজা শঙ্খচূড় মৃদু হেসে বললেন– আপনি কি নিতে চাইছেন বলুন, আমি তাই দেব। তোমার গলায় যে কবচটা ঝুলছে, সেটি আমাকে ভিক্ষা দাও। শঙ্খচূড় কোনো রকম ভাবনা চিন্তা করে গলা থেকে কবচটি খুলে ব্রাহ্মণের হাতে তুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মায়ারূপে আবির্ভূত ব্রাহ্মণ অদৃশ্য হলেন। এবার ব্রাহ্মণের ভেক ছেড়ে নারায়ণ হলেন রাজা শঙ্খচুড়। উদ্দেশ্য শঙ্খচূড়ের পত্নীর সতীত্ব হরণ করা।

ওদিকে যুদ্ধ আবার বেধে গেল। মহাদেব শ্রীহরির কাজ থেকে লাভ করা শূল তুলে নিয়ে শঙ্খচূড়ের দিকে তেড়ে গেলেন। সেই শূলের তেজ গ্রীষ্মকালের মধ্যাহ্নের একশো সূর্যের দীপ্তিকে হার মানায়, ওই অস্ত্রের সম্মুখ ভাগে অবস্থান করছেন নারায়ণ, মূলে শিব আর মধ্যভাগে স্বয়ং ব্রহ্মা, শূলের শানের দায়িত্বের আছেন ভৈরব কাল। প্রলয়কালীন আগুনের শিখায় ন্যায় শূল জ্বাজল্যমান। দুর্নিবার, দুর্ধর্ষ, অব্যর্থ ও শত্রুঘাতিক এই শূল সুদর্শন চক্রের ন্যায় তেজস্বী। যে কোনো অস্ত্র এই আগুন শিখার সামনে জ্বলে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এই ভয়ংকর অস্ত্র বহন করার ক্ষমতা রাখেন একমাত্র শিব ও বিষ্ণু, চার হাজার ও একশো হাত পরিমাপ বিশিষ্ট এই নিত্য অনির্মিত অস্ত্রটি ব্রহ্মস্বরূপ।

শিব সেই ব্রহ্মান্ড ধ্বংস কারী অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। সেটি তীব্র পাক খেতে লাগল শূন্যপথে। তারপর চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে ছুটেলো রাজা শঙ্খচূড়ের দিকে। শঙ্খচূড় এ দৃশ্য দেখে তৎক্ষনাৎ নিজের হাত থেকে ধনুক পরিত্যাগ করলেন। আসন করে বসলেন। পরম ভক্তিভরে শ্রীকৃষ্ণের পদযুগল, বন্দনা করলেন। সেই দুর্ধর্ষ অস্ত্র ততক্ষণে শঙ্খচুড়ের রথের কাছাকাছি চলে এসেছে। রথকে কেন্দ্র করে পাক খাচ্ছে সে তখন। দানব রাজের রথে আগুন ধরে গেল। সেই সঙ্গে রাজা শঙ্খচূড়ও পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন। তিনি নিজের দেহ ত্যাগ করে গোলোকধামে যাত্রা করলেন। তারপর রাজা শঙ্খচূড়, দুই হাত বিশিষ্ট–এক হাতে বাঁশী, রত্ন অলংকারে সজ্জিত কিশোরদিব্য গোপবেশেও কোটি গোপ তাকে সংবর্ধনা করে নিয়ে চললেন। রত্ন নির্মিত এক রথে চড়ে তিনি গোলোকে এলেন।

হে নারদ! তখন শ্রীরাধামাধব রাসমন্ডলে বৃন্দাবনে কুঞ্জের মধ্যে অবস্থান করছিলেন। সুদামা পরম ভক্তিভরে শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করলেন, সকলে তাঁকে দেখে আহ্লাদ প্রকাশ করলেন। স্নেহের বশবর্তী হয়ে অনেকে তাকে কোলে তুলে নিলেন।

শঙ্খচূড়কে ধ্বংস করে সেই শূল ফিরে এল শিবের হাতে। শিব হলেন শূলপানি। শঙ্খচূড়ের হাড়গুলি লবণ সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। সেই হাড়গোড় থেকে এক জাতির সৃষ্টি হয়, তারা হল। শঙ্খজাতি। এই শঙ্খ নানা আকার বিশিষ্ট, নিত্য ও পবিত্র। শঙ্খের জল দেবতাদের আনন্দ দান করে। পূজোতে শঙ্খের জল প্রয়োজন হয়। শিব পূজোয় জলশঙ্খ বিধেয়। শঙ্খের জল তীর্থের জলের সমান পবিত্র। যেখানে শাঁখ বাজানো হয়, সেখানে লক্ষ্মীদেবী অচলা থাকেন। শাঁখের মধ্যে শ্রীহরির অবস্থান। তাই যেখানেই শঙ্খ, সেখানেই শ্রীহরি বর্তমান। শ্রীহরির পাশাপাশি লক্ষ্মীদেবীও সেখানে অবস্থায় করেন, সেখানে কোনো অমঙ্গল ঘটেনা, যে কোনো স্ত্রী অথবা পুরুষ শূদ্র শাখ বাজালে লক্ষ্মীদেবী কুপিত হন। তিনি সেই স্থান ত্যাগ করেন।

শিব তাঁর অতীষ্ট কাজ শেষ করে বৃষের পিঠে চেপে বসলেন। দেবতারাও তাকে অনুসরণ করলেন। দানব রাজ শঙ্খচুড়কে বধ করতে পেরে সকলেই তখন আনন্দিত। শিব ফিরে গেলেন তাঁর নিজস্ব বাসমন্দিরে। দেবতারা নিজের নিজের রাজ্য, অধিকার ক্ষমতা– সব ফিরে পেলেন। স্বর্গে তখন আনন্দের বান ডেকেছে। দুন্দুভি বেজে উঠল নৃত্য ও গীত শুরু হল। দেবতারা শিবের মাথায় পুষ্প বৃষ্টি ঝরালেন। দেবতা ও মুনীন্দ্রদের শিবস্তুতিতে তখন সভাস্থল মুখরিত।

.

একবিংশ অধ্যায়

সৌতি বললেন– হে মুনি, হরি শ্রেষ্ঠ! তুলসীর গর্ভে কিভাবে ভগবান বীর্যধান করেছিলেন, সে কাহিনী নারদকে শোনালেন নারায়ণ! আপনাকে তাঁর কথাতেই বলছি, শ্রবণ করুন।

নারায়ণ বললেন– দেবতাদের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য স্বয়ং ভগবান শঙ্খচূড়ের রূপ ধরলেন। দানবরাজ পত্নী তুলসীর দরজার সামনে এসে তিনি দুন্দুভি বাজালেন। নিজের ফিরে আসার কথা ঘোষণা করলেন। তুলসী স্বামী ফিরে আসার কথা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের ধন দৌলত দান করলেন। মাঙ্গলিক ক্রিয়াকার্য শেষ করলেন। ভিখারী, বন্দি, স্তুতিপাঠকদের দুহাত ভরে ধন বিতরণ করলেন।

এদিকে শঙ্খচূড়রূপী শ্রীবিষ্ণু রথ থেকে নেমে এসে দাঁড়ালেন তুলসীর অমূল্যরত্ন নির্মিত ভবনের দরজার সামনে। পতি প্রিয়া তুলসী সোহাগে স্বামীর পা ধুইয়ে দিলেন। প্রণাম করলেন। আনন্দের অতিশয্যে তাঁর চোখ দিয়ে তখন অঝোরে জল গড়াচ্ছে। কামবিলাসিনী সুন্দরী তুলসী স্বামীকে নিয়ে বসালেন এক রত্ননির্মিত সিংহাসনে, তার হাতে তুলে দিলেন কর্পূর দেওয়া তাম্বুল। মনে মনে বললেন– আহা, আজ আমার জীবন সার্থক হল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পতি আবার আমার কাছে ফিরে এসেছেন। এ সুখ আমি কোথায় রাখি! তিনি মিষ্টি হেসে স্বামীর দিকে কটাক্ষপাত করলেন। আনন্দে গদগদ হয়ে মধুর শব্দচয়নে জানতে চাইলেন- হে কৃপাময় প্রভু! অসংখ্য বিশ্বকে ধ্বংস করা যে পুরুষের কাছে সামান্য, তাকে আপনি কী করে পরাজিত করলেন? আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে, দয়া করে আমার কৌতূহল দমন করুন।

শঙ্খচূড়রূপী শ্রীবিষ্ণু বললেন– হে প্রিয়তমা! আমরা দুজনে এক বছর ধরে যুদ্ধ করেও কেউ কাউকে হারাতে পারলাম না। তখন ব্রহ্মা এসে মীমাংসা করে দিলেন। আমরা তখন পরস্পরের বন্ধু হলাম। আমি দেবতাদের রাজ্য ও অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে যাত্রা করি, শিব শিবলোকে ফিরে গেলেন। শ্রীবিষ্ণু এই কথা বলে শয্যা গ্রহণ করলেন এবং তুলসীর সাথে রমণসুখ উপভোগ করতে লাগলেন, কিন্তু সম্ভোগের সুখ আকর্ষণ অন্য রকম বলে সতী তুলসীর খটকা লাগল। তিনি চিৎকার করে বললেন–আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি কে? তুমি মায়া বলে আমাকে উপভোগ করেছ। তুমি মায়াবী ঈশ্বর। আমার সতীত্ব নষ্ট করেছ, তোমাকে এর শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমি অভিশাপ দেব।

হে নারদ! অভিশাপের ভয়ে শ্রীহরি স্বমূর্তি ধারণ করলেন। দেবী তুলসী তখন সামনে কিশোর নীরদশ্যাম সনাতন পরম পুরুষ নারায়ণকে দেখতে পেলেন। শরৎকালের পদ্মফুলের মত তাঁর দুটি আঁখি। অনিন্দ সুন্দর দুটি অধরে স্মিত হাসি। সেই মূর্তি নানা দুর্মূল্য ভূষণে ভুষিত, তিনি পীতবস্ত্র পরিহিত। কোটি কামদেবের থেকেও বেশি তিনি লাবন্যময়। স্বয়ং শ্রীহরিকে দেখে কামিনী তুলসী কামাবেশে মূচ্ছা গেলেন। খানিকবাদে তিনি জ্ঞান ফিরে পেলেন। উঠে বসলেন। বললেন– হে প্রভু! ভক্তরা আপনাকে দয়াবান বলে জানেন। আপনি সকলকে কৃপা চোখে দেখেন। অথচ আমার ক্ষেত্রে কী করলেন? আমার স্বামীও আপনার পরম ভক্ত, কিন্তু তাকে বধ করলেন পরের জন্য, ছলনাকরে আমার ধর্মভঙ্গ করেছেন, আপনি পাষণ্ড, আপনার হৃদয় দয়ামায়া শূন্য।

আপনি সর্বাত্মা ও সর্বাজ্ঞা হয়েও অন্যের দুঃখে দুঃখিত হন না। তাই আপনাকে আমি অভিশাপ দিচ্ছি। আপনি একজন্ম নিজেকে বিস্মৃত হবেন। হে ব্রহ্মা! তুলসী একথা বলে নারায়ণের পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে হাউ হাউ কেঁদে উঠলেন। নারায়ণ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন– হে সতী! শান্ত হও। আমাকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য তুমি অনেককাল তপস্যা করেছিলে, আর শঙ্খচূড় তোমাকে লাভ করার জন্য কঠিন তপস্যা করেছিল। সেই তপস্যার প্রভাবে শঙ্খচূড় তোমাকে স্ত্রী হিসাবে লাভ করেছিল। কিন্তু তোমার তপস্যার ফল পাওনা থেকে গেছে। তাই তোমাকে বরদান করছি, তুমি এ দেহ ত্যাগ করে দিব্যরূপে গোলকে ফিরে যাবে। লক্ষ্মী যেমন আমার কাছে প্রিয়, তুমিও তেমনিই হবে। রাসমণ্ডলে আমরা দুজনে বিহার করব। আর তোমার এই ত্যাগ করা দেহটি নদীতে পরিণত হবে। সেই নদী গন্ডকী নামে ভারতবর্ষে পরিচিতি লাভ করবে।

গন্ডকী নদীকে মানুষ পবিত্র জ্ঞানে পূজা করবে। তোমার মাথার কেশরাশি পুণ্যদায়ক গাছের ন্যায় হয়ে উঠুক। সেইসব গাছের নাম হোক তুলসী। জল, স্থল ও অন্তরীক্ষে দেবতাদের পূজোর জন্য ফুল ও পাতা লাগে। এদের মধ্যে তুলসী অন্যতম। হে সুন্দরী! সমস্ত ফুল গাছের থেকে তুলসী হবে শ্রেষ্ঠ’ যা আমার অত্যন্ত প্রিয়। বিভিন্ন পুণ্যস্থানে এবং গোলকের বিরজার তীরে বৃন্দাবনের মাটিতে, রাসমন্ডলে চম্পক বনে, চন্দন বাগানে, মাধবী, কেতকী, কুন্দ মল্লিকা, ও মালতীবনে পুণ্য দানকারী তুলসী গাছ জন্মাবে। তুলসীর ঝরা পাতা কুড়োবার জন্য দেবতারা সর্বদা ওই গাছের গোড়ায় ভিড় করবেন। তুলসী পাতার জলে অভিষিক্ত হলে সমস্ত তীর্থে স্নান ও সমস্ত যজ্ঞে দীক্ষার সমান ফল লাভ হয়।

একটা তুলসী পাতা শ্রীহরিকে যতটা সন্তুষ্ট করতে পারে, অমৃতপূর্ণ হাজার হাজার কলস তাকে সেই সন্তষ্টি দিতে পারে না। শ্রীহরির চরণে মাত্র একটি তুলসী পাতা নিবেদন করলে দশ হাজার গোরু দানের সমান ফল লাভ করা যায়। মৃত্যুকালে তুলসীপাতার জল খেলে সমস্ত পাপের ক্ষয় হয় এবং গোলোকে গমন করা যায়।

যে লোক প্রতিদিন তুলসীপাতার জল খায় সে হয় জীবন্মুক্ত এবং গঙ্গাস্নানের ফল লাভ করে, নিত্য তুলসী পাতা নারায়ণের চরণে উৎসর্গ করলে লক্ষ অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান ফললাভ করা যায়। হাতে ও দেহুে তুলসী ধারণ করে তুলসীতীর্থে মরণ হলে বিষ্ণুলোকে যাওয়া যায়। তুলসীকাঠের মালা অশ্বমেধ যজ্ঞের বেশি ফলদায়ক। তুলসীপাতার কণামাত্র মৃত্যুকালে গ্রহণ করলে রত্ননির্মিত রথে চড়ে সে বিষ্ণুলোকে যায়।

তুলসীকে সাক্ষী রেখে যে লোক মিথ্যা বচন দেয় সে পাপাত্মা। কুম্ভীপাক নরক যন্ত্রণা তাকে চন্দ্র সূর্যের স্থিতি কাল পর্যন্ত ভোগ করতে হয়। তুলসী ছুঁয়ে নিজের কথার খেলাপ করলে চৌদ্দজনম ইন্দ্রের সমায় পর্যন্ত কুম্ভীপাক নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়। পূর্ণিমা, অমাবস্যা, দ্বাদশী ও সংক্রান্তি তিথিতে তুলসী গাছের পাতা ছিঁড়তে নেই। দুপুরবেলা তেল মেখে স্নান না করে, রাতে, অশৌচকালে, অশুচি অবস্থায় অথবা বাসি জামাকাপড় পরে গাছ থেকে তুলসী পাতা তোলার অর্থ স্বয়ং শ্রীহরির মুন্ডচ্ছেদ, ঘটানো। শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত বাসি তুলসী পাতা দিয়ে দেবতার পূজো দেওয়া যেতে পারে। বিষ্ণুকে নিবেদন করা তুলসী পাতা মাটিতে বা জলে পড়ে গেলে তা আবার ধুয়ে নিলে শুদ্ধ হয়ে যায়। অন্য কোনো কাজে সেই পাতা ব্যবহার যোগ্য।

তুমিই হবে এই তুলসী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। নিরাময় বিষ্ণুলোকে শ্রীকৃষ্ণ হবেন তোমার নির্জনে নিত্যক্রীড়ার সঙ্গী। তোমার দেহজাত পুণ্যদায়ক নদী ভারতে গন্ডকী নামে প্রসিদ্ধ হবে। আমার অংশে লবণ সমুদ্রের উৎপন্ন হবে। সে হবে তোমার স্বামী। হে মহাসতী! তুমি সর্বদা বৈকুণ্ঠধামে লক্ষ্মীর সমান হয়ে আমার সঙ্গে রাসমন্ডলে বিরাজ করবে। তোমার শাপে আমি হব পাষাণ পাহাড়, গন্ডকীর তীরেই হবে আমার অবস্থান। সেখানে বাস করবে বজ্রকীটরা, যাদের দাঁত বাজের মতো। তারা আমার শিলাগাত্রে আমার চক্র রচনা করবে। যে শিলার একটা দ্বারে চারটে চক্র আঁকা থাকবে এবং বনমালার মতো যে শিলায় একটামাত্র মালা আঁকা থাকবে, নতুন মেঘের মতো শ্যামবর্ণা–শিলার নাম হলো লক্ষী-নারায়ণ।

একদিকে চারটি চক্রবিশিষ্ট, বর্ণমালাহীন, নীরদশ্যাম বর্ণ শিলার নাম লক্ষীজনার্দন। দধিবামন নামক শিলার আকার খুব ছোট, দুই চক্রবিশিষ্ট, নতুন মেঘের মতো কালো রং হবে। দুটো চক্র এবং বর্ণমালা যুক্ত অত্যন্ত ছোটো শিলা শ্রীধর নামে পরিচিত হবে, রঘুনাথ শিলার চারটে চক্র থাকবে, বনমালাহীনও গোস্পদ চিহ্ন যুক্ত হবে, এবং দুটো দ্বার বর্তমান। বড়োসড়ো গোলাকার, বনমালা শূণ্য শিলার নাম দামোদর। দু চক্র খুব ভালোভাবে দেখা যাবে এবং ফলদায়ক। মাঝারি, গোলাকার, দুটি চক্র, বাণের দ্বারা ক্ষত বিক্ষত শরণ চিহ্ন যুক্ত এমন শিলার নাম হবে রণরাম। মাজারি, সাতচক্র বিশিষ্ট চক্র ও তৃণচিহ্ন ও ছত্রচিহ্ন যুক্ত, রাজ্য দানকারী শিলা রাজরাজেশ্বর। অনন্ত শিলার রং হবে নতুন মেঘের ন্যায় কালো, আকারে বড়ো, অনন্তদেব ধর্ম অর্থাৎ কার্য ও মোক্ষ প্রদায়ক।

মধূসুদন নামক শিলার আকার হবে গোল, সেখানে দুটো চক্র যাদবে, গোস্পদের চিহ্ন থাকবে এবং রং হবে কালো। যে শিলায় সুদর্শন চিহ্নের একটা চক্র এবং গুপ্ত চক্র থাকবে, তাকে বলা হবে গদাধর। অশ্বমুখাকৃতি দুই চক্র বিশিষ্ট শিলার নাম গ্রীব, ভয়ংকর দর্শনধারী নরসিংহ শিলায় দুটি চক্র এবং অত্যন্ত বড়ো মুখ থাকবে। দুটি চক্র, মস্ত বড়ো মুখ এবং বনমালা আছে, এমন শিলার নাম লক্ষীনৃসিংহ। এই শিলা যার ঘরে থাকে তার শ্রীবৃদ্ধি হয়। বাসনা অনুসারে যশদানকারী শ্ৰীযুক্ত বাসুদেব শিলায় দুটি চক্র পরিষ্কার দেখা যাবে।

হে সুন্দরী! প্রদ্যুম্ন নামক শিলার সম্মুখ ভাগে বহু ছিদ্র এবং ভেতরে সূক্ষ্ম চক্রের চিহ্ন থাকবে। এর রং কালো মেঘের মতো। ইনি গৃহকে সুখ দান করেন। যে শিলার পিঠের দিক অত্যন্ত প্রশস্ত, দুটি চক্র পাশাপাশি সংলগ্ন, এমন শিলার নাম সঙ্কর্ষন। অত্যন্ত সুন্দর পীতরং গোলাকার, এমন শিলা অনিরুদ্ধ নামে পরিচিত। এই শালগ্রাম শিলা যেখানে থাকবে, সেখানে হরি এবং সমস্ত তীর্থের সঙ্গে স্বয়ং লক্ষী বিরাজ করেন।

শালগ্রাম শিলার নিত্য সেবা করলে ব্রহ্মা হত্যার ন্যায় পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, ব্রত, দান, শ্রাদ্ধ, দেবপুজো সবই শালগ্রামশিলাকে সাক্ষীরেখে করা উচিত। শালগ্রাম শিলা ছাতার আকারে হলে রাজ্য লাভ হয়, গোলাকার হলে অসীম ঐশ্বর্য, শকট আকারের হলে দুঃখ, শুলের অগ্রভাগের মতো হলে মৃত্যু অনিবার্য। বিকৃত মুখ শিলা দারিদ্র বহন করে আনে। পিঙ্গলবর্ণ শিলা ক্ষতির বাহক। লগ্নচক্র হলে ব্যাধি এবং ফাটা হলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

সমগ্র পৃথিবী জুড়ে দানধ্যান করলে, নানাধরনের যজ্ঞ, তীর্থ ভ্রমণ, ব্রত উপবাস ইত্যাদির প্রভাবে যে পুণ্য লাভ হয়, তা শালগ্রাম শিলার স্নানের জলে অভিষেক করার সমান, সমস্ত তীর্থস্থান তার স্পর্শ পেতে চায়। শালগ্রাম শিলা পূজো করলে চারবেদ ও সমস্ত রকম তপস্যার সমান ফল লাভ করা যায়। শালগ্রাম শিলা ধোয়া জল নিত্য পান করলে সে পরিত্রাণ লাভ করে। দেবতারাও এই জল লাভে ধন্য হয়। জন্ম, মৃত্যু ও জরা রহিত হয়। এই জল বৈকুণ্ঠধামে সেই মহাপুণ্যবান এর পদধূলিতে পবিত্র হয়ে ওঠে। তার পুণ্যে লক্ষ পিতৃপুরুষ উদ্ধার হয়। মৃত্যুর সময় শালগ্রামশিলার জল গ্রহণ করলে বিষ্ণুলোকে ঠাঁই হয়। তার সমস্ত পাপের বিনাশ ঘটে, শালগ্রামশিলা স্পর্শ করে মিথ্যে কথা বললে যে ভয়ংকর পাপ হয়, তার ফলে কূর্মদংষ্ট্র নামক নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। ব্রহ্মার আয়ুষ্কাল পর্যন্ত তাকে ওই নরকে কাটাতে হয়। শালগ্রাম শিলাকে সাক্ষীরেখে যে কথা দিয়ে কথার খেলাপ করে সে লক্ষমন্বন্তর পর্যন্ত অসিপত্ৰনাম নামক নরকে বাস করে। শালগ্রামশিলা আর তুলসী পাতা কখনও আলাদা রাখবে না। এর ফলে পরের জন্মে স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে। শাঁখের থেকে তুলসীকে আলাদা করা উচিত নয়। এর ফলে সাত জন্ম ধরে রোগব্যাধি ভোগ করতে হয়। শালগ্রামশিলা, তুলসী ও শঙ্খ পরস্পর সংলগ্ন যে রাখে যে মহাজ্ঞানী হয়। সে শ্রীহরির অনুগ্রহ লাভ করে।

হে সতী! তাই বলছি এক মন্বন্তরকাল শঙ্খচূড়ের ঘরণী থাকার পর, তোমাদের বিচ্ছেদ ঘটেছে। শোক করাই স্বাভাবিক। সর্বজ্ঞ, সর্বাত্মা শ্রীকৃষ্ণ এইভাবে তুলসীকে উপদেশ দান করলেন। তুলসী নিজের দেহ ছেড়ে দিব্যমূর্তি লাভ করলেন। তিনি শ্রীহরির বক্ষ সংলগ্ন হলেন, লক্ষীর মতো কমলাপতি শ্রীহরি তাকে নিয়ে নিজস্ব বাসভবনে ফিরে গেলেন! হে নারদ! গঙ্গা লক্ষী সরস্বতী এবং তুলসী এইভাবে নারায়ণকে পতি হিসাবে পেয়েছিলেন।

তুলসীর ছেড়ে যাওয়া দেহ থেকে গন্ডকী নদীর সৃষ্টি হল। নদীর তীরে আর্বিভাব ঘটল এক পাহাড়ের, যা শ্রীকৃষ্ণের অংশে উৎপন্ন। সেই থেকে ওই পাহাড়ের বুকে নানা কীট বিভিন্ন ধরনের শিলা তৈরী করে চলেছে। কিছু, কিছু এসে পড়ে গন্ডকীর জলে সেগুলি নতুন মেঘের মতো কালো রঙ লাভ করে। যেসব শিলা জলে না পড়ে ডাঙ্গাতে পড়ে থাকে, সেগুলো সূর্যের তাপে পিঙ্গলবর্ণ ধারণ করে। হে নারদ! এখন তোমাকে তুলসীদেবীর পূজোর নিয়ম ও মন্ত্ৰস্তোত্রের কথা বর্ণনা করছি, শোনো।

.

দ্বাবিংশ অধ্যায়

নারদ বললেন– হে ভগবান, আপনি আমাকে বলুন কে প্রথম তুলসীদেরীর পুজো ও স্তব করেছিলেন? কি ভাবেই বা তিনি জগৎবাসীর কাছ থেকে পূজো লাভ করেন। এসব বিষয় শুনতে আমি বড়োই আগ্রহী। গরুড়ধ্বজ নারায়ণ হেসে বলতে শুরু করলেনতুলসীকে লাভ করে শ্রীহরি লক্ষীর সঙ্গে রমনে মেতে উঠলেন। আবার তুলসীকেও লক্ষীর সমান গৌরব ও সৌভাগ্য দান করলেন। শ্রীহরির সপত্নী হিসেবে তুলসীকে গঙ্গা ও লক্ষী মেনে নিলেন। কিন্তু সরস্বতী শ্রীহরির সামনে তুলসীর সঙ্গে ঝগড়া শুরু করলেন, এমনকি মারধোরও করলেন। তুলসী এতে ভীষণ অপমানিত হলেন। লজ্জার হাত থেকে নিজেকে ঢাকতে অন্তধান করলেন। সেই সর্ব সিদ্ধেশ্বরী জ্ঞানশালিনী সিদ্ধযোগিনী তুলসী রইলেন সকলের অগোচরে, এমনকি শ্রীবিষ্ণু তাকে দেখতে পেলেন না? সরস্বতাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করে শ্রীহরি গেলেন তুলসীবনে।

স্নান করে শুদ্ধ বসন পরে তিনি ধ্যান করলেন। তুলসী পুজো করলেন। তুলসীপাতা নিবেদন করে মন্ত্র বললেন, শ্রীং হ্রীং ক্লীং ঐং বৃন্দাবনৈ স্বাহা। লক্ষী মায়া, যম ও রানীর বীজযুক্ত দশ অমর বিশিষ্ট এই মন্ত্র কল্পতরুর ন্যায় পুণ্যদায়ক। হে নারদ! এই মন্ত্রোচ্চারণ করে যে তুলসী পুজো করে, তার সকল অভীষ্ট পূরণ হয়। ধূপ-দীপ-ঘি-সিন্দুর-চন্দন-নৈবেদ্য ও ফুল দিয়ে ভক্তিসহকারে তুলসী পূজো শেষ করলেন। তুলসীদেবী সন্তুষ্ট হয়ে তুলসীগাছ থেকে আবির্ভূত হলেন। তিনি শ্রীহরির চরণে আশ্রয় নিলেন। শ্রীহরি বললেন– তোমাকে আমি বর দিলাম, আজ থেকে তুমি দেবী তুলসীরুপে সকলের পূজো লাভ করবে। তুমি থাকবে আমার মাথায় আর বুকে। সমস্ত দেবতারা তোমাকে তাঁদের মস্তকে স্থান দেবেন। এই কথা বলে শ্রীহরি সেখানে থেকে অদৃশ্য হলেন।

নারায়ণ বলতে থাকেন –শ্রীভগবান তুলসী দেবীর বন্দনা করে বলেছিলেন– আমি তাঁর স্তব করি, যিনি এক স্থানে অসংখ্য গাছরূপে উৎপন্ন হয়ে বৃন্দা নাম ধারণ করেছেন, তিনি আমার প্রিয়বৃন্দা। পুরাকালে যিনি বৃন্দাবনের বনে গাছ হিসাব আর্বিভূত হয়েছেন, তিনি সৌভাগ্য মুক্ত, বৃন্দাবনী, আমি তার ভজনা করি। যিনি সর্বদা অসংখ্য বিশ্বকে পবিত্র করে বিশ্বপাবনী হয়েছেন আমি সেই দেবীর শরণ নিলাম। যিনি বিশ্বপূজিতা। যিনি সর্বদা অসংখ্য বিশ্বে পূজো পাচ্ছেন, আমি সেই জগৎ পূজ্য দেবীর আরাধনা করি, যিনি বিশ্বসংসারে ভক্তি ও আনন্দের হিল্লোল তোলেন। তিনি হলেন নন্দিনী আমি তাঁর ভজনা করি।

হে পুষ্পসারা দেবী, শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে আমি আপনার দর্শন লাভ করতে চাই। যে সতী দেবী শ্রীকৃষ্ণের জীবনের জীবন, সেই কৃষ্ণজীবনী দেবী আমাকে রক্ষা করুন।

এই ভাবে শ্রীহরি তুলসী দেবীর স্তব করে চললেন। হঠাৎ সেখানে স্বয়ং তুলসীর আর্বিভাব ঘটল। তিনি শ্রীবিষ্ণুকে প্রণাম করলেন। তারপর আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলেন। অভিমানিনী তুলসীকে শ্রীহরি বুকে টেনে নিলেন। পরে সরস্বতীর অনুমতি নিয়ে তুলসীকে নিয়ে ফিরে গেলেন নিজের বাসভবনে। সরস্বতী সাথে যাতে তুলসীর মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে সে ব্যবস্থা করলেন। সরস্বতী তুলসীকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর লক্ষী, গঙ্গা ও তুলসীকে সঙ্গে করে নিজের ঘরে অদৃশ্য হলেন।

বৃন্দা, বৃন্দাবনী, বিশ্বপাবনী, বিশ্বপূজিতা, নন্দনী পুষ্পসারা কৃষ্টজীবনী এবং তুলসী– এই অষ্টনাম যুক্ত স্তোত্র ভক্তি সহকারে পাঠ করে যে তুলসী পূজো করে, সে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পুণ্য লাভ করে। পুরাকালে শ্রীহরি কার্তিকমাসের পূর্ণিমা তিথিতে তুলসী পূজা প্রথম করে ছিলেন, ওই শুভ দিনটিতে পূণ্যদায়িনী তুলসীর জন্ম। তুলসীর জন্ম দিনটিতে তার পুজো করলে সমস্ত পাপ নাশ হয় এবং বিষ্ণুর চরণে ঠাঁই হয়। কার্তিকমাসে বিষ্ণুকে তুলসীপাতা দিয়ে পূজো করলে দশহাজার গোরুদানের সমান পূণ্য লাভ হয়। তুলসীর স্তব পুত্রহীনের পুত্র, স্ত্রীহীনের স্ত্রী, বন্ধুজনের বন্ধু দান করে। এই মন্ত্রের গুনে রোগ ব্যাধি দূর হয়। কাপুরুষ সাহসী হয়, পাপাত্মার মনে পাপের লেশমাত্র থাকেনা।

হে নারদ! কাম্বশাখায় তুলসীর ধ্যানের পূজোর নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। আবাহন ব্যতীত ষোলোটি উপাচার দিয়ে ভক্তিভরে দেবীর পূজোর করা উচিত। ধ্যান করার সময় বলতে হয়–হে দেবী তুলসী। তুমি সমস্ত ফুলের শ্রেষ্ট, তুমি জগতপূজ্য ও মনোহর — তোমাকে প্রণাম জানাই। সমস্ত পাপরূপ কাঠকে তুমি তোমার দেবরূপ আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দাও। তুমি পবিত্ররূপা, সকল দেবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তুমি তুলনাহীন, তোমাকে নমস্কার করি, তুমি তুলসী, তুমিই সকলের ইষ্টদেবী, তুমি সকলের মাথায় অবস্থান করো, তুমি জীবন্মুক্ত, তোমার ভজনা করি। তুমি মুক্তি ও হরিভক্তি দানকারী, তুমি বিশ্ব পবিত্ৰকারিনী তোমাকে নমস্কার।

নারায়ণ বললেন– অমৃততুল্য তুলসীর উপাখ্যান তুমি শুনলে, আর কিছু জানতে চাও তো বলো।

.

