জীবের গর্ভপ্রবেশ-বিবরণ
“সিদ্ধ ব্রাহ্মণ বলিলেন, ইহলোকে ফলভোগ ব্যতীত শুভ বা অশুভ কার্য্যের ধ্বংস হয় না। যে ব্যক্তি যেরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করে, জন্মান্তরে দেহপ্রতিগ্ৰহ করিয়া তাহাকে তদনুরূপ ফলভোগ করিতে হয়। বনস্পতি হইতে যেমন ফলকালে বহু ফল সমুৎপন্ন হয়, তদ্রূপ বিশুদ্ধ-অন্তঃকরণে শুভকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিলে সেই কার্য্যপ্রভাবে পরিণামে বহুতর পুণ্যফল এবং দুষ্টান্তঃকরণে দুষ্কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলে সেই কাৰ্য্যপ্রভাবে পরিণামে বহুতর পাপফল সমুৎপন্ন হইয়া থাকে।
‘আত্মা মনকে অগ্রবর্ত্তী করিয়া কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়। এক্ষণে মনুষ্য যেরূপ স্বকর্ম্মে পরিবৃত হইয়া জন্মান্তরে গর্ভে প্রবেশ করে, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। শোণিতমিশ্রিত শুক্র স্ত্রীজাতির গর্ভকোষে প্রবিষ্ট হইয়া জীবের শুভ ও অশুভ কৰ্ম্মানুরূপ দেহে পরিণত হয়। পরে জীব সেই দেহমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া থাকেন। অতিশয় সূক্ষ্মতা ও অলক্ষ্যত্বনিবন্ধন তিনি কুত্রাপি লিপ্ত হয়েন না। ঐ জীবই শাশ্বত ব্রহ্ম বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। ঐ জীবই সমুদয় লোকের বীজস্বরূপ, প্রাণীগণ উঁহারই প্রভাবে জীবিত থাকে। তাম্ৰাদি ধাতু যেমন সুবর্ণরসে সিক্ত হইলে তাহার সমুদয় অঙ্গ সুবর্ণময় বলিয়া বোধ হয়, লৌহপিণ্ডমধ্যে বহ্নি প্রবেশ করিলে যেমন তাহার সমুদয় অবয়ব উত্তপ্ত হইয়া থাকে, তদ্রূপ জীব শরীরমধ্যে প্রবেশ করিলে সমুদয় শরীর জীবময় ও সচেতন বলিয়া বোধ হইয়া থাকে। অন্ধকার সময়ে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ যেমন গৃহস্থিত সমুদয় বস্তু প্রকাশ করে, তদ্রূপ জীবসমুদয় অঙ্গের পরিচালন করিয়া থাকে। জীবমাত্রেই শরীর আশ্রয়পূর্ব্বক জন্মগ্রহণের পর জন্মান্তরীণ কার্য্যের ফলভোগ ও বিবিধ কর্ম্মের অনুষ্ঠান করে। এইরূপে জীব যত কাল মোক্ষধৰ্ম্ম অবগত হইতে সমর্থ না হয়, তত কাল তাহার ফলভোগদ্বারা জন্মান্তরীণ শুভাশুভ কাৰ্য্যক্ষয় ও বর্ত্তমান জন্মে অনুষ্ঠান দ্বারা বিবিধ শুভাশুভ কাৰ্য্যসঞ্চয় হইয়া থাকে।
‘হে ব্রাহ্মণ! এক্ষণে মানবগণ বিবিধ জন্মপরিগ্রহ করিয়া যেরূপ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিলে সুখলাভে সমর্থ হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। দান, ব্রতচৰ্য্যা, ব্রহ্মচর্য্য, বেদাভ্যাস, শান্তি, ইন্দ্রিয়সংযম, জীবের প্রতি দয়া, সরলতা, পরস্বাপহরণে নিস্পৃহতা, প্রাণীগণের অহিতচিন্তা পরিত্যাগ, পিতামাতার শুশ্রূষা, দয়া, শুদ্ধতা এবং গুরু, দেবতা ও অতিথিগণের পূজা প্রভৃতি শুভকাৰ্য্য সমুদয়ের অনুষ্ঠান সাধুদিগের স্বভাবসিদ্ধ ব্যবহার। ঐরূপ ব্যবহারদ্বারা ধৰ্ম্মানুষ্ঠান হয়। ঐ ধৰ্ম্মপ্রভাবেই প্রজাগণ রক্ষিত হইয়া থাকে, পূর্ব্বোক্ত দানাদি-সদাচারসমুদয় সাধুদিগের নিকট নিয়ত বিদ্যমান রহিয়াছে। সদাচারই সনাতনধৰ্ম্মনামে অভিহিত হয়। যাঁহারা ঐ সদাচার অবলম্বন করেন, তাঁহাদিগকে কখন দুর্গতি ভোগ করিতে হয় না। মানবগণ ধৰ্ম্মপথ হইতে পরিভ্রষ্ট হইলে একমাত্র সদাচার-উপদেশদ্বারাই তাহাদিগকে সৎপথে সমানীত করা যায়। অতএব সদাচারপরায়ণ হওয়া লোকের অবশ্য বিধেয়।
‘যোগী ব্যক্তিরা সদাচারপরায়ণ ব্যক্তিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকেন। কারণ, উঁহারা যোগবলে অচিরাৎ সংসারবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করেন, কিন্তু দানাদিধর্ম্মানুষ্ঠাননিরত ব্যক্তিরা বহুকালে সংসার হইতে বিমুক্ত হইতে পারেন। জীবগণ সকল জন্মেই পূৰ্ব্বকৃত কর্ম্মের ফলভোগ করিয়া থাকে। কৰ্ম্মই আত্মার জীবরূপে পরিণত হইবার প্রধান কারণ।
‘হে দ্বিজবর! সৰ্ব্বপ্রথমে কে শরীর গ্রহণ করিল, এই বলিয়া মানবগণের মনোমধ্যে মহাসংশয় উপস্থিত হইয়া থাকে। এক্ষণে আমি সেই সংশয় অপনোদন করিতেছি, শ্রবণ কর। সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা সর্ব্বাগ্রে স্বয়ং শরীরধারণপূৰ্ব্বক পরিশেষে অন্যান্য শরীরীর শরীর কল্পনা করিয়া এই চরাচর বিশ্বের সৃষ্টি করেন। তিনিই দেহের অনিত্যত্ব ও জীবের বিবিধ দেহপরিগ্রহের নিয়ম করিয়াছেন। শরীরীদিগের দেহকে ক্ষর এবং জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে অক্ষর বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়। এই তিন পদার্থমধ্যে দেহ ও জীবাত্মা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অবস্থান করিয়া থাকে।
‘জীবগণের মধ্যে যে ব্যক্তি সুখদুঃখকে অনিত্য, শরীরকে অপবিত্র বস্তুর সমষ্টি, বিনাশকে কর্ম্মের ফল ও সুখকে দুঃখ বলিয়া জ্ঞান করেন, তিনি অনায়াসে সংসারসাগর হইতে সমুত্তীর্ণ হইতে পারেন। যিনি এই জরামৃত্যু ও রোগের অধীন অচিরস্থায়ী শরীর ধারণ করিয়া সমুদয় জীবে সমভাবে দৃষ্টিপাত করেন, তিনি ব্রহ্ম অনুসন্ধান করিলে অনায়াসে অবগত হইতে সমর্থ হয়েন। এক্ষণে যেরূপে সেই শাশ্বত অব্যয় পরমপুরুষকে অবগত হওয়া যায়, তাহা বিস্তারিতরূপে কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।