২০৩. অর্জ্জুনের নিজ জয়কারণ জিজ্ঞাসায় ব্যাসোক্তি

২০৩তম অধ্যায়

অর্জ্জুনের নিজ জয়কারণ জিজ্ঞাসায় ব্যাসোক্তি

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! অতিরথাগ্রগণ্য দ্রোণ ধৃষ্টদ্যুম্নকর্ত্তৃক নিহত হইলে পাণ্ডব ও কৌরবগণ কি করিল, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! দ্রোণাচাৰ্য্য নিপতিত ও কৌরবগণ রণপরাঙ্মুখ হইলে কুন্তীপুত্র ধনঞ্জয় স্বীয় বিজয়াবহ অদ্ভুত ব্যাপার অবলোকন করিয়া যদৃচ্ছাক্রমে সমাগত ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হে ভগবন্! আমি যৎকালে সংগ্রামে সুনিশ্চিত শরনিকরে শত্রুনাশে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, তকালে পাবকসন্নিভ কোন পুরুষকে আমার অগ্রভাগে অবলোকন করিলাম। তিনি শূল উত্তোলনপূর্ব্বক যে যে দিকে ধাবমান হইলেন, সেই সেই দিকের বিপক্ষগণ বিনষ্ট হইতে লাগিল। তৎকালে সকলে বোধ করিল যে, আমা হইতেই সমুদয় সৈন্য ভগ্ন হইতেছে। কিন্তু বস্তুতঃ আমি তৎকালে কেবল সেই হুতাশনসন্নিভ পুরুষের পশ্চাদ্ভাগে অবস্থানপূর্ব্বক তৎকর্ত্তৃক ভগ্ন সৈন্যগণকে পীড়িত করিয়াছি। হে মহর্ষে! সেই সূর্যের ন্যায় তেজঃসম্পন্ন শুলপাণি মহাপুরুষ কে? আমি দেখিলাম, তিনি ভূতলে পাদস্পর্শ বা শূল পরিত্যাগ করিলেন না। তাঁহার তেজঃপ্রভাবে শূল হইতে সহস্র সহস্র শূল বিনির্গত হইতে লাগিল।

“ব্যাসদেব কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! তুমি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্রের নিদানস্বরূপ, সর্ব্বশরীরশায়ী [সর্ব্বদেহস্থিত] ত্রৈলোক্যশরীর [জগন্ময়], সর্ব্বলোকনিয়ন্তা তেজোময়, দেবাদিদেব মহাদেবকে সন্দর্শন করিয়াছ। যে মহাত্মা ভুবনব্যাপী, জটিল, মঙ্গলদায়ক, ত্রিনেত্র, মহাভুজ, রুদ্র, শিখী, চীরবাসা, স্থাণু, বরদাতা, জগৎপ্রধান, জগদানন্দকর, জগদযোনি, বিশ্বাত্মা, বিশ্বস্রষ্টা, বিশ্বমূৰ্ত্তি, বিশ্বেশ্বর, কর্মের ঈশ্বর, শম্ভু, স্বয়ম্ভু, ভূতনাথ, ত্রিকালস্রষ্টা, যোগস্বরূপ, যোগেশ্বর, সর্ব্বলোকের ঈশ্বর, সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, বরিষ্ঠ, পরমেষ্ঠী, দুর্জ্ঞেয়, জ্ঞানাত্মা, জ্ঞানস্বরূপ, জ্ঞানগম্য, লোকত্রয়বিধাতা, লোকত্রয়ের আশ্রয়, জন্মমৃত্যু জরাবিহীন ও ভক্তগণের বাঞ্ছিতপ্রদ, তুমি সেই দেবাদিদেবের শরণাপন্ন হও। বামন, জটিল, মুণ্ডী হ্রস্বগ্রীব, মহোদর, মহাকায়, মহোৎসাহ ও মহাকর্ণ প্রভৃতি বিবিধ বিকৃত বেশধারী বিকৃতানন, বিকৃতপাদ প্রাণীগণ তাঁহার পারিষদ। তিনি তাঁহাদের কর্ত্তৃক পূজিত হইয়া প্রসন্নচিত্তে তোমার অগ্রে গমন করিয়া থাকেন। সেই লোমহর্ষণ ভয়ঙ্কর সংগ্রামে বহুরূপধর মহাধনুর্দ্ধর মহেশ্বর ভিন্ন আর কোন ব্যক্তি মহাবীর অশ্বত্থামা, কৃপ ও কর্ণের রক্ষিত সেনাগণকে পরাভূত করিতে বাসনা করিতে পারে?