ত্রয়োবিংশ অধ্যায়

নারদ বললেন– হে প্রভু! বেদমাতা সাবিত্রীর আবির্ভাব বৃত্তান্ত আপনি আগেই আমাকে বলেছেন। এখন বলুন, কীভাবে তিনি সকলের পূজ্য হয়ে উঠেছিলেন।

নারায়ণ বললেন– দেবতাদের মধ্যে পদ্মযোনি ব্রহ্মা প্রথম, বেদমাতা সাবিত্রীর পূজা করেছিলেন। তারপর অন্যান্য সকলের মতো তিনি প্রথম পুজো লাভ করেন মদ্রদেশের অধিপতি রাজা অশ্বপতির কাছ থেকে। এ অত্যন্ত পূর্ণদায়ক উপাখ্যান মন দিয়ে শোনো।

পুরাকালে ভারতবর্ষের মদ্রদেশে এক মহাপরাক্রমশালী মহারাজ ছিলেন। তার নাম অশ্বপাতি। তার পত্নীর নাম ছিল মালতী। তিনি ছিলেন সতী সাধ্বী, পতি প্রিয়া, ধর্মাত্মা নারী। রাজা অশ্বপতি ও রাণী মালতী ছিলেন ভূলোকের লক্ষী নারায়ণ। মহর্ষি বশিষ্ট মালতাঁকে ভক্তিভরে সাবিত্রী দেবীর পূজো করতে বললেন। পরম নিষ্ঠা সহকারে তিনি দেবীর ব্রত পালন ধরলেন, তার আরাধনা করলেন। কিন্তু দেবীর দেখা তিনি পেলেন না। এমন কি কোনো দৈববাণীও হল না। রাজমহিষী অত্যন্ত শূন্যচিত্তে প্রাসাদে ফিরে এলেন। রাজা অশ্বপতি পত্নীর দুঃখে দুঃখিত হলেন, নানা নীতি কথা শুনিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিলেন। তারপর নিজেই পুষ্কর তীর্থের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। সেখানে সাবিত্রী দেবীর উদ্দেশ্যে পরম ভক্তিভরে প্রণাম জানালেন এবং ধ্যান করতে লাগলেন। ওইভাবে চোখ বুজে একশো বছর কেটে গেল। একদিন রাজা শুনতে পেলেন এক আকাশবার্তা– হে রাজা, তুমি এখানে বসে দশ লক্ষবার গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করো।

তখন সেখানে এসে উপস্থিত হন মহামুণি পরাশর। রাজা তাকে সশ্রদ্ধ চিত্তে প্রনাম করলেন। হে নারদ, মহামুণি পরাশর তখন সাবিত্রী জপের মাহাত্ম্য ও বিধি বর্ণনা করলেন। তিন জন্মের পাপের বিনাশ ঘটে, একশো লক্ষবার গায়ত্রী জপ সর্ব পাপ নাশকারী। আর দশশত লক্ষবার গায়ত্রী জপের ফলে মুক্তি লাভ ঘটে, যে ব্রাহ্মণ লক্ষবার গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করে তার সারা জীবনের পাপ ধুয়ে মুছে যায়। হাজার বার সারা বছরের পাপ, একশো বার– একমাসের পাপ, দশবার একদিন ও রাতের পাপ এবং যে একবার গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে সে সে দিনের পাপ থেকে মুক্ত হয়। গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার সময় পূর্বদিকে মুখ করে বসবে। মুদ্রিত হাত সাপের ফণার মতো মাথার ওপর রাখবে। সামান্য নীচু হয়ে একমনে এই মন্ত্র জপ করা উচিত। ক্রমানুসারে জপ করা বাঞ্ছনীয়। ডান হাতের অনামিকার মধ্যে থেকে শুরু হয়ে নীচের দিকে বা দিক দিয়ে তর্জনীর গোড়া পর্যন্ত আঙুল চালনা করা নিয়ম। হে রাজন! জপকরার সময় হাতে রাখবে জপমালা। সাদা পদ্ম ফুলের বীজ বা স্ফর্টিকের দানা দিয়ে মালা তৈরি করে শোধন করিয়ে নেবে। তীর্থে বা দেবস্থানে বসে জপ করার নিয়ম। সাতটি অশ্বত্থাপাতার ওপর জপমালা রেখে গোচনা মাখাবে এবং গায়ত্রী মন্ত্রে স্নান করাবে। তারপর তাতে একশোবার গায়ত্রী জপ করবে।

এভাবেই মালা সংস্কার করতে হয়। এছাড়া পঞ্চগব্য বা গঙ্গাজলে ধুয়ে নিয়েও মালা শোধন করা যায়। হে রাজা! যে লোক স্নান করে, কাঁচা কাপড় জামা পরে ত্রিসন্ধ্যা দেয়, তার সকল কাজে অধিকার জন্মায়। যে লোক সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা কালে সন্ধ্যা করে না, সে হয় অশুচি। সারাদিন ধরে সে যা যা কাজ করে সব বিফলে যায়। সকালে বা সন্ধ্যাকালে যে ব্রাহ্মণ সন্ধ্যা বন্দনা করে না, সে হয় শুদ্রের সমান, সে ব্রাহ্মণের অধিকার থেকে বিচ্যুত হয়।

প্রতিদিন ত্রিসন্ধ্যা আজীবন যে পালন করে সে সূর্যের সমান তেজস্বী হয়। পবিত্র ও তেজস্বী ব্রাহ্মণ ত্রিসন্ধ্যা বন্দনা করে জীবন্মুক্ত হয়ে ওঠে। এমন পুণ্যবানের পায়ের স্পর্শে সেই স্থান পবিত্র হয়ে ওঠে। স্বেচ্ছায় সন্ধ্যাবন্দনা যে ত্যাগ করে, তার দেওয়া পুজো দেবতারা গ্রহণ করেন না। এইসব অশুচি লোকের অর্পণ করা তর্পণ জল বা শ্ৰদ্ধপিন্ড মৃত পূর্বপুরুষরা গ্রহণ করে না। বিষ্ণু মন্ত্র জপ করে না যে, যে একাদশী পালন করে না, যে ত্রিসন্ধ্যা পালন করেন সে হয় নির্বিষ সাপের মতো নিস্তেজ, ব্রাহ্মণোচিত সমস্ত অধিকার থেকে সে বঞ্চিত হয়।

হে রাজর্ষি! হরিকে নিবেদন করা প্রসাদ গ্রহণ না করা, দূত বা ধোপার কাজ করা, বলদের পিঠে চড়ে বেড়ানো, শুদ্রের অন্ন গ্রহণ করা, শুদ্রের মৃত দেহ পোড়ানো, শূদ্র মেয়েকে পত্নী হিসাবে গ্রহণ করা, শূদ্রের রান্না করে দেওয়া, শূদ্রের দান গ্রহণ করা, শূদ্রের যজ্ঞ করা, ঋতুস্নাতা বা স্বামী পুত্রহীন স্ত্রীর অন্ন গ্রহণ করা, সুদখোর হওয়া, নিজের মেয়ে বিক্রি করা, ভিক্ষে করে জীবিকা নির্বাহ করা, উদয়াস্তের মধ্যে দুবার আহার গ্রহণ করা, মাছ খাওয়া, শালগ্রাম শিলা পূজো না করা এই সমস্ত ব্রাহ্মণ নির্বিষ সাপের মতো ব্রহ্মতেজ শূন্য হয়।

এইভাবে মুনি শ্রেষ্ঠ পরাশর সাবিত্রী পূজো ও তার মন্ত্রের বিধি বর্ণনা করে অদৃশ্য হলেন। রাজা অশ্বপতি মুনির উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। তিনি সবিত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করলেন, স্তব করলেন। তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে সাবিত্রী দেবী রাজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। রাজা তাঁর অভীষ্ট বর লাভ করলেন।

জৈষ্ঠ্য মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে সাবিত্রী পূজো করা এবং নিয়ম বিধির কথা মাধ্যন্দিন শাখায় বলা হয়েছে। জৈষ্ঠ্য মাসের কৃষ্ণ ত্রয়োদশী তিথি এই পূজো করার শ্রেষ্ঠ সময়। চৌদ্দ ধরনের ফলমূল, চৌদ্দটি নৈবেদ্য, কাপড়, পৈতা, ধূপ, দীপ ইত্যাদি উপাচার। চৌদ্দ বছর ধরে সাবিত্রী ব্রত পালন করার নিয়ম কালে ঘট বসিয়ে ছয় দেবতা অর্থাৎ গণেশ, অগ্নি, বিষ্ণু, শিব, সূর্য এবং শিবার পূজো করতে হয়। আবাহন পর্ব শেষ করে সাবিত্রী পূজো করবে। এই দেবী গলানো স্বর্ণবর্ণ, ব্রহ্মাতেজে তেজস্বিনী, গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নের সূর্য তেজস্বিত তার কাছে হার মানে। তিনি ভক্তকে অনুগ্রহ দান করেন। বিভিন্ন রত্ন অলংকারে সুসজ্জিতা, তিনি আগুন রঙা পট্ট বস্ত্র পরেছেন, তিনি সুশীলা, সুপ্রসন্না স্মিতবন্দনা। সুখ ও মোক্ষদানকারী সমস্ত সম্পদ রূপিনী, সম্পদ দানকারী, বেদের অধিষ্টাত্রী দেবী, বেদের স্রষ্ঠা বিধির প্রিয় ভার্য্যা আপনাকে আমি ভজনা করি। প্রথমে দেবীর ধ্যান করে নিজের মাথায় ফুল রাখবে। ভক্তি সহকারে দেবীর পূজো করা উচিত, আবার ধ্যান করে ঘটে দেবীকে আবাহন জানাবে। আসন, অর্ঘ্য, পাদ্য, অনুলেপন, স্নানীয়, নৈবেদ্য, পান, বস্ত্র, ঠান্ডা জল, অলংকার, মালা, গন্ধ, শয্যা, ধূপ, দীপ এবং অচমনীয়–বেদোক্ত এই ষোলো উপাচারে নিয়ম অনুসারে দেবীর পূজো সম্পন্ন করতে হয়। তারপর স্তব করার শেষে প্রণাম করবে।

প্রত্যেকটি উপচার নিবেদন করার মন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। আসনদানের মন্ত্র– হে দেবী, আপনাকে এই আসন নিবেদন করলাম। আপনি এই আসনে উপবেশন করুন। অর্ঘ্য দানের মন্ত্র দুর্বা, ফুল ও আতপ চলযুক্ত শঙ্খজল মিশ্রিত পুণ্য দায়ক এই পবিত্র অর্ঘ্য আপনি গ্রহণ করুন। পাদ্য প্রদানের সময় বলবে, সময় বলবে, পূণ্য ও আনন্দদায়ক শুদ্ধ ও মহৎ তীর্থ জলময় এই পাদ্য আপনাকে নিবেদন করলাম। অনুলেপন-মলয় পর্বতে জাত সুখ প্রদানকারী সুবাস যুক্ত চন্দনের অনুলেপন আপনার শোভা বৃদ্ধি করুক স্নানীয়– সুগন্ধি ধাত্রীতেল রূপ দেহ সৌন্দর্য বর্ধক এই স্নানীয় পরম ভক্তিভরে আপনাকে নিবেদন করলাম। নৈবেদ্য– তুষ্টি, পুষ্টি ও প্রীতি পুণ্য দানকারী এবং ক্ষুধানিবৃত্তকারী সুস্বাদু নৈবেদ্য আপনাকে নিবেদন করছি। পান– তুষ্টি ও পুষ্টিদায়ক কর্পূরযুক্ততম পান আপনাকে উৎসর্গ করলাম।

জল–যে জল জগতের জীবন, স্বরূপ, যে জল পান করলে তুষ্ণা নিবারণ হয়, সেই ঠান্ডা ও সুগন্ধ যুক্ত জল নিবেদন করলাম। অলংকার দেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, সুখ ও পুণ্য দান করে। সেই স্বর্ণ অলংকার আপনাকে নিবেদন করলাম। মালা–যে ফুল আনন্দ ও পুণ্যদানকারী, সেই চন্দন মাখানো নানা ধরনের ফুল নিবেদন করলাম। গন্ধ–মঙ্গল দানকারী, পুণ্যদায়ক ও সুগন্ধ যুক্ত গন্ধ আপনাকে নিবেদন করলাম গ্রহন করুন। শয্যা –উত্তমরত্ন নির্মিত চন্দন ও ফুলে সজ্জিত সুখদায়ক ও পুণ্যদায়ক এই শয্যা আপনি গ্রহণ করুন।

ধূপ-যে ধূপ বিভিন্ন গন্ধদ্রব্যে তৈরী হয়, যা প্রীতি ও দিব্য গন্ধ দান করে, যা পূণ্যস্বরূপ সেই ধূপ ভক্তিসহকারে আপনাকে নিবেদন করলাম। দীপ– সমস্ত অন্ধকার দূরীভূত করে যে সমস্ত জগতকে দেখতে সাহায্য করে সেই দীপ আপনাকে নিবেদন করলাম। আচমনীয় যা শুদ্ধলোকের অত্যন্ত আনন্দের কারণ যে শুদ্ধি দান করে এবং পবিত্র, সেই আচমন আমি আপনাকে নিবেদন করলাম। আপনি গ্রহণ করুন সিস্টুর– যে সিঁদুর নিজেই পরম রমণীয় যে সমস্ত অলংকারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, যে কপালের শোভা বৃদ্ধিকরে সেই সিদূর আপনাকে নিবেদন করলাম। ফল–যা গাছে জন্মায় ফলদায়ক ও ফলস্বরূপ সেই ফল আপনি-গ্রহণ করুন।

ব্রতকারী মূলমন্ত্র পাঠ করে এসব উপাচার নিবেদন করবেন। তারপর স্তব করে দেবীকে প্রণাম জানাবেন। ব্রাহ্মণকে দান ধ্যান করবেন এবং ভোজন করিয়ে সন্তুষ্ট করবেন। সাবিত্রীর মূলমন্ত্র, শ্রীং হং ক্রীং সাবিত্র্যৈ স্বাহা লক্ষ্মীবীজ, মায়াবীজ আর কামবীজকে আগে রেখে অগ্নিদেবের পত্নী সাবিত্রীপদের উত্তর চতুর্থ বিভক্তি যোগ করে এই আট অক্ষরের মন্ত্র।

হে নারদ, পুরাকালে শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মাকে বলেন, তুমি সাবিত্রীকে পত্নীরূপে গ্রহণ করো। কিন্তু সাবিত্রী এ প্রস্তাবে রাজী নয়। তখন শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মাকে বললেন, সাবিত্রীর পূজো করতে। শ্রীকৃষ্ণের আদেশ অনুসারে স্তব করে ব্রহ্মা সাবিত্রীকে সন্তুষ্ট করলেন। ব্রহ্মা বললেন– হে সুন্দরী! তুমি সনাতনী এবং নারায়ণ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, তাই তুমি নারায়ণী, তুমি আমার প্রতি সদয় হও। হে তেজস্বরূপিনী তুমি পরমাস্বরূপা, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ, ব্রাহ্মনদের জাতিস্বরূপ। সর্বমঙ্গলময়ী হে দেবী আমার প্রতি প্রসন্ন হও। হে প্রসন্নময়ী! তোমার ব্রহ্ম তেজে পাপ রূপ কাঠ জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। তুমি পাপবিনাশিনী। হে সুন্দরী ভক্তের প্রতি তুমি অনুগ্রহ দান করো। আমার প্রতি তুষ্ট হও।

ব্রহ্মার স্তরের প্রভাবে সাবিত্রীদেবী ব্রহ্মাকে কামনা করলেন। এবং বেদমাতা সাবিত্রী ব্রহ্মার সাথে পতিগৃহে গমন করলেন। এই মন্ত্র উচ্চারণ করে রাজা অশ্বপতি সাবিত্রীর পূজো করেন, স্তব পাঠ করে তাকে প্রসন্ন করেন। এবং মনের মতো বর লাভ করেন। সমস্ত বাঞ্ছিত ফলদায়ক এবং ব্রাহ্মণদের স্তবত্রিসন্ধ্যায় প্রাণস্বরূপ এই পূণ্যদায়ক শ্রেষ্ঠ যে উচ্চারণ করে সে নিঃসন্দেহে চারবেদ পাঠের ফল লাভ করে।

.

চতুর্বিংশ অধ্যায়

নারায়ণ বলে চললেন– রাজা অশ্বপতির সাধনায় প্রসন্ন হয়ে এক দেবী মূর্তির আর্বিভাব ঘটল। রাজা দেখলেন, অপূর্ব পরমা সুন্দরী সেই দেবী ব্রহ্মতেজে জ্বলছেন, সহস্র সূর্যের সমান সেই তেজ। নিজের দেহের জ্যোতিতে তিনি উদ্ভাসিত সাবিত্রী। মিষ্টি হেসে মধুর কণ্ঠে সেই দেবী বললেন– হে মহারাজ! আমি সর্বজ্ঞ। তোমার এবং তোমার স্ত্রীর মনোবাসনা অনুসারে তোমরা পুত্র ও কন্যার জনক জননী হবে। বর দান করে সাবিত্রীদেবী ব্রহ্মালোকে ফিরে গেলেন। রাজা অশ্বপতি নিজ প্রাসাদের দিকে পা বাড়ালেন।

দেবী সাবিত্রীর ইচ্ছা অনুসারে কিছু দিন পরেই তাঁদের সংসারে এক ফুটফুটে কন্যার আর্বিভাব ঘটল। এই কন্যা লক্ষীদেবীর অংশ থেকে উৎপন্ন। সাবিত্রী দেবীকে আরাধনার ফল। তাই কন্যার নাম রাখা হল সাবিত্রী। যত দিন যায়, ততই কন্যার রূপ বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে রাজকন্যা যৌবনে পা দিলেন। তিনি মনে মনে সত্যবানকে নিজের পতি হিসাবে বরণ করে নিলেন। সত্যবান ছিলেন নানাগুণে সমৃদ্ধ দ্যুমৎসেনের পুত্র। রাজা অশ্বপতি নানা মূল্যবান অলংকার ও পোশাকে সজ্জিত করে সত্যবানের হাতে সম্প্রদান করলেন। সত্যবান পত্নীকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরে এলেন। রমণে ভ্রমণে, সুখে-আনন্দে একটা বছর কেটে গেল।

একদিন বাবার আদেশে সত্যবিক্রম সত্যবান বনে গেলেন কাঠ ও ফল সংগ্রহ করতে। দৈবযোগে সাবিত্রীও তার সঙ্গী হয়েছিলেন। কিন্তু বিধির বিধান কে খন্ডাতে পারে। আচমকা সত্যবান গাছ থেকে পড়ে মারা গেলেন। সেখানে যমরাজ তার অনুচর বৃন্দকে নিয়ে হাজির হলেন। তিনি সত্যবানকে নিয়ে চললেন। সাবিত্রীও তার পেছনে পেছনে চলতে লাগলেন। পেছন পেছন সুন্দরী সাবিত্রীকে আসতে দেখে সাধু প্রধান মহাপুরুষ যমরাজ মধুর কণ্ঠে বললেন– হে সতী, তুমি কি তোমার স্বামীর সাথে যমলোকে যেতে চাও। কিন্তু পঞ্চভূতে যে দেহ বিলীন হয় সেই দেহ নিয়ে যমরাজ্যে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। অতএব তোমাকে দেহত্যাগ করতে হবে।

হে সাবিত্রী! কর্ম করতেই সকলের জন্ম হয়। কর্ম ফুরিয়ে গেলে তার মৃত্যু হয়। সত্যবানও তার ব্যাতিক্রম নয়। নিজের কাজের ফলভোগ করতে সে এখন যমালয়ে যাচ্ছে। কর্মই সকল সংসারের সুখ, দুঃখ ভয়, শোক উৎপন্ন করে। যে রকম কাজ করে, তার ফল অনুসারে ইন্দ্ৰত্ব, ব্রহ্মত্ব, শ্রীহরির দাসত্ব লাভ করবে। কাজ অনুসারে সকল রকমের সিদ্ধি, অমরত্ব, আর বিষ্ণুর সালোক্য, প্রভৃতি চাররকমের মুক্তি লাভ সম্ভব। কর্মের ফলেই দেবত্ব, মনুত্ব, রাজেন্দ্রত্ব লাভ করে, কর্মের ফলে মানুষ ম্লেচ্ছ, শূদ্র, গাছ, পাহাড়, পশু, পাখি ইত্যাদি রূপে জন্ম গ্রহণ করে। ক্ষুদ্র জন্তু, কৃমি, সাপ, গন্ধর্ব, রাক্ষস, কিন্নর, যক্ষ, কুস্মান্ড, প্রেত, বেতাল, পিশাচ, ডাকিনী, দৈত্য, দানব ও অসুর সবই কর্মফলের দোষে বা গুণে জীব প্রাপ্ত হয়। কর্মফল যেমন হয় সেই অনুসারে জীব সুন্দর রোগমুক্ত জীবন কাটায়, আবার কেউ আজীবন রোগ ভোগ করে। কেউ হয় অন্ধ, কেউবা বধির, কেউ কদাকার চেহারা প্রাপ্ত হয়, কেউ আবার পঙ্গু। সবই কর্মফল, স্বর্গে বা নরকে, যাওয়াও নির্ভর করে কর্মফলের উপর।

নিজের কর্মফল অনুসারে জীব চন্দ্রলোক, ইন্দ্রলোক বহ্নিলোক বা ফুলোক, বরুণলোক কুবেরলোক, শিবলোক, জললোক, তপোলোক, নক্ষত্রলোক, সত্যলোক, পাতাললোক প্রাপ্ত হয়। কর্মফল অনুসারে কেউ বৈকুণ্ঠে, কেউবা গোলোক বা কেউ ভারতবর্ষে গমন করে। কর্মফলেই কেউ কোটি কল্পবছর বছর বেঁচে থাকে, কেউ হয় স্বল্পায়ু হয় ক্ষণজীবী, কেউ গর্ভে থেকেই মারা যায়। হে দেবী! তোমাকে মহতত্ত্ব জ্ঞান দান করলাম। তোমার স্বামীও কর্মফলের দাস। অতএব, তুমি নির্দ্বিধায় নিজের গৃহে ফিরে যাও।

.

পঞ্চবিংশ অধ্যায়

শ্রী নারায়ণ বলতে থাকেন–ধর্মরাজ যমের জ্ঞানবাক্য শ্রবণ করে সতী সাবিত্রী খুশি হলেন। তিনি ধর্মদেবতার স্তব করে প্রশ্ন তুলে ধরলেন। হে ধর্মরাজ! আমার মনে অনেকগুলো প্রশ্নের উদয় হয়েছে। আপনি অনুগ্রহ করে তার জবাব দিন। কর্মের বীজ কী আমি জানি না। মানুষের কোন কাজ ভালো আর কোন কাজ অমঙ্গলজনক তা আপনি বলেন। কর্ম উৎপন্ন হয় কীভাবে? এই কর্মফল ভোগকারী কে? সেই কর্মে কে প্রযুক্ত থাকে? দেহ ও দেহীর মধ্যে পার্থক্য কী বিজ্ঞান কাকে বলে? মন বা বুদ্ধির সংজ্ঞাই বা কী? দেহধারী প্রাণীদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটে কীভাবে। ইন্দ্রগুলির লক্ষণ সম্পর্কে বলুন। এইসব ইন্দ্রিয়দের দেবতাদের নাম কি? কে প্রাণীকে আহার যোগান? আর কে সেই আহার গ্রহন করে? জীবের পরিচয় কি? ভোগ এবং ভোগের নিষ্কৃতিই বা কীভাবে ঘটে। পরমাত্মা কী?

যম বললেন– মঙ্গলদায়ী কর্মের কথা বেদে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু যা অশুভ, মঙ্গল দান করে না, তা বেদে ব্যক্ত হয়নি। অর্থাৎ তা অকর্ম। হরি ভক্তের জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি কিছুই আক্রমণ করতে পারে না। সে মোক্ষ লাভ করে। একথা শাস্ত্র বলছে। সাধুব্যাক্তি বাসনা ও কামনাহীন হয়ে বিষ্ণুর সেবা করেন, যা তাদের সমস্ত কর্মকে নির্মূল করে এবং হরিভক্তি দান করে। শাস্ত্রজ্ঞ, পন্ডিত ব্যাক্তিবর্গ মুক্তিকে নির্বাণ ও মোক্ষ নামে চিহ্নিত করেছেন। বৈষ্ণবগণ হরিভক্তিরূপে মোক্ষ কামনা করেন এবং অন্যান্য সাধকরা নির্বাণের পথে মুক্তি পেতে চায়। প্রকৃতি থেকে শ্রেষ্ঠ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি কর্মের বীজস্বরূপ, কর্মের ফলদাতা ও কর্মস্বরূপ। তিনিই কারণস্বরূপ। হে সতী সাবিত্রী। তিনিই সমস্ত কর্মের উৎপত্তির কারণ। জীব কর্মফল ভোগ করে। কিন্তু আত্মা থাকে নির্লিপ্ত। আত্মার প্রতিবিম্ব হল জীব অর্থাৎ দেহী পৃথিবী, বায়ু জল, আকাশ ও তেজ এই পাঁচটি ভুত পদার্থ ধারা দেহ গঠিত। যা নশ্বর ও নিত্য পরমাত্মা হলেন ভোজয়িতা। ঐশ্বর্যের নাম ভোগ আর ভোগ, থেকে নিষ্কৃতি লাভের মাধ্যমে মুক্তি ঘটে।

হে দেবী! সৎ নিত্য ও অসৎ অনিত্য। নানা ধরনের জ্ঞান আছে। রূপ, সার, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ এইসব বিষয় সমুহ ভেদের বিভিন্ন বীজ। বিবেচনা করার নাম বুদ্ধি। বুদ্ধি জ্ঞানস্বরূপা। প্রাণ, অপন, সমান, উদান ও ধ্যান- এই পাঁচটি প্রাণ দেহীদের বলস্বরূপ বায়ু বিশেষ। প্রাণীর দেহে যে মন থাকে তাকে দেখা যায় না। ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ, সকল কাজে প্রেরণাদানকারী সেই মনকে দেহীরা নিরুপণ করতে পারে না। ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা পাঁচ–চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ও ত্বক। এরা দেহীর অঙ্গস্বরূপও সমস্ত রকমের কাজের প্রেরণা জোগায়। এইসব ইন্দ্রিয় সকল কখনও দেহীর সাথে শত্রুতা বা মিত্রতা পাতায়, ফলে জীব সুর্য বা দুঃখের সাগরে পতিত হয়। সূর্য, বায়ু, পৃথিবী ইত্যাদির দেবতারা এইসব ইন্দ্রিয়ে অবস্থান করেন। যে প্রাণ ও দেহ এবং অন্যান্যদের পোষণ করে তাকেই বলা হয় জীব, প্রকৃতি থেকে যিনি শ্রেষ্ঠ নিজেই সমস্ত কারণের কারণ, সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমাত্মা। ও হে বৎস! তোমাকে জ্ঞানীদের জ্ঞান স্বরূপ সেই শাস্ত্র পাঠ করালাম। এবার তুমি নিজের বাসভবনে ফিরে যাও।

সতী সাবিত্রী বললেন, হে জ্ঞানী পন্ডিতজ্ঞানের সাগরে প্রিয় পতিকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ধর্মরাজ। আপনি দয়া করে আর কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে আমার কৌতূহল দমন করুন। কী ভাবে মানুষ স্বর্গে বা নরকে গমন করে? কোন কর্মফলে জীব কোন কোন যোনিতে জন্মলাভ করে? কীভাবে হরির পাদপদ্ম লাভ করা যায়? মুক্তি লাভের পন্থা কী? সুখ দুঃখই বা কীভাবে লাভ করা যায়? দীর্ঘায়ুর বা স্বল্পায়ুর অধিকারী মানুষ কীভাবে হয়? কেনই বা মানুষ পঙ্গু বা অন্ধ, বোবা, কালা হয়ে জন্মগ্রহণ করে? কোন কর্মফলের শাস্তি কেন বা মানুষ পাগল হয়? কেন বা কৃপণ বা দাতা হয়? কেন মানুষ খুন করতে পিছপা হয় না? কী করলে বৈকুণ্ঠে যাওয়া যায়? নিরাময় গোলোকে যাওয়ার পন্থা কী? নরকের সংখ্যা প্রকার ভেদ, নাম, নরক যন্ত্রণা ভোগের পদ্ধতি ইত্যাদি আমাকে ব্যাখ্যা করুন।

.

