০৬১. কৌরবগণের কর্ত্তব্যে কর্ণের উৎসাহ

৬১তম অধ্যায়

কৌরবগণের কর্ত্তব্যে কর্ণের উৎসাহ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে যুধিষ্ঠিরের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, এমন সময়ে কৰ্ণ সভাসীন সমস্ত কৌরবগণের হর্ষোৎপাদন করিয়া দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, “মহারাজ! আমি পূর্ব্বে মিথ্যা প্রতিজ্ঞা [নিজ জাতি গোপন] করিয়া পরশুরাম হইতে ব্ৰহ্মময় অস্ত্ৰ গ্ৰহণ করিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি তাহা জানিতে পারিয়া তখনই কহিলেন, “অন্তকালে এইসকল ব্ৰহ্ম-অস্ত্ৰ তোমার স্মৃতিপথে আরূঢ় হইবে না।” মহর্ষি গুরুদেব আমার সেই মহাপরাধে এই শাপ প্ৰদান করিয়াছেন; সেই উগ্ৰতেজাঃ মহর্ষি সসাগরা ধরিত্রীকেও ভষ্মসাৎ করিতে পারেন। অনন্তর আমি শুশ্রূষা [সেবা] ও পৌরুষদ্বারা তাঁহার মন প্রসাদিত করিলাম। সে যাহা হউক, এক্ষণে আমার অন্তকাল উপস্থিত হয় নাই; সুতরাং সেই সকল অস্ত্ৰ আমার স্মৃতিপথে সমুদিত আছে, অতএব আমিই অর্জ্জুনকে জয় করিবার ভার গ্রহণ করিলাম, আমি সেই মহর্ষির নিমেষমাত্রের প্রসাদে পাঞ্চাল, করুষ ও মৎস্যগণ এবং পুত্রপৌত্রের সহিত পাণ্ডবগণকে নিহত করিয়া শস্ত্ৰজিত লোকসকল হস্তগত করিব। পিতামহ, দ্রোম ও অন্যান্য নরেন্দ্ৰগণ আপনার সমীপে অবস্থান করুন, আমিই প্রধান প্রধান বলসমভিব্যাহারে সমরে গমনপূর্ব্বক পাণ্ডবগণকে নিহত করিব, এই ভার গ্রহণ করিলাম।”

ভীষ্মের প্রতিবাদ

কৰ্ণ এইরূপ কহিতেছেন, এমন সময় ভীষ্ম তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে কালহতবুদ্ধে [আসন্নকালে বিপৰ্য্যস্ত বুদ্ধি-মৃত্যুর সান্নিধ্যবশতঃ বিপরীত মতিযুক্ত] কর্ণ তুমি কেন আত্মশ্লাঘা করিতেছ? তুমি কি জান না যে, প্রধান ব্যক্তিরা বিনষ্ট হইলে ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগকেও নিহত হইতে হইবে? ধনঞ্জয় বাসুদেবের সাহায্যে খাণ্ডবদহনসময়ে যে কাৰ্য্য করিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ করিয়া তুমি বন্ধুগণের সহিত আত্মাকে সংযত কর। মহাত্মা মহেন্দ্র তোমাকে যে শক্তি প্ৰদান করিয়াছেন, তুমি তাহা সমরসময়ে বাসুদেবের চক্ৰে প্ৰতিহত, বিশীর্ণ ও ভস্মীভূত অবলোকন করিবে। তোমার সে সৰ্পমুখ শার প্রদীপ্ত হইতেছে, তুমি মনোহরমাল্যদ্বারা সর্ব্বদা যাহার পূজা করিয়া থাক, সেই শর পাণ্ডুপুত্রের শরজালে প্রতিহত হইয়া তোমার সহিত বিনাশপ্রাপ্ত হইবে। বাণ ও নরকাসুরের নিহন্তা বাসুদেব অর্জ্জুনকে রক্ষা করিতেছেন। তিনি সমরে তোমাদের ন্যায় প্রধান প্রধান যোদ্ধাকে বিনাশ করিবেন।”

ক্রুদ্ধ কর্ণের সভাত্যাগ

কৰ্ণ কহিলেন, “হে পিতামহ ভীষ্ম! মহাত্মা বাসুদেবের কথা যে প্রকার কথিত হইল, তিনি তদ্রূপ বা তদপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি যে কিছু পরুষবাক্য প্রয়োগ করিয়াছি, তাহার তাৎপৰ্য্য শ্রবণ করুন। আমি এই শস্ত্র পরিত্যাগ করিলাম, আপনি আমাকে আর কদাপি যুদ্ধে বা সভামধ্যে দেখিতে পাইবেন না, আপনি মানবলীলা সংবরণ করিলে পর ভূমিপালগণ আমার প্রভাব অবলোকন করিবেন।”

মহাধনুৰ্দ্ধার কর্ণ এই কথা কহিয়া তৎক্ষণাৎ সভা পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বভবনাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। তখন ভীষ্ম সহাস্যবদনে কৌরবগণের মধ্যে দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, “হে রাজন! সত্যপ্রতিজ্ঞ কৰ্ণ প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন যে, ভীষ্ম নিধনপ্রাপ্ত না হইলে তিনি শস্ত্ৰগ্ৰহণ করিবেন না; অতএব তিনি যুদ্ধ করিবেন না বলিয়াই কি ভীমসেন তোমাদিগের সমক্ষে ব্যূহরচনা করিয়া শিরশেছদনপূর্ব্বক লোকক্ষয় করিবেন? আমি অবন্তিরাজ কলিঙ্গেশ্বর, চেদিপতি জয়দ্ৰথ ও বাহ্লিকের সমক্ষে প্রতিনিয়ত সহস্ৰ সহস্ৰ অযুত যোদ্ধাকে সংহার করিব। পুরুষাধ্যম কৰ্ণ যখন আপনাকে ব্ৰাহ্মণ বলিয়া ভগবান পরশুরামের নিকট অস্ত্রশিক্ষা করিয়াছে, তখনই উহার ধর্ম্ম ও তপস্যা বিনষ্ট হইয়াছে।”

পিতামহ ভীষ্ম এই কথা কহিলে এবং সূতপুত্ৰ কৰ্ণ অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিলে পর রাজা দুৰ্য্যোধন ভীষ্মকে কহিতে লাগিলেন।