০৮. কল্মষপাদের কাহিনি

০৮. কল্মষপাদের কাহিনি

সগর বংশের রাজা ছিলেন ঋতুপর্ণ। পাশাখেলায় মহা ধুরন্ধর তিনি। তাঁর পুত্র সুদাস পরম ধার্মিক ও দয়ালু। সুদাসের পুত্র সৌদাস। অতি বড় শিকারী বীর তিনি। সৌদাসের তির গায়ে লেগে বেঁচেছে এমন কোনও প্রাণী জগতে নেই। একদিন তিনি জঙ্গলে গিয়ে তির দিয়ে একটি বাঘকে মেরে ফেললেন।

তারপর দ্বিতীয় বাঘকে মারবার জন্য সৌদাস যখন উদ্যত, তখন সেই বাঘটি বিশাল ভয়ঙ্কর রাক্ষস মূর্তি ধরে গর্জন করতে করতে বলল–তুই আমার ভাইকে মারলি কেন? কি দোষ করেছিল তোর কাছে? আমি তোকে দেখছি?

এই কথা বলেই সেই রাক্ষসটা বনের ভিতরে কোথায় লুকালো, সৌদাস আর তাকে দেখতে পেলেন না। তারপর বহুদিন কেটে গেছে। একসময় সৌদাস কুলগুরু বশিষ্টকে আচার্য করে এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করলেন। মহা ধূমধামে শেষ হল যজ্ঞ।

বশিষ্টদেব রাজাকে বললেন–যজ্ঞ শেষ হল। এরপর কোনও সদ ব্রাহ্মণকে মাংস খাওয়াতে পারলে, এই যজ্ঞের ঠিক ঠিক ফল পাওয়া যাবে।

রাজা সৌদাস বললেন–আপনিই সেই সদ ব্রাহ্মণ। আপনাকেই আমি মাংস ভোজন করাতে চাই। আমি পাঁচককে দিয়ে সব ব্যবস্থা করছি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন।

স্নান শেষ করে এলেন বশিষ্টদেব। ভোজনে বসলেন রাজা পরিবেশন করলেন– অন্ন ব্যঞ্জনাদির সঙ্গে মাংস। রান্না করা মাংসের দিকে তাকিয়ে বশিষ্টদেবের একটু খটকা লাগল। তারপর ভালো করে তাকিয়ে বুঝলেন তাকে পরিবেশিত মাংস প্রকৃতপক্ষে নরমাংস যা মানুষের আহাৰ্য্য নয়। কী স্পর্ধা! সেই নরমাংস আমাকে দিয়েছে খেতে। রাগে তার চোখ লাল হয়ে গেল। তিনি উঠে পড়লেন।

গর্জন করে তিনি বলতে লাগলেন, এতখানি দুঃসাহস তোমার? মানুষের মাংস আমায় খেতে দিলে? মুনির কথা শুনে সৌদাস অবাক। কেমন করে সম্ভব। পাঁচককে ডেকে জিজ্ঞাসা করবেন, কিন্তু সে সুযোগ না দিয়ে বশিষ্টদেব শাপ দিলেন। আমাকে যেমন তুমি নরমাংস খাওয়াতে চেষ্টা করেছিলে, তেমনি তুমি নরমাংস ভোজী রাক্ষস হবে। সৌদাস বিনীত কণ্ঠে বললেন–গুরুদেব আমাকে এ কি অভিশাপ দিলেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি স্বেচ্ছায় এই অন্যায় করিনি। আপনি মাংস খেতে চাইলেন, আমি পাঁচককে বললাম। কেমন করে নরমাংস এল আমাকে একটু জানবার সুযোগ দিন।

এই কথা বলতে বলতে রাজা সৌদাসের মাথাটা গরম হয়ে উঠল। অভিশাপ দেবার জন্য উদ্যত হলেন। হাতে মন্ত্রপূত জল নিলেন। রানি দময়ন্তী সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে বাধা দিলেন রাজাকে, এ কি করছ তুমি? উনি আমাদের কুলগুরু! তাঁর প্রতি রুঢ় আচরণ মানায় না।

রানির কথায় শান্ত হয়ে সৌদাস ভাবলেন–আমাদের অজ্ঞাতে হয়তো নরমাংস এসে গেছে গুরুদেবের পাতে। হয়ত এটাই ভাগ্যের লিখন। কিন্তু এই অভিশপ্ত জল কোথায় ফেলি? এ জল যদি পৃথিবীতে পড়ে গোটা পৃথিবী জ্বলে পুড়ে ছাই হবে। অনেক ভাববার পর সৌদাস নিজের পায়েই ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে পা দুটো বিচিত্র রঙের কল্মষ (মলিন) হয়ে গেল। সেই থেকে সৌদাসের নাম কল্মষপাদ।

এতক্ষণে বশিষ্টদেব শান্ত হলেন, ভাবলেন–কেন এমনি হল? ধ্যানযোগে বুঝতে পারলেন সৌদাসের কোনো দোষ নেই। সকল চক্রান্ত সেই বাঘরূপী রাক্ষসের। ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য এমন ঘটনা ঘটিয়েছে।

অভিশাপ বাক্য যখন মুখ থেকে বেরিয়েছে, তা অব্যর্থ। বশিষ্টদেব এই শাপদানের জন্য অনুতপ্ত হলেন। তিনি রাজাকে প্রদত্ত অভিশাপ লঘু করে দিলেন, তাকে সারা জীবন রাক্ষস রূপে থাকতে হবে না, মাত্র বারোটা বছর, তারপর আপনা আপনি শাপমুক্ত হবেন।

তারপর কল্মষপাদ রাক্ষসরূপে বনে চলে গেলেন। ক্ষুধার জ্বালা মেটান নরমাংস খেয়ে। একদিন তিনি দেখতে পেলেন এক ব্রাহ্মণ দম্পত্তিকে। অল্পদিন হল তাদের বিয়ে হয়েছে। তাই কোনো সন্তান হয়নি। কল্মষপাদ এসে ধরলেন ব্রাহ্মণকে। তাই দেখে আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ব্রাহ্মণী। বলল–এ আপনি কি করছেন? আপনি কি ভুলে গেলেন যে, আপনি প্রকৃতপক্ষে রাক্ষস নন। আপনি রাজা সৌদাস। কিন্তু সৌদাস ব্রাহ্মণীর কথা না শুনে খেয়ে ফেললেন ব্রাহ্মণকে। তখন রাগে দুঃখে ব্রাহ্মণী শাপ দিলেন–তুমি যখন আমাকে সন্তান লাভের সুযোগ দিলে না তখন তুমিও কখনও সন্তানের পিতা হতে পারবে না।

তারপর বারো বছর কেটে যাওয়ার পর কল্মষপাদ শাপমুক্ত হলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণীর অভিশাপে সারাজীবন অপুত্রক রইলেন।