ব্যাসকর্ত্তৃক রুদ্ৰমাহাত্মকীৰ্ত্তন

যাহা হউক, মহাত্মা মহেশ্বর অগ্রে অবস্থিত হইলে কোন ব্যক্তিই সংগ্রামে অবস্থান করিতে সমর্থ হয় না। এই ত্রিলোকমধ্যে তাঁহার সমান আর কেহই নাই। মহাদেব কোপাবিষ্ট হইলে তাঁহার আগমনেই অসংখ্য সৈন্য নিহত, কম্পিত ও পতিত হইয়া থাকে। স্বর্গে সুরগণ নিরন্তর তাঁহাকে নমস্কার করেন। যে সমস্ত স্বর্গলাভোপযুক্ত ব্যক্তি এবং অন্যান্য মানবগণ সেই উমাপতি মহাদেবের অর্চনা করিয়া থাকেন, তাঁহারা ইহলোকে সুখস্বচ্ছন্দে কালযাপন করিয়া পরলোকে সদ্গতিলাভ করেন, সন্দেহ নাই। অতএব হে অর্জ্জুন! তুমি সেই রুদ্র, নীলকণ্ঠ, সূক্ষ্ম, দীপ্ততম, কপর্দ্দ, করাল, পিঙ্গলা, বরদ, যাম্য, রক্তকেশ, সদাচারনিরত, শঙ্কর, কল্যাণকর, হরিনেত্র, স্থাণু, হরিকেশ, কৃশ, ভাস্কর, সুতীর্থ, দেবদেব, বেগবান বহুরূপ, প্রিয়, প্রিয়বাসা, উষ্ণীষধরা সুবক্তব, বৃষ্টিকৰ্ত্তা, গিরিশ, প্রশান্ত, যতি, চীরবাসা, সুবর্ণালঙ্কৃতবাহু, উগ্র, দিক্‌পতি, পৰ্জন্যপতি, ভূতপতি, বৃক্ষপতি, গোপতি, বৃক্ষাবৃতদেহ, সেনানী, অন্তর্য্যামী, স্রুবহস্ত, ধনুর্দ্ধর, ভার্গব, বিশ্বপতি, মঞ্জুবাসা, সহস্ৰমস্তক, সহস্রনয়ন, সহস্রবাহু ও সহচরণ, ভূতভাবন ভগবানকে নিরন্তর নমস্কার কর। যিনি বরদ, ভুবনেশ্বর, উমাপতি, বিরূপাক্ষ, দক্ষযজ্ঞবিনাশন, প্রজাপতি, অনাকুল, ভূতপতি, নরগণের পতি, মাতৃগণের পতি, গণপতি, বৃষধ্বজ, ত্রৈলোক্যসংহারসমর্থ, ধর্ম্মপতি, ধর্ম্মপ্রধান, ইন্দ্রাদির শ্রেষ্ঠ, বৃষাঙ্ক, ধাৰ্মিকগণের বহুফলপ্রদ, সাক্ষাৎ ধর্ম্মস্বরূপ, যোগধর্মৈকগম্য, শ্রেষ্ঠ প্রহরণধারী, ধর্ম্মাত্মা, মহেশ্বর, মহোদর, মহাকায়, দ্বীপিচৰ্ম্মবাসা, লোকেশ, বরদ, ব্ৰহ্মণ্য, ব্রাহ্মণপ্রিয়, ত্রিশূলপাণি, খড়্গচর্ম্মধারী, পিনাকী, লোকপতি ও ঈশ্বর, তুমি সেই দেবদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হও। আমি সেই চীরবাসা শরণ্য ঈশানদেবের শরণাপন্ন হইলাম। সেই বৈশ্রবণসখা, সুরেশ, সুবাসা, সুব্রত, সুধন্বা, প্রিয়ধন্বা, বাণস্বরূপ, মৌর্ব্বীস্বরূপ, ধনুস্বরূপ, ধনুর্ব্বেদগুরু, উগ্ৰায়ুধ, দেব, সুরাগ্রগণ্য, বহুরূপ, বহুধনুর্দ্ধর, স্থাণু, ত্রিপুরঘ্ন, ভগনেত্রঘ্ন, বনস্পতির পতি, নরগণের পতি, মাতৃগণের পতি, গণপতি, গোপতি, যজ্ঞপতি, জলপতি, দেবপতি, পূষার দন্তবিনাশন ত্র্যম্বক, বরদ, হর, নীলকণ্ঠ ও স্বর্ণকেশ ভগবাকে নমস্কার।

