ভাগবত পুরাণ – ০৬ষ্ঠ স্কন্ধ

ভাগবত পুরাণ – ষষ্ঠ স্কন্ধ
প্রথম অধ্যায়
অজামিলের উপাখ্যান, বিষ্ণুদূত ও যমদূতের সংবাদ

রাজা পরীক্ষিৎ বললেন– হে ব্রাহ্মণ, আপনি আগেই আমাকে নিবৃত্তিমার্গ সম্পর্কে বলেছেন। যে মার্গ অবলম্বন করে পুরুষ ক্রমে তোক অতিক্রম করে ব্রহ্মালোকে উপস্থিত হতে পারে। প্রবৃত্তিমার্গের বিভিন্ন ফলস্বরূপ লোকের স্বর্গাদি সুখের প্রাপ্তি ঘটে। ভগবৎ-অনুগ্রহ ব্যতীত প্রকৃতি বা মায়ার বিনাশ না ঘটায় সেখানে বারংবার বিষয়ভোগের জন্য দেহ প্রাপ্তি ঘটে। এই রকম ধর্মের ফলস্বরূপ নরকসকলের বর্ণনা এবং মন্বন্তরেরও ব্যাখ্যা করেছেন। যার মধ্যে স্বায়ম্ভুব মন্বন্তর প্রথম। প্রিয়ব্রত ও উত্তানপদের বংশ ও চরিত্রও বর্ণনা করেছেন। আর দ্বীপ, বর্ষ, পর্বত, সমুদ্র, নদী, উদ্যান, বৃক্ষ এবং বিভাগ লক্ষণ ও পরিমাণ অনুসারে ভূমণ্ডল, জ্যোতিষ্কমণ্ডল এবং অধোলোকের সংস্থান প্রভৃতি সৃষ্টির প্রক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।

হে মহাভাগ, এখন আপনি মানুষ যেভাবে তীব্র বেদনাময় নরক গমন থেকে অব্যাহতি লাভ করতে পারে, তা ব্যাখ্যা করুন।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে রাজনন্দন, ইহলোকে অবস্থানকালীন যদি মানুষ মনবাক্য ও শরীর দ্বারা কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত না করে তাহলে তার যন্ত্রণাময় নরকগমন অবশ্যম্ভাবী।

অভিজ্ঞ বৈদ্য রোগের মূল কারণ নিরূপণ করে চিকিৎসা করেন। তেমনি মানুষও মৃত্যুর পূর্বেই যদি সুস্থ দেহ মনে ইহলোককৃত পাপের নিষ্কৃতির জন্য গুরুত্ব অনুযায়ী প্রায়শ্চিত্ত করে, তাহলে তার মুক্তিলাভ সম্ভব হয়।

রাজা পরীক্ষিৎ বললেন– হে ভগবন্‌, ইহলোককৃত যে পাপের ফলে রাজদণ্ড এবং পরলোকে নরকবাস হবে এ বিষয়ে জ্ঞাত হয়েও, মানুষ বারংবার সেই কার্যে লিপ্ত হয়। পাপের বশীভূত হয়েই যেন সে আবার পাপাচারে লিপ্ত হয়। এই অবস্থায় তো তার পাপ নিবৃত্তির কোনো সম্ভাবনা থাকে না। তাহলে এই রূপ প্রায়শ্চিত্তের কি প্রয়োজন?

হস্তী যেমন স্নান করে উঠেই আবার ধূলিতে নিজ সর্বাঙ্গ মলিন করে ফেলে তেমনই পুরুষও প্রায়শ্চিত্ত সমাপন করেই আবার নতুন করে পাপকার্যে লিপ্ত হয়। তাহলে তার আর প্রায়শ্চিত্তের কি প্রয়োজন?

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে রাজন, চান্দ্রয়াণাদি কর্মরূপ প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা সম্পূর্ণ পাপমুক্তি সম্ভব নয়।

কারণ, যে সকল পুরুষ ঐ প্রায়শ্চিত্ত করেন, তারা অবিদ্বান, তাদের অবিদ্যার কারণে একবার পাপক্ষয় হলেও আবার অবিদ্যামুলক সংস্কারবশতঃ পুনরায় পাপকর্মে প্রবৃত্তি হয়। জ্ঞানই পাপের মুখ্য প্রায়শ্চিত্ত। কারণ এই জ্ঞানের দ্বারাই অবিদ্যার মূলচ্ছেদন সম্ভব। একবার অবিদ্যার মূলচ্ছেদ ঘটালে আর পাপ প্রবৃত্তি জন্মাতে পারে না।

হে রাজ, যে ব্যক্তি হিতকর অন্নভোজন করে, তাকে যেমন রোগসমূহ বিব্রত করতে পারে না, সে ক্রমে ক্রমে নিরাময় হয়।

যে ব্যক্তি, নিয়মনিষ্ঠ, তিনিই ক্ৰমশঃ তত্ত্বজ্ঞানরূপ পরম কল্যাণলাভে সমর্থ হন। অগ্নি যেমন বিশাল বাঁশবনকে দগ্ধ করে ফেলতে পারে, তেমনি জ্ঞানী, ধর্মজ্ঞ ও ধীর ব্যক্তিগণ, তপস্যা, ব্রহ্মচর্য পালন শম — দানাদি ক্রিয়ার মাধ্যমে জপ ও অর্চনা করে ক্রমশঃ দেহার্জিত চরম পাপকেও বিনাশ করতে সক্ষম হন।

তবে জ্ঞানরূপ এই মুখ্য প্রায়শ্চিত্ত খুবই কষ্টকর। সেজন্য অপর একটি প্রায়শ্চিত্তের কথা বলছি। ভগবান সূর্যদেব যেমন কুঙ্খটিকা বিনাশে সক্ষম তেমনি বাসুদেব পরায়ণ ব্যক্তিরা অর্থাৎ ভগবান শ্রীহরির একান্ত শরণাগত ব্যক্তিগণ শুধুমাত্র ঐকান্তিক ভক্তির দ্বারাই পাপবাসিকে সম্পূর্ণভাবে বিনাশ করতে সক্ষম। এই ভক্তিমার্গ, জ্ঞানমার্গ অপেক্ষা শ্রেয়তর পথ।

হে রাজন, ভগবদ্ভক্তের সেবার প্রভাবে যিনি ভগবান কক্ষে প্রাণ সমর্পণ করেছেন, পূর্বে মহাপাতকী হলেও তিনি পবিত্রতা প্রাপ্ত হন। হাজার তপস্যা করলেও পাপীর সেরকম শুদ্ধতা লাভ সম্ভব নয়। ইহলোকে এই ভক্তিমার্গ পরম কল্যাণকর ও সমীচীন পন্থা, কারণ এই পথে সহায়করূপে সুশীল, দয়ালু, নিষ্কাম সাধুগণ বর্তমান রয়েছেন। এই পথে কোনো বিঘ্ন ঘটার আশংকা নেই। শুধুমাত্র ভক্তিই অন্য নিরপেক্ষ হয়ে পবিত্র কর্ম করতে পারে। চান্দ্রায়াণাদি প্রায়শ্চিত্ত ভক্তি ব্যতীত স্বতন্ত্রভাবে শুদ্ধ করতে সক্ষম নয়।

যাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মদ্বয়ে তদীয় গুণরূপী নিজ চিত্তকে মাত্র একবারও নিবিষ্ট করতে সমর্থ হয়েছেন, তাতে তাদের সেই চিত্ত ভগবানের লীলা অনুভব করতে সক্ষম হয়। যমপুরুষেরা স্বপ্নেও তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। কারণ, একবার মাত্র ভগবান চরণপদ্মে মন সংস্থাপিত করার ফলেই তাদের সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে।

হে রাজন, এ বিষয়ে প্রাচীন পণ্ডিতেরা বিষ্ণুদূত ও যমদূত সংবাদরূপ একটি পুরাতন ইতিহাস দৃষ্টান্তরূপে বর্ণনা করেন। সেই ইতিহাস আমি আপনার কাছে বিবৃত করছি, কান্যকুজ নগরে দাসীপতি অজামিল নামে এক ব্রাহ্মণ দাসীর সংসর্গে দূষিত হয়ে সদাচারহীন হয়েছিল। পণ রেখে পাশাখেলা, বঞ্চনা, চৌর্যবৃত্তি প্রভৃতি অবলম্বন করে সে কুটুম্বদের ভরণপোষণ করত।

হে রাজ, এভাবেই এবিধ দুষ্কর্ম সাধন করেই সে ঐ দাসীর গর্ভজাত দশ পুত্রের লালন পালন করতে লাগল। এভাবেই তার সুদীর্ঘ অষ্টাদশ বছর অতিক্রান্ত হল। সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সর্বকনিষ্ঠ পুত্রের নাম নারায়ণ। সে তার পিতামাতার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিল। বৃদ্ধ বয়সে ঐ ব্রাহ্মণ সেই কলাভাষী শিশুর প্রতি আসক্ত হয়েছিল। সর্বদা তার ক্রীড়া হাস্যতে আনন্দ অনুভব করত। মায়ামোহিত চিত্ত অজামিল যখনই নিজে জলগ্রহণ বা খাদ্যগ্রহণ করত তখনই সে আগে পুত্র নারায়ণকে পান-ভোজন করাত।

এভাবে পুত্রের প্রতি নিরন্তর নিবিষ্ট মনোযোগী হওয়ায় কখন যে কালান্তক কাল তার শিয়রে এসে উপবিষ্ট হয়েছে, সে জানতে পারেনি।

অকস্মাৎ অজামিল নিজ শিয়রে ভয়ালদর্শন, বক্রমুখ, ঊর্ধরোম তিনজন পুরুষকে পাশহস্তে দণ্ডায়মান দেখে অত্যন্ত ভীত হয়। সে তখন কাতর হয়ে দূরে ক্রীড়ারত পুত্র নারায়ণের নাম ধরে উচ্চরবে ডাকতে থাকে। অজামিলের শিয়রে তিন জন যমদূতের আগমন হয়েছিল, কারণ সে কায়িক, বাঁচিক, মানসিক এই তিন প্রকার পাপকর্মে লিপ্ত হয়েছিল।

এদিকে মুমূর্ষ অজামিলের মুখে চতুরাক্ষর নারায়ণ-এর নাম শুনে ভগবানের পার্ষদেরা মনে করলেন, তিনি শ্রীভগবানকে স্মরণ করছেন। তারা সেই মুহূর্তে তার কাছে এসে উপস্থিত হলেন। যমকিঙ্করেরা তখন অজামিলকে অর্থাৎ তার সূক্ষ্ম শরীরকে টেনে বের করার জন্য চেষ্টা করছিল। এ অবস্থায় শ্রীবিষ্ণুর পার্ষদেরা তাদের জোর করে প্রতিরোধ করলেন।

বিষ্ণুপার্ষদের কাছে পরাহত হয়ে সরোষে যমদূতগণ প্রশ্ন করল– কে তোমরা? কেন তোমরা এই দুরাচারী পাপাত্মাকে যমালয়ে নিয়ে যাবার জন্য ধর্মরাজের আদেশ পালনে বাধা দিতে এসেছ? তোমরা কে? কোনও দেবতা, নাকি উপদেবতা? অথবা কোনও সিদ্ধ মহাপুরুষ?

তোমাদের আমরা চিনতে পারছি না। আমাদের এই প্রশ্নে তোমরা ক্রুদ্ধ হয়ো না। তোমাদের মনোহর রূপ দর্শন করছি। তোমাদের চারজনেরই চক্ষু পদ্ম পলাশের সঙ্গে তুলনীয়। পরিধানে পীতবস্ত্রাদি, গলায় মনোরম পদ্মমাল্য, মস্তকে কিরীট শোভিত রয়েছে। তোমরা সকলেই নবীন যুবা। চর্তুবাহুতে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ধৃত। স্বীয়ঃ জ্যোতি প্রভাবে পাশ্বস্থ স্থানাদি আলোকোজ্জল হয়েছে। আমরা ধর্মরাজের আজ্ঞাবাহক ভূমাত্র। তোমরা আমাদের কর্তব্যসাধনে বাধা দিচ্ছ কেন?

শ্রী শুকদেব বললেন– হে বান্, যমদূতদের এই কথা শুনে ঐ বিষ্ণুদূতগণ বিস্মিত হয়ে হাস্যযুক্ত জলদ-মন্ত্র স্বরে বলতে লাগলেন, তোমরা যদি ধর্মরাজের আজ্ঞাবাহী হও, তাহলে ধর্মের স্বরূপ ও প্রমাণ বিষয়ে আর কি প্রকারে দণ্ড ধারণ করা হয়, দণ্ডের বিষয়ই বা কি– এ বিষয়ে আমাদের বল।

কর্ম করে এমন সকলেই কি দণ্ডের যোগ্য? মানবগণের কি সবাই দণ্ডনীয়? নতুবা ভগবানের নামস্মরণকারী এই ব্যক্তির দণ্ডবিধান করতে গিয়ে তোমরাই দণ্ডিত হবে!

যমদূতগণ বললেন– যে সমস্ত কর্ম বেদবিহিত অর্থাৎ বেদ যে কর্ম আচরণের নির্দেশ আছে, তাদেরকে ধর্ম বলে। যে সকল কর্ম বেদে নিষিদ্ধ আছে, তাদের অধর্ম বলে। অতএব বিধিনিষেধ স্বরূপ ধর্ম –অধর্মের প্রমাণ হল বেদ। এখন যদি এই প্রশ্ন করা হয় যে, বেদ কি?

নারায়ণের নিশ্বাসের মতো অনায়াসে আবির্ভূত বলে বেদকে সাক্ষাৎ নারায়ণস্বরূপ এবং স্বয়ম্ভু বলা হয়।

যদি জানতে নারায়ণ কে? তবে শোনো।

সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রাণীগণ সততা প্রভৃতি গুণ, অধ্যয়ন প্রভৃতি ক্রিয়া, ব্রাহ্মণদি সংজ্ঞ ও বর্ণাশ্রম প্রভৃতি রূপ অনুযায়ী যার স্বরূপে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে প্রকাশিত হয়ে থাকে, তিনিই নারায়ণ।

যদি আপনারা এই প্রশ্ন করেন, –এই ব্যক্তি যে অধর্ম করেছে, তার প্রমাণ কি?

তার উত্তরে বলি, চন্দ্র সূর্য, অগ্নি, আকাশ, বাতাস, দিবা– রাত্রি, দিক– সকল, জল, পৃথিবী এবং স্বয়ং ধর্মরাজ প্রতিটি প্রাণীর ধর্মাধর্ম, সকল কার্যের সাক্ষাৎ দর্শক।

এদের মাধ্যমেই এই ব্যক্তির কৃত অধর্মের কথা জানা গেছে।

অধর্মই হল দণ্ডের স্থান। কর্ম অনুসারে সকল অধর্মকারীর যথাযোগ্য দণ্ড প্রাপ্ত হয়। কর্মী পুরুষ মাত্রই সত্ত্ব প্রভৃতি গুণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। গুণ অনুসারে শুভ বা পুণ্য এবং অশুভ বা পাপ কার্য করে থাকে। দেহ ধারী জীব কখনই কর্মহীন অবস্থায় থাকতে পারে না। কায়িক, মানসিক বা বাঁচিক যে কোনোও প্রকার কর্মে তারা সতত নিয়োজিত থাকে, সুতরাং যে কোন জীব মাত্রই কর্মী, কর্মী হলেই সে যথাবিধি দণ্ডের অধীন।

ইহলোকে যে ব্যক্তি যে প্রকারে যে পরিমাণ অধর্ম বা ধর্মাচরণ করে, পরলোকে সেভাবেই তার পরিণাম ভোগ করে থাকে।

হে দেবপ্রবরগণ, ইহলোকে প্রাণীদের মধ্যে গুণগত বৈচিত্রের কারণে যেমন বিভিন্ন ভাব দেখা যায়, পরলোকেও তেমনি ত্রিবিধ ভাবের অনুমান করা হয়। বর্তমান বসন্তাদি কাল যেমন অতীত অনাগত বসন্তাদি কালের গুণাবলীর জ্ঞাপক হয়, তেমনি বর্তমান জন্ম অতীত এবং ভবিষ্যতের কর্মাবলীর সংঘটন অনুমান করা সম্ভব।

ধর্মাধর্ম নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ লোক এভাবেই বিচার করে থাকে।

কিন্তু স্বয়ং যমরাজ নিজ সংযম পুরীতে অবস্থানপূর্বক মনের দ্বারাই জীবের পূর্বরূপ অর্থাৎ দেবমনুষ্যাদি, ধর্ম– ধর্মাদিযুক্ত, পূর্ব– স্বরূপ বিশেষভাবে জানতে পারেন। তারপর তার অপূর্বরূপ অর্থাৎ ভাবীরূপ তার সম্বন্ধে যা যোগ্য, তা বিচার করে থাকেন। নিদ্রিত ব্যক্তি যেমন স্বপ্নপ্রকাশিত দেহাদি পদার্থকেই নিজ জ্ঞানে অনুসরণ করে, কিন্তু জাগরণ– কালীন দেহাদি বা পূর্ব-স্বপ্নদৃষ্ট দেহাদির অনুসন্ধান করে না, সেরূপ অবিদ্যাগ্রস্ত অজ্ঞ জীবও পূর্বজন্ম স্মৃতি নষ্ট হওয়ার ফলে, তার দ্বারা লব্ধ বর্তমান দেহকেই অহংজ্ঞানে উপাসনা করে। তারা পূর্ব দেহাদির সন্ধান করে না।

জীব বাক, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ — এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা বাক্যোচ্চারণাদি এই পাঁচ প্রকার কাজ করে থাকে। তারা চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক– এই পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাহায্যে

সংঘটন নির্ণয়ের ক্ষেনি সংযম পূর্ণ বিশেষত্বারে থাকেন। নিজিহাদি বা পুর্নতার দ্বারা লব্ধ রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ অনুভব করতে পারে। পঞ্চ কর্মে পঞ্চবিষয় এদের অতিরিক্ত মন ষোড়শস্থানীয় এবং জীব সপ্তদশ স্থানীয়।

এই জীবের মনের সঙ্গে সম্বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও স্বয়ং একাকীই কর্মেন্দ্রিয় জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মনের বিষয়াদি উপভোগ্য হয়।

সত্ত্বাদি ত্রিগুণের কার্য- স্বরূপ এই ষোড়শ অবয়ব যুক্ত অনাদি লিঙ্গ শরীর জীবের হর্ষ, শোক, ভয় ও পীড়াদায়ক সংসারচক্রের বিধান করে।

গুটিপোকা নিজের দেহনির্গত সুতো দ্বারা নিজের আবরণ নির্মাণ করে তার মধ্যে বদ্ধ হয়। সে তার থেকে বেরিয়ে আসার উপায় জানে না। কামাদি প্রভৃতি ছটি রিপুর বশীভুত জীবও তেমনি লিঙ্গ শরীরের প্রেরণায় কর্মরত হয়ে স্ব-চরিত সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু সেখানে থেকে বন্ধন মুক্তির উপায় জানতে পারে না।

কোনো ব্যক্তিই এক মুহূর্তের জন্যও কর্মহীন অবস্থায় থাকতে পারে না, সকলেই অবশ হয়ে প্রাক্তন কর্মের সংস্কার থেকে উৎপন্ন গুণাদি দ্বারা কর্মে প্রবৃত্ত হয়। তার ফলে যে অদৃষ্ট, তাই জীবের স্কুল অথবা সূক্ষ্ম শরীরের কারণ। সেই বাসনা অতিশয় বলবতী, তার দ্বারা জীবের পিতৃসদৃশ অথবা মাতৃসদৃশ দেহপ্রাপ্তি হয়।

প্রকৃতির সঙ্গবশতঃ পুরুষের বিচিত্র সংসারভার রূপ এই বিপর্যয় উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু, ভগবদ ভজনার কারণে অতি শীঘ্র তার এই বিপর্যয় বিলীন হয়ে যায়।

ব্রাহ্মণ কুলজাত এই অজামিল আগে শাস্ত্র জ্ঞান সম্পন্ন শুদ্ধভাব, সদাচার ও ক্ষমাদি গুণের আধার, নিয়মনিষ্ঠ, মৃদুভাষী ছিলেন। তিনি ইন্দ্রিয়দমনশীল, অসুয়াহীন এবং নিরহংকারী ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। অতিথি, সাধু ও ব্রাহ্মণদের প্রতি তার ভক্তি ছিল সীমাহীন।

একদিন পিতৃ আজ্ঞা পালনার্থে বনে গিয়ে ফল-মূল, সমিধ ও কুশ সংগ্রহ করে প্রত্যাবর্তনের

সময় পথের পাশে একজন আচারভ্রষ্ট শূদ্রকে এক দাসীর সঙ্গে মিলনরত অবস্থায় দর্শন করে।

ঐ দাসীটি তখন মৈরেয় নামক মদ্যের প্রভাবে মত্ত হয়েছিল। তার বস্তুবন্ধন শিথিল হয়ে পড়েছিল। ঐ শূদ্র তখন তার কাছে ক্রীড়া, হাস্য করে তাকে উদ্দীপ্ত করেছিল। অজামিল সেই শূদ্র কর্তৃক অঙ্গরাগলিপ্ত বাহু বেষ্টিত দেখে কামোন্মাদ হয়ে পড়ল।

নিজ ধৈর্য ও শাস্ত্র জ্ঞান অনুসারে নিজেকে সে সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করল। কিন্তু কোনোভাবেই তা করতে সমর্থ হল না। তখন সে সর্বদা ঐ দাসীর কথা মনে মনে ভাবতে লাগল। এভাবে সে নিজ ধর্মপথ থেকে বিচ্যুত হল।

ঐ দাসীকে প্রসন্ন করার জন্য সমস্ত পৈতৃক ধনসম্পত্তি এবং গ্রামে উৎপন্ন নানাবিধ ভোগ্য বস্তু উপঢৌকন দিতে লাগল। সে ঐ পাপাত্মা স্বৈরিনীর কটাক্ষতে বশীভূত হয়ে নিজ পরিণীতা মহাবংশ জাতা ব্রাহ্মণকন্যা যুবতী ভার্যাকেও পরিত্যাগ করেছিল। নীচমতি এই অজামিল তখন ন্যায়-নীতি বিসর্জন দিয়ে যেন-তেন-প্ৰকারণে ধন সংগ্রহ করত। সেই ধন দিয়ে এই দাসীরই কুটুম্বদের ভরণপোষণক করত।

যেহেতু অজামিল অশুচি, স্বেচ্ছাচরী, অতি নিন্দিত স্বভাবা, শূদ্রা নারীর অন্নরূপ অশুচি দ্রব্য ভোজন করেছিলেন, সেহেতু অজামিল পাপে লিপ্ত হয়েছিল। পূর্বে শাস্ত্রজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘকাল শাস্ত্রবিধি লঙঘন করে জীবন অতিবাহিত করেছে। কৃতপাপের কোনও প্রায়শ্চিত্তও সে করেনি।

সেজন্য এই পাপিষ্ঠকে আমরা দণ্ডধারী কৃতান্ত যমরাজের কাছে নিয়ে যাব। সেখানে যথোচিত বিচারের পরে এই পাপী অজামিলের দণ্ড বিধান হবে, যাতে সে দণ্ডভোগের পর শুদ্ধতা লাভ করতে পারে।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়
বিষ্ণুদূতগণ কর্তৃক ভগবন্নাম-মাহাত্ম্য বর্ণন ও অজামিলের মুক্তি

শ্রী শুকদেব বললেন– হে মহারাজ, ন্যায়নিষ্ঠ ঐ বিষ্ণুদূতেরা যমদূতগণের কথা শুনে অতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছিলেন। শ্রীবিষ্ণুদূতগণ বলতে লাগলেন– হায় হায়, এ কি দুঃখের কথা! ধর্মদর্শী সাধুদের সভাকে অধর্ম স্পর্শ করেছে। কারণ এই সভামধ্যে ধর্মদর্শীগণ এখন দণ্ডের অযোগ্য নিষ্পাপ ব্যক্তিদের প্রতি অকারণ দণ্ডবিধান করছে।

যে সাধুপুরুষেরা সর্বত্র সমদর্শী হয়ে প্রজাদের প্রতিপালন করেন, তারা যদি এরূপ বৈষম্য করেন, তাহলে প্রজারা কাদের চরণ গ্রহণ করবে? শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিসকলের আচরণ দেখে সাধারণ লোকও সেইমত আচরণ অনুসরণ করে থাকে। এ কি আশ্চর্য কথা! লোকে যার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে শয়ন করে, সে নিজেই ধর্মাধর্ম সম্পর্কে অবহিত নয়। প্রাণীদের পরম বিশ্বাসভাজন সেই পুরুষ যদি দয়ালু না হন, তাহলে মিত্রভাবে আত্মসমর্পিত কোনো ব্যক্তিকে তিনি কিভাবে শান্তিবিধান করতে পারেন?