ষড়বিংশ অধ্যায়

সুতপুত্র বললেন– হে মনিষী, সতী সাবিত্রীর প্রশ্ন শুনে ধর্মরাজ যম অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। মাত্র বারো বছরের এক কিশোরীর জ্ঞান যে কোনো প্রাচীন জ্ঞানী ও যোগীকে হার মানায়। সাবিত্রী জানেন, তা নারায়ণের কথাতেই শুনুন।

নারায়ণ বললেন– হে নারদ! মৃদু হেসে যম তখন শুরু করলেন। তিনি বললেন– হে কল্যাণী! তুমি হলে লক্ষীস্বরূপা। তোমার পিতা রাজা অশ্বপতি কন্যা লাভের আশায় সাবিত্রীর তপস্যা করেছিলেন। সেই তপস্যায় তুষ্ট হয়ে সাবিত্রীদেবী তাঁকে বর দান করেন। তুমি অশ্বপতির কন্যার রূপে জন্মগ্রহণ করেছ। তুমি হলে সতী শ্রেষ্ঠ। তুমি স্বামী সত্যবানের সৌভাগ্যে সৌভাগ্যশালিনী হবে। তুমি হবে তার প্রিয়। ঠিক যেমন দেবরাজ ইন্দ্রের কোলে শচী, কৃষ্ণের কোলে রাধা, নারায়ণের কোলে লক্ষী, শিবের কোলে দুর্গা, গৌতমে অহল্যা, বশিষ্ঠে অরুন্ধতী, কশ্যপে অদিতি, চন্দ্রে রোহিনী, দিবাকরে সংজ্ঞা, বরুণে বরুণানী, যজ্ঞে দক্ষিণা। বরাহে ধরা, দেব সেনাপতি কার্তিকের কোলে অনুরক্ত, ঠিক তেমনই সত্যবানের প্রেয়সী তুমি, সাবিত্রী, হে বৎস! তুমি আর কী আমার থেকে আশা করো বলো, আমি তা পূরণ করব।

সাবিত্রী বললেন– হে পিতা যম! আপনি আমাকে এই আশীবাদ করুন, আমার স্বামীর ঔরসে আমি যেন একশো পুত্রের জননী হতে পারি। আর আমার বাবা একশো পুত্রের জনক হন। আমার শ্বশুর দৃষ্টি ও রাজ্য ফিরে পান। আমি আমার, স্বামী সত্যবানের সঙ্গে মর্ত্য ভূমিতে সন্তানাদি নিয়ে লক্ষ বছর কাটাতে পারি। তারপর আমরা দুজনে একত্রে হরির পাদপদ্মে ঠাঁই পেতে চাই। জীবের আগ্রহী।

মহাভাগ যম বললেন– হে মহাসতী। আমি তোমায় বর দান করছি। তুমি যা চাইছ, সব কামনা সিদ্ধ হবে। জীবের কর্মবিপাক সম্বন্ধে এবার শোনো। পুণ্যক্ষেত্র ভারতবর্ষে জন্মে নিয়ে মানুষ ভালো মন্দ কাজ করে। শুধু মানুষ নয়, রাক্ষস, গন্ধর্ব, দৈত্য, দানব এমনকি দেবতারাও কর্মের অধীনস্ব দাস। কর্ম বিনা নিজের ইচ্ছেমতো জীবন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। পূর্বজন্মে কে কতখানি পাপ পূণ্য করেছে তা বিচার করেই কর্ম নির্দিষ্ট হয় এবং পরজন্মে তা ভোগ করতে হয়। বিশিষ্ট জীবরা এমনকি মানুষও সব যোনিতে জন্মলাভ করে। শুভ কর্ম করলে স্বর্গলোকের যাত্রী হওয়া যায়, পাপ করলে নরকবাস হয়। মুক্তি ব্যতীত কর্মভোগ নির্মূল করা সম্ভব নয়। নির্বাণ রূপ এবং হরির সেবারূপ– এই দুটি পন্থায় মুক্তি লাভ সম্ভব। কর্ম ফল যার যেমন, সে তেমন ভোগ করে, যেমন কেউ হয় ব্যাধিগ্রস্ত, কেউবা নীরোগ সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী, কেউবা দীর্ঘায়ু হয়ে জন্মায়, কেউ বা ক্ষণস্থায়ীত্ব লাভ করে, কেউ সুখী, কেউ দুঃখী, কেউ চক্ষুস্মান, কেউ চক্ষুহীন– প্রকৃতির নিয়ম শাস্ত্রীয় কর্মের ফলে সিদ্ধিলাভ হয়।

হে সত্যবান প্রিয়া! এই ভারতে সমস্ত জন্মের মধ্যে মানবজন্মই দুর্লভ। সমস্ত মানবজাতির চার বর্গের মধ্যে ব্রাহ্মণ সর্বশ্রেষ্ঠ। সমস্ত কাজে ব্রাহ্মণের অগ্রাধিকার। যে ব্রাহ্মণ বিষ্ণুর দাস, সে হল ব্রাহ্মণদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণ হল দুই ধরনের–সকাম ও নিষ্কাম। সকাম ভক্ত কর্মভোগ করতে চায় আর নিষ্কামরা হয় শান্ত উদ্বেগহীন। এরাই শ্রীহরির আসল ভক্ত। মৃত্যুর পর নিরাময় পরমপদে ঠাঁই পায়। দিব্যরূপে গোলোকে গমন করে এবং দুই হাত বিশিষ্ট পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার সুযোগ পায়।

যারা সকাম ভক্ত। তারা মৃত্যুর পর চতুর্ভুজ নারায়ণের সেবা করার সুযোগ পায় এবং দিব্যরূপে বৈকুণ্ঠে যায়। কিন্তু ফল ভোগ করার পর আবার জন্ম নেয়। ভারতের বুকে ব্রাহ্মণ হয়ে ফিরে আসে। কেননা তখনও তাদের কামনা বাসনার পরিতৃপ্তি ঘটেনি। যতক্ষণ না এরা নিষ্কাম হতে পারে, ততক্ষণ এরা বারে বারে জন্মলাভ করে। তীর্থে বসে যারা তপস্যা করেন, তাদের ব্রহ্মলোক প্রাপ্তি ঘটে। কিন্তু আবার তাদের জন্ম নিয়ে ভূলোকে ফিরে আসতে হয়। যারা তীর্থে বাস করে, অথচ তপস্যা করে না, তারা সত্যালোকে গমন করে এবং ফিরে আসে ভারতে। সূর্যের উপাসক যারা তারা তপস্যার বলে সূর্যালোক লাভ করে এবং যথা সময়ে আবার ভারতের মাটিতে জন্ম নেয়। যারা শিবশক্তি বা গণপতি গনেশের আরাধনা করে তারা শিবলোকে গেলেও আবার জন্ম নিতে বাধ্য হয়।

হে মহাসতী! যারা হরি শিব, শক্তি ও গণেশ ছাড়া অন্য কোনো দেবতার তপস্যা করে তারা ইন্দ্রলোকে গমন করলেও, আবার জন্ম নেয় ভারতে। যেসব ব্রাহ্মণ হরির প্রতি নিষ্কাম ভক্তি প্রদর্শন করে, তাদের তপস্যা করার প্রয়োজন হয় না, তারা শ্রীহরি ধাম লাভ করে। স্বধর্ম পালন না করে অন্য ধর্মের প্রতি যে ব্রাহ্মণ বেশি আকৃষ্ট হয়, অনাচার করে, তাহলে তাকে নরকে যেতেই হবে– একথা তোমাকে আমি নিঃসন্দেহে বলে দিতে পারি। ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্যদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা হচ্ছে। নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শন না করে অন্য ধর্ম পালন করলেও নরকে যেতে হয়। যদি কোন ব্রাহ্মণ স্বধর্ম ব্রাহ্মণের সাথে কন্যার বিয়ে দেয়, তাহলে তার চন্দ্রালোকে যাত্রা হয়। সেখানে চোদ্দ জন ইন্দ্রের আয়ুস্কাল পর্যন্ত বাস করা যায়।

ব্রাহ্মণকে ঘি, চাল, কাপড়, তামা, ফলমূল, জল ইত্যাদি দান করলে দাতা পূণ্য লাভ করেন এবং সেই পূণ্যের জোরেই সে বিষ্ণুলোকে এক মন্বন্তর সময় কাটাতে পারে। সোনা, তামা, গোরু ইত্যাদি দিয়ে যদি একজন বিশুদ্ধ ব্রাহ্মনকে দান করা হয়, তাহলে সেই পূণ্যে সূর্যালোকে অযূত বছর কাটানো সম্ভব। সে হবে জরাব্যাবিমুক্ত, জমি ও প্রচুর ধান ব্রাহ্মণকে দান করার ফলে সেই পুণ্যবান বিষ্ণুধামে গমন করে। চন্দ্র ও সূর্য যতদিন না অদৃশ্য হবে, ততদিন শ্বেতদ্বীপে সে বসবাস করবে। যে দেবতার উদ্দেশ্যে ঘরবাড়ি দান করা হয়, মৃত্যুর পর সেই দেবলোকে সে যাত্রা করেও অনেক বছর সেখানে থাকতে পারে। ঘর বাড়ি দান করার ফলে যতখানি পূণ্য লাভ হয়, সৌধ দান করলে তার চারগুণ, পূর্তদানে একশো গুণ লাভ হয়ে থাকে। উৎকৃষ্ট জলাশয় দান করলে তার থেকেও আটগুণ ফল লাভ করা যায়। জীবের উদ্দেশ্য জলাশয় খনন করার ফলে অযুত বছর জনলোকে বাস করা যায়। সেতুদান করলে পুকুর দানের সমান ফল লাভ করা যায়।

দৈর্ঘ্যে প্রস্থে চার হাজার ক্ষেত্র বিশিষ্ট পুকুরকে বাপী বলে। এই ধরণের পুকুর দান করার ফলে সাধারণ পুকুরের থেকে একশো গুণ বেশি পুণ্য হয়। দশটা বাপী দান করে যে ফল পাওয়া যায়, তা সৎপাত্রের হাতে কন্যা সম্প্রদানের ফলের সমান। আবার মেয়েকে যদি স্বর্ণালংকারে সজ্জিত করে উত্তম বরের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাহলে দ্বিগুণ ফল লাভ করা সম্ভব। পুকুর থেকে পাক তোলা আর পুকুর দান করার ফল সমান। অশ্বত্থ গাছ রোপন করার ফলে অযুত বছর তপোলোকে বাস করা যায়। মানুষের মনোরঞ্জনের উপকারের উদ্দেশে ফুলের বাগান দান করলে ধ্রুবলোকে যাওয়া যায়। সেখানে অযুত বছর বাস করা যায়। বিষ্ণুর নাম স্মরণ করে যে বিমান দান করে, সেই পূণ্যবান দাতা এক মন্বন্তর বিষ্ণুলোকে কাটাতে পারে। শ্রীবিষ্ণুর উদ্দেশে ভক্তি সহকারে দোলমন্দির দান করার ফলে বিষ্ণুলোকে গমন হয় এবং এক মন্বন্তর সেখানে থাকতে পারে।

হে পতিব্রতা নারী, রাজপথে মস্তবড়ো প্রাসাদ তৈরী করলে ইন্দ্রলোক লাভ হয়। অযুতকাল পর্যন্ত সেখানে নিশ্চিন্তে অতিবাহিত করা যায়। দেবতাকে দান করলে যে ফলপাওয়া যায়, ব্রাহ্মণকে দান করলেও সেই একই ফল লাভ হয়। দান করার ফলেই পরে ভোগ করা সম্ভব। কিন্তু যা দান করা হয়নি তা কখনোই লাভ করা সম্ভব নয়। পুণ্যবান ব্রাহ্মণ স্বর্গ সুখ ভোগ করে আবার ভারতের মাটিতেই ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম নেন। পুণ্য কাজ করার ফলে ক্ষত্রিয় প্রভৃতি আবার ক্ষত্রিয় ইত্যাদি বংশে জন্ম লাভ করে। ব্রাহ্মণরা নানা যোনিতে জন্ম গ্রহণ করে। সেখানে কর্মফল ভোগ করার পর আবার ব্রাহ্মণ কুলে জন্মায়। অভুক্ত কর্মের বিনাশ হয় না, শতকোটি কল্প সময় ধরেও তা ক্ষয় লাভ করে না। তাই নিজের ভালো বা মন্দ কাজের ফল নিজেকেই ভোগ করতে হয়। অন্য কেউ এ ভার গ্রহণ করে না, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য শত কোটি কল্প তপস্যা করলেও ব্রাহ্মণ কুলে জন্মাতে পারে না। বহু জন্ম ধরে দেবতাদের তীর্থ ভ্রমণের মাধ্যমেই শুদ্ধি লাভ ঘটে। বেদ ও পুরাণাদির অত্যন্ত দূর্বল ও গোপন তত্ত্ব জ্ঞান তোমাকে শোনালাম। আর কোনো প্রশ্ন আছে তোমার?

সাবিত্রী বললেন– হে ধর্মরাজ! আর কী কী কাজের ফলে মানুষ পাপ-পুণ্যের ভাগীদার হয়ে স্বর্গ বা নরকে যায়, তা বিশদে বলুন।

.

সপ্তবিংশ অধ্যায়

যম বললেন– হে সাবিত্রী! যা সকলের কাছে প্রার্থিত এবং সর্বসম্মত বলে সর্বশ্রেষ্ঠ, সেই কর্ম বিপাকের সম্বন্ধে তোমাকে তত্ত্বদান করছি। শোনো, ভারতের কোনো ব্রাহ্মণকে অন্নদান করলে ইন্দ্রলোকে সে গমন করে। দুধেল গাই-গোরু দান করার ফলে বৈকুণ্ঠে যাত্রা হয় এবং গরুর লোম সংখ্যক সেখানে সুখে কাল যাপন করা যায়। এই দান তীর্থে করলে শত গুণ আর নারায়ণ ক্ষেত্রে দান করলে কোটি গুন এবং কোনো পূণ্য দিনে দান করলে চার গুণ ফল লাভ করা সম্ভব। আসন দিয়ে দেবতা ও ব্রাহ্মণকে নিবেদন করলে অযুত বছর বহ্নিলোকে থাক যায়। শালগ্রামশিলা সহ বস্ত্র দান করলে চন্দ্র ও সূর্যের আয়ুষ্কাল পর্যন্ত বৈকুণ্ঠ ধামে বাস করা যায়। সুন্দর ছাতা দান করার ফলে দশ হাজার বছর ধরে বায়ুলোকে সুখে কালযাপন করা যায়। উত্তম শয্যা দান করলে দাতা চন্দ্রলোকে গমন করবে। এবং চন্দ্র সূর্য যতদিন থাকবে ততদিন বাস করতে পারবে। দেবতা ও ব্রাহ্মণকে প্রদীপ দান করার ফলে ব্রহ্মলোকে এক মনুর সময় পর্যন্ত সাদরে থাকতে পারে। পরের জন্মে সে চক্ষুষ্মন হয়। পুণ্যের ফলে সে আর যমলোকে যায় না। ব্রাহ্মণকে হাতি দান করলে ইন্দ্রের পরমায়ু পর্যন্ত তার অর্ধেক আসন লাভ হয়।

হে দেবী! যে লোক ব্রাহ্মণকে অশ্বদান করে সন্তুষ্ট করে সে পুণ্যের ফলে বরুণলোকে যায়, সেখানে চৌদ্দজন ইন্দ্রের সময়কাল পর্যন্ত সুখে অতিবাহিত করে। উৎকৃষ্ট শিবিকা দানের ফলে বিষ্ণুলোকে গমন হয় এবং এক মন্বন্তর কাল থাকতে পারে। পাখা ও সাদা চামর ব্রাহ্মণকে দান করার ফলে দানী ব্যক্তি বায়ুলোকে দশ হাজার বছর আনন্দে কাটাবে। পর্বত প্রমাণ ধান দান করার ফলে বিষ্ণুলোকে আদর পায় এবং যত ধান তত বছর সেখানে থাকে। পরে নিজের যোনিতে জন্মলাভ করে চিরজীবী ও সুখী হয়। ধান দাতা ও গ্রহীতা–দুজনেই বৈকুণ্ঠে যেতে পারে। হরিনাম জপ যে সর্বদা করে গরুড়কে দেখে সাপ যেমন পালিয়ে যায়, তেমনই মৃত্যু তার ধারে ঘেঁষতে পারে না। যে লোক ভারতে পূর্ণিমা রাতের শেষে শ্রীহরির দোলোৎসব করে, সে হয় জীবন্মুক্ত। জগতের সুখ ভোগ করে যায় বিষ্ণুভবনে।

সেখানে নিশ্চয়ই শত মন্বন্তর কাল পর্যন্ত পূজো পায়। উত্তর ফাল্গুনী নক্ষত্রে যদি দোলোৎসব পালিত হয়, তাহলে ফল পাওয়া যায় দ্বিগুণ। কল্পান্ত পর্যন্ত তার আয়ু হয়। তিল দান করার ফলে তিল পরিমাণ সময় কাল পর্যন্ত বিষ্ণুধামে নিশ্চিন্তে বাস করা যায়। পরে সে নিজের যোনিতে জন্ম নেয় এবং সুখে চিরজীবন কাটায়। তামার পাত্রে ওই তিল দান করলে দ্বিগুণ ফল পাওয়া যায়। নিজের মস্তবড়ো বাড়ি, শস্য পূর্ণ ক্ষেত এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ব্রাহ্মণকে দান করার ফলে কুবেরলোকে যাত্রা হয়। সেখানে এক মন্বন্তর কাল সুখে কাটিয়ে নিজের যোনিতে মহান ও ধনবান রূপে জন্ম গ্রহণ করে। শস্য সমেত জমি দান করলে শত মনুর কাল পর্যন্ত বৈকুণ্ঠ ধামে আনন্দে কাটাতে পারে। পরে নিজের যোনিতে জন্ম নিয়ে মহান ও ধনবান হয়। সে হয় পুত্রবান। রাজা হয়ে প্রজাবৃন্দের সঙ্গে দীর্ঘকাল সুখে অতিবাহিত করে।

হে কল্যাণী! প্রজা সমেত উত্তম একটি গ্রাম দান করার ফলে বৈকুণ্ঠে গমন হয়। সেখানে লক্ষ মন্বন্তর আদরে থাকে। পরে নিজের যোনিতে জন্ম লাভ করে। সে হয় লক্ষ গ্রামের পতি। সেইসব গ্রাম লক্ষ জন্ম পর্যন্ত তাকে ত্যাগ করে না। যে তোক ভারতে ব্রাহ্মণকে সমস্ত অলংকার সহ পতিব্রতা স্ত্রী ও ভোগ্যা সুন্দরী দান করে, সে নিঃসন্দেহে, চৌদ্দজন ইন্দ্রের সময় পর্যন্ত ইন্দ্রলোকে আনন্দে অতিবাহিত করে। অপ্সরাদের সঙ্গে সুখ ভোগ করার সুযোগ পায়। চন্দ্রলোক থেকে সে গন্ধর্ব লোকে যায়। সেখানে দশ হাজার বছর বাস করে। দিনরাত উর্বশীর সঙ্গে সকৌতুকে মেতে ওঠে। পরে সে নিজের যোনিতে জন্ম নেয়।

সতী সাধ্বী ও সৌভাগ্যবতী সুন্দরী প্রিয়ংবদা পত্নী লাভ করে। হাজার জন্ম পর্যন্ত সেই পত্নী তাকে ত্যাগ করে না। গাছপালা, বহু সংখ্যক পুকুর, পাকা শস্যক্ষেত, ফল ও ফুলের বাগানসহ নগর ব্রাহ্মণকে দান করলে বৈকুণ্ঠে যাওয়া যায়। সেখানে দশ লক্ষ পর্যন্ত সুখে কাটিয়ে আবার নিজের যোনিতে জন্ম নিয়ে মহারাজ হওয়া যায় এবং দশ লক্ষ নগর লাভ করা সম্ভব। দশ হাজার জন্ম পর্যন্ত সে সুখ ভোগ করতে পারে। সে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী। যে লোক ভারতে ব্রাহ্মণকে ফল সমেত গাছ দান করে, সে ফলসংখ্যক বছর ইন্দ্রলোকে পূজা পায়। পরে নিজের যোনিতে জন্ম নেয়। সে হয় পুত্রবান, কেবল ফলদান করলে বহু বছর স্বর্গে বাস করার পরে আবার ভারতে জন্ম নেয়। বাগী ও পুকুর, অসংখ্য গাছপালা ও উত্তম প্রজাসহ শত নগর ভক্তি সহকারে ব্রাহ্মণকে যে ব্যাক্তি দান করে সে কোটি মন্বন্তর কাল বৈকুণ্ঠে আদর পায়। পরে নিজের যোনিতে জন্ম নিয়ে ফিরে আসে, সে হয় জম্বুদ্বীপের রাজা এবং ইন্দ্রের সমান সম্পদের অধিকারী। কোটি জন্ম পর্যন্ত সে পৃথিবীতে থাকে। সে মহারাজ হয়ে কল্পান্ত কাল পর্যন্ত সুখভোগ করে।

হে মহাসতী, জম্বুদ্বীপ ব্রাহ্মণকে দান করলে এর থেকে একশো গুণ বেশি ফল লাভ করা যায়। যারা সমস্ত তীর্থের সেবা, সমস্ত তপস্যা, সমস্ত উপপাসব্রতের ফল, অন্যান্য সামগ্রী, সাতটি দ্বীপ সহ পৃথিবী দান করে, তাদেরও আবার ভারতে জন্ম হয়। সংসারের সুখ দুঃখ ভোগ করতে হয়। কিন্তু বিষ্ণু ভক্তরা এর ব্যতিক্রম। তারা আর জন্ম নেয় না। বিষ্ণু মন্ত্রের উপাসক বৈষ্ণবরা মানবদেহ ত্যাগ করে জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুরহিত হয়ে দিব্যরূপ প্রাপ্ত হয়। তারা বিষ্ণুর রূপ সৌন্দর্য পান করে এবং বিষ্ণুর সেবায় কাল কাটায়। এই সময় যত প্রকৃতিলয় হয়, সব গোলকে বসেই তারা প্রত্যক্ষ করে, প্রকৃতিলয়ের সাথে সাথে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ডের ধ্বংস হয়। কিন্তু যাঁরা বিষ্ণুভক্ত, তারা জন্ম, মৃত্যু ও জরা শূণ্য হয়ে কৃষ্ণের চরণে অবস্থান করেন। তাদের বিনাশ ঘটে না।

কার্তিক মাসে ভক্তি ভরে যে শ্রীহরিকে তুলসী নিবেদন করে সে হরি ভবনে ঠাঁই পায়। পাতার সংখ্যা সমান যুগ ধরে সে সুখে বাস করে। তারপর আবার ভূলোকে ফিরে আসে। নিজের যোনিতে জন্ম নিয়ে সুখী ও চিরজীবন লাভ করে। সে হরিদাস্য হয়। ওই মাসে শ্রীহরি উদ্দেশ্যে ঘিয়ের প্রদীপ দান করলে যত সময় ধরে প্রদীপ জ্বলবে সেই পলপরিমিত বছর সে হরিভবনে সুখ অতিবাহিত করে। আবার সে নিজের কুলে জন্ম লাভ করে। সে নিঃসন্দেহে মহাধনশালীতা চক্ষুম্মান ও প্রতাপযুক্ত হয় এবং হরিভক্তি লাভ করে। যে লোক মাঘ মাসে ব্রাহ্ম মূহুর্তে গঙ্গাস্নান করে সে বিষ্ণুর সঙ্গী হয়। ষাট হাজার যুগ ধরে সে পুজো পায়। তারপর ফিরে আসে জন্ম নিয়ে। শ্রেষ্ঠ জিতেন্দ্রিয় ব্যাক্তিতে পরিণত হয় এবং অবশ্যই হরিভক্তি লাভ করে। ওই মাসে ওই সময় প্রয়াগে গঙ্গাস্নান করলে লক্ষ মন্বন্তর কাল পর্যন্ত শ্রীবৈকুণ্ঠে আনন্দে বসবাস করা যায়। তারপর আবার নিজের কুলে জন্ম নিয়ে বিষ্ণুভক্ত হয়। মৃত্যুর পর আবার শ্রীহরি ধামে যাত্রা করে, তাকে আর সংসার যাতনা সহ্য করতে হয় না। সে হয় শ্রীহরির দাস। রোজ গঙ্গায় ডুব দিয়ে স্নান করলে সূর্যের মতো পবিত্রতা লাভ করা যায়। অশ্বমেধ যজ্ঞ করে যে ফলপাওয়া যায় তার সমান ফলপ্রাপ্তি ঘটে। সে যেখানে যায় সেই স্থান পবিত্র হয়। তাকে ছোঁয়ার জন্য সকলে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। সে সানন্দে বৈকুণ্ঠে অবস্থান করে চন্দ্র ও সূর্য উদিত হওয়ার কাল পর্যন্ত। তারপর নিজের কুলে জন্ম নেয়। সে হয় মহাতপস্বী, নিজের ধর্ম পালন করে শুদ্ধ, বিদ্বান ও জিতেন্দ্রিয় হয়ে ওঠে।

গ্রীষ্মকালে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ়– এই তিন মাস সূর্যের প্রচন্ড তাপে চারদিক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই সময় সুবাসিত ঠান্ডা জল যে দান করে সে সানন্দে বৈকুণ্ঠে গমন করে। চোদ্দজন ইন্দ্রের সময়কাল পর্যন্ত সেখানে সুখভোগ করে। তারপর নিজের বংশে জন্ম নিয়ে সুখে জীবন কাটায়, সে হয় সৎ ও ধনী। বৈশাখ মাসে চন্দন দান করলে ষাট হাজার যুগ ধরে বিষ্ণুধামে বাস করা যায়। তারপর নিজের কুলে জন্ম গ্রহণ করে রূপবান ও সুখী হওয়া যায়।

ভগাবন শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর ব্রত পালন করে শত জন্মের পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। সে বৈকুণ্ঠের সুখ ভোগ করে। চোদ্দজন ইন্দ্রের পরামায়ুকাল পর্যন্ত কাটিয়ে ফিরে আসে নতুন জন্ম নিয়ে নিজের যোনিতে। সে হরি ভক্তি লাভ করে। শিবরাত্রির ব্রত পালন করার ফলে শিবলোকে সুখ ভোগ করা যায়। সাতজন মনুর আয়ুষ্কাল পর্যন্ত সে সেখানেই কাটাতে পারে। আর শিবকে ওই দিনে বেলপাতা নিবেদন করলে বেলপাতার সংখ্যা সমান যুগ ধরে শিবলোকে আনন্দে থাকা যায়, তারপর নিজের কুলে ফিরে আসে আর একজন্ম নিয়ে। সে হয় বিদ্বান, পুত্রবান, ধনবান এবং প্রজাবৎসল রাজা। মাঘ বা চৈত্র মাসে শিবের পূজো করে ব্রত উদযাপন করলে, ব্রত পালনের সংখ্যা যুগ পর্যন্ত শিবলোকে আদরে কাটাতে পারে।

যে লোক এই পূণ্য ভূমি ভারতবর্ষে ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথি থেকে এক পক্ষকাল ধরে ভক্তিভরে রোজ উত্তম ষোলোটি উপাচারে মহালক্ষীর পূজো করে, সে সূর্য-চন্দ্রের স্থায়িত্ব পর্যন্ত বৈকুণ্ঠে পূজো পায়। পরের জন্ম নেয় নিজের জাতিতে। তখন সে হয় রাজার রাজা। শ্রীরামনবমী ব্রত পালন করে যে ভক্তিভরে পূজো করে সে বিষ্ণু মন্দিরে গমন করে। সাতজন মনুর সময়কাল পর্যন্ত সেখানে আনন্দে অতিবাহিত করে। পরে নিজের যোনিতে জন্ম নেয়। সে রামভক্তি লাভ করে। সে হয় মহান ও ধার্মিক এবং শ্রেষ্ঠ জিতেন্দ্রিয়। জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্ল পক্ষের চতুর্দশীতে ভক্তি সহকারে যে সাবিত্রীদেবী পূজো করে সে ব্রহ্মালোকে পূজো পায়। সাতজন মনুর সময় পর্যন্ত সুখ ভোগ করে ফিরে আসে নতুন জন্ম নিয়ে আপন কুলে। সে মহা বিক্রমশালী, বিদ্বান এবং ধনবান হয়। তাকে পৃথিবী ত্যাগ করে না। রবিবার সূর্য সংক্রান্তি ও শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে যে বিধি মেনে সূর্যের উপাসনা করে, হবিষ্যান্ন আহার করে, সে সূর্যালোকে আপন সম্মানে বাস করে। সূর্য ও চন্দ্রের স্থায়িত্ব পর্যন্ত সেখানে কাটায়। তারপর জন্ম নিয়ে পূণ্যক্ষেত্র ভারতভূমিতে ফিরে আসে। সে হয়, নীরোগ এবং ধনবান। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে নিয়মানুসারে ষোলোটি উপাচার নিবেদন করে সরস্বতী দেবীর পূজো করলে বৈকুণ্ঠধামে সসম্মানে বাস করা যায়। ব্রহ্মার দিনরাতি পরিমাণকাল পর্যন্ত সেখানে বাস করে নতুন জন্ম নিয়ে কবি ও বিদ্বান হয়। যে লোক রোজ ব্রাহ্মণদের সোনা ও গোরু দান করে এবং আজীবন ওই দানধ্যান করে ব্রাহ্মণদের তুষ্ট করেছে সে সহজেই বিষ্ণু মন্দিরে স্থান পায়। গোরুর লোম পরিমিত বছরের দ্বিগুন বছর শ্রীহরির পার্ষদ থাকে। তারপর নতুন জন্ম নিয়ে নিজের জাতিতে ফিরে এসে অনেক রাজ্যের রাজা হয়। বিদ্যা ও জ্ঞান লাভ করে সে হয় পুত্রবান। প্রত্যহ শালগ্রামশিলা পূজো করে তার চরণামৃত পান করে একশো বৎসর আয়ুষ্কাল পর্যন্ত বৈকুণ্ঠে শ্রদ্ধার সঙ্গে বাস করা যায়।

তারপর নিজের বংশে জন্মগ্রহণ করে সে অবশ্যই শ্রীহরি ভক্তি লাভ করে। বিষ্ণুলোকে পূজো পায়। তাকে আর সংসারের কালপাকে ফিরে আসতে হয় না। পৃথিবীর সমস্ত তীর্থে যে লোক স্নান। করে তার নির্বাণ লাভ হয়, সে ভারতে আর ফিরে আসে না। সমস্তরকম তপস্যা ও ব্রত ভারতের যে লোক পালন করে সে বৈকুণ্ঠে চোদ্দজন ইন্দ্রের পরমায়ুকাল পর্যন্ত সুখভোগ করে ফিরে আসে নিজের কুলে এবং রাজরাজেশ্বর হয়। তারপর তার মোক্ষলাভ হয়। আর জন্ম নিতে হয় না।