দক্ষযজ্ঞবিনাশ-বৃত্তান্ত

‘হে ধনঞ্জয়! এক্ষণে আমি আপনার জ্ঞাত ও শ্রবণানুসারে তাঁহার দিব্য কর্ম্মসমুদয় তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। তিনি কোপাবিষ্ট হইলে সুর, অসুর, গন্ধর্ব্ব ও রাক্ষসগণ পাতালগত হইয়াও পরিত্রাণ পায় না। পূর্ব্বে দক্ষরাজ যজ্ঞের সমুদয় সামগ্রী আহরণ করিয়া বিধিপূর্ব্বক যজ্ঞ আরম্ভ করিয়াছিলেন। মহাদেব কুপিত ও নির্দ্দয় হইয়া তাঁহার যজ্ঞ ধ্বংস করিয়া বাণপরিত্যাগপূর্ব্বক ভীষণ নিনাদ করিতে লাগিলেন। তখন সুরগণ কেহই শান্তিলাভে সমর্থ হইলেন না। তাঁহারা মহেশ্বরকে কুপিত ও সহসা যজ্ঞ বিনষ্ট করিতে দেখিয়া এবং তাঁহার জ্যানির্ঘোষ শ্রবণ করিয়া নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। তখন সমুদয় সুরাসুর নিপতিত ও মহাদেবের বশীভূত হইলেন। তৎকালে সলিলরাশি সংক্ষুব্ধ, বসুন্ধরা কম্পিত, পর্ব্বত ও দিকসকল বিশীর্ণ এবং নাগগণ মোহিত হইতে লাগিল। গাঢ় অন্ধকার প্রাদুর্ভূত হওয়াতে সমুদয়ই অপ্রকাশিত হইল। সূৰ্য্যপ্রভৃতি সমুদয় জ্যোতিঃপদার্থের প্রভা ধ্বংস হইয়া গেল। ঋষিগণ ভীত ও সংক্ষুব্ধ হইয়া আপনাদিগের ও অন্যান্য প্রাণীগণের মঙ্গলার্থ শান্তিকার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সূৰ্য্যদেব যজ্ঞীয় পুরোডাশ ভক্ষণ করিতেছিলেন, শঙ্কর হাস্যমুখে তাঁহার নিকট ধাবমান হইয়া তাঁহার দশনোৎপাটন করিলেন। দেবগণ তদ্দর্শনে কম্পিতকলেবর হইয়া তাঁহার চরণে প্রণিপাতপূর্ব্বক যজ্ঞস্থল হইতে পলায়ন করিতে লাগিলেন। মহাদেব তাহাতেও ক্ষান্ত না। হইয়া পুনরায় দেবগণের প্রতি স্ফুলিঙ্গ ও ধূমপূর্ণ সুনিশিত শরজাল সন্ধান করিলেন। তখন দেবগণ তাহাকে প্রণাম করিয়া তাঁহার নিমিত্ত বিশেষরূপে যজ্ঞভাগ কল্পিত করিয়া তাহার শরণাপন্ন হইলেন। তখন কৈলাসনাথ কোপ পরিত্যাগপূর্ব্বক সেই যজ্ঞ পুনঃস্থাপন করিলেন। হে অর্জ্জুন! সুরগণ সেই অবধি তাহার নিকট নিতান্ত ভীত হইয়া আছেন, অদ্যাপি তাহাদের ভয় দূরীভূত হয় নাই।