এই অজামিল পাপী হলেও শ্রীহরির নাম উচ্চারণ করেছে। সেজন্য তার কোটি কোটি জন্মকৃত পাপ বিনষ্ট হয়েছে। এই হরিনাম শুধুমাত্র প্রায়শ্চিত্ত নয়, অধিকন্তু পরম স্বস্তায়ন অর্থাৎ মঙ্গলপর মোক্ষলাভের সাধন। এই ব্যক্তি পুত্রকে ভোজানাদির সময়ে স্মরণ করায়, তার ‘নারায়ণ’ নাম উচ্চারণ হয়েছে। এইরূপ আভাসেও অর্থাৎ ভগবানের নাম শুধুমাত্র উচ্চারণ করার ফলেই তার কৃত যাবতীয় পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে।

মদ্যপেয়ী, মিত্রদ্রোহী, ব্রহ্মঘাতী, গুরুপত্নীগামী, স্ত্রীহন্তা, রাজহন্তা, পিতৃহন্তা, গো-হন্তা প্রভৃতি মহাপাতকীর একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত হল ভগবান বিষ্ণুর নামোচ্চারণ।

যে কোনো ব্যক্তির জ্ঞাতসারে, অজ্ঞাতসারে, বিষ্ণুর নাম উচ্চারিত হলেই ভগবান বিষ্ণু তাকে নিজ আশ্রিত বলে মনে করেন। ভগবান শ্রীহরির নামোচ্চারিত হলে তার দ্বারা পাপী যেরূপ শুদ্ধি লাভ করে, মনু প্রভৃতি বেদবাদী ঋষিগণ কর্তৃক নির্ধারিত চান্দ্রায়ণাদি ব্রত–রূপ প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা সেরকম শুদ্ধি লাভ সম্ভব নয়।

কৃচ্ছ চান্দ্রায়ণাদি প্রায়শ্চিত্ত শুধুমাত্র পাপক্ষয়টুকুই করায়, কিন্তু এই নামোচ্চারণ পাপনাশ ভিন্ন ভগবান শ্রীহরির গুণাবলীর উপলব্ধি করায়, এটাই এর পরম বৈশিষ্ট্য। চান্দ্রায়ণ প্রভৃতি প্রায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠানের পরেও যদি মন আবার অসৎ পথে ধাবিত হয়, তাহলে তাহা ঐকান্তিক পাপশোধক বলে গণ্য হতে পারে না।

যে সকল ব্যক্তি পাপের আত্যন্তিক ক্ষয়ের ইচ্ছা করেন তাদের পক্ষে শ্রীহরির গুণকীর্তন অপেক্ষা উন্নততর প্রায়শ্চিত্ত কিছু হতে পারেন না। যেহেতু এই ব্যক্তি অজ্ঞান অবস্থায় ভগবানের নাম সম্যকরূপে গ্রহণ করেছিলেন, সেহেতু এর সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে, একে তোমরা নরকে নিয়ে যেও না।

অজামিলের মৃত্যুর সময়ে সে নিজের পুত্র নারায়ণকে ডেকেছিল, অর্থাৎ সাক্ষাৎ ভগবানকে স্মরণ করেনি। কিন্তু, এই নামের মাহাত্ম্য এমন যে, পুত্রাদির সঙ্কেতেই হোক বা পরিহাসে বা নিতান্ত অবহেলাতেই হোক, তা উচ্চারণ করলেই অশেষ পাপ দূরীভূত হয়।

উচ্চ স্থান থেকে পতনের সময়, পথ মধ্যে স্থলন হলে, জুরাদি পীড়ায় সন্তপ্ত বা দণ্ডাদির দ্বারা আহত হয়েও যদি কোনও ব্যক্তি হরি নাম উচ্চারণ করে, তার নরকবাস থেকে মুক্তি হয়।

মনু প্রভৃতি মহর্ষিগণ বিচার পূর্বক গুরুপাপের গুরু প্রায়শ্চিত্ত এবং লঘু পাপের জন্য লঘু প্রায়শ্চিত্ত বর্ণনা করেছেন কিন্তু ভগবানের নাম সম্পর্কে এরূপ বিচার করা হয়নি, কারণ তার নাম উচ্চারণমাত্রই সকল পাপের বিনাশ হয়।

শাস্ত্রোক্ত বিভিন্ন তপস্যা, দান, ব্রত প্রভৃতি দ্বারা শুধুমাত্র বিভিন্ন পাপেরই ক্ষয় হয়, কিন্তু পাপকর্তার পাপজনিত চিত্তের মলিন্য নষ্ট হয় না। কিন্তু ভগবানের পদ সেবার দ্বারা অর্থাৎ তার নাম সংকীর্তনের দ্বারা চিত্তের মালিন্য মুক্তি ঘটে।

অগ্নি যেমন বালকাদির দ্বারা কাষ্ঠরাশির মধ্যে অজ্ঞানতাবশত নিক্ষিপ্ত হলেও নিঃশেষ ভাবে কাষ্ঠরাশি দগ্ধ করে, সেরূপ জ্ঞানতঃ বা অজ্ঞানতঃ যে কোনোভাবেই ভগবানের নাম সংকীর্তন করলে, তা মানুষের পাপ নিঃশেষে দগ্ধ করে।

এ ব্যক্তি কোনো ভগবদ্ভক্ত সাধুর কাছে উপদেশ প্রাপ্ত হয়নি, এমনকী শ্ৰদ্ধাসহকারে ভগবানের নামও উচ্চারণ করেনি, তাই এই অজামিলের কোনও প্রায়শ্চিত্ত হয়নি, এরূপ আশঙ্কা অমূলক।

কারণ, যখন কোনো অজ্ঞান ব্যক্তি কিছু না জেনেও কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছ থেকে ওষুধ সেবন করে, এবং ওষুধ তার নিজগুণ প্রকাশ করে। তেমনি ভগবানের নামও যেভাবে হোক যদি গ্রহণ করা হয়, তবে তা নিজের কার্য অবশ্যই করে।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– মহারাজ, বিষ্ণুদূতগণ, এরূপ সুন্দরভাবে ভাগবত ধর্ম নিরূপণ করে, অজামিলকে যমদূতগণের পাশমুক্ত করলেন।

হে অরিন্দম, যমদূতেরা এভাবে নিরাকৃত হয়ে যমরাজের কাছে গিয়ে যথার্থভাবে সমস্ত বৃন্তান্ত বর্ণনা করল।

এদিকে পাশবন্ধন মুক্ত হয়ে অজামিল নির্ভয় ও প্রকৃতিস্থ হয়ে বিষ্ণুদূতগণকে দর্শন করল। সে অতিশয় আনন্দিত হয়ে অবনত মস্তকে তাদের প্রণাম করল।

হে অনঘ, অজামিল কিছু বলতে ইচ্ছুক, এটা বুঝতে পেরে বিষ্ণুদূতগণ তখনি সেখান থেকে অন্তর্ধান করলেন। অজামিল যমদূত কথিত বেদত্রয়ের প্রতিপাদ্য সগুণ ধর্ম ও বিষ্ণুদূত কথিত বিশুদ্ধ ভাগবত ধর্ম কথা শ্রবণ করে, ভগবানে অতিশয় ভক্তিমান হল।

নিজের পূর্বকৃত অশুভ কর্ম কথা স্মরণ করে অতিশয় অনুতাপ করতে লাগল। সে খেদ করতে লাগল এই বলে যে হায় হায়! ইন্দ্রিয় জয় করতে না পারায় আমার এই কষ্ট।

শুদ্রার গর্ভে পুত্রের জন্ম দিয়ে আমি নিজের ব্রাহ্মণত্ব বিসর্জন দিয়েছি। আমি যুবতী সতী ভার্যাকে পরিত্যাগ করে, মদ্যপায়িনী অসতী শূদ্রার সঙ্গ করেছি। আমি কুলাঙ্গার, আমাকে ধিক্। আমার পিতা –মাতা, অতি বৃদ্ধ অবস্থায় যখন, একমাত্র আমার উপরেই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলেন। আমি অতি অকৃতজ্ঞের মতো তাদের পরিত্যাগ করেছি।

আমার মতো ঘোরতর পাপাত্মার নরকবাস অনিবার্য। কিন্তু, এখন কি আমি স্বপ্ন দেখছি? নাকি জাগ্রত অবস্থায় এমন অদ্ভুত ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম? যারা, পাশহস্তে আমাকে আকর্ষণ করছিল, তারা এখন কোথায় গেল?

হঠাৎ যাঁরা এসে আমাকে সেই পাশবন্ধন থেকে মুক্ত করলেন, সেই চারজন মনোহর দর্শন সিদ্ধপুরুষগণই বা কোথায় গেলেন?

আমি এ জন্মে দুর্ভাগা পাপত্মা হলেও বোধহয় পূর্বজন্মের কোনও সুকৃতিবলে ঐ শ্রেষ্ঠ দেবগণের দর্শন লাভ করতে পেরেছি। সেজন্যই আমার আত্মা আজ প্রসন্নতা অনুভব করেছে। নতুবা, শূদ্রা নারীর পতি হয়ে অশুদ্ধচিত্ত এই আমি কখনও হরিনাম উচ্চারণে সমর্থ হতাম না। কোথায় আমি কিতব (বঞ্চক) নির্লজ্জ, পাপী, বিপ্রত্বনাশক।

ভগবানের পরম মঙ্গলময় এই ‘নারায়ণ’–এই নামটিই বা কোথায়? পূর্বজন্মকৃত কোনও পুণ্য থাকলে, এই নাম কি এখনও আমার মুখ থেকে উচ্চারিত হতে পারে?

যা হোক, আমি এখন থেকে মন, ইন্দ্রিয়সকল ও প্রাণবায়ুকে এভাবে সংযত করার চেষ্টা করব। তাহলে আত্মাকে আবার অন্ধকারময় ঘোর নরকে নিক্ষিপ্ত হতে হবে না।

এক্ষণে আমি অবিদ্যামূলক, কাজকর্মজনিত এই বন্ধন মুক্ত করে সকল প্রাণীর সুহৃৎ, শান্ত, মিত্রভাবাপন্ন, দয়ালু ও স্থিরচিত্ত হব, এবং এতকাল যে মায়া নীচমতি আমাকে যথেচ্ছভাবে খেলা করিয়েছে, আমি নিজেকে তার প্রভাব থেকে মুক্ত করব। এখন থেকে আমি শুধু, ‘আমি’ ‘আমার’ ইত্যাদি দেহে আত্মবুদ্ধি ত্যাগ করে ভগবানের নাম কীর্তনাদি দ্বারা শুদ্ধিপ্রাপ্ত চিত্তকে ভগবানেই ধারণ করব। অর্থাৎ নিরন্তর তারই ধ্যানে নিযুক্ত থাকব।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে রাজন, মাত্র ক্ষণকালের সাধুসঙ্গের কারণেই অজামিলের এরূপ সুন্দর নির্বেদ জন্মাল। তারপরে, তিনি পুত্ৰাদি স্নেহরূপ সকল বন্ধন মুক্ত করে হরিদ্বারে গমন করলেন। তিনি সেই দেবভূমিতে উপবেশন পূর্বক যোগমার্গ অবলম্বন করে ইন্দ্রিয়াদি সকল বিষয় থেকে নিবৃত্ত করে, নিজের মনকে আত্মার সঙ্গে সংযুক্ত করলেন।

তারপরে দেহ ও ইন্দ্রিয়াদির সম্বন্ধ থেকে আত্মাকে পৃথক করে চিত্তের একাগ্রতা দ্বারা জ্ঞানময় পরম ব্রহ্মরূপ ভগবানে সংযোজিত করলেন।

যে সময়ে তার চিত্ত ভগবানের সেই স্বরূপে নিশ্চল হল, তখনই তিনি সামনে চারজন দণ্ডায়মান ব্যক্তির দর্শন লাভ করলেন। পূর্বে দৃষ্ট চারজন বিষ্ণুদূত হলেন ওই চার ব্যক্তি। তৎক্ষণাৎ তিনি তাদের অবনত হয়ে বন্দনা করলেন, তাঁদের দর্শনের পরেই অজামিল গঙ্গাতীর্থে দেহত্যাগ করলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি ভবিষ্যত পার্ষদগণের স্বরূপ ধারণ করলেন। তাদের সঙ্গে সুবর্ণময় বিমানে আরোহন-পূর্বক আকাশপথে-যেখানে নারায়ণ বিরাজমান, সেই বৈকুণ্ঠলোকে গমন করলেন।

হে মহারাজ, এভাবে সর্বপ্রকার ব্রাহ্মণ্যধর্মের ধ্বংসকারী, সদব্রতত্যাগী পাপকর্মহেতু পতিত দাসীপতি আজমিল নরকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার উপক্রমে ভগবানের নাম উচ্চারণ করায়, তখনি পাপমুক্ত হয়েছিল।

মুমূর্ষ ব্যক্তিদের পক্ষে তীর্থপদ (অর্থাৎ যাঁর পাদপদ্ম থেকে গঙ্গাদেবীর উত্থান হয়েছে। সেই ভগবানের নামকীর্তন অপেক্ষা শ্রেয় কর্মবন্ধন ছেদক আর কিছুর অস্তিত্ব নেই।

নাম-সংকীর্তনা দিতে আসক্ত পুরুষের চিত্ত– একান্তভাবে নির্মল হয়, আর পাপ কমে আসক্ত হয় না।

এছাড়া অন্যান্য প্রায়শ্চিত্ত সমূহের পরেও মন রজঃ ও তমঃ গুণের দ্বারা মলিন হয়ে থাকে।

হে রাজন, যে ব্যক্তি পরম গুহ্য, পাপনাশক এই ইতিহাস শ্রদ্ধা সহকারে শ্রবণ করবেন, তিনি কখনই নরকে পতিত হন না। একইরকম সৌভাগ্য যে ব্যক্তিরও হয়ে থাকে, যিনি ভক্তি সহকারে এই কথামৃত কীর্তন করেন।

অধিকন্তু যমদুতেরা তার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপও করে না, সে ব্যক্তি যদি অতিশয় পাপিষ্ঠ হয়, তাহলেও সে বিষ্ণুলোকে পূজিত হয়ে থাকে। অতিশয় পাপাত্মা অজামিল স্রিয়মান অবস্থায় পুত্রের নাম গ্রহণের কারণে গৌণভাবে শ্রীহরির নাম উচ্চারণ করায় বৈকুণ্ঠধামে গমন করেছিলেন।

তাহলে, যখন কোনো ব্যক্তি শ্রদ্ধাসহকারে শ্রী ভগবানের নাম গ্রহণ করেন, ভগবৎ ধাম লাভের বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

.

তৃতীয় অধ্যায়

রাজা পরীক্ষিতের প্রশ্ন শুনে শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে মহারাজ, বিষ্ণুদূতেরা যম কিঙ্করদের কর্তব্যকাজে বাধা দান করেছিল কীভাবে, সেই বৃত্তান্ত ধর্মরাজ যমকে তারা শুনিয়েছিল।

যমকিঙ্করগণ বলল- হে প্রভু। মানুষ কায়িক, বাঁচিক ও মানসিক ব্যাপারের দ্বারা কর্ম নিষ্পন্ন করে থাকে। তাদের কর্মফল প্রদাতা যদি অসংখ্য জন হয়ে থাকে তাহলে বিরোধ বাঁধতে পারে। যদি সকলের মতের মধ্যে ঐক্য থাকে, তাহলে সকল জীবই উভয়ের মত অনুযায়ী সুখ ও দুঃখ ভোগ করতে পারে। একজন মুখ্য শাসক, আর সকলে গৌণ শাসক।

শাসনকর্তার বহুত্ত্ব ঘটে না। তাই আপনিই আমাদের কাছে একমাত্র প্রাণীসমূহের অধীশ্বর। আমরা জানতাম, আপনি যা দণ্ড বিধান দেন, তাই-ই প্রথম ও শেষ কথা। কিন্তু আপনার বিহিত দণ্ড চারজন সিদ্ধ পুরুষ এসে লঙঘন করে গেলেন।

আপনার আদেশমতো একজন পাপাত্মাকে নরকে নিয়ে যাবার পথে বাধা পেলাম। হঠাৎ তারা এসে পাশবন্ধন ছিন্ন করে পাতকীকে মুক্ত করে দেন। পাপী ‘নারায়ণ’ শব্দ উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা ‘মাভৈঃ’ বলে সেখানে হাজির হয়েছিলেন। প্রভু, তাদের পরিচয় আপনি আমাদের বলবেন কি?

যম বললেন– হে কিঙ্করগণ! আমি ছাড়া এই স্থাবর জঙ্গম বিশ্বে আর এক শাসন কর্তা আছেন। আমি তাঁরই দাস পাপীদের ঈশ্বর তিনিই এই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের অধিষ্ঠাতা। তোক যেমন পৃথক পৃথক রঞ্জু দ্বারা আবদ্ধ বলীবদগণকে একটি বৃহৎ রজ্জুতে আবদ্ধ করে, তেমনই পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ ব্রাহ্মণাদি নাম দ্বারা বেদবাক্য স্বরূপ নিজ সূত্রে লোক সকলকে আবদ্ধ করেছেন। তিনি অদৃশ্য তিনি সাকার ও নিরাকার। সমস্ত দেবতাগণ, মরুদগণ, রুদ্রগণ, সিদ্ধগণ যাঁকে চোখে দেখতে পান না। তিনি আমার সামনেও দৃশ্য হন না, তিনি সকলের প্রভু, সর্বোৎকৃষ্ট।

যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা ভগবান শ্রীহরির দূত, তাঁরই মতো রূপ, গুণ ও স্বভাববিশিষ্ট, তারা বিষ্ণু ভক্তদের সর্বদা রক্ষা করে থাকেন। যে ধর্মতত্ত্ব অবগত হয়ে জীব অমৃতপাদ লাভ করে সেই বিশুদ্ধ ও দুর্বোধ্য ভাগবত ধর্ম আমি জানি। ভগবানের নাম কীর্তনের মাধ্যমে তার প্রতি যে ভক্তিযোগের উদয় হয়, তাই হল পুরুষদের উৎকৃষ্ট ধর্ম। ভগবানের নামের মহিমা অপার। ওই নাম স্মরণ করে মহাপাপী অজামিলও মৃত্যুপাশ থেকে মুক্তি পেয়েছিল।

ভগবানের নাম স্মরণ মাত্র অশেষ কলুষ, পাপক্ষয় হয়, তবুও দ্বাদশ বার্ষিক ইত্যাদি ব্রহ্মাদি প্রভৃতি দ্বাদশ মহাপুরুষ ছাড়া সাধারণত অন্য কোনো মহাজনও শ্রীভগবানের নাম সংকীর্তনাদি রূপ এই পরম ধর্মের তত্ত্ব অবগত হতে পারেননি। তাই ওই সমস্ত মহাজনগণ ভগবানের দেবী মায়ায় অতি মাত্রায় আকৃষ্ট হয়েছিল। তাদের আমি কখনোই দণ্ড দিতে পারি না, যদি কখনও কোনো পাপ করে থাকে, তা ভগবানের নামকীর্তনে খণ্ডন হয়।

হে দূতগণ, যারা কখনও ভগবানের নাম উচ্চারণ করে না, সে লোকের চিত্তে তাঁর পদচিহ্ন আঁকা হয় না। যে তার উদ্দেশ্যে প্রণাম করে না। যারা হরিসেবাকে উপহাস করে সেই পাপীদের আমার কাছে নিয়ে আসবে।

যমরাজ এবার ভগবানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন–হে পুরাণ পুরুষ ভগবান নারায়ণ, আপনি সর্বজ্ঞ, অতি মহান। আমার অনুচররা যে অন্যায় কাজ করেছে, তার জন্য আপনার কাছে মাথা নত হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করছি। আপনি আমার প্রণাম গ্রহণ করুন।

শ্রীশুকদেব এবার রাজা পরীক্ষিতের উদ্দেশ্যে বললেন–হে রাজন, বিষ্ণু নাম মঙ্গলদায়ক, এই নাম স্মরণে চিত্তে শুদ্ধি ঘটে। তার সেই শ্রীপাদপদ্মের অমৃত যে একবার আস্বাদন করেছে, সে ভোগ্য ও মোক্ষ লাভ করে, আর যে হরিপ্রেমে বিমুখ সে হল পাপী।

হে মহারাজ, মলয় পর্বতে ঋষি অগস্ত্যের কাছ থেকে আমি এই উপাখ্যান শুনেছিলাম। তাই বলব, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সন্দেহ প্রকাশের কোনও কারণ নেই।

পুরাণবক্তা সূত শৌণকাদি মুনিগণকে সম্বোধন করে বললেন–হে মহর্ষিগণ, শ্ৰী শুকদেব স্বয়ম্ভব মন্বন্তরে দেব, দৈত্য, নর, নাগ, পক্ষী, ইত্যাদি সৃষ্টির ব্যাপারে রাজা পরীক্ষিত যে উপাখ্যান সংক্ষেপে বিবৃত করেছিলেন তা তোমরা শ্রবণ করো।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–প্রাচীন বহির প্রচেতা নামক দশজন পুত্র সমুদ্রগর্ভ থেকে উত্থিত হয়ে এই বসুন্ধরাকে বৃক্ষরাজিতে আবৃত দেখলেন। তখনই ক্রোধের জন্ম হল। তিনি মুখ থেকে বায়ু ও অগ্নির সৃষ্টি করে বৃক্ষরাজি ধ্বংস করে দিতে চাইলেন। বনস্পতিগণের রাজা চন্দ্রদেব প্রচেতাগণের ক্রোধের উপশম ঘটিয়ে বললেন– হে প্রচেতাগণ, তোমরা উদ্দীপ্ত ক্রোধ দমন করো, চোখের পাতা যেমন চোখের বন্ধু জ্ঞানী পণ্ডিত অজ্ঞজনের বন্ধু তেমনই প্রজাগণের জীবিকাস্বরূপ এইসব বৃক্ষদের বিনাশ ঘটানো উচিত নয়। ভগবান শ্রীহরিই নানা রকমের গাছপালা ও ধান্য শস্যাদি প্রজাগণের ভক্ষ অন্নরূপে সৃষ্টি করেছেন। সমস্ত প্রাণীর চিত্তে ভগবান শ্রীহরির অবস্থান। এই বিশ্বচরাচর তাঁরই আবাস স্বরূপ। তোমরা ধ্বংস বন্ধ করে প্রজাদের মঙ্গল সাধন করো। এই সুন্দরী কন্যাটিকে তোমরা গ্রহণ করো। এর নাম মারীয়া। বৃক্ষ সকল দ্বারা সে প্রতিপালিত হয়েছে।

এইভাবে ক্রোধকে সান্তনা দান করে সোমদেব ফিরে গেলেন নিজের বাসভবনে। প্রচেতাগণের ঔরসে সেই কন্যার গর্ভে প্রচেতস নামে দক্ষের জন্ম হল। এই দক্ষের মাধ্যমেই প্রজাগণ সৃষ্টি হয়েছে এবং সারা বিশ্বে তারা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রজাপতি দক্ষের মন থেকে সৃষ্টি হয় দেব, দৈত্য, মানুষ, খেচর, ভূচর ও জলচর জীবরা। তারপর তিনি প্রজা সৃষ্টি রহিত হতে দেখে চিন্তিত হলেন। বিন্ধ্য পর্বতের কাছে একটি ক্ষুদ্র পর্বতে গিয়ে তিনি ধ্যানে বসলেন। হংসগুহা মন্ত্র উচ্চারণ করে শ্রীহরির প্রশস্তি গাইলেন– যিনি জীব ও মায়ার নিয়ামক, অসীম, স্বয়ংসিদ্ধ স্বপ্রকাশক, সেই পরমাত্মা চিৎশক্তিকে আমি প্রণাম করি। জীব যে সর্বজ্ঞ পুরুষকে জানতে পারে না, কেবল তার মূল গুণ সমূহ অবগত হতে পারে, আমি সেই ভগবান অনন্তদেবের চরণ বন্দনা করি, স্বরূপের জ্ঞানের দ্বারা যাঁর প্রতীতি হয় এবং যিনি বিশুদ্ধ চিত্তস্বরূপ, আমি সেই যথার্থ গুরুকে প্রণাম জানাই। অনন্ত বৈচিত্রময়ী মায়ার নিরাসহেতু নির্বাণ সুখের উদয়ে যাঁর অনুভব হয়, যিনি সকল নাম ও সকল রূপের আশ্রয়, তিনি আমার প্রতি তুষ্ট হোন। যিনি সকল কারণের কারণস্বরূপ, যাঁর ঐশ্বর্য অচিন্তনীয়, যিনি নাম ও জপ বর্জিত হয়েও তার চরণযুগল আশ্রয়কারী ভক্তগণের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশের জন্য নানারূপে ও নানা নামে আবির্ভূত হন, সেই পরমাত্মা আমার মনোবাসনা পূর্ণ করুন।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– প্রজাপতি দক্ষের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে স্বয়ং ভগবান সেখানে এসে হাজির হলেন। তিনি গরুড়ের পিঠে উপবেশন করে আছেন। তাঁর আজানুলম্বিত আটটি বাহু, তিনি শঙ্খ, চক্র, গদা, অসি, চর্ম, ধনু, বাণ ও পাশধারী। তার বুকে শ্রীবৎস চিহ্ন আঁকা, মাথায় মণিমানিক্য খচিত কিরীট, গলায় বনমালা হাঁটুর নীচে পর্যন্ত নেমেছে। তিনি মহা মূল্যবান অলংকারে সজ্জিত। নারদ ও নন্দী তাঁর দুপাশে রয়েছে। লোকপালগণ ও সিদ্ধচারণগণ তাঁর মহিমা কীর্তন করছেন।

প্রজাপতি দক্ষ ভগবান জনার্দনের চরণে মাথা রাখলেন। তাঁর অনুগ্রহে তিনি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলেন। ভগবান বললেন– হে প্রজানাথ, প্রাণী সকলের উদ্ভবের কারণে ব্রহ্মা শিবাদ্রি মনুগণ প্রভৃতির সৃষ্টি আমিই করেছি। প্রজাগণের সকল সম্পদ তুমি বৃদ্ধি করো। তপস্যা আমার হৃদয় বিদ্যা আমার দেহ, ধ্যানাদি বিষয়ক ক্রিয়াকর্ম আমার আকৃতি, যাগযজ্ঞ আমার অঙ্গ, আমার মন হল ধর্ম আর যজ্ঞ ভোক্তা, দেবগণ আমার প্রাণ। হে দক্ষ, সৃষ্টির পূর্বে এ জগতের সর্বত্র অন্ধকারে ঢাকা ছিল। কেবল আমি ছাড়া আর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সৃষ্টির কারণে আমার অংশজাত ব্রহ্মার উৎপত্তি ঘটে। আমারই আজ্ঞায় ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা। কঠোর করে তিনি তোমাদের মতো নয়জন বিশ্বস্রষ্টাকে সৃষ্টি করলেন। তুমি পঞ্চজন নামক প্রজাপতির অসিল্লি নামের কন্যাকে পত্নী রূপে গ্রহণ কর। স্ত্রী পুরুষের মিলনে পৃথিবীতে প্রজার সংখ্যা বৃদ্ধি হবে।

এই কথা বলে শ্রীভগবান সেখান থেকে অদৃশ্য হলেন।

.