ব্রাহ্মণকে মিষ্টি খাওয়ালে যে পূণ্য হয়, তার ফলে ব্রাহ্মণের লোমপরিমিত বছর বিষ্ণুমন্দিরে পূজো পাওয়া যায়। তারপর নতুন জন্ম হয়। সে অবশ্যই হরিদাস্য লাভ করে। নারায়ণক্ষেত্রে এই ধরনের দান করলে ফল লাভ হয় কোটি গুণ, আর যে নারায়ণক্ষেত্রে কোটিবার হরিনাম জপ করে তার সমস্ত পাপের বিনাশ ঘটে।

সে বিষ্ণুর পার্ষদ হয় সে বৈকুণ্ঠে কাল অতিবাহিত করে। তাকে আর জন্ম নিতে হয় না। যে ভারতের পূণ্য ভূমিতে শিবলিঙ্গ স্থাপন করে আমরণ প্রত্যহ পূজো করে, সে শিবলোক প্রাপ্ত হয়, মাটির ধূলো পরিমান বছর সেখানে কাটিয়ে আবার ফিরে আসে, সে রাজ্য লাভ করে সুখে দিন কাটায়। রাজসূয় যজ্ঞ করে সে ঘোড়ার লোম সংখ্যার চারগুণ বছর ইন্দ্রের অর্ধেক আসন লাভ করে। আর অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল হয় একগুণ। নরমেধ বা গোমেধ যজ্ঞ করলে অশ্বমেধের অর্ধেক ফল পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণযজ্ঞ ও বৃদ্ধি যাগ করলে গোমেধযজ্ঞের সমান এবং পদ্মযজ্ঞের ফলে তার অর্ধেক লাভ হয়। বিজয়যজ্ঞের ফলে রাজা বিজয়ী হন এবং পদ্মযজ্ঞের সমান স্বর্গ ভোগ করেন। প্রজালাভ ও ভূমি বৃদ্ধির জন্য রাজা প্রাজাপত্য যজ্ঞ করেন। রাজলক্ষী এখানে সুস্থির থাকেন।

হে কল্যাণী। ব্রহ্মা মহা ধুমধাম করে যে যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, তার নাম বিষ্ণু্যজ্ঞ। সমস্ত যজ্ঞের প্রধান এই যজ্ঞকে কেন্দ্র করে শিব ও দক্ষের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়েছিল। ব্রাহ্মণরা নন্দীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। নন্দীও রেগে পাল্টা অভিশাপ তাদের দিয়েছিলেন। তাই প্রজাপতি দক্ষ পরে বিষ্ণু যজ্ঞের আয়োজন করলে শিব ওই যজ্ঞ নষ্ট করে দিয়েছিলেন। হাজার রাজসূয় যজ্ঞের সমান ফলদায়ক এই বিষ্ণু্যজ্ঞ। ধর্ম, কর্দম, কশ্যপ, মনু, তার ছেলে প্রিয়ব্রত, শিব, সনৎকুমার অনন্ত, কপিল ও ধ্রুব এই যজ্ঞ করেছিলেন। বস্তুত এমন কোন দ্বিতীয় যজ্ঞ নেই, যা বিষ্ণুযজ্ঞের সমান ফলদায়িনী। এই যজ্ঞ করলে জ্ঞান ও তপস্যায় বিষ্ণুর সমান হওয়া যায়। সে হয় জীবন্মুক্ত। দেবতাদের মধ্যে বিষ্ণু, ধর্মাত্মার মধ্যে শিব, তীর্থের মধ্যে গঙ্গা, ফুলের মধ্যে তুলসী, স্ত্রীর মধ্যে প্রকৃতি, নক্ষত্রের মধ্যে চাঁদ, পাখির মধ্যে গরুড়, আধারের মধ্যে বসুন্ধরা, বনের মধ্যে বৃন্দাবন, বর্ষের মধ্যে ভারত, পবিত্রদের মধ্যে বৈষ্ণব, ব্রতের মধ্যে একাদশী, দ্রুতগামী চঞ্চল ইন্দ্রিয়ের মধ্যে মন, শ্ৰীসম্পদের মধ্যে লক্ষ্মী, পতিব্রতাদের মধ্যে দুর্গা, সৌভাগ্যবতীদের মধ্যে রাধা, পন্ডিতদের মধ্যে সরস্বতী, ঠিক তেমনই সমস্ত যজ্ঞের মধ্যে বিষ্ণুযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ। হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ এক বিষ্ণুযজ্ঞের সমান ফলদায়ক। সমস্ত তীর্থে স্নান, সমস্ত যজ্ঞে দীক্ষা, সমস্ত বেদ ও তপস্যার আচরন পালন করা, চারবেদ পাঠ, পৃথিবী ভ্রমণ– এইসব শুভ কাজের কারনে যে ফল প্রাপ্ত হয় তা এক কৃষ্ণ সেবার সমান। শ্রীহরির সেবার মাধ্যমে হরি মন্দিরে যাওয়া যায় এবং মুক্তি লাভ হয়, সমস্ত কাজের মধ্যে যা প্রধান, সেই শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্ম সেবার কথা বেদ ও পুরাণাদিতে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যহ শ্রীকৃষ্ণের বর্ণনা তার ধ্যান ও নামগুণের কীর্তন, তার স্তবপাঠ, স্মরণ, বন্দনা, উপাসনা, জপ, ধ্যান, তাঁর চরণামৃত জল ও প্রসাদ খাওয়া– সবই বেদে রচিত হয়েছে। তাই বলছি বাছা, স্বামীকে নিয়ে গৃহে ফিরে যাও, যিনি পরমব্রহ্ম, পরমেশ্বর, নির্গুণ প্রকৃতি থেকে শ্রেষ্ঠ, সেই পরমাত্মার পূজো করো। সুখে কালাতিপাত করো।

.

অষ্টবিংশ অধ্যায়

নারায়ণ বলেছেন- হে নারদ! ধর্মরাজ যমের মুখে শ্রীকৃষ্ণের প্রশস্তি শুনে আনন্দে সাবিত্রীর চোখে জল এল। তিনি চোখ মুছে বললেন– হে ভগবান! হরির নামের মাহাত্ম কথা শুনে আমি বড়োই অভিভূত হয়েছি। বুঝেছি, এ এমন এক নাম, যার কাছে সমস্ত দানধ্যান, ব্রতসিদ্ধি, তপস্যা, শ্রেষ্ঠ বেদ, মোক্ষ, সিদ্ধি, সবই তুচ্ছমাত্র। এই নামকীর্তন যে শোনে এবং যে বলে, উভয়েই পুণ্য লাভ করে। জন্ম, জরা মৃত্যু-কোনোটাই তাদের স্পর্শ করতে পারেনা। হে বেদজ্ঞ শ্রেষ্ঠ! আমার মতো এক সাধারণ নারী কিভাবে সেই পরমাত্মা শ্রী কৃষ্ণের পূজো করবে, আপনি বলে দিন। শুভ ও মঙ্গলদায়ক কাজের পরিনাম কি হতে পারে, তা আপনি আমাকে শুনিয়েছেন। কিন্তু খারাপ কাজ করলে কী ফল লাভ হয়, তা বলেননি, আমাকে তা বিশদে বলুন।

সাবিত্রী এবার ধর্মরাজের পায়ের সামনে মাথা হেঁট করে বসলেন, তারপর ধর্মরাজের বন্দনা করলেন, বেদোক্ত মন্ত্রে সাবিত্রী স্তুতি শুরু করলেন পুরাকালে পুষ্কর তীর্থে ধর্মের আরাধনা করে সূর্যদেব যে পুত্র লাভ করেছিলেন, যিনি ধর্মের অংশ স্বরূপ, যিনি ধর্মরাজ আমি তাকে প্রণাম জানাই, যিনি সমস্ত কাজের সাক্ষীস্বরূপ, যিনি জগতের সমস্ত প্রাণীর কাজের অনুরূপ কালে অন্ত করে থাকেন, যিনি কৃত্যন্ত, তাকে আমি প্রণাম করি। যিনি সমস্ত কাজের শাসক, যিনি পাপীদের শুদ্ধির জন্য শাস্তির বিধান দেন এবং দন্ড ধারণ করেন, সেই দন্ডধরকে নমস্কার করি। সমস্ত জীবের কর্মফল যিনি, তপস্বী, বিষ্ণুর দাস, যিনি সংযমী, ধার্মিক সেই জিতেন্দ্রিয়কে পজো করি, সেই দুর্নিবার যমকে প্রণাম করি, যিনি সকলের আয়ুক্ষয় করেন, যিনি পরমব্রহ্মের ভক্ত, যিনি ব্রহ্মতেজস্বরূপ আমি সেই ব্রহ্ম বংশজাত ধর্মরাজ যমকে প্রণাম নিবেদন করি, হে স্বাত্মাসম, সর্বজ্ঞ, পুণ্যমিত্র, আপনি আমার প্রণাম গ্রহণ করুন।

সাবিত্রী স্তবে সন্তুষ্ট হলেন যমরাজ। সাবিত্রী তাঁকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালেন, যম তাঁকে বিষ্ণুর ভজনা ও কর্ম বিপাক সম্বন্ধে উপদেশ দান করলেন। তারপর বললেন– এই আটটি স্তব রোজ ভোরবেলায় যে আমাকে স্মরণ করে পাঠ করে তার যমভয় দূর হয়ে যায়, যমমন্ত্র সমস্ত পাপনাশক।

.

ঊনত্রিংশ অধ্যায়

নারায়ণ বললেন– হে নারদ, ভক্তি সহকারে কোনো পাপাত্মা যদি বেদোক্ত আটটি স্তব রোজ কীর্তন করে, তাহলে যমরাজ তার প্রতি সদয় হন। কায়ব্যুহ’ এর সাহায্যে তার সমস্ত পাপের বিনাশ ঘটান এবং তাকে পবিত্রতা দান করেন।

যমরাজ মন্দ কাজের পরিণতি সম্পর্কে সতী সাবিত্রীকে কী বলেছিলেন তা শোনো এবার।

যমরাজ বললেন– হে সতী, ভালো কাজের ভালো ফল পাওয়া যায়। আর যা অশুভ, তা অমঙ্গলজনক। অর্থাৎ নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। বিস্তৃত, গভীর, ভয়ংকর, বিকট, বীভৎস ও প্রাণীদের যন্ত্রণাদানকারী নরক কুন্ডের সংখ্যা অনেক। তবে বেদে যেসব নরকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর নাম বলছি, শোনো– তপ্তকুন্ড, ক্ষরকুন্ড, বহ্নিকুন্ড, মূত্রকুন্ড, বিটকুন্ড, শ্লেষ্মকুন্ড, গরকুন্ড, বসাকুন্ড, অসৃককুন্ড, শুক্রকুন্ড, অকুন্ড, দূষিকাকুন্ড, গাত্রমলকুন্ড, কর্ণাবিটকুন্ড, দন্ডকুন্ড, কৃমিকুন্ড, নখকুন্ড, ঘর্মকুন্ড, লোহারকুন্ড, কেশকুন্ড, সর্পকুন্ড, দন্তকুন্ড, তপ্ত তেলেরকুন্ড, তপ্ত সুরাকুন্ড, লবণকুন্ড, মশককুন্ড, বজ্র দংষ্ট্রকুন্ড, কাককুন্ড, গোলকুন্ড, খড়গকুন্ড, পাষাণকুন্ড, বজ্রকুন্ড, লালকুন্ড, অসিকুন্ড, চূর্ণকুন্ড, চক্রকুন্ড, কুর্মকুন্ড, বক্রকুন্ড, জ্বালাকুন্ড, ভীমকুন্ড, তপ্তশূর্মি, বাজকুন্ড, সঞ্চানকুন্ড, নকুন্ড, শূলকুন্ড, শরকুন্ড, পূতিকুন্ড, গোধাকুন্ড, প্রাতকুন্ড, গোধাকুন্ড, সূচীমুখ, গজদংশ, গোমুখ, কুম্ভীপাক, কালমূত্র, অরুন্তুদ, অবটোদ, দন্ডতারণ, জালবন্ধ, নাগবেষ্টন, জিম্ভ, দেহচূর্ণ, দলন, শোষণ, কষ, পূতিলামুখ, প্রকম্পন, ধূমান্ধ, পাশবেষ্ট, পাংশুভোজ, শূলপোত ইত্যাদি। পাপীরা নিজে নিজ কর্মফল অনুযায়ী এইসব নরকে নিক্ষিপ্ত হয় এবং যন্ত্রনা ভোগ করে।

এইসব কুন্ড রক্ষার দায়িত্বে আছে আমারই নিযুক্ত কিঙ্করের দল। এরা প্রয়োজনমতো যোগবলে নানারকম বেশ ধারণ করতে পারে। এদের চোখ ও গায়ের রং তামার মতো পিঙ্গল। এরা দয়ামায়াহীন, দুর্নিবার তেজস্বী ও নির্ভয়। এইসব মদমত্ত যমদূতদের তারাই দেখতে পায়, যারা পাপের ঘড়া পূর্ণ করে মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যারা শিব, শক্তি, সূর্য এবং গণেশের উপাসক এবং যারা পূণ্যকর্ম করে সিদ্ধিলাভ করেছেন, তাঁদের চোখে ওইসব মৃত্যুদূতরা অদৃশ্য থাকে। শক্তিমান ও নির্ভীক বৈষ্ণবরা তা কল্পনাও করতে পারে না।

.

ত্রিংশ অধ্যায়

নারায়ণ বললেন– হে মহর্ষি নারদ! যম যে সমস্ত নরক কুণ্ডের কথা বললেন–যেখানে পাপীরা তাদের কর্মফল অনুযায়ী নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। কোন পাপ কাজের ফলে কোন নরকে নিক্ষিপ্ত হতে হয়, সে বিষয়ে যমরাজ কী বলছেন শোনো।

যম বললেন– হে সতীসাধ্বী সাবিত্রী, যে তোক নিজের বা অন্যের দেওয়া ব্রাহ্মণবৃত্তি হরণ করে, সেই পাপী বিটকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হয়। ষাট হাজার বছর সেখানে মলমূত্রের মধ্যে বাস করে। তারপর কৃমি হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। মলমূত্রের মধ্যে বাস করে, অপরের পুকুরে। পুকুর খুঁড়ে দৈবদোষে উৎসর্গ করলে মূত্রকুন্ড লাভ হয়। সেখানে সে পুকুরের ধূলো পরিমান বছর মূত্রভোজী হয়ে থাকে।

তারপর গোসাপ হয়ে জন্ম নেয়, শ্লেষ্মকুন্ড নরক লাভ করে সেইজন যে কাউকে না দিয়ে একা একা মিষ্টি খায়। ওই নরকে একশো বছর ধরে শ্লেষ্ম খায়, তারপর প্রেত হয়ে জন্ম নেয়। শ্লেষ্ম, মূত্র, পুঁজ, বিষ খেয়ে পাপের বিনাশ ঘটায়। পিতামাতা, গুরু, গুরুপত্নী, পুত্রকন্যা ইত্যাদির যে ভরণ পোষন করে না সে গরকুন্ডে গিয়ে হাজার বছর বিষ খেয়ে কাটায়। তারপর ভূত হয়ে জন্মে একশো বছর কাটিয়ে পাপমুক্ত হয়।

যে শক্তিমান, খলস্বভাবের, কটুবাক্য বলে; সে বহ্নিকুন্ডে গমন করে। সেখানে আগুনে মধ্যে গায়ের লোম সংখ্যক বছর কাটায়। তারপর পরপর তিন জন্ম পশু হয়ে জন্ম নেয়, রোদে পুড়ে পুড়ে তার পাপের নাশ হয়। পরে পুণ্য লাভ করে। যে বাড়িতে উপস্থিত তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মনকে না খাইয়ে ফিরিয়ে দেয় সে তপ্ত কুন্ড লাভ করে, আগুনের মতো গরম সেই নরকে নিজের গায়ের সমান লোমসংখ্যক বছর সেখানে দুঃখ ভোগ করে, তারপর পরপর সাতজন্ম পাখি হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে এভাবে সে শুদ্ধ হয়।

অমাবস্যা, রবিবার, রবিসংক্রান্তি বা শ্রাদ্ধ দিনে কাপড় জামা সাবান দিয়ে কাঁচতে নেই। তাহলে যে পাপ হয় তার ফলে কাপড়ের সুতো সমান সংখ্যক বছর-ক্ষারযুক্ত নরক লাভ হয়। তারপর ভারতে ফিরে এসে ধোপার কাজ করে, এইভাবে দুবার জন্ম নেবার পর তার পাপ মোচন হয়। অসৃককুন্ড তাদের জন্য নির্দিষ্ট যারা ব্রাহ্মন বা গুরুকে আঘাত করে রক্তপাত ঘটিয়ে পাপ করে। সেখানে রক্ত খেয়ে একশো বছর কাটিয়ে সাত জন্ম ব্যাধ হয়ে পাপ থেকে মুক্ত হয়। শ্রীকৃষ্ণের গুণকীর্তন শুনে অনেকে ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে কান্নায় গড়াগড়ি খায়। এদৃশ্য দেখে যে ঠাট্টা করে তাকে অকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়।

একশো বছর জল খেয়ে সেখানে কাটায়। তারপর পরপর তিনবার ভারতে চন্ডাল হয়ে জন্ম নেয়। যে লোকের মন কুটিলতায় ভরা, ইচ্ছাকৃত ভাবে বারবার মানুষকে ঠকায়, সে দশ বছর গাত্রমলকুন্ডে পাপ ভোগ করে। পরে ছবার জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে গাধা ও শেয়াল হয়ে। যে পুরুষ ও নারী পরস্পরের মধ্যে শুক্র বিনিময় করে তবে তারা শুক্রকুন্ডে গিয়ে একশো বছর শুক্র খেয়ে কাটায়। তারপর কৃমি হয়ে জন্ম নেয়। এইভাবে তারা তাদের পাপ থেকে মুক্ত হয়। ব্রাহ্মণকে দান করা জিনিস অন্য কাউকে দিলে বসাকুণ্ডে যেতে হয় এবং একশো বছর বসা খেয়ে থাকতে হয়। তারপর তিনজন্ম চন্ডাল এবং সাতজন্ম কৃকলাস হয়ে মর্তে কাটাতে হয়। পরে শুদ্ধ হয়ে গরীব ও স্বল্পায়ু লাভ করে। অতিথি দেখে যারা মনে মনে অসন্তুষ্ট হয় তাদের দেওয়া তৰ্পন করা জল মৃত পূর্বপুরুষ প্রত্যাখ্যান করে। সে হয় ব্রহ্মা হত্যার সমান পাপী। তাকে দূষিকাকুন্ডে দূষিকা খেয়ে একশো বছর কাটাতে হয়। তারপর সাতবার দরিদ্র হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নেয়।

কানে কালা, এমন লোককে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করার ফলে কর্ণবিটকুন্ডে যেতে হয়। সেখানে কানের ময়লা খেয়ে একশো বছর কাটানোর পর কালা ও দরিদ্র হয়ে মানুষ রূপে সাতবার জন্ম নেয়। পরের সাতজন্ম অঙ্গহীন হয়। এইভাবে সে শুদ্ধতা লাভ করে। লোভের বশবর্তী হয়ে বা নিজের পোষণের জন্য প্রাণীহত্যা করা মহাপাপ, এই ধরনের পাপীরা মহাকুন্ডে যায়, সেখানে মজ্জা খেয়ে কাটায়, তারপর সাতজন্ম মাছ ও সাতজন্ম হরিণ হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। অর্থের লোভে যে পিতা কন্যাকে বিক্রি করে সে মেয়ের গায়ের নোম পরিমিত বছর মাংস খেয়ে মাংসকুন্ডে কাটায়। কিঙ্কর প্রহরীর দল তাকে নির্মম ভাবে প্রহার করে। মুখের সামনে থেকে যে মাংস কেড়ে নেয়, খিদের জ্বালায় সে নিজের রক্ত পান করে। তারপর ক্রিমি হয়ে মেয়ের মলে জন্ম নেয়। তারপর সাতজন্ম ব্যাধ, তিন জন্ম শূকর ও সাতজন্ম কুকুর, সাতজন্ম ব্যাং, সাতজন্ম জোঁক এবং সাতজন্ম কাক হয়ে শুদ্ধতা লাভ করে। ব্রত, উপোস, শ্রাদ্ধ প্রভৃতি সংযমের দিনে চুল, দাড়ি, নখ কাটে না, শাস্ত্র তাকে অশুচি আখ্যা দিয়েছে। সেই পাপাত্মা নখাদিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হয়, তাকে প্রহর করা হয়। যত দিন চুল দাড়ি কাটেনি, ততদিন পরিমিত বছর নখ ইত্যাদি খেয়ে নরক ভোগ করতে হয়।

হে কল্যাণী, নিজের গর্ভবতী স্ত্রীর সঙ্গে যে স্বামী সঙ্গম করে সে মহামুখ। তাকে একশো বছর পরম তাম্ৰ কুন্ডে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। পতি পুত্রহীন রমণীর দেওয়া খাবার বা ঋতুবতী নারীর দেওয়া খাবার যে লোক খায় সে একশো বছর তপ্ত লৌহকুন্ডে বাস করে। পরে সাতজন্ম ধোপা, সাতজন্ম কামার এবং মহাব্রণী ও গরীব হয়ে জন্ম নেয়। শুদ্রের দেওয়া খাবার যে ব্রাহ্মণ গ্রহণ করে, সেই পাপীকে তপ্ত সুরাকুন্ডে একশো বছর ধরে কাটাতে হয়। তারপর সাতজন্ম শুদ্রযাজী ব্রাহ্মণ হয় এবং শুদ্রের শ্রাদ্ধের খাবার খায়। এইভাবে সে তার পাপ থেকে মুক্তি পায়। গয়ায় গিয়ে বিষ্ণুর চরণে মৃত পরিজনের উদ্দেশে পিন্ড দান না করে সেই লোক তার কর্মফল ভোগ করে অস্থিকুন্ডে নিজের গায়ের নোম পরিমান বছর কাল অতিবাহিত করে। তারপর সাতজন্ম ঘোড়া ও অত্যন্ত দরিদ্র হয়ে নিজের কুলে ফিরে আসে।

মৃত্যুর পর সে পাপ থেকে মুক্তি পায়। চুলওয়ালা পার্থিব শিবলিঙ্গের পূজো করা শাস্ত্র সম্মত নয় তবুও যে মহামুখ এই পাপ কাজে লিপ্ত হয় তাকে শিবলিঙ্গের রেণু পরিমান বছর কেশকুন্ডে বাস করতে হয়। পরে যবন হয়ে একশো বছর কাটায়, এইভাবে নিজেকে শুদ্ধ করে এবং পরে নিজের বংশে জন্ম নেয়। তিক্ত বা কটু কথা বলে যে কন্যা দুঃখ যন্ত্রণা দেয়, তাকেও মৃত্যুর পর কন্টককুন্ডে যেতে হয়। তীক্ষ্ম সুঁচালো কাঁটার যন্ত্রণা আর দন্ডের প্রহার তাকে চারযুগ সহ্য করতে হয়। পরে সে উচ্চেঃশ্রবা ঘোড়া হয়ে সাতবার জন্ম নেয়। এইভাবে সে পাপের বিনাশ ঘটায়। বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলে বিষকুন্ডে হাজার বছর ধরে বিষ খেয়ে কাটায়। পরে সাতজন্ম সে-মানুষ হত্যাকারী হিসেবে পৃথিবীতে ফিরে আসে। যে ষাড়বাহক নিজে বা চাকরকে দিয়ে লাঠি দিয়ে ষাঁড়কে আঘাত করে, সে চার যুগ তেলকুন্ডে কাটাবার পর গোরুর নোম পরিমান বছর ধরে ষাঁড় হয়ে থাকে। লাঠি লোহা বা কাটা দিয়ে কাউকে খুন করলে খুনীকে দশ হাজার বছর দন্তকুন্ডে থাকতে হয়, তারপর নিজের যোনিতে জন্ম নেয়। পেটের অসুখে জীবন কাটায়, মৃত্যুর পর সে শুদ্ধ হয়। মৎস্য ভক্ষনকারী ব্রাহ্মণ যদি কোনো কারণে মাংস খায় আর শ্রীহরিকে নিবেদন না করে অন্ন গ্রহণ করে, তাহলে সেই ব্রাহ্মণ কৃমিকুন্ডে গিয়ে শাস্তি ভোগ করে। ম্লেচ্ছজাতিতে পরপর তিনবার জন্ম নেয়। তারপর শুদ্ধ হয়ে স্বজাতিতে ফিরে আসে।

পুঁজকুন্ডে গিয়ে পাপের শাস্তি ভোগ করে সেই পাপাত্মা, যে ব্রাহ্মণ শুদ্রের যজ্ঞ করে এবং তার অন্ন গ্রহণ করে, তার শবদাহ সৎকার করে ওই পুঁজ খেয়ে যজমানদের নোম পরিমাণ বছর পর্যন্ত সে কাটায়। কিঙ্কররা তাকে প্রহার করে। নরক যন্ত্রণা ভোগ করার পর ফিরে আসে পৃথিবীতে, শুদ্রের ঘরে সাতবার জন্ম নেয়। সে হয় মহাশূলের দ্বারা ব্যাধিগ্রস্ত। অবশ্যই সে গরীব হয়। এরপর সে পবিত্রতা লাভ করে, নিজের কুলে জন্ম নেয়। সর্পকুন্ড নামক নরকে সাপেদের বাস, পাপীদের তারা খায় আর যমদূতরা লাঠি দিয়ে তাদের বেদম মার মারে। এই নরক যন্ত্রণা ভোগ করে তারাই যারা শ্রীকৃষ্ণের পায়ের চিহ্নযুক্ত সাপকে হত্যা করে। নিজের দেহের লোম পরিমাণ বছর সেখানে সাপের বিষ্ঠা খেয়ে কাটায়, তারপর স্বল্পায়ু নিয়ে সর্পকুলে জন্ম লাভ করে। দরোগে আক্রান্ত হয় এবং সাপের বিষেই মারা যায়। অন্যকে ছোট প্রাণী বধ করার জন্য উপায় বাতলে দিলে বা নিজে খাবারের টোপ ফেলে ছোটো ছোটো প্রাণীদের প্রাণ কেড়ে নিলে জন্তু পরিমিত বছর ধরে দংশমশককুন্ডে কাটায়, বড়ো বড়ো ভঁস মাছির অত্যচার সহ্য করতে হয়। তাকে কিছু খেতে দেওয়া হয় না। সে কেবল যমদূতের ধোলাই খেয়ে আর্তনাদ করে মরে। যত ক্ষুদ্র জন্তু মারবে, তত ক্ষুদ্র জন্তু হয়ে বারে বারে পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে ফিরে আসবে। তারপর মানুষ হয়ে জন্মলাভ করতে। কিন্তু হয় পঙ্গু, মৃত্যুর পরে সে এই পাপ থেকে মুক্তি পায়। অকারণে কোনো ব্রাহ্মণ বা লোককে শাস্তি দিলে বজ্ৰ দংষ্ট্রকীটদের কুন্ডে, যাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তার লোম পরিমাণ বছর থাকতে হয়। সেইসব ভয়ংকর কীটেরা তাকে সর্বদা কামড়ে ধরে। সে মুক্তি পাওয়ার জন্য চীৎকার করে। এইভাবে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে সে শুদ্ধ হয় এবং অবশ্যই মানুষ হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। যে ব্রাহ্মণের চিত্তে হরির প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা নেই, যে অন্যের বাহকের কাজ করে, শস্ত্র ধারণ করে, সে শবাদিকুন্ডাদিতে যায়। তার দেহের লোমের পরিমাণ বছর থাকতে হয়। সেইসব ভয়ংকর কীটরা তাকে সর্বদা কামড়ে ধরে। সে মুক্তি পাওয়ার জন্য চীৎকার করে। এই ভাবে নরক যন্ত্রনা ভোগ করে সে শুদ্ধ হয় এবং অবশ্যই মানুষ হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। যে ব্রাহ্মনের চিত্তে হরির প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা নেই, অন্যের বাহকের কাজ করে শাস্ত্র ধারণ করে, সে শরাদিকুন্ডাদিতে যায়। তার দেহের লোমের পরিমান বছর ধরে সে শরের দ্বারা সর্বক্ষণ বিদ্ধ হয়। যন্ত্রণা ভোগ করে, তারপর মানুষ হয়ে ফিরে আসে।

হে সুব্রতা! কোনো রাজা যদি নিজের স্বার্থের জন্য অনর্থক প্রজাদের শাস্তি দেয় সে রাজা পাপের ফল ভোগ করে। বৃশ্চিক কুন্ডে গিয়ে প্রজাদের দেহের লোম পরিমাণ বছর সেখানে কাটিয়ে সাতজন্ম বৃশ্চিক হয়ে ফিরে আসে। পরে সে অবশ্যই মানুষ হয়ে জন্ম নেয়, কিন্তু সে হয় অঙ্গহীন এবং রোগগ্রস্ত। মৌমাছিদের মেরে মধু সংগ্রহ করার ফলে গরলকুন্ড নামক নরকে ঠাঁই হয়। যতগুলো মৌমাছি মেরেছে তত পরিমাণ বছর সেখানে বিষ আর যমদূতের দন্ডের আঘাত খেয়ে কাটাতে হয়। পরে সে মৌমাছি হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে এবং মৃত্যুর পর অবশ্যই পবিত্রতা লাভ করে ও মানুষ হয়ে জন্ম নেয়। যে লোক জলাশয় থেকে ওঠা কুমিরকে হত্যা করে, তাকে কুমিরের দেহের কাটার পরিমাণ বছর নকুন্ডে বাস করতে হয়, পরে সে কুমির হয়ে জন্মায়। শাস্তি ভোগ শেষ হলে অবশ্যই মানবদেহে ফিরে আসে। কামের বশবর্তী হয়ে পরস্ত্রীর লজ্জা অঙ্গ তারিয়ে তারিয়ে চোখ দিয়ে উপভোগ করে, সেই পাপীর চোখ কাকের ঠোঁটের আঘাতে কানা করে দেওয়া হয়। নিজের দেহের লোম পরিমাণ বছর কাককুন্ডে কাটিয়ে তিনজন্ম অন্ধ হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। তামা ও লোহাচুরি করার ফলে নিজের দেহের লোম পরিমাণ বছর বাজের ঠোঁটের আঘাতে চোখ কানা হয়ে বাজকুন্ডে কাটাতে হয়। সেখানে সে বাজপাখির বিষ্ঠা খায়। এইভাবে শুদ্ধতা লাভ করে, মানুষ হয়ে জন্মায়, যে মহামুখ দেবতা ও ব্রাহ্মণের সোনা হাতিয়ে নেয়, সে লাভ করে সজ্ঞানকুন্ড নামক নরক। সেখানে সে নিজের দেহের লোম পরিমাণ বছর বাজপাখির বিষ্ঠা খেয়ে তাদের ঠোঁটের আঘাতে অন্ধ হয়ে, যমদূতের মার খেয়ে কাটায়। পরের তিন জন্ম সে অন্ধ হয়। পরের সাত জন্ম হয় গরীব, মহাকুর ও পাপকারী। তারপর নিঃসন্দেহে মনুষ্যদেহ লাভ করে, সে হয় স্বর্ণব্যবসায়ী।