ত্রিপুরাসুরসংহার-সংবাদ

‘পূর্ব্বকালে স্বর্গে মহাবলপরাক্রান্ত অসুরগণের সুবর্ণ, রৌপ্য ও লৌহনির্মিত তিনটি পুর ছিল। কমলাক্ষ সুবর্ণময়, তারকাক্ষ রজতময় ও বিদ্যুম্মালী লৌহময় পুর অধিকার করিত। দেবরাজ সমুদয় অদ্বারা ঐ পুরত্রয় ভেদ করিতে পারেন নাই। অনন্তর ইন্দ্রাদি দেবগণ মহাত্মা মহেশ্বরের শরণাপন্ন হইয়া তাহাকে কহিলেন,-হে প্রভো! এই ত্রিপুরনিবাসী অসুরত্রয় ব্রহ্মার বরে দর্পিত হইয়া লোককে নিতান্ত নিপীড়িত করিতেছে। হে দেবদেবেশ! আপনি ভিন্ন আর কোন ব্যক্তি ইহাদিগের বিনাশসাধনে সমর্থ হইবেন না। অতএব আপনি স্বয়ং ইহাদিগকে বিনাশ করুন, তাহা হইলে সর্ব্বকার্য্যে পশুগণ আপনার ভাগব্যবস্থায় নিয়োজিত হইবে।

শক্তিক্রোড়স্থ শিশুরূপী হরের ইন্দ্রবাহুস্তম্ভন

‘হে অর্জ্জুন! দেবগণ এইরূপ কহিলে ভগবান্ ভূতভাবন তাঁহাদিগের হিতার্থ তাঁহাদের বাক্য স্বীকার করিলেন এবং সেই ত্রিপুরনিপাতনার্থ গন্ধমাদন ও বিন্ধ্যাচলকে বংশধ্বজ, সসাগরা ধরিত্রীকে রথ, নাগেন্দ্র অনন্তকে অক্ষ, সূৰ্য্য ও চন্দ্রমাকে চক্র, এলাপত্র ও পুষ্পদন্তকে অক্ষকীলক, মলয়াচলকে যূপ, তক্ষককে যুগবন্ধন, ভূতগণকে যোক্ত্র, চারিবেদকে চারি অশ্ব, উপবেদনিচয়কে কবিকা [লাগাম], সাবিত্রীকে প্রগ্রহ, ওঁকারকে প্রতোদ, ব্রহ্মাকে সারথি, মন্দরপর্ব্বতকে গাণ্ডীব, বাসুকিকে গুণ, বিষ্ণুকে উৎকৃষ্ট শর, অগ্নিকে শল্য, অনিলকে শরপক্ষ, বৈবশ্বত যমকে পুঙ্খ, চপলাকে শিঞ্জিত ও সুমেরুপর্ব্বতকে ধ্বজ করিয়া সেই দিব্যরথে আরোহণপুরঃসর এক অপ্রতিম ব্যূহ নির্ম্মাণপূর্ব্বক দেবগণ ও ঋষিগণকর্ত্তৃক সংস্তুত হইয়া সেই ব্যূহমধ্যে অচলের ন্যায় সহস্র বৎসর অবস্থান করিলেন। পরিশেষে সেই পুরত্রয় অন্তরীক্ষে একত্রে মিলিত হইলে তিনি ত্রিপযুক্ত শল্যে উহা ভেদ করিলেন। তখন দানবগণ সেই ত্রিপুর বা ত্রিলোচনের প্রতি কিছুতেই দৃষ্টিপাত করিতে সমর্থ হইল না। ঐ সময় সেই কালাগ্নি, বিষ্ণু ও সোমসংযুক্ত শল্যদ্বারা ত্রিপুর দগ্ধ হইতে আরম্ভ হইলে পার্ব্বতী বালকরূপধারী মহাদেবকে ক্রোড়ে লইয়া সেই পথদর্শনার্থ সমাগত হইলেন। তিনি দেবগণের মনের ভাব অবগত হইবার মানসে কহিলেন, -হে দেবগণ! আমার ক্রোড়ে কে অবস্থান করিতেছে? তখন দেবরাজ ইন্দ্র দুর্দ্দেবক্রমে সেই বালকের প্রতি অসূয়াপরবশ হইয়া অবজ্ঞা প্রকাশপূর্ব্বক বজ্রনিক্ষেপে উদ্যত হইলেন। ভগবান ভূতনাথ তদ্দর্শনে ঈষৎ হাস্য করিয়া তাহার বজ্ৰসংযুক্ত বাহু স্তম্ভিত করিলেন। পুরন্দর এইরূপে সেই বালকরূপী মহাদেবের প্রভাবে স্তম্ভিতবাহ হইয়া সুরগণসমভিব্যাহারে সত্বর ব্রহ্মার সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তখন সুরগণ ব্রহ্মাকে প্রণিপাত করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, -হে ব্ৰহ্মন্! আমরা পার্ব্বতীর ক্রোড়ে বালকরূপধারী এক অদ্ভুত জীবকে অবস্থিত দেখিয়া তাঁহার অভিবাদন করি নাই। বালক আমাদের সেই অপরাধে ক্রুদ্ধ হইয়া যুদ্ধ না করিয়াই অবলীলাক্রমে আমাদিগকে পুরন্দরের সহিত পরাজিত করিয়াছেন। আমরা সেই বালকের বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিতে আপনার নিকট আগমন করিয়াছি।