চতুর্থ অধ্যায়

শুকদেব বললেন– প্রজাপতি দক্ষের ঔরসে অসিক্লির গর্ভে হ্যাঁশ্বাদি অযুত পুত্র জন্ম লাভ করল। পিতা প্রজা সৃষ্টির কথা বললে তারা পুণ্যদায়ক মহাতীর্থ নারায়ণ সরোবরের তীরে এসে হাজির হলেন। এই তীর্থের জলে স্নান ও আচমনাদি করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চিত্ত থেকে লোভ, ক্রোধ, বিভিন্ন দোষ দূর হলো। পরমহংস ধর্মে মতি হলেও তারা পিতার আদেশে নিয়ন্ত্রিত হয়ে উগ্র তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন।

এসময় সেখানে দেবর্ষি নারদ এসে হাজির হলেন। তিনি বললেন– তোমরা শুদ্ধান্তঃকরণ হয়েও প্রজাসৃষ্টির জন্য তপস্যা করছ কেন? পৃথিবীর অন্ত কী জানা আছে? তোমাদের সর্বজ্ঞ পিতার কার্য কী? এসব প্রশ্নের জবাব জানা না থাকলে কখনোই সৃষ্টি কাজ শুরু করা ঠিক নয়।

হর্ষাদি দেবর্ষি নারদের কটু বাক্য শুনে সহজ বিচার শক্তি সম্পন্ন বুদ্ধির দ্বারা নিজেরাই বিচার করেছিলেন– ভূমির অন্ত না জেনে অর্থাৎ যা জীবসংজ্ঞক এই লিঙ্গ শরীর, যা আত্মার বন্ধনের কারণ, তাই ভূমি বা ক্ষেত্র, তার অন্ত না জেনে অর্থাৎ বিনাশ দর্শন না করে মোক্ষের অনুপযোগী অসৎ কর্মসকল করলে কোনো অভীষ্ট সিদ্ধ হবে না। এক পুরুষ বলতে সেই সর্বসাক্ষী ভগবান পরমেশ্বরের কথা বলা হয়েছে।

যা হতে কখনও কাকেও নির্গত হতে দেখা যায় না, সেরূপ বিল না দেখে– অর্থাৎ পুরুষ যেখানে গমন করলে আবার ফিরে আসতে পারে না, তা পরম জ্যোতি স্বরূপ ব্রহ্ম।

পুংশ্চলীর পতি সেই পুরুষ, অর্থাৎ পূর্বোক্ত বুদ্ধির সঙ্গবশত শুভাৰ্যযুক্ত ব্যক্তির ন্যায় যার স্বাতন্ত্র লোপ পেয়েছে এবং যে জীব সেই বুদ্ধির সুখ– দুঃখাদিকে নিজের বলে মনে করে, তাই হল জীব। সেই জীবতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ না করে এই অবিবেচনামূলক কর্মসমূহ কোন কাজে লাগবে। সৃষ্টির সংহার কারিনী মায়াই উভয় তীর বাহিনী নদী। যে পুরুষ সাধনার দ্বারা সংসার তরঙ্গকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়, সে মায়ানদী রূপ ক্রোধ, অহংকার ইত্যাদি খাড়া করে বাঁধা দানের চেষ্টা করে। নদীর তত্ত্ব যে জানে না, সে মায়িক কর্ম সমূহ দিয়ে কী করবে। যিনি পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের আশ্চর্য আশ্রয় যিনি কার্য-কারণ সংঘাতের অধিষ্ঠাতা, যিনি সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত প্রকৃতি যিনি প্রকৃতি জাত পদার্থসমূহ এবং জীব তাকে না অবগত হলে, এই সমস্ত কর্ম কোন কাজে লাগবে?

বিচিত্রকথা যুক্ত হংস অর্থাৎ ঈশ্বর প্রতিপাদক শাস্ত্রে চিৎ ও জড় রূপ বিশেষভাবে বিবেচিত হয়েছে। তাই তা হংসস্বরূপ এই শাস্ত্র না জেনে বহির্মুখ কর্মে কী লাভ? ক্ষুর ও বজ্ৰাদি দ্বারা নির্মিত স্বয়ং ভ্রমণশীল অর্থাৎ ক্ষুর ও বজ্রের ন্যায় তীক্ষ্ণ ও সর্বদা ভ্ৰমরি হয়ে কালক্র সমস্ত জগৎকে সংহার করে। এই কালনাশা জগতের অনিত্যতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন না করে এই সব তপস্যার কী প্রয়োজন?

তাছাড়া নারদ বলেছেন, স্বীয় পিতার অনুরূপ আদেশ সম্পর্কে অবগত না হয়ে সৃষ্টি করা কী সম্ভব? অর্থাৎ শাস্ত্র আমাদের পিতাস্বরূপ, তার আদেশ নিবর্তক। এই নিবর্তক আদেশ না জানলে সৃষ্টাদি কার্য কীভাবে করা সম্ভব?

নারদের বাক্য বিশ্লেষণ করে দক্ষপুত্রগণ খুশি মনে দেবর্ষিকে প্রণাম করলেন। তারপর তারা শোনমার্গের পথে যাত্রা করলেন। নারদের কাছ থেকে প্রজাপতি দক্ষ এ সংবাদ শুনে আক্ষেপ করে বললেন– সৎপুত্র লাভই শোকের কারণ। তিনি আবার সৃষ্টির কাজে প্রবৃত্ত হলেন। পাঞ্চজনীর গর্ভে সবলাশ্ব নামে এক হাজার পুত্রের জন্ম হল। পিতা তাদের প্রজাসৃষ্টির আদেশ দিলেন।

তারা নারায়ণ সরোবরে গেলেন। সরোবরের পুণ্যদায়ক জল স্পর্শ করা মাত্র তাদের সমস্ত পাপের বিনাশ হল। তারা কঠোর তপস্যা করলেন। সেখানে আগের ন্যায় দেবর্ষি নারদ এসে হাজির হলেন। এবং একই কটু বাক্য শোনালেন। তিনি বললেন– নিজেদের জৈষ্ঠ্য ভাইদের পদাঙ্ক যারা অনুসরণ করে তার হয় ধর্মজ্ঞ। পুণ্য হয় তাদের পরম বন্ধু। মহর্ষি নারদ সেখান থেকে চলে গেলেন। তাঁর অমোঘ দর্শনের ফলে দক্ষের সহস্র, পুত্রের মধ্যে ভাবান্তর ঘটে গেল। তাঁরা অগ্রজদের পথের পথিক হলেন।

চিত্তের অন্তর্মুখী বৃত্তি দ্বারা যা লাভ করা যায় এবং যা সংসারের একমাত্র প্রকৃষ্ট পথ, সেপথ থেকে দক্ষপুত্রগণ আর ফিরে আসেননি। প্রজাপতি দক্ষ যোগবলে সমস্ত কিছু অবগত হলেন। পুত্রদের স্বধর্ম দূত করার যন্ত্রণা দানের জন্য নারদের ওপর ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি তিরস্কার করে বললেন– হে অসাধো, তুমি আমার পুত্রদের স্বধর্ম ত্যাগ করার প্ররোচনা দিয়েছ। তোমার বাজে উপদেশ শুনে তারা মোক্ষ লাভের পথে অগ্রসর হয়েছে। তুমি দয়ামায়াহীন বালকদের পুত্রোৎপাদনদি ধর্মবিষয়ের বুদ্ধি নষ্ট করে দিয়েছ। তুমি শ্রীহরি ভগবানের যশ নাশ করছ। তুমি কী করে তার মুখ্য পার্ষদে পরিণত হলে? তুমি নির্লজ্জ? তাই লোকের সৌহার্দ বিনষ্ট করা এবং নির্বোধ লোকের প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন করে, তুমি কি জানো বৈরাগ্য ছাড়া উপশম হয় না। আর উপসম না হলে স্নেহ পাশ ছেদনই বা কী ভাবে সম্ভব? হে বংশনাশক মুখ, তোমাকে একবার আমি ক্ষমা করেছি। কিন্তু আর নয়, তোমাকে আমি অভিশাপ দিচ্ছি, তুমি কখনও কোথাও স্থিতি হবে না, চক্রের মতো কেবল তুমি ভ্রমণরত থাকবে।

মহর্ষি নারদ ‘তথাস্তু’ বলে এই অভিশাপ মাথা পেতে গ্রহণ করলেন।

.

পঞ্চম অধ্যায়

শুকদেব বললেন– পদ্মযোনি ব্রহ্মার অনুনয়ে প্রচেতাপুত্র দক্ষ পত্নী অসিক্লীর গর্ভে ষাটটি কন্যার জন্ম দিলেন। কন্যাদের মধ্যে দশটি ধর্মকে, তেরোটি কশ্যপকে, সাতাশটি চন্দ্রকে এবং ভূত,অঙ্গিরা ও কৃশাশ্ব নামক তিন মুনিকে দুটি করে এবং কশ্যপ তাকে চারটি কন্যা দান করলেন। ভানু, লম্বা, মামি, কুকুদ বিশ্বা, সাধ্যা, বসু, মুহূর্তা, মরুতৃতী এবং সংকল্পা–দশ ধর্মপত্নী।

দক্ষকন্যাদের সন্তান পরম্পরা ত্রিভুবন পরিপূর্ণ হয়েছেন। ভানুর পুত্র ঋষভ, তার পুত্র ইন্দ্রসেন। বিদ্যোত হলেন লম্বার পুত্র। তিনি মেঘগণের জন্মদাতা, স্বর্গর মামা, মামি এবং নন্দির পিতা স্বর্গ। সঙ্কটের মাতা কুকুদ, সঙ্কটের পুত্র কীট, পৃথিবী, দুর্গাভিমানী দেবতাগণের যিনি জন্ম দিয়েছিলেন, বিশ্বার পুত্রদের বিশ্বদেবগণ বলা হয়, সাধ্যার পুত্র সাধ্যগণ, তাদের পুত্র অর্থসিদ্ধি। বসুর পুত্ররা

অষ্টবসু নামে বিখ্যাত– দ্রোণ, প্রাণ, ধ্রুব, অর্ক, অগ্নি, দোষ, বাস্তু এবং বিভাবসু। দ্রোণপত্নী অভিমতির পুত্র হর্ষ শোক, ভয় ইত্যাদি। প্রাণভার্য্যা উর্ণস্বতীর পুত্র সহ, আয়ু ও পুরোজব। দ্রবের পত্নী ধরণী বিভিন্ন জুরীসমূহ অর্থাৎ পুরাভিমানী দেবতাদের জন্মদাত্রী।

অর্কের পত্নী বাসনা তর্ষ অর্থাৎ অভিলায়াদি পুত্রদের জন্ম দেন। অগ্নিবসুর স্ত্রী ধারার গর্ভে দ্রবিনক প্রভৃতি বহু পুত্র এবং নকন্দের জন্ম দিয়ে ছিলেন। দোষাসুর পত্নী শর্বরী শিশুমার জন্ম দিয়েছিলেন, যিনি ভগবান শ্রীহরির অংশ জাত। অঙ্গিরসী হলেন বাস্তু বসুর পত্নী। তাঁদের পুত্র বিশ্বকর্মা দেবশিল্পী নামে বিদিত।

বিভাবসুর স্ত্রী ঊষার গর্ভ হতে। রুষ্ট রোচিষ ও আতপ নামে তিন পুত্র ভূমিষ্ঠ হয়। ধর্মপত্নী মুহূর্তকালের অধিষ্ঠাত্রী। দেবতাগণের জন্ম দিয়েছিলেন। মরুস্থান ও জয়ন্ত নামে মরুত্বতীর দুই পুত্র। বাসুদেবের অংশে জয়ন্ত সৃষ্ট, তাই তিনি উপেন্দ্র। সংকল্পার গর্ভজাত পুত্ৰ সংকল্প কামের উৎপত্তি করে।

।হে রাজন, কশ্যপ প্রজাপতির তেরোজন পত্নী– অদিতি, দিতি, দপু, সষ্ট্রা, অকিষ্টা, ইলা, সুরগ, মুনি, বেগবধশা, তাম্ৰা, তিমি, সুরভি এবং সবর্মা। সরমা হিংস্র জন্তুগণের মাতা। তিনি জলজন্তু দেব সুরভি, গোরুমোষ ইত্যাদি দুইক্ষুর বিশিষ্ট জন্তু, তাম্ৰাশ্যেন, গৃধ্র প্রভৃতি হিঙ্গ মুনি অপ্সরাদের ক্রোধবশত দশুক প্রভৃতি সাদের ইলা বৃক্ষলতাদি, সুরমা রাক্ষসদেব, অরিষ্ঠা গন্ধবদের এবং কাষ্টা একক্ষুর বিশিষ্ট জন্তুদের মাতা।

কশ্যপ পত্নী দুপুর একষট্টিটি সন্তানের মধ্যে দ্বিসুধা, শম্বর, অরিষ্ট, হয় গ্রীব, বিভাবসু, অয়োসুখ, শঙ্কুশিরা, স্বভানু, কপিল, অরুণ, পুলোমা, বৃষপূর্বা একচক্র, অনুতাপন, ধ্রুমুকেশ, বিরূপাক্ষ, বিপ্রচিত্ত ও দুর্জয় প্রধান। পুলোমা ও কালকা দানবকন্যা হলেও ব্রহ্মার আজ্ঞায় কশ্যপ তাদের পত্নীরূপে গ্রহণ করেন। পুলোমার পুত্র পৌলোশ এবং কালকার পুত্র কালকেয়গণ যুদ্ধবাজ দানব নামে বিখ্যাত।

ষাট হাজার পৌলোম কালকে সর্বদা মুনি ঋষিদের যাগযজ্ঞ ভন্ডুল করে দিত। বিচিত্তি সিংহিকাট একশো একটি পুত্রের জননী হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজন রাহু এবং বাকি একশোজন কেতু, যারা পরবর্তীকালে আকাশের গ্রহ হিসেবে বিরাজ করছেন।

ভগবান নারায়ণ নিজে অদিতি বংশে জন্ম নিয়েছিলেন। অদিতির পুত্রদের মধ্যে আছেন বিবস্বান, অমা, ত্বষ্টা, সবিতা, ভগ, ধাতা, বরুণ, মিত্র, শুক্র এবং উরুম। বিবস্বান জাত সংজ্ঞা পুত্ররূপে শ্রাদ্ধদেব নামে মনুকে এবং যম ও যমী নামক যমজ সন্তান প্রসব করেন। পরে তিনি ঘোটকী হয়ে দুই অশ্বিনীকুমারের জন্ম দিয়ে ছিলেন। এইভাবে বিবস্বান থেকে ছায়া, শনি ও সাবর্নি মনু নামে দুই পুত্র এবং তপতী নামে এক কন্যার জন্ম হয়েছিল। অর্যমা পত্নী মাতৃকা বহু জ্ঞানবান পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। দৈত্যকন্যা রচনা ছিলেন ত্বষ্টার পত্নী, সন্নিবেশ ও বিশ্বরূপ নামে দুই বীর্যবান পুত্রের জন্মদাত্রী রচনা।

দক্ষ প্রজাপতির দান করা ভূত নামক মুনির দুই পত্নী, তাদের মধ্যে স্বরূপা নামে কন্যা কোটি কোটি রুদ্রের জন্ম দেন। যাদের মধ্যে বৈরবত, অজ, ভব, ভাম, বাণ, উগ্র, অহিব্র ইত্যাদি অন্যতম। ভূতের অন্ধ স্ত্রী প্রেত ও বিনায়কগণের জন্ম দেয়।

স্বৰ্ধা ও সতী নামে মুনি অঙ্গিরার, দুই পত্নী পিতৃগণ ও অথর্বাঙ্গিরস নামক বেদের মাতা, কৃশাখের এক পত্নী অর্চিরগর্ভে ধূমকেতু এবং অন্য পত্নী বিষনরি গর্ভে বেদশিরা দেবল, যুয়ুন ও মনুর জন্ম হয়েছে। বিনতা, কঞ, পতঙ্গী ও যামিনী– তীর্থ কশ্যপের চার পত্নী। যথাক্রমে বিষ্ণুর বাহন গরুড়, বহু বহু সাপ বিভিন্ন ধরনের পাখি এবং ফড়িংদের জননী।

চন্দ্র তার সাতাশজন ভার্যার মধ্যে রোহিনীর প্রতি বেশি কামাসক্ত ছিলেন। ফলে অন্যান্য কন্যারা স্বামীর প্রতি রুষ্ট হন এবং পিতা দক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। দক্ষ রেগে গিয়ে চন্দ্রকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। চন্দ্ৰ ক্ষয় রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তিনি হন নিঃসন্তান। হে রাজন। এই হল প্রজাপতি দক্ষের ষাট কন্যার বংশ পরিচয়।

.

ষষ্ঠ অধ্যায়

শ্ৰী শুকদেব বললেন– আচার্য বৃহস্পতি কী কারণে ভক্ত দেবতাদের পরিত্যাগ করেছিলেন, তাঁর শিষ্যরা কী দোষে দুষ্ট ছিলেন, সেই আখ্যান বর্ণনা করছি শুনুন।

দেবরাজ ইন্দ্র তার প্রিয় পত্নী, শচীদেবীকে পাশে নিয়ে রত্নসিংহাসনে বসে আছেন। রুদ্র, বসু, আদিত্য, ঋতু, বিশ্বদেবগণ, সাধ্যগণ এবং অশ্বিনীকুমার দ্বয়ের দ্বারা তিনি পরিবেষ্টিত। গন্ধর্ব, চারণ, সিদ্ধ, মুনিগণ তার স্তব বন্দনা করছেন।

অপ্সরা ও বিদ্যাধরীরা তাঁকে নাচে গানে বিমোহিত করছে। এক ইন্দ্র ভক্ত তাঁর মাথায় শ্বেতবর্ণ ছাতা ধরে আছেন। অন্য দুজন পার্ষদ তাকে চামর ব্যজন করছে।

এমন সময় সেখানে ইন্দ্র এবং সমস্ত দেবতাদের পরম গুরু মুনিবর বৃহস্পতি সেই সভায় এসে উপস্থিত হলেন। ত্রিলোকের ঐশ্বর্যলাভে মদমত্ত ইন্দ্র আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আচার্যকে অভিনন্দিত করার প্রয়োজন মনে করলেন না। এমনকি তাঁকে আসন গ্রহণ করতেও বললেন–না। দেবরাজের এই নিকৃষ্ট ব্যবহারে গুরু বৃহস্পতি অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ সেই সভা ত্যাগ করেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে ইন্দ্র নিজের দুর্ব্যবহারের কথা বিবেচনা করে হা-হুতাশ করতে থাকেন। নিজের ওপর নিন্দাবাক্য নিক্ষেপ করতে থাকেন। ধিক! আমার ঐশ্বর্য সম্পত্তি। সাত্ত্বিক দেবগণের ঈশ্বর হয়ে আমি সেই গৌরবে অসুর ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছি। রাজাসনে উপবিষ্ট ব্যক্তি সর্বদা অতিথিকে সম্মান জানাবে। যারা তা অবজ্ঞা করে তারা তামস অধোগতি লাভ করে। তারা নরক যন্ত্রনা ভোগ করে। আমি এখন আমার আত্মগরিমা বিস্মৃত হয়ে সেই তারণগুরু বৃহস্পতির চরণযুগল নিজের মস্তক দ্বারা স্পর্শ করব। এইভাবে তাকে আমি প্রসন্ন করব।

সর্বজ্ঞ বৃহস্পতি দেবরাজ ইন্দ্রের অভিলাষ জানতে পেরে ভবন থেকে অদৃশ্য হলেন। ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতারা তার সন্ধান করেও কোনো হদিস পেলেন না। দেবরাজ ইন্দ্র নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করতে লাগলেন।

এই সুযোগে অসুররাজ শুক্রাচার্যের অনুমতি নিয়ে অসুররা দেবরাজ্য আক্রমণ করল। অসুরদের অস্ত্রের আঘাতে দেবতারা ক্ষতবিক্ষত হলেন। যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে ইন্দ্রসহ অন্যান্য দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন।

ব্রহ্মা তাদের শান্ত হতে বললেন–ঐশ্বর্য মদমত্তে মত্ত হয়ে তোমরা ব্রহ্মানিষ্ট ব্রাহ্মণ বৃহস্পতিকে অসম্মান করেছ। যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। অসুররা গুরুর মর্যাদা লঙঘন করে এক সময় অত্যন্ত ক্ষীণবল হয়ে পড়েছিল। আবার তারা গুরুর পাদবন্দনা করে তাঁর কৃপা লাভ করে এবং পুরোনো শক্তি ফিরে পেয়েছে। শুক্রচার্যের শিষ্য সেইসব অসুররা অভেদ্য মন্ত্রে দীক্ষিত। তারা স্বর্গলোকে অত্যাচার চালাবেই। হে দেবতাগণ! তোমরা ত্বষ্টার পুত্র বিশ্বরূপের স্মরণ নাও। তিনি জিতেন্দ্রিয়, তপস্বী ব্রাহ্মণ। যদি তোমরা তার অসুর পক্ষপাতিরূপ পূর্ব কার্যের কথা ভুলে গিয়ে তাঁকে পুজো করতে পারো, তা হলে নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের মনোস্কামনা পূরণ করবেন।

দেবতারা ত্বষ্টা পুত্র ঋষি বিশ্বরূপের স্তব করলেন।–হে বৎস। আজ আমরা অতিথি হয়ে তোমার আশ্রমে এসেছি। তোমার শুভ কামনা করি। আচার্য সাক্ষাৎ বেদস্বরূপ ভ্রাতা মরুৎপতি ইন্দ্র স্বরূপ। মাতা সাক্ষাৎ ধরিত্রী স্বরূপ, ভগিনী দয়াস্বরূপা, অভ্যাগত ব্যক্তি অগ্নিস্বরূপ, এবং নিখিল বিশ্বের প্রাণী সকল আত্মা অর্থাৎ বিষ্ণু নবরূপ।

অতএব হে তাত, তোমার এই পিতৃগণকে বিপক্ষ দলের উৎপাতের হাত থেকে রক্ষা করো। তুমি ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ। তোমাকে আমরা অধ্যক্ষ রূপে গ্রহণ করেছি। তোমার তেজঃজ্যোতির প্রভাবে সকল শত্রুর পরাস্ত হবে, আমরা জানি। তুমি আমাদের থেকে বয়সে ছোটো, কিন্তু প্রয়োজনে কনিষ্ঠদের পাবন্দনা করা নিন্দনীয় নয়, বেদজ্ঞরা বলে থাকেন, তুমি আমাদের জ্যেষ্ঠ এবং পূজ্য।

নিজের প্রশস্তি শুনে ঋষি বিশ্বরূপ সন্তুষ্ট হলেন। বললেন– হে দেবতাগণ। আপনারা আমার শিক্ষাগুরু। আমি আপনাদের শিষ্য। ধর্ম বলেছে, শিক্ষা দাতাদের প্রত্যাখান না করাই শিষ্যের স্বার্থ। আমার বিচারে পৌরোহিত্য একটি নিন্দনীয় বৃত্তি। তবুও আপনাদের প্রার্থিত বিষয় আমি অগ্রাহ্য করতে পারি না।

এইভাবে মহাতপস্বী বিশ্বরূপ পৌরোহিত্য পদব্রতী হলেন। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের বিদ্যার প্রভাবে অসুরদের লক্ষ্মী অচলা হলেও বিশ্বরূপ বৈষ্ণবী বিদ্যার সাহায্যে শ্রীলক্ষ্মীকে আকর্ষণ করেছিলেন। সেই নারায়ণ কবচ ইন্দ্রকে তিনি দান করেছিলেন। যার প্রভাবে দেবরাজ ইন্দ্র অসুরদের হাত থেকে স্বর্গলোক মুক্ত করেছিলেন।

.

