১৯৬. পাণ্ডবগণের অভিযান

১৯৬তম অধ্যায়

পাণ্ডবগণের অভিযান

বৈশম্পায়ন কহিলেন, এ দিকে রাজা যুধিষ্ঠির চেদি, কাশী ও করুষগণের নেতা দৃঢ়বিক্রম ধূষ্টকেতু, বিরাট, দ্রুপদ, যুযুধান, শিখণ্ডী, পাঞ্চালনন্দন, মহাধনুৰ্দ্ধর যুধামনুন্যু ও উত্তমৌজা এবং ধৃষ্টদ্যুম্নপ্রভৃতি বীরগণকে আদেশ করিলে তাহারা বিচিত্র বর্ম্ম ও তপ্তকাঞ্চনময় [সমুজ্জ্বল স্বর্ণময়] কুণ্ডল ধারণ করিয়া যজ্ঞীয় হুতহুতাশনের [ঘৃতাহুতিনিক্ষিপ্ত বহ্নির] ন্যায় ও প্রজ্বলিত গ্রহের [উজ্জ্বলকান্তি গগনচারী গ্ৰহগণের] ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির সৈন্য, বাহ্য [যানবাহী], গজ, অশ্ব, পরিচারক ও শিল্পোপজীবিসমেত [শিল্পকাৰ্য্যদ্বারা জীবিকানির্ব্বাহকারিগণসহ] সেইসকল মহাত্মাকে পূজা করিয়া ভোক্ষ্যভোজ্য প্রদান ও প্রস্থানের অনুমতি করিলেন। তিনি প্রথমে সৈন্যদলে বৃহৎকলেবর [স্থূলকায়] ধৃষ্টদ্যুম্নকে অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রের অগ্রগামী করিয়া এবং ভীম, যুযুধান ও ধনঞ্জয়কে অগ্রবর্ত্তী করিয়া দ্বিতীয় সৈন্যবিভাগে নিযুক্ত করিলেন।

তখন যোদ্ধৃগণ অশ্ব সুসজ্জিত করিয়া ইতস্ততঃ বিচরণ ও প্রধাবনপূর্ব্বক [দ্রুতবেগে দৌড়াইয়া] গগনস্পশী সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। রাজা যুধিষ্ঠির বিরাট, দ্রুপদ ও অন্যান্য মহীপালগণসমভিব্যাহারে তাহাদিগের পশ্চাৎ গমন করিলেন। এইরূপে ধনুৰ্দ্ধরপরিবৃত ধৃষ্টদ্যুম্নপরিপালিত [ধৃষ্টদ্যুম্নরক্ষিত] সেনা পয়ঃপরিপূর্ণা [জলপূৰ্ণা—জলে ভরা] প্রবাহবতী ভগবতী ভাগীরথীর ন্যায় নয়নগোচর হইতে লাগিল। বুদ্ধিমান রাজা যুধিষ্ঠির ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের বুদ্ধিবিলোপবাসনায় [মোহ উৎপাদনের জন্য], পুনরায় সৈন্যযোজনা করিতে লাগিলেন। মহাধনুৰ্দ্ধর দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, অভিমন্যু, নকুল, সহদেব, প্রভদ্রকগণ—ইহারা দশসহস্ৰ অশ্ব, দুই সহস্ৰ হন্তী, অযুত পদাতি ও পঞ্চশত রথসমভিব্যাহারে ভীমসেনের সহকারী হইলেন; বিরাট ও জয়ৎসেন মধ্যমবলে [দ্বিতীয় শ্রেণীর সৈন্যে] অবস্থান করিতে লাগিলেন। গদাকামুকধারী যুধামন্যু সৈন্যের পার্শ্ববর্ত্তী এবং বাসুদেব ও ধনঞ্জয় তাহার মধ্যবর্ত্তী হইলেন। এইরূপে সকলে অস্ত্রশস্ত্র পরিগ্রহ করিয়া রোষাভরে গমন করিতে লাগিলেন। বিংশতিসহস্ৰ অশ্বারোহী, পঞ্চসহস্র রথগজারোহী, অনেক অনেক রথারূঢ় বীর এবং কামুক, অসি ও গদাধারী সহস্ৰ সহস্ৰ শৌৰ্য্যশালী পদাতি তাঁহাদিগের অগ্রপশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল।