সুদুষ্কর বক্রকুন্ডে সেইসব পাপীদের নিক্ষেপ করা হয়, যারা দেবতার মূর্তি বা দেবতার অলংকার চুরি করে। পাপীর নিজের দেহের লোম পরিমাণ বছর যমদুতের মারের আঘাত আর বজ্রাঘাতে দগ্ধে যাওয়া দেহ নিয়ে যন্ত্রণায় না খেতে পেয়ে চিৎকার করে কাটাতে হয়। এইভাবেই পাপের স্খলন ঘটিয়ে তাকে আবার মনুষ্য জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

দেবতা ও ব্রাহ্মণের পিতল, কাসার বাসনপত্র চুরি করলে তীক্ষ্ণ পাষাণকুন্ডে নিজের দেহের লোম পরিমাণ বছর কাটিয়ে সাতজন্ম ঘোড়া হয়। তারপর মানুষ হয়, কিন্তু তার অতিরিক্ত অঙ্গ হয়। তারপরের জন্মে পায়ের রোগ নিয়ে ফিরে আসে। এইভাবে সে তার পাপ থেকে মুক্তি লাভ করে। দেবতা ও ব্রাহ্মণের শস্যাদি, পান, আসন শয্যা ইত্যাদি চুরি করলে পাপীকে একশো বছর চূর্ণকন্ডে যমদুতের প্রহার খেয়ে কাটাতে হয়। তারপর সে পরপর তিনবার ভেড়া ও তিনবার কুকুর হয়ে জন্ম নেয়। তারপর স্বল্পায়ু, বংশহীন, দরিদ্র ও কাশির রোগ গ্রস্ত এক মানুষ হয়ে জন্ম নেয়। এইভাবে সে। তার পাপের শাস্তি ভোগ করে শুদ্ধ হয়। যে লোক ব্রাহ্মণ ও দেবতার রূপো, ঘি ও বস্ত্র চুরি করে, সে পাষণকুন্ডে নিজের দেহের লোম পরিমাণ বছর কাটায় পরে তিনবার বক, তিনবার সাদা হাঁস, এক বা শঙ্খচিল হয়ে জন্মায়। পরে সাতজন্ম স্বল্পায়ু, রক্ত বিকার ও শূলরোগগ্রস্ত হয়ে মানুষরূপে পৃথিবীতে ফিরে আসে। এর পরে শুদ্ধতা লাভ করে সুন্দর মানুষের জন্ম নেয়। বেশ্যার অর্থে যে নিজের জীবিকা নির্বাহ করে সে লোক দেহের নোম পরিমাণ বছর লালাকুন্ডে থেকে নিজের লালা এবং যমদুতের প্রচন্ড মার খেয়ে কাটাতে হয়। পরে মানুষ হয়ে জন্মালেও সে হয় চক্ষুঃশূল রোগী। এভাবে সে শুদ্ধি লাভ করে। যে ব্রাহ্মণ হরি শয়নকালে কচ্ছপের মাংস খায়, সে একশো বছর ধরে কচ্ছপের কামড় খেয়ে কুমকুন্ডে বাস করে। পরের নয় জন্মে শূকর, বিড়াল এবং ময়ূর বংশে জন্ম নেয়। দেবতা ও ব্রাহ্মণের সুগন্ধি তেল বা সুগন্ধযুক্ত অন্যান্য দ্রব্য যে চুরি করে। সেই পাপী নিজের দেহের লোম সমান সংখ্যক বছর দুর্গন্ধকুন্ডে কাটায়। তারপর সাতজন্ম দুগন্ধিকা, তিনজন্ম মৃগনাভি এবং সাতজন্ম সুগন্ধি প্রাণী হয়ে জন্ম নেয়। পরে শুদ্ধ হয়ে সুস্থ মনুষ্য দেহে ফিরে আসে। শক্তি খাঁটিয়ে বা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে অন্যের জমি ছিনিয়ে নিলে, সেই মহাপাপীকে তপ্তসূর্যী নরকে পাঠানো হয়।

সেখানে রাতদিন জ্বলে পুড়ে মরতে হয়। কিন্তু সে দেহ ছাই হয় না। কারণ ভোগদেহ অবিনাশী। ওই নরকে সাত জন মনুর সময়কাল পর্যন্ত যমদুতের দন্ডের আঘাত ভোগ করে। ষাট হাজার বছর বিষ্ঠার কৃমি হয়ে জন্ম নেয়। এইভাবে ওই লোক পাপ থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ হয়ে জন্ম নেয়। অবশ্য গরিব হয়, তারপর নিজের বংশে জন্ম নিয়ে মঙ্গলজনক কাজ করে। যে অর্থের বিনিময়ে অস্ত্রের আঘাতে মানুষ খুন করে সে চোদ্দোজন ইন্দ্রের বয়স কাল পর্যন্ত আসপত্র নরকে থাকতে বাধ্য হয়। যাদের খুন করা হয়, তাদের মধ্যে যদি কেউ ব্রাহ্মণ থাকে তাহলে শাস্তির মাত্রা আরও ভয়ংকর হয়। একশো মনুর সময় পর্যন্ত তাকে খঙ্গের আঘাত সহ্য করতে হয়। তার উপোসী দেহ ভয়ংকর যমদূতদের দন্ডের আঘাতে জর্জরিত হয়।

সে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। তারপর শতবার শূকর, শতবার কুকুর ও সাতবার শিয়াল হয়ে জন্ম নিয়ে ভারতে ফিরে আসে। পরে সাতজন্ম বাঘ, তিনজন্ম বৃষ, সাতজন্ম গরুড় এবং তিনজন্ম মোষ হয়ে জন্মায়, বন্ধু ও ব্রাহ্মণের সঙ্গে নির্দয় ব্যবহার করলে বা হিংসা করলে একযুগ বক্রকুন্ডে বাস করার পরে সাতজন্ম বক্র অঙ্গ, হীন অঙ্গ, গরীব, বংশহীন ও পত্নীহীন হয়ে পাপের স্খলন ঘটাতে হয়। পরে সে মুক্তি লাভ করে। পরের নিন্দা শুনে যে প্রশংসা করে এবং পরের নিন্দা করে সে লোক সূচীমুখ নরক যন্ত্রণা ভোগ করে।

তিনযুগ ধরে সূচীবিদ্ধ হতে হয়। পরে সেই পাপী সাতবার বিছা, সাতবার সাপ, সাতবার বজ্রকীট ও সাতবার ভষ্মকীট হয়ে জন্মাবার পর ভয়ংকর রোগগ্রস্থ মানুষ হয়ে ফিরে আসে। পরে সে পাপ থেকে মুক্তি পায়। সাধারণ জিনিস চুরি করার ফলে চোর নমুখ নরকে এক যুগ কাটিয়ে মহারোগগ্রস্ত হয়। পরে শুদ্ধি লাভ করে এবং মানুষ দেহ লাভ করে। তৃষ্ণার্ত গোরুকে যে জল খেতে দেয় না, গোরুর যত্নআত্তি করে না, তাকে গোমুখ নরকে যেতে হয়! গোরুর মুখাকৃতি এই নরকে কৃমিদের বাস। গরম জলে ভরা এখানে এক মন্বন্তর যন্ত্রনা ভোর করার পর সাতবার গোরুহীন মহারোগিও গরীব মানুষ হয়ে জন্মলাভ করে। পরের সাতবার শুদ্ৰযোনিতে জন্ম গ্রহণ করে মুক্তি পায়।

যে ব্রাহ্মণ যেখানে সেখানে গমন করে, সন্ধ্যা আহ্নিক করে না, দীক্ষা নেয় না, সুরা পান করে, শুদ্রের অনুগামী হয়, গোরু বা ব্রহ্ম বা স্ত্রী হত্যা করে সেই মহাপাপী কুম্ভীপাক নরকে গমন করে। চোদ্দজন ইন্দ্রের জীবিতকাল পর্যন্ত যন্ত্রণা ভোগ করে। যমদূতের প্রহারে তাকে নাস্তানুবাদ হতে হয়। সে আগুনে, গরম জলে বা তেলের কড়ায় পড়ে আর্তনাদ করে। কখনও উত্তপ্ত লোহার দন্ড দিয়ে ছ্যাকা দেওয়া হয়।

নরক যন্ত্রণা ভোগ করার পর শকুনি হয়ে জন্ম নেয়। এককোটি বার এবং একশোবার শূকর হয়ে জন্মায়। সাতজন্ম কাক, সাতজন্ম, সাপ এবং ষাট হাজার বছর কৃমি হয়ে বিষ্ঠা খেয়ে থাকে। তারপর সে শুদ্রবংশে জন্ম নেয়। সে হয় দরিদ্র, যক্ষ্মা, কুষ্টরোগ গ্রস্ত, তার কোনো স্ত্রী হবে না। এইভাবে জন্ম ধরে শাস্তি ভোগ করার পর পাপীর পাপ স্খলন হয়। সে মুক্তি পায়। হে দেবী! যে ব্রাহ্মণ হরিসেবা করে, শুদ্ধযোগী, সিদ্ধ, ব্রত, উপোস পালন করে, তারা নরকপ্রাপ্ত হয় না।

সাবিত্রী বললেন– হে যমরাজ, ব্রহ্মহত্যা বা গো হত্যা পাপের ভাগী কীভাবে হওয়া সম্ভব? অগম্যাগামী সন্ধ্যাহীন, অদীক্ষিত, গ্রামবাসী, ব্রাহ্মণ, শূদ্রের সূপকার– এরা, কারা? এদের লক্ষণ সম্পর্কে আপনি অনুগ্রহ করে ব্যাখ্যা করুন।

যমরাজ বললেন– নির্গণ পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ সকলের আত্মা, সমস্ত কারণের কারণ, তিনি সকলের আদি, মায়াবলে অসংখ্যরূপ ধারণ করেছেন। ব্রহ্মা, শিবা প্রভৃতি দেবতারা তাকে ঈশ্বরজ্ঞানে পূজো করেন, সেই শ্রীকৃষ্ণকে যে অন্য দেবতাদের সমান দেখে, সে হয় ব্রহ্ম হত্যার ভাগীদার, নিজের গুরু ও ইষ্টদেবতার মধ্যে এবং জন্মদাতা বাবা ও গর্ভধারিনী মায়ের মধ্যে যে পার্থক্য দেখে সে হয় ব্রহ্ম হত্যার ভাগী। শ্রীকৃষ্ণ ও তার পূজোর আধার মাটির প্রতিমাতে, শিব ও শিবলিঙ্গ, সূর্য ও সূর্যমণিতে গণেশ ও তার পূজোর মাটির মূর্তিতে এইভাবে অন্যান্য দেবদেবী ও তাদের মাটির প্রতিমার সাথে পার্থক্য দেখে সেই ব্রাহ্মণ ব্রহ্ম হত্যার সমান শাস্তি পায়।

যিনি বিষ্ণুভক্তি দান করেন, সকলের শক্তি স্বরূপ এবং সকলের জননী, সকলের কাছে যিনি পূজ্য, যিনি সকলের আদি ও কারণ সেই বিষ্ণুমায়া প্রকৃতিকে নিন্দা করলে, ব্রহ্ম হত্যার ভাগীদার হতে হয়। যে লোক পূণ্যদায়ক পাঁচটি ব্ৰত অর্থাৎ জন্মাষ্টমী, বামনবাসী, শিবরাত্রি, একাদশী ও রবিবার পালন করে না তারা চন্ডালের থেকেও বেশী পাপী হয় এবং ব্রহ্ম হত্যার ভাগী হয়। বেদক্ত দেবদেবী ও পিতৃগণের পূজো নিজে না করলে এবং অন্যকে পূজো করতে বাধা দিলে ব্রহ্ম হত্যার সমান শাস্তি পায়। ব্রহ্ম হত্যার পাপের ভাগী তাকেও হতে হয়। যে সংসার প্রতিপালন করে না, যে লোকের শ্রীহরির প্রতি ভক্তি নেই, যে লোক নিত্য বিষ্ণু ও পার্থিব শিবলিঙ্গের প্রতি অনাস্থা পোষন করে সে লোক ব্রহ্মহত্যার ভাগী হয়।

যে মূর্খ ব্রাহ্মণ গোরুকে ভাল খাদ্য খেতে দেয় না, তাকে বেত দিয়ে আঘাত করে, গোরুর সেবা করে না, সে গোহত্যা পাপের ভাগী হয়, যে লোক গোরুকে উচ্ছিষ্ট খেতে দেয়, বৃষবাহক ব্রাহ্মণকে দিয়ে পুজো করায় এবং তার অন্ন গ্রহণ করে, শত গোহত্যার সমান পাপের ফল তাকে ভোগ করতে হয়। যে লোক পা না ধুয়ে খায় এবং ঘুমোয়, সূর্য উঠলে দুবার খাদ্য গ্রহণ করে, স্বামী পুত্রহীন স্ত্রীর অন্ন যে খায় এবং যে ত্রিসন্ধ্যা বন্দনা করে না, তাকে গোহত্যা পাপের ভাগী হতে হয়।

নারায়ণ বললেন– হে নারদ, বাস্তব ও আরোপিত পাপপূণ্যের মধ্যে পার্থক্য সম্বন্ধে সাবিত্রী জানতে চাইলে যমরাজ বলেছিলেন, হে সতী সাধ্বী সাবিত্রী। বাস্তব ও আরোপিত কোনোটি প্রধান বা কোনোটি অপ্রধান নয়। বেদে প্রামাণ্য দুটিই সমান। বেদের প্রমাণের ওপর বিশ্বাস না রাখলে গুরুহত্যার সমান পাপী হয়। পূর্ব পরিচিত ব্রাহ্মণ যদি বিদ্যা বা মন্ত্র দান করেন, তিনি হন গুরু। যিনি জন্মদাতা পিতার থেকেও শ্রেষ্ঠ, অর্থাৎ গুরুর ওপর পিতৃত্ব আরোপিত হয়। যা বাস্তব, বেদ বলেছে, বাবার থেকে মা সাতগুণ বেশি পূজ্য এবং সেই মায়ের থেকে বিদ্যাদাতা ও মন্ত্রদাতা গুরু শতগুণে পূজ্য। যেমন ইষ্টদেবতার থেকে তার পত্নী শ্রেষ্ঠ, তেমনই গুরুদেবের থেকে গুরুপত্নী বেশী পূজ্য। সেই ব্রাহ্মণ শিবের সমান, এই রাজা বিষ্ণুর সমান মহাপরাক্রমশালী–আরোপিত থেকে বাস্তব লক্ষণগুণে শ্রেষ্ঠ। সকল ব্রাহ্মণই ব্যাসদেবের সমান– এখানে সকল ব্রাহ্মণ ও ব্যাসদেবের মধ্যে সমতা নির্ণীত হয়েছে। পদ্মযোনি ব্রহ্মা থেকে শুরু করে সমস্ত দেবতাদের অভিমত, আরোপিত হত্যা যত না পাপজনক, তার থেকে চারগুন বেশি পাপ হয় বাস্তব হত্যা করলে।

নারী অগম্য সম্পর্কে বেদ বলেছে, নিজের স্ত্রী ছাড়া সব নারীই অগম্য। শুদ্রের ব্রাহ্মনস্ত্রী এবং ব্রাহ্মণের শূদ্র স্ত্রী মোটেও গম্য নয়। বেদে ও লোকসমাজে এদের কঠোর ভাবে নিন্দা করা হয়েছে। শূদ্র ব্রাহ্মণ হতে গেলে শত ব্রহ্ম হত্যার পাপভাগী হয়। আর ওই রমণী ও একই পাপে পাপী হয়। দুজনে কুম্ভীপাক নামক নরকে বাস করে। যে ব্রাহ্মণ মদ ও একাদশীতে অন্ন খায়, শুদ্র রমনীকে পত্নী হিসাবে গ্রহণ করে, সেই ব্রাহ্মণকেও কুম্ভীপাক নরকে যেতে হয়। গুরুপত্নী রাজমহিষী, মা, মেয়ে, বিমাতা, শাশুড়ি, ছেলের বউ। নিজের বোন, নিজের ভাইয়ের পত্নী, ঠাকুরমা দিদিমা, পিসিমা, মাসীমা, মামীমা, শিষ্যা, শিষ্যের পত্নী, ভাইয়ের ছেলের বউ, বোনের ছেলের বউ ব্রহ্মা এইসব নারীদের অগম্যা বলেছেন। যে মুখ ব্যক্তি এইসব নারীদের মধ্যে একজনকে বা অনেকের সঙ্গে দেহ সম্পর্ক গড়ে তোলে, তারা শত ব্রহ্ম হত্যার সমান শাস্তি ভোগ করে। বেদ এদেরকে নিজের মাতৃগামী বলে উল্লেখ করেছে।

সন্ধ্যাহীন ব্রাহ্মণ তাকেই বলা হয় যে, সন্ধ্যাবন্দনা করেনা, যারা শিব, বিষ্ণু, শক্তি, সূর্য, গণেশ ইত্যাদি দেবতার দীক্ষা গ্রহণ করে না, তারা হল অদীক্ষিত ব্রাহ্মণ, গঙ্গার স্রোতের মধ্যে চার হাত ব্যাপী জায়গার স্বামী হলেন নারায়ণ। এই নারায়ণ স্বামীকে উৎকৃষ্ট গঙ্গার গর্ভমধ্যে কুরুক্ষেত্রে, বদরিকাশ্রমে, হিমালয়ে, ত্রিবেনীতে, গঙ্গাসাগর সঙ্গমে, সোমতীর্থে, কেদারনাথে, বারনসীতে পুরুষোত্তমে, পুষ্করে, সরস্বতী নদীর তীরে, বৃন্দাবনে, গোদাবরী বা কৌশকী নদীর তীরে এছাড়া অন্য যে কোন ধর্মস্থানে ইচ্ছে। করে ব্রাহ্মণ যদি দান গ্রহন করে, তাহলে সে হয় তীর্থপ্রতিগ্রাহী। এরা কুম্ভীপাক নামক নরকে গমন করে, যে ব্রাহ্মণ শূদ্র ব্যতীত অন্য তিনবর্ণের পূজো করে, তাকে বলে গ্রামজী এবং দেবতার পূজো আর্চা করে যে জীবিকা নির্বাহ করে সে ব্রাহ্মণ অবশ্যই দেবল। শূদ্রের আহার তৈরি করে যে ব্রাহ্মণ রোজগার করে সে হল সূপকার, প্রমত্ত ও পতিত ব্রাহ্মণেরা পূজো ও সন্ধ্যাক্কি করে না। এইসব মহাপাপাত্মাদের কুম্ভীপাক নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।

.

একত্রিংশ অধ্যায়

নারায়ণ বললেন–হে নারদ! ধর্মরাজ যম অন্যান্য নরক কুম্ভ বিষয়ে সাবিত্রীকে কী জ্ঞান দান করেছিলেন তা এবার শ্রবণ করো।

ধর্মরাজ বললেন– হে কল্যাণী! শুভ বা অশুভ যে কোনো কাজের ফল খন্ডন করার জন্য বিষ্ণুসেবা অবশ্যই প্রয়োজন। ভালো কাজের পরিবর্তে স্বর্গ লাভ হয়। নতুবা নরকে পচে মরতে হয়। বেশ্যার অন্ন খেয়ে যে জীবিকা নির্বাহ করে, সেই ব্রাহ্মণ কালসূত্র নরকে যায়। একশো বছর সেখানে বাস করার পর শূদ্রকূলে রোগগ্রস্ত হয়ে জন্ম নেয়। এভাবেই শুদ্ধ হয়ে ব্রাহ্মণ যোনি লাভ করে।

বাগদত্তা কন্যাকে যে ব্রাহ্মণ অন্য পাত্রে সম্প্রদান করে সে পাংশুভোজন নরকে যায়, সেখানে পাংশু খেয়ে একশো বছর কাটায়। পরের গচ্ছিত দ্রব্য চুরি করার ফলে পাপবেষ্ট নরকে যেতে হয়। সেখানে একশো বছর ধরে যমের কিঙ্করদের প্রহারের আঘাত সহ্য করতে হয়। তাকে শরশয্যায় শুতে বাধ্য করা হয়। ব্রাহ্মণদের ওপর নির্যাতন বা অত্যাচার করা হলে সেই পাপী লোককে প্রকম্পন নরকে পাঠানো হয়। নিজের দেহের লোমসংখ্যক বছর সেখানে অতিবাহিত করে।

হে দেবী! পতিব্রতা নারী কেবল নিজের স্বামীতেই পরিতুষ্ট থাকে। কিন্তু কুলটা নারী তাকেই বলা হয় যে দুজন পুরুষের সঙ্গ ছাড়া বাঁচতে পারে না। তিনজন পুরুষে যে নারী উপগত হয় সে হল ধর্ষিণী এবং পুংশ্চলী স্ত্রী চারজন পুরুষে গমন করে, বেশ্যা রমনী চার অথবা পাঁচজন পুরুষে উপরত হয়। যুগ্মীরা সাত অথবা আট পুরুষ গামিনী এর থেকে বেশি সংখ্যক পুরুষে যারা উপগত হয় তারা হল মহাবেশ্যা, কুলটা, ধর্ষিণী, পুংশ্চলী। যুগ্মী বেশ্যা ও মহাবেশ্যা নারীতে যে লোক উপগত হয় সে অবটোদ নরকে গমন করে। কুলটার ক্ষেত্রে একশো, ধর্ষিণীর ক্ষেত্রে তার চারগুণ। পুংলীর জন্য ছয়গুণ, বেশ্যার ক্ষেত্রে আটগুণ, যুগ্মীগামীর ক্ষেত্রে তার দশগুণ বছর ওই নরকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।

আর মহা বেশ্যাগামী হলে ওই নরকে বাস করার ফল হয় একশো গুণ বেশি। তবে পদ্মযোনি ব্রহ্মা বলেছেন যে ব্রাহ্মণমহাবেশ্যাতে উপগত হয় সে সর্বগামী নিঃসন্দেহে। যেখানে যমদুতের দন্ডের আঘাতে সে আর্তনাদ করে। কুলটাগামী যে সে তিতির পাখি, পুংশ্চলগামী কোকিল, বেশ্যাগামী হলে বক, যুগ্নীগামী হলে শূকর। মহাবেশ্যাগামী শ্মশানে শিমূল গাছ হয়ে সাতবার জন্ম নেয়। যে অজ্ঞানী সূর্য গ্রহণ বা চন্দ্র গ্রহণ মানে না সেই সময় আহার গ্রহণ করে সে অরন্তুদ নরকে চাঁদের আয়ুষ্কাল পর্যন্ত বাস করে। নরক যন্ত্রনা ভোগ করার পর মানুষ হয়ে জন্ম নেয়। সে হয় গুল্মরোগগ্রস্ত। উদরী রোগে ভোগে, অন্ধ এবং দাঁতহীন হয়। এইভাবে পাপ থেকে মুক্তি পায়।

হে সতী সাধ্বী, যে ব্রাহ্মণ নিজের ব্রাহ্মণী ছাড়া অন্য ব্রাহ্মণীতে গমন করে, তা হলে ওই ব্রাহ্মণ এবং পরস্ত্রীকে কষনরকে বারো বছর ধরে গরম কষায় জল খেয়ে কাটাতে হয়। ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য তিনবর্ণের ক্ষেত্রেও একই বিধান দেওয়া হয়েছে। নরক যন্ত্রণা ভোগ করার পর এরা পবিত্রতা লাভ করে। শিবের পুজো না করলে তার কোপে পড়তে হয়।

একশো বছর তাকে শূলস্রোত নরকে বাস করতে হয়। তারপর সে সাতবার হিংস্র প্রাণী, সাতবার পূজারি ব্রাহ্মণ হয়ে জন্ম নেয়। তারপরে শুদ্ধ হয়। ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য যদি ব্রাহ্মণীতে গমন করে তা হলে তারা হয় মাতৃগামী। এই পাপের ফলে শূর্পনরকে তাদের যেতে হয়। শূর্প আকারের কৃমিদের আর যমদূতদের দন্ডের তাড়না ভোগ করতে হয়। গরম মূত্র খেয়ে চোদ্দজন ইন্দ্রের আয়ুষ্কাল পর্যন্ত যন্ত্রনা ভোগ করার পর সাতবার শুয়োর, সাতবার ছাগল হয়ে জন্ম নেয়। এবং শুদ্ধ হয় তুলসী হাতে নিয়ে গঙ্গাজল, শালগ্রাম শিলা বা অন্য কোনো দেবতাকে স্পর্শ করে যে ব্রাহ্মণ প্রতিজ্ঞা করে, অথচ পরে তা খেলাপ করে সেই ব্রাহ্মণ জ্বালামুখ নরকে নিক্ষিপ্ত হয়।

যে লোক গোরু বা আগুন ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে ও তার খেলাপ করে, যে বন্ধুদ্ৰোহী, বিশ্বাস ঘাতক, কৃতঘ্ন, মিথ্যা সাক্ষী দেয়, সেও জ্বালামুখ নরকে ইন্দ্রের সময়কাল পর্যন্ত যমদূতদের তাড়না সহ্য করে, অঙ্গীরে পুড়ে মরে, তারপর তুলসী স্পর্শ করে যে প্রতিজ্ঞা করে ও ভঙ্গ করে সে সাতজন্ম চণ্ডাল, গঙ্গাজলের ক্ষেত্রে সাতজন্ম বিষ্টার কৃমি, দেবতার প্রতিমার ক্ষেত্রে সাতজন্ম ব্রণকৃমি হয়ে পবিত্রতা লাভ করে। ডান হাত দিয়ে তুলসী, গঙ্গাজল বা যে কোনো দেবতার বিগ্রহ স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করার পর, কথা না রাখার ফলে জ্বালামুখ নরকে গিয়ে সাতজন্ম শাস্তি ভোগ করে এবং পরে হস্তহীন হয়ে জন্ম নেয়।

মন্দিরে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলার ফলে সাতবার পূজারি হয়ে জন্ম নিতে হয়, যে ব্রাহ্মণকে ছুঁয়ে মিথ্যে কথা বলে সে সাতজন্ম অগ্রদানী- বামুন হয়ে জন্মায়, পরে তিনবার বোকা, কালা ও বোবা হয়ে ফিরে আসে। এর কোনো বংশপরিচয় ও ভাষা থাকে না। বন্ধুদ্রোহী সাতজন্ম বেজি, কৃতঘ্ন সাতজন্ম গন্ডার ও বিশ্বাসঘাতক সাতজন্ম বাঘ হয়। মিথ্যা সাক্ষী যে দেয়, সে সাতবার ভাল্লুক হয়ে ভারতে ফিরে আসে, তার পাপের তাড়নায় তার নিজের পূর্বতন সাতপুরুষ ও অধস্তন সাত-পুরুষও শাস্তি ভোগ করে। দেবতা ও ব্রাহ্মণের সম্পত্তি চুরি করার পাপে ধোঁয়া ও ঘন অন্ধকারময় ধূসান্ধনরকে ধোঁয়া খেয়ে ও যন্ত্রনা সহ্য করে চারযুগ ব্যাপী বাস করে। সে তার ও পরের ও নীচের দশ পুরুষকে নীচে নামায়, নরক যন্ত্রণা ভোগ শেষ হলে ফিরে আসে পৃথিবীতে-সাতবার ইঁদুর, বিভিন্ন পাখি, কৃমি ও নানারকম গাছপালা হয়, তারপর স্ত্রীহীন, বংশহীন, রোগক্রান্ত এক মানুষ হয়ে জন্ম নেয়। মৃত্যুর পর স্বর্ণকার তারপর সুবর্ণবনিক এবং সেবী ব্রাহ্মন, সবশেষে গণক হয়।

যে ব্রাহ্মণ বৈদ্য গিরি করে বা লাক্ষা, লোহা, রস ইত্যাদি বেচে জীবিকা নির্বাহ করে। সে নাগবেষ্ট নরকে নিজের দেহের লোম সংখ্যক বছর সাপের কামড় খেয়ে কাটাতে বাধ্য হয়, তারপর যে গণক, বৈদ্য, গোয়ালা, কামার, শঙ্কার হয়ে সাতবার জন্ম নেবার পর পাপ থেকে মুক্তি পায়। যে বেদ বিশ্বাস করে না, জড়তা বশতঃ ব্রাহ্মণদের নিত্যক্রিয়া পালন করে না, ব্রত ও উপবাসের কথা শুনে হাসিঠাট্টা করে, বেদকে উপহাস করে, মিথ্যে কথা অনর্গল বলে, পরের নামে নিন্দা রটায় এমন ধরনের লোক একশো বছর নরকের বরফপূর্ণ জলে কাটায়। তারপর একশো জন্ম জলজন্তু, নানাধরনের মাছ হয়, পরে শুদ্ধ হয়।

যে স্ত্রী ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে স্বামীর দিকে কটাক্ষপাত করে, স্বামীকে যাচ্ছেতাই শব্দে গালিগালাজ করে, সে কন্যা উল্কামুখ নরকে পতিত হয়। সেখানে যমদূত তার মাথায় লাঠির ও নিক্ষিপ্ত উদকার আঘাত স্বামীর দেহের লোম সংখ্যক পরিমান বছর সহ্য করতে হয়। তারপর সাতজন্ম রোগী ও বিধবা হয়ে দুঃখ ভোগ করার পর শুদ্ধ হয়, সে ব্রাহ্মণী অন্ধকূপ নরকে যায়। যেখানে চোদ্দোজন ইন্দ্রের সমানকাল পর্যন্ত গরম শৌচজল ভরা ঘন অন্ধকারে শৌচজল খেয়ে সময় কাটাতে হয়, যমদূতরা তাকে ভীষণ মারে। নরকের দুঃখ ভোগ করা শেষ হলে হাজার জন্ম স্ত্রী কাক, একশো জন্ম শূকরী, একশো জন্ম কুকুরী সাতজন্ম শিয়ালী, সাতজন্ম স্ত্রী পায়রা এবং সাতজন্ম বানরী হওয়ার পর সর্বভোগ্যা চন্ডালী হয়ে জন্ম নেয়, এরপর ধোপানী ও যক্ষারোগী পুংশ্চলী হয়। পরে কুষ্ঠরোগী তৈলকারী হয়, পরে শুদ্ধিলাভ করে।

কুলটা দেহচূর্ণ পুংশ্চলী হয় পরে কুষ্টরোগী, তৈলকারী হয়, পরে শুদ্ধিলাভ করে, কুলটা দেহচূর্ণ, পুংশ্চলী দলন, ধর্ষিণী শোষক, যুগ্মী, দন্ডতাড়ন, বেশ্যা, বেধন এবং মহাবেশ্যা জালবন্ধ নরকে গমন করে। এক মনুর সময়কাল পর্যন্ত তারা মলমূত্র খেয়ে ও যমদূতদের দন্ডের আঘাত খেয়ে নরক যন্ত্রনা ভোগ করে পাপের সঙ্খলন ঘটায়। তারপর বিষ্ঠার কৃমি হয়ে পৃথিবীতে লক্ষ্য বছর কাটায়, শেষে পবিত্রতা লাভ করে। হে সতীসাধ্বী সাবিত্রী। তোমাকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নরক ও তার কর্মকলের কথা বললাম। এছাড়া আরো অনেক নরককুন্ড আছে যেখানে পাপীরা পাপের শাস্তি ভোগ করে। নানা জন্মান্তরের মাধ্যমে তারা শুদ্ধ হয়।

.