সপ্তম অধ্যায়

নারায়ণ কবচ দেবরাজ ইন্দ্রকে দান করে বিশ্বরূপ তার ন্যাস সম্পর্কে বললেন– হে দেবরাজ। হস্ত পদ প্রক্ষালন করে উত্তরমুখো হয়ে কুশ হাতে নিয়ে আচমন করার নিয়ম। তারপর আট বা বারো অক্ষরের মন্ত্রোচ্চারণ করে অঙ্গন্যাস ও করণ্যস্ব করতে হবে। সংযত বাক ও শুদ্ধচিত্তে নারায়ণ কবচবন্ধন করবে। কবচ বন্ধন করার নিয়ম বলা হয়েছে– পা থেকে মাথা পর্যন্ত অর্থাৎ দুটি পা, দুটি জানু, দুটি উরু, উদর, হৃদয়, বক্ষস্থল মুখ ও মস্তক– প্রত্যেকটি অঙ্গের আট অক্ষরের মন্ত্রের দ্বারা বিন্যাস ঘটাতে হয়, বলতে হয় ‘ওঁ’ নমো নারায়ণায়, আবার বিপরীতভাবে অর্থাৎ মাথা থেকে পা পর্যন্ত অক্ষর বিন্যাস করা যেতে পারে।

‘ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়’- এই দশ অক্ষরের মন্ত্রের সাহায্যে করন্যাস করতে হয়। এই মন্ত্রের প্রথম আটটি অক্ষর ডানহাতের তর্জনী, মধ্যামা, অনামিকা, কনিষ্ঠা এবং বাম হাতের কনিষ্ঠা, অনামিকা, মধ্যমা ও তর্জনী আঙুলে বিন্যাস করতে হয়। বাকি চারটি অক্ষর দ্বারা দুই হাতের আঙ্গুলের আদি ও অন্তপর্বে বিন্যাস করবে। ষড়ঙ্গ ন্যাস হল ছয় অক্ষরের ‘ওঁ বিষ্ণবে নম’। সাধক তার হৃদয়ে ‘ওঁ’, ‘মস্তকে’ নি, দুই ভুর মাঝখানে য’ শিখায় ন, দুই চোখে ‘বে’, ‘ন’ সন্ধিস্থান সমূহে বিন্যস্ত করে থাকেন। ম কার হবে অস্ত্র। অস্ত্ররূপ ম কারের সঙ্গে বিসর্গ যুক্ত করে, শেষে কট যোগ করলে হবে ‘ম’ অস্ত্রায় কট এই মন্ত্রের সাহায্যে দিকগুলির বন্ধন করতে হয়, তারপর ঐশ্বর্যাদি ষট শক্তিসম্পন্ন ধ্যেয় পরমাত্মাকে ধ্যান করবে এবং বিদ্যা, তেজ ও তপস্যা যাঁর মূর্তি স্বরূপ, সেই নারায়ণ কবচ নামক মন্ত্রোচ্চারণ করবে।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে রাজন, নারায়ণ কবচ মন্ত্র সম্পর্কে বিশ্বরূপ বলেছিলেন যিনি পক্ষীরাজ গরুড়ের পিঠে উপবিষ্ট, যিনি আটটি হাতে আটটি অস্ত্র ধারণ করে আছেন। সেই ভগবান শ্রীহরির চরণ বন্দনা করি। যিনি মৎস্য অবতার, বটুবামন, ও বিশ্বরূপ ত্রিবিক্রম মূর্তি হয়ে স্থল, জল, অন্তরীক্ষ রক্ষা করেছিলেন। তিনি আমাকে রক্ষা করুন। যিনি হিরণ্যকশিপুর সংহারকারী, যিনি নিজের দাঁত দিয়ে জলমগ্ন পৃথিবীকে তুলে এনেছিলেন, সেই প্রভুকে আমি প্রণাম করি। যিনি সমস্ত গুণ সমুহের ঈশ্বর ভগবান কপিল, যিনি কুর্মমূর্তি শ্রীহরি, তিনি আমাকে সমস্ত কর্মবন্ধন ও নরক থেকে রক্ষা করুন।

জিতেন্দ্রিয় ঋষভদের শীতোষ্ণোদি জনিত ভয় থেকে, যজ্ঞ মূর্তি ভগবান লোকাপবাদ হতে। বলদেব লোককৃত বাধা থেকে এবং নাগরাজ অনন্তদেব ক্ৰোধী সর্পগণ থেকে আমাকে উদ্ধার করুন।

হে দেবেন্দ্র, তারপর ভোরবেলা, দুপুরবেলা ছয়বার এবং সন্ধ্যাবেলা দুবার প্রার্থনা করবে– হে ভগবান কেশব- ভোরবেলা গদা দ্বারা আমাকে রক্ষা করুন। হে সুদর্শনধারী বিষ্ণু মধ্যাহ্নকালে আমাকে রক্ষা করুন। উগ্ৰধনুধারী ভগবান মধূসূদন অপরাহ্নকালে, ব্রহ্মাদি ত্রিমূর্তিধারী ভগবান মাধব সন্ধ্যাকালে, ভগবান হৃষীকেশ প্রদোষ সময়ে এবং ভগবান পদ্মনাভ অর্ধ রাত্র পর্যন্ত রক্ষা করুন। শ্রীবৎসধারী, ঈশ্বর রাত্রির শেষ ভাগ পর্যন্ত আমাকে রক্ষা করুন।

এবার অস্ত্র বন্দনা- হে গদা, শত্রুদের ধ্বংস করা হে চক্র, আমাদের শত্রুদের আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দাও। হে পাঞ্চজন্য শঙ্খ তোমার ভয়ংকর শব্দ দ্বারা শত্রদের হৃদয় কম্পিত করো। রাক্ষস, প্রেত, মাতৃকা, পিশাচ ব্রহ্মরাক্ষস, দুরাত্মা সকলকে নাশ করো, হে তীক্ষ্ণধার খড়গশ্রেষ্ঠ তুমি ঈশ্বরের দ্বারা প্রযুক্ত হয়ে সমস্ত শত্রুর মুণ্ড ছেদন করো। হে শতচন্দ্র ঢাল তুমি পাপী শত্রুদের চোখের দৃষ্টি কেড়ে নাও।

গ্রহ কেতু, নর, সরীসৃপ, হিংস্র জন্তু, ভূতপ্রেত এবং অন্যান্য পাপাত্মা- যারা আমাদের মনে ভয়ের সঞ্চার করেছে, যারা আমাদের মঙ্গল লাভে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে, তারা ভগবানের নামকীর্তন ও রূপমহিমা বর্ণনের দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হোক। যিনি বির্ষক সেনাররূপ যিনি বেদস্বরূপ, যিনি বৃহদ্রথস্তর প্রভৃতি সাম্যরূপ স্তোত্রের দ্বারা বন্দিত হয়ে থাকেন, সেই গরুড় আমাদের রক্ষা করুন।

যাঁরা সর্বত্র একাত্মতা অনুভব করেন, তাদের দৃষ্টিতে ভগবান ভেদরহিত হয়েও নিজ মায়াবলে ভূষণ, অস্ত্র ও চিহ্ন স্বরূপ বিধি শক্তি ধারণ করেছেন। তিনি সর্বজ্ঞ সর্বগত শ্ৰহরি। তিনি সর্বপ্রকার স্বরূপ দ্বারা আমাদের সর্বত্র রক্ষা করুন। ভগবান নৃসিংহদেব নিজ তেজের দ্বারা সমস্ত তেজ গ্রাস করে। নিজ গর্জনধ্বনির দ্বারা লোকভয় বিনাশ করুন, দিক, বিদিক, উর্দু, অধঃ, বাইরে, ভেতরে সর্বত্র তিনি বিরাজ থেকে আমাদের উদ্ধার করুন।

বিশ্বরূপ বললেন– হে দেবরাজ ইন্দ্র। নারায়ণ কবচের কীর্তন ও মহিমা আপনাকে বর্ণনা করলাম। এই কবচ যে ধারণ করে, লোকে তার চরণ স্পর্শ করার জন্য ব্যাকুল হয়, সেই ব্যক্তির সমস্ত ভয় দূরীভূত হয়। এই কবচ ধারণকারী ব্যক্তি সর্বদা যে কোনো ভয়, দস্যু, গ্রহাদি, রাজা বা ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হন না।

আপনি এই অপার মহিমান্বিত কবচ গ্রহণ করে অবশ্যই অসুরদের পরাস্ত করতে পারবেন।

পুরাকালে কৌশিক নামের এক ব্রাহ্মণ এই বিদ্যালাভ করে মরুভূমিতে যোগসাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন। ওই কবচের প্রভাবে তিনি দেহ ছেড়ে বিষ্ণুলোকে গমন করেন। যে স্থানে তিনি দেহত্যাগ করেছিলেন, একসময় সেই স্থানের ওপর দিয়ে গন্ধর্বরাজ চিত্ররথ তাঁর স্ত্রীদের নিয়ে বিমানযোগে যাচ্ছিলেন। সেই স্থান অতিক্রম করা মাত্র তাঁর বিমান অধোমুখী হয়ে নীচে নামতে থাকে।

বিস্মিত গন্ধর্বরাজ পরে কিশোর মুনিদের কাছ থেকে এই সংক্রান্ত উপদেশ লাভ করেন, তখন চিত্ররথ ব্রাহ্মণের অস্থিসমূহ সংগ্রহ করে সরস্বতী নদীতে নামেন। সেই জলে ওগুলো নিক্ষেপ করেন। তারপর নিজে অবগাহন করে ফিরে আসেন।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– দেবরাজ ইন্দ্র ওই নারায়ণ কবচ ধারণ করে অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। অসুররা সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়। ত্রিলোকের ঐশ্বর্য লাভ করে ইন্দ্র সুখী হয়েছিলেন।

.

অষ্টম অধ্যায়

শ্ৰী শুকদেব বললেন– বিশ্বরূপের সোমরস, সুরা ও অন্নভক্ষনকারী তিনটি মুখ ছিল, দেবতারা ছিলেন তাঁর পিতৃকুল, বিশেষ করে তিনি ছিলেন তাদের পুরোহিত। অথচ তার মা ছিলেন দৈত্যকন্যা। তাই তিনি উচ্চস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করে যজ্ঞ সুসম্পন্ন করতেন, এবং তার ভাগ দেবতা ও গোপনে অসুরদের মধ্যে প্রদান করতেন। যজ্ঞে একদিন এই অন্যায় আচরণ লক্ষ্য করে ইন্দ্র ভীষণ ক্ষিপ্ত হলেন। অসুরদের শক্তি বৃদ্ধির আশঙ্কায় তিনি ভীত হলেন এবং বিশ্বরূপের তিনটি মস্তক ছেদন করলেন। তার একটি মাথা থেকে কপিজল, দ্বিতীয়টি থেকে চটক এবং তৃতীয়টি থেকে তিতির পাখির জন্ম হল।

ব্রহ্মহত্যা জনিত পাপ দেবরাজ ইন্দ্র একবছর ভোগ করলেন। শেষে নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য ওই পাপকে চারভাগ করে ভূমি, জল, বৃক্ষ এবং স্ত্রীলোকের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। সেইসঙ্গে প্রত্যেককে বর’ প্রদান করলেন।

ভূমি একভাগ পাপ গ্রহণ করেও, ঘাতপুরণ বর লাভ করল, অর্থাৎ আপনা হতেই জমির ঘাতপূরণ হবে। জমির উষর ভাগ হল সেই পাপেরই চিহ্ন। বৃক্ষদের তিনি বরদান করলেন তোমাদের কর্তন করা হলেও তোমাদের বৃদ্ধি ঘটবে। গাছের গায়ে আঠা দেখা যায়, যা ইন্দ্রের একভাগ পাপের লক্ষণ।

ইন্দ্রের পাপ গ্রহণ করার ফলে রমণীরা প্রতি মাসে ঋতুমতী হয় এবং তার আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়। তারা সর্বদা সম্ভোগে অর্থাৎ গর্ভ ধারণ কালেও সম্ভোগ করতে পারে, কোনোরকম বিঘ্ন ঘটে না। ইন্দ্রের ব্রহ্মহত্যা পাপের বাকি এক অংশ জলরাশি গ্রহণ করল। দুধ প্রভৃতি যে দ্রব্যের সাথে জল মেশানো হবে, জলে সেই দ্রব্যেরই আধিক্য ঘটবে। জলে যে বুদবুদ বা ফেনা দেখা যায়, তাহল ওই পাপের চিহ্ন। তাই জলের ফেনা বা বুদবুদ ফেলে দিয়ে জলপান করা বিধেয়।

বিশ্বরূপের মৃত্যু হলে তার পিতা ত্বষ্টা অত্যন্ত রেগে গেলেন। ইন্দ্ৰবিনাশের কামনা করে তিনি যজ্ঞ করতে শুরু করলেন। তিনি যজ্ঞে আহুতি দান করলেন হে ইন্দ্রশস্ত্রো অর্থাৎ ইন্দ্রের শত্ৰু সংহার করা। যজ্ঞকালে যজ্ঞের অগ্নির ডানদিক থেকে এক ঘোরাকৃতি পুরুষের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু আহুতি দানকালে তিনি এমন ভাবে শব্দদুটি উচ্চারণ করেছিলেন, যার অর্থ হল হে ইন্দ্র, হে শত্রো — ফলে কাজ হল উল্টো। ওই বীভৎস চেহারার পুরুষ প্রতিদিন চারহাত পরিমাণ চুতর্দিকে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

তার গায়ের রং ছিল অগ্নিদগ্ধ পর্বতের ন্যায়। তার দেহের দীপ্তি যেন সন্ধ্যার মেঘমালা, তিনি শ্মশ্রুধারী, তাঁর নেত্রযুগল থেকে দুপুরের সূর্যের প্রখর তেজের প্রকাশ ঘটছে। তিনি তিনটি শিখাবিশিষ্ট শূলের অগ্রভাগে যেন স্বর্গ ও ভূতলকে আরো পিত করে নৃত্য ও উচ্চধ্বনি করতে করতে পা দিয়ে পৃথিবীকে চালনা করছিলেন। পর্বত গুহার মতো বিশাল তার মুখগহ্বর যেন আকাশকে গ্রাস করবে, তার মস্ত বড়ো জিভে নক্ষত্ররাজিকে লেহন করছে। ত্রিভুবনকে উদরস্থ করতে চাইছে, বারবার সেই বীভৎস চেহারার পুরুষ দাঁত বের করে হাই তুলছিল।

ত্বষ্টা সৃষ্ট এই পাপী পুরুষ ছিলেন তমোগুণ স্বরূপ। তিনি হলেন ত্বষ্টা পুত্র, ত্রিভুবন আবরণকারী। তাই তার নাম হল বৃত্র। তাকে দমন করার উদ্দেশ্যে শ্রেষ্ঠ দেবতারা নানা রকম শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাকে আক্রমণ করল।

কিন্তু ওই দৈত্যপুরুষ অনায়াসে সমস্ত অস্ত্র উদরস্থ করতে লাগল। এই অসুরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে বিস্মিত, বিষণ্ণ ও তেজহীন দেবতারা একাগ্রচিত্তে অন্তর্যামী আদি পুরুষের স্তব করতে শুরু করলেন।

দেবতারা বললেন– যে কালদেবতার পূজোপহার আমরা আহরণ করে থাকি, সেই কালদেবতা যাঁকে দেখে ভীত হন, সেই পরমেশ্বর আমাদের রক্ষা করুন। যিনি নিরহংকার, রাগ-দ্বেষ শূন্য, উপাধিকৃত পরিচ্ছেদহীন, সেই পরমেশ্বরকে যে ত্যাগ করে অন্যকে আশ্রয় করে, সে অতিমূর্খ। কুকুরের লেজ ধরে সমুদ্র পার হওয়ার মতো ইচ্ছা সে প্রকাশ করে।

পুরাকালে সৃষ্টির প্রারম্ভে সমুদ্রের জলরাশি প্রবল বায়ুবেগে উত্থিত হলে, তরঙ্গরাজির শব্দ ভয়ংকর হলে, তখন সেই তরঙ্গের নাভিকমল হতে পিতামহ ব্রহ্মা যার দ্বারা ভয় হতে উত্তীর্ণ হন, তিনি নিশ্চয়ই রক্ষা করবেন। হে অন্তর্যামী ঈশ্বর যাঁর মায়াবলে আমরা সৃষ্ট হয়েছি। যাঁর আজ্ঞায় আমরা বিশ্ব সৃষ্টি করে চলেছি, এবং নিজেদের পৃথক পৃথক ঈশ্বর জ্ঞান করি, কিন্তু সেই পরমেশ্বরের রূপ পরিচয় আমাদের কাছে অজ্ঞাত, সেই পরম পুরুষের কাছে আমরা আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

যিনি নিত্যবস্তু স্বরূপ, যিনি মায়াবলে দেবতা, ঋষি, তির্যক প্রাণী ও নরকুলের মধ্যে বিভিন্ন রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন, যিনি সকলকে নিজ ভক্তজ্ঞানে আশ্রয় দান করেন, তিনি অবশ্যই আমাদের মঙ্গল করবেন।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– দেবতাগণের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি শঙ্খ, চক্র, গদা পদ্মধারী। শরৎকালের প্রস্ফুটিত পদ্মের ন্যায় তার চোখ দুটি প্রকাশিত। শ্রীবৎস ও কৌস্তভ ব্যতীত আরও ষোলোজন পার্ষদ দ্বারা তিনি পরিবেষ্টিত।

দেবতারা সেই ভুবন ভুলানো মোহিনী মূর্তি দেখে আনন্দে বিহ্বল হলেন। তারা মাটিতে মাথা স্পর্শ করে তাকে প্রণাম জানালেন। বললেন– হে ঈশ্বর, আপনি স্বর্গাদি ফল উৎপাদনের জন্য অলৌকিক সামর্থ্য পূর্ণ পুরুষ। আপনি স্বয়ং ওই কলের পরিচ্ছেক কালরূপী। তা সত্ত্বেও যজ্ঞ নাশকারী অসুরদের আপনি অভেদ্য অস্ত্র ক্ষেপণ করে থাকেন। আপনাকে প্রণাম। হে ভগবান, আপনি সত্ত্ব, তমো ও রজঃ গুণের পরম অধিষ্ঠান। আপনি ত্রিগুণাতীত, নির্গণ স্বরূপ। আপনাকে প্রণাম পরমহংস পরিব্রাজকগণ অষ্টাঙ্গ যোগমার্গে চিত্তের একাগ্রতার দ্বারা অনুশীলন করলে ভগবদ ভজনের উন্মেষ কারণে চিতরূপে দ্বারের কপাট খুলে যায়।

সেই চিত্তমাঝে, প্রত্যেক স্বরূপের অর্থাৎ অন্তর্যামী তত্ত্ব প্রকটতা লাভ করলে স্বয়ং আত্মার যে স্বরূপ সুখের উপলব্ধি ঘটে, আপনি সেই সুখেরই উপলব্ধি, আপনি সেই সুখেরই অনুভব স্বরূপ। আপনি আমাদের প্রণাম গ্রহণ করুন। আপনি নিরাশ্রয় দেহহীন ও নির্গণ হয়েও নিজেই নিজের আত্মার দ্বারা এই স্বগুণ বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় কার্য সম্পাদন করছেন, অথচ আপনার আত্মা কখনও লীনপ্রাপ্ত হয় না।

এই গুণময় সংসারে জীবরূপে প্রবেশ করে, আপনি ভালো বা মন্দ কর্মের ফল ভোগ করার প্রত্যাশী হন না। চিৎশক্তির কোন চ্যুতি ঘটে না। আত্মারামত্ত উপশমশীল হয়ে সাক্ষীস্বরূপ বিরাজ করে, হে দেব, আপনার ঐশ্বর্য অচিন্তনীয়। আপনার মাহাত্ম্য যা কেউ কখনও বলে শেষ করতে পারে না। বিকল্প, বিতর্ক, বিচার, প্রমাণাভাস ও কুতর্কে পরিপূর্ণ শাস্ত্রসমূহ নির্ধারণে অযোগ্য আপনি সকল সংসার ভাবের নিবৃত্তিস্থান। অকর্তৃত্বাদিই আপনার বাস্তব রূপ।

হে দেব, মানুষ নিজ নিজ বুদ্ধি অনুসারে আপনার মধ্যে সাম্য বা বৈষম্য দর্শন করে, আসলে আপনি উদাসীন, তাই কারোর প্রতি অনুগ্রহশীল বা নিগ্রহশীল হননি, আপনিই একমাত্র সৎ স্বরূপ। সকলের ঈশ্বর, নিখিল জগতের কারণসমূহের কারণ, প্রকাশক রূপে আপনার অস্তিত্ব অস্বীকার্য নয়।

হে মধুসূদন, যাঁরা আপনার মহিমারূপ সমুদ্রের অমৃত রস কণামাত্র আস্বাদন করেছেন। এবং নিজের মনের মধ্যে সেই প্রবাহমান আনন্দ রাশির অনুভব করেন, ক্ষুদ্র সুখের লেশমাত্র তারা বিস্মৃত হয়েছেন, তাঁদের কাছে আপনি প্রিয় এবং সুহৃৎ। আপনার সেবায় যারা সতত নিয়োজিত তাদের আর আর জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না।

হে বিধাতা, আপনি এই অখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আত্মা ও আবাসস্থল। সকল দৈত্য দানো আপনার বিভূতি প্রসূত, আপনিই ত্রিলোকের পালনকর্তা। ভক্তদের মঙ্গল বিধানে আপনি বারে বারে নানা অবতার রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন।

হে পিতা, বৃত্রাসুরকে বধ করে, দেবতাগণকে রক্ষা করুন। আমরা সর্বদা আপনার পাদপদ্মের ধ্যান করি। আপনাতেই আমাদের হৃদয় শৃঙ্খলাবদ্ধ। আপনি আপনার মধুর মনোহর বচনরূপ অমৃতে কলার দ্বারা আমাদের চিত্তের সন্তাপ বিদূরিত করুন।