“ব্রহ্মবিদগণের অগ্রগণ্য ব্রহ্ম দেবগণের সেই বাক্য শ্রবণানন্তর যোগপ্রভাবে সেই অমিততেজাঃ বালককে ত্রিলোচন জানিতে পারিয়া ইন্দ্রাদি দেবগণকে কহিলেন, -হে সুরগণ! সেই বালক এই চরাচর জগতের প্রভু ভগবান্ ভূতভাবন মহেশ্বর, তাহা অপেক্ষা আর কিছুই শ্রেষ্ঠতর পদার্থ নাই। তোমরা পার্ব্বতীর ক্রোড়ে যাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়াছ, তিনি সেই পার্ব্বতীর নিমিত্তই বালকরূপ ধারণ করিয়াছেন, অতএব চল, আমরা সকলে তাঁহার নিকট গমন করি। তিনি সর্ব্বজনেশ্বর দেবাদিদেব মহাদেব। তোমরা সকলে সেই বালকসদৃশ ভুবনেশ্বরকে জ্ঞাত হইতে সমর্থ হও নাই।

হরের কৃপায় ইন্দ্রের পূর্ব্বাবস্থায়

‘লোকপিতামহ ব্রহ্ম দেবগণকে এই কথা বলিয়া মহেশ্বরের নিকট গমন ও তাঁহাকে অবলোকনপূর্ব্বক সর্ব্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান করিয়া বন্দনা করিয়া কহিলেন,—হে দেব। তুমি এই ভুবনের যজ্ঞ, গতি ও শ্রেষ্ঠতর ব্রত। তুমি ভব, তুমি মহাদেব, তুমি ধাম ও তুমিই পরমপদ। তুমি এই চরাচর বিশ্বে ব্যাপ্ত রহিয়াছ। হে ভগবন্‌! হে ভূতভবেশ! হে লোকনাথ! হে জগৎপতে! তুমি ক্রোধাৰ্দিত পুরন্দরের প্রতি কৃপাবলোকন কর।

‘হে অর্জ্জুন! ভগবান্ মহেশ্বর ব্রহ্মার বাক্যশ্রবণে প্রসন্নতাপ্রদর্শনে উন্মুখ হইয়া অট্টহাস্য করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় সুরগণ ভগবতী পার্ব্বতী ও রুদ্রদেবকে প্রসন্ন করিতে লাগিলেন। দক্ষযজ্ঞবিনাশন দেবাদিদেব মহাদেব ও পার্ব্বতী দেবগণের স্তবে তাঁহাদের প্রতি প্রসন্ন হইলেন; দেবরাজ ইন্দ্রের বাহুও পুনরায় প্রকৃতিস্থ হইল। সেই রুদ্রদেবই শিব, অগ্নি ও সর্ব্ববেত্তা। তিনি ইন্দ্র, বায়ু, অশ্বিনীকুমারদ্বয় ও বিদ্যুৎ। তিনি ভব, পর্জ্জন্য ও নিস্পাপ। তিনি চন্দ্র, সূৰ্য্য, ঈশান ও বরুণ। তিনি কাল, অন্তক, মৃত্যু, যম, রাত্রি ও দিবা। তিনি মাসার্দ্ধ, মাস, ঋতুসমূহ সন্ধ্যায় ও সংবৎসর। তিনি ধাতা, বিধাতা, বিশ্বাত্মা ও বিশ্বকর্ম্মকারী। তিনি স্বয়ং অশরীরী হইয়াও সকল দেবগণের আকার স্বীকার করিয়া থাকেন। তিনি দেবগণের স্তবনীয়। তিনি একপ্রকার, বহুপ্রকার, শতপ্রকার, সহস্রপ্রকার ও শতসহস্রপ্রকার। বেদপরায়ণ ব্রাহ্মণগণ কহিয়া থাকেন যে, তাঁহার ঘোরা ও শিবা নামে দুই মূৰ্ত্তি আছে। ঐ মূৰ্ত্তিদ্বয় আবার বহু প্রকার হইয়া থাকে। অগ্নি, বিষ্ণু ও ভাস্করই তাঁহার ঘোরা মূৰ্ত্তি এবং সলিল, চন্দ্র ও জ্যোতিঃপদার্থসমুদয়ই তাঁহার সৌম্য মূর্ত্তি। বেদাঙ্গ, উপনিষৎ, পুরাণ ও অধ্যাত্মনিশ্চয় [মোক্ষশাস্ত্র] মধ্যে যাহা নিতান্ত গৃঢ় আছে, তাহাই দেব মহেশ্বর। তিনি বহুল ও জন্মবিবর্জিত।

