১৮৬. ভীষ্মনাশার্থ অম্বার কঠোর তপস্যা

১৮৬তম অধ্যায়

ভীষ্মনাশার্থ অম্বার কঠোর তপস্যা

“অনন্তর পরশুরাম সর্ব্বসমক্ষে কাশিরাজদুহিতা অম্বাকে আহ্বান করিয়া অতি দীনবচনে কহিতে লাগিলেন, “হে বৎসে! আমি সর্ব্বসমক্ষে শক্ত্যনুসারে পৌরুষ প্রদর্শন ও দিব্যাস্ত্ৰজাল প্রয়োগ করিলাম; কিন্তু কিছুতেই ভীষ্মকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হইলাম না। এই আমার গরীয়সী সর্বোত্তম শক্তি ও এই আমার উৎকৃষ্ট বল; এক্ষণে তুমি স্বেচ্ছানুসারে গমন কর। আমি তোমার গত্যন্তর দেখিতেছি না। ভীষ্ম মহাস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া আমাকে পরাজয় করিয়াছেন; অতএব এক্ষণে আর কি করিব? তুমি মহাবীর ভীষ্মের সন্নিধানে গমন কর।” এই বলিয়া পরশুরাম দীর্ঘনিশ্বাস পরির্ত্যাগপূর্ব্বক তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন। কাশিরাজদুহিতা অম্বা কহিলেন, “ভগবান! দেবগণও রণস্থলে ভীষ্মকে পরাজয় করিতে সমর্থ হয়েন না; ইহাতে অণুমাত্রও সন্দেহ নাই। আর আপনিও শক্তি ও উৎসাহ অনুসারে আমার কাৰ্য্য সম্পাদন করিয়াছেন। ভীষ্মের বীৰ্য্য ও নানাবিধ অস্ত্ৰ অনিবাৰ্য্য, এই নিমিত্ত আপনি তাঁহাকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হইলেন না। যাহা হউক, আমি আর তাঁহার সন্নিধানে গমন করিব না। আমি যে স্থানে গমন করিলে স্বয়ং তাঁহাকে বিনাশ করিতে সমর্থ হইব, তথায় প্রস্থান করিব।” এই বলিয়া অম্বা রোষকলুষিতলোচনে [ক্ৰোধকষায়িতনেত্রে] আমার বধসাধনজন্য তপানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত প্ৰস্থান করিলেন।

“অনন্তর জামদগ্ন্য সেই সমস্ত মহর্ষিগণের সহিত আমাকে আমন্ত্রণ করিয়া মহেন্দ্ৰপৰ্বতে যাত্ৰা করিলেন; আমিও ব্রাহ্মণগণ কর্ত্তৃক ম্তূয়মান হইয়া রথারোহণ ও নগর প্রবেশপূর্ব্বক জননী সত্যবতীকে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিলাম। তিনি তাহা শ্রবণ করিয়া আমাকে অভিনন্দন করিলেন। পরে আমি অম্বার কাৰ্য্যসকল অবগত হইবার নিমিত্ত প্রাজ্ঞ পুরুষদিগকে আদেশ করিলাম। তাঁহারা আমার হিতানুষ্ঠাননিরত [উপকারার্থ যত্নবান] হইয়া প্রতিদিন অম্বার জল্পনা [কথায় বার্ত্তায় মনোগত ভাবের অভিব্যক্তি] গতি ও কাৰ্য্যসমুদয় [*] প্ৰত্যাহরণ [*অনুষ্ঠানসমূহের সংবাদ আনয়নপূর্ব্বক নিবেদন] করিতে লাগিলেন। অম্বা যদবধি বনে গমন করিয়া তপানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন, আমি তদবধি নিতান্ত ব্যথিত, দীন ও হতবুদ্ধি হইতে লাগিলাম। হে রাজন! তপঃপরায়ণ কৃতব্ৰত [ব্ৰহ্মচৰ্য্যাদি ব্ৰতানুষ্ঠায়ী] ব্ৰাহ্মণ ব্যতিরেকে কোন ক্ষত্ৰিয় আমাকে বলবীৰ্য্যে পরাজয় করিতে সমর্থ হয়েন না। অনন্তর আমি দেবর্ষি নারদ ও মহর্ষি ব্যাসকে এই বিষয় অবগত করাইলে তাঁহারা কহিলেন, “হে ভীষ্ম“ তুমি কাশিরাজকন্যাকে তপানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত দেখিয়া বিষণ্ন হইও না; কোন ব্যক্তি পুরুষকারদ্বারা দৈবকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হইবে?”