হে হরে, হে সর্বজ্ঞ, আমাদের অভিলষণীয় বিষয় নতুন করে আর কি জানাব? যিনি নিখিল জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারকারী, যিনি আপন মায়া দ্বারা ক্রীড়া করে চলেছেন। যিনি জীব সকলের অন্তরে ব্রহ্ম ও অন্তর্যামীরূপে অবস্থান করছেন, যিনি প্রকৃতি রূপে দেশ, কাল, দেহ ও অবস্থাবিশেষের অনুকূল ভাবে তাদের উপাদান ও প্রকাশক রূপে সব কিছুই অনুভব করছেন, যে কামনায় পরমগুরু ভগবৎ স্বরূপ আপনার চরণছায়ায় আশ্রয় নিলাম, আপনি সেই কামনা পূরণ করুন, আপনি বুদ্ধি প্রভৃতির সাক্ষী, পরমব্রহ্ম ও পরমাত্মা।

আপনি শুদ্ধ ও আর্তহারী আপনাকে প্রণাম জানাই। হে কৃষ্ণ, যে বৃত্রাসুর দেবগণের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। ত্রিভুবন গ্রাস করার খেলায় মেতে উঠছে, তাকে সংহার করুন।

শ্ৰী শুকদেব বললেন–দেবগণের স্তুতিবাক্যে স্বয়ং শ্রীহরি সন্তুষ্ট হলেন। তিনি বললেন– হে দেবগণ, এই স্তব যে করে সে জ্ঞানী হয় এবং আমার একান্ত ভক্ত হয়। আমাকে যে খুশি করতে পারে তার আর কী চাওয়ার আছে? তবুও যে আমার প্রতি ভক্তি সহকারে আত্মসমর্পণ করে, সেই তত্ত্ব ও ব্যক্তি আমাকে ছাড়া আর কিছু কামনা করে না।

দীন এবং মুখ জনই বিষয় সমূহকে যথার্থ বস্তু বলে মনে করে। সে লোক অজ্ঞ। আর, যে বিজ্ঞ অর্থাৎ শ্রীহরি সম্পর্কে যার জ্ঞান আছে, সে কখনও অজ্ঞলোককে সংসার বন্ধনের কারণ স্বরূপ প্রবৃত্তি মার্গের উপদেশ দিতে পারে না।

হে সুর শ্রেষ্ঠগণ। তোমরা ঋষিশ্রেষ্ঠ দধীচির কাছে যাও। তাঁর দেহটি প্রার্থনা করো, যা বিদ্যা, ব্রত ও তপোবলে দৃঢ়। তিনি নিজে বিশুদ্ধ ব্রহ্মবিদ্যা অবগত হয়ে অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে তা দান করে ছিলেন। অশ্বশির নামক ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করে অশ্বিনী কুমারদ্বয় জীবন্মুক্ত হয়েছিলেন।

কথিত আছে, অশ্বিনীকুমারদ্বয় অবগত ছিলেন যে, দধ্য মুনি প্রবগা ও ব্রহ্মবিদ্যায় দক্ষ। তারা এই বিদ্যা লাভের আশায় তার শরণাপন্ন হলেন। মুনি বললেন–আমি এখন অন্য কাজে ব্যস্ত আছি, তোমরা পরে এসো, বলে তাদের ফিরিয়ে দিলেন।

অশ্বিনীকুমার দুজন আশ্রম ত্যাগ করলেন। এমন সময় সেখানে দেবরাজ ইন্দ্র এসে হাজির হলেন। তিনি বৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে ব্রহ্মবিদ্যা দান করতে বারণ করলেন, যদি তার আদেশ অমান্য করা হয়, তাহলে মুনির মুণ্ডচ্ছেদ ঘটবে। কিছুদিন পর অশ্বিনীকুমার স্বয়ং আশ্রমে এসে হাজির হলেন। দধীচি মুনি ইন্দ্র যা কিছু বলে গিয়েছিলেন, সব তাদের জানালেন।

অশ্বিনীপুত্র দুজন বললেন– হে ঋষিবর, আমরা আপনার মুণ্ড ছেদন করে সেখানে অশ্বের মুখ সংস্থাপন করব। আপনি অশ্বমুণ্ড দিয়েই আমাদের প্রবর্গ ও ব্রহ্মবিদ্যা উপদেশ দেবেন। ইন্দ্র এসে আপনার অশ্বমুণ্ড কেটে দেবেন। আমরা আবার আসল মুণ্ড কবন্ধে সংস্থাপন করব। এই কারণে এই বিদ্যা অশ্বশির নামে প্রসিদ্ধ।

হে দেবরাজ অর্থব বেদজ্ঞ দধীচিই ত্বষ্টাকে সদাত্মক অর্থাৎ নারায়ণবর্ম নামক অভেদ্য কবচ উপদেশ করেন। ত্বষ্টা নিজ পুত্র বিশ্বরূপকে তা বিতরণ করেন। বিশ্বরূপের কাছ থেকে তুমি সেই বিদ্যা লাভ করছে। নারায়ণ কবচের প্রভাবে এই মুনির গাত্র অত্যন্ত দৃঢ়। তোমরা তাঁর দেহ প্রার্থনা করলে শিষ্যবৎসল ঋষি তোমাদের কখনোই বিমুখ করবেন না।

দধীচির অস্থি দ্বারা বিশ্বকর্মা বজ্ররূপ উৎকৃষ্ট অস্ত্র তৈরি করবে, ওই অস্ত্র আমার তেজে তেজীয়ান হয়ে বৃত্রাসুরের মুণ্ড ছেদন করবে। তোমারা আবার নিজেদের তেজ, অস্ত্রশস্ত্র ও অধিকার ফিরে পাবে আমার চরণে যে আশ্রয় নেয়, কোনো বিপদ তাকে স্পর্শে করতে পারে না। তোমাদের মঙ্গল হোক। একথা বলে বিশ্বভাবন ভগবান শ্রীহরি সেই স্থান ত্যাগ করলেন।

.

নবম অধ্যায়

শ্রী শুকদেব বললেন– হে রাজা, শ্রীহরির আদেশ অনুসারে দেবরাজ ইন্দ্র অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে দধীচির আশ্রমে এলেন, তার দেহ প্রার্থনা করলেন।

মুনি দধীচি বললেন– হে দেবগণ। দেহধারী জীবগণ অনায়াসে দেহত্যাগ করতে চায় না। বিশেষ করে যারা ইহলোকে বেঁচে থাকতে চায়। তারা অতিশয় প্রিয় এই দেহের নাশ চায় না। দুঃসহ মৃত্যুযাতনা চেতনাকে বিনষ্ট করে। স্বয়ং বিষ্ণুও যদি দেহদান করতে আজ্ঞা করেন, তাহলে সে কি সহজে তা ত্যাগ করতে চাইবে?

দেবতারা বললেন– হে ঋষি, আপনি দয়ালু, জ্ঞানী এবং পরোপকারী। সর্বদা অন্য সকলের কর্মের প্রশংসা করে থাকেন। যাচক যদি পরের দুঃখ অনুধাবন করতে পারে, তাহলে সে যেমন প্রার্থনা করে না, তেমনই দানে সমর্থ পুরুষও অন্যের কষ্ট বুঝলে ‘না’ শব্দ বলতে পারে না।

অর্থাৎ আমরা স্বার্থপরের ন্যায় আপনার সংকটের কথা বুঝতে চাইছি না, তেমনই আপনি প্রত্যাখান করাতে আমাদের বিপদ সম্পর্কে অবগত হচ্ছেন না।

দধীচি বললেন–তোমাদের কাছ থেকে ধর্মকথা শোনার অভিপ্রায়ে ও কথা বলেছিলাম, যে দেহ তোমরা চাইছ, তা অনিত্য, ক্ষণস্থায়ী এবং ক্ষণভঙ্গুর। ধন, পুত্র, দেহ- এসবই পরবীয়, যা কুকুর শেয়াল ভক্ষণ করে, এইসবের দ্বারা যদি মরণশীল মানুষ পরের উপকার না করে, তাহলে তা হয় অত্যন্ত দৈন্য ও দুঃখের কথা। আমি আমার এই দেহ এখনই পরিত্যাগ করছি।

শ্ৰী শুকদেব, বললেন– মহারাজ, অথর্ব ঋষির পুত্র দধীচি একথা বলে নিজ আত্মাকে পরব্রহ্ম ভগবানে যুক্ত করলেন। উভয়ের মধ্যে ঐক্য সম্পাদিত হল। এইভাবে দধীচি দেহত্যাগ করলেন। ইন্দ্রিয়, প্রাণ, মন ও বুদ্ধিবৃত্তির সংযম করে তিনি হয়েছিলেন তত্ত্বদর্শী, সর্বপ্রকার বন্ধনমুক্ত হয়ে পরম যোগদশা লাভ করেন। তাই তিনি নিজের দেহের পতন অনুভব করতে পারেননি।

মুনির অস্থি দিয়ে বিশ্বকর্মা বজ্র নির্মাণ করলেন। সেই বজ্ৰাস্ত্র দেবরাজ ইন্দ্র ধারণ করে ভগবানের তেজে তেজীয়মান হয়ে উঠলেন। ঐরাবতের ওপর তিনি উপবেশন করলেন। সমস্ত দেবতারা তাকে বেষ্টন করলেন। মুনিরা তাঁর বন্দনা করতে লাগলেন। ত্রিভুবন আনন্দে উল্লাসিত হল। অন্ধক নামে অসুরের সংহারের জন্য পুরাকালে ভগবান রুদ্র যেভাবে শত্রু অভিমুখে জীবিত হয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই দেবসৈন্য পরিবেষ্টিত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র অসুররাজ বৃত্রের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। সত্যযুগের প্রান্ত ভাগে নর্মদা নদীর তীরে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ শুরু হল।

ইন্দ্র সেনাগণের মধ্যে ছিলেন রুদ্রগণ, বসুগণ, আদিত্যগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, বিপতৃগণ, অগ্নিগণ, মরুদগণ, ঋতুগণ, সাধ্যন ও বিশ্বদেবগণ। বৃত্রাসুরের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল নমুচি, শাম্বর, দ্বিমূর্ধা, ঋষভ, অনধা, হয়প্রীব শঙ্কুশিরা, প্রহেতি, হেতি, উল্কল, পুলোমা, সুমালি, মালি প্রভৃতি হাজার হাজার দৈত্য, দানো, যক্ষ ও রাক্ষসগণ সাক্ষাৎ যশ অপেক্ষাও দুর্ধর্ষ অসুরবাহিনী নির্ভীক চিত্তে সিংহনাদ করতে করতে দেবতাদের আক্রমন করল।

প্রাণ, মুখার, শূল পরশুখড়গ গদা, পরিখ, শতুঘী, বান ইত্যাদি অস্ত্র শাস্ত্রের দ্বারা দেব সৈন্যরা আচ্ছন্ন হল। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে যেমন চন্দ্র-সূর্য গ্রহ তারা দেখা যায় না। তেমনই নিবিড় বানজালে দেবতারা আবদ্ধ হলেন। তাঁরা দৃষ্টিগোচর হলেন না। কিন্তু তারা নিজেদের অস্ত্র প্রয়োগ করে আকাশপথেই শদের নিক্ষিপ্ত অস্ত্রের পতন ঘটালেন। ওই সব অস্ত্র দেবতাদের স্পর্শ করতেও পারল না। অসুররাজ বৃত্রাসুর ও দৃশ্য দেখে ক্রোধে উন্মুক্ত হয়ে পবর্তশৃঙ্গে, পাথরের খণ্ড বৃক্ষ ইত্যাদি শত্রুদের দিকে নিক্ষেপ করলেন।

তাকে লক্ষ্য করে সমগ্র, অসুরবাহিনী বৃক্ষ, প্রস্তর, পর্বত শৃঙ্গে সমূহ ক্রমাগত ছুঁড়তে লাগল। কিন্তু ইন্দ্ৰসৈন্যরা প্রত্যেকটি অস্ত্রকে ফিরিয়ে দিলেন শত্রুর দিকে। অক্ষত ও সুখী ইন্দ্র সৈন্যদের দেখে অসুররাজ ও তার সেনারা অত্যন্ত ভীত হলেন।

শুকদেব বললেন– হে রাজা। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যাদের সহায়, তাদের কোনো দুর্জন কোনো ক্ষতি করতে পারে না। অসুররা শ্রীহরির প্রতি বিমুখ ছিল। তারা ভগবানের নামে কুৎসা রটাত। কিন্তু দেবগণ ছিলেন হরিভক্ত। তাই অসুরদের বারবার চেষ্টা বিফলে গেল, এই অবস্থায় অসুরবাহিনী নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে অসুররাজ বৃত্রাসুরকে পরিত্যাগ করে পালিয়ে গেল।

মহাভয়ে ভগ্ন ও পলায়নরত অসুর সৈন্যদের উদ্দেশ্যে মহাবীর বৃত্রাসুর বলল- হে অসুর বীরগণ। জন্মশীল ব্যক্তির মৃত্যু কেউ খণ্ডাতে পারে না, এ তথ্য তোমাদের জানা আছে নিশ্চয়ই। আর সেই মৃত্যু যদি যশ ও স্বর্গলাভে সক্ষম হয়, তাহলে সেই মৃত্যুক কেন বরণ করে নেব না?

শাস্ত্রে দুই ধরনের অতিশয় দুষ্প্রাপ্য মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। যোগ ধারণাপূরক প্রাণ ইত্যাদি জয় করে শরীর পরিত্যাগ করা এক শ্রেণীর মৃত্যু। আবার রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে শত্রুর সঙ্গে নির্ভীক চিত্তে লড়াই করে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া, আর এক শ্রেণীর মৃত্যু। এই ধরনের মৃত্যু সকলের ভাগ্যে ঘটে না। যাঁরা এইভাবে মৃত্যুবরণ করেন, তারা সূর্যমণ্ডল ভেদ করে গমন করেন।

.

দশম অধ্যায়

শ্ৰী শুকদেব বললেন– মহারাজ, অসুররাজ বৃত্রাসুরের ধর্মোপদেশ অগ্রাহ্য করে অসুর সেনারা ভীত হয়ে পালিয়ে যেতে লাগল, সেনাদের ছত্রভঙ্গ হতে দেখে অসুরশ্রেষ্ঠ বৃত্রাসুর অসহিষ্ণু হয়ে রাগে দুঃখে দেবতাদের উদ্দেশ্যে তিরষ্কার করে বললেন– যারা পালিয়ে যেতে গিয়ে পেছন দিক দিয়ে আহত হয়েছে, সেইসব অসুর নিজ মাতার পুরীষের ন্যায় হীন, তাদের বিতাড়িত করতে পেরে কেন তোমরা বৃথা উল্লাস করছ।

যারা বীরত্বের অভিমান করে তারা ভীত, শত্রুকে পদানত করে যশ ও স্বর্গলাভের কামনা করতে পারে না। ঠিক তোমাদের ক্ষুদ্রচিত্তকে, যদি যুদ্ধের প্রতি তোমাদের সামান্য শ্রদ্ধা থাকে, আর হৃদয়ে থাকে ধৈর্য, তাহলে এসে দাঁড়াও আমার সামনে।

দেবতাদের ভয় দেখাতে মহাবল হুঙ্কার দিলেন। তার গর্জনে বুঝি ত্রিভুবন অচেতন হয়ে পড়ার উপক্রম হল। অনেক দেবসৈন্য জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। পাগলা হাতি যেমন ঘাস মর্দন করে, ঠিক সেইভাবেই রণাঙ্গনে অভিমত্ত বৃত্রাসুর শূল উত্তোলন করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দুই পা দিয়ে ওইসব পড়ে থাকা দেবতাদের থেঁতলে পিষতে লাগল।

বজ্রধারী দেবরাজ ইন্দ্র তখন রাগে ফুঁসছেন। তার রোষানল প্রজ্বলিত হল। বৃত্রাসুর তখন তার দিকে ধাবিত হল। ইন্দ্র শত্রুকে লক্ষ্য করে মহতী গদা নিক্ষেপ করলেন। বৃত্রাসুর অনায়াসে সেই গদা বাঁ হাতে ধরে ফেলল। ঘোরতর গর্জন করতে করতে ওই গদাই ছুঁড়ে মারল। সেটি এসে পড়ল ইন্দ্রের বাহন ঐরাবতের কুম্ভস্থলে অর্থাৎ মস্তক স্থিত উন্নত পিণ্ড দুটিতে।

অসুরদের গদার আঘাতে মহেন্দ্ৰবাহন বজ্রাহত পর্বতের মতো পাক খেতে খেতে এবং রক্তবমি করতে করতে রণাঙ্গন থেকে আঠাশ হাত পেছনে গিয়ে পড়ল। প্রিয় বাহন ঐরাবতের মুমুর্ষ অবস্থা দেখে দেবরাজ মনে মনে অত্যন্ত বিষণ্ণ হলেন। তিনি ঐরাবতের কাছে এগিয়ে গেলেন। তার অমৃতস্রাবি কর দ্বারা বাহনের ক্ষতের ওপর ঝুলিয়ে দিতে থাকলেন।

বজ্রধারী ও ভ্রাতৃহন্তা দেবরাজের সকল পাপস্বরূপ ক্রুর কর্ম স্মরণ করে পরিহাস করে বৃত্রাসুর বললেন– হে মহাপাপিষ্ঠ, তুমি ব্ৰহ্মঘাতী, গুরু হত্যাকারী, আমার ভাইদের বিনাশ করেছ, তুমি আমার চরম শত্রু। তুমি আবার আমার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছ। তা আমার পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার, তুমি লজ্জাহীন, শ্রীহীন ও কীর্তিহীন, দানবরাও তোমাকে ঘেন্না করে, তোমার ওই পাথরের ন্যায় কঠিন বক্ষস্থল আমি এখুনি শূল দ্বারা বিদীর্ণ করে দেব।

তাহলেই আমি ভ্রাতৃঋণ থেকে মুক্তি পাব। তোমার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পাপিষ্ঠ দেহ চিল, শকুন, ছাড়া কেউ স্পর্শ করবে না, আর তোমার সাথে হাত মিলিয়ে আমাকে আক্রমণ করতে যদি কেউ আসে তাহলে আমার এই ত্রিশূল তাদের গলদেশ ছেদন করে রক্তপাত ঘটাবে। আমি সেই রক্ত দ্বারা স্বগুণ ভূতনাথ ভৈরবগণের অর্চনা করব। তারপর যদি তোমার অস্ত্রে আমার মৃত্যু থাকে আমার কিছু যায় আসে না। আমি কর্মবন্ধন থেকে ছিন্ন হব। জ্ঞানীদের গতি প্রাপ্ত হব। হে মহেন্দ্র, তোমার গদা কেন। নিষ্ফল হয়ে বসে আছে? কিন্তু তোমার ওই বজ্র?

এর প্রতি কোনো বিরূপ সন্দেহ প্রকাশ করো না। ওই অস্ত্র ভগবান ও মহাঋষি দধীচির তপস্যার গুণ দ্বারা তেজীয়ান। ওই অশনি নিক্ষেপ কর, শত্রুকে ধ্বংস করো। তোমার পরাজয়ের কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ স্বয়ং শ্রীহরি যার সহায়, তার মঙ্গল অবশ্যম্ভাবী।

হে দেবরাজ, তুমি ভাবছ ওই বজ্রের আঘাত আমাকে যন্ত্রণা দেবে? না এরূপ চিন্তা করো না, আমার প্রভু সঙ্কর্ষণের কাছ থেকে আমি যে উপদেশ লাভ করেছি, তার দ্বারা গুরুর চরণে চিত্ত সমাহিত করে দেহত্যাগ করব। যোগীদের গতি লাভ করব। আমি ওই অস্ত্রের আঘাতে আমি বিষয়ভোগ রূপ গ্রাম্য পাশ ছিন্ন হয়ে ভগবান সঙ্কর্ষণের অনুচর হব। তিনি আমাকে স্বর্গাদি সম্পত্তি প্রদান করবেন– আশঙ্কাও ভুল।

আমার প্রভু কখনও এমন সম্পত্তি দান করেন না, যা থেকে দ্বেষ, উদ্বেগমত্ততা বিবাদ থেকে দুঃখ কষ্টের উৎপত্তি হয়। তিনি সেই ভগবান, যিনি ভক্তদের অর্থ, কাম, ধর্ম– এই ত্রিবর্গ বিষয়কে প্রয়াস দূর করেন, যা ধন-সম্পত্তি– ঐশ্বর্যের দ্বারা অনুমান করা যায় না, সেই দুর্লভ ভগবত প্রসাদ অকিঞ্চন ভিক্ষুজন অনায়াসে লাভ করে।

তারপর অসুরপতি বৃত্রাসুর ভগবান শ্রীহরির বন্দনা করলেন- হে ভগবান, যাঁরা তোমার পাদপদ্মযুগল আশ্রয় লাভ করে। আমি তাদের দাস, জন্ম জন্ম এই দাস হয়েই আমি থাকতে চাই। তুমি আমার প্রাণের প্রাণ। তোমার গুণের কথা আমার মন যেন কখনও বিস্মৃত না হয়? আমার মুখ যেন তোমার নামকীর্তনে সদা মুখর থাকে, তোমারই কর্মে আমার শরীর সর্বদা ব্যাপৃত থাকে। হে ঈশ্বর তুমি সকল সৌভাগ্যের আধার।

তাই তুমি বিনা আমি অন্য কিছু কামনা করি না, ছোট্ট ক্ষুধার্ত শিশু যেমন, মাতৃদুগ্ধ পান করার জন্য স্পৃহান্বিত হয়, প্রোষিত ভর্তৃকা কাম সন্তপ্ত নারী যেমন প্রবাসস্থিত প্রিয়তমের জন্য আকুলি বিকুলি করে, তেমনই আমি, আমার মন তোমার দর্শন লাভের কামনায় ক্রন্দনরত। হে প্রভু, সংসার পুত্র, কন্যা, বিষয় আশয় প্রভৃতির আসক্তি থেকে আমার চিত্তকে বিমুক্ত করো। আমি তোমার দাম হতে চাই। আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না।

.

একাদশ অধ্যায়

মহর্ষি শুকদেব বললেন– প্রলয় সমুদ্র জলে ভগবান বিষ্ণুর প্রতি কৌভাসুর যেমনভাবে পতিত হয়েছিল, ঠিক সেইভাবে বৃত্রাসুর দেবরাজের সামনে পতিত হল। সবেগে শূল ঘুরিয়ে সেটা নিক্ষেপ করল ইন্দ্রকে লক্ষ্য করে। দানবরাজের ওই শূল উল্কার মতো বেগসম্পন্ন ছিল। আকাশ পথে শূলাস্ত্র ভেসে আসতে দেখে মহেন্দ্র বিন্দুমাত্র ভীত হলেন না। শত পর্ব সমন্বিত বজ্রের দ্বারা তিনি অনায়াসে সেই ত্রিশূল এবং স্থূল ও বিশাল বৃত্রাসুরের একটি বাহু ছেদন করলেন।

একটি বাহু হারিয়ে সিংহনাদে গর্জন করতে করতে বৃত্রাসুর ইন্দ্রের সামনে এসে দাঁড়াল। পরিখ দিয়ে তার গালে আঘাত করল। ফলে, ইন্দ্রের হাত থেকে বজ্ৰাস্ত্রটি ভূমিতে পড়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে সুর, অসুর, সিদ্ধ, চারণ এবং গন্ধর্বগণ যেমন দানবদের ভূয়সী প্রশংসা করলেন, তেমনই ইন্দ্রের ভয়াবহ সঙ্কট দেখে উচ্চস্বরে হাহাকার করতে লাগলেন। হাত থেকে অস্ত্র পড়ে যাওয়ায় ইন্দ্র লজ্জা পেলেন এবং পুনরায় সেটি তুলে নেবার আগ্রহ দেখালেন না।

বৃত্রাসুর বলল- হে ইন্দ্র, তুমি কেন বৃথা বিষণ্ণ হচ্ছো? যিনি জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের অধীশ্বর, আমরা অর্থাৎ আমাদের দেহ এই সর্বজ্ঞ আদি পুরুষের অধীন। কালরূপী ভগবানই জয় পরাজয়ের কারণ, আমরা নিমিত্ত মাত্র। কিন্তু সকলে তাকে জয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে না। জড়রূপে এই যে দেহ তাকেই কারণ বলে স্বীকার করে, কাষ্ঠনির্মিত নারী যেমন স্বতন্ত্র হয়ে কোনো কাজ করতে পারে না, তেমনই প্রাণীবর্গ সেই ভগবান ঈশের পরতন্ত্র। তার প্রেরণা ছাড়া প্রকৃতি, পুরুষ, ভূত, ইন্দ্রিয়, মন, মহতত্ত্ব ইত্যাদি জীবের সৃষ্টিতে সক্ষম হতে পারে না। ঈশ্বর যেমন পিতা প্রভৃতির দ্বারা পুত্র-পুত্রাদি সৃষ্টি করেন। তেমন বাঘ-সিংহ প্রভৃতি হিংস্র জন্তুদের দ্বারা তাদের সংহার করেন। তাই-বলছি সকলই যখন ঈশ্বরের অধীন, তখন কেন বৃথা জয়-পরাজয়, সুখ-দুঃখ, জীবন-মরণ, এসব ধরে রাখতে চাইছ? সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ– এই তিনটি পদার্থ প্রকৃতির গুণ, আত্মার নয়। অনেকে ওই আত্মাকে ওই ত্রিগুণের সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। তারা হর্ষ-আনন্দ ইত্যাদির দ্বারা আবদ্ধ। হন না।

হে দেবরাজ, তোমার অস্ত্রে আমি আঘাত প্রাপ্ত হয়েছি। আমার অস্ত্র তুমি নিষ্ফল করে দিয়েছ। তুমি আমাকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছ, তবুও তোমাকে বধ করার ইচ্ছায় আমি যথাশক্তি প্রয়োগ করার চেষ্টা করছি। দূতক্রীড়া তুল্য এই যুদ্ধে যোদ্ধা ও প্রতিযোদ্ধার প্রাণই হল প্রধান বাজি। বিভিন্ন অস্ত্র এর পাশ এবং অশ্ব, হস্তি ইত্যাদি ফলক স্বরূপ বিরাজ করে। সেই যুদ্ধরূপ পাশাখেলায় কে জিতবে, আর কে হারবে– আগে থেকে কেউ বলতে পারে না।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে রাজন, বৃত্রাসুরের ওইসব নিষ্কপট কথা শুনে দেবরাজ মোহিত হলেন। কিন্তু তা প্রকাশ করলেন না, মাটি থেকে বজ্র তুলে নিলেন। হাসতে হাসতে বললেন– হে দানবেন্দ্র, তোমার বুদ্ধি প্রশংসনীয়। সকলের আহ্বা ও সুহৃদ যে জগদীশ্বর তুমি মনপ্রাণ ঢেলে তাঁর সেবা করেছ। তোমার মধ্যে অসুর ভাবের পরিবর্তে মহাপুরুষ ভাবের প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু ভগবান বাসুদেবের প্রতি তোমার এমন মতির কারণ কী? তা যাই হোক, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, ক্ষুদ্র গর্তের জলের ন্যায় ঐশ্বর্যাদিতে তোমার প্রয়োজন নেই, তুমি এখন ঈশ্বরের ভক্তি সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছো?