শিবমাহাত্ম্য শতরুদ্রীয় ব্যাখ্যা

‘হে অর্জ্জুন! সেই ভূতভাবন ভগবান্ শিব এইরূপ। আমি সহস্র বৎসরেও তাঁহার সমস্ত গুণ কীৰ্ত্তন করিতে সমর্থ নহি। সেই শরণাগতানুকম্পী [শরণাগতের প্রতি সদয়] দেবাদিদেবে শরণাগত ব্যক্তি সর্ব্বগ্রহগুহীত [নিন্দ্য-অনিন্দ্য সর্ব্বপ্রকার দানগ্রহণকারী] ও সমগ্র পাপসমন্বিত হইলেও তাহার উপর প্রীত হইয়া তাহাকে মুক্তি প্রদান করিয়া থাকেন। তিনি মনুষ্যদিগের আয়ু, আরোগ্য, ঐশ্বৰ্য্য, বিত্ত ও সমগ্র অভিলাষ প্রদান এবং পুনরায় প্রত্যাহরণ করিয়া থাকেন। ইন্দ্রাদি দেবগণমধ্যে তাঁহারই ঐশ্বৰ্য্য বিদ্যমান আছে। তিনি মনুষ্যগণের শুভ ও অশুভবিষয়ে ব্যাপৃত রহিয়াছেন। তিনি স্বীয় ঈশ্বরত্বপ্রভাবে সমুদয় অভিলষিত বিষয় লাভ করিতে পারেন। তিনি মহতের ঈশ্বর ও মহেশ্বর, তিনি বহুতর রূপ, পরিগ্রহ করিয়া এই বিশ্বে ব্যাপ্ত রহিয়াছেন। তাঁহার আস্যদেশ সমুদ্রে অধিষ্ঠিত হইয়া তোয়ময় হবিঃ পানপূর্ব্বক বড়বামুখনামে কীৰ্ত্তিত হইতেছে। তিনি প্রতিনিয়ত শ্মশানে বাস করেন। মনুষ্যেরা সেই বীরস্থানে তাঁহার পূজা করিয়া থাকে। সেই ঈশ্বরের উজ্জ্বল ভয়ঙ্কর বহুতর রূপ আছে। মনুষ্যেরা ঐ সমস্ত রূপের উপাসনা ও বর্ণনা করিয়া থাকে। লোকে তাঁহার কার্য্যের মহত্ত্ব ও বিভূত্বপ্রযুক্ত বহুতর সার্থক নাম কীর্ত্তন করে। বেদে তাঁহার শতরুদ্ৰীয় স্তব, অনন্ত রুদ্রমন্ত্র উল্লিখিত হইয়াছে। তিনি দিব্য ও মানুষ অভিলাষসকল প্রদান করিয়া থাকেন। সেই বিভু এই বিশ্বসংসারে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছেন। ব্রাহ্মণ ও মহর্ষিগণ তাহাকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। তিনি দেবগণের আদি। তাহার আস্যদেশ হইতে হুতাশন প্রাদুর্ভূত হইয়াছে। তিনি নিরন্তর পশুপালন, পশুগণের সহিত ক্রীড়া ও পশুদিগের উপর আধিপত্য বিস্তার করেন, এই নিমিত্ত লোকে তাঁহাকে পশুপতি বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকে। তাঁহার লিঙ্গ নিত্য ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করিয়া অবস্থান করিতেছে এবং তিনি সতত লোকসকলকে উৎসবযুক্ত করেন, এই নিমিত্তই লোকে তাঁহাকে মহেশ্বর বলিয়া কীৰ্ত্তন করে। ঋষি, দেবতা, অপ্সরা ও গন্ধর্ব্বগণ তাঁহার লিঙ্গের অর্চনা করিয়া থাকেন। সেই লিঙ্গ উন্নতভাবে অবস্থিত আছে। উহা পুজিত হইলে মহেশ্বর আনন্দিত হইয়া থাকেন। ত্রিলোকমধ্যে মহাত্মা মহেশ্বরের স্থাবরজঙ্গমাত্মক বহুতর রূপ প্রতিষ্ঠিত আছে, এই নিমিত্তই তিনি, বহুরূপ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। তিনি