বত্রিশতম অধ্যায়

মহাভাগ ধর্মরাজ যিনি বেদ ও বেদাঙ্গে পারদর্শী। সাবিত্রী বললেন–তিনি নানা পুরান, ইতিহাস ও পঞ্চরাত্র প্রভৃতি শাস্ত্রে বিশেষ অভিজ্ঞ, সাবিত্রী জানতে চাইলেন কোন কাজ করলে আর কাজ করতে হয় না। যা প্রশংসনীয় কাজ ও সুখদায়ক। যা যশ দেয়, ধন দেয় ও মঙ্গলদায়ক, যা করলে যমালয়ে যেতে হয় না, সংসারে জ্বালা ভোগ করতে হয় না এবং আবার জন্মগ্রহণ করতে হয় না। পূর্বে বলা নরককুন্ডে যেতে হয় না। যাতে দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

ধর্মরাজ শ্রীগুরুকে নমস্কার করে, হরিকে স্মরণ করে সাবিত্রীর প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করলেন। বললেন–চারবেদ, সকল ধর্মসংহিতা, পুরাণ, ইতিহাস, পঞ্চরাত্র প্রভৃতি শাস্ত্র ও অন্যান্য শাস্ত্র ও বেদাঙ্গ মধ্যে কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণ সেবা সকলেরই প্রার্থনীয় ও সর্বশ্রেষ্ট। যা সকলকে উদ্ধার করে জন্ম, মৃত্যু, জরা, রোগ, শোক ও সন্তাপ থেকে। সকল সিদ্ধির কারণ কৃষ্ণসেবা। যা উদ্ধার করে, নরক সাগর থেকে। কর্মভোগী, গৃহীরা হরিব্রত ও হরিতীর্থে স্নান, হরি বাসরে উপোস করে, নিত্য হরিকে প্রণাম করে ও পূজা করে তারা কখনও ভয়ঙ্কর সংযমনীপুরীতে যান না, যে ত্রিসন্ধ্যায় শুদ্ধাচারী হয়ে নিজের ধর্ম পালন করে ও শান্ত হয় সেও আমার ভবনে যায় না।

ব্রহ্মা নিজেই তাদের ‘মধুপক’ তৈরি করে রাখেন যখন তারা ব্রহ্মলোক অতিক্রম করে গোলকের উদ্দেশ্যে যায়। কৃষ্ণভক্তের স্পর্শেই সকল পাপ পুড়ে যায় যেমন জ্বলন্ত আগুনে কাঠ ও ঘাস পুড়ে যায়। দেহীদের দেহের প্রধান কারণ হল বিধাতার সৃষ্টি পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, বেদ ও জল। সূক্ষ্মদেহকে ভোগ দেহ বলা যায়, যা শস্ত্রের আঘাতে বা অস্ত্রের আঘাতেও নষ্ট হয় না। এরপর তিনি শাস্ত্র অনুসারে লিঙ্গ দেহের বিবরণের কথা বলবেন বললেন।

.

তেত্রিশতম অধ্যায়

অত্যন্ত নীচে ও বিশেষ পাথরে তৈরি সকল নরককুন্ডই পুর্ণ চাঁদের মতো গোল। যা পাপীদের শাস্তি দানের জন্য নির্মিত, বহ্নিকুন্ড নরক জ্বলন, কয়লার মত উজ্জ্বল ও ওপরের দিকে একশো হাত ও চারদিকে একক্রোশ বিস্তৃত যা পাপীদের আর্তনাদে পরিপূর্ণ। হিংস্র জলজন্তুতে ভর্তি তপ্তোদক কুন্ড, আর তারপর একক্রোশ বিস্তৃত ক্ষারকুন্ড, যা তপ্ত ক্ষার জলে পরিপূর্ণ। এরপর গরম মূত্রে পূর্ণ মূত্রকুন্ড। শ্লেষ্মতে পরিপূর্ণ শ্লেষ্মকুন্ড, নেত্রমলকুন্ড, শুক্রকুন্ড, রক্তকুন্ড, গাত্রমলকুন্ড, নখকুন্ড, অস্থিকুন্ড, কেশকুন্ড ও লোমকুন্ড।

একলব্য তামার মূর্তি যুক্ত তপ্ত অকুন্ড, ঘর্মকুন্ড, তপ্তসুরা কুন্ড, কন্টককুন্ড, যার কাটার পরিমাণ চারহাত, একক্রোশ বিস্তৃত বিষকুন্ড যা সাপের বিষে ভর্তি। গরম তেলে ভর্তি তপ্ততৈল কুন্ড। এর দৈর্ঘ্য চার ক্রোশ, শকুন্ড একক্রোশ বিস্তৃত, কুন্তকুন্ড, পুঁযকুন্ড যা দুর্গন্ধ যুক্ত, পুঁজে পূর্ণ যায় পরিমান আধক্রেশন, এরপর মশককুন্ড, শরাদিকুন্ড যা তিন শরাদি পূর্ণ একশো কোটি বিরাট কাক সেখানে পাপীদের খায়। বাজকুণ্ড বাজপাখিতে পরিপূর্ণ, ব্রজকুন্ড অন্ধকার ময়। তপ্ত পুষাণকুন্ড জ্বলন্ত কয়লার মত, উজ্জ্বল পাষাণকুন্ডে রক্তাক্ত দেহে পাপীরা বাস করে। এরপর দুর্গন্ধ যুক্ত লালাকুন্ড, গরমজলে পূর্ণ মসীকুন্ড, এক ক্রোশ দীর্ঘ চূর্ণদ্রবকুন্ড, চারক্রোশ পরিমাণ বক্রকুন্ড, এক ক্রোশ বিস্তৃত জ্বালাকুন্ড, গরম ছাইয়ে পূর্ণ ভষ্মকুন্ড।

একক্রোশ পরিমাণ সম দগ্ধকুন্ড। সূচের মুখের মত অস্ত্রে ভর্তি কুন্ড হল সূচীমুখ কুন্ড। গোধাকুন্ড হল গোসাপের মুখের আকারের মত। গোমুকুন্ড, গোরুর মুখের মত। কোথাও গরম লোহার কুন্ড আবার কোথাও গরম তামার কুন্ড, গরমজলে ভর্তি কালসূত্র নরক, অবটৌক নরক হল কৃপের মতো যার বিস্তার আশি হাত। এখানে পাপীদের গা পুড়ে গেলেও দূতেরা তাড়না করে। চারশো হাত বিস্তৃত পাংশুভোজ নরক। উল্কা মুখ নরক হল যেখানে পাপীদের মুখে উল্কা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। দন্ডতাড়ন নরক হল চৌষট্টি হাত। জ্বালবদ্ধ নরকে এখানে পাপীরা বিরাট জালে আবদ্ধ থাকে। দলন নরকে দূতরা পাপীদের সর্বদা গদা দিয়ে দলন করে থাকে। শোষণ নরক হল যার আয়তন একশো কুড়ি হাত ও গভীরতা একশো পুরুষের মতো জ্বালামুখ নরক ভীষণ কষ্টদায়ক। অন্ধকারে আচ্ছন্ন ও আয়তনে চারশো হাত বিস্তৃত নরকের নাম ধূমান্ধ নরক। যম ছিয়াশি রকম কুন্ডের বর্ণনা দিলেন।

.

চৌত্রিশতম অধ্যায়

সাবিত্রী এরপর যমকে অত্যন্ত দুর্লভ ও শ্রেষ্ট হরিভক্তি দান করতে বললেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণের গুণকীর্তন রূপ ধর্মের কথা জানতে চাইলেন। যম সাবিত্রীকে বললেন, তিনি তার মনের মতো সকল বর দিয়েছেন। যম বললেন–শ্রীকৃষ্ণের গুণকীর্তন যে শোনে তার সকল কুলই উদ্ধার হয়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব যাঁর চরণপদ্ম ধ্যান করছেন, সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গুণকীর্তন করা ভক্তদের পক্ষে সহজ। যা অন্য লোকের কাছে দুর্লভ।

ঈষৎ হাস্যময় শ্রীকৃষ্ণ অমূল্য পীতবস্ত্রে সুশোভিত এবং ব্রহ্মতেজে প্রজ্বলিত। পরম ব্রহ্ম স্বরূপ, তার মূর্তি শান্ত ও দেখতে সুন্দর। চারিদিকে দাঁড়িয়ে গোপীরা তাকে দেখছে সবসময়। তিনি রাসমন্ডলের মাঝে উপবিষ্ট রত্নসিংহাসনে। জীব যদি জ্বলন্ত আগুনেও পড়ে, গভীর জলসাগরে ডোবে, গাছের মাথা থেকে পড়ে, মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে কাল যাঁর ভয়ে তাকে হরণ করে। আটাশ জন ইন্দ্রের বিনাশ রূপ বললে ব্রহ্মার দিন গণনা অনুসারে তিরিশ দিনে ব্রহ্মার এক মাস হয়।

দুমাসে ব্রহ্মার এক যুগ হয়, ছয় ঋতুতে হয় এক বছর। শ্রীহরির চোখের এক পলক পড়ে একশো বছর বয়সী ব্রহ্মার বিনাশ হয়। শ্রীকৃষ্ণের প্রাণে অবস্থান করেন শ্রীকৃষ্ণের প্রাণের অধিষ্টাত্রী দেবী রাধা, শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে মহা আনন্দে অবস্থান করেন বৈষ্ণবরা। তার লোমকূপে সকল বিশ্ব অবস্থিত। পৃথিবীর ধূলোর মতো ব্রহ্মার সৃষ্টি ও ধ্বংসেরও কোন সংখ্যা করা যায় না। মহাত্মারা দিব্যরূপ ধারন করাকে মোক্ষ্য বলেন।

সেবাশূন্য মুক্তি হল চার রকম। জ্ঞানী ব্যক্তিরা নিষেক বলে কৃতকর্মের ভোগকেই। শ্রীকৃষ্ণ সেবায় সমস্ত কৃতকর্মের খন্ডন হয়ে যায় ও শুভ ফল লাভ হয়। শ্রেষ্ট তত্ত্বজ্ঞান শ্রীকৃষ্ণ সেবা। সাবিত্রীকে সুখে থাকার কথা বললেন–যম। এবং বললেন–পুণ্যক্ষেত্র ভারতে লক্ষ বছর ধরে সুখভোগ করার পর গোলোকে শ্রীকৃষ্ণ ভবনে যাবে। জৈষ্ঠ্যমাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে মঙ্গলদায়ক সাবিত্রী চুতর্দশীর ব্রত করতে হয়। ভক্তিভরে ষোল বছর ধরে প্রতি বছর ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমি তিথি থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত আটদিন ধরে মহালক্ষীর ব্রত পালন করে সে শ্রীহরি ধাম বৈকুণ্ঠে যায়।

যে নারী ধন ও সন্তান কামনা করে মঙ্গলবার দেবী মঙ্গলচন্ডীকে প্রতি মাসের শুক্লা ষষ্টীতে, মঙ্গলদায়ক ষষ্টীকে আষাঢ়, সংক্রান্তিতে সর্বসিদ্ধি দাতা মনসাদেবীকে, কার্তিক মাসের রাস পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের প্রাণের থেকেই প্রিয় শ্রীরাধাকে ও প্রতিমাসে শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে উপোস করে বরদাতা দুর্গতিনাশিনী জগতের জননী প্রকৃতি বিষ্ণুজায়া ভগবতী দূর্গাদেবীকে পতিপুত্র আছে। এমন নারীর উপরে কিংবা পতিব্রতা শুদ্ধ সাধারণ নারী বা মন্ত্রে বা প্রতিমাতে ভক্তির সঙ্গে পূজা করে, সেই নারী ইহলোকে সুখভোগ করে শেষে শ্রীহরিধাম বৈকুণ্ঠে গিয়ে থাকে। এরপর যম সাবিত্রীকে একথা বলে নিজের মন্দিরে চলে গেলেন। আর সাবিত্রিও নিজের স্বামীকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলেন।

.

পঁয়ত্রিশতম অধ্যায়

নারায়ণ নারদকে বললেন–পুরাকালে সৃষ্টির প্রথমে রাসমন্ডলে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের বাঁদিক থেকে এই দেবীর আবির্ভাব ঘটেছে। তিনি তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, তার স্তন ছিল কঠিন ও নিতম্ব বিশাল, সাদা চাপা ফুলের মত গায়ের রঙ। রাধা প্রথমে দুহাত বিশিষ্ট শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে বরণ করলেন। মহালক্ষীও তাঁকে কামনা করলে শ্রীকৃষ্ণ দুই রূপ ধরলেন। দ্বিভূজ শ্রীকৃষ্ণ হলেন রাধাকান্ত আর চুতভূর্জ নারায়ণ হলেন লক্ষীকান্ত। নারায়ণ লক্ষীর সঙ্গে বৈকুণ্ঠে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ ও নারায়ণ দুজনে সর্বদিক দিয়েই সমান, পরমাত্মা, পরম পুরুষ। মহালক্ষী সকল রমণীদের মধ্যে প্রধান হলেন, তিনি চাঁদ ও সূর্য রূপা, ক্ষীরোদসাগর কন্যা ও শ্রীরূপে পদ্মিনীতে আছেন, তিনি ঘরে, শস্যে, কাপড়ে, দেব প্রতিমায়, মানিক, মালায় আছেন। মহালক্ষীর পূজা ব্রহ্মা নিজে করেছিলেন। ভাদ্রমাসের শুক্লাষ্টমী থেকে শুরু করে পূর্ণিমা পর্যন্ত আটদিন। বর্ষার শেষে মনু, পৌষ সংক্রান্তির দিন ও চৈত্রমাসের সংক্রান্তির দিন ঘরের ভেতরে শ্রীমহালক্ষ্মীকে আবাহন করে তার পূজা করেছিলেন।

.

ছত্রিশতম অধ্যায়

নারায়ণ প্রিয়া রূপে বৈকুণ্ঠে বাস করেন মহালক্ষ্মী। পূর্বে দুর্বাসার শাপে ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা ও সকল মর্তবাসী শ্রীভ্রষ্ট হলে দেবী রেগে দুঃখ পেয়ে স্বর্গ ছেড়ে বৈকুণ্ঠ ধামে গিয়ে মহালক্ষীতে লীন হলেন। দৈন্য দশায় তখন দেবতাদের গলা ঠোঁট ও তালু শুকিয়ে গিয়েছিল। তাঁরা তখন নারায়ণের স্মরণ নেন। দেবী তখন নারায়ণাদেশে নিজ অংশ দ্বারা সিন্ধুর মেয়ে রূপে উৎপন্ন হলেন ও ইন্দ্রের সম্পৎস্বরূপ হন। দেবতারা দৈত্যদের সাথে মিলিত হয়ে ক্ষীর সাগরে মন্থন করে লক্ষ্মীদেবীর দেখা পান ও তার কাছে বর লাভ করেন।

নারদ জানতে চাইলেন লক্ষ্মীদেবী কী করে সিন্ধুর কন্যা হলেন। মহর্ষি দুর্বাসার শাপে ইন্দ্র ও অন্য দেবতারা ও মর্তবাসী শ্ৰীভষ্ট হলে লক্ষীদেবী রেগে দুঃখিত হয়ে স্বর্গ ছেড়ে বৈকুণ্ঠে গিয়ে মহালক্ষ্মীতে লীন হয়ে যান। দেবতারা তখন ব্রহ্মসভায় উপস্থিত হন। তখন দেবী নারায়ণের আদেশে সিন্ধু কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করেন দেবতারা ক্ষীরোদসাগর মন্থন করে দেবীর কাছে বর চাইলে দেবী সন্তুষ্ট হয়ে বর দিলেন ও বিষ্ণুকে বরমাল্য দিলেন। নারদ এরপর নারায়ণকে নানা প্রশ্ন করলে তার উত্তরে নারায়ণ বলতে লাগলেন। একদিন ইন্দ্র মধু খেয়ে কামার্ত হয়ে নির্জন জায়গায় রম্ভার সাথে ক্রীড়া করছিলেন।

পরে কামুকী রম্ভাকে কামোন্নত্ত অবস্থায় গভীর বনের মধ্যে অবস্থান করতে লাগলেন, দুর্বাসা বৈকুণ্ঠ থেকে কৈলাস পর্বতের দিকে যাচ্ছিলেন,তার গলায় ছিল সাদা যজ্ঞের পৈতা, পরনে কৌপীন, ইন্দ্র তাকে দেখামাত্র প্রণাম করলেন। তাকে দেখে ঋষি ও তার শিষ্যরা আর্শীবাদ করলেন। দুর্বাসা ইন্দ্রকে পারিজাত ফুল দান করলেন। ইন্দ্র সেই ফুল ভুলকরে নিজ হাতির মাথায় রাখলে, হাতি বিষ্ণুর সমতুল্য হয়ে উঠল। তখন মুনি এই কান্ড দেখে ইন্দ্রকে ব্রহ্মহত্যার শাপ দিলেন। তার দেওয়া ফুল হাতিরমাথায় রাখার জন্য লক্ষ্মী ইন্দ্রকে ছেড়ে বৈকুণ্ঠে চলে যাবেন। শ্রীহরির কৃপায় দুর্বাসা ভয়শূন্য হয়ে গেছেন। সুতরাং তার পিতা কশ্যপ তার কিছু করতে পারবে না। পুত্র তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন–তাকে কিছু জ্ঞান দান করতে। ইন্দ্রের কথা শুনে, জ্ঞানশ্রেষ্ট সনাতন মহর্ষি দুর্বাসা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে হেসে তত্ত্বকথা বলতে লাগলেন এবং ইন্দ্রকে বললেন–যে সে বিপদের সময়েও মঙ্গলময় ইষ্টমার্গ সম্বন্ধে জানতে চেয়েছে। সকল মার্গের শ্রেষ্ট জ্ঞানমার্গ থেকে সন্তোষ সন্তুতি লাভ করা যায়।

মানুষের স্বর্গলাভ হয় তপস্যা বা উপোস করলে, জ্ঞানীরা যে সাত্ত্বিক কাজ করেন তা শ্রীকৃষ্ণের পায়ে সমর্পন করে পরব্রহ্ম কৃষ্ণে লীন হন। এটাই নির্বাণ মোক্ষের কারণ বলে নির্দিষ্ট আছে সংসারীদের কাছে।

বৈষ্ণবরা জীবন্মুক্ত ও নিজের কুলকে উদ্ধার করে। ব্রহ্মা থেকে শুরু করে পৃথিবীর রাস পর্যন্ত সকল পদার্থই স্বপ্নের মত মিথ্যা, একমাত্র পরব্রহ্ম রাধাকান্তই সত্য। তার ভজনা করা উচিত, যোগীকে কর্মফল ভোগ করতে হয় না, শ্রীকৃষ্ণের সেবকদের ছোঁয়া মাত্রই সব পাপ ধুয়ে যায়। সমস্ত তপস্যার সার ও নিশ্চিতরূপে যোগ, সিদ্ধি, বেদপাঠ ও সকল ব্রতের সারব্রত।

যে কোনা কৃষ্ণভক্তই কৃষ্ণমন্ত্র নেওয়া মাত্রই ঐ মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে পিতৃকূলের ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন লক্ষপুরুষ, মাতমহকুলের ঐরকম শত পুরুষ এবং বাবা, মা, গুরু, ভাই, স্ত্রী, বন্ধু, শিষ্য, চাকর, শ্বশুর, মেয়ে, জামাই, গুরুপুত্রও নিজেকে উদ্ধার করে থাকে। পবিত্রভাবে তিনজন্ম সূর্যের আরাধনা করে সবরকম বিঘ্নবিনাশকারী গণেশের উত্তম মন্ত্র লাভ করা যায়। গণেশের কৃপায় দিব্যজ্ঞন লাভ হয়, এরপর মহামায়ার আরাধনা আরম্ভ করা উচিত।

মানুষ একশো জন্ম পর্যন্ত মহামায়ার আরাধনা করে থাকে, যে দীর্ঘায়ু অমরত্ব, ইন্দ্ৰত্ব, মনুত্ব ও রাজেন্দ্ৰত্ব দান করতে পারেন–সেই জ্ঞান ও হরি ভক্তিদায়ক আশুতোষকে তিনজন্ম সাধনা করে তার কৃপায় ও বরে নির্মল জ্ঞান লাভ করে থাকে। তখন সেই তত্ত্বজ্ঞানী মানুষ, জ্বলন্ত, নির্মল জ্ঞান রূপ প্রদীপের আলোয় ব্রহ্ম থেকে শুরু করে ঘাস পর্যন্ত সবই যে মিথ্যা একথা জানতে পারে। যারা বিষ্ণুমন্ত্রের উপাসক, গঙ্গা প্রভৃতি তীর্থ সেবী, নিজ ধর্ম পালন করেন এবং ভিক্ষু তাদের জন্ম গ্রহণ করতে হয় না। সকল পাপ ত্যাগ করে হরিসেবা করাই তীর্থ সেবীদের স্বধর্ম বলে বিধাতা নির্দেশ করেছেন। সন্ন্যাসী থাকবে শুদ্ধ, তবেই সে সন্ন্যাসী হবে। যে আপনা থেকে পাওয়া সুস্বাদু বা বিস্বাদ খাবার খান, নিজের খাবার জন্য অন্যের কাছে কিন্তু চান না তিনি সন্ন্যাসী, যে কাঠের তৈরী নারীমূর্তিও ছোঁয় না সে ভিক্ষু। গর্ভে বাস করার দুঃখ সব জায়গায় সমান তা সে দেব বা শূকর যে যোনিতেই হোক না কেন।

যোনির মধ্যে পুরুষের বীর্য পড়লে সেই বীর্য স্ত্রীর রক্তের সঙ্গে তক্ষুনি মিশে যায়। তবে যদি রক্তের অধিক্য থাকে, তবে কন্যা আর শুক্রের আধিক্য থাকলে পুত্র হয়। জোড়দিন ও রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার যোগ হলে পুত্র আর বিজোড় বা অন্য দিনে হলে কন্যা হয়। অল্প আয়ু হয়, প্রথম প্রহরে জন্মালে। চিরজীবী হয় চতুর্থ প্রহরে জন্মালে। রক্ত ও বীর্য একরাতের মধ্যে মেশে ও বীজ সৃষ্টি হয়। এভাবে সাতদিনে কুলের মত হয় ও একমাসে বালিশের মতো হয়। তিন মাসে হাত পা শূন্য এক মাংসপিন্ড হয় ও পাঁচ মাসে আঁটযুক্ত হয়। ছয়মাসে প্রাণ সঞ্চারিত হয়। জীব মাতৃগর্ভে আবদ্ধ হয়ে দুঃখ পায়, সেখানে সে মায়ের খাবার ও জলের অংশ খায়, প্রসবের সময় বেরিয়ে আসে, শৈশবে সে পরাধীন থাকে ও খালি কাঁদে। শিশুর পাঁচ বছর অবধি কথার জড়তা থাকে।

যৌবন আসে পৌগন্ড পর্যন্ত যন্ত্রণা ভোগ করার পরে। এবং খাবার ও মৈথুনের জন্য নানা মোহে পরিবেষ্টিত হয়ে যত্নের সঙ্গে অনুগত ছেলে ও বউকে পালন করে। এবং বুড়ো হয়ে যাবার পর পরিবারের মানুষ তাকে বুনো ষাঁড়ের মত অবহেলা করবে। কানে কম শুনবে, শ্বাসকষ্টে পীড়িত হয়ে পরাধীন হবে। এবং আফশোষ করে বলবে সামনে জন্মে সে শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করবে। মৃত্যুকালে তাকে যমদূতেরা নিয়ে যায়। দূতের দেখামাত্রই ভয়ে মলমূত্র ত্যাগ করে ও পঞ্চ ভূতে তৈরি দেহ ত্যাগ করে। যমদূত তখন লিঙ্গদেহকে ধরে যমালয়ে নিয়ে যায়। যম আগুনের মত শুদ্ধ কাপড় পরেছেন ও নানা রত্ন অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে তিনকোটি দূতের মধ্যে শোভিত।

জ্যোতির্বিদ পন্ডিতরা সময় ঠিক করার জন্য বলেন– ষাট পলে এক দণ্ড, ও দুই দন্ডে এক মুহূর্ত হয়। একদিনরাত হয় তিরিশ মূহুর্তে। একপক্ষ হয় পনের দিনে। কৃষ্ণ ও শুক্ল পক্ষে হয় এক মাস। দুমাসে এক ঋতু, তিন ঋতুতে এক অয়ন ও দুই অয়নে হয় এক বছর। এক যুগ হয় তেতাল্লিশ লক্ষ কুড়ি হাজার বছরে। আয়ুষ্কাল হয় পঁচিশ হাজার পাঁচশো ষাট যুগে এক ইন্দ্রে। এক মনুর কাল হয় দশলক্ষ ইন্দ্রের আয়ুর সমান। এক ব্রহ্মার কাল হয় আট হাজার মন্বন্তরে। এক ব্রহ্মার বিনাশ হয় আট হাজার মন্বন্তরে, প্রাকৃতিক প্রলয় হয় ব্রহ্মার বিনাশে। মহাদেব নিজে বলেছেন যে, পৃথিবীর ধুলোবালি পৃথিবী থেকে যেমন মুক্ত হয় না সেরকম জীবরাও মোক্ষলাভ করতে পারে না।

.

সাঁইত্রিশতম অধ্যায়

নারদ জানতে চাইলেন হরির গুণকীর্তন শুনে জ্ঞান লাভ করে ঘরে ফিরে গিয়ে কি করেছিলেন তা দয়া করে বলুন। ইন্দ্রর দিনে দিনে বৈরাগ্য বাড়তে লাগল। ইন্দ্র স্বর্গরাজ্যকে শত্রুদের হাতে চলে যেতে দেখে গুরু বৃহস্পতির কাছে গেলেন এবং গঙ্গার তীরে বৃহস্পতিকে দেখতে পেলেন তিনি। গঙ্গার জলে দাঁড়িয়ে সূর্যমুখ করে পরমব্রহ্মকে ধ্যান করেছিলেন। তাকে এভাবে ধ্যানমগ্ন দেখে ইন্দ্র সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন! এক প্রহর কেটে যাওয়ার পর বৃহস্পতি উঠে আসলেন এবং ইন্দ্র তাঁকে দেখে কাঁদতে লাগলেন। ইন্দ্র তাকে দুর্বাসার শাপের কথা সব বললেন। শিষ্য ইন্দ্রর কথা শুনে বুদ্ধিমানদের শ্রেষ্ঠ ও সৎপুরুষ বৃহস্পতির চোখ রাগে লাল হয়ে উঠল। তখন তিনি বললেন–দুঃখের কারণ নেই, যে যার মতো কাজের ফল ভোগ করবে। শ্রীকৃষ্ণ নিজে পদ্মযোনি ব্রহ্মাকে সম্বোধন করে নিজের সুখে সামবেদের অন্তর্গত কৌমুথশয্যা এই তত্ত্ব উপদেশ করেছেন।

চাষী যেমন নিজ অভিজ্ঞতায় উর্বর জমিতে অধিক শস্য ফলায়, তেমন দানের পাত্রভেদেও ফলোভের পার্থক্য ঘটে। চন্দ্রগ্রহণে দান করলে, কোটিগুণ ফল হয়, সূর্য গ্রহণে করলে দশগুণ বেশী হয়, অসংখ্য অক্ষয় লাভ হয় অক্ষয় তৃতীয়ায় দান করলে, গঙ্গাতীরে দান করলে কোটিগুণ লাভ হয়। অব্যয় ফল লাভ হয়, নারায়ণ ক্ষেতে দান করলে। কোটিগুণ ফললাভ হয় কুরুক্ষেত্রে, বদরিকা ও কাশীতে দান করলে। লক্ষগুণ ফল লাভ হয় কেদার ও হরিদ্বারে দান করলে। দশলক্ষ গুণ বেশী ফল লাভ হয় পুষ্কর ও ভাস্কর তীর্থে দান করলে। দেবাদিদেব শিব নিজে একথা বলেন যে, যে লোক বিপদে পড়ে মধূসূদনকে স্মরণ করে, তার বিপদে সম্পদের আবির্ভাব হয়। এই বলে বৃহস্পতি ইন্দ্রকে শুভ আশীর্বাদ দান করে, মঙ্গলজনক উপদেশ দেন।

.