হে রাজা, তারপর দুই বীর্যবানের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হল। মহাবল বৃত্ৰ কৃষ্ণবর্ণ লৌহনির্মিত ঘোর পরিখবান হস্তে ধারণ করে নিক্ষেপ করল। সেটি আকাশপথে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে ইন্দ্রের দিকে ধ্বংসধাবিত হল। পরক্ষণেই সেই অস্ত্র ইন্দ্রের শত গ্রন্থি বিশিষ্ট বজ্রের কাছে পরাভূত হল। সেটি এসে আঘাত করল বৃত্রাসুরের অন্য আর একটি হাতে। তখন দুই বাহুর ছিন্নমূলদেশ থেকে রুধির অনর্গল নির্গত হচ্ছে।

বৃত্রাসুর এবার নীচের চোয়াল ভূতলে এবং ওপরের চোয়াল স্বর্গলোকে সংলগ্ন করে সর্পের ন্যায় উগ্র জিহ্বা, আকাশের ন্যায় গম্ভীর মুখ গহ্বর এবং যমের ন্যায় ভয়ংকর তীক্ষ্ণ দন্তরাজি দিয়ে ত্রিভুবনকে গ্রাস করতে চাইল। প্রথমে ঐরাবত সহ ইন্দ্রকে সে গ্রাস করল। এ দৃশ্য দেখে দেবতাগণ ও ঋষিগণ হায় হায় করে উঠলেন। বৃত্রাসুরের উদরস্থ হয়েও ইন্দ্রের কোনো ক্ষতি হল না। কারণ তার সঙ্গে ছিল নারায়ণ কবচ। ওই কবচের প্রভাবে এবং যোগ ও মায়াবলে তিনি অসুরজাতি বস্ত্র দ্বারা বিদীর্ণ করলেন। সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে শত্রুর মস্তক কেটে দিলেন। বৃত্রাসুরের পতন ঘটাতে ইন্দ্রের দ্রুত বেগযুক্ত বজ্রের তিনশো ষাট দিন সময় লেগেছিল।

বৃত্রাসুর বধ হলে দেবতারা দুন্দুভি বাজালেন। দেবরাজ ইন্দ্রের ওপর পুষ্প বর্ষিত হল, গন্ধর্ব ও সিদ্ধ মহর্ষিগণ তার বীর্য প্রকাশক মন্ত্র উচ্চারণ করে প্রশস্তি কীর্তন করলেন। বৃত্রাসুরের পরিত্যক্ত দেহ থেকে একজ্যোতি নির্গত হয়ে লোকতীত ভগবানের কাছে চলে গেল।

.

দ্বাদশ অধ্যায়

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে মহাবদ্রনামা মহারাজ বৃত্রাসুরের সংহার পর্ব শেষ হলে ইন্দ্র বাদে সকলেই ঈর্ষান্বিত মনে নিজের নিজের বাসভবনে ফিরে গেলেন। কেন ইন্দ্র বিষণ্ণ হয়েছিলেন, এখন সেই বৃত্তান্ত বলছি। বৃত্রাসুরের পরাক্রমে উদ্বিগ্ন হয়ে দেবগণ ও ঋষিগণ তাকে বধ করার জন্য ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা জানালে তিনি ব্রহ্মহত্যার ভয়ে ভীত হন।

কারণ এর আগে বিশ্বরূপকে বধ করে তিনি যে ব্রহ্ম হত্যার পাপের ভাগী হয়েছিলেন। তা ভূমি, জল, বৃক্ষ ও স্ত্রীলোকের মধ্যে ভাগ দিয়ে পাপমুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু আবার যদি ব্রহ্মহত্যার পাপে পড়তে হয় তাহলে তা মার্জনা করবেন কী ভাবে?

ইন্দ্রের আশঙ্কার কথা শুনে ঋষিগণ বললেন, আমরা তোমাকে মহা অশ্বমেধ যজ্ঞ করাব, যার দ্বারা ব্রহ্মঘাতী, পিতৃঘাতী, গোহত্যাকারী, মাতৃঘাতী, গুরুহত্যাকারী পাপীও পবিত্র হয়। এমনকি নীচজাতি চন্ডালও যাঁরা নাম কীর্তন করে শুদ্ধ হয়, সেই ভগবান নারায়ণকে ভক্তিভরে অর্চনা করবে। এর ফলে দুষ্টু বৃত্রাসুর কেন, ব্রহ্মসহ চরাচর বিশ্ব সংহার করলেও তুমি পাপলিপ্ত হবে না।

ঋষিদের প্রবোধ বাক্য মতো দেবরাজ ইন্দ্র মহারিপু বৃত্র সংহার করলেন। কিন্তু তাদের স্তোকবাক্য মত ব্ৰহ্ম হত্যার পাপ তার পিছু ছাড়ল না। ফলে ইন্দ্র হলেন বিষণ্ণ, তিনি কিছুতেই নিজেকে সন্তাপ মুক্ত করতে সমর্থ হলেন না। বহু গুণযুক্ত ব্যক্তি যেমন একটি নিন্দনীয় কর্ম করে লজ্জাবোধ করেন, ইন্দ্রও তেমনই ব্রহ্মহত্যা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না। ভীষণ ভয়াল মুর্তি ধারণ করে চন্ডালীর ন্যায় ব্রহ্মহত্যা তাকে তাড়া করে বেড়াল। সর্বক্ষণ চোখের সামনে সেই ভয়ংকর মূর্তি ভেসে উঠল জরাব্যাধিগ্রস্ত তার শরীর কাঁপছে। অতিশয় ক্ষয়রোগে দেহ নুয়ে পড়েছে, রক্তে রাঙা বসন পরিহিত তাম্রবর্ণের কেশরাশি। মরা মাছের ন্যায় তার নিশ্বাসে দুর্গন্ধ বিকীর্ণ করে, সে কেবল চিৎকার করছে– তিষ্ট, তিষ্ট অর্থাৎ দাঁড়াও দাঁড়াও। সহব্রহ্ম ইন্দ্র ওই ভয়াল জঘন্যরূপ দেখে ভীত হলেন।

পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষায় স্বর্গ চষে বেড়ালেন। না, কোনো উপযুক্ত স্থান পাওয়া গেল। শেষ পর্যন্ত পূর্বদিকে গমন করে মানস সরোবরে এসে আশ্রয় নিলেন। সেখানে পদ্মের মৃণাল সূত্রসমূহের মধ্যে হাজার বছর কাটিয়ে দিলেন।

ইন্দ্রের অনুপস্থিতিতে নহুষ দেব সিংহাসনে বসলেন। বিদ্যা, তপস্যা ও যোগবলে রাজা নহুষের স্বর্গ পালনের ক্ষমতা ছিল, কিন্তু অল্প কিছু দিনের মধ্যে তিনি হয়ে উঠলেন ঐশ্বর্যলাভে দাম্ভিক। হিতাহিত জ্ঞান বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি একদিন ইন্দ্রপত্নী শচীকে কামনা করলেন। শচী ধর্মলোপ ভয়ে অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে দেবগুরু বৃহস্পতির শরণাপন্ন হলে দেবগুরু তাকে নহুষের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় বলে দিলেন।

একদিন নহুষ শচীর কাছে এসে হাজির হলেন। আগের মতোই বললেন– আমিই এখন ইন্দ্র। তুমি আমার ইন্দ্রাণী। এসো, আমরা দুজনে নির্জনে বিহার করি। শচীদেবী দেবগুরুর পরামর্শমতো বললেন– রাজন, ব্রাহ্মণদের বাহক করে সেই শিবিকাতে চড়ে তুমি এলে তবেই আমি তোমার ভজনা করব।

বিপ্রগণকে বাহক করলে ব্রহ্মহত্যার শাপে যে পতন ঘটে, তা মনে হয় নহুষের জানা ছিল না। তিনি অগস্ত্য ইত্যাদি শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের শিবিকা বহনের জন্য নিযুক্ত করলেন। বাহকেরা দ্রুত পালকি নিয়ে ছুটছিল। কাম উত্তেজনায় অস্থির হয়ে ঋষিগণকে দ্রুতগতিতে গমনের নির্দেশকালে স্বর্গপতি রাজা নহুষ পা দিয়ে ঋষি অগস্ত্যকে স্পর্শ করে বললেন–সর্প, সর্প। অর্থাৎ চল চল। ঋষি অগস্ত্য অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি অভিশাপ দিলেন- তুমিই সর্প। সঙ্গে সঙ্গে নহুষ মস্ত এক অজগর সাপে পরিণত হলেন।

ব্রাহ্মণদের আহ্বানে দেবরাজ ইন্দ্র, আবার ফিরে এলেন স্বর্গলোকে। সত্য পালক শ্রীহরির ভজনা করাতে তিনি ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। ভগবানের ধ্যান দ্বারা ইন্দ্র পাপমুক্ত হলেও ব্রহ্মর্ষিগণ তাঁকে দিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞ করালেন। কারণ এই যজ্ঞে ভগবান শ্রীহরির আরাধনাই প্রধান কর্ম।

সর্বদেবময় পরমাত্মা পরমপুরুষ শ্রীহরির আরাধনা করার ফলে, সূর্য যেমন তার প্রবল তেজ ও তাপের দ্বারা ঝড়ঝঞ্ঝাকে বিতাড়িত করে, ঠিক তেমনই ভাবে শ্রীহরিই ইন্দ্রের বৃত্রহত্যামূলক পাপের উচ্ছেদ করেছিলেন। ফলে দেবরাজ ইন্দ্র হৃত মহত্ত্ব ফিরে পেয়েছিলেন। . হে রাজন, যে উপাখ্যানে ভগবান শ্রীহরি ও তাঁর ভক্তগণের চরিত্র এবং দেবরাজ ইন্দ্রের পাপমুক্তি

ও বিজয় বর্ণিত হয়েছে, সেই আখ্যান পণ্ডিতগণ সর্বদা পাঠ করেন। এতে ধন ও যশ লাভ হয়। পাপক্ষয় ও শত্ৰুজয়মূলক এই আখ্যান যে শ্রবণ করে বা পাঠ করে তার সকল কামনা পূরণ হয়, তার আয়ু বৃদ্ধি হয়।

.

এয়োদশ অধ্যায়

রাজা পরীক্ষিৎ বললেন– হে মহামুনি, রাজাস্তমঃ প্রকৃতি পাপাত্মা বৃত্রাসুর ইন্দ্রের ভয়ে, ভগবানের আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন, একথা বলা যায় না। বরং তিনি রণাঙ্গনে এমন পীরুন্থর প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, যা স্বয়ং ইন্দ্রকে ভীত করে তুলেছিল। শুদ্ধসত্ত্ব দেবতাদের এবং নির্মল মনের ঋষিদেরও যাঁর পাদপদ্ম যুগলের প্রতি ভক্তি জন্মায় না, তাতে বৃত্ৰসুরের ভক্তির উদয় হল কীভাবে, কোটি কোটি ব্যক্তির মধ্যেও এমন পুরুষ অতি দুর্লভ, যে গৃহ সমাহতেচ যুক্ত হয়ে নারায়ণ পরায়ণ প্রশান্ত চিত্তের মানুষ হয়েছেন। এই অবস্থায় কিভাবে বৃত্রাসুরের ভগবান শ্রীহরির প্রতি ভক্তি জন্মেছিল তা শ্রবণ করার জন্য আমি অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠেছি। আপনি কৃপা করে সেই বৃত্তান্ত ব্যাখ্যা করুন।

শ্রী শূকদেব বললেন– পুরাকালে মহর্ষি ব্যাসদেব, শ্রীনারদ ও দেবলের কাছ থেকে আমি যা শুনেছিলাম, তোমাকে সেই কথাই বলছি। এখন সেই সময় শূরসেন অর্থাৎ মথুরা মন্ডপের রাজা ছিলেন চিত্রকেতু। তিনি ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ সার্বভৌম নরপতি। রূপবতী, যুবতী, লাবন্যময়ী, বিদ্যাবতী, ঐশ্বর্যশালিনী এবং ঔদার্যপূর্ণ কোটি পত্নী থাকা সত্ত্বেও সেই রাজা ছিলেন সন্তানহীন। বন্ধ্যা পত্নীদের পতি হওয়ায় তিনি সর্বদা মনোদুঃখে ভুগতেন। সমস্ত সম্পদ ঐশ্বর্য, পত্নীগণ, রাজ্য সবকিছু তার কাছে। অবস্থিত মনে হল।

অঙ্গিরা ঋষি একবার ভ্রমণে বেরিয়ে এলোক সেলোক করতে করতে মথুরামন্ডলে এসে হাজির হলেন। ব্রহ্মপুত্র অঙ্গিরাকে দেখে রাজা চিত্রকেতু অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, তিনি নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঋষিকে অভিনন্দিত করে সিংহাসনে বসতে বললেন। রাজা নিজে ভূমিতে আসন গ্রহণ করলেন। সম্ভাষণ পর্ব শেষ হলে ঋষি বললেন– তোমার খবর ভালো তো? তোমার রাজ্য এবং পত্নীগণ মঙ্গলে আছেন? যেমন সপ্ত প্রকৃতির দ্বারা জীব নিত্য রক্ষিত হয়, তেমনই রাজও সপ্তবিধ প্রকৃতির অর্থাৎ স্বামী, অমাত্য, রাজ্য দুর্গ, কোষ দন্ড এবং মিত্র দ্বারা সুরক্ষিত হয়। রাজা যেমন প্রকৃতি বর্গের কাছে আত্মসমর্পন করে রাজ্যসুখ ভোগ করে তেমনই প্রকৃতিবর্গ সেই রাজ প্রদত্ত কর্মভার প্রাপ্ত হয়ে ধনসমৃদ্ধি লাভ করে থাকে।

তোমার পত্নীগণ অমাত্য গণ, মন্ত্রীগণ, রাজ্যবাসীগণ সকলে তোমার বশবর্তী আছেন তো? হে রাজা, নিজের মনকে যে বশে রাখতে পারে না, সে কাউকে বশে রাখতে পারে না। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার চিত্তে ব্যাকুলতা জেগেছে। তোমার মুখ চিন্তাচ্ছন্ন, চেহারা বিবর্ণ, তুমি নিশ্চয়ই এমন কোনো কামনা পোষণ করেছ, যা থেকে তুমি বঞ্চিত।

প্রজাবৎসল রাজা বিনয়ে অবনত হয়ে বললেন– হে ভগবান, আপনি সর্বজ্ঞ কোনো কিছুই আপনার অজানা নয়। তবু আপনার আজ্ঞায় আমি আমার মানসিক চিন্তার কথা আপনাকে অবগত করছি। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর ব্যক্তি, যেমন মালা চন্দনাদিতে সন্তুষ্ট হয় না, সে জল ও অন্ন আকাঙ্ক্ষা করে, তেমনই এই বিশাল সাম্রাজ্য, অমাত্যবর্গ, ঐশ্বর্য, প্রজাবৃন্দ সন্তানহীন আমাকে আনন্দ দিতে পারছে না। হে মহাভাগ, আমি সন্তানের অভাবে পূর্বপুরুষগণের সাথে নরকপ্রাপ্তির ভয়ে শিউরে উঠেছি। আপনি আমাকে সন্তান দানে সাহায্য করুন। এই দুস্তর নরক কী ভাবে আমি অতিক্রম করব, আপনি আমাকে বলে দিন।

পরম কারুণিক অঙ্গিরা ত্বষ্ট দেবতার যজ্ঞ শুরু করলেন। চিত্রকেতুর মনস্কামনা জানিয়ে তাকে প্রার্থনা জানালেন। চরু তৈরি করে সেই যজ্ঞে আহুতি দিলেন। তারপর চরুর কিছুটা চিত্রকেতুর সর্বজ্যেষ্ঠা ও শ্রেষ্ঠা মহিষীকে দিলেন। মহিষী কৃতদ্যুতি সেই পরমান্ন ভক্ষণ করলেন।

মহর্ষি অঙ্গিরা বিদায়কালে বলে গেলেন হে রাজন, তুমি একটি মাত্র পুত্রের জনক হবে, যে তোমাকে একদিকে আনন্দ দান করবে, অপরদিকে শোক সাগরে ভাসাবে।

তারপর যথাসময়ে চিত্রভানুর ঔরসে কৃতদ্যুতির গর্ভে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হল। রাজকুমারের জন্মের সুসংবাদ শুনে রাজ্যবাসী আনন্দে আত্মহারা হল। রাজা শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের ডেকে পাঠালেন। হাতজোড় করে নবজাতক পুত্রের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন, তারপর দানধ্যান শুরু করলেন, বস্ত্র, অলংকার গ্রাম, ঘোড়া, হাতি, দুগ্ধবতী গাভী-সব কিছু ব্রাহ্মণদের হাতে প্রদান করলেন। পুত্রের ধন, যশ ও আয়ু কামনা করে তিনি অকাতরে দান করেছিলেন। রাজা তখন পুত্রকে নিয়ে সদাব্যস্ত থাকেন, তার প্রতি সমস্ত আদর স্নেহ বর্ষণ করেন।

এদিকে মা কৃতদ্যুতিরও পুত্রের প্রতি মোহজনক স্নেহ উদয় হয়েছিল। কৃতদ্যুতি পুত্র লাভ করেছে কিন্তু তার সপত্নীদের পুত্রকামনায় মনস্তাপ জন্মাল অন্তরেও। তাছাড়া পুত্রবতী ভার্যার প্রতি রাজা চিত্রভানু বেশি নজর দিতে শুরু করেছেন। অন্যান্য পত্নীরা স্বামীর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

পুত্রসন্তানের অভাবজনিত দুঃখে এবং রাজার অনাদর হেতু তাদের অবস্থা এমন হল যে নিজেরাই নিজেদের, নিন্দায় মুখর হল। তারা ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে ছাই হতে লাগল। ওই নবজাতক কুমারের প্রতি তারা কোনো আকর্ষণ বোধ করল না। দিনে দিনে তাদের মনের তিক্ততা বেড়ে গেল। রাজার সুখের প্রতি নজর দেওয়াও অবঞ্ছিত বলে মনে হল তাদের, তাদের চিত্তে নিষ্ঠুরতা দেখা দিল, তাঁদের বুদ্ধি নাশ হল। তারা বিষপ্রয়োগ করে ওই শিশুকুমারের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন।

সেদিন কুমার শয্যায় ঘুমিয়ে আছে। কৃতদ্যুতি ঘরে এসে ঢুকলেন। ছেলেকে নিদ্রিত দেখে তাকে আর জাগালেন না। নিজে ঘরের মধ্যেই পদচারণা করতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে কেটে যাওয়ার পর রাজমহিষী বললেন– ধাত্রী ছেলেটাকে জাগিয়ে দাও, আমার কাছে নিয়ে এসো। ধাত্রী রাজমহিষীর আজ্ঞা অনুসারে বালকের বিছানার কাছে এল।

দেখল, ছেলেটি বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। মণিদুটো নিশ্চল ও ওপরদিকে উঠে আছে। প্রাণহীন দেহটা ঘাটের ওপর শুয়ে আছে। সে আর্ত চিৎকার করে উঠল– হায় হত হলাম, পরক্ষণেই সে বুক চাপড়ে চিৎকার করে হাহাকার করে উঠল।

ধাত্রীর ক্রন্দনধ্বনি শুনে রাজমহিষী ছুটে এলেন। মৃত বালককে দেখে সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা গেলেন। তাঁর আলুলায়িত কেশরাশি ছড়িয়ে পড়ল। বস্ত্র হল অবিন্যস্ত। ততক্ষণে অন্তঃপুরে সকলে এসে হাজির হয়েছে। নিস্পন্দ, নিথর কুমারের দিকে তাকিয়ে সকলে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলেন, অপরাধিনী সেই রাজপত্নীগণ কপট শোক বিলাপ করতে লাগল। সপত্নীদের নৃশংসতার বিষয়ে কৃতদ্যুতি কিছুই অবগত ছিলেন না।

পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে রাজা পুত্রের কক্ষের দিকে গমন করলেন। কী কারণে তার হঠাৎ মৃত্যু হল, তার হদিস পেলেন না। আকস্মিক শোক সংবাদে তার চোখ দুটি দৃষ্টি হারাল। ব্যগ্র হয়ে তাড়াতাড়ি যেতে গিয়ে পড়ে গেলেন। আবার উঠে দাঁড়ালেন। বারবার তিনি জ্ঞান হারালেন। পারিষদবর্গের সাহায্যে কোনোরকমে মৃতপুত্রের পায়ের সামনে এসে পড়লেন। তাঁর কেশদাম তখন অবিন্যস্ত, বসন আলু থালু। বাষ্পবিন্দু দ্বারা সংবৃত্ত হয়ে তাঁর কণ্ঠরোধ হল। কথা বলার ক্ষমতা নেই। কেবল চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল আর দীর্ঘনিশ্বাস।

মহিষী কৃতদ্যুতি আক্রোশে বিধাতাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বললেন– হে ভগবান। তোমাকে সবাই দয়ালু বলে জানে, কিন্তু আমি তোমাকে নিষ্ঠুর পাষাণ বলছি। বৃদ্ধ পিতাকে জীবিত রেখে ছোটো ছেলেকে তুমি মৃত্যু দিলে। এই কি জন্ম মৃত্যুর ক্রম। যদি তাই হয়, তাহলে কেন লোকে তোমার কর্মাধীন হবে। জীবগণ নিজ নিজ কর্মনুসারেই যে কোনো সময়ে জন্ম-মৃত্যু ঘটাবে। যে বৃদ্ধ সৃষ্টি ক্ষমতাহীন, তাকে বাঁচিয়ে রেখে শিশুপুত্রের প্রাণ ছিনিয়ে নিলে।

এভাবে চলতে থাকলে সৃষ্টিই বিনষ্ট হবে। তুমি হয়তো বলবে, ঈশ্বর ছাড়া কেবল কর্মদ্বারা জন্ম মৃত্যু সিদ্ধ হতে পারে না। তাহলে আমি বলব, তুমি নিজ সৃষ্টি বৃদ্ধির জন্য যে স্নেহপাশ রচনা করেছ, নিজের কাজের মাধ্যমে নিজেই তা ধ্বংস করছ। এরকম ব্যবস্থা চলতে থাকলে কোনো পিতা-মাতা

পুত্রাদির প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করবে না।

তারপর মৃত শিশুপুত্রকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে বিলাপ করতে লাগলেন– বাছা আমার, তোমার এই হতভাগিনী মাকে অনাথ করে দিয়ে যেও না। দেখো, তোমার বাবা তোমার শোকে সন্তপ্ত। চোখ মেলে তাকাও বৎস। দেখো, তোমার সঙ্গীরা তোমাকে ডাকছে। তুমি ওদের সঙ্গে খেলতে যাবে। আর কতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবে। এবার উঠে পড়ো।

হে রাজপুত্র, ওঠো, তোমার নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে। ওঠো স্তন্য পান করো। তোমার পদ্মমুখের মিষ্টি হাসি দেখার জন্য আমার অন্তর আকুল হয়ে উঠেছে। তোমার মধুর কথা আমি কেন শুনতে পাচ্ছি না? তোমার আঁখিপল্লব মুদ্রিত। তাহলে কালরূপী যম কি তোমাকে লোকান্তরে নিয়ে গেছে?