একাক্ষিদ্বারা জাজ্জ্বল্যমান বা সর্ব্বতঃ অমিয় হইয়া অবস্থান করিতেছেন। তিনি ক্রোধাবিষ্ট হইয়া লোকমধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন, এই নিমিত্ত লোকে তাতাঁকে সর্ব্ব বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকে। তিনি ধূম্ররূপ, এই নিমিত্ত ধুর্জ্জটি বলিয়া প্রসিদ্ধ এবং তাহাতে বিশ্বদেব অবস্থান করিতেছেন বলিয়া তিনি বিশ্বরূপনামে প্রখ্যাত হইয়াছেন। তিনি সর্ব্বকায্যে অর্থসকল পরিবর্দ্ধিত ও মনুষ্যগণের মঙ্গল অভিলাষ করেন, এই নিমিত্ত শিবনামে প্রসিদ্ধ আছেন। তিনি সহস্রাক্ষ, অযুতাক্ষ ও সর্ব্বতঃ অক্ষিমৎ [শূন্যে বিকীর্ণ]। তিনি এই মহৎ বিশ্বকে প্রতিপালন করিতেছেন, এই নিমিত্ত লোকে তাঁহাকে মহাদেব বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকে। সেই ভুবনেশ্বর ত্রিলোক প্রতিপালন করিতেছেন বলিয়া ত্র্যম্বকনামে বিখ্যাত হইয়াছেন। তিনি প্রাণের উৎপত্তি ও স্থিতির কারণ এবং সমাধিদ্বারা সাক্ষিরূপ হইয়াও অবিকৃত রহিয়াছেন বলিয়া লোকে তাঁহাকে স্থাণুনামে কীৰ্ত্তন করিয়া থাকে। চন্দ্র ও সূর্যের আকাশাকীর্ণ তেজোরাশি তাঁহার কেশস্বরূপ হওয়াতে তিনি ব্যোমকেশনামে প্রসিদ্ধ হইয়াছেন। কপি শব্দের অর্থ শ্ৰেষ্ঠ ও বৃষ শব্দের অর্থ ধর্ম্ম। মহাত্মা মহাদেব শ্রেষ্ঠ ও ধর্ম্মম্বরূপ বলিয়া বৃষাকপিনামে বিখ্যাত আছেন। তিনি ব্রহ্মা, ইন্দ্র, বরুণ, যম ও কুবেরকে নিগ্রহ করিয়া সংহার করেন বলিয়া লোকে তাঁহাকে হরনামে কীৰ্ত্তন করে। তিনি উন্মীলিত নেত্রদ্বয় হইতে বলপূর্ব্বক ললাটে নয়ন সৃষ্টি করিয়াছেন, এই নিমিত্ত ত্র্যম্বকনামে কথিত হইয়া থাকেন। তিনি কি পাপাত্মা, কি পুণ্যশীল সমুদয় শরীরীর শরীরে সমভাবে প্রাণ, অপান প্রভৃতি পাঁচ প্রকার [প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান চক্ষু] বায়ুরূপে অবস্থান করিতেছেন। যিনি মহাদেবের বিগ্রহপূজা ও লিঙ্গার্চ্চনা করেন, তাঁহার নিত্য লক্ষ্মীলাভ হয়। তাঁহার কেবল এক পদ অগ্নিময় ও অন্য পদ সোমময়, এমন নহে, সমুদয় শরীরই অর্ধাংশ অগ্নিময় ও অর্ধাংশ সোমময় বলিয়া কথিত আছে। তাহার অগ্নিময় দেহ দেবগণ ও মনুষ্যগণ অপেক্ষা অধিক দীপ্তিমান। মহাত্মা মহাদেবের যে মঙ্গলদায়িনী মূর্ত্তি আছে, তিনি সেই মূর্ত্তি ধারণপূর্ব্বক ব্রহ্মচর্য্যানুষ্ঠান এবং তাঁহার যে ঘোরতর মূর্ত্তি আছে, তাহা ধারণপূর্ব্বক সকলকে সংহার করেন। তিনি দহনশীল, তীক্ষ্ণ, উগ্র, প্রতাপশালী এবং মাংস, শোণিত ও মজ্জাভোজী বলিয়া রুদ্রনামে উক্ত হইয়া থাকেন।