রাজা যুধিষ্ঠির স্বয়ং যে সৈন্যসাগরে অবস্থান করিয়াছিলেন, অধিকসংখ্যক ভূমিপাল এবং সহস্ৰ হন্তী, অযুত অশ্ব, সহস্র রথ, ও সহস্র পদাতি তাহার অন্তর্নিবেশিত [তাহাতে যোগ করিয়া দেওয়া] হইল। প্রচুর সৈন্যসমেত চেকিতান, চেদিনায়ক ধৃষ্টকেতু এবং শতসহস্র রথে পরিবৃত বৃষ্ণিবংশের প্রধানরহী মহাধনুৰ্দ্ধর সাত্যকি তাঁহার সমভিব্যাহারী হইলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ ক্ষত্ৰদেব ও ব্রহ্মদেব সৈন্যের পশ্চাদভাগ রক্ষা করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। যে স্থানে শকট [গাড়ী—গো-গাড়ী, অশ্ব ও গর্দতবাহিত গাড়ী], বণিক, বেশ্যা [পরপক্ষ বিমোহনাৰ্থ সৈন্যমধ্যে বেশ্য রক্ষিত হয়; সুতরাং বেশ্য সৈন্যের এক অঙ্গ], যুদ্ধযোগ্য বাহন ও অন্যান্য বাহন ছিল, তথায় সহস্ৰ হন্তী ও অযুত অশ্ব অবস্থান করিতে লাগিল। রাজা যুধিষ্ঠির সহস্ৰ সহস্ৰ গজ, অশ্ব, যাবতীয় বালক, স্ত্রী, দুর্ব্বল সৈন্য ও ধনসঞ্চয়বাহী [যুদ্ধে ব্যয়ের জন্য সঞ্চিত মুদ্রাদির বহনকারী] অশ্বগণ ও শস্যাগার [সৈন্যগণের ভোজনার্থ সঞ্চিত খাদ্যশস্য] এইসকল গজগণদ্বারা রক্ষিত করিয়া শনৈঃ শনৈঃ গমন করিতে লাগিলেন। যুদ্ধদুর্ম্মদ [সমরোম্মত্ত—যুদ্ধে দুৰ্দ্ধর্ষ] সত্যধৃতি, সৌচিত্তি, শ্রেণিমান, বসুদান ও কাশিরাজপুত্র বিভু এবং তাঁহাদিগের অনুযায়ী বিংশতিসহস্র রথ, কিঙ্কণীজালমণ্ডিত [ক্ষুদ্ৰ ঘণ্টায় মালায় শোভিত] দশকোটি অশ্ব, বিশাল দশনসম্পন্ন [বৃহৎ দন্তশালী] উত্তম শ্রেণীস্থ জলদগমন [মেঘতুল্য দ্রুতগতিশীল] মদস্রাবী [যুদ্ধাদির উন্মাদনায় যাহাদের চোয়াল দিয়া সুগন্ধ মদ্য রক্ষিত হয় তাদৃশ] দশকোটি হস্তীসমভিব্যাহারে রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুগমন করিলেন। ধৰ্মরাজের সপ্ত-অক্ষৌহিণী [১ লক্ষ ৯ হাজার ৩ শত ৫০ পদাতি, ৬৫ হাজার ৬ শত ১০ অশ্ব, ২১ হাজার ৮ শত ৭০ হস্তী, ২১ হাজার ৮ শত ৭০ রথ—মোট ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৭ শত সৈন্য এক অক্ষৌহিণী। সাত অক্ষৌহিণী উহার সাত গুণ।] সৈন্যের অন্তৰ্গত বর্ষণশীল মেঘের ন্যায় মদস্রাবী সপ্ততি সহস্ৰ [সত্তর হাজার] রণমাতঙ্গ [পর্ব্বতাকার যুদ্ধের বড় বড় হাতী] সচল পর্ব্বতশ্রেণীর ন্যায় তাঁহার অনুগমন করিল। তদনন্তর শত শত, সহস্ৰ সহস্র ও অযুত অযুত মনুষ্য আপনাদের [নিজ নিজ] সহস্ৰ সহস্র সৈন্যসমভিব্যাহারে হষ্টচিত্তে ঘোরনাদসহকারে তাঁহাদিগের পশ্চাৎগমন ও সহস্ৰ সহস্র ও অযুত অযুত ব্যক্তি প্ৰফুল্লচিত্তে সহস্ৰ সহস্ৰ ভেরী [শিঙা] ও অযুত অযুত শঙ্খ বাদ্য করিতে লাগিল।

হে মহারাজ! ধীমান কুন্তীপুত্রের এবংপ্রকার [এইরূপ] ভীষণ বল [ভয়ঙ্কর সৈন্য] তাঁহাকে আশ্রয় করিয়া ধৃতরাষ্ট্রনন্দন দুৰ্য্যোধনের সহিত সংগ্রাম [যুদ্ধ] করিয়াছিল।

অম্বোপাখ্যান-পর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।

উদ্যোগপর্ব্ব সম্পূর্ণ