একদিকে মহিষীর বিচিত্র শব্দের বিলাপ, অন্যদিকে রাজা চিত্রকেতুর মুক্তকণ্ঠে ক্রন্দন দুই নারী পুরুষের শোক বিলাপ দেখে উপস্থিত সকলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। একসময় তাদের এমন অবস্থা হল যেন তারা পাথরের ন্যায় নির্বাক, প্রায় জ্ঞানশূন্য।

সর্বজ্ঞ ঋষি অঙ্গিরা রাজা চিত্রকেতুর বিপদের কথা জানতে পেরে নারদকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে এসে হাজির হলেন।

.

চতুর্দশ অধ্যায়

শুকদেব বললেন– শোক-সন্তপ্ত পিতা চিত্রকেতুকে মৃত পুত্রের সামনে প্রায় অচেতন হয়ে বসে থাকতে দেখে ঋষি অঙ্গিরা ও দেবর্ষি নারদ তাকে নানা সদবাক্যের দ্বারা প্রবোধ দিয়ে বললেন– হে রাজেন্দ্র। সকল বীজ থেকে কী গাছ উৎপন্ন হয়? কোনো কোনো বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটে তা ধীরে ধীরে বেড়ে বৃক্ষে পরিণত হয়, কোনো বীজ অঙ্কুরোদগম কালেই বিনষ্ট হয়।

তেমনই পিত্রাদি রূপ পরিচিত কোন জীব হতে পুত্ৰাদিরূপে কখনও অন্য জীবের উৎপত্তি হয়, কখনও হয় না, কখনও উৎপত্তি হলেও অকালেই তার বিনাশ ঘটে। আসলে সবই পরমেশ্বরের মায়া। যার কোনো সত্যতা নেই অর্থাৎ পিতৃ-পুত্রভাবের কোনো নিত্যতা নেই।

হে রাজন! বর্তমানে যা কিছু দেখছ, এখানে যারা আছে, প্রত্যেকের সাথেই তোমার কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে, কাল এদের মৃত্যু হলে এরা আর থাকবে না। অর্থাৎ এদের কোনো বাস্তব সত্তা নেই, ভূতগণের সৃষ্টি পূর্ণকাম বলে সৃষ্টি প্রভৃতি কার্যের কালাকাঙ্খী তুলেও বালকের ন্যায় লীলাচ্ছলেই নিজস্ব মায়ার চিতপরতন্ত্র ভূতসমূহের দ্বারাই ভূত সকলের সৃষ্টি, পালন ও সংহার করেন। অর্থাৎ কারও দ্বারা কারও সৃষ্টি, কারও দ্বারা কারও পালন, কারও দ্বারা কারও সংহার করছেন, অকালে তার মায়াবলেই সবকিছু সাধিত হচ্ছে, এতে কোন সন্দেহ নেই।

হে রাজা, বীজ থেকে যেমন অপর বীজ উৎপন্ন হয়, সেরকমই পিতৃ প্রভৃতি দেহধারী ব্যক্তির দেহদ্বারা মাতৃপ্রকৃতি দেহধারী অপর ব্যক্তির দেহ থেকে পুত্রাদি দেহধারী দেহই উৎপন্ন হয়। বীজের উৎপত্তিস্থলে ভূমির যেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না, তেমনই দেহী আত্মার কোনোরূপ অবস্থান্তর হয় না। একমাত্র সৎস্বরূপ অদ্বিতীয় ব্রহ্মবস্তুতে মনুষত্বাদি জাতি এবং মনুষ্যাদিরূপ ব্যক্তির ভেদ যেরূপ অজ্ঞান বা মায়ারই কল্পনা মাত্র, সেরূপ ব্রহ্মবস্তুতেই দেহ ও দেহী এরূপ ভেদ অজ্ঞান কর্তৃকই অনাদিকাল হতে রয়েছে। সুতরাং অনাদি সিদ্ধ বস্তুতে কোনোরকম আশঙ্কার উদয় হতে পারে না।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে মহারাজ, মহর্ষি অঙ্গিরা ও দেবর্ষি নারদের এহেন উপদেশে আশ্বস্ত হয়ে মনস্তাপে মালিন্যগ্রস্ত নিজ মুখমণ্ডল তুলে রাজা চিত্রকেতু বললেন– হে মহাশয়গণ, আপনাদের জ্ঞানবাক্য শ্রবণ করে আমার ধারণা, আপনারা কোনও মহীয়ান লোকেদের থেকেও মহত্তর। স্বরূপ গোপন করে এখানে এসেছেন। আমি অন্ধকারে নিমগ্ন, মূঢ়বুদ্ধি, গ্রাম্য পশুতুল্য। আপনারা দয়া করে আপনাদের জ্ঞান প্রদান করে আমার অজ্ঞতা দূর করুন।

অঙ্গিরা নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ঋষি আমিই, তোমার পুত্র কামনা পূর্ণ করেছিলাম, আর ইনি হলেন সাক্ষাৎ ব্রহ্মার পুত্র দেবর্ষি নারদ। তোমার মতো হরিদাসের পুত্রশোকে তমোম হওয়া উচিত নয়। পুত্রবান ব্যক্তিরা মনস্তাপে ভোগে। এই সংসারের যা কিছু স্ত্রী, গৃহ, ধন, বিবিধ ঐশ্বর্য ও সম্পদরাশি সন্তাপ দায়ক, ভৃত্য, অমাত্য রাজভাণ্ডার, শত্রু, মিত্র, প্রজাবৃন্দ– সকলই অস্থায়ী, এদের যেমন সৃষ্টি আছে, তেমনই বিনাশও ঘটে। এইসবই ইন্দ্রজাল, স্বপ্নের ন্যায়। এদের কোনো বাস্তবসত্তা নেই, সবই অপ্রতীতি মনের কল্পনাপ্রসূত মাত্র। অবশ্য শাস্ত্রে একেই পাপ ও পুণ্য কর্মের ফল বলা হয়েছে। তবুও পুরুষ মনের দ্বারা বিষয় সমূহের চিন্তা দূর করেই তা লাভ করার জন্য কর্মের অনুষ্ঠান করে এবং ফলরূপে স্বর্গাদি প্রাপ্ত হয়। ওই স্বর্গ ইত্যাদিও আসলে মনকল্পিত পদার্থ, তাই বলছি, তুমি স্থির চিত্তে আত্মতত্ত্ব বিচার করো এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস পরিত্যাগ করে শান্তিমার্গে প্রবেশ করো।

.

পঞ্চদশ অধ্যায়

দেবর্ষি নারদ যোগবলে মৃত রাজপুত্রের আত্মাকে অনুশোচনারত জ্ঞাতিদের দেখিয়ে সেই আত্মাকে সম্বোধন করে বললেন–হে জীবাত্মন, তোমার মঙ্গল হোক। দেখো, তোমার বিরহে তোমার পিতামাতা, তোমার প্রিয়জনরা শোকসন্তপ্ত হয়েছেন। অপমৃত্যুর কারণে আয়ুষ্কাল পূর্ণ না হতেই তুমি দেহ পরিত্যাগ করেছ। তুমি আবার নিজ দেহে প্রবেশ করে সুহৃদদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আয়ুর অবশিষ্টকাল পিতৃপ্রদত্ত বিষয় ভোগ করো এবং রাজাসনে উপবেশন করো।

মৃত-শরীরে প্রবেশ করে জীব বলল– কর্মের ফলে আমি দেব, পশু ও মনুষ্যকুলে বারে বারে জন্ম নিয়েছি। জন্ম ভেদে সকল মানুষই সকলের পিতা-মাতা, বন্ধু, আত্মীয়, জ্ঞাতি ইত্যাদি সম্পর্ক হয়ে থাকে, ক্রয়-বিক্রয় যোগ্য দ্রব্য যেমন একের হাত থেকে অন্যের হাতে ঘুরে বেড়ায়, তেমনই মানবগণ একের কাছ থেকে অন্যের কাছে পুত্ৰাদি নানারূপে ভ্রমণ করে। যার সঙ্গে যতকাল সম্বন্ধ থাকে, ততকাল সে আমায় ‘আমার’ বলে আঁকড়ে রাখে। জীব আসলে নিত্য বস্তু। দেহের জন্ম মরণের দ্বারা তার জন্ম মৃত্যু ঘটে না। তাই আমি এর পুত্র– এরকম অভিমানও সে করে না। জীবের প্রিয়-অপ্রিয় কিছু নেই। দোষ, গুণ, ক্রিয়াকাল– কিছুই জীব গ্রহণ করে না। জীব কারণ ও কার্যের সাক্ষীমাত্র। আমরা সকলেই এই আত্মা। আমাদের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। তাই আমার তোমাদের মধ্যে কোনো সম্বন্ধ নেই। তাই বৃথা শোক বা মোহগ্রস্থ হওয়া নিষ্প্রয়োজন। এই কথা বলে জীব দেহ ত্যাগ করে চলে গেল।

শুকদেব বললেন– রাজা চিত্রকেতুর যেসব পত্নীরা বালককে বিষদানে হত্যা করেছিল তারা এবার লাঞ্ছিত হল। শিশু হত্যার পাপে পাপগ্রস্ত হল। তারা শিশু হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য যমুনাতীরে গমন করল।

নারদ ও অঙ্গিরার উপদেশ বাক্য শ্রবণ করে রাজা চিত্রকেতু জীবাত্মা ও ভগবৎ স্বরূপ বুঝতে পারলেন। তিনি গৃহরূপ অন্ধকার থেকে নির্গত হয়ে যমুনার তীরে এলেন। স্নান ও তর্পণ সমাপ্ত করে মৌনী ও জিতেন্দ্রিয় হয়ে ওই দুই ব্রহ্মপুত্র অঙ্গিরা ও নারদের চরণ বন্দনা করলেন। নারদ সন্তুষ্ট হয়ে রাজাকে মন্ত্র উপনিষদ প্রদান করলেন।

নারদ বললেন– হে মহারাজ! এই মন্ত্র ধারণ করে তুমি সাত রাতের মধ্যে সর্বব্যাপক ভগবান সংকর্ষণ দেবের দর্শন লাভ করতে পারবে। সেই সংকর্ষণ দেবের স্তব করবে– হে প্রভু, যিনি পরম আনন্দময়, যিনি আত্মারাম এবং শান্ত। যা থেকে দ্বৈত দৃষ্টি নিরস্ত হয়েছে, আমি সেই প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ ও সংকর্ষণের প্রতি প্রণিপাত হই। যিনি স্বয়ং বিষয়, ইন্দ্রিয় সকলের ঈশ্বর, সেই মহানও অনন্ত মূর্তিধারী বাসুদেবকে প্রণাম জানাই। যিনি একাকী প্রকাশিত, যিনি নাম ও রূপহীন, যিনি চিন্ময় স্বরূপ কার্য ও কারণের কারণ, তিনি আমাকে রক্ষা করুন।

যা থেকে এই জগৎ প্রপঞ্চ আবির্ভূত হয়ে যাতে অবস্থান করে এবং অন্তে যাঁর মধ্যে লয় প্রাপ্ত হয়, যিনি চরাচরের সকল পদার্থে অনুসৃত হয়ে আছেন, আমি সেই পরমব্রহ্মকে প্রণাম নিবেদন করি। প্রাণীগণ যাঁকে স্পর্শ করতে পারে না, মন, বুদ্ধি বা ইন্দ্রিয় সকলের দ্বারা যাঁকে জানতে পারে না, যিনি আকাশের ন্যায় জগতের অন্তরের ও বাইরে বিরাজ করছেন, তিনিই ব্রহ্ম। জীব স্রষ্টা হলেও সেই ব্রহ্ম বস্তুকে অবগত হতে পারে না। কারণ জাদ্রেদাদি কালে ব্রহ্মই দ্রষ্টা, এই সংজ্ঞা প্রাপ্ত হয় বলে, জীবন্ততা হতে ভিন্ন নয়। এ অবস্থায় একের মধ্যে কতৃত্ব ও কর্মত্ব উভয়ভাব অসম্ভব বলে, ব্রহ্ম ভিন্ন জীবের পক্ষে ব্রহ্মার গতি বা ব্রহ্মার প্রকাশ করা সম্ভবপর হয় না। সেই মহাপুরুষ মহানুভব মহবিভূতি ভগবানকে প্রণাম জানাই।

দুর্লভ বিদ্যা দান করে দেবর্ষি নারদ ও ঋষি অঙ্গিরা সেখান থেকে অদৃশ্য হলেন। রাজা চিত্রকেতু ওই মন্ত্র জপ করতে শুরু করলেন। সামান্য জলপান করে সাত রাত কাটিয়ে দিলেন। ওই বিদ্যার প্রভাবে তিনি এক অভর্থ ফললাভ করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই ওই বিদ্যার বলে তার মন উদ্দীপ্ত হল। সেই মনের দ্বারা গতিশীল হয়ে তিনি দেবদেব ভগবান অনন্তদেবের চরণপ্রান্তে গমন করলেন।

সেখানে তিনি ভগবান সংকর্ষণকে প্রত্যক্ষ করলেন। তিনি পার্ষদ পরিবেষ্টিত হয়ে রত্ন- সিংহাসনে আসীন। তিনি কিরীটি, কেয়ুর, কঙ্কন, আর কত কী অলংকারে সুশোভিত। তিনি শান্ত ও প্রসন্ন। অনন্তদেবকে দর্শন করে রাজা চিত্রকেতুর সমস্ত পাপ বিনষ্ট হল। তিনি শুদ্ধ হলেন মস্তক অবনত করলেন অনন্তদেবের পাদপদ্ম যুগলের ওপর। চোখের জলে অভিষিক্ত হল সেই চরণদ্বয়। চিত্রকেতু তখন ভগবান বন্দনা করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন। নিজের বুদ্ধি বলে মনকে সংযত করলেন। ইন্দ্রিয় সমূহের ব্যহ্যবৃত্তি অবরুদ্ধ করে বাকশক্তি ফিরে পেলেন। জগদগুরু ভগবানের উদ্দেশ্যে স্তব করলেন।

তিনি বললেন– হে ভগবান, জগতের সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, প্রবেশ, নিয়মাদি, যা কিছু দৃষ্ট হয়, এসবই আপনার বৈভব, জগতের সৃষ্টি প্রভৃতি ক্রিয়ার কর্তা বলে যাঁরা খ্যাত, সেই ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু, প্রভৃতি আপনার অংশস্বরূপ। পুরুষের অংশমাত্র কামনা সহকারে ও নির্গণ স্বরূপ আপনার উপাসনা করলে, উপাসকের ক্রমশ নৈগুণ্য হতে পারে।

হে অজিত, অনিন্দনীয় ভাগবত ধর্মের উপদেশকালে আপনি সর্বপ্রকার জয়লাভ করেছেন। অন্য কাম্য ধর্মের ন্যায় ভাগবত ধর্মে ভেদবুদ্ধি নেই। যে ধর্ম নিজের এবং অন্যের পীড়ার কারণ হয়, সেই ধর্ম কারো কোনো মঙ্গল করতে পারে না। স্থাবর ভাঙ্গন সকল প্রাণীর প্রতি সমবুদ্ধি সম্পন্ন ভগবত ভক্তগণ ওই ভাগবত ধর্মের সেবা করে থাকেন।

হে ভগবান। আপনার নাম যে উচ্চারণ করে, তার সকল পাপ বিনষ্ট হয়, দেবর্ষি নারদের উপদেশেই আমি আপনার দর্শন লাভ করেছি। আমার মনের সমস্ত মলিনতা দূর হয়েছে। আমি পবিত্রতা লাভ করেছি।

হে প্রভু, আপনি অন্তর্যামী আপনি সর্বজ্ঞ, নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের অধীশ্বর। হে পরমহংস শ্ৰী, আপনাকে প্রণাম করি, যিনি সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্যত হলে, তাঁরই আজ্ঞায় বিশ্বস্রষ্টা দেবগণ নিজ নিজ কাজে উদ্যম প্রকাশ করেন, যিনি আত্মপ্রকাশ দ্বারা জাগতিক প্রকাশ্য বস্তুসমূহের প্রকাশ করলেই ওই সব বিষয়ের প্রকাশে সমর্থ হয়, যার একটি মাত্র মস্তকের এক পাশে নিখিল ব্রহ্মাণ্ড ক্ষুদ্রাকৃতি সরষের ন্যায় অবস্থান করে। সেই সহস্র শীর্ষ ভগবান অনন্তদেবের চরণে প্রণাম জানাই।

বিদ্যাধরপতি চিত্রকেতুর স্তব বন্দনায় ভগবান শ্রীহরি অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন। তিনি বললেন– হে রাজন, আমি ভূতসকলের প্রকাশক ও কারণ, আমিই সকল ভূতের আত্মা। অনেকে শব্দব্রহ্ম অর্থাৎ বেদকে প্রকাশক এবং পরব্রহ্মকে কারণ বলেছেন। এর মধ্যে কোনো মিথ্যা নেই। কারণ ওই শব্দব্রহ্ম ও পরব্রহ্ম আমারই সনাতন মূর্তি। ভোক্তা এবং ভোগ্য উভয়েই কারণরূপী আমার দ্বারা পরিব্যাপ্ত রয়েছে। আসলে তারা আমার মায়াবলে রচিত।

হে রাজন। সুষুপ্তব্যক্তি যে স্বরূপ দ্বারা সেই সময় নিজের গাঢ় নিদ্রা ও অতীন্দ্রিয় সুখ অনুভব করে, আমাকেই জীবের সেই ব্রহ্মস্বরূপ আত্মা বলে জানবে। সুষুপ্তি ও জাগরণ– এই দুই অবস্থায় স্মরণকারী পুরুষের সুষুপ্তি ও জাগরণ অবস্থার প্রকাশরূপে যা নিয়ত বিদ্যমান, অথচ যা উক্ত, উভয় অবস্থা হতে পৃথক পদার্থ, সেই জ্ঞানই পরম ব্রহ্ম বলে জানবে। এই ধরনের ব্রহ্মই হল আত্মা।

যে ব্যক্তি মনুষ্য জন্ম লাভ করে আত্মাকে অবগত না হয়, সে কোথাও মঙ্গল লাভ করতে পারে না। প্রবৃত্তিমার্গে কামনামূলক কর্মাদির অনুষ্ঠানে নানা রকম যন্ত্রণা ভোগ করে। অপরদিকে নিবৃত্তিমার্গে মোক্ষলাভ করে। সুখলাভে এবং দুঃখ ঘোচানোর জন্য সংসারে নারী পুরুষ নানারকম কাজ করে থাকে। কিন্তু তাতে দুঃখনিবৃত্তি বা সুখপ্রাপ্তি কিছুই হয় না। আত্মার জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির অতীত বিলক্ষণ সূক্ষগত চিন্তা করে, মানুষ নিজ বিবেকবলে ঐহিক ও পারলৌকিক বিষয় হতে বিমুক্ত এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের দ্বারা পরিতৃপ্ত হয়ে আমার ভক্ত হবে। তুমি ভক্তি সহকারে আমার এই উপদেশ স্মরণ কর, অচিরেই জ্ঞানবিজ্ঞান সম্পন্ন হয়ে সিদ্ধিলাভ করবে।

.

ষোড়শ অধ্যায়

শ্ৰী শুকদেব বললেন– ভগবান অনন্তদেব অন্তর্ধান করলে বিদ্যাধর চিত্রকেতু সেদিকে তাকিয়ে তার উদ্দেশ্যে প্রণাম করলেন। তারপর আকাশ পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। বহু লক্ষ বছর অপ্রতিহত দৈহিক বল ও ইন্দ্রিয়শক্তির অধিকারী হয়ে মহাযোগী চিত্রকেতু সিদ্ধিক্ষেত্রে অবস্থান করলেন।

একদিন তিনি আকাশপথে বিমানে চড়ে উড়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন– ভগবান মহাদেব সিদ্ধ চারণগণ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে ভগবতী পার্বতাঁকে কোলে তুলে নিয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বসে আছেন।

তিনি তাঁদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। উপহাস করে বললেন– যিনি লোকসকলের গুরু, সাক্ষাৎ ধর্মের বক্তা, জটাধারী, ব্রহ্মবাদী, সেই ভগবান শংকর নির্লজ্জের ন্যায় প্রকাশ্যে স্ত্রীকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। স্ত্রীর সাথে নির্জনে মিলিত হতে হয়, সম্ভবত এই জ্ঞানটুকু ওই দেবতার নেই।

শ্রী শুকদেব বললেন– মহারাজ, চিত্রকেতুর কটু বাক্য শ্রবণ করে গভীর বুদ্ধিধারী শঙ্কর কোনো প্রতিবাদ করলেন না। বরং মুখ টিপে হাসতে লাগলেন। কিন্তু দেবী পার্বতী জিতেন্দ্রিয় ভিমানী, তিনি ধৃষ্ট চিত্রকেতুকে অভিশাপ দিয়ে বললেন– যাঁর চরণপদ্ম ব্রহ্মাদি দেব বৃন্দ ধ্যেয় এবং যিনি স্বয়ং মঙ্গল সকলের মঙ্গল অর্থাৎ পরম ধর্মমূতি, এই ক্ষত্রিয়াধম ব্রহ্মাদি সকলকে অজ্ঞ মনে করে, স্বয়ং জগদগুরুকে শাসন করছে।

এই ধৃষ্টতা দণ্ডযোগ্য অপরাধ। যে তোক নিজেকে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে, সে হরিপাদমূলের সান্নিধ্য লাভের যোগ্য নয়। হে পুত্র, তোমায় দুর্মতি ভর করেছে। আমার অভিশাপে তুমি অসুর যোনিতে জন্ম নাও। মহাপুরুষদের সামনে ধৃষ্টতা দেখাবার সাহস আর হবে না।

চিত্রকেতু দেবী পার্বতাঁকে প্রসন্ন করে বলেছিলেন– হে দেবী অম্বিকা, আপনার প্রদত্ত অভিশাপ আমি মাথা পেতে গ্রহণ করলাম। এই সংসার মায়াময় গুণসকলের প্রবাহমাত্র, এখানে শাপ, আশীর্বাদ, সুখ, দুঃখ, নরক-স্বর্গ, সবই মূল্যহীন, স্বয়ং নিষ্কল পরমেশ্বরের নিজের মায়ার দ্বারা সকল প্রাণী ও তাদের বন্ধন, মোক্ষ, সুখ, দুঃখের সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিরন্ধন, তাই সর্বত্র সমভাবে বর্তমান। তার কাছে প্রিয়-অপ্রিয়, বন্ধু-মিত্র, নিকট-পর বলে কিছু নেই।

যেহেতু তার মায়ার দ্বারা সকল পাপ– পুণ্যাদি কর্ম হয়, তাই শরীরীদের সুখ-দুঃখ, হিত- অহিত, বন্ধ-মোক্ষ, জন্ম-মৃত্যুরূপ সংসার উৎপাদনে সমর্থ হয়। তাই বলছি আপনি বৃথা আমায় প্রতি কূপিত হবেন না। আপনি প্রসন্ন হোন। হে মাতা, আমি বস্তুত সাধু ভক্তিই করেছি, যদি আপনার কাছে তা অসাধু বলে মনে হয়, তাহলে ক্ষমা করে দেবেন।

চিত্রকেতুর ধর্মতত্ত্বজ্ঞান দেখে গিরি এবং গৌরী অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। বিমানে আরোহণ করে চিত্রকেতু ফিরে গেলে শংকর পার্বতাঁকে বললেন– হে প্রিয়তমে, নারায়ণের প্রতি যাঁরা ভক্তি প্রদর্শন করেন, তারা কখনও ভীত হন না। তারা ভগবানের একনিষ্ঠ ভক্ত। স্বর্গ, মুক্তি ও নরক–এই তিনটিতেই তারা তুল্য প্রয়োজন দর্শন করে থাকেন। পরমেশ্বরে লীলা করে থাকেন। পরমেশ্বরে লীলা দ্বারাই দেহীদের দেহসংযোগ ও তার দ্বারা দ্বন্দ্ব অনুষ্ঠিত হয়।

যে সকল ব্যক্তি ভগবান বাসুদেবের প্রতি ভক্তিভাব পোষণ করেন, তাঁরা জ্ঞান ও বৈরাগ্যের বীর্য সম্পন্ন, জগতের কোন পদার্থই তাদের আকৃষ্ট করতে পারে না। চিত্রকেতু ভগবান হরির দাস, তাই তার এমন উদারতার প্রকাশ, এ আশ্চর্য কিছু নয়। আমরা অর্থাৎ প্রধান প্রধান দেবতাগণ যাঁরা স্বয়ং শ্রীহরির অংশ, তারা তাঁর স্বরূপ জানতে পারি না। আর যেসব দেবগণ তাঁর অংশের অংশ, তারা কী করে তার স্বরূপ জানবে? তারা তাই নিজেদের পৃথক ঈশ্বর বলে গণ্য করে। ভগবান শ্রীহরিই সর্বভূতের আত্মা, তিনি সকলেরই প্রীতির একমাত্র বিষয়, মহাভাগ্যবান চিত্রকেতু যে হরির প্রিয় অনুচর, আমিও সেই অচ্যুত শ্রীহরিরই প্রিয়, অতএব, হে সুশ্রোণি, তুমি শান্ত হও।

শ্রী শুকদেব বললেন–চিত্রকেতু ছিলেন সাধুজন। দেবীকে অভিশাপ দানের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজে ভগবতীর অভিশাপ নিজ মস্তকে গ্রহণ করেছিলেন। এবং সেই শাপে তিনি দানবী যোনি প্রাপ্ত হয়ে ত্বষ্টার যজ্ঞে আবির্ভূত হন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন মহাপরাক্রমশালী অসুরপতি বৃত্রাসুর। হে রাজন, ভগবত মাহাত্মে পরিপূর্ণ চিত্রাসুরের এই পবিত্র আখ্যান যে শ্রবণ বা পাঠ করে সে পরমগতি প্রাপ্ত হয়।

.