“এদিকে অম্বা আশ্রমপ্রবেশ ও যমুনাতীর আশ্রয় করিয়া লোকাতিগণ [লোকগীতিশায়ী-অলৌকিক] তপানুষ্ঠানে প্ৰবৃত্ত হইলেন। তিনি নিরাহার, কৃশ, রুক্ষ, জটাভারমণ্ডিত [বহু জটাদ্ধারা শোভিত] ও মললিপ্ত [ধূলিজালপরিব্যাপ্তা] কলেবর হইয়া ছয়মাস বায়ু ভক্ষণপূর্ব্বক স্থাণুর [পত্রপল্লবহীনবৃক্ষের স্থূলাংশের মত নিশ্চল] ন্যায় দণ্ডায়মান রহিলেন। এক বৎসর যমুনাজলে অবস্থিতি করিয়া উপবাস করিলেন, এক বৎসর একমাত্র শীর্ণপত্ৰদ্বারা পারণ করিলেন এবং একবৎসর তীব্র কোপপরবশ হইয়া পদাঙ্গুষ্ঠে [পায়ের আঙ্গুলে ভর করিয়া] দণ্ডায়মান রহিলেন। অম্বা এইরূপ ঘোরতর তপানুষ্ঠানদ্বারা দ্বাদশবৎসর ভূলোক ও দ্যুলোক [স্বৰ্গলোক] পরিতাপিত করিলেন। কিন্তু তৎকালে তাঁহার জ্ঞাতিবর্গ তাঁহাকে এই অধ্যবসায় হইতে নিবৃত্ত করিতে সমর্থ হইলেন না।

অম্বার প্রতি গঙ্গার শাপ

“কাশিরাজকন্যা অম্বা সিদ্ধচারণসেবিত পুণ্যশীল তাপসাগণের আশ্রমসমন্বিত বৎসভূমিতে সমুপস্থিত হইলেন এবং পবিত্র তীর্থসমূদয়ে স্নান করিয়া দিবারাত্র স্বেচ্ছানুসারে সঞ্চরণ করিতে লাগিলেন। পরে অতি কঠোর ব্রতানুষ্ঠানপূর্ব্বক নন্দাশ্রম, উলুকাশ্ৰম, চ্যবনাশ্রম, ব্রহ্মস্থান, প্রয়াগ, দেবযজন, দেবারণ্য, কৌশিকাশ্রম, মাণ্ডব্যাশ্রম, দিলীপাশ্রম, রামহ্রদ ও শৈলগাশ্রমে স্নান করিলেন।

“আমার জননী ভাগীরথী সলিলমধ্যে অবস্থান করিয়া অম্বাকে কহিলেন, “হে ভদ্রে! তুমি কি নিমিত্ত ক্লেশপ্রাপ্ত হইতেছ। এবং ইহার কারণই বা কি?”

“অম্বা কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “হে চারুলোচনে! মহাবীর পরশুরাম ভীষ্মকর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছেন; ভীষ্মকে পরাজয় করিতে আর কেহই সমর্থ হইবে না; সুতরাং আমি স্বয়ং তাঁহাকে সংহার করিবার নিমিত্ত অতি দারুণ তপানুষ্ঠান করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছি। পৃথিবীতে সঞ্চরণ করিয়া যে প্রকারে হউক, ভীষ্মকে বিনাশ করিব; ভীষ্মকে বিনাশ করাই আমার ব্ৰতফল।”

“ভাগীরথী কহিলেন, “হে ভদ্রে! তুমি অতি ক্রূরাচরণে [কুটিল ব্যবহারে] প্রবৃত্ত হইয়াছ। তোমার এই অভিলাষ কদাচ সফল হইবে না। যদি তুমি ভীষ্মবিনাশার্থ ব্ৰতানুষ্ঠানে তৎপর হও, অথবা নিয়মস্থ হইয়া শরীরপাত কর, তাহা হইলে তুমি কুটিল [বক্ৰগতিশীল] কুতীর্থসম্পন্ন, ভীমগ্রাহসন্ধুল [ভীষণ কুম্ভীরাকীর্ণ], ভয়ঙ্কর নদীরূপ ধারণ করিবে; কেবল বর্ষাকালেই তুমি জলপূর্ণ থাকিবে; অন্য সময়ে তোমার জল শুকাইয়া যাইবে। তুমি বার্ষিকী বা অষ্টমাসিকী [সমস্ত বৎসরের কেবল চারি মাস কাল তোমাকে নদী বলিয়া বুঝিতে পরিবে, অবশিষ্ট আট মাস নদী বলিয়া তোমাকে কেহ জানিতে পরিবে না], তাহা কেহই বুঝিতে পরিবে না।” এই বলিয়া জননী সহাস্যমুখে কাশিরাজকন্যাকে নিবৃত্ত করিলেন। তখন কাশিরাজকন্যা কখন অষ্ট-মাস, কখন দশম মাসেও জলগ্ৰহণ করিতেন না। অনন্তর তিনি তীৰ্থপৰ্য্যটনলোভে বৎসভূমিতে সমুপস্থিত হইলেন এবং তথায় তপঃপ্রভাবে দেহাৰ্দ্ধ দ্বারা বার্ষিকী [কেবল বর্ষাকালপ্রবাহিতা], গ্ৰাহবহুলা দুস্তীর্ণা, কটিলা স্রোতস্বতীর রূপ ধারণ করিয়া প্রবলবেগে প্রবাহিত হইতে লাগিলেন।”