১২শ অধ্যায়
নকুলের কর্ম্মের অনুকূলে প্ররোচনা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! তখন ধাৰ্ম্মিকাগ্রগণ্য মিতভাষী মহাবাহু নকুল অর্জ্জুনের বাক্য শ্রবণ করিয়া রাজা যুধিষ্ঠিরকে অবলোকনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! দেবগণ বিশাখযূপক্ষেত্রে বহিস্থাপনার্থ স্থণ্ডিল [অগ্নিগৃহ] নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের সেইসমুদয় স্থণ্ডিল অদ্যাপি নেত্রগোচর হয়, অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, দেবগণও কৰ্ম্মানুষ্ঠানদ্বারা দেবত্বলাভ করিয়াছেন। যে পিতৃলোকেরা জলবৰ্ষৰ্ণাদিদ্বারা প্রাণীগণের প্রাণরক্ষা করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগকেও বিধি-অনুসারে কৰ্ম্মানুষ্ঠান করিতে হয়। যাহারা বেদোক্ত নিয়ম পরিত্যাগ করে, তাহারাই নাস্তিক। যে ব্রাহ্মণ সমুদয় কাৰ্য্যেই বেদোক্ত নিয়ম প্রতিপালন করেন তিনিই দেবমার্গদ্বারা ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়েন। বেদবি ব্রাহ্মণেরা গৃহস্থাশ্রমকে সমুদয় আশ্রমের শ্রেষ্ঠ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। যে ব্যক্তি ধৰ্ম্মপথ অবলম্বনপূৰ্ব্বক ধন উপার্জ্জন করিয়া প্রধান প্রধান যজ্ঞে ব্যয় করেন, তিনি সাত্ত্বিক সন্ন্যাসী; যিনি গার্হস্থ্যসুখাস্বাদনে নিরপেক্ষ হইয়া মোক্ষকামনায় বনে পরিভ্রমণ করিয়া দেহ পরিত্যাগ করেন, তিনি তামস সন্ন্যাসী। আর যে জিতেন্দ্রিয় ঋষি বৃক্ষমূলে অবস্থান ও কাহার নিকট কিছু প্রার্থনা করিয়া ভিক্ষাৰ্থ পর্য্যটন করেন, তিনি ভিক্ষুক সন্ন্যাসী। আর যে ব্রাহ্মণ ক্রোধ, হর্ষ ও ক্রূরতা পরিত্যাগ করিয়া নিয়ত বেদাধ্যয়ন করেন তাঁহাকেও ভিক্ষুক সন্ন্যাসী বলা যায়। পণ্ডিতেরা কহিয়া থাকেন যে, এক গৃহস্থাশ্রম ব্রহ্মচৰ্য্যাদি তিন আশ্রমের তুল্য। অন্য অন্য আশ্রমে কেবল স্বর্গলাভ হয়, কিন্তু গৃহস্থাশ্রমে কাম ও স্বর্গ উভয়ই লাভ হইতে পারে। অতএব এই আশ্রম লোকতত্ত্ববেত্তা মহর্ষিগণের প্রধান গতি। যে ব্যক্তি গার্হস্থ্যাশ্রম প্রধান জ্ঞান করিয়া উহা অবলম্বনপূৰ্ব্বক রাগদ্বেষাদি পরিত্যাগ করিতে পারেন, তিনিই যথার্থ ত্যাগশীল। যে ব্যক্তি গৃহ পরিত্যাগ করিয়া মূঢ়ের ন্যায় কেবল অরণ্যে গমন করে, তাহাকে ত্যাগশীল বলা যায় না। ধর্ম্মধ্বজী[কপটাচারী] ব্যক্তি বনে থাকিয়া কামাদি স্মরণ করিলে যম পরিণামে মৃত্যুপাশদ্বারা তাহার কণ্ঠবন্ধন করেন। অভিমান সহকারে কাৰ্য্য করিলে উহা কদাপি ফলপ্রদ হয় না। ত্যাগী হইয়া কাৰ্য্য করিলেই উহা মহাফল প্রদান করে। গৃহস্থাশ্রমে শম, দম, ধৈৰ্য্য, সত্য, শৌচ, সরলতা, যজ্ঞ ও ধর্ম্ম প্রভৃতি তপস্বিজনোচিত কার্য্যকলাপ এবং দেবতা, অতিথি ও পিতৃগণের অর্চ্চনা অনায়াসে সম্পাদিত হইতে পারে। এই আশ্রমে ত্রিবর্গ ফললাভ হয়। যে