সপ্তদশ অধ্যায়

শ্রী শুকদেব বললেন– সবিতার পত্নীর নাম পৃশ্নি। তাদের সন্ততিদের নাম সাবিত্রী, ব্যাহৃতি, অগ্নিহোত্র, পশুগ, সোমবাগ, ত্রয়ী, চাতুর্যান্য যাগ এবং পঞ্চ মহাযজ্ঞ। আদিত্য ভগের ঔরসে স্ত্রী সিদ্ধির গর্ভে তিনটি পুত্র ও একটি কন্যার জন্ম হয়– মহিমা, বিভু ও প্রভু এবং কন্যা আশী। কুহ, মিনাবলী, অনুমতি ও রাকা, ধাতার চার পত্নী।

এরা যথাক্রমে সয়ং, দর্শ, পূর্ণমান ও প্রতিঃ–নামে চার সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। বিধাতার পত্নী ক্রিয়া ও পুরীষ্য নামক পাঁচজন অগ্নির জন্মদাত্রী। বরুণ পুত্র ভৃগুর মাতা চনী বল্মীক থেকে উৎপন্ন হয়ে যিনি মহাযোগী বাল্মিকী হয়েছিলেন। মিত্র ও বরুণ উভয়েই উর্বশীর সমক্ষে কুম্ভের মধ্যে বীর্যাধান করার ফলে অগস্ত্য ও বশিষ্ঠের জন্ম হয়। মিত্রের ঔরসে, রেবতীর গর্ভে উৎসর্গ, অবিষ্ট ও পিমুল নামে তিন সন্তানের জন্ম হয়, প্রাচীনগণ বলে থাকেন, পৌলমী অর্থাৎ শচীর গর্ভে এবং দেবরাজ ইন্দ্রের বীর্যে তিন পুত্রের জন্ম হয়- জয়ন্ত, ঋষভ এবং মীয়ুষ।

স্বেচ্ছায় বামনরূপ ধারী ভগবান উরুক্রম তাঁর ভার্য্যা কীর্তির গর্ভে বৃহৎশ্লোক নামে এক পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। কাশ্যপ পত্নী দিতি যেসব দৈত্যদের জন্ম দিয়েছিলেন তার মধ্যে ভগবান প্রহ্লাদ ও বলির নাম উল্লেখ্য। এছাড়া দিতি দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু। তারা দৈত্য ও দানবদের দ্বারা পূজ্য।

দানবী জম্ভাসুরের কন্যা এবং হিরণ্যকশিপুর স্ত্রী কয়াধু চারটি পুত্রের জননী হয়েছিলেন– সংহাদ, অনুদ, হ্রদ ও প্রহ্লাদ। বিপ্ৰচিত পত্নী এবং হিরণ্যকশিপুর কন্যা সিংহিকা এক পুত্র প্রসব করেন, তাঁর নাণ রাহু, দেবগণের সাথে অমৃত পান করার চেষ্টা করলে ভগবান শ্রীহরি সুদর্শন চক্র দ্বারা তার মুন্ড কর্তন করেন।

সংহ্রাদের পত্নীমতি পঞ্চজন, হ্রদের স্ত্রী ধমনি– বাতাপি ও ঈম্বল এবং অহুহ্রাদের পত্নী সূর্যা, বাস্কল ও মহিষ নামক পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। বিরোচনের পিতা ছিলেন প্রহ্লাদ।

বিরোচন ও দ্রবীর পুত্র বলি। বলি ও অশনা একশো পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র বান দিতির পুত্র, মরুদগণ নিঃসন্তান ছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তাদের দেবত্ব লাভ করান।

পরীক্ষিৎ জানতে চাইলেন- হে গুরুদেব, মরুদগণ কি এমন পুণ্যকর্ম করেছিলেন। যার দ্বারা তারা আসুরভাব পরিত্যাগ করে দেবত্ব প্রাপ্ত হন।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– মহারাজ, বিষ্ণুর সহায়তা লাভ করে ইন্দ্র দিতির সমস্ত পুত্রদের হত্যা করলেন। দিতি পুত্রশোকে কাতর হয়ে হাহাকার করে উঠলেন। তিনি পুত্রশোকে জ্বলতে জ্বলতে প্রতিজ্ঞা করলেন আমি ওই সুখানক্ত, স্বভাব, কঠিন চিত্ত, ভ্রাতৃঘাতী পাপিষ্ঠ ইন্দ্রকে হত্যা করে সুখে দিন কাটাব। ইন্দ্র এই দেহগুলিকে নিত্য জ্ঞান করে অতিশয় উচ্ছশৃঙ্খল হয়েছেন। এমন পুত্র জন্ম দেব, যে ইন্দ্রের গর্ব চূর্ণ করবে।

এইরকম শপথ নিয়ে দিতি স্বামী সেবায় ব্রতী হলেন। স্বামীর মনানুযায়ী চলতে লাগলেন। তার প্রতি পরম ভক্তিশ্রদ্ধা প্রদর্শন করলেন। মিষ্টি মিষ্টি কথা এবং মুচকি হেসে কটাক্ষ পাত করে পতির মন আকৃষ্ট করলেন। বিদ্বান কশ্যপ মনোরমা পত্নীর অধীন হলেন।

কশ্যপ তার পত্নীকে সম্বোধন করে বললেন– হে প্রিয়তমা, স্বামীকে যে নারী পরিতুষ্ট করে তার মনের বাসনা সর্বদা পূরণ হয়। বলো, তুমি কী বর আশা করো? নারীদের কাছে পতিই পরম দেবতা। তোমার ভক্তিপূর্ণ পূজো আমাকে সন্তুষ্ট করেছে। অতএব আমি তোমার সেই অভিলাষ সম্পাদন করব। যা অসতী রমণীদের পক্ষে দুর্লভ দিতি বললেন– হে ঋষি, আমি মৃত পুত্রা। ওই দাম্ভিক ইন্দ্র বিষ্ণুর সাহায্য নিয়ে আমার দুই পুত্রকে হত্যা করেছে। আমি ওই ইন্দ্রকে বিনষ্ট করতে চাই। আমাকে ইন্দ্র বিনাশকারী একটি অমর পুত্র দান করুন।

দিতির এই ভয়ংকর প্রার্থনা শুনে কশ্যপ মনে মনে কেঁপে উঠলেন। পরিতাপের সুরে স্বগোক্তি করলেন হায়, আজ আমার ধর্ম ধূলিসাৎ হতে চলেছে। কেন যে বিষয় ও ইন্দ্রিয়সুখে আকৃষ্ট হয়ে ওই রমণীর বশীভূত হলাম? আমার নিশ্চয়ই নরকবাস হবে। স্বভাবের অনুবর্তিণী রমণীর এই ধরনের বর প্রার্থনা ধিকৃত নয়। কিন্তু যেহেতু আমিই অজিতেন্দ্রিয়, অতএব, স্বার্থ বিষয়ে অনভিজ্ঞ আমাকেই ধিক।

স্বার্থসিদ্ধি পরায়ণা নারী যে কোনো কাজ অনায়াসে করতে পারে না। তারা প্রয়োজনে স্বামী-পুত্র ভাইকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু শরতের পদ্মের মতো সুন্দর মুখোনি দেখে বোঝার উপায় থাকে না যে হৃদয় ক্ষুরের ন্যায় তীক্ষ্ণধার।

যাই হোক কশ্যপ ভাবলেন, এমন উপায় বের করতে হবে, যার সাহায্যে দুটি কাজই সুসম্পন্ন হয়। অর্থাৎ দিতির কাছে মিথ্যেবাদী হতে হবে না, আবার ইন্দ্রও বধ হবে না। এইভাবে কশ্যপ নিজেই নিজেকে ভর্ৎসনা করলেন, তারপর দিতিকে বললেন– হে কল্যাণী, ইন্দ্রের হত্যাকারী পুত্রলাভের জন্য নিয়ম ও নিষ্ঠা অনুসারে ব্রত পালন করতে হবে।

দিতি ব্ৰত ধারণ করতে রাজী হলে কশ্যপ বললেন– এই ব্রত কীভাবে পালন করবে, প্রথমে তা বলছি শোনো। প্রতিদিন ভোর বেলা শয্যা ত্যাগ করে স্নান করে শুদ্ধ কাপড় পরে মাঙ্গলিক দ্রব্যে সাজবে। পবিত্রভাবে, গো, ব্রাহ্মণ, সাক্ষী ও নারায়ণের ভজনা করবে। বীরবতী রমণীদের উদ্দেশ্যে মালা, বস্ত্র, অলংকার ও গন্ধ নিবেদন করবে। পতির অর্চনা করবে। তিনি তোমার উদরে অবস্থান করছেন, এমন কল্পনা করে তার ধ্যান করবে।

হে দিতি, এবার শোনো গর্ভবস্থাকালীন একত্রিশটি নিষিদ্ধ কার্যের কথা। কাউকে শাপ দেবে না, প্রতিহিংসা পরায়ণ হবে না, নখ ও রোম ছেদন করা চলবে না, অশুভ বা অমঙ্গলজনক কোনো দ্রব্য স্পর্শ করবে না, মিথ্যাচারী হবে না, কখনও কুপিত হবে না, জলের মধ্যে ডুব দিয়ে কখনও স্নান করবে! অধৌত বসন পরিত্যাগ করবে, দুর্জনের সঙ্গে বাক্যালাপ করবে না। গ্রহণ করা মালা ধারণ করবে । আঞ্জলির দ্বারা জল পান করবে না, ভদ্রকালীর নিবেদিত অন্ন, উচ্ছিষ্ট অন্ন, আমিষযুক্ত অন্ন, শুদ্রের রান্না করা অন্ন, রজঃস্বলার দৃষ্ট অন্ন কখনও গ্রহণ করবে না।

সন্ধ্যাকালে চুল এলো করে রাখবে না। অনাবৃতা দেহে বাইরে যাবে না। অলংকারশূন্য হয়ে ও আচমন স্নান না করে গৃহের বাইরে পা দেবে না। পা দুটি অপ্রক্ষালিত বা আর্দ্রপদ হয়ে কখনও শয়ন করবে না। উত্তর বা পশ্চিমদিকে মাথা রেখে শয়ন করবে না। প্রাতঃকালে বা সান্ধ্যকালে অথবা নগ্ন অবস্থায় শয়ন করা নিষিদ্ধ। তুমি যদি এক বছরকাল এই পুংসবন ব্রত ধারণ করতে পারো তাহলে তুমি ইন্দ্ৰবিনাশকারী পুত্র লাভ করবে।

উদারমতি দিতি মাথা অবনত করে কশ্যপের উপদেশমতো সব করবেন বলে স্বীকার করলেন, কশ্যপ তার গর্ভে বীর্যাধান ঘটালেন। এরপর শুরু হল দিতির ইন্দ্ৰনাশকারী ব্রতানুষ্ঠান।

এদিকে দিতির মনের এই অভিপ্রায়ের কথা জানতে পেরে ইন্দ্র তৎপর হয়ে উঠলেন। তিনি ছলনার আশ্রয় নিলেন। ব্যাধ যেমন হরিণদের ঠকানোর জন্য মাঝে মাঝে নিজে মৃগবেশ ধারণ করে, তেমনই কপট, সাধুবেশে ইন্দ্র দিতির পরিচর‍্যা করেছিলেন। বন থেকে ফুল, ফল, মূল, কুশ, পত্র, মৃত্তিকা সংগ্রহ করে এনে দিতেন আর দিতির ব্রতের খুঁত ধরার চেষ্টা করতেন। কিন্তু দিতি অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে ব্রত পালন করেছিলেন, কোনো একটি খুঁত না পেয়ে ইন্দ্র মনে মনে অত্যন্ত চিন্তিত হলেন।

একদিন আচমন ও পা ধৌত না করেই শয়ন করলেন। যোগেশ্বর ইন্দ্র এই অবকাশে যোগমায়ার দ্বারা দিতির উদরে প্রবেশ করলেন। দিতি অচেতনে নিদ্রিত থাকায় কিছুই টের পেলেন না। ইন্দ্র দিতির উদর মধ্যস্থিত স্বর্ণপ্রভ গর্ভস্থশিশুকে বজ্ৰদ্বারা সাতভাগে ভাগ করলেন।

ওই সাত গর্ভখণ্ড কেঁদে উঠল। ইন্দ্র তাদের সান্ত্বনা দিয়ে আবার প্রত্যেকটি টুকরোকে সাতটি ভাগে ভাগ করলেন। এবার সব গর্ভ খণ্ডগুলি কঁদতে কাঁদতে বলে উঠল– হে ইন্দ্র, আমরা তোমার ভ্রাতা, আমরা মরুৎ। কেন ভ্রাতৃহত্যা করছ? ইন্দ্র সম্ভাব সম্পন্ন সেই মরুৎগণকে বললেন– তোমরা ভীত হয়ো না। তোমরা আমারই ভাই।

–হে মহারাজ, মাতৃগর্ভে অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্রের দ্বারা দগ্ধ হয়েও ভগবান শ্রীহরির অনুকম্পায় তুমি যেমন বিনষ্ট হও নি, তেমনই শ্রীনিবাসের অনুগ্রহে দিতির গর্ভস্থ খণ্ডগুলি ইন্দ্রের বর্জ্যের দ্বারা মৃত্যুগ্রস্ত হল না। সেই ঊনপঞ্চাশ জন মরুৎ ইন্দ্রের সাথে মিলিত হয়ে পঞ্চাশজন দেবতা হলেন। ভগবান তাদের মাতৃদোষ অর্থাৎ অসুরভাব দূর করে তাঁদের সোমপানের অধিকার দিয়েছিলেন।

নিদ্রাভঙ্গ হলে ইন্দ্রের সাথে মিলিত অগ্নির ন্যায় তেজীয়ান পুত্রগণকে দেখে অনিন্দিতা দেবী দিতি অত্যন্ত তুষ্ট হলেন। তিনি ইন্দ্রকে সম্বোধন করে বললেন– হে বৎস, আমি অদিতির পুত্রদের ভয় উৎপাদক সন্তানলাভের ইচ্ছায় এক বছর সময় ধরে অত্যন্ত দুষ্কর ব্রত পালন করেছিলাম। আমি একটি মাত্র সন্তানের প্রার্থনা করেছিলাম। কিন্তু এমন দেখছি উনপঞ্চাশজন। এ কী করে সম্ভব হল?

তখন দেবরাজ ইন্দ্র অকপটে সমস্ত কিছু স্বীকার করলেন। বললেন– হে অম্বে, যাঁরা নিষ্কামভাবে ভগবানের আরাধনায় রত হয়ে মোক্ষপদ লাভ করার বাসনা প্রকাশ করে না, তারাই প্রকৃতপক্ষে স্বার্থকুশল।

ভক্তের নিকট আত্মস্বরূপ সমস্ত জগতের অধীশ্বর ভগবান হরির আরাধনা করে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি বিষয় ভোগরূপ তুচ্ছ ফলের প্রার্থনা করতে পারে? হে, মহীয়সী মাতা, আমি মূর্খ, আমার দুর্বলতা ক্ষমা করুন। আপনার গর্ভ মৃত হয়েও পুনরায় জাগ্রত হয়েছে আপনার সৌভাগ্যের কারণে।

ইন্দ্রের এই আন্তরিক শুদ্ধ বাক্যে দিতি অত্যন্ত তুষ্ট হলেন। দিতির অনুমতিক্রমে ইন্দ্র মরুৎগণকে সঙ্গে নিয়ে স্বর্গের পথে যাত্রা করলেন।

.

অষ্টাদশ অধ্যায়

শ্ৰী শুকদেব এবার মহারাজ পরীক্ষিতের ইচ্ছানুসারে পুংসবন ব্রতের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে শুরু করলেন।

তিনি বললেন– অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে এই ব্রত করার নিয়ম। ব্রত শুরু করার আগে নারী তাঁর স্বামীর কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করবে। ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে মরুৎগণের জন্মবৃত্তান্ত শুনবে। তারপর স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করবে। এই ব্রতে ভোরবেলা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর পুজো করতে হয়। বিষ্ণুর স্তব করে বলবে– হে ভগবান, আপনি ঐশ্বর্যশালী লক্ষ্মীদেবীর পতি, আপনি পুণ্যকাম, আপনাকে প্রণাম জানাই।

হে ঈশ, আপনি কৃপা, ধৈর্য, তেজ, মহিমা ও সামর্থ্য এবং সত্যসঙ্কল্পত্ব প্রভৃতি অন্যান্য সকল প্রকার গুণরাশির দ্বারা যথাযথ সমৃদ্ধ। আপনি সকলের প্রভু। আপনি আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। হে জন্মদাতা, হে মহাভাগে, আমার প্রতি আপনি প্রসন্ন হোন। আপনাকে প্রণতি জানাই– এইভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করতে হয়।

এ বার ধ্যান করবে মহানুভব ভগবান মহাপুরুষকে প্রণতি জানাই, মহাবিভূতির সহিত মহাবিভূতি অতি ভগবানের নিমিত্ত পুজোপহার আহরণ করছি। এবার পাদ্য, অর্ঘ্য, স্নানীয় বসন, ভূষণ, উপবীত, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ দীপাদি ইত্যাদি উপচার নিবেদন করতে হয়। এবার যজ্ঞ করে বারোবার ওইসব দ্রব্যসামগ্রীর অবশিষ্টাংশ আহুতি দেবে।

এই সময় মন্ত্র বলবে– ভগবান মহাপুরুষ মহাবিভূতি পাজক প্রণাম, স্বাহা। ভক্তি ও নিষ্ঠা সহকারে পুজো শেষ করে ভূমিতে মাথা স্পর্শ করে প্রণাম করবে। দশবার মন্ত্র জপ করার নিয়ম।

পুংসবন ব্রতের স্তোত্র– হে দেব, হে দেবী, আপনারা এই বিশ্ব চরাচরের জনক-জননী। সূক্ষ প্রকৃতির দূরত্যায়া মায়াশক্তি এই লক্ষীদেবীর আপনিই পরম অধীশ্বর, আপনি নিজে সকল প্রকার যজ্ঞ, আর লক্ষ্মীদেবী যজ্ঞ নিম্পাদক ভাবনা রূপ বিশেষ।

লক্ষ্মীদেবী ক্রিয়া, আর আপনি সেই ক্রিয়াকালের ভোক্তা। সকল জীবের আত্মায় আপনি বিরাজিত, আর লক্ষ্মীদেবী দেহ, ইন্দ্রিয় ও প্রাণস্বরূপা। আপনি পরমেশ্বর আর লক্ষ্মীদেবী পরমেশ্বরী। আপনাদের অনুগ্রহে সকল প্রার্থীর কামনা পূরণ হয়। আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে আমাকে বরদান করুন।

ভগবানের স্তব শেষ করে নিবেদিত দ্রব্যসামগ্রী সেখান থেকে সরিয়ে ফেলবে। তারপর আচমন করবে এবং অর্চনা করবে। আবার ভক্তিসহকারে স্তব পাঠ করে পুজো করার নিয়ম।

পত্নী তার পতির ভজনা করবে। এবং পতিপ্রেম পরবশ হয়ে পত্নীর সকল কাজে আনুকূল্য প্রদর্শন করবে। এই ব্রত, পতি অথবা পত্নী যে কোনো একজন করতে পারে। কিন্তু ফল দুজনেই লাভ করে।

এই ব্রতের মাহাত্মে নারী সন্তানহীনা হয় না, ব্রাহ্মণ ও ত্রয়োস্ত্রীদের মালা, গন্ধ, স্বর্ণ ও অন্যান্য সামগ্রী দান করতে হয়। ভগবানের আরাধনা শেষ করে তাকে নিবেদিত ভোগ সামগ্রী প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করবে। এবার দেবতাকে নিজ বাস ভবনে প্রতিষ্ঠার জন্য বিসর্জন দেবে।

এইভাবে অগ্রহায়ণ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত পূজো করতে হয়। ব্রত ভঙ্গের দিন উপবাসী থেকে ভোরবেলা স্নান সেরে আচমনাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করবে। তারপর শ্রীহরির পুজো করবে। বারোবার ঘি যুক্ত খই হোমযজ্ঞে প্রদান ব্রাহ্মণদের প্রণাম করবে। তাদের অনুমতি নিয়ে আহার করবে।

এবার আচার্য ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে পতিদেবতা পত্নীর কাছে আসবে। অবশিষ্ট পত্নীর কাছে আসবে। অবশিষ্ট চরু যা সৎপুত্র ও সৌভাগ্যদায়ক, দুজনে মিলে তা সকলের মধ্যে দান করবে। যে পুরুষ এই বিষুব্রত ভক্তি ও নিষ্ঠাসহকারে পালন করে, শ্রীবিষ্ণুর কৃপায় তার সকল অভিষ্ট পূরণ হয়। আর ব্রতকারী নারী সন্তানবতী হয়। এই সৌভাগ্যদায়ক ব্রত যশ ও গৃহদানে সমর্থ হয়। ঐশ্বর্য কামনা করে এই ব্রত করলে সে আশা পূরণ হয়। কুমারী কন্যা এই ব্রত পালন করলে সর্বসুলক্ষণ যুক্ত পতিলাভ করে আর বিধবা রমণী পুণ্যগতি প্রাপ্ত হয়। মৃতবৎসা স্ত্রী ওই ব্রতের কল্যাণে জীবিতপুত্রা ও ধনেশ্বরী হয়। দুর্ভাগা নারী সৌভাগ্যবতী এবং বিরূপা রমণী সুন্দরীতে পরিণত হয়। হে মহারাজ, এই ব্রত রোগমুক্ত করে। যজ্ঞ, পিতৃ-মাতৃর শ্রাদ্ধ-কর্ম বা যে কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে এই উপাখ্যান পাঠ করলে পিতৃ ও দেবতাগণ অক্ষয় তৃপ্তি লাভ করেন।

হে ভারত রাজ পরীক্ষিৎ। এই মরুৎগণের পুণ্যজন্ম এবং দিতির মহৎ ব্রত- বৃত্তান্ত; যা সকল প্রকার কার্য ফল প্রদান করে।