আটত্রিশতম অধ্যায়

ইন্দ্র শ্রীকৃষ্ণকে চিন্তা করে বৃহস্পতিকে সামনে রেখে ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মার সভায় গেলেন। ব্রহ্মা দেবগুরুর কাছে সব শুনে ইন্দ্রকে বললেন– তুমি আমার প্রপৌত্র, বৃহস্পতির শিষ্য ও দেবরাজ। তোমার মাতামহ দক্ষ হলেন বিষ্ণুর ভক্ত। সুতরাং শুদ্ধ কুলের সন্তান অহঙ্কারী হতে পারে না। তিনি বললেন, শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপায়ের নির্মাল্য ফুল যাঁর মাথায় থাকে, সকল দেবতার মধ্যে তারই আগে পূজা হয়। তুমি দুর্ভাগ্যবশতঃ তা থেকে বঞ্চিত হয়েছ। এখন তুমি বৃহস্পতি ও আমার সাথে বৈকুণ্ঠে চল। সেখানে নারায়ণের স্তুতি করে তার বরে লক্ষ্মীকে লাভ করতে পারবে।

যেখানে নারায়ণের নিন্দা হয় লক্ষ্মী সেখানে নিজের অপমান মনে করে চলে যায়। যেখানে শালগ্রাম শিলা পুজো হয় না ও ব্রাহ্মণদের খাওয়ান হয় না, লক্ষ্মী সেখানে থাকে না। লক্ষী নিজের পরাজয় মনে করে সেখানে থেকে চলে যায়। যে হরিনাম বিক্রি করে টাকা নেয়, যে নিজ কন্যা বিক্রয় করে, যে বাড়ীতে অতিথি খাওয়ান হয় না সে বাড়ী থেকেও লক্ষ্মী দেবী চলে যান। শুদ্রের রান্না করে যে ব্রাহ্মণ, এবং লাঙ্গল চষে জলপান ভয়েই লক্ষ্মী তাকে ছেড়ে চলে যান। যে ব্রাহ্মণ বিশ্বাসঘাতক, বন্ধু হত্যা করে, মানুষ হত্যা করে, লক্ষ্মী তাকে ছেড়ে চলে যান। মহাপাতকীর ঔরসে বেশ্যার গর্ভে যার জন্ম, পতিপুত্র হীন নারীর প্রতারণা করে খায়, লক্ষ্মী তার ঘর ছেড়ে চলে যান। যে ব্রাহ্মণ এক সূর্যে দুবার খায়, দিনের বেলা শুয়ে ঘুমায় ও দিনের বেলা শ্রীসংসর্গ করে হরিপ্রিয়া লক্ষ্মী তার ঘর ছাড়েন। যে লোক ভেজা পায়ে বা উলঙ্গ হয়ে শোয় এবং অল্প বিদ্যাসম্পন্ন ও অত্যন্ত বাঁচাল হয় তাকে ছেড়ে লক্ষ্মী দেবী চলে যান।

যেখানে শাঁখবাজে ও শাঁখ, শালগ্রামশিলা ও তুলসী এবং শ্রীহরির সেবা, বন্দনা ও ধ্যান করা হয়– লক্ষ্মী সেখানে থাকেন। নারায়ণ দেবতাদের একথা বলে লক্ষ্মীকে বললেন–দেবী, তুমি নিজ কলার দ্বারা ক্ষীরোদ সাগরে জন্মগ্রহণ কর। লক্ষ্মী ক্ষীরোদশায়ী সর্বেশ্বর বিষ্ণকে বনমালা দান করলেন।

লক্ষ্মীদেবী ব্রহ্মশাপ দূর করার জন্য দেবতাদের ঘরের দিকে তাকালেন ও দয়া করে বর দিলেন। দেবতারা নিজেদের রাজ্য ফিরে পেলেন। ভগবান নারদকে বললেন– যে মহালক্ষ্মীর উত্তম কথা বললেন–আর কি জানতে চায় সে।

.

উনচল্লিশতম অধ্যায়

নারদ লক্ষ্মীদেবীর স্তব ও ধ্যান শুনতে চাইলেন। নারায়ণ বলেন– তীর্থে স্নান করে ইন্দ্ৰ ধোওয়া বস্ত্রে ক্ষীরসাগর তীরে ঘট পেতে গণেশ, সূর্য, বহ্নি, বিষ্ণু, শিব ও শিবার পুজো করে ব্রহ্মাকে পুরোহিত করে সেখানে পরম ঐশ্বর্যরূপিনী লক্ষ্মীকে আবাহন করে তার পূজো করেন। লক্ষ্মীকে বিশ্বকর্মা নির্মিত আসনে বসতে বলেন, তাকে মহামূল্য রত্নে তৈরী ফুল চন্দনযুক্ত রত্ন অলঙ্কারে সজ্জিত সুন্দর বিছানা গ্রহণ করতে বললেন।

ইন্দ্র এরপর তার স্তব করে বললেন, মহালক্ষ্মীকে আমার প্রণাম। পদ্মপাতার তুল্য চোখ যার, যে সিদ্ধি দান করেন তাকে আমার প্রণাম। রত্নপদ্মে সুশোভিত ও সকল সৌন্দর্য যুক্ত কৃষ্ণ শোভাবরণ সকল সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী নিজ শস্যস্বরূপাকে প্রণাম।

নারদ বললেন–প্রভু! আপনি বলছেন দুর্বাসার দেওয়া শ্রীহরির পায়ের ফুল যার মাথায় থাকে তার পুজো হয় সকল দেবতার আগে ঐ ফুল ঐরাবতের মাথায় রাখেন ইন্দ্র। নারায়ণ বলেন– দুর্বাসা ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন। তখন গণেশ জন্মায়নি, গণেশের জন্ম হয়েছিল ইন্দ্র যখন লক্ষ্মীর পূজো করেন তখন। দুর্বত্সর শাপে দেবতারা বহুকাল দুঃখভোগ করে চারিদিকে ঘুরে বেড়িয়ে শ্রীহরির বরে আবার লক্ষ্মীদেবীকে ফিরে পান।

.

চল্লিশতম অধ্যায়

নারদ তাঁকে বললেন–যে তার অর্থাৎ ভগবানের উপাখ্যান শুনতে পেলেন। এরপর অন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাখ্যান শুনতে চাইলে তিনি বলেন– পূর্বে দেবতারা সৃষ্টির প্রথমে খাবার জন্য ব্রহ্মালোকে অগম্য মনোহর ব্রহ্মসভায় গেলেন। ব্রহ্মার কাছে খাবার চাইলে তিনি তা দিতে সম্মত হলেন ও হরির ধ্যান করতে লাগলেন। ব্রহ্মা ঘি কে দেবতাদের খাবার হিসাবে ঠিক করলেন। কিন্তু দেবতারা তা না পেয়ে পুনরায় তার কাছে গেলেন, তখন তিনি হরির আদেশে প্রকৃতি দেবীর পূজা করলেন। প্রকৃতিদেবী দাহিকাশক্তি রূপে অগ্নির স্ত্রী স্বাহা নামে বিখ্যাত হলেন। এবং ব্রহ্মাকে বললেন–মনের মত বর চাইতে। ব্রহ্মা বললেন, অগ্নির দাহিকা শক্তি হয়ে তার পত্নী হতে, অগ্নি যেন তার সাহায্য ছাড়া কিছু পোড়াতে না পারে।

এরপর দেবী কামমোহন কৃষ্ণকে দেখে কামার্ত হলেন ও মূছ গেলেন। তার মনের কথা বুঝে হরি তাকে কোলে তুলে নিলেন। এরপর অগ্নি দেবের ঔরসে স্বাহার দক্ষিন, গার্হপত্য ও আহুনীয় নামে সুন্দর তিন পুত্র জন্মায়, ব্রাহ্মণ ও ঋষিরা বৈদিক মন্ত্রের শেষে স্বাহা উচ্চারণ করে এবং তা উচ্চারন করার সাথে সাথে সকল ইচ্ছা পূর্ণ হয়। যে ‘ওঁং’ হীং শ্রীং বহ্নিজায়ায়ে স্বাহা মন্ত্রে তার পূজা করে তার সকল কামনা বাসনা পূর্ণ হয়। যে ভক্তিভরে স্বাহার নাম কররে তার ইহ ও পরলোক সিদ্ধি লাভ করবে।

.

একচল্লিশতম অধ্যায়

নারায়ণ বললেন, এই স্বধা উপাখ্যান পিতৃগণের কাছে তৃপ্তির কার, যা সকল শ্রাদ্ধের ফল বাড়ায়, যে লোক জন্মে হরির সেবা করে না, হরির নৈবেদ্য বিহীন অন্ন খায় তার আমৃত্যু জন্ম অশৌচ থাকে। তার অধিকার নষ্ট হয় দৈব কোন কাজে। যে ঘটে বা শালগ্রামশিলায় স্বধা দেবীর পূজা করবে, যে শ্রাদ্ধের সময় সমাহিত মনে স্বধাস্তোত্র শোনে, সে শত শ্রাদ্ধের পুণ্য ফল লাভ করে- পূর্বে স্বাহা গোলোকে রাধার সখী ছিলেন।

এবং কৃষ্ণকে রমণের কথা বলেছিলেন। বসন্তকালে তাকে কৃষ্ণের সাথে প্রমত্ত অবস্থায় দেখে রাধা। তাকে অভিশাপ দিলে সে মর্ত্যলোকে এসে অগ্নির স্ত্রী হয়েছেন। যে লোক শুদ্ধ হয়ে একমনে স্ববীর স্তব শোনে তার সব তীর্থে স্নান ও সব বেদ পাঠের ফল লাভ হয়।

.

বিয়াল্লিশতম অধ্যায়

এরপর নারায়ণ দক্ষিণা দেবীর উপাখ্যান বলবেন বললেন, পৌরাণিক কালে শ্রীকৃষ্ণের সুশীলা নামে এক প্রেয়সী ছিলেন পুরাণে। তিনি ছিলেন বিদ্যাবতী-গুণবতী-রূপবতী; সুশীলা রাধার সামনে কৃষ্ণের ডান কোলে বসেন। রাধা অভিমান করে, আসেন ঠোঁট ফুলিয়ে তা দেখে শ্রীকৃষ্ণ পালিয়ে যান! রাধা গোপীদের শ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণকে পালাতে দেখে সুশীলাও ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পালান।

এদিকে গোপীরা বিপদের আশঙ্কা করে ‘দেবী রক্ষা কর’ বলতে বলতে তার পায়ে আশ্রয় নিল। দক্ষিণা দেবী গোলোক থেকে ভ্রষ্ট হয়ে দীর্ঘকাল তপস্যা করে দেহে ঢোকেন এবং ব্রহ্মা শ্রীহরির ধ্যান করলেন। তিনি তখন মহালক্ষ্মীর দেহ থেকে মর্তের লক্ষী স্বরূপ দক্ষিণাকে বের করে এনে ব্রহ্মাকে দান করলেন। সৎলোকদের কাজের পূর্ণতার, সিদ্ধির জন্য ব্রহ্মা সেই দক্ষিণাকে যজ্ঞের হাতে দিলেন। যজ্ঞ নির্জন বনে দক্ষিণার সঙ্গে দৈব পরিমাণ একশো বছর পরমানন্দে বাস করলেন এবং যজ্ঞের বীর্যে বার বছর ধরে গর্ভধারণ করলেন। ব্রহ্মধন যে চুরি করে আর দক্ষিণা দেয়না তারা দুজনেই দড়িকাটা ঘটের মত নীচের দিকে যায়, যজমান দক্ষিণাপ্রার্থী ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা না দেয় সে ব্রহ্মধন চুরি করে ও কুম্ভিপাক নরকে যায় সেখানে লক্ষ বছর ধরে কষ্ট পায় যমদূতের তাড়নায়। নারদ বললেন– যে সব কাজের দক্ষিণা দিতে হয়। না যেসব কাজের ফল কে ভোগ করে, পুরাকালে যজ্ঞ কোন নিয়ম অনুযায়ী দক্ষিণার পূজো করেছিলেন? তা আমায় বলুন দক্ষিণাহীন ফল কি করে হবে। শ্রীকৃষ্ণের ডান কোলে বসার জন্য শ্রীরাধার অভিশাপে এখন নাম হয়েছে দক্ষিণা। যে মন দিয়ে দক্ষিণার ধ্যান শোনে সে লোকের কোনো কাজের অঙ্গহানি ঘটে না। বিপদে, বন্ধু বিচ্ছেদের সময়, সঙ্কটে ও বাঁধা থাকা অবস্থায় এই স্তোত্রপাঠ একমাস শুনলে তার সব বিপদ কেটে যাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।

.

তেতাল্লিশতম অধ্যায়

নারদ এবার ষষ্ঠী মঙ্গলচণ্ডী ও মনসা প্রকৃতির কলা এই দেবীদের নামের অর্থ ও চরিত্র বিশেষভাবে শুনতে চাইলেন। নারায়ণ তাকে বললেন– ষষ্টী হলেন প্রকৃতি দেবীর ষষ্ট অংশস্বরূপ ইনি মাতৃকাদের মধ্যে দেবসেনা নামে বিখ্যাত। ষষ্টীদেবী সবসময় মায়ের মত বালকদের পরমায়ু বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেন। রাজা প্রিয়ব্রত হলেন স্বায়ম্ভর মনুর ছেলে। তিনি সবসময় তপস্যা করতেন তাই অবিবাহিত থেকে যান। ব্রহ্মার আদেশে বিয়ে করলেও বহুদিন তাঁর পুত্র হয়নি। তাঁর স্ত্রী মালিনী কশ্যপের যজ্ঞের চরু খেলে তার গর্ভ সঞ্চার হয় এবং তা তিনি বার বছর ধরে তা ধারণ করেন। তারপর তাঁর এক পুত্র হলেও তার চোখের মণি বেরিয়ে এসেছিল।

রাজা তাকে বুকে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। রাজা বনে এক দেবীকে দেখলেন যে ভক্তদের জন্য দয়ালু ও তৎপর। রাজা দেবীর পরিচয় চাইলে তিনি বললেন–তিনি দেবসেনা। দেবী মরা ছেলেকে নিয়ে মহাজ্ঞান বলে অবলীলাক্রমে শিগগিরই তাকে বাঁচিয়ে তুললেন। দেবী তাকে নিয়ে আকাশ পথে চলে যেতে উদ্যত হলেন। রাজা ভয় পেলেন। তিনি দেবীর স্তব করতে লাগলেন। দেবী তখন তাঁকে তাঁর পুজো প্রচার করতে বললেন। তাতেই তিনি এই পুত্র ফেরত দেবেন বললেন।

রাজা পুত্রকে পেয়ে খুশি মনে রাজ্যে ফিরে প্রতিমাসের শুক্লপক্ষের ষষ্টী তিথিতে ষষ্ঠীদেবীর পূজা শুরু করলেন, এতে সদ্যোজাতদের মঙ্গলকামনা হয়। রাজা একুশ দিনের দিন যত্নসহ ষষ্ঠীপুজোর আদেশ দিলেন। রাজা প্রিয়ব্রত ষষ্টীদেবীর স্তবকরে তার কৃপায় যশস্বী হলেন ও রাজেন্দ্র সন্তান লাভ করলেন। যে লোক ষষ্টীস্তোত্র এক বছর শোনে তার সন্তান হয় ও সেই সন্তান দীর্ঘজীবী হয়। মহাবন্ধ্যা নারীও সন্তান লাভ করে। কাকাবন্ধ্যা নারী এ স্তব শুনলে দেবীর কৃপায় তার যশস্বী সন্তান লাভ হয়। রোগগ্রস্ত সন্তানের বাবা মা এই স্তব শুনলে ষষ্টীদেবীর দয়ায় সন্তান রোগমুক্ত হয়।

.

চুয়াল্লিশতম অধ্যায়

এরপর নারায়ণ নারদকে মঙ্গল চন্ডীর পূজোর কথা বললেন। পুরাকালে পরমেশ্বর বিষ্ণু মহাদেবকে ত্রিপুরাসুর বধের জন্য পাঠিয়ে ছিলেন, তখন শিব এই পরমেশ্বরীকে সবার প্রথমে পূজো করেন। শিব তখন সঙ্কটাপন্ন হলে ত্রিপুরাসুর রাগে আকাশ থেকে মহাদেবের রথ নীচে ফেলে দেয়, মহাদেব তখন দূর্গার স্তব করলে, দেবী মঙ্গলচন্ডী রূপে আবিভূর্ত হন ও মহাদেবকে বলেন আপনার কোন ভয় নেই, শিবের বাহন হলেন বিষ্ণু। তিনি ষাঁড়ের রূপ ধরেন। শিব বিষ্ণুর দেওয়া অস্ত্রের সাহায্যে ত্রিপুরাসুরকে হত্যা করলেন। ত্রিপুর দৈত্য মারা গেলে সকল দেবতা ও মহর্ষিরা মাথা নিচু করে শিবকে প্রণাম করে তার স্তব করলেন।

শ্রী শ্রী মঙ্গলচন্ডী দেবীর পূজা করলেন। আর মাধ্যন্দিন শাখায় ধ্যান এর কথা বলা হয়েছে, ভক্তি করে দেবীর ধ্যান করে মূলমন্ত্র বলে ঐ সকল উপাচার করলেন, শ্রী শ্রী মঙ্গলচন্ডীর দেবীর, ‘ও হ্রীং শ্রীং ক্লীং সবপূজ্যায়ে দেবী মঙ্গলচন্ডিকায়ে ফট স্বাহা’ এই একুশ অক্ষরের মূলমন্ত্র। মঙ্গলচন্ডীকে মুনি দেবতা মনু ও মানুষরা পূজো করতে লাগল। যে দেবী মঙ্গল চন্ডীর মঙ্গল স্ত্রোত্র শোনেন তার সব সময় মঙ্গল হয়। তার পুত্র পৌত্রের ও মঙ্গল বাড়তে থাকে।

.

পঁয়তাল্লিশতম অধ্যায়

এরপর নারায়ণ মনসা দেবী উৎপন্ন হয়েছেন তার গল্প কথা বললেন। মনসা উৎপন্ন হয়েছিলেন কশ্যপ ঋষির মন থেকে। ইনি মনে পরমেশ্বরের ধ্যান করেন বলে তাঁর নাম মনসা, আত্মারাম বৈষ্ণবী মনসা দেবী তিন যুগ ধরে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করে সিদ্ধযযাগিনী হয়েছিলেন। দেবী সর্বদা বিষ্ণু ভক্ত ছিলেন বলে তাঁর নাম বৈষ্ণবী। সাপের ভয় আছে এমন বিছানায়, সাপ থাকে এমন মন্দিরে, সাপ কামড়ালে পর সেই দুর্দান্ত মহাবিপদের সময় এবং সারা দেহে সাপ জড়িয়ে গেলে পর যে লোক বারোটি নামযুক্ত মন্ত্র পাঠ করে, সাপের ভয় থেকে সে মুক্ত হয়ে যায়।

.

ছেচল্লিশতম অধ্যায়

মনসাদেবীর স্তোত্র–যাঁর গায়ের রঙ সাদা চাপা ফুলের মত, যিনি রত্নালংকারে সজ্জিতা, যার পরণে অগ্নিশুদ্ধ কাপড়, যাঁর গলায় সাপের মত পৈতা, যিনি মহাজ্ঞান যুক্ত, সেই মনসা দেবীর ভজনা কর। মহর্ষি কশ্যপ তপস্যায় মন থেকে সাপের মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসাকে সৃষ্টি করলেন। শিব সকলের পূজ্য যে স্তব, ভুবন ধ্যান, বেদোক্ত সর্বসম্মত পুরশ্চৰ্য্যাক্রমও মনসাদেবীকে দান করলেন। দেবী তখন শিবের কাছ থেকে মৃত্যুঞ্জয় নামক শ্রেষ্ঠজ্ঞান পেলেন। পুরাকালে কশ্যপমুনি শ্রেষ্ঠ জরকারুকে সেই কন্যা দান করেন ও ব্রহ্মার আদেশে জরষ্কারু মুনি অযাচিত ভাবে সেই মনসা দেবীকে গ্রহণ করেন।

যে লোক শৃঙ্গার মুহূর্তে ও ঘুমের সময় ব্যাঘাত ঘটায়, তাকে অনন্তকাল কালসূত্র নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। বিশেষভাবে পতিব্রতা নারীর পক্ষে বিশেষভাবে নিষিদ্ধ এই কথা বলে মনসাদেবী ভয়ে পেয়ে ভক্তি ভরে স্বামীর পায়ে পড়লেন ও কাঁদতে থাকলেন। মুনি তখন সূর্যকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে, সূর্যদেব ভয় পেয়ে সন্ধ্যাদেবীর সঙ্গে সেখানে এলেন।

সকল তত্ত্বের মূল কথা হল শ্রীহরি। তিনি ছাড়া সবকিছুই বিড়ম্বনা মাত্র। সে গুরু, পিতা বা বন্ধু। হবে না যে লোক গর্ভযন্ত্রণা ও যম যাতনা থেকে মানুষকে মুক্ত না করে।

ইন্দ্র মনসা দেবীর স্তব করে নানা অলংকারে সাজিয়ে তাঁর সঙ্গে নিজের পুরীতে গেলেন। পুত্র আস্তিকের সাথে মনসা দেবী চিরকালই বাবার বাড়িতেই থাকতে লাগলেন। গোমাতা সুরভী মনসা দেবীকে চিরকালই অত্যন্ত দুর্লভ জ্ঞান দিলেন।

.

সাতচল্লিশতম অধ্যায়

নারদ সুরভীদেবীর জন্ম ও চরিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলেন। নারায়ণ বলতে লাগলেন– গোরুদের অধিষ্টাত্রী দেবী হলেন সুরভীদেবী। তিনি গোলোকে উৎপন্ন হয়েছেন। সুরভীর জন্ম হয়েছিল বৃন্দাবনের সুন্দর বনে। একদিন শ্রীকৃষ্ণ রাধার সঙ্গে গোপী দ্বারা পরিবৃত হয়ে বৃন্দাবনে গেলেন। সেখানে তাঁর দুধ খাওয়ার ইচ্ছা হল। তিনি তখন তার বাঁদিক থেকে সুন্দর বাছুরযুক্ত দুধেল গরু দেখে দুধ দোয়ালেন। শ্রীকৃষ্ণ দুধ খাওয়ার পর পাত্রের দুধ দিয়ে এক সরোবর সৃষ্টি হল। যার বিস্তার একশো যোজন। তা ক্ষীর সরোবর নাম পেল। রাধা ও তার সহচরীদের জল কেলির জায়গা হল এটি। এর চারধার রত্ন দিয়ে বাঁধানো। সুরভী দেবীকে ‘ওঁ সুরভৈ নমঃ এই ছয়অক্ষরের মূলমন্ত্র লক্ষবার জপ করে সিদ্ধ হলে তা কল্পতরু মত হয়। ঘটে, গরুর মাথায়, গরু বাঁধার খুঁটিতে, শালগ্রাম শিলায়, আগুনে কিংবা জলে ব্রাহ্মণ এই সুরভি দেবীর পূজা করবে। জগতে সবাই তাঁর পূজা করবে। ইন্দ্র তাঁকে প্রণাম করে বললেন, আপনি সকল গরুর বীজস্বরূপ, আপনি সবার প্রিয় আপনি লক্ষ্মীর অংশস্বরূপ। আপনি কৃষ্ণপ্রিয় ও গরুদের মা, আপনি শ্রেষ্ঠ কল্পতরুর মতো। আপনি তুষ্ট হয়ে সকলকে মঙ্গল ও গোধন দান করেন। আপনি যশ-ধর্ম ও কীর্তি দান করেন। আপনাকে সহস্র প্রণাম।

.

আটচল্লিশতম অধ্যায়

নারদ এরপর উত্তম রাধার উপাখ্যান, তার জন্মবৃত্তান্ত ধ্যান ও কবচ মন্ত্র শুনতে চান। নারায়ণ বললেন– পুরাকালে কৈলাস পর্বতে ভগবান সনাতন, সিদ্ধেশ্বর, সিদ্ধিপ্রদ, সর্বস্বরূপা, মহাদেব কার্তিকের কাছে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের রাসমন্ডলে রাধার সঙ্গে রাসলীলা বর্ণনা করে ছিলেন। মহাদেব দৃর্গাকে অপূর্ব রাধার উপাখ্যান বললেন। দূর্গা পুনরায় তা শুনতে চাইলেন। মহাদেব শ্রীকৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে অপূর্ব রাধার উপাখ্যান বলতে শুরু করলেন। পরম রমণীয় রমণী রাসেশ্বরী রাধা রমণ করতে উৎসুক হলেন। নানা বহুমূল্য রত্ন অলংকারে সজ্জিত রাধা রত্ন সিংহাসনে বসলেন। গ্রীষ্মকালের সূর্যের মত সৌন্দর্যযুক্ত রত্ন মালা ধারণ করেছিলেন। সেই মুক্ত মালা গঙ্গা স্রোতের মত সাদা ও পবিত্র ছিল। কৃষ্ণভক্তরা শ্রীরাধার রাস মন্ডলে উদ্ভব এবং শ্রীকৃষ্ণের আলিঙ্গনের জন্য দৌড়চ্ছেন। শ্রীকৃষ্ণের সন্দতে রাধা অভিসার করছেন। শ্রীরাধার লোমকুপ থেকে সকলগোপীরা আর শ্রীকৃষ্ণের লোমকূপ থেকে সকল গোপদের উৎপত্তি হয়েছে। শ্রীরাধার পাদপদ্ম ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবতাদের পক্ষে পাওয়া কঠিন হলেও, তার ভক্তদের পক্ষে পাওয়া কঠিন না।

.

উনপঞ্চাশতম অধ্যায়

পার্বতী জানতে চাইলেন শ্রীরাধাকে সুদামা কেন অভিশাপ দিলেন? ভৃত্য হয়ে সুদামা কেন নিজের ইষ্টদেবের পত্নী রাধাকে অভিশাপ দেন? শিব বললেন– রাধানাথ একদিন গোলোকে বৃন্দাবনে শতশৃঙ্গ পাহাড়ের এক পাশে বিরজা নামে এক গোপিনী যে কিনা সৌভাগ্যে রাধার সমান, তার সঙ্গে নানা অলংকারে সজ্জিত হয়ে খেলা করছিলেন। রত্ন দিয়ে তৈরী সেই রাসমন্ডলের চারদিকে রত্ন প্রদীপ জুলছিল। সখী পরিবৃতা হয়ে শ্রীরাধা প্রস্থে দশ যোজন ও দৈর্ঘ্যে শত যোজন পরিমিত ও অমূল্য রত্ন দিয়ে তৈরী দিব্য রথে চড়লেন। এটি অমূল্যরত্ন দিয়ে তৈরী। নানা আয়না, বহু মূল্য মণি ও ফুলের মালা সেখানে শোভা পাচ্ছিল। রাধার সঙ্গে নিজের প্রেম ভঙ্গের ভয়ে শ্রীকৃষ্ণ বিরজাকে পরিত্যাগ করে পালিয়ে গেলেন। বিরজা প্রাণত্যাগ করলেন। বিরজার সখীরা ভয়ে আকুল হয়ে বিরজার শরণাপন্ন হল। বিরজা তখন রাধার ভয়ে গোলোকে নদীরূপ ধরলেন। এ নদী দৈর্ঘ্যে শতকোটি যোজন আর প্রস্থে কোটি যোজন। যা গোলককে ঘিরে রাখল পরিখার মতো। শ্রীরাধা বৃষভানু মেয়ের দেহে নিজের ছায়া রেখে নিজেই অহিত হলেন। রাধার বিয়ে হয় রায়ানের সাথে। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে কুঞ্জবনে কিছু কাল রাধার সঙ্গে বিহার করেছিলেন। পরমেশ্বরী শ্রীকৃষ্ণ নিজে গোলোকে কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে রাসমন্ডলে শ্রীরাধার পূজা করেছিলেন।

.

পঞ্চাশতম অধ্যায়

পার্বতী এরপর সূযজ্ঞ রাজার কথা জানতে চাইল। কেন সে ব্রহ্মশাপ পেয়েছিল। রাধা শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়তমা ও তাঁর পূজনীয়। সুতরাং মলমূত্রের আধার যুক্ত সাধারণ একজন মানুষ। তার আরাধনা করেছিলেন। যজ্ঞশেষে রাজা মহানন্দে মহাদেব বললেন–শতরূপার স্বামী হলেন তপস্বী স্বায়ম্ভর মনু। ইনি ব্রহ্মার পুত্র ছিলেন। স্বায়ম্ভবের পুত্র উত্তানপাদ এবং উত্তানপাদের পুত্র ধ্রুব। ধ্রুবের পুত্র নারায়ণ ভক্ত উৎকল। ইনি পুষ্করে হাজার রাজসূয় যজ্ঞ করেছিলেন। রত্ন ও সকল সম্বৎ দান করেছিলেন। রত্ন দিয়ে শিং বাঁধিয়ে দশ লক্ষ গরু দক্ষিণার সঙ্গে সানন্দে ব্রাহ্মণদের দিয়েছিলেন। রাজা সুজজ্ঞ যজ্ঞ শেষ করে শ্ৰেষ্ঠরত্নে তৈরী, কোটি ছাতাযুক্ত সুন্দর সভায় রত্নসিংহাসনে বসলেন। এই সভা চন্দন-পল্লবে সুশোভিত, শাখাযুক্ত ভর্তি কলস ও কলাগাছে সুশোভিত, চন্দন অগরু-কস্তুরী ফল সিন্দুরযুক্ত। যেখানে শোভা পাচ্ছেন ইন্দ্র-চন্দ্র-রুদ্র-সূর্য ও অন্যান্য মুনিরা, নারদ মনু প্রভৃতি এবং সেখানে আসন গ্রহণ করেছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। সেখানে ব্রহ্মা এসে হাজির। পরণে তার ছেঁড়া ও নোংরা কাপড়।

তিনি এসে রাজাকে আর্শীবাদ করলেন। তাঁকে দেখে সভাসদরা মুচকি হাসলেন। ব্রহ্মা রেগে গিয়ে রাজাকে শাপ দিলেন। তিনি রাজাকে বললেন–লক্ষ্মী ছাড়া হও, কুষ্ট রোগগ্রস্ত ও বুদ্ধিহীন হয়ে বিপন্ন হও। রাজা তার কাছে ক্ষমা চাইলেন। রাজা অনুতপ্ত হয়ে সভা থেকে বেরিয়ে গেলেন। ব্রাহ্মণের পিছনে যেতে লাগলেন পুলহ, পুলস্ত্য, প্রচেতা, ভৃগু, অঙ্গিরা, মরীচি, কশ্যপ, বশিষ্ঠ, ক্রতু, শুক্র, বৃহস্পতি, দুর্বাসা, লোমশ, গৌতম, কণাদ, কন্থ, কাত্যায়ন, কঠর পাণিনি, জাবালি, ঋষ্যশৃঙ্গ, ভরদ্বাজ, আস্তীক, লাঙ্গলী, গর্গ, বৎস, বামদেব, বালখিল্য প্রভৃতি পতিবৃন্দ, শক্তি দক্ষ, কর্দম, প্ৰস্কন্ন, কপিল, বামদেব, বিশ্বামিত্র ও অন্যান্য মুনিরা, পিতৃগণ, অগ্নি ও হরিপ্রিয়া দেবতারা এবং দিকপালেরা সবাই সেই ব্রাহ্মণদের পিছনে যেতে লাগলেন। তাঁরা ব্রাহ্মণকে বুঝালেন ও সেখানে বসালেন। তারপর সেই সব নীতিশাস্ত্রজ্ঞ মুনিরা ব্রাহ্মণকে একথা বললেন।

.