ব্যক্তি এই ব্রাহ্মণসেবিত গার্হস্থ্যধৰ্ম্মানুষ্ঠানে নিরত থাকিয়া ত্যাগশীল হইতে পারেন, তাহার কখনই অপকার হয় না। হে মহারাজ! ধৰ্ম্মপরায়ণগণ নিস্পাপ প্রজাপতি বহুদক্ষিণ যজ্ঞসমুদয়ের ভাগ গ্রহণ করিবেন বলিয়া সমুদয় প্রজা, যজ্ঞীয় তরুলতা, ওষধি, পশু ও পবিত্র ঘৃতের সৃষ্টি করিয়াছেন। গৃহস্থের যজ্ঞকাৰ্য্য অবশ্য কর্ত্তব্য, এই নিমিত্তই গার্হস্থ্যধৰ্ম্ম নিতান্ত দুর্লভ। গৃহস্থ যদি পশু ও ধনধান্যে পরিপূর্ণ হইয়া যজ্ঞ না করে, তাহা হইলে তাহাকে নিয়ত পাপভোগ করিতে হয়। বেদাধ্যয়ন, জ্ঞানোপার্জ্জন ও মনে মনে শাস্ত্রীয় তর্কবিতর্কই ঋষিদিগের যজ্ঞ। ব্রহ্মস্বরূপ ব্রাহ্মণদিগের মনঃসমাধান দেবগণের প্রার্থনীয়।
“হে মহারাজ! এক্ষণে আপনি এই সমস্ত সমাহৃত বিচিত্র রত্ন যজ্ঞকার্য্যে ব্যয় করিবার বাসনা না করিয়া নাস্তিকের ন্যায় বাক্য প্রয়োগ করিতেছেন। যিনি পরিবারবর্গে পরিবৃত হইয়া বাস করেন, সৰ্ব্বত্যাগী হওয়া তাঁহার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। আপনি আমাদের আহৃত ধনদ্বারা ব্রাহ্মণগণের অভিমত রাজসূয়, অশ্বমেধ ও সৰ্ব্বমেধ প্রভৃতি বিবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করুন। রাজার প্রমাদদোষেই প্রজারা দস্যুতস্করাদিকর্ত্তৃক ক্লেশিত হয়। যে রাজা প্রজাগণকে রক্ষা না করেন, তিনি কলিস্বরূপ। আমরা যদি ব্রাহ্মণগণকে অশ্ব, গো, দাসী, সমলঙ্কৃত হস্তী, গ্রাম, জনপদ, ক্ষেত্র ও গৃহ প্রদান না করিয়া মাৎসর্য্যপরায়ণ হই, তাহা হইলে আমাদিগকে নিশ্চয়ই কলিস্বরূপ হইতে হইবে। রাজা অদাতা ও শরণাগতপ্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইলে তাঁহাকে নিশ্চয়ই পাপগ্রস্ত হইয়া অশেষ দুঃখভোগ করিতে হয়। তিনি কদাচ সুখাস্বাদন করিতে পারেন না। যদি আপনি মহাযজ্ঞ, পিতৃশ্রাদ্ধ ও তীর্থাবগাহনে পরাঙ্মুখ হইয়া অরণ্যবাস আশ্রয় করেন, তাহা হইলে আপনার মাহাত্ম্য মারুতোদ্ধূত [বায়ুচালিত] ছিন্নমেঘের ন্যায় বিলীন হইয়া যাইবে এবং আপনাকে উভয় লোক হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া পিশাচযোনিতে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে। যে ব্যক্তি অহঙ্কার ও মমতা পরিত্যাগ করিতে পারে, সেই যথার্থ ত্যাগশীল; কেবল গৃহত্যাগ করিলে ত্যাগশীল হইতে পারে না। ব্রাহ্মণ এই নিয়মানুসারে কার্য্য করিতে পারিলে তাহাকে কখনই হীন হইতে হয় না। হে মহারাজ! কোন্ ব্যক্তি দৈত্যসূদন দেবরাজের ন্যায় স্বধৰ্ম্মানুসারে বলশালী অরাতিগণকে নিপাতিত করিয়া শোক করিয়া থাকে? আপনি স্বীয় ধৰ্ম্মানুসারে পরাক্রম প্রকাশ করিয়া পৃথিবী জয় করিয়াছেন। এক্ষণে উহা মন্ত্রবেত্তা ব্রাহ্মণদিগকে বিতরণপূর্ব্বক অনায়াসে স্বর্গারোহণ করিতে পারেন। অতএব আপনার শোক করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য।”