১৪৪তম অধ্যায়
সাত্যকি-ভূরিশ্রবার পূর্ব্বজন্মবৃত্তান্ত
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! যে মহাবীর সাত্যকি যুধিষ্ঠিরের নিকট প্রতিজ্ঞারূঢ় হইয়া অনায়াসে সৈন্যসাগর সমুত্তীর্ণ হইল এবং মহাবীর দ্রোণ, কর্ণ, বিকর্ণ ও কৃতবর্ম্মা যাহাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হয় নাই, ভূরিশ্রবা কিরূপে তাঁহাকে নিগ্রহ করিয়া বলপূর্ব্বক ভূতলে নিপাতিত করিল?”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! আমি এক্ষণে মহাবীর সাত্যকি এবং ভূরিশ্রবার জন্মবৃত্তান্ত বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন, তাহা হইলে অনায়াসে আপনার সন্দেহভঞ্জন হইবে। মহর্ষি অত্রির পুত্র সোম, সোমের পুত্র বুধ, বুধের পুত্র পুরন্দরসদৃশ পুরূরবা, পুরূরবার পুত্র আয়ু, আয়ুর পুত্র নহুষ ও নহুষের পুত্র দেবতুল্য রাজর্ষি যযাতি। দেবযানীর গর্ভে যযাতিরাজের যদুনামে পুত্র সমুৎপন্ন হয়েন। তিনি সর্ব্বজ্যেষ্ঠ; তাঁহার বংশে দেবমীঢ়নামে এক মহাত্মা জন্মগ্রহণ করেন। দেবমীঢ়ের পুত্র ত্রিলোকপ্রসিদ্ধ শূর। শুরের পুত্র মহাযশস্বী বসুদেব। মহাপরাক্রান্ত শূর ধনুর্বিদ্যাপারদর্শী ও যুদ্ধে কাৰ্ত্তবীর্য্য অর্জ্জুনের তুল্য ছিলেন। তাঁহারই বংশে শিনিনামে এক মহাত্মা জন্মগ্রহণ করেন। হে মহারাজ! মহাত্মা দেবকরাজের কন্যার স্বয়ংবরসময়ে মহাবীর শিনি সমস্ত ভূপালগণকে পরাজিত করিয়া দেবকীনন্দিনীকে গ্রহণ করিয়াছিলেন। ঐ মহাবীর বসুদেবের সহিত দেবকীর পরিণয়সম্পাদনমানসে তাঁহাকে আপনার রথে আরোপিত করিয়া গৃহগমনে সমুদ্যত হইলেন। ঐ সময় মহাতেজস্বী সোমদত্ত শিনির এই কাৰ্য্য সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া তাঁহার সহিত সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। বেলা দুই প্রহর পর্য্যন্ত সেই বীরদ্বয়ের অতি অদ্ভুত বাহুযুদ্ধ হইল। পরিশেষে মহাবীর শিনি অসংখ্য ভূপালসমক্ষে বলপূর্ব্বক সোমদত্তকে ভূতলে নিপাতিত করিয়া কেশাকর্ষণপূর্ব্বক তরবারি উদ্যত করিয়া তাঁহাকে পদাঘাত করিতে লাগিলেন। অনন্তর কৃপা প্রকাশপূর্ব্বক ‘তুমি জীবিত থাক’ এই বলিয়া তাঁহাকে পরিত্যাগ করিলেন।
“হে কুরুরাজ! মহাবধীর সোমদত্ত শিনির নিকট সেইরূপ আঘাতিত হইয়া অমর্ষিতচিত্তে ভগবান্ ভূতনাথের আরাধনায় প্রবৃত্ত হইলেন। বরদাতা মহাদেব সোমদত্তের ভক্তিভাবে প্রীত হইয়া তাঁহাকে বর প্রার্থনা করিতে কহিলেন। তখন সোমদত্ত বলিলেন, ‘হে ভগবন্! আমি এরূপ এক পুত্র প্রার্থনা করি, যে অসংখ্য মহীপালসমক্ষে সমরাঙ্গনে শিনির পুত্র বা পৌত্রকে নিক্ষেপ করিয়া পদাঘাত করিতে সমর্থ হইবে।’ ভগবান ভূতপতি তাঁহার প্রার্থনা শ্রবণান্তর ‘তথাস্তু’ বলিয়া অন্তর্হিত হইলেন। সোমদত্ত সেই বরপ্রভাবে ঐ ভূরিশ্রবানামে পুত্র লাভ করিয়াছিলেন। ভূরিশ্রবা মহাদেবের বরপ্রভাবেই সমস্ত নরপতিগণসমক্ষে সমরক্ষেত্রে সাত্যকিকে পতিত ও পদাহত করিলেন। হে মহারাজ! আপনি যাহা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন, তৎসমুদয়ই আপনার কর্ণগোচর করিলাম।
বৃষ্ণিবংশের প্রশংসা
“হে কুরুকুলতিলক! সাত্যকিকে কেহই পরাজিত করিতে সমর্থ নহেন। বৃষিবংশীয়েরা সমরাঙ্গনে লব্ধলক্ষ্য হইয়া নানাপ্রকার যুদ্ধকৌশল প্রকাশ করিয়া থাকেন। উঁহারা দেব, দানব ও গন্ধর্ব্বদিগের বিজেতা এবং কখন বিস্মিত হয়েন না। উঁহারা স্বীয় বাহুবলেই যুদ্ধ করিয়া থাকেন, অন্যের সাহায্য অপেক্ষা করেন না। উঁহাদিগের তুল্য বলবান্ ব্যক্তি কখন দৃষ্টিগোচর হয় নাই, হইবেও না এবং এক্ষণেও হইতেছে না। উঁহারা জ্ঞাতিদিগকে অবজ্ঞা করেন না এবং নিয়ত বৃদ্ধগণের আজ্ঞা প্রতিপালন করিয়া থাকেন। মনুষ্যগণের কথা দূরে থাকুক, দেব, দানব, গন্ধৰ্ব্ব, যক্ষ, উরগ এবং রাক্ষসেরাও বৃষ্ণিদিগকে পরাজিত করিতে সমর্থ নহেন। উঁহারা ব্রাহ্মণ, গুরু ও জ্ঞাতিদিগের দ্রব্যে অভিলাষী নহেন। আপদ উপস্থিত হইলে যে কেহ তাঁহাদিগকে রক্ষয়িতা হয় তাঁহারা কদাপি পরদ্রব্যে অভিলাষ করেন না। ঐ সত্যবাদী, ব্রাহ্মণ্যানুষ্ঠাননিরত [সন্ধ্যাবন্দনাদিতে প্রযত্ন] মহাত্মারা বিপুল অর্থশালী হইয়াও গর্ব্ব প্রকাশ করেন না। তাঁহারা বিপদকালে সমর্থ ব্যক্তিদিগকেও দীনবোধে উদ্ধার করিয়া থাকেন। তাঁহারা দেবপরায়ণ, দাতা ও নিরহঙ্কার; তন্নিবন্ধন বৃষ্ণিবংশীয়দিগের চক্র সতত অপ্রতিহত থাকে। হে রাজন! যদি কেহ ভূধরবহনে অথবা জলজন্তু পূর্ণ মহার্ণব সন্তরণেও সমর্থ হয়, তথাপি সে বৃষিবীরগণের সহিত সংগ্রামে জয়লাভ করিতে পারে না। হে প্রভো! আপনার যে বিষয়ে সংশয় ছিল, তদ্বিষয় আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন করিলাম। যাহা হউক, আপনার দুর্নীতিনিবন্ধই এইরূপ ঘটিতেছে।”