একান্নতম অধ্যায়

পার্বতী ব্রহ্মার কাছে জানতে চাইলেন সেই ব্রাহ্মণকে কি বলেছিলেন? মহাদেব বললেন, তাঁরা ব্রাহ্মণকে তুষ্ট করলেন ও বললেন– তুমি রাজাকে শাপ দিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তোমার পেছনে লক্ষ্মী, কীর্তি, যশ রাজাকে ছেড়ে চলে গেছেন। তুমি রাজাকে ক্ষমা করে রাজভবনে এসে তা শুদ্ধ কর। দেবগুরু বৃহস্পতি বললেন, অতিথি যে বাড়ী থেকে মন খারাপ করে চলে যায়, অনাদর করার জন্য কোন বস্তু না নিয়েই ফিরে যায়, তার বাড়ী থেকে সবকিছু চলে যায়। কশ্যপ বললেন, যে লোক বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণকে দেখে অবজ্ঞা করে ও উপহাস করে, সেই পাপী বিষ্ণু পুজাহীন হয়। দুর্বাসা বললেন, গুরু ব্রাহ্মণ কিংবা দেবতার মুর্তি দেখে যে তোক প্রণাম না করে, সে পরজন্মে শূকর হয় ও মিথ্যা সাক্ষ্যদান ও বিশ্বসঘাতকরূপে পাপ কাজে লিপ্ত হয়। ব্রাহ্মণ হত্যা করলে স্ত্রী হত্যার দ্বিগুণ পাপ হয়। সে কুম্ভীপাক নরকে বাস করে লক্ষ বছর। ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন– সামবেদে ষোল রকমের কৃতপ্নের কথা বলা হয়েছে। কৃতঘুদের ভিন্ন ভিন্ন লোকে ভিন্ন ভিন্ন যোনিতে জন্ম হয়। পরাশর বললেন, যে দুর্বুদ্ধি ব্রাহ্মণ শূদ্রদের রান্নাবান্না করে, সেই ব্রাহ্মণ একাত্তর যুগ ধরে অসিপত্র নরকে বাস করে। ভরদ্বাজ বললেন–যে ব্রাহ্মণ শূদ্রদের মরা পোড়ায় সে কৃতঘ্ন। মার্কণ্ডেয় বললেন–ব্রাহ্মণ যদি শূদ্র স্ত্রী সঙ্গম করে তার যে দোষ হয় তা হল তাকে কৃতঘুদের মধ্যে সব থেকে নিকৃষ্ট ও পাপী বলা হবে।

.

বাহান্নতম অধ্যায়

রাজা সুজজ্ঞ প্রশ্ন করলে এবার নারায়ণ বলতে লাগলেন- হে রাজা! যে লোক নিজের দেওয়া বা পরের দেওয়া ব্রহ্মবৃত্তি চুরি করে, সে কৃতঘ্ন। যমদূতরা ভীষণ মেরে তাকে গরম আগুন খাওয়ায় এবং মহাপাপের ফলে ষাট হাজার বছর বিষ্ঠা মধ্যে কৃমি রূপে বাস করে। আস্তিক বললেন–মাতৃগমনের যে দোষ শুদ্রের ব্রাহ্মণ গমনেও সেই একই হয়। সেই দোষেই ব্রাহ্মণের সঙ্গে শূদ্রের সঙ্গম হয়। চন্ডালরাও তাকে স্পর্শ করতে সঙ্কোচ বোধ করে। সে পাপী বিষ্ঠার মতই নিতান্ত অপবিত্র। মহাভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক প্রলয় হয় যাবার পর আবার সৃষ্টির আরম্ভে সেই পাপী সেই রকমই থাকে অথবা ষাট হাজার বছর বিষ্ঠ কৃমি হয়ে থাকে। যে ব্রাহ্মণকে যত্নের সঙ্গে পূজা করে তাড়াতাড়ি বনে গিয়ে তপস্যা করে তার আশীর্বাদে ব্রহ্মশাপ থেকে মুক্ত হয়ে আবার নিজ রাজ্যে ফিরবে।

.

তিপান্নতম অধ্যায়

মুনিরা চলে যাওয়ার পর রাজা ঘুমিয়ে পড়লেন। বশিষ্ট মুনির আদেশে ব্রাহ্মণের পায়ে শুয়ে পড়ে প্রণাম করলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের মঙ্গলের জন্য পরমাত্মা শ্রীহরির তপস্যা করেন। বর পেয়ে নারায়ণের কাছে এক তেজস্বী ব্রাহ্মণ সন্তান লাভ করেন। সুযজ্ঞ রাজার যজ্ঞে সকল মুনিরা এসেছেন শুনে বিষ্ণুভক্তি লাভের জন্য পরমপূজ্য মুনিদের কৃপায় বিষ্ণুভক্তি পাওয়ার জন্য এখানে এসেছি। শ্রীকৃষ্ণ প্রকৃতির স্রষ্টা পরমাত্মা, এ কারণে ধ্যানেও তাকে পাওয়া যায় না। মহাবিষ্ণুর প্রাকৃতিক পুরুষ এক ডিমের থেকে উৎপন্ন হয়েছে যা আবার শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় শ্রীরাধার গর্ভ থেকে উৎপন্ন। প্রকৃতি ও প্রাকৃতরা সবাই কালকে ভয় পান, কারণ কালের বলেই জরা জন্মগ্রহণ করেন ও মহাপ্রলয়ের সময় শ্রীকৃষ্ণে লীন হন।

.

চুয়ান্নতম অধ্যায়

রাজা সুজজ্ঞ জানতে চাইলেন, জগতের আধার বিষ্ণুর আধার কে? বিশ্বের উপর দিকে বা কোন লোক আছে? বা মুনি সুতপা বললেন, সকল বিশ্বের থেকেও বড় ও আকাশের মত সর্বব্যাপী গোলাকধাম সব সময় নিত্য লোক। যা পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় ডিমের আকারে উৎপন্ন হয়ে বিরাজ করছে। প্রথম সৃষ্টির সময় প্রকৃতির সঙ্গে সৃষ্টির খেলায় কিছুটা পরিশ্রান্ত শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে ঘাম ঝরে পড়ে সেই জলে গোলকধাম পরিপূর্ণ। সেই গোলকধামই প্রকৃতির গর্ভজাত ডিমের থেকে উৎপন্ন সেই বিশ্বের আধার হচ্ছে মহাবিষ্ণুর অতি বিস্তৃত আধার। এই গোলোকধাম বৈকুণ্ঠধাম থেকে পঞ্চাশ কোটি যোজন উপরে অবস্থিত। বিরাজা নদীর ও শতশৃঙ্গ পর্বতের অর্ধেক পরিমাণ বৃন্দাবন দিয়ে এই গোলকধাম সুসজ্জিত। সেই বৃন্দাবনের অর্ধেক পরিমাণ জায়গা বাসমন্ডল এবং সুন্দর গোলোক ধামের চারিদিক ঘেরা। বৈষ্ণবরা মহাশক্তি মহালক্ষীকে শ্রীরাধা বলে থাকেন। ইনি শ্রীকৃষ্ণের অর্ধাংশ স্বরূপ, নারায়ণের স্ত্রী মহালক্ষী কৃষ্ণ মন্ত্রের উপাসক, কৃষ্ণভক্তি পারায়ণা ও বিষ্ণুর নৈবেদ্য খান। তিনি শ্রেষ্ঠ, মহান ও পরম পবিত্র। শ্রীরাধা কৃষ্ণের বুকে অবস্থান করেন। রাধার সখীরা চামর দুলিয়ে বাতাস করে। আগে রাধার নামোচ্চারণ, পরে কৃষ্ণ ও মাধব এভাবে উচ্চারণ করার বেদজ্ঞ পন্ডিতরা কথা বলেন।

.

পঞ্চান্নতম অধ্যায়

সুযজ্ঞ মুনিশ্রেষ্ঠ সুতপাকে জিজ্ঞাসা করলেন –যে তিনি কার পূজা করবেন? সুতপা তাকে শ্রীরাধার ভজন করতে বললেন। আর বললেন—’ওঁ রাধায়ৈ স্মাহা’ এই ছয় অক্ষরের মন্ত্র দান করলেন। রাজা মুনির দেখান ক্রমানুসারে উত্তম রাধামন্ত্র জপ করতে লাগলেন। চুলের খোঁপায় মালতী ফুলের মালা, যিনি রূপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, গজরাজের মত আস্তে চলেন যিনি। যিনি শ্রীকৃষ্ণের কাজে প্রাণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। রাসমন্ডলে রত্নসিংহাসনে যিনি বসেন ও রাসে যিনি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে থাকেন সেই রাসেশ্বরী শ্রীরাধাকে ভজনা করি। আসন-বসন-পাদ্য-অর্ঘ্য-গন্ধ-অনুলেপন-ধূপ-দীপ-উত্তম-ফুল স্থানীয়-রত্ন অলংকার-নানা নৈবেদ্য-তাম্বুল– সুগন্ধি জল– মধুপর্ক এবং রত্নময় শয্যাশ্রীরাধার পূজোর ষোল উপাচার এগুলি। হে রাধা! আপনি অমূল্য রত্নে তৈরী বলাচূড় ইত্যাদি ও সুন্দর শঙ্খ ও ভূষণ নিন। সুন্দর কর্পূর মেশানো এই তাম্বুল নিন। এভাবে ভক্তি ভরে পূজা করে তাঁকে তিন বার পুস্পাঞ্জলি দিলেন। শ্রীরাধা পূজারূপ ব্রতে ব্রত পালনকারী ভক্ত রাজা সুযজ্ঞ রাধাকে যুথিকা, মালতী ও পদ্মামালা দান করবে। শ্রীরাধাকে কৃষ্ণও পূজা করেন। পুরাকালে বৃন্দাবনের মধ্যে রাসমন্ডলে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার স্তব করে তার পূজা করেছিলেন। কাশ্যপ রাধার আরাধনা করে অদিতিকে লাভ করেছেন। যে দুর্ভাগা স্ত্রী হারিয়ে এক মাস ধরে রাজার স্তব শোনে, যে শীঘ্র সুন্দরী স্ত্রী লাভ করে। দক্ষের মেয়ে সতী মারা গেলে কৃষ্ণের আদেশে রাধাকে স্তব করে তাকে পেয়েছেন শিব। সাবিত্রীকে ব্রহ্মা লাভ করেছিলেন রাধার স্তব করে। দুর্বাসার শাপে যখন সকল দেবতারা শ্রীহীন হয়ে পড়েন তখন রাধার স্তবের দ্বারা তারা স্ত্রী ও দুর্লভ সম্পদ লাভ করে। যে ভক্তির সাথে শ্রীরাধার পূজা করে প্রতিদিন এই রাধা স্তব পড়বে, সে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গোলোকধামে যাবে।

.

ছাপান্নতম অধ্যায়

পার্বতী এরপর শ্রীরাধার কবচ শুনতে চাইলেন। এটি অত্যন্ত গোপনীয় মন্ত্রের মূর্তবিগ্রহের মত। যা ধারণ করে ও পাঠ করে ব্রহ্মা বেদমাতা সাবিত্রীকে লাভ করেছেন। এই কবচ ধারণ করে বিষ্ণু সমুদ্র কন্যাকে লাভ করে জগৎ পালন করেছেন। এই কবচ ধারণ করে মৃত্যু আলাদা হয়ে সকল প্রাণীদের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। এই কবচ ধারণ করে মহালক্ষী সকল সম্পদ দান করেন। ও রাধায়ৈ স্বাহা’ এই কল্পতরুর মত মন্ত্র শ্রীকৃষ্ণ নিজে উপাসনা করেছেন। পার্বতীকে শ্রীরাধা কবচ কথা বললেন। আকাশ থেকে শ্রেষ্ঠ বিস্তৃত আর কোন বস্তু নেই, সেইরকম বিষ্ণুভক্ত মহাদেব থেকে শ্রেষ্ঠ আর কোনো জ্ঞানী ও যোগী পুরুষ নেই। শিব সবসময় কৃষ্ণের ধ্যানে নিমগ্ন, শি শব্দের অর্থ মঙ্গল, ‘ব’ শব্দের দ্বারা যিনি দান করেন তাকে বোঝায়। যিনি মঙ্গল দান করেন তিনিই শিব।

.

সাতান্নতম অধ্যায়

নারদ ব্রহ্মাকে বললেন, তিনি দূর্গা দেবীর শ্রেষ্ঠ উপাখ্যান শুনতে চান। তিনি বললেন–দূর্গ শব্দের অর্থ–দৈত্য, মহাবিঘ্ন, সংসার বন্ধনের কাজ, নরক যমদন্ড এবং ‘আ’ শব্দের অর্থ হত্যা করা। যিনি এই সকল হনন করেন তিনিই দূর্গা। যিনি নারায়ণের এই শক্তি তিনি নারায়ণী। বিষ্ণু প্রথমে সৃষ্টির সময় মায়া সৃষ্টি করে তা দিয়ে সকল বিশ্ব মোহিত করে রেখেছিলেন। দূর্গাকে বলা হয় বিশ্বমায়া। শিবের প্রিয় হল ‘শিবা’। যে দেবী সকলকে আনন্দ, সম্পদ ও কল্যাণ দান করেন তিনি সর্বমঙ্গলা। সৃষ্টির প্রথমে কৃষ্ণ গোলোকধামের অন্তর্গত বৃন্দাবনের রাসমণ্ডলে প্রথম পূজো করেন। ব্রহ্ম দ্বিতীয়বার মধু ও কৈটভ এর ভয়ে পূজা করেন। তৃতীয়বার মহাদেব ত্রিপুরাসুরকে পুড়িয়ে মারার জন্য দুর্গার আরাধনা করেন। চতুর্থবার দূর্বাসার শাপে স্বর্গের অধিকার হারিয়ে ইন্দ্রভক্তির সঙ্গে ভগবতীর পূজা করেন। নদীতীরে সমাধি নামে একবৈশ্যও এই দেবীকে বিশেষভাবে পূজা করে মুক্তি লাভ করেছেন। রাজা সুরথ পুষ্কর তীর্থে দারুন কঠোর তপস্যা করেন। তার নাম হয় সাবৰ্ণি মনু। ব্রহ্মা নারদকে জিজ্ঞেস করল যে সে আর কি শুনতে চায়।

.

আটান্নতম অধ্যায়

এবার নারদ রাজা সুরথের সকল বৃত্তান্ত জানতে চাইল। নারায়ণ বললেন, ব্রহ্মার পুত্র অত্রি, অত্রির পুত্র নিশাকর চন্দ্র। চন্দ্র রাজসূয় যজ্ঞ করে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ হন। বৃহস্পতির পত্নী তারার গর্ভে চন্দ্রের যে পুত্র হয় তার নাম বুধ। মহাকামুক চন্দ্র একদিন তারাকে গঙ্গাতীরে দেখলেন। বাতাসে তার নিচের দিকে কাপড় সরিয়ে দিচ্ছে। চন্দ্র তাকে দেখে কামাসক্ত হয়ে পড়লেন ও লজ্জা হারিয়ে ফেললেন। তিনি তারাকে বললেন, তিনি বেরসিক লোকের সঙ্গে কি সুখ পেয়েছেন। বৃহস্পতি সবসময়ই তপস্যা করে চলেছেন।

চন্দ্র তাকে বললেন–বাসন্তী ফুলের বিছানায় তুমি আমাকে নিয়ে রতিসুখ পাও । সুন্দর মলয় পর্বতের গুহায় চন্দনের গন্ধ চাপাবনে ঠান্ডা চাপা ফুলের গন্ধময় বায়ু বইছে। সেখানে বিহার করত। তারা ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে বললেন–ধিক্ চাঁদ তোমায়। ব্রহ্মার পুত্র অত্রির দুর্ভাগ্য যে তুমি তার ছেলে হয়েছে। ছিঃ লম্পট। যদি তুমি নিজের ভালো চাও তো আমাকে মা ভেবে ছেড়ে চলে যাও। চন্দ্র তাঁর কথা অগ্রাহ্য করে জোর করে তাঁকে পাশে বসিয়ে তাঁর সাথে রমণ করতে লাগলেন। এভাবে তাঁদের একশো বছর কেটে গেল। চন্দ্র বৃহস্পতির ভয়ে ভীত হয়ে পড়লেন। গুরু বৃহস্পতির তাঁর মায়ের সমান। দেবতাদের বৃহস্পতির মত মারত্মক শত্রু আর নেই। যে রজোগুণের বশবর্তী হয়ে অপরের কীর্তিকে ম্লান করে, সে চন্দ্রের পাপে এক যুগ ধরে কুম্ভীপাক নরকে বাস করে। যে বেশ্যার অন্ন, পতিপুত্রহীন নারীর অন্ন, ঋতুমতী স্ত্রীর অন্ন খায়, চন্দ্রের পাপ অবশ্যই তার কাছে যাবে। দৈত্য গুরু শুক্রাচাৰ্য্য চন্দ্রকে শুদ্ধ করে তারা দেবীকে বললেন, হে সতী। তুমি চন্দ্রকে ছেড়ে স্বামীর কাছে যাও। তুমি পবিত্র কারণ যে নারীর কামনা থাকে না, তাকে কেউ বলাৎকার করে উপভোগ করলেও সে নারী নির্দোষ হয়।

.

ঊনষাটতম অধ্যায়

নারায়ণ এরপর নারদের প্রশ্নের উত্তরে বৃহস্পতি কি করেছিলেন বললেন–স্নান করে ফিরে আসতে তারার দেরী দেখে বৃহস্পতি তাকে খোঁজার জন্য এক শিষ্যকে মন্দাকিনী তীরে পাঠান। তিনি তারার চুরি হয়ে যাবার খবর শুনে গুরুর কাছে এলেন। বৃহস্পতি তা শুনে মূর্ছা গেলেন। ‘ ‘ তিনি বললেন–যার স্ত্রীকে শত্রু চুরি করে নিয়ে গেছে, তার বনে যাওয়া উচিত। স্ত্রী হীন ব্যক্তির দৈব ও পিতৃকাজে অধিকার থাকে না সে অশুচি। বৃহস্পতি হাজার দূতকে নানা দিকে পাঠিয়ে দিলেন। বৃহস্পতি তাঁর মেজভাই উতথ্যের গর্ভবতী সতী স্ত্রীকে কামের তাড়নায় চুরি করেছিলেন। সে নিজের ভাই বৌ কে চুরি করে কাম চরিতার্থ করার জন্য তাঁর হাজার ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়।

পূর্বে মিজ কর্ম দোষে অঙ্গিরার স্ত্রীর এক মরা ছেলে হল। সে শ্রীকৃষ্ণের ব্রতপালন করতে শুরু করে। শ্রীকৃষ্ণ তাকে বর দেওয়াতে তার বরজ-বীৰ্যজ-ক্ষেত্ৰজ-পাল্য-বিদ্যাজ-মন্ত্রজ ও দত্তক এই সাত পুত্র হয়। জ্ঞানীশ্বর বৃহস্পতি শ্রীকৃষ্ণের বরপুত্র।

.

ষাটতম অধ্যায়

নারদ এরপর বললেন, যে শিবের কাছে গিয়ে বৃহস্পতি তাকে কি বলেছিলেন? নারায়ণ বললেন–লজ্জায় ম্লান বৃহস্পতি কৈলাসে গেলে শিব তাকে জিজ্ঞেস করলেন তার শোভাহীন অবস্থার কারণ কি? শ্রীকৃষ্ণ ভক্তদের কি নির্মলগুণ যে গুরু বৃহস্পতি নিজের স্ত্রী চুরির জন্য চাঁদকে এখনও অভিশাপ দেন নি। বৃহস্পতির কাছে সব শুনে একথা শিব বললেন। বৃহস্পতি নিশ্চয়ই তারাকে লাভ করবেন। দেবতারা স্তব করলে শুক্রাচার্য সন্তুষ্ট হবেন। সকল দেবতারা শুক্রের আশ্রমে যাক। একথা বলে বিষ্ণু চলে গেলেন। ব্রহ্মা মহাদেবের অনুমতি নিয়ে সেখানে মুনিদের ও দেবতাদের নীতি কথা বললেন–শোনো, আমি এই শিব বিষ্ণু ও সর্বসাক্ষী ধর্ম আমাদের এই স্নেহ দৈত্য ও দেবতা সবার উপরই সমান। রাতের দেবতা চাঁদ এখন দৈত্যদের গুরু শুক্রাচার্যের শরণাপন্ন হয়েছে। দেবতারা কখনও সেই শত্রুকে জয় করতে পারে না। দেবতারা শুক্রাচার্যকে বিশেষ সমাদর করে। তারাকে আনার জন্য শুক্রাচার্যের আশ্রমে যাচ্ছেন। সবাই বিষ্ণুর আদেশমত সমুদ্র তীরে যাও, একথা বলে ব্রহ্মা পুত্রের কাছে গেলেন। অন্যদিকে দেবতারা ও অন্যান্য ব্রাহ্মণরা সবাই সমুদ্র তীরে এলেন।

.

একষট্টিতম অধ্যায়

নরায়ণ বললেন– ব্রহ্মা মহাত্মা শুক্রের দৈত্যতে ভরা আশ্রমে গেলেন। সেখানে পঞ্চাশ কোটি ব্রহ্মবাদী শিষ্য ছিল। সেখানে সাতটা পরিখা ছিল। এই আশ্রমের দেওয়ালে পদ্মরাগমণি লাগান। শুক্রাচার্য ব্রহ্মাকে দেখে ভয়ে হাত জোড় করে তাঁকে প্রণাম করলেন। আর ষোল রকম উপকরণ দিয়ে তার পুজো করলেন। ব্রহ্মা বললেন–তুমি আমার পৌত্র, অনেকদিন তোমাকে না দেখায় উদ্বিগ্ন হয়ে তোমাকে দেখতে এসেছি। এরপর ব্রহ্মা চাঁদের সঙ্গে সহবাস করার জন্য, সতী নারী তারাকে গর্ভবতী অবস্থায় তাকে প্রণাম করতে দেখলেন। চাঁদকে মায়া বলে কোলে নিয়ে সেই মলিন ও কাতর তারাকে বললেন–হে মা তারা! কামনা করলেও যে অবলা স্ত্রীকে বলবান অন্যপুরুষ বলাৎকার করে, সেই স্ত্রীর দোষ হয়না। যখন নির্দয় চাঁদ তাকে ধরেছিল তখন সে ব্যাপারে সবাই সাক্ষী ছিলেন। চাঁদ ব্রহ্মাকে প্রণাম করলেন ও বৃহস্পতির হাতে সতী তারাকে সমর্পণ করলেন এবং দেবতাদের অভয় দিলেন। এবং ব্রহ্মা ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন। তারার গর্ভে চাঁদের ঔরসে বুধ জন্মায়। সে একদিন নন্দন কাননে চিত্রাকে একা পেল। সে ঘৃতাচীর গর্ভজাত। কুবের তাঁর পিতা বুধের ওরসে চিত্রার গর্ভে চৈত্র উৎপন্ন হন। সেই চৈত্রের ছেলে হল রাজা অধিরথ। তার ছেলে মহাজ্ঞানী সুরথ। ইনি মুনি শ্রেষ্ঠ মেধসের কাছে বিষ্ণুমায়ার উপাসনা করেছিলেন। রাজা সুরথ দেবর কৃপায় নিজের নিষ্কণ্টক রাজ্য ও মারা যাওয়ার পর বৈবস্বত মনুর পদ লাভ করেন।

.

বাষট্টিতম অধ্যায়

নারদ বলতে লাগলেন স্বায়ম্ভুব মনুর বংশজাত ধ্রুবর ছেলের ছেলে, উৎকলের রাজা নন্দী। সে সুরথের কোলনগরী আক্রমণ করে। রাজা সুরথ ব্রহ্মাকে বলেন তার জন্ম চৈত্রবংশে। বলবান নন্দী তাকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেছে। তাকে নিজের বাড়ী থেকে বার করে দিয়েছে। দয়ালু মুনি মেধস রাজা সুরথকে কবচ ও মন্ত্র দান করলেন। বৈশ্য সমাধি দুর্গার আরাধনা করে মুক্তি লাভ করলেন।

.

তেষট্টিতম অধ্যায়

নারদ একবার জানতে চাইলেন, সুরথ কেমন করে দুর্গার পূজা করেন। নারায়ণ বললেন–রাজা ও বৈশ্য- এঁরা দুজনেই মেধস মুনির কাছে দেবীর মন্ত্র, স্তব, কবচ, ধ্যান ও পুরশ্চরণ লাভ করলেন। পরে সারা বছর ধরে পুষ্কর তীর্থে তিনবার স্নান করে মন্ত্র জপ করতে লাগলেন। আদি প্রকৃতি ঈশ্বরী তাদের দেখা দিলেন। বৈশ্য বলল– যা ব্রহ্মত্ব বা অমরত্ব আমি চাই না। আমাকে অবিনশ্বর সর্বশ্রেষ্ঠ বর দাও। অসাধু, পাপী যাদের এই বিষ্ণু ভক্তি থাকে না তাদের আয়ু সবসময় হরণ করেন। আর যিনি তগত সেইই বৈষ্ণব ভক্ত চিরজীবী হয়।

.

চৌষট্টিতম অধ্যায়

রাজা সুরথের শ্রেষ্ঠ প্রকৃতি দেবীর আরাধনার নিয়ম হল– মহারাজ স্নান শেষ করে আচমন, করে করন্যাস ও অঙ্গন্যাস ও আট মন্ত্রে ন্যাস করে, ভূতশুদ্ধি প্রাণায়াম ও নিজের অঙ্গ শোধন করে দেবীর ধ্যান ও তাকে মাটির প্রতিমায় আবাহন করলেন। তারপর ভক্তি ভরে ধ্যান করে পুজো করলেন। পরম ধার্মিক সুরথ, দেবীর ডান দিকে লক্ষীকে স্থাপন করে, ভক্তি ভরে পুজো করে দেবীর সামনের ঘটে গণেশ, সূর্য, অগ্নি, বিষ্ণু, শিব ও শিবা এই ছয় দেবতার নিয়ম মত আয়োজন করে ভক্তি ভরে পুজো করলেন ও মহাদেবীকে ধ্যান করলেন। দেবী দুর্গার একশো হাত। ইনি অসুরদেব ধ্বংস করেছেন। এর চোখের সৌন্দর্য দিনের বেলার পদ্মের শোভাকেও ম্লান করে দিয়েছে। হে দুর্গা! মহা মূল্যবান রত্নপাত্রের মধ্যে নির্মল গঙ্গার জল আপনার পা ধোওয়ার জন্য রাখা হয়েছে, আপনি তা নিন। অনাথ-নীরোগ বিবাহিত দীক্ষিত-পরস্ত্রীবিমুখ-অজার জাত-বিশুদ্ধ শ্রেষ্ঠ সৎ শূদ্র যুবককে তার আত্মীয়দের কাজ থেকে অর্থ দিয়ে কিনে ধার্মিক ব্যক্তি তাকে স্নান করিয়ে, কাপড়, চন্দন, মালা, ধূপ, দিয়ে পূজা করে শেষে দুর্গাকে নিবেদন করবে।

.

পঁয়ষট্টিতম অধ্যায়

নারায়ণ বললেন– আদ্রা নক্ষত্রে দেবীর বোধন করবে ও মূলা নক্ষত্রে দেবীকে ঘরে প্রবেশ করাবে, উত্তরফাল্গুনী নক্ষত্রে পুজো করে শ্রবণা নক্ষত্রে দেবীকে বিসর্জন দেবে। নবমী তিথিতে বোধন করে একপক্ষধরে দেবীর পুজো করলে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান ফল লাভ হয়। আর দশমীর দিন বিসর্জন। রাজা সুরথ সারা বছর ভক্তিভরে পুজো করে গলায় কবচ বেঁধে পরমেশ্বরীকে স্তব করলেন। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সকলের ঈশ্বর একথাই পরম জ্ঞান, বেদ, ব্রত, তপস্যা, তীর্থ দেবতা পূণ্য এসমস্ত কিছুর সার হলেন শ্রীকৃষ্ণ।

.

ছেষট্টিতম অধ্যায়

পূর্বে গোলোকধামে রাসমন্ডলী বৈশাখে শ্রীকৃষ্ণ পরমানন্দে দুর্গার প্রথম স্তব করেন, দ্বিতীয়বার বিষ্ণু করেন মধুকৈটভের সঙ্গে যুদ্ধের সময়, চতুর্থবার মহাদেব ও পঞ্চমবার বৃত্রাসুর বধের সময় ঘোর সঙ্কট উপস্থিত হলে ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা করে।

শ্রীকৃষ্ণ দেবীকে বলেছিলেন–তুমিই সর্বজননী, প্রকৃতি ঈশ্বরী মূল সত্ত্ব। রজ ও তমো গুণময়ী হওয়া তোমার ইচ্ছাধীন। তুমি আত্মার নিদ্রা, তৃষ্ণা, লজ্জা, দয়া, মায়ময়ী শক্তি। তুমি বন্দনীয়, মোহরাত্রি, মোহিনীশক্তি। বন্ধ্যা, কাকবন্ধ্যা যক্ষারোগী, রাজদ্বারে, শ্মশানে, বনে হিংস্র জন্তুর সামনে এই স্তব শুনলে তার মুক্তি পায়। কোন দারুন গরীব ও মূর্খ এই স্তব পাঠ করলে বিদ্বান ও ধনী হয়। নারদ এরপর ব্রহ্মাণ্ড মোহন নামক কবচের কথা শুনতে চাইলেন। নারায়ণ বলতে শুরু করলেন। কৃষ্ণ কৃপা করে যে কবচ ব্রহ্মাকে দিয়েছিলেন, ব্রহ্মাও গঙ্গা তীরে সকল কবচ ধর্মকে বলেছিলেন। ধর্ম দয়া করে তাঁকে পুষ্কর তীরে এই কবচ দিয়েছিলেন। জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ দুর্বাসা কবচ ধারণ করে শিবের সমান হয়েছেন। যে লোক সিদ্ধ কবচ ধারণ করে বিপদে অস্ত্রও তাকে বিদ্ধ করতে পারে না। জল, আগুন ও বিষ এদের কোনটাতেই তাদের মৃত্যু হয় না। ভগবান কৃষ্ণ নিজের অংশে গণেশরূপে উৎপন্ন হয়েছেন। মানুষ এই শ্রুতিমধুর অমৃতের সমান প্রকৃতিখন্ড শুনে দই ভাত খাইয়ে বক্তাকে সোনা দান করবে আর বাচ্চা সমেত সুন্দর গোরু ভক্তি ভরে দেবে। দেবীর অনুগ্রহে তার পুত্রপৌত্রাদির সংখ্যা বাড়বে।