‘হে অর্জ্জুন! তুমি সংগ্রামকালে যে পিনাকধারী দেবদেব মহাদেবকে তোমার অগ্রভাগে অবস্থিত ও শত্ৰুসংহারে প্রবৃত্ত দেখিয়াছ এই তাঁহারই গুণ কীৰ্ত্তন করিলাম। তুমি সিন্ধুরাজবধে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইলে কৃষ্ণ তাঁহাকেই তোমায় স্বপ্নে প্রদর্শিত করিয়াছিলেন। ঐ ভগবানই সংগ্রামে তোমার অগ্রে অগ্রে গমন করিয়া থাকেন। তুমি যাঁহার প্রদত্ত অস্ত্রের প্রভাবে দানবগণকে নিপাতিত করিয়াছ, তোমার নিকট সেই দেবদেবের ধন্য, যশস্য, আয়ুস্য, পরমপবিত্র, বেদসম্মিত শতরুদ্রীয় ব্যাখ্যা করিলাম। যে ব্যক্তি সর্ব্বদা এই সৰ্বার্থসাধক, সর্ব্বপাপবিনাশন, ভয়দুঃখ নিবারণ, পবিত্র, চতুর্বিধ স্ত্রোত্র শ্রবণ করে, সে সমুদয় শত্রুগণকে পরাজয় করিয়া শিবলোকে পূজিত হয়। যে মনুষ্য সর্ব্বদা যত্নবান্ হইয়া মহাত্মা দেবদেবের মঙ্গলপ্রদ সাংগ্রামিক দিব্যরচিত ও শতরুদ্রীয় পাঠ বা শ্রবণপূর্ব্বক বিশ্বেশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করে, ত্রিনয়ন প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে অভিলষিত বর প্রদান করেন। হে অর্জ্জুন! তুমি এক্ষণে গমনপূর্ব্বক সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও। জনার্দ্দন যাঁহার পার্শ্বস্থ, মন্ত্রী ও রক্ষয়িতা, তাহার পরাজয়সম্ভাবনা কখনই নাই।’

“হে মহারাজ! পরাশরতনয় ব্যাসদেব সংগ্রামস্থলে অর্জ্জুনকে এই কথা বলিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। হে রাজন! এইরূপে মহাবলপরাক্রান্ত দ্রোণাচার্য্য, পাঁচ দিন ঘোরতর যুদ্ধ করিয়া কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হইলেন।”

বেদাধ্যয়নে যে ফল, এই দ্রোণপর্ব্ব অধ্যয়নেও সেই ফললাভ হয়। এই পর্ব্বে নির্ভয় ক্ষত্রিয়গণের যশ বর্ণিত এবং অর্জ্জুন ও বাসুদেবের জয় কীৰ্ত্তিত হইয়াছে। এই পর্ব্ব প্রত্যহ পাঠ বা শ্রবণ করিলে মহাপাপলিপ্ত পুরুষও পাপমুক্ত হইয়া মঙ্গললাভ করিতে পারে। ইহা শ্রবণ ও পাঠে ব্রাহ্মণগণের যজ্ঞফললাভ, ক্ষত্রিয়গণের ঘোর সংগ্রামে বিজয়লাভ এবং বৈশ্য ও শূদ্রের ধনপুত্রাদি অভিলষিত বিষয়লাভ হয়, সন্দেহ নাই।।

নারায়ণাস্ত্রমোক্ষপৰ্বাধ্যায় সমাপ্ত।

।। দ্রোণপর্ব্ব সম্পূর্ণ ।।